বিজয়নগর – শ্রীপারাবত
দে’জ পাবলিশিং ৷৷ কলকাতা ৭০০ ০৭৩
প্রথম প্রকাশ : কলকাতা পুস্তকমেলা জানুয়ারি ২০০৭, মাঘ ১৪১৩
অনুষ্টুপ, অজন্তা, অত্রি, মনস্বিণী, অগ্নি ও আর্যকে–
এদের আনন্দে আমার আনন্দ। নিরানন্দকে প্রশ্রয় না দেওয়ার শক্তি যেন পায়।
লেখকের অন্যান্য বই
চন্দ্রকেতুগড়
আরাবল্লী থেকে আগ্রা
অযোধ্যার শেষ নবাব
মুর্শিদকুলি খাঁ
বাহাদুর শাহ
নাদির শাহ
রাজপুত নন্দিনী
চিতোরগড়
কিতাগড়
মিশর সম্রাজ্ঞী হতশেপসুত
মেবার-বহ্নি পদ্মিনী
রাণাদিল
রণস্থল মাড়োয়ার
উপন্যাসটি লিখতে Robert Sewell-এর A Forgotten Empire : Vijayanagar নামক গ্রন্থটির ওপর নির্ভর করেছি।
–শ্রীপারাবত
.
ভারতবর্ষের উত্তরখণ্ডে তখন পরাক্রান্ত মুসলমান সাম্রাজ্য। দক্ষিণ-ভাগেও তাদের প্রভাব অনেকটা বিস্তৃত। তারই মধ্যে দীর্ঘ তিনশো বৎসর স্থায়ী এক হিন্দুসাম্রাজ্যের উত্থান ঘটল—নাম তার বিজয়নগর। অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য অধ্যুষিত দক্ষিণের রাজন্যবর্গ উত্তরের শক্তিশালী মুসলমানদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধে পারদর্শী একজন হিন্দু সমরনায়কের অধীনে সঙ্ঘবদ্ধ হল। তার ফলে এই বিজয়নগর সাম্রাজ্য যার বিস্তৃতি ছিল মহারাষ্ট্রের নিন্মাঞ্চল থেকে সুদূর সিংহল গমনের সমুদ্র পর্যন্ত।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নাম রাজধানীর নামেই নামাঙ্কিত। এটি একটি দুর্গ নগরী। এর চতুর্দিকে পর পর তিনটি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এই ভূখণ্ডের উপর দিয়ে তুঙ্গভদ্রা নদীর প্রবাহ আজও অব্যাহত। তবে এক সময়ে তার গতির মধ্যে যে হাস্যলাস্যের ধ্বনি ঝঙ্কৃত হত এখন তেমন আর দেখা যায় না। মনে হয় যেন অতীত গৌরবের কথা ভেবে সে ম্রিয়মান। গতির মধ্যেও শ্লথতা লোকে বুঝতে পারে না, বোঝার কারণও নেই। তারা অতি ক্ষুদ্র আনেগুণ্ডি রাজ্যের কথা জানবে কি করে? এই আনেগুণ্ডির রাজাই বিজয়নগরের প্রথম নৃপতি। লোকে বলে তিনি ছিলেন ওয়ারেঙ্গলের রাজার মন্ত্রী। রাজ্য মুসলমান সুলতান দ্বারা আক্রান্ত এবং অধিকৃত হলে তিনি চলে আসেন আনেপত্তিতে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাই বাক্কা। তিনিও ওয়ারেঙ্গনের উচ্চপদস্ত কর্মচারি ছিলেন।
বিজয়নগরের পত্তন নিয়ে একটি চমকপ্রদ প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে। তুঙ্গভদ্রার অপর তীর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। রাজী সেখানে মৃগয়ায় যেতেন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। একদিন মৃগয়ার সময় রাজার কুকুরগুলো যখন এক ঝাঁক খরগোশের পিছু ধাওয়া করল তখন খরগোশেরা প্রাণভয়ে পালিয়ে না গিয়ে রুখে দাঁড়াল এবং কুকুরদের আক্রমণ করল। কুকুরেরা সভয়ে পালিয়ে এসে তাদের প্রভূর পায়ের কাছে জড়ো হয়ে কাঁপতে থাকল। রাজা এবং সবাই এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। মৃগয়া স্থগিত রেখে তিনি ফিরে এলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন সবকিছু জানিয়ে গুরুদেবের উপদেশ নিতে হবে।
কৃষ্ণানদীর তীরে ছিল সিদ্ধপুরুষ মাধবাচার্যের আশ্রম। মাধবাচার্যই রাজা এবং তাঁর ভাই-এর গুরু। পরদিনই তাঁরা ছুটে গেলেন গুরুদেবের কাছে। সব শুনে মাধবাচার্য বললেন, ওই স্থানটিই হবে তোমাদের ভবিষ্যতের রাজধানী। ওখানে নগরী গড়ে তোলো। মাধবাচার্যের অপর নাম ছিল বিদ্যারণ্য। তাঁর জন্ম কৃষ্ণানদীর তীরবর্তী এক গ্রামে। প্রথমে নগরীর নাম বিদ্যারণ্যের নামেই রাখা হয়েছিল। পরে সেটি পরিবর্তিত হয়ে বিজয়নগর হয়। প্রথমে নগর, তারপর রাজ্য এবং সব শেষে সাম্রাজ্য। এই দুর্গ নগরীকে বলতে গেলে পাঁচটি পর্বত আড়াল করে রেখেছে। পর্বতগুলির নাম ঋষ্যকূট, অঞ্জনা, মাতঙ্গ, মলয়াবন্ত ও হেমকূট। রামায়ণের বহু চরিত্রের লীলাক্ষেত্র এই ভূমি। ওই মাতঙ্গ পর্বতে সুগ্রীব ও হনুমান আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ভূখণ্ড শিব শক্তি ও বিষ্ণুর পবিত্র স্থান।
বিজয়নগরের অধীশ্বরেরা নিজেদের রাজত্বকালে কত সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করে গিয়েছেন। এখানে রয়েছে রামমন্দির, বিরুপাক্ষ বা পম্পাপতি মন্দির। পম্পাপতির অর্থ পম্পার পতি। ব্রহ্মার কন্যা কিংবা পম্পাতীর্থ। তুঙ্গভদ্রার নামও এখানে পম্পানদী। আরও কত দেবদেবীর মন্দির রয়েছে। মুক্তি নরসিংহ, পাতালেশ্বর নবদুর্গা। তারকেশ্বরের মন্দিরে যেখানে শিবের ক্রোড়ে ক্ষুদ্রাকৃতির দুর্গা বসে রয়েছেন, রয়েছে সরস্বতীর মন্দির, পট্টভিরাম মন্দির। মন্দিরের শেষ নেই।
রাজারা ধর্মবিষয়ে গোঁড়া নন মোটেই। এখানে যেমন রয়েছে বৌদ্ধ চৈত্য, তেমনি রয়েছে জৈন মন্দির। সবার ধর্মাচরণ নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে করে।
.
মা একদিন তার ত্রয়োদর্শী মেয়ে শ্রীমতীর হাত ধরে অনেক পথ অতিক্রম করে বিজয়নগরের পশুপতি মন্দির দ্বারে এসে উপস্থিত হল। তখন মধ্যাহ্ন। মহানগরীর মন্দিরের পথে তেমন লোকজন দেখা যায়না। শ্রীমতী তৃষ্ণার্ত হলেও মাকে বলতে দ্বিধা। মায়ের মনের অবস্থা সে জানে। তিনি জানেন কন্যা আর কোনোদিনই সগৃহে ফিরতে পারবে না, যেখানে সে পিতৃস্নেহে লালিত হয়েছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত। মা হয়তো একা সপ্তহে ফিরবে; কিন্তু শ্রীমতীকে সঙ্গে করে কিছুতেই নিয়ে যাবে না। সেকথা ভেবে তারও বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। সবাই বলে সে খুব বুদ্ধিমতী। তাই বোধহয় কাঁলে না। সে বুঝতে পারছিল জীবনে আজ শেষ দেখা দেখে নেবে মাকে। এর পরে দেবতার পায়ে সমর্পিতা হয়ে যাবে সে, যদি এঁরা তাকে গ্রহণ করেন। মা তাকে অনেকবার তার ভবিষ্যৎ জীবন বেছে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সব চেয়ে সহজ উপায় ছিল গ্রামেরই খুবই অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলের সঙ্গে বিবাহ। সে সাহস পায়নি। এখানকার অবস্থা সম্পূর্ণ চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। পর পর তিনবছর খরা চলছে। লোকে প্রথমে অর্ধাহারে থাকতে শুরু করল, তারপর এখন অনাহার। চেনা অচেনাদের অনেকে মরতে শুরু করেছে। তুঙ্গভদ্রার জলধারায় বাঁধ দিয়ে বাঁধানো খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে বিজয়নগরের আশেপাশের কৃষিক্ষেত্রে জলাভাব থাকে না। সর্বদাই হরিৎ ক্ষেত্র। কিন্তু তাদের গ্রাম রাজধানী থেকে বহুদূরে। কৃষ্ণা নদীও তাই।
পিতা জীবিত থাকলে তাদের হয়তো অনাহারের প্রান্তে এসে উপস্থিত হতে হত না। কারণ তার পিতা ছিলেন বিজয়লাভের সেনা বিভাগের এক উঁচুদরের সেনা। তাঁর ভূমিকাও তাই ছিল অনেকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভাগ্য বলে একটা কথা রয়েছে। গত বছর সুলতানের সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করার সময় সহসা একটি তীর এসে তাঁর বুকে বিঁধে যায়। তিনি পড়ে গিয়ে আর উঠলেন না। খবর এনেছিল গ্রামেরই একজন। সে সেই যুদ্ধে ছিল। পিতার মৃত্যু ঠিক যুদ্ধ করে হয়নি। তাঁর আত্মা হয়তো সেজন্য তৃপ্ত নয়। তিনি সব সময় বলতেন, সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুর স্বাদ আলাদা। সে জানে তার পিতা ছিলেন জ্ঞানী। যুদ্ধ তাঁর পেশা। সেই পেশায় পারদর্শী হতে তিনি এতটুকুও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু তাঁর নেশা ছিল পুস্তক। তাঁর কাছে শ্রীমতী অনেক কিছু শিখেছে।
বহুবার সে গভীর রাতে মাকে নিঃশব্দে কাঁদতে দেখেছে। সে তখন মাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানত। মায়ের কান্না আর শব্দহীন থাকত না, ফুঁপিয়ে উঠত। সে জানে মা তাকে এখানে রেখে গিয়ে গ্রামে ফিরছে নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করতে। স্বামী নেই, একমাত্র কন্যাও আর কখনো কাছে থাকবে না। কোনো পিছুটান নেই। মরণে তার ক্ষোভ নেই। মরণের সময় হয়তো আবছা হাসির রেখা ফুটে উঠবে তার অনাহারক্লিষ্ট মুখে। এভাবে কেউ তো সাধারণত মরতে পারে না। তখন কি মায়ের চোখের সামনে তার মুখ ভেসে উঠবে? নাকি বাবার? হয়তো দু’জনারই। কিংবা তীরবিদ্ধ বাবার কল্পিত মুখখানা যা সে নিজেও দেখে শয়নে স্বপনে সেইমুখ।
আজ মন্দিরের দ্বারদেশে এসে মা তাকে কাছে টেনে নিয়ে মুখচুম্বন করে। বলে, তোর রূপ পার্বতীর মতো। এই মন্দিরই তোর উপযুক্ত স্থান। পশুপতি তোকে ঠিক দেখবেন। আমি জানি পশুপতির মতো মানুষও রয়েছেন পৃথিবীতে। কিন্তু সে তো দুর্লভ। আমার তেমন সাধই ছিল। একবার দেবদাসী হলে সেই সাধ পূর্ণ হওয়ার নয়।
মা থেমে যায়। একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি এগিয়ে এলেন ধীরে ধীরে। প্রথম দর্শনেই ধারণা হয় তিনিই এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। প্রধান পুরোহিত বলা তো কম বলা হল। ইনি নিশ্চয় একজন সিদ্ধপুরুষ। নইলে একটা জ্যোতির্বলয় তাঁর মস্তকের চতুর্দিকে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল কেন? এমন তো সে দেখেনি। শুনেছে সিদ্ধপুরুষের অমন হয়। মায়ের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে তিনি বলেন—তুমি কি পুজো দিতে চাও মা?
মনে মনে মা বলে, আপনি তো সবই জানেন ঠাকুর।
মা ঘাড় নেড়ে জানায়, পুজো সে দেবে না।
—তবে, বিগ্রহ দর্শন?
—হ্যাঁ বাবা, দর্শন অবশ্যই করব। মন্দিরে এসে বিগ্রহ দর্শন করব না? সাধ্য থাকলে প্রাণভরে পুজো দিতাম। সেই সাধ্য আর নেই। আমি এসেছি আপনার কাছে।
-আমার কাছে?
—হ্যাঁ ঠাকুর। আমি এক হতভাগিনী। দেশে দুর্ভিক্ষ। গ্রামে মড়ক। আমার স্বামী যুদ্ধে নিহত। নিজের জন্য ভাবি না। আমার মেয়ের জন্য এসেছি। একে আপনি আশ্রয় দিন।
–আমি আশ্রয় দেব?
–একে দেবতার কাছে সমর্পণ করলাম।
–এতো কিশোরী, রূপবতীও বটে। একে কোন্ কাজ দেব?
—দেবদাসী।
পূজারীর মুখে বিস্ময়। তিনি কিশোরীর মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখেন। তারপর মাকে বলেন দেবদাসীর অর্থ বোঝ?
—হ্যাঁ, দেবতার পদাশ্রিতা। দেবতাই তার মন-প্রাণ, জীবন-যৌবন।
—সহজ অর্থে তাই বটে। কিন্তু সব কিছু জান?
—আমি গ্রামের সামান্য একজন গৃহবধূ। সব কিছু জানার ক্ষমতা কোথায়? প্রয়োজনও নেই। আমি শুধু জানি আমার মেয়ে এখানে অন্তত অনাহারে মরবে না। মনুষ্যরূপী পশুরাও একে ছিঁড়ে খাবে না। এখানে আপনি আছেন।
বৃদ্ধ আকাশের দিকে চেয়ে বলেন—খাওয়ার নানান প্রক্রিয়া থাকে মা। যাহোক তোমার মেয়ের অনাহারে মৃত্যু হবে না, এটাই তুমি চাও।
—হ্যাঁ বাবা।
—জীবনে আর কখনো সংসারধর্ম করতে পারবে না সে কথা জানা সত্ত্বেও?
-হ্যাঁ।
-তোমার সঙ্গে হয়তো জীবনে আর দেখা হবে না।
মা কেঁদে ফেলে বলে—সব জানি, সব জানি। তবু তার মতই আমার মত।
সে গ্রামে থাকতে চায় না।
বৃদ্ধ কিশোরীকে প্রশ্ন করেন—তুমি ঘর বাঁধতে চাও না?
—গ্রামে থাকব না।
—বিয়ে করবে না?
—কেউ নেই।
-দেবতার পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারবে?
–বাবা বলতেন, চেষ্টা আর সাধনায় অসাধ্যও সাধ্য হয়। বাবা অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন আমাকে
—তুমি লেখাপড়া শিখেছ?
— হ্যাঁ।
বৃদ্ধ অবাক হয়ে আবার বলেন—শিখেছ?
—হ্যাঁ, যতটা পেরেছি। বাবা তো চলে গেলেন। নইলে আরও শিখতাম।
-তোমার নাম কি?
—শ্ৰীমতী।
–সত্যি? তোমাকে তাহলে বলি, এই বিজয়নগরের পত্তন হয়েছিল যাঁর পরামর্শে সেই সিদ্ধপুরুষের মায়ের নামও ছিল তোমার নামে।
শ্রীমতীর সারা দেহে শিহরণ জাগে।
মা ভাবে, তার মেয়ের আশ্রয় সুনিশ্চিত।
মেয়ে ভাবে, তার তো অতীতের শ্রীমতী হওয়ার সম্ভাবনা আর সৌভাগ্যের পথ চিরতরে বন্ধ হতে বসেছে।
বৃদ্ধ বলেন—আমি একে গ্রহণ করলাম। তবে একে অনেক কিছু শিখতে হবে। নাচ গান তো বটেই। মনে হয় তোমার মেয়ে পারবে।
বিগ্রহ দর্শন করে মা মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়। মেয়ে প্রধান দ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে সজল নয়নে মায়ের গমন পথের দিকে চেয়ে থাকে। সে খেয়াল করে না তার পাশে একজন দুজন করে আরও কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে। মা চোখ মুছে পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
মেয়েরা শ্রীমতীকে ঘিরে ধরে। ওদের অনেক কৌতূহল, অনেক প্রশ্ন চব্বিশ পঁচিশ বছরের একজন বলে—তুমি এত ছোট বয়সে চলে এলে কেন? আর একজন বলে—তোমার বাড়ি কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে একজন জিজ্ঞাসা করে—তোমাকে ডাকাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বুঝি?
শ্রীমতী বলে ওঠে—কেন, ডাকাতে ধরবে কেন?
আর একজন হেসে বলে ওঠে—ওকে ধরে নিয়েছিল বলে, ও ভাবে সবাইকে বুঝি ডাকাতে ধরে। ওর মামা তাই ওকে মন্দিরের সামনে ফেলে রেখে গিয়েছিল। ঠাকুর দয়া করে স্থান দিয়েছেন। দেখতে তো একটু সুন্দর, তবে তোমার মতো নয়। এই বয়সেই যা রূপ।
কেউ বলে-নাচ গান জান?
একজন কচি মুখের মেয়ে তার হাত ধরে বলে—তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। শ্রীমতী থতমত খেয়ে যায়। সেই সময় বৃদ্ধ এসে সবাইকে হেসে বলেন—ওর সঙ্গে তোমাদের পরিচয় হবেই। এখন ছেড়ে দাও। অনেক দূর থেকে এসেছে। হয়তো অভুক্ত রয়েছে।
তাঁর কথায় মেয়েরা শান্তভাবে ভেতরে চলে যায় ৷
—তুমি চল।
দুদিনের মধ্যে শ্রীমতী বুঝতে পারে বৃদ্ধের অঙ্গুলি হেলনে এই মন্দিরের সব কিছু পরিচালিত হয়। এত ক্ষমতা যার তিনি এত কোমল স্বভাবের এবং ঈশ্বরে নিবেদিত প্রাণ হন কিভাবে? তার এক এক সময়ে মনে হয় ইনি নররূপী ঈশ্বর। এখানকার দেবদাসীদের কথাবার্তায় সেই রকমই অনুভূত হয়। মন্দিরের তো অভাব নেই বিজয়নগরে। কত মন্দির এবং সেইসব মন্দিরের কত পূজারী রয়েছে। তাঁদের মধ্য থেকে তাঁকেই রাজপরিবারের গুরুরূপে নির্বাচন করার অন্য কোনো কারণ নেই। গুরুর নাম ক্রিয়াশক্তি। এই নামে তিনি পরিচিত এবং বিখ্যাত। শ্রীমতীর ভাগ্য ভালো যে তার এবং তার মায়ের সঙ্গে বিজয়নগরে এসে সর্বপ্রথম এঁরই সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ঈশ্বরের অভীপ্সা ছাড়া এমন কখনো হতে পারে না। হয়তো গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় তার স্বর্গীয় পিতাও ওপর থেকে এই প্রার্থনাই করেছিলেন ঈশ্বরের কাছে।
আরও কিছুদিন কেটে যায়। শ্রীমতী অনুভব করে গুরুদেব তাকে অদৃশ্যভাবে সবার থেকে একটু স্বতন্ত্র করে রেখেছেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে তাকে তাদের কথা বলতে পারে না। অথচ তাদের চোখে মুখে তীব্র কৌতূহল আর আকাঙ্খা। তার নিজেরও কি অন্যদের সম্বন্ধে জানার ইচ্ছা নেই? থাকাটাই তো স্বাভাবিক। সবার চেয়ে ছোট হলেও সেও তো নারী।
অন্যান্য দেবদাসীর সঙ্গে তারও নৃত্যগীতের শিক্ষা শুরু হয়। তারা সবাই অনেক বেশি জানে। কেউ কেউ তো রীতিমতো পারদর্শিনী। প্রথম দিনেই মাধবী নামে একজন এসে তাকে বলে—তুই ঠিক পারবি। দেখে বোঝা যায় তোর মধ্যে সুরও আছে ছন্দও আছে। কচি মুখের মঞ্জরী প্রথম দিনেই তার ঘরে তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ক্রিয়াশক্তি হেসে সম্মতি দিয়েছিলেন। রাতে মঞ্জরী তাকে বলে—একটা কথা বলবি?
-কোন কথা?
–তোর মা কি নাচ-গান জানতেন?
—না। একথা জানতে চাইলে কেন?
—দয়াবতী শেখাতে শেখাতে বলছিল, তোর মধ্যে নাচ গান দুটোই আছে। তাড়াতাড়ি শিখে যাবি। দয়াবতী গান খুব ভালো জানে, তাই শেখায়।
কথাটা শুনে শ্রীমতীর আনন্দ হয়। সে বলে—ভালোই তো। তোমরা কত সুন্দর নাচো, দয়াবতী দিদির কী সুন্দর গানের গলা। মনে হয় স্বর্গ থেকে ভেসে আসছে কোনো দেবীর বা অপ্সরার সঙ্গীত।
—মুক্তি বলে, এমন গলা পৃথিবীতে খুব কম আসে। হয়তো একশো বছরে একবার।
– ঠিক বলেছ। এত ভালো গান আমি কখনো শুনিনি। কল্পনাই করিনি।
—রাজপুরীতে প্রায়ই যেতে হয় তাকে।
-কেন?
-রানীরা ডেকে পাঠান। মন খারাপ হলে, গান শুনে তৃপ্তি পেতে।
—রানীদেরও অতৃপ্তি?
—তুই খুবই ছেলেমানুষ। সম্পদ মানুষকে কতটুকু তৃপ্তি দেয়? নারীদের মনের জ্বালা কতটুকু মেটে তাতে? রাজার শত শত রানী। তার মধ্যেও শ্রেণীভেদ।
—শ্রেণীভেদ?
—হ্যাঁ। বোধহয় রূপের তারতম্যে এই পার্থক্য গড়ে ওঠে। যারা সাধারণ মানের রানী, তারা অধিকাংশ সময়ে পদব্রজেও যাতায়াত করে।
–সে কি? তবে কেন রানী করা হল?
-হয়তো রাজার কোনো অসতর্ক মুহূর্তে সেই হতভাগিনীকে নজরে পড়েছিল এবং সে তার স্পর্শ পেয়েছিল। তাই সে রানী। যারা শকট কিংবা ডুলিতে যাতায়াত করে তারা সত্যই সুন্দরী। তোরও সুযোগ মিলবে। তখন দেখিস।
—তাদের অতৃপ্তি কিসে তবে?
–আমি আর বলতে পারব না। গুরুদেব নিশ্চয় চান না সব কিছু তোকে বলি। তুই খুব ছোট।
—তিনি তোমাকে বলেছেন?
—না। তবে আমরা সবাই গুরুদেবকে বুঝতে পারি। যাকে শ্রদ্ধা করা যায় যাঁকে ভালোবাসা যায়, তাঁর মন বুঝতে কি অসুবিধা হয়?
—না। কিন্তু কতদিন পরে বলবে?
—বলতে হবে না। তুই নিজেই বুঝবি। তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি। কখনো রাজপুরীতে গেলে সব সময় রাজার নজরের বাইরে থাকবি।
– কেন?
—উনি সঙ্গে সঙ্গে তোকে রানী করে রাজপুরীতে রেখে দেবেন। —দয়াবতী দিদি তো মাঝে মাঝে রাজপুরীতে যান। রাজা তাকে কিন্তু রানী করেননি।
—দয়াবতীদির কণ্ঠস্বরে যাদু রয়েছে। তাঁর রূপ নেই। থাকলে কবে রানী হয়ে যেত।
—তাই হয় নাকি?
—হবে না কেন? রাজা আর দেবতায় কতটুকু পার্থক্য?
—কিন্তু বয়স? দয়াবতীদিদির বয়স চব্বিশ। রাজার বয়স অনেক বেশি। দেবতার বয়স বাড়ে না।
—পুরুষের আবার বয়স। তাছাড়া রাজার বয়স বাড়ে না।
–তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না।
–তুই যে বলিস আমাকে দেখতে কচি কচি। আমাকে তোর ভালো লাগে?
—লাগে। তবে এখনকার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে না। মন কেমন করে দেয়।
মঞ্জরী একটু থমকে যায়। শ্রীমতী কেসে খুব ভালোবাসে। ভালোবাসে তার স্বভাবের জন্য। সে ধীরে ধীরে বলে—তুই অনেক আঘাত পাবি। মনে রাখিস পৃথিবীটা কল্পনা দিয়ে গড়া নয়। এখানে পথ চললে ধুলো লাগে, কাদা লাগে, পোশাক ময়লা হয় ৷
-আমাদের গ্রামেও অনেক ধুলো। চাষের ক্ষেতে ধুলো উড়ছে বৃষ্টির অভাবে। তারই জন্য বাধ্য হয়ে এখানে চলে আসতে হয়েছে। ধুলোমাটি আমার বড় প্রিয়, বড় আপন। আমার পোশাকও দেখেছিলে কত মলিন ছিল, তোমাদের পোশাকের মতো পরিষ্কার ছিল না। তবু গ্রামের লোকের কথাবার্তা এমন নয়।
– কেমন?
—তুমি যেভাবে বলার চেষ্টা করছ, একটা কুৎসিত কিছুর ইঙ্গিত দিতে গিয়েও থেমে গেলে।
মঞ্জরী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে—আমারই ভুল হয়েছিল। তোর বয়স এখনো অনেক কম। তোকে আমি কিছু বলব না। অনেক সময় তোকে আমার সমবয়সী ভেবে ফেলি। তবে তুই কিছুদিনের মধ্যেই বুঝবি। রক্তে একটু দোলা লাগুক। এতকিছুর মধ্যেও যখন কোনো সময়ে নিজেকে খুব একা একা লাগবে তেমন কোনো দিনে আমার কাছে এসে তুই-ই কিছু জানতে চাইবি।
–আমার এখনই একা একা লাগে মায়ের জন্য।
মঞ্জরী বিষণ্ণ হাসি হেসে বলে—তুই ভাবিস আমাদের কারও মা নেই, বাবা নেই, ভাই বোন কেউ নেই। সব আছে, আমাদেরও সব আছে।
শ্রীমতী মঞ্জরীর বিষণ্ণ মুখ দেখে ধাক্কা খায়। সে ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বলে—আমি স্বার্থপর তাই নিজের কথাই ভাবছিলাম। তুমি আমাকে ক্ষমা কর ৷
—সেকি! ক্ষমা কেন? তুই ছোট তো তাই অমন বলেছিস।
–তোমার মা বাবাদের জন্য কষ্ট হয় না?
—হতো, খুব হতো, দিনের পর দিন কেঁদেছি। এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
-আমারও অমন হবে?
–না হলে, বাঁচবি কি করে?
—মাকে ভুলে যাব?
—কেউ কি ভোলে? প্রথমে অহরহ মনে পড়ে, তারপর ক’দিন পর পর। তারপর মাসে।
-তারপর? বছরে একবার?
—জানি না। তেমন অবস্থায় এখনো পড়িনি। আমার ভাইটির কথা মনে পড়ায় কালও কেঁদেছি। জানি, যে মুখ মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, সেই মুখের ইতিমধ্যেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন আমার মা। তাকে সধবা দেখেছিলাম। বাবা তারপর মারা গিয়েছে খবর পেয়েছি। তবু আগের মায়ের চেহারাই তো দেখি। মঞ্জরীর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে শ্রীমতী কেঁদে ফেলে বলে—আমাকে ক্ষমা কর। আর কখনো এমন বলব না।
মঞ্জরী হেসে ফেলে বলে—একই বলে ছেলেমানুষী। ক্ষমা চাওয়ার কি হল? আমার সঙ্গে তো তোর ক্ষমা চাওয়া-চাওয়ির সম্পর্ক নয় ৷
.
কয়েকদিন পরে গুরুদেব একদিন দেবদদাসীদের বললেন—আজ তোমাদের নৃত্যগীত শিক্ষা বন্ধ থাকবে। তার পরিবর্তে তোমরা দুপুরে বিগ্রহের সামনে আসবে। তোমাদের আমি বিজয়নগরের ইতিহাস সম্বন্ধে কিছু বলব। তোমরা নগরীর পাঁচজন সাধারণ মানুষ তো নও। তোমাদের একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
সবাই ভাবে, বিশেষ দায়িত্ব আবার কি? বিগ্রহের সামনে নৃত্যগীত আর রাজপুরীর কোনো নির্দেশ থাকলে সেটি পালন করা। মঞ্জরী ঠিক সেরকম ভাবল না। গুরুদেব দেশের ইতিহাস শোনাবেন বলেছেন। কেন বলেছেন তাও বুঝতে পারে সে। শ্রীমতীকে বলে যেতে চান। কারণ একমাত্র সে-ই তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। তাকে সামনে রেখে অন্যদের বলবেন, যাতে দেশ সম্বন্ধে তাদেরও ধারণা হয়। তবে মঞ্জরী এ সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করে না। এমন কি শ্রীমতীকেও কিছু বলে না। বরং শ্রীমতীর কল্যাণে কিছু জ নতে পারবে ভেবে আনন্দিতই হয়।
নির্দিষ্ট সময়ে সবাই বিগ্রহের সামনে এসে গুরুদেব তাদের বিগ্রহের সামনে বসতে বলে নিজেও আসন গ্রহণ করেন। তিনি বলেন—তোমরা ভাবছ, তোমাদের কোন পাঠ দেব।
শ্রীমতীর মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে—খুব ভালোই হয় তাহলে।
গুরুদেব হেসে বলেন—পড়তে খুব ভালো লাগে তোমায় আমি জানি। তবে আজকে তোমাদের ডেকেছি একটা ধারণা দিতে। এই বিজয়নগর তো এত শক্তিশালী সম্পদশালী ছিল না। এটি ছিল খুবই ক্ষুদ্র। তোমরা জান মাধবাচার্য নামে একজন সিদ্ধপুরুষ আজকের বিজয়নগরের শক্তিশালী হয়ে উঠার মূলে। তিনি এই সাম্রাজ্যের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। দুইভাই হরিহর আর বাক্কার একান্ত অনুরোধে। তিনি এদের গুরুদেবও ছিলেন। আমাদের দেশ সম্পদশালী হয়ে ওঠার প্রধান কারণ কিন্তু পররাজ্য অধিকার করার মাধ্যমে নয়, বাণিজ্যের মাধ্যমে। মাধবাচার্যের পুত্র সায়নাচার্যও ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাশালী। তাঁর সম্বন্ধে সঠিক কিছু আমি বলতে পারব না। কারণ হরিহর আর বাক্কার মৃত্যুর পরে এই বিজয়নগর মুসলমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তখনকার মহারাজ সেই আক্রমণ প্রতিহত করলেও তাঁর স্বভাবের জন্য সায়নাচার্য বিরক্ত হয়ে রাজ্য ত্যাগ করে পূর্বদিকে চলে যান। কেউ কেউ বলে তিনি অঙ্গবঙ্গের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। যাহোক ওসব জেনে তোমাদের লাভ নেই। তবে একটা কথা সব সময় মনে রেখো, বিজয়নগরের মানুষেরা অত্যন্ত দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনচেতা। এ দেশের পথের ভিখারীকেও তোমরা অবজ্ঞা করবে না। তোমরা জান না, দিল্লির সুলতান একবার আনেগুণ্ডি আক্রমণ করে এখানকার তৎকালীন রাজপরিবারের প্রত্যেককে হত্যা করে তাঁর প্রতিনিধিকে এই দেশ শাসনের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু দু-চার মাস পরেই সে দিল্লিতে ফিরে গিয়ে বলেছিল, তার পক্ষে এখানে থাকা অসম্ভব। সর্বদা প্রাণভয়ে থাকতে হয়। সুলতান তখন আনেগুণ্ডিরই এক রাজপুরুষকে রাজ্যশাসনের ভার দেন।
শ্রীমতী বলে—এখনকার রাজা কি তাঁরই বংশধর?
–না, বিজয়নগর ধীরে ধীরে সম্পদশালী হয়ে উঠলেও রাজার পরিবর্তন হয়েছে। সব রাজবংশেই এমন হয়। কখনো রাজা অপুত্রক হলে কিংবা কখনো সিংহাসন অধিকারের জন্য সংঘর্ষ ঘটলে বংশধারার পরিবর্তন হয়। কিন্তু তাতে বিজয়নগর সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠায় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। যাহোক, আজ তোমাদের ডেকেছি, কিছু কিছু মন্দির দেখাবার জন্য। তোমরা তো নিজেরা কোথাও যেতে পার না। তাই বলে তোমরা বন্দি ভেব না নিজেদের। ইচ্ছে করলে, আমার অনুমতি নিয়ে নগর দেখে আসতে পার। এই রাজ্যে মেয়েরা অনেক নিরাপদ।
সেই সময় মধ্যবয়সী একজন নারী এসে গুরুদেবকে আভূমি নত হয়ে প্রণাম করে বলে—আমার একটু দেরি হয়ে গেল প্রভু। রাজপথে দুই ষাঁড়ের লড়াই বেঁধেছিল। ভীড় জমে যায়। ভয়ও করছিল।
গুরুদেব হেসে ফেলেন। বলেন—শেষ পর্যন্ত কে জিতল।
—বোধহয় লালরঙের ষাড়টাই জিতেছে। কারণ কালোটা পেছিয়ে যেতে যেতে একটা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল।
গুরুদেব বলেন-আমাদেরও এই দশা না হয়।
কেউ তাঁর কথা বুঝতে পারে না। শ্রীমতী বলে ফেলে—একথা বললেন কেন?
সবাই হতচকিত হয়। এমনকি মধ্যবয়সী নারীও।
গুরুদেব গম্ভীর হয়ে বলেন–এমনিই বললাম। ওসব কথা থাক। হেমাঙ্গিনী এসে গিয়েছে। ও হল প্রাসাদের বিগ্রহের সেবাদাসী। তোমাদের মতো নৃত্যগীত ওর জানা নেই। তবে ওর ভেতরে যথেষ্ট সংগীত রয়েছে।
একথা শুনে হেমাঙ্গিনী অবাক হয়ে তাকায়।
—আমি জানি তুমি অবাক হবে। কিন্তু যখন একদিন নিমীলিত চোখে বিগ্রহের সামনে আপন মনে মন্ত্রোচ্চারণ করছিলে, তখন আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম।
হেমাঙ্গিনীর মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে কিছু বলতে পারে না।
—হেমাঙ্গিনী তোমার ওই স্তব ঈশ্বরের কাছে না পৌঁছোলে, কার স্তব পৌঁছাবে? ওই স্তরের মধ্যে ধ্বনিত হয় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদনের আকুতি। তবে তোমার চেয়েও নিবেদিত-প্রাণ কারও দর্শনও মিলতে পারে ভবিষ্যতে তার কণ্ঠস্বরও হয় যদি কোকিলকণ্ঠী।
শ্রীমতী সহসা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মঞ্জরী তাকে চেপে ধরে বলে–কাঁদছিস কেন?
গুরুদেব শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকেন। হেমাঙ্গিনী তাকে কাছে ডেকে নেয়। শ্রীমতী আঁচলে চোখ মুছে শান্ত হয়ে বসে। হেমাঙ্গিনীর আত্মনিবেদনের কথা গুরুদেবের মুখে শুনে তার কেন যে কান্না পেল, নিজেই বুঝতে পারে না।
গুরুদেব শ্রীমতীর দিকে একবার দৃষ্টি ফেলে বলেন—হেমাঙ্গিনী একাহারী। সন্ধ্যার পর সামান্য প্রসাদ পায় ৷
শ্রীমতী ভাবে, তবু কী সুন্দর স্বাস্থ্য।
গুরুদেব বলেন—নীরোগ শরীর নির্ভর করে, নির্মল হৃদয় আর পরিমিত আহারে। যাহোক এসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। হেমাঙ্গিনী বরং আজকে কয়েকটা মন্দির দেখিয়ে দাও। আগামী কাল একটু আগে এসে আরও কিছু দেখিয়ে দিও। আমি তো অত পারব না।
—না গুরুদেব, এই সামান্য কারণে আপনি কেন যাবেন। আপনার যখন যা প্রয়োজন আমাকে বলবেন, আমি দিয়ে যাব।
–তোমাকে সন্ধ্যারতির আগে ফিরে যেতে হবে তো।
–আপনি ভাববেন না। আমরা তাহলে আসি?
—হ্যাঁ হ্যাঁ এসো।
সবাই মন্দির ছেড়ে পথে পা রাখতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। হেমাঙ্গিনী স্মিত হেসে বলে—মনে হচ্ছে, তোমরা এতদিন খাঁচায় বন্দি ছিলে?
শ্রীমতী বলে—অদৃশ্য খাঁচা।
—সেটা কিরকম?
—আমি তো নতুন। এরা অনেকে দুই তিন বছর রয়েছে। তবু একা একা বাইরে যেতে পারে না। ওরা বলে, যদি কিছু হয়ে যায়? যদি কেউ কিছু বলে? আমরা দেবদাসী কিনা।
—না থাকলেও সবাই বুঝতে পারে। সাধারণ ঘরের মেয়েরা একটু অন্যরকম। আমাদের চলন-বলনে এক ধরনের শৃঙ্খলা রয়েছে। ওরা বাধাহীন।
অন্য সবাই শ্রীমতীর কথা শুনছিল। তাদের এতকিছু মনে আসেনি। অথচ শ্রীমতীর কথাগুলো যেন তাদেরই কথা যা বলতে পারেনি কখনো।
হেমাঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—তুমি অনেক ভাবো। এখন বুঝতে পারছি মন্দিরে তুমি যে কেঁদে উঠেছিলে তারও একটা কারণ রয়েছে।
শ্রীমতী হেমাঙ্গিনীর একটা হাত জড়িয়ে ধরে চলতে থাকে। নিজের মায়ের কথা মনে হয় তার। বুকের ভেতরে টনটন করে ওঠে।
হেমাঙ্গিনী বলে—আমরা প্রথমেই নগরীর একটি দ্বারের দিকে যাচ্ছি।
বিপরীত দিক থেকে জনশূন্য রাজপথ ধরে আসছিল একজন অশ্বারোহী। নগরীর কোলাহল এখানে পৌঁছয় একটু দেরিতে। সে তাদের দলের দিকে চেয়ে অশ্ব থামিয়ে নেমে পড়ে। এর আগে আরও দু-একজন কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাদের দেখেছিল বটে, কিন্তু এভাবে থেমে যায়নি। তাছাড়া অশ্বারোহী যেন কাকে নিম্নস্বরে ডাকল। ওরা থেমে যায়। লোকটি আবার ডাকল—হেমা
শ্রীমতীরা স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা সবাই একসঙ্গে হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চায়। তার মুখ বিবর্ণ বলে মনে হল। সে যেন অন্য হেমাঙ্গিনী। গুরুদেব যে হেমাঙ্গিনীর কথা তাদের বলেছেন, এ যেন সে নয়। সে বলে- তোমরা একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি। বেশি সময় লাগবে না।
ওরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামে। মনে তীব্র কৌতূহল। তাই বারবার পেছনে ফিরে দেখছিল। দু’জনে কথা বলছে। কোনোরকম অস্বাভাবিকতা নেই। কিছুক্ষণ পরে যেন হেমাঙ্গিনী নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে দৃঢ়পদে তাদের কাছে এসে পৌঁছে বলে—চল।
ওরা প্রথমে নীরবেই চলছিল। মাঝে মাঝে শুধু হেমাঙ্গিনীর দিকে চাইছিল। হেমাঙ্গিনী একটু অন্যমনস্ক মুক্তি প্রশ্ন করে—উনি আপনার পরিচিত তো বটেই।
—হ্যাঁ, পরিচিত না হলে নাম ধরে ডাকে? ত্রিশ বছর পরে দেখা হল।
—তবু চিনতে পারলেন উনি?
—আমিও অবাক হচ্ছি।
-আপনার গ্রামের কেউ?
–না, পাশের গ্রামের।
মঞ্জরী বলে—আত্মীয়?
–না, কোনো সম্ভাবনাই ছিল না আত্মীয়তার। বয়স আমাদের কম ছিল তো। বুঝিনি।
শ্রীমতী বলে—আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।
স্নিগ্ধ হাসি হেমাঙ্গিনীর মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বলে—তোমার বয়স কম। কিন্তু প্রখর বুদ্ধি রয়েছে তোমার। আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তবে তোমাদের মনে একটা কৌতূহল থেকে যাবে। তাই বলেই ফেলি। খুব অল্প বয়সে ওই পুরুষটি আমাকে যেমন চাইত, আমিও ওকে তেমনি চাইতাম। জাতের মধ্যে উঁচু নিচু শ্রেণী রয়েছে জানতাম, কিন্তু তার মধ্যেও আরও নানা ভেদাভেদ থাকে জানতাম না। আর জানলেই বা কি। জীবনে সঠিকভাবে একজনকেই তো চায় নারী বা পুরুষ। অভিভাবকেরা আমাদের সরিয়ে দিলেন। এর পরে তো কিছু করার ছিল না।
অবলা নামে মেয়েটি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে—না, কিছুই করার ছিল না। থাকে না।
—এই তো বুঝতে পেরেছ। আমি তাই দেবতার সেবায় নিজেকে সমর্পণ করলাম। এর পরে ওপথে যাওয়ার প্রবৃত্তি কি থাকে? এমন হওয়ার পরও অনেকেই সংসারী হয়। কি করে হয় আমি বুঝতে পারি না। কল্পনাও করতে পারি না। হয়তো ওরাই ঠিক। নইলে সংসার চলবে কি করে? নারী কায়মনোবাক্যে একটা সংসারই তো চায়। সে চায় সন্তানসন্ততি। আমি নিশ্চয়ই খাপছাড়া।
শ্রীমতী বলে ওঠে—আপনিই ঠিক।
হেমাঙ্গিনী হেসে ওর চিবুক তুলে ধরে বলে—তুমি জানবে কি করে? সেই বয়স তো হয়নি। অবিশ্যি দেরিও নেই।
-বয়সের দরকার কি? অনুভূতি রয়েছে।
হেমাঙ্গিনী ওকে জড়িয়ে ধরে বলে—তাই আমি দেবতার সেবায় নিজেকে সঁপে দিলাম। মা বাবা খুব আঘাত পেয়েছিলেন, বেশিদিন বাঁচেননি। কিন্তু আমি তো নিরুপায়। অনেক চেষ্টায় রাজমাতার আশ্রয় পেলাম।
মুক্তি বলে—দেবদাসী হলেন না কেন?
—আমার মধ্যে নাচ-গান তেমন নেই। মনের মধ্যে একটা আকুতি রয়েছে, যা দেবতাকে সমর্পণ করি।
শ্রীমতী বলে–আপনি দেবী।
–আর তুমি একটা পাগ্লী। চল।
মুক্তি বলে—আর অশ্বারোহী?
—মনে হল, ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে। দু’জনের মনের গঠন যে এক রকমই ছিল। ইচ্ছে করেই কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। শুধু বললাম, এই দেখাই যেন শেষ দেখা হয়। ও বলল—আমি তো জানতাম শেষ দেখা করেই শেষ হয়েছে। কিন্তু দৈবের কথা কেউ তো বলতে পারে না।
.
হেমাঙ্গিনীর কথা শ্রীমতীকে কিছুদিন আচ্ছন্ন করে রাখে। অন্যান্য মেয়েদের কারও কারও হয়তো করেছে। তবে তারা মুখ ফুটে কিছু বলেনি। ভেবেছে কিছু বললে হেমাঙ্গিনীকে ছোট করে ফেলা হবে। অথচ আরও তিনদিন হেমাঙ্গিনী তাদের নিয়ে অনেক কিছু দেখিয়েছে। বিজয়নগর সম্বন্ধে ওরা মোটামুটি জেনেছে, পথঘাটও চিনেছে। এখন আর একা একা কোথাও যেতে হলে অসহায় বোধ করবে না।
সব দেখানো শেষ হলে এক অপরাহ্নে হেমাঙ্গিনী সবাইকে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে নিয়ে আসে।
—ওদের সব কিছু দেখলাম ঠাকুর। সব তো দেখানো যায় না।
—তাকি সম্ভব? তুমি সন্তুষ্ট হয়েছ তো?
—আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু কারও মনে আরও আকাঙ্খা রয়েছে কিনা আমি জানি না। আমাকে কিছু বলেনি। ওরা ভাবতে পারে আমার খুব পরিশ্রম হচ্ছে, সংকোচবোধ করছে।
-ওদের দোষ কি? আমারই তেমন মনে হত।
হেমাঙ্গিনী বিদায় গ্রহণের আগে ক্রিয়াশক্তির পদধূলি গ্রহণ করে। ক্রিয়াশক্তি এদের বলেন—হেমাঙ্গিনীর মতো হওয়া চেষ্টা কর। পারলে তোমাদের ইহজীবন সার্থক হবে। মানুষের মনে সহস্র দুর্বলতা থাকে। সেসব দমন করে নিজেকে মুক্ত রাখার নিয়ত চেষ্টা মানুষকে দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। হেমাঙ্গিনী সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেলে আমি অবাক হব না।
শ্রীমতী মন্তব্য করে—শুনেছি দেবতাদেরও কত দুর্বলতা থাকে। ইনি তাঁদের চেয়ে অনেক উঁচুতে।
ক্রিয়াশক্তি স্তব্ধ হয়ে যায়। একটু পরে তিনি শান্ত স্বরে প্রশ্ন করেন—তুমি বুঝলে কি করে?
–শুধু আমি কেন, সবাই জানে।
হেমাঙ্গিনী ঠাকুরের দিকে চেয়ে বলে—একটি ঘটনা ঘটেছিল। এদের বোধহয় তারপর থেকেই এমন ধারণা হয়েছে। ছেলেমানুষ তো। আমি আপনাকে পরে বলব।
.
মুক্তি যেসব বিদেশিদের দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হয় তারা এদেশে এসেছে বাণিজ্যের জন্য। রাজার আরব দেশের অশ্বের উপর প্রচণ্ড লোভ। তিনি জানেন এই অশ্বগুলি এক একটি অগ্নিবাণ। যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সর্বক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত কার্যকরী। তাই রাজা কখনই চান ওরা এগুলোকে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে তিনি সেইজন্য তাঁর লোকজনকে গোয়ায় রাখেন। কোনো জাহাজ সেখানে ভিড়লেই তারা গিয়ে উপস্থিত হয় এবং যত অশ্ব আসে কিনে নেয়। বিজাপুরের শক্তিশালী সুলতান বিজয়নগরের চিরশত্রু। তারা যেন আমদানি করা অশ্বে ভাগ না বসায়। এই বিদেশিরা পর্তুগালের অধিবাসী। তারা অশ্বের সঙ্গে নিজেদের দেশের অনেক কিছু এখানে এনে সওদা করে। পরিবর্তে তারা প্রধানত হীরে জহরৎ সোনা ইত্যাদি নিয়ে যায়। ওরা বিজয়নগরের রাজাদের বরাবর পছন্দ করে এসেছে। কারণ রাজারা তাদের সঙ্গে কখনো দুর্ব্যবহার করেননি। বরং তাঁরা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ওরাও বুঝেছে যে সারা ভারতবর্ষে বিজয়নগরই একমাত্র সাম্রাজ্য যেখানে তাদের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি রক্ষা পাবে। তাই এই রাজ্যে তাদের আধিক্য লক্ষ করার মতো। নগরীর রাজপথে বহু মানুষের যাতায়াত। তাদের মধ্যে ওদের অনেক দেখা যায়। শ্রীমতীরাও ওদের দেখে প্রায়ই। গুরুদেব তো তাদের বন্দি করে রাখেননি। হেমাঙ্গিনী সংস্পর্শে এসে নগরীর পথে চলাফেরা করতে তাদের আর অসুবিধা হয় না। মুক্তি আবার ওই বিদেশিদের চেহারায় খুবই আকৃষ্ট হয়। তার জন্যে দেবদাসীদের মধ্যে হাসাহাসি হয়। একদিন পথ চলতে তারা দেখে পথে কাপড় বিছিয়ে একজন দামি পাথর বিক্রি করছে, আর দুজন বিদেশি পাথরগুলো হুমড়ি খেয়ে দেখছে। মাধবী মঞ্জরীর গা টেপে। মঞ্জরী মুক্তিকে বলে—কোন জনকে পছন্দ করলি? বেশি লম্বা না কম লম্বা? ওরা সবাই তো দীর্ঘদেহী।
মুক্তি খেপে ওঠে—তার মানে? তোরা ভেবেছিস কি? আজই গুরুদেবকে গিয়ে বলব।
–কি বলবি?
মুক্তি কেঁদে ফেলে।
অবলা বলে—চুপ চুপ। লজ্জার সীমা থাকবে না কেউ দেখে ফেললে। তোরা কখনো ওকে রাস্তায় কিছু বলবি না। বিদেশিদের দেখতে তো ভালোই। তোরা অস্বীকার করতে পারিস? তবে ও মাঝে মাঝে অনেক সময় বিদেশির অঙ্গভঙ্গি নকল করে। সেটা খুব খারাপ। ওরা দেখে ফেললে ভুল ভাববে।
মাধবী কপালে হাত রেখে বলে–হে ঈশ্বর।
শ্রীমতী লক্ষ্য করে কয়েকজন পথচারী তাদের দেখছে। সে ফিস্ ফিস্ করে সেকথা বলতেই ওরা তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করে।
.
পর্তুগীজ পর্যটক ক্রিস্টোভাও ডি ফিগুয়েইডিডো অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে রাজার কাছে রাজপ্রাসাদ দর্শনের অনুমতি প্রার্থনা করল। রাজা কিছুক্ষণ বিদেশির দিকে চেয়ে বললেন –কেন?
—মহারাজ আমরা পৃথিবীর অনেক দেশেই তো যাই, কিন্তু এত ঐশ্বর্য কোথাও দেখিনি। প্রতাপ, প্রতিপত্তি অনেক দেখেছি, কিন্তু সৌন্দর্য দেখিনি। এই নগরীতে এখন আমাদের দেশের অনেকে রয়েছে। যদি প্রাসাদ দেখতে পাই তাহলে আমার মাধ্যমে সবাই দেখবে। আমাদের দেশে গল্প করার মতো একটা বিষয় পাওয়া যাবে।
রাজা সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, অতিথিকে প্রাসাদের কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়ে অন্য সব দেখিয়ে দিতে। মহিষীরাও ওখানে বাস করেন বলে অবারিত ভাবে সর্বত্র যাওয়া সম্ভব নয়। ক্রিস্টোভাওএর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। প্রাসাদের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারিরা এক জায়গায় বিদেশিদের থামতে নির্দেশ দিল। যেখানে তারা দাঁড়ালো সেটি একটি দ্বার। পরিচারিকারা রানীদের সেবা করার পরে যে দ্বার দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয় তার বিপরীত দিকে সবাই থামল। এখানে বিদেশিদের কতজন রয়েছে গুণে দেখা হল। তারপর একজন একজন করে ভেতরে একটি ক্ষুদ্র মসৃণ ও বাঁধানো চত্বরে নিয়ে গেল। এর চারদিকে শ্বেতবর্ণের প্রাচীর। এখানে একটি দ্বার রয়েছে সেটাই রাজার বাসভাবন। এই দরজার প্রবেশমুখে দুটি তৈলচিত্র রয়েছে যা চিত্রের ব্যক্তিদের সামনে বসিয়ে শিল্পী এঁকেছেন। ডান দিকের চিত্রটি রাজার পিতার এবং বাঁদিকের চিত্র স্বয়ং রাজার। পিতা ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের। তিনি সুঠাম দেহের অধিকারী এবং পুত্রের চেয়েও বলিষ্ঠ ছিলেন। তাঁরা উভয়েই তাঁদের পোশাক পরিচ্ছদ পরিহিত অবস্থায় রয়েছেন। এর পর দরজার ভেতরে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করলে আবার তাদের গণনা করা হল। তারা সবাই একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। প্রবেশ করেই বাঁদিকে ওপরে নীচে দুটি কক্ষ। নীচেরটি মেঝের চেয়েও নিচু। সেখানে দুটি তাম্রপাতের ধাপ রয়েছে। সেখান থেকে ওপর অবধি সোনা দিয়ে মোড়া এবং বাইরে গম্বুজাকৃতি। এর একটিতে চতুষ্কোণ বারান্দা রয়েছে যা হীরা চুনি এবং দামি পাথর ও মুক্তা দ্বারা মণ্ডিত। এই বারান্দার উপরে স্বর্ণনির্মিত হৃদয়াকৃতি একটি দ্রব্য মণিমুক্তা খচিত অবস্থায় ঝুলছে। এই কক্ষে একটি শয্যা রয়েছে, তার ওপর লম্বিত স্বর্ণ দ্বারা মণ্ডিত এবং তার উপর একটি কৃষ্ণবর্ণের রেশমি গদি রয়েছে। ওপরের কক্ষগুলো দেখা হয়নি। এই অট্টালিকায় একটি খোদিত প্রস্তরের স্তম্ভবিশিষ্ট কক্ষ রয়েছে। সেই কক্ষের সব কিছু হস্তী দত্ত দ্বারা নির্মিত। দেয়ালের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত হস্তীদন্তের লম্বালম্বিভাবে যে বর্গা স্তম্ভের ওপর রয়েছে তাতে গোলাপ ও পদ্ম ফুলগুলি সবই গজদন্তের। তাদের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। এ দেশের মানুষ কিভাবে জীবনযাপন করে তার চিত্রাবলী এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যার মধ্যে পর্তুগীজদেরও স্থান হয়েছে। রাজার মহিষীরা এই চিত্র দেখে সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে বুঝতে পারেন। অন্ধ এবং ভিখারীও বর্জিত হয়নি। এগুলি এত মনোমুগ্ধকর এবং এত জাঁকজমকপূর্ণ যা পৃথিবীর অন্যত্র দেখতে পাওয়া অসম্ভব।
এত দেখেও তৃপ্তি মেটে না। তবু এক সময় বিদেশিরা এটি ত্যাগ করে এল একটি বৃহৎ প্রাঙ্গণে। এটি খুব সুন্দরভাবে বাঁধানো। এর মাঝামাঝি কয়েকটি কাঠের স্তম্ভ রয়েছে। তার ওপর আড়াআড়ি ভাবে তাম্রমণ্ডিত বর্গা রয়েছে। মাঝখানে চারটি রৌপ্য নির্মিত শৃঙ্খল রয়েছে। যেগুলি আঁকড়া দিয়ে একটার সঙ্গে অপরটি যুক্ত রয়েছে। এটি রানীদের দোলনা রূপে ব্যবহৃত হয়। এই প্রাঙ্গণের ডান দিকের প্রবেশ পথে পর্তুগীজ অতিথিরা চার-পাঁচ ধাপ উপরে উঠে সুন্দর কয়েকটি গৃহে প্রবেশ করে, সেগুলি একতলা। এখানে একটি অট্টালিকা রয়েছে, যেটি অনেক স্তম্ভবিশিষ্ট এবং প্রস্তর নির্মিত। স্তম্ভগুলি গিলটি করা, যাতে তাদের স্বর্ণনির্মিত বলে মনে হয়।
এরপরে অট্টালিকার প্রবেশ পথে ঠিক কেন্দ্রস্থলে চারটি স্তম্ভের ওপর একটি চন্দ্রাতপ রয়েছে যেটিতে বহু নৃত্যরতা নারীমূর্তি অংকিত এবং আরও ক্ষুদ্র মূর্তি রয়েছে যেগুলি প্রস্তরে খোদিত। এগুলিও গিলটি করা।
দর-দালানে রৌপ্য শিকলে একটি পালংক ঝুলছে, যার পায়াগুলি স্বর্ণনির্মিত, প্রত্যেকটি সোনার পায়ায় হীরা জহরৎ বসিয়ে কারুকার্য করা। আরও কত কি যে রয়েছে, স্বর্ণনির্মিত বিরাটাকারের কড়াই অনেক রয়েছে রন্ধনের জন্য।
বিদেশিরা সব দেখে মুক হয়ে যায়। এত ঐশ্বর্য পৃথিবীর আর কারও রয়েছে বলে তাদের মনে হয় না। ক্রিস্টোভাও ডি ফিগুয়েই ডিডো তাঁর বিবরণীতে সব কিছু লিখেছেন। তাছাড়া পেজ, নুনিজ ইত্যাদি বহু পর্যটকও তাঁদের বিবরণ লিখে গিয়েছেন।
.
তিন বছর অতিক্রান্ত হয়। ক্রিয়াশক্তির চলনে সামান্য একটু শ্লথতা লক্ষ্য করা যায়। আর শ্রীমতী যেন ফুটন্ত গোলাপ। মঞ্জরী, মাধবীদের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। তবু একটি জিনিস সবাই বুঝতে পারে সাধারণ সময়ে শ্রীমতী অন্য সবার মতো বাইরে গেলেও মহানবমী নববর্ষ বা প্রাসাদের কোনো অনুষ্ঠানে গুরদেব তাকে একবছর হল যেতে দেন না। দু-বছর আগে শুধু একবার সে গিয়েছিল আর যায়নি। অবলা একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় তাদের বলে—আমার একটা কথা মনে হয়।
মঞ্জরী বলে—কি কথা !
—এবারে গুরুদেব কেন শ্রীমতীকে মহানবমীতে যেতে দিলেন না।
– কেন?
—এরমধ্যে হেমাঙ্গিনী দিদির ভূমিকা থাকতে পারে।
–সে আবার কি? উনি শ্রীমতীর এই সর্বনাশ করতে যাবেন কেন?
—সর্বনাশ? উনি শ্রীমতীকে রক্ষা করতে চেয়েছেন! রাজপুরীর সংবাদ তার চেয়ে বেশি কে জানবে?
মঞ্জরী বলে—কি জানি। ও না যাওয়ায় আমার মন খুব খারাপ ছিল। মনটা পড়ে থাকত ওর কাছে।
শ্রীমতী হেসে বলে—সত্যি? আমার খুব ভালো লাগছে তোমার কথা শুনে। অবলা বলে—আমি সত্যি কথা বলছি, হেমাঙ্গিনী দিদি ওকে বাঁচাতে চেয়েছেন। মহানবমীর শেষ দিনের অনুষ্ঠানের সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
–কি করে বুঝলে?
–বলব না। সত্যি হবে এমন কোনো কথা নেই।
সবাই হাল ছেড়ে দিলেও শ্রীমতী পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে শেষ দিনের অনুষ্ঠানের চিত্রটি মনের মধ্যে এনে দেখতে থাকে। কিন্তু ওই প্রকাণ্ড অনুষ্ঠানের শুধু শেষ দিনের দৃশ্যগুলো বেছে নেওয়া খুব কঠিন। তাই মহানবমীর যাবতীয় কিছু তার মনের মধ্যে এসে যায়। কিন্তু সেই চেষ্টা থেকে আপাতত নিবৃত্ত হয়। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারলেও নিজেকে খুব একটা হতাশ মনে হয় না। কারণ গুরুদেব সেই সব দিনে তাকে অনেক কিছু শেখান।
একদিন তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করেন—তোমরা তো দেবদাসী। জানতে ইচ্ছে করে না, তোমাদের ভবিষ্যৎ কি?
-না।
—চিরকাল তো যুবতী থাকবে না! বয়স হবে। নৃত্যে ছন্দ মিলবে না, কণ্ঠস্বরে কর্কশতা ফুটে উঠবে। তখন কি করবে?
গুরুদেবকে খুবই গম্ভীর এবং চিন্তান্বিত বলে মনে হয় তার। ভয় পেল। বলে—তবে আপনি কেন আমাকে গ্রহণ করেছিলেন?
শ্রীমতী দুঃখের সঙ্গে হেসে বলে—কতই তো মরল, আমিও না হয় তাদের মধ্যে একজন হতাম। মা কি বেঁচে আছে? থাকলে এই কয় বছরের মধ্যে একবার অন্তত আমার খোঁজে আসত। শ্রীমতীর চোখ ছলছল করে ওঠে।
সে প্রশ্ন করে—কী হয় ওদের? পথের ভিখারী হতে হয়? না, মন্দিরে মন্দিরে অন্য কাজ করে?
ক্রিয়াশক্তি বলে—অধিকাংশই তো তোমার মতো শিক্ষিতা নয়। এই যেমন আমাদের ভবানী।
—ভবানী? আমাদের ভবানীদি?
—হ্যাঁ। তাই মন্দিরের কাজে রয়েছে।
—উনি তো আমাদের রান্না করে দেন।
—হ্যাঁ ক্ষতি কি? তোমরা নিজের বাসন নিজে মাজো বলে ওকে আর মাজতে হয় না, নইলে মাজত
—এটা ঠিক কি?
—আমি জানি না, তবে শুনেছি একজন সেবাদাসী সত্যিই কয়েক বছর আগে পথের ধারে ভিক্ষাবৃত্তি করতে গিয়েছিল। তাদের মন্দিরের কেউ দেখতে পেয়ে তাকে রাজপুরীতে নিয়ে গিয়ে কোনো রানীর কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই রানী তারই গ্রামের মেয়ে ছিলেন। রানীর তো শেষ নেই। কয়েক শো।
—কয়েক শো?
—হ্যাঁ, সহস্রও হতে পারে।
—সহস্রও? কিন্তু অত রানী কোন প্রয়োজনে লাগে?
—রানীর সংখ্যা যত বেশি হয় রাজার মর্যাদা প্রজাদের কাছে তত বাড়ে। প্রজাদের যা বোঝানো হয় তাই বোঝে
—গুরুদেব আমাদের কি হবে?
—সেই কথাই ভাবছি কিছুদিন ধরে। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই, কারণ এখন তুমি সব বুঝতে পার। তোমরা নৃত্য পটিয়সী। নগরীর নটি হয় অনেকেই। নটীর আসল পরিচয় তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। অনেক নটী সুনাম অর্জন করে। সম্পদশালিনী হয়েও তার জন্য নৃত্যের সঙ্গে রূপ গুণ ও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। তোমার সবই আছে।
—ছিঃ গুরুদেব!
—অত আতঙ্কিত হতে হবে না। তোমার চাহনি দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। আজ সময় পেয়েছি বলে তোমাকে সব কিছু খুলে বলছি। তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি নিজেই খুব চিন্তিত। শুধু তুমি কেন, মঞ্জরী, মাধবী সবারই। কিন্তু সবার জন্য এই বয়সে আমি হয়তো কিছু করে উঠতে পারব না। যে ক’জনকে পারব দেখব। দুই পুরুষ আগের একটা ঘটনার কথা বলি শোন। এই সাম্রাজ্যের বাইরে মুদকল বলে একটি অঞ্চল রয়েছে, যেখানে এক চাষি পরিবারে একজন পরমাসুন্দরী কন্যা জন্মেছিল। লোকে বলত, ঈশ্বর মনের সবটুকু মাধুর্য ঢেলে দিয়ে ওকে রূপসী করেছিলেন। গ্রামবাসীরা মুগ্ধ। একজন ব্রাহ্মণ ওদের গুরু ছিলেন। তিনি ভাবলেন, এই রূপসীকে কে আশ্রয় দেবে? কে এর রূপের মর্যাদা দেবে? ব্রাহ্মণ অনেক ভেবেচিন্তে বিজননগরের রাজপ্রাসাদে এসে রাজার দর্শনপ্রার্থী হলেন। ভাবলেন, রাজার পুত্র রয়েছে একজন। রাজা যদি সম্মত হন। বিদেশি ব্রাহ্মণ দর্শন প্রার্থী, তাই রাজার দর্শন মিলতে দেরি হল না। ব্রাহ্মণ রাজাকে সেই কন্যার কথা সবিস্তারে বললেন। রাজা দৃঢ় চরিত্রের ছিলেন না। তবে কন্যার চেয়ে তিনি বয়সের তুলনায় অনেক বড়। তবু তিনি বললেন–আমি যদি সম্মত হই তাহলে ক্ষতি আছে? ব্রাহ্মণ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন-এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর কি হতে পারে? এতটা আমি চিন্তা করতে পারিনি। শুনেছি আপনার পুত্র রয়েছেন। কিন্তু আপনি যখন নিজেই সম্মত তখন অন্য কিছু আর ভাবতে চাই না।
রাজা ব্রাহ্মণকে অনেক উপঢৌকন দিলেন। সেই সঙ্গে কন্যার জন্য দুর্লভ অলংকার দিলেন। তার পরিবারকে বহু অর্থ দিয়ে বললেন–কন্যাকে অলংকারাবৃত করে দেবেন। তার পিতা মাতাকে এই অর্থ দেবেন। আমাদের নিয়ম হল কন্যা আমাদের অলংকার পরলেই বিবাহ স্থির হয়ে গেল।
ব্রাহ্মণ মুলে ফিরে কৃষকের গৃহে গিয়ে সমস্ত কথা বলেন। কন্যার বাবা মা খুবই আনন্দিত। তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের মহারাজা স্বয়ং কন্যার পাণিগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করবেন। তারা গুরুকে সঙ্গে নিয়ে অলংকার সমেত কন্যার সামনে এল। কন্যা সব শুনে এই বিবাহ করতে অস্বীকার করল। বলল—ওই রাজপুরীতে একবার রানী হয়ে ঢুকলে কেউ জীবনে আর বাইরে আসে না। তাই আমি এ বিবাহ করব না। কারণ আমি মা বাবাকে না দেখে থাকতে পারব না।
শ্রীমতী তন্ময় হয়ে শোনার পর মনে মনে সেই কবেকার কন্যাকে প্রণাম জানায়। গুরুদেব বলেন—আমারও তোমাদের জন্য এই একই ভয়।
–আপনি কি করবেন?
-পারলে তোমাদের বিবাহ দেব।
শ্রীমতী স্তম্ভিত হয়ে যায়। রাজকুলগুরু ক্রিয়াশক্তি আবাহমানকাল প্রচলিত একটি ধারার সমাপ্তি ঘটাতে চান !
—কিন্তু গুরুদেব একি সম্ভব?
—খুবই কঠিন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করলে কিছুটা সফল হতে পারি
—এই মন্দিরের একজন সেবাদাসীরও যদি বিবাহ দেন, তাহলে আপনার প্রভাব প্রতিপত্তি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাসাদ থেকেও বহিষ্কৃত হতে পারেন।
ক্রিয়াশক্তি হেসে বলেন—আমার প্রভাব অত সহজে বিনষ্ট করার ক্ষমতা কারও নেই। রাজারও নেই।
-কিন্তু দেবদাসীকে কেউ বিবাহ করবে কি? আপনার মুখ থেকে না শুনলেও, দেবদাসীরাই আলোচনা করে, তাদের লোকে বারবণিতা ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। এদের থেকে পছন্দমতো সুন্দরীদের বেছে রাজা রানী করে নেন।
–তোমার কথা একেবারে মিথ্যা না হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। তবে সমাজে এসব নিয়ে কথাবার্তা হয়।
আরও অনেক কথা হয় গুরুদেবের সঙ্গে। তাঁকে মহাপুরুষ বলে মনে হয় শ্রীমতীর। গুরুদেব বলেছেন, তোমরা দেবদাসী শুধু নও, তোমরা পূজারিণী, একথা কখনো ভুলে যেও না। নৃত্যগীতের মাধ্যমে পূজা কর তোমরা। দেশের সর্বত্র মন্দিরে মন্দিরে পূজারিণীর খোদিত মূর্তিই বেশি, রাজা মহারাজার নয়।
সেই সময় মঞ্জরীদের কলবর শোনা যায়। গুরুদেব উঠে দাঁড়িয়ে বলেন—তোমার জন্য একজন পাত্র নির্বাচন করেছি।
-পাত্র? তার অর্থ?
—যার সঙ্গে তোমার বিবাহ দিতে চাই সেই পুরুষটি নির্বাচন করেছি মনে মনে।
কথাটা শুনেই শ্রীমতীর সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। হাত পা হিমশীতল।
সেই সময়ে সবাই ভেতরে এসেই গুরুদেবকে সামনে দেখে প্রাণাম করে।
-কেমন লাগল তোমাদের?
অবলা বলে—বেশ ভালো। প্রত্যেকবারই দেখি, অথচ নতুন বলে মনে হয়।
.
অবলা ঠিকই বলেছে। মহানবমীর উৎসব প্রতি বছর দেখলেও তার আকর্ষণ কমে না। এটি প্রতি বছরে শুরু হয় পয়লা আশ্বিন শুক্লপক্ষের প্রতিপদের দিন। আর নববর্ষ হয় পয়লা কার্তিক শুক্লপক্ষের প্রতিপদে। সেই দিনে নগরীর রাজপথে দীর্ঘ শোভাযাত্রা বের হয়। তাতে রথে করে মন্দিরের অনেক বিগ্রহকে নেওয়া হয়। দেবদাসীরা তো অংশগ্রহণ করেই, এমনকি রাজার বহু রানী যাঁরা নিজের রূপ লাবণ্যের অভাবে শকট পান না, তাঁরা অন্যান্যদের মতো পদব্ৰজে শোভাযাত্রার সঙ্গে চলেন। কিছু রূপসী দামি ডুলিতে আরোহন করে যান। তবে মাল্লাদেবী গৌরীদেবীর মতো বিখ্যাত রানীদের শোভাযাত্রায় সচরাচর দেখা যায় না।
এই মহানবমীর অনুষ্ঠানে একদিন ধার্য থাকে ভূস্বামীদের সম্মান প্রদানের জন্য। রাজ-প্রদত্ত সব চেয়ে মূল্যবান সামগ্রী হল দুটি ব্যজনী যে দুটি স্বর্ণ ও বহুমূল্যবান রত্নরাজি খচিত। এই দুটিও একশ্রেণীর গরুর শ্বেতবর্ণের পুচ্ছদ্বারা নির্মিত। রাজা যদি কোনো করদ রাজাকে উচ্চ সম্মান প্রদান করতে চান তাহলে তিনি তাঁকে পদচুম্বনের অনুমতি দেন। কারণ তিনি কাউকে তাঁর হস্তচুম্বনের অনুমতি দেন না।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ। কারণ তারা গরু বা ষাঁড়কে পূজা করে। এ ছাড়া তারা সবকিছু ভক্ষণ করে। মেষ, শূকর, তিন্তির, খরগোশ, ঘুঘু, কোয়েল, এবং সব জাতীয় পক্ষী, এমনকি চড়ুই, ইঁদুর টিকটিকি, গিরগিটি, সবই বিজয়নগরের বিক্রয়কেন্দ্রগুলিতে বিক্রয় করা হয়। তবে প্রত্যেকটি জীবত অবস্থায় বিক্রিত হয়। এমনকি মৎস্যও, যাতে ক্রেতা বুঝতে পারে সে কি কিনছে। বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতে সব সময় ফলের প্রাচুর্য দেখা যায়। সেগুলি হল আঙুর, কমলালেবু, লেবু, ডালিম, কাঁঠাল এবং আম।
রাজা ঝর্ণার জল পান করেন। সেই জল আনার ভার থাকে তাঁর অতি বিশ্বাসী একজনের ওপর। যে সমস্ত পাত্রে এই জল আনা হয়, সেগুলি আবৃত থাকে এবং তাতে শীলমোহর দেওয়া থাকে। এই পাত্রগুলিকে রাজার সেবাদাসীদের হাতে দেওয়া হয়। তারা সেগুলি অন্তঃপুরে রানীদের নিকটে নিয়ে যায়।
.
একদিন মঞ্জরী শ্রীমতীকে বলে—তোকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? শ্রীমতী বলে—একটা কেন, সহস্র প্রশ্ন কর।
—না না, আমি গুরুত্ব দিয়েই বলছি।
-বল।
—তুই এত গম্ভীর হলি কবে থেকে? আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝি? সেই সময় মাধবী পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। বলে—কি হয়েছে? শ্রীমতী গম্ভীর তো? মঞ্জরী বলে—শুনলি মাধবীর কথা?
-শুনলাম তো। তাই কি?
অবলাও এসে জোটে। সব শুনে বলে—আমি জানি।
মঞ্জরী বলে—কি জানিস?
—শ্রীমতীর মুখে হাসি নেই তো?
মঞ্জরী বলে—শুনলি তো? সবাই বুঝতে পেরেছে। পারবে না কেন? যে মেয়েটার সব সময় হাসি মুখ, তার হাসি মিলিয়ে গেলে সবার চোখে পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ছে, তাই না?
শ্রীমতী ব্যথিত কণ্ঠে বলে—মায়ের কথা ভেবে কত কাঁদি, তোমাদের চোখের আড়ালে। গুরুদেবের কাছে মায়ের প্রসঙ্গে বললে, তিনি চুপ করে থাকেন। আমার মনে হয়, মায়ের অনাহারে মৃত্যু হয়েছে।
অবলা বলে—আজকে গম্ভীর অন্য কারণে। সেটা হল ওকে আমাদের সঙ্গে আজকের অনুষ্ঠানে পাঠানো হয়নি বলে।
শ্রীমতী বলে—তার জন্য আমার বিন্দুমাত্রও দুঃখ নেই।
–তবে?
শ্রীমতী বলে—তোমরা একটা কথা ভেবে দেখেছ?
মাধবী বলে—কোন কথা?
–তোমাদের এই বয়স চিরকাল থাকবে না, যৌবনও থাকবে না। তখন তোমরা কি করবে? কণ্ঠস্বরও থাকবে না। স্থবির হয়ে পড়বে। তখন কি করবে?
–কিছু না হই, ভবানীদিদি হব।
—এত মন্দির রয়েছে মহানগরীতে দেবদাসীও অনেক। সবার ভবানীদিদি হওয়ার ভাগ্য থাকে না। ওঁর ভাগ্য ভালো, তাই মন্দিরে ঠাঁই পেয়েছেন।
মঞ্জরী বলে—এর জন্য তোর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে? তাহলে তো মৃত্যুর কথাও ভাবতে হয়।
—মৃত্যু তো ভালো। জরা বার্ধক্য থেকে নিষ্কৃতি দেয়। কিন্তু তার আগের অবস্থা?
-এই জন্য ভাবছিস? ভবিষতের উপর নির্ভর করতে হয়।
শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ সবাই তাই করে। কিন্তু ব্যতিক্রমও দু-একজন আছেন, তাঁরা সাধারণ নন। তাঁরা দেবদাসীদের জীবনের শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা ভেবে আকুল হন।
মুক্তি এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। সে এবারে এসে শ্রীমতীর কাছে বসে বলে—তুই যেন কিছু একটা বলতে চাস্। আমরা যা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবি না, ভাবার চেষ্টা করি না, তুই তাই ভেবে বিমর্ষ। সত্যি কথাটা বল্।
–সত্যি কথা হল, নগরীর কোনো বিক্রয় কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় জীর্ণ বসনে আবৃত হয়ে ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বসতে ভালো লাগবে না তোমাদের
মঞ্জরী বলে—বেশ তো ছিলাম। তুই এই উদ্ভট কথা বলে মন খারাপ করে দিলি।
পরদিন মধ্যাহ্নের আহারের সময়, ভবানীদিদি পরিবেশন করছিল। ওরা সবাই প্রথমে প্রতিবাদ করেছিল। রান্না করাটা এই বয়সে যথেষ্ট পরিশ্রমের, তার ওপর পরিবেশন। ভবানী ওদের কথা মানেনি। বলল, আমি তো প্রত্যেকদিন পরিবেশন করছি না। তোমাদের এই ভাবে খাওয়াতে আমার ভালো লাগে, একটা তৃপ্তি পাই। ভাবি নিজের মেয়েদের খাওয়াচ্ছি।
ওদের সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকার পর পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চায়।
ভবানী বলে—কি হল? খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল কেন?
অবলা বলে—ভবানী দি তোমাকে আমরা যদি মা’ বলে ডাকি তাহলে তোমার ভালো লাগবে?
ভবানীর চোখ ছলছল করে ওঠে। বলে—তাই কি হয়? আসলে তো আমি দেবদাসী। আমাদের ওকথা ভাবতে নেই। মন্দিরের বিগ্রহ আমাদের সব কিছু তিনি আমাদের পতি পুত্ৰ সব।
শ্রীমতী বলে—এতদিন শুদ্ধাচারে থেকেও নারীর চিরকালের গোপন ইচ্ছা কাটিয়ে উঠতে পারেনি?
—কেউ পারে? আমি শুধু তোমাদের আমার সন্তান বলে ভাবছি। যে নারী অনেক উঁচু পর্যায়ে চলে গিয়েছেন, তিনি জগত সংসারের সবাইকে সন্তানের মতো ভাবেন।
ভবানীর এই কথা শ্রীমতীর মনে নাড়া দেয়। সে ভাবে, গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির চিন্তা বোধহয় এই কারণেই। তিনি জানেন, দেবদাসীরা ভগবৎ প্রেমে আকুল হয়ে মন্দিরে ছুটে আসেনি। তাদের মধ্যে সাধারণ নারীর সব প্রবৃত্তিই রয়েছে। পৃথিবীতে অতি সামান্য সংখ্যক নারী-পুরুষ রয়েছেন যাঁদের ঈশ্বর প্রবলভাবে টানেন। তাঁরা সংসারে স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। যেমন বুদ্ধদেব, মহাবীর।
শ্রীমতী মুখ হাত ধুয়ে এসে ভবানীকে প্রণাম করে। অন্যান্য মেয়েরা বিস্মিত। ভবানী বলে—একি করলে? না না, এটা ঠিক করলে না।
শ্রীমতী বলে—ঠিকই করেছি। তোমাকে তো মা বলে ডাকতে পারব না, দিদি বলেই ডাকব। কিন্তু আসলে তুমি আমাদের মা। নিজের মা বেঁচে আছেন কি না জানি না। বোধহয় নেই। অনেকের থেকেও নেই! এমন সুন্দর মাকে কে না পেতে চায়?
সবাই একে একে প্রণাম করে। আর এককালের দেবদাসী এবং এখনকার রাঁধুনির চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।
শ্রীমতী এবারে বুঝতে পারে, গুরুদেব দেবদাসীদের জন্য কেন এতটা উতলা হয়েছেন। তিনি জানেন মন্দিরে মন্দিরে দেবদাসীর অভাব হবে না, কিন্তু এই ভাবে অভাবের তাড়নায়, কিংবা অন্য কোনো অত্যাচারের ভয়ে যে সমস্ত কুমারী মন্দিরে দেবদাসী হয়ে প্রবেশ করে তাদের অন্তরে কত সুপ্ত বাসনা থেকে যায়। তাদের কত গুণ সুপ্তই থেকে যায়, যা তারা পরিতৃপ্তির সঙ্গে ব্যবহার করলে কত সংসার সোনার হয়ে উঠত।
কিন্তু কে সেই মানুষ যার কথা বলতে গিয়েও গুরুদেবের বলা হল না? তিনি কি এই বিজয়নগরেরই কেউ? যাঁকে তিনি নির্বাচিত করে রেখেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি কি তরুণ না বয়স্ক? গুরুদেব কি তার নিরাপত্তার কথা ভেবে বয়স্ক কাউকে নির্বাচন করে রেখেছেন? না না সেটা কেমন হবে? গুরুদেব কি অতটা অবুঝ হবেন? মুক্তি, মঞ্জরীদের জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। কিন্তু, তার বেলায় নির্বাচন করে রেখেছেন কেন? সে তো সবচেয়ে ছোট। ওদের চেয়ে পরে হলেও চলত। তাছাড়া মনকে একভাবে প্রস্তুত করে ফেলে হঠাৎ এই পরিবর্তন বড়ই পীড়াদায়ক। গুরুদেবের কাছে সে নানা বিষয়ে শিক্ষা পেত। এখন কিছু যদি ঘটে যায়, তাহলে শিক্ষার কি হবে? বন্ধ হয়ে যাবে? না না সেটা অসম্ভব। তার ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে গুরুদেবের পায়ে পড়ে প্রার্থনা করে যাতে তাকে এইসব থেকে নিষ্কৃতি দেন। সে দেবদাসীই থাকবে। পরে ভবানীদিদি হতেও সে রাজি। পথের ভিখারিণীও বরং হবে।
.
মহানবমীর শেষ দিনে রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রধান অনুষ্ঠান হয়। মঞ্জরীরা সবাই গিয়েছে। সব মন্দিরের দেবদাসীদেরই যেতে হয়। গুরুদেব তাকে যেতে দেন না। এবারের শেষ দিনে সন্ধ্যার পরে মঞ্জরীরা আসে। তাদের হাবভাবে প্রতিদিনের সেই উচ্ছ্বলতার অভাব দেখা যায়। নিশ্চয় একটা কিছু ঘটেছে।
শ্রীমতী অবলাকে জিজ্ঞাসা করে—কি হয়েছে?
—তুই জানলি কি করে?
—আমি কিছুই জানি না। দেখছি তোমরা কেমন যেন মন-মরা। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
অবলা বলে-সরস্বতী মন্দিরের সরস্বতীকে চিনিস?
—না চিনে পারি? সবাই বলে, দেবদাসী সরস্বতীর প্রতিমাই যেন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
—হ্যাঁ, তাকে তুলে নেওয়া হল অনুষ্ঠান থেকে
—তুলে নেওয়া হল মানে?
—রাজার চোখে পড়েছে। কয়েকজন রানী এসে তাকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন। সরস্বতী বুঝতে পেরে অচেতন হয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থাতেই তাকে সযত্নে তুলে নিয়ে যাওয়া হল।
শ্রীমতীর বুকের ভেতরে ধক্ ধক্ করে। মুলের সেই পরমাসুন্দরী কৃষক কন্যার উক্তি মনে পড়ল—”ওখানে একবার প্রবেশ করলে বহির্গমনের পথ চিররুদ্ধ।”
মঞ্জরী বলে—তুই সরস্বতীর চেয়ে কম সুন্দরী নোস। গুরুদেব দূরদর্শী। তাই তোকে পাঠান না।
শ্রীমতী গুরুদেবকে মনে মনে প্রণাম করে। সে ঠিক করে গুরুদেব যাকেই নির্বাচন করুন সে কোনো কথা বলবে না। তার মঙ্গল গুরুদেবের চেয়ে আর কেউ বেশি বুঝবে না। তিনি যে মহাপুরুষ।
কদিন পরে রাজপুরী থেকে হেমাঙ্গিনী এল গুরুদেবের কাছে। অনেকক্ষণ একান্তে কথাবার্তা হল। তারপর চলে যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করল।
মুক্তি বলে—সরস্বতী কেমন আছে হেমাঙ্গিনীদি?
গম্ভীর মুখে হেমাঙ্গিনী বলে—ভালো নেই।
–কেন?
—বুঝলে না? বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হলেন সমুদ্রের মতো। সেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যদি আছড়ে পড়ে ক্ষীণকায়া তুঙ্গভদ্রার ওপর তাহলে কি দশা হয়? প্রথম দর্শনের পর সেই অবস্থা হয়েছে সরস্বতীর।
হেমাঙ্গিনী যেন চিত্র এঁকে দেখিয়ে দিয়ে গেল। সেই চিত্র দেখার পর এরা সবাই অসুস্থতা বোধ করল। রাতে কারও আহারে রুচি রইল না। ভবানীদি বলল-তোমরা কেউ খাচ্ছ না কেন? কি হয়েছে?
যে দয়াবতী শুধু সঙ্গীত নিয়েই থাকে সে আজ কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলে দিল। অবলা উঠে গিয়ে দয়াবতীর চোখ মুছিয়ে দিল। মুক্তি তাকে ধরে রাখল। সবাই জানে সঙ্গীত ছাড়া ও কিছু জানে না। গুরুদেবও ওকে ভিন্ন চোখে দেখেন। বলে থাকেন—দয়াবতীর কণ্ঠে মা সরস্বতীর ঠাঁই। আজ যেন সেই সরস্বতীর অমার্যাদা করা হয়েছে। তাই দয়াবতী সহ্য করতে পারেনি। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ।
ভবানীদি বলে—নারী সর্বংসহা। নীরবে সে নিজেকে ভস্মীভূত করে ফেলে। সরস্বতীরও সেই দশা হবে। তবে রাজা জানতে পারবেন না। শত শত রানীর মধ্যে জীবনে কয়জনের সঙ্গে একাধিকবার দেখা হয়? খুব কম। এমন বহু রানী রয়েছেন যিনি রাজার স্পর্শ পাননি। সরস্বতী অতটা ভাগ্য নিয়ে আসেনি পৃথিবীতে। তাছাড়া তার রূপ হল তার বৈরী। হরিণী যেমন নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্য নিজের ধ্বংস ডেকে আনে ঠিক তেমনি। সরস্বতী-মন্দিরের পূজারী আমাদের গুরুদেবের মতো অতটা পরিনামদর্শী নয়। তাছাড়া তাঁর মতো দেবদাসীদের প্রতি মমত্ববোধ কাউকে দেখিনি।। অন্য সবাইকে তো দেখেছি এত বছরের মধ্যে।
.
বিজয়নগরের রাজার দশ লক্ষ স্থায়ী সেনাদল রয়েছে। তার মধ্যে পঁয়ত্রিশ হাজার সশস্ত্র অশ্বারোহী যারা প্রত্যেকেই নিয়মমতো বেতন পায়। এই সৈন্যদল একই জায়গায় থাকে এবং প্রয়োজন হলে যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থানে এদের পাঠানো যেতে পারে। পঞ্চাশজন সেনাপতির অধীনে অশ্বারোহী সহ দেড়লক্ষ সৈন্য পাঠানো হয় এক এক দলে। তাঁর বহু সংখ্যক হস্তীও রয়েছে, যাদের দাঁতের সঙ্গে তরবারি বেঁধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে এই বিপুল বাহিনীর ব্যয় কি করে সম্ভব হয়? রাজার রাজত্ব কত? আসলে এই সাম্রাজ্যে অনেক সামন্তরাজা রয়েছেন, যাঁরা মহানগরী, অন্য নগরী ছোট ছোট শহর এবং গ্রামগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত। এঁদের প্রত্যেকেই বিপুল রাজস্ব পান। প্রত্যেকের রাজস্ব অনুযায়ী রাজা ধার্য করে দেন কে কত পদাতিক, অশ্বারোহী বা হস্তী যুথ প্রতিপালন করবেন। এই বাহিনী সব সময় যে কোনো স্থানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই সেনানায়কগণ সবচেয়ে দক্ষ সেনাবাহিনী প্রদানের জন্য রীতিমতো পরিশ্রম করেন। এদের কুচকাওয়াজ অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।
সৈন্যদল প্রতিপালন ছাড়াও রাজাকে তাঁদের বাৎসরিক অর্থ প্রদান করতে হয়। তবে রাজার একেবারে নিজস্ব যে বাহিনী রয়েছে, তাদের বেতন তাঁর অর্থ ভাণ্ডার থেকেই দেওয়া হয়।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের নিজস্ব মুদ্রার নাম “পারদাও” এই মুদ্রা শুধুমাত্র এই সাম্রাজ্যেই প্রচলিত। “পারদাও” একটি গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা যা ভারতবর্ষের অন্য কাথাও মুদ্রিত হয় না। এটির একদিকে দুটি প্রতিমূর্তি মুদ্রিত থাকে, অন্যদিকে সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার নাম সমেত মূর্তি।
বিজয়নগরের উত্তর-পশ্চিমে এই নগরীর সঙ্গে যুক্ত কৃষ্ণপুর নামে আর একটি নগর রয়েছে, তাকে বলা যেতে পারে মন্দিরনগরী। এখানকার অধিবাসীরা সবাই পুরোহিত সম্প্রদায়ের। তারাই সেই নগরীর রাজস্ব ভোগ করে।
নগরীর দক্ষিণ দিকে সমতলভূমিতে নগলাপুর বলে আর একটি নগরী রয়েছে। দক্ষিণ দিকে আরও একটি নগরী রয়েছে। সেটি নাকি রাজা তাঁর এক রানীর প্রতি প্রেমের নিদর্শন রূপে নির্মাণ করেন। নগরীর নাম আবদোগেময়। রাজার রানীর নামও তাই।
হেমাঙ্গিনী একদিন এসে এইসব কথা বলছিল। এরা এমন কিছুই জানে না নগরীর ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে। কিন্তু যখন প্রেমের নিদর্শন রূপে নগরী নির্মাণের কথা শুনল তখন মাধবী মঞ্জরীরা হেসে ফেলল। তবু যদি সরস্বতীর ঘটনা না ঘটত। হাসিও পেত না। হেমাঙ্গিনী যেদিন ওদের মন্দির দেখিয়েছিল, সেদিন মন্দির গাত্রে কামার্ত নারী-পুরুষের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেনি। মঞ্জরী শুধু প্রশ্ন করে ফেলেছিল—এরা কারা? হেমাঙ্গিনী বলেছিল—দেবদেবী বা দেবদাসী নয় এটুকু নিশ্চয় বুঝেছ।
—তাহলে যাদের প্রতিমূর্তি দেবালয়ের গায়ে কেন?
-কারণ তাদের জন্যই এইসব দেবালয়, তারা দেশের সাধারণ নরনারী। তারা দেবতাও নয়, পশুও নয়। অথচ তাদের মধ্যে দেবত্ব আর পশুত্ব দুটোই রয়েছে। ঈশ্বর এই ভাবেই পৃথিবীর জীবজগতকে টিকিয়ে রেখেছেন।
সেদিন এরা হেমাঙ্গিনীর কথার মর্মার্থ অনুভব করেছিল। কিন্তু সরস্বতীর ঘটনার পরে তারা মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। সবচেয়ে অস্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে দয়াবতীর সঙ্গীত বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিও বিচলিত।
অবশেষে সব কিছুর অবসান ঘটল হেমাঙ্গিনীর আনা একটি সংবাদ। রানী সরস্বতী বিষপান করে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। একটা স্তব্ধতা নেমে আসে মন্দিরে, বোধহয় সব মন্দিরেই। রাজপ্রাসাদের এই ধরনের সংবাদ সাধারণত এতটা প্রচারিত হয় না। রানীর তো শেষ নেই। তাঁদের মধ্যে এক আধজনের দু-চার বছরের মধ্যে মৃত্যুও ঘটে। কিন্তু সাধারণত অনেকে জানতে পারে না। কিন্তু সরস্বতীর ক্ষেত্রে এটি একটি সংবাদ। কারণ সে তার রূপের জন্য আগে থেকেই নগরবাসীর মধ্যে আলোচিত।
যে মঞ্জরী সর্বদা হাস্যময়ী, সেও গম্ভীর হয়ে শ্রীমতীর কাছে এসে বলে—তোর জন্য দুর্ভাবনা হচ্ছে। তোর রূপ আর সরস্বতীর রূপের মধ্যে কোনো তারতম্য নেই। গুরুদেব তোকে আড়াল করে রেখেছিলেন বলে তুই এখনো নিরাপদে আছিস। প্রাসাদ থেকে রাজপুরুষদের কেউ প্রয়োজনে এলে তোকে সামনে রাখা হয় না। রাজপরিবারের রানীরা বিগ্রহ দর্শনে এলে তোকে লুকিয়ে ফেলা হয় বলে তোর দিকে রাজা হাত বাড়াননি। কিন্তু কতদিন?
শ্রীমতী ম্লান হেসে বলে—অসুবিধা নেই। সরস্বতী পথ দেখিয়ে গিয়েছে। তবে আমার একটা দুঃখ থেকে যাবে। অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলাম, শিখতে চেয়েছিলাম। এ জীবনে তা হবে না। সরস্বতীরও হয়তো কত ইচ্ছাই ছিল। মুদকলের সেই কৃষকের অসাধারণ রূপবতী কন্যা পারতল রাজার রানী হতে অস্বীকার করার সাহস পেয়েছিল একটি কারণে। কারণ সেই স্থানটি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল না। ওটি ছিল কোনো সুলতানের অধীনে। রূপসী পারতলের পরে কি হয়েছিল, জানা যায় না। কখনই সে সাধারণ পরিবারের গৃহবধূ হয়নি। কেউ কেউ বলে শেষপর্যন্ত সুলতানের হারেমে ঠাঁই হয়েছিল কিনা কে জানে? রূপসী নারী হয়ে জন্মানো একটা অভিশাপ। অথচ ঈশ্বর সশরীরে সম্মুখে এসে যদি জিজ্ঞাসা করেন—তুমি কি হতে চাও? সাধারণ না রূপসী? তাহলে?
মঞ্জরী বলে—তুই এত গভীরভাবে চিন্তা করিস?
.
রাজপ্রাসাদের বিশাল সীমানার মধ্যে চারহাজার নারী রয়েছে। এদের কেউ কেউ নর্তকী অন্যেরা বহনকারিনী। এরা রানীদের তাদের কাঁধে করে বহন করে। তারা রাজাকেও বহন করে। কারণ প্রাসাদ-সীমানায় অট্টালিকাগুলির মধ্যে দূরত্ব অনেকখানি। রাজার নারী কুস্তিগীর রয়েছে, নারী জ্যোতিষী রয়েছে। রয়েছে নারী ভবিষ্যদবক্তা। প্রাসাদের অভ্যন্তরের জন্য প্রতিদিন বহু অর্থব্যয় হয়। সেইসবের হিসাব যে রাখে সে-ও একজন নারী। অন্যেরা রাজ্যের সমস্ত ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ করে। সংগীত শিল্পীরা তো রয়েছেই। তারা বাদ্যযন্ত্র বাজায় ও গান গায়। রাজার রানীরাও অনেকে সংগীত বিষয়ে অভিজ্ঞ। কোনো মন্দিরে সুকণ্ঠী কোনো দেবদাসীর সন্ধান পেলে রানীরা অনতিবিলম্বে তাকে ডেকে পাঠান। এত করেও সময় তাঁদের কাটে না। এত ঐশ্বর্য অথচ মনে তৃপ্তি নেই। রানীরা যেন অন্য জগতের প্রাণী। তাঁরা যেন স্বয়ম্ভূ, তাঁদের পিতা-মাতা থাকতে নেই, ভ্রাতা-ভগিনী থাকতে নেই। তাই সরস্বতীর মতো আকস্মিক কোনো মৃত্যুও মাঝে মাঝে ঘটে যায়।
রাজা তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ একবার ছাড়া দ্বিতীয়বার ব্যবহার করেন না। একজন কর্মচারি রয়েছে যে এগুলির হিসাব রাখে। তাঁর পোশাক অতি সূক্ষ্ম রেশম দিয়ে প্রস্তুত, তাতে সোনার বুনুনি রয়েছে। রাজার শিরোভূষণে বুটির কাজ করা এবং অত্যন্ত মূল্যবান। অথচ মাথা থেকে একবার খুললে আর পরেন না।
গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি একদিন শ্রীমতীকে এইসব কথা বলতে বলতে বলেন-শক্তিশালী মুসলমান সাম্রাজ্যকে অগ্রাহ্য করে এত বড় যে হিন্দুসাম্রাজ্য পাশাপাশি গড়ে উঠল তার আয়ুষ্কাল কতদিন জানি না।
শ্রীমতী বলে—আপনার বিবরণ শুনে মনে হয়, বড় বেশি অপব্যয় হয়।
—ঐশ্বর্য থাকলে অপব্যয় হয়ে থাকে। তাকে খুব আসে যায় না। বরং এইভাবে প্রকাশ ঘটলে প্রজারা আর বহিরাগত ব্যক্তিরা মুগ্ধ হয়। প্রজারা গর্ব বোধ করে। এখনকার রাজার কিছু দোষ থাকলেও, তাঁর সময়ে এই সাম্রাজ্যের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে রাজার নিদ্রাভঙ্গ হয়। অশ্ব প্রস্তুত থাকে। সেই অশ্ব নিয়ে রাজপথ ধরে বিদ্যুৎগতিতে তিনি বহুদূর চলে যান। গ্রামের মধ্যে গিয়ে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশে তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নেন। যথাসময়ে রাজসভায় প্রবেশ করেন। দুপুরে সামান্য বিশ্রাম। পরিশ্রম না করলে কারও চেহারা অত সুন্দর হয় না।
শ্রীমতী বলে ফেলে—তবু সরস্বতীর মতো নারীর মৃত্যু ঘটে যায়।
ক্রিয়াশক্তি একটু থেমে যান। তারপর বলেন—হ্যাঁ, তাও হয়। কিন্তু কেন হয়, সেটা তোমার এই বয়সে আমি বলতে পারব না। হেমাঙ্গিনীকে বলে রাখব। দুই বছর পরে শুনে নিও।
—আমি এখনই সবকিছু বুঝতে পারি।
—জানি, তবু বলব না। বুদ্ধিমতী হলেও তোমার মন অপরিণত। তাছাড়া আর একজনকে বলে রাখব যে তোমার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে।
—কে সে? ভবানীদিদি?
–না, সে একজন তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন পুরুষ।
—পুরুষ? কোনো পুরুষ তো এখানে আসেন না। শুধু রাজার সভার কয়েকজন মাঝে মাঝে আসেন। শুনেছি সব মন্দিরই তাঁরা পরিদর্শন করেন।
গুরুদেব বলেন, তাদেরই একজন।
সেইদিন থেকে শ্রীমতী মন্দির পরিদর্শন করে যাওয়া পুরুষদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করে। এঁরা যখন আসেন তখনও গুরুদেব তাকে এবং মঞ্জরীকেও কোনো কাজের অছিলায় সরিয়ে নেন। এতে মঞ্জরীর খুব গর্ব। সে বলে—আমিও তাহলে সুন্দরী, তাই না রে?
—তুই অসুন্দর কে বলল?
—কেউ বলেনি, তবে আমার ধারণা, আমাকে দেখতে কচি কচি লাগে বলে বোধহয় সামনে আসতে দেন না।
শ্রীমতী মঞ্জরীর কথায় মনোযোগ না দিয়ে মুখগুলো একে একে মনের মধ্যে আনার চেষ্টা করে। এঁদের মধ্যে প্রবীণ ব্যক্তিও দুতিন জন রয়েছেন। শ্রীমতী তাঁদের কথা মাথায় রাখে না।
মাধবীর খুব অভিমান হয় গুরুদেবের উপর। কারণ তাকে সবার সামনে আসতে নিষেধ করেননি তিনি।
সে বলে—আমি তো কুৎসিত। তাই আমাকে ওঁদের সঙ্গে নিয়ে মন্দিরের এটা ওটা দেখাতে বলা হয়। শ্রীমতীদের লুকিয়ে রাখা হয় কেন? এঁরা তো রাজা নন।
দয়াময়ী বলে—রাজা না হলেও ওঁদের কারও কারও ওপর রাজার নির্দেশ থাকতে পারে সুন্দরীর সন্ধান তাঁকে জানাতে। সবাই চুপ করে যায়।
মুক্তি হঠাৎ মন্তব্য করে—ওদের মধ্যে কটা কটা চুলের ওই মানুষটাকে আমার খুব ভালো লাগে।
মাধবী চেঁচিয়ে ওঠে—এ্যাঁ! পছন্দ?
লজ্জায় মুক্তির মরতে ইচ্ছে করে। তবু সে আমতা আমতা করে যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করে বলে—তুই সাধারণ একটা কথার এমন বিশ্রী অর্থ করিস যে কিছুই বলা যায় না।
সবার মুচকি হাসির মধ্যে মাধবী বলে—কোন অর্থ করেছি? তুই পছন্দের কথা বললি বলে অবাক হয়েছিলাম। তুই না দেবদাসী? তোর আবার পছন্দ-অপছন্দ কি?
দয়াবতী বলে—তা থাকতেই পারে। আমার যেমন লাল গরু খুব পছন্দের।
মঞ্জরী বলে—আমার কালো গরু।
শ্রীমতী টিপ্পনি কাটে—যাঁরা আসেন তাঁরা সব তাহলে গরু।
সবাই খিল্ খিল্ করে হেসে ওঠে।
সেই সময় ভবানী ওখান দিয়ে যাচ্ছিল, একটু থেমে জিজ্ঞাসা করে—এত হাসি কিসের?
অবলা বলে—বাঁচতে হলে হাসির দরকার ভবানীদি। তাই আমরা হাসি আবিষ্কার করি।
ভবানী বলে—ঠিকই বলেছ। আরও আবিষ্কার কর। আমার সেই সব দিন চলে গিয়েছে। আমি শান্তিতেই আছি। তোমরাও শান্তি পাবে একসময়।
অবলা বলে—হ্যাঁ, সরস্বতীর মতো।
—শুধু সরস্বতী বা অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে পৃথিবী নয়।
ওরা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল না। ভবানী আজ পনীর দিয়ে কিছু করবে কথা আছে, বিরক্ত না করাই ভালো।
অবসর মতো শ্রীমতী আবার ভাবতে বসে, কে হতে পারে সেই পুরুষটি। সে মঞ্জরীকে বলে—হাসাহাসি করলেও আমরা মুক্তিকে দোষ দিতে পারি না। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে। পছন্দ হলে যে বিয়ে করতে হবে এমন কথা নেই। তাছাড়া আমরা দেবদাসী, এ কথা ভুললে চলবে না। আমি যদি তোমাকে প্রশ্ন করি, তোমার পছন্দের কোনো ব্যক্তির কথা নিশ্চয় তার উত্তর দেবে।
—দেব না কেন? পছন্দ করা মানে ভালোবাসা নয়।
–কে তোমার পছন্দের?
-আমার সব সময় রূপের দিকে ঝোঁক। কারণ আমি অতটা রূপসী না হলেও আমার মা রূপসী, বাবা রূপবান ছিলেন। এখানে যে মানুষটি সবচেয়ে রূপবান, তাঁর বয়স সামান্য বেশি হলেও আমার ভালো লাগে।
—বয়স কম-বেশির কথা আমি বলিনি।
মঞ্জরী হেসে বলে—এবারে তোর কথা শুনি।
শ্রীমতী হেসে বলে—আমি তো ছোট, আমার এসব কথা বলতে নেই। গুরুদেব রাগ করবে।
মঞ্জরী হেসে লুটিয়ে পড়ে। ছুটে অন্যদের কাছে যায়। সব দেবদাসী এসে উপস্থিত হয়। একজন বলে দেখি গাল টিপলে দুধ বেরোয় কি না? আর একজন বলে—একটু হাঁটো তো খুখু। হাঁটি হাঁটি পা-পা।
অবলা গম্ভীর হয়ে বলে—ওসব কথা থাক্। এখন তোর পছন্দের কথা বল। —আমি একজনকে দেখেছি তার দৃষ্টি অন্তর্ভেদী।
—অন্তর্ভেদী? তুই তো সামনে ছিলি না। তোর অন্তর কি করে ভেদ করল রে?
—দূর থেকেই বোঝা যায়, তোমাদের হাবভাব দেখেও বুঝেছি। আমার ধারণা, তাঁর দৃষ্টির মধ্যে একটু স্বপ্নও ছিল।
অবলার মতো রাশভারী মেয়েও মেঝেতে বসে পড়ে দুহাতে দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলে—বাবাঃ। এত বুঝে ফেললি?
—হ্যাঁ। রূপ কিংবা সোনালি চুল সাদা চোখেই দেখা যায়। কিন্তু আমার— মাধবী ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলে—তোর দেখা অন্তর দিয়ে দেখা, যেমন পার্বতী শিবের দিকে দেখেন, যেমন রাধা কৃষ্ণকে দেখেন।
শ্রীমতীর মুখ লাল হয়ে ওঠে রাগে। সে বলে—আমারই দোষ। আমি সোজাসুজি বলতে পারিনা। কেন জানি না।
দয়াবতী তার পিঠে হাত রেখে বলে—তোর কোনো দোষ নেই। আসলে তুই সবার চেয়ে একটু আলাদা।
মাধবী বলে ওঠে—তোর রূপ—
দয়াবতী বলে—না, শুধু রূপ নয়, ওর মনও। আর সেই মনের গভীরতাও বটে।
মঞ্জরী বলে—তা ঠিক। ও সব বিষয়ে চিন্তা করে।
মুক্তি বলে ওঠে—আহা, ওই মনের গভীরে যে পুরুষ ডুব দেবে, তার কী শান্তি।
দয়াবতী বলে ওঠে—না, এই প্রসঙ্গ বাদ দিতে হবে। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে দেখে আয় ভবানীদি পনীর দিয়ে কি করছে।
—উনি পছন্দ করেন না। পরিবেশন করার পর মুখে দিয়ে সবার চোখে মুখে যদি পরিতৃপ্তির রেখা ফুটে ওঠে, তাহলে ওঁর মন জুড়িয়ে যায়।
.
বিজয়নগর সাম্রাজ্যে দোষীকে খুব কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। একজন চোর যত সামান্য সামগ্রীই চুরি করুক না কেন তার একটা হাত এবং একটা পা সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলা হয়। চুরি যদি গুরুতর ধরনের হয় তাহলে তার চিবুকের নীচে বাঁকানো লোহা ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যদি কেউ কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলা বা কুমারীকে ধর্ষণ করে তার জন্যও একই শাস্তি। কোনো ভূস্বামী, সেনানায়ক উচ্চপদস্থ কোনো ব্যক্তি যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাকে জীবন্ত অবস্থায় কাঠের শূলে দেওয়া হয়। সেই শূল তার পেটের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। নিম্নস্তরের কোনো মানুষ যদি কোনো অন্যায় করে, তাহলে তাকে বাজারের মধ্যে শিরশ্চেদ করার আদেশ দেন রাজা। হত্যার অপরাধেও একই শাস্তি, যদি সেই হত্যা কোনো দ্বন্দ্বযুদ্ধে না হয়। কারণ যারা দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করে, তারা বিশেষভাবে সম্মানিত হয় এবং জীবিত ব্যক্তি মৃতের ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়। তবে মন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া কেউ দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করতে পারে না, যে অনুমতি সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায়।
অন্য ধরনের চটকদার শক্তিও রয়েছে। রাজার মর্জি অনুযায়ী অপরাধীকে হাতির নীচে ফেলে দেওয়া হয়। হাতি তার দেহটাকে পা দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
মন্দিরের দেবদাসীরা কখনো স্বচক্ষে এইসব শাস্তি প্রদান দেখেনি। শুনেই সর্বাঙ্গ হিম হয়ে যায়। তবে সমাজের নিয়ম-কানুন গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে সবিস্তারে শুনেছে। না শুনেই অনেক জিনিস তারা জানত। যেমন সমাজে ব্রাহ্মণেরা হল শ্রেষ্ঠ। তারা সৎ, তারা জীবহত্যা করে না। তাদের খাদ্য নিরামিষ। ঋজু সুঠাম চেহারা হলেও তারা খুব একটা শক্তিশালী হয় না। বুদ্ধি তাদের প্রখর। তাই তারা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত এবং তাদের তত্ত্বাবধানে রাজ্য চলে।
গুরুদেব বলেন, সহমরণ প্রথা সমাজে বহুদিন ধরে চলে আসছে।
শ্রীমতী সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন তোলে-আগে যিনি বিজয়নগরের অধিপতি ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে সমস্ত রানী সহমরণে গিয়েছিলেন?
– হ্যাঁ।
—সব?
—অবশ্যই? অবাক হচ্ছ কেন?
–আমি ভেবেছিলাম, যাঁরা যাতায়াতে শকট পান না, পদব্রজে যাওয়াই যাদের একমাত্র উপায়, তাঁরা নিষ্কৃতি পেয়েছেন।
—শ্রীমতী, নিরাশ্রয় বিধবাদের মূল্য কোথায়?
শ্রীমতী আর কিছু বলেনি। মায়ের কথা মনে পড়েছিল তার। বাবা জীবিত থাকলে মায়ের এই দশা হত না। কিন্তু মা না থাকলে তার কি দশা হত? সে বুঝতে পারে না। তবে সিদ্ধান্ত নেয় গুরুদেবের কোনো আলোচনায় প্রশ্ন তুলবে না।
সহমরণেরও অনেক নিয়ম রয়েছে, কারণ এটি খুবই সম্মানজনক তাদের পক্ষে। তাদের স্বামীদের যখন মৃত্য হয় তখন তারা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বিলাপ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ যদি অতিমাত্রায় কান্নাকাটি করে তাহলে বুঝতে হবে স্ত্রীলোকটির স্বামীর সন্ধানে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তাদের আত্মীয়স্বজনদের বিলাপ বন্ধ হলে সদ্য বিধবাটিকে বংশের সম্মান যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তার জন্য সহমরণে যেতে প্ররোচনা দিতে থাকে। মৃত ব্যক্তিকে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা দ্বারা নির্মিত এবং পুষ্পশোভিত একটি চন্দ্রাতপের নীচে শোয়ানো হয়। স্ত্রীলোকটিকে তারা একটি অকেজো অশ্বের পৃষ্ঠে চাপায়। সে অনেক অলংকারাদি সজ্জিত হয়ে গোলাপ ফুলে আবৃত হয়ে পেছনে পেছনে যায়। সে এক হাতে একটি আয়না এবং অন্য হাতে এক গুচ্ছ ফুল নেয়। তার সঙ্গে সঙ্গে যায় নানারকমের বাদ্যযন্ত্র। তার আত্মীয়স্বজনেরাও তার সঙ্গে আনন্দ করতে করতে যায়। একজন পুরুষ একটি ক্ষুদ্র ঢাক বাজাতে বাজাতে যায়। পুরুষটি গান গাইতে গাইতে বলে স্ত্রীলোকটি তার স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছে। উত্তরে সদ্য বিধবাটিও বলে, সে তাই যাচ্ছে।
শ্মশানে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত বাদকদলের সঙ্গে সে অপেক্ষা করে। স্বামীর দেহ একটি বৃহৎ গর্তে রাখা হয়। আগে থেকেই সেটি প্রস্তুত করা থাকে। সেটি কাঠ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অগ্নি সংযোগের আগে মৃতের মা কিংবা নিকট আত্মীয় এক পাত্র জল মাথায় নিয়ে এবং হাতে একটি জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে গর্তটি তিনবার প্রদক্ষিণ করে। প্রতি প্রদক্ষিণে পাত্রটিতে একটি করে ছিদ্র করে। তিনবার প্রদক্ষিণের পর পাত্রটি ভেঙে ফেলে এবং জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ডটি গর্তটিতে নিক্ষেপ করে। তারপর গর্তের কাষ্ঠগুলিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দেহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হলে স্ত্রী এগিয়ে এসে তার নিজের পদদ্বয় ধৌত করে এবং একজন ব্রাহ্মণ এগিয়ে এসে রীতি অনুযায়ী কিছু অনুষ্ঠান করেন। স্ত্রীলোকটি তার সমস্ত অলংকার খুলে ফেলে সেগুলি তার স্ত্রীলোক আত্মীয়দের মধ্যে বিতরণ করে। যদি তার পুত্র থাকে, তাহলে সেই পুত্রের প্রশংসা করে আত্মীয়দের কাছে।
অলংকার বিতরণের পর তার সব কিছুই খুলে নেওয়া হয়, এমনকি তার পরিধানের মূল্যাবান বস্ত্রও। তাকে পরিয়ে দেওয়া হয় একটি অতি সাধারণ হলুদ রঙের শাড়ি। এরপর তার আত্মীয়ারা তার একটি হাত ধরে। অন্য হাতে সে একটি গাছের ডাল নেয়। এরপর সে ছুটে গিয়ে জ্বলন্ত গর্তের কিনারায় উঁচু জায়গায় দাঁড়ায়। তখন আত্মীয়রা একটি বস্ত্রখণ্ডে কিছু চাউল বেঁধে দেয়। অন্য হাতের বস্ত্রে চিরুণী পানের ডাবর আর আয়না বেঁধে দেয়, যাতে স্বামীর পাশে গিয়ে সেগুলি সে অঙ্গসজ্জায় ব্যবহার করতে পারে। সে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাথায় একটি তৈলপাত্র রেখে আগুনে ঝাঁপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ যে সমস্ত আত্মীয়স্বজন হাতে কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তারা সেগুলি নিক্ষেপ করে তাকে তাই দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর তারা উচ্চকণ্ঠে শোক-ক্রন্দন শুরু করে।
.
সহমরণে যাওয়া যত গৌরবের হোক না কেন দেবদাসীদের কারও হৃদয় স্পর্শ করেনি। কারণ এরপর এই বিষয়টিকে তারা আলোচনার বিষয়বস্তু করেনি। শুনে যাওয়ার তাই শুনেছে। তার চেয়ে তাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় একজন বারবনিতার কথা, প্রথম যৌবনে রাজা যার প্রেমে পাগলা হয়েছিলেন সেই বারবনিতা তখনই রাজাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল যে, কোনোদিন যদি তিনি সিংহাসন লাভ করেন তাহলে তাকে রানীর মর্যাদা দিতে হবে। রাজা তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন। সেই বারবনিতা সত্যই আজ রানী। তার নামে নগরও নির্মাণ করেছেন। পদব্রজে যাতায়াতকারী রানীরা যেমন সহমরণ ছাড়া অতি সামান্য মর্যাদার অধিকারিণী তেমনি বহু রানী রয়েছেন যাঁদের সম্মান এবং সুযোগ তাদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। তাঁদের প্রত্যেকের রয়েছে পৃথক পৃথক বাসগৃহ। সেখানে রয়েছে তাঁদের নিজস্ব দাসীবৃন্দ, পরিচারিকা এবং মহিলারক্ষী। এখানে কোনো পুরুষের প্রবেশের অধিকার নেই। শুধু নপুংশকেরা যেতে পারে। কারণ তারাই তাঁদের পাহারা দেয়। এই রানীরা কোনো পুরুষকে দেখতে পান না। শুধু রাজার অনুগ্রহে কিছু উচ্চপদস্থ বৃদ্ধ ব্যক্তি তাঁদের দেখতে পারে। যখন এই সমস্ত রানী বাইরে যেতে চান তখন চারদিকে আবৃত শিবিকা তাদের বহন করে, যাতে কেউ তাদের দেখতে না পায়। তিন চারশো নপুংশক সঙ্গে যায়, সাধারণ মানুষদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই রানীদের প্রত্যেকের অনেক অর্থ, মণিমাণিক্য এবং ব্যক্তিগত অলংকার রয়েছে যেমন অনন্ত, বালা,মোতিমুক্তো, হীরা—প্রতিটিই পরিমাণমতো।
রাজা প্রাসাদের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্রভাবে থাকেন। যখন তাঁর মনে কোনো পত্নীর সান্নিধ্য লাভের বাসনা জাগে তখন কোনো নপুংশক তাঁকে ডাকতে যায়। সেই নপুংশক কিন্তু রানী যেখানে রয়েছেন সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। সে নারীরক্ষীদের মাধ্যমে রানীকে জানায়। রানী তখন রাজা যেখানে রয়েছেন সেখানে যান কিংবা রাজাই তাঁর কাছে যান। এইভাবেই দিন যায়।
অন্তঃপুরের এত সব খবর দেবদাসীরা জানতে পারে প্রাসাদের সাধারণ দাসীদের কেউ যদি মন্দিরে পূজা দিতে কিংবা হেমাঙ্গিনীর বার্তা নিয়ে কোনো দাসী এলেও রাজপরিবারে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। দেবদাসীদের সবাই গুরুদেবের আড়ালে তাদের ঘিরে ধরে। তারা বুঝতে পারে, এসব তাদের পক্ষে অনুচিত। তবু প্রবল আকর্ষণ বোধ করে। সেই সময়ে ভবানীদিদিও গুটি গুটি এসে উপস্থিত হয়। তারপর রাজপুরীর লোক চলে গেলে ভবানী সবাইকে বলে—এটা তোমাদের পক্ষে ঠিক নয়। এতে মন চঞ্চল হয়। এই কথা শুনে অবলা, এমনকি দয়াবতীও হেসে ওঠে। ভবানীদি রান্নাঘরের দিকে ছোটে। পেছনের হাসির শব্দ তাকে যেন তাড়া করে। তবে প্রাসাদ থেকে আসে যারা তাদের কাছে রাজার দৈনন্দিন জীবন যাত্রারও কিছু খবর তারা পায়। রাজা শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে অনেকখানি তিল তৈল পান করে। তারপর একজন এসে তাঁর সর্বাঙ্গে তিলতেল মর্দন করে। এরপর রাজা একজন ‘কুস্তিগীরের সঙ্গে কুস্তী লড়েন। এইভাবে তাঁর গায়ের তেল ঘাম হয়ে ঝরে পরে। তখনও সূর্য পূর্বাকাশে উঁকি দেয় না। ইতিমধ্যে রাজার বিদ্যুৎগতিতে অশ্ব চালনার কথা আগেই বলা হয়েছে। সবাই বোঝে, রাজা মানে শুধু রূপসী রানী পরিবৃত হয়ে অলস জীবনযাপন নয়। যে সব সোনালি চুলের বিদেশিরা রাজধানীতে আসে তারা কচিৎ কখনো রাজার দর্শন পেয়ে এবং তাঁর কাহিনী শুনে চমৎকৃত হয়। তারা রাজাকে শ্রদ্ধা করে তাদের প্রতি তাঁর হার্দিক ব্যবহারের জন্য। ফলে তাঁর সময়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়ে চলে এবং রাজা তাঁর পছন্দমতো তেজি অশ্বের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেন।
.
কয়েকদিন সমানে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি যেমন নেশা ধরায়, তেমনি দীর্ঘস্থায়ী হলে বিরক্তি এনে দেয়। পশুপতি মন্দিরের দেবদাসীরা দীর্ঘক্ষণ নৃত্যগীতে মগ্ন থেকেও বাইরের আকাশে কোনো বৈচিত্র্য দেখতে পেল না।
মুক্তি বলে ওঠে—ধুস্, আর ভালো লাগে না।
মাধবী ওকে বলে—তোর অনাবৃষ্টি ভালো লাগে?
অবলা বলে—ছুতো নাতায় তর্ক করতে নেই। মুক্তি খারাপ কিছু বলেনি।
—আমিও খারাপ কিছু বলিনি। আমি জানি অনাবৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হলে আরও ভয়ঙ্কর। তাতে শ্রীমতীর মতো মেয়েদের ঘর ছাড়তে হয়।
মুক্তি বলে—কিসের সঙ্গে কি। আমি জানি কোনোটাই বেশি ভালো নয়। সব কিছুর মধ্যে সমতা থাকলে ভালো লাগে। তাই বলে, দুর্ভিক্ষ হবে না? বন্যা হবে না? আসলে সবই ঈশ্বরের দান বলে মেনে নিতে হয়। তাঁর উদ্দেশ্য আমরা বুঝব কি করে?
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা বিরাজ করে।
হঠাৎ দয়াবতী বলে ওঠে—বাব্বাঃ, মুক্তি এত জ্ঞানী জানতাম না তো?
মাধবী বলে—এই একঘেয়ে বৃষ্টি মুক্তিকে জ্ঞানবতী করে তুলেছে। সে একান্তে চিন্তার অবকাশ পেয়েছে। তাই জ্ঞান বেড়েছে।
শ্রীমতী এতক্ষণে মুখ খোলে। সে বলে—তাই বোধহয় কালিদাস ‘মেঘদূত’ লিখেছিলেন।
মঞ্জরী বলে—কালিদাসের নাম কারও অজানা নয়, মেঘদূতও পরিচিত নাম কিন্তু তাতে কি লেখা রয়েছে আমরা বোধহয় কেউ জানি না।
দয়াবতী বলে—পশুপতি মন্দিরের দেবদাসী হয়ে মেঘদূত পড়ার সখ? শুনলে সবাই ছি ছি করবে। ওটা বিরহা-বিরহিনীর কাব্য। আমাদের কারও হৃদয়ে কল্পনা করেও বিরহ সৃষ্টি করা উচিত নয়। মুক্তির মনে স্বর্ণালী চুলের বিরহ রয়েছে হয়তো। ওদের মধ্যে একজনের মুখও কি ওর মনে গেঁথে নেই।
মুক্তি বলে—তাই নাকি? তবে আমিও সদ্য ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা বলি। সেদিন রাজপ্রাসাদের কাছে বাজারে আমরা সবাই তো গিয়েছিলাম। হঠাৎ একজন মানুষকে দেখলাম। বেশ দীর্ঘদেহী, সুপুরুষ কিনা জানি না। যে ভালোভাবে দেখেছে সে বলতে পারে।
মঞ্জরী বলে ওঠে—কে দেখেছে?
—জানি না, আমি অন্তত দেখিনি। তবে তার হাতে একটি বাঁশি দেখেছি। হাবভাব দেখে বোঝা যায় বাঁশি বাজানোই তার পেশা, কিংবা নেশা। যা হোক, আমি দেখলাম দয়াবতী প্রথমে তার বাঁশির দিকে চেয়ে রইল। তারপর অনেক কৌশলে তার মুখ দেখল। দয়াবতীর পুলকিত হাবভাব। তারপর এক কাণ্ড।
দয়াবতী বলে ওঠে—মিথ্যে বলবি না কখনো। বানিয়ে বানিয়ে সব বলছে।
—আমি তো শেষই করলাম না। কি করে বুঝলে বানিয়ে বলছি। দয়াবতী সবাইকে বলে—তোরা কেউ ওর কথা বিশ্বাস করিস না। অবলা বলে—সেই বিচার আমরা করব। তার আগে বাকিটুকু শুনে নেব। দয়াবতীকে রাগ করতে সাধারণত কেউ দেখেনি। কিন্তু আজ বেশ ক্রোধান্বিত। মুক্তি বলে—দয়াবতী তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে মনে হল লজ্জায় মরে যাচ্ছে। লোকটা খুবই অপ্রস্তুত। সে অপরাধীর মতো তাড়াতাড়ি সরে গেল।
দয়াবতী কাঁদতে কাঁদতে বলে—মিথ্যে কথা। আমাকে এভাবে অপমান করলি শেষে?
অবলা বলে—থাক্, এই নিয়ে আর কোনো কথা না বলাই ভালো। তোরা সবাই দয়াবতীকে ভুল বুঝিস। আসলে ও কিন্তু সাধারণ নয়। ও শিল্পী, ও ঈশ্বর-মুখী।
শ্রীমতী বলে—তুমি ঠিক বলেছ। লোকে যতই বলুক আমরা দেবদাসী। আসলে আমরা আশ্রিতা একটা সম্মান চাপানো হয়েছে আমাদের ওপর। তবে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ আমাদের শ্রদ্ধা করে দেখেছি। বিজয়নগরের অধিবাসীরা সেই সম্মান করে কি? জানি না। না জানলেও ক্ষতি নেই। কারণ আমাদের অধিকাংশের মধ্যে প্রতিভা রয়েছে সৌন্দর্য আছে, পবিত্রতা আছে। নীচতা আমাদের নেই। দেবদাসী না হয়ে সাধারণ থাকলে, আমরা অনেক কিছু হতে পারতাম। কিংবা সংসারের দারিদ্র্য গ্রাস করত।
.
গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি মাঝে মাঝে তাদের মন্দিরের আশেপাশের বনাঞ্চল দেখাতে নিয়ে যান। তিনি তাদের পথে ঘাটে যেতে দিলেও এইসব অঞ্চলে একা যেতে দেন না। বুনো হাতি তো রয়েছে। তাছাড়া অজানা আশঙ্কাও থাকতে পারে। তিনি ওদের নিয়ে যান ছোটখাটো ঝোপঝাড় চেনাতে, যার পাতা ও শিকড় থেকে রোগ নিরাময়ের জন্য নানারকম ওষুদ তৈরি করা যায়। গুরুদেবের এ বিষয়ে খ্যাতি আছে। ওদের মধ্যে শ্রীমতী এই বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যেই সে দেবদাসীদের শরীরের হেরফের হলে ভালো করে দিয়েছে। গুরুদেব শুনে একটু বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ শ্রীমতী মিশ্র ওষুধ প্রয়োগ করে। কোন গাছের সঙ্গে অন্য গাছের শিকড় বেটে ওষুধ দেয়। সে এ ওষুধ মন্দিরের আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকেই পেয়ে যায়। একদিন সূর্যোদয়ের একটু পরেই সে একা গিয়েছিল একটা শিকড়ের সন্ধানে। ওষুধটি একজন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির। সে মনুষ্যচক্ষুর আড়ালে বাড়িতে বসে থাকে। এক নারী তার দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছিল, তাই তার চিবুকে একটি লোহার বালা ঝোলে। তার স্ত্রী এসেছিল গুরুদেবের কাছে। তার স্বামীর পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। আগে মাসে এক আধবার হত, এখন মাঝে মাঝেই হচ্ছে। গুরুদেবের কাছে যখন রোগীরা আসে তাঁর সঙ্গে শুধু শ্রীমতী থাকে। তিনি স্ত্রীলোকটির কথা শুনে বলেন—ওকে না দেখলে তো ওষুধ দিতে পারব না। রোগের লক্ষণ জানতে ওর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
-ও তো আসতে পারবে না।
–তাহলে চিকিৎসা হবে না।
স্ত্রীলোকটি কেঁদে ওঠে।
গুরুদেব বলেন—সে কি সত্যই জঘন্য অপরাধী?
–ঠাকুর, সে সব অনেক কথা। আমার তাড়াতাড়ি ওষুধের দরকার। ওর যন্ত্রণা দুচোখে দেখা যায় না।
—তাই তো। দেখা দরকার।
শ্রীমতী বাল–গুরুদেব আমার একটা প্রার্থনা রয়েছে।
জিজ্ঞাসু নেত্রে উনি শ্রীমতীর দিকে তাকান।
—আমি গিয়ে রোগীকে দেখব?
গুরুদেবের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে—তুমি!
—হ্যাঁ, ঠাকুর। এই স্ত্রীলোকটির বয়স দেখছেন, মাঝবয়সী। এর স্বামী নিশ্চয় আরও বয়স। অনেক দিনের ঘটনা বলে মনে হয়। শাস্তি তো ওর হয়ে গিয়েছে। রাজা কি বলেছেন ওকে একঘরে করতে? ওর রোগ হলে কি চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারবে না? আমি অবগুণ্ঠিতা হয়ে যাব। আপনি আমার প্রার্থনা পূরণ করুন। আপনি আমার গুরু, চিকিৎসা শাস্ত্রেও তাই।
গুরুদেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে শ্রীমতীকে বলেন—তুমি ঠিক বলেছ। আমি সাধারণ ধারণার বশীভূত হয়ে পড়েছিলাম। আজকাল এমন বিভ্রম হচ্ছে দেখছি।
পরে স্ত্রীলোকটিকে প্রশ্ন করেন—তোমার বাড়ি কতদূরে?
—বেশিদূর নয়। এঁর কোনো বিপদ হবে না।
গুরুদেব অনুমতি দিলেন। আর শ্রীমতী গুরুদেবের পা জড়িয়ে ধরল।
-একি করছ শ্রীমতী?
—প্রতিক্ষণে আমি আপনাকে নতুন করে চিনতে পারি বাবা।
মধ্যবয়স্কা স্ত্রীলোকটির চোখে জল। সে দূর থেকে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। পথে নেমেই স্ত্রীলোকটি বলে-আপনি দেখতেও দেবীর মতো, মনও তেমন। আপনি আমার স্বামীকে ঘৃণা করেননি। অথচ আমি আপনাকে প্রত্যাশাও করিনি। আমি আপনাকে প্রথম দেখলাম। তবু আপনি সাগ্রহে একজন ঘৃণিত মানুষকে দেখতে যাচ্ছেন।
–আমি তো ব্যক্তিটি ঘৃণিত কিংবা শ্রদ্ধেয় কিনা তার বিচার করতে যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি, তার রোগের নিরাময় করতে, পারি কিনা চেষ্টা করতে। এতে আমার স্বার্থই বেশি। আর যদি তাঁকে সুস্থ করতে পারি তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন। আমার আনন্দও কম হবে না।
স্থানটি মনোরম কিন্তু কুটিরটি ছন্নছাড়া। শ্রীমতী লক্ষ্য করে আগে যেকটি কুটির রয়েছে যাদের প্রতিবেশী বলা যায় তারা কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দেখে তাকে।
–তোমার পড়শিরা আসে না?
—আসে, তারা সাহায্যও করে। তারা ওর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়।
—তারা ঘৃণা করে না?
–না, তারা ওকে শৈশব থেকে চেনে।
—তাহলে?
–ও অন্যায় করেনি, ভুল করেছিল।
—কি ভুল?
—আমাদের বিয়ের পরই সেই বছর ছিল নববর্ষের উৎসব। রাস্তায় ও ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল। একজন সম্ভ্রান্ত গৃহবধূ তার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তার পরনের পরিধেয় বস্ত্র ছিল অসাধারণ। ওর ইচ্ছা হল, অমন একটি আমার জন্য কিনে দেবে। ও ভাবল ওটি যদি রেশমের তৈরি হয় তাহলে হয়তো আমাকে কিনে দিতে পারবে না। মহিলার ওড়নার প্রান্ত হাওয়ায় উড়ছিল, আমার স্বামী হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখতে গিয়েছিল ওটা রেশমের কিনা।
—রেশম তো দেখলেই মোটামুটি বোঝা যায়।
—ওর কোনো ধারণা ছিল না। একথা ওর পরিচিতেরা বিশ্বাস করে, কিন্তু সাধারণ কেউ বিশ্বাস করবে না। ও শৈশবে মাতৃহীন। জীবনে একমাত্র নারী আমি। সেই নারী চিৎকার করে ওঠেন, ওঁর ওড়নায় হাত দেওয়া মাত্র। তারপর যা হওয়ার হয়ে গেল। শাস্তি পেয়ে ও কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল। একদিন বন্ধুরা ওকে ধরে আমার কাছে নিয়ে এল।
শ্রীমতী কুটিরে প্রবেশ করতে একজন জীর্ণশীর্ণ প্রায়-বৃদ্ধ ব্যক্তি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শ্রীমতীর দিকে চেয়ে বলে উঠল—আপনি ভুলে চলে এসেছেন। আমায় দোষ দেবেন না। সত্যি আপনি এই ঘরে ঢুকছেন আমি জানতাম না।
ওর স্ত্রী বলে—আমি ওঁকে এনেছি। তোমার কোনো দোষ নেই।
-কেন এনেছ। এই বালা ঝুলছে, বলনি সে কথা?
—বলেছি।
—আমি কিন্তু কিছু জানি না, আপনি বিশ্বাস করুন।
শ্রীমতী তার অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়। লোকটি তার মুখের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে—আপনি দেবী। স্বর্গ থেকে এসেছেন। আমার খুব যন্ত্রণা। আপনি ভালো করে দিন দেবী।
লজ্জিত শ্রীমতী বলে—আমি দেবী নই। অতি সাধারণ একজন মানবী। তবে আপনার চিকিৎসার জন্যই এসেছি। আমার গুরুদেবের নাম আপনি নিশ্চয় শুনেছেন।
—তাঁকে সবাই চেনে।
—তিনি আমাকে চিকিৎসাবিদ্যা শেখান।
শ্রীমতী তাকে ভালোভাবে দেখে। তার জন্য তার গায়ে হাত দিতে হয়। সে ছিটকে সরে যায়।
—অমন করবেন না।
শ্রীমতী দুটো গাছের শিকড় দিয়ে স্ত্রীলোকটিকে বলেন—এটি ভালোভাবে বেটে তুলসীর রস আর মধু দিয়ে দিনে তিনবার খাওয়াতে হবে। দশদিন পরে আমাকে জানালে ভালো হয়।
—জানাব। আপনি দয়া করে এসেছেন, এটাই সৌভাগ্য।
–না না, আমি এমন কিছু জানি না। তবে আমার গুরুদেবের তুলনা নেই। আমি তাঁর সঙ্গে আপনার উপসর্গ নিয়ে পরামর্শ করতে পারব।
স্ত্রীলোকটি শ্রীমতীকে বাইরে নিয়ে এলে শ্রীমতী তার স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করে।
সে বলে—স্বামীর নাম তো নিতে নেই। পশুপতিনাথের বাস যে পর্বতে, সেই স্থানেরই নাম।
শ্রীমতী হেসে বলে—বুঝেছি কৈলাস।
—হ্যাঁ।
—কুটিরে শুধু তোমাদের দু’জনকে দেখলাম, সন্তান নেই?
স্ত্রীলোকটি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। বলে—সেই ভয়ঙ্কর দিনের আর কদিন আগেই বা বিয়ে হয়েছিল। ও আমাকে পাগল করে দিত। কিন্তু সেদিনের পর থেকে স্পর্শ করে না।
—স্পর্শ করেন না মানে?
-ভালোবাসার স্পর্শ। ও ভয় পায়। একটা অনাগ্রহ এসে গিয়েছে। বেঁচে কি লাভ আমার বলুন। সন্তানহীনা এক নারী, যে স্বাীমীর নিবিড় স্পর্শ থেকেও বঞ্চিত। শ্রীমতী ভাবে, সংসার সম্বন্ধে সে কতটুকু জানে? এত যে কুটির দেখতে পায় তারা, সেগুলোর ভেতরে কত শোক-দুঃখের ইতিহাস নীরবে রচিত হচ্ছে, কে খোঁজ রাখে? তার মধ্যে যতটুকু আশা-আনন্দ তাই আঁকড়ে রেখে মানুষ বাঁচে, স্বপ্ন দেখে।
.
কৈলাস সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি বুঝতে পারেন শ্রীমতী অসাধারণ প্রতিভাময়ী। তিনি তাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন। সেই সঙ্গে বুঝতে পারেন দু-এক বছরের মধ্যেই তিনি অশক্ত হয়ে পড়বেন। মন্দিরের দায়িত্ব কাকে দেবেন? দিলে শীঘ্রই ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই ব্রাহ্মণ যে জিতেন্দ্রিয়? সরস্বতী মন্দিরে দুজন ব্রহ্মচারী পুরোহিত রয়েছেন তিনি জানেন। রাজাকে অনুরোধ করতে হবে, তাঁদের একজনকে পশুপতি মন্দিরের ভার দিতে। তার আগে শ্রীমতীদের এবং দু-একজনকে দেবদাসীত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া। কিন্তু কি করে? যাদের কথা ভাবেন, তারা কি আদৌ সম্মত হবে দেবদাসীদের গ্রহণ করতে? তিনি নিজে অনুরোধ করলে কি তারা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে? এ পর্যন্ত কোনো বিষয়ে তেমন ঘটেনি। কিন্তু বিবাহের বিষয়ে পারিবারিক সম্মতিও প্রয়োজন রয়েছে। পশুপতি কি করবেন জানা নেই। নববর্ষ আসতে আর আটমাস বাকি রয়েছে। সেই মহোৎসব এবং মহাভোজের রাতে রাজ্যের সমস্ত নর্তকীদের উপস্থিতি অবশ্য পালনীয়। পশুপতি মন্দিরের পুরোহিত রাজার এই নির্দেশকে গোপনে অগ্রাহ্য করেছেন। দেবদাসীরাও সবাই জানে। নগরীতে খবর রটেছে যে সব মন্দিরের সব দেবদাসী এই বৃহৎ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে না। কথাটা শুনে ক্রিয়াশক্তির মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্নমানুষও বিচলিত না হলেও, জানেন একটু বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন। তিনি নিজের গুরুদেবকে স্মরণ করেন। তিনি দেখা দিয়েছিলেন ত্রিশ বছর পূর্বে কুম্ভমেলায়। বলেছিলেন, সিদ্ধপুরুষদের মধ্যেও অহংভাব আসতে পারে, সাবধান। পারিস তো সমাজের কল্যাণ করে যাস। এরপর আর দেখা হয়নি পরমহংসের সঙ্গে। এখন তিনি সমাজের কাজেই উদ্যোগী হয়েছেন।
ক্রিয়াশক্তি মাঝে মাঝে শ্রীমতীকে নিয়ে আশেপাশে অসুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে যান। তিনি সর্বত্র যেতেন না। কিন্তু শ্রীমতীর দ্বারা কৈলাসের নিরাময়ের পরে তিনি সর্বত্রই যাওয়ার চেষ্টা করেন। শ্রীমতীর সঙ্গে মঞ্জরী মাধবীদেরও কেউ কেউ থাকে।
দূর থেকে একটা কুটির দেখিয়ে শ্রীমতী গুরুদেবকে বলে—ওই যে কৈলাসের কুটির।
—সুন্দর দেখতে তো!
—এমন ছিল না। তখন তো কাজ করতে পারত না।
—হু। তুমি ওদের সংসারে শান্তি এনে দিয়েছ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করবেন। শ্রীমতী মনে মনে ভাবে, শান্তি তো সম্পূর্ণ আসেনি।
সেইসময় কৈলাসের স্ত্রী তাদের দেখতে পেয়ে ছুটতে ছুটতে আসে। ক্রিয়াশক্তি উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন—মেয়েটা পড়ে যাবে যে।
–আমাদের দেখে আনন্দ হয়েছে। ভাবতে পারেনি এদিকে আসব। মঞ্জরীর চোখে বিস্ময়
কৈলাসের স্ত্রী একটু দূর থেকে গুরুদেবকে নত হয়ে প্রণাম করে। তারপর শ্রীমতীকে ডাকে। মঞ্জরীও শ্রীমতীর সঙ্গে যায়। কিছুক্ষণ কথা বলার পরে কৈলাসের স্ত্রীর নিকট থেকে শ্রীমতী যখন ফিরে এল, তখন তার সারা মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। মঞ্জরীর মুখেও সেই আনন্দ প্রতিবিম্বিত।
ক্রিয়াশক্তি বলেন—এত আনন্দ কিসের?
শ্রীমতী গুরুদেবের মুখের দিকে চেয়ে বলে—জীবনে প্রথম এই স্ত্রীলোকটি সন্তান-সম্ভবা।
স্তম্ভিত দুই দেবদাসী চেয়ে দেখে গুরুদেবের দুই চোখ অশ্রুসিক্ত। তিনি শ্রীমতীর মাথায় হাত রেখে বলেন—একজন অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করেই তুমি আমার সারা জীবনের সাফল্যকে অতিক্রম করেছ। আমি কোনো ব্যক্তির চিকিৎসা করে একটি সংসারের পরিপূর্ণতা এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারিনি।
—গুরুদেব সবই আপনার দান।
–না না, একথা বলো না শ্রীমতী। ঈশ্বর তোমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আমি সেই মহাশক্তির সামান্য পূজারী মাত্র। যদি তোমাকে আমি সার্থকভাবে রক্ষা করতে পারি সেটাই হবে যথেষ্ট।
সেই সময় আঁকাবাঁকা পথের আড়াল থেকে কয়েকজন পুরুষকে তারা আসতে দেখে। ক্রিয়াশক্তি তাদের দেখে বিস্মিত হন। শ্রীমতীরাও দ্বিধাগ্রস্ত। এদের দেখলে বোঝা যায়, একেবারে সাধারণ মানুষ নয়। চেহারা আর পোশাক পরিচ্ছদে এদের পরিচয় মেলে। দু’জন প্রবীণ এবং দুজন নবীন। তারা ক্রিয়াশক্তিকে দেখে বিস্মিত না হলেও, প্রত্যাশা করেনি বলে মনে হল। পথের উপরেই তারা গুরুদেবের পদধূলি গ্রহণ করে।
একজন হেসে বলে—ভালোই হল, দেবদর্শন হয়ে যাবে।
—কোথায় যাচ্ছিলে?
যে ব্যক্তিটি তরুণ, সংকুচিত কণ্ঠে সে বলে—তেমন নির্দিষ্ট কোথাও নয়। ওঁদের অভিযোগ, আমি নাকি রাজকার্যে মন দিই না। শুধু পাহাড়-পর্বত বনাঞ্চল আর মানুষের মন নিয়ে ব্যস্ত থাকি।
গুরুদেব বলেন—সে তো উত্তম কাজ।
তরুণ অন্যদের দিকে চেয়ে সরলভাবে হাসে। তারাও হাসে। একজন বলে—ঠাকুর এ পরিশ্রমে বিমুখ।
—মনে তো হয় না। কদিন আগেই দেখলাম এক ক্ষিপ্ত ষণ্ডের শিং ধরে ভিড় থেকে দূরে ঘুরিয়ে দিল। পরিশ্রম বিমুখ হলে এড়িয়ে যেত। কয়েকজন আহত হত।
সবাই হেসে ওঠে। একজন বলে–আপনার সাক্ষ্যে ও বেঁচে গেল। কিন্তু সত্যিই ও মাটিতে পা ফেলে চলে না।
এবারে গুরুদেবেরও মুখে পবিত্র হাসি ফুটে উঠল। বললেন—এক আধজন এমন থাকা ভালোই। বৈচিত্র্যের স্বাদ মেলে। সবাই হেসে ওঠে।
এদিকে শ্রীমতী এবং মঞ্জরী স্থানুর মতো পথের ধারে দাঁড়িয়ে। আবহাওয়া চমৎকার, অথচ শ্রীমতীর মুখমণ্ডল ঘর্মাক্ত। যে পুরুষটিকে আড়াল থেকে মন্দিরে দেখেছিল আজ তাকে ভালোভাবে দেখল। তাকে নিয়েই আলোচনা। ষাঁড়ের শিং ধরে যে ঘুরিয়ে দিতে পারে সে যথেষ্ট বলশালী। অথচ তাকে কেন্দ্র করেই অভিযোগের কৌতুক।
মঞ্জরী লক্ষ্য করে তরুণটি শ্রীমতীর রূপ দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। তারপর থেকে স্বাভাবিক।
গুরুদেব বলেন—এরা এই মন্দিরের দেবদাসী।
একজন প্রবীণ বলে—তেমনই অনুমান করেছিলাম।
মঞ্জরী সহসা ভীত হয়ে পড়ে। ভাবে, এঁরা যদি শ্রীমতীর কথা রাজার কানে তোলেন? সে আতঙ্কিত চোখে শ্রীমতীর দিকে চায়। দেখে শ্ৰীমতী অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেও বোধহয় আতঙ্কিত। কিন্তু গুরুদেবকে স্বাভাবিক বলে মনে হল।
তিনি বলেন—কিন্তু দেবদাসী হলেই সবার ক্ষেত্রে পরিচয় শেষ হয়ে যায় না। তুমি অমরু তসি এই সাম্রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ। কিন্তু তাতেই কি তোমার পরিচয় শেষ হয়ে গেল? এটুকু কেউ জানলে তোমার কিছুই সে জানল না।
সবাই ঘাড় হেলিয়ে সায় দেয়। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলে—সে তো দেখলেই বোঝা যায়। এঁর রূপ অসাধারণ, সচরাচর দেখা যায় না।
গুরুদেব বলেন—সেটাই আমার চিন্তা। ভাগ্যের পরিহাস বলতে হবে যে আমি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েও একজন সংসারী ব্যক্তির মতো এদের দু-একজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। তোমরা সবাই আমার স্নেহাস্পদ। কিন্তু তার আগে সব কথা শেষ করি। তাছাড়া এদের সামনে এভাবে বলা বিসদৃশ। তাই আমি তোমাদের বলি; নারীর রূপ চিরস্থায়ী নয়। যৌবন অতিক্রান্ত হলে সেই রূপ অস্তমিত হতে থাকে। কিন্তু গুণ? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গুণ আজীবন স্থায়ী হয়। এ অসামান্য গুণবতী। এ যখন কিশোরী ছিল, এর মা দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চল থেকে মেয়ের হাত ধরে এসে একে আমার হাতে সমর্পণ করেছিলেন।
গুরুদেব সহসা থেমে যান। ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মঞ্জরীর মস্তক স্পর্শ করে বলেন—আমি জানি তুমি শ্রীমতীকে ভালোবাস। তাই তোমার সামনেই ওর প্রশংসা করেছি।
মঞ্জরী নিম্নস্বরে বলে—আমার খুব গর্ব হচ্ছে গুরুদেব। আপনি আরও বলুন। সব গুণের কথা বলুন। আমি সবসময় ওর কাছে থেকেও ওকে চিনতে পারি না। আপনি বলুন, আমি শুনি।
—তুমি অসাধারণ। তবে আমি বুঝতে পারছি, তোমাদের দুজনের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তোমরা বরং মন্দিরে ফিরে যাও। এদের সঙ্গে কথা বলে আমি ফিরব। শ্রীমতীকে বলে দিও এরা রাজাকে কিন্তু বলবে না। কোনো ভয় নেই।
শ্রীমতীর যেন ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। তবু ফিরতে হল। সেই সময় অমরুকে লুকিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। অমরুও ঠিক একই সময় তার দিকে চেয়েছিল। সেই দৃষ্টির মধ্যে কোনো লুকোচুরি ছিল না, কিন্তু মুগ্ধতা ছিল, অন্তত শ্রীমতীর মনে হল।
সম্ভবত ভালোভাবে দেখার অবকাশ পায়নি সে। তার মনের মধ্যে অমরু নামটা বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল। কেমন যেন চেনাচেনা।
মঞ্জরীও তখন নিজের চিন্তায় বিভোর। সেই সুন্দর তরুণটি যে তার দিকে কয়েকবার চেয়েছেন তার মনের মধ্যে খচখচ্ করছে। সে পাপচিন্তা করছে। উচিত হচ্ছে না। সে তো দেবদাসী। পশুপতি দেব তার সব।
—শ্ৰীমতী।
মঞ্জরীর ডাকে শ্রীমতী অবাক হয়। মনে হয় আর এক অপরিচিতা মঞ্জরী তাকে ডাকছে। কোনো উচ্ছ্বাস নেই, বরং দুঃখভারাক্রান্ত।
—কি বলছ?
—আমার মধ্যে বোধহয় পাপ ঢুকেছে।
– কেন?
বারবার একটা চিন্তা আসছে। আমি দেবদাসী। অমন চিন্তা আমার মনে আসা উচিত নয়।
—কোন চিন্তা?
–তোকে আমি সব বলি। না বলে আর পারছি না। ওই অতীশ নামে মানুষটির কথা ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে আসছে। আমাকে উনি বারবার দেখছিলেন।
শ্রীমতী বলে—তাতে কি হয়েছে? শুধু একটা ভয়, এঁরা রাজার কাছে আমাদের কথা বলবেন কিনা।
মঞ্জরী বলে—গুরুদেব তোকে বলতে বলেছেন যে ওঁরা রাজার কাছে আমাদের কথা বলবেন না।
—সত্যি?
—হ্যাঁ।
শ্রীমতীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে যেন একজন সমব্যথী পেয়েছে। যেভাবেই হোক তার মনের অবস্থার সঙ্গে মঞ্জরীর মানসিক অবস্থার কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে।
—তুই হাসছিস?
—কিছু মনে করো না। এই হাসি আসল হাসি নয়। আমিও যে নারী, তার ওপর তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গিনী।
রাতে ভবানীদিদি এসে বলে—গুরুদেব তোমাদের ডাকছেন।
মঞ্জরী চমকে ওঠে—আমাকেও।
—হ্যাঁ। তোমাদের দু’জনকেই।
–ভবানীদিদি, এই সময়ে তো উনি ডাকেন না।
–আমিও তাই জানতাম। কিন্তু ডাকছেন যখন নিশ্চয় কোনো কারণ রয়েছে।
মঞ্জরী ভবানীদির সামনেই কেঁদে ফেলে।
—কাঁদছ কেন? গুরুদেব ডাকছেন। তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
—পাচ্ছি তো। সেইজন্যেই কাঁদছি। আমার আশ্রয় বোধহয় হারালাম।
ভবানীদি ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে—পাগলামী কোরো না। এতো খুব আনন্দের। গুরুদেব তোমাদের দু’জনের কথা নিশ্চয় বেশি করে ভাবছেন।
গুরুদেবের কক্ষে উঁচুতে একটি মাত্র বাতায়ন, তারই নীচে একটি অতি সাধারণ ভূমিশয্যা। তার পাশে একটি মৃগচর্মের আসন। নিজের গৃহে থাকলে এ আসনে তিনি অধিকাংশ সময়ে যোগাসনে বসে থাকেন। ওখানেই তাঁর চক্ষুদ্বয় নিমীলিত থাকে অধিকাংশ সময়। তবে কথাবার্তা ওখানে বসেই বলেন। এই কক্ষে থাকলে ভূমিশয্যায় নিদ্রা খুবই কমই যান। সবাই জানে তিনি সাধনায় মগ্ন থাকতেই চান ৷ ইচ্ছাও তাই। তবে পিতৃ আদেশে কর্তব্য করছেন। পিতা প্রথম জীবনেই চলে গিয়েছিলেন। শিশুপুত্রের মাকে বলেছিলেন, তাঁর ইচ্ছার কথা। ক্রিয়াশক্তি পিতৃ আজ্ঞা পালন করে চলেছেন। পিতার আশীর্বাদেই গুরুদেব পরমহংসের সাক্ষাৎ মেলে।
গুরুদেব তাই আসনের অদূরে তাদের বসতে বললেন। ওরা প্রতীক্ষা করে। তিনি একটু পরে বলেন—শ্রীমতী, তোমার মধ্যে ঈশ্বর রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা দিয়েছেন। সঠিক ঔষধ নির্বাচন করতে হলে রুগ্ন ব্যক্তিকে বিন্দুমাত্র ঘৃণা করলে চলে না। তার প্রতি মমত্ববোধ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাছাড়া অতি সূক্ষ্ম অনুভূতিও থাকতে হয়। তোমার সব গুণই রয়েছে। আর মঞ্জরীকে ডেকেছি তোমাকে সহায়তা করতে। আমি লক্ষ্য করেছি, তোমাদের দুজনার মধ্যে প্রগাঢ় হৃদ্যতা রয়েছে যা সচরাচর চোখে দেখা যায় না। মঞ্জরী, তুমি হবে সেবিকা। রুগ্ন ব্যক্তি পুরুষ কিংবা নারী যে বয়সেরই হোক না কেন, তাকে সন্তানবৎ ভাবতে হবে। সেবিকার মন হবে সন্ন্যাসিনীর মতো। নিজের রুগ্ন স্বামীকেও সেই চোখে দেখা উচিত। তবে সাধারণ অসুখ-বিসুখের কথা বলছি না। সেখানে পুরুষ পুরুষই, নারী নারীই এবং শিশুরা তো সবসময়েই শিশু। আমি শুধু গুরুতর অসুখ কিংবা আপাত দৃষ্টিতে মৃত্যুপথগামী ব্যক্তিদের কথা বলছি।
মঞ্জরী বলে ওঠে—গুরুদেব এ সৌভাগ্য আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। আমার শিশু ভাইটি অসুস্থ হলে তার শুশ্রূষা আমিই করতাম। মা সেই সময় ছিলেন রুগ্ন। তাঁর সেবাও আমি করতাম। প্রাণ ঢেলে করতাম।
-খুব ভালো হয়েছে তাহলে।
–কিন্তু আমরা যে দেবদাসী।
—হ্যাঁ, দেবদাসী বটে। দেখি কি করতে পারি। তোমরা দুজনে পরশুদিন আমার সঙ্গে যাবে প্রত্যুষে। কাল আমি একবার রাজসভায় যাব।
ওরা দুজনা নিজেদের ঘরে চলে আসে। কিন্তু মনে উত্তেজনা থাকলেও অনেক কথা বলার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন নৃত্যগীত শিক্ষাকালে, তারা দু’জনে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা নীরবতা বিরাজ করে। সবার দৃষ্টি তাদের দু’জনার দিকে নিবদ্ধ।
মঞ্জরী বলে—কি হল তোদের। আমরা দুজনা কি অস্পৃশ্য? অবলা দি, তুমিও ওদের দলে?
অবলা বলে–কেউ কারও দলে নয়। দেবদাসীদের আবার দল। তাদের জাতও নেই। ব্রাহ্মণ হোস্ কিংবা যা-ই হোস, তোরা দেবদাসী।
মঞ্জরী বলে—ঠিকই তো।
মাধবী বলে—তবু একটা পার্থক্য তো রয়েইছে। তোরা গুরুদেবের সঙ্গে ঘুরিস, তিনি তোদের ডেকে পাঠান।
—হ্যাঁ। কালও আমরা তাঁর সঙ্গে যাব।
দয়াবতী বলে—তবে? এ তো সঙ্গীত নয় যে আমার খাতির বেশি। আমার এতে আনন্দই হচ্ছে। বিগ্রহের দিকে চাইলে যেমন আনন্দ হয় তেমনি।
-সংগীত নয়, এটা চিকিৎসা আর সেবা। দেবদাসীর কখনো কখনো রুগ্নব্যক্তির সেবাদাসী হতে হলে দয়াবতীর যেমন আনন্দ হয়-
দয়াবতী নিমেষে মঞ্জরীর পাশে উঠে গিয়ে, তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—প্রাণের কথা বলেছিস। এর চেয়ে ভালো কিছু আছে নাকি? আমাদের শুধু গোপনীয়তা ভালো লাগছিল না। এবারে তোদের জন্যে গর্ব হচ্ছে।
সেই সময় গুরুদেব সেখানে উপস্থিত হন। ওরা নিমেষে চুপ করে যায়। গুরুদেব বলেন—আমি রাজসভায় যাচ্ছি, তোমরা দয়াবতীর কথামতো চলবে। ভবানীও তোমাদের অনেক সাহায্য করবে।
ওরা বুঝতে পারে না, গুরুদেব এসব কথা বলছেন কেন। তিনি কি কোনো কারণে বিচলিত? তাঁর মতো সংযমী পুরুষ কখনো বিচলিত হতে পারেন না। হয়তো অন্য কোনো চিন্তা করছেন।
রাজসভায় যাওয়ার সময় গুরুদেব বলেন—আমি এই সভাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবি। তোমরা জান না, বিজয়নগর সাম্রাজ্য কত বড়, এমনকি এই নগরীও কত বিশাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ তোমাদের সেই ধারণা নেই। কারণ তোমরা অন্য কোনো নগর দেখনি। যে সব বিদেশি এখানে আসে তারা নিশ্চয় বুঝতে পারে।
.
এক বিদেশি পর্যটকের চোখে : বিজয়নগর নগরী পর পর সুদৃঢ় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের ভিতরে সুরক্ষিত আশ্রয়স্থলও রয়েছে। এই প্রাচীরের অনেক জায়গায় জলপূর্ণ পরিখা রয়েছে। অন্য ধরনের সুরক্ষায় ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রথম প্রাচীর থেকে নগরীর দূরত্ব অনেকখানি। এর মধ্যে কত ক্ষেত পড়বে, যেখানে নগরবাসী ধান বোনে, কত বাগান আর ঝিল, যে ঝিল দুইটির জলধার থেকে আসে। এই জল প্রথম সারির বেষ্টনীর মধ্যে দিয়ে আসে। এখন বসন্তকাল বলে জলাধারে প্রচুর জল রয়েছে। রয়েছে ফলের বাগিচা আর তাল-খেজুরের কুঞ্জ। তাছাড়া রয়েছে অনেক বসতবাটি।
ক্ষুদ্র জলাশয়ের পাশ দিয়ে প্রবেশের আগে দুটি বুরুজ। ভেতরে গেলেই দেখা যায় দুই দিকে দুটি মন্দির। তার একটি প্রাচীরবেষ্টিত এবং বৃক্ষসমাচ্ছন্ন। তারপর সুন্দর সুন্দর শ্রেণীবদ্ধ আবাসগৃহ। এগুলি সবই সেনানায়ক, ধনী এবং সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গের। এইসব গৃহ অনেক মূর্তি সজ্জিত এবং নানারকম নয়নমুগ্ধকর অঙ্কনে শোভিত। আসল রাজপথ দিয়ে চলতে চলতে আপনি এসে পৌঁছোবেন প্রধান প্রবেশদ্বারগুলির একটিতে। সেটি পার হলেই রাজপ্রাসাদের সম্মুখে বিশাল একটি উন্মুক্ত চত্বর। এর বিপরীত দিকে আর একটি দ্বার, যেখান দিয়ে নগরীর অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যায় ৷ এই উন্মুক্ত স্থান দিয়ে সমস্ত যানবাহন, মালপত্র এবং সবকিছু আসে, কারণ নগরীর কেন্দ্রস্থল বলে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এই বেষ্টিত স্থানটির আয়তন লিস্বনের যাবতীয় দুর্গের আয়তনের চেয়েও বেশি।
আরও অগ্রসর হলে দুটি মন্দিরকে যুক্ত দেখা যাবে। এর একটির দ্বারদেশে প্রতিদিন বহু মেষ বলি দেওয়া হয়। কারণ নগরীর অন্য কোথাও মেষ বলি হয় না, বিক্রিও হয় না। মন্দিরের বিগ্রহকে মেষের রক্ত সমর্পণ করা হয়। মুণ্ডগুলি বিগ্রহের পাশে রেখে দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি মেষের জন্য তারা একটি করে চক্রম্ (মুদ্রা বিশেষ) প্রদান করে।
বলিদানের সময় একজন যোগী (পুরোহিত) উপস্থিত থাকেন। তাঁর ওপরই মন্দিরের ভার। বলিদান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগী শিঙা বাজান। বিগ্ৰহ যে বলিদান গ্রহণ করেছেন এটি তারই সংকেত।
মন্দিরের নিকটে রয়েছে একটি বিজয়রথ যেটি নানা মূর্তি ও শিল্পকার্য খোদিত। বছরের বিশেষ একদিনে তারা এটিকে টেনে নগরের পথে নিয়ে যায়। যেসব রাস্তায় এটি আড়াআড়িভাবে যেতে পারে সেই সব রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ এটি এতবড় সে এটিকে কোণার দিকে ঘোরানো যায় না। আরও অগ্রসর হলে প্রশস্ত এবং সুন্দর রাস্তা দেখা যাবে। যার ওপর সুন্দর সুন্দর সব বাড়ি রয়েছে। ধরে নিতে হবে এই সমস্ত অট্টালিকা ধনী ব্যক্তিদের। যাদের এমন রাস্তায় থাকার ক্ষমতা রয়েছে। এই রাস্তায় বহু বণিকের বাস। এখানে আপনি মণিমাণিক্য, হীরা, জহরৎ মোতি মুক্তা, পোশাক পরিচ্ছদ, এবং পৃথিবীতে প্রাপ্ত যাবতীয় সামগ্ৰী ইচ্ছা করলে কিনতে পারেন। প্রত্যেকদিন বিকালে এখানে মেলা বসে যেখানে অশ্ব, টাট্টু ঘোড়া ছাড়াও লেবু, কমলালেবু, আঙুর এবং বাগানের সব রকম সবজী, কাঠ ইত্যাদি সবই মেলে। একটি সড়ক রয়েছে যেখানে শুধু কারিকর ও শ্রমশিল্পীরা রয়েছে। তারা নানা ধরনের দ্রব্য বিক্রি করে। এখানকার প্রতিটি রাস্তাতেই মন্দির রয়েছে, কারণ এগুলি আমাদের দেশের মতো ধর্মসংক্রান্ত ভ্রাতৃসংঘ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু সবচেয়ে প্রধান এবং বৃহত্তম দেবালয়টি নগরীর বাইরে অবস্থিত। প্রতি শুক্রবার এখানে হাট বসে, যেখানে প্রচুর শূয়োর, মুরগী, সামুদ্রিক শুকনো মাছ এবং দেশের আরও অনেক কিছু পাওয়া যায়। যে সবের নাম আমার জানা নেই। এইভাবে নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে বাজার বসে প্রতিদিন।
নগরীর আয়তন সম্বন্ধে আমি এক্ষেত্রে লিখছি না। কারণ একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে এটি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি একটি পাহাড়ে উঠেছিলাম, যেখান থেকে আমি নগরীর অনেকটা অংশ দেখতে পেয়েছিলাম। এটি একাধিক পর্বতমালার মধ্যে স্থাপিত বলে সারা শহরকে দেখতে পাওয়া যায় না। সেখান থেকে আমি যতটা দেখেছিলাম তাতে আমার মনে হয়েছিল যে এটি রোম নগরীর মতোই বড়। দেখতেও অপূর্ব। এই নগরের ভিতরে গৃহসংলগ্ন উদ্যানে বহু বৃক্ষ-কুঞ্জ রয়েছে, তাদের ভেতর নালা দিয়ে জল বয়ে যায়। কোনো কোনো জায়গায় জলাশয় রয়েছে। রাজপ্রাসাদের পাশে খেজুর জাতীয় গাছের বীথিকা। তাছাড়াও রয়েছে ভালো ভালো ফলের গাছ। রয়েছে আম, সুপারি, কাঁঠাল, লেবু, কমলালেবুর গাছ, যারা এত কাছাকাছি যে মনে হয় যেন ঘন অরণ্য। এখানে সাদা আঙুরও রয়েছে। নগরীর সমস্ত জল আগে দেখা দুটি জলাধার থেকে আসে।
নগরীতে অসংখ্য মানুষের বাস। তার সংখ্যা আমি উল্লেখ করতে চাই না। কারণ সেটি অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। তবে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, যে কোনো সৈন্যদল তারা অশ্বারোহী বা পদাতিক হোক কোনো বড় বা ছোট রাস্তায় জনতার ভীড় ভেঙে এগিয়ে যেতে পারবে না। মানুষ আর হাতির সংখ্যা খুব বেশি।
পৃথিবীর কোনো নগরীতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এত সহজলভ্য নয়, যেমন ধান গম ভারতীয় শস্যদানা কিছু পরিমাণে যব, শিম, মুগডাল, মুসুরী এবং নানারকমে দানাশস্য যা দেশের লোকেরা খাদ্যরূপে গ্রহণ করে। এ সবের বিরাট মজুতভাণ্ডার রয়েছে এবং সেগুলো অত্যন্ত সস্তা। কিন্তু অন্যান্য শস্যের মতো গম অতটা প্রচলিত নয়। সবাই আপনারা দেখতে পাবেন রাস্তা এবং হাট বাজার অসংখ্য বোঝাই করা বলদের গাড়িতে ভর্তি। তাদের সংখ্যা গোণা যায় না। অনেক সময় এমনও হয় যে রাস্তা পার হওয়ার সময় আপনাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নইলে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। এখানে মুরগী, হাস এবং গৃহপালিত পাখি যথেষ্ট রয়েছে। নগরীতে যে দামে একটি মুরগী কিনতে পাওয়া যায়, নগরীর বাইরে একই দামে চারটি মুরগী পাওয়া যায়।
এদেশে অনেক তিতির পাখি রয়েছে, তবে সেগুলি আমাদের দেশের মতো নয়। তারা ইতালির তিতিরের (ইস্টার নাম) মতো। এরা তিন শ্রেণীর। এক শ্রেণীর পাখির পর্তুগালের মতো একটি ক্ষুদ্র কাঁটা রয়েছে। আর এক শ্রেণী রয়েছে যাদের প্রত্যেকের পা দুটি খুব তীক্ষ্ণ। অন্য এক ধরনের রয়েছে যারা রঙচঙে এবং এদেরই বাজারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রয়েছে কোয়েল, খরগোস, সমস্ত ধরনের বন্য মোরগ এবং জলাশয়ে বাস করে এমন সব পাখি যাদের হাঁসের মতো দেখতে। এই সব পাখি এবং শিকারের জন্তুদের জীবন্ত বিক্রয় হয়। খুব সস্তায় তাদের পাওয়া যায়। ছয় বা আটটি তিতির পাখি এক ভিন্টেমে পাওয়া যায়। তারা এই দামে কখনো দুটি এবং কখনো একটি খরগোস দেয়। অন্যান্য পাখির ক্ষেত্রে তারা এত বেশি দেয় যে গুণে শেষ করা যায় না। এমনকি বড় বড় পাখির ক্ষেত্রেও তারা এত বেশি সংখ্যায় দেয় যে ছোট ছোট পাখিগুলো নজর এড়িয়ে যায়। যেমন ঘুঘু পায়রা এবং ও দেশের অন্যান্য পাখি। ঘুঘু রয়েছে দুই রকমের। কতকগুলি পর্তুগালের ঘুঘুর মতো এবং কতগুলি গান গাওয়া পাখিদের মতো বড়। প্রতিদিন এত বেশি পরিমাণে ভেড়া মারা হয় যে গুণে শেষ করা যায় না। কারণ প্রতি রাস্তায় ভেড়ার মাংস বিক্রেতার দেখা মিলবে। সেগুলি এত পরিষ্কার এবং চর্বিযুক্ত যে মনে হবে বুঝি শুয়োরের মাংস। আপনি শুয়োরের মাংসও কিছু কিছু রাস্তায় কসাই-এর বাড়িতে পাবেন। সেই মাংস এত শ্বেতবর্ণের এবং পরিষ্কার যে অন্য কোনো দেশে এমন পাবেন না। এরপর পোভোসে (লিস্বনের নিকটবর্তী একটি স্থান) যেমন দেখতে পাওয়া যায় তেমনি এখানেও আপনি দেখবেন বোঝা বোঝা লেবু আনা হচ্ছে। এছাড়াও আনা হচ্ছে মিষ্টি ও টক কমলালেবু, বুনো বেগুণ, এবং বাগানে উৎপাদিত অন্যান্য দ্রব্য এত বেশি পরিমাণে আনা হয় যে অবাক হতে হয়। এখানকার নগরীর অবস্থা অন্যান্য নগরীর মতো নয়, যেখানে প্রায়ই দ্রব্য সামগ্রী, যোগাতে টান পড়ে। কারণ এখানে সব কিছুরই প্রাচুর্য। যে পরিমাণ মাখন,তেল এবং দুধ এখানে বিক্রি হয় চিন্তা করা যায় না। গরু, মহিষ যেভাবে প্রতিপালন করা হয় এমন দেখা দুর্লভ। এখানে ডালিম এবং থোকা থোকা আঙুর সস্তায় পাওয়া যায়।
বিদেশী পর্যটকটি আরও দীর্ঘ বিবরণ লিখে গিয়েছেন।
নৃত্যগীত নিয়মিতো অভ্যাস করছে দয়াবতীরা। বিশেষ করে দয়াবতীর কণ্ঠস্বর যেন কোকিলকণ্ঠ। মুক্তি দয়াবতীকে জড়িয়ে ধরে আজ।
–এ কি করছিস?
-আর পারছি না। এত মিষ্টি স্বর, স্থির থাকতে পারি না।
–কি যা তা বলছিস?
সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে—ঠিক বলেছে।
অবলা বলে—তোর সুর এখন যেন দেবলোক স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। একেই বলে বোধহয় কিন্নর কণ্ঠী। কিছুদিন হল তোর ওপর কিছু ভর করেছে।
দয়াবতী হেসে ওঠে।
—হাসলে যে?
—কিন্নরদের মুখ কেমন দেখতে জানিস?
—না। নিশ্চয় দেবী কিংবা অপ্সরার মতো।
–না, কিন্নর তো পুরুষ। তাছাড়া তারা ঘোড়া-মুখো।
সবাই দয়াবতীর দিকে দৃষ্টি ফেলে।
-আর কিন্নরীরাও।
—হ্যাঁ, কিন্নরীদের মুখও অমন।
—অত শত জানি না। ওরা সব স্বর্গবাসী। কেমন দেখতে, জানার দরকার নেই। তোর সংগীত শুনে দূর থেকে কেউ তোর রূপের কথা ভাববে না।
দয়াবতী বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে—আমার তো রূপ নেই।
অবলা বলে-আমরা সবাই পরিপূর্ণ নারী, এমনকি শ্রীমতীকেও আর ছোট বলা চলবে না। কথায় কথায় অভিমান করা আমাদের মানায় না। তাছাড়া কার ওপর অভিমান করব আমরা? আমাদের যারা স্নেহ করতেন তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন হয়তো। ভবানীদির ওপর অভিমান করা যায়?
দয়াবতী বলে—আবোল তাবোল বকিস না। আমি অভিমান করিনি।
—তাহলে রূপ নেই বলে অত দুঃখ কিসের? সবাই কি রূপসী হয়ে জন্মায়? তাছাড়া তোর মতো কণ্ঠস্বর কয়জনের হয়?
সেই সময় গুরুদেব প্রবেশ করেন। সবাই সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন—কাল প্রত্যুষে মঞ্জরী আর শ্রীমতী আমার সঙ্গে যাবে। শয্যাশায়ী এক পীড়িত ব্যক্তি রয়েছে। সারা গায়ে যার ঘা। আমি তোমাদের আরও দুই-একজনকে অন্য কাজ দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে এসব কাজে ঈশ্বরের আনুকূল্য প্রয়োজন হয়। আমি সফল হলে আমার উদ্দেশ্য তোমরা হয়তো বুঝতে পারবে। এতে অনেক ঝুঁকি। আমার প্রাণ সংশয়ও হতে পারে।
দয়াবতী গুরুদেবের পায়ের সামনে আছড়ে পড়ে কেঁদে ওঠে— না না, গুরুদেব। এসব আপনি করবেন না। আপনি আমাদের আশ্রয়স্থল। আপনি আমাদের ঈশ্বর।
–সারা জীবন সেই ধারণারই সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমি জানি তেমন কিছু নাই। তাই আমি একটু চেষ্টা করতে চাই।
দেবদাসীরা ক্রিয়াশক্তির সুখের দিকে আকূল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তিনি বলেন—তোমাদের দেবীর অংশে জন্ম। আর সেই দেবীর লাঞ্ছনা সর্বত্র। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ভোগ্য তোমরা। কেন? তোমরা জান না। কেউ জানে না। শুধু এই ভাবেই চিরকাল চলেছে, এমন ধারণা সবার মনের মধ্যে রয়েছে। তাই সরস্বতীদের অমন দশা হয় ৷
দেবদাসীরা কেঁপে ওঠে।
—অথচ সেবার মাধ্যমে তোমরা মানুষের কতখানি শ্রদ্ধা পেতে পার, আমি জানি। স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই তোমাদের আপন ভাবতে পারে।
শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ, গুরুদেব। আমি অনুভব করেছি।
–তোমাদের কাছে আমার একটিই আজ্ঞা, কখনো এসব কথা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে না।
.
প্রত্যুষে গুরুদেব শ্রীমতী ও মঞ্জরীকে নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশের দিকে রওনা হন। সেখানে পৌঁছোতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু উপায় কি, রোগী যদি শয্যাশায়ী হয় তাহলে তার কাছেই যেতে হয়। এতদিন ক্রিয়াশক্তি এই ধরনের রোগীকে দেখতে যেতেন না, তারা কেউ ডাকত না। তারা ওষুধ নিয়ে চলে যেত। ডাকতে সাহস পেত না। কিন্তু শ্রীমতী অসুস্থদের গৃহে যাওয়ার পর থেকে গুরুদেবও যান। এতদিন যাননি বলে মনে মনে একটা দুঃখ হয়। তবে রাজপুরীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য যেতে হয় বলে, তিনি সাধারণত বাইরে যেতে পারেন না। শ্রীমতী মঞ্জরীকে নিয়ে একাই যায়। ওদের এভাবে পাঠাতে তাঁর দ্বিধা হয়। বন জঙ্গলের পথে শুধু হিংস্র পশু তো থাকে না। ভরসা এই যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পীড়িতের গৃহের কোনো পুরুষমানুষ এসে নিয়ে যায়।
আজ গুরুদেব নিশ্চিন্ত, সঙ্গে তিনি নিজে রয়েছেন। আজ তিনি ওদের দুজনার কাজ দেখবেন। তাছাড়া আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসা সম্ভব কিনা তারও পরীক্ষা হয়ে যাবে। যদি সেই পরীক্ষা ব্যর্থ হয় তাহলে অতি যত্নে লালিত তাঁর একটি স্বর্গ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ভাগ্যাহত সরস্বতীদের নিষ্কৃতির পথ চিরকাল রুদ্ধ হয়ে যাবে হত।
একটি জীর্ণ কুটিরের সামনে দাঁড়ান তাঁরা। একজন শীর্ণকায়া স্ত্রীলোক তাঁদের দেখে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ওরা লক্ষ্য করে স্ত্রীলোকটি বিগত-যৌবনা নয়। গৃহের অভ্যন্তরে একটা হালকা দুৰ্গন্ধ।
গুরুদেব ঝুঁকে পড়েন রোগীর ওপর। ভালোভাবে দেখতে থাকেন ভ্রূকুঞ্চিত করে। তারপর শ্রীমতীকে দেখতে বলেন। শ্রীমতী নির্বিকার চিত্তে তার একটা পা তুলে দেখে। সে আর্তনাদ করে ওঠে। এরপর তার একটি হাত উঠিয়ে নিয়ে আলোয় ধরে। তারপর রোগীকে বলে—দেখতে পেয়েছিলে?
গুরুদেব চমকে ওঠেন। এ কেমন ধরনের প্রশ্ন? তিনি রোগীর মুখের দিকে কৌতূহলের দৃষ্টি তাকান।
রোগী বলে—না, গাছে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, সেই সময় হাতে কামড়ালো। তারপরেই পায়ে। কী জ্বালা! ভেবেছিলাম সাপে কামড়েছে।
–না, সাপে কামড়ালে দেখা যেত। অন্য কোনো পোকা। যখন ফুলে উঠল তখন গুরুদেবের কাছে এলে এভাবে পড়ে থাকতে হত না।
-আমাদের অত সাহস হয়নি। আপনারা দয়া করে ভালো করে দিন। নইলে আমার স্ত্রী না খেয়ে মরবে।
গুরুদেব বুঝতে পারেন বিজয়নগরে একজন ধন্বন্তরীর উদয় হয়েছে। অতটুকু একটি মেয়ে যেদিন মন্দিরের দ্বারে মায়ের হাত ধরে এসে দাঁড়াল সেদিনই তার চোখ দুটো দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই চোখের দৃষ্টি অতলান্ত। তিনি শ্রীমতীকে বলেন—আজকে আমি আর দেখব না। তোমরাই দেখ। এরা কেউ আপত্তি করবে না।
অনেক সময় নিয়ে রোগীর সব রকম ব্যবস্থা করে গুরুদেব যখন ওদের দু’জনকে নিয়ে কুটিরের বাইরে চলে এলেন স্ত্রীলোকটি তখন ওদের পায়ের সামনে উপুর হয়ে প্রণাম করে। গুরুদেব অভ্যস্ত। কিন্তু ওরা দু’জনা লজ্জিত। হাত ধরে তুলে বলে—একি করছেন।
—এতদিন দেবতাকে দেখেছি, আজ দুই দেবীকে দেখলাম। এমন যে হয় আমি কল্পনা করিনি। আমার স্বামীর ব্যথার যথেষ্ট উপশম হয়েছে। উনি আর আর্তনাদ করছেন না।
শ্রীমতী বলে—মনে হয় কমে যাবে। তবে গায়ে অনেক দাগ থাকবে।
গুরুদেব বলেন—শ্রীমতী, তোমাকে আমি জেনেছি আগেই, কিন্তু আজ মঞ্জরীর মধ্যে যা দেখলাম—
শ্রীমতী কেঁদে ফেলে বলে—ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন রোগীটির মা। এতটুকুও ঘৃণা নেই, কী অগাধ স্নেহ, হ্যাঁ স্নেহ। ছাড়া আর কি বলব?
গুরুদেব বলেন—হ্যাঁ ৷
মঞ্জরী সংকোচে জড়োসড়ো হয়।
শ্রীমতী বলে—তুমি আর মানুষ থাকো না মঞ্জরী, যেন অন্য জগতের কেউ। গুরুদেবও কেমন হয়ে যান। সত্যিই তো সেই শৈশব থেকে মন্দিরে রয়েছেন, শেষবেলায় এসব কি দেবীদর্শন? দেবদাসীর রূপ ধরে এ কারা তাঁকে দেখা দিতে এসেছে? অমরু আর অতীশ কি এদের উপযুক্ত হবে?
পাহাড়ি রাস্তার বিপরীত দিকে দেখা গেল দুইজন তরুণ নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। তাদের দেখে শ্রীমতীরা চিনতে পারে। ওরা থমকে যায়।
গুরুদেব বলেন—থামলে কেন? ওদের এদিকে আসার কথা ছিল।
দুজনেই বিস্মিত হয়ে গুরুদেবের দিকে দৃষ্টি পেলে।
তিনি বলেন—ওরা জানে না, তোমরা আছ।
শ্রীমতী ভাবে, গুরুদেব কি করে বুঝলেন, ওই তীক্ষ্ণ চেহারার মানুষটার মধ্যে সে একটা আকর্ষণ অনুভব করে। মঞ্জরী ওকে ফিসফিস করে বলে—এই সেই সুন্দর পুরুষ। এখানে এল কি করে? আমার পা ভেঙে পড়ছে। তুই আমাকে একটু ধরবি?
ওই দুই তরুণের একজন বলে—গুরুদেব আপনি আমাদের কোন কাজে ডেকেছিলেন বলেছিলেন।
–কাজ তো বটেই। কিন্তু একটু আগে তোমরা যদি পৌঁছাতে তাহলে এরা দুজনে এক অসাধারণ কাজ করেছে চাক্ষুস দেখতে পেতে।
–আমাদের আপনি তো সেকথা বলেননি।
—না না। দৈবাৎ ঘটে গিয়েছে।
গুরুদেব ওদের সবিস্তারে সব কিছু বলেন। ওরা উভয়ের দিকে চেয়ে থাকে। ঠিক যেন বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুন্দর তরুণটি বলে-আমরা গিয়ে দেখতে পারি?
—নিশ্চয়। চল।
আবার সবাই মিলে কুটিরের কাছে যায়। শ্রীমতীরা অনুভব করে, এ যেন অন্য ধরনের সুখ।
কুটিরের দুয়ার খোলা ছিল। স্ত্রীলোকটি মঞ্জরীর কাছে গিয়ে বলে—এক জায়গায় রক্ত বের হচ্ছে।
—নতুন করে বেঁধেছি বলে অমন হয়েছে। ও কিছু না। এখন ভালো লাগছে? —হ্যাঁ। আপনারা দুজনা দেবী। ঠাকুর আপনাদের সঙ্গে করে এনেছেন। ও ভালো হয়ে যাবে। ওর এত শাস্তি আমি দেখিনি।
দুই তরুণ সব শোনে সব দেখে।
সবাই বাইরে আসে।
একটু এগিয়ে গুরুদেব তরুণদের সামনেই শ্রীমতীদের বলেন—তোমরা দুজনা উচ্চবংশীয় হলেও দেবদাসী। কিন্তু এদের মধ্যে একজন মলয়াবন্ত পর্বতের পাদদেশ থেকে বহুদূর পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলের ভূস্যাধিকারী। নাম অতীশ। আর অন্যজন খুবই পরিচিত, তবে চেনো কিনা জানি না। অন্যজনের নাম অমরু। একশত পদ লিখে বিখ্যাত।
শ্রীমতীর সর্বাঙ্গে শিহরণ। এই নামই পিতার মুখে শুনেছে। বাবা বলেছিলেন মাত্র ঊনিশ বছর বয়সের এক কিশোরের লেখা ওই কাব্যগাথা। এই সেই কিশোর। এখন যুবক। মহা সৌভাগ্য তার।
শ্রীমতী নিম্ন স্বরে বলে—আমি জানি।
—তুমি জান? কোথা থেকে জানলে?
—বাবা।
–তোমার বাবা পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তাহলে।
অমরু বলে—উনি জীবিত নন?
-না, তাহলে কি এই মন্দিরে ওকে স্থান নিতে হত? মহারাজার নিজস্ব বাহিনীর কর্মচারি ছিলেন। নিহত হন। তিনি তোমার গ্রন্থের খবর প্রথম থেকে জানতেন ৷ বলতে গেলে প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকেই বুঝতে পারছি।
—আমি বিস্মিত হচ্ছি। এই সব বিষয়ে ওঁর প্রবল অনুসন্ধিৎসা ছিল। সেই পিতার কন্যার তীক্ষ্ণধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
—ভুল বলনি।
—চিকিৎসার কথাও শুনলাম।
শ্রীমতীর হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে নিজেকে তিরস্কার করে বলে—এতটা ভালো নয়। সে যত যা-ই হোক দেবদাসী।
ঋষ্যকুট পর্বতের দিকে সাদা মেঘে রোদের প্রতিফলন। সূর্যোদয়ের পর থেকে খুব দ্রুত আকাশের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ক্রিয়াশক্তি বলেন—একে প্রতিভাময়ী বলা চলে। আমি এই প্রথম এমন একজনকে দেখলাম। কিন্তু কি করব? শুধু প্রতিভাময়ী নয়, এ অত্যন্ত সুন্দরী, এরা দু’জনেই ৷
মঞ্জরী বলে ওঠে—গুরুদেব, আপনি ওর সঙ্গে আমার তুলনা করছেন? ও তো-
–আমি তুলনা করছি না। তবে তোমার সেবাপরায়ণতা দেখে আমি রূপের ভেদাভেদ বিচার করতে ভুলে গিয়েছি।
অতীশ বলে—ঠিক। আমি দেখেছি কুটির থেকে বাইরে আসার আগে উনি রোগীর ললাটে হস্তস্পর্শ করে সান্ত্বনার হাসি হেসে চলে এসেছিলেন। বোঝাই গেল, রোগীর ক্ষেত্রে ওঁর ভেদাভেদ নেই। বোধহয়, আপনার মতো অবস্থা।
একটা হালকা হাসির আওয়াজ ভেসে ওঠে।
.
পর্যটকের আরও বিবরণ :
উত্তরদিকে নগরীর প্রাচীরের বাইরে তিনটি খুব সুন্দর মন্দির রয়েছে, যার একটিকে বলা হয় বিশালাক্ষ্মী। এটি রাজ্যবাসীর কাছে খুব পবিত্র ও শ্রদ্ধার স্থান। এখানে বহু তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়।
প্রধান দ্বারদেশের বিপরীত দিকে বহু সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা সমন্বিত একটি চমৎকার সড়ক রয়েছে। বাড়িগুলির ঝুলবারান্দা রয়েছে, থামের উপর রয়েছে খিলান শ্রেণী, যেখানে মন্দিরে আগত তীর্থযাত্রীরা অবস্থান করে। এখানে উচ্চশ্রেণীর মানুষেরও তীর্থভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। এই একই রাস্তায় রাজার একটি প্রাসাদ রয়েছে। মন্দিরে এলে তিনি ওই প্রাসাদে থাকেন।
প্রথম দ্বারদেশের ওপরে একটি নারী-তীর্থযাত্রীর মূর্তি রয়েছে। এই দ্বার একটি সুউচ্চ বুরুজ বিশিষ্ট, যেটির সর্বাঙ্গে পুরুষ ও নারী মূর্তির সারি। এতে মৃগয়ার দৃশ্যও রয়েছে, আরও বহু বিষয়ের মূর্তি রয়েছে। এই বুরুজটি উপর দিকে উঠতে উঠতে ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে মূর্তিগুলোও ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এসেছে।
প্রধান দ্বারের বিপরীত দিকে রয়েছে চারটি স্তম্ভ যার দুটি স্বর্ণমণ্ডিত এবং অন্য দুটি তাম্রমণ্ডিত। যে দুটি থেকে কালের প্রভাবে, আমার মনে হয় স্বর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। মন্দিরের সবচেয়ে নিকটে যেটি রয়েছে সেটি বর্তমান রাজা প্রদান করেছেন। অন্যান্যগুলি তাঁর পূর্ব পুরুষদের দ্বারা প্রদত্ত। মন্দিরের প্রবেশ দ্বারের বাইরের সমস্ত অংশ তাম্রমণ্ডিত এবং গিলটি করা। ছাদের ওপরের প্রত্যেক দিকে ব্যাঘ্রসদৃশ কোনো বৃহদাকার জন্তু। সেটিও গিল্টি করা। বিগ্রহের মন্দিরে প্রবেশ করলে প্রতিটি স্তম্ভের গায়ে সজ্জিত গর্ত যাতে তৈল প্রদীপ রাখা হয়। প্রদীপগুলি প্রতি রাতেই জ্বালানো হয়। এদের সংখ্যা আড়াই তিন হাজার। মন্দির অতিক্রম করলে একটি ক্ষুদ্রাকার মন্দির দেখা যাবে। যেটি অনেকটা গীর্জার নীচের সমাধি গৃহের মতো। আর একটু অগ্রসর হলে উপাসনালয়ের মতো দেখতে, যেখানে ওদের উপাস্য দেবতার বিগ্রহ রয়েছে। এখানে পৌঁছোবার আগে তিনটি দরজা রয়েছে। এই পবিত্র স্থানটি খিলান-যুক্ত। বাইরের আলো প্রবেশ করে না বলে এটি অন্ধকার এবং সবসময় মোমবাতি দ্বারা আলোকিত। প্রথম প্রবেশদ্বারে দ্বাররক্ষীরা রয়েছে যারা ওই স্থানের ভারপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণদের ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না। এবং আমি যেহেতু ওদের কিছু দিয়েছিলাম তাই ওরা আমাকে প্রবেশ করতে দিল। এক প্রবেশ পথ থেকে অন্যটির মধ্যবর্তী স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্তি রয়েছে। আসল বিগ্রহ একটি গোলাকার প্রস্তর খণ্ড যার কোনো আকার নেই। এরই ওপর ওদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা। এই অট্টালিকার বহির্ভাগ সম্পূর্ণরূপে তামার গিলটি করা। মন্দিরের পশ্চাতে বাইরের দিকে আমি যে বারান্দাগুলোর কথা বলেছি সেখানে শ্বেতবর্ণের স্ফটিকের একটি মূর্তি রয়েছে, যেটি দৃঢ়হস্ত বিশিষ্ট। এক হাতে রয়েছে (কি রয়েছে মূল রচনার নেই), অন্য হস্তে তরবারি এবং অন্যগুলিতে পবিত্র প্রতীক। এর পদতলে রয়েছে একটি মহিষ এবং একটি বৃহদাকার জন্তু। যেটি এটিকে বধ করতে সাহায্য করছে। এই মন্দিরে অষ্টপ্রহর একটি ঘৃতের প্রদীপ জ্বলছে। এর চতুর্দিকে আরও ছোট ছোট মন্দির ও উপসনালয় রয়েছে।
.
পশুপতি মন্দিরের দেবদাসীদের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন চলছে কয়েকদিন হল। এমনকি ভবানী দিদিও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে ওদের দু-একবার জিজ্ঞাসা করে কোনো সদুত্তর পায়নি। শেষে একদিন গুরুদেবকে একা দেখে তাঁর সামনে গিয়ে প্রণাম করে দাঁড়িয়ে থাকে।
–কি হল ভবানি, কিছু বলতে চাও।
—হ্যাঁ। গুরুদেব।
-বল।
—এদের মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তি দেখতে পাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করলে বলে না।
—হ্যাঁ, সত্যি একটা অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে।
–আপনি জানেন প্ৰভু?
—জানি বৈকি। আমিই যে সৃষ্টি করেছি সেই অস্বস্তি।
ভবানী বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকে কি বলবে ভেবে পায় না।
–আচ্ছা ভবানী এখানে যারা দেবদাসী হয়ে আছে, তারা কি কুৎসিত? –না, না, ঠাকুর। একজনও তেমন নেই। এমনকি সবচেয়ে যে খারাপ, সে ও অনেক ভালোর চেয়ে ভালো।
—আর সুন্দরী?
—আমি তো নগরে বেশি যাই না। তবে শ্রীমতীর মতো কাউকে দেখব বলে কল্পনাও করি না। রানীদের মধ্যেও কেউ আছেন বলে বিশ্বাস করি না। তাঁদের সবাইকে তো দেখেছি।
—সরস্বতী নামে একজন—
—না না, ঠাকুর ওই হতভাগীর কথা বলবেন না।
-এখানকার দেবদাসীদের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে বলে তোমার ধারণা?
—জানি না। আমি দেখতে যেমন ছিলাম, এরা সবাই তার চেয়ে ভালো দেখতে। আমার ভবিষ্যৎ মোটামুটি বোঝা যায়। কিন্তু এরা অল্পবয়সী, হয়তো অনেকেই এখানে থেকে যাবে। শুনেছি পথের ভিখারিনীও হতে হয়েছে অনেককে। যা হওয়ার হবে। ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। প্রত্যেকেই নিজের নিজের কপাল নিয়ে এসেছে।
–তুমি এই মন্দিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এর মঙ্গল তুমি চাও। ভবানী ঘাবড়ে যায়। গুরুদেব তাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন? সে তো কোনো বিষয়ে আলোচনার যোগ্য নয়।
—জান ভবানী আমি ভাবছি চেষ্টা করে এদের দু’একজন করে মন্দিরের দেবদাসীত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিতে চেষ্টা করব।
ভবানী ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে—ঠাকুর–
—ভয় পেলে কেন?
—বিগ্রহ কুপিত হবেন না? মন্দিরের সবার উপরের অভিশাপ বর্ষিত হবে না?
—বোধহয় না। আমি এঁকে পূজা করি। একান্তে ধ্যান করি। মনে হয় ওঁর সম্মতি রয়েছে। যুগ যুগ ধরে দেবতা ব্যথা পাচ্ছেন। দেবদাসী রাখতে হলে যোগ্য সম্মান দিয়ে রাখতে হবে। তাদের মধ্যে গার্হস্থ জীবনের লোভ উঁকি দেবে না। তাদের দেখে রাজা প্রজা কারও মনে কলুষ চিন্তার উদয় হবে না। তারা হবে পূজনীয়া, প্রণম্যা।
ভবানীর চোখের সামনে অন্য দৃশ্য ফুটে ওঠে। এই দৃশ্য চিন্তার অবকাশই তার হয়নি। সে বলে—তাহলে কি হবে এদের?
—সংসারে দেওয়ার চেষ্টা করব।
—দেবদাসীদের কোনো পরিবার সংসারে গ্রহণ করতে রাজি হবে?
—তাই দেখছি। তুমি চুপ করেই থাক। ওরা জানতে পেরেছে বলে এত অস্বস্তি ৷ কিন্তু পশুপতিদেব আমাকে যেন এগিয়ে দিচ্ছেন। তুমি এদের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিও না।
—না। আমি রন্ধন করি। দেবতার পুজো করি। আর আপনাকে গুরু বলে মানি। দেবতার চেয়ে পৃথক বলে ভাবি না আপনাকে। ভাববই বা কেন? আপনি তো ঠাকুরই।
.
রাজপ্রাসাদ থেকে মাঝে মাঝে এক আধজন কর্মচারি এসে ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে। কখনো তাঁকে পত্র দিয়ে যায়। কখনো তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শ নিয়ে যায়।
একদিন একজন উচ্চশ্রেণীর কর্মচারি ক্রিয়াশক্তিকে কথাপ্রসঙ্গে বলে—ঠাকুর, আপনার মন্দিরে রূপসী দেবদাসী আছে শুনলাম।
—তুমি এ ধরনের কথা আমাকে—
কর্মাচারি তাড়াতাড়ি গুরুদেবের পদস্পর্শ করে বলে—আমি এক আশঙ্কায় আপনাকে বলে ফেলেছি।
-কিসের আশঙ্কা?
-মহারাজা নাকি বলাবলি করেছেন আপনার মন্দিরে রূপবতী দেবদাসী থাকা সত্বেও তিনি জানতে পারেননি বলে অবাক হয়েছেন।
—হুঁ। দেখো, ওরা কে কতখানি রূপ ধরে, আমি ততটা গুরুত্ব দিই না। আমি ওদের নৃত্যগীত আর শিক্ষার দিকে লক্ষ্য রাখি। সেই সঙ্গে ওদের মনে যাতে ভক্তির প্রকাশ পায় তাও দেখি।
—গুরুদেব তেমন কেউ থাকলে রানী হতে চলেছেন।
—দেখা যাক।
কর্মচারি বিদায় নিতেই তিনি শ্রীমতী আর মঞ্জরীকে ডেকে বলেন—কাল প্রত্যুষে তোমরা আমার সঙ্গে যাবে।
সবাই বুঝল কোনো রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে দেখে গুরুদেব মন্দির ছেড়ে দ্রুতপদে বাইরে চলে গেলেন। জানল না তিনি রাজসভার দিকে চললেন।
পরদিন ক্রিয়াশক্তি দুজনকে নিয়ে জনহীন এক জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে বিশাল বটগাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালেন। মঞ্জরীর গা ছম্ছম্ করে। এ কোথায় নিয়ে এলেন তাদের? এখানে তো কোনো লোকালয় নেই। কার চিকিৎসা হবে? শ্রীমতী ভীত না হলেও গুরুদেবের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না।
–তোমাদের ভয় করছে?
শ্রীমতী বলে—না কিন্তু এখানে এলাম কেন?
–আমি দুজন ব্যক্তিকে এখানে আসতে বলেছি। তাদের আমি দুটি প্রশ্ন করেছিলাম। তারা আজ উত্তর দেবে।
—তাতে আমাদের কিসের প্রয়োজন?
—তারা এলে বুঝতে পারবে।
তারা এলো। আর তাদের দেখে এদের দুজনার সর্বাঙ্গে তড়িৎপ্রবাহ বইতে শুরু করল। শ্রীমতীকে মঞ্জরী অতীশ সম্পর্কে তার মনোভাব অকপটে বলে ফেলেছে। পরক্ষণেই বলেছে একথা না বললে সে থাকতে পারত না। অথচ এই আশা পোষণ করা নিশ্চয় পাপ। শ্রীমতী অতটা উচ্ছ্বাস প্রবণ হতে পারে না। তবে অমরুর মতো পুরুষ শুধু স্বপ্নে দেখার বেশি সে ভাবে না।
গুরুদেবকে তারা প্রণাম করে। তিনি বলেন—আমি তোমাদের পিতৃতুল্য। অনেক চিন্তা করে, আর দ্বিধা কাটিয়ে আমি তোমাদের চারজনকে এখানে এনেছি। আমার মনে হয়েছে এতে তোমাদের মঙ্গল হওয়ার সম্ভাবনা। কন্যার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না এক্ষেত্রে। তবু আমি তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী নির্বাচন করেছি। এখন তোমরা দুজনা বল তোমাদের বাবা মা এবং পিতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মতো রয়েছে কিনা।
অতীশ বলে—গুরুদেব, আমার পিতা অতিবৃদ্ধ। বলতে গেলে আমি তাঁর বৃদ্ধ বয়সের পুত্রসন্তান। আমার চেয়ে বয়সে বড় তাঁর আরও তিন কন্যা রয়েছে। আমার মূল্য তাঁর কাছে খুবই বেশি। তাই তিনি এতে সম্মতি দেননি প্রথমে। আমার মা এঁর সেবাপরায়ণতার কথা শুনে বলে উঠলেন, সেকি! তুমি ভুলে গেলে সেই কন্যাকুমারীর কথা? গুরুদেব জানতে চান, কোন ঘটনার কথা। অতীশ বলে—ওঁরা দুজনে সেই কথা উল্লেখ করলেন না। শুধু বাবা বলেন—তোমার মা অনুমতি দিলে আমি বাধা দেব না। আমার মা বলেন—তোমার বোনেরা নানা কথা বলবে। প্রজারাও বলবে। তুমি সহ্য করতে পারবে?
-পারব।
একথা শুনে গুরুদেব বলেন—প্রস্তুত হয়েই এসেছ বলতে চাও?
—হ্যাঁ।
মঞ্জরী শ্রীমতীকে আঁকড়ে ধরে। গুরুদেব তাকে বলেন—তুমি ওই প্রস্তরখণ্ডের ওপর বসো মঞ্জরী।
সে বসে পড়ে।
—এবারে তোমার উত্তর জানতে চাইব অমরু।
অমরু মৃদু হেসে বলে—আমার বাবার গত বছর মৃত্যু হয়েছে।
—শোন অমরু, তোমার পিতৃবিয়োগের কথা বিজয়নগরের মানুষকে ডেকে বলতে হয়নি। এমনিতেই সবাই জেনে গিয়েছে।
–মা, আমার মুখে সব শুনে বলেন, তাড়াতাড়ি গিয়ে নিয়ে আয়। একা থেকে থেকে দম বন্ধ হয়ে যায় সারাদিন। তুই রাজসভায় কিংবা ঘরের কোণে মুখ গুঁজে থাকিস। আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই। কবে আনবি?
গুরুদেব আর অতীশ উভয়ের মুখেই হাসি।
অমরু বলে—অতীশ হাসতে পারে কিন্তু আমাকে তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। একজন মানুষ গেলে একটা শয্যারও তো দরকার হয়। আছে কিনা কে জানে।
অতীশ বলে—আছে। তোমার পিতার শয্যাটি বড়। তাছাড়া আর একটা রয়েছে।
গুরুদেব বলেন—তুমি এত জান, ও জানে না।
—ওর চোখ দুটো শোভাবর্ধনের জন্য। এদিকে মা ও ছেলে কারও সাহায্য নেবেন না। কায়িক সাহায্যও নয়। অমরুর পোশাক দেখেই তো বুঝতে পারছেন।
গুরুদেব হেসে ফেলেন। তিনি উভয়ের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক উপলব্ধি করেন। মনে মনে পশুপতিনাথকে বারবার প্রণতি জানান। তিনি তাঁকে সাহায্য করছেন। অন্যদের বিষয়েও করবেন হয়তো।
এক সময় শ্রীমতীও কখন যেন মঞ্জরীর পাশে পাথরের উপর বসে পড়ে। সে-ও যেন দেহের শক্তি হারিয়েছে। তার সামনে ঠিক এক অভিনয় হয়ে চলেছে। যেন সত্যি নয়। সত্যি হলেও হয়তো অধরা থেকে যাবে।
গুরুদেব সবাইকে বলেন—তোমরা এখনি আমার সঙ্গে মন্দিরে চল। খুব দ্রুত তোমাদের বিবাহসম্পন্ন করতে হবে। নইলে বিপদও হতে পারে।
তরুণ দুজনা কি যেন অনুমান করল। তারা গুরুদেবের সঙ্গে চলল।
মন্দিরে দুই তরুণ সহ গুরুদেবকে প্রবেশ করতে দেখে দেবদাসীরা সারি বেঁধে দাঁড়াল। ভবানীও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্রিয়াশক্তির পরে সে-ই এখানকার সবার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন।
গুরুদেব বলেন—তোমরা সবাই বিগ্রহের সামনে চল। এদের বিবাহে তোমরা সাক্ষী।
ভবানী থেকে শুরু করে দয়াবতী, সবার চোখে বিস্ময়।
তরুণ দুজনে ওদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। শ্রীমতী এবং মঞ্জরী লজ্জাবনত। সাথীদের দিকে মুখ তুলে চাইতে পারে না। তাদের মনে হয় তারা এদের প্রতারিত করেছে। তারা যখন নতুন জীবনের অজানা পথে অগ্রসর হতে চলেছে। তখন এরা আগের মতোই একঘেয়ে দিন কাটাবে। মঞ্জরী দয়াবতীকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুপাত করে। অবলা অশ্রুসজল শ্রীমতীর মুখ চুম্বন করে।
বিগ্রহের সম্মুখে শাস্ত্রমতে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হল। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি বলেন—আমি যে কদিন জীবিত রয়েছি। তোমাদের আরও কয়েকজনকে তাদের গার্হস্থ জীবনে স্থাপন করার চেষ্টা করব।
দয়াবতী অমরুদের বলে—আমরা দেবদাসী। তবু আপনাদের দুজনকে আত্মীয় বলে মনে হচ্ছে। এরা দুজনেই আমাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। আমরা আপনাদের মঙ্গল কামনা করি।
অতীশ বলে—দেবদাসী সম্বন্ধে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আমরা দেশের মানুষদের অসংখ্য গোষ্ঠীতে ভাগ করে সেগুলিতে বিশেষ বিশেষ দোষগুণ আরোপ করি। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সেটা ঠিক না, উচিতও নয়।
গুরুদেব বলেন—তোমরা অনর্থক দেরি করছ! তেমন দিন এলে এই মন্দিরের দ্বার চিরকালই উন্মুক্ত পাবে। তোমরা তখন কোথায় যাবে?
অমরু বলে—আমার গন্তব্যস্থল মাত্র একটিই রয়েছে নগরে। মা নিশ্চয় চিন্তিত হয়ে রয়েছেন। মাঝে মধ্যে বাড়িতে ফিরতে আমার দেরি হয় ঠিকই। তবু মায়ের দুশ্চিন্তার অভাব ঘটে না। কখনো কখনো অদ্ভুত অদ্ভুত বিপদের কল্পনা করে ছটফট্ করেন।
গুরুদেব বলেন—তুমি নতুন কিছু বলছ না, অধিকাংশ মায়েরাই অমন। অতীশ তুমি কোথায় যাবে এখন?
—আমিও এর বাড়ি ৰাব। দেখব, সত্যিই শয্যার অভাব রয়েছে কিনা। থাকলে একটা ব্যবস্থা করে নেব। শয্যার চেয়েও আমি খাদ্যের অভাবের আশঙ্কা করছি। দেখব হয়তো অমরুর খাবার ছাড়া কিছু নেই।
সবাই হেসে ওঠে।
—রাজধানীতে তোমার লোকজন নেই?
—সব আছে। হাতি ঘোড়াও রয়েছে।
–তোমাকে আগামীকাল হাতিঘোড়া লোকজন নিয়েই বাড়িতে ফিরতে হবে। রাজধানীর নজরে পড়ুক আমি চাই। তুমি রওনা হবে অমরুর গৃহ থেকে। সেখানে
অমরু ওর মা এবং নববধূ তোমাদের শুভযাত্রার সূচনা করে দেবেন।
—তাই হবে গুরুদেব।
.
এক পর্যটকের লিখিত বিবরণ :-
রাজ্যে নয়দিনের অনুষ্ঠান শেষ হলে রাজা তাঁর সেনাবাহিনীর সবকিছু পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করেন। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা হয় এইভাবে। নগর থেকে দেড় ক্রোশ দূরে পূর্বনির্ধারিত একটি স্থানে রাজা মক্কা-রেশমের একটি শিবির স্থাপন করতে বলেন। সেই শিবিরে যাঁর সম্মানে এত সব অনুষ্ঠানাদি প্রতিপালন করা হল তাঁর বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। এই শিবির থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সেনানায়কগণ তাদের নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে নিজেদের পদের গুরুত্ব অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে দণ্ডায়মান হয়। কিন্তু দেখে মনে হয় না তারা একই সারিতে দণ্ডায়মান রয়েছে। এক এক জায়গায় সামনে পেছনে দুই তিন সারিতেও দাঁড়ায়। পথের জলাশয়গুলি সৈন্যদ্বারা বেষ্টিত থাকে। যেখানে রাজপথ সরু সেখানে তাদের সারিকে সমতলভূমিতে এগিয়ে আনা হয়। পদাতিকেরা অশ্বারোহীদের সামনে থাকে, হস্তীরা দাঁড়ায় অশ্বদের পেছনে। এই সারিতে দলপতিরা তাদের নিজ নিজ বাহিনীর সঙ্গে থাকে।
এখন আমি ওদের অস্ত্রসজ্জার ধরন সম্বন্ধে বলব। অশ্বগুলি সম্পূর্ণ সজ্জিত। তাদের অনেকের ললাট রৌপ্য পাত দিয়ে আবৃত, অনেকের গিলটি করা এবং ঝালরযুক্ত নানা বর্ণের রেশমি কাপড়ের দড়ি দিয়ে বাঁধা। অশ্বের লাগামও ওই একই ধরনের। অন্যান্যদের বিবিধ রঙের মক্কার ভেলভেট দিয়ে তৈরি। তাতেও ঝালর এবং অলঙ্কার রয়েছে। অন্য ধরনের রেশমির কাপড়ও রয়েছে। যেমন সার্টিন ও কিংখাব। এছাড়া চীন ও পারস্যদেশ থেকে আনা বুটিদার কাপড়। কারও কারও অঙ্গ গিটি করা পাত দিয়ে শোভিত। তাতে মূল্যবান পাথর বসানো, ধার বরাবর ছোট ছোট পাথরের কাজ। এই অংশগুলির কারও কারও মস্তক সর্প-শোভিত কিংবা অন্যান্য বন্য জন্তুদের প্রতিকৃত যুক্ত। এগুলি এমনভাবে তৈরি যে তাতে কোনো খুঁত নেই। শিল্পের চূড়ান্ত দক্ষতার নিদর্শন সেগুলি। অশ্বারোহীগণ দুর্ভেদ্য নরম ও পুরু পোশাক পরিহিত। তাছাড়া অনেকে বুটিদার রেশমি বা ভেলভেটের পোশাক পরেছে। এই পোশাকগুলোতে রয়েছে চর্ম ও ইস্পাতের স্তর, যাতে সেগুলি শক্ত হয়। এদের মস্তক শিরস্ত্রাণ যুক্ত। এই শিরস্ত্রাণ এমন ভাবে তৈরি যে গলা আবৃত থাকে। প্রত্যেকটি শিরস্ত্রাণে মুখমণ্ডলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া সোনা রূপা দিয়ে তৈরি কণ্ঠবর্মও রয়েছে। অন্যগুলি আয়নার মতো উজ্জ্বল ইস্পাত দিয়ে তৈরি। এদের কটিদেশে থাকে তরবারি ও রণকুঠার, হাতে থাকে বল্লম বা বর্শা যাদের দীর্ঘ হাতল সোনা কিংবা রূপো দিয়ে মোড়া। প্রত্যেকের নিকটে রাজপ্রদত্ত ছত্র রয়েছে যেগুলি ভেলভেট ও রেশমের সূচীশিল্প শোভিত। এরা বহু পতাকা আন্দোলিত করে যেগুলি শ্বেত ও নানা রঙের হয়। পতাকাগুলি দেখতে অশ্বপুচ্ছের মতো। হস্তীরাও একই ভাবে নানা বর্ণের ঝালর দিয়ে আচ্ছাদিত, যাতে ঘণ্টি বাঁধা। সেগুলি টুংটাং শব্দ করে। তাদের মুখমণ্ডল রাক্ষস ও অন্যান্য বৃহৎ পশুর মতো করে চিত্রিত। প্রত্যেক হস্তীর পৃষ্ঠদেশে দুর্ভেদ্য পোশাক পরিহিত ঢাল ও বর্শা হাতে তিন চারজন করে অশ্বারোহী। তাদের দেখলে মনে হয় যেন কোথাও আচমকা আক্রমণ করতে চলেছে। এরপর পদাতিক বাহিনীর কথা। তারা সংখ্যায় এত বেশি যে তারা সমস্ত উপত্যকা এবং পর্বতগুলি এমনভাবে ঘিরে ফেলতে পারে যে পৃথিবীতে তার কোনো তুলনা নেই। এদের মধ্যে আপনি এত দুর্লভ পোশাক দেখতে পাবেন যে তাদের কোথায় পাওয়া যায় সেই ধারণা আমার নেই। সেই সব পরিচ্ছদ এত রঙ-বেরঙের যে কত রকমের রঙ রয়েছে বলা সম্ভব নয়। ঢালিদের ঢাল সোনা আর রুপোর তৈরি ফুল দিয়ে সজ্জিত। অনেকগুলিতে রয়েছে ব্যাঘ্র ও অন্যান্য পশুদের প্রতিকৃতি। বাকিগুলি চিত্রিত। কিছু কিছু কালো রঙের এবং এত বেশি পালিশ করা যে তার মধ্যে দিয়ে আয়নার মত দেখতে পাওয়া যায়। ওদের তরবারি এত সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত যে তার চেয়ে সুন্দরভাবে কিছু করা হয়তো সম্ভব নয়। তীরন্দাজদের সম্বন্ধে একই কথা। তাদের ধনুক সোনা বা রূপা দিয়ে মোড়া, তাদের তীরও খুব সুন্দর এবং এমন ভাবে পালকযুক্ত যে অসামান্য দেখতে। তাদের কটিদেশে রয়েছে ছোরা বা রণকুঠার যার হাতল ও শেষ অংশ সোনা বা রূপার তৈরি। এরপর বন্দুকধারীদের কথা। এরা শক্ত পোশাক পরিহিত এবং সশস্ত্র। এর পর মুরদের কথাও বলতে হয়। তারাও রাজার সৈন্যদলে ঢাল-বল্লম, তুরস্কের ধনুক, অনেক বোমা আর অগ্নিনিক্ষেপক নিয়ে অংশগ্রহণ করে। আমি খুবই বিস্মিত হলাম যে এদের মধ্যে অনেকে এইসব অস্ত্র ব্যবহারে খুবই পারদর্শী।
রাজা অশ্বারূঢ় অবস্থায় প্রাসাদ পরিত্যাগ করেন। সেই অতি পরিচিত অশ্বটির পোশাক শ্বেত-শুভ্র সঙ্গে তার দুটি রাজকীয় ছত্র থাকে। সেটি উজ্জ্বল রক্ত বর্ণের ভেলভেটের উপর নানা মতি মুক্তা খচিত এবং এইসব অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত। যাদের এই হীরা জহরৎ ব্যবহারের অভ্যাস রয়েছে, কোন ধরনের সামগ্রী তাদের মহান নরপতি ধারণ করতে পারেন, কল্পনা করুন। এরপর রয়েছে সমস্ত রাজাগণ ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের আড়ম্বর। এতসব বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। আর আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এরপর রয়েছে সেই অশ্বগুলির এবং তাদের গাত্রবর্মের কথা। তারা ধাতবপাত দিয়ে এমনভাবে আবৃত যে আমি কী যে দেখলাম, বলে বোঝাতে পারব না। সব অশ্ব সম্বন্ধে বলাও দুঃসাধ্য। কারণ একে অপরকে আড়াল করে রাখায় দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই সব কিছু সম্বন্ধে বলার আশা ত্যাগ করাই ভালো। কারণ মাথাটাকে এতবার এদিকওদিক করতে হচ্ছিল যে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আমার অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়ার দশা। এই সবে যে বিপুল ব্যয় হয় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই দেশে ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি। সামন্ত রাজগণও খুবই ঐশ্বর্যশালী। রাজার সামনে একদল হাতি নানা সজ্জায় সজ্জিত হয়ে চলছিল। তাঁর সম্মুখে কুড়িটি অশ্ব সজ্জিত অবস্থায় ছিল। স্বর্ণ ও হীরা জহরৎ খোদিত ছিল অশ্বের সাজ। এই আড়ম্বরের মধ্যেই প্রতিভাত হয় রাজার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা। তাঁর অতি নিকটে একটি পিঞ্জর ছিল, লিনে “কর্পোডিভাইস” উৎসবে যেমন দেখা যায়। মনে হয় এটি তাম্র কিংবা রৌপ্য নির্মিত এবং যথেষ্ট বড়। এটিকে দুইদিকে আটজন করে ষোলজন মানুষ বহন করে নিয়ে যায়। পালা করে আরও অনেককে এটিকে বহন করতে দেখেছি। এর মধ্যে অধিষ্ঠিত রয়েছে সেই বিগ্রহটি যার কথা পূর্বে বলেছি। এদের সঙ্গে নিয়ে পরিদর্শনকালে রাজা তাঁর সেনাদলের দিকে চাইতে চাইতে তাদের অতিক্রম করছিল, দেখলাম। তারাও সেইসময় চিৎকার করতে থাকে। তাদের ঢাল বর্ম বাজাতে থাকে। অশ্বদল হ্রেষা রব করে ওঠে এবং সেই সঙ্গে হস্তীদের বৃংহণ। মনে হয় নগরী বুঝি উল্টে যাবে। পর্বত উপত্যকা এবং সমগ্র ভূমি কামান ও বন্দুকের গর্জনে কম্পিত হয়। বোমা ও আতসবাজী দেখতে সত্যই মনোমুগ্ধকর। প্রকৃতই মনে হয় বুঝি সমস্ত পৃথিবী এখানে একত্রিত হয়েছে।
.
অমরু আর অতীশ নববধূদের নিয়ে অমরুর গৃহে পদার্পণের সময় দিন অবসানের কিছুটা দেরি। তাদের দেখে অমরুর মা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে থাকেন। তার মাথায় কিছুই ঢোকে না। এদের সঙ্গে দুই সুন্দরী যুবতী; একজন তো অসামান্যা রূপসী। এরা কারা? কাদের নিয়ে এল অতীশরা। পুত্রকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না, এসব ব্যাপারে। অতীশই চমকপ্রদ কিছু ঘটাতে পারঙ্গম। পার্থিব বিষয়ে তাঁর পুত্র বিশেষ কিছু বোঝে না। অতীশ তাকে চালনা করে। কিন্তু এরা কারা? অতীশের বয়সী ছেলে এই বয়সের মেয়েদের কোথায় পেল? কোন বাবা মা তাদের সুন্দরী মেয়েদের এদের হাতে ছেড়ে দেবে? অতীশের কথা আলাদা। সে তো রাজা।
-এসব কি অতীশ? তোমরা কোথা থেকে আনলে এদের? আমি এখন কি
করব?
—বাড়িতে চাল আছে?
–তা আছে।
—সবার হয়ে যাবে?
–হবে, কিন্তু তাই কি?
–আনাজ নেই তো?
—কবে থাকে? তুমি এসব কথা না বলে আমাকে সত্যি কথা আগে বলতো?
—আমি আনাজ নিয়ে আসি। আপনি ঘরের বউদের ঘরে তুলুন। চল অমরু। ওরা বাইরে চলে যায়।
অমরুর মা বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মাথা ঘুরতে থাকে। মঞ্জরীর সেবাপরায়ণতার স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে। সে অমরুর মাকে ধরে ফেলে।
তার স্পর্শে যেন যাদু রয়েছে। মঞ্জরীকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন–তুমি কে মা? এত ভালোবাসা কোথায় পেলে? তোমার স্পর্শেই তোমাকে চেনা যায়।
—আমরা আপনার পুত্রবধূ।
–তোমরা ওদের স্ত্রী?
—হ্যাঁ, পশুপতি মন্দিরের পুরোহিত গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি নিজে বিগ্রহের সামনে ওঁদের দুজনার সঙ্গে আমাদের বিবাহ দিয়েছেন।
-এ যে আমার স্বপ্নের অতীত। কিন্তু কোথায় রাখব তোমাদের?
—খুব ভালো আছি তো? আমরা ততক্ষণে বরং রান্নার ব্যবস্থা করি।
–না, আজকে তোমরা কিছু করতে পারবে না। তোমার নাম কি?
—মঞ্জরী।
—আর তোমার? তুমি খুব লাজুক, মায়ের কাছে লজ্জা পেতে হয়?
এতক্ষণে শ্রীমতীর মনে যা ঝড় তুলতে গিয়েও পারোনি, এবারে তার বাঁধ ভাঙল। তার নিজের মাকে বারবার মনে পড়ছিল। ইনি যেন সেই মা। সে কান্নায় তাঁর বুক ভেঙে পড়ে।
-আহা বাছা, বুকে এত কান্না চেপে ছিলে? আর কেঁদোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।
মঞ্জরী বলে—এর নাম শ্রীমতী। আপনার পছন্দ হয়েছে?
–সে কি! পছন্দ হবে না? তুমি একথা বললে কেন?
–ও আপনার কাছে সব সময় থাকবে। মনে হয় আমি আসব যাব।
-ও।
তিনি শ্রীমতীর মুখখানা তুলে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। এত রূপ। ছেলেটা একে রাখবে কোথায়? কি খেতে দেবে?
মঞ্জরীকে নিজের মেয়ে ভেবে তিনি বলেন—পূজারী বিবেচনা করে এ কাজ করেছেন তো?
—কোনো ভুল করেননি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
—আমার মনে হচ্ছে এ অতীশের ঘরে গেলে খুবই সুখে থাকত।
এতক্ষণে শ্রীমতী বলে—না মা, আমি আপনার কাছে থাকতে এসেছি। মঞ্জরী খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাই দেখে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। বলেন—তুই গত জন্মে আমার মেয়ে ছিলি। আমার কোলে বস।
–না মা, কোলে বসলে ব্যথা পাবেন। বরং আপনার বুকে মাথা রাখি। মা, আপনার পুত্রবধূটি অত্যন্ত জ্ঞানবতী। ওর জ্ঞান, ওর বিদ্যাবুদ্ধি, ওর রূপকে ছাড়িয়ে যায়। আমরা দুজনা একসঙ্গেই থাকতাম। তবু আমি ওকে মনে মনে ভয় পাই। অথচ ও আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটই হবে।
মা বলেন—এইটুকু মেয়ের আর কত বুদ্ধি হবে। আমাকে ওসব বুদ্ধিটুদ্ধির কথা বলিস না। একজনের বুদ্ধি দেখে দেখে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। আর একটা বুদ্ধি এলে আমি ঘর ছেড়ে পালাব।
এতক্ষণে শ্রীমতীও হেসে ফেলে। তার হাসির আওয়াজ মায়ের মনে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। এত মিষ্টি কণ্ঠস্বর? এই দেবকন্যাকে কি ভাবে পেল ছেলেটা? ক্রিয়াশক্তির আশীর্বাদ নিশ্চয়। তিনি তো সন্ন্যাসী। তিনি সিদ্ধাপুরুষ।
বাইরে একাধিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মা ভাবেন এত লোক কেন? তিনি জানলা দিয়ে দেখেন চার পাঁচটি অশ্ব। সবজী আনাজ নামানো হচ্ছে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে।
অতীশ এসে বলে—দুই চারদিনের ব্যবস্থা করলাম। এখন অমরু একটু সামলে নেওয়ার অবকাশ পাবে।
মায়ের মুখ একটু গম্ভীর। অমরু বলে—কিছুতেই শুনল না। তবে কথা দিয়েছে আর এসবে যাবে না।
অতীশ বলে—কাল সকালে আমাদের যাওয়ার পর্ব রয়েছে। ওর সময় কোথায়? আমরা চলে যাওয়ার পরে ওরা দুজনে সব গুছিয়ে নেবে। এখন রাতে শোয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
মা বলেন—আমি আমার দুই মেয়েকে দুই পাশে নিয়ে শোব। তোমরা তোমাদের ব্যবস্থা করে নাও।
—দুপাশে নিয়ে শোবার মতো জায়গা কোথায়?
—মেঝেতে। আমি জানি আমার এক কন্যা এরপর থেকে সোনার পালঙ্কে শোবে। এক রাতের জন্য কোনো অসুবিধা হবে না। পাশে মা থাকলে যে কোনো শয্যা সোনার পালঙ্কের চেয়েও ভালো।
অতীশ বলে—সোনার পালঙ্ক হলেই যদি সুখের হত অমরু আমার চেয়ে সহস্রগুণ শান্তিতে থাকে কি করে? আমার মা ছাড়া যতটুকু শাস্তি আমি পাই অমরু আর আপনার কাছে এসে। আমরা রাজসভার সম্মানীয় সদস্য। আমি বলতে গেলে রাজার ভৃত্য।
অমরু বলে—খুব হয়েছে। এবারে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করলে হয় না?
.
পরদিন ভোর বেলায় অমরুর প্রতিবেশীদের নিদ্রা ভাঙল, লোকজনের কথাবার্তা, আর অশ্বখুরের আওয়াজে। তারা দেখে কবি অমরুর বাড়ির সামনে কারা এসে উপস্থিত হয়েছে। আটজন সশস্ত্র অশ্বারোহী সুসজ্জিত অশ্বে উপবিষ্ট। দুইটি জমকালো পোশাকে আবৃত হস্তী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের স্তম্ভ আন্দোলিত করছে। তাদের পিঠে হাওদা।
মঞ্জরী বাইরে এসে এসব দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। সে কাঁপা হাতে শ্রীমতীকে চেপে ধরে।
শ্রীমতী হেসে বলে—খুব আনন্দ হচ্ছে দেখে। তোমার মুখ বরাবরই দেখতে কচি কচি। খুব ভালো হয়েছে।
অমরুর মা মঞ্জরীর হাত ধরে এগিয়ে আসেন। অতীশের নির্দেশে একটি হাতিকে মাহুত বসতে বলে। অতীশ নববধূসহ তাঁকে প্রণাম করে। অমরুর সঙ্গে আলিঙ্গাবদ্ধ হয়। মঞ্জরী অমরুর মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। যেন পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুরালয়ে যাচ্ছে। তার অশ্রু দেখে বাকি দুইজনের আঁখিও অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
অতীশের অশ্বারোহীরা সামনে চলে তারপর দুই হাতি। একটির হাওদা শূন্য। সবার শেষে সৈন্যদল। ধীরে ধীরে তারা পথের আড়ালে অদৃশ্য হয়। শ্রীমতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবারে শুধু স্বামী আর তার মা। সে এই পরিবারের বধূ। স্বামীকে সে প্রথম দিন দেখেই তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। মনে হয়েছিল কী যেন রয়েছে এর মধ্যে। সবার মতো ঠিক নয়। যখন তার পরিচয় পেল, তখন দেবদাসী হয়েও নিজের মন নিবেদন করে ফেলেছিল। কোনো ঘরের গৃহবধূ হয়ে যাওয়ার কল্পনা সে কখনো করেনি। কারণ সেটা ছিল অবাস্তব কল্পনা। আজ এই মুহূর্তে নিজের গর্বধারিণীর কথা বারবার মনে পড়ছে। সেই করাল দুর্ভিক্ষের গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া তার পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি। তিনি কন্যার রূপ সম্বন্ধে বরাবর সচেতন ছিলেন। কিন্তু সে যে রূপসী সেই সম্বন্ধে তাকে সচেতন হয়ে উঠতে দেননি। তবে সে কি করে যেন বুঝতে পারত।
যে কোনো বয়সের পুরুষ তর দিকে চাইলে তাদের দৃষ্টি কেমন কোমল হয়ে যেত। এমনকি মেয়েরাও তাকে বারবার দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত। এখন বুঝতে পারে কয়েক জনের চোখেমুখে ঈর্ষা ফুটে উঠত তাদের মধ্যে বাসন্তীর কথা মনে পড়ে। মা চেয়েছিলেন তার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। নিজের বুদ্ধি এবং সাধ্যমতো তিনি যা পেরেছেন তাই করেছেন। এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে তিনি যা করেছেন তার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারত না। তাঁর প্রচেষ্টায় পশুপতির আশীর্বাদ ছিল। একবার গ্রামে যাওয়া যায় না? একবার অন্তত গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসত? ঋষ্যকূট পর্বতের পেছনে সেই দিগন্তবিস্তৃত চাষের জমির পাশে নিরিবিলি ছায়াচ্ছন্ন ছোট্ট গ্রামটি—নুটি। এত ছোট নাম কেউ বোধহয় শোনেনি। মঞ্জরী নামটা শুনে হেসে ফেলেছিল। তার নিজের হাসি পায়নি কখনো। জন্ম থেকে এই নাম শুনেছে বলে এর চেয়ে স্বাভাবিক কোনো নাম সে কল্পনা করতে পারে না।
সেই রাতে স্বামীর সঙ্গে তার রাত্রিবাসের কথা। দিন যত গড়িয়ে চলে ততই তার মধ্যে কেমন একটা ভাব। এ কি আনন্দ, না ভয়? স্বামী কি তাকে পছন্দ করেছেন? তিনি তো শুধু রূপ দেখবেন না। শাশুড়ি মা বলেছেন—ওর জন্য কোনো চিন্তা নেই। সময়মতো ওকে খেতে দিও। যত্ন করে দিলে মনে মনে ওর খুব আনন্দ হয়। আমি অনেক কিছু ভুলে যাই আজকাল।
সে উত্তরে বলেছিল—আপনি কিছু ভাববেন না মা। আপনি নিশ্চিন্ত হোন। শেষে একসময় খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। মা শুতে যান। শ্রীমতী নিজের ঘরে এসে দেখে প্রদীপের নীচে অমরু কি যেন পড়ছে। তার পায়ের শব্দে মুখ ফেরায়। শ্রীমতী আরও কাছে গেলে অমরু তার হাত ধরে পাশে বসায়। শ্রীমতীর মনে হল জীবনে এই প্রথম এক অনাস্বাদিত কিছুর স্বাদ পেল।
-তোমার নামটি খুব সুন্দর।
শ্রীমতী কি বলবে ভেবে পায় না।
অমরু তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে—তোমাকে এই মুহূর্তে প্রথম ভালোভাবে দেখছি। তুমি এত সুন্দর আমি কল্পনাই করিনি।
শ্রীমতীর সব ভয় মুহূর্তে মিলিয়ে যায়।
সে বলে—না হলে কি হত?
—কি আবার হত?
—আমাকে অপছন্দ হত।
—তাই হয় নাকি? শুনেছি তুমি এত বুদ্ধিমতী এটুকু জানো না!
-না।
—জান, তোমার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। –যাঃ, সেই ইচ্ছে করতে হয় নাকি?
–কেন, ক্ষতি কি?
–তোমার আসল কাজ কে করবে, যে কাজে তোমার খ্যাতি।
–ও, অবশ্যই সেই কাজ করে যাব। নাহলে আমার জীবনই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
–তোমার এই কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। একটা কথা বলব?
–বলবে না কেন শ্রীমতী, সব কথাই বলবে।
স্বামীর মুখে শ্রীমতী নামটি উচ্চারিত হতে তার হৃদয়ে দোলা লাগে। এত মিষ্টি করে কেউ ডাকতে পারে?
-না থাক।
—থাকবে কেন? বল। এখন থেকে থাকতে শুরু করলে জীবনে অনেক কিছু থেকে যাবে।
–আমি ভাবতাম কবিরা শুধু লেখনী হাতে নেয় বলে তাদের হাত নরম হয় ৷ কিন্তু তোমার হাত এত শক্ত, তুমিও বলিষ্ঠ।
—মন খারাপ হয়ে গেল?
–না, খুব আনন্দ হয়েছে বলেই তো বলছি।
—আমার বাবার কঠোর নির্দেশ ছিল শরীর চর্চা আর স্বাস্থ্যবান হওয়া জীবনে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাঁর ধারণা কালিদাস অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। নইলে এত সুন্দর কাব্য লিখতে পারতেন না। তাই—
—আর বলতে হবে না। বাবা ঠিক বলেছেন তোমাকে।
—কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।
–কি কথা।
—তুমি এত রূপবতী আমার এই গরিব সংসারে-
শ্রীমতী হাত দিয়ে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বলে ওঠে—তোমার এই কথায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বোঝোনা কেন, ঈশ্বর আমাকে তোমার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আমার চেয়ে ভাগ্যবতী কে?
এবারে অমরু স্ত্রীকে নির্দ্বিধায় কাছে টেনে নেয়।
.
পরদিন সূর্যোদয় উভয়ের জীবনে নিয়ে এল এক নতুন প্রভাত। সেই সঙ্গে প্রাসাদ থেকে লোক এসে জানিয়ে গেল, কবিকে রাজা স্মরণ করেছেন।
একদিনের মধ্যে সমগ্র বিজয়নগরে রটে গিয়েছে যে কবি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু সামন্তরাজ অতীশ বিবাহ করেছেন। তাঁরা বিবাহ করেছেন পশুপতি মন্দিরের দুই দেবদাসীকে। অনেকের ভ্রূকুঞ্চিত হল। তবে সবাই দুই কন্যার রূপ লাবণ্যের কথাও শুনল। সব চেয়ে বিস্মিত হল এই সবের মূল উদ্যোগীর পরিচয় জেনে। মন্দিরের মুখ্য পুরোহিত এবং স্বয়ং রাজার গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি স্বহস্তে বিগ্রহকে সাক্ষী রেখে এদের বিবাহ দিয়েছেন। রাজার কানেও সংবাদ পৌঁছেছে। পাত্রীদের বিজয়নগরের কেউ চাক্ষুস দেখেনি। তবে কবি অমরুর প্রতিবেশীরা অবগুণ্ঠিতা অবস্থাতেই যতটুকু দেখেছে,তাতেই মোহিত হয়েছে। তাদের মুগ্ধতার কথাও দশগুণ বাড়িয়ে রাজার কাছে নিবদেন করা হয়েছে। সামন্তরাজের কথা ভিন্ন, কিন্তু যৌবন দেখা দিতে না দিতে অপরিপক্ক মস্তিষ্কে এক কাব্য লিখে অমরু এমন কি যোগ্যতা অর্জন করলেন যে এক রূপবতীকে তার বধূ করা হল? সন্ন্যাসীরা সংসারের কতটুকু বোঝেন? ওই রূপতো অনাহারে দুদিনেই শুকিয়ে যাবে।
রাজসভায় রওনা হওয়ার আগে এতদিন মাকে প্রণাম করে যেত অমরু। আজ
যাওয়ার সময় সামনে মাকে না দেখে ডাকে সে।
মা বলেন—আজ থেকে আমি দাঁড়াব না। প্রণাম করতে হলে ভেতরে আয়। না করলেও চলে, শ্রীমতী রয়েছে।
অমরু মাকে প্রণাম করে। বিদায়ের সময় শ্রীমতী তাকে দাঁড় করিয়ে প্রণাম করে।
–এ আবার কি?
—এটাই প্রথা। আমি আমার মাকে দেখেছি।
—আমি কি করব?
শ্রীমতী লজ্জায় হেসে ফেলে বলে—আমি কি জানি?
—বুঝেছি। ফিরে এসে।
এত পুলকিত অন্তরে বহুদিন অমরু বাড়ির বাইরে পা রাখেনি
রাজসভায় প্রবেশ করলে একজন পরিচিত কর্মচারি তাকে এসে বলে—রাজা বিশ্রামালয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
কবি অমরু একটু বিস্মিত হয়। এমন সাধারণত হয় না। তবু সে সভাসংলগ্ন বিশ্রামকক্ষে গিয়ে দেখে স্বয়ং রাজার পাশে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিও উপস্থিত। কেন যেন সামান্য একটু আশঙ্কার ছায়াপাত ঘটল তার মনে।
রাজা হেসে বলেন—আসুন কবি।
বয়সে অনেক ছোট হলেও রাজা এইভাবে তাকে বরাবর সম্বোধন করে থাকেন। সম্মানও দেন যথারীতি। তিনি যেকোনো গুণের সমাদর করে থাকেন। কারণ তিনিও বহু গুণের অধিকারী। হস্তীর দক্ষ মাহুত তিনি। বন্য হস্তীকে কিভাবে বশ করতে হয়, তিনি জানেন। বিদেশিদের কাছে বেয়াদপ নতুন অশ্বকে শান্ত করার কৌশল শিখেছেন। প্রতিদিন তিনি শ্রেষ্ঠ কুস্তীগিরের সঙ্গে কুস্তী লড়েন। দক্ষ তীরন্দাজ তিনি। কিছু মুরকে রাজ্যে রেখে দক্ষ বন্দুকধারী ও গোলন্দাজ হয়ে উঠেছেন। তেমনি তিনি সঙ্গীতপ্রিয় এবং সর্বোপরি সাহিত্যরসিক।
—বসুন।
গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করে রাজাকে নমস্কার করে সে আসন গ্রহণ করে।
রাজা বলেন—শুনুন কবি, গতকাল আমি যখন শুনলাম, গুরুদেব এক অসামান্য সুন্দরী দেবদাসীর সঙ্গে আপনার বিবাহ দিয়েছেন এবং দিয়েছেন আমার অজ্ঞাতে তখন আমি প্রায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। তারপর ভাবলাম, আপনারা উভয়ে যখন এতে জড়িত তখন গুরুদেবের কাছে ভালোভাবে শুনে নেব। কারণ একটা অলিখিত নিয়ম রয়েছে দেবদাসী হলে তো কথাই নেই, এমনকি সাম্রাজ্যের কোথাও কোনো রূপবতী কন্যার সন্ধান পেলে তার স্থান আমার অন্তঃপুরে।
রাজা একটু থেমে তার দিকে দৃষ্টি ফেলেন। গুরুদেব নির্বাক। অমরুর বুক যেন কেঁপে ওঠে। তেমন কিছু ঘটার আগে সে শ্রীমতীকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেবে।
রাজা বলেন—তারপর গুরুদেব বোঝালেন আপনার স্ত্রী হয়তো সুন্দরী কিন্তু তিনি আমারই এক সম্মানীয় প্রজার স্ত্রী। সম্মানীয় ব্যক্তিরা যদি নির্ভয়ে বসবাস করতে না পারেন, তাহলে এদেশ থেকে সব গুণী ব্যক্তিরা চলে যাবেন। তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তো আমারই। সুতরাং কারও সঙ্গে কারও সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর আমার আর কোনো অধিকার থাকে না। তিনিও আমার শ্রদ্ধার পাত্রী। ঠিক কিনা?
—মহারাজ, এতদিন আমি আপনার গুণমুগ্ধ ছিলাম, কিন্তু আজ থেকে আপনার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জন্মালো।
–এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।
এতক্ষণ ক্রিয়াশক্তির মুখে বিন্দুমাত্র হাসি ছিল না। এখন হাসি ফুটল। বললেন—সব ঈশ্বরের কৃপা। অতীশকে ডেকে পাঠাও রাজা।
-হ্যাঁ, লোক পাঠাচ্ছি। তার আগে একটা কথা বলতে চাই।
-বল।
-কবিকে আসতে দেখি, যেতে দেখি। পোশাক পরিচ্ছদ অনেক সময় মলিনও দেখি। এখন আবার বিবাহ করলেন। চলবে কি করে?
ক্রিয়াশক্তি বলেন—সেকথা তো ভাবিনি।
–কবি, আপনার কিভাবে চলে?
অমরু আমতা আমতো করে নীরব হয়ে যায়।
—বুঝেছি। চলুন সভায় গিয়ে বসি।
তাঁরা সভায় গেলে রাজা স্বর্ণসিংহাসনে বসে সভাসদদের দিকে তাকিয়ে বলেন—আপনারা জানেন কি যে আমাদের কবি বিবাহ করেছেন?
অনেকে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—মহারাজা, রাজধানীর কারও জানতে বাকি নেই। আমরা ভাবছিলাম এত বড় মহানগরীর কাক চিল পর্যন্ত কি করে জেনে ফেলেছে।
মহারাজা হেসে বলেন—তারাই তো আগে জানে। আর তার উত্তর তো খুব সোজা। উনি অমরুশতকের কবি।
একজন বলে—শুনলাম যোগ্য স্ত্রী পেয়েছেন কবি।
রাজা হেসে বলেন—সোজা কথা সোজা ভাষায় বলুন। কবির স্ত্রী অত্যন্ত রূপবতী। সেটা তো আরও আনন্দের। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে কবি এই রাজ্যের সভাকবি। তিনি নিয়মিতোভাবে যথাযোগ্য সম্মান-ভাতা পাবেন। এতে উনি নিশ্চিন্তে কাব্যচর্চা করতে পারবেন। কবির আর্থিক বিষয়টা এতদিন আমার মাথায় আসেনি, এতেই আমার অযোগ্যতার প্রমাণ মেলে।
ক্রিয়াশক্তি বলেন—সেকথা ঠিক নয়। আসলে এতদিন একথা চিন্তা করার প্রশ্ন ওঠেনি। ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তুমি ব্যবস্থা নিলে, এতেই তোমার যোগ্যতা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হল।
অমরু যেন স্বপ্ন দেখছে। ভাবে, কখন বাড়ি গিয়ে শ্রীমতী আর মাকে একথা বলবে। মা নিশ্চয়ই বাবার কথা ভেবে গোপনে অশ্রুমোচন করবেন। আর শ্রীমতী? তার নিশ্চয়ই খুবই আনন্দ হবে।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলোচনার পরে সভার কাজ সেদিনের সভাকবির সম্মানের জন্য শেষ হয়।
অমরু বাড়ি ফিরে মা এবং স্ত্রীকে কিছু বলার আগেই একজন এসে বলে—মহারাজের আদেশে আমি আপনার বাড়িতে রোজ আসব। কোনো কিছু করার থাকলে করে দিয়ে যাব।
অমরুর মনে পড়ল যে এমন একটা কথা হয়েছিল বটে। কিন্তু তার অর্থ তখন বোঝেনি। এখন বুঝতে পেরে সংকুচিত হল। বলল- না না। কি এমন কাজ।
-দোকান থেকে কিছু এনে দিতে হবে? আনাজপত্র যদি দরকার হয়।
—না না, কিছুর দরকার নেই।
—আমি কাল সকালে আবার আসব।
—ঠিক আছে।
সে চলে যায় ৷
মা জিজ্ঞাসা করেন—এসব কি অমরু?
—বুঝেছি। আমাকে যাতে সংসারের কোনো কাজ করতে না হয় তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন রাজা।
– হঠাৎ !
অমরু হেসে বলেন—মা তোমার ছেলে আজ থেকে যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সভাকবি।
শ্রীমতীর বুক গর্বে ভরে ওঠে। আর আশ্চর্য, মা পুত্রকে কাছে না টেনে, পুত্রবধূকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন—আমার ঘরের লক্ষ্মী আসতেই উন্নতি শুরু হল। এবারে নিশ্চিন্তে মরতে পারব।
—আজকের দিনে একি কথা বলছ মা?
—ঠিক বলেছি। আজ যে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। গৃহে লক্ষ্মী এল, তোর দুর্ভাবনা গেল। এর চেয়ে মৃত্যুর আর সুসময় কি হতে পারে?
শ্রীমতী মুখ ভার করে বলে—মা, গুরুদেব বোধহয় ভুল করেছেন। তিনি মাতা-পুত্রের মধ্যে বিচ্ছেদ এনে দিচ্ছেন।
মা শ্রীমতীর মুখ চুম্বন করে বলেন—বিচ্ছেদ নয় মা। এটাই সংসারের পরিপূর্ণতা, এটাই সৃষ্টির প্রবাহমানতা।
.
একবার রাজার নিকটতম কোনো এক আত্মীয় দ্বারা তাঁকে হত্যার মরিয়া চেষ্টা করা হয়। আবদার রজ্জাক বলেন আত্মীয়টি ছিল তাঁর এক ভ্রাতা। নুনিজ বলেন ভ্রাতুষ্পুত্র। আবদার রজ্জাকের কাহিনী নিঃসন্দেহে অধিকতর নির্ভরযোগ্য। কারণ তিনি ছিলেন সমসাময়িক সাক্ষী। নিজের বর্ণিত কাহিনী তাঁর লিখিত ঘটনাপঞ্জীর একেবারে শেষ খণ্ডে স্থান পেয়েছে। আবদার রজ্জাক ছিলেন কালিকট ও বিজয় নগরের জন্য পারস্যদেশ থেকে প্রেরিত রাষ্ট্রদূত। তাঁর বর্ণনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে নির্দিষ্টভাবে তারিখ দেওয়া রয়েছে।
“সেই সময়ে কাহিনীর বর্ণনাকার সাময়িকভাবে তখনো কালিকটে অবস্থান করছিলেন, যখন বিজয়নগর মহানগরীতে এক অভূতপূর্ব এবং অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল—
“মহারাজার ভ্রাতা তাঁর নিজের বসবাসের জন্য এক নতুন অট্টালিকা নিৰ্মাণ করে সেখানে রাজা এবং সাম্রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিবর্গদের আমন্ত্রণ জানালেন। কাফেরদের মধ্যে একটা প্রচলিত রীতি রয়েছে যে একে অপরের সম্মুখে ভোজন করে না। অতিথি বর্গ যারা এসেছিল তারা একটি কক্ষে সমবেত হয়। কিছুক্ষণ পর পর রাজভ্রাতা কিংবা তার প্রেরিত অন্য কেউ গণ্যমান্যদের এক এক করে ডেকে নিয়ে গেল। নগরে যত ভেরী দামামা, ঢাক, শিঙা ইত্যাদি ছিল সব আনা হয়েছিল ওই নতুন অট্টালিকায়। সেগুলি একযোগে প্রচণ্ডভাবে বাজতে শুরু করল। আপ্যায়িতেরা যখন একে একে ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তখন একটি গুপ্তস্থান থেকে ঘাতক প্রত্যেকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে বিদ্ধ করে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে লাগল। তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ অপসারিত করে তারা পরের অতিথিকে ডাকতে পাঠায়। এইভাবে সাম্রাজ্যের অনেক উচ্চশ্রেণীর এবং রাজার অতিবিশ্বস্ত ব্যক্তিগণ একে একে অদৃশ্য হলেন। এই সব রণভেরী, দামামা শিঙা ইত্যাদির কর্ণভেদী শব্দে কি ঘটছে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। রাজভ্রাতা তখন তার রক্তাপ্লুত বাসভবন থেকে রাজপ্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে প্রহরীদের সে মিষ্ট ও মন গলানো কথায় তার ভবনে ভোজনের আমন্ত্রণ জানায়। তারাও রাজভ্রাতার আমন্ত্রণে বিমোহিত হয়ে সেখানে গেলে তাদেরও একই পরিণতি হল। এইভাবে প্রতিরোধ এবং প্রহরার কিছুই অবশিষ্ট রইল না। দুরাত্মা তখন তীক্ষ্ণ অস্ত্র সুপারীপূর্ণ একটি থালায় রেখে মহারাজের সামনে এসে সবিনয়ে বলে যে সবাই প্রস্তুত হয়ে রাজকীয় উপস্থিতির জন্য প্রতীক্ষা করছে।
.
“কথায় বলে বিখ্যাত ব্যক্তিগণ স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকেন। রাজার কথায় তার প্রতিফলন ঘটল। তিনি বললেন, আজ আমার শরীর ভালো নেই।”
.
“রাজাকে এই অপ্রকৃতিস্থ ভ্রাতা প্রলুব্ধ করতে অপারগ হয়ে তার তীক্ষ্ণ অস্ত্রটি টেনে নিয়ে রাজার দেহের দুই এক স্থানে প্রচণ্ড আঘাত করায় তিনি সিংহাসনের পেছনে পড়ে যান। এই বিশ্বাসঘাতক রাজাকে মৃত ভেবে তার একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে রাজার শিরশ্ছেদ করতে বলে সেখানে রেখে গেল। কক্ষ থেকে বাইরে এসে সবাইকে ডেকে বলল—আমি রাজাকে হত্যা করেছি, হত্যা করেছি ব্রাহ্মণদের। মন্ত্রী আর অমাত্যরাও নিহত হয়েছে। এখন আমিই হলাম রাজা।”
ইতিমধ্যে তার অনুচর রাজার মুণ্ড কাটার উদ্দেশ্যে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু রাজা যে সিংহাসনের পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন সেই অসনটিকে চেপে ধরে অনুচরটির বুকে এত জোরে আঘাত করলেন যে সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। রাজার দেহরক্ষীদের একজন এতক্ষণ সব কাণ্ডকারখানা দেখে এককোণে লুকিয়ে ছিল। রাজা তার সাহায্যে ঘাতককে হত্যা করে অন্তঃপুরে পথ ধরে প্রাসাদের বাইরে চলে গেলেন।
তাঁর ভ্রাতা তখনও সভাকক্ষের সোপান শ্রেণীর উপর দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার কাছে তাকে রাজা বলে স্বীকৃতি দিতে আবেদন জানাচ্ছিল। সেই সময় রাজা চিৎকার করে উঠলেন—আমি জীবিত। আমি সুস্থ আর নিরাপদ। ওই দুরাত্মাকে তোমরা ধর।
সমস্ত জনতা একসঙ্গে রাজার অপরাধী ভায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করল।
“মন্ত্রীদের মধ্যে শুধু একজন রক্ষা পেয়েছিল, সে হল মন্ত্রী দানায়িক। সে এইসব দুঃখজনক ঘটনার আগেই সিংহল সীমান্তে ভ্রমণে গিয়েছিল। রাজা তাকে এখানকার সদ্য সমাপ্ত ঘটনার কথা সবিস্তারে জানিয়ে দ্রুত দেশে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একজন দূত পাঠালেন। এই চক্রান্তে যারা কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হল, চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হল, জীবন্ত দগ্ধ করা হল, এমনকি তাদের পরিবারবর্গকেও নির্বংশ করা হল। যে লোকটি নিমন্ত্রণপত্রগুলি এনেছিল, তাকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হল।….”
রাজধানী স্তব্ধ। রাজপথ ফাঁকা ফাঁকা। অমরু রাজপ্রাসাদে গিয়ে পরিচিত কোনো মুখ না দেখতে পেয়ে একটি আসনে বসে পড়ে মাথাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে রইল। একজন প্রহরী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার পাশে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল।
সে হঠাৎ বলে উঠল-আমরা মূর্খ, আমরা ভীরু।
—একথা বলছ কেন?
—ওই দুরাত্মা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে আমাদের ছয় জনকে মেরে ফেলেছে। আমরা যেতে চাইনি। আচমকা ওদের তরবারি ঘুরিয়ে ঢুকতে দেখে এক কোণে লুকিয়ে ছিলাম। রাজার ভাইকে দেখে বুঝে উঠতে পারিনি, ঠিক কি ঘটতে চলেছে। সর্বনাশ হয়ে যেত।
–তোমরা নিজেদের কাজ করনি। আমার ধারণা এই অনুশোচনা তোমাদের জীবনেও যাবে না।
—আমরা মহারাজাকে বলেছিলাম, আমাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে। উনি দিলেন না। বললেন, আমরা মূর্খ হলেও বিশ্বাসঘাতক নই।
—উনি কোথায়?
—নিজের কক্ষে শয্যাশায়ী।
—দেখতে যেতে পারি?
–আপনি বসুন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখি।
একটু পরে তার সঙ্গে একজন নারী প্রহরী এল। অমরু দেখে প্রাসাদের চতুর্দিকে বহু প্রহরীকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
একজন নারী প্রহরী এসে তাকে রাজার কক্ষে নিয়ে গেল। সে রাজাকে দেখল। তাঁর মুখমণ্ডল যন্ত্রণাকাতর। তিনি তাকে শয্যার পাশে যেতে বললেন।
অমরু তাঁর কাছে যেতেই তিনি বলেন—আমার কেউ নেই কবি। সবাই চলে গিয়েছে। আমি একা।
অমরু প্রথমেই বলে ফেলে—অতীশ? সেও নেই।
—সে আছে। আর রয়েছে দানায়িক। দুজনকেই খবর পাঠিয়েছি। দানায়িক অভিজ্ঞ, কিন্তু আসতে দেরি হবে। অতীশ তো তরুণ, এসব তার জানা নেই। তবে বুদ্ধিমান আর কর্মঠ।
—মহারাজা, আপনাকে আর কি বলব। ধীরে ধীরে আবার গড়ে উঠবে সব। তবে যাঁরা গেলেন, তাঁরা আর কোনোদিন ফিরবেন না। সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করতেন আমাকে স্নেহ করতেন। এই ক্ষত নিয়ে দেশকে চলতে হবে। ক্ষত নিশ্চয় শুকিয়ে যাবে একদিন। সবাই যায়, কিন্তু একসঙ্গে এভাবে—ভাবতে পারছি না।
—কিন্তু, আমাকে ওই পশুটা বিশ্রীভাবে আঘাত করেছে। যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছি। আমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। আমার দুইজন চিকিৎসক আয়ুর্বেদজ্ঞ বলেছে, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের হাবভাব দেখলে যেন ভরসা হয় না।
আরও কিছুক্ষণ রাজার পাশে বসে যতটা পারে তাঁকে উৎসাহিত করে কবি। কারণ সে বুঝলো রাজার বহু রানীর মধ্যে প্রধানা মাল্লা দেবীও তাঁর মনে উৎসাহের সঞ্চার করতে পারল না। তাকেও এখানে দেখা যাচ্ছে না। শুধু একজন সেবাদাসী কক্ষের এক কোণে উপস্থিত রয়েছে।
—মহারাজা আপনাকে শুশ্রূষা করার জন্য কেউ নেই?
–একজন আছে না?
—একজনকে দেখছি। সে কি পারবে?
–জানি না। ওসব নিয়ে ভাববেন না কবি। আমি শুধু সুস্থ হয়ে উঠতে চাই। আমার অনেক কাজ।
–আমি অতীশকে আসতে বলব?
—খবর গিয়েছে।
–আমি তবে একটু ঘুরে আসি?
–আপনি আবার আসবেন কেন? গৃহে যান।
-অতীশ না আসা অবধি আমি এই প্রাসাদেই থাকব। আপনি বাধা দেবেন না মহারাজ।
—আপনার কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে। আচ্ছা, নগরের মানুষেরা কি বলছে?
—নগর জনশূন্য বলতে গেলে। তারা শোকে মুহ্যমান।
—আমাকে তারা তবে একটু ভালোবাসে। শুনে কত ভালো লাগছে।
–আপনি তাদের প্রাণ। আমি আসি মহারাজ।
রাজা অনুমতি দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
.
ঘরে ফিরে অমরু মা আর স্ত্রীকে রাজার অবস্থার কথা বলে। বলে, তাঁর অসীম সহ্যশক্তির কথা আমরা বলাবলি করি, আজ স্বচক্ষে দেখলাম। অতখানি আঘাত নিয়ে সাধারণ মানুষ সচেতন থাকতে পারে না। রাজা নিশ্চয় নিজেকে স্বহস্তে যন্ত্রণা দিয়ে এই ক্ষমতা অর্জন করেছেন।
কিন্তু আজ কবির মনে হয়েছে যন্ত্রণা অবশ্যই রয়েছে, তবে যন্ত্রণার চেয়েও তাঁকে অস্থির করেছে রাজ্যের পরিস্থিতির কথা ভেবে। তিনি নিশ্চয় বিজয়পুরের সুলতানের কথা ভাবছেন। এই টালমাটাল অবস্থায় তিনি বিজয়নগর আক্রমণ করতে পারেন। তাহলে সামলানো যাবে না। যে উদ্দেশ্যে দেড় দুই শতাব্দী পূর্বে বিজয়নগরের সৃষ্টি হয়েছিল, তাই বিফলে যাবে।
মা শুনে কেঁদে ফেলেন। অমরু বলে—আমি আবার প্রাসাদে যাব। অতীশকে আসতে বলা হয়েছে।
নিজের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী আসে। তাকে হাওয়া করতে থাকে। অমরু হাত থেকে পাখা কেড়ে নিয়ে তাকে পাশে বসায়।
—অমন করতে নেই। তুমি একটু বিশ্রাম করে খেয়ে নাও।
–তার জন্যে হাওয়া করতে হবে না। তুমি কাছে থাকলেই যথেষ্ট।
–তা নয়। তুমি সুস্থ থাকলে, তুমি কাছে থাকলে আমার আর কিছু চাই না।
—ঠিক আছে, দুজনের কথাই ঠিক।
এবারে শ্রীমতী অমরুর কোল ঘেঁষে বসে। অমরু একটু অবাক হয়।
—একটা কথা বলব?
–সহস্র কথা বল, আমি শুনব। আমার তো তাই আকাঙ্খা। তোমার কণ্ঠস্বর কত মিষ্টি তুমি জানই না।
–শোন আমি অন্য একটা কথা বলতে চাই।
-বল।
–তুমি তো জান আমি একটু চিকিৎসা করতে জানি।
—জান মানে? গুরুদেব তো তোমার খুব প্রশংসা করেছেন। তোমার মধ্যে নাকি আলাদা একটা কিছু রয়েছে—
-যাক ওটা গুরুদেবের স্নেহপ্রসূত। আমি মহারাজাকে একটু দেখতে চাই।
—তুমি!
–কেন, অন্যায় হবে?
অমরু একটু ভেবে নিয়ে বলে—অন্যায় কি করে বলি? স্বচক্ষে তাঁকে দেখে এলাম। আমার কষ্ট হচ্ছিল।
-তাহলে মায়ের অনুমতি চেয়ে নাও। দাঁড়াও তুমি আগে খেয়ে নাও।
খেয়ে নিয়ে অমরু বলে, তুমি খেয়েছ তো?
শ্রীমতী হেসে ফেলে।
—ও বুঝেছি। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, তুমি খেয়ে নাও। মা খেয়েছেন তো।
—হ্যাঁ, তাঁকে বেলা বেশি না হতেই খাইয়ে দি। তাতে ওঁর বিশ্রাম ভালো হয়।
অমরু ভাবে, শ্রীমতী রূপে গুণে সরস্বতী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সংসারের এত সব জানল কি করে? প্রতিভাময়ী তো অবশ্যই। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি সেই কথা বলেছেন। তিনি নিজেই ওর চিকিৎসা জ্ঞানে বিস্মিত। সবই যেন ওর করাও। সে ভেবে পায় না একে কিভাবে রাখবে। কালিদাস বিরহ কাব্য লিখেছিলেন। সে কি তাহলে মিলনকাব্য লিখবে? সঙ্গে সঙ্গে তার মন থেকে কে যেন বলে ওঠে, বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে চল। স্ত্রীকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভেবে ভালোবাস।
অমরু স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মা একটু হেসে বলেন—কিসের অনুমতির প্রয়োজন?
দু’জনেই হেসে ফেলে। অমরু বলে—মা, শ্রীমতী রাজাকে একটু দেখতে যেতে চায়।
মা চমকে ওঠেন—রাজাকে? কেন?
–ও তো চিকিৎসাবিদ্যা জানে।
—হ্যা। কিন্তু রাজাকে কেন?
—তিনি খুবই আহত। তুমি তো জানই।
—দেবদাসী সরস্বতীর কথা মনে আছে?
এবারে শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ মা, খুব মনে আছে। কিন্তু এই রাজা সেই রাজা নন্। উনি অসুস্থ, যন্ত্রণাকাতর।
—কিন্তু যখন নিরাময় হয়ে যাবেন?
—তখন আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আমি জানি। মঞ্জরীকে আপনি তো দেখেছেন। তাকে আমি রাজার কক্ষের পাশে দিন রাত থাকার ব্যবস্থা করছি। অমরু একথা শুনে চমকে ওঠে। তার জানা ছিল না শ্রীমতীর এই পরিকল্পনার কথা।
মা একটু চুপ করে থেকে বলেন—আমার মনে হয় আমি আজকাল অনেক কিছু বুঝতে পারি না। বয়সে এমন হয় জানি। তোমরা যা ভালো বুঝবে করবে। রাজার শুভ আমি চাই। তবে অতীশের অনুমতি নিও।
ওরা রাজবাড়িতে যায়। কবি সকালে এসেছিলেন, ওরা দেখেছে। কিন্তু সঙ্গে অবগুণ্ঠিতা একজন নারী।
অমরু বলে—ইনি আমার স্ত্রী। ইনি চিকিৎসকও বটে। রাজাকে দেখতে এসেছেন। প্রহরীরা নির্বাক। অবগুণ্ঠনের মধ্যেও শ্রীমতীর সৌন্দর্য ঢাকা পড়েনি। প্রহরীরা নত হয়ে অভিবাদন জানায়।
অমরু প্রহরীকে প্রশ্ন করে—এখন আপনাদের প্রধান কে?
মহারাজা আপাতত আমাকে নির্বাচন করেছেন, পরে ভেবে দেখবেন।
—অতীশকে আসতে বলা হয়েছে?
—লোক চলে গিয়েছে।
—কিন্তু ওকে আর একটা খবর দেওয়ার ছিল যে।
–বলুন, এখন রাজার পক্ষে বলার যে কেউ নেই। আপনার কথাই মহারাজের আদেশ।
প্রহরীর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
অমরু বলে—তাহলে আর একজন অশ্বারোহীকে পাঠান। সে যেন গিয়ে বলে, তিনি সঙ্গে করে তাঁর স্ত্রীকেও অবশ্যই আনেন এবং তাঁরা যেন এই প্রাসাদে এসে ওঠেন। এখানে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি গিয়ে রাজাকে বলছি। আপনি আয়োজন করুন।
অমরু জানে, মা বলেছেন, রাজার কক্ষে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার আগে অতীশের অনুমতি নিতে। কিন্তু বাধ্য হয়ে মায়ের অবাধ্য হতে হচ্ছে। কারণ চিকিৎসা বিষয়ে স্ত্রীর ওপর তার অগাধ আস্থা। গুরুদেবের আস্থাই তার একমাত্র কারণ। শ্রীমতীকে নিয়ে অমরু মহারাজার কক্ষের দিকে যায়। নারীরক্ষীরা পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। এখানে কোনো পুরুষ নেই। শ্রীমতী অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়। রক্ষীরা নারী হয়েও বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে।
শ্রীমতী তাদের একজনকে মৃদুস্বরে বলে—মহারাজের শুশ্রূষাকারিণী কয়জন রয়েছে?
-একজন রয়েছে কক্ষের ভেতরে। বাকি তিনজন বাইরে রয়েছে।
—ঠিক আছে।
রাজার কক্ষে প্রবেশ করতে শুশ্রূষাকারিনী উঠে দাঁড়ায়। সে রূপবতী শ্রীমতীর সঙ্গে কবিকে দেখে তার পরিচয় বুঝতে পারে। কিন্তু অবগুণ্ঠন ছাড়া রাজার দিকে তাকে এগিয়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়। মহারাজের চক্ষুদ্বয় নিমীলিত। মুখমণ্ডল রক্তশূণ্য। তাতে একটা বেদনার আভাষ। যে বস্ত্রদ্বারা বুকের কাছে ক্ষত স্থান বাঁধা রয়েছে, সেখান থেকে রক্ত পড়ছে।
কবি মৃদুস্বরে ডাকে—মহারাজা, আপনি কি জেগে আছেন?
মহারাজা চোখ খুলতে খুলতে দুর্বল কণ্ঠে বলেন—নিদ্রা পেলে স্বস্তি পেতাম। পায় না।
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে শ্রীমতীর দিকে তাঁর দৃষ্টিনিবদ্ধ হয়। তিনি একদৃষ্টে চেয়ে ভাবেন, ইনি কি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন? কিংবা তাঁর মৃত্যু হয়েছে? মৃত্যু হলে তো যন্ত্রণার অবসান হয়। তাঁর যন্ত্রণা যে রয়েছে। ইনি কে তবে? আমার কক্ষে, এমন কি রাজপ্রাসাদের সীমানায় কোনো রূপসী নারী তো আসতে সাহস পায় না। তাকে যে অন্তঃপুরে নিয়ে রাখা হয়।
অমরু বলে—ইনি আমার স্ত্রী। আপনাকে দেখতে এসেছেন।
-আমাকে? আপনার সাহস হল কি করে? অবশ্য আপনি জানতেন, আপনার স্ত্রী সম্পূর্ণ নিরাপদ। ক্রিয়াশক্তিও সেকথা জানতেন। তাই বলে আমার কক্ষে? অমরু বলে—উনি চিকিৎসক রূপে এসেছেন। আমার পত্নীরূপে নয়।
—উনি চিকিৎসক?
এবারে শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ, মহারাজ।
সে ঝুঁকে পড়ে মহারাজের ললাট স্পর্শ করে। তারপর তাঁর শয্যাপার্শ্বে দ্বিধাহীনভাবে বসে ডান হাত তুলে নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করে।
মহারাজা শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকেন, ভাবেন কবির স্ত্রী সাক্ষাৎ দেবী। কবি ভাগ্যবান। মনের মধ্যে তিনি এক অনাস্বাদিত পুলক অনুভব করেন। আহা, একেই বলে বোধহয় নারীর রূপ, এই রূপ এতদিন চোখে পড়েনি।
হাত ছেড়ে দিয়ে শ্রীমতী বলে—মহারাজ, বুকের ডানদিকে বড়ই যন্ত্রণা আপনার।
—হ্যাঁ, ঠিক তাই। এদের সেকথা বললেও বোঝে না, বলে—ওদিকে তেমন আঘাত নেই।
—বাইরে দেখলে তাই মনে হয়। কিন্তু ওখানে আসল আঘাত। আপনি একটুও ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনাকে যে ভালো হতেই হবে, নইলে সাম্রাজ্য চলবে কি করে? নতুনভাবে সব গড়ে তুলতে হবে।
অমরু ভাবে এসব কি বলছে শ্রীমতী? এটা কি ধরনের চিকিৎসা। মহারাজা বলে ওঠেন—তবে? আমার শুয়ে থাকলে চলবে?
তিনি উঠে বসতে চান। শ্রীমতী তাড়াতাড়ি তাঁকে চেপে ধরে বলে—কয়েকদিন সময় লাগবে।
—কতদিন?
—ঠিক বারোদিন। বারোদিনের পরে আপনি রাজসভায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে পারবেন। আপনার সেবিকাকে কয়েকটা ঔষধ দিয়ে যাচ্ছি। সে খাইয়ে দেবে।
–আপনি আবার কবে আসবেন?
-আসব। তার আগে একজন বোধহয় আগামীকালই এসে পড়বে।
–কে সে?
সে আপনার সেবার ভার নেবে। আপনার শুশ্রূষাকারিণীদের পরিচালনা করবে। তার স্বামী আপনার অপরিচিত নন।
-কে।
অমরু বলে—অতীশ। আমার স্ত্রীর সখী তিনি। মন্দিরে একই সঙ্গে থাকতেন।
—বুঝেছি। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির দান।
—ঠিক বলেছেন।
বাড়ি ফেরার পথে শ্রীমতী বলে—আমাদের মহারাজা অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি। অমরু হেসে বলে—সে কথা দেশের সবাই জানে।
–সে কথা বলছি না। বলছি—
—বুঝেছি। মহারাজের ভাই-এর মতো বহু মানুষই রাজ পরিবারে কিংবা উচ্চপদে আসীন রয়েছে। তাই কুমন্ত্রণা দেবার লোকের কোনো অভাব নেই। এবারে মহারাজ এক এক করে সবাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবেন। তুমি জান, এই রাজ্যের শাস্তি কত কঠোর, কত নির্মম।
—তুমি কোনো শাস্তিপ্রদান কখনো দেখেছ?
—আমি! তুমি পাগল হলে নাকি? ওসব দিকে আমি নেই। আসলে আমি অকর্মণ্য। মা সেকথা সব চেয়ে ভালো জানেন। তুমিও জানবে আস্তে আস্তে। শ্রীমতীর ইচ্ছা হল স্বামীর কণ্ঠলগ্না হতে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ওই নয়ন দুটো দেখলে তার ভিতরটা যেন কেমন করে ওঠে। একজন নিষ্পাপ ব্যক্তি, যাকে শুধু ভালোবাসা যায়।
এই নিষ্পাপ ব্যক্তি হঠাৎ প্রশ্ন করে—চিকিৎসা করতে গিয়ে রাজ্যের অবস্থার কথা বলতে শুরু করলে কেন?
–ওতে উনি কত উৎসাহ পেলেন দেখলে না? উনি বড় নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন, আমি উসকে দিলাম। দেখো, পরের দিন কত স্বাভাবিক দেখাবে। যন্ত্রণার কথা ওঁর মুখে আর শোনা যাবে না।
-তা বটে। আমার একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।
-কি?
—আমার বেশ অসুখ হয়। খুব অসুখ।
শ্রীমতী গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর বলে—একথা বললে কেন?
—আমাকেও ওভাবে দেখবে। মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠবে।
—তুমি জান কি তোমার জন্য আমার কত চিন্তা। তাছাড়া আমি তো তোমাকে আমার সব কিছুই দিয়েছি। অদেয় যে কিছু নেই।
—তুমি এখনো বালিকা। লোকে যতই বলুক তোমার অনেক জ্ঞান, অনেক বুদ্ধি
—আর তুমি হলে পরিপক্ক বৃদ্ধ। কথা বন্ধ।
—কী বললে?
শ্রীমতী মুখের উপর তর্জনী চেপে ধরে ইঙ্গিত করে, আর কোনো কথা নয়।
.
মঞ্জরী এসেই তাকে ডেকে পাঠায়। শ্রীমতী যে তার জন্য এমন সুন্দর ফাঁদ পেতে রেখেছে সে ভাবেনি। তার চেয়েও অপ্রস্তুত অতীশ। কিন্তু সে অমরুর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। রাজপ্রাসাদে যে পুরনো কোনো ব্যক্তিই প্রায় নেই, সে ভাবতে পারেনি। রাজার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারছে না। শুনেছে তিনি খুবই আহত। অমরু আর শ্রীমতীর কথাও সে শুনেছে। তাই দু’জনে মিলে ওদের ডেকে পাঠিয়েছে।
শ্রীমতী এসেই অতীশকে প্রশ্ন করে—রাজার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
—এখনো যাইনি।
—ভালো হয়েছে। আমি তাঁর শরীরের কথা ভেবেই এটা বলছি। আপনি দেখা করার সময় এতটুকুও উৎসাহের অভাব দেখাবেন না। শুধু এই কথাই বলতে হবে যে যা হয়েছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার জন্য ভেঙে পড়ার কিছু নেই। বড় বড় যুদ্ধেও এমন হতে পারে। তাই বলে সাম্রাজ্য ভেঙে যায় না।
অতীশ মন দিয়ে শুনল। মঞ্জরীও শুনল। অতীশ অমরুকে বলে—তোমরাও আমার সঙ্গে যাবে তো?
অমরু বলে-আগে তোমরাই যাও। আমরা একটু পরে যাচ্ছি। তুমি তোমার স্ত্রীর পরিচয় দিও। তাকে আনার উদ্দেশ্যে বলবে।
অতীশ মঞ্জরীকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। মহারাজা জেগে ছিলেন। তিনি সেবিকাকে প্রশ্ন করে কবি-পত্নী এলেন বুঝি?
সে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলে—না।
মহারাজার মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। বলেন—কে এল?
ততক্ষণে অতীশ সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে—আমি অতীশ।
উৎসাহিত মহারাজা বলেন—এসেছ? যাক্ এবারে তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে, শিখতে হবে।
মহারাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই মঞ্জরীর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সে শুশ্রূষাকারিণীকে নতুন বস্ত্রখণ্ড আনতে বলে। বাঁয়ের দিকের বুকের কাছে ক্ষতস্থানে রক্ত দেখা দিয়েছিল, সেবিকা সামান্য উষ্ণ জল তাড়াতাড়ি এনে দিতেই মঞ্জরী সযত্নে স্থানটি মুছিয়ে দিতে থাকে। মহারাজা নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। অতীশকে প্রশ্ন করেন এই বালিকা তোমার সঙ্গে এসেছে? আমি তো লক্ষ্য করিনি। এ যে সেবার প্রতিমূর্তি। এ কে?
-আমার স্ত্রী।
–তোমার স্ত্রী? বালিকা?
সেই সময় অমরু এবং শ্রীমতী আসে। মহারাজের কথা শুনে শ্রীমতী বলে—ও বালিকা নয় মহারাজা, আমার চেয়ে একটু বড়ই।
—কিন্তু—
-ওকে দেখতে কচি কচি। আমার তাই ওকে খুব ভালো লাগে।
মহারাজের মুখে সামান্য হাসির রেখা ফোটে যেন।
তিনি বলেন—আমার একজন প্রধান এবং নিকটতম সামন্তের স্ত্রী ইনি? ভাবাই যায় না। আপনি কিছু মনে করবেন না।
—না মহারাজ আমি তো আপনার চেয়ে ছোটই। ঈশ্বর আমার মুখখানা বিশ্রীভাবে গড়েছেন—
—বিশ্রীভাবে কে বলল? এমন মুখ পাওয়া তো ভাগ্য বলতে হবে। আমার যদি আপনার মতো একজন ছোট বোন থাকত—
অমরু আর অতীশ খুব আনন্দিত হয়ে ওঠে। অমরু বলে—ছোট বোনই তো। আপনাকে ওর হাতে ছেড়ে দিন, দুদিনেই ভালো হয়ে যাবেন। তবে ওঁর সেবা কিন্তু রাজা, প্রজা, দুঃখী, ভিখারী সবার ক্ষেত্রেই এক।
—কবি, আমার বিশ্বাসঘাতক ভাই যে ঘোর বিপদ, আমার ও আমার সাম্রাজ্যের ঘটিয়েছে তার ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গুরুদেবের আশীর্বাদে বোধহয় আমার আত্মার কল্যাণ হয়েছে। আমি একটা নতুন দৃষ্টি ফিরে পেয়েছি।
মঞ্জরী শ্রীমতীকে বলে—তুই মহারাজকে পরীক্ষা করে নে। আমার আরও কাজ বাকি রয়েছে।
মহারাজের মনে হল একটা গোটা পরিবার যেন তাঁকে ঘিরে রয়েছে। তিনি নিশ্চিন্ত।
সেই মুহূর্তে এক সুন্দরী নারী যার নাসারন্ধ্র ক্রোধে স্ফূরিত তিনি কক্ষে এসে একটু উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন—দু’দিন ধরে আমি এখানে আসতে পারছি না। ওরা বলছে আপনি নাকি খুবই অসুস্থ। সংকটাপন্ন নাকি আপনার অবস্থা। দিব্যি কথা বলছেন এদের সঙ্গে। কারা এরা জানি না। তবে দুই সুন্দরী রয়েছে বটে। আমার চেয়ে এদের বয়স কম। তাই বোধহয় অবাধ গতি।
কারও মুখে কোনো কথা ছিল না কিছুক্ষণ।
তিনি বলেন—মহারাজা আমাকে ভুলে গিয়েছেন? একসময়ে আমি আপনার পাটরানী ছিলাম বলে জানতাম। গৌরীর স্থান ছিল আমার পরেই। আপনার মস্তিষ্কও কি আমার দেবরের আঘাতে বিবশ?
মহারাজা এবারে নিজেকে সামলে নেন, তারপর বলেন—রানী আমার মস্তিষ্ক খুবই সুস্থ রয়েছে। মনে হয় এত সুস্থ আগে কখনো ছিল না। যে দুজন পুরুষকে এখানে দেখছ, তাঁদের একজন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সভাকবি আর অপরজন বিজয়নগরের নিকটতম সামন্তরাজ্যের অধিপতি আর দুইজন নারী এঁদের দুইজনের স্ত্রী। তবে স্ত্রী রূপে এঁরা আসেননি। একজন হলেন আয়ুর্বেদজ্ঞ। আমার ধারণা এই মুহূর্তে রাজ্যের মধ্যে ইনি সর্বশ্রেষ্ঠ। অপরজন শুশ্রষা কার্যে দক্ষ। তিনি মমতাময়ী। আমার ভগিনীস্বরূপা। তবে হ্যাঁ, এঁদের রূপ রয়েছে। এত রূপ প্রথম যৌবনেও তোমার ছিল না। কারণ রূপ দেখে তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়নি। উড়িষ্যা রাজের ভগিনী হওয়ার দৌলতে বিজয়নগরের অধিপতির সহধর্মিনী হয়েছিলে।
মহারাজ একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
মাল্লাদেবী কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কক্ষ ত্যাগ করেন।
.
১৪৪৩ খৃষ্টাব্দের দ্বিতীয়ার্ধের কথা উল্লেখ করে আবদার রজ্জাক বলেছেন, এই সময়ে মন্ত্রী দানায়িক কুলবার্গা রাজ্যের দিকে অভিযান শুরু করে। যে জন্য এই অভিযান তার কারণগুলি হল, সুলতান আলাউদ্দিন বিজয়নগরের নরপতিকে হত্যার জন্য বিশ্বাসঘাতকতার প্রচেষ্টা এবং সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিও অমাত্যদের নিহত হওয়ার কথা শুনেছিলেন। তিনি মহারাজার নিকট “সাত লক্ষ বরাহ” দাবি করলেন। তিনি ভাবলেন, সাম্রাজ্যটিকে ধ্বংস করার এটি প্রকৃষ্ট সময়। বিজয়নগরের অধিপতি এই সংবাদ পেয়ে খুবই বিব্রত ও বিরক্ত হলেন। কিন্তু তিনি একটি সাহসী জবাব পাঠিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।
“দুই পক্ষ সৈন্য প্রেরণ করল, যার ফলে দুই রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক কিছু ধ্বংস হল। দানায়িক কুলবর্গার সীমান্তে আক্রমণ চালিয়ে বহু হতভাগ্য বন্দিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলেন”…..
.
অমরু মাতৃহারা হল। পুত্রবধূ চিকিৎসা শাস্ত্রে পারদর্শিনী হয়েও কিছু করতে পারল না। হৃদপিণ্ড সম্পৰ্কীয় খুবই পুরনো ব্যাধি ছিল তাঁর। শ্রীমতী এসেই বুঝতে পেরেছিল। স্বামীকে বলে রেখেছিল। তাই তারা কখনো নিজেদের বিবাহের পরে মাকে একা রাখত না। শুধু মহারাজা যখন অসুস্থ ছিলেন তখন দু’একদিন দুজনে একসঙ্গে রাজপুরীতে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যু ঘটল খুবই শান্তিতে, নিদ্রিত অবস্থায়। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, শান্তিতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। শ্রীমতী অশ্রুসিক্ত অবস্থায় স্বামীকে বলে—দেখো, মুখে হাসি লেগে রয়েছে।
—এখন কি হবে? মা যে নেই।
—এ আঘাত সবাই পায়। তোমার কিছু করার নেই। তুমি তো ভাগ্যবান, মায়ের মৃত্যু-যন্ত্রণা দেখতে হয়নি। এই রোগে এত শ্বাসকষ্ট হয় যে চোখে দেখা যায় না। মা দেবী ছিলেন। তিনি হাসি মুখে বিদায় নিলেন।
শ্রীমতীর নিজের মায়ের কথা আজ বারবার মনে পড়ে। কিন্তু তিনি তো জীবিত থাকতে পারেন না। তবু এক এক সময় মনে হয় থাকতে তো পারেন। সে স্বার্থপর, তাই নিজের সুখের দিনে তাঁর কথা বিস্মৃত হয়েছে। মায়ের সধবা অবস্থার চেহারার কথা তার মনে পড়ে না। কিন্তু যে বেশে তিনি তার হাত ধরে মন্দিরের প্রবেশ পথের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মুখের স্পষ্ট ছবি তার হৃদয়ে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে। মৃত শ্বশ্রূমাতার জন্য অশ্রু ধারার সঙ্গে তার নিজের মায়ের জন্য হৃদয়-মথিত ক্রন্দনের ধারা মিলে অবিরলভাবে ঝরে পড়তে থাকে।
তাকে এত অস্থির দেখে অমরু বুঝতে পারে না কিভাবে সান্ত্বনা দেবে। সে উত্তরীয় দিয়ে স্ত্রীর অশ্রু মুছিয়ে দেয়। তাকে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়। মায়ের বিচ্ছেদ বেদনা মনের মধ্যে চেপে বসতে পারে না। শ্রীমতী, দুঃখের সময়েও যে এমন সান্ত্বনা পাওয়া যায়, তার আস্বাদ কখনো পায়নি। সে স্বামীর বুকে মুখ লুকোয়। ভাবে তার তো একবারও মনে হচ্ছে না যে তার স্বামী একজন বাস্তব বুদ্ধি বিবর্জিত কল্পনাপ্রবণ মানুষ। তাহলে এঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য এত নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল বলে মনে হত না।
—শ্রীমতী, এবারে আমাকে ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিবেশীরা একটু দেরিতে খবর পেল। সঙ্গে সঙ্গে তারা এসে জড়ো হয়। অমরুর রাজপুরীতে খবর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। রাজা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। রাজসভা শুরু হয়েছে। অধিকাংশ নতুন সদস্য। অতীশের ফিরে যাওয়া হয়নি। রাজা তার উপর বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। দানায়িকের পরই তার স্থান। রাজা দানায়িককে মন্ত্রীরূপে অতীশের যোগ্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন।
দানায়িক উত্তরে বলেছিল—যাঁরা ছিলেন, তাঁরা স্বর্গে গিয়েছেন। বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্বের সেখানেই স্থান। তবে একথা বলতে পারি, অতীশ তাঁদের অনেকের চেয়েই যোগ্য।
রাজার খুব আনন্দ হয়। এর ফলে অতীশকে স্থায়ীভাবে রাজধানীতে থাকতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মাকে দেখতে মঞ্জরীকে নিয়ে দু-একদিন ঘুরে আসে। তাই আজকের দিনে অতীশকে না বলে তো উপায় নেই। ফলে মহারাজাও শুনবেন। তিনি কি কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন জানা নেই। নিজের মায়ের সব কিছু অনাড়ম্বরে হওয়া তার একান্ত বাসনা। তবু রাজা এবং অতীশকে সে খবর পাঠাল এবং অতীশকে জানাতে ভুলল না যে খুব সাধারণভাবে সে মায়ের কাজ করবে। প্রতিবেশীরা সবাই সঙ্গে রয়েছে। তারাই তার হিতাকাঙ্খী।
অতীশ বুঝল এবং মহারাজাকে বোঝাল। অতীশ আর মঞ্জরী এল শুধু। রাজা সমবেদনা জানালেন অতীশের মাধ্যমে।
.
অমরু কেমন যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে। মায়ের মৃত্যু প্রায় ছয়মাস হয়ে গেল, কিন্তু হাতে লেখনী ওঠেনি। তবে বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
–তুমি আজকাল লেখনা কেন?
শ্রীমতীর মুখে এই প্রশ্ন শুনে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বলে—আমিও তাই ভাবি। সরস্বতী দেবী কি আমার প্রতি বিরূপ?
–একটা কথা বলব?
—তার জন্যে অনুমতির প্রয়োজন?
– হ্যাঁ।
-কেন?
—আমার স্বার্থ রয়েছে বলে।
-সে তো আরও জরুরি। এখনি বল।
–বলছিলাম, আমার মনে হয় রাজধানীর বাইরে দু-একদিন ঘুরে এলে নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। তাতে একঘেয়েমী ভাব কাটবে। উপকার হবে।
—আমি তোমার স্বার্থের কথা আগে শুনতে চাই।
–আমাদের একটা গ্রাম ছিল, যেখান থেকে মা আমাকে পশুপতি মন্দিরে নিয়ে এসেছিলেন।
—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তো সব ভুলে গিয়েছ।
শ্রীমতী মনে মনে দুঃখের হাসি হাসে। এগারো বছরের একটি মেয়ে কখনো সব ভুলতে পারে? এতে অমরুর কোনো দোষ নেই। তার ধারণা সে খুব শিশু ছিল। কিন্তু তা তো নয়। মা শৈশবে তাকে আদর করে বলতেন, বিজয়নগরে তারকেশ্বরের মন্দির রয়েছে শুনেছি, সেখানে শিবের কোলে রয়েছে ছোট্ট দুর্গা। তুই হলি সেই দুর্গা। মা বেঁচে থাকলে তাঁর আনন্দের সীমা থাকত না। তিনি স্বচক্ষে দেখতে পেতেন তাঁর আদরের দুর্গা সত্যই শিব পেয়েছে এবং তাঁর কোলে বসতে পারে ইচ্ছেমতো।
অমরু আবার বলে—ভুলে যাও নি?
–আমি এগারো বছর বয়সে গ্রাম ছেড়েছি।
অমরু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে—তাহলে সব কিছুই তো মনে আছে। এতদিন বলনি কেন? গুরুদেব বলেননি কেন? তুমি কেন লুকিয়ে রেখেছিলে এতদিন? আমি জানতাম, তুমি কোনো অন্যায় করতে পার না। এখন দেখছি নিজের উপর সব চেয়ে বেশি অন্যায় করে ফেলেছ। কোথায় তোমার গ্রাম? এখুনি বল। শ্রীমতী স্বামীর পাশে বসে তার গায়ে হাত রেখে বলে—অমন করো না। সে ধীরে ধীরে সব বলে। প্রথমেই বলে যেরকম দ্রুত তার ভাগ্যের পরিবর্তন হল তা কল্পনার অতীত। সে নিজেই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। মনে হয়েছিল গুরুদেব তাকে স্বর্গ থেকে দেবতাকে এনে দিলেন। তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল বোধহয়। এমনকি মনে হয়েছিল, সে কি স্বার্থপর হয়ে পড়েছিল? মা তার মনের মধ্যে সব সময়েই রয়েছেন ইষ্ট দেবতার মতো। অথচ সংসারে তাঁর মূল্য রয়েছে বলে হয়তো মনে হয়নি।
–ঠিক আছে আর কোনো কথা নয়। তোমার গ্রাম কোথায়?
—হেমকূট পর্বতের পেছনে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম, নামও তার বিচিত্র—নুটি। আখ হত খুব। চলে আসার সময় আখের জমি ফেটে চৌচির। সবুজের চিহ্ন ছিল না কোথাও। ঘাসও মরে গিয়েছিল।
—মা বৃদ্ধা ছিলেন?
—না। বাবা কম বয়সে মারা যান। আমি তাঁর একমাত্র সন্তান।
—তুমি করেছ কি শ্রীমতী? আমাকেও তোমার পাপের ভাগীদার করে নিলে? তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি নেই। বরং তোমার পাপ হ্রাস করতে প্রায়শ্চিত্তও করতে পারি। কিন্তু আর দেরি নয়। আগামীকাল ভোরবেলা রওনা হব। দেখতে হবে সত্যি তাঁর মৃত্যু হয়েছে কিনা।
শ্রীমতীর দৃঢ় বিশ্বাস মা বেঁচে থাকতে পারেন না। মেয়েকে কোনোরকমে কিছুটা খাদ্য যোগাড় করে দিতে দিতে কংকালসার হয়ে পড়েছিলেন। মন্দিরে আসার পথে কতবার বসে বিশ্রাম নিয়েছেন। তবু সত্যি যদি অসম্ভব সম্ভব হয়? তার ভাগ্যে তেমনই ঘটে চলেছে যে একের পর এক।
.
সূর্য উঠতে কিছুটা বাকি। পূব আকাশে আলোর অতি সামান্য আভাস। শ্ৰীমতী দ্বার খুলে স্বামী সহ বাইরে পদার্পণ করতেই দেখে সেখানে একটি শকট এসে থামে। দু’জনেই বিস্মিত হয়। অমরু বুঝল অতীশ এসেছে। কিন্তু এখন কেন? তাছাড়া সস্ত্রীক এসেছে নিশ্চয়ই। সে একা এলে অশ্ব নিয়ে আসত। একটা কিছু ঘটেছে। কারণ মঞ্জরীর মুখ থমথমে। সহজেই বোঝা যায়, সে ইতিমধ্যেই চোখের জল ফেলেছে। শকট থেকে নেমে সে শ্রীমতীর বাহু ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়।
অতীশ ইশারায় অমরুকে কাছে ডাকে। সে কাছে যাওয়ার আগেই ভোরের নৈঃশব্দের মধ্যে চাপা ক্রন্দন-ধ্বনি শোনা যায়। অতীশ বলে—মুক্তি নামে কাউকে চিনতে?
–নামে চিনি না কাউকেই, তবে এ নাম ওর মুখে অনেক শুনেছি। ওদের সবার নামই নিশ্চয়ই শুনেছি। শোনা তো স্বাভাবিক।
—মুক্তি নাম কেন শুনেছ?
—অদ্ভুত প্রশ্ন করছ। কেন আবার শুনব? ওর একজন বান্ধবী বলে, ওর মতো দেবদাসী বলে।
—অনেক সময় খুব পরিচিত ব্যক্তি সম্বন্ধে বলতে গেলে তার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথাও লোকে বলে।
—বুঝেছি। কিন্তু কি হয়েছে? এটুকু বুঝেছি মুক্তি আর নেই। এও বুঝেছি স্বাভাবিকভাবে তার মৃত্যু হয়নি। ও হ্যাঁ, ওর একটা বৈশিষ্ট্য কথা মনে পড়েছে।
অতীশ ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে।
—সোনালি চুলের বিদেশিদের ওর ভালো লাগত। তাই বলে—
—আশ্চর্য!
এবারে বিস্মিত হওয়ার পালা অমরুর। সে বলে—কোনো সোনালি চুল—
-হ্যাঁ।
–কি হয়েছে সব বল।
—কাল সন্ধ্যায় মন্দিরের পাশের জঙ্গলে গাঁয়ের লোকেরা একজন বিদেশিকে দেখতে পায় মুক্তিকে তাড়া করেছে আর মুক্তিও প্রাণভরে মন্দিরের দিকে ছুটছে। গ্রামের কিছু লোক দেখতে পেয়ে অনেককে জুটিয়ে তাকে তাড়া করে ধরে ফেলে। তারা রেগে যার যা অস্ত্র ঘরে ছিল হাতে নিয়ে সেই বিদেশিকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। গুরুদেব খবরটা আমাকে পাঠান। আমি রাজাকে বলতে তিনি বিচলিত হন। কারণ বিদেশিদের সঙ্গে তাঁর বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব ভালো ৷ অন্যদিকে এর সঙ্গে তাঁর রাজধানীর এক বিখ্যাত মন্দিরের দেবদাসী জড়িত। তবে গ্রামবাসীদের তিনি প্রশংসা করেন। দেশের দেবালয়গুলির প্রতি তাদের সজাগ দৃষ্টির তুলনা নেই।
—তারপর?
—মুক্তি অক্ষত অবস্থায় মন্দিরে রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়ে। কিন্তু দেবদাসীদের মুখে ঘৃণার কুঞ্চন। মুক্তি হয়তো তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে সে নিরপরাধ। কেউ নিশ্চয় বিশ্বাস করেনি। সে নীরবে সরে গিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। গুরুদেব জীবনের সায়াহ্নে এই আঘাত পেয়ে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন। সেই সময়ে শ্রীমতীরা বাইরে আসে। শ্রীমতীকে এত অস্থির হতে অমরু কখনো দেখেনি। শ্রীমতী কাছে এসে বলে—মন্দিরে যাব।
-নিশ্চয় যাবে। আমরা সবাই যাব।
—কৌতুক প্রিয়তা ওর সর্বনাশ ডেকে আনল। ওর একমাত্র দোষ, ওর অনুকরণ-প্রিয়তা। যে কোনো মানুষকে একটু দেখেই তাকে হুবহু নকল করতে পারে। তোমাদের দুজনকে কতটুকুই বা দেখেছে? তোমাদের কথাবার্তা ভাবভঙ্গি সব নিখুতভাবে আমাদের সামনে বলে আমাদের হাসিয়েছে। নিশ্চয় ওই বিদেশিকে ও অনুকরণ করেছিল। সেটা তার চোখে পড়ে যায়। তাতে হয়তো সে প্রশ্রয় পেয়ে পেছনে এসেছিল।
অমরু বলে—শ্রীমতী সবাই তোমার মতো গভীরভাবে চিন্তা করে না। মনে হয়, মুক্তির ওপর ভুল ধারণা থেকেই যাবে।
—অন্তত দেবদাসীদের বোঝাতে পারব।
গুরুদেবকে বললে, তিনি বুঝবেন। তিনি সান্ত্বনা পাবেন।
–সেকথা ঠিক।
শুধু গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি নন গ্রামবাসীরা আরও সহজে বিশ্বাস করল, কারণ তারা প্রত্যক্ষদর্শী। অবলা দয়াবতীরাও মনে হয় মুক্তির স্বপক্ষে ভাবতে শুরু করেছে। ওদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না যে মেয়েটি কত সরল ছিল। তবু সব কিছু কি মুছে ফেলা যায়? এই ঘটনার কথা গল্পের আকারে ভেসে বেড়াবে বহুদিন ধরে। শ্রীমতী সেটা বুঝতে পারে।
গ্রামবাসীরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তির দাহকার্য সম্পন্ন করতে গেল। দেবদাসীরা কেউ গেল না। এমন কি শ্রীমতী আর মঞ্জরীও নয়। তারা নিম্নস্বরে নিজেদের মধ্যে মুক্তির নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে থাকে। তারা নিজেরাই জানে না মুক্তি তাদের মুখ দিয়ে তার কথাটা বলিয়ে নিয়েছে। কেউ মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে।
নগরীতে বাস করে বলে সব পর্বতের মতো হেমকূট পর্বতকেও সে কয়েকবার দেখেছে। যে কয়েকবার পর্বতটি তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ততবার তার মন কেমন করে উঠেছে। ওখান থেকে কি যেন টানছে তাকে। ওই টান বড় প্রবল বেদনাদায়ক। যতদূর মনে পড়ে পর্বতটি পার হয়ে দু-একটি গ্রামের পরে গ্রাম তার সীমান্তে একটি বিশাল নিমগাছ। দুর্ভিক্ষে নিমগাছের হরিদ্রাভ প্রায় বিনষ্ট হয়েও জীবিত ছিল। মা ওদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলেছিলেন, ওটাই আমাদের গ্রাম। এখনো নিজেকে কোনোরকমে বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো বেঁচে যাবে। কিন্তু গাছটি তার পরিচিত অনেককেই আর দেখতে পাবে না। তোকেও নয় আমাকেও নয়।
কোমল স্বরে অমরু জিজ্ঞাসা করে—কি ভাবছ শ্রীমতী?
স্বামীর কণ্ঠ খুবই কোমল এবং দরদভরা। বুক জুড়ায়। গত জন্মে সে যতখানি পাপ করেছিল পুণ্যি করেছিল বোধহয় তার চেয়েও বেশি। কিংবা সমান-সমান? বুঝতে পারেন সে। ক্ষেতে ফসল ভর্তি। একটি গ্রামে প্রবেশ করে তারা। ওখানে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নানা বর্ণের সবজী। নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী। এতদিনে মনে পরে এইসব দৃশ্য তার খুব পরিচিত। বুকের মধ্যে বাষ্প জমে ওঠে। সেই নিমগাছটি কি এখনো রয়েছে? থাকলেও সে চিনতে পারবে কি? পারলেও তার বাড়ি চিনতে পারবে কি। বাড়িটি কি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে? থাকলেও মা রয়েছেন কি? সে অস্থির হয়ে ওঠে। নিরালা পথ হলে অমরু তাকে কাছে টেনে নিত। ওর অমন চাহনির অর্থ সে জানে। ওই চাহনিতে ফুটে উঠছে শ্রীমতীর প্রতি তার বুকভরা ভালোবাসা, আর গভীর করুণা। এই করুণা পৃথিবীর সবার প্রতি রয়েছে তার। এই করুণা পংক্তি হয়ে তার কবিতায় ফুটে ওঠে।
সহসা শ্রীমতী উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে—ওই-ওইটা।
–কী !
—ওই সেই নিমগাছ। এখনো রয়েছে। আমি চিনতে পেরেছি।
অমরু খুশি হয়ে বলে ওঠে—ভালো তো। কত আনন্দের। এতদিন পরে নিজের গ্রামে এসেছ। সুন্দর গ্রাম। আমারও একটা গ্রাম ছিল। কিন্তু খুঁজে পাব না। বাবা চিরকাল নগরবাসী ছিলেন।
—ভালোই করেছেন।
–কেন?
—না হলে তোমাকে পেতাম না।
—তুমি খুব স্বার্থপর
—খুব না হলেও একটু তো বটেই। আমার মনে হয় সব মেয়েরাই। তবে হেমাঙ্গিনীদি একটু অন্যরকম।
—চিনি না।
—সুযোগ পেলে চিনিয়ে দেব।
শ্রীমতী লক্ষ্য করে একটি গ্রাম্যবধূ পথের ধারে ছেলেকে কাঁখে নিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। বধূটির ভঙ্গি খুব পরিচিত। তা কি হতে পারে? তার দু’জন বাল্যসখী ছিল। একজন হল সরলা। সে সত্যই সরল। অন্যজনের নাম ছিল বাসন্তী। সে ছিল নাদুসনুদুস। শ্যামলা রঙ। তার প্রতি হিংসা ছিল। অথচ তাকে ভালোবাসত। বলত আমি যদি তোর মতো দেখতে হতাম তাহলে তোকে আরও ভালোবাসতাম। কথা শুনে শ্রীমতী খুব হাসত। বলত, এটুকু ভালোবাসাই যথেষ্ট। তাতে বাসন্তী রেগে যেত। বলত, তোর যেন কুৎসিত স্বামী হয়। স্বামীর ব্যাপার শ্রীমতী অত বুঝত না। সে ওকে খুশি করার জন্য বলত, ঠিক আছে। কিন্তু ছেলে কোলে বউটি বড্ড রোগা। বাসন্তী হতে পারে না ও।
একেবারে কাছে এলে বধূটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলে ওঠে—শ্রী? শ্রীমতীর বুকে ঝড় ওঠে। ছুটে গিয়ে ছেলে সমেত বাসন্তীকে জড়িয়ে ধরে বলে—বাসন্তী? তুই এত রোগা হয়েছিস্। এতদিন বুঝিনি, এখন বুঝছি তোকে
কত ভালোবাসতাম। তোর ছেলে? আমার কোলে দে।
ছেলেটি কাঁদে না। দুই সখী কাঁদতে থাকে। শ্রীমতী বলে ওঠে—মা?
—আজ আছেন কিনা জানি না, কালও ছিলেন।
–মা বেঁচে রয়েছেন? শুনছ, মা বেঁচে আছেন।
—চল, শিগগির চল। আপনি একটু পথ দেখিয়ে দেবেন?
–দেব না কেন। আপনি তো আপনজন।
কথাটা অমরুর খুব ভালো লাগে। এ পরিবেশে থেকেই শ্রীমতী এমন হয়েছে। শ্রীমতী একা এলে নিজের বাড়ি চিনতে পারত না। একটি মাত্র কুটির দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারপাশের প্রাচীর নেই। উঠোন নেই, অন্য কুটিরগুলোও নেই। কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি পড়ে না। সে দেখতে চায় মা বেঁচে রয়েছেন কিনা। একটি কিশোরী ঘর থেকে বাইরে এসে তাদের দেখে থতমত খায়।
তাকেই শ্রীমতী বলে—মা বেঁচে আছেন?
সে বুঝতে পারে না। শ্রীমতী ছুটে ভিতরে ঢুকতে যায়। অমরু তার হাত চেপে ধরে বলে—না, ও ভাবে নয়। একটু ধৈর্য ধর।
সে কিশোরীকে প্রশ্ন করে—উনি বেঁচে আছেন?
–হ্যাঁ।
—কথা বলতে পারেন?
—খুব আস্তে।
—খেতে পারেন?
—কিছুই খেতে চান না।
—তুমি এই কাজ করছ কেন?
–মা বাবা বলেছেন, আমরা এঁদের কাছে চিরঋণী। তাই আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আমি এঁর সেবার ভার নিতে পারব কি না।
বাসন্তী বলে ওঠে—অনন্ত কাকাকে চিনতিস শ্ৰী?
—মনে পড়ছে না।
–এ তাঁরই মেয়ে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
শ্রীমতী অধৈর্য হয়ে বলে—এবারে মায়ের কাছে যেতে পারি?
—যাও। আস্তে আস্তে যাও। এঁদের দুজনাকে সঙ্গে নাও।
শ্রীমতী গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে মনে মনে প্রণাম করে তারপর পশুপতি নাথকে স্মরণ করে।
সে এগিয়ে যায়। ঘরের ভেতর মোটেই অন্ধকার নয়। জানালাগুলি খোলা। হালকা হাওয়া বইছে। বিছানায় অতি শীর্ণ মাকে শায়িত দেখতে পায় শ্রীমতী। মাকে সে এইভাবে অবহেলা করেছে? দেবদাসী থাকার সময় হয়তো কোনো কোনো দিন একবারও মাকে মনে পড়েনি অথচ মা প্রতিনিয়ত তার কথা ভেবেছেন। এখনো ভাবছেন। তার বুক ফেটে কান্না এসে যায়। দুহাত দিয়ে কণ্ঠ চেপে ধরে। কিশোরী তার হাত সজোরে ছাড়িয়ে নেয়।
–মা।
অমরু তাড়াতাড়ি এসে দাঁড়ায়। বাসন্তীর ছেলে কেঁদে ওঠে। এই থমথমে পরিবেশে সে ভয় পেয়ে যায়।
শায়িতা মা মাথা ঘুরিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন—কে যেন কাঁদছে না, ওতো
অনেক বড় এখন ৷
বাসন্তী বলে—কাকিমা, আমার ছেলে কাঁদছে।
-ও।
মা নিশ্চিন্ত হন। বাসন্তীর কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেছেন। শ্রীমতী আশান্বিত হয়। বাসন্তী তাঁর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে—কেমন আছেন কাকিমা।
মা অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন—ভালো, খুব ভালো।
—শ্রীমতীর কথা মনে হচ্ছে?
—এ্যাঁ। ওকথা কেন? সে নেই?
এবারে শ্রীমতী মাকে যতটা আলগোছে সম্ভব জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে মুখ এনে বলে—আমি এসেছি আম্মা।
–আম্মা?
এ নামে ডাকছ কেন?
—আমি শ্রীমতী আম্মা। তোমার মেয়ে আম্মা আম্মা আম্মা–
মা শ্রীমতীকে ধরতে চান। অমরু তাড়াতাড়ি ওঁর হাত তুলে নিয়ে বলে—আপনি একটু স্থির হোন, একটু সবল হোন, সব দেখতে পাবেন, সব শুনতে পাবেন। অমরু একটু দূরে সরে গেলে সেই সুযোগে শ্রীমতী মায়ের কানে কানে বলে—অমরু শতকের অমরু তোমার সঙ্গে কথা বললেন। তোমার জামাই।
মা বড় বড় চোখে চেয়ে থাকেন। কিছুই বুঝতে পারেন না।
ছেলেকে কিশোরীর কোলে দিয়ে বাসন্তী শ্রীমতীকে বলে-মায়ের কানে কানে কি বললি রে? মনে হয়, আমাকে বলিস্ নি।
—পরে বলব।
–কেন? আমাকে পরে বলবি কেন?
শ্রীমতী হাসতে হাসতে বলে—তুই দেখছি আগের মতোই হিংসুটে আছিস।
তার কথার ধরনে বাসন্তী হেসে ফেলে। বলে—পরেই বলিস।
ওদের দু’জনার হৃদ্যতা দেখে কিশোরীর ভালো লাগে। তার এদের মতো সখী নেই ৷
শ্রীমতী বাসন্তীকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের স্বামীর পরিচয় দেয়।
বাসন্তী স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর বলে—তোর সুখে আমি যে কত সুখী বলে বোঝাতে পারব না।
—জানিরে।
—আমার মন আনন্দে ভরে উঠছে। যাই সবাইকে গিয়ে বলে আসি।
—এখনি যাবি? তোকে যে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
-আমারও কি ইচ্ছে করছে? কিন্তু এত আনন্দ একা একা উপভোগ করা যায় না। ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হয়। আমি সবাইকে গিয়ে বলে, আবার আসছি। আমার সুবিধা হল এতবড় ছেলেকেও তোলা দুধ খাওয়াতে হয় না।
শ্রীমতী হেসে ওঠে।
–ওসব হাসি বেরিয়ে যাবে। সময় আসুক।
শ্রীমতীর মুখে হাসি ফোটে, কারণ সে বুঝতে পারে তার মাকে বাঁচানো যাবে। তবে, মা এখনো সব কিছু বুঝতে পারছেন না। এখনো স্বপ্নের মধ্যে রয়েছেন যেন। হয় তাঁর শ্রীমতীর উপস্থিতির কথা এখন মনে নেই। হয়তো অমরু শতকের কবির কথা মন থেকে সরে গিয়েছে। তবু তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁকে সে মরতে দেবে না। তেমন অবস্থা তাঁর নয়। আয়ুর্বেদ তাকে এটুকু জ্ঞান দিয়েছে। আজ মঞ্জরী থাকলে বড় ভালো হত। কিন্তু এই মেয়েটি প্রাণ দিয়ে তাঁর সেবা করেছে। এক নজরেই সেটা বুঝতে পেরেছে সে। অথচ মেয়েটির নাম এখন পর্যন্ত জানতে চায়নি।
সে মেয়েটি বলে—তুমি এত সুন্দরভাবে সেবা করছ, আমার মাকে দেখে আসছ, অথচ তোমার নাম অবধি জানতে চাইনি। আমার অন্যায় হয়েছে। তুমি ক্ষমা কর।
মেয়েটি বলে ওঠে—একি বলছেন আপনি! এযে আমার কর্তব্য। আমার বাবা, আপনাদের কাছে চিরঋণী। আপনি অন্যায় একটুও করেননি। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
-তোমার বাবা কিজন্যে কতখানি ঋণী আমি জানি না, জানতেও চাই না। বাসন্তী আবার বলে, আমি বাড়ি যাই শ্রী। তোরা তো অনাহারে থাকবি না। জামাই এসেছেন এই প্রথম। কাকিমার খাওয়ার ব্যবস্থা পার্বতীদের বাড়িতে হয়ে থাকে।
শ্রীমতী মেয়েটিকে বলে—তোমার নাম পার্বতী। সুন্দর নাম।
অমরু ঘরের বাইরে আঙিনায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। তার মনের মধ্যে অনেক ভাবনার উদয় হচ্ছিল। সেগুলির মধ্যে একটা ভাবনা প্রবল। শ্রীমতীর মা এতদিনে একবারও কেন নিজের মেয়ের খবর নেননি। দারিদ্র্য এর কারণ হতে পারে না। কারণ প্রথম সুযোগ আসার পরে ওঁর জমি অকর্ষিত হয়ে পড়ে নেই আর। লোকবল যথেষ্ট রয়েছে। নইলে মৃতপ্রায় ব্যক্তির সেবার জন্য কাউকে পাওয়া যেত না।
মেয়ের চিকৎসায় মা পাঁচ দিনের মধ্যে অনেক সুস্থ হয়ে ওঠেন। নিজের মেয়েকে ভালোভাবে চিনতে পারেন। অজস্র অশ্রুপাত করেন। বারবার এই বলে আক্ষেপ করেন যে তিনি ঘোরতম পাপ করেছেন। তাঁকে কিছুতেই শান্ত করা যায় না। কী পাপ যে তিনি করেছেন, তাও বলতে পারছেন না। শুধু জামাতার উপস্থিতি টের পেলে তিনি তাড়াতাড়ি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
ইতিমধ্যে শুধু নিজেদের গ্রামেই নয়, চারদিকে ছড়িয়ে যায় যে শ্রীমতী আগের চেয়ে শতগুণ সুন্দরী হয়েই শুধু আসেনি সে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান নিয়ে ফিরেছে। নিজের মাকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছে। বাড়িতে মানুষের ভীড় জমতে শুরু করল।
অমরু একসময় বলে, তোমার সময় তো ভালোই কাটছে। আমি একবার বিজয়নগর ঘুরে আসি।
শ্রীমতী নিরালায় তার গ্রীবাবেষ্টন করে বলে—তাকি হয়? তুমি না থাকলে আমি হলাম দিনের চাঁদ।
—সেটা কেমন কথা
–বুঝে নাও। তুমি তো কবি।
–তা না হয় বুঝে নিলাম। কিন্তু ভুলে যেও না আমি সভাকবি। সভায় আমার উপস্থিতি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। বলতে পার অপ্রয়োজনীয় শোভা।
শ্রীমতীর সম্বিত ফেরে। ভাবে, তাই তো। স্বামীকে আটকে রাখা উচিত নয়। অথচ তাঁর অনুপস্থিতে সব কিছু তার বিস্বাদ বলে মনে হবে। সে বলে—মাকে সঙ্গে করে নেওয়া যায় না?
কবি মৃদু হেসে বলে—সে কথা বলার যোগ্যতা একমাত্র তোমারই রয়েছে।
-না না, মাকে আরও অন্তত দশ দিন এখানে রাখতে হবে।
–তাহলে আমি আগামী কালই রওনা হব।
এতক্ষণ কথা হচ্ছিল একটু আড়ালেই। কিশোরী মেয়েটি সেখানে গিয়ে বলে—আপনার মা ডাকছেন, আপনার নাম ধরে।
মেয়েটির চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কারণ এভাবে কখনো কারও নাম ধরে তিনি ডাকেননি। মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত আহ্বানে তাড়াতাড়ি মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শ্রীমতী।
ইতিমধ্যে বাসন্তীও ছেলে কোলে নিয়ে এসে গিয়েছিল। এসেছিল শ্রীমতীর কাছে চিকিৎসা করাতে আরও দু-একজন। সবাই জেনেছে মা শ্ৰীমতীকে ডেকেছেন।
মায়ের কাছে সে গিয়ে দেখে মায়ের মুখে হাসি। তিনি সোজা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
অমরুও শ্রীমতীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়ের চোখের দৃষ্টির মধ্যে সে শ্রীমতীর দৃষ্টির মিল খুঁজে পায়। তিনিও তবে সুন্দরীই ছিলেন।
শ্রীমতী মায়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে—আম্মা। মা বলেন—তুই এত সুন্দরী হলি কি করে? —তুমিই জান। আমি যে তোমার মেয়ে। –তোর খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না?
-কেন?
–তোকে ওভাবে রেখেছিলাম।
মা কেঁদে ফেলেন। শ্রীমতী তাঁকে চেপে ধরে বলে—থাক্, পরে শুনবে। আমার কোনো কষ্ট হয়নি আম্মা।
এবারে বাসন্তী গলা ছেড়ে বলে ওঠে—তুমি ঠিক বলেছ কাকিমা, ও খুব সুন্দরী হয়েছে। ও ভালো বৈদ্য হয়েছে। ও না এলে তুমি ভালো হতে না। সবাই জেনে গিয়েছে। আজও রোগী এসেছে।
মা কোনোরকমে কান্না চেপে বলেন—সত্যি? ওর স্বামীরও শুনলাম নাম-ডাক আছে। কি যেন করে, ভুলে গিয়েছি।
বাসন্তী বলে-অমরু শতকের কবি।
কথাটা শুনেই শ্রীমতীর মন খারাপ হয়ে গেল। স্বামী চলে যাবেন বলছেন।
মা বলেন—এত অল্প বয়স।
শ্রীমতী স্বামীর খ্যাতির কথা না বলে থাকতে পারে না। বলে—হ্যাঁ, উনি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সভাকবি।
অমরু সংকুচিত হয়। শ্রীমতীর মুখে তার সম্বন্ধে এভাবে বলতে শোনেনি। তারপরে শ্রীমতী যা করে বসল তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাত ধরে বলে—তুমি ওকে যেতে দিও না আম্মা ও কিছু জানে না। আমি না থাকলে খাওয়াও হবে না।
বাসন্তী মজা পায়। সে বলে—সে কি রে খিদে পায় না?
–সে বোধও নেই। আমি যা দি, তাই খায়।
সবাই এবার অমরুর দিকে তাকায়। এমন মানুষ তারা জন্মে দেখেনি।
শ্রীমতী মাকে বলে—তুমি ওকে যেতে মানা কর আম্মা।
সবার মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। অমরু কল্পনাও করতে পারেনি এমন পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হবে। কি করবে এখন? ছুটে তো চলে যেতে পারে না। সে শ্রীমতীর মাকে বলে—ও মিছিমিছি ভাবে। আমি অত ভুলি না।
শ্রীমতী বলে ওঠে—আম্মা ওকে তুমি জান না। আমি না থাকলে ও না খেয়ে থাকবে। আমি ঠিক জানি। তুমি একটু ভালো হলে তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু নাড়ি দেখে বুঝলাম আরও ছ—দিন না গেলে তুমি যেতে পারবে না।
মায়ের খুব আনন্দ হর। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে মনে মনে প্রণাম জানান তিনি। এমন ষোলকলা পূর্ণ হবে তাঁর স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। কি করে সম্ভব হল, তিনি পরে নিজে জানবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি কি করে সামলাবেন?
বাসন্তী বলে ওঠে—বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস তুই শ্রী। তুই যতই চিকিৎসা করিস, তোর চেয়ে ওঁর জ্ঞান অনেক বেশি, দেখলেই বোঝা যায় ৷
—তুই বুঝবি না বাসন্তী। সেটিই তো হয়েছে মুশকিল। খাওয়ার কথা মনেই থাকে না। আমি ওকে একা ছেড়ে দিতে পারব না।
সবাই মজা দেখছে। মা অসহায়। এবারে অমরু নিজেই শ্রীমতীকে বলে— আমি তবু সাবালক। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি ছোট্ট মেয়ে।
মা বলেন-আমারও তেমনই মনে হচ্ছে।
অমরু বলে—আমার জন্য ওর এত দুশ্চিন্তার কারণই নেই। ওর সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী আমার বন্ধুর স্ত্রী। আমার বন্ধু বিজয়নগরের খুব কাছের একটি রাজ্যের সামন্ত রাজা। সে প্রতিদিন নিজে এসে আমার খোঁজ নেয়। ওর স্ত্রীও অনেক সময়ে সঙ্গে আসেন। ওকে জিজ্ঞাসা করুন, সত্যি বলছি কিনা।
শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ, হ্যাঁ সব সত্যি। তুমি মিথ্যা বল না, সবাই জানে ৷ রাজাও জানেন।
—তাহলে?
বাসন্তী খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে—এবারে বুঝেছি কাকিমা।
-কি?
—মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকতে পারে না। এ হল ওর ছুতো। শ্রী
মতীর মুখ’রাঙা হয়ে ওঠে।
মা হেসে বলেন—ও।
অমরু অপ্রস্তুত। সে বলে—না না, তেমন কিছু নয়। আমি তো জানি না। বাসন্তী বলে ওঠে—আপনি কিছুই বোঝেন না। দরকারও নেই। আপনি বরং কবিতা লিখুন। তাতে দশের উপকার।
সবাই হেসে ওঠে।
একজন অসুস্থ ব্যক্তি ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে বলে ওঠে—আর তো পারি না। কতক্ষণ অপেক্ষা করব? আমার পেটের ব্যথা শুরু হয়েছে রোজকার মতো।
শ্রীমতী তার মুখের দিকে চেয়ে বলে—কতক্ষণ খাওয়া হয়নি।
—সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি।
—সঙ্গে খাবার আছে?
—তা আছে। তোমাকে দেখিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় খাব।
—এখনি খেয়ে নিন, ব্যথা থাকবে না। আপনার না খেয়ে থাকা চলবে না। কোনো অসুখ নেই
একথা শুনে সবাই অবাক। দেখা গেল, খাওয়ার পর সত্যই ব্যথা কমে গেল। সে বলে ওঠে—তুমি মা ধন্বন্তরী।
শ্রীমতী হেসে বলে—ধন্বন্তরী নই। আমি নুটি গাঁয়ের মেয়ে শ্রী। আপনি কখনো বহুক্ষণ খালি পেটে থাকবেন না। নাড়িতে ঘা হবে।
.
বিশাল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেও রাজা রসিকতা করতে জানেন। সবার ধারণা যিনি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, স্বভাবতই তাঁর দায়িত্ব অসীম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সব সময় চিন্তা করতে করতে তাঁর মন নীরস হয়ে যায়। কিন্তু রাজার তেমন হয়নি কখনো। রাজ্যের দায়িত্ব তাঁর কাছে গুরুভার বলে মনে হয় না কখনো। তাঁর দৈনন্দিন কর্ম বলে মনে হয়। তাই তিনি রসহীন নন। যখন শুনলেন ছয়দিন পরে কবিপত্নীর মাকে রাজধানীতে আনা নিরাপদ তখন অতীশকে বলেন—তোমাকে একটা অভিযানে যেতে হবে।
অতীশ বিস্মিত হয়। কোনো অভিযানের আগে আলোচনা হয় এবং সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার পরে এখন তার দায়িত্ব অনেক বেশি। তার স্থান বলতে গেলে দানায়িকের পরেই। তাই অভিযানে যেতে হবে অথচ সে জানে না?
রাজা বলেন—শোন, ছয়দিন পরে তুমি তোমার বাহিনী থেকে পাঁচটি সুসজ্জিত হস্তী, পঞ্চাশটি অশ্ব, পাঁচশো পদাতিক আর চারটি শিবিকা নিয়ে কবি-পত্নীর গ্রামে অভিযান চালাবে।
রাজার ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই অতীশ হেসে ওঠে। রাজা ধমকে ওঠেন—হাসছ কেন? শুধু কবি-পত্নী নন, উনি রাজবৈদ্য, একথা ভুলে গেলে?
—না মহারাজ। আপনি বলুন।
—একটি শর্ত রয়েছে। যাওয়ার পথে কোনো গ্রামবাসীর মনে যেন বিন্দুমাত্র আতঙ্কের সৃষ্টি না হয়। বাহিনীর সবাই যেন তাদের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে যায়। তারাও যেন মজা পায়। তবে এজন্য সৈন্যরা ফিরে এলে তাদের পনের দিন নতুন করে কঠোরভাবে শিক্ষা নিতে হবে। নইলে প্রকৃত যুদ্ধের সময়ও তারা সব কিছু সহজভাবে নিতে চাইবে।
—বুঝেছি মহারাজ।
—যেদিন ওখানে পৌঁছোবে, তার পরের দিনই ফিরতে হবে। কোন সময় পৌঁছাতে হবে এবং ফিরতে হবে সেটা তোমরা ঠিক করবে। ইচ্ছে করলে তোমার পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পার।
—নিয়ে যেতেই হবে মহারাজ।
—ঠিক আছে। কবি কেমন আছেন?
—ভালোই আছে, তবে একটু অন্যমনস্ক
-কবিরা অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন। তোমরা অশ্ব হাতি আর পদাতিক নিয়ে ওঠাবসা কর বলে ওসব বুঝবে না।
অতীশ মনে মনে ভাবে, যার সঙ্গে শৈশবে থেকে তার ওঠা-বসা তাকে সে চিনবে না, চিনবেন মহারাজ? তবু তিনি অধীশ্বর। তাই চুপ করে থাকবে ভেবেও বলে ফেলে—এ অন্যমনস্কতা অন্য ধরনের
—অত ভাবতে হবে না। ভাবনার দিন আসছে। আজ দূত এসে খবর দিয়েছে দিল্লির সুলতানের সঙ্গে নিজাম-উল-মুকের শলাপরামর্শ চলছে বুঝতেই পারছ এই আক্রমণ খুবই বড় ধরনের হবে। আমাদের যেসমস্ত অল্পবয়সী সেনা নায়কগণ ভালো কাজ দেখাচ্ছে, তাদের স্থায়ীভাবে পদোন্নতি করতে হবে। দানায়িক এই কথাই বলেছেন।
অতীশ ভীষণভাবে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। বুঝতে পারল, মহারাজের সত্যই তুলনা নেই।
.
শ্রীমতী ভাবে, আজ সকালে চারদিন শেষ হল। আরও কত বাকি। আগামী কাল সকাল হবে, রাত্রি হবে, তারপর আর একটা দিন তারপরও……ওঃ সে আর ভাবতে পারে না। মা তার পাশে বিছানায় শুয়ে হাসি মুখে কি যেন বলছে। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু তার মন পড়ে রয়েছে বিজয়নগরে। প্রথম যেদিন ওকে গুরুদেবের সঙ্গে দেখেছিল সেদিন তার মনের ভেতরে একটা অনাস্বাদিত অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর থেকে সব কিছু তার মনে আসা যাওয়া করতে থাকে। তারপর সেই স্পর্শ, ওই প্রথম স্পর্শ করেছিল বটে, কিন্তু সেজন্য তাকে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। নইলে হয়তো সেদিন স্পৰ্শই করত না। নিজেকে বেহায়া বলে মনেও হয়নি তার। আজও হয় না।
মা বলে ওঠে—তুই আমার কথা শুনছিস না।
চমকে উঠে শ্রীমতী বলে—শুনব না কেন? শোনার জন্যই বসে রয়েছি।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—তুই না এলেই পারতিস।
শ্রীমতী দুবাহু দিয়ে মাকে ঘিরে ঝুঁকে বলে—তুমি নিষ্ঠুর বলে একথা বললে। অথচ আমি ভাবতাম আমি অনাথ। আমার মা আমাকে এখানে পৌঁছে দিলে অনাহারে মারা গিয়েছে। একবারও মাথায় আসেনি, তুমি ওই দুর্ভিক্ষের পরে বেঁচে রয়েছ। গ্রামে এমন কেউ ছিল না যে নিজেদের পরিবারের লোকদের বাঁচিয়ে অন্য কাউকে বাঁচাবে।
–ঠিকই বলেছিস। তেমন কেউ ছিল না। আজ বাসন্তীরা বেঁচে রয়েছে। তেমন আরও যারা বেঁচে রয়েছে তাদের দেখতে হয়েছিল কংকালের মতো। তবু তারা বেঁচে ছিল, কিছু পেটে দিতে পারত বলে। তোর বাবা বেঁচে থাকলে আমরাও পারতাম।
–তুমি বাঁচলে কি করে?
—এক সিদ্ধপুরুষের দয়ায়। তাঁর কোনো আশ্রম নেই। সেই সময় তুঙ্গভদ্রার তীরে কিছুদিনের জন্য একটি শাম্মলী গাছের নীচে আসন করেছিলেন। একদিন দেখতে পেলেন গ্রামের কিছু লোক একটি মৃত দেহকে ভাগাড়ে ফেলে দিতে পায়ে দড়ি বাঁধছে। সেই সময়ে এত লোক মরছিল যে পাহাড়ের পাশে এক গভীর খাদের মধ্যে মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসত। সন্ন্যাসীর সন্দেহ হল। তিনি দূর থেকে হাত নেড়ে ওদের মানা করলেন। কাছে গিয়ে বললেন—ওর দেহে প্রাণ আছে।
গ্রামবাসীরা বিদ্রূপ করে বলে—সাধুরা দূর থেকেই সব বলে দিতে পারেন নাকি? সারাদিন পড়ে আছে আমরা দেখছি। গায়ে মাছি বসছে।
সাধু কোনো কথা না বলে কমণ্ডুল থেকে জল নিয়ে আমার মুখে ঝাপটা দিলেন। তারপর ফোঁটা ফোঁটা জল পান করানোর চেষ্টা করে শেষে সফল হলেন। গ্রামবাসীরা তাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। সাধু হেসে বলেন—তোমরা কোনো অন্যায় করনি। এ বলতে গেলে মৃতই ছিল। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল।
এর পরে ওই শাল্মলী গাছের নীচেই তিনি আমাকে সুস্থ করতে সচেষ্ট হলেন। গ্রামবাসীরা সবাই তাঁকে সাহায্য করেছিল।
শ্রীমতী বলে—তারপর?
—তারপর আর কি। আমি সুস্থ ছিলাম, সবল হলাম। সাধু বিদায় নিলেন। গ্রামবাসীরা তাঁকে কত সাধ্যসাধনা করল ওখানে আশ্রম করতে। তিনি মৃদু হেসে বলেন—তা হয় না। চরে বেড়ানোই আমার কাজ। তখন আমি ওঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বললাম—আমাকে আপনি আর দর্শন না দিলে আমি এই প্রাণ রাখব না। তিনি বললেন—তোর সুখের দিনে একবার আসব। কথা শুনে আমার বুকের ভিতরে হাহাকার করে উঠেছিল। কারণ অভুক্ত অবস্থায় থাকলেও পথে সবাই যখন শুনছিল তোকে দেবদাসী হতে মন্দিরে রেখে ফিরছি তখন তারা ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়েছিল। অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়েছেন। দেবদাসী হওয়ার পরিণতির কথা সবিস্তারে বলেছিল। আমি আত্মহত্যা করতে পারিনি। বুঝে ছিলাম, আত্মহত্যা করতে হলেও শক্তি দরকার। আমার সেই শক্তিও নেই। গ্রামের মানুষেরা দেবদাসী সম্বন্ধে অতশত জানে না। তাই তারা বিদ্রূপ করেনি। কিন্তু আমি নিজের অন্যায়বোধের জ্বালা ক্রমাগত দগ্ধ হতাম। তোকে দেখতে যেতে সাহস পাইনি। এখন বুঝতে পারি আমি তোর বাবার উপযুক্ত স্ত্রী ছিলাম না, তোর মা-ও হতে পারিনি।
–ও সব আমি জানি না মা। তবে এটুকু বুঝলাম। তোমার ওপর ভগবানের আশীর্বাদ রয়েছে।
—কিভাবে?
—তিনি তোমাকে নিয়ে পশুপতি মন্দিরে গিয়েছিলেন বলে। তিনি তোমার হাত দিয়ে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে আমাকে সঁপে ছিলেন বলে। নইলে তুমি যা আশঙ্কা করতে এতদিন ধরে, তাই হত। তুমি পুণ্যবতী মা, তাই আমার বাবার মতো স্বামী পেয়েছিলে, আর আমিও তোমার স্বামী ভাগ্যের মতো ভাগ্যবতী। তোমার পুণ্যের ফলে ওঁর দেখা আমিও পাব বলেছেন। কিন্তু আমার গুরুদেবের প্রয়াণের পরে আমি সেকথা ভাবতেও পারছি না। বরং আমার গুরুদেব চিরজীবী হোন। অবিমিশ্র সুখ বা দুঃখ কিছুই বোধহয় মানুষের ভাগ্যে জোটে না।
মা চোখ মুছল—দুঃখের না সুখের? হয়তো দুই চোখে দুই ধরনের ধারা। কারণ আজ স্বামী নেই তাঁর।
.
তারপর একদিন মধ্যাহ্নের পরেই বহু অশ্বের পদধ্বনি। গ্রামবাসীরা কুটির থেকে বাইরে এসে কি করতে হবে ভেবে পায় না। আশেপাশে বনজঙ্গল নেই। ক্ষেত কর্ষিত। বীজ বপন করা হয়নি। অনেক অশ্ব হঠাৎ থেমে গেল। তারপর সুসজ্জিত দুটি হস্তী এসে শ্রীমতীদের কুটিরের অদূরে থামল। হাঁটু মুড়ে বসল। শ্ৰীমতী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল। কিশোরী মেয়েটি কেঁদে ফেলল। শ্রীমতী তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। শেষে দুজনা দেখল অবিশ্বাস্য দৃশ্য। হাওদা থেকে নামল অমরু। তার মন নেচে উঠল। বলে উঠল—মা, তোমার জামাই এসেছে।
–তাই নাকি। মা কোনোরকমে উঠে বসতে চায়।
—উঠো না। একটা শিবিকা দেখছি। ওমা, মঞ্জরীও এসেছে।
—মঞ্জরী কে?
—আমার সখী। ওমা, ওর স্বামীও এসেছেন। এসব কি করেছে ওরা। কত সৈন্য এসেছে। এরা থাকবে কোথায়? খাবে কি? কোথায় কি করব এখন !
—তাহলে? জামাইরা অভুক্ত থাকবে? ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি হয়নি? তোর সখীও ভাবল না! সে তো মেয়ে।
মঞ্জরী ছুটে এসে শ্রীমতীকে জড়িয়ে ধরে বলে—মনে হচ্ছে কতদিন তোকে দেখিনি।
—এবার তো দেখলে। কিন্তু থাকা খাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?
—ওসব ভাবিস না। ওরা যুদ্ধ করতে বেরিয়েছে। সব ওরা করে নেবে। —কার সঙ্গে যুদ্ধ?
—এখানকার মানুষদের সঙ্গে। তবে একটা শর্তে সন্ধি হতে পারে। গ্রামবাসীরা মাসীমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে দিলে স্থায়ী শান্তি।
শ্রীমতী হেসে ফেলে। বলে—মা তোমার আর একটা মেয়ে। বিয়ের পর খুব তাড়াতাড়ি পেকে গিয়েছে।
মঞ্জরী মাকে প্রণাম করতে তিনি তাকে আদর করেন, আশীর্বাদ করেন।
.
পরদিন বিজয়নগরে যাত্রার আগে অতীশ এসে মাকে বলে—আপনার জমিতে নিয়মিত ফসল ফলবে, আপনার কুটির সংস্কার করে অটুট রাখা হবে। যখন খুশি আসতে পারবেন।
এতদিন পরে স্বামীর শোকে তিনি কাতর হলেন। মঞ্জরী আর শ্রীমতী তাঁকে ধরে রাখে। একটু পরে দুটি শিবিকা এল। তার সঙ্গে সঙ্গে একজন সাধু এসে দাঁড়ালেন। কোথা থেকে এলেন এই সন্ন্যাসী? সবাই বিস্মিত। মা তাঁকে দেখেই তাড়াতাড়ি এসে বলে—বাবা, আপনি এসেছেন?
–তাই তো কথা ছিল।
–আমি এত ভাগ্যবতী ভাবিনি বাবা।
-তোমার ওপর ভগবানের কৃপা রয়েছে। ক্রিয়াশক্তি দেখছি ভালোই করেছে। শ্রীমতী বলে ওঠে—আপনি তাঁকে চেনেন?
—ওকে ছেড়ো না। আয়ুর্বেদের সবকিছু জানো না এখনো। কেউ আমাকে অনুসরণ করো না।
সাধু সৈন্যদের মধ্য দিয়ে পথ করে চলে গেলেন।
অতীশ অস্থির হয়ে বলে ওঠে—আমি যাই। ওঁর পা ধরে নিয়ে আসি। অমরু হেসে বলে—পাগলামি করিস না। মনে হলে, উনি নিজেই আসবেন, ডাকতে হবে না।
সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই সমস্ত অঞ্চল জনশূন্য হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা শোকাচ্ছন্ন অথচ গর্বিত। একদিনের মধ্যে যা ঘটে গেল, সে সব ওদের কল্পনাতীত ছিল। ওদের গ্রামের মেয়ে শ্রী, রানী না হয়েও যেন রাজেশ্বরী। ওর স্বামী রাজা না হয়েও যে রাজাধিরাজ। আর ওই সাধু। সবাই বলাবলি করে, উনি তো স্বয়ং ঈশ্বর। কেউ চিনতে পারল না।
একজন প্রৌঢ় বলে ওঠে—সব কিছুর মূলে যে রয়েছে, তার নাম তোমরা একবারও বলছ না।
সবাই তার দিকে ফিরে বলে—কে?
—একজন অসাধারণ পুরুষ। সে ছিল বীর চরিত্রবান, দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তারই কন্যা বলে শ্রীমতী এত গুণসম্পন্না হয়েছে। সে আমাকে বলত নিজের মেয়ে বলে বলছি না সব কিছু এত তাড়াতাড়ি বুঝে নেয়, আমি নিজেই অবাক হই। ওর জ্ঞানপিপাসা মেটাতে আমাকে রাজধানীতে পুস্তকের খোঁজে ছোটাছুটি করতে হয়।
এক বৃদ্ধ বলে—হ্যাঁ, সোমেশ্বর। ওর মৃত্যু এত আকস্মিক ছিল যে আমরা সেই ভয়াবহ সংবাদ শুনতে প্রস্তুতই ছিলাম না। তবু শুনলাম, সয়েও গেল।
এতদিন পরে সোমেশ্বরের চেহারা সবার চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সবাই মনে মনে অনুতপ্ত হল। সোমেশ্বরের কথা তাদের মনে আসা উচিত ছিল। আসত ঠিকই, কিন্তু সেই টানা করাল দুর্ভিক্ষ তাদের অমানুষ করে দিয়েছিল। সোমেশ্বর গেল যুদ্ধে, তাছাড়া নটবর গেল, বদ্রীনাথের স্ত্রী আর মেয়ে গেল, কৈলাস গেল, এমন কি পালোয়ান ভবশঙ্করও গেল দুর্ভিক্ষে ধুঁকতে ধুঁকতে। চোখের সামনে ভবশঙ্করের অতবড় দেহটা শুকিয়ে কেমন হয়ে গেল, অথচ কারও মনে এতটুকু সহানুভূতিও জাগল না। সবাই তো তখন অমানুষ। গরু ছাগল কিছু ছিল না।
.
শ্রীমতীর অন্তঃকরণে সংগোপনে একটি ইচ্ছা রয়েছে। এই ইচ্ছার কথা কাউকে বলা যায় না, অথচ দমনও করা যায় না। মাধবী প্রথম তার মনে এই ইচ্ছা জাগায়। মাধবীর মনে তেমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সে অনেক সময় ভবানী দিদির কাছে গিয়ে বসত তার সুখ-দুঃখের কথা শুনতে। সেই সময় ভবানীদি এক দুৰ্বল মুহূর্তে তাকে বলে ফেলেছিল তার কিশোরী জীবনের এক অতি অল্প স্থায়ী প্ৰণয় কাহিনী। সেই তরুণটি তারই গ্রামের। ভালোবেসে ফেলেছিল তাকে। ছেলেটি কিছু বুঝত না, শুধু সে ভবানীকে ভালোবাসতে জানত, তীব্রভাবে ভালোবাসত। ভবানী মাধবীকে বলেছিল, ওই বয়সে অমন হয়। তারও হয়েছিল। সে তরুণকে নদীর ধারে নিয়ে যেত, তার মাথা কোলে তুলে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকত। সেও চেয়ে থাকত। ওদের আর কিছু মনে হত না। শুধু মনে হত, পৃথিবীতে আর কেউ নেই, কিছু নেই। ফলে ধরা পড়ে গেল। দোষ হল ভবানীর যদিও ছেলেটি বলেছিল, ভবানীর দোষ নেই। অথচ ভবানী জানত সম্পূর্ণ দোষ তারই। কিন্তু সে একে দোষ ভাবেনি। ফলে ভবানীর আশ্রয় হল এই মন্দিরে। কার পরামর্শে তাকে এখানে পাঠানো হল, সে জানে না। তবে ভালোই হল। ওকে ছাড়া অন্য কারও কথা সে ভাবতে পারত না। তারপর অবশ্য সব ফিকে হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির মুখও তার মনে পড়ে না। এ জন্য একটা অপরাধ বোধ রয়েছে তার। কারণ ছেলেটি তাকে মনে রেখেছে হয়তো। মাধবী আর একটা কথা বলেছিল। দেবদাসীদের অনেক মানুষ হেয় চোখে দেখে। তার কারণ রয়েছে বৈকি। দেবদাসী হলেও, তারা প্রকারান্তরে বারবনিতাও বটে। তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় অনেককে। কিন্তু সবাই তো একরকমের নয়। সরস্বতীই তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। প্রত্যেক মন্দিরেই এমন কেউ একজন থাকে যায় কাছে বিষ আছে। সে হয়তো নিজের নিরাপত্তা আর কুমারীত্ব অটুট রাখার আকাঙ্খায় বিষ সংগ্রহ করে রাখে। তারপর সেই বিষ থেকেই যায়। ভাবে, অন্যের দুঃসময়ে কাজে লাগতে পারে। ভবানী দিদি মাধবীকে বলেছে, তার কাছে আছে।
শ্রীমতী ভাবে এখন সে বিষের পরিবর্তে অমৃত চায়। না, অমৃতও তো পেয়ে গিয়েছে। তার অমৃত অমরু। কিন্তু অমরুর মাথা নিজের কোলে রেখে তুঙ্গভদ্রার তীরে কোনো এক চন্দ্রালোকিত রাত্রে সে যদি নির্নিমেষ নয়নে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে পারত তাহলে তৃষ্ণা মিটত। ভবানীদিদির কৈশোরের প্রণয়ের সেই সাধ এখনো মেটেনি তার। কিন্তু আর কি সম্ভব? লোকে দেখলেই চিনে ফেলবে। কৌতুকের চমকপ্রদ খোরাক পাবে তারা। চাঁদনি রাতে আয়ুর্বেজ্ঞ স্ত্রীর ক্রোড়ে সভাকবি মাথা রেখে তুঙ্গভদ্রার তীরে শুয়ে রয়েছেন। কেন, নিজের শয়নকক্ষ নেই? হতে পারে কবির খেয়াল। অমন রূপসী স্ত্রীর জ্যোৎস্নালোকধৌত মুখখানি দেখে নতুন ভাবের উদয় হবে, শ্লোকের জন্ম হবে। কিংবা রূপসী স্ত্রী দেখে নিতে চায় কবির স্বপ্নময় দৃষ্টির গভীরতার অতলান্ত রয়েছে কিনা। সে ডুব দিতে চায়। এইসব চিন্তা যখন শ্রীমতীকে বারবার দোলা দিচ্ছে তখন অমরু একদিন বলে আমার কৃষ্ণানদীর তীরে যেতে ইচ্ছে হয় খুব। শ্রীমতী চমকে ওঠে। বলে কেন কৃষ্ণা নদী কেন? তুঙ্গভদ্রাও তো রয়েছে। চাঁদের আলো তুঙ্গভদ্রার জলধারা প্রস্তর খণ্ডে বাঁধা পেয়ে কেমন টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দেখে মুগ্ধ হতে হয়।
–আমি শোভা দেখার কথা বলছি না ৷
—তবে?
-মাধবাচার্যের আশ্রম দেখার সাধ। তাঁকে তো চেনই।
–কি করে চিনব? কত বছর আগের মানুষ তিনি। তবে মায়ের কাছে পুত্রের পরিচয় না দিলেও চলবে।
অমরু হেসে ওঠে। বলে—তবে আর কি। পুত্রের আশ্রম দেখতে যেতে পার।
শ্রীমতীর মনেও আগ্রহ জন্মায়। মাধবাচার্য সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। তাঁর মতো পুত্র গর্ভে ধারণ করা মহা ভাগ্যের। তিনি যে আশ্রমে বাস করতেন সেটি তো তীর্থস্থান। সে বলে-আমরা দু’জনা গেলে মা একা থাকবেন। বছরের পর বছর একা থেকেছেন।
—প্রতিবেশীরা রয়েছেন। তাছাড়া রাজপুরী থেকে তো একজন আসে।
—রাত্রে?
—দেখি অতীশকে বললে একটা বুদ্ধি দিতে পারে।
—আমি জানি কি বুদ্ধি দেবেন উনি।
– কি?
—মঞ্জরী রাতে মায়ের কাছে থাকবে।
–আমার কেমন সংকোচ হয়।
-আমারও। এখানকার মা হলে চলত।
–তার চেয়ে মাকে সঙ্গে নেওয়া যায় না?
-গ্রাম ছেড়ে আসার সময়ে দেখলে তো তো ওঁর কষ্ট হয়। ওঁকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
—চল, মাকে বলে দেখি।
মা তো শুনে মহাখুশি। বললেন—আমার জন্য ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি। রাজপুরী থেকে লোক আসছে আশেপাশের সবাই আছে। আমি বেশ আছি। তোরা ঘুরে আয়। এতটুকুও দ্বিধা করিস না। জামাই-এর সাধ হয়েছে বাধা দিস না।
অতীশ শুনে বলল—আমি মঞ্জরীর একজন পরিচারিকাকে রেখে দেব। মঞ্জরী গেলে উনি হয়তো বাড়াবাড়ি ভাববেন।
আশ্রমে মাধবাচার্যের বংশের কেউ নেই। ওই গ্রামেও তাঁদের বংশের কাউকে পাওয়া যায় না। তবে আশ্রমটি খুব ভালো লাগল দুজনারই। ওখানে মাধবাচার্যের একজোড়া কাষ্ঠনির্মিত পাদুকা রয়েছে। ওরা ওই পাদুকাকে প্রণাম করে। বোঝা যায় আশ্রমটিকে সযত্নে রক্ষা করা হয়। অনেকেই আসে। শয়নাচার্যও এখানে আসতেন। কারণ এটি তাঁর পিত্রালয়। তিনি তাঁর শৈশব এখানে অতিবাহিত করেছেন। তাঁরও একজোড়া পাদুকা আর একটি সোনার অঙ্গুরীয় রয়েছে ওখানে। উভয়ের পাদুকাই চন্দন-চর্চিত।
.
গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে যেতেই হয় আয়ুর্বেদশাস্ত্র সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে। সিদ্ধপুরুষের আদেশ। অমরু যখন রাজসভায় যায় তখন মাঝে মাঝে পশুপতি মন্দিরে শ্রীমতী যায়। যেতে খুব ভালো লাগে। মাধবী, অবলা দয়াবতীদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা হয়। গুরুদেবের দর্শন মেলে, শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
গুরুদেব তাকে বলেন—রোগনির্ণয়ই হল প্রধানতম কাজ, আর সেই কাজ শাস্ত্রপাঠ করলেই ঠিকভাবে আয়ত্তে আসে না। এই ক্ষমতা বলা যেতে পারে ভগবদ্-প্রদত্ত। মাধবীর মধ্যে এই গুণটা কিছু রয়েছে দেখছি।
শুনে শ্রীমতীর খুব আনন্দ হয়। তারপর অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে বলে–আপনি শুধু আমাদের দু’জনকেই পাত্রস্থ করলেন—
গুরুদেব হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন— চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো পারিনি। বিজয়নগরের সুদিনও তো শেষ হয়ে আসছে। আর বড়জোর পঁচাত্তর-আশি বৎসর।
শ্রীমতী ভীত কণ্ঠে বলে—কেন, গুরুদেব?
—মাধবাচার্যও বলে গিয়েছিলেন, রাজপুরুষদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে, এই হিন্দু সাম্রাজ্য তিনশো বছরের বেশি নয়। আবার টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শুরু তো হয়ে গিয়েছে। ভ্রাতা ষড়যন্ত্র করে রাজাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। ভাগ্যক্রমে রাজা বেঁচে গেলেন। এমন ঘনঘন হবে হয়তো। রাজপুত্রকে পিতার মতো উপযুক্ত বলেও মনে হয় না।
শ্রীমতী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সঙ্গে মাধবীদের পাত্রস্থ হওয়ার বিষয়টি কেমন করে যেন গুলিয়ে ফেলে। কারণ ক্রিয়াশক্তিই ওইভাবেই বলেছিলেন। আসলে তিনি রাজপরিবারের ঘটনায় খুবই বিচলিত হয়েছেন। সবাই হয়েছে। মাধবী শ্রীমতীর সঙ্গে চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা করে। মাধবী বলে–তুমি কত জান।
—তুমিও শিখবে। গুরুদেব তোমার প্রশংসা করেছেন।
দয়াবতীর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। শ্রীমতী মুগ্ধ হয়ে শোনে। মাধবী বলে—আমার যদি অমন প্রতিভা থাকত।
—সবার সব হয় না।
-দয়াবতী কি বলে জান?
– কি?
–বলে, তোমায় গুরুদেব যেমন সুপাত্র এনে দিয়েছেন, তাকে দিতে পারবেন না। সে তো সুন্দরী নয়। তবে এনে দিতে চাইলেও সে সম্মত হবে না।
– সে কি? কেন?
–সে তার স্বামী পেয়ে গিয়েছে। পশুপতি নাথ তার স্বামী। তেমনই মনে হয় কিন্তু। সব সময় একা একা সেখানে যায়। রাতেও যায়। অন্য কেউ ভাববে, মাথা খারাপ হয়েছে। আসলে কিন্তু মাথা ঠিক আছে।
-আশ্চর্য! যাই তো আর একবার দেখে আসি।
শ্রীমতী দয়াবতীকে পেল বিগ্রহের সামনে। নিমীলিত চক্ষে গান গেয়ে যাচ্ছে। অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরে পড়ছে।
মাধবী নিম্নস্বরে বলে—ওর স্তবের শেষ নেই।
–কোথায় পায়?
—ওর নিজের তৈরি।
—গুরুদেব জানেন?
–জানতেন না, জেনেছেন। কিছু বলেন না। শুধু নিজে যখন পূজা করেন তখন ওকে কাছেই রাখেন। ওকে গাইতে বলেন। স্তবগুলো গান হয়ে ওঠে। ফেরার পথে শ্রীমতী ভাবে, দয়াবতীর কাছে সে পরাজিত। দয়াবতী যেমন নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিয়েছে তার দয়িতের কাছে, সে তেমন পারেনি। অথচ অমরু তার রূপে যে মুগ্ধ হয়নি তেমন নয়। কিন্তু সেই মুগ্ধতা, অন্যরকমের। সে অমরুকে ফিসফিস্ করে বলেছে—আমি তো রূপবতী নই। আমাকে তোমার ভালো লাগে না।
—না না, কে বলেছে একথা? তোমার রূপ স্বর্গের দেবীর মতো। ওই রূপে মোহের চেয়ে মুগ্ধতা সৃষ্টি করে অনেক বেশি।
হতাশ হয়েছে শ্রীমতী। অন্তত প্রথম সেইদিন সে নিজে দেবী হতে চায়নি। সে হতে চেয়েচিল ঊর্বশী, হতে চেয়েছিল মেনকা। দয়াবতীর বিগ্রহ দেবতা হয়েই রয়েছেন। এতে তার এতটুকুও বিকার নেই। নির্বিকার হয়ে সে স্তব সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু শ্রীমতী? কতদিন অমরুকে বিগ্রহ করে রাখতে পারল? সে অমরুর মুগ্ধতায় সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। কারণ তার শিরা-উপশিরায় তখন উষ্ণতার ছোটাছুটি। তাই প্রাণপণে অমরুরর মুগ্ধতাকে মোহাবিষ্ট করতে প্রয়াসী হল। তাতেই অমরুকে পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যাবে। তাতে তার নিজের পরিতৃপ্তি। অবশেষে কাঙ্খিত রাত্রি এল।
পরদিন সকালে মা শ্রীমতীর মুখের দিকে চেয়ে পুত্রকে বলেছিলেন তুই কাব্য লিখিস ভালো কথা। সেটা একধরনের সৃষ্টি। তাই আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে জেনে যেতে চাই যে তোদের বংশধারার শেষ পুরুষটি যেন তুই না হোস্।
শ্রীমতী অত্যন্ত লজ্জা পায়। আজই উনি একথা বললেন কেন? আর বললেন তারই মুখের দিকে চেয়ে। তবে কি তিনি এতদিন তার মুখে অতৃপ্তির ছায়া দেখতে পেতেন? সে ধীরে ধীরে মায়ের সামনে থেকে সরে যায়।
.
গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি একদিন রাজপুরীতে গেলে মহারাজা তাঁকে একান্তে বলেন—আমার পুত্রটির জন্য আমার অশান্তি বেড়ে যাচ্ছে প্রভু। এর একটা প্রতিবিধান করুন। নইলে সাম্রাজ্যের ক্ষতি হবে।
—আমি রাজনীতি করি না মহারাজ। তবে এটুকু বলতে পারি যে কেউ নিজের স্বভাবের পরিবর্তন কখনো করতে পারে না। আপনিও পারেননি।
—আমি?
—হ্যাঁ। ভেবে দেখবেন। তবে আপনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা আর বিবেকসম্পন্ন বলে, নিজেকে সংযত রাখতে পারেন। স্বভাবের অনেক পরিবর্তন এনেছেন। একবার ভাবুন তার জন্য আপনাকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু আপনার পুত্রতো অমন নয়।
—তাহলে? বিজাপুরের সুলতান অবধি জেনে গিয়েছেন, যে রাজপরিবারে অশান্তি চলছে। তিনি আমাদের প্রতিবেশী সুলতান কুতুব খাঁকে উসকে দিচ্ছেন বারবার। -আপনি জীবিত থাকতে কোনো বিপদ হবে না। তবে শত্রুর আক্রমণ বন্ধ করা যাবে না।
–সে তো হবেই। তার জন্য আমি প্রস্তুত।
—আপনার সদ্যজাত পৌত্র কিন্তু সুলক্ষণযুক্ত। যদি আপনার পুত্রের রাজত্বকাল ভালোয় ভালোয় কেটে যায়, তাহলে দুর্দিন এড়ানো যাবে।
—কিন্তু আমার পুত্রটি মন্ত্রীদের অপমান করতে শুরু করেছে।
-তাকে আমার সামনে আনা যাবে?
—নিশ্চয়। সে একমাত্র আপনাকে মান্য করে। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে।
—আপনাকে?
—জানি না।। আমার নিজের ভাই যদি ষড়যন্ত্র করতে পারে, পুত্রই এবার না কেন?
—ওকে ডাকুন।
কিছুক্ষণ পরে রাজকুমার এসে উপস্থিত হয়। বয়স ত্রিশ। ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করে বলে—আমাকে ডেকেছেন?
ক্রিয়াশক্তি রাজকুমারের চোখে মুখে অনাচারের ছাপ দেখতে পান। বলেন—তুমি এই বিশাল সাম্রাজ্যের ভাবী অধীশ্বর। তাই তো?
রাজকুমার হেসে বলে—হ্যাঁ। আপনার আশীর্বাদে।
—তুমি যদি সামান্য একটু হাঁচো, তাহলে রাজ্যের সবাই জানতে পারে। বিশ্বাস কর?
–আপনি যখন বলছেন, বিশ্বাস করব।
–বাঃ, তাহলে বসাও বিশ্বাস করবে যে কোনো গর্হিত কাজ যদি তুমি কর, সবাই জেনে যাবে।
—হ্যাঁ, স্বাভাবিক।
—ভাবী মহারাজকে আমি শুধু এই কথাটুকুই বলতে চেয়েছিলাম। সাম্রাজ্যের সবার চোখ-কান এই পরিবারের দিকে নিবদ্ধ।
—জানি গুরুদেব।
-সফল অধীশ্বর হতে হলে স্বভাবের অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। তোমার পিতা তাই করেছেন। আশা করি তুমিও করবে। আমাকে তোমরা একটু সম্মান কর, সেই দাবিতে এইটুকু আমার পরামর্শ।
—মনে রাখার চেষ্টা করব। আমি মৃগয়ায় যাব। অনেকে অপেক্ষা করছে। এবারে যেতে পারি?
—নিশ্চয়ই।
রাজকুমার আবার প্রণাম করে নিষ্ক্রান্ত হয়।
ক্রিয়াশক্তি বলেন—মহারাজ, রাজকুমারের ব্যবহারের মধ্যে কোনো ত্রুটি
পেলাম না। শুধু ধৈর্যের অভাব।
—তাই দেখছি। দেখা যাক।
—আপনাকে অন্য একটি বিষয়ে বলতে চেয়েছিলাম।
–বলুন গুরুদেব।
—আমার আয়ু খুব বেশিদিন নেই। বড়জোর দু-এক বছর।
-না।
-মহারাজ আমার কোনো রোগ নেই। একটা প্রদীপ কখনো চিরকাল জ্বলতে পারে না। একসময় নির্বাপিত হয়। আমি আমার মন্দিরের ভার নিতে একজনকে ইতিমধ্যে মনস্থ করেছি। সে রাজপুরীতেও আমার স্থলাভিত্তি হতে পারে। সে আপাতদৃষ্টিতে উপযুক্ত। তবু যদি ব্যর্থ হয় পরমহংস দেখবেন।
—তিনি কে?
-আমার গুরুদেব। তিনি সর্বত্রগামী। আমি নিশ্চিন্ত। দেখি দেবদত্ত সম্মত কিনা। তার সম্মতি এখনো নেওয়া হয়নি ৷
–আপনি বললেও সম্মত হবেন না?
—না। তার নিজস্ব মতামত তো রয়েছে এবং তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও বয়স তার চল্লিশও হয়নি। বলতে গেলে যুবক।
–কে তিনি?
—একজন তপস্বী। কঠোর ব্রহ্মচারী। নাম দেবদত্ত। তোমরা অবশ্যই তাকে স্বামীজী বলে ডাকবে। স্বামী দেবদত্ত।
—বিজয়নগরে থাকেন?
—হ্যাঁ। মলয়াবন্ত পর্বতের পাদদেশে ওর আশ্রম। অনতিদীর্ঘ বৃক্ষশ্রেণীর বনাঞ্চল সেটি। তবে তার কোনো শিষ্য নেই। তার আশেপাশে সব সময় কেউ থাকুক সে পছন্দ করে না। অরণ্যবাসীরা তার অজ্ঞাতে অনেক কাজ করে দিয়ে যায়। তারা বলে সন্ন্যাসী সব বুঝতে পারেন। একদিন তাদের একজনকে দেখে বলেন—তোমরা অনেক কিছু করে দাও, আমি জানি। এসব কর কেন?
–কি করব বাবা, ঘরে এক ফোঁটা জল থাকে না। গলা শুকিয়ে যেত যে।
—তাই নাকি? ঠিক আছে, আমি নিজেই এবার থেকে আনব।
—না। আপনাকে আনতে দেব না। অনেক জলের দরকার। আপনার ভাতটুকু ফুটিয়ে নিতেও জল লাগবে। তাছাড়া নুন লাগবে।
-না। আমাকে কি গৃহী বানিয়ে ছাড়বে?
—আপনাকে? তাই হয় নাকি প্রভু? আপনাকে আমরা পুজো করি। এদিকে একজন মেয়েকেও আসতে দিই না। তারা আড়াল থেকে প্রণাম করে চলে যায়।
—ভালো। আমি বলি কি, আমাকে তোমরা একটু কম দেখাশোনা করো।
—তাই করব।
ক্রিয়াশক্তি এভাবে আনুপূর্বিক বলে একটু হেসে বলেন—এই হল স্বামী দেবদত্ত।
.
ফিরিশতার বর্ণনা :–
ইসমাইল আদিল শাহা যাত্রা করলেন “বিজয়নগরের রাজার নিকট থেকে মুদকল ও রায়চুর পুনরুদ্ধারের জন্য। রাজা পূর্বেই সুলতানের উদ্দেশ্যের আভাস চরের মুখে শুনে কৃষ্ণা নদীর তীরে বহু সৈন্য নিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে অনেক সামন্ত এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিল। ফলে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী এবং বহু পদাতিক। সুলতানকে তাঁর অভিযান বিলম্বিত করতেই হল। কারণ শত্রুরা কৃষ্ণার সমস্ত ফেরী নৌকো দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ঘোষণা করে ফেলার পর তা থেকে বিচ্যুত হওয়া অসম্মানজনক। তাই সুলতান সাত হাজার বিদেশি অশ্ব সঙ্গে নিলেন এবং শত্রুদের ঠিক বিপরীতে নদীর তীরে ছাউনি ফেললেন। তিনি নৌকোয় নদী অতিক্রম করে শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রতীক্ষা করলেন।
“এখানে আসার কিছুদিন পরে তিনি তাঁর তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সেই সময় একজন সহচরকে একটি কবিতার স্তবক আবৃত্তি করতে শুনলেন “ওঠো, স্বর্ণ নির্মিত পানপাত্র ধূলায় লুণ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই আমোদ প্রমোদের মদিরায় পরিপূর্ণ কর।’ সুলতান এ শ্লোকটি শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর প্রিয় বয়স্যদের ডেকে পাঠালেন। তাদের সঙ্গে বসে তিনি সংগীত শুনলেন ও মদ্যপান করে স্ফূর্তি করলেন। ভোজনপর্ব নির্ধারিত সময়ের পরে শেষ হল। মদিরার প্রভাবে সুলতান আচ্ছন্ন হলেন। তাঁর প্রবল বাসনা হল নদী অতিক্রম করে তখনই শত্রুদের আক্রমণ করবেন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি তাঁর উদ্দেশ্যের কথা সবার অগোচরে রেখে হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করে নদীর তীরে অগ্রসর হলেন। যেন স্থানটি পর্যবেক্ষণের জন্য যাচ্ছেন। সহসা তিনি হুকুম দিলেন, যত সংখ্যক সম্ভব সৈন্য যেন ভাসমান কাষ্ঠগুলির উপর উঠে পড়ে আর অন্য সবাই তাঁর হস্তীকে জলের মধ্য দিয়ে অনুসরণ করুক। ওমরাহবৃন্দ তাঁর ভ্রম এবং তার জন্য উদ্ভূত বিপদের সম্ভবনায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সুলতান কারও কথা গ্রাহ্য না করে নদীর স্রোতের মধ্যে নেমে পড়লেন। তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যেরা দুইশত পঞ্চাশটি হস্তীতে আরোহণ করে তাঁর পিছনে পিছনে চলল।
“বরাত নেহাৎ ভালো, তাই সবাই নিরাপদে অপর পাড়ে গিয়ে পৌঁছল। বহু সংখ্যক সৈন্য কাঠের ভেলায় করে নদী পার হল। কিন্তু শত্রুসংখ্যা এতই বিপুল যে সুলতানের সম্ভবত দুই হাজার সৈন্য দিয়ে ত্রিশহাজারের বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিত্রাণের কোনো উপায় রইল না। ইসলামের বীরবৃন্দ এক প্রাণে উদ্বুদ্দ হয়ে এমন সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধ করল যে প্রায় এক সহস্র অবিশ্বাসীর পতন ঘটল। কিন্তু অবশেষে শত্রুদের গোলাবারুদ এবং নানা রকম নিক্ষেপণ অস্ত্রে বিপর্যস্ত হয়ে জীবিতেরা অনন্যোপায় হয়ে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নদীগর্ভে লম্ফ প্রদান করল। নুসরু বাহাদুর ও ইব্রাহিম যারা সুলতানের সঙ্গে একই হস্তীতে আরোহণ করেছিল তারা সেটিকে নিয়ে নদীর মধ্যে নেমে পড়ল। কিন্তু নদীর স্রোত এত তীব্র ছিল যে শুধুমাত্র সুলতানের হস্তী এবং সাতজন সৈন্য ব্যতীত বাকিরা নিমজ্জিত হল। সুলতানের এই অবিমৃশ্যকারিতার জন্য অপরিমেয় ক্ষতি হল। তিনি একাগ্র চিত্তে শপথ গ্রহণ করলেন যে যতদিন না তিনি এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারেন ততদিনে আর কখনো মাদকাসক্ত হবেন না। তারপর তিনি মন থেকে পরাজয়ের বিষাদাচ্ছন্নতা সরিয়ে তাঁর ব্যর্থতার দুর্ভাগ্যকে মোচনের জন্য তৎপর হলেন।
“এই অভিযানে মীর্জা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রেষ্ঠ উপায় নির্ধারণের জন্য সুলতান আসাদ খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আসাদ খান বলে যে ক্ষতির পরিমাণ অত্যাধিক হওয়ায় এখনকার মতো বিজাপুরে ফিরে যাওয়াই ভালো। সুলতান এই উপদেশ গ্রহণ করে, কৃষ্ণার অববাহিকা থেকে বিজাপুরের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আসাদ খানকে নিজের জায়গীরের সঙ্গে আরও কয়েকটি জিলা প্রদান করে তাকে সিপাহসালারের পদে উন্নীত করে সমস্ত গুরুতর বিষয়ের মুখ্য পরামর্শদাতা নিযুক্ত করলেন।”
মুসলমান সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়নগরের জয় হলেও ক্ষতিও কম হল না। সব চেয়ে বড় ক্ষতি সেনাপতি সঞ্জিত রায়ের মৃত্যু। মহারাজা বলেছিলেন এই যুদ্ধের পর তিনি সঞ্জিত রায়কে প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত করবেন। এতেই প্রমাণ হয়ে গেল মহারাজের কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। অতীশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে সঞ্জিতের অসমসাহসী যুদ্ধ এবং কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সে নিজেও এই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হল। তার বাঁ চোখের কোণা থেকে চিবুক পর্যন্ত বিপক্ষের তলোয়ারের আঘাতে গভীরভাবে কেটে গেল। প্রচুর রক্তক্ষরণে সে যুদ্ধক্ষেত্রেই অচেতন হয়ে পড়েছিল।
শ্রীমতী মঞ্জরী আহত সমস্ত সেনার চিকিৎসা আর সেবার ভার নিল। সঙ্গে নিল একদল সেবিকা। দেশবাসী ওই দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি। তারা ধন্য ধন্য করল। মহারাজা নিজে এসে আহতদের দেখে গেলেন। দেখতে দেখতে ওদের মধ্যে অতীশকে দেখে খুব বিস্মিত হলেন। বললেন—তুমিও এদের মধ্যে কেন? তোমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারত।
অতীশ যন্ত্রণাকাতর মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলে—এখানে ওদের দুজনার আদেশ চূড়ান্ত। তারা বলেছে, আমাকেও এখানে থাকতে হবে।
রাজা গম্ভীর স্বরে বলেন—বুঝলাম।
অতীশ বুঝল, পাশে অন্য একজন সৈন্য মহারাজের কথা শুনতে উৎকৰ্ণ ছিল বলে, তিনি অন্য কোনো মন্তব্য করেননি।
মহারাজা শ্রীমতীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন-কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
—না। হলে আপনার কাছে খবর যাবে।
মহারাজা চলে যাচ্ছিলেন। শ্রীমতী ডাকে—মহারাজা।
তিনি ঘুরে দাঁড়ান-কিছু বলবেন?
—মহারাজা আপনার সৈন্যরা বলছে, তারা তাদের পরিবারের প্রত্যেকটি
পুরুষকে পরের যুদ্ধে পাঠাবে। বলছে, যুদ্ধ তো হবেই।
রাজা হেসে বললেন—যুদ্ধের জন্য লালায়িত মনে হচ্ছে?
—তারা অনুপ্রাণিত।
-স্বাভাবিক। এত যত্ন এত গুরুত্ব আগে কখনো এরা পায়নি। আমি ভাবছি আমার বয়স যদি অনেক কম হত কিংবা আমার পুত্রটি যদি পুরুষের মতো পুরুষ হত।
মহারাজা মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে যান।
মঞ্জরী অনেক দূরে সেবায় ব্যস্ত ছিল। মহারাজা তাকে দেখতে পাননি।
ইতিমধ্যে যুদ্ধের ঝড়ঝাপটা মিলিয়ে গিয়েছে। শ্রীমতী একদিন গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে এল। এবারে মঞ্জরী আসেনি। আহত সৈন্যরা মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে। তাদের ভূস্বামীরা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। অতীশ এখনো শয্যাশায়ী বলে শ্রীমতী একা মন্দিরে এসেছে। সে মঞ্জরীর অট্টালিকায় গিয়ে অতীশকে দেখে এসেছে। তাকে শ্রীমতী একটু ম্রিয়মান দেখে বলে উঠেছিল—বাঃ এবারে বেশ মানিয়েছে।
সখীর কথায় অতীশের সঙ্গে মঞ্জরীও অবাক হয়। বলে—একথা বলনি কেন?
পুরুষের মুখে আঘাতের চিহ্ন থাকলে মনে হয় তার পৌরুষ অনেক বেড়ে যায়। ওকে দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে।
দুজনা হেসে ওঠে।
শ্রীমতী বলে—কাল গুরুদেবের কাছে যাব। তোমার এবারে যাওয়ার দরকার নেই।
—ঠিক আছে। তবে আমার চার পাঁচজন সৈন্যের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। তাদের আরও কিছুদিন দেখাশোনার প্রয়োজন ছিল। কি জানি খারাপ কিছু হয়ে না যায়।
—ভালোভাবে বলে দিয়েছোস তো?
—যতটুকু পেরেছি বলেছি। ওদের সামনে তো পরিবারের কেউ থাকে না।
—কিছু করার নেই।
গুরুদেবকে দেখে শ্রীমতী চিন্তান্বিত হয়। গুরুদেব হেসে বলেন—আমার কথা ভেবে কিছু লাভ নেই। বরং যতটুকু পার শিখে নাও। তুমি তো জান শিক্ষার শেষ নেই। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তেও মানুষ নতুন কিছু জানতে পারে।
এরপর বহুক্ষণ ধরে তিনি শ্রীমতীর সঙ্গে অনেক আলোচনা করেন। একসময় সবার অনুরোধে ভবানীদিদি গুরুদেবকে গিয়ে বলে—প্রভু আজ থাক। আপনি পরিশ্রান্ত।
শ্রীমতী লজ্জিত হয়ে বলে ওঠে—হ্যাঁ গুরুদেব। আমার বোঝা উচিত ছিল।
—আমি রাজপুরীর জন্য আমার জায়গায় আর একজনকে আনার ব্যবস্থা করছি। তবে সে সম্মত হবে কিনা তার উপর নির্ভর করছে।
-এরকম একটা কথা আমি শুনেছি।
-রাজার আপত্তি হবে না। আপত্তি হতে পারে সেই অল্প বয়সী তপস্বীর। সে যদি এই মন্দিরের ভার নিত আমি নিশ্চিন্ত হতাম। দয়াবতী তো ভার নিতে পারবে না।
শ্রীমতী চমকে ওঠে—আপনি কি বললেন গুরুদেব?
—ঠিকই বলেছি। সংগীতের মধ্য দিয়ে দয়াবতী সাধনার অনেক উন্নত মার্গে পৌঁছে গিয়েছে। ওর পূজা সিদ্ধ। স্তরের মধ্য দিয়ে ও যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তাতে কোনো ত্রুটি নেই। কিভাবে পেল আমি জানি না। তবু সে নারী, তার পক্ষে অবিচ্ছিন্নভাবে পূজা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, সমাজ সংস্কার এতটা মানবে না। তাই পুরুষ ব্রহ্মচারীর প্রয়োজন। কোথায় পাব সেই ব্রহ্মচারী? রাজপুরীর এবং এই মন্দিরের ভার একজনের উপর ন্যস্ত করাই আমার অভিপ্রেত।
.
অবশেষে একদিন ক্রিয়াশক্তি এত লোক থাকতে রাজার অনুমতিক্রমে সভাকবি অমরুকে নিয়ে মলয়াবন্ত পাহাড়ে গেলেন। বনবাসীরা তাঁদের দুজনকে আশ্রমের দিকে যেতে দেখে কৌতূহলোদ্দীপ্ত হয়। তারা এগিয়ে আসে। আশ্রম কোনদিকে জানতে চাইলে তারা দেখিয়ে দিয়ে বলে, সাধুর অসুবিধা হবে না? উনি একা থাকতে ভালোবাসেন।
—জানি। আমি সব বললে, উনি রাগ করবেন না।
একজন বলে–আপনিও তো সাধু। উনি বোধহয় অসন্তুষ্ট হবেন না। ওরা দূর থেকে আশ্রম দেখিয়ে দিয়ে ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করে।
ব্রহ্মচারী দেবদত্ত এঁদের আসতে দেখেই তাড়াতাড়ি কুটির ছেড়ে এগিয়ে আসেন। তিনি ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করতে গেলে তিনি বলেন—আমাকে প্রণাম করছ কেন ব্রহ্মচারী?
—আপনি প্রবীণ এবং ব্রহ্মচারী বলে। আমি পশুপতি মন্দিরে শৈশবে অনেক বার গিয়েছি। আপনি আমার অপরিচিত নন।
–তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। তোমার গুরুদেব ব্রহ্মানন্দজী হিমালয়ে চলে যাওয়ার আগে আমি দেখা করেছিলাম।
সেই সময় একটি ময়ূর আঙিনায় উড়ে এসে বসল। অমরু সেটিকে দেখে তপস্বীদের অস্তিত্ব ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত হল। সে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত দিল। এই দৃশ্য দেখে দেবদত্ত অবাক হয়ে ক্রিয়াশক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন—ইনি কে?
–ও বিজয়নগরের সভাকবি।
-উনি আসার পর থেকে আমি ওঁর চোখের দিকেই চাইছি বারবার। স্বর্গীয় ওই চাহনি। আপনি দেখেননি?
ক্রিয়াশক্তি হেসে বলেন—দেখেছি। ওর বিবাহ দিয়েছি এক দেবদাসীর সঙ্গে। উপযুক্ত পাত্রী।
—ওই ময়ূর কিন্তু পোষা নয়, বনের ময়ূর। ওভাবে নিশ্চিন্তে ওঁর গায়ের সঙ্গে মাথা ছোয়াচ্ছে। ওঁকে সভাকবি করা হয়েছে। উনি তো বিব্রত হবেন।
–না, মহারাজ সেই বিষয়ে খুব সচেতন, ওকে খুবই সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। ওর স্ত্রী খুব প্রতিভাময়ী আয়ুর্বেদশাস্ত্রজ্ঞ। আমার কাছে হাতেখড়ি। এখন আমি সম্ভবত ওর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারি।
দেবদত্ত হাসেন। ক্রিয়াশক্তি বলেন—আমি তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।
—অনুরোধ? বলুন আদেশ।
—তুমি যেভাবে চলছ এটি তার বিপরীত। তাই আদেশ বলা সঙ্গত হবে না। শোন, আমি আর বেশিদিন নেই। আমার বাসনা, তুমি আমার সব কাজের ভার নাও। বিজয়নগরে উপযুক্ত আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না আপাতত।
–এ যে বিপুল কাজ।
—না। তোমার পক্ষে বিপুল নয়। তুমি ব্রহ্মচারী। পশুপতি মন্দিরের একটি অংশ সম্পূর্ণ পৃথক। একদিকে যেমন দেবদাসীরা থাকে। অন্যদিকে তেমনি আমার নির্দেশে কয়েকজন ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করত এক সময়ে। ব্রহ্মচারী হয়ে তারা কেউ থাকল না। চলে গেল। আমি নিষেধ করিনি। তোমাকে রাজপুরী আর পশুপতি মন্দির দুটিরই ভার নিতে হবে। আমি নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। অন্য কাউকে ব্রহ্মচারী করতে পারিনি।
দেবদত্ত কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে—আমাকে দুদিন সময় দেবেন?
—নিশ্চয় দেব। দুদিন পরে তবে আসব?
—আপনি? না, আমিই যাব পশুপতি মন্দিরে। বুধবারে পূর্বাহ্নে। কবিকে সেদিন ওখানে দেখতে পাব?
ক্রিয়াশক্তি কবিকে ডাকেন। অমরু কাছে এলে দেবদত্তর ইচ্ছার কথা বলতে সে বলে—খুব ভালো হবে।
—শ্রীমতীকে নিয়ে যেও। ওখানেই প্রসাদ পাবে।
.
অতীশ বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিল আহত হয়ে। একদিন মঞ্জরী প্রত্যুষে তার ঘুম ভাঙিয়ে মুখে হাত বুলিয়ে হেসে বলে—এবারে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ বীরপুরুষ।
—বিদ্রূপ করছ?
সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জরী স্বামীর বুকের উপর ভেঙে পড়ে বলে—বিদ্রূপ? কল্পনা করাও পাপ। শ্রীমতী ঠিকই বলেছিল, তোমার এই আঘাত একটা অন্য ধরনের শ্রী এনেছে মুখে।
–আমি কাল অমরুর বাড়িতে যাব।
—কালই?
—হ্যাঁ। ওদের সংসার কেমন চলছে দেখতে হবে।
—আমিও যাব।
–তোমার সখী তো রোজই এসেছেন আমাকে দেখতে। তখন তুমি অনেক গল্প করেছ। এবারে আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করব। কাল রাজসভা নেই।
—বেশ যেও। অসুবিধা হলে কিন্তু বেশিক্ষণ থেকো না।
সাদা রঙের প্রিয় অশ্বটিতে চেপে অতীশ বের হয়। বরাবর প্রত্যুষে ওঠা তার অভ্যাস। সেই অভ্যাস নিজের রাজ্যের চেয়ে রাজধানীতে থেকে আরও নিয়মিত হয়েছে। সে চেষ্টা করে মহারাজা তাঁর শেষ রাত্রের কুস্তী ইত্যাদি শেষ করে যখন অশ্ব নিয়ে বাহিনী পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বিদ্যুৎবেগে ছোটেন, সেই সময় অশ্ব নিয়ে ছুটতে। তবে মহারাজ বিরক্ত যাতে না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখে। কিছুদিন শয্যাশায়ী থেকে তার নিয়মের একটু ব্যতিক্রম হয়েছে। খানিকটা দুর্বলও হয়েছে মনে হচ্ছে, অশ্ব চালনা করতে করতে। তাছাড়া এই ঋতুতে গ্রীষ্ম কেটে গেলেও শীত আসতে অনেকটা বাকি থাকে। কিন্তু তার একটু ঠাণ্ডাই লাগছে। বুঝতে পারে, নিরাময় হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। তাই ধীরে ধীরে চলে।
অমরুর গৃহদ্বারে গিয়ে দেখে রাজপুরীর যে লোকটি প্রতিদিন সকালে আসে, সে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অতীশকে দেখে সে অভিবাদন করে।
—সভাকবি?
—আমি আসার আগেই ওঁরা বাইরে গিয়েছেন। এত তাড়াতাড়ি কখনো যান না।
-কেউ জানে?
—হ্যাঁ। প্রতিবেশীদের বলে গিয়েছেন, পশুপতি মন্দিরে রওনা হয়েছেন একটু আগেই।
অতীশ নিশ্চিন্ত হয়। পথিমধ্যে ওদের ধরে ফেলবে। একটু পরেই দেখা মিলল। অশ্ব থেকে নেমে সেটিকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে লাগল। সে বলল—আজ আমার বহুদিন পরে খুব ভালো লাগছে। মঞ্জরী থাকলে আরও ভালো লাগত। বুঝতে পারছি, আমি অপরিণামদর্শী।
সবাই হেসে ওঠে।
অমরু বলে, তাদের আসার উদ্দেশ্য। অতীশ কৌতূহলান্বিত হয়। অল্পবয়সী তপস্বীর কথা, সে আগে শুনেছে। কিন্তু গুরুদেব যে তাঁকে এতখানি গুরুত্ব দেবেন কোনোদিন সে কথা ভাবেনি। গুরুদেব নিশ্চয়ই যোগ্য বয়স্ক কোনো ব্রহ্মচারী পাননি
তারা মন্দিরে প্রবেশের একটু আগে দেখতে পায় একজন ক্ষীণদেহী গৌরবর্ণের তাপস দ্রুতগতিতে এসে মন্দিরে প্রবেশ করলেন।
অমরু বলে ওঠে—এই তো তিনি।
শ্রীমতী আর অতীশ তখনো বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়েছিল।
শ্রীমতী বলে—গুরুদেব এঁর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
অতীশ বলে—কত কম বয়স, অথচ দেখলেই মাথা নত হয়ে যায়।
সবাই গিয়ে গুরুদেবের কাছে আভূমি প্রণাম করে দূরত্ব বজায় রেখে বসে। শ্রীমতী বুঝতে পারে দেবদাসীরা আশেপাশেই রয়েছে, তবে গুরুদেবের আদেশ ছাড়া তারা আসতে পারছে না।
ক্রিয়াশক্তি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। দেবদত্ত বলেন—আমি কবিকে খুব ভালো চিনেছি।
ক্রিয়াশক্তি শ্রীমতীকে দেখিয়ে বলে—এ এখানে দেবদাসী ছিল, এখন কবির পত্নী।
দেবদত্ত বলেন—আয়ুর্বেদজ্ঞ?
–-হ্যাঁ, সেদিন বলেছিলাম বটে।
শ্রীমতী অতীশকে দেখিয়ে ক্রিয়াশক্তিকে বলে—গুরুদেব এঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। অনেকদিন আহত অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন, আজ প্রথম বাইরে বেরিয়েছেন সকালে। ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে। জ্বর আসবে। মঞ্জরীকে ভুগতে হবে।
অতীশ আপত্তি তুলতে গিয়েছিল। গুরুদেব বলেন—কোনো কথা নয়, তুমি এখনি বাড়ি চলে যাও।
অতীশ মুখ ভার করে গুরুদেব ও দেবদত্তকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শ্রীমতী অতীশকে বলে—মঞ্জরীর কাছে ওষুধ আছে। শরীরের উত্তাপ তাতেই কমে যাবে। আপনি আর দুদিন বিশ্রাম করুন।
অমরু শ্রীকে অভিযোগের কণ্ঠে বলে—অতীশকে চলে যেতে বললে কেন? ওর কত কষ্ট হল। অনেকদিন পরে একটু আনন্দ পেয়েছিল।
শ্রীমতী বলে—আমি তো মাকে নিয়ে তোমার বন্ধুর কাছে যাব, তখন বুঝিয়ে বোলো। বন্ধুর দুঃখ থাকবে না।
—তা ঠিক। কিন্তু আমার কেমন লাগছে।
শ্রীমতী বিচলিত হয়।
সেই সময় বিগ্রহের বেদীর নিকট থেকে দয়াবতীর সংগীত ভেসে আসে। তপস্বী দেবদত্ত উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ক্রিয়াশক্তি ডাকেন—এসো ব্রহ্মচারী, দেবদাসীর পূজা দেখবে এসো।
সবাই গিয়ে দেখেন নিমীলিত চক্ষে বিগ্রহের সম্মুখে করজোড়ে বসে দয়াবতী তার সুধাকণ্ঠে গেয়ে চলেছে।
কিছুক্ষণ শুনে দেবদত্ত বলে ওঠেন—এ যে স্বৰ্গীয়।
—হ্যাঁ। আমি পূজায় বসার সময় একে ডেকে নিই।
–এতো সংগীত শুধু নয়, এযে স্তব।
—হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞাসা করিনি এত স্তব কোথায় পায়। তুমি প্রশ্ন করতে পার।
একটু পরে দয়াবতী আঁখি উন্মীলিত করে সবাইকে দেখে লজ্জিত হয়। সে উঠে দাঁড়ায়।
ক্রিয়াশক্তি বলেন—ইনি তপস্বী দেবদত্ত।
দয়াবতী তাঁদের দুজনকে প্রণাম করে। শ্রীমতীকে দেখে হাসে।
দেবদত্ত বলেন—এইসব স্তব কোথা থেকে পেলে?
—পাইনি তো প্রভু। নিজেই গাই।
—কিভাবে গাও মহেশ্বরের এত স্তব।
—আমি জানি না। আমি কি অন্যায় করেছি?
ক্রিয়াশক্তি বলেন–কে বলেছে তুমি অন্যায় করেছ?
দেবদত্ত বলেন—তোমার স্তব নির্ভুল। তোমার স্তব মহাকাল-প্রদত্ত।
ভোগ গ্রহণের পর ক্রিয়াশক্তি দেবদত্তকে বলেন—তুমি ভেবেছ?
—হ্যাঁ। আমি সম্মত হলাম এই ভেবে যে নইলে রাজপুরীতে অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাবনা। আমি আশ্রম থেকেই আসব।
—আমি নিশ্চিন্ত হলাম। অবশিষ্ট দিনগুলি আমি এই মন্দিরেই থাকব। পরশু রাজপুরীতে আসতে পারবে?
—আমি আগামী কাল আসতে চাই।
—উত্তম। তবে কয়েকজনকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষাদানের চেষ্টা করো।
—অবশ্যই।
—যদি পার, বুঝতে হবে তুমি ভাগ্যবান।
.
মন্দির থেকে বাড়িতে আসতে বেলা পড়ে আসে। শ্রীমতী কিছুক্ষণ ঘরের কাজ করে এক সময় দেখে অমরু জানলার পাশে বসে অস্তগামী সূর্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে রয়েছে। তার জন্য বড় কষ্ট হয় শ্রীমতীর। বন্ধুকে সঙ্গে রাখতে চেয়েছিল। এদিক ওদিক কয়েকবার ঘোরাঘুরি করা সত্ত্বেও অমরুর তন্ময়তা ভাঙল না। তখন ধীরে ধীরে পেছনে বসে স্বামীর মাথাটা বুকে চেপে ধরে। অমরু সামান্য একটু চমকে উঠতে গিয়েও নিশ্চিন্তে স্ত্রীর হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়।
—খুব কষ্ট হয়েছে?
– -কেন?
—বন্ধুকে থাকতে দিইনি বলে?
অমরু একটু হেসে বলে—ভুলে গিয়েছি। না না ফেরার পথেও দুঃখটা ছিল।
–জানি। কাল যাবে?
—তুমিও যাবে?
—যাব না? তোমার বন্ধুর জ্বর বেড়েছে কিনা দেখতে হবে যে।
–সত্যিই জ্বর হয়েছে নাকি?
—আমার তাই ধারণা। বেশ তো দেখতে গেলেই বোঝা যাবে। তাছাড়া মঞ্জরীকে বলতে হবে তোমার বন্ধু-প্রীতির কথা।
–না না, ওসব বললে আমার কেমন লাগে।
-তাহলে বলব না। তোমার যাতে একটুও অসুবিধা হয় আমি তা কখনো বলি না, করিও না।
—আমি জানি শ্রীমতী। তোমার রূপ সরস্বতীর মতো, মনটাও তেমন।
–আমার রূপ তোমার চোখে পড়ে?
—পড়ে না?
-শুনিনি তো বেশি।
–সত্যি কথা বলব? –তুমি মিথ্যা বল নাকি?
–না, তা নয়। তবু—
—বল।
—তুমি এত সুন্দর। কিন্তু সে কথা বললে, মনে মনে তুমি হাস। আমি বুঝতে পারি।
শ্রীমতী হেসে ফেলে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে।
—আমি জানতাম। সেই জন্যেই বলি না।
.
এক এক সময় মানুষের নিজের জীবন অথবা দেশের জনসাধারণের জীবন-প্রবাহ মসৃণ গতিতে চলতে থাকে, কোনো বৈচিত্র্য থাকে না। আবার কখনো কখনো সেই প্রবাহ বাত্যবিক্ষুব্ধ তরঙ্গ সংকুল হয়ে ওঠে।
দুই বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। অমরু এবং শ্রীমতী উভয়েই ইতিমধ্যে মাতৃহারা। ক্রিয়াশক্তি আরও অশক্ত। সব চেয়ে সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে রাজপুরীতে তথা বিজয়নগর সাম্রাজ্যে। ইসমাইল আদিল শাহ আবার বিজয়নগর আক্রমণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে গেলেও তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল এবং বিজয়নগরের রাজকুমার নিহত হয়েছেন। মহারাজের বজ্রাহত অবস্থা। রাজকুমারের যত দোষই থাকুক, তিনি ভালো যোদ্ধা ছিলেন। প্রাসাদ প্রাঙ্গণের অন্য অট্টালিকা থেকে পুত্রবধূর ক্রন্দন ধ্বনি তাঁর কানে না এলেও তার গর্ভধারিণী গৌরীদেবী বারবার ছুটে ছুটে আসছেন। কোথায় বা সান্ত্বনা খুঁজবেন আর তিনিই বা কি সান্ত্বনা দেবেন। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি এখন আর মন্দিরের বাইরে আসেন না। একটি কোণে বসে কোনোরকমে ধ্যান করেন কিছুক্ষণ। স্বামী দেবদত্ত প্রাসাদে আসেন নিয়মিত, কিন্তু ক্রিয়াশক্তিকে মহারাজ যেমন পিতার মতো ভালোবাসতেন, স্বামীজীর প্রতি আস্থা থাকা সত্ত্বেও সেইভাবে নিজের মনকে উদ্ঘাটিত করে দিতে সংকোচ হয়। বয়স বড়ই কম। তিনি জানেন ব্যক্তিগত শোক তাপ নিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখলে সাম্রাজ্য চলে না। কিন্তু নিজের দেহে যখন বিপদের সংকেত দেখা দেয় তখন তো স্থির থাকা যায় না। কারণ তাঁকে এখন কয়েক বছর সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তিনি যে পুত্রহারা। এতবড় সাম্রাজ্যের উত্তরাধীকারী যে অষ্টম বর্ষীয় এক বালক। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি এবং স্বামী দেবদত্ত উভয়েই বলেছেন, এই বালক সামান্য নয়। তিনিও বুঝতে পারেন, কিন্তু তাকে তো রক্ষা করতে হবে। যতদিন সে সাবালক না হচ্ছে ততদিন তাঁকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এক একদিন তাঁর বাঁ হাত কিছুক্ষণের জন্য একটু অসার বলে মনে হয়। কুস্তী তিনি এখনো করেন, কিন্তু আগের মতো কখনই নয়। কুস্তীগীরও যেন বুঝতে পেরেই ঢিলে দেয়। মহারাজ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে ওঠেন—তুমি কি আমার জোর কমেছে বলে ভাবছ নাকি?
সে মহারাজের পা দুহাত দিয়ে ছুঁয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বলে—মহারাজ কোনো জন্মেই যেন সে কথা না ভাবি।
–সব জন্মেই তুমি আমার কুস্তীগীর হবে নাকি?
—না হলে বাঁচব না।
মহারাজা হেসে ওঠেন। বলেন—মজার কথা বলেছ তো। এ জন্মে কি কি পাপ-পুণ্য করেছ তার উপর তো সব নির্ভর করে।
কুস্তীগীর নিশ্চিন্তে বলে—আমি সব জানি মহারাজ।
মহারাজের ওর সঙ্গে কথা বলতে ভালোই লাগছিল। কোনোদিন দুটো কথাও হয় না, অথচ আজ বলতে ইচ্ছে করছে। বলেন—তুমি হয়তো পাপ তেমন করনি, কিন্তু আমি তো করেছি। কত লোকের প্রাণদণ্ড দিয়েছি, তাছাড়া আরও অনেক ঘটনার কথা তো সাম্রাজ্যের সবাই জানে। আমি আর মহারাজা হব না। নইলে এই জন্মেই শাস্তি শুরু হয়ে যায়? রাজকুমার চলে গেল—
কুস্তীগীর ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করল। তার বিরাট দেহটা থরথর করে কেঁপে কেঁপে ওঠে।
মহারাজ ভাবেন, তিনি খুবই ভুল করে ফেললেন, সাধারণ একজন মানুষের কাছে মন খুলে দিয়ে। তাঁর মনের শক্তি কমে গিয়েছে বাঁ হাতও একদিন কয়েক মুহূর্তের জন্য অসার হয়, আর পৌত্র মাত্র অষ্টম বর্ষীয়। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি যখন আসতে পারেন না তখন স্বামী দেবদত্ত ব্রহ্মচারীর কাছে এই প্রশ্ন তিনি তুলবেন। তিনি কি বলেন শুনতে হবে।
.
রাতে স্বামীর পাশে শুয়ে শ্রীমতী বলে—মঞ্জরীর ছেলেটা কী সুন্দর দেখতে হয়েছে, তাই না? ঠিক ওর বাবার মতো
—হ্যাঁ, দেবশিশু যেন। সব শিশুই তো দেবশিশু। ওদের সারল্য ওদের দেবতা করে দেয়। বড় হয়ে গেলে মানুষের চোখে ওই চাহনি থাকে না।
–কে বলল থাকে না?
থতমত খেয়ে অমরু বলে—থাকে, তবে কম মনে হয়। তবু শিশুদের তুলনায় আসে না।
–আসে, একেবারে তাদের মতোই।
–কি করে হবে? শিশুরা সামনে অগ্নিশিখা দেখলে আনন্দে ধরতে চাইবে, বড়রা তা করবে না। শিশুরা পৃথিবীর বিপদ-আপদের কথা জানে না, সব কিছুই তার আপন। বড়রা তা ভাবতে পারে না। ভাবতে পারে না বলে মন বেদনার্ত হয়ে থাকলেও উপায় নেই। এই যে সব সময় মনের মধ্যে কিছুর একটা ব্যথা, একটা অপূর্ণতার ক্রন্দন গুমরে মরে বলে শিশুর মতো অমন হাসতে পারে না। সবাই দেখি হাসে, তুমিও হাস। আমি জানি ওসব অভিনয়। পৃথিবীতে চলতে গেলে মানুষকে আনন্দ দিতে হলে অমন অভিনয় না করে উপায় নেই। তুমিই বল।
শ্রীমতী স্তব্ধ হয়ে থাকে। কি নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল ভুলে যায়। ভাবে, এসব বলছেন কি তার স্বামী? মন সব সময় কাঁদে তাঁর? কি জন্য? সে তো সব সময় তাঁর মনে ভরিয়ে রাখতে চাইছে সব কিছু দিয়ে?
—আমাকে পেয়ে তুমি তাহলে সুখী হওনি?
অমরু ব্যস্ত হয়ে স্ত্রীকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে—এ তুমি কি বলছ? পৃথিবীতে আমার চেয়ে ভাগ্যবান কে? তোমার মুখে এই কথা এল কেন? আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি।
–তুমি যে বললে, তোমার মন সব সময় কাঁদে।
—বলেছি বটে। কিন্তু সেই কান্না তো অন্য কান্না। আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারিনি। পরে বলব। দেখো, ঠিক বুঝবে তুমি। আমার ওপর তখন আর রাগ থাকবে না।
–তোমার ওপর রাগ ছিল কখন? কোনোদিন হয়েছে?
–তা অবশ্য হয়নি।
শ্রীমতী ভাবে মঞ্জরীর মতো তার পুত্র হলেও দেবপুত্রের মতো দেখতে হবে হয়তো, কিন্তু তার মনটা কি পিতার মতো হবে? তা কি সম্ভব? পুত্র তো সেও চায়। কিন্তু ভয় হয়। সে যদি সাধারণ হয়ে যায়? তবু অপুত্রক হয়ে থাকলে লোকে সুলক্ষণা বলবে না। এইস কথা ভাবতে ভাবতে কোনো একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে।
.
দুদিন পরে রাজপুরী থেকে সংবাদ আসে সেদিনই পূর্বাহ্নে স্বামী দেবদত্ত ব্রহ্মচারী সেখানে শ্রীমতীকে ডেকে পাঠিয়েছেন। অমরু এবং শ্রীমতী দুজনাই বিস্মিত হয়। এভাবে তিনি কখনো ডাকেন না। স্বামীজীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ মন্দিরেই হয়ে থাকে, যেখানে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিও উপস্থিত থাকেন। আজ রাজপুরীতেই ডেকেছেন। কোনো রানী কিংবা অন্য কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ডাকা হয় না। অন্য চিকিৎসক রয়েছেন, তাঁরাই দেখেন। তাই তাকে যখন ডেকেছেন, নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে।
সেদিন সভা বসবে না। রাজপ্রাসাদে সভাসদেরা কেউ নেই। অমরু স্ত্রীকে নিয়ে প্রবেশ করতেই একজন প্রহরী এসে বলে—স্বামীজী এইমাত্র এসেছেন। তিনি মহারাজের বিশ্রাম কক্ষে তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। আপনাদের সেখানে যেতে বলেছেন।
প্রহরী চলে যেতেই অমরু দাঁড়িয়ে পরে। বলে-আমার যাওয়ার দরকার কি? শ্রীমতী তার হাত চেপে ধরে টানে। বলে—এসো। তুমি সব নিয়মের বাইরে। মহারাজা উভয়কে দেখেই উৎফুল্ল হন।
স্বামী দেবদত্ত শ্রীমতীকে বলেন—আমি চিকিৎসক নই। তবু আমার মনে হল, তোমার একবার মহারাজকে পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে।
শ্রীমতী সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে, স্বামীজী নিশ্চয় মহারাজের শারীরিক কোনো বৈলক্ষণ্য দেখেছেন। সে মহারাজের কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাঁকে পরীক্ষা করে!
মহারাজ মৃদু হেসে বলেন—আর কতদিন?
শ্রীমতী বলে—একথা বলছেন কেন মহারাজ? কী হয়েছে আপনার?
–সে কথা তো আপনিই বলবেন।
—আপনার অসুবিধার কথা আগে বলুন।
–আমার এমনিতে কোনো অসুবিধা নেই। স্বামীজী ডেকেছেন আপনাকে। কথা বলতে বলতে শ্রীমতী মহারাজকে পরীক্ষা করে চলে। শেষে বলে–আপনার সামান্য কোনো অসুবিধা বা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্বাভাবিক কোনো কিছু অনুভূতির কথা বলুন।
স্বামীজী বলে ওঠেন—হ্যাঁ, সেই কথাই বলুন মহারাজ।
মহারাজ উভয়ের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি ফেলে স্বামীজীকে বলেন—আপনাকে কি আমি কিছু বলেছি?
—হ্যাঁ। সেইজন্যই তো একে ডেকে এনেছি।
—কি বলেছিলাম স্বামীজী?
–বাঁ হাত কয়েক মুহূর্তের জন্য অবশ হয়ে গিয়েছিল।
—হ্যাঁ, আমার হয়ে গেল। পরক্ষণেই কুস্তীগীরকে চিৎ করে দিয়েছিলাম। তবু আমার মনে হল সে ইচ্ছে করে হেরে গেল। আমি ক্রোধান্বিত হয়েছিলাম। সে স্বীকার করেনি।
শ্রীমতী বলে—শুধু একদিন? শুধু সেইদিনই? আর কোনোদিন নয়?
—আর একদিনও হয়েছিল।
—কতদিন পর পর?
–আমার খেয়াল নেই।
শ্রীমতী মহারাজের নাড়ি দেখে অনেকক্ষণ ধরে। দুই চোখ দেখে। দুই হাত ওপরে তোলে, নীচে নামায় কয়েকবার। তারপর উঠে দাঁড়ায়।
–কি দেখলেন?
শ্রীমতী স্বামীজীর দিকে তাকায়।
স্বামীজী বলেন—মহারাজের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তুমি যা দেখবে ওঁকে জানাতে হবে।
মহারাজ আকুতি মেশানো দৃষ্টিতে বলেন—আমার পৌত্রের বয়স মার আট বৎসর, সেটাই চিন্তার। তবে আপনি কিছু বলার আগে দানায়িকের উপস্থিতি প্রয়োজন। তিনি বোধহয় এতক্ষণে এসে গিয়েছেন।
একটু পরেই দানায়িক এসে প্রবেশ করেন। স্বাস্থ্যবান হলেও বৃদ্ধ তিনি।
কবি-পত্নীর রূপের কথা শুনলেও প্রথম দেখলেন। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। বলেন—চির এয়োতী হোন আপনি।
স্বামী দেবদত্ত ব্রহ্মচারী শ্রীমতীর দিকে চেয়ে বলেন—এবারে বলতে পার, কি দেখলে।
—স্বামীজী আমি প্রথমেই বলব, মহারাজ প্রত্যেকদিন খালি পেটে যে তিল তেল পান করেন সেটি বন্ধ করতে হবে।
মহারাজ বলে ওঠেন—সে কি! এ যে আমার চিরকালের অভ্যাস।
—এতদিন মহারাজ আপনার বয়স কম ছিল, সহ্য হত। এখন বিপদ ডেকে আনছে।
স্বামী দেবদত্ত প্রশ্ন করেন—কোন ধরনের বিপদ?
—কয়েক বৎসরের মধ্যে উনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।
মহারাজের চোখে মুখে দুশ্চিন্তা ফুটে ওঠে। তিনি বলেন-আমার পৌত্রের যে ততদিনে কৈশোরও অতিক্রম করবে না।
—সেই জন্যই বলছি খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে আপনাকে অনেক সংযত থাকতে হবে।
–আমি যে দুর্বল হয়ে পড়ব।
–না, এতটুকুও দুর্বল হবেন না। কারণ আপনি আপনার দৈনন্দিন শরীর চর্চা এতটুকুও কম করবেন না।
দেবদত্ত ব্রহ্মচারী হাত তুলে বলেন—ব্যস, আর কোনো কথা নয়। মহারাজ, এইভাবেই আপনাকে চলতে হবে। কারণ আপনার শরীর শুধু আপনার জন্য নয়, সমস্ত সাম্রাজ্যের মানুষের মঙ্গল অমঙ্গল তার ওপর নির্ভর করছে।
মহারাজ আর কিছু বলতে পারেন না। শুধু অমরুকে বলেন—কবি, আপনি বাড়িতে তেল খান?
—হ্যাঁ মহারাজ। তবে শুধু শুধু তেল খাই না। কখনো তো খাইনি। কেমন লাগে জানি না।
অমরুর সরলতা এত বেশি প্রকট হয়ে ওঠে, যে দেবদত্ত ব্রহ্মচারীও হেসে ফেলেন।
.
মন্দিরে প্রবেশের মুখে শ্রীমতী নৃত্যগীতের ধ্বনি শুনতে পায়। সাধারণত এইসময় অবসরের সময়। আজ সে একা এসেছে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে দেখতে এবং নিভৃতে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। অমরু সঙ্গে আসেনি। সে গিয়েছে রাজপুরীতে। মহারাজা বলেন, অমরু শুধু সভাকবি নয়, সে তাঁর পরামর্শদাতাও বটে। যে সব জটিল সমস্যার উত্তর তিনি খুঁজে পান না, কবি সহজভাবে তার সমাধান করে দেয়। তাই তার ডাক পড়ে মাঝে মাঝে স্বতন্ত্রভাবে। এই পরামর্শ দিতে অমরুকে বিশেষ কোনো চিন্তা করতে হয় না।
শ্রীমতী ইতস্তত করে নৃত্যগীতের কক্ষে প্রবেশ করত। সেই সময় ভবানীদি তাকে দেখে ফেলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে—গুরুদেব শুনতে চাইলেন এই সময়।
-কেমন আছেন?
—আরও অশক্ত হয়ে পড়েছেন। যা কোনোদিন বলেন না তাই বলে দিয়েছেন কালকে। বলেছেন, তিনি আর বেশিদিন নেই। তাঁর খুব দুঃখ তোমাদের দু’জনার মতো আর কাউকে সংসার জীবনে নিয়ে যেতে পারলেন না।
–আমি একটু দেখা করতে পারব?
পারবে না কেন? সন্ন্যাসী হয়েও তোমার ওপর তার আলাদা স্নেহ রয়েছে, আমরা বুঝতে পারি।
শ্রীমতী গিয়ে দেখে গুরুদেব প্রায় শয্যাশায়ী। সে তাঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই তিনি বলেন—ভালোই হয়েছে। এদের সঙ্গে না নাতো।
শ্রীমতী একমুহূর্ত দেরি না করে ওদের সঙ্গে নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। তবে অনেকদিনের অনভ্যাসে সে কিছুক্ষণ পরে সামান্য ক্লান্ত হয়। সেই ক্লান্তি চেপে রেখে নেচে যায়। গুরুদেব থামতে বলেন।
অবলা তাকে ফিসফিস করে বলে—তুই হাঁপিয়ে গেলেও অনেকক্ষণ পেরেছিস। গুরুদেব বলেন-এখন তোমরা যারা দেবদাসী রয়েছ, তারা দেবদাসীই থাকবে। কারণ আমি আর কিছু করতে পারলাম না। তবে এটুকু বলতে পারি তোমাদের ওপর কোনোরকম অত্যাচার হবে না। তোমাদের সম্মান নির্ভর করবে তোমাদেরই ওপর।
ওরা চলে গেলে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি বলেন—তোমার সংসার কি রকম চলছে শ্ৰীমতী?
শ্রীমতী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
গুরুদেব একটু অপেক্ষা করে বলেন—হুঁ। ওটা পশুপতিনাথের ওপর ছেড়ে দাও। তিনি যা করছেন, ভালোর জন্যই করছেন।
-সবাই হয়তো ‘করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আমার দিকে।
—অমরু কি বলে?
—ওঁর অত খেয়াল নেই। তবে মঞ্জরীর ছেলেকে দেখলে তার সঙ্গে খেলতে শুরু করে।
—ঈশ্বর যেটুকু দেন, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাক। তোমার মনের দুঃখ বুঝতে পারি। সব সময় ভাববে, যা পেয়েছ তাই যথেষ্ট।
—হ্যাঁ গুরুদেব, যত পাওয়া যায় আকাঙ্ক্ষা তত বাড়ে। আমি সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করব। অবলাদের কথা ভাবি, আমি কতখানি পেয়েছি অথচ ওরা ভাবে হয়তো ওরা কিছু পায়নি। আবার ওরা অন্য কিছুও ভাবতেও পারে। এই সুন্দর পরিবেশে আপনার আর স্বামীজীর উপদেশ পাচ্ছে। দয়াবতীর মতো পুণবতীর সান্নিধ্য পাচ্ছে।
—ঠিকই বলেছ।
—গুরুদেব আপনার নিজের কথা বলুন।
গুরুদেব হেসে বলেন—বুঝতে পেরেছ তাহলে?
—হ্যাঁ, মাধবী কেমন শিখছে?
—যতটা ভেবেছিলাম ততটা নয়। তোমার মতো কাউকে দেখলাম না। সেজন্যই হয়তো ঈশ্বর তোমাকে সন্তান দেননি। তবে পরে কি হবে এখনো স্পষ্ট জানি না।
-গুরুদেব, আপনি না থাকলে কি করব?
—সব ঠিক হয়ে যাবে শ্রীমতী। তোমার মতো বুদ্ধিমতীকে কি আর বোঝাব?
—আর কিছুদিন কি থেকে যেতে পারেন না? এযে খুবই তাড়াতাড়ি দেখছি।
-চেষ্টা কি করিনি? সারা দেহে নাড়ির স্পন্দন শুনতে পাই। তুমি দেখো।
গুরুদেব হাত বাড়িয়ে দেন। শ্রীমতী একটু দেখেই ছেড়ে দিয়ে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে ফেলে।
—ওঠো। তুমি আয়ুর্বেদজ্ঞ। আমি তো বৃদ্ধ। কত সদ্য বিবাহিতার স্বামীকে এমন দেখবে, কত মায়ের যুবক সন্তানকে এমন দেখবে, তবু অবিচল থাকতে হবে তোমাকে। এক বিন্দু অশ্রুপাত হলে চলবে না।
–এদের কি হবে?
–কেন, দেবদত্ত রয়েছে।
শ্রীমতী আবার কেঁদে ফেলে।
—কেঁদো না শ্রীমতী। বরং ওদের প্রকৃত সত্য জানিয়ে দাও। এতদিন আমাকে দেখেছে, ভেঙে পড়তে পারে।
শ্রীমতী ওঁকে প্রণাম করে ওদের কাছে যায়। ভবানীদিকেও ডাকে। সবাইকে বলে—তোমরা আজ রাতে গুরুদেবের কক্ষের বাইরে থাকবে। দয়াবতী, গুরুদেব তোমার স্তব শুনতে ভালোবাসেন। তুমি সারারাত নিম্নস্বরে স্তব করতে পারবে?
–কেন পারব না?
ভবানীদি উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে—কিন্তু কেন? কি হয়েছে শ্রীমতী?
—উনি কালকে আর থাকবেন না।
সবাই একসঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
—আমি যাচ্ছি। আমি আবার আসব। স্বামীজীকে সংবাদটা দিতে হবে। তোমাদের কান্না যেন কিছুতেই গুরুদেব শুনতে না পান।
ভবানীদি বলে—একি নাড়ি দেখে তোমার নিদান?
-গুরুদেব নিজেই বলেছেন। তারপর হাত বাড়িয়ে আমাকেও দেখে নিতে বলেন।
দয়াবতী সহসা ছুটে চলে যায় তাঁর কক্ষের দিকে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরেই দয়াবতী এসে শ্রীমতীকে বলে—তোমায় ডাকছেন। শ্রীমতী দৌড়ে যায়। গুরুদেব তাকে মৃদু কণ্ঠে বলেন—আমি তোমার ক্রোড়ে একটি শিশু দেখলাম এইমাত্র।
–আমি সেকথা ভাবছি না, আপনি আর কয়েক দিন ভালো থাকুন। আপনি তো বুঝছেন ঠাকুর।
ক্রিয়াশক্তির মুখে অতিক্লান্ত এক ফোঁটা স্নেহের হাসি—পাগলি।
শ্রীমতীর সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। সে চিৎকার করে কাঁদবে না। সে শব্দ করবে না। তার নড়তে ইচ্ছা করছে না ওখান থেকে। তবু একবার অন্তত যেতেই হবে।
গুরুদেবের প্রয়াণের পরে প্রায় ছয়মাস অতিবাহিত হয়েছে। শ্রীমতীর মন্দিরে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অমরু ইতিমধ্যে একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছে।
একদিন মঞ্জরী একা এসে উপস্থিত তার কাছে। শ্রীমতী বলে—পৃথ্বীশকে আনলে না?
মঞ্জরী গম্ভীর স্বরে বলে—না। তুই আমার সঙ্গে মন্দিরে চল্।
—হঠাৎ?
—দয়াবতীর সঙ্গীত, স্তব সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে একা থাকতে ভয় পাচ্ছে।
সব সময় একসঙ্গে থাকতে চায়।
–কেন? বিগ্রহই তো তার প্রাণ।
—কিছু বলছে না। তুই একটু চল্। তুই বুঝতে পারবি। সেই সময় অমরু এসে সব শুনে বলে—আমি সঙ্গে যাব? মঞ্জরী বলে–আপনার বন্ধুকে আনিনি। আমাদের ব্যাপার। —তাহলে শ্রীমতী একাই যাক।
মঞ্জরীর শকট ছিল। মন্দিরে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না।
ওদের আসতে দেখে দেবদাসীরা সবাই সামনে চলে আসে। দয়াবতীও ওদের সঙ্গে চলে আসে। ওদের দুজনকে দেখে সে যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।
শ্রীমতী জিজ্ঞাসা করে—কি হয়েছে দয়াবতী?
দয়াবতী চুপ করে থাকে।
সেই সময় স্বামী দেবদত্ত ব্রহ্মচারী বাইরে এসে সবাইকে দেখে বিস্মিত হন। তিনি বলেন—কি হয়েছে? তোমরা সবাই এখানে। শ্রীমতীও এসেছ? কারও ব্যাধি হয়েছে?
—দয়াবতীর সঙ্গীত বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুনলাম।
—হ্যাঁ। তুমি এসে ভালোই হয়েছে। তুমি দেখ, যদি বুঝতে পার।
সেই সময় একজন সাধু এসে উপস্থিত হন। তিনি সোজা বিগ্রহের সামনে গিয়ে প্রণাম জানান, তারপর গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কক্ষটি দেখেন। তাঁর আসন যেখানে ছিল সেখানে প্রণাম করেন। শেষে বিগ্রহের পশ্চাতে যেখানে তিনি তাঁর পুঁথি রাখতেন সেখানে গিয়ে পুঁথিগুলো নাড়াচাড়া করে মস্তক ঠেকিয়ে বাইরে আসেন।
স্বামী দেবদত্তও তাঁকে বলেন—এই স্থানটি আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে।
সাধু হেসে বলেন—হ্যাঁ, আমি পনেরো বৎসর এখানে ছিলাম। গুরুদেব আমাকে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দেন। গুরুদেব দীক্ষান্তে নাম দিয়েছিলেন আনন্দস্বামী।
অমরু, শ্রীমতী, দয়াবতী, অবলা, মঞ্জরী সবাই সাধুর স্নিগ্ধ হাসি দেখে শ্রদ্ধাবনত হয়। গুরুদেবের যোগ্য শিষ্য। বড় আপন বলে মনে হয়।
স্বামী দেবদত্ত বলেন—শুনে খুবই আনন্দ হল। শুনেছিলাম হিমালয়ে ছিলেন। তবু দীক্ষাস্থানের কথা মনে পড়েছে। খুবই স্বাভাবিক।
–না, ঠিক তা নয়। আমি আমার কথা ভাবিনি কখনো। একদিন মহাযোগী পরমহংস দেব আমার সামনে আবির্ভূত হয়ে বললেন, এখানে চলে এসে এই মন্দিরের ভার নিতে। তাই বাধ্য হয়ে এসেছি। তাঁর আদেশ সব সময় শিরোধার্য।
স্বামী দেবদত্ত ক্রুদ্ধস্বরে বলেন—আমি তো জানি না। আমি তবে কোথায় যাব? ক্রিয়াশক্তি নিজে আমাকে রেখে গিয়েছেন। তাছাড়া রাজপুরীর ভার কে নেবে? আনন্দস্বামী বলেন—রাজপুরী? না না আমি পারব না। পরমহংস আমাকে শুধু মন্দিরের ভার নিতে বলেছেন।
স্বামী দেবদত্ত হেসে বলেন—তবে? নিশ্চয় কোনো ভুল হয়েছে।
–না, ভুল হয়নি।
দেবদাসীরা চাইছে নতুন সাধু মন্দিরের ভার নিলে খুব ভালো হয়। কিন্তু স্বামীজীকে মন্দির পরিত্যাগের আদেশ কে দেবেন?
সেই সময় সহসা মহাযোগী পরমহংস মন্দিরে প্রবেশ করেন। মুহূর্তেই শ্ৰীমতী চিনতে পারে মায়ের সেই সন্ন্যাসীকে। সে ছুটে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করার আগেই তিনি বলেন–ক্রিয়াশক্তি শেষ যে দৃশ্য দেখে তোমাকে বলেছিল, তা সত্য। তুমি শীঘ্রই সন্তানবতী হবে।
মঞ্জরী তো এগিয়ে এসে শ্রীমতীকে স্পর্শ করে। তাকে জড়িয়ে ধরার সাহস পায় না মহাযোগীর সামনে।
মহযোগী তীব্র দৃষ্টিতে দেবদত্তের দিকে চেয়ে বলেন—তুমি মহাপাপ করেছ। এখুনি মলয়াবন্ত পাহাড়ের আশ্রমে ফিরে গিয়ে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন কর অন্তত পনেরো বৎসর। নইলে সংসারী হও। আমি রাজপুরীতে তারকেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতকে পাঠাচ্ছি।
মহাযোগী মন্দির ত্যাগ করে দু চার পা গিয়ে অদৃশ্য হন।
সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে দেবদত্ত মাথা নিচু করে মন্দির ত্যাগ করে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছেন।
আনন্দময়ী বলেন—দয়াবতী কে?
দয়াবতী এগিয়ে আসে।
সাধু বলেন-তুমি বিগ্রহের সামনে গিয়ে তোমার স্তব শুরু কর। আমি কিছুক্ষণ পরে যাচ্ছি।
দয়াবতী তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। অবলাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দীর্ঘদিন পরে দয়াবতীর চলনে কোনো জড়তা নেই।
শ্রীমতীকে তিনি বলেন—তুমি তো দেখলাম ওঁকে চেনো।
—আজ্ঞে হ্যাঁ প্রভু। উনি আমার মায়ের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। মায়ের ওপর ওঁর কৃপা ছিল।
সাধু মিষ্টি হেসে বলেন—তোমার ওপরও রয়েছে দেখলাম।
-আমার ভাগ্য। আমাদের সবার ভাগ্য গুরুদেবের জায়গায় আপনাকে পেলাম। এও বোধহয় সেই মহাপুরুষের দান।
দয়াবতীর সঙ্গীত ভেসে আসছিল। সাধু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন—স্বর্গীয়।
একসময় শ্রীমতীরা মন্দির ছাড়ে। ফেরার পথে মঞ্জরী বলে—অপেক্ষার দিন শুরু হল শ্রীমতী।
শ্রীমতী লজ্জিত হয়।
.
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানীর তুলনা মেলা ভার। অনেক পর্যটকের বিবরণীতেই লিখিত প্রমাণ রয়েছে। এখানকার জনজীবন সুখে-দুঃখে হাসি-কান্নায় অতিবাহিত হয়। হিন্দুদের মধ্যে নানান শ্রেণী ভেদ, কিন্তু নেই কোনো অশান্তি। মহারাজা মুসলমানও এনে রেখেছেন, তারা নিপুণ গোলন্দাজ হয়ে ওঠে বলে। তাদের জন্য মসজিদ রয়েছে। রাজা এবং অধিবাসীরা ধর্মবিষয়ে খুবই সহনশীল। বিদেশিরা বিস্মিত এতবড় সংস্কৃতিসম্পন্ন দেশ তারা দেখেনি বলে। তারা বাণিজ্য করতে এলেও রাজাকে শ্রদ্ধা না করে পারত না। অস্ত্রের ঝনঝনানির চেয়ে সঙ্গীতের মুর্ছনা স্বভাবতই এদের প্রিয়। অতুলনীয় ঐশ্বর্য এবং অফুরন্ত খাদ্যসম্ভার এদের এমন করেছে। মরুভূমির খাদ্যাভাবে ক্লিষ্ট হয়ে নিজেদের জীবিত রাখার তাগিদে অনন্যোপায় হয়ে এদের অন্য দেশের দিকে ধাবিত হতে হয়নি। তাই চোখের সামনে যা দেখেছে তা-ই টেনে হেঁচড়ে নিজেদের দখলে আনতে চায় নি। এটা কোনো অলসতা বা কাপুরুষতার পরিচয় নয়। দেশের জলবায়ু মানুষের স্বভাব চরিত্রের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেলে, তবে সম্পূর্ণরূপে নয়। দিগ্বিজয়ী বীর হতে হলে কোন ধরনের জলবায়ুর প্রয়োজন বোঝা কঠিন। চেঙ্গিস খাঁয়ের দেশ ছিল খুবই শীতল এবং দেশে খাদ্যাভাব নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু আলেকজাণ্ডারের জন্ম যে দেশে সেই দেশ ছিল শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। বিজয়নগরও ছিল সমৃদ্ধ। এর এক এক ঋতুতে এক এক রূপ। কখনো ঘন বর্ষা, কখনো বসন্ত। শীতের আমেজও পাওয়া যায়। আবার মাঝে মাঝে এই সাম্রাজ্যের কোথাও কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শ্যামল ক্ষেত বাদামি রঙ ধরে শুকিয়ে যায়। মাটি ফেটে চৌচির। চারদিকে হাহাকার ওঠে একটু অন্নের জন্য, দেহ হয় কংকালসার এবং অবশেষে মৃত্যু। এরপর আবার বর্ষণ নামে, মাটি সরস হয়ে ওঠে সবুজের দেখা মেলে, আবার ফুলে ফলে ভরে ওঠে চারদিক। তখন শুধুই প্রাচুর্য। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধিবাসীগণ এই প্রাচুর্য দেখেই অভ্যস্থ। অনটন ব্যতিক্রম মাত্র।
.
শ্রীমতী মর্মে মর্মে বুঝতে পারে আয়ুর্বেদজ্ঞ হলেও প্রসব বেদনা থেকে নিষ্কৃতি নেই। মনুষ্যকুলে নারী হয়ে জন্মালে এর জন্য প্রস্তুত থাকতেই হবে। অথচ পশু-মাতারা কত নিশ্চিন্তে জন্ম দেয়। গর্ভে যে তার সন্তান রয়েছে সেই বোধও থাকে না। তাই জন্মের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পশুমাতার মাতৃস্নেহ থাকে না। জন্মানোর পরেও তারা সন্তান সম্বন্ধে যে সচেতনতা দেখায়, জিহ্বা দিয়ে তার পিচ্ছিল গাত্র লেহন ইত্যাদির মধ্যে গভীর মাতৃস্নেহ কতটা কাজ করে জানা যায় না। তার অন্যান্য আচার আচরণের মতো এসবও সম্ভবত সহজাত। কিন্তু মনুষ্যকুলে নারীর গর্ভে অঙ্কুরের উন্মেষ হতেই অন্তরে তার মাতৃস্নেহ জাগ্রত হয়। সেই স্নেহের উত্তাপে গর্ভের ভ্রূণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মায়ের মনে কত স্বপ্নের উদয় হয়। সেই স্বপ্ন শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দশ মাস মনকে রঙিন করে রাখে। যেটি শেষের দিকে অধৈর্য হয়ে গর্ভে নড়াচড়া শুরু করে। প্রসব কালের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও মা আকুলভাবে প্রতীক্ষা করে সেই কচি মুখটি দর্শনের জন্য।
শ্রীমতীর প্রত্যাশা শিশুর মুখে সেই নিষ্কলুষ স্বপ্নময় চাহনি দেখবে যা তার স্বামীর চাহনিতে রয়েছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সে শুনতে পায় মঞ্জরী যেন দূর থেকে তাকে ডাকছে—চোখ মেলে দেখ শ্রীমতী দেবশিশুর জন্ম দিয়েছিস।
শ্রীমতী বুঝতে পারে সে অচেতন হয়ে পড়েছিল। অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তাকে। এবারে নিজের সন্তানের মুখদর্শন করবে। মঞ্জরী আবার ডাকে—জন্মেই মাকে দেখবে বলে কাঁদছে, আর তুই চোখই খুলছিস না।
এবারে শ্রীমতী একটু ভয় পায়, যদি সে আশাহত হয়। পরমুহূর্তে ভাবে, ছিঃ নিজের গর্ভের সন্তানকে পৃথিবীতে অভ্যর্থনা করতে দ্বিধাগ্রস্থ হলে সন্তানের অমঙ্গল হতে পারে। সে চোখ মেলে। রাজপুরী থেকে পাঠানো দাই মায়ের মুখের সামনে শিশুকে মেলে ধরে। সত্যই ঠিক যেন দেবশিশু। কিন্তু চোখের সেই দৃষ্টি?
মঞ্জরীকে সে জিজ্ঞাসা করে—এর চোখ কেমন হয়েছে মঞ্জরী?
—খুব সুন্দর হয়েছে।
—চাহনি?
—এখনো ঠিকভাবে তাকাতেই পারে না। দৃষ্টি স্থির হোক। তুই বড় নির্দয় ৷ একবার বুকে টেনে নিতেও ইচ্ছে করছে না?
-করছে, খুবই করছে। তবু একটু মিলিয়ে নিতে চাইছি।
—একটা জিনিস আমি বলে দিতে পারি।
আগ্রহ ভরে শ্রীমতী জিজ্ঞাসা করে—কি?
—এ খুব শক্তিশালী হবে।
শ্রীমতী বারবার শিশুর চোখের দিকে চায়। আঙুল দিয়ে বারবার তার মুখ নিজের মুখের সামনে ফিরিয়ে ধরে। তারপর বুঝতে পারে।
মঞ্জরী বলে—কি হল? মুখের হাসি মিলিয়ে গেল কেন?
-না। এর বাবা কোথায়?
মঞ্জরী হেসে ওঠে–বাঃ সুন্দর নাম দিয়েছিস তো? “এর বাবা”। তিনি তো বাইরে বসে রয়েছেন, সঙ্গে তাঁর বন্ধু।
–এখন ডাকা যায় না?
—তুই বললেই ডাকা যায় ৷
-তাহলে ডেকে নিয়ে আয়।
—ওঁর বন্ধুকে?
—তিনিও আসুন।
—তুই একটা অদ্ভুত মেয়ে। এই সময় স্বামীকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে ডাকে কেউ।
একটু পরেই অমরু আর অতীশ আসে। অতীশ তো শিশুকে দেখে লাফিয়ে ওঠে। অমরুর মুখেও হাসি। আনন্দের হাসি।
শ্রীমতী তাদের দু’জনকে জিজ্ঞাসা করে—এ বড় হয়ে কি হবে?
অতীশ এক মুহূর্ত দেরি না করে বলে ওঠে—-বীর যোদ্ধা।
অমরু বলে—আমি বুঝতে পারছি না।
শ্রীমতী প্রশ্ন করে—কবি হবে?
—কবি হতে হলে কেমন হতে হয়, আমি জানি না।
—পরে ভেবে বলো।
অমরু ঘাড় কাত্ করে।
শ্রীমতী জানে, সেই দৃষ্টি পায়নি তার সন্তান। তবে খুবই সুন্দর হয়েছে। দৃষ্টিও স্নিগ্ধ। বীর হতে পারে, জ্ঞানী হতে পারে, দয়াবান হতে পারে, সব হতে পারে। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি আর পরমহংসের আশীর্বাদে এ মানুষের মতো মানুষ তো হবেই। তার চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর কি হতে পরে?
সে সবার সামনে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে, তার মুখে হাসি ফোটে। মঞ্জরী বলে—বাবাঃ, এতক্ষণে মাতৃস্নেহ জেগে উঠল। তোর সব কিছুই বিদঘুটে।
অতীশ বলে—কিন্তু এর নাম কি হবে? আমাদেরটি তো পৃথ্বীশ।
শ্রীমতী ধীরে ধীরে বলে-এর নাম মানব। আমি কিছু চাই না। শুধু চাই মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠে যেন। এ যেন অনুভূতিসম্পন্ন হয়। সবার দুঃখ-কষ্ট যেন হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারে। আর অবশ্যই যেন জ্ঞানবান হয়।
সবাই শ্রীমতীর মধ্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে দেখল পরিপূর্ণ এক মাতৃরূপ।
***
Leave a Reply