1 of 2

নিজের দেশে ম্যান্ডেলা

নিজের দেশে ম্যান্ডেলা

যেন কতকাল হয়ে গেল, ম্যান্ডেলা ঘরবাড়ি ছেড়ে কেবল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাঁচ-সাত দিনও হয়নি তবু কেন যে মনে হয় কত কাল। বেশিদিন সে তার মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। এটাই হয়েছে তার ভারি জ্বালা। মা ঠিক ছটফট করছে। আবার উধাও মেয়েটা! যায় কোথায়! সে যে তার নিখোঁজ বাবাকে খুঁজতে বের হয়ে কত দেশে চলে যায়, তা মা কিংবা বুচার মামা বিশ্বাস করবে কেন! সে বলেও না কিছু। চুপচাপ থাকে। আগে হম্বিতম্বি হত। পুলিশ থেকে শহরের বড়ো বড়ো কাগজগুলিতে তার নিখোঁজ হবার খবর চলে যেত। সে ফিরে এলেই, হাজার প্রশ্ন। কোথায় গেছিলে, কে তোমাকে নিয়ে গেছিল? কোনো দুষ্টচক্রের পাল্লায় পড়ে যে সে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে না, তাই বা বিশ্বাস করবে না কেন তারা।

আর তখন এক কথা, জানি না।

কোথায় গা ঢাকা দিয়েছিলে, জান না।

না জানি না।

আরে বলছ কি, তুমি বাচ্চা মেয়ে, বোঝ না—তোমার পক্ষে কোথাও এতদিন পালিয়ে থাকা সম্ভব নয়।

ম্যান্ডেলা সাড়া দিত না। করুক না বকবক, কতক্ষণ করতে পারে দেখা যাক। তবে এবারে বেশ কদিন সে ঘরছাড়া। উড়তে শুরু করলে তার এই হয়। ঘরবাড়ির কথা মনে থাকে না, মা-র কথা মনে থাকে না, এমনকী বুচার মামা যে তার এই বাঁদরামিতে ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে তাও সে গ্রাহ্য করে না। উড়তে উড়তে সে সেবারে ফনের রাজত্বে ঢুকে গেছিল। সে না থাকলে মুম্বাটুকে যে পুড়িয়ে মারা হতো, কেউ বিশ্বাস করবে না। মা না, মামা না, কেউ না। আর এসব বলে সে তার সেই জাদুকরকে ছোটো করতে চায় না। জাদুকর তাকে পালকের টুপি না দিলে তার বাবাকে খুঁজে বের করাও মুশকিল। আর এমনভাবে ওড়ার আনন্দই বা সে পেত কোথায়!

সে তার বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, বাবা না থাকলে কেউ থাকে না, এরা বুঝবে কী করে। জাহাজডুবি যে কোথায় হল, এটাই সে বুঝতে পারছে না। জাহাজ তলিয়ে গেলেও বোট থাকে জাহাজে-বাবা যে বোটে ভেসে পড়েনি কে বলবে! কোনো দ্বীপে কিংবা অরণ্যে বাবা তার বেঁচে আছে, কারণ মানুষের জন্য ঈশ্বর সর্বত্র বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তার সেই বুড়ো হানসের কথাও মনে হয়। মানুষটা নির্জন দ্বীপে কতকাল কাটিয়ে দিল—সেই কবে সারা পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ হয়েছিল, হানস ছিল একজন সৈনিক—সে যুদ্ধজাহাজ থেকে পালিয়ে একটা দ্বীপে উঠে গেছিল। পালিয়ে না, জাহাজটা ডুবে যাচ্ছিল—কী যে খবর, সে আর এখন মনে করতে পারছে না। উড়তে উড়তে কোনো নির্জন দ্বীপে কেউ চুপচাপ বালুবেলায় দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেলে কার না বিশ্বাস হবে, নিশ্চয়ই সেই নিখোঁজ মানুষটি, সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে তার ছোট্ট মেয়ে ম্যান্ডেলার কথা ভাবছে! কিংবা সমুদ্রের কোথাও যদি কোনো জাহাজ কিংবা জেলে নৌকার সন্ধান পাওয়া যায়, সেই আশাতেও মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

সে যাই হোক, ম্যান্ডেলা দ্বীপে নেমে গেছিল। সঙ্গে তো হাইতিতি আছেই। সে কাছে গিয়ে দেখল, একজন বুড়ো মানুষ, চুল সব পেকে গেছে—সাদা দাড়ি, গায়ে পাতার পোশাক। তার বাবা নয় ঠিক, তবে মানুষটার জন্য কম তার ভোগান্তি হয়নি। এই আছে এই নেই, কারণ ম্যান্ডেলা পালকের টুপি মাথায় দিলেই অদৃশ্য, খুলে ফেললে ম্যান্ডেলা। হাইতিতি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার গলায় ঘণ্টা বাজছে। দ্বীপে কোনো ভুতুড়ে উপদ্রব শুরু হয়েছে ভেবে লোকটা দৌড়াতে শুরু করেছিল। এতটুকুন দ্বীপে আর যে মানুষজন নেই, ম্যান্ডেলা উড়তে উড়তে টের পেয়েছে—তারপর লোকটার কাছে গিয়ে টুপি খুলে দাঁড়িয়ে পরিচয় দিয়েছে, তা নাম ম্যান্ডেলা। সে থাকে নিউ প্লাইমাউথ শহরে। জাদুকর তাকে পালকের টুপি দেওয়ায় সে যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারে। সঙ্গে আছে ক্যাঙারুর বাচ্চা হাইতিতি—গলায় রূপোর ঘণ্টা বেঁধে দিলে, সেও অদৃশ্য হয়ে যায়–উড়ে যায়। সে তো ছোট্ট মেয়ে—একা একা ঘুরতে ভয় পাবে বলেই, হাইতিতিকেও দয়াপরবশ হয়ে জাদুকর রুপোর ঘণ্টা দিয়ে গেছে। হাইতিতি সঙ্গে থাকলে, তার আর কোনো ভয় থাকে না।

বুড়ো মানুষটি কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না তাকে। এমন আজগুবি কথা কে কবে শুনেছে! বাধ্য হয়ে ম্যাণ্ডেলা টুপি পরে দেখিয়েছে, খুলে দেখিয়েছে। হাইতিতি যে একটা ক্যাঙারুর বাচ্চা তাও দেখিয়েছে। রুপোর ঘণ্টা খুলে নিতেই হাইতিতি লাফিয়ে পড়েছিল, একেবারে বুড়ো মানুষটির নাকের ডগায়। সে বিশ্বাসই করতে পারেনি, হাইতিতি একটা ক্যাঙারুর বাচ্চা, আর এত চতুর। সারা দ্বীপে ছুটে বেড়িয়েছিল কিন্তু শত হলেও বুড়ো মানুষ, পারবে কেন—ক্লান্ত অবসন্ন বুড়ো মানুষটি পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়েছিল—আর হাঁপাচ্ছিল। তারপর যখন বুঝল,, ম্যান্ডেলা সত্যি সুন্দর ছোট্ট পরির মতো একটা মেয়ে এবং হাইতিতিও সত্যি একটা ক্যাঙারুর বাচ্চা, তখন বিশ্বাস করেছিল, ঈশ্বরের পৃথিবীতে সবই সম্ভব। মানুষ তার কতটুকু জানে।

সেই মানুষটি দ্বীপে থাকতে থাকতে তার নাম ভুলে গেছিল দেশের নামও মনে ছিল না। দ্বীপে থাকে। কচ্ছপের খোলে জল ধরে রাখে। পাখিরা উড়ে আসে দ্বীপের পাহাড়ে। তারা সেখানে বাসা বানায় মুখের লালা দিয়ে। সেই বাসা বুড়ো মানুষটা জলে ভিজিয়ে খায়—খুবই উপাদেয় স্যুপ। পুড়ো মানুষটার পাতার ঘরেও নিয়ে গেছে। বুড়ো মানুষটা সমুদ্রের ধার থেকে কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করে পুড়িয়েছে? ম্যান্ডেলাকে খেতে দিয়েছে। বড়ো বড়ো চিংড়িমাছ সমুদ্রের ধারে ধারে জলজ ঘাসের মধ্যে লাফিয়ে বেড়ায়। নীল স্ফটিক জল, খিদে পেলে চিংড়ি মাছ তুলে এনেছে। পুড়িয়ে নিজে খেয়েছে। তাকে খেতে দিয়েছে। তারপর ম্যান্ডেলা আবিষ্কার করেছিল, বুড়ো মানুষটা বিশাল একটা গাছের কাণ্ডে তার নাম লিখে রেখেছে, নদীর নাম, মেয়ের নাম। দ্বীপে এলে কেউ যেন তার অবর্তমানে টের পায় হানস ওটো নামে এক যুদ্ধপলাতক আসামি দ্বীপটায় জীবন অতিবাহিত করে দিয়েছে তার কোনো কষ্ট হয়নি। ঈশ্বর মানুষের জন্য সর্বত্রই বেঁচে থাকার কিছু কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

হানস ওটোর কথাও সে তার মাকে বলেনি, মামাকে বলেনি। বললেই তাদের হাজার প্রশ্ন। এত প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভালো লাগে না।

কোথায় সে দ্বীপ?

কোথায় কতদূরে সে বলতেই পারে না। কারণ পালকের গুণ, নিমেষে উড়ে যাওয়া যায়, মেঘেরা ভেসে যায় তার সঙ্গে। মেঘ কাটিয়ে বাতাসের আগে সে উড়ে যেতে পারে। আবার ইচ্ছে করলে মেঘের আড়ালে সে লুকিয়ে থাকতে পারে। দ্বীপটা কত দূরে, হাজার মাইল না তারও বেশি সে জানে না। সে শুধু জানে লোকটির নাম হানস ওটো। সে শুধু জানে তার মেয়ে আছে। ম্যান্ডেলারই বয়সি হবে হয়তো। নয়তো তাকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে কেন? মেয়ের নাম, নদীর নাম গাছে লিখে রাখবে কেন! মানুষের তো সবচেয়ে প্রিয় তার নদী আর গ্রাম। গ্রামের নামও লিখে রেখেছিল। হানস ওটো কোন দেশের লোক তাও সে জানে না। যে দেশেরই হোক, মেয়েকে ছেড়ে থাকার কষ্ট সব বাবারই এক। হানস নিজেও জানে না, কতকাল সে অতিবাহিত করেছে দ্বীপে। থাকতে থাকতে দ্বীপের গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি তার বন্ধু হয়ে গেছে। নিজের গাঁয়ের নাম ভুলে গেছে। নদীর নামও। মানুষ যেখানে থাকে, বড়ো হয়, সে অরণ্যই হোক, নির্জন দ্বীপই হোক প্রিয় হয়ে যায় তার। হানসের তাই হয়েছিল, বুড়ো হয়ে সে ভুলেই গেছিল, তার দেশ আছে, বাড়ি আছে, নদী আছে, মেয়ে আছে।

এসব মনে হলেই বাবার জন্য তার কষ্ট বাড়ে। বাবাও একদিন ভুলে যাবে তার কথা, টিলার উপর তাদের লাল নীল রঙের কাঠের বাড়ির কথা। আপেল বাগানের কথা। গির্জার কথাও ভুলে যেতে পারে। সে যে তার বাবার হাত ধরে পাইন ফেস্টিভ্যালে যেত—তাও ভুলে যেতে পারে। দ্বীপ কিংবা অরণ্যের গাছপালা, মানুষের কত প্রিয় হতে পারে হানস ওটোকে না দেখলে সে টের পেত না।

এই একটা আতঙ্ক থেকেই সে এত অস্থির। বাবা তার হয়তো একদিন বাড়ি ফেরার কথাই ভুলে যাবে।

বাবা যদি তার কথা ভুলে যায়, মা-র কথা ভুলে যায় তবে আর ম্যান্ডেলার বেঁচে থেকে কি হবে। ওয়াকার কথাও ভুলে যেতে পারে। সে বাড়ি না থাকলে, বেচারা ওয়াকাকে মামা কেবল ধমকাবে।—’গেল, কোথায় মেয়েটা? খুঁজে দ্যাখ! তারপর বলবে, এত করে বলি, ম্যান্ডেলাকে ফেলে কোথাও যাস না, তাও তুই পাইনের জঙ্গলে ঢুকে গেলি! ওখানে কী আছে তোর? ওখানে গেলে সেই জাদুকরের দেখা পাওয়া যাবে! তুইও কী চাস, জাদুকর তোকে কিছু দেবে! ওটা তো পাথরের মূর্তি। সমুদ্রের কিনারে পড়েছিল। শহরের মেয়র খবর পেয়ে ছুটে গেছে। শিশুরাও। একেবারে রাজবেশ। সাদা পাথরের মূর্তি। মাথায় মিনা করা বাদশাহি টুপি, ময়ূরের পালক মাথায়, পরনে আলখাল্লা। পায়ে নাগরাই জুতো। পাথরের রাজপুত্র বলা যায়। তুই কি ভাবিস ওয়াকা, ম্যান্ডেলাকে জাদুকর অদৃশ্য করে রাখে! তুই কি জাদুকরের পায়ের কাছে বসে বারবার প্রার্থনা করিস,ম্যান্ডেলার সুমতি দাও। ম্যান্ডেলা ফিরে এসেছে, ওকে আর তুমি অদৃশ্য করে রেখ না। বুচার মামা, লুসি মাসির ত্রাস বোঝো না। এমন একটা ছোট্ট মেয়ে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলে কত কষ্ট বল! সে কোথায় যায়, তুমি ঠিক জান। বলে দাও না, ম্যান্ডেলা কোথায় যায়। তুই মূর্তিটিকে তাই বলিস?

ওয়াকার তখন এক কথা, না কর্তা কিছু বলি না তাকে?

বুচার মামা বলবে, ফের যদি দেখি ওয়াকা, তুই জাদুকরের বাগানে ঢুকেছিস, পা খোঁড়া করে দেব।

জাদুকর পাথরের। কোথা থেকে কিভাবে যে সমুদ্রের ঢেউ ফেলে দিয়ে গেছে তাকে, কেউ তা জানে না। তা এটা বেশ একটা রহস্য।

শহরের বেলাভূমিতে জাদুকর পড়ে আছে। সেই জাদুকর—যে জাহাজে এসেছিল, যে পাতার বাঁশি বাজাত—যে শিশুদের নিয়ে পাইন ফেস্টিভ্যালের দিনে, মিছিল বের করেছিল—ঠিক সেই পোশাকে, সেদিন সে যা পরে পাইন ফেস্টিভ্যালে শহরের রাস্তায় নেমে এসেছিল, শহরের মানুষজন তাকে দেখে তো অবাক-বাড়ির কাচ্চা-বাচ্চারা সব ছুটে বের হয়ে গেল, পাতার বাঁশির সুরে মুগ্ধ করে সব শিশুদের সে বের করে নিল, সে যদি মাস কাবার না হতেই পাথরের মূর্তি হয়ে ভেসে আসে আর বেলাভূমিতে পড়ে থাকে—তবে মানুষের দোষ কি! তারা তো অবাক হবেই।

ম্যান্ডেলা উড়ে যাচ্ছে, আর বাড়ির কথা ভাবছে। মা-র কথা, ওয়াকার কথা, মামা বুচার ঠিক বাগানে পায়চারি করছে। শহরের লোকজন বলাবলি শুরু করে দিয়েছে, ভুতুড়ে মেয়েটা সত্যি এবারে উধাও! এতদিন তো সে বাড়ির বাইরে কখনো থাকে না। শহরের ছেলে-মেয়েদের চোখেও ঘুম নেই সম্ভবত। ওয়াকা অস্থির হয়ে পড়বে। সে পাইনের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে। উপত্যকায় আপেলের বাগানে ঘুরে বেড়াবে কিংবা ভেড়ার পাল নিয়ে যারা নীচে নেমে যায়, তাদের কাছে খোঁজাখুঁজি করবে, ম্যান্ডেলাকে দেখেছ! কোথায় যে আছে! কোথায় যে গা ঢাকা দিয়ে থাকে। খায় কী! অবশ্য খাবার ভাবনা থাকার কথা না। চেরি ফলের বাগানে ঢুকে গেলে চেরি ফল খেয়ে আনন্দেই দিন কাটিয়ে দিতে পারে কিংবা আঙুরের খেতে যদি লুকিয়ে থাকে, তবে তো হাইতিতিরও খুব মজা। আঙুর খেতে ওস্তাদ। আর কোনো খামারে পালিয়ে থাকলে, সেখানে দুধ মাখন সব পাবে। নদী এবং হ্রদের পাড়ে পাড়ে ঘুরে বেড়ালেও তার ভয় থাকার কথা না। ম্যাণ্ডেলার ভারি মিষ্টি স্বভাব। সবাই তাকে আদর করে খাওয়াতে পারে। মেয়েটার মধ্যে ঐশী শক্তি আছে, এমনও এখন শহরের লোকজনরা বিশ্বাস করে। তার পক্ষে পাঁচ সাতদিন নিখোঁজ হয়ে থাকা খুব কঠিন না। এমনকী এখন রাত জেগে ছাদে বসে থাকবে সবাই-ওর ফেরার সময় শহরের মাথায় ঘণ্টাধবনি হয়। সাধারণ মানুষ তো জানে না হাইতিতির গলায় ম্যান্ডেলা রুপোর ঘণ্টা বেঁধে দেয়। সে এই রুপোর ঘণ্টা পেল কোথায় তাও কেউ জানে না। তা হাইতিতি ভাসতে ভাসতে নেমে এলে ঘণ্টা বাজবে, ঘণ্টাধবনি হবে—এবং নীল আকাশে দেখা যাবে ছেড়া রুমালের মতো কী যেন দুটো ভেসে চলে আসছে। তখনই তারা বলবে, লুসির ভুতুড়ে মেয়েটা ফিরল। যাক কিছু যে হয়নি—কোথায় যায়! লুসির প্রাণে এবার জল এল। সবাই লুসিকে এজন্য কিছুটা মা মেরির কাছাকাছি জননী ভেবে থাকে। তাকে সবাই ভক্তি শ্রদ্ধাও করে। বাগানের সুমিষ্ট ফল, ভেড়ার বাচ্চা উপহারও পাঠায় কেউ কেউ।

ম্যান্ডেলা দ্রুত বাতাস কেটে নেমে আসছে। এতদিন এভাবে তার বাইরে ঘোরা উচিত কাজ হয়নি। তারপরই মানে হল, সে না থাকলে ফনের আদেশে মুম্বাটুকে পুড়িয়ে মারা হত। একজন মানুষের প্রাণ বড়ো, না মা-র দুশ্চিন্তা বড়ো কিছুতেই ম্যাণ্ডেলা তার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। মাকে সে কষ্ট দিতে চায় না। সেবারে, সেই প্রথম, পালকের টুপি আর রুপোর ঘণ্টা পেয়ে কী বোকামিই না করে ফেলেছিল। পাইনের জঙ্গলে এভাবে কেউ পালকের টুপি ফেলে রেখে যায় না। রুপোর ঘণ্টাও ফেলে রেখে যায় না। যদি যায়, তবে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য আছে। এবং সেদিনই স্বপ্নে কে যেন তাকে বলে গেল, আরে সেই জাদুকরই তো, তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ওটা অমূল্য জিনিস—তোমার বাবা নিখোঁজ। তাকে ওটা পরে খুঁজতে যেতে পারবে। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায়, তুমি ইচ্ছেমতো উড়ে যেতে পারবে। তারপর মনে হল, না যেন এটা জাদুকর তার হাতে দিয়েই বলেছিল—কি যে হয়, কখনও মনে হয় স্বপ্নে, কখনো মনে হয় বাস্তবেই মানুষটি তার নিখোঁজ বাবার কষ্ট বুঝে পালকের টুপিটি তাকে দিয়ে গেছিল। তবে রহস্যময় মনে হলেও তার কেন যে মনে হয়, জাদুকর বসন্তনিবাস তার ভালোই চায়। এই যে সে ফনের রাজত্বে ঘুরে এল, তাও বোধহয় জাদুকরের ইচ্ছে। তা না হলে, সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে সে নিমেষে উড়ে যায় কী করে! তবে এটা মনে আছে, জাদুকর তাকে পইপই করে বলেছে, এই টুপির খবর, রুপোর ঘণ্টার খবর কেউ যেন না জানে—এতে মন্ত্রগুণ নষ্ট হয়ে যায় সে এজন্য কিছুই বলতে পারে না। ওড়াউড়ির শুরুতে লায়ন রকে গেছিল। সবে সে পালক আর রুপোর ঘণ্টা পেয়েছে। পেয়েই টুপিটা মাথায় দিতেই কেমন হালকা হয়ে গেল। উড়তে থাকল—তার খুব ভয় ধরে গেছিল—আরে বাতাসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে তাকে। সমুদ্রের উপরে যে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। যেই না ভয় সঙ্গে সঙ্গে সে দেখতে পায়, বাড়ির দিকে উড়ে যাচ্ছে–কী সুন্দর বাড়িটা—এত উপর থেকে তো সে তার বাড়ি কখনো দেখেনি। সবুজ পাইনের জঙ্গলে পাহাড়ের মাথায় বাড়িটা মনে হচ্ছিল, আশ্চর্য সুন্দর। সামনে সমুদ্র, সমুদ্রের বালিয়াড়িতে পাথরের জাদুকর একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখেও ছিল। বলেছিল, ভয় কি! মাথায় পালকের টুপি আছে, ভয় কি! তুমি যা ভাববে, ঠিক সেমতো টুপিটা কাজ করবে। তোমার ভয় ধরে গেল, তাই আবার বাড়ির দিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তোমাকে। তারপর বলেছিল, তুমি একা কেন হাইতিতি কোথায়। ওকে সঙ্গে নাও। তারও তো আছে রুপোর ঘণ্টা। একা ওড়াউড়ি করলে ভয় পাবারই কথা। আমারও ভয় করত। এই যে সমুদ্রবেলায় তোমরা আমাকে পাথরের মূর্তিতে বন্দি করে রেখেছ, আমারও একা ভয় করে। ভয় করে বলেই তো সব পাখিরা ওড়াউড়ি করে মাথার উপর। রাতে যখন শহর ঘুমিয়ে পড়ে তখনও একটা বড়ো অ্যালবাট্রস পাখি আমার মাথায় চুপচাপ বসে থাকে। আমাকে সঙ্গ দেয়। কথা বলে। হাইতিতি সঙ্গে থাকলে তোমার ভয় করবে na। মানুষের সঙ্গে পাখি, প্রজাপতি, শুধু পাখি, প্রজাপতি কেন, সব প্রাণীরই একটা মধুর সম্পর্ক থাকে। যারা শুধু মানুষের কথা ভাবে, তারা স্বার্থপর। মানুষের সঙ্গে গাছপালারও গভীর সম্পর্ক। কেউ কাউকে ছেড়ে বাঁচতে পারে না। বড়ো হতে পারে না।

রাত শেষ হয়ে আসছে। আকাশে স্বাতি নক্ষত্রের গায়ে যেন কুয়াশার জল লেগে গেছে। আকাশ আর নক্ষত্রমালার ভিতর ম্যান্ডেলা ভেসে যাচ্ছিল। ম্যান্ডেলা কত কিছু ভাবছিল। বাড়ি ফেরার সময়ই তার সব কথা মনে হয়। এমনকী বাবার লাগানো প্রিয় গাছগুলোর কথাও মনে হয়। কাঠের সেই লাল নীল বাড়িটার চায়পাশে, বাবা কত দেশ থেকে সব সুন্দর সুন্দর গাছ এনে লাগিয়েছে। বাবার জন্য আগে মন খারাপ হলে সে গাছগুলির চায়পাশে ঘুরে বেড়াত। সিলভার-রক গাছটিও তার প্রিয়। শুধু তার কেন, হাইতিতিরও। হাইতিতিকে তো গাছটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সুযোগ পেলেই সে জঙ্গলে ঢুকে যেতে চায়। এমনও হয় যে তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। গেল কোথায়! ওয়াকা, সে, বুচার মামা পর্যন্ত টর্চ হাতে পাইনের জঙ্গলে খুঁজতে বের হয়। বাড়িটার নীচে বিশাল পাইনের বন— কতদূর চলে গেছে। কোথায় কোন জঙ্গলে ঘাপটি মেয়ে আছে তারা বুঝবে কী করে। না, খুঁজে খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না। নিরাশ তারা। আর বাড়ি ফিরে দেখে, দুষ্টুটা সিলভার-ওক গাছের নীচে চুপচাপ বসে আছে। গাছটাকে হাইতিতিও কত ভালোবাসে এটা যেন তার প্রমাণ।

সেই গাছটা সে কতদিন দেখে না। গাছটার নীচে বসে থাকে সকাল হলে। গাছের ছায়ায় নীল রঙের বেতের চেয়ারে সে বসে থাকে। হাইতিতি তখন একেবারে পোষা কুকুরের মতো। সে যা খাবে, ভাগ না পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে কখনও গিয়ে সে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। টমেটো সস দিয়ে স্যান্ডউইচ খেলে হাইতিতিরও চাই স্যান্ডউইচ, টমেটো সস। এত পাজি কখনো লাফিয়ে হাঁটুতে দু-পা রেখে ঝুঁকে দেখবে সে কী খাচ্ছে।

সেই গাছটাও তাকে টানছে, এই টানের জন্যই সে মেঘ ফুঁড়ে বের হয়ে আসছে। মেঘেরা কী, দায় নেই, দায়িত্ব নেই, তাদের মা-বাবাও নেই, ঘরবাড়ি তাদের কোথায় সে জানে না, মেঘেরা ঝরঝর করে ঝরে পড়লেই খালাস। তাদের মতো ঢিমেতালে ভেসে বেড়ালে চলবে কেন। সে সাঁ সাঁ করে উড়ে চলেছে, দুরন্ত ঈগল কিংবা কোনো অ্যালবাট্রস পাখির ঝাঁক নিমেষে পড়ে যাচ্ছে তার পেছনে। রকেটের মতো সে ছুটে চলেছে। মা রোজ আশা করছে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাবে তাকে। দুপুরে খাবার নিয়ে বসে থাকছে হয়তো। রাতেও। আর রোজ ঠিক গির্জায় যাচ্ছে প্রার্থনা করতে। রাত হলে চুপচাপ জানালায় দাঁড়িয়ে থাকবে। এখন আর আগের মতো মা ত্রাসে পড়ে যায় না। আগে তাকে না দেখলেই কান্নাকাটি জুড়ে দিত। বুচার মামাকে ফোন করত, ম্যান্ডেলাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যস। সারা শহর তোলপাড়-থানা-পুলিশ কত কিছু হয়েছে। কিন্তু যে উড়তে পারে, অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে, থানা-পুলিশের সাধ্য কি তাকে খুঁজে বের করে।

সেই সেবারে-দূর ছাই মনেও থাকে না। সেই সেবারে বললেই তো হয় না, আরে ওই যে লায়ন রকে তারা যেবারে যায়—পুরো চব্বিশ ঘণ্টা নিখোঁজ। তা এতটুকুন ছোট্ট মেয়ের পক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা নিখোঁজ হয়ে থাকা যে কত ঝকমারি বাড়ি ফিরে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিল।

হাওয়ায় ভেসে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মনে হয়েছিল, তাদের বাড়িতে মানুষজনের ভিড়, পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। কী হল রে বাবা!

তাদের বাড়ির সামনে সুন্দর ঘাসের লন। সবুজ—আর সেখানে এত মানুষের ভিড়! নীচে পাইনের বনভূমি, সেখানেও লোকজন কি খোঁজাখুঁজি করছে। বাড়ির পেছনে সাদা পাহাড়—এপমন্ট হিল। প্রায় সারাটা বছর তুষার শৃঙ্গ রোদে ঝকমক করে। বৃষ্টির দিনে, কিংবা কুয়াশা হলে পাহাড়টা কখনো কখনো আড়ালে পড়ে যায়। তখন কেন যে বাড়িটা তাদের ন্যাড়া ন্যাড়া মনে হয় সে বুঝতে পারে না। কুয়াশা থাকায় সে পাহাড়টা দেখতে পায়নি—তবে পাহাড় না থাকলেও, সবই আগের মতো আছে। বনভূমির নীচে ছোট্ট বেলাভূমি। আর আছে অজস্র লাল নীল পাথর, ফুলের উপত্যকায় রাজবেশে জাদুকর দাঁড়িয়ে আছেন। এমনকী পাহাড়ের নীচে সবুজ ঘাসের চারণভূমিতে সে অজস্র ভেড়ার পালও দেখতে পেয়েছিল। সবই এত ঠিকঠাক, তবু কেন যে বাড়িতে তাদের এত লোকজন প্রথমে ঠাউর করতে পারেনি।

পরে বুঝেছিল, অ তাইতো, সে যে মনের আনন্দে হাইতিতিকে নিয়ে লায়ন রকে উড়ে গেছে তা তো কেউ জানে না। সে পাইনের বন থেকে উঠে আসার সময়ই সবাই হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল—ওই তো ম্যান্ডেলা! ওই তো হাইতিতি! মা প্রায় পাগলের মতো ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, আর হাউহাউ করে কাঁদছিল।

বুচার মামার গম্ভীর গলা, কোথায় গেছিলে—দিনকাল ভালো না, বিচ্ছু মেয়ে, তোমাকে নিয়ে তো আমরা সবাই পাগল হয়ে যাব দেখছি। বল, কোথায় গেছিলে!

সে তো বলতে পারে না, লায়ন রকে গেছিল। জাদুকর যদি রাগ করে। জাদুকর তো স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলতেই পারে—’ম্যান্ডেলা তোমার একদম বুদ্ধি নেই। ওরা বিশ্বাস করবে—তুমি গেলে কি করে জানতে চাইবে না! এখন লায়ন রকে যাওয়া যায় না। ঝড়ের দরিয়া বলে ফেরি বন্ধ! স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, তুমি গেলে কী করে। কী দরকার বলার, লায়ন রকে গেছিলে–চুপ করে থাকলেই তো হয়।

২.

সে সেবারে অবশ্য মামার দাবড়ানিতে ভাগ্নে বলে ফেলেছিল সব। লায়ন রকে উড়ে গেছে। এমনকী টিউলিপ ফুল খেয়ে হাইতিতির কি আনন্দ। সে লাফায় আর টিউলিপ ফুল খায়। যত পায় তত খায়। কিন্তু মামা বিশ্বাসই করলেন না। ভাবলেন মিছে কথা বলছে।

গুরুগম্ভীর গলায় প্রশ্ন, এই তোমার শিক্ষা! তুমি জান না, গুরুজনদের সঙ্গে মিছে কথা বলতে নেই। আমরা খোঁজাখুঁজি করে হয়রান। বাড়িটার উপর এত ভুতুড়ে উপদ্রব। তোমার বাবা জাহাজে গেলেন, আর ফিরলেন না, তুমি বড়ো হতে না হতেই নিখোঁজ হয়ে গেলে। কোথায় না খুঁজেছি—পিকাকোরা পার্কে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে। তোমার তো ধারণা, তোমার বাবা সেখানে লুকিয়ে আছেন। বল, সত্যি করে বল, কোথায় সারাটা দিন ঘাপটি মেরে ছিলে। না বললে, বলেই লুসিকে ডেকে বললেন, তোমার অনেক ভোগান্তি আছে। এ মেয়ে তোমাকে ভোগাবে। যাও নিয়ে যাও। তালা বন্ধ করে ফেলে রাখ ঘরে। কোথায় যায় দেখব! বাবাকে খুঁজতে যায়। আর কিছু খোঁজার অজুহাত পেল না!

সহৃদয় পুলিশ অফিসারটিই তাকে সেবারে বলতে গেলে রক্ষা করছিল। বলেছিল, ওকে আর বকাবকি করবেন না। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ওকে কোনো প্রশ্ন করবেন না। নিজে না বললে, ভয় দেখিয়ে কথা বের করতে যাবেন না। শিশুরা একটু চঞ্চল হয়েই থাকে। পুলিশ অফিসারটি আরও জানিয়েছিল, মি. হাসিমারা আসবেন। তিনি একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। সেই বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিটিই হয়তো বলেছেন, নিরুদ্দেশ থেকে বাচ্চা ছেলেমেয়ে ঘরে ফিরে এলে তাকে অযথা প্রশ্ন করে উত্ত্যক্ত করতে নেই।

বুচার মামা এসব কারণেই বোধহয় নানা বিভ্রমে পড়ে গেছিলেন। তাকে বুকে তুলে নিয়ে বলেছিলেন, মা আমার খুব ভালো। বেশ বেড়িয়ে হাওয়া খেয়ে ফিরলে। তা কোথায় গেছিলে? নিশ্চয় খুব সুন্দর জায়গা। আমরাও না হয় যেতাম। আর তখনই সে বোকামি করে ফেলল, জান বুচার মামা-আমরা না, লায়ন রকে গেছিলাম।

বুচার হতভম্ব।

লায়ন রকে! কেন? কী করতে!

বাবাকে খুঁজতে।

বুচার মামা তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বিশ্বাস করবে কেন, সে তার বাবাকে খুঁজতে লায়ন রকে গিয়েছিল। আসলে শিশুরা মনে মনে নানা জায়গায় ভ্রমণ করে থাকে। এও বোধহয় তাই—এমনই হয়তো ভেবেছিলেন বুচার মামা। শুধু বলেছিলেন, বাবাকে একা খুঁজতে গেলে? ভয় করল না।

একা কেন? সঙ্গে হাইতিতি ছিল। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ না?

বোকা হাইতিতিও কম যায় না! সে সোজা ঢেকুর তুলে দুটো তাজা টিউলিপ ফুল জিভে তুলে এনেছিল। তারপর জিভ বের করে দেখিয়েছিল, মনের আনন্দে সে সারাদিন টিউলিপ ফুল খেয়ে বেড়িয়েছে। একমাত্র এসময়ে লায়ন রকেই টিউলিপ ফুল ফুটে থাকার কথা, অন্যত্র তারা যে ঝরে গেছে বুচার মামা কেন–সবাই সেটা জানে!

বুচার মামা এরপর আর কি প্রশ্ন করবেন বুঝতে পারছিলেন না। হতভম্ব অবস্থা বোধহয় কিছুটা কেটে গেছে। লোকজনের ভিড়ও পাতলা হয়ে আসছে। সবাই বলাবলি করছিল, মেয়েটার মাথায় নিশ্চয় ভূত চেপেছে। অথবা বাবাকে খুঁজতে যায় বলায় মনে করেছে, শেষে তার বাবাই মেয়েটাকে খাবে। কোথায় কোন গভীর সমুদ্রে জাহাজডুবিতে মারা গেছে কে জানে—তার প্রেতাত্মা যে মেয়াটাকে ঘরছাড়া করতে চাইছে না, তারই বা ঠিক কি! বরং এসব ব্যাপারে পুলিশ, শিশুবিশেষজ্ঞ না ডেকে ওঝা গুণিন ডাকাই বেশি শ্রেয়। ঝাড়ফুঁক করলে নিরাময় হয়ে যেতে পারে।

ম্যান্ডেলা দেখছিল মাকে ঘিরে প্রতিবেশীরা নানা উপদেশ দিচ্ছে। ওয়াকা মা-র ফুটফরমাস খাটছে। ম্যাণ্ডেলা ফিরে আসায় তার আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। সেও লাফিয়ে বেড়াচ্ছে টুকিটাকি কাজ সারার সময়।

আসলে বুচার ভেবেছিলেন, পাইনের বনে ঢুকে মেয়েটা নির্ঘাত রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল। তারপর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে কোনো গাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপরই মনে হল, রাস্তা হারালে, ফের পথ চিনে বাড়ি এল কি করে! এও হতে পারে বাবার খোঁজে সে পাইনের বন পার হয়ে কোনো উপত্যকায় উঠে গেছিল। কিংবা কোনো আপেল বাগানে, বাবা নিখোঁজ-কোথায় আর যাবে, ঠিক খুঁজে বের করবে এমন আশাতে সে আর বাড়ি ফেরার কথা মনে রাখতে পারেনি। এও হতে পারে বাবার কথা ভাবতে ভাবতে কোনো পাথরে বসে কাঁদছিল। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তারপর সকাল হলে বাড়ির কথা মনে হয়েছে। মার কথা মনে হয়েছে। আর স্থির থাকতে পারেনি। ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখতে পারে। স্বপ্নে সে লায়ন রকে ঘুরে আসতেই পারে। সুতরাং ম্যান্ডেলার বিশ্বাসকে বুচার ক্ষুন্ন করতে চায়নি। টিউলিপ ফুল সব ঝরে গেছে তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

তা হলে লায়ন রক থেকে ঘুরে এলে?

হাঁ মামা।

বেশ করেছ। একা অবশ্য যাওয়া তোমার ঠিক হয়নি।

তুমি না মামা, খুব বোকা! হাইতিতি আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়, কোথাও থাকে!

বুচার অবশ্য তা জানেন। তার ভগ্নীপতির এই এক শখ ছিল—পৃথিবীর যেখানে যা কিছু পাওয়া যায় মেয়ের জন্য নিয়ে আসতে পারলে, যেন তার সমুদ্র-সফর সফল। আর ম্যান্ডেলারও আবদারের শেষ ছিল না।

বাবা আমার চাই সিংহলের হাতি।

বাবা তার জন্য সিংহল থেকে কাঠের হাতি কিনে এনেছিলেন।

বাবা আমার চাই জাভাদ্বীপের গিরগিটি।

বাবা ম্যান্ডেলার জন্য পাথরের গিরগিটি নিয়ে এলেন।

বাবা আমার চাই, তুষার হরিণ!

বাবা নিয়ে এলেন, রুপোর একটা সাদা হরিণ।

বাবা আমার চাই ক্যাঙারুর বাচ্চা!

বাস যেমন বাবা তেমনি তার মেয়ে। তিনি সেবারে নিয়ে এলেন সত্যি একটা জ্যান্ত ক্যাঙারুর বাচ্চা। ম্যান্ডেলা যা চায় তাই পায়। বাবার জাহাজ কবে ফিরবে সেই আশায় কতদিন জেটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার জাহাজ ফেরার কথা আছে জানলেই ম্যান্ডেলা বাড়ির লনে বসে সাদা জাহাজের অপেক্ষায় থাকে। বাড়িতে বসে থাকলে নীল সমুদ্র দেখারও একটা আনন্দ আছে। টিলার ওপরে বাড়ি—সমুদ্র অনন্ত অসীমে মিশে গেছে—ঝড় এবং তরঙ্গমালা উভয়ই সে কাঁচের জানালায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়। নীচে পাইনের বনভূমি, গাছগুলি ঝড়ের দাপটে নুয়ে পড়ে। ঝড়ের ঝাপটার গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে—কখনো সমুদ্রের জলকণা ভেসে এসে নানা কারুকার্য গড়ে দেয় জানালার কাচে। এমন মেয়ের জন্য বাবার কেন শখ হবে না—একটা জ্যান্ত ক্যাঙারুর বাচ্চা। মেয়ের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারার জন্য বুচার জানেন, পারলে ভগ্নীপতি সারা পৃথিবীর সব বিচিত্র গাছপালা পাখি জীবজন্তু বাড়িটায় ছড়িয়ে দেয়—নানা মজা সৃষ্টি করার খুবই আগ্রহ তার।

সেই ভগ্নীপতি যেবারে ক্যাঙারুর বাচ্চাটি নিয়ে জাহাজ থেকে নামল, কী ভিড় বাচ্চাটাকে দেখার জন্য। বাড়িতেও ভিড়। ম্যান্ডেলাকে খুশি করার জন্য সেবারে আর কাঠ নয়, পাথরের নয় একেবারে রক্তমাংসের জীব এনে হাজির করলেন। তবে ক্যাঙারুর বাচ্চা তো—পোষ মানবে কেন! খায় না, শুয়ে থাকে। ম্যান্ডেলা বোঝে ক্যাঙারুরও মা-বাবা থাকে। মা-বাবার জন্য মন তো খারাপ করবেই।

এই দুধ খাও?

খাবো না!

না খেলে, আমিও খাচ্ছি না। ম্যান্ডেলা গুম মেরে বসে থাকত বাচ্চাটার সামনে। লুসি রাগারাগি করছে–তুমি কি, মেয়ে বলল, আর জ্যান্ত একটা ক্যাঙারুর বাচ্চা ধরে আনলে!

বাঁচবে।

ন্ডেলার মনে আছে, বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, বাড়িতে ম্যান্ডেলা আছে। বাঁচবে। ভালোবাসা পেলে কে না বাঁচে! বাঁচতে চায়!

তখন তো বাচ্চাটা ভালো করে লাফাতেও পারত না। ম্যান্ডেলার আদরে মাথাটিও গেছে। ম্যান্ডেলা খেতে বসলে নিজেই লাফিয়ে এসে বসে পড়বে। টেবিলের চারপাশে চারটে চেয়ার। ডাইনিং টেবিলে কারুকাজ করা চিনামাটির প্লেট, বাচি, চা-এর পট, ননদানি জলের মগ। চারপাশে চারজন। বাবা-মা একদিকে—সে আর হাইতিতি একদিকে। ওয়াকাই নামটা দিয়েছিল। বাড়িতে কেউ অতিথি এলে তার যে একটা নাম থাকে ওয়াকাই মনে করিয়ে দিয়েছিল।

কত নাম ঠিক করা হল।

ম্যান্ডেলার একটাও পছন্দ না।

সি-গাল।

সি-গাল কেন? ও কি পাখি! সি-গাল নাম রাখছ! ও কি উড়তে পারে? ওর কি ডানা আছে?

বাবা বললেন, শ্যাময় নামটা বেশ।

ম্যান্ডেলা জানে না শ্যাময় কোনো নাম হতে পারে। সেটা আবার কি বস্তু?

বাবা বলেছিলেন, শ্যাময় একপ্রকারের হরিণ। আল্পস পর্বতমালায় তারা বিচরণ করে। তুষার হরিণও বলতে পার। রঙটা তো হরিণের মতো। শ্যাময় নামটাই আমার পছন্দ।

মা ধমকে উঠেছিল, যেমন মেয়ে তেমনি বাবা। নাম নিয়ে এত দুশ্চিন্তা! কেউ খাচ্ছে না। কেউ কাঁটা চামচ ধরছে না। আর বাচ্চাটাও হয়েছে, দেখ, যেন সব বুঝতে পারে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কে কি নাম রাখতে চায়, নামটা পছন্দ কিনা, বোঝার চেষ্টা করছে।

মা-র ধমকে সবারই মনে হল, খাবার টেবিলে গল্পও করতে হয়, আবার খেতেও হয়। তারা শুধু গল্পই করছে। ওয়াকা ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে ক্যাঙারুর বাচ্চাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি নাম রাখতে চায়, কারো সে বিষয়ে যেন কোনো আগ্রহ নেই জানার।

তার খুব অভিমান। সে কোনো কথা বলছে না। গুম মেরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে-ই যে বাজার থেকে, বন থেকে বাচ্চাটার জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনে কেউ যদি তার কষ্টটা বুঝত। সে-ই তো আবিষ্কার করেছিল, বাচ্চাটা খেতে ভালোবাসে আনারস আর তরমুজ। লেটুস পাতাও তার প্রিয় খাবার। আর বুনো ফল এবং গাছের নরম শেকড়-বাকড়। যেমন বনআলু তার খুব প্রিয়। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ওয়াকা লতা দেখলেই চিনতে পারে, কোনটা বনআলুর, কোনটা শালুই লতা। লতার ফল দেখলেও সে চিনতে পারে। দুটো লতাই একরকম দেখতে। পাতাও একরকমের। পানপাতার মতো। ওয়ালনাট গাছ কিংবা কৌরিপাইনের কাণ্ড খুব প্রিয় এ-দুটো লতারই। গাছের ডালপালা জড়িয়ে এমন বিতিকিচ্ছি অবস্থা করে ফেলে যে তখন গাছটাকে আর চেনাই যায় না। ঝুপড়ি মতো হয়ে যায় গাছটা। এত সব কারণে দু-একবার ওয়াকা যে না ঠকেছে তা নয়। বনআলু ভেবে লতার গুঁড়ি কুপিয়ে দেখা গেল, কিছুই নেই। শালুই লতার মূল বলে বিশেষ কিছু থাকে না। লতার নীচে হাতির দাঁতের মতো নরম রসালো মূলও থাকে না। পরিশ্রমই বৃথা। এখন অবশ্য সে জঙ্গলে ঘুরে ফুল এবং ফল দেখে চিনতে পারে, কোনটা বনআলুর। কোনটা শালুই লতা। শালুই লতার ফুল এবং ফল দুই হয়। ফুলগুলি কাকটাস লতার ফুলের মতো। নীল রঙের। ফল হলে লম্বা পটলের মতো দেখতে। বিস্বাদ খেতে। মুখে দিলে বমি হবেই। আর বনআলুর কোনো ফুল হয় না। ফল হয়। ফলগুলি দেখতে বিশ্রী। বড়ো জড়ালের মতো যেন থোকা থোকা ঝুলে থাকে। পুড়িয়ে খেতে দারুণ। বাচ্চাটা কী খায়, না খায় তাও জানা নেই। তবে দুধ খায়। দুধ সব বাচ্চারাই খায়। ক্যাঙারুর বাচ্চা দুধ খাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুধ তো বার বার খেতে ভালো লাগে না। মুখরোচক কিছু চাই। আর এজন্যই হাইতিতির ডিসে লেটুস পাতা, বনআলুর টুকরো—কিছুটা শাঁখআলুর মতো কেটে রাখা হয়েছে। আনারসও কেটে রাখা হয়েছে। সব রেডি-অথচ খাওয়ার নাম নেই। বাচ্চাটার নাম নিয়ে সবাই পড়েছে। অথচ ওয়াকার মতামত এ ব্যাপারে সবাই অগ্রাহ্য করছে। ওয়াকার তো রাগ হবেই।

ম্যান্ডেলা মা-র কথাতে সচকিত হয়ে গেছে। সত্যি তো কেউ কিছু মুখে তুলছে। গ্রিন পিজ আর টমেটোর স্যুপ—ভাপ উঠতে উঠতে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, সে খেয়ালও নেই। মা-র তো রাগ হবেই। সাদা ন্যাপকিন ভাঁজ করা। কেউ খুলে হাঁটুতে বিছিয়েও নিচ্ছে না। যেন নামকরণ না হলে কেউ কিছু মুখে দেবে না ঠিক করেছে। অগত্যা কাঁটা চামচে গেঁথে নিল একটা লেটুস পাতা। ম্যালো বাচ্চাটার মুখের কাছে নিয়ে গেলে, মুখ হাঁ করল। বাচ্চাটার বায়নাও শেষ ছিল না তখন! ম্যাণ্ডেলা না খাইয়ে দিলে কিছু মুখে দেবে না। একবার সে বাচ্চাটার মুখে খাবার তুলে দেয়, একবার সে চামচে স্যুপ খায়। আহার পর্ব শুরু হতেই বাবা যে কেন বললেন, ওয়াকা কী বলে?

আর যায় কোথায়।

ওয়াকার মুখে একগাল হাসি।

সে বোধহয় রাগে ক্ষোভে ঘামছিল। তার তখন সব ঠান্ডা। সে জামার আস্তিনে মুখ মুছে বলল, হাইতিতি।

হাইতিতি আবার নাম হয় নাকি! মা মুরগির রোস্ট কেটে সবার পাতে দেবার সময় কথাটা বলেছিল।

ব্যস, ওয়াকার আবার মন খারাপ। টিকল না। তার নাম পছন্দ না। সে ব্যাজার মুখে চায়ের পর্টে গরম জল ঢেলে দিল। খাওয়া হলে ওয়াকা সব যখন সাফ করে তুলে নিয়ে যাবে তখন সবাই এক পেয়ালা চা না হয় কফি খায়। সে হাতের কাছে সব জোগাড় রাখে। যে যার মতো পট থেকে চা নেয়। চিনি নেয়। দুধও নেয়। তবে বাবা চা-এর লিকারই বেশি পছন্দ করেন তিনি তাঁর চা-এ কখনো দুধ মেশান না।

ম্যান্ডেলার খারাপ লাগছিল। ওয়াকার ব্যাজার মুখ সে একদম পছন্দ করতে পারে না। তাছাড়া ওয়াকারই তো ভাব ছিল বেশি জাদুকরের সঙ্গে। সেই তো জাদুকরকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। সেই তো বাড়ি ফিরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল–জান, জাদুকর বসন্তনিবাস এসেছে শহরে। সে যা চায় পেয়ে যায়। আলখাল্লার ভিতর থেকে যখন তখন সে একটা বেড়ালের বাচ্চা বের করে আনে। তারপর জাদুকরের কান যত ফরফর করে নড়াচড়া করে তত বেড়ালছানাটা বড়ো হয়ে যায়। শেষে বাঘ হয়ে যায়। বাচ্চারা বাঘ দেখে খুশি হলে, জাদুকরের আর কান ফরফর করে না। বাঘটা ছোটো হতে হতে শেষে আবার বেড়ালছানা হয়ে যায়। তারপর লাফিয়ে জাদুকরের আলখাল্লার পকেটে ঢুকে পড়ে। তবে ওয়াকা এ-সব ম্যান্ডেলাকেই বলে। কারণ বড়োরা তো বিশ্বাস করবে না। বাচ্চারা যা দেখতে পায় বড়োরা তা দেখতে পাবে কেন।

তার মনে আছে, বাবা সেদিনই সমুদ্রযাত্রায় বের হয়ে গেছিলেন। খুব ইচ্ছে। ছিল, জাদুকরের খবরটা বাবাকে দেয়। কিন্তু বাবা যদি বিশ্বাস না করে-ওয়াকা তো বলেছে, ছোটোরা যা দেখতে পায়, বড়োরা তা দেখতে পায় না। বড়োরা বিশ্বাস নাও করতে পারে। বিশ্বাস না করলে জাদুকরের অপমান না! সে রেগে গেলে, তাদের ক্ষতিও করতে পারে। বিশ্বাসীদের জন্য জাদুকর-অবিশ্বাসীদের প্রতি জাদুকর খাপ্পা। পর পরই ওয়াকা বলেছিল, আমাদের ধর্মে আছে, তুমি জান মেসাইয়া কি না করেছেন। তিনি ইচ্ছে করলে কুষ্ঠরুগীর আরোগ্য লাভ করাতে পারেন। মূক-বধির তাঁর কৃপায় কথা বলতে পারে, অন্ধ ব্যক্তি দৃষ্টি ফিরে পায়। মৃত ব্যক্তির জীবনলাভ হয়। অবিশ্বাসীরা এ-জন্যই তো বিধর্মী।

খুবই অকাট্য যুক্তি।

ম্যান্ডেলা বাবাকে জাদুকরের খবর দিতে সাহসই পায়নি। আর সে-বারই তো বাবা জাহাজডুবিতে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। বাবা কি কারও কাছ থেকে শহরে জাদুকরের আবির্ভাবের খবর পেয়েছিলেন! খবর পেয়ে কি তিনি অবিশ্বাস করেছিলেন—যত্ত সব আজগুবি কথা! জাদুকর আজগুবি হলে যিশুর দয়াও আজগুবি। কই তার বেলায় তো তিনি অন্ধজনে দেহ আলো গোছের। তিনি কত সব অলৌকিক ক্রিয়া কাণ্ড করে গেছেন, গির্জায় গেলে কিংবা মা যখন অত্যন্ত নিরিবিলি পবিত্র গ্রন্থটি পাঠ করেন, তখন তো তিনি কখনো বলে না—আজগুবি। বরং যিশুর দয়ার কথা পড়তে পড়তে মা কেঁদে চোখ ভাসায়। তারও যিশুর কথা শুনতে শুনতে কেন যে কান্না পায় বোঝে না। মনে হয়, তিনি একজন মাস্টার ম্যাজেসিয়ান। তাঁর দয়ায় মানুষ সঠিক পথের খোঁজ পায়। শয়তান শত লোভে ফেলেও তাঁকে কজা করতে পারনি—মানুষের মঙ্গল ছাড়া মাস্টার ম্যাজেসিয়ান আর কিছু ভাবতেই পারতেন না। যিশু রাস্তায় আসছে জেনে দু’জন অন্ধলোক অপেক্ষা করছে। কাছে আসতেই তো তারা চিৎকার করে বলেছিল, প্রভু আপনি আমাদের স্পর্শ করুন। যীশু তাদের চোখে হাত রাখলেন। তারা আবার পৃথিবীর সব কিছু দেখতে পেল। কত বড়ো জাদুকর হলে এটা যে সম্ভব! বসন্তনিবাস তাকে পালকের টুপি দিয়ে গেছে—কাউকে বলা যায় না। অথচ তিনি যে একজন প্রবল জাদুকর কেউ বিশ্বাসই করবে না। যিশুর সেই গল্পটাও তো তার মনে গেঁথে আছে। সক্কাল বেলায় তিনি জেরুজালেমে ফিরছেন। বড়ো ক্ষুধার্ত। রাস্তায় একটা মরা যজ্ঞিডুমুরের গাছ দেখতে পেলেন। পাতা নেই, ফল নেই। তিনি শুধু বললেন, আমি ক্ষুধার্ত—তুমি কি আমাকে কিছু ডুমুর ফল দিতে পার না! সঙ্গে সঙ্গে গাছটি পাতা মেলে দিল। হাওয়ায় তার ডালপালা দুলতে থাকল। ডুমুর ফলে ভরে গেল ডালপালা। যিশুর শিষ্যরা তো দেখে অবাক। তাঁরা প্রশ্ন করলেন, প্রভুকে—কী করে সম্ভব? প্রভু বললেন, যদি তোমাদের অটুট বিশ্বাস থাকে, যদি কোনো সংশয় না থাকে, এর চেয়ে আরও অলৌকিক কাজ তোমরা ইচ্ছে করলে করতে পার। এই যে সামনে মাউন্ট অফ অলিভস রয়েছে, তাকে যদি বল, সমুদ্রে বিচরণ কর—তবে সে তাই করবে। যদি প্রার্থনায় বিশ্বাস জন্মায়, হেন কাজ নেই মানুষের মঙ্গলের জন্য তুমি তা করতে পার না।

ম্যান্ডেলা মা-র কাছে শুনেছে, আরও কত অলৌকিক ঘটনার কথা। বাবা জাহাজে চলে গেলে মা তো সারাদিন চুপচাপ কাজ করত, ঘর সাজাতে, বাবার লাগানো গাছগুলিতে জল দিত, তাকে নিয়ে বসাতো–হাতের লেখা, অঙ্ক ড্রইং সব খাতাগুলির মলাট দিত যত্নের সঙ্গে। ইস্কুলের নাম, তার নাম, কোন ক্লাস সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে দিতে পারলে খুশি হত।

তারপর অবসর সময়ে যিশুর মহিমা পাঠ করে শোনাতো মা। বিশ্বাস করলে মাউন্ট অলিভসকেও যে নির্দেশ দেওয়া যায়, যাও সমুদ্রে গিয়ে বিচরণ কর—আর তক্ষনি পাহাড়টা হয়তো চলে যাবে সমদ্রে। আসলে বিশ্বাস। পালকের টুপি পরে সেটা আরও বেশি বুঝেছে। জাদুকরের প্রতি প্রবল বিশ্বাসই তাকে পালকের টুপিটা যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারে। যতই দুর্গম অঞ্চল হোক, যতই দূরের হোক সব দেশে সে ঘুরে বেড়াতে পারে। তার কি মজা কেউ বুঝবে না।

সে তো একদিন মাকে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেছিল, আচ্ছা মা, পাহাড় কখনও সমুদ্রে বিচরণ করতে পারে। তার কি হাত পা আছে, যে হেঁটে বেড়াবে, নয় সাঁতার কাটবে। পাহাড় কখনো সমুদ্রে হেঁটে যেতে পারে!

মা চোখ কপালে তুলে বলেছিল, বলছিস কি! অমন কথা মুখে কখনো বলবি না। তিনি ঈশ্বরের পুত্র। তাঁর মহিমা অপার। তিনি বললে সব হয়। তিনি ইচ্ছা করলে সব পারেন। পাহাড় কেন, সব এক মুহূর্তে লন্ডভন্ড হয়ে যেতে পারে। পাহাড় গুড়িয়ে যেতে পারে। সমুদ্রের জল তিনি অঙ্গুলি হেলনে শুয়ে নিতে পারেন। কখনো আর এমন কথা বলবে না। বলে মা হাঁটু গেড়ে বলেছিল—বিড়বিড় করে প্রার্থনা করেছিল-’মেয়েটা অবুঝ প্রভু। তার দোষ ধরো না।

দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে সেই প্রিয় এগমন্ট হিল। এই পাহাড়টার কোলেই তার প্রিয় শহর নিউ প্লাইমাউথ। সমুদ্রের ধারে পাহাড়ের কোলে শহরটা। ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে। বন্দর এলাকা পার হয়ে সি-ম্যান মিশান-ট্রাম গাড়ি এক বগির। গাড়িটা দুলকি চালে পাহাড়ের চড়াই-উত্রাই পার হয়ে যখন যায় তখন দূর থেকে মনে হয় খেলনার গাড়ি। তার কেবল ইচ্ছে হচ্ছে, কতক্ষণে সেই গাড়িটা তার দৃষ্টিগোচর হবে।

এ সব ভাবার সময়ই মনে হলো, বাবা ওয়াকার কথাই শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন। হাইতিতি নামটা ভারি সুন্দর। জব্বর নাম ছিক করেছে ওয়াকা। তবু বাবার বোধহয় কোনো সংশয় ছিল নাম নিয়ে। তিনি ওয়াকাকে প্রশ্ন করেছিলেন, নামটি তোর সুন্দর। কিন্তু হাইতিতি বললে তো কিছু বোঝায় না। এই যেমন সব নামেরই একটা ব্যাখ্যা থাকে—তোর নাম ওয়াকা। মাউরি উপজাতিদের ভাষায় ওয়াকা মানে সুন্দর। হাইতিতির মানেটা কি বুঝতে পারছি না।

৩.

ওয়াকা সত্যি বিপদে পড়ে গেল। সে ভেবেও কিছু বলেনি—তবু কেন যে বাচ্চাটার নাম সে হাইতিতি রাখতে চাইছে। তারপরই এক গাল হেসে বলেছিল, আমরা ডাং খেলি না?

তা খেলিস। তোর তো কাজকাম না থাকলেই ডাং খেলার নেশা। তখন তোর পাত্তা পর্যন্ত পাওয়া যায় না। কোথায় যে লুকিয়ে পড়িস!

বেচারা পড়ে গেল মহা ফাঁপরে। ঠিক নালিশ গেছে তার নামে। সে তবু কিঞ্চিৎ চুপচাপ থেকে কী ভাবল-তারপর বলল, ডাং ছুঁড়ে দেবার সময় আমরা চিৎকার করি-হাই।

হাই! সে আবার কী?

জিজ্ঞেস কর না ম্যান্ডেলাদিদিকে। কী তুমি চুপ করে আছ কেন? তুমি খেল। আহা, কী ভালো মেয়ে সেজে বসে আছে!

শহরটায় মাউরি উপজাতির লোকেদেরও বাড়িঘর আছে। তবে ম্যান্ডেলা বোঝে না, তারা কেন গরিব হয়। গরিব বলেই তো ওয়াকা সেই বাচ্চা বয়স থেকে তাদের বাড়িতে আছে। তার সঙ্গে বড়ো হচ্ছে। ওয়াকা ফাঁক পেলেই ডাং খেলতে না চলে যায়। পাহাড়ের উপত্যকায় উঠে গেলে সে দেখতে পায় ওয়াকার বন্ধুরা তার অপেক্ষায় বসে আছে। এদের প্রায় সবার বাবা-মাই দিনের বেলা কাজে বের হয়ে যায়। কেউ রাস্তা পরিষ্কার করে। কেউ আঙুরের জমি চাষ করে মালিকের হয়ে। মেয়েরা দোকানে কাজ করে। বাজারে নানা কিসিমের মাছও বিক্রি করে। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্যও দলে দলে তারা বের হয়ে যায়। তখন বাড়ির কাচ্চাবাচ্চারা স্বাধীন। যে যার মতো হুটোপুটি করে বেড়ায় অথবা সমুদ্রের ধারে ঘোরে। কেউ গিয়ে জেটিতেও বসে থাকে। নাবিকদের পিকাকোরা পার্কে চিনিয়ে নিয়ে যায়।

ম্যান্ডেলা বলছিল, জানো বাবা, একটা ছোট্ট লাঠি, সাইপ্রাস গাছের ডাল কেটে তৈরি। জানো বাবা লাঠিটা না খুব ভারি। দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। এক লাইনে কেউ আগু-পিছু থাকতে পারবে না। তারপর না, দলের রাজা ঠিক হবে। তারপরে না, রাজা ডাং ছুঁড়ে দেবার সময় চিৎকার করে উঠবে—হাই। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে সবাই এক পায়ে লাফাতে থাকবে। তিতি তি—সবাই এক পায়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর মুখে তি তি বলছে। যে আগে যেতে পারবে, আগে কজা করতে পারবে ডাং সেই হবে ফের দলের রাজা।

বাবা বলেছিল, বা, সুন্দর খেলা তো। তা এই হাইতিতি খেলার সঙ্গী হতে পারি না আমি?

বাবা জাহাজ থেকে ফিরে এলে মাঝে মাঝে বড় ছেলেমানুষ হয়ে যেত। একবার তো সত্যি ওয়াকার সঙ্গে ডাং খেলতে চলে গেল।

মার এক কথা, তোর বাবা গেল কোথায়! ম্যান্ডেলাও জানে না, গেল কোথায়। বাবা বাড়ি নেই, ওয়াকাও নেই, এমনকী হাইতিতি নেই—তা ওয়াকা বাচ্চা হাইতিতিকে নিয়ে মাঝে মাঝে শহরে ঘুরতে বের হয়। কখনো ম্যান্ডেলা সঙ্গে থাকে। শহরটা না চিনলে হবে কি করে! তারা হাইতিতিকে নিয়ে পিকাকোরা পার্কেও বেড়াতে গেছে। মুশকিল, হাইতিতিকে দেখলে সব বাচ্চাদের কেন যে ল্যাজ গজিয়ে যায়। ভিড়ে হাঁটা যায় না কখনো। আর নানা প্রকারের দুষ্টুমি—কেউ কান টেনে দেয়—লম্বা কান বলে টানতে খুবই সুবিধা। কেউ ল্যাজ টেনে দেয়। কেউ আবার চিমটি পর্যন্ত কাটে। তখনই রেগে যায় ওয়াকা।—কি হচ্ছে, এটা কি বাঁদর,—এটা কি কুকুর! হ্যাঁ, তোরা বাচ্চাটার পেছনে লেগেছিস! জানিস ফুঁ মন্তরে বাঘ বানিয়ে দিতে পারি—জানিস ইচ্ছে করলে হাতি হয়ে যেতে পারে। বাঁদরামি করছিস, জাদুকরের কথা মনে নেই’ আর তখনই সবাই খুব ভালো ছেলে। একেবারে ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। তারা তো দেখেছে জাদুকরের সঙ্গী ওয়াকাকে। ওয়াকা বললেই তো জাদুকর যে যা চাইত দিত। দুষ্টুমি করলে জাদুকরকে বলত, না, দেবে না। তোমার পেছনে লুকাই প্যাক দিচ্ছিল। তুমি টের পাওনি! ওকে পাতার বাঁশিও দেবে না। জাদুকর পাইন পাতা দিয়ে সব সুন্দর সুন্দর বাঁশি বানিয়ে দিয়ে গেছে তাদের। এখনও তারা পাইন ফেস্টিভ্যালের দিন, পাতার বাঁশি বের করে সমস্বরে আশ্চর্য মিউজিক তৈরি করে। তখন শহরের লোকজন না বলে পারে না, ভাগ্যিস জাদুকর বসন্তনিবাস জাহাজে করে এসেছিল, পাতার বাঁশি বানিয়ে দিয়েছিল বাচ্চাদের, না দিলে এমন একটা সুন্দর বন্দর শহরে এই আশ্চর্য মিউজিকের খবরই কেউ পেত না। এখন তো নানা সাজপোশাকে পাইন পাতার পোশাক পরে সবাই যখন শহরের বড় গির্জার দিকে হাঁটে তখন এই মিউজিক শোনার জন্য রাস্তার পাশে, ঘরের ছাদে, জানালায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। জাদুকর বলেই সম্ভব, যেন এই শহরে সবই ছিল— ছিল না কোনো অকল্পনীয় মিউজিক। যার স্রষ্টাও জাদুকর নিজে। সে সেবারে মিছিলটি নিজেই পরিচালনা করছিল। তার লম্বা আলখাল্লার উপর পাইন পাতার নানা বাহার। ওয়াকাই বুঝিয়েছিল, তুমি জান না বসন্তনিবাস, এটা আমাদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। সারাদিন সারারাত উৎসব চলবে। যে যার মতো বাহারি মিছিল বের করবে। আমরা বের করব বাঁশির মিছিল। সবার হাতে থাকবে পাইন পাতার বাঁশি, তুমি তো সুন্দর সুন্দর বাঁশি বানিয়ে দিয়েছ আমাদের। মন ভালো না থাকলে আমরা সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরি আর বাঁশি বাজাই। বাঁশির সুর কতদূর থেকে শোনা যায়! আর কি সুমিষ্ট। তখন মানুষের তো দুঃখকষ্টও থাকে না। তোমার হাতেও থাকবে লম্বা পাইন পাতার বাঁশি। ক্লারিওনেটের মতো লম্বা। তুমি যে সুর দেবে, সেই সুরে আমরা বাঁশি বাজাব। শহরের লোকজন বুঝতে পারবে, কত বড়ো ওস্তাদ লোক তুমি।

সুতরাং ম্যান্ডেলার কেন যে মনে হয়েছিল, বাবা, ওয়াকা কোথাও কোনো নির্জনে বসে পাতার বাঁশি বাজাতে পারে। কে জানে, বাবা হয়তো চুপি চুপি বলছে-’এই ওয়াকা, আমাকে দিবি একটা পাতার বাঁশি। আমি বড়ো হয়ে গেছি বলে কি বাঁশি বাজাতে পারি না। ছোটোরা যা পারে, বোরাও তাই পারে। ছোটোদের মতো বড়োদেরও ইচ্ছে হয় পাতার বাঁশি বাজিয়ে যদি দুঃখকষ্ট ভুলে থাকা যায়। তা জাহাজে উঠলে তো ফেরার দিনক্ষণ ঠিক থাকে না। কবে জাহাজ ফিরবে কেউ জানেও না। পাঁচ-সাত মাস এমনকী কখনও বছর কাবার হয়ে যায়। তখন তো বাবার মন বাড়িঘরের জন্য খারাপ লাগতেই পারে। পাতার বাঁশি বাজাতে জানলে, মানুষের যে দুঃখকষ্ট অনেক লাঘব হয় বাবাও বোধ হয় টের পেয়েছিলেন।

বেশ বেলা হয়ে গেছিল বাবার ফিরতে।

মা কেবল ঘরবার করছিল।

গেল কোথায়? দ্যাখ না ম্যান্ডেলা সে গেল কোথায়। আরে ওয়াকার না হয় কাণ্ডজ্ঞান থাকতে না পারে, তাই বলে সে না বলে কয়ে সকালে বের হয়ে গেল!

ম্যান্ডেলার কি যে তখন রাগ হচ্ছিল। তাকে ফেলে চুপচাপ বাবা চলে গেল। একবার বলতেও পারল না, আমরা যাচ্ছি, তুই যাবি! ওয়াকা বাবার এত প্রিয় হয়ে গেল! সে তার বাবার কেউ না!

ম্যান্ডেলার তখন এক জবাব, জানি না, কোথায় গেছে তারা। আমি জানব কী করে। মাছ ধরতে গেলে ছিপ হুইল ঘরে পড়ে থাকত না। মাছের খবর ওয়াকা ভালো জানে। সমুদ্রে সারভিনের ঝাঁক কখন উঠে আসে সেই ঠিক খবর দিতে পারে। মাছ ধরার নেশা ওয়াকারও কম নেই। তার দাদুর ছোট্ট সরু সাদা নৌকাটির সে মালিক। দাদু ছিলেন মাছ মারার ওস্তাদ লোক। মৃত্যুর আগে নৌকাটি নাকি ওয়াকাকে দান করে গেছেন। আর নৌকাটিরও আছে নানা বাহারি শখ। সে যেদিকে যেতে চায়, যেতে দিতে হয়। যেমন চিংড়িমাছ বড়ো বড়ো—প্রায় হাতখানেক এক একটা লম্বা—নৌকাটিই তার খবর জানে, কোথায় আছে কী মাছ! —সমুদ্রে কবে যে নৌকাটি ভাসানো হয়েছিল কেউ জানে না। সরু ছিপনৌকা। খুবই ছোটো। একজনের বেশি আরোহী উঠতে পারে না। আর এর আশ্চর্য ক্ষমতা বিশাল বিশাল ঢেউ অবলীলায় পার হয়ে যাওয়া। যতই ঝড় থাকুক সমুদ্রে, হাল ঠিক রাখতে পারলে সাধ্য কি ঢেউ নৌকাটিকে গ্রাস করতে পারে! চেষ্টার ত্রুটি নেই। নৌকাটি ভাসলেই সমুদ্রের তর্জন গর্জন শুরু হয়। আবার তুমি! দেখাচ্ছি মজা। দু-হাত তুলে, হা রে রে করে ঢেউগুলি নৌকাটিকে তেড়ে আসে। ওয়াকা নিপুণভাবে সমুদ্রের ওপর তার নৌকা ভাসিয়ে দূরে দূরে চলে যায়। এটাও তার এক ভারি মজার খেলা। ফেরার সময় নৌকায় থাকে নানা রঙের ঝিনুক, শঙ্খ, চিংড়িমাছ বড়ো বড়ো। আর সারডিন মাছ। সে নৌকার খোল থেকে মাছগুলি যখন সমুদ্রের কিনারে নামিয়ে আনে, ম্যান্ডেলার কি আনন্দ। বেছে বেছে তাজা আর সুস্বাদু মাছগুলি ম্যান্ডেলা দিদির জন্য রেখে দেয়। বাকি সব দিয়ে দেয় তার জাতভাইদের। সে মাছ কখনো বিক্রি করে না।

ওয়াকা সমুদ্রে গেছে খবর পেলেই তার জ্ঞাতিভাইরা সব ছুটে আসবে বেলাভূমিতে। ওয়াকা যখন মাছ ধরতে গেছে, তখন সে খোল ভরতি করে মাছ শিকার করে ফিরবেই। সবাই ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকে। ওয়াকা নৌকা টেনে বালিয়াড়িতে তুলে আনলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ওয়াকা তখন খুব গম্ভীর। সে বেশ বড়োদের মতো তখন কথা বলে।

লাইন দিয়ে দাঁড়াও।

সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যায়।

এস এক এক করে।

সবাই এক এক করে এলে ভালোমন্দ মিশিয়ে মাছ তুলে দেয়।

কাজেই বাবা ওয়াকার পাল্লায় পড়ে মাছ শিকারেও যেতে পারে। ওয়াকার তো মাথার ঠিক নেই—এক ভেবে বাবুর সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছে, আর এক ভেবে নৌকায় উঠে গেছে! বাবা যে তার কত ছেলেমানুষ তখনই টের পায় ম্যান্ডেলা। তা না হলে বাড়ির কাজের ছেলেটি কখনো মনিবের মতো কথা বলতে পারে-’চলুন কর্তা বাঁশি বাজাইগে। চলুন কর্তা ডাং খেলিগে। চলুন কর্তা মাছ শিকারে। আরে কারও বাবা কি এমন হলে হয়! নিজের মর্জির কথা বুঝতে হয় না। ওয়াকার মর্জিতে যেখানে সেখানে চলে যাওয়া কি ঠিক?

কাজেই ম্যান্ডেলার গোঁসা হবে না তো কার হবে! তার দায় পড়েছে, কোথায় গেল তারা রোদে বের হয়ে খুঁজতে হবে। ডাকাডাকি করতে হবে।

বাবা কেন যে জাহাজ থেকে ফিরলে এত ছেলেমানুষ হয়ে যেত সে বুঝত না। এটাই ছিল তার ক্ষোভের কারণ। যেন ওয়াকা বাড়ির কাজের ছেলে নয়, বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

সেই বাবা আর ওয়াকা ফিরে এল। পাইনের জঙ্গল ভেঙে উপরে উঠে এল। হাইতিতিও ফিরছে। তিনজন একেবারে যেন বিশ্বজয় করে ফিরেছে। তিনজনের কাছেই পাইন পাতার বাঁশি। বাবারটা হাতে, ওয়াকারটা পকেটে গোঁজা আর হাইতিতির বাঁশিটা বগলে।

এখন কেন যে মনে হয়, জাদুকর শহরের শিশুদের খুশি করার জন্য, যে যা চেয়েছে দিয়ে গেছে। যেমন ওয়াকাকে দিয়ে গেছে পাতার বাঁশি। পাইন পাতা দিয়ে কি সুন্দর বাঁশি বানানো যায় সে-ই শুধু জানে। আর সবাই যে চেষ্টা না করেছে তা নয়, কিন্তু পাতা মুড়ে বাঁশি হয় তবে কোনো সুর থাকে না। ফুঁ দিলে সুমিষ্ট সুর ভেসে বেড়ায় না। ওয়াকাকে এই জাদুবিদ্যা দেওয়ায় সে কি খুশি। ওয়াকা তো জানে না, তাকেও দিয়ে গেছে পালকের টুপি, হাইতিতিকেও দিয়ে গেছে রুপোর ঘণ্টা। ওয়াকা মনে করে জাদুকর কেবল তাকেই ভালোবাসত। ম্যান্ডেলাদিদিকে সেই তো জাদুকরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেই ম্যান্ডেলাদিদি যে আরও আশ্চর্য টুপির মালিক ওয়াকা জানেই না। ওয়াকার এত অনুগত ছিল বসন্তনিবাস যে সে ছাড়া কাউকে কোনো জাদুবিদ্যার অধিকারী করবে বিশ্বাস করতে পারত না। অন্তত যেদিন বসন্তনিবাস জাহাজে চলে গেল সেইদিন তো মনে হয়েছিল, ওয়াকাই জাদুকরের প্রিয়জন। সে শহরের সব শিশুদের এনে জড় করেছিল জাহাজঘাটায়। বড়ো বড়ো ক্রেনের নীচে দাঁড়িয়ে তারা সাদা রঙের পোশাকে বিদায় জানিয়েছিল জাদুকর বসন্তনিবাকে। তারা সবাই একটি আশ্চর্য মেলডি পাতার বাঁশিতে সৃষ্টি করেছিল। সেই সুরে কান্না পায়নি, এমন একটি শিশুও ছিল না জেটিতে। ম্যান্ডেলা আর ওয়াকা মাঝখানে। তাদের দুজনের মাঝখানে হাইতিতি। হাইতিতি পর্যন্ত অপলক দেখছিল, জাহাজে সেই ক্ষেপাটে নাবিক দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত জাহাজের ছোটোবাবু ওয়াকাকে কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিল, নজর রেখ। জাহাজ থেকে পালিয়ে কোথায় যে গিয়ে বসে থাকে—আমরা খুঁজতে বের হই। দেখছ তো কেমন কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পরে জাহাজ থেকে নেমে আসে! লক্ষ্মী ছেলে, খবর দিতে পারলে জাহাজের কাপ্তান খুশি হবে। ওয়াকা জাদুকরকে ক্ষেপাটে লোক বলায় খুবই ক্ষুব্ধ হত। তবে প্রকাশ করত না। সে বলত, ছোটোবাবু, জাদুকর কখনো ক্ষেপাটে হয়! আমরা যা চাই তিনি তাই দেন। চাইতে জানতে হয়। তবে আপনি স্যার, যখন বলেছেন, জাহাজে পৌঁছে দিতে, যতই রাত হোক বসন্তনিবাসকে আমরা জাহাজে ঠিক পৌঁছে দেব। যত রাতই হোক ওয়াকা বসন্তনিবাসকে জাহাজঘাটায় পৌঁছে দিত। জাহাজের ছোটোবাবু এবং আরও দু-চারজন নাবিক টর্চ হাতে সি ম্যান মিশানের সামনে অপেক্ষা করত। ওয়াকা বসন্তনিবাসকে যত রাতই হোক জাহাজঘাটায় পৌঁছে দেবে এমন বিশ্বাস তাদের যথেষ্টই ছিল। ‘ সেই ওয়াকা পাতার বাঁশি পেয়েই খুশি। জাদুকরের জন্য মন খারাপ হলে, সে চুপচাপ জাদুকরের মূর্তির পায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকে। শহরের মানুষেরা অবাক হবে না! জাদুকর জাহাজে চলে গেল, ওয়াকা তার ব্যান্ড বাজিয়ে বিদায় জানাল–হাজার হাজার বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হল বাতাসে–আর সাদা জাহাজ যত দূরে যায়, তারা দেখতে পায়, জাদুকর একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে ডেকে। শিশুদের উদ্দেশে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে—যেন বলতে চায় সব শিশুদের মনেই আছেন। একজন জাদুকর—যে তাকে যে-ভাবে চিনতে পারে। সাদা জাহাজ নীল জলে ক্রমে অদৃশ্য হয়ে গেলে ওয়াকা ফিরে এসেছিল—আর কি কান্না! বোধহয় জাদুকর ওয়াকার কষ্ট টের পেয়েই মাস কাবার না হতেই বেলাভূমিতে এসে তিনি পড়ে থাকলেন। সেই এক পোশাক। একই রকমের নাগরাই জুতো, মাথায় ময়ূরের পালক—একেবারে রাজবেশ। জাদুকর ছিলেন রক্তমাংসের, হয়ে গেলেন শেষে সাদা পাথরের মূর্তি।

আর তাই না দেখে শহরবাসীদের চোখ কপালে উঠে গেল। একজন জাদুকর যদি পাথরের মূর্তি হয়ে শহরের শিশুদের কাছে ফের ফিরে আসেন, তবে তাঁকে অবহেলা করা যায় না। বাচ্চাদের শুভ-অশুভ বলে কথা। সব বাবা-মারাই তো চায় তাদের শিশুরা বড়ো হয়ে উঠুক—পৃথিবীর তাবৎ স্বপ্ন নিয়ে। নগরপাল সভা করলেন তখন, এই মূর্তি নিয়ে কি করা। শিশুরা দাবি করল, বেলাভূমিতেই মূর্তিটি বসিয়ে দেওয়া হোক। গড়ে তোলা হোক সুন্দর একটি বাগান। বাগানে নানা ফুলের গাছ লাগিয়ে দেওয়া হোক। আর যেসব পাখিরা ফুল ভালোবাসে মধু খেতে ভালোবাসে তাদের বলা হোক, এখানেই এসে তোমরা থাকবে। কেউ তোমাদের ক্ষতি করবে না।

৪.

দূর থেকে যত শহরের কাছে উড়ে যাচ্ছে তত ম্যান্ডেলা উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। প্রথমেই দেখতে পাবে সেই বিশাল পর্বতশ্রেণি। এগমণ্ড হিলের শৃঙ্গগুলি বরফে ঢেকে থাকে। রোদের বর্ণছটায় ঝিকমিক করে পাহাড় চূড়ো। কখনো মনে হয় সোনালি পাহাড়। কখনো রূপালি পাহাড়। তার সেই বর্ণছটায় রাতেও কেমন শহরটা বিভোর হয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়বে অনন্ত হয়ে আছে সেই পাহাড়ের দেশটা। সে এত জায়গায় উড়ে গেছে নিজের এই পাহাড়টির ওপরে কখনও উড়ে যায়নি। দু-চোখ মেলে তার প্রিয় এই পাহাড় দেখার ইচ্ছে কেন যে হয়নি বোঝে না। দূর থেকে পাহাড় যত রহস্যময় ঠেকে, কাছে গেলে তা হারিয়ে যেতে পারে। এই আতঙ্কেই হয়তো সে কখনো পাহাড়ের ওপর দিয়ে উড়ে যায়নি। যেন পাহাড়টা আছে থাক। সে তার রহস্য নিয়ে সারাজীবন ম্যান্ডেলার মনে বেঁচে থাক। উড়ে গেলেই দেখতে পাবে, সেই একই বনভূমি, নদীর খাদ কিংবা যেমন আর দশটা পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে আসে তেমনি কোনো নিরাভরণ ঝরনা নিয়ে জেগে আছে পাহাড়টা। দিন রাত জল পড়ার ঝরোঝরো শব্দ যদি কখনো একঘেয়ে মনে হয়, তবে যেন পাহাড়ের মহিমা খাটো হয়ে যাবে।

তারপর আরও কাছে গেলে সে দেখতে পাবে পাহাড়ের কোলে সব আপেল কমলালেবুর বাগান, পাকা সড়ক—লাল-নীল কাঠের বাড়ি। গাছগুলিতে আপেল আর আপেল। গোলাপি কিংবা টকটকে সিঁদুরের রং আপেলের গায়। উপত্যকায় এই আপেলের বাগানগুলি কি যে টাটকা আর তাজা! মাঝে মাঝে এখানে সেখানে কৌরিপাইনের জঙ্গল, নীচে আবাদের ভূমি কিংবা মেষপালকরা অস্থায়ী কুটীর বানিয়ে চলে আসে এখানে। সারাদিন তারা ভেড়ার পাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘাস খাওয়ায়। রাতে মাঠের মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকে ভেড়ার পাল। অঁতোগুতিও করে— তখন মেষপালকের কাজ ছুটে যাওয়া। ঝগড়া থামিয়ে দিতে না পারলে শিং-ফিং ভেঙে রক্তপাত। বড় বিশ্রী ব্যাপার। মেষপালক কুটীরে শুয়ে থাকে খড়ের বিছানায়। কখনো সে নির্জন প্রান্তরে সেই বাঁশি বাজায়। যা দিয়ে গেছে বসন্তনিবাস সবার হাতে হাতে।

নীচে সেই সমুদ্র কিংবা দ্বীপটিকে শুধু সে দেখতে পাচ্ছে। দুটো একটা জেলেডিঙিও দেখতে পেল। সকাল হচ্ছে। এবারে দূরে এক ঝলক আলোর মতো পাহাড়টা চোখে ভেসে উঠল। তার চোখ বাঁধিয়ে গেছে। তুষারশৃঙ্গে সূর্যোদয়ের সময় তাকালে যা হয়! সে কেমন মুহ্যমান হয়ে পড়ে। হাইতিতি উড়ে যাচ্ছে আরও বেগে। সে বোধহয় ভেবেছে ম্যান্ডেলার আগে পাইনের বনভূমিতে টুপ করে নেমে পড়বে। হাইতিতির এই এক দোষ। কিছু বুঝতে চায় না। মাঝে মাঝে গোয়ার্তুমিও করে ফেলে—সে যা বলে হাইতিতি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। বোঝে না— সমুদ্রপাখিরা পথ ভুল করে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারে। সমুদ্রের উপর উড়ে যাওয়া এমনিতেই কঠিন—কেবল ম্যান্ডেলা জানে, সে বাড়ি ফিরছে, বাড়ির জন্য তার মন খারাপ, মাকে দেখার জন্য সে উত্তেজিত হয়ে আছে—পালকের টুপি জানে, সে কি চায়। জানে বলেই সে বাড়ি ফিরে যেতে পারছে

হাইতিতির তা না। হাইতিতির মা-বাবার কথাও বোধহয় মনে নেই। সমুদ্রে ঝাঁক ঝাঁক পাখি দেখলেই সে তাদের সঙ্গে খেলা করে বেড়ায়। উড়ে বেড়ায়, ওরা যদি কোনো দ্বীপের দিকে ধাওয়া করে, সেও পিছু নেয়। পিছু নিলে তাদের যে নিজের দেশে ফেরা হবে না হাইতিতি বোঝে না। এত বোকা। ডাকলেও শোনে না। তখন আর কি করা। অগত্যা ছুটে যেতে হয়, ডাকতে হয়, হাইতিতি ভালো হচ্ছে না। পাখিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ভালো। কিন্তু পাখিরা জলে ভেসে থাকতে পারে, ঘুমাতে পারে, তুমি পারবে ডালে বসে থাকতে, ঘুমাতে পারবে। খাবে কি? পাখিরা ছোঁ মেরে সমুদ্র থেকে মাছ তুলে নিতে পারে দরকারে! তুমি পারবে। তোমার কি আর কখনো কাণ্ডজ্ঞান হবে না!

কে শোনে কার কথা।

অগত্যা ছুটে গিয়ে কান টেনে ধরতে হয়—

বলতে হয়, ওদিকে নয়, এদিকে। ওদের সঙ্গে কোথায় রওনা হলে ফিরছি বাড়ি, মন ভালো নেই, মা কত চিন্তা করছে আর তুমি পাখিদের দেশে উড়ে যেতে চাও। সে না হয় যাওয়া যাবে। ওড়া তো তোমার ফুরিয়ে যায়নি। ম্যান্ডেলাদিদি তোমাকে একবার পাখিদের দেশও ঘুরিয়ে আনবে। এখন চল। লক্ষ্মী ভাইটি।

হাইতিতি রেগে যায়।

তুমি আমার কান ধরলে কেন?

একশোবার ধরব।

আমি যাব না।

হাইতিতি ভালো হচ্ছে না। নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শেখ। আমি চিরদিন থাকছি না যে তোমাকে পাহারা দিয়ে বেড়ায়।

হাইতিতির রাগ জল। সত্যি তো ম্যান্ডেলাদিদি না থাকলে সে খুবই বিপদে পড়ে যাবে। সে একেবারে তখন খুবই অনুগত হয়ে যায়। আমি চিরদিন থাকছি না’ ম্যান্ডেলাদিদি শুধু বলে না, বুচার মামাও বলে। লুসি মাসিও বলে। ম্যান্ডেলাদিদি উৎপাত শুরু করলেই লুসি মাসি বলবে, ম্যান্ডেলা নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শেখ। আমি চিরদিন থাকছি না, যে তোমাকে পাহারা দিয়ে বেড়ায়।

ছোটোরা যে বড়োদের কথাই অনুকরণ করে—ম্যান্ডেলাদিদির শাসনে এটা সে ভালোই টের পায়। ছোটোরা বড়োদের কাছেই সব শেখে। বজ্জাতিও। তবে ম্যান্ডেলাদিদি খুবই সরল। আর মনটাও খুব ভালো। তার যে ভালো চায় হাইতিতি তাও বোঝে। সে আর পাখিদের ঝাঁকের পেছনে ধাওয়া করে না। কিংবা পাখিদের মতো ডিগবাজিও খায় না। সত্বর বাড়ি ফেরা দরকার। মা-র জন্য মন খারাপ পাখিদের সঙ্গে ওড়াউড়ির খেলা পছন্দ নাই করতে পারে। সে দুষ্টুমি করলে রেগে তো যাবেই। পাখিরা কেন তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। আর পাখিরা তাকে দেখতে পায় কিনা তাও সে বোঝে না। তার গলায় ঘণ্টা বাজলে শব্দ হয় ঢং ঢং। তাকে দেখতে না পাক ঘণ্টার শব্দ ঠিকই টের পায়। তখন পাখিদের মধ্যে কলরব পড়ে যায়। উড়তে উড়তে যদি পাখির ঠ্যাং ধরে ফেলে—তবে খুব জব্দ। কিন্তু ম্যান্ডেলাদিদি তেড়ে আসবে।

এই হাইতিতি, হচ্ছেটা কি! ছেড়ে দাও। কাউকে জব্দ করাও মোটা বুদ্ধির লক্ষণ। তোমার খেলা আর একজনের প্রাণসংশয়। ঠ্যাং ভেঙে গেলে, পাথা মচকালে, পাখিটা আর উড়তে পারে! দেব তোমার ঠ্যাং ভেঙে। বুঝবে মজা। কারও অনিষ্ট করলে তোমার অনিষ্ট হতে পারে বোঝো না। বয়স তো কম হল না–ধেড়ে বাঁদর কোথাকার।

তুমি আমাকে বাঁদর বললে।

বাঁদরামি করলে বাঁদর বলব না তো কি বলব।

পাখিদের সঙ্গে তো খেলা করছিলাম। বাঁদর বললেই হল।

এটা খেলা! খেলা বোঝ না। একজনের খেলা, আর একজনের প্রাণসংশয় এটা তোমার কাছে খেলা হতে পারে—কিন্তু পাখির জীবনসংশয় বোঝো! তুমি তাকে আদর করতে চাইছ বুঝবে কী করে। সে তো ছটফট করবেই। এস।

আবার হাওয়ায় ভেসে চলে তারা।

এগমন্ট হিল চোখের ওপর ক্রমশ বড় হচ্ছে। এবারে শতরঞ্জের মতো পাহাড়তলি ভেসে উঠেবে চোখে। একবারে দাবার ছকের মতো মনে হয়। গাছপালা স্পষ্ট নয়, ধীরে ধীরে সব এবারে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তার শরীর আর ততটা হালকা নেই যেন। গতি কমে আসছে।

আর তার যে কি হয়। দেশে ফেরার সময় মনে হয়, সে হয়তো বাড়িতে গিয়েই দেখবে, বাবা তার ফিরে এসেছেন। ম্যান্ডেলাকে বাড়িতে দেখতে না পেলে ছটফট করবেন সে জানে। বাবা যদি জানে, ম্যান্ডেলা তাকে খুঁজতে বের হয়েছে খুশিই হবে। তবে বাবা রাগও করতে পারে। বলতেই পারে, তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে ম্যান্ডেলা, তুমি আমাকে কোথায় খুঁজতে বের হয়েছিলো তোমার এই দুর্জয় সাহস হল কী করে? তখন তো সে বলতে পারবে না, জান বাবা জাদুকর না আমাকে একটা পালকের টুপি দিয়ে গেছে। হাইতিতিকে রুপোর ঘণ্টা। আমার মুখ ব্যাজার দেখে জাদুকরের মনে দয়া হয়েছিল।

এটাও ঠিক, বাবা ফিরে এলে সে আর ওড়াউড়ি করতে পারবে না। জাদুকর বলেই দিয়েছে, টুপিটা পরলে তুমি যেখানে খুশি ইচ্ছে করলে উড়ে যেতে পারবে, বাবাকে খুঁজে বেড়াতে পারবে। বাবা তোমার ফিরে এলেই পালকের টুপি হারিয়ে ফেলবে। বাবা ফিরে না আসা তক তুমি ছোটো থাকবে। বয়স বাড়বে না। বড়ো হয়ে গেলে তুমিও একজন তখন অবিশ্বাসী হয়ে যাবে। অবিশ্বাসীদের জন্য কখনো কোনো পালকের টুপি থাকে না। জীবনে কিছু পেতে হলে, কিছু হারাতে হয়, এও জাদুকর তাকে বলে গেছেন। সে তার বাবাকে ফিরে পেলে, পালকের টুপি হারিয়ে ফেলবে।

ম্যান্ডেলা যদি গিয়ে দেখে বাবা সত্যি ফিরে এসেছেন—ইস—সে আর একদণ্ড স্থির থাকতে পারছে না! সে সব হারাতে রাজি, তার পালকের টুপিও-বাবা ফিরে এলে, তার আর কিছুর দরকার হবে না। যেন গিয়েই দেখতে পারে, দেয়ালের হুকে বাবার জাহাজি টুপি ঝুলে আছে। বাবা ফিরে এলে কত কিছু নিয়ে আসতে পারে। তাহিতি দ্বীপের রঙিন পাথর বাবা তাকে এনে দেবে বলেছেন। দামি পাথরের মালা পরে সে ঘুরে বেড়াতে পারবে। তার জন্য হনলুলু দ্বীপের টিয়া পাখির মুখোসও নিয়ে আসতে পারেন। মুখোস পরে সে, ওয়াকা আর হাইতিতি চলে যাবে জাদুকরের মূর্তিটির নীচে। তারপর তারা গান গাইবে। পাতার বাঁশি বাজাবে ঘুরে ঘুরে। জাদুকরের দয়াতেই বাবা যে একদিন ফিরে আসবেন, এই বিশ্বাস তার আছে। সে জানে না, জাদুকরের মনে কি আছে? তিনি যদি চান, তার বাবা ফিরে আসুক, তবে যত সাত সমুদ্র তের নদীর পারেই বাবা তার থাকুক না, ঠিক ফিরে আসবে।

আর তখনই এটা কি দেখতে পাচ্ছে!

সমুদ্রের জল তোলপাড় করে বিশাল একটা হাঙর তেড়ে যাচ্ছে কাকে। আরে করছে কী, জল যেন পাহাড় কেটে দু-ভাগ হয়ে গেছে। সমুদ্রের জলে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে—আরে মাছটা কি ক্ষেপে গেছে! ক্ষেপে যাবার কি কারণ। তার বাবার কথা মনে থাকল না, বাড়ির কথা মনে থাকল না—এমন একটা রাক্ষুসে দৈত্য তাদের সমুদ্রে এসে হাজির—আর হাঁ করে কাকে তাড়া করছে। তারপরই ম্যান্ডেলার চক্ষুস্থির। ওয়াকা আর তার ছিপ-নৌকাটি গভীর সমুদ্রে মোচার খোলের মতো নামছে উঠছে, কাত হচ্ছে। সে কি ধরে আছে ঠিকমতো? আর নীচে নামতেই টের পেল ওয়াকা তার ঠাকুরদার ছিপ নিয়ে গভীর সমুদ্রে চলে এসেছে। ছিপটার সুতো ছেড়ে দিয়েছে—এবং নীল হাঙরের গলায় আটকে গেছে বিশাল একটা বঁড়শি। মাছটা তো ক্ষেপে যাবেই। ছলচাতুরী করে মাছটাকে লোভে ফেলে দিয়ে ওয়াকা এতক্ষণ মজা দেখছিল বোধহয়। বঁড়শি গেঁথে গেলে মাছটা এত হিংস্র হয়ে উঠতে পারে সে হয়তো অনুমানই করতে পারেনি।

বোঝো মাছ ধরার মজা!

বোঝো এবার কার পাল্লায় পড়ে গেছ!

দেখছ না, কী দ্রুত ছুটে আসছে। আরে ওয়াকা সুতো কেটে দাও। ছেড়ে দাও। তুমিও যাবে, মাছও যাবে।

তারপরই মনে হল, সে কাকে বলছে! কে তার কথা শুনবে! তার কথা আকাশে ভেসে থাকলে কেউ শুনতে পায় না। তবে হাইতিতির ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। বোধহয় ঘণ্টার শব্দেই চকিতে একবার ওপরের দিকে তাকিয়েছিল, তার খেয়ালও নেই যেন দ্রুত ছুটে আসছে একটা অতিকায় হাঙর। থামের মতো কালো শিরদাঁড়া ভেসে আছে। লাফিয়ে ঢেউ-এর মাথাও উঠে গেল। সাদা পাথরের মতো পেটের মাংস থলথল করছে। ধারালো অজস্র দাঁতগুলি রৌদ্রকিরণে চকচক করছে —যেন খুঁজছে কোথায় আছে সেই আততায়ী এবং লাফিয়ে ঢেউ-এর মাথায় ভেসে উঠেই তলিয়ে যাচ্ছে। আবার ভেসে উঠছে।

ওয়াকা মরবে।

মরণের ওষুধ কানে ঝুলিয়ে বেড়াচ্ছে।

কি সাহস!

বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়।

ওয়াকা, ওয়াকা?

সে শুনতে পাবে কেন, মাথার ওপর ম্যান্ডেলাদিদি উড়ে ওকে ডাকছে। সতর্ক করে দিচ্ছে।

ঘণ্টার শব্দে কি তবে টের পেয়ে গেছে, যাক কাছে কোথাও ম্যান্ডেলাদিদি আর হাইতিতি আছে। তার আর ভয় নেই, সে বুঝছে না কেন, রাক্ষুসে মাছটা ল্যাজের এক ঝাপটায় তার নৌকা তলিয়ে দিতে পারে। নৌকা তো নয়, যেন একটা ডোঙা। বাবা যদি ফিরে আসেন, ওয়াকার এই দুর্জয় সাহসও তিনি পছন্দ করতে পারেন। ধমক দিতে পারেন, প্রাণ হাতে করে মাছটার সঙ্গে লড়লে! তোমার এত সাহস, একা একা গভীর সমুদ্রে ঢুকে গেছে! মাছটা তোমার কোনো অনিষ্ট করেছে!

অবশ্য পলকের ভাবনা, কিন্তু মাছটা যে ওয়াকার নৌকা দেখতে পাচ্ছে না বোঝাই গেল। কারণ একেবারে পাশ কাটিয়ে দূরে গিয়ে ভেসে উঠল।

জলের ঝাপটায় ওয়াকার জামা প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। ঢেউ এসে তাকে এবং নৌকাটাকে ডুবিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। সে টাল খেয়ে একবার পড়েও গেল। আবার উঠে দাঁড়াল। হুইল থেকে সুতো ছেড়ে দিচ্ছে। আবার গুটিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ওস্তাদ মাছ শিকারির মতো তার ভাবভঙ্গি ওয়াকা নুয়ে কী খুঁজল! আবার মাছটা ঢেউ-এর মাথায় লাফ দিয়ে উঠে গেল। কিনার দেখা যাচ্ছে না। শহরবাসীরা কেউ জানেই না, ওয়াকা আজ মরণ খেলায় মেতেছে—হয় মাছ শিকার করে বেলাভূমিতে ফিরবে নয় সে নিজেকে নিঃশেষ করে দেবে।

ম্যান্ডেলা ইচ্ছে করলে নৌকায় নেমে যেতে পারে। কিন্তু এত পলকা নৌকায় সে নামলে, তার ভরে যে নৌকাটা ডুবে যাবে না কে বলতে পারে। সে পাটাতনে নেমেও যেতে পারছে না। সে ভাবল, যদি মাছটাকে মুক্তি দেওয়া যায়। কি যে। করে! এত শক্ত সুতো যে হাঙরের দুর্ধর্ষ ধারালো দাঁত পর্যন্ত অকেজো। অথবা মাছটার হৃৎপিণ্ডে যদি বঁড়শি গেঁথে যায় তবে মাছটা নিজের ছটফটানিতেই অস্থির হয়ে উঠেছে। দাঁতে বঁড়শি কেটে দেবার কথা বেমালুম ভুলে যেতে পারে—এই সব সাত-পাঁচ ভেবেই সে আলগাভাবে ওয়াকার মাছ কাটার ধারালো ছোট্ট ছুরিটা তুলে ঘ্যাঁচ করে সুতো কেটে দিল। মাছটা ফিরে যাক নিজের দেশে, যে যার মতো সুখে থাক ভেবেই কাজটা করেছে। এ ছাড়া যেন ওয়াকার প্রাণ রক্ষা করার উপায় তার জানা ছিল না।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। মাছটা ঠিকই ওয়াকাকে দেখেছে, তার নৌকাটাও। এতক্ষণ ওয়াকাই ছিল সবল প্রতিপক্ষ। সুতোয় টান দিলেই মাছের অন্তরাত্মা থরথর করে কাঁপে! সে অবশ হয়ে যায়। প্রতিপক্ষ সবল বুঝতে কষ্ট হয় না। এবার যেন মাছটা ছাড়া পেয়ে আরও হিংস্র হয়ে উঠল। ঢেউ-এর ওপর লাফিয়ে ডিগবাজি খেল দু-বার। জলে বিশাল ঘূর্ণি তুলে ভেসে বেড়াতে থাকল— ওয়াকা হতাশ। সে জানে তার বুঝি রক্ষা নেই—এতক্ষণ সে ছিল সবল প্রতিপক্ষ, এক মুহূর্তে সুতো ছিঁড়ে যাওয়ায় সে কত দুর্বল হয়ে গেছে, হতাশ মুখ দেখে টের পেল ম্যান্ডেলা।

সমুদ্রের নীল জলে মাছটা চক্কর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে এবার মরণ খেলায় বুঝি মাতবে। নৌকাটার চারপাশে বেশ দূরে সে মুখ তুলে বিশাল হাঁ করল তারপর ডুব দিল। সমুদ্রের বিশাল ঢেউ ঝাপটা মারছে। ওয়াকা সত্বর তার সব গুটিয়ে নিয়ে ভেগে পড়ার তালে আছে। সে হয়তো জানে, অতিকায় মীনটি সমুদ্রের নীচে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার খোঁজে। এবং নীল জলরাশি ভেদ করে যে কোনো মুহূর্তে তার নাকের ডগায় লাফিয়ে পড়তে পারে। তারপর ওয়াকাকে গিলে খেতে পারে।

ম্যান্ডেলা ভেবে পাচ্ছে না—কী করবে! সে কেমন অস্থির হয়ে পড়ছে। ওয়াকার কিছু হলে কি যে হবে! সে খুবই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সে নৌকার ঠিক মাথার ওপরই ওড়াউড়ি করছে। হাইতিতি একবার নৌকায় নেমে যেতে চেয়েছিল, তার ল্যাজ ওয়াকার পিঠেও মাঝে মাঝে লেগে যাচ্ছে। পিঠে সুড়সুড়ি লাগছে–ওয়াকা জানে হাইতিতির ঘণ্টা এভাবেই বাজে। রাতে অদৃশ্য হবার মুখে শহরবাসীদের মতো সেও শুনতে পায় আকাশে ঘণ্টাধবনি করে কারা চলে যাচ্ছে। শহরবাসীদের তখন এক কথা, লুসির ভূতুড়ে মেয়েটার কাজ। শিশুরা বলবে, জাদুকরের কৃপায় এটা হয়। মানুষ ইচ্ছে করলে উড়তে পারে না, এমন অবিশ্বাসী তারা নয়। মানুষই সব পারে। জাদুকর ইচ্ছে করলেই পারে। লুসির ভূতুড়ে মেয়েটা বললে তারা ক্ষেপে যায়। ওয়াকাও ক্ষেপে যায়। সেই একই ঘণ্টাধবনি তার মাথার উপর অনবরত বাজতে থাকলে, সে চিৎকার করে উঠল— ‘ম্যান্ডেলাদিদি, শিগগির খবর দাও, সমুদ্রের দৈত্যটা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। ওই দেখ দূরে ভেসে উঠছে-ওই দ্যাখ দূরে পিঠের শিরদাঁড়া ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে। ওই দ্যাখ আবার ফিরে আসছে।

ম্যান্ডেলা এবার দেখল, সেই অতিকায় মীন ফের সমুদ্রের ঢেউ ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিল—অনেকটা উপরে উঠে দেখার চেষ্টা করল কত দুরে তার সেই প্রবল প্রতিপক্ষ–তারপর ছুটে আসতে লাগল এবং ঝাঁপিয়ে পড়ল নৌকার ওপর। নৌকা উলটে গেল।

ওয়াকা লাফিয়ে পড়ল জলে-চিৎকার করে উঠল, ম্যান্ডেলাদিদি। আর কোনো আওয়াজ উঠল না। ঢেউ-এর ঝাপটায় সে অনেক দূরে সরে গেছে। ওয়াকা সাঁতারে পটু—সে ঢেউ-এর ওপর একবার হাত তুলে দিল, তারপর ঢেউএর ভিতর ডুব দিয়ে সে আরও কিছুটা দূরে সরে গেল—অতিকায় মীনের আর পাত্তা নেই। ম্যান্ডেলার বুকে ত্রাস—সে উড়তে থাকল—এবং যেখানে সেই মীন ফের ভেসে উঠল তার নাকে ল্যাজ দিয়ে হাইতিতি সুড়সুড়ি দিল। মাছটা মুখ ঝামটাল। হাঁ করা মুখ বন্ধ। মীন ভেসে উঠলেই হাইতিতি ছুটে যাচ্ছে, আর ল্যাজের ডগা দিয়ে নাকে মুখে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। যেন কোনো রকমে আটকে রাখা—এবং সেই ফাঁকে যদি ওয়াকা তার নৌকা ভাসিয়ে পালাতে পারে। কিন্তু নৌকাটা যে উলটে আছে। তার পাটাতনের কাঠ ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রে। ওটাকে টেনে নেওয়া সহজ কাজ নয়। নৌকা ভেসে থাকলে, ম্যান্ডেলাই দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারত। সে জলেও নামতে পারছে না। যদি পালকের টুপি সমুদ্রে ভেসে যায়। যেতেই পারে। আসলে ম্যান্ডেলা ভুলেই গেছে তার পালকের টুপি ঝড় কিংবা ঢেউ কেউই উড়িয়ে নিতে পারে না। তার কেবল এখন লক্ষ্য কোনদিকে অতিকায় মীন ছুটে যাচ্ছে। অনেক দূরে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওয়াকাকে। ঢেউ-এর প্রবল ঝাপটায় সে একান্ত স্থির থাকতে পারছে না। আর তখনই দেখল, আবার সেই অতিকায় মীন জলে ঘূর্ণি তুলে তালগাছের মতো সমুদ্রের পিঠে ভেসে উঠেছে। এবং তীরের ফলার মতো ছুটে যাচ্ছে ওয়াকার দিকে।

এ সময় হা-হুতাশ করে লাভ নেই ম্যান্ডেলা জানে–সে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। সে দেখতে পাচ্ছে পাটাতনের একটা লম্বা কাঠ ঢেউ-এর মাথায়। দ্রুত উড়ে গিয়ে সে কাঠটা তুলে নিল। প্রথমে ভেবেছিল, ভাসলেই কাঠটা দিয়ে মারবে মাথায়। সে মারলও। আশ্চর্য মাছটার যেন তাতে কিছুই আসে যায় না। পাথরের মতো শক্ত মাথা। অতিকায় মীন তার লক্ষ্যে স্থির। সে ওয়াকাকে গিলে খাবেই। ওয়াকাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ডুবে যাচ্ছে, ভেসে উঠছে। সে খুঁজছে তার নৌকাটাকে। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চারপাশে ক্ষেপা সমুদ্র তাকে ঘিরে ধরেছে। ঘণ্টাধবনি দূরে শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসছে না। প্রাণপণে সে ঢেউ কাটিয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে। এই গভীর সমুদ্রে ঢুকে গিয়ে সে বুঝতেও পারছে না, কোথায় তার প্রিয় বেলাভূমি, পাইনের বন, আর টিলার ওপর মিকি মাউসের মতো লাল-নীল রঙের কাঠের বাড়ি। কোনদিকে সাঁতার কাটলে, সে সেখানে পৌঁছাতে পারবে তাও জানে না। কেবল মাঝে মাঝে হাঁকছে, ম্যান্ডেলাদিদি তুমি সব পার। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও। হাইতিতিকে বল, ঘণ্টাধবনি করুক, তা অনুসরণ করি।

কিন্তু প্রবল ঢেউ-এর গর্জনে ম্যান্ডেলা ওয়াকার কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছে না। সে এখন পাহাড়ের মতো বিচরণ করে বেড়াচ্ছে সমুদ্রে-অতিকায় মীনের খোঁজে। কোথায় গেল। যেন প্রকৃতির রুদ্ররোষে তারা পড়ে গেছে। ঝড় উঠলে বড়রকমের সর্বনাশ। সমুদ্রের জলকণা বাতাসে ভেসে বেড়ালে সে কিছুই চোখে দেখতে পাবে না। না ওয়াকাকে, না সেই অতিকায় মীনকে।

আবার দেখল, দিগন্ত থেকে মাছটা ভেসে আসছে। সমুদ্রের জল উথাল-পাতাল করে ভেসে আসছে। সে খুঁজছে ওয়াকাকে। মাছের ঘ্রাণশক্তি প্রবল। সে ঠিক ওয়াকাকে খুঁজে পাবেই—যত দূরেই থাক ওয়াকা, ঘ্রাণশক্তি প্রবল বলে ঘোরাফেরা করতে করতে অতিকায় মীন ঠিক পেয়ে যাবে ওয়াকাকে।

ম্যান্ডেলা উড়ছে।

হাইতিতি উড়ছে।

হাইতিতি হাঁ করা মুখের কাছে ল্যাজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মাছটা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না—অথচ কিছু যেন নাকের ডগায় স্পর্শ করছে। সেটা কি মাছটা বুঝতে পারছে না। হ্যাঁচ্চো দিচ্ছে কিনা তাও ম্যান্ডেলা জানে না। কারণ মাছের হাঁচি কাশি থাকে কিনা সে জানে না।

ম্যান্ডেলা যে উড়ে গিয়ে বুচারমামার বন্দুকটা নিয়ে আসবে তার উপায় নেই।

সদা ব্যস্ত রাখতে হচ্ছে মাছটাকে।

ভেসে উঠলেই সে পাটাতনের লম্বা কাঠটা দিয়ে পিঠে মাথায় যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, মারছে।

মাছটা তখন জলের নীচে লুকিয়ে পড়ছে। কিন্তু অতিকায় মীন, ভবি ভুলবার নয়।

আবার হাঁ করে সমুদ্রের তলায় ঘূর্ণি তুলছে—বেঁকে যাচ্ছে, চিৎ হয়ে খেলা করছে। যেন যে আছে সমুদ্রে, সে তার কজার মধ্যে। খুশিমতো গিলে ফেলা শুধু কাজ। ভেসে উঠে ডুবে গিয়ে সে যে মজা করছে না অদৃশ্য কোনো অশুভ আত্মার সঙ্গে কে বলবে! যেন বলছে, দেখ আমরা জলের জীব। তাবৎ শক্তি আমাদের জলে। অন্তরীক্ষে তুমি আর যাই কর, জলের নীচের সাম্রাজ্যে তোমার হাতিয়ার ভোঁতা।

ম্যান্ডেলা এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আর দেখছে, ওই তো ওয়াকা, ভাসছে— জলে ডুবছে। আর দূরে নৌকা উলটে গিয়ে যেমন লম্বা একটা কুমিরের মতো রোদ পোহাচ্ছে।

আর তখনই ম্যান্ডেলা দেখল, আবার সেই মীন ভেসে উঠেছে। চোখ হিংস্র। দাঁতালো মাছটা ওয়াকাকে মুখ হাঁ করে গিলতে যাচ্ছে। ম্যান্ডেলা উপায়ান্তর না দেখে হ্যাঁ করা মুখে পাটাতনের লম্বা কাঠটা ঢুকিয়ে দিল। ক্রিকেট মাঠে স্টাম্প পুঁতে দেবার মতো হাঁ করা মুখে ঢুকিয়ে দিল। খাপে খাপে বসে গেল কাঠটা। নাও বোঝ মজা!

এতে এখন জব্দ হবে মাছটা ম্যান্ডেলা অনুমানই করতে পারেনি। মাছটা আর তার চোয়াল বন্ধ করতে পারছে না। ছুটছে, ল্যাজ তুলে ছুটে বেড়াচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, জলে অজস্র বুদবুদ উঠছে। আবার ভেসে উঠছে। চোয়াল বন্ধ করতে পারছে না। কাঠটা দু-চোয়ালে ঠেকার কাজ করছে। কাঠটা দু-চোয়ালে বসে গেছে। ভাসলেও মুখ হাঁ করা, ডুবলেও মুখ হাঁ করা।

ম্যান্ডেলা যত দেখে তত হাততালি দেয়। একটা অতিকায় মীনকে এভাবে সে জব্দ করতে পারবে আশাই করতে পারেনি।

সে এবার হাত ঝেড়ে নৌকাটার কাছে গেল। ওয়াকা সাঁতার কাটছে।

নৌকাটা ম্যান্ডেলা আর হাইতিতি টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। আর মাছটা করুণ চোখে সমুদ্রে ভেসে থেকে অন্তরীক্ষের কাণ্ডকারখানা দেখছে। যেন বলছে, আমার দু-চোয়ালে কেন কাঠ আটকে দিলে। না পারছি ওগলাতে, না পারছি গিলতে।

ম্যান্ডেলা বলল, মজা বোঝ। ওয়াকাকে তুমি চেন না। সুতো কেটে দিলাম, তাই রক্ষে। পারতে সুতো ছিঁড়ে পালাতে। যতদিন তুমি জব্দ না হতে ওয়াকা নৌকায় ভেসে বেড়াত! ওয়াকাকে তুমি চেন না। বেইমানি আর কাকে বলে! প্রতিশোধ নেবে! আরে মানুষই তো ভুল করে। তাই বলে তাকে শোধরাবার সুযোগ দিতে হবে না। সে না হয় বঁড়শিতে আটকে ফেলেছিল, তোমার কি বুদ্ধি বুঝি না বাপু, দাঁত এত তোমার ধারালো-সুতো কেটে দিতে পারলে না। এথচ বড়াই ষোলো আনা!

নৌকাটা হাতের নাগালে পেয়ে ওয়াকা অদ্ভুত কৌশলে উলটে দিল, জল সেচে ফেলে দিল—আর দেখল, সেই অতিকায় মীন তার নৌকার পাশে ঘোরাফেরা করছে। আর হাই তোলার মতো মুখ ভাসিয়ে দেখাচ্ছে, কে যে তাকে এভাবে জব্দ করে গেল!

ওয়াকাও অবাক। সত্যি তো মাছটার চোয়ালে একটা পাটাতনের কাঠ আটকে রয়েছে। না পারছে ওগলাতে, না পারছে গিলতে। কে যে কাজটা করল! তবে সে ঘণ্টাধবনি শুনতে পেয়েছে। ম্যান্ডেলাদিদিরই কাজ। সে অবাক হয়ে শুনল, মাথার ওপর তখনও ঘণ্টা বেজে চলেছে।

ওয়াকা ঘণ্টাধনি অনুসরণ করল। তীরের কাছাকাছি এসে দেখল মাছটা তার দিকে তখনও করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।

সে মাছটার কাছে গেল। হাঁ করা মুখের কাঠটা সে বৈঠায় চাড়ি মেরে ভেঙে দিল। আর তখন মাছটা ছুটল—যেন উড়ে যাচ্ছে—ছোট্ট একটা বিমানের মতো। সমুদ্রের ধারে যারা ওয়াকার অপেক্ষায় ছিল তারা তো দৃশ্যটা দেখে অবাক। তারা এসেছিল মাছ নিতে, কিন্তু দেখল, নৌকার খোলে একটাও মাছ নেই। পাটাতন সাফ। সে টলতে টলতে পাইন বনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। সারা গায়ে তার অজস্র ক্ষত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *