1 of 2

২৭. অমরনাথের শরীর

অমরনাথের শরীর বয়সের তুলনায় বেশী বুড়িয়ে যাচ্ছিল। আজকাল একটুতেই মাথা ঘোরে, প্রেসার বেড়ে গিয়েছে খুব। চিন্তা করলেই মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। বাগানের ডাক্তার ছুটি নেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, পনের দিন একদম বিশ্রামে থাকতে হবে, চিন্তা করলে চলবে না। দীপাকে নিয়ে যে সমস্যা তিনি তৈরী করেছিলেন তার ধাক্কা সামলানোই যখন মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠিক তখনই মৃত পিতা ফিরে এলেন সন্ন্যাসের শেষ বাধা পুত্র হতে। ব্যাপারটাকে মেনে নিতে তাঁর খুব কষ্ট হয়েছিল। পরদিন সকালে সর্বত্র খোঁজ করেও তিনি সন্ন্যাসীর দর্শন পাননি। অথচ মনোরমার দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক হয়ে যান। মনোরমা যেন ঘটনাটা সম্পর্কে একদম নির্বিকার। তিনি মানতেই বাজি নন যে তাঁর স্বামী জীবিত, এবং এই বাড়িতে এসেছিলেন। বিধবার যা যা করণীয তাই নিষ্ঠাব সঙ্গে করে চলেছেন তিনি।

এখন অনেকটা অজান্তেই দীপার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অমরনাথ। চিঠিপত্র আর লেখেন না। সেই ভার দিয়েছেন অঞ্জলিকে। সে-ই মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। জলপাইগুড়িতে বন্যার খবর পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছিলেন। খবরটা এসেছিল সন্ধেবেলা। সেদিন রেডিওতেও শুনেছিলেন। সন্ধে নামলে যাওয়ার উপায় নেই। সাবরাত ছটফট করেছিলেন। সকালবেলায় বানারহাট মালবাজার সেবক হয়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছে শুনেছিলেন সেদিন যাওয়া যাবে না। পরের দিন মেয়ের কাছে এক হাঁটু কাদা মেখে পৌঁছে বলেছিলেন, তোমার মা বললেন। এখানে অসুবিধে হলে আমার সঙ্গে চা-বাগানে চলে আসতে।

দীপা মাথা নেড়ে বলেছিল তার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। অমরনাথ সেদিনই আবার ঘুরপথে ফিরে গিয়েছিলেন চা-বাগানে। মাথা ঘোরা আরম্ভ হয়েছিল তখন থেকেই। দীপা এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা দিচ্ছে। অঞ্জলি একাই দুদিন ঘুরে এসেছে। বাগানের ডাক্তারের ওষুধে অমরনাথের শরীর ভাল হচ্ছে না। বাঁ দিকের বুকে প্রায়ই কৰ্ম, খা হচ্ছে। বাগানের ডাক্তার এবার পরামর্শ দিলেন কোন স্পেশালিস্টকে একবার দেখাতে।

জলপাইগুড়ি শহরে এইসময় বুকের বিশেষজ্ঞ তেমন কেউ নেই। শিলিগুড়িতে আছেন, কিন্তু অনেক আলোচনার পর স্থির হল শিলিগুড়িতে যাওয়ার চেয়ে কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা করানো ঢের ভালো। থাকা খাওয়ার খরচ এক তাছাড়া আরও ভালো চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো যাবে। অঞ্জলি তার দাদা সুভাষচন্দ্ৰকে চিঠি লিখল। দীপার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই তারা দিন সাতেকের জন্যে অমরনাথকে নিয়ে কলকাতায় যেতে চায় তাঁর চিকিৎসার জন্যে। সুভাষচন্দ্র চটপট উত্তর দিলেন, সাত দিনের জন্যে কোন অসুবিধে নেই।

এই লাইনটা অমরনাথ অপছন্দ করলেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে সাতদিনের বেশী থাকলে সুভাষচন্দ্ৰ যে অসুবিধায় পড়বেন তা লাইনটিতে স্পষ্ট। কলকাতায় সাধারণ মানুষের বাসস্থানের সমস্যা প্রকট তা তিনি জানেন। যদিও সুভাষচন্দ্র যখন এখানে আসেন এবং বেশ কিছুদিন থেকে যান তখন তাঁর আচরণে সেটা বোঝা যায় না। অঞ্জলি তাঁকে লিখেছে। যদি অল্প ভাড়ায় মাসখানেকের জন্যে একটা বাড়ি পাওয়া যায় তাহলে খুব ভাল হয়।

ছেলের জন্যে মনোরমাও উদ্বিগ্ন হয়েছেন। যদিও কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে যাওয়ার প্ৰস্তাবে তাঁর কিছুটা অস্বস্তি হয়েছে। বউমার দাদার বাড়িতে গিয়ে থাকার বাসনা বিন্দুমাত্র নেই। অবশ্য এখনও কেউ তাঁকে যেতে বলেনি। সমস্ত কিছুর উদ্যোগ অঞ্জলিই নিচ্ছে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে। ইতিমধ্যে বাড়িতে সবাই বুঝতে পেরেছে যে করেই হোক অমরনাথকে সুস্থ করা দরকার। এই পরবারের প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ ওই একটি জীবনের ওপর নির্ভর করছে। মনোরমার উদ্বেগ তাই মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়াচ্ছে। অঞ্জলির কাছে সেটা এখন বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। শেষপর্যন্ত অঞ্জলি মনোরমাকে বলতে বাধ্য হল, মা, ওঁকে নিয়ে কলকাতায় কতদিন থাকতে হবে বুঝতে পারছি না। ওখানে তো আপনার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে না।

মনোরমা চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, জলপাইগুড়িতে ভাল ডাক্তাব নেই?

থাকলে কেউ সাধ করে অতদূর যায়? অঞ্জলি তখনই কথা শেষ করেছিল। তার হঠাৎই মনোরমার জন্যে কষ্ট হল। অমরনাথ ওঁর  একমাত্র পুত্র। অঞ্জলি নিজের দুই ছেলের একজনের এমন হলে ছেড়ে দিয়ে দূরে থাকতে পারত? অসম্ভব। অঞ্জলির সন্ন্যাসীব কথাও মনে পড়ল। এ ব্যাপার নিয়ে আর কোন আলোচনা এই বাড়িতে না হলেও অঞ্জলির বিশ্বাস ভদ্রলোককে মনোরমা চিনতে পেরেও না চেনাব ভান করেছেন। কেন করেছেন সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু করার সময় এবং তার পরে বুকোব মধ্যে যে যন্ত্রণা নিয়ে উনি আছেন তার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু কোথায় ওঠা হবে কি রকম পরিবেশ হবে না জেনে ওঁকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?

বিকেলের ডাকে দুটো চিঠি এল। দীপার পরীক্ষা সামনের সপ্তাহে। সে তৈরী। দ্বিতীর্য চিঠিটা লিখেছেন সুভাষচন্দ্র। কলকাতার মেডিকেল কলেজের একজন হার্ট স্পেশালিস্টের সঙ্গে এ্যাপয়ন্টমেন্ট করা হয়েছে। এখানে নামকরা ডাক্তারদের দেখা একমাস আগে পাওয়া। প্রায় অসম্ভব। সুভাষচন্দ্রের এক পবিচিত ভদ্রলোক মিজাপুর স্ট্রিটে থাকেন। তাঁর বাসায়। দুটো ঘর পাওয়া যাবে। তবে তাঁকে অন্তত দুমাসেব ভাডা দিতে হবে। মাসিক দেড শো টাকা। কলকাতায় পৌঁছাবার দিন জানালে সুভাষচন্দ্র স্টেশনে থাকতে পাববেন।

চিঠিটা পড়ে অমরনাথ স্বস্তি পেলেন। যদিও দেড় শো টাকা মাসিক ভাডা তাঁর কাছে যথেষ্ট বেশী। তবু এই টাকা কোনমতে ব্যবস্থা করা যাবে। যাতায়াতেব ভাড়া অফিস থেকে পাওয়া যাবে। দু বছর অন্তর বেড়ানোর জন্যে একটা নির্দিষ্ট টাকা পাওয়া যায় অফিস থেকে। অনেকেই সেটা নিয়ে বাড়িতে বসে থাকে। চিকিৎসাব খরচ চেষ্টা করলে কিছুটা অন্তত পাওয়া যাবে। বেশিরভাগ চা-বাগানগুলোর হেড অফিস কলকাতায়। এখন যিনি হেড অফিসের মেজকতা তিনি একসময় এই চা-বাগানে নিয়মিত ট্র্যাবে আসতেন। ভাল আলাপ আছে অমরনাথের সঙ্গে। মিস্টার মুখোপাধ্যায় বলে সম্বোধন করেন তাঁকে। গিয়ে দাঁড়ালে তিনি নিশ্চয়ই না বলতে পারবেন না। নিজের শরীরের বদলে অমরনাথের এবার দীপার জন্যে চিন্তা শুরু হল। যা ঝড় গেল মেয়েটার ওপর দিয়ে তাতে পরীক্ষার ফল আর কত ভাল হতে পারে; জলপাইগুড়ি থেকে গ্র্যাজুয়েট হলে স্কুলে একটা চাকরি পেতে পারে মেয়েটা। কলকাতায় ডাক্তার স্থির হবার খবর পেয়েই মনে হতে লাগল শরীর অনেক ভাল হয়ে গিয়েছে।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর অঞ্জলি মনোরমার ঘরের দরজায় শব্দ করল। দীপা না থাকলে রাত নটার মধ্যে দরজা বন্ধ করেন তিনি। চাপা গলায় প্রশ্ন এল, কে?

আমি। অঞ্জলি নিচু গলায় জানান দিল।

মনোরমা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?

অঞ্জলি ভেতরে ঢুকল, দাদার চিঠি এসেছে আজ। আমাদের জন্যে দুটো ঘর ভাড়া করেছেন। আমার একার পক্ষে সবদিক সামলে চলা মুশকিল হবে।—।

দীপা তো যাচ্ছে। সে বেশ বড় হয়ে গিয়েছে আজকাল।

কিন্তু আমার ইচ্ছে আপনি সঙ্গে চলুন। আমি ভরসা পাই তাহলে।

আমাকে কেন যেতে বলছো? তোমাদের সমস্যা বাড়বে মনোরমা মুখ ফেরালেন।

দুটো ঘর আছে। আপনি আপনার ছেলের সঙ্গে একটা ঘরে থাকবেন। এতে কোন সমস্যা হবে না। বরং আমাকে যদি বেরুতে হয় আপনি ওর পাশে থাকতে পাববেন।

মনোরমা চুপ করে রইলেন। অঞ্জলি তাঁর দিকে তাকিয়েছিল! উত্তর না পেয়ে বলল, মা, আপনি চলুন। এখানে একা থাকলে চিন্তাই করে যাবেন, কষ্ট বাড়বে। ওখানে আমি চেষ্টা করব আপনার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করে দিতে।

মনোরমা মাথা নাড়লেন, আমার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে না।

মানে? অঞ্জলি অবাক।

বিদেশে গিয়ে নিয়ম মানার কোন দরকার নেই।

কিন্তু আপনার ছেলের জন্যে মাছ মাংস বাঁধতে হতে পারে।

আগে নিরামিষ করে নিও পরে ওসব করো।

অঞ্জলি মাথা নাড়ল। তার খুব অবাক লাগছিল। মনোরমা এত পাল্টে গেলেন কি করে? নাকি নিজের বাসনা পূৰ্ণ করতে শেষ পর্যন্ত এইটুকু মেনে নিলেন। এখন এখানে যে ছাঁয়াছুয়ি বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছেন, সেটাও স্বচ্ছন্দে বিস্মত হলেন। স্বচ্ছন্দে কি? অঞ্জলি বুঝতে পারল না।

করে যাবে? মনোরমা প্রশ্ন করলেন।

দীপার পরীক্ষার পরেই।

এ বাড়ির কি হবে?

বুধুয়া আছে। ওই দেখাশোনা করবে। পাশের বাড়িকেও বলে যাব।

খোকা কি চাইছে আমি যাই?

ওঁর সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়নি। কলকাতায় যেতে গেলে আপনার কি কি জিনিস কিনতে হবে তার একটা ফৰ্দ করে রাখবেন। আমি দীপার পরীক্ষার দিন জলপাইগুড়িতে যাব, তখন কিনে আনব। অঞ্জলি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর মন এখন ভাল।

 

পরীক্ষার শেষ দিনে হোস্টেলে ফিরে এসে দীপা দেখল। অঞ্জলি তার জন্যে বসে আছে। পরীক্ষার আগেই তার আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেইসময় অমরনাথ আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটু ভাল লাগলেই ছুটি বাঁচাতে কাজে বেরুতেন তিনি। দিন পাঁচ ছয় মোটামুটি চলত। তারপর আর পারতেন না। এ ব্যাপারে অঞ্জলির নিষেধ শোনার মানুষ তিনি নন। এই রকমটাই হয়েছিল। কয়েকদিন আগে। ফলে অঞ্জলির আর জলপাইগুড়িতে আসা হয়নি। কিন্তু এই খবর মেয়েকে না জানিয়ে অনা কথা লিখেছিল চিঠিতে। আজ মাকে দেখে খুশি হল দীপা। দ্রুত কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, বাবা কেমন আছে মা?

অঞ্জলি বলল, ভাল না। বুকের ব্যথাটা কিছুতেই কমছে না। ওষুধ খেলে ভাল থাকছে না খেলে যেকে সেই। তোর পরীক্ষা কেমন হল?

হল। আমরা কলকাতায় যাচ্ছি, করে?

অঞ্জলি যা যা ঘটেছে তা দীপাকে খুলে বলল। বলতে বলতে হঠাৎ তার ধারণা হল সেই একদিনের বাচ্চা মেয়ে আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। ঠিক মেয়ে নয়,বন্ধুর মত এর সঙ্গে সব কথা খুলে বলা যায়। সংসারের যাবতীয় অর্থচিন্তা, অমরনাথের কিছু হয়ে গেলে যে বিপর্যয় আসবে সেসব ভাবনাও অকপটে বলতে পারল সে।

দীপা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, তুমি আগ বাড়িয়ে এতসব ভাবছ কেন? ভাল চিকিৎসা হলে বাবা ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে কলকাতায় গিয়ে মামার ওখানে না উঠে সোজা ওই ভাড়াবাড়িতে উঠলে ভাল হয়।

কেন?

এতে মামার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকবে।

অঞ্জলির ব্যাপারটা পছন্দ হল না। একথা ঠিক সুভাষচন্দ্র নিজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। প্ৰতি নববর্ষে এবং বিজয়াতে অঞ্জলি চিঠি দিয়েছে এই বছরগুলো ধরে এবং সেই সব চিঠিতে বউদিকেও প্ৰণাম জানিয়েছে কিন্তু সেই মহিলার কাছ থেকে কোন চিঠি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যেহেতু অঞ্জলির মা একসময় ওই মহিলাকে অপছন্দ করতেন তাই তিনি নিজেকে নির্লিপ্ত রেখেছেন। আর অমরনাথও গায়ে পড়ে ওঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে যাননি। অঞ্জলি দু-একবার বলেছিল। কিন্তু অমরনাথ উৎসাহিত হননি। কথাটা অপছন্দ হলেও মেয়ের বুদ্ধিতে আস্থা বাড়ল। তাঁর। সেইদিন বিকেলে যা কিছু কেনাকাটা করে মেয়েকে নিয়ে ফিরে এল সে চা-বাগানে।

বাড়িতে ঢুকে অমরনাথের সামনে দাঁড়াল দীপা। অমরনাথ ইজিচেয়ারে শুয়ে জানল, দিয়ে লিচুগাছের দিকে তাকিয়েছিলেন, পায়ের শব্দে মুখ ফেব্যালেন। মুখ সহজ করে জানতে চাইলেন, কেমন হল?

পাশ করব।

একবার সত্যসাধন মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে এস। কাল শ্যামল এসে বলল ও<ব শব্যাক খুব খারাপ। তোমার পড়াশুনার পেছনে ওঁর দান সবচেয়ে বেশী।

দীপা মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি কেমন আছ?

আমি ভাল আছি। তোমার মা ঠাকুমা অনর্থক চিন্তা করছেন। তুমি তো এদের মত মানুষ হওনি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে এসব চিন্তার কারণ কি?

তুমি কি ভেবেছ?

শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে একটা বটগাছ আছে। গাছটা যখন প্রথম বড় হয়েছিল। তখন তার মূল গুঁড়ির ওপর সমস্ত শরীরটা দাঁড়িয়েছিল। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ডাল থেকে কুরি নামতে নামতে সেগুলো মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে নিজেরাই এক একটা গাছ হয়ে গেল। কিন্তু যতদিন সেটা হয়নি। ততদিন মূল গাছটির গোড়াবা ওপর তার জীবন নির্ভব কর ত। আমি জানি আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজন অনেকটা এই কারণেই। তুমি এবং তোমার ভাইরা যতদিন পায়ের তলায় মাটি না পারে ততদিন আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। এটা শুধু ঐাদের আকাঙক্ষা নয়, আমারও। যাও বিশ্রাম কর। দীপার মনে হল বিশ্রামটা অমরনাথের দরকার। একটানা কথা বলে তিনি কাহিল হয়ে পড়েছেন। মুখে ক্লান্তি জমেছে, নিঃশ্বাস দুত হল। সে আর দাঁড়াল না।

দুই ভাই এখন পূর্ণ কিশোর। একসঙ্গে থেকেও এরা চিরকালই দীপার থেকে আলাদা স্বভাব নিয়ে রয়েছে। দুজনেই খুব উত্তেজিত হয়ে বয়েছে। কলকাতার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর লিস্ট করে রেখেছে। এই বয়সে বাবার অসুখ নিয়ে ভাবান মত মানসিকতা এদের তৈরী হয়নি। অথচ ওই বয়সে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ছেলেরা সম্ভবত অনেক সময় নেয় প্রাপ্তবয়স্ক হতে।

মনোরমার ঘরে ঢুকে সে বিছানায় ধাপ করে বসেই আবার লাফিয়ে উঠল, এই যাঃ।

মনোরমা নাড়, বানাচ্ছিলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল?

বাইরের কাপড়ে বিছানায় বসে পড়েছিলাম।

ও। মনোরমা মুখ ফেরালেন, এখন তো ভেতর বাইরে বিচার করলে চলবে না। বসেছ যখন তখন বসো। বিদ্যাধরীর বিদ্যা কতদূর হল?

ইন্টারমিডিয়েটটা পাশ করে যাব মনে হচ্ছে।

গ্রাজুয়েট হতে হলে আর কতদিন পড়তে হবে?

দু বছর।

ওরে বাবা। তা যাই বলিস তুই যে পরীক্ষা দিলি আমাদের বংশেব কোন মেয়ে দূরের কথা ছেলেরাই ওই পরীক্ষা দেয়নি। গর্বেব হাসি হাসলেন মনোরমা।

দীপা এক পলক দেখল। তারপর ইচ্ছে করেই বলল, আমি তোমাদের বংশেব কেউ নই।

তাতো বলবেই। নিজের ছানা ভেবে বড় করে এখন তো কোকিলেব ডাক শুনব।

শব্দ করে হেসে উঠল দীপা। এবং হাসতে হাসতে প্ৰায় চিৎকার করে উঠল, ও ঠাকুমা, তুমি এটা কি বললে?

কি হল, চেঁচাচ্ছিস কেন? তোর বাবুর অসুখ খেয়াল নেই? মনোরমা অপ্রস্তুত।

আমি কোকিল হলে তোমরা, তুমি নিজেকে কাক বলছ।

এইসময় অঞ্জলি এসে দাঁড়ায় দরজায় চিৎকার এবং হাসি শুনে। মনোরমা তাকেই সাক্ষ্মী মানলেন, দ্যাখো বউমা, কলেজ থেকে ফিরে আমাকে জ্বালাতে এল।

অঞ্জলি ভ্ৰ কোঁচকালো, কি বলছিস তুই?

জবাবটা মনোরমাই দিলেন, পড়াশুনো করে ওর শিক্ষা হয়েছে যে উনি আমাদের বংশের নন।

দীপা বড় চোখে তাকাল, কথাটা মিথ্যে, বল মা?

এসব কথা উঠছে কেন? অঞ্জলির মুখ গম্ভীর হল!

কথার কথা। আমি তোমাদের বংশেব নই। কিন্তু আমার চেয়ে, আপনি তোমাদের কেউ নেই। আচ্ছা, আমরা করে বাওনা হচ্ছি? প্রশ্নটি মনোরমাকে; কারণ অঞ্জলি তাকে আগেই জানিয়েছিল বাগানোব ম্যানেজাব তাদের জন্যে টিকিট কাটতে শিলিগুড়িতে লোক পাঠিয়েছেন। খবরটা আজ দুপুরেই বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা।

মনোরমা মাথা নাড়লেন, আমি জানি না তো। কেউ কিছু বলেনি।

দীপা অঞ্জলিকে বলল, আমি একটু মাস্টারমশাই-এবা কাছ থেকে খুবে আসছি।

কাল সকালে যাস না। এখনই সন্ধে হয়ে যাবে।

যাব আর আসব। দীপা উঠোনে নেমে এল। সে দেখল। বুধুয়া তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বুধুয়ার এখন মধ্যবয়স। দীপা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

বুধুয়া মাথা নাড়ল, ভাল না। বউ ভোগে গিয়েছে।

মানে? দীপা অবাক।

ছয় মাস আগে শাদী হয়েছিল। বানারহাটেব মেয়ে! আমি চা-বাগানে কাজ কবি না, বাবুবাড়িতে নোকর হয়ে আছি বলে থাকল না। বুধুয়া বিমর্ষ মুখে বলল।

তুমি তো বাবাকে বলে চা-বাগানে চাকরি নিতে পার?

নাঃ। আমার ওইসব কাজ ভাল লাগে না?

দীপার কৌতূহল বাড়ছিল, বউ-এর জন্যে তোমার মন কেমন করে না?

বুধুয়া দ্রুত মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল।

তাহলে তুমি চা-বাগানে কাজ নিয়ে নাও।

বুধুয়া উদাস চোখে কাঁঠাল গাছের মাথায় তাকাল। সেখানে দুটো শালিক তর্ক জুড়েছে। দীপা আর দাঁড়াল না। খিড়কি দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। এখন ঘন বিকেল। মাঠে ছেলেরা খেলছে। বাগানের মেয়েরা সেজোগুজে দলবেঁধে মাঠের একাধারে পাক খাচ্ছে। এরা নিতান্তই ছোট। কিন্তু ভাবভঙ্গিতে ইতিমধ্যেই পাকামি এসে গিয়েছে। ওরা দূর থেকে দীপাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। দীপা যেন ওদের লক্ষ করেনি এমন ভঙ্গীতে হেঁটে আসাম রোডে উঠে এল।

মসৃণ পিচের রাস্তার দুধারে ছায়া টেনে আনা দেওদার গাছের সারি। এই রাস্তায় হাঁটতে দীপার খুব ভাল লাগছে আজ। কয়েকটি মদেশিয়া কামিন ওর দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। এবং তখনই সে বিশুর বাবা আর মাকে আসতে দেখল। এই চা-বাগানে যে রক্ষণশীল মানসিকতা এখনও চলে আসছে তাতে কোন স্বামী স্ত্রী তা যে বয়সেরই হোক না। কেন একসঙ্গে পথে হাঁটতে বড় একটা দেখা যায় না। মুখোমুখি হতেই দীপা দাঁড়িয়ে পড়ল, কেমন আছেন জ্যেঠিমা?

বিশুর মা মাথা নাড়লেন, ভাল না। তুমি নিশ্চয়ই জানো বিশু মিলিটারিতে গিয়েছে।

হ্যাঁ। ওরা যেদিন যায় সেদিনই বন্যা এসেছিল জলপাইগুড়িতে।

ও, তুমি জানো তাহলে। দুটো ছেলে একসঙ্গে গেল, খোকন ফিরে এল কিন্তু বিশু এল না। সে শুনেছি কাশ্মীর না কোথায় এখন আছে। দেডমাস। চিঠি পাইনি। তাই তোমার জ্যাঠামশাইকে নিয়ে তেলিপাড়ায় গিয়েছিলাম।

তেলিপাড়ায় কেন?

ওখানে একজন কাপালিক এসেছেন। ত্রিকালজ্ঞ। মারণ-উচাটন সবরকম বিদ্যে জানেন তাঁর পায়ে পড়ে বললাম ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনতে। উনি কথা দিয়েছেন। এখন কি আছে বরাতে কে জানে

দীপা হাসি সামলালো বেশ চেষ্টা করে, কিন্তু ফিরিয়ে আনতে চাইছেন কেন? ওব। যদি ওই চাকরি ভাল লাগে তাহলে করতে দিন না।

তারপর কোথায় শত্ৰুর গুলি খেয়ে মরে থাকুক, আমরা জানতেও পারব না। একি কথা বলছি তুমি? ভদ্রমহিলার গলার স্বর পাল্টে গেল।

মিলিটারিতে যদি কেউ চাকরি না নিয়ে যায় তাহলে আমাদের দেশকে শত্ৰুব আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। কারা?

ওসব কথা ভাবাব লোক আছে, আমি চাই বিশু ফিরে আসুক। ওঁরা আর দাঁড়ালেন না। দীপা লক্ষ করল বিশুর বাবা তাকে কোন প্রশ্ন করলেন না বিশু নিশ্চয়ই ফিরে আসবে না। কিন্তু খোকন ফিরে এসেছে কেন? খোকনের চরিত্রের মধ্যে একটা মেয়েলি নবম ভাব ছিল। কিন্তু তাই বলে ভয় পেয়ে ফিরে আসবে। এটা কখনও মনে হয়নি।

বাজারের রাস্তায় পৌঁছে দীপা দেখল প্রচুর অচেনা ছেলে এসে গিয়েছে এখানে। তারা শহরের ছেলেদের মত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। এরকম দৃশ্য আগে এখানে দেখা যেত না। একটি ছেলেকে বলতে শুনল, দারুণ জিনিস।

দীপা এক মুহুর্তে থমকে দাঁড়াল। ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিল। এদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার কোন মানে হয় না বলে মনে হল দীপার সে আবার হাঁটতে আরম্ভ করল।

সত্যসাধন মাস্টারের বাড়ি স্কুল পেরিয়ে কলোনির মধ্যে। এলাকাটা ছাড়ালেই খুঁটিমারি ফরেস্ট। কাঠের বাড়ি। ছোট উঠোন, টিনের বাউণ্ডারি দেওয়া। টিনের গেট খুলতেই একজন বয়স্ক মহিলা মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়ালেন। রোদে শুকুতে দেওয়া কাঠের টুকরো বুড়িতে ভরছিলেন তিনি।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, মাস্টারমশাই আছেন?

মহিলা মাথা নাড়লেন, তুমি দীপা, না?

হ্যাঁ। দীপা এগিয়ে এসে প্ৰণাম করল। মহিলার দিকে তাকালেই বোঝা যায় অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি আশীর্বাদ করলেন, আয়ুষ্মতী হও মা। যাও ভিতরে যাও, তিনি শুইয়া আছেন। দীপা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

পরীক্ষা কেমন দিলা? চিনচিনে গলায় একটা প্রশ্ন ভেসে এলো ঘরের কোেনা থেকে। এখনও আলো জ্বালা হয়নি। জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরটিতে চিমসে গন্ধ ভাসছে। দীপা সেখানে দাঁড়িয়েই জানতে চাইল, আপনি, আপনার কি হয়েছে?

পেটে বড় যন্ত্রণা হয়, আর কিছু না। এখানে আস, পরীক্ষা কেমন দিলা?

দীপা এগিয়ে খাটের পাশে দাঁড়াল। খাট বলতে তক্তপোশ এবং তার ওপর প্ৰায় সত্যবঞ্চি হয়ে যাওয়া তোষক। সতাসম্বধন মাস্টার চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। এই আধা-অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল তাঁর মুখ চোখ ভেঙে গিয়েছে। অত্যন্ত শীর্ণ হয়েছেন তিনি, চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছে। দীপা খাটের পাশে বাখ্যা কাঠেব চেয়ারে বসতে বসতে বলল, পরীক্ষা ভালই দিয়েছি। কিন্তু এ কি চেহারা হয়েছে। আপনার?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চোখ বন্ধ করে সত্যসাধন জিজ্ঞাসা করলেন, সিক্সটি পার্সেন্ট নম্বর পাইবা তো? ইউ মাস্ট রিমেম্বার দ্যাট ইউ আর ফাইটিং এগেইনস্ট ডেস্টিনি। ইউ আর টু মোক ইওর ওন ফিউচাব। ভুলব না। কখনও কথাটা।

আমি চেষ্টা করার।

না। বল, তোমারে জয়ী হইতে হইব।

কিন্তু আপনি ডাক্তার দেখাচ্ছেন?

কবিরাজী করাইতেছি। কলোনিতে একজন ভাল কবিৰ্ব্বাজ আইছেন। বাজসাহীর মানুষ। মাঝে মাঝে একটু উপকার দেয়। নিঃশ্বাস ফেললেন সত্যসাধন। তারপর যেন মনে পড়ল এমন শুঙ্গীতে বললেন, তোমার বাবার তো খুব অসুখ। কেমন আছেন?

ভাল না। কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে।

তুমি যাইবা সঙ্গে?

হ্যাঁ।

গুড। শোন, যখনই টাইম পাইবা তখনই কয়েকটা জায়গায যাইবা। ধব, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ন্যাশনাল লাইব্ৰেবি। ওইসব জায়গায় কিছুক্ষণ থাকলেই মনের পরিবর্তন হয়। আমার ইচ্ছা ছিল তুমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হও।

এইসময় একটা হ্যারিকেন নিয়ে সত্যসাধনের স্ত্রী প্ৰবেশ করলেন, অল্প কথা কইলে ভাল হয়। কবিরাজ মশাই রাগ করবেন।

আরে রাখো তোমার কবিরাজ এরে চেনো তুমি?

মহিলা হাসলেন, তোমারে দেইখ্যা ওনার মুখে কথা ফুটতেছে।

শোন, সারাজীবন অনেক ছাত্র ছাত্রী দেখলাম। কিন্তু এ হল আমার বেস্ট স্টডেন্ট। কিছু খাইতে দাও এরে।

দীপা তড়িঘড়ি বলে উঠল, না না। আমার একটুও খিদে নেই। কিন্তু ডাক্তার মানে কবিরাজ কি বলছে? অসুখটা কি?

লিভারে পচন ধরছে। মদ্যপান করলে নাকি এই রোগ হয়। দুবেলা ভাত জোটে নাই ঠিকমত, মদ্যপান করার মত মনও হয় নাই কখনও অথচ দ্যাখো, আমার লিভারে সেই রোগ বাসা বাঁধিল। এরেই বলে কপাল।

আপনি কপালকে মেনে নিচ্ছেন কেন? লড়াই করছেন না কেন? ওরে মা, লড়াই করনের একটা বয়স থাকে। যখন রক্ত গরম তখন দুনিয়া পায়ের তলায়। জীবন থিকা আমার আর পাওনের কিছু নাই।

এসব কথা শুনতে চাই না। বাগানের ডাক্তারকে আপনি দেখিয়েছেন?

না। তিনি আমারে দেখবেন কেন?

আমি বলব। আপনাকে সেরে উঠতেই হবে।

দীপা যখন উঠে দাঁড়াল তখন বাইরে ঘন অন্ধকার। একটু আগে বুধুয়া হাজিব হয়েছে টার্চ নিয়ে। অঞ্জলি তাকে পাঠিয়েছে। দীপার কেবলই মনে হচ্ছিল মাস্টারমশাই আর বেশীদিন বাঁচবেন না। এই একটু কথা বলেই কেমন হাঁপিয়ে পড়েছেন। বোঝা যাচ্ছে তাঁর পেটে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। শায়িক মানুষকে প্ৰণাম করতে নেই। সে মাস্টারমশাই-এর কপালে হাত রাখল, আপনাকে বাঁচতে হবে। আমার জন্যে আপনাকে বাঁচতে হবে।

সত্যসাধন বললেন, পাগল। তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন আর নাই। আমার যা ছিল আমি দিতে পারি তার সব নিয়া তুমি রান শুক করছ। তোমারে পড়ানোব, যোগ্যতা আর আমার নাই। শিশু যখন মায়ের কোলে থাকে তখনই তার স্তন্যদুগ্ধেব প্রয়োজন হয়। কিন্তু যেই সে অন্য খাদ্য গ্ৰহণ করতে শেখে তখন মায়ের স্তন্যের দুগ্ধ শুকাইযা যায়। এইটাই জীবনের নিয়ম। শোন মা, তোমারে একটা কথা বলি, কখনও পিছন দিকে তাকাইবা না। তোমার চেয়ে নিচে যার স্থান তার সঙ্গে হৃদয়ের কথা বলব না। তুমি যতক্ষণ নিজে না মনে কর অন্যায় ততক্ষণ পাঁচজনে যাই বলুক তুমি কথা কানে তুলিবা না। তোমার বিচারক তুমি।

আগামীকাল আবার আসবে বলে দীপা বাইরে বেরিয়ে এল। বুধুয়া দাঁড়িয়ে ছিল গেটেব সামনে। ওকে দেখামাত্র টর্চ জ্বালল। এই অন্ধকারে পথ হাঁটা সত্যিা মুশকিল। দীপা অঞ্জলির কাণ্ডজ্ঞানে কৃতজ্ঞ হল। দূরে শেয়াল ডাকছে। বুধুয়া টর্চ হাতে আলো ফেলতে ফেলতে পেছনে আসছে। সত্যসাধন মাস্টারের জন্যে দীপার খুব কষ্ট হচ্ছিল। বাজার পেরিয়ে বাগানে এসে সে বুধুয়াকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্সে চলে এল। লুঙ্গি পরে হ্যারিকেনের আলোয় খবরের কাগজ পড়ছিলেন ডাক্তারবাবু বাইরের ঘরে বসে। দীপাকে দেখে অবাক হলেন, কি ব্যাপার তুমি? পরীক্ষা কেমন হল?

ভাল। আপনাকে একবার যেতে হবে।

কেন? বাবার কি শরীর আবার খারাপ হয়েছে?

না বাবার না। মাস্টারমশাই, সত্যসাধনবাবুর।

হ্যাঁ, শুনেছিলাম বটে। উনি অসুস্থ। কিন্তু উনি তো চা-বাগানের স্টাফ নন।

কিন্তু কোন মানুষ, অসুস্থ হলে এসব বিচার কি সবসময় করা উচিত?

বেশ, তুমি চাইছ যখন তখন আমি যাচ্ছি। কিন্তু ওঁর বাড়ি আমি চিনি না।

আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।

দরকার হবে না। তোমাদের কাজের লোক চেনে? ও সঙ্গে গেলেই হবে।

খোকন বাড়িতে আছে?

না হে। সে আজ আলিপুরদুয়ারে চলে গেল। মাসীর বাড়িতে। আর তো কিসু্য হবে না। জীবনে। যে ছেলে মিলিটারিতে গিয়ে পরিশ্রম সহ্য না করে পালিয়ে আসে তার জন্যে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয় না। হঠাৎ লাস্ট বাসে আলিপুরদুয়ার চলে গেল। তুমি বাড়িতে যাও, আমি মাস্টারকে দেখে আসছি।

বুধুয়াকে নির্দেশ দিয়ে অন্ধকার মাঠের মধ্যে দিয়ে কোয়ার্টার্সে ফিরতে ফিরতে দীপার মনে হল খোকন কি তার সঙ্গে দেখা হওয়া এডাতেই মাসীর বাড়িতে চলে গেল? নইলে হুট করে লাস্ট বাস কেউ ধরে না। অন্তত একটু আত্মসম্মানবোধ এখনও ওর মধ্যে কাজ করছে। মনে হতে ভাল লাগল। দীপার।

রাত আটটার মধ্যেই বাতেব খাবার, ওষুধ-খেয়ে শুয়ে পড়েন অমরনাথ। দীপা পরিষ্কার হয়ে তাঁর ঘরে গেল। মশারি এখনও ফেলা হয়নি। অমরনাথ চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। মেয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ মেললেন। দীপা জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ?

অমরনাথ হাসলেন।কিন্তু তৎক্ষণাৎ হাসিটা কাঁপতে লাগল। তাঁর ঠোঁট মুচড়ে উঠল। চোখ বন্ধ হল। চোখের দুই কোণ বেযে জল গড়িয়ে পড়ল। দীপা ধীরে ধীরে ঔব মাথাব পাশে উঠে বসল। আঙুলের ডগায় জলেরধারা মুছিয়ে দিয়ে বলল, কেঁদো না। কাঁদলে তোমার শরীর আরও খারাপ হবে।

অমরনাথ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললেন। দীপা ওঁর মাথায় গালে হাত বুলিযে দিতে আরম্ভ করল! ধীরে ধীরে অমরনাথ নিজের ডান হাত দীপার কোলেব ওপর রাখলেন। অঞ্জলি কাজ সেরে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দৃশ্যটি সে দেখল, দেখে খুশি হল। ওরা কেউ কোন কথা বলচে না। অন্যদিন ঘুমেব ওষুধ না খেলে অমরনাথের কিছুতেই ঘুম আসে না। আজ পনের মিনিটের মধ্যে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। অঞ্জলির মনে পড়ল ঠিক এইভাবেই অনেক অনেক বছর আগে মেয়েকে পাশে নিয়ে শুয়ে অমরনাথ নিজেই ঘুমিয়ে পড়তেন আর মেয়ে চুপিচুপি উঠে আসত।

রান্নাঘরে গিয়ে দীপা জানতে পারল তাদের টিকিট হয়েছে। পরশু। ম্যানেজার বলে পাঠিয়েছেন। এখান থেকে বাগানের গাড়িতে সবাইকে পৌঁছে দেওয়া হবে শিলিগুড়িতে। বেলা একটায় বেরিয়ে পড়তে হবে। মনোরমা আর অঞ্জলির ব্যস্ততা বেডে গিয়েছে। পরশু। যেন আগামীকাল। বুধুয়া ফিরে এল। সে বলল ডাক্তারবাবু থেকে গিয়েছেন মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে। ওঁর নাকি ব্যথা খুব বেড়েছে। দীপা অঞ্জলিকে সব বলল। কাল সকালে চা খেয়েই দীপা মাস্টারমশাই-এর কাছে যাবে।

অঞ্জলি দরজায় শব্দ করতে মনোরমার ঘুম ভাঙল। তখন রাত শেষ হয়েছে কিন্তু দিন আরম্ভ হয়নি। মনোরমা দরজা খুলতেই অঞ্জলি বলল, ডাক্তারবাবু এইমাত্র বাড়ি ফিরলেন।

কেন মনোরমা বুঝতে পারলেন না।

আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখি উনি ফিরছেন। কথাগুলি বলার সময় অঞ্জলি দেখল দীপা বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। সে পরিষ্কার গলায় প্রশ্ন করল, উনি কি বললেন?

আজ ভোর সাড়ে তিনটের সময় মাস্টারমশাই চলে গিয়েছেন।

হঠাৎ একটা কান্না ছিটকে বেরুলো দীপার গলা থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে আঁচল চেপে ধরলেন মনোরমা, মুখপুড়ি করছিস কি? বাড়িতে একটা রুগী রয়েছে না? খবরটা পেলে তার কি অবস্থা হবে কেউ বলতে পারে?

কান্না চেপে ছটফট করতে লাগল দীপা। তারপর ছুটে চলে গেল বাথরুমে। মুখে জল দিয়েই সে ছুটল উঠোন পেরিয়ে খিড়কির দরজার দিকে। প্ৰায় পাগলের মত সে দৌড়াতে লাগল পালি পায়ে আসাম রোড ধরে। এখন রাস্তায় একটিও লোক নেই। প্ৰতিদিনের মত পাখিরা ডাকছে গাছের ডালে ডালে। ভোর হচ্ছে। স্কুলবাড়ির সামনের মাঠের কাছে পৌঁছে থমকে গেল দীপা। তারপর হাঁটুমুড়ে বসে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। যে কান্নাটা এতক্ষণ বুকের পাঁজরায় পাক খাচ্ছিল তা ভোরের শূন্য প্রান্তরে উগরে দিতে পেরে স্বস্তি হল। একসময় সম্মোহিতের মত সে মাস্টারমশাই-এর বাড়ির সামনে পৌঁছাল সেখানে, কিছু ছাত্র, পাড়ার লোকজন ইতিমধ্যে ভিড় জমেছে। স্কুলের অন্যান্য মাস্টারমশাই, কিছু ছাত্র, পাড়ার লোকজন। ওরা দীপাকে দেখল। দীপা উঠোনের একপাশে আঁচল দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে রইল। মাস্টারমশাই-এর মৃতদেহ নিয়ে স্কুলে যাওয়া হবে কিনা। এইসব কথা হচ্ছিল। শুধু ভেতর থেকে মাস্টারমশাই-এর স্ত্রীর ভাঙা গলায় কান্না ভেসে আসছিল। পবিবেশেব সঙ্গে একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে দীপা ধীরে ধীরে কাঠেব সিঁড়ি বেয়ে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে চার পাঁচ জন মানুষ চুপচাপ বসে আছে। একজন মহিলা মাস্টারমশাই-এর স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আছেন। আর মাস্টারমশাই নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন। জীবনের সমস্ত সমস্যার বাইরে। মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। হঠাৎ দীপার কানেব কাছে কেউ বলে উঠল, ইউ মাস্ট রিমেম্বার দ্যাট ইউ আর ফাইটিং এগেইন্সট ডেস্টিনি। কখনও পিছন দিকে তাকাইবা না। দীপা বিড়বিড় করল, কক্ষনো না।

বেলা বারোটা নাগাদ সবাই তৈরী। ডাক্তারবাবু, তেজেনবাবু, শ্যামল এসেছে বিদায় দিতে। জিনিসপত্র তোলা হয়ে গিয়েছে গাড়িতে। অমরনাথ ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠলেন। তাঁর পাশে মনোরমা অঞ্জলি আর দীপা। দুই ছেলে সামনে। বুধুয়া দাঁড়িয়েছিল করুণ মুখে।

গাড়ি চলতে শুরু করল। কোয়ার্টার্সের সামনের মাঠ পেরিয়ে আসাম রোড ধন্বতেই দীপার মনে সত্যসাধন মাস্টারের মুখ ভেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট চাপল দাঁতে, মুখে মেঘ জমল। অমরনাথ সেটা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মন খারাপ করছে? তোর তো মন খারাপ করার কথা না জলপাইগুড়িতে থেকে এ জায়গা ছেড়ে যাওয়া অভ্যোস হয়ে যায়নি? দীপা জবাব দিল না। সত্যসাধনমাস্টারের মৃত্যুর কথা অমরনাথকে জানানো হয়নি। সহজ হতে চেষ্টা করল দীপা। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল তার জীবন এবার অন্য বাঁক নিতে যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *