1 of 2

২৮. কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

অমরনাথকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হল। সুভাষচন্দ্ৰ যে বড় ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছিলেন তিনিই হাসপাতালের ওই বিভাগের কতা। রোগীকে দেখে নির্দেশ দিয়েছিলেন অবিলম্বে ভর্তি করে নিতে। ব্যাপারটা যদি জলপাইগুড়ি অথবা শিলিগুড়ি হাসপাতালে হত তাহলে অঞ্জলি এত ভর পেত না। পশ্চিমবাংলার সেরা হাসপাতালে সেবা চিকিৎসা পাচ্ছে তার স্বামী এবং সেটা ভাইয়ের জন্যেই সম্ভব হয়েছে, এই নিয়ে সে বেশ সুখে ছিল।

হ্যাঁ, এটা ঠিক সুভাষচন্দ্রর কাছে যা আশা করা গিয়েছিল তার সবই সে পূৰ্ণ করেছে। মীজাপুর স্ট্রিটে দু ঘরের একটা বাসা ভাডা করে রান্না থেকে শোওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা রেখে দিয়েছিল। এমন কি প্রথম দুদিনের বাজারও। এটা কে করে? শুধু ট্রেন থেকে নামার পরে  সুভাষচন্দ্র যখন রিকশায় চাপিয়ে মীজাপুর স্ট্রিটে নিয়ে এল তখনই একটু তিক্ততা তৈরি হল। বোঝা গেল নিজের বাসায় না নিয়ে গিয়ে সুভাষচন্দ্র তাদের ভাড়া করা বাসায় নিয়ে এসেছে। মনোরমা বলেই ফেললেন, এ খুব ভাল হয়েছে। এত লোক গিয়ে তোমার বাড়িতে ওঠাও তো ঠিক না। বউমার ওপর চাপ পড়ত।

অমরনাথ কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে বলতে ছাড়েনি, আর গেলেও তো সাতদিনের মধ্যে বিদায় হতে হত।

এই ব্যাপারটা অঞ্জলির খুব গায়ে লেগেছিল। হাজার হোক সুভাষচন্দ্র তার দাদা। যতই দূরত্ব থাকুক, একতরফা কাজে কর্মে শুধু সুভাষচন্দ্ৰই চা-বাগানের বাড়িতে গিয়েছেন। করে অমরনাথ সুভাষচন্দ্রের স্ত্রীকে চিঠি দিয়ে উত্তর পাননি। আর তারপর থেকেই যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন, এতে সুভাষচন্দ্রের কোন দায় ছিল না। তবে আর যাই হোক, আজকের রাতটা অন্তত সুভাষচন্দ্র তাঁদের নিজের বাড়িতে তুলতে পারতেন। তাহলে এই ঘুরিয়ে বলা কথার খোঁটা সহ্য করতে হত না।

জিনিসপত্র রেখে সুভাষচন্দ্র যখন অঞ্জলি আর দীপাকে নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন চাপা গলায় অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করেছিল, বউদি বাড়িতে নেই?

সুভাষচন্দ্র মাথা নেড়েছিলেন, আছে। ওর এক দাদা এসেছে আজ সকালে।

অঞ্জলি তৎক্ষণাৎ বুঝে গিয়েছিল ব্যাপারটা। সংসারে বাস করতে গেলে স্ত্রীর ওপর ভার চাপিয়ে দেওয়ার মানুষ সুভাষচন্দ্ৰ নন। এক রাত থাকতে দিলে হয়তো। ওকে অনেক রাত অশান্তিতে ভুগতে হবে। সুভাষচন্দ্ৰ যোগ করেছিলেন, কাল পরশু তোমার বউদি এসে দেখা করে যাবে। এমনিতে ওর শরীর ভাল যাচ্ছে না।

দীপা বলেছিল, এত বাস্ত হবার কি আছে, মামীমাকে সুবিধে হলে আসতে বলো।

শাশুউী স্বামী এবং মেয়ে এই যে উদারতা দেখাচ্ছে তা মোটেই ভাল লাগেনি অঞ্জলির। সবাই যেন সুভাষচন্দ্রের অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে একটা আরবণ দিতে চাইছে। যদি এত নিকট আত্মীয়বা চা-বাগানে যেত তাহলে মরে গেলেও অমরনাথ বাড়িতে না তুলে কোন বাড়ি ভাড়া করে সেখানে নিয়ে যেতেন না। এটা বোধ হয়। কলকাতাতেই সম্ভব। সুভাষচন্দ্রের অসহায়তা যেন অঞ্জলিকেই ছোট করে রাখছিল শাশুড়ি স্বামী পুত্রকন্যার কাছে। সেই সুভাষচন্দ্র যখন প্রতিদিন দেখাশোনা করে, অমরনাথকে বড় ডাক্তাবের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলেন তখন এক ধরনের স্বস্তি এল। মানুষের কৃতকর্ম তার পরবর্তী কাজের দ্বারাই চেহারা পাল্টে নেয়। এই যা স্বস্তি।

দুঘরের এই বাসাটি দোতলায়, রাস্তা দেখা যায়। কিন্তু বাথকম পায়খানা আর এক ভাড়াটের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়। এ জীবনে এমন অভিজ্ঞতা ওদের কারোবই হয়নি। সব চেয়ে অসুবিধে মনোরমার। তার স্নান ও কাচাকুচিতে সময় লাগে। তার ওপর কাপড় মেলে দিতে ছাদে যেতে হয়। সেখানে বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটেদের কাপড় শুকোয়। ছোঁয়াছুয়ি বাঁচিয়ে চলা অত্যন্ত মুশকিল। প্রথম রাত্রে সুভাষচন্দ্র তাদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িওয়ালার সঙ্গে। তিনি থাকেন তিনতলায়।

সেইসময় রেডিওতে খবর শুনছিলেন ভদ্রলোক গড়গড়া হাতে। বছর সত্তর বয়স। সুভাষচন্দ্ৰ পরিচয় করিয়ে দিতেই চিৎকার করে ডাকলেন, হ্যাঁ গা শুনছি।

ভেতর থেকে জবাব এল, অমন ষাঁড়ের মত চেঁচিও না তো, যাচ্ছি।

পুরনো আমলের রঙ-ওঠা সোফায় ভদ্রলোক তাদের বসিয়ে ছিলেন। এই সময় মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে মোটাসোটা বৃদ্ধ ঘরে ঢুকলেন। বাড়িওয়ালা গড়গড়ায় টান দিয়ে হাত দেড়ে দেখিয়ে দিলেন, তোমার নতুন ভাড়াটে। কথা কয়ে নাও।

কথা কইবার আর কি আছে। টাকা নিয়ে ভাড়াটে বসাচ্ছ যখন, তখন তো এরা থাকবেই। তা ঘরদের পছন্দ হয়েছে? শেষ প্রশ্নটি অঞ্জলিকে।

হ্যাঁ। অঞ্জলি মাথা নাড়ল।

একটা কথা জানা হয়নি। তুমি বলছি ভাই। তুমি তো ওঁর বোন। উনি এ-পারের বলে শুনেছি। তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায় ছিল?

কেন? অঞ্জলি অবাক হল।

দ্যাখো বাপু, স্বাধীনতা না কি ছাই হবার পর তো কলকাতার রাস্তায় আর হাঁটা যায় না। গিজ গিজ করছে বাঙালি। আমাদের বাড়ির সামনের ফুটপাতগুলোতেও ছিটকাপড় নিয়ে বসে গেছে। এটো কীটা মানে না, বিছানায় বসে ভাত খায়, ওরা বোয়াল মাছ পর্যন্ত খাদ্য, জানো? কী নোংরা কী নোংরা। আর ইনি, শিব হয়ে বসে আছেন। তোমাদের পাশের ঘরের ভাড়াটেরা যে বাঙালি তা খোঁজ নিয়েও দ্যাখেননি। তোমার দাদার মত একজন এসে কথা বলেছিল। হাইকোর্টের উকিল, ব্যাস, উনি গলে গিয়েছিলেন।

এবার বাড়িওয়ালা বললেন, ওদের উত্তরটা না জেনেই তুমি কথা বলে যাচ্ছ।

অঞ্জলি মাথা নাড়ল, আমরা এপারেরই মানুষ। ওঁর কেউ কখনও পাকিস্তানে ছিল না।

সেটা বুঝেছি বলেই তো মনের কথা বললাম। তবে জলপাইগুড়ির লোক তো শুনেছি আধারাঙাল। তোমরা একটু পরিষ্কার হয়ে থেকে বাপু। সঙ্গে কে এসেছে? তোমার শাশুড়ি? তিনি তো বিধবা, নিয়মটিয়ম মানে তো?

দীপা জবাব দিল, একটু বেশিমাত্রায় মানেন।

তবু রক্ষে। যাক, স্বামীর অসুখটা কি? খারাপ রোগ নয় তো।

অঞ্জলি বলল, বুকে ব্যথা হয়। মাথা ঘোরে।

অ, এটি মেয়ে?

হ্যাঁ।

এই বাঙালিরা আসার পর থেকে মেয়ে ধেড়ে হয়ে গেলেও ঘরে রাখা রেওয়াজ হয়ে গেছে। পড়াশুনা করেছে কতদূর?

এবার আই এ পরীক্ষা দিয়েছে।

ওমা তাই। বাড়িওয়ালি বড় বড় চোখে দীপাকে দেখলেন, শোন মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি, হুট হাট একা রাস্তায় বেরুবে না। ভদ্রমেয়েদের সঙ্গে ব্যাটাছেলে থাকে। খুব খারাপ জায়গা কলকাতা। রাস্তায় একা হাঁটা মোটেই নিরাপদ নয়। মনে রেখো।

বাড়িওয়ালা বললেন, গিল্পী, কথা বলার অনেক সময় পারে। এরা এই মাত্র অতিক্ষণ জানি করে ট্রেন থেকে নেমেছে, একটু বিশ্রাম নিতে দাও।

বাড়িওয়ালি তাদের তিনতলার দরজা পৰ্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বললেন, ছাদে কাপড় শুকোতে যেতে পারে, সকালে দশটা থেকে এগারটা আর বিকেলে চারটে থেকে পাঁচটা। জল কলে এলে ধরে রাখবে। সবসময় তো জল আসে না। গঙ্গাজলের কল অবশ্য সারাদিন ভরা থাকে। আর হ্যাঁ, উনুন জ্বালাবে নাকি?

না, স্টোভ। সুভাষচন্দ্ৰ উত্তরটা দিলেন।

তালে ভাল। এক ভাড়াটের ধোঁয়ার জ্বালায় দুবেলা অন্ধকার দেখি।

মাটিতে বিছানা করে ফেলেছিলেন ছেলেরা মনোরমার নির্দেশ্যে। ফিরে এসে ওরা দেখল পাশের ভাড়াটে-বউ রীতিমত গল্প জুড়ে দিয়েছে মনোরমার সঙ্গে। সুভাষচন্দ্র গিয়ে অমরনাথের পাশে বসলে অঞ্জলিদের সঙ্গেও বাউটির আলাপ হল। এই বাড়িটা খুব খারাপ। কলে সুতোর মত জল পড়ে। দশটা বাজিলেই সদর দরজা বন্ধ করে দেয় বাড়ি ওয়ালাব লোক। আর সারাক্ষণ পেছনে টিক টিক করে যায়। এই ধোঁয়া কেন ওপরে উঠছে, ওখানে নোংরা ফেলল কে, বউটি শেষ করল, আমরা কি মাছ খাই তাই নিয়া পর্যন্ত ওদের চিন্তা জানেন দিদি!

এই সময় একটি অল্প বয়সী মেয়ে দরজায় এল। এক মুহুর্তে দীপা দেখল মেয়েটি চোখ ঘুরিয়ে লক্ষ্য করে শরীর বেঁকিয়ে বলল, বউদি, দাদায ডাকে।

বউটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল। যাওয়ার আগে যাচ্ছি বলে যাওয়ার সৌজন্য পর্যন্ত দেখাল না। মেয়েটি দীপার দিকে একবার তাকিয়ে বউদিকে অনুসরণ করল। এই মেয়েটির চেহারা বেশ পাকা পাকা। রোগা কিন্তু শরীরে যেন চেষ্টাকৃত ঔদ্ধত্য রয়েছে। হাঁটা চলা তোকানো পর্যন্ত কোন চেনা মেয়ের মত নয়। দীপা কলকাতার মেয়েদের নানান গল্প হোস্টেলে থাকতে শুনেছে। এ বোধ হয় সেইরকম একজন! কপালেব দুপাশের চুল ছোটেছে সামান্য। দীপা ঠিক করল যেচে মেয়েটাবা সঙ্গে আলাপ করবে না।

খানিক বাদেই একটি কাজের মেয়ে এল বাটি হাতে! বাটিব মুখটা সে আঁচলে ঢেকে রেখেছিল। অঞ্জলির হাতে দিয়ে বলল, মা পাঠিয়ে দিল! আপনারা আজ প্রথম এয়েছেন, তাই মুখে মিষ্টি দিতে বলল।

অঞ্জলি দেখল বাটিতে গোটা দশেক আমৃতি বয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করাল, মা কে?

কাজের মেয়েটি চোখ ঘুরিয়ে বলল, এ বাড়ির মালিকের গিন্নি।

ও হো। অঞ্জলি তাড়াতাড়ি সুভাষচন্দ্রের কিনে আনা প্লাস্টিকের ডিশে মিষ্টিগুলো ঢেলে রেখে বাটিটা ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই কাজে বা মেয়েটি চলে গেল। মনোরমা বললেন, বাড়িওয়ালি মানুষটি তো ভাল। আমরা কেউ নই। অথচ মিষ্টি পাঠিয়ে দিল। এই শুনলাম কলকাতার মানুষের মনে মায়া। দয়া নেই, কথাটা ঠিক নয়।

অঞ্জলিও এই ব্যবহারে খুশি। সে বাটি হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এইটে ফেরত দেওয়া দরকার। এইসময় পাশের ভাড়াটে বউটির সঙ্গে চোখাচে্যুখি হল। সে দাঁড়িয়ে আছে তার দরজায়, আপনাদের বুঝি মিষ্টি দিয়া গেল কালুব মা?

অঞ্জলি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বউটি বলল, আমরা যেদিন প্রথম আইছিলাম আমাদেরও দিছিল। আমি তো বুঝি নাই, খালি বাটি ফিরত দিয়া দিছিলাম। আর তারপর কি কথা, কি কথা। আমরা বাঙাল, ভদ্রতা জানি না, জংলী, এইসব।

অঞ্জলি আর কথা না বাড়িয়ে পাশের ঘরে ঢুকাল। সেখানে সুভাষচন্দ্ৰ কথা শেষ করে দাঁড়িয়েছেন যাওয়ার জন্যে। তাকে দেখে বললেন, তোমার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। আজকের রাতটায় তোমাদের রাঁধতে নিষেধ করেছিলাম! ওদের হাতে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার শাশুড়ির জন্যে নিরামিষ পাঠাবো ভাল দোকান থেকে। ওঁকে আজকের রাতটা কষ্ট করতে বলে।

ছেলেরা রাস্তা হারিয়ে ফেলবে না তো?

আরে বাবা ওদের এ বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যাব।

আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। আমাদের চা-বাগানে কেউ কারো বাড়িতে কোন খাবার পাঠালে বাটিটাকে ফেরত দিয়ে দিতাম। পরে যখন কোন ভাল খাবার হত তখন আমিও পাঠাতাম। এখানকার নিয়ম কি?

সুভাষচন্দ্র বললেন, যদি ঘটিবাড়ি থেকে আসে তাহলে খবরদার খালি বাটি ফেরত দিও না। তারা ভাববে তুমি সভ্যতা জানো না।

তাহলে ওদের হাতে দশ টাকার মিষ্টি কিনে পাঠাতে হবে।

অমরনাথ শুয়েছিলেন চুপচাপ, জিজ্ঞাসা করলেন, কে আবার ভদ্রতা করল?

ওপর থেকে, বাড়িওয়ালার গিন্নী।

তাই বলে দশ টাকার মিষ্টি এখনই পাঠাতে হবে কেন?

সুভাষচন্দ্ৰ বললেন, দশ টাকা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আসলে, এটা উত্তর কলকাতার নিজস্ব ভদ্রতা। না করলে ওঁরা আপনাদের সম্পর্কে খারাপ ভাববেন।

ছেলেরা যখন রাতের খাবার নিয়ে এল তখন দীপা শুয়ে। অঞ্জলি তাকে বলল, যা বাটিটা দিয়ে আয়।

দীপা চোখ বন্ধ করল, অসম্ভব। ওদের বলো, আমার দ্বারা সম্ভব না।

কেন? অঞ্জলি বিরক্ত হয়েছিল।

চুক্তিবদ্ধ ভদ্রতায় আমি বিশ্বাস করি না, তাই।

দুই কিশোর ভাই যত সহজে কলকাতার সঙ্গে মিশতে পারল মনোরমার তা পাবা সম্ভব নয়। অঞ্জলিও এত গাড়ি এবং মানুষ দেখলেই ভয় হয়। দীপার মনে অন্য একটা ধাবণা তৈরি হল। মাঝরাত্রে অথবা ভোরে জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালে শহরটাকে দারুণ শান্ত, সুন্দর মনে হয়। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ আর মানুষে চার পাশ থিক থিক করে। অথচ এইসব মানুষের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ তার দিকে লুক্ষেপ করে না। কারো প্রয়োজন পড়ে না দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কথা বলার। পরস্পরের সম্পর্কে নির্লিপ্ত থেকে এরা একই রাস্তা ব্যবহার করে। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। সেটা অঞ্জলি অথবা মনোরমার ক্ষেত্রে হয় না। অল্প বয়সী তরুণ অথবা চল্লিশ পার হওয়া প্রৌঢ়েবা। তাকে দেখেশী দৃষ্টি পাল্টায়। মানুষের চোখের মধ্যে লালা গড়ানো জিভ আছে তা কলকাতায় না এলে জানা যেত না। আর তখনই তার আঙরাভাসা নদীর গায়ে খুঁটিমারির জন্মলের কথা মনে পভে যায়। সেই গভীর জঙ্গলের পায়ে চলা পথে হাঁটলে কান ঝালাপালা হয়ে যায় বিঝির ডাকে, পাখির চিৎকারে। কিন্তু গাছগুলো ঠাসাঠাসি দাঁড়িয়ে থাকে অত্যন্ত নির্লিপ্ত হয়ে। পাশ দিয়ে কে হেঁটে যাচ্ছে তা গ্ৰাহ্যই করে না যেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই বাড়িয়ে থাকা কোন কাঁটাগাছের ডালে শরীর জ্বলতে থাকে। আর সেই ডালগুলো যে গাছে হয় তাকে গাছ না। বলে ঝোপ বলাই সঙ্গত। এইসব লোভী চোখ দেখলে ওই কাঁটাডালের কথা মনে পতে যায়।

অমরনাথকে দেখতে যাওয়ার জন্য দুবেলা এই বাড়ি থেকে মিছিল বের হয়। সুভাষচন্দ্ৰ তাদের অন্য একটি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। বড় রাস্তা এড়িয়ে গলি দিয়ে হেঁটে মেডিকেল কলেজের সামনে পড়া যায়। এতে ঝামেলা কম। অমরনাথের বিছানার পাশে একটি মাত্র টুল, তাতে মনোরমা বসেন। হাসপাতালে আসা-যাওয়ার জন্য দুবেলা মনোরমাকে জামাকাপড় ধুতে হয়। কিন্তু তিনি টুলে বসে থাকেন। গম্ভীর মুখে। আশেপাশের রোগীদের দিকে ভুলেও তাকান না। ছেলেরা কিছুক্ষণ বাবার কাছে দাঁড়িয়ে করিডোরে চলে যায়। অঞ্জলি রোজই এক প্রশ্ন করে। অমরনাথের রাত্রে ঘুম হচ্ছে না, এই হাসপাতালের খাবার মুখে দেওয়া যাচ্ছে না, আজ পায়খানার সময় আয়াকে তিনবার ডাকতে হয়েছে, বন্ড ডাক্তার কাল রাত্রে দেখতে আসেননি। অমরনাথ এইসব উত্তর দিয়ে যান। শুনতে শুনতে দীপার মনে হয়। অসুস্থ হলে মানুষ অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে যায়। খুব সামান্য ব্যাপারও তার কাছে তখন অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে। অমরনাথের শরীরের তেমন উন্নতি হচ্ছে না। বিকেলে সুভাষচন্দ্ৰ দেখতে আসেন রোজ। তিনি অবশ্য খুব আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। বডি ডাক্তার সমস্ত পরীক্ষা করিয়েছেন, রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেবেন। এই ব্যাপারে চিন্তা করার কিছু নেই।

তৃতীয় দিন বিকেলে সুভাষচন্দ্র স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। দীপা এই প্রথম তার মামীকে দেখল। হাসপাতালে দেখা করতে আসার সুবিধে এই যে পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম না করলেও চলে যায়। ভদ্রমহিলাকে দীপার অঞ্জলির থেকেও আধুনিক বলে মনে হল। সাজপোশাক এবং কথা বলার ধরন অনেক আলাদা। প্ৰত্যেকের সঙ্গে আলাপ হবার পর তিনি দীপাকে বললেন, তোমার কথা খুব শুনেছি। পড়াশুনায় খুব ভাল তুমি। তোমার মামা যখন পাত্র খুঁজছিলেন আবার তখন আমি ওঁকে নিষেধ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল। আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত।

দীপা বলল, আপনি ঠিক বলেছেন।

ভদ্রমহিলা অনর্গল কথা বলে গেলেন। তাঁর নিজস্ব সমস্যা, কলকাতার সমস্যা, কিছুই বাদ গেল না। জায়গাটা যে হাসপাতালের ভেতর তা তাঁর খেয়ালেই থাকল না। দীপা দেখল আশেপাশের বোগীবা বেশ বিরক্ত হয়েই এদিকে তাকিয়ে আছে। সে বলল, মা, আমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।

অঞ্জলি কিছু বলার আগে ভদ্রমহিলা বললেন, তাই ভাল। আমার হাসপাতালে এলেই শরীর গুলিয়ে ওঠে। গন্ধে। চল, আমিও সঙ্গে যাই।

অগত্যা দীপাকে মামীর সঙ্গে বেরুতে হল; খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মামী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আই এ পাস করে কি করবে?

পড়ব।

কোথায়? জলপাইগুড়িতে?

দেখি।

তুমি কি বিধবাদের নিয়মকানুন মানো?

না।

বাড়িতে কিছু বলেনি?

প্ৰথম দিকে বলেছিল তারপর বলা ছেড়ে দিয়েছে।

কথা শুনে মামী। উদাস চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, তোমার মামার ইচ্ছে ছিল যে তোমরা আমার ওখানে ওঠ। আরো আমরাই ভাল করে নিঃশ্বাস নিতে পারি না, তোমরা গেলে তো বিপদে পড়তে। দুটো ঘর তার ওপর পাশের বাড়িতে একটি বখাটে ছেলে, তোমাদের নিয়ে যাই কি করে বলতো? যাক, এখানে কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? কদিনের ব্যাপার, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

কিন্তু দেখতে দেখতে কাটল না। অমরনাথ তিন মাস বিছানায় পড়ে রইলেন। ডাক্তার অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাঁর অপারেশন করলেন। অঞ্জলির টাকা শেষ হয়ে আসছিল। তার চেয়ে বড় সমস্যা ছেলেদের স্কুল কামাই হচ্ছে। এইভাবে চললে বছর নষ্ট হবে। অনেক চিন্তার পর নিতান্ত অনিচ্ছায় অঞ্জলি ভেবেছিল যে ছেলেদের নিয়ে ফিরে যাবে। কলকাতার বাসায় মনোরমা থাকবেন দীপাকে নিয়ে। চা-বাগানে ফিরে গিয়ে অঞ্জলি টাকার ব্যবস্থা করবে। কি ভাবে সেটা হবে তা জানা নেই। কিন্তু সেই পরিচিত পরিবেশে সেটা যদিও সম্ভব কিন্তু এই কলকাতায় চাইলে কেউ একটা টাকাও দেবে না।

অমরনাথ যখন অপারেশনের পর চৈতন্যহীন তখন দীপার পরীক্ষার ফল বের হয়েছিল। ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে পরীক্ষার ফল ছাপা বই কিনে এনেছিলেন সুভাষচন্দ্র। এনে দীপার নম্বরটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। এই নম্বর মনের মধ্যে গাঁথাই ছিল। দীপা লক্ষ্য করল ঘরের সবাই উদ্বিগ্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে বয়েছে। দীপার একটুও ভয় করছিল না। সে জানে ফেল করার মত পরীক্ষা সে দেয়নি। নম্বরটা বলতেই সুভাষচন্দ্ৰ তডিঘড়ি পাতা ওল্টাতে লাগলেন। শেষে তাঁর দৃষ্টি পড়ল। নম্বরটার ওপরে এবং তিনি হেসে উঠলেন, সজোরে, আরো কাবাস, তুই ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছিস দীপা।

সঙ্গে সঙ্গে মনোরমা এবং অঞ্জলির মুখে প্রশান্তি নেমে এল। অঞ্জলি বলল, ইস, তোর বাবার অপারেশনটা যদি কালকে হত তাহলে আজই ওঁকে খবরটা দেওয়া যেত।

মনোরমা বললেন, আঃ, খবর দেওয়ার সময় যেন পারে না। এমন ভাবে বললে!

অঞ্জলি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, না-না, আমি তা বলতে চাইনি।

সুভাষচন্দ্র তখন দীপার সামনে দাঁড়িয়ে, শোন, তোর আর জলপাইগুড়িতে থেকে পড়া চলবে না। তুই কলকাতার কলেজে ভর্তি হবি। হয় বেথুন নয় ব্ৰেবোর্ন।

অঞ্জলি বলল, তুমি পাগল হলে? কলকাতায় পড়তে কত খরচ!

খরচ? ও তো জলপাইগুড়ির হোস্টেলে থেকে পড়ত। সেখানে খরচ হত না।

অঞ্জলি চুপ করে গেল এবং তখনই তার মনে পড়ল ব্যাঙ্কে অমরনাথ আর দীপার নামে প্রতুলবাবুর দেওয়া টাকাটা এখনও আছে। দীপার পরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্র অমরনাথ নির্দেশ দিয়ে এসেছিলেন যেন সুদের টাকা আর হোস্টেলে না পাঠানো হয়। সেই টাকাটা পেলে এখনকার অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান হতে পারে। কিন্তু অঞ্জলি ভাবার সময় পেল না। সুভাষচন্দ্র তখন গড়গড় করে দীপার। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন।

হঠাৎ দীপা প্রশ্ন করল, তুমি বেথুন ব্ৰেবোর্নের কথা বলছি কেন?

ওই দুটো হচ্ছে শুধু মেয়েদের কলেজ। বেথুন বেটার।

কিন্তু কলেজ হিসেরে প্রেসিডেন্সি সবচেয়ে ভাল।

তা ঠিক। কিন্তু ছেলেদের সঙ্গে পড়তে পাঠিয়ে মা-বাবা চা-বাগানে আরামে থাকতে পারবে তো? আর প্রেসিডেন্সিতে মেয়েদের জন্যে হোস্টেল আছে কিনা জানি না।

তাহলে বি এ পাস করার পর কি করব? মেয়েদের জন্যে কি আলাদা এম এ পড়ার ব্যবস্থা আছে? জলপাইগুড়িতেও আমি ছেলেদের সঙ্গে পড়তাম। মামা আমি প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হব। দীপা জোর গলায় বলল।

শেষ পর্যন্ত অঞ্জলি না বলে পারল না, তুই কী রে। উনি ওদিকে বিছানায় পড়ে আছেন আর তুই নিজের জন্যে চিন্তা করছিস?

দীপা তথমত হয়ে গেল। সে অবাক হয়ে অঞ্জলির দিকে তাকাল। সুভাষচন্দ্ৰ বললেন, এটা কি রকম কথা হল। রেজাল্ট বেরিয়েছে। এখনই সব ছেলেমেয়ে কলেজে ভর্তি হবার চেষ্টা করবে। ও যদি চুপচাপ বসে থাকে তাহলে পরে সুযোগই পারে না। কিন্তু তোকে মার্কস আনতে হবে তো জলপাইগুড়ি কলেজ থেকে।

অঞ্জলি বলল, হ্যাঁ, পরে আমার মনে হয়েছে ওকেও আমার সঙ্গে একবার জলপাইগুড়িতে যেতে হবে। বিশেষ কাজে ওরা যাওয়া দরকার।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি কাজ?

সেটা ওখানে গেলেই জানতে পারবে।

রেজাল্ট বেরুনোর পর দীপার মনে হল অঞ্জলি যেন আচমকা পাল্টে গিয়েছে। সুভাষচন্দ্র চলে যাওয়ার পর নিজের মনেই গজগজ করল, আর পড়াশুনা করে যে কি হাতি ঘোড়া হবে কে জানে! ওই তো সত্যসাধনমাস্টার, কত পড়াশুনা লোকটার, শেষ সময়ে, প্ৰায় বিনি চিকিৎসায় মরতে হল। মামা বলল আর ভাগ্নী হাত তুলে নাচলেন।

মনোরমার কানে গোল কথাটা, কি যা তা বলছি বউমা। মেয়েকে পড়ানোর জন্যে তুমিই তো একসময় উঠেপড়ে লেগেছিল। জানলায্য দাঁড়িয়ে রোজ দেখি কত বড় বড় মেয়ে এম এ পড়তে যাচ্ছে। এমনি এমনি যাচ্ছে তারা?

অঞ্জলি বলল, আপনি এসব বুঝবেন না। আপনার ছেলের কিছু হলে আমি কোথায় ভেসে যাব তা জানেন? ওই বলদ দুটোর কি হবে? এতবাব বললাম যে মামাকে নিয়ে হেড অফিসে গিয়ে ধনা দে, তা না একবার গিয়েই উৎসাহ ফুরিয়ে গেল। টাকা কি মিনমিন করে চাইলে কেউ দেয়? আপনার ছেলের পেছনে কত খরচ হচ্ছে জানেন? সেই টাকা জোগাবে কে?

তা এর সঙ্গে দীপার পড়ার কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে। অঞ্জলি কথা বাড়াতে আর চাইল না।

দীপার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে সে দু-দিন গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই কলেজে তাকে ভর্তি হতে বলেছিলেন সত্যসাধনমাস্টার। আজ অঞ্জলির কথাবার্তারি ধরনে তার সব স্বপ্ন চুরমার হতে চলেছে। বুকের ভেতর অভিমান একটু একটু করে বিদ্রোহের চেহারা নিচ্ছিল।

তোমায় দ্যাখে। পেছন থেকে গলাটা কানে আসতেই দীপা ঘুরে দাঁড়াল; পাশের ভাড়াটেদের মেয়েটা। আজ শাড়ি পরেছে। দীপার সামনে জানলা, তার ওপাশে রাস্তা! সেদিকে ইঙ্গিত করল মেয়েটা। দীপা মুখ ফিরিযে দেখল রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

মেয়েটি বলল, আমারে দুদিন কইছিল তোমার সঙ্গে কথা কওয়ার ইচ্ছা খুব।

তুমি ওদের চেনো? কি করে ওরা?

আগে চিনতাম না। আলাপ করছে তাই নাম জানি। বাপের পয়সা আছে, সেই পয়সা দিয়ে সিনেমা দ্যাখে, আমারেও দেখাইছে। তুমি দেখবা।

চটপট মাথা নাড়ল দীপা। না। আমার ঘেন্না করে।

মেয়েটি ঠোঁট ওল্টালো। তারপর রাগত ভঙ্গীতে চলে গেল। একটু বাদেই দীপা লক্ষা করল মেয়েটি রাস্তায় উদাসীন ভাবে হাঁটছে। আর সেই ছেলে দুটো কয়েকবার তার দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে অনুসরণ করল।

এই কয় মাসে মেয়েটির সঙ্গে তার সামান্যই কথাবার্তা হয়েছে। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ে শেষ পর্যন্ত পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ওর দাদার নাকি একটা কাটা কাপড়ের দোকান আছে। বউদি সিনেমা দেখতে ভালবাসে। আর মেয়েটা যখন ইচ্ছে তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে দাদা বাইরে থাকলে।

মনোরমাকে একা কলকাতায় রেখে যাওয়া অশোভন। অথচ তিনি ছেলেকে সুস্থ না করে কলকাতা ছাড়বেন না বলে জিদ ধরেছেন। দশ দিনের চাল ডাল আলুর ব্যবস্থা হয়ে গেলেই নাকি তিনি দিব্যি থাকতে পারবেন। এই দশ দিনের মধ্যে দীপা যদি ফিরে আসে তাহলে তো কোন চিন্তা নেই। সুভাষচন্দ্রের চিনিয়ে দেওয়া গলি দিয়ে দু-বেলা হাসপাতালে যাবেন আর এই ঘরে শুয়ে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্ৰ আশ্বাস দিলেন তিনি বোজ না হলে একদিন অন্তর এসে দেখে যাবেন। তা ছাড়া হাসপাতালে গিয়ে অমরনাথের দেখাশোনা করা, ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা-এসব তো তাঁকে করতে হবেই।

ফিরে যাওয়ার আগের দিন বিকেলে অমরনাথের কিছুটা চেতনা ফিরেছে দেখা গেল। তিনি মানুষ চিনতে পারছেন। অক্সিজেনের নল খুলে দেওয়া হয়েছে। অঞ্জলি কাদো কাঁদো গলায় তাঁকে জানাল দীপা পাস করেছে এবং সেই কারণে জলপাইগুড়িতে ফিরে যাওয়া। দরকার। অমরনাথের পাণ্ডুর মুখে যেন আলো ফুটল। তিনি ইশারায় দীপাকে কাছে ডাকলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, তুই এবার কলকাতার কলেজে পড়বি। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র অঞ্জলির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।

চা-বাগানে পৌঁছে সুখবরটা পাওয়া গেল! হেড অফিস থেকে অমরনাথের সম্পর্কে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছিল ম্যানেজারের কাছে। তিনি সেটা যথাসময়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিছু টাকা মঞ্জুর হয়ে এসেছে। অত্যন্ত অল্প হলেও টাকা টাকাই! বাগানের সমস্ত বাবু এসে খোঁজ নিতে লাগলেন অমরনাথ কেমন আছেন! তাঁর মাইনে এবং হেড অফিসেব দেওয অনুদান অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার বড়বাবুকে সঙ্গে নিয়ে অঞ্জলির হাতে দিয়ে গেলেন। অঞ্জলি একটু স্বস্তি পেল। সেদিনই কিছু টাকা সুভাষচন্দ্রের নামে মনি-আডাবি করে পাঠিয়ে দিল সে।

পরদিন সকালে দীপা যখন জলপাইগুড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে তখন দেখল অঞ্জলিও প্ৰস্তুত। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

জলপাইগুড়িতে।

ওমা, তুমি গিয়ে কি করবে?

টাকা তুলতে হবে।

কোত্থেকে?

ব্যাঙ্ক থেকে। তোমার আর তোমার বাবার নামে ব্যাঙ্কে যে টাকা রাখা হয়েছিল, যাব সুদে তুমি এই দু বছর পড়লে সেটা প্রতুলবাবুর দেওয়া বলে একসময় রাগ করে পড়া ছেভে দিয়ে এসেছিলে। বলেছিলে ওই টাকা ছুঁয়ে দেখারও প্রবৃত্তি তোমার নেই? মনে পড়ছে? আজ সেখান থেকে টাকা তুলে তোমার বাবার চিকিৎসা করাতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই এতে কোন আপত্তি নেই?

কেন আপত্তি করব? কত টাকা তুলবো?

দশ হাজার।

বাব্বা! অত টাকা নিয়ে ফিরে আসবে কি করে?

যেভাবে সবাই আসে।

জলপাইগুড়ি শহরে ওরা যখন পৌঁছালো তখন ঠিক এগারটা। দীপার ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই কলেজে গিয়ে মার্কসিটি দেখতে। পয়ষট্টি শতাংশর ওপর নম্বর না পাওয়া গেলে অনার্স পড়তে দেবে না প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু অঞ্জলি আগে ব্যাঙ্কে যেতে চাইল। চেক-বই ও পাস-বই অমরনাথের ড্রয়ার থেকে নিয়ে এসেছিল অঞ্জলি।

ব্যাঙ্কের কাউন্টারে পৌঁছে সে জানতে চাইল দশ হাজার টাকা তুলতে হলে কি করতে হবে। ভদ্রলোক, জানালেন, সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে অত টাকা তুলতে গেলে আগে নোটিস দেওয়ার নিয়ম। অবশ্য ম্যানেজার ইচ্ছে করলে অনুমতি দিতে পারেন। এ ব্যাপারে অঞ্জলিদের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

দীপাকে নিয়ে অঞ্জলি ম্যানেজারের ঘরে এল। ভদ্রলোক বসতে বলে বক্তব্য শুনলেন। তিনি বললেন, আপনার স্বামীর অসুস্থতার জন্যে টাকাটা প্রয়োজন বলে একটা দবখাস্ত করুন। আমি ততক্ষণ আপনাদের খাতাটা আনিয়ে দেখছি। তিনি চেক-বুক এবং পাস-বই চেয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দীপা ব্যানার্জি কে?

দীপা বলল, আমি।

অমরনাথ মুখোপাধ্যায়?

আমার বাবা।

ও, আপনাদের তো জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। দীডান দাঁড়ান মনে পড়েছে। আপনাকে হোস্টেলের ঠিকানায় ইন্টারেস্ট পাঠানো হত প্ৰত্যেক মাসে, তাই না?

দীপা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

ভদ্রলোক নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট তিনেক বাদে একটা বড় লেজার-বুক নিয়ে ফিরে এসে বললেন, আপনারা কি কিছুই জানেন না?

অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, কি বিষয়ে?

ম্যানেজার লেজার বই-এর বিশেষ পাতাটি মেলে ধরলেন। সেখানে আর একটি কাগজ পিন দিয়ে আটকানো আছে। ম্যানেজার বললেন, প্ৰথম কথা, আইদাবি আর নয়, টাকা তুলতে গেলে দুজনেরই সই লাগবে। তবে একজন মারা গেলে অন্যজনের সইতে টাকা তোলা যাবে ডেথ সাটিফিকেট দেখিযো। দ্বিতীয়ত, আজ থেকে দু বছর আগে অমরনাথবাবু এবং দীপা দেবী একসঙ্গে সই করে ব্যাঙ্ককে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুদের টাকা থেকে একটা অঙ্ক প্ৰতি মাসে হোস্টেলের ঠিকানায দীপা দেবীর নামে পাঠিয়ে দিতে। আজ থেকে সাড়ে তিন মাস আগে অমরনাথবাবু সেই চিঠির সূত্র উল্লেখ করে আকার নির্দেশ দিয়েছেন জলপাইগুড়ির কলেজ হোস্টেলের ঠিকানায় আর টাকা পাঠাতে হবে না। এবার থেকে টাকা পাঠাতে হবে কলকাতার কলেজ হোস্টেলের ঠিকানায় এবং সেই ঠিকানাটা ক্যাঙ্ককে তিনি অথবা দীপা দেবী পরে জানিয়ে দেবেন। এখন এই চিঠির বক্তব্যে যদি দীপা দেবীর। আপত্তি থাকে এবং যেহেতু তিনিও টাকাটার একজন অংশীদার তাহলে আমাদের জানালে আমরা অমরনাথবাবুর নির্দেশ অগ্ৰাহ্য করব। আপত্তি না থাকলে কলকাতার হোস্টেলের ঠিকানায় দীপা দেবীর নামে পাঠানো আরম্ভ হবে। তবে কোন অবস্থায় দুজনের সই চেকে না থাকলে এখনই টাকা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

অঞ্জলির মুখ কথাগুলো শুনতে শুনতে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। দীপা ভাবতে পারছিল না। অমরনাথ তাকে কিছু না জানিয়ে ব্যাঙ্ককে এই নির্দেশ দিয়েছেন। ম্যানেজার বললেন, আপনার কলকাতায় হোস্টেলের ঠিকানাটা জানিয়ে আমাদের একটা চিঠি পাঠালে ভাল হয়

ওরা চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে এল। এসেই অঞ্জলি চাপা গলায় বলল, ওঃ কত বড় বড় কথা বলেছিলি, টাকার ওপর তোর তো কম লোভ না!

আমি কিছুই জানি না মা। আমি ব্যাঙ্ককে লিখতে পারি। কলকাতায় টাকা পাঠাতে হবে না। এতে তুমি খুশি হবে?

তাতে লাভটা কি হবে? তোমার বাবার সই চাই টাকা তুলতে। উঃ, আমি আর ভাবতে পারছি না। অঞ্জলি হন হন করে হাঁটতে লাগল। অবাক দীপা দৌড়ে এল পাশে, তুমি কোথায় চললে?

বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। অঞ্জলি আর দাঁড়াল না। স্তম্ভিত দীপা কি করবে বুঝতে পারছিল না। একটা সাইকেল রিকশার হনের শব্দে তার চেতনা ফিরল। তাকে কলেজে যেতেই হবে। মার্কসিটি নেওয়া সবচেয়ে জরুরি। সে একা হাঁটতে লাগল। এই অঞ্জলিকে সে কোনদিন দেখেনি। মানুষের কতগুলো মুখ থাকে? কতগুলো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *