ডাকিনীতন্ত্র – কর্নেল সমগ্র ৩ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
০১.
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার নিউজরুমে বসে একটা ক্রাইম রিপোর্ট লিখছিলাম। সেই সময় নিচের রিসেপশন থেকে টেলিফোন এল, সুদর্শন সান্যাল নামে এক ভদ্রলোক আমার দর্শনপ্রার্থী।
কপি লেখার সময় বাইরের কেউ এলে বিরক্ত হই। কিন্তু আজকের কপিটা ছিল মামুলি ধরনের। জেলপালানো এক উগ্রপন্থী কলকাতার একটা হোটেলে ধরা পড়েছে। আজকাল পঞ্জাব, কাশ্মীর অসম থেকে উগ্রপন্থীরা তাড়া খেয়ে কলকাতায় প্রায়ই আশ্রয় নিচ্ছে। কলকাতার মতো বিশৃংখল ভিড়েভরা বিশাল। শহরে গা ঢাকা দেওয়া সোজা। তবে পুলিশের কেরামতি আছে বলা উচিত। মাঝে মাঝে উগ্রপন্থীরা ধরা পড়ে এবং কাগজে খবর হয়, যদিও আমাদের। নিউজ ব্যুরোর নতুন সম্পাদক কমলদার মতে, কারে ধরতে কারে ধরছে। ছাড়ান দাও।
একটু পরে সুদর্শন সান্যাল এলেন।
ভদ্রলোক সত্যিই সুদর্শন। তবে চেহারায় কেমন বিষাদের ছাপ। উসকো খুসস্কো চুল। চোখে পুরু কাঁচের লেন্স। পরনে ঢিলে চকরাবকরা শার্ট এবং জিনস। কাঁধে কালো ব্যাগ। বললেন, পুরুলিয়া ডাইনি হত্যার রিপোর্টাজ আপনিই লিখেছেন।
–একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
–আপনার নাম জয়ন্ত চৌধুরী?
–হ্যাঁ। কী ব্যাপার বলুন তো?
সুদর্শন সান্যাল প্রশস্ত নিউজরুমে চোখ বুলিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তবে গোপনে বলতে চাই।
বেশ তো! চলুন, লবিতে গিয়ে বসা যাক।
লবিতে বসার জায়গা নেই। অগত্যা এক কোণে গিয়ে দুজনে দাঁড়ালাম। সুদর্শন সান্যাল চাপা স্বরে বললেন, আপনার রিপোর্টাজ খুঁটিয়ে পড়েছি। তবে আপনার ব্যাখ্যা ছকবাঁধা বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ আপনি ডাইনিদের ব্যাপারটা, ইংরেজিতে যাকে বলে উইচক্র্যাফ্ট, একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন।
হাসি পেল। বললাম, আপনি উইচ্যাটে বিশ্বাস করেন বুঝি?
করি। সম্প্রতি আমি পুরুলিয়ায় গিয়েছিলাম। অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গলের ভেতর
ওঁর কথার ওপর বললাম, ডাইনি দেখেছেন?
ঠিক তা-ই। সুদর্শন সান্যাল মার্লবরো সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন, নিন। স্মাগড় সিগারেট নয়। গত সপ্তাহে আমেরিকা থেকে ফিরেছি। এখনও দু প্যাকেট আছে। সিগারেট আমি তত বেশি খাই না কিন্তু গত এক মাস ধরে আমার সিগারেট খাওয়া বেড়ে গেছে। আসলে একটা ভীষণ অ্যাংজাইটিতে ভুগছি।
সিগারেট নিয়ে বললাম, থ্যাঙ্কস্। তো অ্যাংজাইটি কি ডাইনি নিয়ে?
ঠিক ধরেছেন। আমি আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলিসে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছিলাম। হঠাৎ আমার জীবনে অদ্ভুত একাট অশান্তি এসে গেল। আমার স্ত্রী গোপা
বলুন!
ওয়েস্টে মেমসাহেবদের মধ্যে এখন উইচক্র্যাফ্ট নিয়ে খুব হিড়িক। গোপা কী ভাবে একটা গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, জানতাম না। সে-ও আমার সঙ্গে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছিল। যাই হোক, সংক্ষেপে বলি। আমি ও সব ব্যাপার একটুও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু ক্রমশ গোপা আমাকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ল। ধরুন, একটা সুন্দর আপেল। গোপা সেটা কেটে দেখাল, ভেতরে কুৎসিত একটা লার্ভা। কিংবা বেগুন কেটে তাজা রক্ত। রক্তটা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, সত্যিকার রক্ত।
ম্যাজিক!
সুদর্শন সান্যাল বিষঃ হেসে বললেন, না জয়ন্তবাবু! আমি একজন বিজ্ঞানী। আমাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। গোপা একদিন বলল, ওর গ্রুপলিডারের নির্দেশ, ওকে ভারতে ফিরতে হবে। ভারতই নাক উইচক্র্যাফটের আদি উৎস। এখানকার ডাইনিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের গুপ্তবিদ্যা সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে গোপাকে মরতে হবে। তাই গোপার সঙ্গে আমাকে ফিরতে হলো।
তারপর?
আমার পৈতৃক বাড়ি বাগবাজারে গঙ্গার ধারে। বাবা-মা বৈচে নেই। আমার মামাতো দাদা অবনী মৈত্র বাড়িটা দেখাশোনা করেন। নিচের তলায় ভাড়াটে আছে। অবনীদা বিপত্নীক। ছেলেমেয়ে নেই। একটা ঘরে একা থাকেন। সাধু সন্ন্যাসী টাইপের মানুষ বরাবর।
ঘড়ি দেখে বললাম, কলকাতায় ফিরে কী হলো বলুন?
বলছি। অবনীদার আবার তন্ত্রসাধনার বাতিক আছে। কাজেই গোপার সঙ্গে ওঁর জমে গেছে। কিন্তু আমার এটা একেবারে অপছন্দ।
কেন?
রাতবিরেতে দুজনে একটা ঘরে দরজা আটকে ধুনো জ্বেলে কী সব করে। অদ্ভুত শব্দ শুনে উঠি। ভীষণ ভয় করে আমার।
হুঁ। তা পুরুলিয়ায় কেন গিয়েছিলেন?
আপনার রিপোর্টাজ বেরুনোর পরদিন অবনীদা আর গোপা বলল, জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছে। ফিরতে দু দিন দেরি হবে। আমি ওদের গোপনে ফলো করলাম। ওরা পুরুলিয়া গেল ট্রেনে। তারপর ট্যুরিস্ট বাসে অযোধ্যা পাহাড়ে। একটা জিপ ভাড়া করে ফলো করেছিলাম। জঙ্গলের ভেতর ওরা বাস থামিয়ে। নামল। জিপ একটু দুরে থামিয়ে ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বললাম। তখন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ড্রাইভার বলল, আধঘণ্টার মধ্যে না ফিরলে সে জিপ নিয়ে চলে যাবে। কারণ ওখানে বুনো হাতির বড় উপদ্রব।
আপনি কী করলেন?
ওকে টাকার লোভ দেখালাম। আপনি তো দেখেছেন, অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে অনেক বসতি আছে। ড্রাইভার একটা বসতি দেখিয়ে বলল, আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে। তবে আমি যেন সাবধানে যাই। তখনও গোপাদের আবছা দেখা যাচ্ছিল জঙ্গলের পথে। তাই ফলো করতে অসুবিধে হয়নি। কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের পথ ছেড়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। ততক্ষণে জ্যোৎস্না ফুটেছে। জঙ্গলের ভেতর একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে ওরা থামল। তারপর আগুনের কুণ্ড জ্বলে উঠতে দেখলাম।
সুদর্শন সান্যালের মুখে উত্তেজনা ফুটে উঠেছিল। বললাম, তারপর কী দেখলেন বলুন?
আপনাকে বলতে লজ্জার কারণ নেই। দুজনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কিছুক্ষণ আগুনের কুণ্ডের চারদিকে অদ্ভুত নাচল। তারপর
বলুন!
সুদর্শন সান্যাল চাপা স্বরে বিকৃত মুখে বললেন, সে এক জঘন্য দৃশ্য। স্বামী দেখছে, তার স্ত্রী তার মামাতো দাদার সঙ্গে–এনিওয়ে! আর মাথার ঠিক ছিল না। আমার সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। কী করব ভাবছি, হঠাৎ দেখি, গোপা এবং অবনীদা ওই অবস্থায় শূন্যে ভাসছে।
আপনার চোখের ভুল!
না। ওরা আগুনের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছিল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে চুপচাপ চলে এলাম। কলকাতা ফেরার দু দিন পরে ওরা ফিরল। আমি ঘুণাক্ষরে জানতে দিলাম না ওদের, কী দেখেছি। যাই হোক, এর পর আমার সিদ্ধান্ত, আমার আর বেঁচে থাকা উচিত নয়। গোপা ছিল আমার জীবনের স্বপ্ন। স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। এবার আমার কাছে বাঁচার অর্থ হয় না। আমি সুইসাইড করব।
আঁতকে উঠে বললাম! কেন ওসব কথা ভাবছেন?
সুদর্শন সান্যাল আবার একটা সিগারেট ধরালেন এবং আমাকেও দিলেন। বললেন, আমার জীবন আমার আপনাকে শুধু জানাতে এসেছিলাম, আপনার ব্যাখ্যা ঠিক নয়। ডাইনি আছে। আই মিন, উইচক্র্যাফ্ট সত্য। বিজ্ঞান এখনও সবকিছুর ব্যাখ্যা করতে পারে না। আচ্ছা চলি! আমার এই কার্ডটা রাখুন।
বলে ভদ্রলোক একটা নেমকার্ড দিয়ে হন্তদন্তভাবে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সুদর্শন সান্যাল, পাগল নন তো?
নাকি অসতী স্ত্রীর কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতেই পাগল হয়ে গেছেন?
কিন্তু সত্যিই যদি উনি আত্মহত্যা করে বসেন?
উদ্বিগ্নভাবে নিউজরুমে ফিরে গেলাম। সাংবাদিক জীবনে বিচিত্র ধরনের মানুষ দেখেছি। কিন্তু এমনটি কখনও দেখিনি। তাছাড়া ঘটনাটাও বড়। রোমাঞ্চকর।……….
.
০২.
হু, নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর। বিশেষ করে সুদর্শন সান্যালের আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটা।
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মুখের দিকে তাকালাম। ওঁর টেবিলে একগোছ পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন প্রজাপতির ছবি। আমার মুখে আগের সন্ধ্যার বিস্তারিত বিবরণ শুনতে শুনতে ছবিগুলো দেখছিলেন এবং একটা প্যাডে কী সব লিখছিলেন। আমার কথা শেষ হলে উনি ওই মন্তব্য করে আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
বললাম, এক্ষেত্রে আমার একটা নৈতিক দায়িত্ব এসে গেছে। সেজন্যই আপনার কাছে এই সাতসকালে ছুটে এসেছি।
ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গিয়েছিল। কফিতে চুমুক দিয়ে দাড়ি চুলকে কর্নেল বললেন, নৈতিক দায়িত্বটা কিসের?
বা রে! সুদর্শনবাবুকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচানো উচিত নয় কি?
যে সত্যি সত্যি মরতে চায়, তাকে কী করে বাঁচাবে? তা ছাড়া, এমন তো হতেই পারে, উনি গত রাতেই আত্মহত্যা করে ফেলেছেন। বলে কর্নেল ছবি থেকে মুখ তুললেন। চওড়া টাকে হাত বুলিয়ে একটা চুরুট ধরালেন। জয়ন্ত! তুমি একটা ভুল করেছ।
ভুল করেছি?
হ্যাঁ। গতকাল সন্ধ্যাতেই আমাকে টেলিফোন করতে পারতে। কিংবা অফিস থেকে আমার কাছে চলে আসতে পারতে।
ঠিক। ভুলটা স্বীকার করছি। আসলে–
আসলে তুমি গোপা এবং অবনীবাবুর অবৈধ সম্পর্কের উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলে।
এখনও দিচ্ছি। তবে উইচক্রাফট ব্যাপারটা বোগাস। সুদর্শনবাবু স্বচক্ষে ওদের কীর্তিকলাপ দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভদ্রলোক যে মানসিক রোগে ভুগছেন, তা স্পষ্ট বুঝেছি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বায়োকেমিস্ট। রসায়নবিদ্যার দৌলতে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার অবশ্য ঘটানো যায়। বিশেষ করে জৈবরসায়নবিদ্যা খুব ইন্টারেস্টিং।
কর্নেল, বাগবাজারে গিয়ে সুদর্শনবাবুর খোঁজ নেওয়া দরকার। আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছে।
তুমি অবশ্য থানায় ফোন করে জেনে নিতে পারতে, সত্যি ও নামে কেউ রাতারাতি আত্মহত্যা করেছে কি না। কিন্তু তাতে হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। বরং ওঁর বাড়িতে ফোন করো।
কার্ডেও বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লেখা আছে।
দেখেছি। ডট পেনে লেখা। কার্ডে ছাপানো ঠিকানা লস অ্যাঞ্জেলিসের। সুদর্শনবাবুর বাড়িতেই ফোন করো।
নেমকার্ডটা কর্নেলের টেবিলে রেখেছিলাম। তুলে নিয়ে ফোনের ডায়াল করলাম। আমার হাত কাঁপছিল। একটু পরে সাড়া এলে বললাম, মিঃ সুদর্শন সান্যালের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
পুরুষকণ্ঠে সাড়া এসেছিল। মনে হলো, বাড়ির কাজের লোক। বলল, আজ্ঞে সায়েব তো এখনও ঘুমুচ্ছেন! আধঘণ্টা পরে ফোন করবেন। কিছু বলতে হবে?
মেমসাহেব আছেন?
আজ্ঞে উনি ঠাকুরঘরে জপে বসেছেন।
অবনীবাবু আছেন?
তিনি গঙ্গাস্নানে গেছেন। ফিরতে দেরি হবে। আপনি কোত্থেকে বলছেন স্যার?
ইলিয়ট রোড থেকে।
আপনি কে স্যার? সাহেব যদি জিজ্ঞেস করেন।
–আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরী। তুমি–আপনি কে বলছেন ভাই? আজ্ঞে আমি ভবতারণ। সাহেবের বাবার আমল থেকে এ বাড়িতে আছি।
ঠিক আছে। বলে ফোন রেখে দিলাম।
কর্নেল বললেন, কী বলল?
সুদর্শনবাবু এখনও ঘুমুচ্ছেন। গোপাদেবী ধ্যান করছেন। অবনীবাবু মা গঙ্গার বুকে। ভবতারণ নামে বাড়ির পুরাতন ভৃত্য ফোন ধরেছিল।
কর্নেল দেওয়ালে ওঁর প্রিয় গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের দিকে তাকিয়ে বললেন, নটা পাঁচ। এখনও সুদর্শনবাবু ঘুমুচ্ছেন? আমেরিকা ওঁর এদেশি অভ্যাস বদলাতে পারেনি, এটা গোলমেলে ঠেকছে। জয়ন্ত! তোমার কেসটা ইন্টারেস্টিং। চলো, বেরুনো যাক।
কর্নেল হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ওঁর হাবভাব লক্ষ্য করে উদ্বেগ আবার ঘনিয়ে এল। একটু পরে দুজনে তিনতলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নেমে এলাম। লনের পার্কিং জোনে আমার গাড়ি পার্ক করা ছিল। স্টার্ট দিয়ে বললাম, গিয়ে কী দেখব কে জানে?
কর্নেল কোনও কথা বললেন না। জ্বলন্ত চুরুট কামড়ে ধরে চোখ বুজলেন। সাদা একরাশ দাড়িতে একটুকরো ছাই খসে পড়ল। তারপর গাড়ির ঝাঁকুনিতে এবং বাতাসে টুকরোটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
রবিবারের সকালে রাস্তা ফাঁকা। বাইরে থেকে রোজ নাকি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ লাখ লোক হইহই করে কলকাতায় এসে ঢোকে। আজ তাদের অভাবে কলকাতাকে কেমন নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে। বাগবাজার এলাকায় নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে বাড়িটা পাওয়া গেল। চিৎপুর রেলইয়ার্ডের কাছে গঙ্গার ধারে সেকেলে একটা দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় সারবন্দি দোকানপাট বন্ধ। গলির ভেতর এগিয়ে ডানদিকে বাড়ির গেট। গেটটা একেবারে জরাজীর্ণ এবং বাড়ির সঙ্গে মানানসই। ভেতরে এলোমেলো কয়েকটা গাছ, ঝোঁপঝাড়, পোড়ো ঘাসে ঢাকা জমি। পোর্টিকো দেখে বোঝা যায়, এককালের উত্তর কলকাতার বনেদী পরিবারের বাড়ি।
হর্ন বাজানোর পর একজন রোগা বেঁটে হাফপ্যান্ট-গেঞ্জিপরা প্রৌঢ় লোক এসে গেটের মরচে ধরা গরাদের ওপাশে দাঁড়াল। তারপর কর্নেলকে দেখামাত্র সেলাম ঠুকল। কর্নেল বললেন, সাহেব উঠেছেন? না উঠলে আমরা বরং অপেক্ষা করব। তোমার নাম কি ভবতারণ?
আজ্ঞে স্যার!
গেট খুলে দাও। আমরাই টেলিফোন করেছিলাম।
পোর্টিকোর খোলামেলা ছাদ থেকে কেউ বলল, কে রে ভবা?
ভবতারণ ঘুরে বলল, আজ্ঞে এঁরা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
গাড়ির ভেতর থেকে কর্নেলের কাঁধের উপর দিয়ে দেখলাম লোকটিকে। হৃষ্টপুষ্ট সুন্দর চেহারা। মাথায় কালো লম্বা চুল এবং দাড়ি। পরনে গেরুয়া ফতুয়া এবং লুঙ্গি। কপালে লাল তিলক। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। ইনিই তা হলে সেই তান্ত্রিক অবনী মৈত্র। কণ্ঠস্বর বেশ অমায়িক। বললেন, দাঁড়া। যাচ্ছি।
কর্নেল বাইনোকুলারে গাছপালায় পাখি কিংবা ঝোঁপঝাড়ে প্রজাপতি খুঁজছিলেন। রাজ্যের হাড়হাভাতে কাক ছাড়া এখানে ওঁর দর্শনীয় কিছু নেই। বাতিক!
একটু পরে খড়ম পায়ে তান্ত্রিক এসে অমায়িক হেসে করজোড়ে নমস্কার করলেন। মশাইদের কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
কর্নেল বললেন, সত্যসেবক পত্রিকা থেকে।
ও! তা হলে আপনারা গোপার ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন?
হ্যাঁ।
অবনী মৈত্রের মুখে গাম্ভীর্য ফুটে উঠল। বললেন, কিন্তু গোপা তো ইন্টারভিউ দেয় না কোনও কাগজকে। কী করে গোপার কথা রটে গেছে জানি না। রোজই কাগজ থেকে কেউ-না-কেউ আসে। গোপা বিরক্ত হয়। ও পাবলিসিটি চায় না।
সুদর্শনবাবু আমাদের বলেছেন, ওঁর ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন।
তা-ই বুঝি? তো সুদর্শন এখনও ঘুমোচ্ছে যে!
উনি কি রোজই বেলা অব্দি ঘুমোন?
হ্যাঁ। দশটা সাড়ে-দশটার আগে ওঠে না। সায়েন্টিস্ট তো। রাত জেগে ল্যাবে কাজকর্ম করে। অবনী মৈত্র একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, তা সুদর্শন যখন আপনাদের আসতে বলেছে, তখন আর কথা নেই। ভবা! গেট খুলে দে। এঁদের নিয়ে গিয়ে বসা। চা-ফা দে! আর দ্যাখ, ও উঠেছে না কি।
গেট খুলে দিল ভবতারণ। অবনী তান্ত্রিক প্রাঙ্গণের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হলেন। ওদিকে একটা পুরনো মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছিল। তার পেছনেই গঙ্গা। কারণ খিড়কির খোলা দরজা দেখতে পেলাম।
পুরনো আমলের আসবাবে সাজানো বড় একটা ঘরে আমাদের বসিয়ে ফ্যান চালিয়ে দিল ভবতারণ। তারপর ভেতরে চলে গেল। কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখছিলেন। বললেন, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। বাণিজ্য গেছে। তাই লক্ষ্মীও রাগ করে পালিয়ে গেছে। জয়ন্ত, অনুমান করো তো, এই ফ্যামিলির কী বাণিজ্য ছিল?
লোহালক্কড় কিংবা মুদিখানার।
কর্নেল হাসলেন। উঁহু। ওষুধের।
কিসে বুঝলেন?
ওই ছবিটা দেখে।
এতক্ষণে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর দিকে চোখ গেল। একটা প্রকাণ্ড ছবিতে এক ভদ্রলোকের মাথার ওপর অর্ধচন্দ্রাকৃতি সাইনবোর্ডে লেখা সান্যাল ফার্মেসিউটিক্যালস্ লিমিটেড। ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে সুদর্শনবাবুর মুখের মিল আছে। কাল সন্ধ্যায় দেখা একটা মুখের স্মৃতি মনে এখনও স্পষ্ট। আবার সেই উদ্বেগটা ফিরে এল।
তারপর হঠাৎ ঘরের ভেতর একটা কড়া সুগন্ধের ঝঝ ছড়িয়ে এল। একটু চমকে উঠেছিলাম। বললাম, একটা গন্ধ পাচ্ছি, কর্নেল! আপনি পাচ্ছেন না?
হু। পারফিউমের। সম্ভবত ফরাসি সুগন্ধি। গোপা দেবী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন বলা চলে।
গন্ধ পাঠিয়ে?
ঠিক ধরেছ।
অ্যাবসার্ড।
গন্ধটা কিন্তু সত্যি আমাদের ঘিরে ধরেছে। সাবধান জয়ন্ত!
কর্নেলের মুখে হাসি ছিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, উনি কী ভাবে গন্ধ পাঠাতে পারেন?
ডাকিনীবিদ্যার জোরে।
সুগন্ধটা যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ মিলিয়ে গেল। তারপর আমাকে আবার চমকে দিয়ে ওপর থেকে দুটো লাল গোলাপের কুঁড়ি মেঝের ফরাসে পড়ল। কর্নেল কুঁড়ি দুটো কুড়িয়ে নিয়ে একটা আমাকে দিলেন। বললাম, অদ্ভুত তো!
কর্নেল সহাস্যে বললেন, অভ্যর্থনা। গোপাদেবীকে পাবলিসিটি দেবে কিন্তু!
ম্যাজিক।
চুপ। বলে কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন।
তারপর পর্দা তুলে এক লাবণ্যময়ী যুবতীর আবির্ভাব ঘটল। পরনে গৈরিক শাড়ি এবং হাতকাটা ব্লাউজ। চুড়ো করে বাঁধা চুল। কপালে উজ্জ্বল লাল টিপ। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। গা ছমছম করে ওঠে। বলল, নমস্কার।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন গোপা দেবী! সুদর্শনবাবু নিশ্চয় বলে রেখেছেন আমরা আসছি।
গোপা বসল না। ঠোঁটের কোণে হাসির তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য একে বলল, ও কিছু বলেনি। তবে আমি জানি আপনারা আসবেন। বসুন।
আপনি আপনার অলৌকিক শক্তি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। আমরা মুগ্ধ।
কর্নেল সরকার! আমি জানি আপনি কে এবং কেন এসেছেন।
আপনি অলৌকিক শক্তির সাহায্যে তা হলে সবই জানতে পারেন?
পারি। গোপা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী। আপনি পুরুলিয়ায় ডাইনিহত্যা নিয়ে যে রিপোর্টাজ লিখেছেন, তা পড়েছি। আপনার ব্যাখ্যার নাইনটি নাইন পারসেন্ট কারেক্ট। ওয়ান পারসেন্ট ঠিক নয়। যাদের ডাইনি বলে খুন করা হয়েছে, তারা কেউ ডাইনি নয় তা ঠিক। নানা কুটিল স্বার্থেই হতভাগিনীদের খুন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ডাইনিদের চেনা যায় না। তারা আছে। থাকবে।
ওঁর কথা নোট করে নাও জয়ন্ত!
কর্নেল সরকার! সুদর্শন আত্মহত্যা করেনি। আত্মহত্যা করার জন্য মনের জোর থাক চাই। ওর তা নেই। বহুদিন থেকে ও ওর বন্ধু এবং চেনাজানা লোকের কাছে আত্মহত্যার কথা বলে আসছে। ও একজন সাইকিক পেশেন্ট।
কর্নেল তুম্বো মুখে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, আপনার অলৌকিক শক্তি দেখে সত্যি আমি মুগ্ধ।
সরি কর্নেল সরকার! আপনার বোঝা উচিত ছিল, সুদর্শন সাইকিক পেশেন্ট। আমার নামে মিথ্যা স্ক্যান্ডাল রটিয়ে বেড়াচ্ছে।
আপনার অলৌকিক শক্তিতে ওঁকে সুস্থ করে তুলছেন না কেন গোপাদেবী? ইচ্ছে করলেই তো
এনিওয়ে, ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ততক্ষণ আপনারা কফি খান। আমি জানি, আপনি কফির ভক্ত।
কর্নেল হাসলেন। মার্কিন কফি?
–হ্যাঁ।
ভবতারণ ঢুকল ট্রে নিয়ে। টেবিলে ট্রে রেখে সে গোপার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। আমি নিলাম। কিন্তু চুমুক দিতে গিয়ে ভীষণ চমকে উঠলাম। পেয়ালার কফির রঙ গাঢ় লাল। একেবারে রক্তের মতো।
কর্নেলও কফির পেয়ালার দিকে তাকিয়ে বললেন, অপূর্ব! কফিটা রক্তে পরিণত করে দিলেন। মনে হচ্ছে মুরগির রক্ত!
গোপা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হেসে বলল, রক্তের পিছনে ছোটাছুটি করে বেড়ান। রক্তটা মানুষের হলে খুশি হতেন। একটু বসুন! ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তখন সত্যিকার কফি খাবেন।
বলে সে পর্দা তুলে চলে গেল। কর্নেলের দেখাদেখি কফির পেয়ালা রেখে দিলাম। চাপা স্বরে বললাম, আশ্চর্য! ভবতারণ যখন কফি আনল, তখন কিন্তু রক্ত ছিল না। ম্যাজিকটা
আমার কথার ওপর কর্নেল বললেন, ম্যাজিক নয় ডার্লিং। অলৌকিক শক্তি। ম্যাজিকবিদ্যার সাহায্যে আমাকে গোপাদেবীর চেনার কথা নয়।
এইসময় ভবতারণ আবার ঘরে ঢুকল। গোমড়ামুখে ট্রেতে পেয়ালাদুটো তুলে চাপা স্বরে বলল, বাড়ির মানসম্মান আর রইল না। ক্ষমা করবেন স্যার! আসা অব্দি মেমসাহেব সকলের সঙ্গে এইরকম বুজরুকি করছেন। আমার সঙ্গেও যখন-তখন এইসব ফষ্টিনষ্টি। খেতে বসেছি দু মুঠো। হঠাৎ দেখি ভাতের ভেতর হাড়। ওয়াক থুঃ!
সে দ্রুত ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল। কর্নেল সিলিঙের দিকে বাইনোকুলার তাক করলেন। একটু পরে সেটা নামিয়ে আপন মনে বললেন, হুঁ।
কী?
লোহার বিম আর কড়িকাঠ। বাড়িটার বয়স একশো বছরের বেশি। টালিগুলো কিন্তু এখনও পোক্ত। ইটালিয়ান মার্বেলের টালি।
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
গোপাদেবীকে পাবলিসিটি দাও।
বাইরে কাশির শব্দ হলো। তার একটু পরে পাজামা-পাঞ্জাবিপরা সুদর্শন সান্যাল ঘরে ঢুকল। মুখটা তেমনি বিষণ্ণ আর গম্ভীর। আমার মুখোমুখি সোফায় বসে ক্লান্ত স্বরে বলল, মর্নিং জেন্টলমেন!
বললাম, মর্নিং। আপনাকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য দুঃখিত মিঃ সান্যাল। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুদর্শন সান্যাল কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমার পরিচিত। তবে মুখোমুখি আলাপের সৌভাগ্য হয়নি। নেচার পত্রিকায় মাঝেমাঝে আপনার প্রবন্ধ বেরোয়। আপনার ছবি দেখেছি। তবে গোপা বলল, আপনি নাকি প্রাইভেট ডিটেকটিভও। ইজ ইট?
কর্নেল মাথা নেড়ে বলল, কথাটা আমি পছন্দ করি না মিঃ সান্যাল। আমাকে বরং রহস্যভেদী বলতে পারেন।
হ্যাঁ, রহস্য। গোপার কীর্তিকলাপ সত্যিই রহস্যময়। জয়ন্তবাবু কি সেই রহস্যভেদের জন্য কর্নেল সরকারকে নিয়ে এসেছেন? এটা ঠিক করেননি জয়ন্তবাবু।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আসলে আপনি আত্মহত্যা করবেন বলায় জয়ন্ত ভয় পেয়েছিল।
করিনি।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
সুদর্শন মাথার এলোমেলো চুল আঁকড়ে ধরে বলল, করতে পারছি না। যতবার অ্যাটেম্পট নিয়েছি, ফেল করেছি। গোপা যেন আমাকে সবসময় চোখে চোখে রেখেছে। কিন্তু আমাকে সুইসাইড করতেই হবে।
কলকাতায় ফিরে আপনি কি ফের রিসার্চ শুরু করেছেন?
— নাহ্। তবে গোপা ওপরে একটা ঘরে আমার জন্য ল্যাবরেটরি গড়ে দিয়েছে। ইনসিস্ট করছে কিন্তু জয়ন্তবাবুকে তো সব বলেছি। সুদর্শন গলার ভেতর খুব আস্তে বলল, আই হেট হার। বিকজ আই কান্ট কিল হার। শি ইজ সো পাওয়ারফুল! সোড়!
আপনি ঘুম থেকে দেরিতে ওঠেন শুনলাম?
কলকাতায় ফেরার পর এটা হচ্ছে। ঘুমের বড়ি ইচ্ছে করেই খাই না। কেন খাই না, জয়ন্তবাবু বুঝবেন। আমি আসলে চুপিচুপি–
আপনার স্ত্রীর প্রতি লক্ষ্য রাখেন?
হ্যাঁ। ও একজন রিয়্যাল ডাইনি।
উনি কি আলাদা ঘরে শোন?
শি নিডস আ সেপারেট রুম। ঘরের ভেতর ও আমাকেও ঢুকতে দেয় না। কাকেও না। শুধু দ্যাট স্কাউলে লোফার হিপোক্রিট অবনীদা বাদে।
ভবতারণ এবার সত্যিকার কফি নিয়ে এল। সে চলে গেলে সুদর্শন বলল, রিস্ক নিয়ে খাবেন। আপনারা আউটসাইডার। তা ছাড়া গোপা কর্নেল সরকারকে দেখে আমার ওপর চটে গেছে বলছিল, আমিই নাকি ওর পেছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছি।
কর্নেলকে কফিতে চুমুক দিতে দেখে সাহস করে আমিও কফিতে চুমুক দিলাম। কফিটা চমৎকার। সুদর্শন কফি খেতে খেতে ফের চাপা স্বরে বলল, আমার সব কথাবার্তা গোপা শুনতে পাচ্ছে। পাক। আমি ওকে আর ভয় করে চলব না। সুইসাইড করার আগে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব, ওকে খুন করতে পারি কি না!
কর্নেল বললেন, সর্বনাশ! স্ত্রীকে আপনি খুনের চেষ্টা করেন নাকি?
করি। পারি না।
কীভাবে?
ল্যাবের ধারালো ছুরি দিয়ে ওর গলা–হঠাৎ থেমে গেল সুদর্শন। ম্লান হাসল। ধুস! আমার দ্বারা কিস্যু হবে না। এই বলে হঠাৎ ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়াল। ওই যাঃ। চিঠিটা…বলে সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। এবং গেল তো গেলই। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা এ বাড়িতে অবাঞ্ছিত। চলো। কেটে পড়া যাক।…
.
০৩.
কর্নেলের বাড়িতে এমন অনেক ছুটির দিন কাটিয়ে দিয়েছি এবং ষষ্ঠীচরণের সুস্বাদু রান্নায় আপ্যায়িত হয়েছি। তবে ওই এক জ্বালা। আমার বৃদ্ধ বন্ধু কোনও বিষয়ে মুখ খুললে কান ঝালাপালা করে দেন। এদিনের বিষয় ছিল অকাল্ট বা গুপ্তবিদ্যা।
কিন্তু আজ আমি কান করেই ওঁর বকুনি শুনছিলাম। কারণ গোপাদেবীর কাণ্ডকারখানা দেখে আমার তাক লেগে গিয়েছিল। আঁঝালো সুগন্ধ, ওপর থেকে পড়া দুটি গোলাপকুঁড়ি এবং কফির পেয়ালা হঠাৎ রক্তের পেয়ালায় রূপান্তর ম্যাজিক, নাকি সত্যি অলৌকিক শক্তির ক্রিয়াকলাপ? কর্নেল আমার প্রশ্নের কোনও সদুত্তর না দিয়ে দেশবিদেশের আদিম জনজাতির মধ্যে এখনও প্রচলিত নানা গুপ্তবিদ্যা নিয়ে জ্ঞান ছড়াচ্ছিলেন। এক সময় ওঁর বকুনি থামল এবং আমি ড্রয়িংরুমের সোফায় ভাতঘুমে লম্বা হলাম। চোখ বুজে আসার আগে দেখলাম, উনি বইয়ের র্যাক থেকে কী একটা মোটা বই বের করে এনে ইজিচেয়ারে বসলেন।
চোখ বুজে ভাবছিলাম গোপাদেবী কর্নেলের পরিচয় জানে এবং তার স্বামী সুদর্শনও জানেন, এতে অবশ্য অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। মার্কিন বিজ্ঞানপত্রিকা নেচার পাখি-প্রজাপতি-পোকামাকড় নিয়ে কর্নেলের অনেক সচিত্র লেখা ছেপে আসছে। তার ছবি এবং বিচিত্র জীবনকাহিনী সংক্ষেপে ছেপেছে। জৈবরসায়নবিজ্ঞানী দম্পতির সেটা চোখে পড়া স্বাভাবিক। দৈনেক সত্যসেবকে প্রকাশিত আমার ডাইনিসংক্রান্ত রিপোর্টাজও ওরা পড়েছে। কাজেই এক্ষেত্রে দুইয়ে-দুইয়ে চার করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কাল সন্ধ্যায় সুদর্শন কি আমার কাছে নিছক ডাইনির সত্যাসত্য জানাতেই গিয়েছিলেন?
তার চেয়ে বড় কথা, আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত কি কেউ ওভাবে অপরের কাছে। ঘোষণা করে?
কখন ভাতঘুম এসে গিয়েছিল। কলিংবেলের শব্দে ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলাম, ষষ্ঠীচরণ এক যুবতাঁকে নিয়ে এল। মহিলাদের সঠিক বয়স আঁচ করা আমার পক্ষে কঠিন। গোপার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি মনে হয়েছিল। এর বয়স কিছু কম হতে পারে। চেহারায় নম্র লাবণ্য আছে এবং পরনে সাধারণ কিন্তু রুচিসম্মত শাড়ি। কাধ পর্যন্ত ছাঁটা চুল। চোখে চশমা। নমস্কার করে বলল, আমার নাম অপর্ণা রায়।
কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, বসুন। আপনার চিঠি কাল পেয়েছি।
আমাকে তুমি বললে খুশি হব।
অপর্ণা আমার দিকে ঘুরলে আমি সোজা হয়ে বসলাম। কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। সাংবাদিক।
অপর্ণা আমাকে নমস্কার করে বলল, পুরুলিয়ায় ডাইনিহত্যা নিয়ে আপনার লেখাটা পড়ে সত্যসেবক পত্রিকায় টেলিফোন করেছিলাম। আপনি তখন অফিসে ছিলেন না।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত! অপর্ণা কলকাতার কাছেই একটা কলেজে পড়ায়। অপর্ণা, তোমার চিঠি পড়ে মনে হয়েছিল, তুমি নিজের জন্যই উদ্বিগ্ন। এখন মনে হচ্ছে, তুমি অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন।
অপর্ণা আস্তে বলল, হ্যাঁ।
তুমি কি সুদর্শন সান্যালের জন্য উদ্বিগ্ন?
অপর্ণা মুখ তুলল। চোখে বিস্ময়ের ছাপ। বলল, আপনার সম্পর্কে যা সব শুনেছি বিশ্বাস করতাম না। আপনি সত্যিই
সুদর্শন কি তোমার আত্মীয়?
না। য়ুনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপর ও আমেরিকা চলে গেল। সেখান থেকে রেগুলার চিঠি লিখত। তারপর হঠাৎ চিঠি লেখা বন্ধ করে দিল। প্রায় এক বছর পর, মাস তিনেক আগে আবার ওর চিঠি পেলাম। প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছে। স্ত্রী রিসার্চ স্কলার। একসঙ্গে কাজ করে। কিন্তু বউকে নিয়ে ও খুব সমস্যায় পড়েছে। কী সমস্যা, তা খুলে লেখেনি। হঠাৎ গত সপ্তাহে সুদর্শন লেকটাউনে আমাদের বাড়িতে হাজির। সব কথা খুলে বলল। তারপর বলল, আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই। ওকে অনেক বোঝালাম। কিন্তু–অপর্ণা শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার ধারণা ওর মানসিক অসুখ হয়ে গেছে।
ওর স্ত্রী গোপার সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?
না। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে সুদর্শন যা বলেছে, তা শোনার পর তার সঙ্গে আলাপ করা সম্ভব নয়।
অবনী মৈত্রকে তুমি চেনো?
চিনতাম না। সুদর্শনের বাড়িতে কখনও আমি যাইনি। সুদর্শনের কাছে সেদিন। ওঁর পরিচয় পেলাম।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, যাই হোক, তুমি কী করতে বলছ আমাকে?
সুদর্শনকে আপনি বাঁচান!
কর্নেল হাসলেন। সে তো দিব্যি বেঁচে আছে।
কর্নেল সরকার! আমার ভয় হচ্ছে, ও যে-কোনও সময় ঝোঁকের বশে আত্মহত্যা করে বসবে। ও মানসিকভাবে মোটেও সুস্থ নয়।
ওকে কোনওভাবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাও। তোমার কথা শুনে মনে হলো, সুদর্শন তোমাকে বিশ্বাস করে। সম্ভবত তোমার সাহায্য চায়।
অপর্ণা মুখ নিচু করে ঠোঁটের কোনা কামড়ে ধরল। একটু পরে বলল, আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। সুদর্শন বলছিল, ও বাঁচতে চায়। কিন্তু আত্মহত্যা ওকে নাকি করতেই হবে। কারণ ওর বউ ওকে আত্মহত্যা করিয়ে ছাড়বে। এ একটা অদ্ভুত ব্যাপার। দেখুন কর্নেল সরকার, আমি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতাম, ওর বন্ধু হতাম, তাহলে ওর বউকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। সেইসঙ্গে ওই ভণ্ড তান্ত্রিক লোকটাকে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলতাম।
সুদর্শনের কোনও বন্ধু নেই?
ছাত্রজীবনে ছিল। এখন কে কোথায় আছে, জানি না। তবে ও বরাবর অমিশুকে স্বভাবের ছেলে। বন্ধু বলছি বটে, কিন্তু সেই অর্থে তত ঘনিষ্ঠতা ওর কারও সঙ্গে ছিল না।
তোমার বাড়িতে কে আছেন?
মা আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা বেঁচে নেই।
তুমি সুদর্শনকে তোমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করো। একজন সাইকিয়াট্রিস্টকেও করো। বুঝেছ?
বুঝেছি। কিন্তু ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার সমস্যা আছে।
কেন? টেলিফোনে করো।
ওর বউ সত্যিই ডাইনি। কীভাবে টের পায় সম্ভবত। ওদের কাজের লোকটা ফোন ধরে বলে, ধরুন, ডেকে দিচ্ছি। একটু পরে বলে সাহেব ঘুমুচ্ছেন।
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। একটু পরে বললেন, তুমি সুদর্শনের হিতাকাঙিক্ষনী। আমার মতে, তোমার রিস্ক নেওয়া উচিত।
অপর্না ব্যগ্রভাবে বলল, বলুন, কী রিস্ক নেব।
তুমি ওর বাড়ি চলে যাও।
ওর বউ যদি বাড়ি ঢুকতে না দেয়?
চেষ্টা করে দেখ।
অপর্ণার মুখ দেখে মনে হলো, সে দ্বিধায় পড়ে গেছে। একটু পরে রুমালে মুখ স্পঞ্জ করে সে বলল, ঠিক আছে। আমি এখনই গিয়ে দেখছি। কী হলো, আপনাকে টেলিফোনে জানাব। প্লিজ, আপনার নাম্বারটা দিন।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নেমকার্ড দিলেন। তারপর বললেন, একটা কথা। আমার ঠিকানা তুমি কার কাছে পেয়েছিলে?
আমার মামা অপরেশ মজুমদার রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। সল্টলেকে বাড়ি করেছেন। প্রথমে মামার কাছেই গিয়েছিলাম। সুদর্শনের ব্যাপারে কোনও হেল্প করতে পারেন কি না। মামা বললেন, পুলিশ এ ব্যাপারে আইনত কিছু করতে পারে না। বরং তুই কর্নেল সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্যাখ। আমি সরাসরি আপনার কাছে আসার আগে চিঠি লিখেছিলাম। জবাবের জন্য ধৈর্য ধরতে পারিনি। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন। অপর্ণা একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল।
বললাম, হাই ওল্ড বস!
বলো ডার্লিং!
অপর্ণাদেবীর সঙ্গে সুদর্শনের যোগাযোগ কি আপনিও গুপ্তবিদ্যার জোরে জেনে ফেলেছিলেন?
নাহ্। কর্নেল চোখ খুলে সিধে হলেন। অপর্ণা তোমার রিপোর্টাজ পড়ে তোমার খোঁজ করেছে বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলাম। লেগে। গেল। বলে হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! কফি!
বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। জানালার বাইরে মাঠের সোনালি রোদ্দুর ঘরবাড়ির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কফিতে কয়েকটা চুমুক দিয়েছি, টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ধরো জয়ন্ত!
ফোন তুলে সাড়া দিতেই কেউ ছ্যাাৎরানো গলায় বলল, এই ব্যাটা বুড়োঘুঘু! নাক গলাতে এসো না। গলা কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।
তারপর ফোন রাখার শব্দ। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কর্নেল বললেন, কী হলো? তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
ফোন রেখে বললাম, কেউ হুমকি দিল এবং আপনাকে গালাগাল!
বলো কী! কী বলল?
এই ব্যাটা বুড়োঘুঘু! নাক গলাতে এসো না। গলা কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।
কর্নেল গম্ভীর মুখে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে?
হ্যাঁ।
তার মানে সুদর্শনের বাড়ির পেছনে গঙ্গায়। কর্নেল হঠাৎ ব্যস্তভাবে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। নাম্বার ডায়াল করতে থাকলেন। কয়েকবার ডায়াল করার পর বললেন, এনগেজড।
কোথায় ফোন করতে চান?
সুদর্শনের বাড়িতে।
কর্নেল! আমার এখন মনে হচ্ছে, কেউ চাইছে সুদর্শন আত্মহত্যা করুক।
ঠিক ধরেছ। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘড়ি দেখে বললেন, চলো। বেরুনো যাক।
কোথায়?
বাগবাজারে। অবনী মৈত্রের সঙ্গে এখনই দেখা করা দরকার। কুইক!
আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। সকালে কর্নেল যে বাড়ি থেকে আমরা এখানে অবাঞ্ছিত বলে চলে এলেন, সেখানে আবার যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া একটু আগে টেলিফোনে ওই কুৎসিত হুমকি! বড্ড বেশি ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে না কি?
পথে যেতে যেতে কর্নেল যেন আমার মনোভাব আঁচ করেই বললেন, ফোনে যারা হুমকি দেয়, তারা কাওয়ার্ড। যারা সত্যি ক্ষতি করার হিম্মত রাখে তারা আড়াল থেকে গর্জন করে না। মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, লোকটি ভীতু। ভীতু, কিন্তু ধূর্ত আর বদমাশ! তার উদ্দেশ্যটা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না অবশ্য।
লোকটা সম্ভবত অবনী মৈত্র।
কেন তাকে সন্দেহ করছ?
সুদর্শন আত্মহত্যা করলে লোকটা তার সাধনসঙ্গিনী গোপাকে বিয়ে করবে এবং সুদর্শনের সম্পত্তির মালিক হতে পারবে।
কর্নেল হাসলেন। সুদর্শনের কথা সত্যি হলে বিয়ের কী দরকার? গোপাকে তো সে অবাধে পেয়েছে। সম্পত্তির ভোগদখলও করে আসছে।
একটু অবাক হয়ে বললাম, সুদর্শনের কথা সত্যি হলে মানে?
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, জয়ন্ত! অবনী মৈত্রের সঙ্গে গোপার অবৈধ সম্পর্কের কথা আমরা সুদর্শনের মুখেই শুনেছি। তবে শুধু এটুকু জানি, অবনী মৈত্র তান্ত্রিক সাধুর মতো জীবনযাপন করে এবং গোপার উইচক্র্যাফটের বাতিক আছে।
বাতিক কী বলছেন? আচমকা সুগন্ধ, গোলাপকুঁড়ি, কফির পেয়ালায় রক্ত!
কর্নেল আর কোনও কথা বললেন না। বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে সোজা এগিয়ে ট্রামলাইন পেরিয়ে গঙ্গার ধারে গলির মোড়ে পৌঁছুতে রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছিল। কর্নেলের নির্দেশে গলির মুখে গাড়ি রাখলাম। গলিটা এঁকেবেঁকে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছেছে। বাঁধানো প্রাচীন ঐতিহাসিক ঘাটের পাশে বিশাল একটা বটগাছ। গাছটার তলা একসময় বাঁধানো ছিল। এখন ভেঙেচুরে গেছে। একদল লোক বসে আড্ডা দিচ্ছে। গাঁজার ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। খড়বোঝাই একটা নৌকো ঘাটে বাঁধা আছে। সন্ধ্যাস্নান এবং আহ্নিকরত কয়েকজন ধর্মানুরাগীকে দেখা গেল। কাকের চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হচ্ছিল। একটু পরে কাকগুলো চুপ করল। কর্নেল ঘাটের মাথায় দাঁড়িয়ে গঙ্গাদর্শন করছিলেন। জলে আলোর ঝিকিমিকি ছটা। কেউ গঙ্গার জল থেকে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে জপতে উঠে আসছিল। কর্নেলের পাশে আসতেই কর্নেল বললেন, অবনীবাবু!
ছায়ামূর্তি থমকে দাঁড়াল। এখানে গাঢ় ছায়া। লোকটা বলল, কে?
আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম অবনীবাবু! কথা আছে।
আপনারা সকালে এসেছিলেন না গোপার ইন্টারভিউ নিতে?
হ্যাঁ, এবার আপনার ইন্টারভিউ নেব।
গোপা বলছিল আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সুদর্শন আপনাকে ওর পেছনে লাগিয়েছে। একজন উন্মাদের কথায় আপনি
অবনীবাবু! আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। কিন্তু এখানে নয়।
তান্ত্রিক আস্তে বলল, আচ্ছা। আসুন!
কয়েক পা এগিয়ে বাঁদিকে ঘুরে খিড়কির সেই দরজা। ঠেলতেই খুলে গেল। পায়েচলা পথের দুধারে ঝোঁপঝাড়। সামনে মন্দির। মন্দিরের নিচে একটা চওড়া বেদি। বাড়ির পোর্টিকোর মাথায় যে বাস্তু জ্বলছে, তার আলো ক্রমশ ফিকে হতে হতে এখানে কোনও ক্রমে এসে নেতিয়ে পড়েছে। অবনী মৈত্র বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন। ভিজে কাপড়চোপড় ছেড়ে আসি।
কর্নেল বেদিতে পা ঝুলিয়ে বসলেন। আমিও বসলাম। বাড়িটা একেবারে সুনসান স্তব্ধ। ওপরের কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে। একবার কেউ খক খক্ করে কাশল।
আমি বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি লক্ষ্য করে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, ভয় নেই জয়ন্ত! তোমাকে বলেছি, আড়াল থেকে যারা হুমকি দেয়, তারা ভীতু।
অবনী মৈত্র শিগগির এসে গেল। সকালে দেখা সেই বেশভূষা। তবে এখন হাতে একটা বেঁটে ছড়ি। বেদির একপ্রান্তে বসে বলল, পাগলটা বিকেলে কোথায় বেরিয়েছে নইলে ঠিকই টের পেয়ে যেত এবং এখানে এসে ঝামেলা বাধাত।
কর্নেল বললেন, আপনার সাধনসঙ্গিনী এখন কী করছেন?
কী বললেন? সাধনসঙ্গিনী? তান্ত্রিক রেগে গেল। কী বলছেন মশাই? গোপা আমার শিষ্যা।
সুদর্শন বলছিল–
ও যে সত্যি পাগল হয়ে গেছে, আপনার বোঝা উচিত ছিল। আমেরিকায় এক সাইকিয়াট্রিস্ট ওর চিকিৎসা করছিলেন। সারল না বলেই গোপা কলকাতায় নিয়ে এল। পাগলামির জন্য ওর চাকরি গেছে জানেন?
তাই বুঝি? তা গোপা তো নিজেই স্বামীর অসুখ সারাতে পারে।
চেষ্টা করছে। আমিও করছি। যাক গে, বলুন কী আপনার কথা?
সুদর্শনের বাবার প্রপার্টি এই বাড়িটা। তাই না?
হ্যাঁ। পিসেমশাই উইল করে গেছেন ছেলের নামে। উইলের ট্রাস্টি আমি।
এই বাড়ি ছাড়া আর কী প্রপার্টি আছে?
আগে বলুন কেন একথা জানতে চাইছেন?
পরে বলছি। প্লিজ, আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
ব্যাঙ্ক ফিক্সড ডিপজিট আর কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বড়জোর লাখ পাঁচেক।
সুদর্শন কি বাবা-মার একমাত্র সন্তান?
হ্যাঁ।
সুদর্শন যদি মারা যায়, প্রপার্টি কে পাবে?
সুদর্শনের স্ত্রী এবং সন্তানাদি থাকলে, তারাই পাবে। উইলে এই ব্যবস্থা করা আছে।
আপনি কিছু পাবেন না?
আমি যতদিন বাঁচব, মাসোহারা পাব এক হাজার টাকা করে। এখনও পাচ্ছি। অর্থাৎ নিচ্ছি।
সুদর্শনের স্ত্রী বা সন্তানাদি না থাকলে কে প্রপার্টি পাবে?
আপনি স্বামী ব্রহ্মানন্দের নাম শুনেছেন? চণ্ডীতলায় ওঁর আশ্রম। পিসেমশাই ওঁর ভক্ত ছিলেন। কাজেই সেই আশ্রম এই প্রপার্টি পাবে।
চণ্ডীতলা কোথায়?
নদীয়ায় কেষ্টনগরের কাছে।
আশ্রমের কেউ এ বাড়ি আসেন?
ডোনেশন নিতে আসে। প্রতি বছর গুরুপূর্ণিমায় ব্রহ্মানন্দজীর জন্মোৎসব। টাকা দিই। অবনী মৈত্র হঠাৎ চাপাস্বরে বললেন, আপনি তো মশাই প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ওই ভণ্ড সাধুকে ধরিয়ে দিন না। আশ্রমের আড়ালে ড্রাগ আর আর্মস স্মাগলিং করে। গভর্নমেন্টের হোমরা-চোমরা লোকেরা ওর ভক্ত। নৈলে কবে ওর বুজরুকি ফঁস করে দিতাম।
আপনি এর প্রমাণ পেয়েছেন?
ধ্যানবলে জেনেছি।
আশ্রমে কখনও গেছেন আপনি?
নাহ্। নেমন্তন্ন করে। যাই না।
গোপা গেছে এখানে আসার পর?
কক্ষণো না। ওকে সব বলেছি। গোপা ডাকিনীতন্ত্রের খেল দেখাবে। অপেক্ষা। করুন।
তাহলে সুদর্শনের মৃত্যু হলে এখন প্রপার্টি পাবে গোপা।
পাবে। অবনী মৈত্র আবার চাপাস্বরে বললেন, সুদর্শনের কাছে আপনি কত ফি নিয়েছেন?
ফি নেওয়া আমার অভ্যাস নয় অবনীবাবু! কারণ আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই।
তাহলে আপনি আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কেন মশাই? তান্ত্রিক আবার রেগে গেলেন। নাক গলানোর স্বভাব থাকলে ব্রহ্মানন্দের ডেরায় গিয়ে গলান। দেখি আপনার কত হিম্মত।
আচ্ছা অবনীবাবু, সুদর্শন কি এখানে আসার পর ওই আশ্রমে গেছে?
যেতে চেয়েছিল। গোপা যেতে দেয়নি। গোপার মধ্যে হিরোটিক পাওয়ার আছে। ইচ্ছে করলে ও যে-কোনও মানুষকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারে। ওর চোখদুটি দেখেছেন?
হুঁ, দেখেছি। দৃষ্টিতে অস্বাভাবিকতা আছে।
তাহলেই বুঝুন।
আপনারা দুজনে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়েছিলেন সম্প্রতি?
গিয়েছিলাম। আপনি-আশ্চর্য! অবনী মৈত্র নড়ে বসল। তাহলে সুদর্শন এখানে এসেই আপনাকে আমাদের পেছনে লাগিয়েছে? দেখুন মশাই! খুলেই বলি। গোপা ইন্ডিয়ান ডাকিনীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমার সাহায্য চেয়েছিল। আমি ওকে পুরুলিয়ার আদিবাসী এরিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ব্যস! আর আমি কিছু বলব না।
আপনি অপর্ণা রায় নামে কোনও মেয়েকে চেনেন?
নাহ্। বলে অবনী মৈত্র উঠে দাঁড়াল। আপনারা এবার আসুন। আমার জপের সময় হয়ে গেছে।
আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি, সেই সময় কেউ বলে উঠল, কর্নেল সরকার! প্রত্যেক ফ্যামিলির রাইট অব প্রাইভেসি আছে। আই ওয়ার্ন য়ু, ডোন্ট ইন্টারফিয়ার।
কর্নেল বললেন, মিসেস সান্যাল! আপনি বিপন্না। সাবধানে থাকবেন।
গোপা এগিয়ে এসে ক্ষিপ্তভাবে বলল, দ্যাটস নট ইওর বিজনেস, ওল্ড ম্যান! অ্যাওয়ে! গো অ্যাওয়ে আই স্যে।
আমরা খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। অবনী মৈত্র দরজা বন্ধ করে দিল গলিরাস্তায় গিয়ে বললাম, সাংঘাতিক মেয়ে। বেচারা সুদর্শনের জন্য আমার ভয় হচ্ছে।
গাড়িতে ওঠার পর কর্নেল বললেন, এবার নাটকটা জমে উঠবে আশা করি।
.
০৪.
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলে ষষ্ঠীচরণ বলল, বাবামশাইকে একটা মেয়েছেলে ফোং করেছিল। আমি বললাম, উনি বেইরেছেন। তখন বলল, পরে ফোং করব।
ড্রয়িংরুমে ঢোকার মুখে টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ওই শোন্ ফোং করছে। তুই কফি নিয়ে আয়। শিগগির!
ষষ্ঠী ফোনকে ফোং বলে। কর্নেলের মুখেও ফেং শুনলে সে বেজার হয়। তুম্বো মুখে চলে গেল। বুঝলাম কফিটা প্রচণ্ড কড়া হবে।
ফোন তুলে সাড়া দিয়ে কর্নেল বললেন, বলো অপর্ণা!…গিয়েছিলে?..। বলো।…আচ্ছা। তারপর?…কর্নেল কিছুক্ষণ হুঁ দিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। সময়মতো আমাকে জানাবে।
টেলিফোন রেখে ইজিচেয়ারে বসে কর্নেল বললেন, অপর্ণা আমার এখান থেকে সোজা সুদর্শনের বাড়ি গিয়েছিল। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কারও সাড়াশব্দ পায়নি। তখন বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে দেখে, সুদর্শন ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
বললাম, বাঃ! তারপর?
অপর্ণাকে নাকি শেষ দেখা দেখতে গেছে। শুনে অপর্ণা ওকে অনেক। বুঝিয়েছে। অপর্ণার মাও বুঝিয়েছেন। রাত্রে ওখানে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন। কিন্তু সুদর্শন থাকেনি।
সত্যিই ভদ্রলোক বদ্ধ পাগল।
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, তবে আজ রাত্র সে আত্মহত্যা করবে না। বলেছে। চণ্ডীতলা আশ্রমে তার বাবার গুরুদেবের কাছে যাবে। তাকেও সব কথা জানিয়ে বিদায় নেবে। ফিরে এসে আত্মহত্যা করবে।
উত্তেজিতভাবে বললাম, কর্নেল! ব্রহ্মানন্দজি কী করবেন আমি বাজি রেখে বলতে পারি।
বলো শোনা যাক।
ওর আত্মহত্যায় সায় দেবেন। তবে তার আগে সব প্রপার্টি আশ্রমের নামে লিখিয়ে নেবেন। ওইসব সাধুর শিষ্যদের মধ্যে দুদে অ্যাডভোকেট থাকা স্বাভাবিক। ব্রহ্মানন্দজি ওকে বলবেন, তুমি যখন মরবে ঠিক করেছ, মরো। তবে তুমি মরলে তোমার প্রপার্টি ওই খারাপ মেয়েছেলেটা পাবে। সেটা কি ঠিক?
কর্নেল হাসলেন। উইলে সত্যি কী আছে, আমরা এখনও জানি না জয়ন্ত। অবনী মৈত্র মিথ্যাও বলতে পারে। শুধু এটুকু বুঝেছি, সুদর্শনের বাবার গুরুদেবের সঙ্গে তার সম্ভবত শত্রুতা আছে। এটা খুব স্বাভাবিক। অবনী একজন তান্ত্রিক। কাজেই সে নিজেও ও বাড়িতে কিংবা অন্য কোথাও আশ্রম করতে চাইবে।
এবং গোপা হবে তার সাধনসঙ্গিনী!
ষষ্ঠী কফি আনল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, তোমার থিওরিটা মন্দ না। তবে তার আগে জানা দরকার উইলে সত্যিই কী আছে। কলকাতার অ্যাটর্নিমহলে আমার কিছু জানাশোনা আছে। সুদর্শনের বাবা সদানন্দবাবু কার মক্কেল ছিলেন জানা দরকার।
সুদর্শনের বাবার নাম আপনি জানেন?
ওদের ঘরের দেয়ালে একটা ছবিতে নাম এবং জন্মমৃত্যুর তারিখ লেখা আছে।
আমি ওসব লক্ষ্য করিনি।
কর্নেল চুপচাপ কফি খেতে থাকলেন। ওঁর মুখ দেখে টের পাচ্ছিলাম, ষষ্ঠী কফিটা প্রচণ্ড কড়া করেছে। আমারটা অবশ্য স্বাভাবিক। একটু পরে কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ও ঘরে সুদর্শনের মায়ের ছবি দেখিনি।
সুদর্শন নিজের ঘরে রেখেছে নিশ্চয়। রিং করে জেনে নিন না!
ওকে পাচ্ছি কোথায়? অপর্ণাকে বলেছে, আজ রাত্রেই ট্রেনে কৃষ্ণনগর চলে যাবে। তারপর চণ্ডীতলা যেতে অসুবিধে নেই। সাইকেল রিকশা বা এক্কাগাড়ি পাওয়া যায় সবসময়। নদীর ধারে নাকি বেশ বড় আশ্রম।
আচ্ছা কর্নেল, আপনি গোপাকে বিপন্ন বললেন। সুদর্শন ওকে মার্ডার করবে বলে? নাকি নিছক ভয় দেখিয়ে এলেন?
কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। কিন্তু আমার ইনটুইশন–এনিওয়ে, শুধু এটুকু বলতে পারি গোপাকে যেন কেউ বা কারা টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে। সুদর্শন দৈবাৎ মারা গেলে গোপার বিপদ।
বুঝিয়ে বলুন!
এ মুহূর্তে কিছু বুঝিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, জয়ন্ত!
বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বইয়ের র্যাক থেকে সেই প্রকাণ্ড বইটা নিয়ে এলেন। টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে বইটার পাতা খুললেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী বই ওটা?
মার্লো পোঁতির লেখা, দা ফেনোমেলোলজি অব পার্সেপশন। মানসিক অসুখবিসুখ নিয়ে সিরিয়াস দার্শনিক আলোচনা।
আমি উঠি। বড় টায়ার্ড।
ঠিক আছে। এসো।
কর্নেল বইয়ের পাতায় মন দিলেন। আমি বেরিয়ে এলাম। ষষ্ঠী দরজা বন্ধ করতে এসে ফিক করে হেসে চাপাস্বরে বলল, বাবামশাইকে খুব জব্দ করেছি। আর্ধেক কাপও খেতে পারেননি। আপনারটা কিন্তু কড়া করিনি।
এই সময় কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি! এবার তেতো করলে লিন্ডাদের কুকুরটা এনে ঘরে ছেড়ে দেন।
ষষ্ঠীর মুখ আবার বেজার হয়ে গেল। সে কুকুরকে বড় ভয় করে।
পরদিন সকালে চা খেতে খেতে খবরের কাগজগুলোয় চোখ বুলোচ্ছি, টেলিফোন বাজল। সাড়া দিতেই কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, সুপ্রভাত ডার্লিং!
সুপ্রভাত বস্! কোনও খবর আছে?
আছে। তুমি শ্যামপুকুর থানায় চলে এস। অপেক্ষা করছি।
থানায় কেন?
সুদর্শন মারা গেছে।
সর্বনাশ! কোথায় কী ভাবে মারা গেল? তার তো রাত্রে চণ্ডীতলা আশ্রমে যাওয়ার কথা!
সুদর্শন যে কোনও কারণে হোক, চণ্ডীতলা যায়নি। নিজের ঘরে মারা গেছে। টেবিলে একটা সুইসাইডাল নোট পাওয়া গেছে। তুমি চলে এস। ফোনে সব বলা যাবে না।
ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়লাম। দশটায় ব্রেকফাস্ট করি। এখন নটা বাজে। শ্যামপুকুর থানার সামনে গিয়ে দেখি, কর্নেল অপেক্ষা করছেন। গাড়িতে উঠে বললেন, সুদর্শনের বাড়িতে চলো। বডি মর্গে চলে গেছে। পুলিশকে কিছু জানাইনি। পুলিশ সুইসাইডাল নোট পেয়েছে। দ্যাটস এনাফ ফর দেম।
সুদর্শনের হাতের লেখা?
হ্যাঁ। ওর প্যাডে ওরই রাতের লেখা। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ইত্যাদি। ওসি বললেন, হাতের লেখার নমুনা পেয়ে গেছেন।
আপনি কী করে খবর পেলেন?
ভবতারণ আমাকে ফোন করেছিল। সুদর্শন গত রাত্রে প্রায় একটায় বাড়ি ফরে। ভবতারণকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিল, কিছু ঘটলে যেন এই নাম্বারে রিং করে জানিয়ে দেয়। ট্যাক্সি করে গিয়ে দেখি, পুলিশ এসে গেছে। আমাকে কনস্টেবলরা ঢুকতে দিল না। অগত্যা থানায় চলে গেলাম। তখন প্রায় আটটা বাজে। বাঁয়ের গলি দিয়ে শর্টকাট করো।
গলিতে সুদর্শনের বাড়ির গেট বন্ধ। সামনের দিকের রাস্তায় লোকেরা ভিড় করে আছে। হর্ন বাজানোর পর অবনী মৈত্রকে পোর্টিকোর ছাদে দেখতে পেলাম। তারপর ভবতারণ দৌড়ে এসে গেট খুলে দিল। কান্না চেপে বলল, আমি আর কারও পরোয়া করি না স্যার। আমাকে গেট খুলতে মানা করছে। ইশ! সাধু সেজে আছে। পরের ঘাড়ে বসে ফুর্তি ওড়াচ্ছে। এবার মজাটা দেখাচ্ছি।
পোর্টিকোর ছাদ থেকে ততক্ষণে অবনী মৈত্র অদৃশ্য। পোর্টিকোর তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা বেরোলাম। ভবতারণ বলল, ভেতরে আসুন স্যার! সাহেব আমাকে বলে গেছেন, খারাপ কিছু ঘটলে আপনাকে যেন খবর দিই। আপনি এলে যেন যত্নআত্যি করি।
অবনী মৈত্র পর্দা তুলে ঘরে ঢুকে বলল, এতে গোয়ন্দোগিরির কিছু নেই মশাই! পুলিশ যা করার করেছে। খামোকা আপারা জলঘোলা করতে এসেছেন। অ্যাই ভবা! তুই কেন এঁদের বাড়ি ঢোকালি?
ভবতারণ খুঁসে উঠল। যা তা বলবেন না দাদাবাবু! সাহেব যা বলে গেছেন, সেই মতো কাজ করছি।
তান্ত্রিক যথারীতি গঙ্গাস্নান করে এসেছে বোঝা যাচ্ছিল। পরনে সেই পোশাক। গেরুয়া লুঙ্গি এবং ফতুয়া। কপানে ত্রিপুণ্ড্রক। ভবতারণের দিকে রুষ্ট দৃষ্টে শুধু তাকিয়ে রইল।
আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, বসুন অবনীবাবু! কথা আছে।
যা বলার গতকাল সন্ধ্যায় বলেছি মশাই! এখন আমি মন্দিরে যাচ্ছি।
বলে তান্ত্রিক যথারীতি খড়মের শব্দ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। ভবতারণ চোখ মুছে বলল, রাত্তিরে সাহেবের কথা শুনে খটকা লেগেছিল। ঘুম হয়নি। আমি নিচের ঘরে থাকি। খুটখাট শব্দ হলেই উঠে বসেছি। তারপর পোড়া চোখে কখন কালঘুম নেমে এসেছিল। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। ওপরে গিয়ে দেখলাম, সাহেবের ঘরের দরজা বন্ধ। কিন্তু তখন কি জানি দরজা ভেজানো আছে? উনি দশটার আগে ওঠেন না। ছটায় দাদাবাবু আর মেমসাহেব গঙ্গাস্নানে গেলেন। সাড়ে সাতটায় ফিরলেন।
কর্নেল বললেন, রোজই কি ওই সময় ফেরেন?
আজ্ঞে। আমি ওঁদের জন্য চা করছিলাম। হঠাৎ ওপরে মেমসাহেবের কান্নাকাটি শুনে চমকে উঠলাম। গিয়ে দেখি, সাহেবের ঘরের দরজা খোলা। সাহেব টেবিলে মাথা রেখে বসে আছেন। মেমসাহেব ওঁকে ওঠানোর চেষ্টা করছেন। আমি গিয়ে সাহেবকে সিধে করলাম। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে গেছে। মুখে নাকে রক্ত গড়াচ্ছে। রক্ত আর ফেনা। মেঝেয় একটা কাপ উল্টে পড়ে আছে। দাদাবাবু ও ঘরে গিয়ে সব দেখে বললেন, সর্বনাশ! সুইসাইড করেছে। থানায় ফোন করতে হবে। উনি টেলিফোন করলেন। আমার মাথায় তখন সাহেবের কথাটা ভাসছে। সামনের সাইডে রাস্তার ধারে ভকতবাবুর রঙের দোকানে টেলিফোন আছে। আমাদেরই ভাড়াটে স্যার। ওঁকে ডাকাডাকি করে সব বললাম। ফোন করলাম আপনাকে। এই দেখুন, সাহেবের লিখে দেওয়া আপনার নম্বর।
সে পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে দিল কর্নেলকে। কর্নেল সেটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন, মেমসাহেব এখন কী করছেন?
নিজের ঘরে আছেন। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। ডাকছিলাম। সাড়া পেলাম না।
তোমার সাহেবের ঘরে কি পুলিশ তালা এঁটেছে?
আজ্ঞে না তো! পুলিশ ভাঙা কাপটা আর টেবিলে রাখা একটা চিঠি নিয়ে গেছে।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, পুলিশের মতে পটাসিয়াম সায়নায়েড। চা বা কফির সঙ্গে খেয়েছে। ভবতারণ, চা বা কফি তো তুমিই করো?
আজ্ঞে। তবে সাহেবের কফি সেই দশটায়।
তা হলে তোমার সাহেবকে চা বা কফি কে দিয়েছিল?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার!
চলো! ওঁর ঘরটা দেখব।
ভবতারণ আমাদের ওপরে নিয়ে গেল। একটা ঘরের দরজা খুলে বল, এই ঘরে স্যার।
ঘরের জানালাগুলো ভোলা। কিন্তু পর্দা ঝুলছে। একপাশে সেকেলে খাটে সুদৃশ্য বেডকভার চাপানো। ভবতারণ আলো জ্বেলে দিল। কর্নেল আগে বেডকভার তুললেন। বললেন, সুদর্শন বিছানায় শোয়নি।
একপাশে ডিভান। পিছনে বইয়ের র্যাক। অন্যপাশে লেখার টেবিল এবং গদি আঁটা চেয়ার। দেওয়ালে বিক্ষিপ্তভাবে টাঙানো কয়েকটা রঙিন ছবি। বিখ্যাত চিত্রকরদের প্রিন্ট। টেবিলের নিচে ডানদিকে ভাঙা কাপের কয়েকটা টুকরো পড়ে আছে। কর্নেল আতস কাঁচ বের করে কাপের টুকরোগুলো দেখলেন। চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মিনিট দুয়েক। তারপর বললেন, ভবতারণ! কী অবস্থায় অবস্থায় তোমার সাহেবকে দেখেছিলে, তুমি বসে দেখিয়ে দাও।
ভবতারণ একটু দ্বিধার সঙ্গে চেয়ারে বসে দুটো হাত ট্রেবলের ওপর ছড়িয়ে দিল এবং মুখটা একপাশে কাত করে টেবিলে রাখল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
কর্নেল আতস কাঁচ দিয়ে টেবিলের ওপরটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, তোমার সাহেবের একটা ল্যাব আছে শুনেছি। ল্যাবরেটরি মানে বোঝো?
আজ্ঞে! ওই সে পর্দা ঝুলছে দরজায়। বলে সে পর্দা তুলল। দরজাটা ভেজানো ছিল। খুলে দিল। আমরা ল্যাবে ঢুকলাম। কর্নেল বললেন, গ্যাসের সিলিন্ডার আছে দেখছি। কেটলি এবং কাপও! সুদর্শন রাত্রে কফি খেত। গুড়ো কফির প্যাকেট আছে কয়েকটা।
বিচিত্র গড়নের জার, নল, শিশিবোতল এবং দুটো কম্পিউটার। একটা জারে কয়েকটা টিকটিকি কী আরকে ডোবানো আছে। গা ঘিনঘিন করছিল। পশ্চিমের জানালার পর্দা তুলে কাঁচের ভেতর গঙ্গা দেখতে পেলাম। জানালার নিচে একটা স্টিলের ইজিচেয়ার। সুদর্শন নিশ্চয় এখানে বসে গঙ্গদর্শন করত।
কর্নেল ল্যাবের ভেতর চক্কর দিচ্ছিলেন। হঠাৎ গ্যাসের চুল্লীর কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন। এ ঘরের মেঝে কিছুটা নোংরা। আতস কাঁচে পরীক্ষা করার পর কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা ভবতারণ, তোমার সাহেব কি তোমাকে কিছু হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন?
আজ্ঞে না তো?
ওঁকে কাল কিছু খোঁজাখুঁজি করতে দেখেছিলে?
ভবতারণ স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল, আজ্ঞে না। কই? তেমন কিছু
কর্নেল সরকার!
চমকে উঠে দেখি ল্যাবের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে গোপা। পরনে গৈরিক শাড়ি ব্লাউজ। চুড়ো করে বাঁধা চুল। চোখে অস্বাভাবিক উজ্জ্বল সেই দৃষ্টি। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, আপনার দুর্ভাগ্যের জন্য দুঃখিত মিসেস সান্যাল।
দ্যাটস মাই বিজনেস। এগেন আই ওয়ার্ন যু! ডোন্ট ইন্টারফিয়ার কর্নেল সরকার!
মিসেস সান্যাল! এবার সত্যিই আপনি বিপন্ন।
আপনি চলে যান কর্নেল সরকার।
মিসেস সান্যাল! আপনি বিপজ্জনক ফাঁদে পা দিয়েছেন।
গোপা এতক্ষণে একটু দমে গেল। আস্তে বলল, কী বলতে চান আপনি?
আপনার স্বামীর খুনী এবার আপনাকে সরিয়ে দেবে পৃথিবী থেকে।
ননসেন্স! ও সুইসাইড করেছে। একটু অসতর্কতার জন্য
না ম্যাডাম! সুদর্শন সুইসাইড করেনি। হি ইজ ডেলিবারেটলি মার্ডার্ড।
গোপা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।
হ্যাঁ। কেউ একটা কাপ এই গ্যাসের চুল্লীর কাছে রেখে দিয়েছিল যাতে সুদর্শন হাতের কাছে পায় এবং তাতে সায়নায়েড বড়ি ব্রেখেছিল। সুদর্শন লক্ষ্য করেনি। কারণ বড়িটা ছিল সাদা। চিনি ছাড়া র কফি খাওয়ার অভ্যাস আমেরিকায় কিছুকাল থাকলে রপ্ত হয়ে যায়।
গোপা শ্বাস ছেড়ে বলল, বাট হি ওয়াজ এ সাইকিক পেশ্যান্ট! সব সময় সবাইকে বলে বেড়াত সুইসাইড করবে। একটা সুইসাইডাল নোটও পাওয়া গেছে।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, খুনী সেই সুযোগটা নিয়েছে কাল। সকালে নিচের ঘরে কথা বলার সময় সুদর্শন হঠাৎ বলেছিল, ওই যাঃ চিঠিটা–এখন বুঝতে পারছি, ঝোঁকের বশে একটা সুইসাইডাল নোট কালই সে লিখেছিল। তারপর সেটা নিপাত্তা হয়ে যায়। আই এগ্রি গোপাদেবী, হি ওয়াজ এ সাইকিক পেশ্যান্ট। তাই ওটা সম্পর্কে হইচই বাধায়নি। হয়তো আঁচ করতেই পারেনি ওটা কেউ কাজে লাগাবে।
কিন্তু কে সে?
এখনও জানি না।
সে কি আমাদের মধ্যে কেউ?
জানি না।
বাট হোয়াট ইজ দা মোটিভ?
এখনও আমার কাছে তা স্পষ্ট নয়। প্লিজ গোপাদেবী! আপনি এখনই আপনার জিনিসপত্র নিয়ে আপনার কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান। আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
কলকাতায় আমার কোনও আত্মীয় নেই।
হোটেল আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। আপনি আমার অ্যাপার্টমেন্টে উঠতে পারেন। তারপর আমেরিকায় ফিরে যান। কোনও ফ্লাইটে ভি. আই. পি. কোটা থেকে একটা সিটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।
সরি কর্নেল সরকার। আপনি কেন এসব কথা বলছেন আমার মাথায় আসছে না। নিজেকে বাঁচানোর শক্তি আমার আছে। গোপর মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠল। আই হ্যাভ আকোয়ার্ড দা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার, য়ু নো কর্নেল সরকার! আজই আমার প্ল্যান ছিল, প্রেস কনফারেন্স ডেকে তার প্রমাণ দেব। কিন্তু মাই হাজব্যান্ড ইজ ডেড!
পর্দা সরিয়ে তান্ত্রিক ঢুকল। কী হয়েছে গোপা? গোয়েন্দামশাই কি তোমাকে জেরা করছেন?
অবুদা, হি ইজ টেলিং স্ট্রেঞ্জ থিংস!
ওকে কী বলছেন মশাই?
কর্নেল জবাব দিলেন না। গোপা বলল, উনি বলছেন মাই লাইফ ইজ ইন ডেঞ্জার।
আঁ? তার মানে?
আর বলছেন, সুদর্শন সুইসাইড করেনি। কেউ নাকি তাকে মার্ডার করেছে।
তান্ত্রিক হাসলেন। গোয়েন্দারা এরকম বলেই থাকে। যার যা বুলি! তুমি ভয় পেয়ো না গোপা! ও মশাই! সুদর্শন যদি খুন হয়েই থাকে খুনী কি আমি? নাকি ওই ভবা?
অবনীবাবু! কর্নেল বললেন। সুদর্শনকে সত্যিই খুন করা হয়েছে।
আমি মশাই খুনটুন করতে পারি না। ভবাটাও না আরশোলা দেখলে ব্যাটাচ্ছেলে তুলকালাম করে। হুঁ, সুদর্শন যদি সত্যিই খুন হয়ে থাকে তাহলে সেই চণ্ডীতলার ব্রহ্মানন্দ খুন করিয়েছে। দাঁড়ান! থানায় খবর দিই!
টের পেলাম, তান্ত্রিক কারণবারি পান করেছে। সে পাশের ঘরে টলতে টলতে ঢুকল। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন। আমিও ওঁর সঙ্গ ধরলাম। কর্নেল টেলিফোনের কাছে গিয়ে বললেন, অবনীবাবু! এসব কথা পুলিশকে জানালে আপনিই বিপদে পড়বেন।
কেন মশাই? আমি কী করেছি?
পুলিশ প্রথমে আপনাকেই সন্দেহ করবে এবং হাতকড়া পরাবে। বেচারা ভবতারণও রেহাই পাবে না। এবং পুলিশ গোপাদেবীকেও রেয়াত করবে না।
অবনী মৈত্র মাথা দোলালেন। ঠিক। ঠিক বলেছেন মশাই! আমরা তিনজনেই ফেঁসে যাব। কাজেই চেপে যাওয়া যাক। অ্যাই ভবা! সাবধান! বলে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আচ্ছা গোয়েন্দামশাই! পুলিশ যদি নিজের বুদ্ধিতে টের পায়, সুদর্শন সুইসাইড করেনি, খুন হয়েছে?
টের পাবে না। কারণ আমি যা জানি পুলিশ তা জানে না। সুইসাইডাল নোটই ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক আছে। আমরা মুখ বুজে থাকব। কী বলল গোপা?
গোপা হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কর্নেল তাকে অনুসরণ করে বললেন, গোপাদেবী! আর ভুল করবেন না।
দেখলাম, গোপা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং সশব্দে দরজা বন্ধ করল। কর্নেল আস্তে বললেন, চলো জয়ন্ত!
তান্ত্রিক ডাকছিলেন, ও মশাই! শুনুন! শুনুন! যা বাবা! হচ্ছেটা কী?…..
.
০৫.
ভবতারণ আমাদের পেছন-পেছন নিচের ঘরে এল। কাতর স্বরে বলল, চলে যাচ্ছেন স্যার? এর কোনও আস্কারা হবে না? আমি যে এবার ভেসে যাব! দাদাবাবু আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন।
কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমাকে তাড়ায় কারও সাধ্য নেই। যদি তুমি আমার কথার ঠিক-ঠিক জবাব দাও।
ভবতারণ বলল, দেব স্যার। বলুন কী জানতে চান?
এ বাড়িতে বাইরের কোনও লোক আসত কি?
বাইরের লোক তো অনেক আসত। মেমসাহেব আসার পর মানা করেছিলেন, কেউ যেন বাড়িতে না ঢোকে।
যারা আসত, তাদের তুমি চেনো?
কাউকে কাউকে চিনি।
বেশি কে আসত?
আজ্ঞে রঙের দোকানের ভকতবাবু।
কার কাছে আসতেন?
দাদাবাবু ছাড়া আর কার কাছে আসবেন? মন্দিরে বসে দুজনে কথা বলতেন। কখনও দাদাবাবুর ঘরেও বসে থাকতেন। ধম্ম নিয়ে কথাবার্তা হতো।
তোমার সাহেব-মেমসাহেব আসার পর ভকতবাবু এসেছিলেন?
একদিন এসেছিলেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর আর আসেননি।
তোমার সাহেবের মা তো বেঁচে নেই?
ভবতারণ গলার ভেতর বলল, বেঁচে আছেন। কিন্তু
বলো ভবতারণ!
ভবতারণ চোখ মুছে বলল, সে অনেক দুঃখের কথা স্যার! বড়সাহেব– আমার কর্তার চরিত্তির মোটেও ভাল ছিল না। অত বড় ওষুধের ব্যবসা মদ আর মেয়েমানুষে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ছেলে পর্যন্ত আমেরিকা পালিয়ে গিয়েছিল বাবার ওপর রাগ করে।
সুদর্শন বাবার ওপর রাগ করে চলে গিয়েছিল?
আজ্ঞে। ছেলেও গেল, মা-ও চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। এখন চণ্ডীতলা আশ্রমে আছেন। দেশে যাবার নাম করে দেখে আসি। ভালই আছেন। ইস্কুল করেছেন আশ্রমে।
সুদর্শনের মায়ের নাম কী?
করুণাময়ী। বড়সাহেব মরার আগে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি চণ্ডীতলা গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি আসেননি। খুব কড়া ধাতের মেয়ে স্যার! ভবতারণ শ্বাস ছেড়ে বলল, ছেলের মরার খবরটা এখন আমাকেই দিয়ে আসতে হবে। দাদাবাবু তো যাবেন না। দাদাবাবুর সঙ্গে আশ্রমের সাধুবাবার বনিবনা নেই।
আচ্ছা ভবতারণ, তোমার বড়সাহেব এই বাড়িঘর সম্পত্তির কোনও উইল করে গেছেন?
হ্যাঁ স্যার! আমি সাক্ষী। দাদাবাবু সাক্ষী। ভকতবাবুও সাক্ষী।
কোন উকিল উইল লিখেছিলেন?
পাড়াতেই থাকেন স্যার। শিবপদ ঘোষ। ট্রামরাস্তার ওধারে নতুন চারতলা বাড়ি।
উইলে সম্পত্তি কার কার নামে দেওয়া আছে?
মনে পড়ছে না স্যার! ও সব ভজকট ব্যাপার বুঝি না। আপনি উকিলবাবুর কাছে জানতে পারবেন। আমি শুধু এটুকু জানি, যদ্দিন বাঁচব, মাসে পাঁচশ টাকা মাসোহারা পাব। আর দাদাবাবু পাবেন একহাজার টাকা।
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, আর একটা কথা ভবতারণ। তোমার বড়সাহেবকে একবার পুলিশ আরেস্ট করেছিল। বাড়ি সার্চ হয়েছিল। কেন তা জানো?
ভবতারণ চমকে উঠল। বলল, খামোকা হয়রানি স্যার! বড়সাহেব নাকি চোরাই ওষুধের কারবারি! স্রেফ মিথ্যা। এক ঘণ্টা আটকে রেখে দিয়েছিল পুলিশ। বাড়িতে কি পায়নি।
চলি ভবতারণ। চিন্তা কোরো না। কিছু ঘটলে আমাকে টেলিফোন করো। এই আমার কার্ড। বলে কর্নেল তার একটা নেমকার্ড দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, ধরে নিচ্ছি সুদর্শনের সুইসাইডাল নোট কেউ চুরি করে তাকে সায়নায়েড খাইয়ে মেরেছে। কিন্তু আপনি তা প্রমাণ করতে পারবেন কি?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, দেখা যাক।
সুদর্শন সাইকিক পেশেন্ট তা ঠিক। কিন্তু এই বোকামিটা কেন করল বোঝা যাচ্ছে না। আগে থেকে সুইসাইডাল নোট কি কেউ লেখে?
অনেকে লেখে বৈকি। এক মিনিট! তুমি দেখ, কোথাও গাড়ি পার্ক করা যায় কি না।
ঘিঞ্জি ট্রামরাস্তায় পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া কঠিন। বাগবাজার স্ট্রিটের মুখে পৌঁছে গাড়ি রাখলাম। কর্নেল বললেন, ভকতবাবুর সঙ্গে আলাপ করা দরকার। এস। আমরা নতুন বাড়ি করেছি। রঙ কিনতে চাই। বুঝেছ তো?
গাড়ি লক করে বললাম, অত ঝুটঝামেলায় না গিয়ে ভবতারণকে সঙ্গে আনলেই পারতেন।
নাহ্। লোকটা তাতে ঘাবড়ে যেত। এস।
দোকানের নাম লালজি পেইন্টিং কোম্পানি। সবে দোকান খুলে বেঁটে নাদুস-নুদুস চেহারার এক অবাঙালি ভদ্রলোক সিদ্ধিদাতা গণেশকে প্রণাম করছিলেন। আধুনিক কেতায় কাউন্টার আছে। শো কেশ এবং রঙবেরঙের কাটআউট। দুজন সেলসম্যান গম্ভীরমুখে বসে আছে টুলে। আমাদের দেখে একজন বলল, বলুন স্যার!
কর্নেল বললেন, আপনাদের নিজেদের কোম্পানির রঙ?
নিজেদের কোম্পানির আছে। অন্য কোম্পানিরও পাবেন। তবে আমাদের কোম্পানির কিনলে কিছু সুবিধে দিই। যেমন ধরুন, আমরা এক্সপার্ট মিস্ত্রি পাঠিয়ে সাহায্য করি। তাদের মজুরির হার কম। তা ছাড়া ছ মাসের মধ্যে গড়বড় হলে আমরা নিজেদের খরচে রি-পেইন্ট করিয়ে দিই। অবশ্যি ইনসাইড ওয়াল। আউটার ওয়াল বা দরজা-জানলার ক্ষেত্রে হাফ কস্ট আপনার। সে-ও ছমাসের মধ্যে।
বাঃ! এমন সুবিধে তো কেউ দেয় না।
এটাই আমাদের স্পেশালিটি স্যার! আমাদের ইনসাইড ডেকরেটার্স অ্যান্ড ডিজাইনার্স সেকশনও আছে। নতুন বাড়ি?
হ্যাঁ। একেবারে নতুন।
সেলসম্যান একটা রঙিন মোটা বই বের করে দিল। এই দেখুন। কিচেন, বাথ, স্টাডি, ডাইনিং, বেডরুম–সবেরই নানারকম পেইন্টিং ডিজাইন আছে।
উনিই কি কোম্পানির মালিক? ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
নাদুস-নুদুস চেহারার অবাঙালি ভদ্রলোক তাকিয়েছিলেন। সহাস্যে বললেন, আসুন, আসুন। কথা বলার জন্য আমি সবসময় তৈয়ার আছি! বেটা রাজু! দো কাপ চায় বোলাও!
কোণের দিকে হাফসেক্রেটারিয়েট টেবিল। সামনে দুটো চেয়ার। আমরা বসলাম। তারপর কর্নেল বললেন, আপনিই কি ভকতবাবু! নমস্কার!
নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ। আমি সে-ই আছি। ছোটা কোম্পানি। কুছু এজেন্সিভি আছে।
আপনি তো ভবতারণকে চেনেন। তার কাছেই শুনলাম আপনার রঙের কারবার আছে।
ভবতারণের কাছে শুনলেন? ভকতবাবু একটু অবাক হলেন। তাকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ। ওর মালিক সদানন্দবাবু ছিলেন আমার বন্ধু। হঠাৎ আজ ওঁদের বাড়িতে এসেছিলাম। আপনি নিশ্চয় শুনেছেন কী হয়েছে?
ভকতবাবুর মুখে গাম্ভীর্য ফুটে উঠল। হ্যাঁ! বহুৎ আফশোসকি বাত! সাচ কথা বলি আপনাকে আমেরিকা মুল্লুকে গিয়ে ড্রাগ পিয়ে সুদর্শনের মাথা বিগড়ে গিয়েছিল।
অবনীবাবুকে তো আপনি চেনেন?
ভুরু কুঁচকে ভকতজী বললেন, চিনব না কেনো? আমি তাদের টেনান্ট আছি। পাঁচশ টাকা ভাড়া দিই মাসে। অবনী সাধু আছে। জপ করে। লেকিন ভাড়ার দিকে খুব নজর। মদভাঙের জন্য টাকার দরকার। পাবে কোথায়?
ভবতারণ বলছিল, উনি সম্পত্তি থেকে মাসে হাজার টাকা পান। মালিকের নাকি উইল করা আছে।
ভকতবাবু বাঁকা হাসলেন। উইল তো হইয়েছে। সেই উইল কোর্টে প্রোবেট করতে হবে, তবে তো প্রপার্টির সেটলমেন্ট হবে। তা ভকিলবাবু দয়া করে অবনীকে টাকা পাইয়ে দিচ্ছে।
অবনীবাবু নাকি উইল অনুসারে প্রপার্টির ট্রাস্টি। তা হলে কেন উকিল ওঁকে টাকা পাইয়ে দিচ্ছেন।
ট্রাস্টি আছেন শিবপদ ভকিলবাবু। উইলের উইটনেস আমিভি আছি। উইল আছে ভকিলবাবুর কাছে। ভকতবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, সুদর্শন ফিরল। আমি তাকে বললাম, ভকিলবাবুর কাছে যাও। কোর্টে প্রোবেট করো। তুমি প্রপার্টির মালিক আছ। সুদর্শন বলল, সে প্রপার্টি নেবে না। সুইসাইড করবে।
আপনাকে বলেছিল সুইসাইড করবে?
হ্যাঁ। ছাড়িয়ে দিন। বেটা রাজু! চায় লাও! ভকতজি ঘুরে বসলেন। রং কিনবেন তো রংয়ের কথা বলুন। কম্মল! ডিজাইনবুক এখানে দিয়ে যাও।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনাকে ভাড়ার রসিদ দেয় তো ওরা?
রসিদ দেয় ভকিলবাবু। আমি তার কথামতো অবনীকে পাঁচশো টাকা দিই।
আচ্ছা ভকতজি, এই যে সুদর্শন মারা গেল, এবার প্রপার্টি কে পাবে?
তার ওয়াইফ। তবে কোর্টে উইল প্রোবেট করতে হবে। খুব ঝামেলা আছে। স্যার!
সুদর্শনের মা তো বেঁচে আছে।
সে কুছু পাবে না। সদানন্দবাবু তাকে ডিভোর্স করেছিলেন। ভকতজি চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন কর্নেলের দিকে। আপনি তো তার বন্ধু ছিলেন। আপনি সে কথা জানেন না?
ডিজাইনবুকটা ইতিমধ্যে টেবিলে এসেছিল। সেটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কর্নেল বললেন, তা হলে প্রপার্টি এখন সুদর্শনের স্ত্রীর। তাই না?
হ্যাঁ। বেটা রাজু, চায় কাহা?
একজন সেলসম্যান বিরক্তমুখে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, আমি বলি ভকতজি, এই বাড়িটা আপনি কিনে নিন। সুদর্শনের বউ নাকি আমেরিকা ফিরে যাবে প্রপার্টি বেচে।
আপনাকে সে বলেছে?
হ্যাঁ। কর্নেল নির্বিকারমুখে বললেন। প্রপার্টি না বেচে সে কী করবে? সে তো এখানে থাকতে আসেনি।
ভকতজি হাসলেন। আগে পুভ করতে হবে সে সুদর্শনের ম্যারেড ওয়াইফ। আমি শুনেছি, আমেরিকায় ওদের শাদি হয়েছে। সে শাদির কাগজ ইন্ডিয়ায় চলবে না। কোর্টে অনেক ঝামেলা করতে হবে।
তাহলে প্রপার্টি কে পাবে?
একটা আশ্রম। সদানন্দবাবুর গুরুজীর আশ্রম। কিষাননগরের নজদিকে আছে।
এই সময় দু কাপ চা এল। আমরা চুপচাপ চা খেলাম। লক্ষ্য করলাম, ভকতজির চোখেমুখে এতক্ষণে সন্দেহের ছাপ ফুটে উঠেছে। একটু নার্ভাস, কেশে বললেন, বলুন, কোন্ কোন্ ডিজাইন চয়েস করলেন?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু ঠিক করতে পারলাম না ভকতজি! পরে আসবখন।
ভকতজি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, সুদর্শনকে খুনের মোটিভ তাহলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, প্রায় এগারোটা বাজে। আডভোকেট শিবপদবাবুকে এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে না। যাই হোক, পরে দেখা যাবে। জয়ন্ত! আজ পত্রিকা থেকে ছুটি নাও। শিগগির লাঞ্চ সেরে আমরা চন্ডীতলা আশ্রমে যাব।
কর্নেলের আপার্টমেন্টে ফিরে চমকে উঠলাম। বড় ব্রিফকেস নিয়ে বিষণ্ণ মুখে গোপা বসে আছে। বেশভূষা একেবারে অন্যরকম। পরনে সালোয়ার কামিজ। কর্নেল সহাস্যে বললেন, গুড! ভেরি গুড! য়ু আর ইনটেলিজেন্ট ডার্লিং!
গোপা শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলল, অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। আপনি চলে যাওয়ার একটু পরে মন্দিরে গিয়েছিলাম অবুদার খোঁজে। হঠাৎ জবাফুলের ঝোঁপ থেকে একটা মুখোশ পরা লোক ড্যাগার হাতে বেরিয়ে এল। আমি চেঁচিয়ে ওঠার আগেই ভবতারণ ইট ছুড়ল। লোকটা পাঁচিল টপকে পালিয়ে গেল। আমার ধারণা ভবতারণ আমাকে ফলো করে এসেছিল। সে বলল, আপনি এ বাড়িতে আর থাকবেন না মেমসাহেব। একবার ভাবলাম, থানায় ফোন করি। কিন্তু করলাম না। তখনই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বেরোলাম। ভবতারণ ট্যাক্সি ডেকে আনল।
অবনী মৈত্রের সঙ্গে তোমার আর দেখা হয়নি?
না। এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে, অবুদা সাংঘাতিক লোক। ওকে চিনতে ভুল হয়েছিল।
কর্নেল ইজিচেয়ারে বসলেন। ষষ্ঠী! একে কফি খাইয়েছিস?
গোপা বলল, হ্যাঁ। আপনার লোকটি খুব ওবিডিয়েন্ট।
তোমার মিশন সাকসেসফুল হয়েছে কি গোপা?
গোপা চমকে উঠল। মিশন? কিসের মিশন? ব্ল্যাক মেরি অকাল্ট আসোসিয়েশন আমাকে ইন্ডিয়ান উইচদের সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন আনতে পাঠিয়েছিল। আমার কাজ এখনও বাকি থেকে গেছে। দ্যাট ওয়জ মাই মিশন। এনিওয়ে, আমি ফিরে যেতে চাই। আপনি বলেছিলেন, ভি. আই. পি. কোটা থেকে আমার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবেন। প্লিজ কর্নেল সরকার! আমার আর এদেশে এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমার শ্বশুর সদানন্দবাবু সম্পর্কে কিছু জানো?
গোপা তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না।
সুদর্শন তোমাকে কিছু বলেনি?
বলেছিল, ওঁর ওষুধ তৈরির ফার্ম ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তির জন্য ফার্ম আর চালাননি। ধর্মকর্ম নিয়ে কাটাতেন। সুদর্শন তখন আমেরিকায়।
সুদর্শন বলেনি, মাকে তার বাবা ডিভোর্স করেছেন?
গোপা ঘড়ি দেখে ব্যস্তভাবে বলল, এ সব কথা বলে অনর্থক সময় নষ্ট হচ্ছে কর্নেল সরকার! দেখুন, আপনি বলেছিলেন, আমার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আপনার কথামতো অমি এসেছি।
চিন্তা কোরো না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার আগে আমার এসব কথা জানা দরকার।
গোপা আস্তে আস্তে বলল, সুদর্শনের মানসিক অসুখের মূল কারণ তার। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। সোমাচ আই নো। মায়ের চিঠি পাওয়ার পর ও ভীষণ। বিচলিত হয়ে উঠেছিল। মাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল। ওর মা যাননি।
বাবার সম্পর্কে সুদর্শন সত্যিই কি তোমাকে কিছু বলেনি?
তেমন কিছু না। বাবা-মা সম্পর্কে কোনও কথা তুললে ও এড়িয়ে যেত।
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে বললেন, সদানন্দবাবু ডাক্তারি পড়েননি। কিন্তু ওঁর আশ্চর্য মেধা ছিল। প্রথম জীবনে একটা মেডিক্যাল কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলেন। পরে নিজেই ওষুধ তৈরির কারখানা করেন। তারপর চিকিৎসাবিদ্যার বইপত্র ঘেঁটে নিজেও নানা অসুখবিসুখের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করতেন। শেষে আয়ুর্বেদ আর দিশি আদিম চিকিৎসা পদ্ধতি যাকে বলে টোটকা, এসব নিয়ে চর্চা শুরু করেন। পুলিশ রেকর্ড থেকে এসব কথা জেনেছি। আদিবাসীদের টোটকা সংগ্রহে অবনী ছিল ওঁর সহকারী। অবনীর সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী ওঝাদের পরিচয় এই সূত্রেই হয়েছিল।
গোপা শুনছিল। বলে উঠল, আই সি।
সদানন্দবাবু একধরনের মাদক আবিষ্কার করেছিলেন। মারাত্মক নার্কোটিকস। কিছু বিদেশী কোম্পানিতে সেই ড্রাগ বেচতেন। পুলিশ টের পেয়ে ওঁকে অ্যারেস্ট করেছিল। টাকার জোরে বেঁচে যান। যাই হোক, সদানন্দবাবুর সেই মাদক তৈরির ফরমুলা তুমি কি খুঁজে পেয়েছ?
গোপা উঠে দাঁড়াল। রুষ্টমুখে বলল, আমাকে এভাবে অপমান করার জন্য আপনি আপনার বাড়িতে আসতে বলেছিলেন, আমি চিন্তাও করিনি! আমি বরং কোনও হোটেলে চলে যাচ্ছি। ট্রাভেল এজেন্টের সাহায্যে এয়ার-টিকিট পেতে আমার অসুবিধে হবে না।
কর্নেল নির্বিকারভাবে বললেন, ফরমুলার ফাইলটা তুমি নিয়ে যেতে পারবে নাগোপা। আমি জানিয়ে দিলে গভর্নমেন্টের অ্যান্টি-ড্রাগ সেলের লোকেরা এয়ারপোর্টে সার্চ করে তোমাকে বিপদে ফেলবে। কাজেই ওটা তুমি পেয়ে থাকলে আমাকে দাও। আই আসিওর য়ু ডার্লিং, তোমার এয়ার-টিকিটের ব্যবস্থা শুধু নয়, তোমাকে নিরাপদে আমি প্লেনে তুলে দিতে রাজি।
গোপা ঠোঁট কামড়ে ধরল। একটু পরে বলল, দিস ইজ আবসার্ড!
তুমি ভুল করছ গোপা! ওটা তোমার কাছে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তুমি বিপন্ন। কারণ ওই ফাইলটার কথা কলকাতাতেও সদানন্দবাবুর ঘনিষ্ঠ কোনো লোকের পক্ষে জানা সম্ভব। অবনীও জানতে পারে।
গোপা এবার শান্তভাবে বসল। তারপর মুখ নামিয়ে বলল, ফাইলটা আমাকে সুদর্শন দিয়েছিল। কিন্তু আজ মর্নিংয়ে চুরি গেছে।
কখন জানতে পারলে ওটা চুরি গেছে?
এখানে আসার সময় জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম। ওটা ছিল আমার এই সুটকেসে। খুঁজে দেখলাম ফাইলটা নেই। আমি তালা দিয়ে রাখতাম। তালাটা কেউ কীভাবে খুলেছে। অবুদা এ কাজ করেনি। কারণ আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। ভবতারণকেও সন্দেহ করতে পারছি না। সে তত লেখাপড়া জানে না। স্যুটকেসে আরও অনেক কাগজপত্র ফাইলটাইল আছে। ওই ফাইলটার কোনও স্পেশালিটি ছিল না যে আলাদা করে চেনা যাবে।
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, তোমার এয়ার-টিকিটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কিন্তু এয়ারপোর্টে আন্টিড্রাগ সেলের লোকেরা তোমাকে সার্চ করবে। মাইন্ড দ্যাট!
গোপা ক্লান্তভাবে বলল, করুক। আমার এদেশে থাকতে আর এক মুহূর্ত ইচ্ছে করছে না।……..
.
০৬.
সেদিন আমাদের চণ্ডীতলা আশ্রমে যাওয়া হলো না। গোপাকে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটা সান্ধ্য ফ্লাইটে দিল্লি এবং দিল্লি থেকে প্যান আমের জাম্বো জেটে করাটি ফ্রাঙ্কফুর্ট-হিথরো হয়ে শিকাগো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিলেন কর্নেল। দমদম এয়ারপোর্ট থেকে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেল।
ষষ্ঠীচরণ বলল, সেই মেয়েছেলেটা দুবার ফোং করেছিল। কী যেন নামটা
কর্নেল বললেন, অপর্ণা রায়?
আজ্ঞে! তা-ই বটে। ষষ্ঠী কাচুমাচু মুখে বলল, পেটে আসছিল, মুখে আসছিল না।
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, কফি!
ষষ্ঠী অমনি চলে গেল। সোফায় বসে বললাম, বাপস্! দিনটা যা গেল!
এখনও যায়নি। কফি খেয়েই বেরুব। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন।
আবার বেরুবেন? কোথায়?
কর্নেল ফোনে মন দিলেন।……অপর্ণা আছে?……আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রী সরকার। আপনি কি অপর্ণার মা বলছেন?……….কখন বেরিয়েছে? বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন।…..আচ্ছা। ফিরলে বলবেন আমার কথা।
ফোন রেখে কর্নেল তার ইজিচেয়ারে বসলেন। বললেন, গোপাকে যারা সদানন্দবাবুর ফর্মুলা হাতাতে পাঠিয়েছিল, তারা নিঃসন্দেহে নার্কোটিকসের কারবারি। ব্ল্যাক মেরি অকাল্ট আসোসিয়েশন তাদের মুখোশ। সদানন্দবাবুবর মার্কিন ড্রাগ কারবারিদের যোগাযোগের কথা পুলিশ রেকর্ডে আছে।
ষষ্ঠী কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে বললাম, কিন্তু গোপার ডাকিনীবিদ্যার নমুনা দেখে তাক লেগে গেছে। হঠাৎ সুগন্ধ, গোলাপকুঁড়ি, কফির কাপে রক্ত! আপনি অলৌকিক শক্তি বলেছিলেন। কিন্তু কস্মিনকালে আপনার অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসের কথা শুনিনি। ব্যাপারটা ম্যাজিক ছাড়া আর কিছুই নয়।
কর্নেল হাসলেন। কোনও বায়োকেমিস্ট যদি ডাকিনীবিদ্যার চর্চা করে, তাহলে সে অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। গোপা একজন বায়োকেমিস্ট।
বলে কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে উনি চুরুট ধরালেন। তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনে ডায়াল করলেন। একটু পরে বললেন, সান্যালবাড়িতে রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। অবশ্য ভবতারণ নিচের ঘরে থাকে। টেলিফোন আছে ওপরে সুদর্শনের ঘরে….হ্যালো! হ্যালো! আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…..ভবতারণ পালিয়েছে? কী করে বুঝলেন? ওর ঘরে….হ্যাঁ। তালাবন্ধ থাকতেই পারে। হয়তো কোথাও গেছে।…..নাহ্! গোপার খবর জানি না। ………ঠিক, ঠিক। আপনার সঙ্গে একমত। ………সে কি মশাই! আপনি তান্ত্রিক মানুষ। আপনার ভয় কিসের? ……আচ্ছা। অপেক্ষা করুন। আমরা যাচ্ছি…….না, না। থানায় জানাবার মতো কিছু নয়। আমি যাচ্ছি।…….
কর্নেল টেলিফোন রেখে ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলাম, অবনীবাবু কী বলছে?
ওকে টেলিফোনে কেউ হুমকি দিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে না গেলে বডি গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে।
আশ্চর্য তো!
ভবতারণের ঘরে তালাবন্ধ। অবনীর ধারণা, সে এই সুযোগে সুদর্শনের টাকাকড়ি হাতিয়ে কেটে পড়েছে। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।
পথে যেতে যেতে কর্নেল বললেন, গোপার কথা থেকে আমিও আঁচ করেছি, ভবতারণ যে কোনো কারণেই হোক, গোপাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে। মুখোশপরা লোকটা ভবতারণেরই সাজানো ব্যাপার হতে পারে।
কেন ভবতারণ এ কাজ করল?
জানি না। ইচ্ছে ছিল, অ্যাডভোকেট শিবপদবাবুর বাড়ি যাব। রাত নটার পর ওঁকে ফ্রি পাব। আগে তান্ত্রিক সকাশেই যাওয়া যাক। সুদর্শনের ল্যাবটা আর একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
এলাকা জুড়ে লোডশেডিং। গেটে টর্চ আর ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়েছিল তান্ত্রিক। গেট খুলে দিল। আমাদের গাড়ি পোর্টিকোর তলায় গেলে ফিরে এল। চাপা স্বরে বলল, তালা এঁটে দিলাম।
সিঁড়ির ওপর বসার ঘরের দরজাতে তালা আটকানো। খুলে দিল। ভেতরে টেবলের ওপর একটা হ্যারিকেন জ্বলছিল। দরজা ভেতর থেকে এঁটে বলল, ওপরে চলুন।
কর্নেল বললেন, আগে সুদর্শনের ল্যাবে যেতে চাই।
অবনী মৈত্র বলল, আগে আলো আসুক। ততক্ষণ আমার ঘরে
না অবনীবাবু! আমার মাথায় একটা খটকা ঢুকেছে। আমার এই স্বভাব। যতক্ষণ না সেটা ঘোচাতে পারছি, ততক্ষণ আপনার কথায় মন দিতে পারব না।
তান্ত্রিক হ্যারিকেনটা আমাকে ধরতে দিল। আমার গা ছমছম করছিল। গঙ্গার ধারে এই পুরনো বাড়ি যেন অন্ধকারে হিংস্র হয়ে উঠেছে। সুদর্শনের ঘরেও তালা আটকানো ছিল। তালা খুলে দিল তান্ত্রিক। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়ে খাটের কাছে গেলেন। তারপর বেডকভার তুলে বালিশ সরালেন। কী করছেন, হ্যারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তারপর উনি পকেট থেকে খুদে টর্চ বের করে সোজা পর্দা তুলে ল্যাবে ঢুকে গেলেন। অবনী হ্যারিকেনটা আমাকে টেবিলে রাখতে বলল। তারপর ভেতর থেকে দরজা এঁটে চাপা স্বরে বলল, সাবধানের মার নেই। তবে এই ত্রিশূলটা দেখছেন, এটা সাংঘাতিক পাওয়ারফুল।
ল্যাব থেকে কর্নেল বেরিয়ে এলেন। অবনী বলল, কী দেখলেন?
ও ঘরের নিচের তলায় ঘর কি কাকেও ভাড়া দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ। কমাস আগে ভকতবাবুকে ভাড়া দিয়েছি। অ্যাদ্দিন খালি পড়েছিল। ভকতবাবু ওঘরে গোডাউন করেছেন। রঙের পিপে রাখেন। পিসেমশাইয়ের আমলে নিচের ওই ঘরটাই ছিল বসার ঘর।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ল্যাবের যে দরজাটা সকালে বাথরুমের দরজা মনে করেছিলাম, সেটা তালা আটকানো আছে। কেন যে তখন মাথায় এল না বাথরুম হলে তালা বন্ধ থাকবে কেন?
অবনী বলল, ওটা নিচের ঘরে নামার সিঁড়ি। ভাড়া দেওয়ার সময় আমি নিজে তালা আটকে দিয়েছিলাম। ভোলা দেখলেন নাকি?
না। আটকানোই আছে। তবু আপনি দেখে আসুন, সেই তালাটা নাকি।
তান্ত্রিক সবেগে ঢুকে গেল। আমরাও ঢুকলাম। তান্ত্রিক দরজার তালা টেনে দেখে বলল, একই অবস্থায় আছে। একই তালা।
কর্নেল বললেন, চাবি তো আপনার কাছে আছে?
হুঁ। খুলব নাকি? তবে ভকতবাবু টের পেলে চাঁচামেচি করতে পারেন।
সাবধানে খুলুন।
অবনী তালা খুলল। তারপর দরজা ঠেলল। কিন্তু দরজা খুলল না। সে বলল, সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত রঙের পিপে বোঝাই করা আছে। কিংবা এমনও হতে পারে, কখন উনি নিজেই আমার অজান্তে ওদিকের দুই চৌকাঠে একটা কাঠে পেরেক ঠুকে দরজা সিল করে দিয়েছেন। দিনের বেলা খোঁজ নেবখন। মহা ঘুঘু লোক মশাই! রঙের পিপে আমি কিংবা ভবা চুরি করতে পারি ভেবে এই কল্মটি করে রেখেছে।
সুদর্শনের ঘর থেকে বেরিয়ে অবনী তালা আটল। তারপর বলল, আসুন। আমার ঘরে বসবেন।
যেতে যেতে কর্নেল বললেন, মর্গ থেকে সুদর্শনের বডি কখন ফেরত পেলেন?
বিকেলে। কাছেই নিমতলা! সাড়ে সাতটার মধ্যে দাহক্রিয়া শেষ। বাড়ি ফিরে দেখি, তখনও ভবার পাত্তা নেই। তারপর উড়ো ফোনে হুমকি।
গোপা যে ঘরে থাকত, তার পাশে অবনীর ঘর। দরজা খুলতেই ধূপধুনোর কড়া গন্ধ ভেসে এল। অবনী আমার হাত থেকে হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, আসুন। এই আমার ডেরা।
বাঁদিকে একটা জলচৌকিতে সম্ভবত নকল বাঘছালের আসন পাতা। নিচে প্রকাণ্ড ধূপদানি। আসনের একপাশে মড়ার খুলি। পেছনে মা কালীর বিশাল পোর্ট্রেট। তার পেছনে বইয়ের র্যাক পুরনো জীর্ণ বইয়ে ঠাসা। একটা কমণ্ডলুও দেখতে পেলাম। ঘরের অন্য পাশে মেঝেয় পরিপাটি সুদৃশ্য গৈরিক বেডকভারে ঢাকা বিছানা পাতা আছে।
তান্ত্রিক পশ্চিমের দরজা খুলে দিল। বলল, গঙ্গার দিক থেকে ফুরফুরে বাতাস আসে। বুঝতে পারছি, লোডশেডিংয়ে আপনাদের গরম লাগছে। আহ্। এই দেখুন, কেমন সুন্দর বাতাস আসছে! এখানে আসুন।
লক্ষ্য করলাম, দরজার ওধারে পোর্টিকোর ছাদ। রেলিঙ আছে। সেখানে গিয়ে দুটো চেয়ার দেখলাম। বুঝলাম গোপা এবং অবনী এখানে রাত্রে বসে থাকত।
কর্নেল একটা চেয়ারে বসলেন। আমি অন্যটায় বসলাম। অবনী রেলিঙে ঝুঁকে টর্চের আলো ফেলে প্রাঙ্গণ এবং মন্দির পর্যন্ত দেখে নিল। তারপর চাপা স্বরে বলল, আপনি টেলিফোন না করলে আমি থানায় যেতাম।
বললাম, আপনার ত্রিশূল থাকতে থানায় কেন?
ত্রিশূল তো আছেই মশাই! তা হলেও আইন বলে কথা। তাই না কর্নেল সাহেব?
কর্নেল সায় দিলেন। হ্যাঁ। তাছাড়া আইনত আপনি উইলের ট্রাস্টি।
অবনীর কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। ক্ষমা চাইছি কর্নেল সাহেব! ওই একটা মিথ্যা কথা বলেছি। বাদ বাকি সব সত্যি।
উইলের ট্রাস্টি আডভোকেট শিবপদ ঘোষ?
জানেন আপনি?
ভকতবাবু বলছিলেন। উনি নাকি উইলের একজন সাক্ষী।
হ্যাঁ। অবনী আবার চাপাস্বরে বলল, আমার সন্দেহ, ওই ব্যাটাছেলেই উড়ো ফোনে আমাকে হুমকি দিয়েছে। ও এই বাড়িটা ছলেবলে দখল করতে চায়।
আচ্ছা অবনীবাবু, ভাড়াটেদের কাছে মাসে মোট কত ভাড়া পান আপনি?
আমি মাত্র হাজার টাকা পাই। বাকি দু হাজার শিবু উকিল ব্যাঙ্কে নাকি জমা রাখে। খুলে বলি। ভকতবাবুর পাঁচশো, তারক মুদির দেড়শ, রামবহাল ভুজাওয়ালার পঞ্চাশ, হাবুলের স্টেশনারি স্টোর্সের দুশো আমি পাই। শিবু উকিল এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বাকি ভাড়াটেরা তাকেই টাকা দেয়।
নিয়মিত আপনার শেয়ার আপনি পান?
নাহ্। ভাড়া আদায় বড় ঝামেলার কাজ। শিবু উকিলের কাছ থেকে আমার শেয়ারের ভাড়াটেদের পয়লা তারিখে রসিদ এনে রাখি। আদায় করতে রক্ত জল হয়ে যায়। এদিকে দেখুন, ভবা মাহে পাঁচশো করে শিবু উকিলের কাছ থেকে নিয়ে আসে। অবনী ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। নেহাত মায়ের মন্দিরের সেবার জন্য এখানে পড়ে আছি। চলে গেলে মা রুষ্ট হবেন। মন্দিরে মায়ের সামনে ধ্যানে বসলেই শুনি মা বলছেন, অবু! আমাকে ছেড়ে যেন চলে যানে। তাই আছি। বুঝলেন তো?
বুঝলাম। কিন্তু মায়ের সেবার খরচের টাকা কি শিববাবু দেন না?
নাহ্। বলে ওই হাজার টাকা থেকেই সব হয়ে যাবে। শুধু বাৎসরিক পুজোর সময় উইলের শর্ত অনুসারে শিবু উকিল নিজে সব ব্যবস্থা করে। ধূমধাম হয়। আলোটালো মাইক কিন্তু তখন আমি কে? পাড়ার মস্তানরা এসে জোটে। তখন তারাই সব।
মূর্তি কি পাথরের?
আজ্ঞে! পিসেমশাইয়ের ঠাকুর্দা গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মাকে পেয়েছিলেন।
এই সময় আলো জ্বলে উঠল। অবনী বলল, বসুন। দেখি গোপার ঘরে কফির প্যাকেট পাই নাকি। ও তো সব নিয়ে গেছে। কফি না পেলে চা খাওয়াব।
চলুন, গোপার ঘরটা একটু দেখি।
অবনী পাশের ঘরের দরজা খুলল। সেই ঘরে ঢুকতেই ঝাঁঝালো সুগন্ধ টের পেলাম। জানালা বন্ধ ছিল। সুইচ টিপে আলো জ্বালল অবনী। করিডরের দিকের দরজা বাইরে থেকে আটকানো দেখেছি। ঘরের ভেতর একটা খাট। খাটে শুধু ম্যাট্রেস আছে, চাদর নেই। ডেসিং টেবিল আছে। কোনও প্রসাধনী নেই। ওয়াড্রোব হাট করে খোলা। মেঝেয় একটা সুন্দর গালিচা পাতা আছে। অবনী বলল, সব নিয়ে গেছে। শুধু কার্পেটটা বাদে।
কর্নেল বললেন, কার্পেটটা গোপা এনেছিল?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কর্নেল ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখার পর আস্তে বললেন, অবনীবাবু! যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
স্বচ্ছন্দে।
সুদর্শন আমাকে বলেছিল, সে গোপার সঙ্গে আপনাকে নাকি
তান্ত্রিক অদ্ভুত শব্দে হাসল। মেন্টাল পেশ্যান্ট মশাই! সবসময় প্রলাপ বকত। তবে এটা ঠিক, গোপাকে আমি সাধন সঙ্গিনী করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মহা ধড়িবাজ মেয়ে মশাই! ছলাকলায় ওস্তাদ!
কর্নেল হাসলেন। আপনাকে পাত্তা দেয়নি!
অবনী মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বলল, স্বয়ং এক ডাকিনীর বাস ওর মধ্যে। তাকে বশ করতে সময় লাগত। হাত ফসকে পালিয়ে গেল। হারামজাদা লাশ একবার পেলে মায়ের সামনে বলি দেব। গোপাকে কী ভয় দেখাল ক ৷ এত বড় প্রপার্টি ফেলে পালিয়ে গেল?
ভকতবাবু বলছিলেন, গোপার বিয়ে হয়েছে আমেরিকায়। কাজেই এখানে স্বামীর প্রপার্টি পেতে আইনের ঝামেলা আছে। তার চেয়ে বড় কথা, গোপা। মার্কিন নাগরিক। হ্যাঁ, স্বামী যে দেশের নাগরিক, স্ত্রী ভিন্ন দেশের হলেও স্বামীর দেশের নাগরিকত্ব সে আপনাআপনি পাবে। কিন্তু বিয়েটা হিন্দু প্রথা বা সামাজিক আচার অনুসারে হয়েছিল কি না, তার প্রমাণ চাই।
অবনী হাঁ করে শুনছিল। বলল, এত ফ্যাকড়া?
গোপার সঙ্গে এ নিয়ে আপনার আলোচনা হয়নি?
গোপাকে আমি বলেছিলাম উইলের কথায় কিন্তু আমার কথায় কান করেনি।
গোপা কি আপনাকে বলেছিল আমেরিকায় ফিরে যাবে?
তো। ও এদেশে থেকে ডাকিনীতন্ত্রের চর্চা করবে বলেছিল।
কর্নেল একটা দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজায় পর্দা ঝুলছিল। পর্দা তুলে বললে, ঘরটা কি খালি?
অবনী দরজার ছিটকিনি খুলে বলল, না। ওটাই তো সুদর্শনের ঘর।
বুঝলাম করিডর দিয়ে গেলে সুদর্শনের ঘরের একটা দরজা এবং এ ঘর থেকে গেলে আরেকটা দরজা তার মানে, গোপার ঘর থেকে পা বাড়ালেই সুদর্শনের ঘর।
কর্নেল বললেন, থাক। ও ঘরে আর যাব না। বলে আমার দিকে ঘুরলেন। জয়ন্ত এবার কিন্তু অলৌকিক শক্তি নয়, ম্যাজিক দেখতে পাবে।
উনি গালিচাটা সরিয়ে দিলেন। মেঝেয় গোলাকার ইঞ্চটাক একটা গর্ত দেখতে পেলাম। অবনী কাচুমাচু মুখে বলল, পুরনো বাড়ি। ছুঁচো ইঁদুরের বড্ড উপদ্রব।
কর্নেল গর্তে প্রায় নাক ঠেকিয়ে বসলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফরাসি পারফিউম এই গর্ত দিয়ে পিচকিরিতে ছড়ানো সোজা। নিচের ঘরে ফ্যান ঘুরলে একটু পরে উবে যায়। গোলাপকুঁড়িও গর্ত দিয়ে গলিয়ে ফেলা যায়।
বললাম, কিন্তু কফির কাপে রক্ত?
সি ইজ আ বায়োকেমিস্ট, জয়ন্ত! মুর্গির রক্তকে রাসায়নিক সংশ্লেষণ প্রক্তিয়ায় জমিয়ে একটা কণার আকারে কাপে রেখে গরম কফি ঢাললে দু-তিন মিনিটের মধ্যে কণাটা গলে যায় এবং কফি লাল হয়ে ওঠে।
আমি বলেছিলাম ম্যাজিক! আপনি বলেছিলেন অলৌকিক শক্তি।
কর্নেল হাসলেন। কার্য কারণ তত্ত্ব অনুসারে কার্যে অলৌকিক শক্তির প্রকাশ এবং কারণটা ম্যাজিক। কাজেই আমরা দুজনেই ঠিক বলেছিলাম।
অবনী জোরে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
কর্নেল বললেন, ও কিছু না। চলুন, আপনার ঘরে যাই।
এবার তান্ত্রিক পোর্টিকোর ছাদ থেকে চেয়ার দুটো ঘরে নিয়ে এল। ফ্যান চালিয়ে দিল। আমরা চেয়ারে বসলাম। সে বলল, তাহলে দু কাপ চা করে আনি কর্নেল সাহেব?
থা। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। একটা প্রশ্ন করে আমরা উঠব।
বলুন!
সুদর্শনের মা করুণাময়ী কোথায় আছেন আপনার জানার কথা।
অবনী একটু চুপ করে থাকার পর বলল, পিসিমা চণ্ডীতলা আশ্রমে আছেন। আমার পিসেমশাই খুব বাজে লোক ছিলেন। ফ্যামিলির স্ক্যান্ডাল রটাতে নেই। তবে পিসিমাও ভুল করেছেন। ব্রহ্মানন্দ ব্যাটাছেলের পাল্লায় পড়া ওঁর উচিত হয়নি। আমাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখে যেতে বলেন। ওই ভণ্ড সাধুর জন্য যাই না।
ছেলের মৃত্যুর খবর ওঁকে পাঠিয়েছেন?
শিবু উকিল পাঠিয়েছে। শ্মশানে গিয়েছিল। তখন বলল।
কর্নেল হঠাৎ ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন। আচ্ছা চলি অবনীবাবু। আপনার ভয়ের কারণ নেই। ফোনে কেউ শাসালে আপনিও পাল্টা শাসাবেন।
.
০৭.
ঘিঞ্জি ট্রামরাস্তার দুধারে দোকানপাট এত রাত্রে বন্ধ। একটা পান-সিগারেটের দোকানে জিজ্ঞেস করে আডভোকেট শিবপদ ঘোষের বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেল। হর্নের শব্দে দারোয়ান যেভাবে শশব্যস্তে গেট খুলে দিল, বুঝলাম শাঁসালো মক্কেলদের জন্য উকিলবাবুর দরজা সর্বদা অবারিত এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত মক্কেল আসে। কর্নেল ড্যাশবোর্ডের আলোয় একটা কাগজ পড়ছিলেন। পকেটে রেখে দিলেন। কৌতূহলটা থেকেই গেল। গাড়ি লনে পৌঁছুলে লক্ষ্য করলাম, এখনও মক্কেলের ভিড় জমে আছে। বারান্দায় একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা লোককে ঘিরে জনা তিন মক্কেল জটলা করছে। আমাদের দেখে সেই লোকটি তাদের তক্ষুনি বিদায় দিয়ে সম্ভাষণ করলেন, ভেতরে আসুন স্যার।
ঘরটা প্রশস্ত। আইনের বইয়ে ঠাসা অনেকগুলো আলমারি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো। কার্পেট ঢাকা মেঝে এবং সারবন্দি অগুনতি গদি আঁটা চেয়ার। কয়েকজন অবাঙালি ভদ্রলোক বসে আছেন। নামী ডাক্তারের চেম্বারে যেন রোগীরা উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছেন। ও পাশে একটা ঘরে অফিস দেখা যাচ্ছিল। সে ঘরেও এতরাত্রে কর্মব্যস্ততা।
ধুতিপাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক সম্ভবত উকিলবাবুর ক্লার্ক, চলতি কথায় যাঁদের মুহুরিবাবু বলা হয়। অমায়িক হেসে বললেন, একটুখানি বসতে হবে স্যার।
কর্নেল তাঁর নেমকার্ড দিয়ে বললেন, কার্ডটা দিয়ে আসুন। আমরা অনেক দূর থেকে আসছি।
ভদ্রলোক অফিসঘরে ঢুকে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে বললেন, আসুন।
অফিস ঘরের একধারে পার্টিশন করা চেম্বার। ভেতরে বেঁটেখাটো মোটাসোটা মধ্যবয়সী গুঁফো এবং রাশভারী চেহারার অ্যাডভোকেট প্রায় সিংহাসনসদৃশ একটা আসনে বসেছিলেন। সামনে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি গম্ভীর মুখে নমস্কার করে বললেন, বসুন। আপনারা আসবেন আমি জানতাম।
কর্নেল বললেন, জানতেন?
শিববাবু বললেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন সুদর্শন প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগিয়েছিল!
সরি মিঃ ঘোষ! আম প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই। আমার সঙ্গীর পরিচয় দিই। জয়ন্ত চৌধুরী দৈনিক….
জানি। আপনাদের দুজনেরই পরিচয় আমার অজানা নয়।
অবনীবাবুর কাছে জেনেছেন?
শিববাবু সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, সুদর্শন সুইসাইড করেনি। হি ইজ মার্ডার্ড। এই নাকি আপনার ধারণা। আপনি নিশ্চয় তেমন কোনও প্রমাণ পেয়েছেন? বেশ তো! পেয়ে থাকলে বলুন, একজন ল-ইয়ার হিসেবে আমি লিগ্যাল স্টেপ নেব।
মিঃ ঘোষ! আমি সদানন্দবাবুর উইল সম্পর্কে জানতে এসেছি। কারণ আপনিই নাকি উইলের শর্ত অনুসারে সম্পত্তির ট্রাস্টি।
হ্যাঁ। আমি ট্রাস্টি। বলুন আর কী জানতে চান?
সুদশনের অবর্তমানে সম্পত্তি কে পাবে?
তার স্ত্রী। স্ত্রী না থাকলে চণ্ডীতলা আশ্রম।
তাহলে এখন সম্পত্তির মালিক সুদর্শনের স্ত্রী গোপা?
গোপা সম্পত্তি দাবি করলে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে সুদর্শনের স্ত্রী। শিববাবু ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসলেন। কিন্তু সে তো হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
তাকে ভবতারণ ভয় দেখিয়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে।
বলেন কী? তা সুদর্শনের স্ত্রী কি এখন আপনার শেল্টারে আছে?
না! আমেরিকা ফিরে গেছে।
তাই বুঝি? আডভোকেট আরও গম্ভীর হলেন। একটু পরে বললেন, আর কিছু জানতে চান?
সুদর্শন আপনাকে বলেছিল সুইসাইড করবে। তাই না?
ও আমেরিকা যাওয়ার আগে থেকেই মেন্টাল পেশেন্ট। শিববাবু ঘড়ি দেখলেন। এনিওয়ে, আপনি যদি সত্যি প্রমাণ পেয়ে থাকেন, সুদর্শনকে কেউ বিষ খাইয়ে মেরেছে, আম আপনার পাশে আছি। কী বিষ যেন?
পটাসিয়াম সায়নায়েড, মিঃ ঘোষ!
হ্যাঁ। পোস্টমর্টেম রির্পোট আমি দেখেছি। ও বাড়িতে খুঁজলে হয়তো এখনও অনেক মারাত্মক বিষ বেরুবে। সদানন্দের ওষুধের কারখানা ছিল। তাছাড়া তার ছেলে বায়োকেমিস্ট ছিল। ছেলের বউও বায়োকেমিস্ট। হাসলেন শিববাবু। মেয়েটা নাকি ডাকিনীবিদ্যারও খেল দেখাত। ওদিকে অবুটাও তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে থাকে। যত রাজ্যের পাগলের আখড়া! তবে আপনি বলছেন, সুদর্শনকে মারা হয়েছে। কে মারবে? কেনই বা মারবে? ওর স্ত্রীকে সন্দেহ করা যেত। কিন্তু আপনি বলছেন সে আমেরিকা ফিরে গেছে। এবার বলুন, হোয়াট ইজ দা মোটিভ অব দা মার্ডার?
জানি না। আচ্ছা মিঃ ঘোষ, এবার তা হলে প্রপার্টি আপনি আশ্রমের হাতে তুলে দেবেন?
দিতে বাধ্য। সুদর্শনের বউ যখন আমেরিকা চলে গেছে বলছেন, তখন ধরে নেওয়া যায় লিগ্যাল ম্যারেজের প্রমাণ তার হাতে নেই।
ভবতারণকে আপনি চণ্ডীতলা পাঠিয়েছেন কেন মিঃ ঘোষ?
আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার নজর রাখা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?
ভবতারণের সাহায্য নিয়ে গোপাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো হয়েছে, পাছে গোপা প্রপার্টির দাবি করে।
আডভোকেট বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।
হা মিঃ ঘোষ! এবং কাজটা আপনিই করেছেন।
শিববাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রুষ্টস্বরে বললেন, প্রমাণ করতে পারবেন?
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। প্রমাণ করা কঠিন কাজ নয় মিঃ ঘোষ! আপনি চণ্ডীতলা আশ্রমের হাতে সদানন্দবাবুর প্রপার্টির তুলে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আশ্রম প্রপার্টির স্থাবর অংশ যাতে ভকতজিকে জলের দরে বিক্রি করে, তার
ব্যবস্থা আপনি করে রেখেছেন। ভকতজি ওই বাড়িতে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং তৈরি করবেন। আপনি পাবেন প্রচুর কমিশন।
আডভোকেট বাঁকা হাসলেন। আপনি দেখছি অন্তর্যামী!
না মিঃ ঘোষ! কিছুক্ষণ আগে সুদর্শনের ঘরে ঢুকেছিলাম। স্রেফ ইনটুইশন বলতে পারেন। সকালে ওর বিছানা পরীক্ষার প্রয়োজন মনে করিনি। হঠাৎ মনে হলো, বিছানাটা দেখা উচিত। দেখতে গিয়ে বালিশের তলায় ভাজকরা একটা কাগজ পেয়েছি। গোপাকে লেখা সুদর্শনের একটা চিঠি। চিঠিটা সকালে পেলে গোপাকে আমেরিকা ফিরতে দিতাম না।
শিববাবু শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, কী চিঠি?
সুদর্শন আপনার প্ল্যানের কথা টের পেয়ে গোপাকে সতর্ক করতে চেয়েছিল। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, চিঠিটা গোপাকে দেয়নি। কিংবা পরে দেবে ভেবেছিল! কিন্তু দেবার সুযোগ আর পায়নি।
চিঠিটা দেখতে পারি?
সরি মিঃ ঘোষ! চিঠিটা আপনাকে দেখানো যাবে না।
পিছন থেকে শিববাবু বললেন, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট আই আম এ লিগ্যাল এক্সপার্ট। ওই সব চিঠিফিটি দিয়ে কিস্যু হবে না মশাই! যা পারবেন, করুন।
কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। বললেন, চলো জয়ন্ত।
.
পথে যেতে যেতে বললাম, আমার অবাক লাগছে! সুদর্শন গোপাকে ঘৃণা করত। গোপাকে সে খুন করবে বলছিল। এমনকি গোপার জন্যই সে সুইসাইড করতে চেয়েছিল। সেই গোপাকে সে অমন একটা চিঠি লিখল?
চিঠিটা পড়লে তুমি ব্যাপারটা বুঝবে। কর্নেল হাসলেন। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। এত রাত্রে তোমাকে সল্ট লেকে ফিরতে দিচ্ছি না। আজকাল রাতের কলকাতা বড় ভয়ঙ্কর।
কাগজের অফিস থেকে ফিরতে আমার রাত একটাও বেজে যায় কোনও কোনও দিন। কাজেই ভয় দেখাবেন না।
ডাইনের গলিতে ঢোকো জয়ন্ত! কুইক! একটা গাড়ি আমাদের ফলো করছে।
ব্যাকভিউ মিররে একটা গাড়ির আলো চোখে পড়ল। গাড়িটা জোরে আসছিল। ডাইনে ঢুকে গেলাম। নির্জন আঁকাবাঁকা গলিরাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে গ্রে স্ট্রিট। তারপর কর্নেলের কথামতো বাঁয়ে ঘুরে সোজা গিয়ে উঠলাম এ.পি.সি. সার্কুলার রোডে।
কর্নেলের বাড়িতে পৌঁছে বললাম, গাড়িটা কি সত্যিই আমাদের ফলো করেছিল?
হ্যাঁ। সুদর্শনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিববাবুর বাড়ির কাছে গাড়িটা দেখেছিলাম। আমরা শিববাবুর বাড়ি থেকে চলে আমার কিছুক্ষণ পরে দেখলাম বাগবাজারে ঢুকছে। আমার ধারণা, আমরা সুদর্শনের বাড়ি ঢোকার সময় থেকেই আমাদের ওপর নজর রাখা হয়েছিল।
গাড়ির নাম্বার লক্ষ্য করেছেন?
সঙ্গে বাইনাকুলার থাকলে নাম্বার দেখতে পেতাম। তবে গাড়িটা কালো আম্বাসাডার। যাই হোক, খিদে পেয়েছে। ষষ্ঠী! আমরা খাব।
ষষ্ঠীচরণ বলল, সব রেডি বাবামশাই!
কেউ ফোং করেনি?
ষষ্ঠীচরণ তুম্বো মুখে বলল, সেই মেয়েছেলেটা সকালে আসবে বলেছে।
খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে বসে অভ্যাসমতো কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, অপর্ণা কাল কলেজে যায়নি। কাল সুদর্শন তার কাছে গিয়েছিল। তারপর সে চণ্ডীতলা আশ্রমে গিয়েছিল। কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা আসার ট্রেন বা বাস প্রচুর। রাত একটায় বাড়ি ফিরে চিঠিটা লিখেছিল।
বললাম, চিঠিটা দিন। পড়ি।
কর্নেল পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আমাকে দিলেন। খুলে দেখি, ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি। বাংলায় অনুবাদ করলে মোটমুটি এই দাঁড়ায়ঃ
গোপা,
তোমাকে আমি ঘৃণা করি। ভেবেছিলাম তোমাকে আগে খুন করে তারপর আত্মহত্যা করব। কিন্তু তুমি ডাইনি। ডাইনিকে খুন করা সহজ নয়। কাজেই তোমাকে রেহাই দিলাম। তুমি বেঁচে থাকো। অবনীদার সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক বৈধ করে নিও। তবে অবনীদা লোকটা ভাল নয়। তোমাকে বাবার যে গোপন ফাইলটা দিয়েছিলাম, অবনীদা টের পেলে সেটা হাতাবে। কিংবা তোমাকে নিষিদ্ধ মাদক তৈরিতে প্ররোচিত করবে। তাই তোমার ভালোর জন্য ফাইলটা তোমার স্যুটকেস থেকে চুরি করেছি। আর একটা কথা। আজ চণ্ডীতলা আশ্রমে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মা আমাকে আসতে দিচ্ছিলেন না। জোর করে চলে এলাম। মা আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, শিবু উকিল আর ভকতবাবু চক্রান্ত করেছে। আমি যেন তোমাকে নিয়ে শিগগির আমেরিকা ফিরে যাই। তাহলে বাড়িটা আশ্রমের দখলে আসবে না এবং ভকতজিও জলের দরে কিনতে পারবে না। স্বামী ব্রহ্মানন্দ নাকি সাদাসিধে মানুষ। ভকতজি তাঁকে ভক্তিতে নুইয়ে ফেলেছে। তাকে স্বামী ব্রহ্মানন্দ কথা দিয়েছেন, বাড়িটা যদি আশ্রমের হাতে কোনদিন আসে, তাহলে ভকতজিকেই বেচে দেবেন। ভক্তের সঙ্গে দরাদরি আবার কী? ভকতজি মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে। অথচ বাড়িটার দাম খালি জমিসমেত এ বাজারে অন্তত কয়েক লক্ষ টাকা। যাই হোক, আমি আত্মহত্যা করার কথাটা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারিনি। কিন্তু আমি আত্মহত্যা তো করবই। তারপর তুমি আমার প্রপার্টির মালিক হবে। তাই তোমাকে সাবধান করে দেওয়া আমার কর্তব্য। আর বেশি কিছু লেখার ধৈর্য নেই। তুমি ডাইনি। শিবু উকিল আর ভকতজিকে তুমি তোমার ডাইনিবিদ্যার জোরে জব্দ করতে পারবে।..
চিঠিটা তাড়াহুড়ো করে লেখা। তলায় সুদর্শন তারিখ দিয়ে সই করেছে। সময় রাত তিনটে পনের, তা-ও লিখেছে।
বললাম, বদ্ধ পাগল!
কর্নেল চিঠিটা আমার কাছ থেকে নিয়ে বললেন, বদ্ধ পাগল নয়। অসুখটা সম্ভবত স্কিটজোফ্রেনিয়া। এ সব মানসিক রোগীর কাছে বাস্তব-অবাস্তবের সীমারেখা ঘুচে যায়। সে কী করছে, তা অনেক সময় টের পায় না। হ্যালুসিনেশন বা ভুল দেখা এই অসুখের একটা লক্ষণ। তাছাড়া এদের কাছে বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। কাজেই সুদর্শন কোনও এক সময়ে আত্মহত্যা করতই। কিন্তু খুনীর তর সইছিল না।
বললাম, শিববাবু এবং ভকতজি ভবতারণকে দিয়ে খুন করিয়েছেন। আমি শিওর। কারণ সুদর্শনের সুইসাইডাল নোট চুরি এবং তার কফির পেয়ালা সায়নায়েড রাখা বাইরের লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া সে মুখোশপরা একটা লোকের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে গোপাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে, এটা তো আপনারই সিদ্ধান্ত।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, হ্যাঁ। ভবতারণ এটা করেছে। শিববাবু এবং ভকতজির কথাতেই করেছে। উইল অনুসারে নাকি তার পাঁচশো টাকা মাসোহারা। তার মতো মানুষ ওঁদের কথায় দায়ে পড়ে এ কাজ করতেই পারে। তা ছাড়া গোপাকে সে হয়তো পছন্দ করত না। চণ্ডীতলা আশ্রমে চিঠি নিয়ে যেতেও সে বাধ্য। কিন্তু
কিন্তুটা কিসের?
সুদর্শনের সুইসাইডাল নোট ইংরেজিতে লেখা। ভবতারণ ইংরেজি জানে না। তারচেয়ে বড় কথা, শিববাবু এবং ভকতজি সুইসাইডাল নোটের খবর পেলেন কী ভাবে? সুদর্শন সবাইকে বলে বেড়িয়েছে সুইসাইড করবে। কিন্তু অলরেডি সেই চিঠিও লিখে রেখেছে, এমন কথা কি তার পক্ষে বলা সম্ভব? কোনও আত্মহত্যাকারী কি বলে বেড়ায় আত্মহত্যার চিঠিও লিখে ফেলেছে?
সুদর্শনের মতো মানসিক রোগীর পক্ষে–
বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, তাহলে তোমাকে এবং গতকাল সকালে আমাকেও বলত। মানসিক রোগী বলেই বাকি কথাটাও বলা তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। স্মরণ করো জয়ন্ত, কাল সকালে সে আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওই যাঃ! চিঠিটা বলে হঠাৎ সে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যদি চিঠিটা হারিয়ে গিয়ে থাকত, সে হইচই বাধাত। অন্তত গোপা জানতে পারত। গোপা আমাদের সে কথা বলত। এ থেকে ধরে নিচ্ছি, চিঠিটা সে লিখতে লিখতে উঠে এসেছিল। লেখার পর কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে কেউ চুরি করে। সুদর্শন নিশ্চয় টের পায়নি। পেলে সাবধান হয়ে যেত। এখানেই আসছে টাইমিংয়ের প্রশ্ন। সুদর্শন আত্মহত্যার নির্দিষ্ট সময় স্থির করেনি। এমনকি গতরাত্রে গোপাকে লেখা চিঠিতেও তার আভাস নেই।
গোপাকে আপনি সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন দেখছি!
দিয়েছে। কারণ তার মিশন ছিল ভিন্ন। কয়েক লক্ষ টাকার প্রপার্টির চেয়ে সদানন্দবাবুর ফর্মুলার দাম অনেক বেশি। সুদর্শন তাকে ওটা দিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর গোপা আবিষ্কার করেছে, ওটা স্যুটকেসে নেই।
তা হলে অবনী মৈত্র—
হ্যাঁ। অবনী আমার সন্দেহের তালিকায় আছে।
তার মোটিভ?
টাকার বিনিময়ে ভকতজিকে সুইসাইডাল নোট সে বেচতেই পারে। কিন্তু তাকে কেউ টেলিফোনে নাকি ভয় দেখিয়েছে। এর কারণ কী?
কর্নেল চুরুট অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে বললেন, মাই গুডনেস! রাত প্রায় একটা বাজে। শুয়ে পড়া যাক…
ভোরে উঠে কর্নেল বাড়ির ছাদে তাঁর বিচিত্র শূন্যোদ্যান পরিচর্যায় যান। আটটায় নেমে আসেন। সাড়ে আটটায় ষষ্ঠীর ডাকে ঘুম ভাঙল। ষষ্ঠী মুচকি হেসে বলল, সেই মেয়েছেলেটা এয়েছে দাদাবাবু!
অপর্ণা রায়?
আজ্ঞে। আপনি বাথরুম সেরে আসুন। কফি রেডি করি গে।
কিছুক্ষণ পরে কফির পেয়ালা হাতে ড্রয়িংরুমে গেলাম। কর্নেল তার রীতি অনুসারে সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
অপর্ণার মুখে শোকদুঃখের গাঢ় ছাপ। আস্তে আস্তে বলল, আমি উঠি কর্নেল সরকার! এখান থেকে শেয়ালদা চলে যাব। আজ কলেজে না গেলেই নয়।
সে চলে যাওয়ার পর বললাম, অপর্ণা কী বলছে?
সুদর্শন তাকে একটা ফাইল রাখতে দিয়ে এসেছিল কিসের বুঝতে পারেনি অপর্ণা।
নড়ে বসলাম। সেই ড্রাগ ফর্মুলার ফাইল?
হাঁ। সুদর্শন অপর্ণাকে বলেছিল, পরে একসময় সে ওটা ফেরত নেবে। তবে তারপর আত্মহত্যা সে করবেই।
তা হলে দেখা যাচ্ছে, সে আত্মহত্যার সময় ঠিক করেনি।
ঠিক ধরেছ।
ফাইলটা কি এখনও অপর্ণার কাছে আছে?
না। আমাকে দিয়ে গেল। বলে কর্নেল টেবেলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করলেন। কাগজের মোড়ক খুলতেই একই সাইজের একটা ফাইল বেরুল। কর্নেল বললেন, দেখ। বুঝতে পারো নাকি।
ক্লিপে আঁটা এক গোছা পুরনো কাগজপত্রে ইংরেজিতে অজানা শব্দ লেখা এবং দুর্বোধ্য আঁকজোক। পাতায়-পাতায় নকশাও আছে। ফেরত দিয়ে বললাম, এক বর্ণ বুঝলাম না। তবে আপনি কোটিপতি হওয়ার এমন সুযোগ আর পাবেন না।
কর্নেল গোমড়া মুখে বললেন, ফাইলটা এখনই পুড়িয়ে ফেলব। এটা সাংঘাতিক বিষধর সাপ। চলো, ছাদে গিয়ে এটা পোড়ানো যাক।
ছাদের বাগানের এক কোণে কর্নেল ফাইলটা পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন। তার একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, এক সাধুবাবা এয়েছেন। বললেন, খুব জরুরি দরকার।
নেমে এসে দেখি, গেরুয়া পোশাকপরা অবনী তান্ত্রিক ত্রিশূল হাতে বসে আছে।…
.
০৮.
কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার অবনীবাবু? কোনও গণ্ডগোল হয়নি তো?
অবনী তান্ত্রিক হাসল। মা আমাকে সারাক্ষণ গার্ড দিচ্ছেন। গণ্ডগোল করে কার সাধ্য? একটা সুখবর দিতে এলাম। আপনার চলে আসার পর ধ্যানে বসেছিলাম। ভোররাত্রে গোপাকে খুঁজে বের করলাম।
বলেন কী! কোথায়?
দিল্লিতে।
আপনি দিল্লি মন্ত্রবলে উড়ে গিয়েছিলেন বুঝি?
ধুর মশাই! তন্ত্রের আকর্ষণ। ট্রাঙ্ককলে নিজেই সাড়া দিল। বলল, আমেরিকা ফিরে যেতে চেয়েছিল। প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে। আজ কিংবা কালই কলকাতা আসছে। আমি যেন কথাটা আপনাকে জানিয়ে দিই।
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ভাল। ভবতারণের খোঁজ পাননি এখনও?
হুঁ। পেয়েছি। ব্যাটাছেলে চণ্ডীতলা আশ্রমে গেছে।
ধ্যানে খোঁজ পেলেন তা হলে?
তান্ত্রিক অদ্ভুত শব্দে হাসতে লাগল। ভাবার জন্য ধ্যানে বসতে হবে? ধ্যান অত শস্তা? শিবু উকিলের মুহুরি কালীবাবুর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলো। বললাম, ভবার খবর জানো কালীদা? কালীদা বলল, বাবু ওকে চণ্ডীতলা আশ্রমে পাঠিয়েছে। ব্যাপারটা বুঝলেন?
না তো!
অবনী মৈত্র চোখ নাচিয়ে বলল, ব্রহ্মানন্দকে চিঠি লিখে পাঠিয়েছে–কাম অন! অল ক্লিয়ার হুঁ! আসুক না কেউ! পেটে ত্রিশূল বিধিয়ে দেব। গোপা প্রপার্টির মালিক। আমি উইলের সাক্ষী। শিবু উকিল ফ্যাকড়া বাধালে রঞ্জুবাবুকে লড়িয়ে দেব।
কে তিনি?
শিবু উকিলের বৈমাত্রেয় দাদা। বাঘা উকিল। দুজনের মুখ দেখাদেখি নেই। কেস দিলে লুফে নেবে। বুঝলেন তো?
কর্নেল চোখ তুলে বললেন, আচ্ছা অবনীবাবু, আপনি তো আপনার পিসেমশাইয়ের ওষুধ কারখানায় কাজ করতেন। কী কাজ করতেন?
কাজ মানে ওভারঅল সুপারভিশন।
কিছু মনে করবেন না। আপনার পড়াশোনা কতদূর?
অবনী তান্ত্রিক যথারীতি কারণবারি পান করেছে সকালে। কথাবার্তার সুরেই তা বোঝা যাচ্ছিল। বলল, ছোটবেলা থেকে পিসেমশাইয়ের কাছে মানুষ। মা বাবার মুখ মনে পড়ে না। পিসেমশাই খোঁচা মেরে মেরে বি. এস-সি পর্যন্ত তুলেছিলেন। কিন্তু মা আমাকে অন্যদিকে টানছিলেন। টানাটানিতে শেষে মায়েরই জয় হলো। তারা! ব্রহ্মময়ী! মাগো! এবার উঠি মশাই! গঙ্গাস্নান করেই চলে এসেছি।
আচ্ছা অবনীবাবু! আপনার পিসেমশাইকে পুলিশ কী কেসে আরেস্ট করেছিল?
অবনী বাঁকা মুখে বলল, আপনাকে কাল রাত্রেই বলেছি পিসেমশাই খুব বাজে লোক ছিলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে আদিবাসী মুলুকে ওদের টোটকা জড়িবুটি কিনতে যেতেন। তবে মাথা ছিল মশাই! নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত ছিল।
হু। কিন্তু পুলিশ কেন ওঁকে আরেস্ট করেছিল?
অবনী তান্ত্রিক চাপাস্বরে বলল, নিজের নামে একটা ওষুধ তৈরি করেছিলেন। সদানন্দ বটিকা। সব কৌটোর গায়ে লেখা থাকত স্নায়ুদৌর্বল্যের ওষুধ। কিন্তু কিছু কিছু কৌটোর গায়ে লাল যুক্তচিহ্ন থাকত। সেগুলো কিন্তু সাংঘাতিক ড্রাগ। মিলিয়ে-মিশিয়ে কৌটোগুলো প্যাকেটভর্তি চালান যেত দেশবিদেশে। ব্যস্! তারপর কেউ ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল। আন্টিড্রাগ সেল থেকে অফিসাররা পুলিশ নিয়ে এসে পিসেমশাইকে পাকড়াও করল। শেষ শিবু উকিল বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
সেই ড্রাগের ফর্মুলা সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
না মশাই! আমার ড্রাগট্রাগ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মায়ের কৃপায় কারণবারিই যথেষ্ট। তবে লুকোব না। রাত্রিবেলা বাবার সেবাও একটুখানি করি। বাবাকেও তো দেখতে হবে। বাবার প্রসাদ খাই।
ভাং?
হ্যাঁ।
গোপা আপনাকে সদানন্দ বটিকা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
কই না তো! তারা! ব্রহ্মময়ী! মা গো! উঠি কর্নেলসাহেব!
অবনী তান্ত্রিক উঠে দাঁড়াল। তারপর দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে বলল আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। আপনারা যেন আর আমাদের তল্লাটে যাবেন না মশাই। শিবু উকিলের মুহুরি কালীদা আমাকে বলছিল, বাবুর পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে কে জানো অবু? আমি চেপে গেলাম। তখন কালীদা বলল, বাবু গোয়েন্দা দুটোকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন। বাবুর পোষা গুণ্ডারা ওত পেতে আছে। বুঝলেন তো?
সে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতে জপতে বেরিয়ে গেল। ষষ্ঠীচরণ দরজা বন্ধ করতে গেল।
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন, তা হলে গোপা ফিরে আসছে। দিল্লি গিয়ে হঠাৎ প্ল্যান বদলানোর কারণ কী হতে পারে? স্পষ্টই সে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু দিল্লি গিয়ে হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠল। শিবপদবাবুর যা মনোভাব জেনেছি, তাতে গোপার সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। গোপার জীবনের ঝুঁকিও আছে। ঝুঁকি নিয়েই সে ফিরে আসছে।
বললাম, দিল্লিতে গিয়ে হয় তো সে তার গ্রুপের এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ওদের নেটওয়ার্ক সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। ফর্মুলা উদ্ধার করার জন্যই গোপাকে কলকাতা ফরতে হচ্ছে।
তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমাকে খবর দিতে বলার কারণ কী?
জাস্ট এ ফরম্যালিটি! আপনি ওর ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাই
নাহ্ জয়ন্ত! আমি গোপার চ্যালেঞ্জের গন্ধ পাচ্ছি।
আপনাকে চ্যালেঞ্জ? গোপা আপনাকে ভালই জানে।
নেচার পত্রিকার প্রবন্ধের তলায় দু-চার কথায় লেখা আমার পরিচিতি থেকে আমাকে তত বেশি জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। বলে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! ব্রেকফাস্ট।
ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল, সব রেডি বাবামশাই!
কর্নেল উঠলেন। কুইক জয়ন্ত! ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বেরুব। না– গাড়িতে নয়। ট্যাক্সি করে শেয়ালদা স্টেশন। তারপর ট্রেনে।
চণ্ডীতলা আশ্রমে যাবেন?
হ্যাঁ। সুদর্শনের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।..
.
ট্রেনে কৃষ্ণনগর পৌঁছুতে প্রায় সওয়া একটা বেজে গিয়েছিল। একটা হোটেলে খেয়ে নিয়ে আমরা বাসস্টপেজে গেলাম। তিনটের আগে বাস নেই। তা-ও বাসস্টপ থেকে নেমে নাকি প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে। তার চেয়ে এক্কাগাড়ি ভাল। একেবারে আশ্রমে পৌঁছে দেবে। মোটে ছকিলোমিটার দূরত্ব।
কর্নেলের পোশাক টুরিস্টের। মাথায় টুপি। কাঁধে কিটব্যাগ এবং প্রজাপতিধরা নেট। গলায় ঝুলন্ত বাইনাকুলার এবং ক্যামেরা। আমার পরনে শুধু প্যান্টশার্ট। এক্কাগাড়ির কোচোয়ান মওকা বুঝে তিরিশ টাকা হাঁকল।
রোগা টিঙটিঙে টাটুঘোড়া সম্ভবত কর্নেলের ওজনের চাপে কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। বেহদ্দ পিচ রাস্তার পর মোরামবিছানা রাস্তা। তার অবস্থাও শোচনীয়। তবে আশ্রমযাত্রীদের ভিড় দেখার মতো। ওই এক চিলতে রাস্তায় কী কৌশলে আরও এক্কা, গোরু-মোষের গাড়ি, সাইকেল রিশো এবং প্রাইভেট কার পরস্পরকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, তাও দেখার মতো। সরকারি বনসৃজন প্রকল্পের রূপায়ণ, মরসুমি ধানখেত, ইটখোলা, একটা ছোট্ট গ্রাম। তারপর অদূরে নদীর বাঁক দেখা গেল। কর্নেল সারাপথ চোখে বাইনাকুলার রেখে পাখি দেখছিলেন। মাঝে মাঝে সাদা বক ছাড়া আমার চোখে আর কোনও পাখি পড়ল না।
আশ্রমের গেটের সামনে দু ধারে খলপা আর চটের ছাউনি দেওয়া কয়েকটা দোকান। ভিড় গিজগিজ করছে। এক্কা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কর্নেল এগিয়ে গেলেন।
জুতো পরে আশ্রমে ঢোকা যাবে না। কর্নেল গেটের প্রহরী একজন ভক্তকে জিজ্ঞেস করলেন, আশ্রমের স্কুল খোথায়?
সে বলল, ডানদিকে ঘুরে চলে যান।
আশ্রমের পাঁচিল নিচু। কিন্তু পেরে কাঁটাতারের বেড়া। ঘন গাছপালা দেখা যাচ্ছিল ভেতরে। মন্দির, নাটমন্দির, সারবন্দি কুটির এবং মাইকে সংকীর্তন। স্কুলের গেটটা ছোট। ভেতরে ফুলবাগিচা ঝলমল করছে। এদিকটা মোটামুটি শান্ত এবং নিরিবিলি। মাইকের আওয়াজ এদিকে না পৌঁছানোর কারণ দোতলা একটা লম্বা বাড়ি। বাড়িটার চেহারা দেখে বোঝা যায় খুব পুরনো। সম্ভবত কোনও বড়লোক বা জমিদারের বাড়ি। আশ্রমকে দান করা হয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে : কর্মশালা।
প্রাঙ্গণে একদল ছাত্রী বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে কসরত করছে। একজন শিক্ষিকা সামনে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন। আমরা অফিসঘরে ঢুকলাম। নীল পাড়ে সাদা শাড়ি পরা তিনজন মহিলা একসঙ্গে মুখ তুললেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমরা করুণাময়ী দেবীর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
একজন মহিলা বললেন, হেডমিস্ট্রেস তো অসুস্থ। স্কুলে আসেননি কাল থেকে।
আমরা কলকাতা থেকে আসছি। যদি ওঁর কোয়ার্টারটা দেখিয়ে দেন, বাধিত হব।
উনি কি দেখা করবেন? ভীষণ অসুস্থ।
কর্নেল পকেট থেকে কার্ড বের করে বললেন, এই কার্ডটা ওঁকে দিলে আশা করি উনি দেখা করবেন।
লক্ষ্য করলাম, কর্নেলের এই কার্ডটা অন্য কার্ড। সাধারণ কার্ডে নামের নিচে শুধু লেখা থাকে নেচারিস্ট। এই কার্ডের নামের নিচে লেখা আছে, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার।
মহিলা কার্ডটি দেখে বললেন, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার মানে?
মানে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না প্লিজ! করুণাময়ী দেবী ঠিকই বুঝবেন।
মহিলা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, চলুন।
স্কুলবাড়ির পেছনে গাছপালার ভেতর সারবন্দি একতলা ঘর দেখা যাচ্ছিল। তার উল্টোদিকে একটা আলাদা একতলা বাড়ি। বাড়ির পাশেই একটা ছোট মন্দির। এক টুকরো ফুলবাগান। বাড়িটার বারান্দায় তেমনি নীলপাড়ের সাদা শাড়িপরা এক তরুণী দাঁড়িয়েছিল। সে আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আমাদের সঙ্গিনী মহিলা বললেন, শুভা! মাসিমা কেমন আছেন রে? এঁরা কলকাতা থেকে মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
শুভা আস্তে বলল, মাসিমা শুয়ে আছেন।
মহিলা পর্দা তুলে সামনেকার ঘরে ঢুকে গেলেন। শুভা কর্নেলকে দেখছিল। কর্নেল মিষ্টি হেসে বললেন, আপনি টিচার?
শুভা মাথা দোলাল। আমি নার্স।
আশ্রমে হাসপাতাল আছে বুঝি?
হ্যাঁ।
এইসময় সেই মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, ভেতরে যান আপনারা। শুভা! আমি যাই রে! তুই তো আছিস।
ভেতরে ঢুকে দেখি, সাদামাঠা বিছানায় প্রৌঢ়া এক মহিলা বসে আছেন। পরনে সাদা থান। চেহারায় রুক্ষ ভাব। চশমার ভেতর চোখদুটি তীক্ষ্ণ। রোগাটে গড়ন। গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। কার্ডটা ওঁর হাতের মুঠায় ধরা। বললেন, বসুন।
ঘরে আসন বলতে একটা মোড়া এবং একটা চৌকো টুল। দুটোই অবশ্য গদি আঁটা। সম্ভবত এই আশ্রমেরই তৈরি। কর্নেল মোড়ায় বসে বসলেন, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
আপনি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি কী ইনভেস্টিগেট করেছেন?
আপনার ছেলে সুদর্শনের মৃত্যু সম্পর্কে।
খোকা সুইসাইড করেছে। আমাকে ওর দুঃখের কথা বলতে এসেছিল। আমি ওকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি।
সুইসাইডের খবর আপনাকে ভবতারণ দিয়ে গেছে। তাই না?
হ্যাঁ। সে কাল এসেছিল। রাত্রে আশ্রমে থেকে সকালে ফিরে গেছে। আমার সঙ্গে দেখা করে যায়নি। তবে ভবতারণ খোকার বউ সেজে থাকা মেয়েটাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে, এটুকুই যা সান্ত্বনা। ওই মেয়েটাই খোকার আত্মহত্যার জন্য দায়ী। খোকা আমাকে বলেছিল। কিন্তু আমি কী করতে পারি? যা-ও বা পারতাম, সময় পেলাম না। খোকা বরাবর হঠকারী স্বভাবের ছেলে ছিল।
আপনি সদানন্দবাবুর উইলের কথা জানেন?
গুরুজির কাছে শুনেছি।
প্রপার্টি আপনাদের আশ্রম পাবে। তাই না?
করুণাময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, গুরুজিকে বলে রেখেছি, ওই পাপের সম্পত্তি যেন না নেন।
কর্নেল হাসলেন। বললেন, পাপের সম্পত্তি পুণ্যের কাজে লাগানো উচিত।
না। আমি গুরুজিকে বলেছি, উনি ওই সম্পত্তি নিলে আমি আশ্রম ছেড়ে চলে যাব।
গুরুজি কী বলেছেন?
আমাকে ভেবে দেখতে দুদিন সময় দিয়েছেন। কিন্তু আমার এক কথা।
কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, ক্ষমা করবেন। একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।
করুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি।
সদানন্দবাবুর সঙ্গে আপনার লিগ্যালি ডিভোর্স হয়েছিল কি?
আমরা কোর্টে যাইনি। গুরুজির আদেশে আমাদের সেপারেশন হয়েছিল। করুণাময়ী ঠোঁটের কোনা কামড়ে ধরে যেন আত্মসম্বরণ করলেন। তারপর বললেন, খোকার মৃত্যু সম্পর্কে আপনি তদন্ত করছেন কেন? কে আপনাকে তদন্তের ভার দিয়েছে? ওই বজ্জাত মেয়েটা?
না। আমার ব্যক্তিগত কিছু হবি আছে। আসলে আমি একজন রহস্যভেদী।
করুণাময়ী আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকালেন। খোকার মৃত্যুতে কি কোনও রহস্য আছে?
আছে। তাকে কেউ মার্ডার করেছে।
কী বললেন?
মার্ডার। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা। আপনার ছেলের মানসিক অসুখ ছিল। সে আত্মহত্যার কথা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিল। এমনকি একটা সুইসাইডাল নোটও লিখেছিল। কিন্তু ওটা তার অবচেতন অভিমানেরই প্রকাশ মাত্র। সুইসাইড সে শেষ পর্যন্ত হয়তো করত না। আমি হয়তো বলছি। কারণ সে ঠিক করেনি কখন আত্মহত্যা করবে। আমার ধারণা, সে এইভাবে তার স্ত্রী গোপার মনোযোগ দাবি করেছিল এই মাত্র। গোপা–শুধু গোপা তাকে সুস্থ করে তুলতে পারত। কিন্তু গোপা তা করেনি। কেন করেনি, এখনও আমি জানি না। তবে কেউ এই সুযোগটা নিয়েছে। সুইসাইডাল নোট চুরি করেছে। তারপর তার কাপে পটাসিয়াম সায়নায়েডের বডি রেখে দিয়েছে। ভোরে কফি খাওয়ার অভ্যাস ছিল সুদর্শনের। খুনী তা জানত। গ্যাসওভেনের কাছে একটা কাপে বড়িটা ছিল। জায়গাটা আমি দেখেছি। সেখানে সরাসরি আলো পড়ে না। সাদা কাপের তলায় সাদা বড়ি! চিন্তা করুন! অভ্যাসমতো সুদর্শন তাতে কফি ঢেলেছে এবং কফিতে চুমুক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়েছে। খুনী তাকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে টেবিলে বসিয়ে দিয়েছে এবং টেবিলে সুইসাইডাল নোটটা পেপারওয়েট চাপিয়ে রেখে দিয়েছে। গ্যাসের ওভেনের তলা থেকে ভাঙা কাপের টুকরোও কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের টেবিলের নিচে ফেলেছে।
দুহাতে মুখ ঢাকলেন করুণাময়ী। শরীর কেঁপে উঠল।
প্লিজ মিসেস সান্যাল, একটু শান্ত হোন।
করুণাময়ীর চোখে জল। রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বললেন, আমি মিসেস সান্যাল নই।
আইনের চোখে আপনি এখনও মিসেস সান্যাল! প্লিজ ফেস দা রিয়্যালিটি।
করুণাময়ী একটু পরে আস্তে আস্তে বললেন, কে খুন করল খোকাকে? কেন খুন করল?
আপনার কী ধারণা আমি জানতে চাই। তাছাড়া আপনার সাহায্যও পেতে চাই।
আপনি পটাসিয়াম সায়নায়েড বললেন। তাই না?
হ্যাঁ। পটাসিয়াম সায়নায়েড।
করুণাময়ী খুব চাপা স্বরে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কলকাতা যাব।
বেশ তো!
করুণাময়ী ফিসফিস করে বললেন, আপনারা গিয়ে মেইন গেটের বাইরে অপেক্ষা করুন। আমি যাচ্ছি।…
.
০৯.
শুধু এটুকু বুঝেছিলাম, করুণাময়ী চুপিচুপি আশ্রম থেকে কলকাতা যেতে চান। কর্নেলকে জিজ্ঞেস করে কোনও হদিস পাইনি। এক্কাগাড়ি চেপে কৃষ্ণনগর স্টেশন, তারপর ট্রেনে শেয়ালদা পৌঁছুতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছিল। সারা পথ করুণাময়ী গম্ভীর এবং নীরব ছিলেন। কর্নেলও তাই।
শেয়ালদা থেকে ট্যাক্সি থেকে চেপে বাগবাজারের দিকে যাওয়ার সময় আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। কর্নেল নির্বিকার। পেছনে কোনও কালো আম্বাসাডার দেখামাত্র মনে হচ্ছিল, আমাদের ফলো করে আসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তেমন কোনও কালো গাড়ি ফলো করে এল না।
ট্যাক্সিচালক ট্রামলাইন থেকে গলিতে ঢুকতে রাজি হলো না। কালকের মতো এ রাত্রেও এলাকা জুড়ে লোডশেডিং। প্রতি মুহূর্তে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, শিববাবুর গুণ্ডারা হামলা করবে। বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে করুণাময়ী ডাকলেন, ভবতারণ! অবু!
পোর্টিকার ছাদ থেকে টর্চের আলো এসে পড়ল। অবনীর সাড়া পাওয়া গেল, কে? কী চাই?
আমি। গেট খুলে দে!
টর্চ নিভে গেল। একটু পরে নিচের প্রাঙ্গণে আবার জ্বলে উঠল। অবনী ত্রিশূল এবং টর্চ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসছিল। করুণাময়ী রুষ্ট স্বরে বললেন, আলো নিভিয়ে দে বলছি!
কী কাণ্ড! পিসিমা না? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? ব্রহ্মময়ী! মা গো!
ন্যাকামি করলে থাপ্পড় খাবি। শিগগির গেট খুলে দে বলছি।
অবনী গেট খুলে দিল। আমরা ঢুকলে সে তক্ষুণি তালা এঁটে দিয়ে বলল, মায়ের এ কী লীলা! আমি মাইরি বিশ্বাস করতে পারছি না–
চুপ। ভবতারণ কোথায়?
সন্ধ্যায় বেরিয়েছে। অবনী হাঁটতে হাঁটতে বলল। দুপুরে ব্যাটাচ্ছেলে ফিরল। বাড়ি ঢুকতে দেব না ভেবেছিলাম। কিন্তু ঝামেলার ভয়ে ওকে ঘাটালাম না। শিবু উকিলের গুণ্ডাদের নিয়ে এসে উল্টে আমাকেই যদি বাড়ি থেকে বের করে দেয়? তা তুমি হঠাৎ এসে পড়বে কল্পনাও করিনি। মায়ের দিব্যি! কর্নেলসাহেব তোমাকে ডেকে এনেছেন মনে হচ্ছে? ও মশাই! ব্যাপারটা কী?
কর্নেল বললেন, গোপার খবর কী অবনীবাবু?
এখনও পৌঁছুতে পারেনি। তবে অলরেডি আমি রঞ্জুবাবুর সঙ্গে কনসাল্ট করে এসেছি।
করুণাময়ী দোতলায় উঠে বললেন, অবু! খোকা কোন্ ঘরে ছিল?
পিসেমশাইয়ের ঘরে।
ঘরটা খুলে দে। আর লণ্ঠন বা মোম নিয়ে আয়।
অবনী নিজের ঘর থেকে আগে হ্যারিকেন নিয়ে এল। তারপর সুদর্শনের ঘরের তালা খুলল। করুণাময়ীর নার্ভ যে কত শক্ত, তা টের পাচ্ছিলাম। বললেন, কর্নেলসাহেব! আমাকে সব বুঝিয়ে দিন। খোকাকে যে সত্যি মার্ডার করা হয়েছে, আপনি কী করে বুঝলেন আমি ডিটেলস জানতে চাই।
কর্নেল সেই চেয়ারে বসে হাত দুটো টেবিলে বিছিয়ে মুখ কাত করে রেখে চমৎকার অভিনয় করলেন। তারপর বললেন, ভাঙা কাপটা এখানে পড়েছিল। চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিলে কাপ নিচে পড়বে না। পটাসিয়াম সায়নায়েড কয়েক সেকেন্ডেই কাজ করে। কাজেই কাপটা টেবিলেই গড়িয়ে পড়া উচিত ছিল। টেবিলে কোনও তরল পদার্থের চিহ্ন ছিল না। ডান হাত টেবিলে ওভাবে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও ছিল না। এবার সুদর্শনের ল্যাবে আসুন।
অবনীর হাত থেকে করুণাময়ী হ্যারিকেন নিলেন। অবনী বলল, আমি পোর্টিকোর ছাদে যাচ্ছি পিসিমা! বাড়িতে চোর ঢুকতে পারে। পাহারা দিই গে।
সে চলে গেল। সুদর্শনের ল্যাবে ঢুকে করুণাময়ী শ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে বললেন, এ ঘরে খোকার বাবার ল্যাবরেটরি ছিল।
কর্নেল গ্যাসওভেনের কাছে গিয়ে খুদে টর্চ জ্বেলে হাঁটু মুড়ে বসলেন। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর মুখে বললেন, আশ্চর্য! কাপের কয়েকটা সূক্ষ্ম কুচি পড়ে ছিল। নেই। কফির দাগ ছিল। ঘষে মুছে দিয়েছে কেউ।
করুণাময়ী এগিয়ে গেলেন একটা কাঁচের দেওয়াল-আলমারির দিকে। নানা সাইজের কৌটো, প্যাকেট আর শিশি-বোতলে আলমারিটা ভর্তি। উনি কাঁচের পাল্লা ধরে টানতেই খুলে গেল।
কর্নেল বললেন, আলমারিটা খোলা ছিল দেখছি!
করুণাময়ী লণ্ঠনটা আমাকে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে আনলেন। চেয়ারে উঠে উপরের তাকের পেছনে হাত ভরলেন। তারপর ব্যস্তভাবে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন।
কর্নেল বললেন, পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি খুঁজছেন কি?
হ্যাঁ। কিন্তু পাচ্ছি না।
আপনি জানতেন ওখানে শিশিটা ছিল?
জানতাম। করুণাময়ী চেয়ার থেকে নামলেন। তবে এক বছর আগের কথা। খোকার বাবা পরে কোথাও সরিয়ে রেখে থাকবে। শুধু বুঝতে পারছি না, আলমারিটা খোলা কেন?
সুদর্শন হয়তো বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল।
করুণাময়ী আমার হাত থেকে হ্যারিকেন নিয়ে ল্যাবের ভেতর ঘোরাঘুরি করে বললেন, এই ল্যাবে অনেক নতুন যন্ত্রপাতি দেখছি। এ দুটো কি কম্পিউটার?
হ্যাঁ। আপনার বউমাও বায়োকেমিস্ট। স্বামীর রিসার্চের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
করুণাময়ী বাঁকা মুখে বললেন, ওর চালাকি খোকা ধরতে পেরেছিল। সরল সাদাসিধে ছেলেটাকে এক্সপ্লয়েট করছিল মেয়েটা।
কর্নেল পকেট থেকে সুদর্শনের লেখা চিঠিটা বের করে দিলেন। বললেন, পড়ে দেখুন।
করুণাময়ী একটা টেবিলে লণ্ঠন রেখে চিঠিটা পড়লেন। তারপর বললেন, আমি খোকাকে কখনও বলিনি বউকে নিয়ে আমেরিকা ফিরে যাক। এ কথা খোকা কেন লিখল জানি না। আমি ওকে বলেছিলাম, ওকে তোর বাবার ফমুল্ম দিয়ে ভুল করেছিস। ফাইলটা কেড়ে নিয়ে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দে।
কর্নেল বললেন, ফাইলটা কেড়ে নেওয়ার সাহস সুদর্শনের ছিল না। তাই গোপনে গোপার স্যুটকেস থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল। এখন বুঝলাম আপনার কথায় সে এ কাজ করেছিল।
ফাইলটা কি খুঁজে পেয়েছেন আপনি?
ফাইলটা আমি পেয়েছিলাম। পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছি।
ভাল করেছেন।
চিঠিটা আমাকে প্লিজ ফেরত দিন।
চিঠিটা দুহাতে ধরে ঠোঁটে চেপে ধরলেন করুণাময়ী। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আমার খোকার হাতের শেষ চিহ্ন!
যথাসময়ে ওটা আপনার হাতেই তুলে দেব। আই প্রমিস!
করুণাময়ী চিঠিটা কর্নেলকে ফেরত দিয়ে বললেন, পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশিটা খুঁজে বের করা উচিত। শিশিটা ভর্তি ছিল দেখেছিলাম।
বলে উনি পাশের ঘরে গিয়ে ডাকলেন, অবু! শুনে যা তো!
অবনী করিডরে এসে বলল, পিসিমা! মাইরি আমি কল্পনা করতে পারছি না, তুমি এসেছ!
ভাং গিলেছিস?
তোমার দিব্যি
তুই ল্যাবের কাঁচের আলমারি খুলেছিলি?
আমি? আমার মাথা খারাপ? ওষুধের আলমারি খুলে আমি করবটা কী?
ওতে পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি ছিল। খুঁজে পেলাম না।
ওরে বাবা! এ কী সাংঘাতিক কাণ্ড!
অবু? এখনও ব, তুই ওটা চুরি করে কাউকে বেচেছিস কি না?
মা কালীর দিব্যি! পিসিমা! আমি তাই পারি? আমি কেমন করেই বা জানব ওই আলমারিতে সায়নায়েড আছে?
তুই খোকার বাবার আসিস্ট্যান্ট ছিলি। তুই নিশ্চয় জানতিস।
আমার কিস্যু মনে নেই! তপজপ তন্ত্রসাধনা নিয়ে কাটাচ্ছি। আমাকে দেখেই তোমার বোঝা উচিত ছিল, কী ছিলাম আর কী হয়েছি। বলে অবনী হঠাৎ গলার স্বর চাপা করল। আমার সন্দেহ হচ্ছে, এ নিশ্চয় ভবার কাজ। চলো তো পিসিমা, ভবার ঘর সার্চ করে দেখি। সে কর্নেলের দিকে তাকাল। ও মশাই! আপনি তো গোয়েন্দা! তালা ভাঙতে পারবেন?
কর্নেল হাসলেন। তালা ভাঙার দরকার কী অবনীবাবু! আমরা বরং অপেক্ষা করি। ভবতারণ ফিরে আসুক।
পিসিমা! এস। আমার ঘরে বসবে। আমি চা-ফা করে আনি।
করুণাময়ী রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বললেন, না। আমরা নিচে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আমাকে আজ রাত্রেই আশ্রমে ফিরতে হবে।
অবনী কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, আশ্রমে কাল দিনেই যেও বরং। কে জানে কেন আজ রাত্রে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। তুমি থাকলে সাহস বাড়ে। বুঝলে না? শিবু উকিলের গুণ্ডারা কখন এসে হামলা করে বলা যায় না। অন্তত আজ রাত্রিটা থেকে যাও পিসিমা! কাল থেকে আমার আর ভয় নেই।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। গোপা দিল্লি থেকে এসে গেলেই আপনি নিশ্চিন্ত।
করুণাময়ী বললেন, সেই বজ্জাত ডাইনি মেয়েটা আবার আসবে? তার সাহস তো কম নয়।
অবনী গম্ভীর মুখে বলল, পিসেমশাই যে কেলোর কীর্তি করে গেছেন। উইল অনুসারে গোপা এই প্রপার্টির মালিক। শিবু উকিলের কাছে উইল আছে। দেখে এসো গে না!
করুণাময়ী শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, চলুন কর্নেলসাহেব! নিচে যাই। এখানে থাকতে আমার দম আটকে আসছে।
আমরা নিচে গেলাম। পোর্টিকোর সামনে লনে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ ফিরে এল। অবনী বলল, ততক্ষণ মন্দিরে গিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আসি! তারা! ব্রহ্মময়ী! মা গো!
এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, অবনী মৈত্রের পায়ে খড়ম নেই। খালি পা। আজ সকালেও কর্নেলের বাড়িতে সে খালি পায়ে গিয়েছিল।
কর্নেল বললেন, অবনীবাবুর তন্ত্রসাধনার বাতিক সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
করুণাময়ী বললেন, গুরুজি ওকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে খোকার বাবার সঙ্গে আশ্রমে যেত। গুরুজির খড়ম চুরি করে ধরা পড়েছিল। খড়মজোড়া গুরুজিকে হিমালয়ে এক সন্ন্যাসী দিয়েছিলেন। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, সেই খড়ম পায়ে দিয়ে গুরুজি এক হাত উঁচুতে শূন্যে দাঁড়াতে পারেন।
সব সময়?
না। বছরে মাত্র একবার। কালীপুজোর রাত্রে অমাবস্যার তিথিতে হাজার হাজার ভক্তের চোখের সামনে উনি এই অলৌকিক শক্তি দেখান। সেই খড়ম চুরি করেছিল অবু। গুরুজি ক্ষমা করেছিলেন। ভক্তরা অবশ্য তার আগেই ওকে মারধর করেছিল। আমি আর খোকার বাবা তো লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনি গুরুজিকে। শেষে উনি নিজেই এ বাড়ি এসে আমাদের আশ্রমে ডেকে নিয়ে যান। করুণাময়ী শ্বাস ফেলে বললেন, যাক সেসব পুরনো কথা।
আপনি গোপনে আশ্রম থেকে এলেন কেন?
গুরুজি অনুমতি দিতেন না বলে।
কর্নেল হাসলেন। উনি অলৌকিক শক্তিধর সিদ্ধপুরুষ। উনি নিশ্চয় টের পাবেন।
পাবেন। কিন্তু উনি ক্ষমাশীল। মায়ের মন উনি বুঝবেন।
এইসময় গেটের কাছে ভবতারণের হাঁকডাক শোনা গেল। অবনী মন্দিরের দিক থেকে দৌড়ে এসে গেট খুলতে গেল। বলল, দ্যাখ গে কারা এসেছে। তোর পিণ্ডি চটকানো হবে।
ভবতারণ, হন্তদন্ত এসে থমকে দাঁড়াল।
করুণাময়ী বললেন, ভবতারণ! তুই আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে এলি যে?
আজ্ঞে, সময় পাইনি।
অবনী হুঙ্কার দিয়ে বলল, ঘর খোত্ হতচ্ছাড়া! তোর ঘর সার্চ হবে।
ভবতারণ পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে বলল, যান! বেশি জাঁক দেখাবেন না। আমি, কি চুরি করেছি যে আমার ঘর সার্চ হবে?
করুণাময়ী বললেন, তোর ঘরটা একবার দেখতে চাই ভবতারণ!
ভবতারণ ভড়কে গেল। তা দেখবেন বৈকি। কিন্তু কেন–ঠাকরুন?
অবনী ত্রিশূল নেড়ে বলল, শাট আপ! ঘর খোল শিগগির?
গোমড়ামুখে ভবতারণ তার ঘরের তালা খুলল। সুইচ টিপে আলো জ্বালল। ছোট্ট ঘর। একটা তক্তাপোশে বিছানা পাতা। দড়িতে কয়েকটা জামাকাপড় ঝুলছে। দেওয়ালে অনেকগুলো ক্যালেন্ডার এবং তাকভর্তি ওষুধের শিশি।
অবনী বলল, সার্চ শুরু করুন কর্নেলসাহেব!
কর্নেল তাকের ওষুধের শিশিবোতলগুলো দেখতে ব্যস্ত হলেন। অবনী তান্ত্রিক তক্তাপোশের তলায় টর্চের আলো ফেলল। তারপর বলল, স্যুটকেসের পেছনে একটা শিশি দেখতে পাচ্ছি। দেখুন তো এটা কী?
শিশিটা দেখামাত্র করুণাময়ী কেড়ে নিলেন। তারপর শিশিটা মুঠোয় বুকের কাছে চেপে ধরে ভাঙা গলায় বললেন, ভবতারণ! তোর মনে এই ছিল?
অবনী বলল, আমি থানা থেকে পুলিশ ডেকে আনি। ওকে পালাতে দেবেন না।
কর্নেল বললেন, ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই অবনীবাবু!
কী বলছেন মশাই! হাতেনাতে ধরাপড়া আসামীকে ছেড়ে দেব?
একটু ধৈর্য ধরুন। আমি দেখছি!
ভবতারণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গলার ভেতর থেকে বলল, আজ্ঞে, কী। হলো কিছু তো বুঝতে পারছি না।
এই শিশিটা তুমি কোথায় পেয়েছিলে ভবতারণ?
আজ্ঞে, শিশিটা কোত্থেকে এল তা তো বুঝতে পারছি না স্যার!
এখনও খুলে বলো ভবতারণ!
সত্যি বলছি স্যার! শিশিটা আমি রাখিনি।
কী আছে এতে তুমি বুঝতে পারছ?
পারছি মনে হচ্ছে। বি-বিষ ভরা আছে।
এর আগে তুমি এটা দেখেছিলে কোথাও?
না স্যার! বলে ভবতারণ করুণাময়ীর পা জড়িয়ে ধরল। কেঁদে ফেলল সে। বিশ্বাস করুন মা-ঠাকরুণ! আমি কিছু জানি না। কেউ আমাকে ফাঁসাবার জন্য আমার ঘরে শিশিটা রেখে দিয়েছে।
করুণাময়ী পা ছাড়িয়ে নিয়ে বাইরে গেলেন। কর্নেল বললেন, ভবতারণ! আজ আশ্রম থেকে ফিরে তুমি ঘর পরিষ্কার করেছিলে। দরজার পাশে ধুলো জড়ো করা আছে।
দুপুরে পরিষ্কার করেছি। তখন শিশিটা দেখিনি।
আজ তোমার ঘরে কে এসেছিল?
একবার জগা এসেছিল। কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেল।
কে সে?
আজ্ঞে উকিলবাবুর লোক।
অবনী বলে উঠল, গুণ্ডা কর্নেলসাহেব! সাংঘাতিক লোক।
কর্নেল বললেন, আর কে এসেছিল?
তারকবাবুর ছেলে গোপাল এসেছিল।
অবনী বলল, সে-ও এক বাটপাড় মস্তান! জগার রাইটহ্যান্ড!
কর্নেল বললেন, গোপাল কেন এসেছিল?
টাকা ধার চাইতে।
অবনীবাবু! আপনি কি ওদের দেখেছিলেন?
না। কী করে দেখতে পাব? অবনী এগিয়ে গিয়ে ওপাশের একটা দরজা খুলল। এই দেখুন, ভবার চ্যালাচামুণ্ডাদের যাতায়াতের পথ।
ওদিকে কর্পোরেশনের আবর্জনার গাদা এবং একটা জঙ্গুলে পোড়ো জমি দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দিন অবনীবাবু! আবর্জনার দুর্গন্ধ আসছে।
অবনী দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, তা হলে এবার থানায় যাই?
ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই অবনীবাবু! বলে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন।
দেখলাম লনে আলো-আঁধারে দাঁড়িয়ে করুণাময়ী ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কর্নেল ওঁর কাছে গিয়ে বললেন, শিশিটা আমাকে দিন। আমার সঙ্গে আসুন। এ বাড়ি আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। জয়ন্ত, এগিয়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি দ্যাখো! মোড়ে পেয়ে যাবে।…
.
১০.
করুণাময়ীকে শেয়ালদা স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিয়ে কর্নেলের আপার্টমেন্টে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছিল। এ রাতেও কর্নেল আমাকে বাড়ি ফিরতে দিলেন না। তবে খবরের কাগজে চাকরির কারণে প্রায়ই আমাকে এ রকম বাইরে কাটাতে হয়।
খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে বসে কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, করুণাময়ী সম্পর্কে কী বুঝলে জয়ন্ত?
বললাম, জেদি এবং কড়া ধাতের মহিলা। কিন্তু আশ্রমের গুরুজির প্রতি আনুগত্যের চেয়ে ভয়টাই যেন বেশি।
স্কুলটার কথা ভুলে যাচ্ছ তুমি।
স্কুলে কী আছে?
ওঁর অন্তিম আশ্রয়। জীবনে যে সবকিছু হারিয়েছে, তার পক্ষে একটা শক্ত আশ্রয় আঁকড়ে ধরে থাকা খুবই স্বাভাবিক। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তাছাড়া চিন্তা করো, স্কুলের হেডমিস্ট্রেস হওয়ার মতো শিক্ষাদীক্ষাও ওঁর আছে। এদিকে সদানন্দবাবুর যতই প্রতিভা থাক, অ্যাকাডেমিক শিক্ষা তত কিছু ছিল না। কাজেই স্ত্রীর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলার প্রশ্ন ছিল। এসব ক্ষেত্রে রুচির সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
কর্নেল চোখ বুজে অভ্যাস মতো ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। বললাম, একটা ব্যাপার আমার আশ্চর্য লাগছে। পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি খুঁজে বের করতেই যেন উনি আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন। শিশিটা পাওয়া গেল ভবতারণের ঘরে। অথচ উনি আর উচ্চবাচ্য করে চুপচাপ চলে গেলেন। বলবেন, আপনি ওঁকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু আফটার অল ওঁর একমাত্র ছেলেকে খুন করা হয়েছে। একজন জেদি কড়া ধাতের মহিলার পক্ষে এই রিঅ্যাকশন অস্বাভাবিক। বরং বলব, অবনীর রিঅ্যাকশন অত্যন্ত স্বাভাবিক। এতক্ষণ সম্ভবত সে থানায় খবর দিয়েছে।
কর্নেল হাসলেন। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, থানায় গেলে এতক্ষণ থানা থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো। আমার ধারণা, গোপা ফিরে না আসা পর্যন্ত অবনী অপেক্ষা করবে।
কিন্তু আমার ভাবনা হচ্ছে, ভবতারণের সঙ্গে অবনীর ঝামেলা বেধেছে কি না।
বাধবার চান্স আছে। তবে
তবে কী?
ভবতারণ শিববাবুর অনুগত। তাছাড়া তার সঙ্গে পাড়ার গুণ্ডামস্তানদের যোগাযোগ আছে। অবনী তাকে ঘাঁটাবার সাহস এই রাত্রিবেলায় পাবে কি না সন্দেহ।
আচ্ছা কর্নেল, ভবতারণের ঘরে শিশিটা পাওয়া গেল। অথচ সে বলছে কিছু জানে না। কিন্তু তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে বেপরোয়া।
হ্যাঁ। শিববাবু তার গার্জেন। সে বেপরোয়া হতেই পারে।
শিববাবু এবং ভকতজির চক্রান্তের কথা সুদর্শনের চিঠিতে আছে। ওঁরা ভবতারণকে দিয়ে পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি হাতিয়ে থাকতে পারেন। তারপর কাউকে দিয়ে–
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বেশি ভাবলে ঘুমুতে পারবে না। ওঠ। শুয়ে পড়া যাক।
সকালে আবার কথাটা তুললাম। কর্নেল খবরের কাগজে চোখ বুলোচ্ছিলেন। বললেন, হুঁ। ভবতারণ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য। মালিক ওষুধের কারবারি। কাজেই ওষুধ সম্পর্কে কিছু ধারণা তার থাকতেই পারে। তার ঘরে অবনী বা সুদর্শনের অজ্ঞাতসারে বাইরের লোক আসার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। সুদর্শনের মৃত্যুর। পর শিববাবু এবং ভকতজির নির্দেশে সে গোপাকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে। টাকাকড়ির লোভ সাংঘাতিক লোভ।
উৎসাহিত হয়ে বললাম, অবনী এবং গোপাকে ফলো করে সুদর্শন পুরুলিয়ার অযোধ্যাপাহাড়ে গিয়েছিল। তখন এই শিশিটা হাতানোর অগাধ সুযোগ ভবতারণের ছিল।
নিশ্চয় ছিল।
আবার দেখুন, সুদর্শনের ল্যাবে ভকতজির গোডাউন থেকেও সিঁড়ি বেয়ে ঢোকা যায়। কেউ ল্যাবের দরজা খুলে দিলেই হলো। ঘটনার রাত্রে সুদর্শন ঘরে ছিল না। রাত একটায় ফিরে এসেছিল। ওই সময়ের মধ্যে তার সুইসাইডাল নোট চুরি করা সোজা।
হুউ। খুব সোজা। কিন্তু সুইসাইডাল নোটের কথা কার জানা ছিল, সেই প্রমাণ আমরা পাইনি।
ধরুন, দৈবাৎ ওটা কারও চোখে পড়েছিল।
তা হলে বলব, ওটা চোখে পড়ার পরই সুদর্শনকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল। তার আগে নয়। কারণ সুদর্শনকে মেরে ফেলার ঝুঁকি ছিল। অনেকেই জড়িয়ে যেত খুনের মামলায়। কাজেই শিশিটা চুরি অত আগে হয়নি।
হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, নাহ্। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
কর্নেল বললেন, সব ডেলিবারেট মার্ডারের মোটিভ থাকে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ কিংবা বৈষয়িক লাভ। এক্ষেত্রে কারও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার। কোনও সূত্র আমরা পাইনি। কাজেই বৈষয়িক লাভই মোটিভ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই না?
চমকে উঠলাম। বললাম, তাহলে গোপা প্রথমেই সন্দেহযোগ্য। কিন্তু গোপা। তো এসেছিল সদানন্দ বটিকার ফর্মুলা হাতাতে। এই প্রপার্টির ওপর তার লোভ থাকার কথাও না। আপনার মতে সে বিদেশী কোনও মাফিয়াচক্রের মেম্বার। ফর্মুলা হাতানোর পর সুদর্শনকে সে মেরে ফেলবে কেন?
ঠিক বলেছ। কিন্তু অবনীকে সে ট্রাঙ্ককলে জানিয়েছে, প্ল্যান বদলে কলকাতা ফিরে আসছে। সত্যি যদি সে ফিরে আসে, তখন রহস্যের পর্দা আশা করি সরে যাবে। কর্নেল কাগজ ভাঁজ করে রেখে বললেন, সমস্যা হলো জয়ন্ত, এ এমন একটা কেস, যা কোনওভাবেই হোমিসাইড বলে প্রমাণ করা যাবে না। আমার উদ্দেশ্য শুধু এই হত্যারহস্য জানা। তবে তোমার পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ।
কোন্ পয়েন্টটা?
ভবতারণের ঘরে পটাসিয়াম সায়নায়েডের শিশি পাওয়া গেল কেন? চলো, বেরুনো যাক।
কোথায় যাবেন?
ভবতারণের কাছে। তাকে রাত্রে কিছু জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি।…
গাড়িতে যেতে যেতে বললাম, বৈষয়িক লাভ যখন মোটিভ, তখন নিঃসন্দেহে ভকতজি এভং তাঁর সহযোগী শিববাবু এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে আছেন, যদি গোপাকে আপনি রেহাই দেন।
কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না।
বাগবাজার স্ট্রিটে ঢুকে অস্বস্তি হচ্ছিল। কালো অ্যামবাসাডর দেখলেই বুক ধড়াস ধড়াস করে উঠছিল। কর্নেল নির্বিকার। ট্রামরাস্তা পেরিয়ে সেই গতিতে ঢুকে গেটের কাছে হর্ন দিলাম। মন্দিরের দিক থেকে অবনী তান্ত্রিক দৌড়ে এল। এক গাল হেসে বলল, ভবা কাটু। সকালে ভকতজির খোঁজে গেলাম। সে-ও কাট। ওর কর্মচারীরা বলল, বোম্বে গেছে। বুঝলেন তো?
কর্নেল বললেন, বুঝলাম। থাক্। আর ভেতরে যাব না। ভবতারণকে জেরা করতে এসেছিলাম।
অবনী অদ্ভুত হাসতে লাগল। বলল, কাল রাত্রে আপনারা যাওয়ার পর শিবু উকিলের কাছে গিয়েছিল ব্যাটাচ্ছেলে। সকালে কালীদা চুপিচুপি বলল, শিবু উকিল ওকে গা ঢাকা দিতে বলেছে।
ভবতারণ কখন চলে গেছে জানেন?
কাল রাত্রেই। শিবু উকিলের বাড়ি থেকে এসে স্যুটকেস বোঁচকাকুঁচকি নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি ওকে পুলিশে দেবার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে নিষেধ করেছেন। তাই চুপচাপ ছিলাম। এই এক্ষুণি ভাবছিলাম আপনাকে টেলিফোন করি। মায়ের দয়ায় আপনি এসে পড়লেন।
গোপা এখনও এসে পৌঁছতে পারেনি?
এসে যাবে। তন্ত্রের আকর্ষণ। তারা! ব্রহ্মময়ী! মা গো!
আচ্ছা চলি!
শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে পৌঁছে কর্নেল বললেন, আমাকে এখানে নামিয়ে দাও জয়ন্ত! আজ আর অফিস কামাই কোরো না। দরকার হলে আমি রিং করব।…
কর্নেল সেদিন রিং করলেন রাত নটায়। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে রিপোর্টারস রুমে তখন খুব কাজের হিড়িক। আমার ছোট একটা অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। প্রেসক্লাবে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স থেকে সদ্য ফিরেছি। তাড়াহুড়ো করে কপিটা লিখে বেরিয়ে পড়লাম।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, গোপা বসে আছে। মুখে যেন হিংস্রতার তীক্ষ্ণ ছাপ। আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখল।
কর্নেল বললেন, তুমি কি শুধু তোমার ফেলে যাওয়া নোটবইটা নিতেই এসেছিলে?
গোপার চোখে সেই অস্বাভাবিক চাউনি লক্ষ্য করছিলাম। সে শুধু মাথাটা দোলাল।
তা হলে প্রপার্টির দাবি তুমি করবে না?
না। প্রপার্টির দাবি করার অধিকার আমার নেই।
কেন তা বলতে আপত্তি আছে?
উই ওয়্যার নট লিগ্যালি ম্যারেড কর্নেল সরকার। উই ওয়্যার জাস্ট লিভিং টোগেদার।
আই সি! কর্নেল হাসলেন। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছ।
দ্যাটস্ রাইট। সেজন্যই আমার ফেরার কথা আপনাকে জানাতে বলেছিলাম।
কিন্তু তুমি তো চলে যাচ্ছ! আমাকে লড়ার সময় দিচ্ছ না।
সময় যথেষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি–এনিওয়ে! উঠি বলে সে দরজার কাছে গিয়ে মার্কিন ঢঙে বলল, বাই! তারপর বেরিয়ে গেল।
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! দরজা বন্ধ করে দে।
বললাম, মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।
কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, আমিও বুঝিনি! গোপা সাড়ে আটটা নাগাদ এসে বলল, এ দেশের ডাকিনীতন্ত্র সম্পর্কে সে অনেক তথ্য। সংগ্রহ করেছিল। সেই নোটবইটা সে ভুল করে ফেলে গিয়েছিল। সেটা নাকি এতই জরুরি যে
হঠাৎ কর্নেল চোখ খুলে সোজা হলেন তারপর হাত বাড়িয়ে টেলিফোনে ডায়াল করলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে। অবনী কি ভাঙের নেশায় কাত হয়ে গেছে?
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন রেখে দিলেন। আবার ধ্যানস্থ হলেন। আপনমনে বললেন, গোপা কি সত্যিই ডাকিনীতন্ত্রের নোটবই ফেলে গিয়েছিল?
বললাম, আপনাদের এই চ্যালেঞ্জের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার টেলিফোন তুললেন। ডায়াল করে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। ব্যাপারটা দেখতে হয়।
জয়ন্ত! কুইক!
কোথায় যাবেন?
সান্যালবাড়ি।
সে কী!
জয়ন্ত! আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ওঠ। ষষ্ঠী! বেরুচ্ছি। দরজা বন্ধ করে দে।
লনে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম দুজনে। স্টার্ট দিয়ে বললাম, ও বাড়ি যেতে আমারও অস্বস্তি হচ্ছে।
কর্নেল গলার ভেতর বললেন, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক আমাকে আর ঘাঁটাতে সাহস পারেন না। সম্ভবত উনি পুলিশমহলে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। ভবতারণ এবং ভকতজি ঠিকই গা ঢাকা দিয়েছে ওঁর পরামর্শে। তা না হলে অবনীই বাড়ি থেকে গলাধাক্কা খেত।
কর্নেলের নির্দেশে গলির মোড়ে গাড়ি লক করে রেখে দুজনে এগিয়ে গেলাম। আলো দেখে বুঝলাম, নিয়মিত লোডশেডিংয়ের সময় উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথমেই চোখে পড়ল গেটে তালা দেওয়া নেই। কর্নেল ঢুকে পড়লেন, তারপর হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করে পোর্টিকোর তলায় গিয়ে দেখি, দরজা হাট করে খোলা।
ওপরতলার করিডরে গিয়ে কর্নেল অবনীর ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। দরজা খোলা। কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হুঁ! যা ভেবেছিলাম।
ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। মেঝেয় উপুড় হয়ে পড়ে আছে অবনী তান্ত্রিক। স্পন্দনহীন শরীর। একটা মদের গেলাস ভেঙেচুরে মেঝেয় ছড়িয়ে রয়েছে। অবনীর মুখের পাশে একটু রক্ত। বললাম, এ কী! সর্বনাশ!
কর্নেল আস্তে আস্তে বললেন, সুদর্শনের হত্যাকারীকে শাস্তি দিতেই ফিরে এসেছিল গোপা। মাফিয়াচক্রের মেম্বারদের কাছে সাংঘাতিক বিষের বড়ি থাকে। চলে এস জয়ন্ত! আমাদের এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়।
আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুল না। শরীরের ওজন বেড়ে গেছে যেন। গেট দিয়ে বেরুনোর সময় কেউ লক্ষ্য করছে কি না, সেদিকে মন ছিল না। যন্ত্রচালিতের মতো গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলাম। আমার ভয় হচ্ছিল, অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব হয় তো।
বাগবাজার স্ট্রিটে পৌঁছে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম, থানায় জানানো উচিত ছিল।
ছেড়ে দাও। যথাসময়ে পুলিশকে জানানোর লোক প্রচুর পাওয়া যাবে।
কিন্তু অবনী কেন সুদর্শনকে মেরে ফেলল?
গোপাকে পাওয়ার লোভে। এবং সে ভেবেছিল গোপাকে পাওয়া মানে কার্যত প্রপার্টি হাতে পাওয়া। তবে ভুলটা করেছিল গোপাই। অবনীকে বড় বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিল। সেটা হয়তো স্রেফ অভিনয়। কিন্তু নির্বোধ অবনীর মনে লোভ জাগিয়ে দেওয়ার পক্ষে সেটা যথেষ্টই।
আমি এই সম্ভাবনার কথা আপনাকে বলেছিলাম কিন্তু!
নেহাত আন্দাজে বলেছিলে। কিন্তু গোড়া থেকেই অবনী আমার সন্দেহের তালিকায় ছিল। পরে জানলাম সে বি. এস-সি পর্যন্ত পড়েছে এবং ওষুধ কারখানায় কাজও করেছে। তার পক্ষে পটাসিয়াম সায়নায়েডের খোঁজ রাখা খুবই সহজ। কিন্তু দৈবাৎ সুসাইডাল নোটটা তার হাতে না এলে সে গোপার। প্রতি যত লোভীই হোক, সুদর্শনকে খতম করার ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। সুদর্শন নিজে থেকে কবে আত্মহত্যা করবে, সেই আশায় তাকে থাকতে হতো। তবে আজ ভবতারণের ঘরে শিশি উদ্ধারে অতি উৎসাহ তার মুখোশ খুলে দিয়েছিল।
বললাম, গোপা দিল্লি থেকে ফিরে সুদর্শনের হত্যাকারীকে শাস্তি দিল। কেন? এখানে থাকার সময় কি সে আঁচ করেনি কিছু? এখানে থাকার সময় সে এটা করতে পারত।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, এ প্রশ্নের জবাব গোপাই দিতে পারে। কিন্তু এখন আর তাকে পাচ্ছি কোথায়?
চ্যালেঞ্জ কথাটা এখনও আমি বুঝতে পারিনি কর্নেল!
সুদর্শনের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জ।…
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে দেখি, ভবতারণ ফুলো ফুলো মুখ এবং লাল চোখ নিয়ে মেঝেয় বসে আছে। কর্নেলকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে পা ধরতে এল। কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তোমার ভয়ের কারণ নেই। ভবতারণ! কিন্তু আগে বলো, কে তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে?
ভবতারণ চোখ মুছে বলল, উকিলবাবু আমাকে চণ্ডীতলা আশ্রমে গিয়ে মাঠাকরুণের কাছে সব বুঝিয়ে বলতে বলেছিলেন। সেখানে গিয়ে দিব্যি কেটে সব বললাম। মাঠাকরুণ আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। দিনে আসতে আমার সাহস হলো না পুলিশের ভয়ে। তাই সন্ধ্যার ট্রেনে চলে এলাম।
হুঁ। তোমার কোনও দোষ নেই ভবতারণ। কিন্তু তোমার ঘরে বিষের শিশি গেল কী করে?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার! তবে
বলো!
আমার ঘরের তালা খোলা সহজ। বাড়ির সব তালার চাবি অবনীবাবুর কাছে আছে। খুললে উনিই খুলতে পারেন।
ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে?
আজ্ঞে!
আচ্ছা ভবতারণ, তুমি সুদর্শনকে সাহেব বলতে কেন?
উকিলবাবু বলেছিলেন ওঁদের সাহেব-মেমসাহেব বলবি। তাই বলতাম।
তুমি সুদর্শনের ঘর পরিষ্কার করতে?
আজ্ঞে।
সুদর্শনের ঘরের কোনও কাগজপত্র অবনীবাবুকে দিয়েছিলে?
ভবতারণ চমকে উঠল। বলল, সাহেব জোরে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে কোথায় বেরিয়েছিলেন। ঘর সাফ করতে গিয়ে দেখি, একটা ভাঁজ করা কাগজ টেবিলের নিচে পড়ে আছে। আমি কাগজটা কুড়িয়ে টেবিলে রাখতে যাচ্ছি, সেইসময় অবনীবাবু এসে বললেন, ওটা কী রে দেখি! উনি কাগজটা দেখে বললেন, পাগলের কাণ্ড! ওর বউকে দেখাই। বলে হাসতে হাসতে ওটা নিয়ে চলে গেলেন।
কবে?
যেদিন রাত্রে সাহেব মারা গেলেন।
কিন্তু কখন কাগজটা পেয়েছিলে?
বিকেলবেলায়। সেদিন দুপুর পর্যন্ত সাহেব ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন। ডাকাডাকি করে ওঠালাম। খেয়ে দেয়ে বেরুলেন। ফিরলেন রাত একটায়। তারপর–
তুমি ওকে কাগজটার কথা বলোনি?
মনে ছিল না। উনিও কিছু জিজ্ঞেস করেননি। করলে নিশ্চয় বলতাম।
এমন সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন, গোপা! কোথা থেকে ফোন করছ?… ঠিক আছে? বোলো না। শুধু একটা কথা জানতে চাই। তুমি দিল্লি গিয়ে কী ভাবে জানতে পারলে অবনী…হ্যাঁ। আমি দেখে এসেছি।… না। অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, যে মৃত্যু হত্যা বলে প্রমাণ করা যাবে না, তা নিয়ে…হ্যাঁ, বুঝেছি।… হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
কর্নেল ফোন রেখে বললেন, গোপা লাইন কেটে দিল।
ও কী বলল?
কর্নেল ভবতারণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে। তুমি এস ভবতারণ! তোমার চিন্তার কারণ নেই। তুমি আশ্রমে গিয়েই থাকো কিছুদিন। মাঠাকরুণের সেবাযত্ন করো।
ভবতারণ বেরিয়ে যাওয়ার পর বললাম, গোপা কী বলল?
বিবেকযন্ত্রণা তাকে দিল্লি থেকে ফিরিয়ে এনেছিল।
সে কি জানত কে সুদর্শনকে খুন করেছে?
জানতে পেরেছিল। কিন্তু রিস্ক নিতে চায়নি। এখানে শিববাবু তার পিছনে লেগেছেন। তার চেয়ে দিল্লি থেকে গোপনে ফিরে অবনীকে শাস্তি দিয়ে যাওয়া তার পক্ষে নিরাপদ মনে হয়েছিল। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে ফের বললেন, আমাকে কথাটা অবনীর মাধ্যমে জানাবার কারণ এবার আশা করি বুঝতে পারছ। সে বলতে চেয়েছিল আমি তাকে যেন বিপদে না ফেলি। কারণ আমিও সুদর্শনের হত্যাকারীর শাস্তি চাই। কিন্তু সত্যি বলতে কী, খুনের বদলে খুন, এমন শাস্তি চাইনি।…
Leave a Reply