1 of 2

স্বপ্নবৎ

স্বপ্নবৎ

শৈশবে সাঁকো পারাপার ছিল আমাদের প্রিয় খেলা। অবশ্য শৈশব না কৈশোরকাল এখন আর তা ঠিক মনে করতে পারছি না। আমি, কুট্টি মাসি, কুট্টি মামা, ছোটন দাদু সবার ছিল এটা বড়ো প্রিয় খেলা। শীত গ্রীষ্মে মামার বাড়ি যাবার এই এক আগ্রহ ছিল।

মামার বাড়ি যেতাম মা-র সঙ্গে। শীতে গ্রীষ্মে কখনো বর্ষায় মাতামহের চিঠি আসত। মাতামহের সেই গোপনীয় চিঠি একবার দেখে ফেলেছিলাম। মা এই চিঠি এলেই আড়ালে কাঁদতে বসতেন। চিঠিটাতে কী এমন দুঃসংবাদ থাকত, জানি না। বড় জ্যাঠামশায় তখন বৈঠকখানা ঘর থেকে খড়ম পায়ে বের হয়ে ডাকতেন, বাহার, বাহার আছিস!

বাহার চাচার সাড়া পাওয়া যেত গোয়ালঘরের পেছনে। বলত, যাই কর্তা।

বাহার চাচাকে তিনি বলতেন, মেজবউ কান্নাকাটি করছে। বাপের বাড়ি যাবে বলছে। দিয়ে আয়। দিনক্ষণ দেখে দিচ্ছি।

ব্যাস, আমার তখন মজা। কারণ মামার বাড়ি গেলেই সাঁকো পারাপারের খেলা শুরু হয়ে যাবে। এই এক মজা যেমন আমাকে তাড়া করত, সঙ্গে এক আতঙ্কও ছিল গভীর। মুখ ব্যাজার হয়ে যেত সেসব দৃশ্যের কথা মনে হলে।

যেমন, মাতামহের চিঠিতে লেখা থাকত, তোমার গর্ভধারিণী আবার গর্ভবতী। এই গর্ভবতী শব্দ মাকে কিছুটা বোধ হয় ত্রাসের মধ্যে ফেলে দিত। চিঠিটা পড়েছি জানতে পেরে, মা একবার খুব মেরেছিলেন আমাকে।

মা, দিদিমার দ্বাদশ বর্ষের প্রথম সন্তান। আমি মা-র পঞ্চদশ বর্ষের একমাত্র জাতক। আমার বয়স তখন আট-দশ হতে পারে, কিংবা দশ-বারো হতে পারে–সে যাই হোক, দিদিমা যে যুবতী সে বয়সেও টের পেতাম। একটা চুল পাকেনি। চোখ বড়ো বড়ো–প্রতিমার মতো মুখ। মায়ের রং আশ্চর্য রকমের লাবণ্যে ভরা। কুট্টিমাসি, আমার বছর দু-তিনের বড়। ছোটন দাদু মা-র কনিষ্ঠ খুড়ামশাই। আমার মা-র চেয়ে আট-দশ বছরের ছোটো।

তবু মা তাকে আপনি আজ্ঞে করতেন। মামার বাড়ি গেলে প্রণামের ধুম পড়ে যেত। মা-র একমাত্র সন্তান বলে আমাকে ছেড়ে তিনি কোথাও এক রাত কাটাতে পারতেন না। আমার মাতামহের পিতৃদেব দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করেন। ছোটন দাদু তার দ্বিতীয় পত্নীর সন্তান। মাতামহের পিতৃদেবকে আমি দেখিনি। বাড়ির বৈঠকখানায় তাঁর একটি তৈলচিত্র আছে। খড়ম পায়, দীর্ঘকায় সুপুরুষ, খালি গায়ে কোঁচানো ধুতি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা গোঁফ, চোখে চশমা, গলায় সাদা ধবধবে উপবীত। মাথায় লম্বা শিখাঁটি পর্যন্ত ছবিতে ধরা আছে। চোখ বিস্ফারিত, সাদা মারবেল পাথর বসানো চোখে এবং তাতে মনে হত দুটো বেতুন ফল বসানো আছে। তৈলচিত্রটির সামনে যেতে আমার ত্রাস সৃষ্টি হত কেন জানি না। কাছে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস হয়নি। তেজস্বী চেহারা, গম্ভীর এবং গর্জন তেলের মতো চকচকে।

আর সবচেয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করত, হাতে তাঁর এক গণ্ডা অতিকায় ইলিশ। শিল্পী এই ইলিশ কেন হাতে রেখেছেন জানি না। গাঁয়ের কুলদা আচার্য ছবিটি এঁকেছিলেন। মা কথায় কথায় এমন বলতেন। এত দাপট ছিল তাঁর বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। তিনি মেঘনার ইলিশ পছন্দ করতেন। গাঁয়ের রথতলায় তিনি হাট বসিয়েছিলেন যাতে মেঘনা থেকে জেলেরা সোজা হাটে চলে আসতে পারে। হাটে তিনি যেতেন, সবচেয়ে বড়ো এবং তাজা এক গণ্ডা ইলিশ কিনবেন বলে। গৃহভৃত্য সঙ্গে থাকলেও তিনি নিজে হাতে ঝুলিয়ে ইলিশ আনতেন। হয়তো কুলদা আচার্যের কাছে এই দৃশ্যটাই বড়ো গুরুত্ব পেয়েছিল। মানুষটিকে বুঝতে হলে, এক গণ্ডা ইলিশ হাতে ঝোলানো রাখা দরকার তিনি হয়তো এমন ভেবেছিলেন—গুরু বংশ বলে কথা! আমার সব সময়ই মনে হয়েছে মাতামহের পিতৃদেব কাজটি ভালো করেননি। তাঁর আঠারোটি সন্তান এবং জীবিত অবস্থায় যোলোটি সন্তানের দাহকার্য সম্পন্ন করেছেন। দুই স্ত্রী গত হয়েছিলেন। আমার মাতামহ এবং ছোটন দাদুকে ছাড়া শেষ বয়সে তাঁর আর কেউ ছিল না। পিতার অসম্পূর্ণ কাজটি মাতামহ শুরু করে দিতেই তিনি নিশ্চিন্তে দেহত্যাগ করতে পেরেছেন এমন মনে হত আমার।

তিনি যে বিশাল বিত্তের অধিকারী, তাঁর চিহ্ন রথতলায় মঠ, প্রাসাদতুল্য বাড়ি, সামনে সবুজ ঘাসের লন, ঘাটলা বাঁধানো দিঘি—এবং নদীর পাশে এক বিশাল অরণ্য। বৈঠকখানায় মেহগিনি কাঠের চেয়ার, শ্বেতপাথরের টেবিল, পালঙ্ক তাকিয়ার ঠেস দিয়ে অম্বুরি তামাকের ধোঁয়া গিলে চোখ বুজে বিত্ত-বৈভবের কথা হয়তো ভাবতেন, এ-হেন দৃশ্যেরও দু-একটা ছোটোমাপের তৈলচিত্র আঁকিয়ে রেখেছিলেন।

তিনি একটি কালীবাড়িও প্রতিষ্ঠা করে যান। ধুতুরা ফুলটি এবং চারটি করবী গাছ নিজ হাতে রোপণ করেন। কালীবাড়িটি বিশাল জঙ্গলের মধ্যে। বর্তমানে আমার মাতামহ সেবাইত। জাগ্রত দেবী তিনি। শনি মঙ্গলবারে জোড়া পাঁঠা বলি, তার পূজা হোম লেগেই থাকে। পাশেই নদী। ছাগল বামনি। বোধহয় মেঘনার খাড়ি নদী এটা-মেঘনা থেকে বের হয়ে মাতামহের গাঁয়ের পাশ দিয়ে বিশ-বাইশ ক্রোশ দূরের শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশেছে। সাঁকোটা তারই ওপর। বাঁশের সাঁকো। বর্ষায় নদী হয়ে যায়। জলের খরস্রোতে সাঁকোটি ভেসেও যায়। বর্ষার শেষে নদী শীর্ণ হতে হতে যখন দু-পাড় খুবই কাছে এসে যায়, সাঁকোটি তৈরি হয়। বাঁশের সাঁকো। নীচে দুটো করে বাঁশ ফেলা থাকে। নদীতে আট-দশ গজ অন্তর বাঁশের খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়। এভাবে সাঁকোটি উপরের দিকে কিছুটা উঠে গিয়ে ফের নীচের দিকে নামতে শুরু করে। পঞ্চাশ ষাট গজ, কি তারও বেশি হতে পারে সাঁকোর পাশে লম্বা বাঁশ টেনে দেওয়া—নদী পারাপারের জন্য। বাঁশ ধরে সন্তর্পণে হেঁটে যেতে হয়। খুঁটি নড়ে। বেশ ঝাঁকুনি খায়, অথচ হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। আট দশজন লোক পারাপার হয় একসঙ্গে।

রথতলার মাঠে বিশাল একটি বকুল বৃক্ষ। এটি কে রোপণ করেছিলেন, কিংবা অবহেলায় বেড়ে উঠেছিল কি না আমাদের জানা নেই। কালো কালো ডাল, অজস্র শাখাপ্রশাখায় জায়গাটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। দূরের পথিকরা গাছের গোড়ায় খর রোদ থেকে বাঁচার জন্য দু-দণ্ড জিরিয়ে নেয়। মাতামহের বাড়ি থেকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা পথ আছে। অন্দরমহল থেকেও সেই পথ ধরে এই বকুল বৃক্ষের তলায় আসা যায়। আমার কুট্টি মাসি বকুল ফল এবং ফুল দুই ভালোবাসে। আমার সঙ্গে কুট্টি মাসি মাঝে মাঝে বকুল ফুল তোলার জন্য গাছটার নীচে এসে দাঁড়াত। ফুল এত অজস্র যে বর্ষার প্যাঁচপ্যাঁচে ফুলের গন্ধ। কাদা থেকে ফুল তোলা যেত না। আমরা গাছের শাখাপ্রশাখায় নজর রাখতাম। ফুল এসে মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলতাম। মাটিতে পড়লে কাদা লাগবে ভয়ে এটা করা হত। কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুলের ওড়াউড়ি কেমন নেশা ধরিয়ে দিত কুট্টি মাসিকে।

বিকেল বেলাতে কুট্টি মাসির সাঁকো পারপারের খেলা শুরু। আমরা সমবয়সীরা তার সঙ্গী। তার কথামতো না চললে, দুপদাপ পা ফেলে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে পালাত। তারপর সত্যি-মিথ্যা নালিশ তার। এবং অকপটে এমন মুখ ব্যাজার করে নালিশ দিত যে আমরা শুনে আহাম্মক বনে যেতাম।

সাঁকো পারাপারের নেশা আমার কম না। আগে কুট্টি মাসি সাঁকোর ওপর উঠে টলতে টলতে হাঁটত। হাতলের বাঁশ না ধরে হাঁটত। প্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। আমরা সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে। আমরা পারি না, কারণ বিকেল থেকেই খেলার শুরু। কেউ কিছুটা গিয়ে, কেউ মাঝপথে হাতলের বাঁশ ধরে ফেলি। কুট্টি মাসি বিনা অবলম্বনে টলতে টলতে পার হয়ে যাচ্ছে, এটা আমার সহ্য হত না। আমি সাঁকো ঝাঁকিয়ে দিতাম। সঙ্গে সঙ্গে কুট্টি মাসি আত্মরক্ষার্থে হাতলের বাঁশ ধরে ফেলত। না ধরলে বিশ-বাইশ ফুট গভীরে জলে কাদায়, কচুরিপানায় ডোবাডুবির কেলেঙ্কারি।

কে ঝাঁকাল।

এক কথা, না আমরা ঝাঁকাইনি।

মিথুক। বলেই কান ধরে টানাটানি করতে এলে বলতাম, মাসি কুকুর। ব্যা

স হয়ে গেল। রাস্তায় জোড়া কুকুর দেখলেই মাসির মাথা খারাপ।

তাড়া তাড়া।

ঢিল নিয়ে ছুটছি। কুকুর দুটোকে তাড়িয়ে না দিতে পারলে, চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য করে দিতে না পারলে বাড়ির সবার ভোগান্তি। শুয়ে থাকবে মাসি। খেতে বসলেই ওক উঠবে।

শ্রাবণ-ভাদ্রে কুট্টি মাসির জোড়া কুকুরের ভয় এত যে তার ঘরের দক্ষিণের জানালা বন্ধ রাখতে হয়। কারণ জানালা খুললে লিচু বাগান এবং হাটের দোকানপাট সহ রাস্তা ভেসে ওঠে এবং জোড়া কুকুরও। জানালাটা শ্রাবণ-ভাদ্রে এ-জন্য বন্ধ করে রাখা হয়। আমার কুট্টি মাসি ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার পর থেকেই এটা হয়েছে। ন-মাসি ফ্রক পরে। আমার ছোটো। অন্না মাসি তারও ছোটো। মামা মাসি মিলে বারো তেরোজন। শুধু বারো বলতে পারি না, আবার তেরোও বলতে পারি না। বারো বললে মিছে কথা হযে, তেরো বললেও মিছে কথা হবে। কারণ মাতামহীর গর্ভের সন্তানটিকে বাদ দিলে বাক্যের অপলাপ হবে।

মাতামহ তান্ত্রিক মানুষ। মাথায় বিশাল শিখা। সকাল বেলায় প্রাতঃস্নান, স্তোত্র পাঠ। বর্ষায় নদীর ঘাটলায় অবগাহন—সূর্য প্রণাম থেকে কালী কবচ পাঠ-হাতে এক ঘটি জল নিয়ে মঠের শিবের মাথায়, কালীমন্দিরের চার করবী গাছে এবং ধুতুরার জঙ্গলে জল ছিটিয়ে বাড়ি ফেরেন। গরদের কাপড় পরনে। ঘরে তাঁর পাঁজিপুঁথি, দূর দূর গ্রাম থেকে শ্রাদ্ধ, অশৌচ, পাকা দেখা বেং অন্যান্য শুভ দিন, যাত্রা শুভ না অশুভের ভিড়। মূল প্রাসাদের বাইরে বিশাল উঠান। বড়ো বড়ো গোলা, ধানের, মুসুরির, মুগের। তার সংলগ্ন ভেঁকিশালা। অধিরথ দাদুর তত্ত্বাবধানে সব। পাঁঠা বলি থেকে, জমিজমা চাষ আবাদ দেখার দায় তার।

কাকভোরে খড়ম পায়ে মাতামহ তার ঘর থেকে বের হলে হৃৎকম্প দেখা দিত আমাদের। উচু লম্বা এবং এত ফর্সা যে রক্তচন্দনের প্রলেপ চকচক করত কপালে। শিখাতে একটি লাল জবা দোদুল্যমান। গ্রামটা বিশাল, সাহা, পাল, ধোপা, নাপিত, বাদ্যকার এবং আচার্য ব্রাক্ষণ বলতে এক ঘর—আর বাদবাকি জেলেপাড়ার বাসিন্দা। ব্রাহ্মণ পরিবার বলতে আমার মাতামহ এবং তাঁর পরিবার। পরিবারের নানাবিধ লোক মিলিয়ে ত্রিশ একত্রিশ। মামা বলতে কুট্টি মামা। আর সব মাসি। পাঁচ মাসির বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পরিবারের জনসমষ্টি কিছুটা ভাটার দিকে। কুট্টি মাসির সম্বন্ধ আসছে। পছন্দ হচ্ছে না। কারণ পাত্রপক্ষ কী করে খবর পেয়ে যায় মাসির মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়। অস্বাভাবিক আচরণ। খাওয়া-নাওয়া বন্ধ। খেতে বসলে বমি পায়।

শ্রাবণ ভাদ্রে রোগের লক্ষণ প্রকাশ। শীত এলে নিরাময়। এছাড়াও এই রোগের প্রকোপ বাড়ে মাতামহীর গর্ভধারণে। কারণ, গর্ভধারণের শেষ দিকে আমার মাকে আসতেই হয়। মাতামহীর সেই চিঠির কথা আগেই বলেছি—একবার চিঠিটি দেখেই বুঝেছিলাম, বার বার এই একই বার্তা থাকে, তোমার গর্ভধারিণী আবার গর্ভধারণ করেছেন। তুমি কাছে থাকলে তিনি মনে বল পান। বড়ো পুত্রার অনুমতি সাপেক্ষে তোমার আসা বাঞ্ছনীয়।

বড়ো পুত্রার অনুমতি সাপেক্ষে অর্থাৎ আমার বড়ো জ্যাঠামশাইর অনুমতি নিয়ে যাত্রা করার নির্দেশ থাকত চিঠিতে। আগে শুনেছি, মাতামহ মাকে চিঠি দিতেন না। বাবা প্রবাসে থাকেন, তাঁকে চিঠি দেবার প্রশ্নই নেই। গৃহকর্তা বর্তমানে বড়ো জ্যাঠামশাই। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে তাঁর কাছেই চিঠি দিতেন। সবই শোনা কথা।

আমার মাও বোধ হয় গর্ভধারিণীর গর্ভধারণে সংকোচ বোধ করতেন। আগে শুনেছি গুম মেরে যেতেন। ঠাকুমা টের পেয়ে বলতেন, মেজো বউমার শরীর বোধ হয় ভাল নেই। কিংবা বলতেন, বাপের বাড়ি থেকে কী দুঃসংবাদ এল কে জানে! বড়ো জেঠির তত্ত্বতালাশ শুরু হয়ে যেত এবং ক্রমে জ্যাঠামশাইর কানে কথাটা উঠলে বাহার চাচাকে দিয়ে ডুলিতে মাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমাদের গাঁয়ের ছাড়া বাড়িতে সাত-আটজন লোক পালকি নিয়ে শীত গ্রীষ্ম বসবাস করত। বর্ষাকাল এলে সুদূর মুঙ্গের বলে একটি দেশ আছে সেখানে চলে যেত। গাঁটাগোট্টা মোটা গোঁফ, বেঁটে মতো লোকগুলি মুঙ্গেরের মানুষ খুব অচেনা জায়গা নয়—কারণ বই এ তখনকার দিনে মুঙ্গেরের ভূমিকম্প কথাটা লেখা হয়ে গেছিল। আমরা স্কুলের পাঠ্য বই থেকে মুঙ্গের নামক স্থানটির পরিচিতি লাভ করে ফেলেছি। লোকগুলিকে চিনতে অসুবিধা হত না। ওদের দেশোয়ালি ভাষা আমরা একদম বুঝতাম না। তবে ভাঙা বাংলা বলতে পারত বলে রক্ষা। ডুলি কাঁধে যাবার সময় আমি আর বাহার চাচা অনেক পেছনে পড়ে থাকতাম। তারা মাঠ পার হয়ে খাল নদী বিল পার হয়ে কোনো গাছতলায় অপেক্ষা করত। আমরা গাছতলায় পৌঁছালে আবার তারা রওনা দিত। মা শুধু একবার ডুলির কাপড় তুলে মুখ বার করে আমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।

বর্ষায় কোনো অসুবিধা ছিল না। ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে দিলেই হল। পাল তুলে দিলেই হল। বর্ষার জল থই থই করছে। আমি আর মা ছই-এর ভিতর। কাঠের পাটাতনে সাদা ফরাস পাতা বিছানা। দুদিকে কাঠের দরজা। দরজা খুলে প্রায়ই আমি বাইরে এসে বসতাম। বাহার চাচা তামাক খেতে খেতে আমার মাতামহের যশ করতেন খুব। সাচ্চা আদমি বলতেন মাতামহকে। আমি গর্ব বোধ করতাম।

এমন একজন মাতামহের প্রতি কুট্টি মাসি খুব রুষ্ট ছিলেন ধরতে পারতাম। মাতামহকে সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর কী অপরাধ তাও ধরতে পারতাম না। কথায় কথায় কুট্টি মাসি বলত, যাব যেদিকে দু-চোখ যায় বের হয়ে?

আমি বলতাম, যাও না কেন?

যাব কী করে। দেখিস না, কুকুরগুলি কী জ্বালায়।

তা হলে একমাত্র কুকুরের ভয়ে কুট্টি মাসি দেশান্তরী হতে পারছেন না। কুকুরের উপদ্রব নেই কোথায়! এমন জায়গা আমারও চেনা নেই যে বলি, কুট্টি মাসি, আমি চিনি, যাবে! কুকুরের উপদ্রবে পড়তে হবে না এও ভেবে পাই না, জোড়া কুকুর দেখলেই মাসি এত খেপে যায় কেন। এক কথা, মার মার। লাঠি পাচ্ছিস না! বলে কোত্থেকে একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে বলত, ঠেঙা। হাত-পা নুলো করে দে। কী রে দাঁড়িয়ে থাকলি কেন!

কামড়াবে মাসি।

দে আমাকে। বলে লাঠি নিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে যেতেন। অধিরথ দাদু দেখলে ছুটে যেত। বলত আবার মাথা খারাপ হয়েছে দেখছি। ইস করছেন কী কুট্টি মাসি। মরে যাবে যে। কুকুরগুলিও বেহায়া আবার ঠিক কুট্টি মাসির জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। একবার এক জোড়া কুকুরের পেছনে তাড়া করতে গিয়ে আমি আর ছোটন দাদু সেই ভূতুড়ে দেশটায় গিয়ে পড়েছিলাম। নদীর পাড়ে শ্মশান, চালাঘর, তার পাশে আঁশশ্যাওড়ার জঙ্গল—নানারকমের ঢিবি। জায়গাটায় গেলেই গা ছমছম করত। কারণ এ-জায়গাটা কোনো রাক্ষসের রাজত্ব মনে হত। আমি, মাতামহ, ছোটন দাদু, কুট্টি মামা এর আগেও দুবার এসেছিলাম জায়গাটায়। ছোটন দাদুর মাথায় হাঁড়ি। কুট্টি মামার কাঁধে কোদাল। মাতামহের কোলে মৃত শিশু। শিশুটি আমার মাসি হতে পারত। ছোটো ছোটো দুটো নীলচে পা কাঁথার ফাঁকে বের হয়ে আছে। আমরা তাকে জঙ্গলে পুঁতে রাখব বলে যাচ্ছিলাম। আমার হাতে কিংবা মাথায় কিছু ছিল না। না গেলেও চলত। ভয়ে আমি কুট্টি মাসির ঘরে পালিয়েছিলাম। বার বার ডাকছেন মাতামহ, দিবানাথ, দিবানাথ! তারপরে তেতে উঠেছিলেন, পুংগির ভাই গেল কোথায়! সাড়া পাচ্ছি না! মাতামহীর শোকার্ত চিৎকারের মধ্যেও তিনি নির্বিকার। পরিহাসচ্ছলে যেকথা বলে থাকেন, আমাকে সেদিন খোঁজাখুঁজির সময় সেই বাক্য উচ্চারণ। মারও ইচ্ছা নয় এমন শবযাত্রায় আমি সঙ্গী হই। তিনি জানতেন, কার ঘরে আমি আশ্রয় নিতে পারি। জেনেও চুপ করেছিলেন। ভয়ডর বলে কথা। অথচ মাতামহের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলারও সাহস রাখেন না।

উঠানে তিনি এবং প্রতিবেশীরা।-অধিরথ দাদু কোদাল নিতে পারতেন, হাঁড়িও। আমাদের কারও যাওয়ারই দরকার পড়ে না। কিন্তু বামুনের মড়া, চুলে জাত যাবে—এবং শুদ্ধাচারী মানুষের বাড়ি বলে সবাই তটস্থ। ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে না যায়। একপাশে আলগাভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ডাকছিলেন, দিবানাথ তোমার সঙ্গে যাওয়া দরকার। প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। তুমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছ। তুমি বুঝতে পারছি আতঙ্কগ্রস্ত। কোথায় পালিয়ে আছ জবাব দাও।

লম্বা বারান্দা পার হয়ে অন্দরমহল। সেখান থেকে আর্ত কান্না ভেসে আসছে, বাবারে কোথায় গেলি রে। আমার কী হবে রে। আমার সোনার চাঁদকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। শোকার্ত মাতামহী বাবা বলে কেন আর্তনাদ করতেন আমার কাছে বিস্ময়। মা বারান্দা ধরে নীচে নেমে বলেছিলেন, দিবানাথের শরীর ভালো নেই বাবা।

সে কোথায়!

কুসুমের ঘরে।

কুট্টি মাসির নাম কুসুম।

ফুলের নামে সবার নাম। কেবল কুট্টি মাসির নাম কুসুম। মা-র নাম নিতে হয়, ছেলেবেলায় এই শিক্ষা পাওয়ার দরুন বুঝি ফুলের সঙ্গে মেয়েদের নামের কোথাও একটা মিল থেকে গেছে। মাতামহীর প্রতিমার মতো মুখ মেয়েরাও পেয়েছে। এত ঘন চুল, আর ছবির মতো ঘরবাড়ি মিলে, বাড়িটা অঙ্গরা।

মাতামহর গলায় গাম্ভীর্য এ ত যে, শেষ পর্যন্ত আর পালিয়ে থাকতে পারিনি। তিনি অধিরথ দাদুকে দিয়ে আমাকে মন্দিরে পাঠালেন। আমাকে উলঙ্গ হয়ে মন্দির থেকে ফুল বেলপাতা তুলে আনতে হবে। ফেরার সময়ও উলঙ্গ। আমার জামা প্যান্ট অধিরথ দাদুর হাতে। তিনি মন্দিরের সামনে গেট খুলে বলেছিলেন, নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়ান। মন্দিরের চারপাশে বিশাল পাঁচিল। মন্দিরটি এক কোনায়। মন্দিরের বাইরে খোলা আকাশের নীচে একটি থান আছে। থানটি তেল সিঁদুরে মাখামাখি। চত্বর বাঁধানো থানের ওপর বাসি ফুল বেলপাতা। মাতামহ মন্দিরের পূজা শেষ করে থানে পূজা দিতেন। মন্দির গর্ভে করালবদনা দেবীমূর্তি। কষ্টি পাথরের। তার রক্ত জিভ লকলক করছে। মাথায় সোনার মুকুট এবং নাকে একটি বৃহৎ নোলক। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। যার যা মানত থানে। মন্দির গর্ভে প্রবেশের অধিকারী আমার মাতামহ এবং তার অনুপস্থিতিতে ব্রাক্ষণদির বিজয় চক্রবর্তী। তিনি সম্পর্কে আমার মেসো হন। বর্ষাকালে মাতামহ শিষ্যবাড়ি ঘুরে বেড়ান। সে এক এলাহি বন্দোবস্ত। ঠাকুর চাকর, দুজন মাঝি এবং একটি পানসি নৌকায় তাঁর বিলাস ভ্রমণ। শীতেও বের হয়ে পড়েন—অর্থাৎ মাতামহীর গর্ভধারণের সময় কাল বুঝে তিনি পর্যটনে বের হতেন।

বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দিরের ঢোকার সদর দরজাটি তালাবন্ধ থাকত। অসময়ে মানত দিতে এলে পাঁচিলের বাইরে থেকে পয়সা ছুঁড়ে দিতে হত থানে। জাগ্রত দেবী বলে কেউ থানের পয়সা তুলে নিতে সাহস পেত না। কেউ কেউ পাঁচিল টপকে জোড়া পাঁঠা ছেড়ে দিয়ে যেত। অধিরথ দাদুর কাজই ছিল পয়সা এবং পাঁঠা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া। মন্দিরে মাতামহ আসতেন দুপুরে। পূজা শেষ করতে বেলা গড়িয়ে যেত। রাতে পঞ্চপ্রদীপ, শঙ্খ এবং ধূপের সমারোহ। ঢাকি ঢাক বাজাত। অঞ্চলের মানুষজন চত্বরে দাঁড়িয়ে দেবী দর্শন করতেন। মাতামহ কেমন অন্য এক গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। চামরের হাওয়ায় দেবীর ফুল বেলপাতা যেন ওড়াউড়ি শুরু করে দিত। মাতামহের সঙ্গে আমি, ছোটন দাদু, কুট্টি মামা একমাত্র প্রবেশের অধিকার পেয়েছিলাম। ধোওয়া জামা প্যান্ট পরার পর চরণামৃত তিনি আমাদের শরীরে ছিটিয়ে দিতেন। ছড়িয়ে দিলেই আমরা পুণ্যবান হয়ে যেতাম। পঞ্চপ্রদীপ জ্বালাতে পারতাম। ধুনুচিতে নারকেলের ছোবড়ায় আগুন দিতে পারতাম। এবং কো-কুশি এগিয়ে দেবারও অনুমতি মিলে যেত।

অধিরথ দাদুর কথামতো পাঁচিলের গেট থেকে নিশ্বাস বন্ধ করে থান থেকে ফুল বেলপাতা তুলে এনেছিলাম। বিশাল এক অরণ্যের ভিতর দিয়ে পথ। বড়ো বড়ো শাল জারুল এবং বট বৃক্ষের ভিতর অরণ্যটি সব সময় ভীতির উদ্রেক করে। একা এই পথ ধরে কখনো নদীর পাড়ে আসতে সাহস পেতাম না। বনজঙ্গলের ভিতর ঢুকে অধিরথ দাদুকে বলেছিলাম, জামা-প্যান্ট দাও। আমার লজ্জা করছে।

অধিরথ দাদু হেসে বলেছিলেন, এতটুকুন ছেলের কিসের লজ্জা!

বোঝাই কী করে নির্জন মন্দিরের সামনে উলঙ্গ হয়ে ফুল বেলপাতা তুলে আনা একরকমের, আর বাড়ির ভিতর উলঙ্গ হয়ে ঢাকা অন্য রকমের। মা মাসির, গাঁয়ের অন্য নাবালিকার ভিড়ের মধ্যে উলঙ্গ থাকতে কার না লজ্জা হয়! অধিরথ দাদু মুচকি হাসছিলেন।

সবচেয়ে ভয় কুট্টি মাসিকে। আমাকে উলঙ্গ দেখলেই গোপনে শাসাবে, তুই কি মানুষ! না পাঁঠা। আমি মুখ ব্যাজার করে ফেললে ঠিক বলবে, আসলে তুই অপদেবতা। ওঝা বদ্যির বশ। তোর কী দোষ!

কুট্টি মাসি আমার সুখদুঃখ টের পায় খুব। কারণ মামাবাড়ি গেলে, কুটি মাসির অজস্র ফুটফরমাস খাটতে হত।

এই সেমিজটা দে।

খালি গা। সুপরি ওঠার মতো স্তন। আমার কোনো বিকার সৃষ্টি হয়নি। সেবারে মাতামহীর সূতিকা গৃহে সাঁঝ লাগার সঙ্গে মা স্নান সেরে ঢুকে যেত। ঢুকে যাবার আগে দরজার সামনে একটি অগ্নিকুণ্ড সৃষ্টি করা হত। মাতামহ অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে বটুক ভৈরব স্তোত্র পাঠ করতেন। মা সূতিকা গৃহে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিতেন। ভিতরেও থাকত একটি অগ্নিকুণ্ড। দিবানিশি গাছের গুঁড়ি পুড়ছে। সকালে মাতামহী কালোজিরে বাটা আর ঘি দিয়ে অগ্নিকুণ্ডের দিকে পিঠ রেখে খেতে বসতেন। কোনায় ছেড়া কাপড়ের মধ্যে মাংসের ডেলার মতো পড়ে আছে শিশুটি। হাত পা নাড়ছে, কখনো গগন ফাটিয়ে আর্তনাদ। মাতামহী সঙ্গে সঙ্গে বুকে তুলে বিশাল স্তনে সন্তানের মুখ ঠেসে ধরতেন। মা সূতিকা গৃহে ঢুকে গেলে আমি একা। কুট্টি মাসি তখন আমার সব। আমার সঙ্গী। এক সঙ্গে খাওয়া, এক সঙ্গে ঘাটলায় গিয়ে বসে থাকা, গাছ থেকে চাঁপা ফুল পেড়ে আনা—সব। এবং শোওয়ার সময় তার পালঙ্কে আর একটা বালিশ রেখে বলত, কীরে ভয় পাবি না তো! ভয় কী। তোর মা নেই, আমি তো আছি। তখন আমার মনেই হত না কুট্টি মাসি আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড়। এমনকী পড়াশোনার কথাও বলতেন। অঙ্কগুলো করেছিস। তোর ছটির পড়া কখন করবি? টেবিলে সেজবাতি জ্বালিয়ে আমার পাঠ্য বই-এর সামনে ঝুঁকে বসতেন। আমি গেলে, মা গেলে যে কোনো কারণেই হোক কিছুটা স্বাভাবিক থাকতেন। বাড়ির আমসত্ত্ব, নাড়, সন্দেশ আমাকে চুরি করে খাওয়াতে ভালোভাসতেন। এ-জন্য হতে পারে, কিংবা কুট্টি মাসির শরীরের কোনো হেতু থেকেও হতে পারে। আমি প্রায় তাঁর কাছ ছাড়া হতাম না।

আমাদের সাঁকোর খেলাটা সে-জন্যই এত প্রিয় ছিল। মাতামহ বাড়ি থাকলে কুট্টি মাসি, বনজঙ্গল পার হয়ে নদীর পাড়ে চলে আসতে পারত। আমার সঙ্গে কটি মাসি থাকলে স্বাভাবিক থাকবে এই ধারণা থেকেও বিধিনিষেধের বেড়া কিছুটা আলগা করে দিতেন মাতামহ। অসূর্যম্পশ্যা নারী। শাড়ি পরার সঙ্গে এ গৃহে নারীরা অসূর্যম্পশ্যা হয়ে যায়। বুকে সুপারির মতো স্তন ওঠার সঙ্গে শাড়ির ছিল গভীর সম্পর্ক। ফ্রক পর নিষেধ। সতর্ক নজর মাতামহের। মাতামহী কিছুটা আলগা স্বভাবের। তার পানের ডাবর এবং সুপারি কাটার জাতি সামনে থাকলে তিনি স্থিরচিত্ত থাকতেন। রান্নাবাড়ি সামলাবার দায় একজন ঠাকুরের। সেই মাতামহীর লিস্টি মতো জলখাবার থেকে ভোজনের ব্যবস্থা করে থাকে। ঘরের ভিতর বিশাল পালঙ্ক। খাটের পায়াগুলি সিংহের থাবা যেন। এক পাশে কাঠের একটা বিশাল সিন্দুক। দেড় মানুষ উঁচু সিন্দুকটির কপালে অজস্র সিঁদুরের ফোঁটা। একটা কড়াতে মালি সোলার এক জোড়া কদম ফুল। প্রশস্ত ঘরের জানালা এত ছোটো যে বাইরের আলো ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারত না। আমাদের যখন তখন ঢোকা ছিল বারণ।

আমি সেবারে হাতে বাসি ফুল বেলপাতা নিয়ে বাড়ি ঢুকতে সংকোচ বোধ করছিলাম। অথচ তার আগের বার ঘাটলায় গেলেই জামা প্যান্ট খুলে দিঘিতে সাঁতার কাটার নেশা ছিল। কিন্তু সেবারে আমি রাজি না।

অধিরথ দাদু বলেছিলেন, আপনার কী হয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকলেন!

আমার কী হয়েছে বোঝাই কী করে! আমার লজ্জা করে বলার পরও যদি তিনি জোর খাটান আমি যাই কোথায়!

অবশ্য আমি জানি এই নিয়ম।

এর আগের বার কুট্টি মামার ওপর ভার পড়েছিল। কুট্টি মামা সহজেই থানের আশীর্বাদী ফুল বেলপাতা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় হাজির হয়েছিলেন। আমার পালার সময়, পারছি না। কুট্টি মামা পারলেন, আমি পারছি না। কিংবা সেবারে কুট্টি মামাকে না পাঠিয়ে আমাকে কেন পাঠানো হল আশীর্বাদী ফুল বেলপাতা আনতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

অধিরথ দাদু আমার গোঁ দেখে বিপাকে পড়ে গেছিলেন। ওদিকে মাতামহ অপেক্ষা করছেন জানি।

অধিরথ দাদুর ওপর বিরক্ত হতে পারেন। সেই ভয়েই হয়তো বলেছিলেন, দাঁড়িয়ে থাকবেন না ঠাকুর। দেরি হয়ে যাচ্ছে। কর্তার মাথা গরম হলে কী হয় জানেন। তিনি কাউকে আস্ত রাখেন না। অধিরথ দাদু আলগা দাঁড়িয়ে আছেন। পাঁঠাবলির সময় তাকে নিষ্ঠুর মনে হয়। রক্তচক্ষু হয়ে যায়। আমার ওপর বোধ হয় সে-ভাবে হম্বি-তম্বি করারও অধিকার নেই। তবে টের পাচ্ছিলাম, চোখ নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে উঠছে। হাতে রামদা থাকলে এই গভীর বনজঙ্গলে দেবীর নামে উৎসর্গ করে দিতে পারেন। আতঙ্কে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। অভিযোগ, আমাকে কেন! কুট্টি মামা এল না কেন।

কুট্টি মামা বড়ো হয়ে গেছে না!

বড়ো হয়ে গেছে তো কী হয়েছে!

উপনয়ন হয়ে গেছে ঠাকুরের। তিনি পারবেন কেন!

ইস কুট্টি মাসির সামনে পড়লেও রক্ষা থাকবে না। মাতামহের অনুপস্থিতিতে আমাকে বিড়াল কুকুরের মতো তাড়া করবেন। কী কারণে একবার প্যান্ট ছাড়ার সময় উলঙ্গ হয়েছিলাম—কুট্টি মাসির সে কী ক্ষোভ।-কুকুর! কুকুর কোথাকার। আমি তাড়াতাড়ি প্যান্ট পরে ফেললে মাসি আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন।

চুমু খেয়েছিলেন কপালে। তারপর আমাকে নিয়ে দৌড়ে নদীর পাড়ে এসে সাঁকো পারপারের খেলা শুরু করে দিয়েছিলেন।

শিশুটিকে নির্জন ঝোপ জঙ্গলে পুঁতে দেবার আগে এই আশীর্বাদী ফুল বেলপাতা দরকার।

দরকার নতুন হাঁড়ি পাতিলের।

দরকার পঞ্চ শস্যের।

মন্ত্রপূত জবাফুল দেওয়া হয় হাঁড়িতে।

অপদেবতার ছড়াছড়ি। পর পর শিশুমৃত্যু। পেঁচোয় পাওয়া যাবে বলে। প্রাথমিক কর্তব্য শিশুটিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া। যতক্ষণ থাকবে মাতামহী পাগলের মতো প্রলাপ বকবে। এবং তার চিল কান্না গগনভেদী তীর্যক বজ্রপাতের মতো। সারা বাড়িতে অস্বাভাবিক আচরণ চলছে। কুট্টি মাসির এ-সময় ফিটের ব্যামো দেখা দেয়। গর্ভসঞ্চারের পর থেকেই কুট্টি মাসি কেন খেপে যায়, আর ক্রমে এই খেপে যাওয়া অস্থিরতায় ডুবে গেলে, কুট্টি মাসির দাঁত লেগে যায়। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

বাড়ি থেকে মৃত শিশুটি নিক্রান্ত হলে সবাই চুপ মেরে যায়। গৃহে কেউ বসবাস করে মনে হয় না। কুট্টি মাসি কেমন আছে কে জানে! সুন্দর সরল চোখ এই মৃত্যু পর্বে হিংস্র হয়ে ওঠে। হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে ফেলে। বাড়িতে ভাঙচুরের পর্বটিও শুরু হয়। মাতামহ জানেন, শিশুটিকে মাটি না দেওয়া পর্যন্ত বাড়ির অস্বস্তি কাটবে না। সে-জন্যও অধিরথ দাদু অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। আমাকে একা ফেলে কবর দিতে যেতে পারছেন না। গিয়ে বলতে পারছেন না, ঠাকুরের পোঁ, ন্যাংটা হয়ে বাড়ি ফিরবে না।

তারপরই রুদ্রমূর্তি।

ঠাকুর ভাবছটা কী! হাঁটো। না হাঁটলে ঠাং ভেঙে দেব।

বুঝতে পারি ক্রোধ সীমাহীন। আর উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কড়া ভাষা ব্যবহারের রীতি শুরু হয়ে গেছে। আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। ভয় প্রদর্শন করছে। জানো ইচ্ছে করলে তোমাকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে যেতে পারি! জানো ইচ্ছে করলে তোমাকে নদীর জলে চুবিয়ে মারতে পারি। এক কোপে দু-খান করে দিতে পারি। আমি পারি না হেন কাজ নেই। হাঁটো!

অগত্যা আর কী করা। আমার কান্না পাচ্ছিল। ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। এক হাতে ফুল বেলপাতা, অন্য হাতে চোখের জল মুছছি। লজ্জায় কান্না পায় সেই প্রথম টের পেয়েছিলাম। তারপর মনে হয়েছিল যেন, ঠিক লজ্জা না, আমাকে উলঙ্গ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। ক্ষোভ হতেই পারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ কে সহ্য করে! ক্ষোভবশত কান্নার উদ্রেক। জামা-প্যান্ট পরে গেলে অশুচি ভাববেন মাতামহ। অশুচি অবস্থায় থান থেকে ফুল বেলপাতা সংগ্রহ করা বিধর্মীর লক্ষণ। অধিরথ দাদুর ওপর ক্রোধে আচ্ছন্ন হলে তাঁরও রক্ষা থাকবে না। অধিরথ দাদু আমার পেছনে।

কারণ কে জানে কখন কোন ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ব। ডেকে সাড়া পাওয়া যাবে না। বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড। যতক্ষণ না শিশুটির সদগতি হচ্ছে, বাড়িটা নরক হয়ে থাকবে।

ছোটাছুটি। জল জল। হাওয়া কর। তামার পয়সা আন। দাঁত লেগে গেছে কুসুমের। লবঙ্গ পোড়াও চোখে জলের ঝাপটা দাও। যতক্ষণ না ফুল বেলপাতা নিয়ে যাব, কুট্টি মাসি বিসর্জনের প্রতিমা হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকবেন।

বোধহয় সেই কষ্টদায়ক অনুভূতিও আমাকে সেবারে তাড়া করে থাকতে পারে। আমি বেশ পা চালিয়ে বাড়ির কাছে হেঁটে এসেছিলাম। তারপর দৌড়ে বাড়ি ঢুকে পলকে হাঁড়ির ভিতর ফুল বেলপাতা রেখে ঘরের ভিতর অদৃশ্য। জামা-প্যান্ট পরে নিষ্ক্রান্ত হলে, মাতামহ বলেছিলেন, অনুসরণ করো।

মা কোত্থেকে ছুটে এসে পাগলের মতো ডাকতে থাকলেন, দিবানাথ, বাবা দিবানাথ একটু দাঁড়া বাবা।

আমি দাঁড়ালে কোমরের ঘুনসিতে হাত দিয়ে কী যেন খুঁজলেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, যাও।

এতটা নিশ্চিন্ত হবার কারণ, আমি আবার কোনো অশুভ আত্মার প্রভাবে না পড়ে যাই। অশুভ আত্মার প্রকোপ বাড়িটার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে—বিশেষ করে সেই নির্জন নদীতীরের পরিত্যক্ত ছাড়াবাড়িতে শিশুদের সদগতির আশ্রয়টি যে মোটেই নিরাপদ নয়, মা বিশ্বাস করতেন। আমার ঘুনসিতে তিনি কী খুঁজছিলেন। তাও জানি। জালের কাঠি ঘুনসিতে বাঁধা থাকলে অশুভ আত্মার নজর লাগে না এমন বিশ্বাস তাঁর প্রবল। আমার ঘুনসিতে একটা জালের কাঠি, ফুটো তামার পয়সা আর রুদ্রাক্ষ গাঁথা আছে। ঘুনসি ছিঁড়ে গেলে এটা ওটা হারায়। মা আবার যত্নের সঙ্গে ঘুনসিতে তা জড়িয়ে দেন। আমার অনুসরণের পালার সময় মা-র হয়তো মনে হতে পারে প্যান্টের সঙ্গে ঘুনসিটাও খুলে গেছে। আপদের তো শেষ নেই।

বাড়ি থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেই বনজঙ্গল। সরু রাস্তা হাটে যাবার। হাট পার হয়ে ক্রোশ খানেক গেলে শ্মশান এবং নদীর চড়া। চড়াটা বর্ষায় ডুবে গেলে পাশের ছাড়াবাড়ি সম্বল। হেমন্তের সময় ছিল। সেটা। গাছপালার ভিতর দিয়ে সবার আগে মাতামহ, পেছনে আমরা। একেবারে শেষে অধিরথ দাদু। চড়ার মাটি তুলে হাড়িটা বসিয়ে দেওয়া হল। কাঁথা কাপড়ের মধ্যে মাতামহের পক্ষকালের জাতক। গত তিন চারদিনই বাড়ির কারও ঘুম ছিল না। শিশুটির মধ্যে ভূতুড়ে কান্নার লক্ষণ প্রকাশ পেতেই ওঝা গুনিন সব ছুটে এসেছে। কিম্ভুতকিমাকার পোশাক। নখ, বড়ো বড়ো দাঁত বের হয়ে আছে। ঝোলায় ঝাঁটা থেকে কুরুণ্ডি গাছের মূল। হোমিওপ্যাথ ডক্তারও ঘুরে গেছেন সাইকেলে—যেখানে যত ওঝা বদ্যি আছে সবার কাছে খবর চলে গেছিল। দিঘির পাড় ধরে উঠে আসছিল।

কে আসে?

গুনধর ওঝা আসে।

কে আসে?

নিকু গুনিন আসে।

খবর যায় অন্দরমহলে। আমরা সন্ত্রস্ত দিনরাত। কুট্টি মাসির নাওয়া খাওয়া। বন্ধ। অরাজক অবস্থা।

জাতকের খিচুনি ধরে গেছে। হাত পা ছুঁড়ছে। দাপাচ্ছে। বুকের দুধ মুখে দিচ্ছে। দিন রাত মা পায়ের ওপর রেখে, কখনো বুকে রসুন তেল মেখে দিচ্ছে। হাত মুঠো করে পৃথিবী বিদীর্ণ চিৎকারে যখন সারা বাড়ি তটস্থ মাতামহ তখনও নির্বিকার। তার পূজা আর্চা হোমের কোনো খামতি নেই। মন্দিরে আরতি হচ্ছে— পঞ্চপ্রদীপ জ্বলছে। ধূপদীপের গন্ধ এবং জোড়া পাঁঠাবলি। মৃত্যু শেষ কথা নয়। ডুব মাত্র অশৌচ। নদীর ঘাটে ডুব দিয়ে ফিরে এলে, বাড়িটা আবার ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠত। মাতামহীর শোক থাকত সপ্তাহকাল। তারপর তিনি ধীরে ধীরে উঠে বসতেন, খেতেন। খোঁজখবর নিতেন সবার। তারপর দেখতাম পায়ে আলতা পরে পাট ভাঙা শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছেন। মুখে পাউডার মাখছেন। সুঘ্রাণ উঠছে শরীরে।

চুল উঠে যাচ্ছে গোছা গোছা।

মাতামহীর মুখে চোখে উদ্বেগ।

ডাকতেন, চাঁপা, চাঁপা!

মা কাছে গেলে চিরুনি থেকে চুল গোছ করে তুলে আনতেন। দলা পাকাতেন। তারপর মাকে দেখাতেন।

আমার সব চুল উঠে যাচ্ছে!

মা বলত, কত চুল তোমার মা।

চুল আর আছে! সব যে উঠে গেল! কী হবে!

মাতামহী চুলের গোলাটায় থুতু ছিটিয়ে জানালার বাইরে নিক্ষেপ করার সময় মাতামহর খোঁজ নিতেন।

আমি ঠিক বুঝতাম না, কেন এই খোঁজ।

তারপরই বৈঠকখানা দেখতাম খালি হয়ে যেত রাত দশটা না বাজতেই। বৈঠকখানার পালঙ্কে বিছানা হত না। মাতামহ অন্দরে শোবেন ঠিক হয়ে যেত।

কুট্টি মাসি দরজায় দাঁড়িয়ে বলত, দিদিকে ডাকল কেন রে!

দিমিমার চুল উঠে যাচ্ছে।

বাবা কোথায়?

জানি না তো!

রাত দশটায় কুটি মাসি আমাকে দাদুর বৈঠকখানা দেখে আসতে বলতেন।

আমি দৌড়ে অন্দরের উঠোন পার হয়ে দরদালানের বাইরে চলে আসতাম। একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে রাখা হয় বারান্দায়। বৈঠকখানায় মাতামহের শুতে শুতে রাত বারোটা—সেদিন দেখি, বৈঠকখানায় দরজা জানালা দশটা বাজতেই বন্ধ হয়ে গেছে। কেমন নিঝুম পরিবেশ। ছাদের মাথায় জাম গাছের একটা বড়ো ডাল জ্যোৎস্নায় শুধু জেগে আছে। ভয়ে গা সিরসির করে উঠলে দৌড়ে পালাতাম। আর আশ্চর্য কুট্টি মাসিকে খবরটা দিতেই বলত, যা তোর মার সঙ্গে গিয়ে শুয়ে থাক। বলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিত। কেন যে আমার দিকে তাকাতেই তখন চোখে জ্বালা ফুটে উঠত জানি না।

মাকে গিয়ে বলতাম, মা কুট্টি মাসি দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কোথায় শোব?

আসলে মামাবাড়িতে গেলে আমরা কোথায় কে শোব ঠিক করে দিতেন মা। কুট্টি মাসির আবদার রক্ষার্থেই আমি, আন্না মাসি, কুট্টি মাসি এক পালঙ্কে শুতাম। এতে কুট্টি মাসির মধ্যে বেশ স্বাভাবিক স্বভাব ফুটে উঠত। আমরা বিকালে কোনোদিন এককা দোককা খেলতাম। কিংবা পাশান্তি। অধিরথ দাদুর পঙ্গপালও আমাদের সঙ্গে তখন জুটে যেত। কখনো গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছি। কুট্টি মাসি ঝোপ জঙ্গলের নড়ানড়ি দেখে টের পেত কে কোথায় আছে। সেই কুট্টি মাসির অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ক্ষোভ হত—বলতাম, আর কোনোদিন শোব না। দরজা বন্ধ করে দিলে কেন! কুট্টি মাসি আমার দিকে অপলক তাকিয়ে বলত, সোনা আমার। রাগ হয়েছে। রাগ কার ওপর এত। তোরা তো কুকুর বেড়ালের অধম।

আমি এসে মাকে নালিশ দিতাম।

মা বলতেন, বলুক গে! ওর কি মাথার ঠিক আছে। ওর কথা ধরিস না।

সেবারে কেন যে মাকে সহসা প্রশ্ন করেছিলাম, জানো মা দাদুর বৈঠকখানায় কেউ নেই। দাদু কোথা। দরজা জানালা বন্ধ।

অন্দরে।

অন্দরে কোথায় মা?

তিনি এতে অস্বস্তি বোধ করতেন। বলতেন, রাত হয়েছে শুয়ে পড়। বকবকানি আর ভালো লাগছে না।

আমিও নাছোড়বান্দা দাদুর শোওয়া বসার বিষয়টিতে যেন কোনো পারিবারিক মর্যাদা জড়িত থাকত। দাদুর কাজকামে আমার অশেষ কৌতূহল। সেই দাদুর অন্তর্ধান আমার কাছে বিস্ময় ছিল। মাতামহীর মহলে মাতামহকে আমি খুব কমই দেখেছি। কিংবা কোনো কারণে মাতামহীর পরামর্শ দরকার হলেও তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিতেন। ঘরে ঢুকতেন না। সেই মাতামহ বৈঠকখানায় নেই, বৈঠকখানায় থাকলে জানালা খোলা থাকত। একটা সেজবাতি জ্বলত। না কিছু ছিল

বলতাম, জানো মা বৈঠকখানার সব দরজা জানালা বন্ধ। সেজবাতি জ্বলছে না। বারান্দায় অধিরথ দাদু শোয়, সেও নেই।

মা না পেরে বলত, তোমার দাদুর শরীর খারাপ। ভিতর বাড়িতে তিনি শুতে গেছেন। ভিতর বাড়িতে! কোথায়।

ইস তুই এত জ্বালাস। তুই কী রে। দাদুর বয়স হয়েছে না। শরীর খারাপ হতে পারে না। একা মানুসটা বৈঠকখানায় পড়ে থাকবে! দেখে কে! তুই ঘুমাবি, না বকবক করবি।

বুঝতাম, মা মাতামহর প্রসঙ্গ নিয়ে একদম কথা বলতে চান না আর। চুপ মেরে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তাম। কুট্টি মাসির পাশে শুলে হুটোপাটির শেষ থাকত না। এ ওর চাদর টেনে, বালিশ টেনে কাড়াকাড়ি শুরু হত। জানালার দিকে কেউ ভয়ে শুতে চাইত না। কারণ জানালা দিয়ে গাছপালার ফাঁকে দূরের হাটবাজার দেখা যায়, আর ক্রোশ খানেক গেলে শ্মশান দক্ষিণের বাতাসে মরা পোড়ার গন্ধ পর্যন্ত কখনো ভেসে আসত। রাত হলেই ঝোপ জঙ্গলে জোনাকি জ্বলত, শেয়াল ডাকত বড়ো জঙ্গলে, শ্মশান থেকে যে সব মৃত আত্মারা ভেসে আসত তারা সহজেই জানালা গলিয়ে হাত বাড়াতে পারে। এমন আতঙ্কে আমরা সবাই কাবু। কুট্টি মাসি জানালার পাশে শুত—যেন তার ভয়ডর কম। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙলে দেখতাম, জানালার পাশে আমি। খেপে যেতাম। ঠিক ঘুমের ঘোরে কুট্টি মাসি আন্না মাসি আমাকে চ্যাংদোলা করে জানালার পাশে এন ফেলে রেখেছে! খেপে গেলে কুট্টি মাসি বলত, তোর যা শোওয়া, কখন কাকে লাথি মারিস ঘুমের ঘোরে। কখন কাকে টপকে যাস ঘুমের ঘোরে—আর যত দোষ আমার!

বিশ্বাসও করতে পারতাম না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারতাম না। আমার শোওয়া ভালো না, মা বলতেন। খাটের এক পাশে শুলে শেষ রাতে আর এক পাশে গিয়ে পড়ে থাকি। মশারির ফাঁকে ঠ্যাং ঝুলে থাকে। মা নাকি ঠ্যাং তুলে দেয়। ঘুমের ঘোরে লাথি ছুঁড়ে মারি, কত যে অভিযোগ!

অথচ পরদিন সকালে ঘরে শুয়েই শুনতে পাই মাতামহ ভরাট গলায় স্তোত্র পাঠ করছেন। তাঁর ক’ উদাত্ত। ভোর রাতের দিকে শুকতারাটি জ্বলজ্বল করছে। খড়মের খটাস খটাস শব্দ উঠছে। স্তোত্রপাঠ, নীল আকাশের শুকতারা, এবং গাছপালা পাখির ওড়াউড়ি মিলে বাড়িটায় অন্য একটি গ্রহ তৈরি হত।

কে বলবে মাস খানেকও হয়নি, এ-বাড়িতে একটি শিশুমৃত্যু হয়েছে। তার কথা কেউ আর মুখে উচ্চারণই করে না। অথচ বীভৎস দৃশটি ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাঁড়ির মুখে ঢুকছে না। মাতামহ মট মট করে শিশুটির হাত পা ভেঙে দিতেন। ঘার মটকে দিতেন। তারপর ভিতরে ঢুকিয়ে মালসায় ঢেকে হাঁড়িটি গর্তে রাখতেন। মাটি চাপা দিতেন। তাঁর বোধ হয় অভ্যাস হয়ে গেছিল। বিষয়টি তাঁর কাছে মন্দিরে জোড়া পাঁঠা বলি দেবার চেয়ে বোধ হয় বেশি গুরুত্ব পেত না। নদীর ঘাটে এসে স্নান পর্ব সারা হত। বটুক ভৈরবের স্তোত্র পাঠ হত। আমরা ফিরতাম। মনে হত সেই শিশুটি হাঁড়ির ভিতর ঘুমিয়ে আছে। কিংবা তার দু-বাহু খুঁজছে হাঁড়ির ঢাকনা খুলে আবার পৃথিবীর গাছপালার ভিতর শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া যায় কিন না।

সব চেয়ে আতঙ্কে পড়ে যেতাম কুট্টিমাসির ডাকে।

 আমায় ডাকতেন, দিবানাথ, দিবানাথ।

আমি সাড়া দিলে বলতেন, এদিকে শোন।

ঘরে গেলে বলতেন, বাবা কোথায় জানিস?

মাতামহ বিকালে সেদিন বাড়ি ছিলেন না। কার্য উপলক্ষে দু-ক্রোশ দূরে দুপতারার হাইস্কুলে গেছেন। স্কুলের নির্বাচন। তিনি একজন প্রার্থী। তিনি বলতে গেলে অঞ্চলের সব। ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতি। বাড়িতে বৈঠকখানার পাশে। একটি অস্থায়ী টিনের ঘরে নীল বাক্স। ডাকঘরটির মাথায় জালালি কবুতর। সামনে বড়ো বড়ো অর্জুন গাছ—এবং মানুষজনের চলাচল। কর্মব্যস্ত মানুষটির সঙ্গে দু-জন সঙ্গী থাকত সব সময়। তারা যখন নেই, তিনিও বাড়ি নেই। খবরটা মাসিকে দিতেই বলেছিল, চল। দেখে আসি।

কী দেখে আসবে!

মাসির তখন কী তাড়া! প্রায় গোপনে জঙ্গলের রাস্তা ধরে ছুটে যেতেন। তার চুল উড়ত। শাড়ির আঁচিল উড়ত। কারণ সাঁঝ লাগার আগে ফিরতে হযে। আশ্চর্য মাসির সঙ্গে গেলে আমরা আর সেই শিশুটিকে খুঁজে পেতাম না। গর্ত খালি। হাঁড়ি ভাঙা। মালসা দূরে পড়ে আছে। শিশুটির কোনো চিহ্ন নেই। দেখতে পেতাম সামান্য দুরে দুটো কুকুর হিজ মাস্টারস ভয়েস হয়ে বসে আছে। ঠোঁট চাটছে।

গেল কোথায়?

মাসি বলত, দেবদূত হয়ে উড়ে গেছে। আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগত। কুকুর দুটির পাশ দিয়ে হেঁটে আসতাম। মাসি তাকিয়েও দেখত না। মাসির চোখে জল চিক চিক করত।

এবারে আমরা আবার যাচ্ছি।

সেই গর্ভধারিণীর গর্ভধারণের খবর।

শরতকাল। ডুলিতে মা, আমি আর বাহার চাচা পেছনে। খাল পাড় হয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু আখের জমি। সড়ক ধরে কিছুটা গেলেই আখের জমিতে হারিয়ে যেতে হয়। রাস্তার জ্ঞানগম্যি না থাকলে, সারাদিন আখের জমিতে ঘুরেও বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বড়ো হয়ে যাওয়ায় এবং সঙ্গে বাহার চাচা থাকায় ভয়ডর কম। একই দৃশ্য দেখতে হবে জানি। আমার উপনয়ন হয়ে গেছে। এবারে আর মন্দিরের থান থেকে ফুল বেলপাতা নিয়ে আসার ভার আমার ওপর পড়বে না। কুট্টি মাসিকে দেখার আগ্রহ এবং সাঁকো পারাপারের খেলা আমাকে অধীর করে তুলছিল।

সাঁঝ লেগে গেছিল। কারণ বেহারা চারজন আখের জমিতে পড়ে দিক নির্ণয় করতে পারছিল না। মাঝে মাঝে হাঁকছিল, কই হ! আখের জমির ভিতর চারজন বেহারা আর ডুলিতে আমার মা। মাঠের বিশাল নিমগাছটার নীচে অপেক্ষা করার কথা। আমরা গেলে যাত্রা করার কথা। কিন্তু গিয়ে অবাক, কেউ নেই। ফাঁকা মাঠে একটা গাছ। কিছু বক এবং হরিয়াল পাখি বসে আছে। ভয়ে আমার মুখ চুন হয়ে গেছিল। বাহার চাচা বললেন, তাজ্জব বাত। কিছু করারও নেই। কারণ চারপাশে শুধু আখের জমি দিগন্ত প্রসারিত। সবুজ এবং কখনো ঘন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে আছে মাঠ। বাহার চাচা নিমগাছের মগডালে উঠে গেলেন। দূরে কী দেখতে পেয়ে কিংবা এস্ত গলা শুনতে পেয়ে হেঁকে উঠলেন–হই হই শব্দটা টেনে এত লম্বা করে বলেছিলেন যে মনে হয়েছিল দূরে আখের খেতে ঝড় উঠে গেছে। খস খস শব্দ। মটমট শব্দ। আখ গাছ ভেঙে কেটে হু হুমনা করে এগিয়ে আসছে কারা।

আসলে দূর থেকে নিমগাছের মাথা দেখা যেতেই পারে কিংবা বাহার চাচার সেই স্ফীত গলায় চিৎকার তাদের কর্ণগোচর হতে পারে। ফাঁকা মাঠে শব্দের সমারোহ প্রবল হয়—দূরের শব্দভেদী বাণ শ্রুতিগোচর হতেই তারা দিক নির্ণয় করে থাকতে পারে। এগিয়ে এলে দূরে আখ জমির উপরে নিমগাছটি দৃষ্টিগোচর হতে পারে—সে যে কারণেই হোক দু-মানুষ লম্বা আখের জমি থেকে ডুলি নিয়ে নিষ্ক্রান্ত হতে পারায় গলদঘর্ম বাহার চাচা স্বস্তি বোধ করেছিলেন। আমার শুকনো মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আমরা আবার যাত্রা করি।

বেশ রাত হয়ে গেছে। দিঘির পাড়ে হ্যাজাক নিয়ে প্রতীক্ষায় অধিরথ দাদু। দুর্ভাবনা তাদেরও ছিল—রাস্তার কোনো দৈব দুর্বিপাকের শিকারের ভয় তো আছেই। আর এই সব দুশ্চিন্তার মধ্যে মা ডুলি থেকে নেমেই মাতামহীর ঘরে ছুটেছিলেন।

মাতামহী পা ছড়িয়ে বসে আছেন। আমি প্রণাম করতে গেলে রে রে করে উঠলেন তিনি। এসময় প্রণাম নিতে নেই। কুট্টি মাসিকে দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। এ-সময় তিনি ঘরের বারই হন না। মা আসায় সবদিক সামলাতে পারবে—মাতামহী কিছুটা নিশ্চিন্ত। কে দেখে!

আমি কুট্টি মাসির মহলে যেতেই দেখলাম বেশ বড়ো হয়ে গেছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এল না। প্রণাম করতে গেলে বলল থাক হয়েছে। শোন, তুই এসেছিস ভালো হয়েছে। আমি তো ভাবলাম, তুই এবারে আসবি না। কী যে ভালো লাগছে। তোর তো উপনয়ন হয়ে গেছে।

উপনয়ন হয়ে গেলে কি মানুষের দ্বিতীয় জন্ম শুরু হয়। জানি না। তবে খাওয়া-দাওয়ার পর, দেখি আমার শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে ছোটন দাদুর ঘরে। পালঙ্কটা ছোটো। দু-জন শুতে পারে। তবু আপাতত রাতের মতো এই ব্যবস্থাই থাকল। …..শীতকাল, জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকলে ওম বেশি। রাতটা সেভাবেই কাটল। এখন কটা দিন আবার বাড়িতে আগের পরিস্থিতি। এবারে মাতামহীর মাঝে মাঝে ফিট হচ্ছে। দিন যত এগিয়ে আসতে থাকল, মাতামহীকে নিয়ে টানাপোড়েন বাড়ছে। এক দিন মা কিঞ্চিৎ রুষ্ট গলায় চেঁচামেচি করতেই ছুটে গেছিলাম। আড়ালে দাঁড়িয়ে যা শুনলাম স্তম্ভিত।

মানুষটার কী দোষ বল। রাগ করিস কেন বুঝি না।

তাই বলে…মা কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছিল।

মা আবার বলছিল, আমি জানতাম।

মাতামহী বলছিল, আমি তো চেষ্টা করছি সামলাবার।

মার গলা–বাবার চিঠি পেলে অস্থির হয়ে পড়তাম। শেষমেশ কী যে কপালে লেখা আছে। আর বলি নবীন ভট্টাচার্যের আক্কেল নেই। ঘোরাঘুরি করছে!

তোর বাবার খুব পছন্দ।

মরণ!

মার এই মরণ কথাটি যে ঘৃণা বিদ্বেষ থেকে প্রসূত টের পেতে কষ্ট হল না।

মরণ বলছিস কেন! তার শরীর বলে কথা। তাকে দোষ দিচ্ছিস কেন। আর ঠিক এ-সময়ে বনজঙ্গল পার হয়ে ঢাকের বাদ্য শুরু হয়ে গেল। সেখানে দেবীর আরতি হচ্ছে। ধূপ দীপ জ্বলছে। মাতামহ গদগদচিত্তে মাতৃ আরাধনায় মত্ত। আর কিছু শুনতে পেলাম না।

সব আমার কাছে স্পষ্ট না হলেও ঘোর বিপত্তি দেখা দিয়েছে পরিবারে বুঝতে পারি। এই আশঙ্কা হয়তো মা আরও আগেই টের পেয়েছিলেন। গুরু বংশের দোষ। চিঠি পেলেই সব আশঙ্কা প্রবল হত। মাতামহী আর পারছেন না তবু চেষ্টা যদি ধরে রাখা যায়।

আর তখনই দেখি আমার ঘাড়ে কার নিশ্বাস পড়ছে। অন্ধকারে কে? মুখ ঘুরিয়ে ছায়া মতো যাকে দেখলাম—তিনি কুট্টি মাসি। অন্ধকারেও চোখ জ্বলছে টের পেলাম।

আমি বললাম, তুমি!

এই প্রথম আমার হাত টেনে মাসি নিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর হতাশ গলায় বলল, কী বুঝলি!

আমি তো স্পষ্ট কিছু জানি না। জানি না বললে ভুল হবে যেন সবই বুঝি। তবু কেন যে বললাম, বুঝতে পারছি না।

তুই একটা ম্যাড়া।

আর কী বলি! ঘর থেকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল।

তারপর ক-দিন আমরা সেই লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়ে গেলাম। বিকালে সাঁকো পারাপারের খেলা। এবারের খেলা জমে উঠল এই কারণে, সবাই আমরা বাঁশ না ধরেই নদী পারাপার করতে পারছি। মাসি একটু দ্রুত পারে। প্রায় দৌড়ে পার হয়ে যায়। তার আঁচল বাতাসে ওড়ে বলে কোনো ব্যালেন্স খুঁজে পায় আঁচল ওড়ার মধ্যে। আমাদের তা নেই—এখনও সতর্ক পা ফেলে পার হতে হয়। আঁচল উড়লে, খসে পড়লে মাসির স্তন দেখে কখনো মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। মাসি আঁচল সামলে নেমে আসে সাঁকো থেকে। আমার দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ হানে।

সেদিন আমরা বাড়ি ফিরছি। প্রচণ্ড ঠান্ডা। শীতে নদীতে স্নান করে হি হি করে কাঁপছি। ক-দিন ধরে সুতিকা গৃহটি পবিত্র করার কাজে মাতামহ খুব ব্যস্ত ছিলেন। ঘরটি স্থায়ী। মা বলতেন, আমিও নাকি এই ঘরটিতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছি। মাসিরাও গর্ভসঞ্চার হলে এই গৃহে প্রবেশ করতেন। কুট্টি মাসির বিয়ে হলে সেও আসবে সন্তান ভূমিষ্ঠের কারণে। এ-সব ভাবলে গা সিরসির করত আমার। মাতামহ সূতিকা গৃহটি নতুন করে তৈরি করেছেন। এবার চণ্ডীপাঠ হয়েছে। হোম-যজ্ঞ, দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন সব করা হয়েছে। বেড়ার গাত্রে বেতপাতা, এবং মটকিলার ডাল গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বড়ো বড়ো শুকনো কাঠের গুঁড়ি এনে ফেলে রেখেছিলেন। তবু রেহাই নেই। শীতে আন্ধকার নদীতে অবগাহন সেরে ফিরছি। অধিরথ দাদু আগে। হাতে হ্যাজাক। আমার কাঁধে কোদাল। এবার গর্তটি করার ভার মাতামহ আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটু বেশি পরিমাণে গর্ত খুঁড়লে তিনি রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, কতদূর যাবে! কতদূর যেতে চাও? আমি এর সঠিক অর্থ ধরতে পারিনি বলে কোদাল চালাচ্ছিলাম। এক ভূতুড়ে ঘোর আমার মধ্যে প্রবেশ করছে। যেন প্রোথিত করার মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে। তারপর সব নামিয়ে দেওয়ার পর কাঁটা গাছ দিলাম কিছু ওপরে। মাতামহ দাঁড়িয়েই আছেন। আর কিছু বলছেন না। কেবল ফেরার পথে বললেন, প্রকৃতিই হেতু। তুমি বড়ো বেশি ভিতু স্বভাবের।

ভিতু স্বভাবের এটা টের পেলাম রাস্তায় ফেরার সময়। মনে হচ্ছিল শিশুটি আমার পায়ে পায়ে হেঁটে আসছে। যেন আমার হাত ধরে হাঁটতে চাইছে। মাঝে মাঝে এমন ঘোর সৃষ্টি হচ্ছিল যে অন্ধকারে কাকে খুঁজছিলাম। কাঁপছি, দাঁত ঠকঠক করছে শীতে না আতঙ্কে বুঝতে পারছিলাম না।

বাড়ি ফিরে আগুনে হাত স্যাকার পর ঘরে ঢুকতেই দেখি মাতামহীর মাথা কোলে নিয়ে মা মেঝেতে বসে আছেন। মাতামহীর চোখ দিয়ে দর দর করে জল পড়ছে। কুট্টি মাসি ছুটে বের হয়ে একটা গরম চাদরে আমার শরীর ঢেকে দিল। তারপর বলল, চল খাবি।

আমার খেতে ইচ্ছে করছিল না। বমি পাচ্ছিল।

কুট্টি মাসি মাকে বলল, দিদি ও তো একা শুতে ভয় পাবে। অধিরথ কাকু শোবে ছোটন কাকুর ঘরে। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।

মাসি আমাকে লেপে জড়িয়ে নিলেন। তারপর গভীর রাতে টের পেলাম, মাসি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। আমার হাত নিয়ে স্তনে এবং নাভিমূলে নরম উলের গভীর উষ্ণতায় ডুবে গেলেন। শেষে যেন পাগলের মতো আমাকে আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছিলেন। আমি সাড়া দিতে পারছিলাম না। ভয় আতঙ্ক এবং জন্মমৃত্যু রহস্য আমাকে এত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সকালে উঠে বিষয়টি স্বপ্নবৎ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি।

সেবারেই মাসি আরোগ্য লাভ করলেন এবং তাঁর বিবাহ পাকা হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *