বিজয়নগর – ৭

বিশাল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেও রাজা রসিকতা করতে জানেন। সবার ধারণা যিনি সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, স্বভাবতই তাঁর দায়িত্ব অসীম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সব সময় চিন্তা করতে করতে তাঁর মন নীরস হয়ে যায়। কিন্তু রাজার তেমন হয়নি কখনো। রাজ্যের দায়িত্ব তাঁর কাছে গুরুভার বলে মনে হয় না কখনো। তাঁর দৈনন্দিন কর্ম বলে মনে হয়। তাই তিনি রসহীন নন। যখন শুনলেন ছয়দিন পরে কবিপত্নীর মাকে রাজধানীতে আনা নিরাপদ তখন অতীশকে বলেন—তোমাকে একটা অভিযানে যেতে হবে।

অতীশ বিস্মিত হয়। কোনো অভিযানের আগে আলোচনা হয় এবং সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার পরে এখন তার দায়িত্ব অনেক বেশি। তার স্থান বলতে গেলে দানায়িকের পরেই। তাই অভিযানে যেতে হবে অথচ সে জানে না?

রাজা বলেন—শোন, ছয়দিন পরে তুমি তোমার বাহিনী থেকে পাঁচটি সুসজ্জিত হস্তী, পঞ্চাশটি অশ্ব, পাঁচশো পদাতিক আর চারটি শিবিকা নিয়ে কবি-পত্নীর গ্রামে অভিযান চালাবে।

রাজার ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই অতীশ হেসে ওঠে। রাজা ধমকে ওঠেন—হাসছ কেন? শুধু কবি-পত্নী নন, উনি রাজবৈদ্য, একথা ভুলে গেলে?

—না মহারাজ। আপনি বলুন।

—একটি শর্ত রয়েছে। যাওয়ার পথে কোনো গ্রামবাসীর মনে যেন বিন্দুমাত্র আতঙ্কের সৃষ্টি না হয়। বাহিনীর সবাই যেন তাদের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে যায়। তারাও যেন মজা পায়। তবে এজন্য সৈন্যরা ফিরে এলে তাদের পনের দিন নতুন করে কঠোরভাবে শিক্ষা নিতে হবে। নইলে প্রকৃত যুদ্ধের সময়ও তারা সব কিছু সহজভাবে নিতে চাইবে।

—বুঝেছি মহারাজ।

—যেদিন ওখানে পৌঁছোবে, তার পরের দিনই ফিরতে হবে। কোন সময় পৌঁছাতে হবে এবং ফিরতে হবে সেটা তোমরা ঠিক করবে। ইচ্ছে করলে তোমার পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পার।

—নিয়ে যেতেই হবে মহারাজ।

—ঠিক আছে। কবি কেমন আছেন?

—ভালোই আছে, তবে একটু অন্যমনস্ক

-কবিরা অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন। তোমরা অশ্ব হাতি আর পদাতিক নিয়ে ওঠাবসা কর বলে ওসব বুঝবে না।

অতীশ মনে মনে ভাবে, যার সঙ্গে শৈশবে থেকে তার ওঠা-বসা তাকে সে চিনবে না, চিনবেন মহারাজ? তবু তিনি অধীশ্বর। তাই চুপ করে থাকবে ভেবেও বলে ফেলে—এ অন্যমনস্কতা অন্য ধরনের

—অত ভাবতে হবে না। ভাবনার দিন আসছে। আজ দূত এসে খবর দিয়েছে দিল্লির সুলতানের সঙ্গে নিজাম-উল-মুকের শলাপরামর্শ চলছে বুঝতেই পারছ এই আক্রমণ খুবই বড় ধরনের হবে। আমাদের যেসমস্ত অল্পবয়সী সেনা নায়কগণ ভালো কাজ দেখাচ্ছে, তাদের স্থায়ীভাবে পদোন্নতি করতে হবে। দানায়িক এই কথাই বলেছেন।

অতীশ ভীষণভাবে চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। বুঝতে পারল, মহারাজের সত্যই তুলনা নেই।

.

শ্রীমতী ভাবে, আজ সকালে চারদিন শেষ হল। আরও কত বাকি। আগামী কাল সকাল হবে, রাত্রি হবে, তারপর আর একটা দিন তারপরও……ওঃ সে আর ভাবতে পারে না। মা তার পাশে বিছানায় শুয়ে হাসি মুখে কি যেন বলছে। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু তার মন পড়ে রয়েছে বিজয়নগরে। প্রথম যেদিন ওকে গুরুদেবের সঙ্গে দেখেছিল সেদিন তার মনের ভেতরে একটা অনাস্বাদিত অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর থেকে সব কিছু তার মনে আসা যাওয়া করতে থাকে। তারপর সেই স্পর্শ, ওই প্রথম স্পর্শ করেছিল বটে, কিন্তু সেজন্য তাকে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। নইলে হয়তো সেদিন স্পৰ্শই করত না। নিজেকে বেহায়া বলে মনেও হয়নি তার। আজও হয় না।

মা বলে ওঠে—তুই আমার কথা শুনছিস না।

চমকে উঠে শ্রীমতী বলে—শুনব না কেন? শোনার জন্যই বসে রয়েছি।

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—তুই না এলেই পারতিস।

শ্রীমতী দুবাহু দিয়ে মাকে ঘিরে ঝুঁকে বলে—তুমি নিষ্ঠুর বলে একথা বললে। অথচ আমি ভাবতাম আমি অনাথ। আমার মা আমাকে এখানে পৌঁছে দিলে অনাহারে মারা গিয়েছে। একবারও মাথায় আসেনি, তুমি ওই দুর্ভিক্ষের পরে বেঁচে রয়েছ। গ্রামে এমন কেউ ছিল না যে নিজেদের পরিবারের লোকদের বাঁচিয়ে অন্য কাউকে বাঁচাবে।

–ঠিকই বলেছিস। তেমন কেউ ছিল না। আজ বাসন্তীরা বেঁচে রয়েছে। তেমন আরও যারা বেঁচে রয়েছে তাদের দেখতে হয়েছিল কংকালের মতো। তবু তারা বেঁচে ছিল, কিছু পেটে দিতে পারত বলে। তোর বাবা বেঁচে থাকলে আমরাও পারতাম।

–তুমি বাঁচলে কি করে?

—এক সিদ্ধপুরুষের দয়ায়। তাঁর কোনো আশ্রম নেই। সেই সময় তুঙ্গভদ্রার তীরে কিছুদিনের জন্য একটি শাম্মলী গাছের নীচে আসন করেছিলেন। একদিন দেখতে পেলেন গ্রামের কিছু লোক একটি মৃত দেহকে ভাগাড়ে ফেলে দিতে পায়ে দড়ি বাঁধছে। সেই সময়ে এত লোক মরছিল যে পাহাড়ের পাশে এক গভীর খাদের মধ্যে মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসত। সন্ন্যাসীর সন্দেহ হল। তিনি দূর থেকে হাত নেড়ে ওদের মানা করলেন। কাছে গিয়ে বললেন—ওর দেহে প্রাণ আছে।

গ্রামবাসীরা বিদ্রূপ করে বলে—সাধুরা দূর থেকেই সব বলে দিতে পারেন নাকি? সারাদিন পড়ে আছে আমরা দেখছি। গায়ে মাছি বসছে।

সাধু কোনো কথা না বলে কমণ্ডুল থেকে জল নিয়ে আমার মুখে ঝাপটা দিলেন। তারপর ফোঁটা ফোঁটা জল পান করানোর চেষ্টা করে শেষে সফল হলেন। গ্রামবাসীরা তাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। সাধু হেসে বলেন—তোমরা কোনো অন্যায় করনি। এ বলতে গেলে মৃতই ছিল। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল।

এর পরে ওই শাল্মলী গাছের নীচেই তিনি আমাকে সুস্থ করতে সচেষ্ট হলেন। গ্রামবাসীরা সবাই তাঁকে সাহায্য করেছিল।

শ্রীমতী বলে—তারপর?

—তারপর আর কি। আমি সুস্থ ছিলাম, সবল হলাম। সাধু বিদায় নিলেন। গ্রামবাসীরা তাঁকে কত সাধ্যসাধনা করল ওখানে আশ্রম করতে। তিনি মৃদু হেসে বলেন—তা হয় না। চরে বেড়ানোই আমার কাজ। তখন আমি ওঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বললাম—আমাকে আপনি আর দর্শন না দিলে আমি এই প্রাণ রাখব না। তিনি বললেন—তোর সুখের দিনে একবার আসব। কথা শুনে আমার বুকের ভিতরে হাহাকার করে উঠেছিল। কারণ অভুক্ত অবস্থায় থাকলেও পথে সবাই যখন শুনছিল তোকে দেবদাসী হতে মন্দিরে রেখে ফিরছি তখন তারা ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়েছিল। অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়েছেন। দেবদাসী হওয়ার পরিণতির কথা সবিস্তারে বলেছিল। আমি আত্মহত্যা করতে পারিনি। বুঝে ছিলাম, আত্মহত্যা করতে হলেও শক্তি দরকার। আমার সেই শক্তিও নেই। গ্রামের মানুষেরা দেবদাসী সম্বন্ধে অতশত জানে না। তাই তারা বিদ্রূপ করেনি। কিন্তু আমি নিজের অন্যায়বোধের জ্বালা ক্রমাগত দগ্ধ হতাম। তোকে দেখতে যেতে সাহস পাইনি। এখন বুঝতে পারি আমি তোর বাবার উপযুক্ত স্ত্রী ছিলাম না, তোর মা-ও হতে পারিনি।

–ও সব আমি জানি না মা। তবে এটুকু বুঝলাম। তোমার ওপর ভগবানের আশীর্বাদ রয়েছে।

—কিভাবে?

—তিনি তোমাকে নিয়ে পশুপতি মন্দিরে গিয়েছিলেন বলে। তিনি তোমার হাত দিয়ে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে আমাকে সঁপে ছিলেন বলে। নইলে তুমি যা আশঙ্কা করতে এতদিন ধরে, তাই হত। তুমি পুণ্যবতী মা, তাই আমার বাবার মতো স্বামী পেয়েছিলে, আর আমিও তোমার স্বামী ভাগ্যের মতো ভাগ্যবতী। তোমার পুণ্যের ফলে ওঁর দেখা আমিও পাব বলেছেন। কিন্তু আমার গুরুদেবের প্রয়াণের পরে আমি সেকথা ভাবতেও পারছি না। বরং আমার গুরুদেব চিরজীবী হোন। অবিমিশ্র সুখ বা দুঃখ কিছুই বোধহয় মানুষের ভাগ্যে জোটে না।

মা চোখ মুছল—দুঃখের না সুখের? হয়তো দুই চোখে দুই ধরনের ধারা। কারণ আজ স্বামী নেই তাঁর।

.

তারপর একদিন মধ্যাহ্নের পরেই বহু অশ্বের পদধ্বনি। গ্রামবাসীরা কুটির থেকে বাইরে এসে কি করতে হবে ভেবে পায় না। আশেপাশে বনজঙ্গল নেই। ক্ষেত কর্ষিত। বীজ বপন করা হয়নি। অনেক অশ্ব হঠাৎ থেমে গেল। তারপর সুসজ্জিত দুটি হস্তী এসে শ্রীমতীদের কুটিরের অদূরে থামল। হাঁটু মুড়ে বসল। শ্ৰীমতী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল। কিশোরী মেয়েটি কেঁদে ফেলল। শ্রীমতী তার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। শেষে দুজনা দেখল অবিশ্বাস্য দৃশ্য। হাওদা থেকে নামল অমরু। তার মন নেচে উঠল। বলে উঠল—মা, তোমার জামাই এসেছে।

–তাই নাকি। মা কোনোরকমে উঠে বসতে চায়।

—উঠো না। একটা শিবিকা দেখছি। ওমা, মঞ্জরীও এসেছে।

—মঞ্জরী কে?

—আমার সখী। ওমা, ওর স্বামীও এসেছেন। এসব কি করেছে ওরা। কত সৈন্য এসেছে। এরা থাকবে কোথায়? খাবে কি? কোথায় কি করব এখন !

—তাহলে? জামাইরা অভুক্ত থাকবে? ওদের বুদ্ধিসুদ্ধি হয়নি? তোর সখীও ভাবল না! সে তো মেয়ে।

মঞ্জরী ছুটে এসে শ্রীমতীকে জড়িয়ে ধরে বলে—মনে হচ্ছে কতদিন তোকে দেখিনি।

—এবার তো দেখলে। কিন্তু থাকা খাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?

—ওসব ভাবিস না। ওরা যুদ্ধ করতে বেরিয়েছে। সব ওরা করে নেবে। —কার সঙ্গে যুদ্ধ?

—এখানকার মানুষদের সঙ্গে। তবে একটা শর্তে সন্ধি হতে পারে। গ্রামবাসীরা মাসীমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে দিলে স্থায়ী শান্তি।

শ্রীমতী হেসে ফেলে। বলে—মা তোমার আর একটা মেয়ে। বিয়ের পর খুব তাড়াতাড়ি পেকে গিয়েছে।

মঞ্জরী মাকে প্রণাম করতে তিনি তাকে আদর করেন, আশীর্বাদ করেন।

.

পরদিন বিজয়নগরে যাত্রার আগে অতীশ এসে মাকে বলে—আপনার জমিতে নিয়মিত ফসল ফলবে, আপনার কুটির সংস্কার করে অটুট রাখা হবে। যখন খুশি আসতে পারবেন।

এতদিন পরে স্বামীর শোকে তিনি কাতর হলেন। মঞ্জরী আর শ্রীমতী তাঁকে ধরে রাখে। একটু পরে দুটি শিবিকা এল। তার সঙ্গে সঙ্গে একজন সাধু এসে দাঁড়ালেন। কোথা থেকে এলেন এই সন্ন্যাসী? সবাই বিস্মিত। মা তাঁকে দেখেই তাড়াতাড়ি এসে বলে—বাবা, আপনি এসেছেন?

–তাই তো কথা ছিল।

–আমি এত ভাগ্যবতী ভাবিনি বাবা।

-তোমার ওপর ভগবানের কৃপা রয়েছে। ক্রিয়াশক্তি দেখছি ভালোই করেছে। শ্রীমতী বলে ওঠে—আপনি তাঁকে চেনেন?

—ওকে ছেড়ো না। আয়ুর্বেদের সবকিছু জানো না এখনো। কেউ আমাকে অনুসরণ করো না।

সাধু সৈন্যদের মধ্য দিয়ে পথ করে চলে গেলেন।

অতীশ অস্থির হয়ে বলে ওঠে—আমি যাই। ওঁর পা ধরে নিয়ে আসি। অমরু হেসে বলে—পাগলামি করিস না। মনে হলে, উনি নিজেই আসবেন, ডাকতে হবে না।

সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই সমস্ত অঞ্চল জনশূন্য হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা শোকাচ্ছন্ন অথচ গর্বিত। একদিনের মধ্যে যা ঘটে গেল, সে সব ওদের কল্পনাতীত ছিল। ওদের গ্রামের মেয়ে শ্রী, রানী না হয়েও যেন রাজেশ্বরী। ওর স্বামী রাজা না হয়েও যে রাজাধিরাজ। আর ওই সাধু। সবাই বলাবলি করে, উনি তো স্বয়ং ঈশ্বর। কেউ চিনতে পারল না।

একজন প্রৌঢ় বলে ওঠে—সব কিছুর মূলে যে রয়েছে, তার নাম তোমরা একবারও বলছ না।

সবাই তার দিকে ফিরে বলে—কে?

—একজন অসাধারণ পুরুষ। সে ছিল বীর চরিত্রবান, দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তারই কন্যা বলে শ্রীমতী এত গুণসম্পন্না হয়েছে। সে আমাকে বলত নিজের মেয়ে বলে বলছি না সব কিছু এত তাড়াতাড়ি বুঝে নেয়, আমি নিজেই অবাক হই। ওর জ্ঞানপিপাসা মেটাতে আমাকে রাজধানীতে পুস্তকের খোঁজে ছোটাছুটি করতে হয়।

এক বৃদ্ধ বলে—হ্যাঁ, সোমেশ্বর। ওর মৃত্যু এত আকস্মিক ছিল যে আমরা সেই ভয়াবহ সংবাদ শুনতে প্রস্তুতই ছিলাম না। তবু শুনলাম, সয়েও গেল।

এতদিন পরে সোমেশ্বরের চেহারা সবার চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সবাই মনে মনে অনুতপ্ত হল। সোমেশ্বরের কথা তাদের মনে আসা উচিত ছিল। আসত ঠিকই, কিন্তু সেই টানা করাল দুর্ভিক্ষ তাদের অমানুষ করে দিয়েছিল। সোমেশ্বর গেল যুদ্ধে, তাছাড়া নটবর গেল, বদ্রীনাথের স্ত্রী আর মেয়ে গেল, কৈলাস গেল, এমন কি পালোয়ান ভবশঙ্করও গেল দুর্ভিক্ষে ধুঁকতে ধুঁকতে। চোখের সামনে ভবশঙ্করের অতবড় দেহটা শুকিয়ে কেমন হয়ে গেল, অথচ কারও মনে এতটুকু সহানুভূতিও জাগল না। সবাই তো তখন অমানুষ। গরু ছাগল কিছু ছিল না।

.

শ্রীমতীর অন্তঃকরণে সংগোপনে একটি ইচ্ছা রয়েছে। এই ইচ্ছার কথা কাউকে বলা যায় না, অথচ দমনও করা যায় না। মাধবী প্রথম তার মনে এই ইচ্ছা জাগায়। মাধবীর মনে তেমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। সে অনেক সময় ভবানী দিদির কাছে গিয়ে বসত তার সুখ-দুঃখের কথা শুনতে। সেই সময় ভবানীদি এক দুৰ্বল মুহূর্তে তাকে বলে ফেলেছিল তার কিশোরী জীবনের এক অতি অল্প স্থায়ী প্ৰণয় কাহিনী। সেই তরুণটি তারই গ্রামের। ভালোবেসে ফেলেছিল তাকে। ছেলেটি কিছু বুঝত না, শুধু সে ভবানীকে ভালোবাসতে জানত, তীব্রভাবে ভালোবাসত। ভবানী মাধবীকে বলেছিল, ওই বয়সে অমন হয়। তারও হয়েছিল। সে তরুণকে নদীর ধারে নিয়ে যেত, তার মাথা কোলে তুলে নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকত। সেও চেয়ে থাকত। ওদের আর কিছু মনে হত না। শুধু মনে হত, পৃথিবীতে আর কেউ নেই, কিছু নেই। ফলে ধরা পড়ে গেল। দোষ হল ভবানীর যদিও ছেলেটি বলেছিল, ভবানীর দোষ নেই। অথচ ভবানী জানত সম্পূর্ণ দোষ তারই। কিন্তু সে একে দোষ ভাবেনি। ফলে ভবানীর আশ্রয় হল এই মন্দিরে। কার পরামর্শে তাকে এখানে পাঠানো হল, সে জানে না। তবে ভালোই হল। ওকে ছাড়া অন্য কারও কথা সে ভাবতে পারত না। তারপর অবশ্য সব ফিকে হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির মুখও তার মনে পড়ে না। এ জন্য একটা অপরাধ বোধ রয়েছে তার। কারণ ছেলেটি তাকে মনে রেখেছে হয়তো। মাধবী আর একটা কথা বলেছিল। দেবদাসীদের অনেক মানুষ হেয় চোখে দেখে। তার কারণ রয়েছে বৈকি। দেবদাসী হলেও, তারা প্রকারান্তরে বারবনিতাও বটে। তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় অনেককে। কিন্তু সবাই তো একরকমের নয়। সরস্বতীই তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। প্রত্যেক মন্দিরেই এমন কেউ একজন থাকে যায় কাছে বিষ আছে। সে হয়তো নিজের নিরাপত্তা আর কুমারীত্ব অটুট রাখার আকাঙ্খায় বিষ সংগ্রহ করে রাখে। তারপর সেই বিষ থেকেই যায়। ভাবে, অন্যের দুঃসময়ে কাজে লাগতে পারে। ভবানী দিদি মাধবীকে বলেছে, তার কাছে আছে।

শ্রীমতী ভাবে এখন সে বিষের পরিবর্তে অমৃত চায়। না, অমৃতও তো পেয়ে গিয়েছে। তার অমৃত অমরু। কিন্তু অমরুর মাথা নিজের কোলে রেখে তুঙ্গভদ্রার তীরে কোনো এক চন্দ্রালোকিত রাত্রে সে যদি নির্নিমেষ নয়নে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে পারত তাহলে তৃষ্ণা মিটত। ভবানীদিদির কৈশোরের প্রণয়ের সেই সাধ এখনো মেটেনি তার। কিন্তু আর কি সম্ভব? লোকে দেখলেই চিনে ফেলবে। কৌতুকের চমকপ্রদ খোরাক পাবে তারা। চাঁদনি রাতে আয়ুর্বেজ্ঞ স্ত্রীর ক্রোড়ে সভাকবি মাথা রেখে তুঙ্গভদ্রার তীরে শুয়ে রয়েছেন। কেন, নিজের শয়নকক্ষ নেই? হতে পারে কবির খেয়াল। অমন রূপসী স্ত্রীর জ্যোৎস্নালোকধৌত মুখখানি দেখে নতুন ভাবের উদয় হবে, শ্লোকের জন্ম হবে। কিংবা রূপসী স্ত্রী দেখে নিতে চায় কবির স্বপ্নময় দৃষ্টির গভীরতার অতলান্ত রয়েছে কিনা। সে ডুব দিতে চায়। এইসব চিন্তা যখন শ্রীমতীকে বারবার দোলা দিচ্ছে তখন অমরু একদিন বলে আমার কৃষ্ণানদীর তীরে যেতে ইচ্ছে হয় খুব। শ্রীমতী চমকে ওঠে। বলে কেন কৃষ্ণা নদী কেন? তুঙ্গভদ্রাও তো রয়েছে। চাঁদের আলো তুঙ্গভদ্রার জলধারা প্রস্তর খণ্ডে বাঁধা পেয়ে কেমন টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দেখে মুগ্ধ হতে হয়।

–আমি শোভা দেখার কথা বলছি না ৷

—তবে?

-মাধবাচার্যের আশ্রম দেখার সাধ। তাঁকে তো চেনই।

–কি করে চিনব? কত বছর আগের মানুষ তিনি। তবে মায়ের কাছে পুত্রের পরিচয় না দিলেও চলবে।

অমরু হেসে ওঠে। বলে—তবে আর কি। পুত্রের আশ্রম দেখতে যেতে পার।

শ্রীমতীর মনেও আগ্রহ জন্মায়। মাধবাচার্য সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। তাঁর মতো পুত্র গর্ভে ধারণ করা মহা ভাগ্যের। তিনি যে আশ্রমে বাস করতেন সেটি তো তীর্থস্থান। সে বলে-আমরা দু’জনা গেলে মা একা থাকবেন। বছরের পর বছর একা থেকেছেন।

—প্রতিবেশীরা রয়েছেন। তাছাড়া রাজপুরী থেকে তো একজন আসে।

—রাত্রে?

—দেখি অতীশকে বললে একটা বুদ্ধি দিতে পারে।

—আমি জানি কি বুদ্ধি দেবেন উনি।

– কি?

—মঞ্জরী রাতে মায়ের কাছে থাকবে।

–আমার কেমন সংকোচ হয়।

-আমারও। এখানকার মা হলে চলত।

–তার চেয়ে মাকে সঙ্গে নেওয়া যায় না?

-গ্রাম ছেড়ে আসার সময়ে দেখলে তো তো ওঁর কষ্ট হয়। ওঁকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

—চল, মাকে বলে দেখি।

মা তো শুনে মহাখুশি। বললেন—আমার জন্য ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি। রাজপুরী থেকে লোক আসছে আশেপাশের সবাই আছে। আমি বেশ আছি। তোরা ঘুরে আয়। এতটুকুও দ্বিধা করিস না। জামাই-এর সাধ হয়েছে বাধা দিস না।

অতীশ শুনে বলল—আমি মঞ্জরীর একজন পরিচারিকাকে রেখে দেব। মঞ্জরী গেলে উনি হয়তো বাড়াবাড়ি ভাববেন।

আশ্রমে মাধবাচার্যের বংশের কেউ নেই। ওই গ্রামেও তাঁদের বংশের কাউকে পাওয়া যায় না। তবে আশ্রমটি খুব ভালো লাগল দুজনারই। ওখানে মাধবাচার্যের একজোড়া কাষ্ঠনির্মিত পাদুকা রয়েছে। ওরা ওই পাদুকাকে প্রণাম করে। বোঝা যায় আশ্রমটিকে সযত্নে রক্ষা করা হয়। অনেকেই আসে। শয়নাচার্যও এখানে আসতেন। কারণ এটি তাঁর পিত্রালয়। তিনি তাঁর শৈশব এখানে অতিবাহিত করেছেন। তাঁরও একজোড়া পাদুকা আর একটি সোনার অঙ্গুরীয় রয়েছে ওখানে। উভয়ের পাদুকাই চন্দন-চর্চিত।

.

গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে যেতেই হয় আয়ুর্বেদশাস্ত্র সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে। সিদ্ধপুরুষের আদেশ। অমরু যখন রাজসভায় যায় তখন মাঝে মাঝে পশুপতি মন্দিরে শ্রীমতী যায়। যেতে খুব ভালো লাগে। মাধবী, অবলা দয়াবতীদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা হয়। গুরুদেবের দর্শন মেলে, শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।

গুরুদেব তাকে বলেন—রোগনির্ণয়ই হল প্রধানতম কাজ, আর সেই কাজ শাস্ত্রপাঠ করলেই ঠিকভাবে আয়ত্তে আসে না। এই ক্ষমতা বলা যেতে পারে ভগবদ্-প্রদত্ত। মাধবীর মধ্যে এই গুণটা কিছু রয়েছে দেখছি।

শুনে শ্রীমতীর খুব আনন্দ হয়। তারপর অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে বলে–আপনি শুধু আমাদের দু’জনকেই পাত্রস্থ করলেন—

গুরুদেব হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন— চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো পারিনি। বিজয়নগরের সুদিনও তো শেষ হয়ে আসছে। আর বড়জোর পঁচাত্তর-আশি বৎসর।

শ্রীমতী ভীত কণ্ঠে বলে—কেন, গুরুদেব?

—মাধবাচার্যও বলে গিয়েছিলেন, রাজপুরুষদের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে, এই হিন্দু সাম্রাজ্য তিনশো বছরের বেশি নয়। আবার টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শুরু তো হয়ে গিয়েছে। ভ্রাতা ষড়যন্ত্র করে রাজাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। ভাগ্যক্রমে রাজা বেঁচে গেলেন। এমন ঘনঘন হবে হয়তো। রাজপুত্রকে পিতার মতো উপযুক্ত বলেও মনে হয় না।

শ্রীমতী বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সঙ্গে মাধবীদের পাত্রস্থ হওয়ার বিষয়টি কেমন করে যেন গুলিয়ে ফেলে। কারণ ক্রিয়াশক্তিই ওইভাবেই বলেছিলেন। আসলে তিনি রাজপরিবারের ঘটনায় খুবই বিচলিত হয়েছেন। সবাই হয়েছে। মাধবী শ্রীমতীর সঙ্গে চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা করে। মাধবী বলে–তুমি কত জান।

—তুমিও শিখবে। গুরুদেব তোমার প্রশংসা করেছেন।

দয়াবতীর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল। শ্রীমতী মুগ্ধ হয়ে শোনে। মাধবী বলে—আমার যদি অমন প্রতিভা থাকত।

—সবার সব হয় না।

-দয়াবতী কি বলে জান?

– কি?

–বলে, তোমায় গুরুদেব যেমন সুপাত্র এনে দিয়েছেন, তাকে দিতে পারবেন না। সে তো সুন্দরী নয়। তবে এনে দিতে চাইলেও সে সম্মত হবে না।

– সে কি? কেন?

–সে তার স্বামী পেয়ে গিয়েছে। পশুপতি নাথ তার স্বামী। তেমনই মনে হয় কিন্তু। সব সময় একা একা সেখানে যায়। রাতেও যায়। অন্য কেউ ভাববে, মাথা খারাপ হয়েছে। আসলে কিন্তু মাথা ঠিক আছে।

-আশ্চর্য! যাই তো আর একবার দেখে আসি।

শ্রীমতী দয়াবতীকে পেল বিগ্রহের সামনে। নিমীলিত চক্ষে গান গেয়ে যাচ্ছে। অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরে পড়ছে।

মাধবী নিম্নস্বরে বলে—ওর স্তবের শেষ নেই।

–কোথায় পায়?

—ওর নিজের তৈরি।

—গুরুদেব জানেন?

–জানতেন না, জেনেছেন। কিছু বলেন না। শুধু নিজে যখন পূজা করেন তখন ওকে কাছেই রাখেন। ওকে গাইতে বলেন। স্তবগুলো গান হয়ে ওঠে। ফেরার পথে শ্রীমতী ভাবে, দয়াবতীর কাছে সে পরাজিত। দয়াবতী যেমন নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিয়েছে তার দয়িতের কাছে, সে তেমন পারেনি। অথচ অমরু তার রূপে যে মুগ্ধ হয়নি তেমন নয়। কিন্তু সেই মুগ্ধতা, অন্যরকমের। সে অমরুকে ফিসফিস্ করে বলেছে—আমি তো রূপবতী নই। আমাকে তোমার ভালো লাগে না।

—না না, কে বলেছে একথা? তোমার রূপ স্বর্গের দেবীর মতো। ওই রূপে মোহের চেয়ে মুগ্ধতা সৃষ্টি করে অনেক বেশি।

হতাশ হয়েছে শ্রীমতী। অন্তত প্রথম সেইদিন সে নিজে দেবী হতে চায়নি। সে হতে চেয়েচিল ঊর্বশী, হতে চেয়েছিল মেনকা। দয়াবতীর বিগ্রহ দেবতা হয়েই রয়েছেন। এতে তার এতটুকুও বিকার নেই। নির্বিকার হয়ে সে স্তব সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু শ্রীমতী? কতদিন অমরুকে বিগ্রহ করে রাখতে পারল? সে অমরুর মুগ্ধতায় সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। কারণ তার শিরা-উপশিরায় তখন উষ্ণতার ছোটাছুটি। তাই প্রাণপণে অমরুরর মুগ্ধতাকে মোহাবিষ্ট করতে প্রয়াসী হল। তাতেই অমরুকে পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যাবে। তাতে তার নিজের পরিতৃপ্তি। অবশেষে কাঙ্খিত রাত্রি এল।

পরদিন সকালে মা শ্রীমতীর মুখের দিকে চেয়ে পুত্রকে বলেছিলেন তুই কাব্য লিখিস ভালো কথা। সেটা একধরনের সৃষ্টি। তাই আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে জেনে যেতে চাই যে তোদের বংশধারার শেষ পুরুষটি যেন তুই না হোস্।

শ্রীমতী অত্যন্ত লজ্জা পায়। আজই উনি একথা বললেন কেন? আর বললেন তারই মুখের দিকে চেয়ে। তবে কি তিনি এতদিন তার মুখে অতৃপ্তির ছায়া দেখতে পেতেন? সে ধীরে ধীরে মায়ের সামনে থেকে সরে যায়।

.

গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি একদিন রাজপুরীতে গেলে মহারাজা তাঁকে একান্তে বলেন—আমার পুত্রটির জন্য আমার অশান্তি বেড়ে যাচ্ছে প্রভু। এর একটা প্রতিবিধান করুন। নইলে সাম্রাজ্যের ক্ষতি হবে।

—আমি রাজনীতি করি না মহারাজ। তবে এটুকু বলতে পারি যে কেউ নিজের স্বভাবের পরিবর্তন কখনো করতে পারে না। আপনিও পারেননি।

—আমি?

—হ্যাঁ। ভেবে দেখবেন। তবে আপনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা আর বিবেকসম্পন্ন বলে, নিজেকে সংযত রাখতে পারেন। স্বভাবের অনেক পরিবর্তন এনেছেন। একবার ভাবুন তার জন্য আপনাকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু আপনার পুত্রতো অমন নয়।

—তাহলে? বিজাপুরের সুলতান অবধি জেনে গিয়েছেন, যে রাজপরিবারে অশান্তি চলছে। তিনি আমাদের প্রতিবেশী সুলতান কুতুব খাঁকে উসকে দিচ্ছেন বারবার। -আপনি জীবিত থাকতে কোনো বিপদ হবে না। তবে শত্রুর আক্রমণ বন্ধ করা যাবে না।

–সে তো হবেই। তার জন্য আমি প্রস্তুত।

—আপনার সদ্যজাত পৌত্র কিন্তু সুলক্ষণযুক্ত। যদি আপনার পুত্রের রাজত্বকাল ভালোয় ভালোয় কেটে যায়, তাহলে দুর্দিন এড়ানো যাবে।

—কিন্তু আমার পুত্রটি মন্ত্রীদের অপমান করতে শুরু করেছে।

-তাকে আমার সামনে আনা যাবে?

—নিশ্চয়। সে একমাত্র আপনাকে মান্য করে। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে।

—আপনাকে?

—জানি না।। আমার নিজের ভাই যদি ষড়যন্ত্র করতে পারে, পুত্রই এবার না কেন?

—ওকে ডাকুন।

কিছুক্ষণ পরে রাজকুমার এসে উপস্থিত হয়। বয়স ত্রিশ। ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করে বলে—আমাকে ডেকেছেন?

ক্রিয়াশক্তি রাজকুমারের চোখে মুখে অনাচারের ছাপ দেখতে পান। বলেন—তুমি এই বিশাল সাম্রাজ্যের ভাবী অধীশ্বর। তাই তো?

রাজকুমার হেসে বলে—হ্যাঁ। আপনার আশীর্বাদে।

—তুমি যদি সামান্য একটু হাঁচো, তাহলে রাজ্যের সবাই জানতে পারে। বিশ্বাস কর?

–আপনি যখন বলছেন, বিশ্বাস করব।

–বাঃ, তাহলে বসাও বিশ্বাস করবে যে কোনো গর্হিত কাজ যদি তুমি কর, সবাই জেনে যাবে।

—হ্যাঁ, স্বাভাবিক।

—ভাবী মহারাজকে আমি শুধু এই কথাটুকুই বলতে চেয়েছিলাম। সাম্রাজ্যের সবার চোখ-কান এই পরিবারের দিকে নিবদ্ধ।

—জানি গুরুদেব।

-সফল অধীশ্বর হতে হলে স্বভাবের অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। তোমার পিতা তাই করেছেন। আশা করি তুমিও করবে। আমাকে তোমরা একটু সম্মান কর, সেই দাবিতে এইটুকু আমার পরামর্শ।

—মনে রাখার চেষ্টা করব। আমি মৃগয়ায় যাব। অনেকে অপেক্ষা করছে। এবারে যেতে পারি?

—নিশ্চয়ই।

রাজকুমার আবার প্রণাম করে নিষ্ক্রান্ত হয়।

ক্রিয়াশক্তি বলেন—মহারাজ, রাজকুমারের ব্যবহারের মধ্যে কোনো ত্রুটি

পেলাম না। শুধু ধৈর্যের অভাব।

—তাই দেখছি। দেখা যাক।

—আপনাকে অন্য একটি বিষয়ে বলতে চেয়েছিলাম।

–বলুন গুরুদেব।

—আমার আয়ু খুব বেশিদিন নেই। বড়জোর দু-এক বছর।

-না।

-মহারাজ আমার কোনো রোগ নেই। একটা প্রদীপ কখনো চিরকাল জ্বলতে পারে না। একসময় নির্বাপিত হয়। আমি আমার মন্দিরের ভার নিতে একজনকে ইতিমধ্যে মনস্থ করেছি। সে রাজপুরীতেও আমার স্থলাভিত্তি হতে পারে। সে আপাতদৃষ্টিতে উপযুক্ত। তবু যদি ব্যর্থ হয় পরমহংস দেখবেন।

—তিনি কে?

-আমার গুরুদেব। তিনি সর্বত্রগামী। আমি নিশ্চিন্ত। দেখি দেবদত্ত সম্মত কিনা। তার সম্মতি এখনো নেওয়া হয়নি ৷

–আপনি বললেও সম্মত হবেন না?

—না। তার নিজস্ব মতামত তো রয়েছে এবং তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যদিও বয়স তার চল্লিশও হয়নি। বলতে গেলে যুবক।

–কে তিনি?

—একজন তপস্বী। কঠোর ব্রহ্মচারী। নাম দেবদত্ত। তোমরা অবশ্যই তাকে স্বামীজী বলে ডাকবে। স্বামী দেবদত্ত।

—বিজয়নগরে থাকেন?

—হ্যাঁ। মলয়াবন্ত পর্বতের পাদদেশে ওর আশ্রম। অনতিদীর্ঘ বৃক্ষশ্রেণীর বনাঞ্চল সেটি। তবে তার কোনো শিষ্য নেই। তার আশেপাশে সব সময় কেউ থাকুক সে পছন্দ করে না। অরণ্যবাসীরা তার অজ্ঞাতে অনেক কাজ করে দিয়ে যায়। তারা বলে সন্ন্যাসী সব বুঝতে পারেন। একদিন তাদের একজনকে দেখে বলেন—তোমরা অনেক কিছু করে দাও, আমি জানি। এসব কর কেন?

–কি করব বাবা, ঘরে এক ফোঁটা জল থাকে না। গলা শুকিয়ে যেত যে।

—তাই নাকি? ঠিক আছে, আমি নিজেই এবার থেকে আনব।

—না। আপনাকে আনতে দেব না। অনেক জলের দরকার। আপনার ভাতটুকু ফুটিয়ে নিতেও জল লাগবে। তাছাড়া নুন লাগবে।

-না। আমাকে কি গৃহী বানিয়ে ছাড়বে?

—আপনাকে? তাই হয় নাকি প্রভু? আপনাকে আমরা পুজো করি। এদিকে একজন মেয়েকেও আসতে দিই না। তারা আড়াল থেকে প্রণাম করে চলে যায়।

—ভালো। আমি বলি কি, আমাকে তোমরা একটু কম দেখাশোনা করো।

—তাই করব।

ক্রিয়াশক্তি এভাবে আনুপূর্বিক বলে একটু হেসে বলেন—এই হল স্বামী দেবদত্ত।

.

ফিরিশতার বর্ণনা :–

ইসমাইল আদিল শাহা যাত্রা করলেন “বিজয়নগরের রাজার নিকট থেকে মুদকল ও রায়চুর পুনরুদ্ধারের জন্য। রাজা পূর্বেই সুলতানের উদ্দেশ্যের আভাস চরের মুখে শুনে কৃষ্ণা নদীর তীরে বহু সৈন্য নিয়ে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে অনেক সামন্ত এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিল। ফলে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী এবং বহু পদাতিক। সুলতানকে তাঁর অভিযান বিলম্বিত করতেই হল। কারণ শত্রুরা কৃষ্ণার সমস্ত ফেরী নৌকো দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু ঘোষণা করে ফেলার পর তা থেকে বিচ্যুত হওয়া অসম্মানজনক। তাই সুলতান সাত হাজার বিদেশি অশ্ব সঙ্গে নিলেন এবং শত্রুদের ঠিক বিপরীতে নদীর তীরে ছাউনি ফেললেন। তিনি নৌকোয় নদী অতিক্রম করে শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রতীক্ষা করলেন।

“এখানে আসার কিছুদিন পরে তিনি তাঁর তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সেই সময় একজন সহচরকে একটি কবিতার স্তবক আবৃত্তি করতে শুনলেন “ওঠো, স্বর্ণ নির্মিত পানপাত্র ধূলায় লুণ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই আমোদ প্রমোদের মদিরায় পরিপূর্ণ কর।’ সুলতান এ শ্লোকটি শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর প্রিয় বয়স্যদের ডেকে পাঠালেন। তাদের সঙ্গে বসে তিনি সংগীত শুনলেন ও মদ্যপান করে স্ফূর্তি করলেন। ভোজনপর্ব নির্ধারিত সময়ের পরে শেষ হল। মদিরার প্রভাবে সুলতান আচ্ছন্ন হলেন। তাঁর প্রবল বাসনা হল নদী অতিক্রম করে তখনই শত্রুদের আক্রমণ করবেন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি তাঁর উদ্দেশ্যের কথা সবার অগোচরে রেখে হস্তীপৃষ্ঠে আরোহণ করে নদীর তীরে অগ্রসর হলেন। যেন স্থানটি পর্যবেক্ষণের জন্য যাচ্ছেন। সহসা তিনি হুকুম দিলেন, যত সংখ্যক সম্ভব সৈন্য যেন ভাসমান কাষ্ঠগুলির উপর উঠে পড়ে আর অন্য সবাই তাঁর হস্তীকে জলের মধ্য দিয়ে অনুসরণ করুক। ওমরাহবৃন্দ তাঁর ভ্রম এবং তার জন্য উদ্ভূত বিপদের সম্ভবনায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সুলতান কারও কথা গ্রাহ্য না করে নদীর স্রোতের মধ্যে নেমে পড়লেন। তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যেরা দুইশত পঞ্চাশটি হস্তীতে আরোহণ করে তাঁর পিছনে পিছনে চলল।

“বরাত নেহাৎ ভালো, তাই সবাই নিরাপদে অপর পাড়ে গিয়ে পৌঁছল। বহু সংখ্যক সৈন্য কাঠের ভেলায় করে নদী পার হল। কিন্তু শত্রুসংখ্যা এতই বিপুল যে সুলতানের সম্ভবত দুই হাজার সৈন্য দিয়ে ত্রিশহাজারের বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিত্রাণের কোনো উপায় রইল না। ইসলামের বীরবৃন্দ এক প্রাণে উদ্বুদ্দ হয়ে এমন সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধ করল যে প্রায় এক সহস্র অবিশ্বাসীর পতন ঘটল। কিন্তু অবশেষে শত্রুদের গোলাবারুদ এবং নানা রকম নিক্ষেপণ অস্ত্রে বিপর্যস্ত হয়ে জীবিতেরা অনন্যোপায় হয়ে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নদীগর্ভে লম্ফ প্রদান করল। নুসরু বাহাদুর ও ইব্রাহিম যারা সুলতানের সঙ্গে একই হস্তীতে আরোহণ করেছিল তারা সেটিকে নিয়ে নদীর মধ্যে নেমে পড়ল। কিন্তু নদীর স্রোত এত তীব্র ছিল যে শুধুমাত্র সুলতানের হস্তী এবং সাতজন সৈন্য ব্যতীত বাকিরা নিমজ্জিত হল। সুলতানের এই অবিমৃশ্যকারিতার জন্য অপরিমেয় ক্ষতি হল। তিনি একাগ্র চিত্তে শপথ গ্রহণ করলেন যে যতদিন না তিনি এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারেন ততদিনে আর কখনো মাদকাসক্ত হবেন না। তারপর তিনি মন থেকে পরাজয়ের বিষাদাচ্ছন্নতা সরিয়ে তাঁর ব্যর্থতার দুর্ভাগ্যকে মোচনের জন্য তৎপর হলেন।

“এই অভিযানে মীর্জা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রেষ্ঠ উপায় নির্ধারণের জন্য সুলতান আসাদ খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আসাদ খান বলে যে ক্ষতির পরিমাণ অত্যাধিক হওয়ায় এখনকার মতো বিজাপুরে ফিরে যাওয়াই ভালো। সুলতান এই উপদেশ গ্রহণ করে, কৃষ্ণার অববাহিকা থেকে বিজাপুরের দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং আসাদ খানকে নিজের জায়গীরের সঙ্গে আরও কয়েকটি জিলা প্রদান করে তাকে সিপাহসালারের পদে উন্নীত করে সমস্ত গুরুতর বিষয়ের মুখ্য পরামর্শদাতা নিযুক্ত করলেন।”

মুসলমান সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়নগরের জয় হলেও ক্ষতিও কম হল না। সব চেয়ে বড় ক্ষতি সেনাপতি সঞ্জিত রায়ের মৃত্যু। মহারাজা বলেছিলেন এই যুদ্ধের পর তিনি সঞ্জিত রায়কে প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত করবেন। এতেই প্রমাণ হয়ে গেল মহারাজের কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। অতীশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে সঞ্জিতের অসমসাহসী যুদ্ধ এবং কৌশল দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সে নিজেও এই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হল। তার বাঁ চোখের কোণা থেকে চিবুক পর্যন্ত বিপক্ষের তলোয়ারের আঘাতে গভীরভাবে কেটে গেল। প্রচুর রক্তক্ষরণে সে যুদ্ধক্ষেত্রেই অচেতন হয়ে পড়েছিল।

শ্রীমতী মঞ্জরী আহত সমস্ত সেনার চিকিৎসা আর সেবার ভার নিল। সঙ্গে নিল একদল সেবিকা। দেশবাসী ওই দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি। তারা ধন্য ধন্য করল। মহারাজা নিজে এসে আহতদের দেখে গেলেন। দেখতে দেখতে ওদের মধ্যে অতীশকে দেখে খুব বিস্মিত হলেন। বললেন—তুমিও এদের মধ্যে কেন? তোমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারত।

অতীশ যন্ত্রণাকাতর মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলে—এখানে ওদের দুজনার আদেশ চূড়ান্ত। তারা বলেছে, আমাকেও এখানে থাকতে হবে।

রাজা গম্ভীর স্বরে বলেন—বুঝলাম।

অতীশ বুঝল, পাশে অন্য একজন সৈন্য মহারাজের কথা শুনতে উৎকৰ্ণ ছিল বলে, তিনি অন্য কোনো মন্তব্য করেননি।

মহারাজা শ্রীমতীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন-কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

—না। হলে আপনার কাছে খবর যাবে।

মহারাজা চলে যাচ্ছিলেন। শ্রীমতী ডাকে—মহারাজা।

তিনি ঘুরে দাঁড়ান-কিছু বলবেন?

—মহারাজা আপনার সৈন্যরা বলছে, তারা তাদের পরিবারের প্রত্যেকটি

পুরুষকে পরের যুদ্ধে পাঠাবে। বলছে, যুদ্ধ তো হবেই।

রাজা হেসে বললেন—যুদ্ধের জন্য লালায়িত মনে হচ্ছে?

—তারা অনুপ্রাণিত।

-স্বাভাবিক। এত যত্ন এত গুরুত্ব আগে কখনো এরা পায়নি। আমি ভাবছি আমার বয়স যদি অনেক কম হত কিংবা আমার পুত্রটি যদি পুরুষের মতো পুরুষ হত।

মহারাজা মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে যান।

মঞ্জরী অনেক দূরে সেবায় ব্যস্ত ছিল। মহারাজা তাকে দেখতে পাননি।

ইতিমধ্যে যুদ্ধের ঝড়ঝাপটা মিলিয়ে গিয়েছে। শ্রীমতী একদিন গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির কাছে এল। এবারে মঞ্জরী আসেনি। আহত সৈন্যরা মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে। তাদের ভূস্বামীরা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। অতীশ এখনো শয্যাশায়ী বলে শ্রীমতী একা মন্দিরে এসেছে। সে মঞ্জরীর অট্টালিকায় গিয়ে অতীশকে দেখে এসেছে। তাকে শ্রীমতী একটু ম্রিয়মান দেখে বলে উঠেছিল—বাঃ এবারে বেশ মানিয়েছে।

সখীর কথায় অতীশের সঙ্গে মঞ্জরীও অবাক হয়। বলে—একথা বলনি কেন?

পুরুষের মুখে আঘাতের চিহ্ন থাকলে মনে হয় তার পৌরুষ অনেক বেড়ে যায়। ওকে দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে।

দুজনা হেসে ওঠে।

শ্রীমতী বলে—কাল গুরুদেবের কাছে যাব। তোমার এবারে যাওয়ার দরকার নেই।

—ঠিক আছে। তবে আমার চার পাঁচজন সৈন্যের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। তাদের আরও কিছুদিন দেখাশোনার প্রয়োজন ছিল। কি জানি খারাপ কিছু হয়ে না যায়।

—ভালোভাবে বলে দিয়েছোস তো?

—যতটুকু পেরেছি বলেছি। ওদের সামনে তো পরিবারের কেউ থাকে না।

—কিছু করার নেই।

গুরুদেবকে দেখে শ্রীমতী চিন্তান্বিত হয়। গুরুদেব হেসে বলেন—আমার কথা ভেবে কিছু লাভ নেই। বরং যতটুকু পার শিখে নাও। তুমি তো জান শিক্ষার শেষ নেই। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তেও মানুষ নতুন কিছু জানতে পারে।

এরপর বহুক্ষণ ধরে তিনি শ্রীমতীর সঙ্গে অনেক আলোচনা করেন। একসময় সবার অনুরোধে ভবানীদিদি গুরুদেবকে গিয়ে বলে—প্রভু আজ থাক। আপনি পরিশ্রান্ত।

শ্রীমতী লজ্জিত হয়ে বলে ওঠে—হ্যাঁ গুরুদেব। আমার বোঝা উচিত ছিল।

—আমি রাজপুরীর জন্য আমার জায়গায় আর একজনকে আনার ব্যবস্থা করছি। তবে সে সম্মত হবে কিনা তার উপর নির্ভর করছে।

-এরকম একটা কথা আমি শুনেছি।

-রাজার আপত্তি হবে না। আপত্তি হতে পারে সেই অল্প বয়সী তপস্বীর। সে যদি এই মন্দিরের ভার নিত আমি নিশ্চিন্ত হতাম। দয়াবতী তো ভার নিতে পারবে না।

শ্রীমতী চমকে ওঠে—আপনি কি বললেন গুরুদেব?

—ঠিকই বলেছি। সংগীতের মধ্য দিয়ে দয়াবতী সাধনার অনেক উন্নত মার্গে পৌঁছে গিয়েছে। ওর পূজা সিদ্ধ। স্তরের মধ্য দিয়ে ও যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তাতে কোনো ত্রুটি নেই। কিভাবে পেল আমি জানি না। তবু সে নারী, তার পক্ষে অবিচ্ছিন্নভাবে পূজা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, সমাজ সংস্কার এতটা মানবে না। তাই পুরুষ ব্রহ্মচারীর প্রয়োজন। কোথায় পাব সেই ব্রহ্মচারী? রাজপুরীর এবং এই মন্দিরের ভার একজনের উপর ন্যস্ত করাই আমার অভিপ্রেত।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *