৫
এক পর্যটকের লিখিত বিবরণ :-
রাজ্যে নয়দিনের অনুষ্ঠান শেষ হলে রাজা তাঁর সেনাবাহিনীর সবকিছু পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করেন। সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা হয় এইভাবে। নগর থেকে দেড় ক্রোশ দূরে পূর্বনির্ধারিত একটি স্থানে রাজা মক্কা-রেশমের একটি শিবির স্থাপন করতে বলেন। সেই শিবিরে যাঁর সম্মানে এত সব অনুষ্ঠানাদি প্রতিপালন করা হল তাঁর বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। এই শিবির থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সেনানায়কগণ তাদের নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে নিজেদের পদের গুরুত্ব অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে দণ্ডায়মান হয়। কিন্তু দেখে মনে হয় না তারা একই সারিতে দণ্ডায়মান রয়েছে। এক এক জায়গায় সামনে পেছনে দুই তিন সারিতেও দাঁড়ায়। পথের জলাশয়গুলি সৈন্যদ্বারা বেষ্টিত থাকে। যেখানে রাজপথ সরু সেখানে তাদের সারিকে সমতলভূমিতে এগিয়ে আনা হয়। পদাতিকেরা অশ্বারোহীদের সামনে থাকে, হস্তীরা দাঁড়ায় অশ্বদের পেছনে। এই সারিতে দলপতিরা তাদের নিজ নিজ বাহিনীর সঙ্গে থাকে।
এখন আমি ওদের অস্ত্রসজ্জার ধরন সম্বন্ধে বলব। অশ্বগুলি সম্পূর্ণ সজ্জিত। তাদের অনেকের ললাট রৌপ্য পাত দিয়ে আবৃত, অনেকের গিলটি করা এবং ঝালরযুক্ত নানা বর্ণের রেশমি কাপড়ের দড়ি দিয়ে বাঁধা। অশ্বের লাগামও ওই একই ধরনের। অন্যান্যদের বিবিধ রঙের মক্কার ভেলভেট দিয়ে তৈরি। তাতেও ঝালর এবং অলঙ্কার রয়েছে। অন্য ধরনের রেশমির কাপড়ও রয়েছে। যেমন সার্টিন ও কিংখাব। এছাড়া চীন ও পারস্যদেশ থেকে আনা বুটিদার কাপড়। কারও কারও অঙ্গ গিটি করা পাত দিয়ে শোভিত। তাতে মূল্যবান পাথর বসানো, ধার বরাবর ছোট ছোট পাথরের কাজ। এই অংশগুলির কারও কারও মস্তক সর্প-শোভিত কিংবা অন্যান্য বন্য জন্তুদের প্রতিকৃত যুক্ত। এগুলি এমনভাবে তৈরি যে তাতে কোনো খুঁত নেই। শিল্পের চূড়ান্ত দক্ষতার নিদর্শন সেগুলি। অশ্বারোহীগণ দুর্ভেদ্য নরম ও পুরু পোশাক পরিহিত। তাছাড়া অনেকে বুটিদার রেশমি বা ভেলভেটের পোশাক পরেছে। এই পোশাকগুলোতে রয়েছে চর্ম ও ইস্পাতের স্তর, যাতে সেগুলি শক্ত হয়। এদের মস্তক শিরস্ত্রাণ যুক্ত। এই শিরস্ত্রাণ এমন ভাবে তৈরি যে গলা আবৃত থাকে। প্রত্যেকটি শিরস্ত্রাণে মুখমণ্ডলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া সোনা রূপা দিয়ে তৈরি কণ্ঠবর্মও রয়েছে। অন্যগুলি আয়নার মতো উজ্জ্বল ইস্পাত দিয়ে তৈরি। এদের কটিদেশে থাকে তরবারি ও রণকুঠার, হাতে থাকে বল্লম বা বর্শা যাদের দীর্ঘ হাতল সোনা কিংবা রূপো দিয়ে মোড়া। প্রত্যেকের নিকটে রাজপ্রদত্ত ছত্র রয়েছে যেগুলি ভেলভেট ও রেশমের সূচীশিল্প শোভিত। এরা বহু পতাকা আন্দোলিত করে যেগুলি শ্বেত ও নানা রঙের হয়। পতাকাগুলি দেখতে অশ্বপুচ্ছের মতো। হস্তীরাও একই ভাবে নানা বর্ণের ঝালর দিয়ে আচ্ছাদিত, যাতে ঘণ্টি বাঁধা। সেগুলি টুংটাং শব্দ করে। তাদের মুখমণ্ডল রাক্ষস ও অন্যান্য বৃহৎ পশুর মতো করে চিত্রিত। প্রত্যেক হস্তীর পৃষ্ঠদেশে দুর্ভেদ্য পোশাক পরিহিত ঢাল ও বর্শা হাতে তিন চারজন করে অশ্বারোহী। তাদের দেখলে মনে হয় যেন কোথাও আচমকা আক্রমণ করতে চলেছে। এরপর পদাতিক বাহিনীর কথা। তারা সংখ্যায় এত বেশি যে তারা সমস্ত উপত্যকা এবং পর্বতগুলি এমনভাবে ঘিরে ফেলতে পারে যে পৃথিবীতে তার কোনো তুলনা নেই। এদের মধ্যে আপনি এত দুর্লভ পোশাক দেখতে পাবেন যে তাদের কোথায় পাওয়া যায় সেই ধারণা আমার নেই। সেই সব পরিচ্ছদ এত রঙ-বেরঙের যে কত রকমের রঙ রয়েছে বলা সম্ভব নয়। ঢালিদের ঢাল সোনা আর রুপোর তৈরি ফুল দিয়ে সজ্জিত। অনেকগুলিতে রয়েছে ব্যাঘ্র ও অন্যান্য পশুদের প্রতিকৃতি। বাকিগুলি চিত্রিত। কিছু কিছু কালো রঙের এবং এত বেশি পালিশ করা যে তার মধ্যে দিয়ে আয়নার মত দেখতে পাওয়া যায়। ওদের তরবারি এত সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত যে তার চেয়ে সুন্দরভাবে কিছু করা হয়তো সম্ভব নয়। তীরন্দাজদের সম্বন্ধে একই কথা। তাদের ধনুক সোনা বা রূপা দিয়ে মোড়া, তাদের তীরও খুব সুন্দর এবং এমন ভাবে পালকযুক্ত যে অসামান্য দেখতে। তাদের কটিদেশে রয়েছে ছোরা বা রণকুঠার যার হাতল ও শেষ অংশ সোনা বা রূপার তৈরি। এরপর বন্দুকধারীদের কথা। এরা শক্ত পোশাক পরিহিত এবং সশস্ত্র। এর পর মুরদের কথাও বলতে হয়। তারাও রাজার সৈন্যদলে ঢাল-বল্লম, তুরস্কের ধনুক, অনেক বোমা আর অগ্নিনিক্ষেপক নিয়ে অংশগ্রহণ করে। আমি খুবই বিস্মিত হলাম যে এদের মধ্যে অনেকে এইসব অস্ত্র ব্যবহারে খুবই পারদর্শী।
রাজা অশ্বারূঢ় অবস্থায় প্রাসাদ পরিত্যাগ করেন। সেই অতি পরিচিত অশ্বটির পোশাক শ্বেত-শুভ্র সঙ্গে তার দুটি রাজকীয় ছত্র থাকে। সেটি উজ্জ্বল রক্ত বর্ণের ভেলভেটের উপর নানা মতি মুক্তা খচিত এবং এইসব অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত। যাদের এই হীরা জহরৎ ব্যবহারের অভ্যাস রয়েছে, কোন ধরনের সামগ্রী তাদের মহান নরপতি ধারণ করতে পারেন, কল্পনা করুন। এরপর রয়েছে সমস্ত রাজাগণ ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের আড়ম্বর। এতসব বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। আর আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এরপর রয়েছে সেই অশ্বগুলির এবং তাদের গাত্রবর্মের কথা। তারা ধাতবপাত দিয়ে এমনভাবে আবৃত যে আমি কী যে দেখলাম, বলে বোঝাতে পারব না। সব অশ্ব সম্বন্ধে বলাও দুঃসাধ্য। কারণ একে অপরকে আড়াল করে রাখায় দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই সব কিছু সম্বন্ধে বলার আশা ত্যাগ করাই ভালো। কারণ মাথাটাকে এতবার এদিকওদিক করতে হচ্ছিল যে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আমার অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়ার দশা। এই সবে যে বিপুল ব্যয় হয় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই দেশে ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি। সামন্ত রাজগণও খুবই ঐশ্বর্যশালী। রাজার সামনে একদল হাতি নানা সজ্জায় সজ্জিত হয়ে চলছিল। তাঁর সম্মুখে কুড়িটি অশ্ব সজ্জিত অবস্থায় ছিল। স্বর্ণ ও হীরা জহরৎ খোদিত ছিল অশ্বের সাজ। এই আড়ম্বরের মধ্যেই প্রতিভাত হয় রাজার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা। তাঁর অতি নিকটে একটি পিঞ্জর ছিল, লিনে “কর্পোডিভাইস” উৎসবে যেমন দেখা যায়। মনে হয় এটি তাম্র কিংবা রৌপ্য নির্মিত এবং যথেষ্ট বড়। এটিকে দুইদিকে আটজন করে ষোলজন মানুষ বহন করে নিয়ে যায়। পালা করে আরও অনেককে এটিকে বহন করতে দেখেছি। এর মধ্যে অধিষ্ঠিত রয়েছে সেই বিগ্রহটি যার কথা পূর্বে বলেছি। এদের সঙ্গে নিয়ে পরিদর্শনকালে রাজা তাঁর সেনাদলের দিকে চাইতে চাইতে তাদের অতিক্রম করছিল, দেখলাম। তারাও সেইসময় চিৎকার করতে থাকে। তাদের ঢাল বর্ম বাজাতে থাকে। অশ্বদল হ্রেষা রব করে ওঠে এবং সেই সঙ্গে হস্তীদের বৃংহণ। মনে হয় নগরী বুঝি উল্টে যাবে। পর্বত উপত্যকা এবং সমগ্র ভূমি কামান ও বন্দুকের গর্জনে কম্পিত হয়। বোমা ও আতসবাজী দেখতে সত্যই মনোমুগ্ধকর। প্রকৃতই মনে হয় বুঝি সমস্ত পৃথিবী এখানে একত্রিত হয়েছে।
.
অমরু আর অতীশ নববধূদের নিয়ে অমরুর গৃহে পদার্পণের সময় দিন অবসানের কিছুটা দেরি। তাদের দেখে অমরুর মা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে থাকেন। তার মাথায় কিছুই ঢোকে না। এদের সঙ্গে দুই সুন্দরী যুবতী; একজন তো অসামান্যা রূপসী। এরা কারা? কাদের নিয়ে এল অতীশরা। পুত্রকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না, এসব ব্যাপারে। অতীশই চমকপ্রদ কিছু ঘটাতে পারঙ্গম। পার্থিব বিষয়ে তাঁর পুত্র বিশেষ কিছু বোঝে না। অতীশ তাকে চালনা করে। কিন্তু এরা কারা? অতীশের বয়সী ছেলে এই বয়সের মেয়েদের কোথায় পেল? কোন বাবা মা তাদের সুন্দরী মেয়েদের এদের হাতে ছেড়ে দেবে? অতীশের কথা আলাদা। সে তো রাজা।
-এসব কি অতীশ? তোমরা কোথা থেকে আনলে এদের? আমি এখন কি
করব?
—বাড়িতে চাল আছে?
–তা আছে।
—সবার হয়ে যাবে?
–হবে, কিন্তু তাই কি?
–আনাজ নেই তো?
—কবে থাকে? তুমি এসব কথা না বলে আমাকে সত্যি কথা আগে বলতো?
—আমি আনাজ নিয়ে আসি। আপনি ঘরের বউদের ঘরে তুলুন। চল অমরু। ওরা বাইরে চলে যায়।
অমরুর মা বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মাথা ঘুরতে থাকে। মঞ্জরীর সেবাপরায়ণতার স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে। সে অমরুর মাকে ধরে ফেলে।
তার স্পর্শে যেন যাদু রয়েছে। মঞ্জরীকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন–তুমি কে মা? এত ভালোবাসা কোথায় পেলে? তোমার স্পর্শেই তোমাকে চেনা যায়।
—আমরা আপনার পুত্রবধূ।
–তোমরা ওদের স্ত্রী?
—হ্যাঁ, পশুপতি মন্দিরের পুরোহিত গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি নিজে বিগ্রহের সামনে ওঁদের দুজনার সঙ্গে আমাদের বিবাহ দিয়েছেন।
-এ যে আমার স্বপ্নের অতীত। কিন্তু কোথায় রাখব তোমাদের?
—খুব ভালো আছি তো? আমরা ততক্ষণে বরং রান্নার ব্যবস্থা করি।
–না, আজকে তোমরা কিছু করতে পারবে না। তোমার নাম কি?
—মঞ্জরী।
—আর তোমার? তুমি খুব লাজুক, মায়ের কাছে লজ্জা পেতে হয়?
এতক্ষণে শ্রীমতীর মনে যা ঝড় তুলতে গিয়েও পারোনি, এবারে তার বাঁধ ভাঙল। তার নিজের মাকে বারবার মনে পড়ছিল। ইনি যেন সেই মা। সে কান্নায় তাঁর বুক ভেঙে পড়ে।
-আহা বাছা, বুকে এত কান্না চেপে ছিলে? আর কেঁদোনা সব ঠিক হয়ে যাবে।
মঞ্জরী বলে—এর নাম শ্রীমতী। আপনার পছন্দ হয়েছে?
–সে কি! পছন্দ হবে না? তুমি একথা বললে কেন?
–ও আপনার কাছে সব সময় থাকবে। মনে হয় আমি আসব যাব।
-ও।
তিনি শ্রীমতীর মুখখানা তুলে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। এত রূপ। ছেলেটা একে রাখবে কোথায়? কি খেতে দেবে?
মঞ্জরীকে নিজের মেয়ে ভেবে তিনি বলেন—পূজারী বিবেচনা করে এ কাজ করেছেন তো?
—কোনো ভুল করেননি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
—আমার মনে হচ্ছে এ অতীশের ঘরে গেলে খুবই সুখে থাকত।
এতক্ষণে শ্রীমতী বলে—না মা, আমি আপনার কাছে থাকতে এসেছি। মঞ্জরী খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাই দেখে মায়ের মুখে হাসি ফোটে। বলেন—তুই গত জন্মে আমার মেয়ে ছিলি। আমার কোলে বস।
–না মা, কোলে বসলে ব্যথা পাবেন। বরং আপনার বুকে মাথা রাখি। মা, আপনার পুত্রবধূটি অত্যন্ত জ্ঞানবতী। ওর জ্ঞান, ওর বিদ্যাবুদ্ধি, ওর রূপকে ছাড়িয়ে যায়। আমরা দুজনা একসঙ্গেই থাকতাম। তবু আমি ওকে মনে মনে ভয় পাই। অথচ ও আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটই হবে।
মা বলেন—এইটুকু মেয়ের আর কত বুদ্ধি হবে। আমাকে ওসব বুদ্ধিটুদ্ধির কথা বলিস না। একজনের বুদ্ধি দেখে দেখে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। আর একটা বুদ্ধি এলে আমি ঘর ছেড়ে পালাব।
এতক্ষণে শ্রীমতীও হেসে ফেলে। তার হাসির আওয়াজ মায়ের মনে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। এত মিষ্টি কণ্ঠস্বর? এই দেবকন্যাকে কি ভাবে পেল ছেলেটা? ক্রিয়াশক্তির আশীর্বাদ নিশ্চয়। তিনি তো সন্ন্যাসী। তিনি সিদ্ধাপুরুষ।
বাইরে একাধিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মা ভাবেন এত লোক কেন? তিনি জানলা দিয়ে দেখেন চার পাঁচটি অশ্ব। সবজী আনাজ নামানো হচ্ছে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে।
অতীশ এসে বলে—দুই চারদিনের ব্যবস্থা করলাম। এখন অমরু একটু সামলে নেওয়ার অবকাশ পাবে।
মায়ের মুখ একটু গম্ভীর। অমরু বলে—কিছুতেই শুনল না। তবে কথা দিয়েছে আর এসবে যাবে না।
অতীশ বলে—কাল সকালে আমাদের যাওয়ার পর্ব রয়েছে। ওর সময় কোথায়? আমরা চলে যাওয়ার পরে ওরা দুজনে সব গুছিয়ে নেবে। এখন রাতে শোয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
মা বলেন—আমি আমার দুই মেয়েকে দুই পাশে নিয়ে শোব। তোমরা তোমাদের ব্যবস্থা করে নাও।
—দুপাশে নিয়ে শোবার মতো জায়গা কোথায়?
—মেঝেতে। আমি জানি আমার এক কন্যা এরপর থেকে সোনার পালঙ্কে শোবে। এক রাতের জন্য কোনো অসুবিধা হবে না। পাশে মা থাকলে যে কোনো শয্যা সোনার পালঙ্কের চেয়েও ভালো।
অতীশ বলে—সোনার পালঙ্ক হলেই যদি সুখের হত অমরু আমার চেয়ে সহস্রগুণ শান্তিতে থাকে কি করে? আমার মা ছাড়া যতটুকু শাস্তি আমি পাই অমরু আর আপনার কাছে এসে। আমরা রাজসভার সম্মানীয় সদস্য। আমি বলতে গেলে রাজার ভৃত্য।
অমরু বলে—খুব হয়েছে। এবারে ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করলে হয় না?
.
পরদিন ভোর বেলায় অমরুর প্রতিবেশীদের নিদ্রা ভাঙল, লোকজনের কথাবার্তা, আর অশ্বখুরের আওয়াজে। তারা দেখে কবি অমরুর বাড়ির সামনে কারা এসে উপস্থিত হয়েছে। আটজন সশস্ত্র অশ্বারোহী সুসজ্জিত অশ্বে উপবিষ্ট। দুইটি জমকালো পোশাকে আবৃত হস্তী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের স্তম্ভ আন্দোলিত করছে। তাদের পিঠে হাওদা।
মঞ্জরী বাইরে এসে এসব দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। সে কাঁপা হাতে শ্রীমতীকে চেপে ধরে।
শ্রীমতী হেসে বলে—খুব আনন্দ হচ্ছে দেখে। তোমার মুখ বরাবরই দেখতে কচি কচি। খুব ভালো হয়েছে।
অমরুর মা মঞ্জরীর হাত ধরে এগিয়ে আসেন। অতীশের নির্দেশে একটি হাতিকে মাহুত বসতে বলে। অতীশ নববধূসহ তাঁকে প্রণাম করে। অমরুর সঙ্গে আলিঙ্গাবদ্ধ হয়। মঞ্জরী অমরুর মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। যেন পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুরালয়ে যাচ্ছে। তার অশ্রু দেখে বাকি দুইজনের আঁখিও অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
অতীশের অশ্বারোহীরা সামনে চলে তারপর দুই হাতি। একটির হাওদা শূন্য। সবার শেষে সৈন্যদল। ধীরে ধীরে তারা পথের আড়ালে অদৃশ্য হয়। শ্রীমতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবারে শুধু স্বামী আর তার মা। সে এই পরিবারের বধূ। স্বামীকে সে প্রথম দিন দেখেই তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। মনে হয়েছিল কী যেন রয়েছে এর মধ্যে। সবার মতো ঠিক নয়। যখন তার পরিচয় পেল, তখন দেবদাসী হয়েও নিজের মন নিবেদন করে ফেলেছিল। কোনো ঘরের গৃহবধূ হয়ে যাওয়ার কল্পনা সে কখনো করেনি। কারণ সেটা ছিল অবাস্তব কল্পনা। আজ এই মুহূর্তে নিজের গর্বধারিণীর কথা বারবার মনে পড়ছে। সেই করাল দুর্ভিক্ষের গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া তার পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি। তিনি কন্যার রূপ সম্বন্ধে বরাবর সচেতন ছিলেন। কিন্তু সে যে রূপসী সেই সম্বন্ধে তাকে সচেতন হয়ে উঠতে দেননি। তবে সে কি করে যেন বুঝতে পারত।
যে কোনো বয়সের পুরুষ তর দিকে চাইলে তাদের দৃষ্টি কেমন কোমল হয়ে যেত। এমনকি মেয়েরাও তাকে বারবার দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত। এখন বুঝতে পারে কয়েক জনের চোখেমুখে ঈর্ষা ফুটে উঠত তাদের মধ্যে বাসন্তীর কথা মনে পড়ে। মা চেয়েছিলেন তার একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। নিজের বুদ্ধি এবং সাধ্যমতো তিনি যা পেরেছেন তাই করেছেন। এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে তিনি যা করেছেন তার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারত না। তাঁর প্রচেষ্টায় পশুপতির আশীর্বাদ ছিল। একবার গ্রামে যাওয়া যায় না? একবার অন্তত গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসত? ঋষ্যকূট পর্বতের পেছনে সেই দিগন্তবিস্তৃত চাষের জমির পাশে নিরিবিলি ছায়াচ্ছন্ন ছোট্ট গ্রামটি—নুটি। এত ছোট নাম কেউ বোধহয় শোনেনি। মঞ্জরী নামটা শুনে হেসে ফেলেছিল। তার নিজের হাসি পায়নি কখনো। জন্ম থেকে এই নাম শুনেছে বলে এর চেয়ে স্বাভাবিক কোনো নাম সে কল্পনা করতে পারে না।
সেই রাতে স্বামীর সঙ্গে তার রাত্রিবাসের কথা। দিন যত গড়িয়ে চলে ততই তার মধ্যে কেমন একটা ভাব। এ কি আনন্দ, না ভয়? স্বামী কি তাকে পছন্দ করেছেন? তিনি তো শুধু রূপ দেখবেন না। শাশুড়ি মা বলেছেন—ওর জন্য কোনো চিন্তা নেই। সময়মতো ওকে খেতে দিও। যত্ন করে দিলে মনে মনে ওর খুব আনন্দ হয়। আমি অনেক কিছু ভুলে যাই আজকাল।
সে উত্তরে বলেছিল—আপনি কিছু ভাববেন না মা। আপনি নিশ্চিন্ত হোন। শেষে একসময় খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। মা শুতে যান। শ্রীমতী নিজের ঘরে এসে দেখে প্রদীপের নীচে অমরু কি যেন পড়ছে। তার পায়ের শব্দে মুখ ফেরায়। শ্রীমতী আরও কাছে গেলে অমরু তার হাত ধরে পাশে বসায়। শ্রীমতীর মনে হল জীবনে এই প্রথম এক অনাস্বাদিত কিছুর স্বাদ পেল।
-তোমার নামটি খুব সুন্দর।
শ্রীমতী কি বলবে ভেবে পায় না।
অমরু তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে—তোমাকে এই মুহূর্তে প্রথম ভালোভাবে দেখছি। তুমি এত সুন্দর আমি কল্পনাই করিনি।
শ্রীমতীর সব ভয় মুহূর্তে মিলিয়ে যায়।
সে বলে—না হলে কি হত?
—কি আবার হত?
—আমাকে অপছন্দ হত।
—তাই হয় নাকি? শুনেছি তুমি এত বুদ্ধিমতী এটুকু জানো না!
-না।
—জান, তোমার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। –যাঃ, সেই ইচ্ছে করতে হয় নাকি?
–কেন, ক্ষতি কি?
–তোমার আসল কাজ কে করবে, যে কাজে তোমার খ্যাতি।
–ও, অবশ্যই সেই কাজ করে যাব। নাহলে আমার জীবনই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
–তোমার এই কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। একটা কথা বলব?
–বলবে না কেন শ্রীমতী, সব কথাই বলবে।
স্বামীর মুখে শ্রীমতী নামটি উচ্চারিত হতে তার হৃদয়ে দোলা লাগে। এত মিষ্টি করে কেউ ডাকতে পারে?
-না থাক।
—থাকবে কেন? বল। এখন থেকে থাকতে শুরু করলে জীবনে অনেক কিছু থেকে যাবে।
–আমি ভাবতাম কবিরা শুধু লেখনী হাতে নেয় বলে তাদের হাত নরম হয় ৷ কিন্তু তোমার হাত এত শক্ত, তুমিও বলিষ্ঠ।
—মন খারাপ হয়ে গেল?
–না, খুব আনন্দ হয়েছে বলেই তো বলছি।
—আমার বাবার কঠোর নির্দেশ ছিল শরীর চর্চা আর স্বাস্থ্যবান হওয়া জীবনে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাঁর ধারণা কালিদাস অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। নইলে এত সুন্দর কাব্য লিখতে পারতেন না। তাই—
—আর বলতে হবে না। বাবা ঠিক বলেছেন তোমাকে।
—কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।
–কি কথা।
—তুমি এত রূপবতী আমার এই গরিব সংসারে-
শ্রীমতী হাত দিয়ে স্বামীর মুখ চেপে ধরে বলে ওঠে—তোমার এই কথায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বোঝোনা কেন, ঈশ্বর আমাকে তোমার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আমার চেয়ে ভাগ্যবতী কে?
এবারে অমরু স্ত্রীকে নির্দ্বিধায় কাছে টেনে নেয়।
.
পরদিন সূর্যোদয় উভয়ের জীবনে নিয়ে এল এক নতুন প্রভাত। সেই সঙ্গে প্রাসাদ থেকে লোক এসে জানিয়ে গেল, কবিকে রাজা স্মরণ করেছেন।
একদিনের মধ্যে সমগ্র বিজয়নগরে রটে গিয়েছে যে কবি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু সামন্তরাজ অতীশ বিবাহ করেছেন। তাঁরা বিবাহ করেছেন পশুপতি মন্দিরের দুই দেবদাসীকে। অনেকের ভ্রূকুঞ্চিত হল। তবে সবাই দুই কন্যার রূপ লাবণ্যের কথাও শুনল। সব চেয়ে বিস্মিত হল এই সবের মূল উদ্যোগীর পরিচয় জেনে। মন্দিরের মুখ্য পুরোহিত এবং স্বয়ং রাজার গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি স্বহস্তে বিগ্রহকে সাক্ষী রেখে এদের বিবাহ দিয়েছেন। রাজার কানেও সংবাদ পৌঁছেছে। পাত্রীদের বিজয়নগরের কেউ চাক্ষুস দেখেনি। তবে কবি অমরুর প্রতিবেশীরা অবগুণ্ঠিতা অবস্থাতেই যতটুকু দেখেছে,তাতেই মোহিত হয়েছে। তাদের মুগ্ধতার কথাও দশগুণ বাড়িয়ে রাজার কাছে নিবদেন করা হয়েছে। সামন্তরাজের কথা ভিন্ন, কিন্তু যৌবন দেখা দিতে না দিতে অপরিপক্ক মস্তিষ্কে এক কাব্য লিখে অমরু এমন কি যোগ্যতা অর্জন করলেন যে এক রূপবতীকে তার বধূ করা হল? সন্ন্যাসীরা সংসারের কতটুকু বোঝেন? ওই রূপতো অনাহারে দুদিনেই শুকিয়ে যাবে।
রাজসভায় রওনা হওয়ার আগে এতদিন মাকে প্রণাম করে যেত অমরু। আজ
যাওয়ার সময় সামনে মাকে না দেখে ডাকে সে।
মা বলেন—আজ থেকে আমি দাঁড়াব না। প্রণাম করতে হলে ভেতরে আয়। না করলেও চলে, শ্রীমতী রয়েছে।
অমরু মাকে প্রণাম করে। বিদায়ের সময় শ্রীমতী তাকে দাঁড় করিয়ে প্রণাম করে।
–এ আবার কি?
—এটাই প্রথা। আমি আমার মাকে দেখেছি।
—আমি কি করব?
শ্রীমতী লজ্জায় হেসে ফেলে বলে—আমি কি জানি?
—বুঝেছি। ফিরে এসে।
এত পুলকিত অন্তরে বহুদিন অমরু বাড়ির বাইরে পা রাখেনি
রাজসভায় প্রবেশ করলে একজন পরিচিত কর্মচারি তাকে এসে বলে—রাজা বিশ্রামালয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
কবি অমরু একটু বিস্মিত হয়। এমন সাধারণত হয় না। তবু সে সভাসংলগ্ন বিশ্রামকক্ষে গিয়ে দেখে স্বয়ং রাজার পাশে গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিও উপস্থিত। কেন যেন সামান্য একটু আশঙ্কার ছায়াপাত ঘটল তার মনে।
রাজা হেসে বলেন—আসুন কবি।
বয়সে অনেক ছোট হলেও রাজা এইভাবে তাকে বরাবর সম্বোধন করে থাকেন। সম্মানও দেন যথারীতি। তিনি যেকোনো গুণের সমাদর করে থাকেন। কারণ তিনিও বহু গুণের অধিকারী। হস্তীর দক্ষ মাহুত তিনি। বন্য হস্তীকে কিভাবে বশ করতে হয়, তিনি জানেন। বিদেশিদের কাছে বেয়াদপ নতুন অশ্বকে শান্ত করার কৌশল শিখেছেন। প্রতিদিন তিনি শ্রেষ্ঠ কুস্তীগিরের সঙ্গে কুস্তী লড়েন। দক্ষ তীরন্দাজ তিনি। কিছু মুরকে রাজ্যে রেখে দক্ষ বন্দুকধারী ও গোলন্দাজ হয়ে উঠেছেন। তেমনি তিনি সঙ্গীতপ্রিয় এবং সর্বোপরি সাহিত্যরসিক।
—বসুন।
গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে প্রণাম করে রাজাকে নমস্কার করে সে আসন গ্রহণ করে।
রাজা বলেন—শুনুন কবি, গতকাল আমি যখন শুনলাম, গুরুদেব এক অসামান্য সুন্দরী দেবদাসীর সঙ্গে আপনার বিবাহ দিয়েছেন এবং দিয়েছেন আমার অজ্ঞাতে তখন আমি প্রায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম। তারপর ভাবলাম, আপনারা উভয়ে যখন এতে জড়িত তখন গুরুদেবের কাছে ভালোভাবে শুনে নেব। কারণ একটা অলিখিত নিয়ম রয়েছে দেবদাসী হলে তো কথাই নেই, এমনকি সাম্রাজ্যের কোথাও কোনো রূপবতী কন্যার সন্ধান পেলে তার স্থান আমার অন্তঃপুরে।
রাজা একটু থেমে তার দিকে দৃষ্টি ফেলেন। গুরুদেব নির্বাক। অমরুর বুক যেন কেঁপে ওঠে। তেমন কিছু ঘটার আগে সে শ্রীমতীকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেবে।
রাজা বলেন—তারপর গুরুদেব বোঝালেন আপনার স্ত্রী হয়তো সুন্দরী কিন্তু তিনি আমারই এক সম্মানীয় প্রজার স্ত্রী। সম্মানীয় ব্যক্তিরা যদি নির্ভয়ে বসবাস করতে না পারেন, তাহলে এদেশ থেকে সব গুণী ব্যক্তিরা চলে যাবেন। তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব তো আমারই। সুতরাং কারও সঙ্গে কারও সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর আমার আর কোনো অধিকার থাকে না। তিনিও আমার শ্রদ্ধার পাত্রী। ঠিক কিনা?
—মহারাজ, এতদিন আমি আপনার গুণমুগ্ধ ছিলাম, কিন্তু আজ থেকে আপনার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জন্মালো।
–এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।
এতক্ষণ ক্রিয়াশক্তির মুখে বিন্দুমাত্র হাসি ছিল না। এখন হাসি ফুটল। বললেন—সব ঈশ্বরের কৃপা। অতীশকে ডেকে পাঠাও রাজা।
-হ্যাঁ, লোক পাঠাচ্ছি। তার আগে একটা কথা বলতে চাই।
-বল।
-কবিকে আসতে দেখি, যেতে দেখি। পোশাক পরিচ্ছদ অনেক সময় মলিনও দেখি। এখন আবার বিবাহ করলেন। চলবে কি করে?
ক্রিয়াশক্তি বলেন—সেকথা তো ভাবিনি।
–কবি, আপনার কিভাবে চলে?
অমরু আমতা আমতো করে নীরব হয়ে যায়।
—বুঝেছি। চলুন সভায় গিয়ে বসি।
তাঁরা সভায় গেলে রাজা স্বর্ণসিংহাসনে বসে সভাসদদের দিকে তাকিয়ে বলেন—আপনারা জানেন কি যে আমাদের কবি বিবাহ করেছেন?
অনেকে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—মহারাজা, রাজধানীর কারও জানতে বাকি নেই। আমরা ভাবছিলাম এত বড় মহানগরীর কাক চিল পর্যন্ত কি করে জেনে ফেলেছে।
মহারাজা হেসে বলেন—তারাই তো আগে জানে। আর তার উত্তর তো খুব সোজা। উনি অমরুশতকের কবি।
একজন বলে—শুনলাম যোগ্য স্ত্রী পেয়েছেন কবি।
রাজা হেসে বলেন—সোজা কথা সোজা ভাষায় বলুন। কবির স্ত্রী অত্যন্ত রূপবতী। সেটা তো আরও আনন্দের। আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে কবি এই রাজ্যের সভাকবি। তিনি নিয়মিতোভাবে যথাযোগ্য সম্মান-ভাতা পাবেন। এতে উনি নিশ্চিন্তে কাব্যচর্চা করতে পারবেন। কবির আর্থিক বিষয়টা এতদিন আমার মাথায় আসেনি, এতেই আমার অযোগ্যতার প্রমাণ মেলে।
ক্রিয়াশক্তি বলেন—সেকথা ঠিক নয়। আসলে এতদিন একথা চিন্তা করার প্রশ্ন ওঠেনি। ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তুমি ব্যবস্থা নিলে, এতেই তোমার যোগ্যতা দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হল।
অমরু যেন স্বপ্ন দেখছে। ভাবে, কখন বাড়ি গিয়ে শ্রীমতী আর মাকে একথা বলবে। মা নিশ্চয়ই বাবার কথা ভেবে গোপনে অশ্রুমোচন করবেন। আর শ্রীমতী? তার নিশ্চয়ই খুবই আনন্দ হবে।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলোচনার পরে সভার কাজ সেদিনের সভাকবির সম্মানের জন্য শেষ হয়।
অমরু বাড়ি ফিরে মা এবং স্ত্রীকে কিছু বলার আগেই একজন এসে বলে—মহারাজের আদেশে আমি আপনার বাড়িতে রোজ আসব। কোনো কিছু করার থাকলে করে দিয়ে যাব।
অমরুর মনে পড়ল যে এমন একটা কথা হয়েছিল বটে। কিন্তু তার অর্থ তখন বোঝেনি। এখন বুঝতে পেরে সংকুচিত হল। বলল- না না। কি এমন কাজ।
-দোকান থেকে কিছু এনে দিতে হবে? আনাজপত্র যদি দরকার হয়।
—না না, কিছুর দরকার নেই।
—আমি কাল সকালে আবার আসব।
—ঠিক আছে।
সে চলে যায় ৷
মা জিজ্ঞাসা করেন—এসব কি অমরু?
—বুঝেছি। আমাকে যাতে সংসারের কোনো কাজ করতে না হয় তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন রাজা।
– হঠাৎ !
অমরু হেসে বলেন—মা তোমার ছেলে আজ থেকে যে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সভাকবি।
শ্রীমতীর বুক গর্বে ভরে ওঠে। আর আশ্চর্য, মা পুত্রকে কাছে না টেনে, পুত্রবধূকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন—আমার ঘরের লক্ষ্মী আসতেই উন্নতি শুরু হল। এবারে নিশ্চিন্তে মরতে পারব।
—আজকের দিনে একি কথা বলছ মা?
—ঠিক বলেছি। আজ যে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। গৃহে লক্ষ্মী এল, তোর দুর্ভাবনা গেল। এর চেয়ে মৃত্যুর আর সুসময় কি হতে পারে?
শ্রীমতী মুখ ভার করে বলে—মা, গুরুদেব বোধহয় ভুল করেছেন। তিনি মাতা-পুত্রের মধ্যে বিচ্ছেদ এনে দিচ্ছেন।
মা শ্রীমতীর মুখ চুম্বন করে বলেন—বিচ্ছেদ নয় মা। এটাই সংসারের পরিপূর্ণতা, এটাই সৃষ্টির প্রবাহমানতা।
.
একবার রাজার নিকটতম কোনো এক আত্মীয় দ্বারা তাঁকে হত্যার মরিয়া চেষ্টা করা হয়। আবদার রজ্জাক বলেন আত্মীয়টি ছিল তাঁর এক ভ্রাতা। নুনিজ বলেন ভ্রাতুষ্পুত্র। আবদার রজ্জাকের কাহিনী নিঃসন্দেহে অধিকতর নির্ভরযোগ্য। কারণ তিনি ছিলেন সমসাময়িক সাক্ষী। নিজের বর্ণিত কাহিনী তাঁর লিখিত ঘটনাপঞ্জীর একেবারে শেষ খণ্ডে স্থান পেয়েছে। আবদার রজ্জাক ছিলেন কালিকট ও বিজয় নগরের জন্য পারস্যদেশ থেকে প্রেরিত রাষ্ট্রদূত। তাঁর বর্ণনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে নির্দিষ্টভাবে তারিখ দেওয়া রয়েছে।
“সেই সময়ে কাহিনীর বর্ণনাকার সাময়িকভাবে তখনো কালিকটে অবস্থান করছিলেন, যখন বিজয়নগর মহানগরীতে এক অভূতপূর্ব এবং অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল—
“মহারাজার ভ্রাতা তাঁর নিজের বসবাসের জন্য এক নতুন অট্টালিকা নিৰ্মাণ করে সেখানে রাজা এবং সাম্রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিবর্গদের আমন্ত্রণ জানালেন। কাফেরদের মধ্যে একটা প্রচলিত রীতি রয়েছে যে একে অপরের সম্মুখে ভোজন করে না। অতিথি বর্গ যারা এসেছিল তারা একটি কক্ষে সমবেত হয়। কিছুক্ষণ পর পর রাজভ্রাতা কিংবা তার প্রেরিত অন্য কেউ গণ্যমান্যদের এক এক করে ডেকে নিয়ে গেল। নগরে যত ভেরী দামামা, ঢাক, শিঙা ইত্যাদি ছিল সব আনা হয়েছিল ওই নতুন অট্টালিকায়। সেগুলি একযোগে প্রচণ্ডভাবে বাজতে শুরু করল। আপ্যায়িতেরা যখন একে একে ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তখন একটি গুপ্তস্থান থেকে ঘাতক প্রত্যেকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে বিদ্ধ করে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে লাগল। তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ অপসারিত করে তারা পরের অতিথিকে ডাকতে পাঠায়। এইভাবে সাম্রাজ্যের অনেক উচ্চশ্রেণীর এবং রাজার অতিবিশ্বস্ত ব্যক্তিগণ একে একে অদৃশ্য হলেন। এই সব রণভেরী, দামামা শিঙা ইত্যাদির কর্ণভেদী শব্দে কি ঘটছে কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। রাজভ্রাতা তখন তার রক্তাপ্লুত বাসভবন থেকে রাজপ্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে প্রহরীদের সে মিষ্ট ও মন গলানো কথায় তার ভবনে ভোজনের আমন্ত্রণ জানায়। তারাও রাজভ্রাতার আমন্ত্রণে বিমোহিত হয়ে সেখানে গেলে তাদেরও একই পরিণতি হল। এইভাবে প্রতিরোধ এবং প্রহরার কিছুই অবশিষ্ট রইল না। দুরাত্মা তখন তীক্ষ্ণ অস্ত্র সুপারীপূর্ণ একটি থালায় রেখে মহারাজের সামনে এসে সবিনয়ে বলে যে সবাই প্রস্তুত হয়ে রাজকীয় উপস্থিতির জন্য প্রতীক্ষা করছে।
.
“কথায় বলে বিখ্যাত ব্যক্তিগণ স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকেন। রাজার কথায় তার প্রতিফলন ঘটল। তিনি বললেন, আজ আমার শরীর ভালো নেই।”
.
“রাজাকে এই অপ্রকৃতিস্থ ভ্রাতা প্রলুব্ধ করতে অপারগ হয়ে তার তীক্ষ্ণ অস্ত্রটি টেনে নিয়ে রাজার দেহের দুই এক স্থানে প্রচণ্ড আঘাত করায় তিনি সিংহাসনের পেছনে পড়ে যান। এই বিশ্বাসঘাতক রাজাকে মৃত ভেবে তার একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে রাজার শিরশ্ছেদ করতে বলে সেখানে রেখে গেল। কক্ষ থেকে বাইরে এসে সবাইকে ডেকে বলল—আমি রাজাকে হত্যা করেছি, হত্যা করেছি ব্রাহ্মণদের। মন্ত্রী আর অমাত্যরাও নিহত হয়েছে। এখন আমিই হলাম রাজা।”
ইতিমধ্যে তার অনুচর রাজার মুণ্ড কাটার উদ্দেশ্যে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু রাজা যে সিংহাসনের পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন সেই অসনটিকে চেপে ধরে অনুচরটির বুকে এত জোরে আঘাত করলেন যে সে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। রাজার দেহরক্ষীদের একজন এতক্ষণ সব কাণ্ডকারখানা দেখে এককোণে লুকিয়ে ছিল। রাজা তার সাহায্যে ঘাতককে হত্যা করে অন্তঃপুরে পথ ধরে প্রাসাদের বাইরে চলে গেলেন।
তাঁর ভ্রাতা তখনও সভাকক্ষের সোপান শ্রেণীর উপর দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার কাছে তাকে রাজা বলে স্বীকৃতি দিতে আবেদন জানাচ্ছিল। সেই সময় রাজা চিৎকার করে উঠলেন—আমি জীবিত। আমি সুস্থ আর নিরাপদ। ওই দুরাত্মাকে তোমরা ধর।
সমস্ত জনতা একসঙ্গে রাজার অপরাধী ভায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করল।
“মন্ত্রীদের মধ্যে শুধু একজন রক্ষা পেয়েছিল, সে হল মন্ত্রী দানায়িক। সে এইসব দুঃখজনক ঘটনার আগেই সিংহল সীমান্তে ভ্রমণে গিয়েছিল। রাজা তাকে এখানকার সদ্য সমাপ্ত ঘটনার কথা সবিস্তারে জানিয়ে দ্রুত দেশে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একজন দূত পাঠালেন। এই চক্রান্তে যারা কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হল, চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হল, জীবন্ত দগ্ধ করা হল, এমনকি তাদের পরিবারবর্গকেও নির্বংশ করা হল। যে লোকটি নিমন্ত্রণপত্রগুলি এনেছিল, তাকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হল।….”
রাজধানী স্তব্ধ। রাজপথ ফাঁকা ফাঁকা। অমরু রাজপ্রাসাদে গিয়ে পরিচিত কোনো মুখ না দেখতে পেয়ে একটি আসনে বসে পড়ে মাথাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে রইল। একজন প্রহরী ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার পাশে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল।
সে হঠাৎ বলে উঠল-আমরা মূর্খ, আমরা ভীরু।
—একথা বলছ কেন?
—ওই দুরাত্মা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে আমাদের ছয় জনকে মেরে ফেলেছে। আমরা যেতে চাইনি। আচমকা ওদের তরবারি ঘুরিয়ে ঢুকতে দেখে এক কোণে লুকিয়ে ছিলাম। রাজার ভাইকে দেখে বুঝে উঠতে পারিনি, ঠিক কি ঘটতে চলেছে। সর্বনাশ হয়ে যেত।
–তোমরা নিজেদের কাজ করনি। আমার ধারণা এই অনুশোচনা তোমাদের জীবনেও যাবে না।
—আমরা মহারাজাকে বলেছিলাম, আমাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে। উনি দিলেন না। বললেন, আমরা মূর্খ হলেও বিশ্বাসঘাতক নই।
—উনি কোথায়?
—নিজের কক্ষে শয্যাশায়ী।
—দেখতে যেতে পারি?
–আপনি বসুন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখি।
একটু পরে তার সঙ্গে একজন নারী প্রহরী এল। অমরু দেখে প্রাসাদের চতুর্দিকে বহু প্রহরীকে নিযুক্ত করা হয়েছে।
একজন নারী প্রহরী এসে তাকে রাজার কক্ষে নিয়ে গেল। সে রাজাকে দেখল। তাঁর মুখমণ্ডল যন্ত্রণাকাতর। তিনি তাকে শয্যার পাশে যেতে বললেন।
অমরু তাঁর কাছে যেতেই তিনি বলেন—আমার কেউ নেই কবি। সবাই চলে গিয়েছে। আমি একা।
অমরু প্রথমেই বলে ফেলে—অতীশ? সেও নেই।
—সে আছে। আর রয়েছে দানায়িক। দুজনকেই খবর পাঠিয়েছি। দানায়িক অভিজ্ঞ, কিন্তু আসতে দেরি হবে। অতীশ তো তরুণ, এসব তার জানা নেই। তবে বুদ্ধিমান আর কর্মঠ।
—মহারাজা, আপনাকে আর কি বলব। ধীরে ধীরে আবার গড়ে উঠবে সব। তবে যাঁরা গেলেন, তাঁরা আর কোনোদিন ফিরবেন না। সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করতেন আমাকে স্নেহ করতেন। এই ক্ষত নিয়ে দেশকে চলতে হবে। ক্ষত নিশ্চয় শুকিয়ে যাবে একদিন। সবাই যায়, কিন্তু একসঙ্গে এভাবে—ভাবতে পারছি না।
—কিন্তু, আমাকে ওই পশুটা বিশ্রীভাবে আঘাত করেছে। যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছি। আমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। আমার দুইজন চিকিৎসক আয়ুর্বেদজ্ঞ বলেছে, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের হাবভাব দেখলে যেন ভরসা হয় না।
আরও কিছুক্ষণ রাজার পাশে বসে যতটা পারে তাঁকে উৎসাহিত করে কবি। কারণ সে বুঝলো রাজার বহু রানীর মধ্যে প্রধানা মাল্লা দেবীও তাঁর মনে উৎসাহের সঞ্চার করতে পারল না। তাকেও এখানে দেখা যাচ্ছে না। শুধু একজন সেবাদাসী কক্ষের এক কোণে উপস্থিত রয়েছে।
—মহারাজা আপনাকে শুশ্রূষা করার জন্য কেউ নেই?
–একজন আছে না?
—একজনকে দেখছি। সে কি পারবে?
–জানি না। ওসব নিয়ে ভাববেন না কবি। আমি শুধু সুস্থ হয়ে উঠতে চাই। আমার অনেক কাজ।
–আমি অতীশকে আসতে বলব?
—খবর গিয়েছে।
–আমি তবে একটু ঘুরে আসি?
–আপনি আবার আসবেন কেন? গৃহে যান।
-অতীশ না আসা অবধি আমি এই প্রাসাদেই থাকব। আপনি বাধা দেবেন না মহারাজ।
—আপনার কথা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে। আচ্ছা, নগরের মানুষেরা কি বলছে?
—নগর জনশূন্য বলতে গেলে। তারা শোকে মুহ্যমান।
—আমাকে তারা তবে একটু ভালোবাসে। শুনে কত ভালো লাগছে।
–আপনি তাদের প্রাণ। আমি আসি মহারাজ।
রাজা অনুমতি দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
.