বিজয়নগর – ৬

ঘরে ফিরে অমরু মা আর স্ত্রীকে রাজার অবস্থার কথা বলে। বলে, তাঁর অসীম সহ্যশক্তির কথা আমরা বলাবলি করি, আজ স্বচক্ষে দেখলাম। অতখানি আঘাত নিয়ে সাধারণ মানুষ সচেতন থাকতে পারে না। রাজা নিশ্চয় নিজেকে স্বহস্তে যন্ত্রণা দিয়ে এই ক্ষমতা অর্জন করেছেন।

কিন্তু আজ কবির মনে হয়েছে যন্ত্রণা অবশ্যই রয়েছে, তবে যন্ত্রণার চেয়েও তাঁকে অস্থির করেছে রাজ্যের পরিস্থিতির কথা ভেবে। তিনি নিশ্চয় বিজয়পুরের সুলতানের কথা ভাবছেন। এই টালমাটাল অবস্থায় তিনি বিজয়নগর আক্রমণ করতে পারেন। তাহলে সামলানো যাবে না। যে উদ্দেশ্যে দেড় দুই শতাব্দী পূর্বে বিজয়নগরের সৃষ্টি হয়েছিল, তাই বিফলে যাবে।

মা শুনে কেঁদে ফেলেন। অমরু বলে—আমি আবার প্রাসাদে যাব। অতীশকে আসতে বলা হয়েছে।

নিজের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী আসে। তাকে হাওয়া করতে থাকে। অমরু হাত থেকে পাখা কেড়ে নিয়ে তাকে পাশে বসায়।

—অমন করতে নেই। তুমি একটু বিশ্রাম করে খেয়ে নাও।

–তার জন্যে হাওয়া করতে হবে না। তুমি কাছে থাকলেই যথেষ্ট।

–তা নয়। তুমি সুস্থ থাকলে, তুমি কাছে থাকলে আমার আর কিছু চাই না।

—ঠিক আছে, দুজনের কথাই ঠিক।

এবারে শ্রীমতী অমরুর কোল ঘেঁষে বসে। অমরু একটু অবাক হয়।

—একটা কথা বলব?

–সহস্র কথা বল, আমি শুনব। আমার তো তাই আকাঙ্খা। তোমার কণ্ঠস্বর কত মিষ্টি তুমি জানই না।

–শোন আমি অন্য একটা কথা বলতে চাই।

-বল।

–তুমি তো জান আমি একটু চিকিৎসা করতে জানি।

—জান মানে? গুরুদেব তো তোমার খুব প্রশংসা করেছেন। তোমার মধ্যে নাকি আলাদা একটা কিছু রয়েছে—

-যাক ওটা গুরুদেবের স্নেহপ্রসূত। আমি মহারাজাকে একটু দেখতে চাই।

—তুমি!

–কেন, অন্যায় হবে?

অমরু একটু ভেবে নিয়ে বলে—অন্যায় কি করে বলি? স্বচক্ষে তাঁকে দেখে এলাম। আমার কষ্ট হচ্ছিল।

-তাহলে মায়ের অনুমতি চেয়ে নাও। দাঁড়াও তুমি আগে খেয়ে নাও।

খেয়ে নিয়ে অমরু বলে, তুমি খেয়েছ তো?

শ্রীমতী হেসে ফেলে।

—ও বুঝেছি। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, তুমি খেয়ে নাও। মা খেয়েছেন তো।

—হ্যাঁ, তাঁকে বেলা বেশি না হতেই খাইয়ে দি। তাতে ওঁর বিশ্রাম ভালো হয়।

অমরু ভাবে, শ্রীমতী রূপে গুণে সরস্বতী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সংসারের এত সব জানল কি করে? প্রতিভাময়ী তো অবশ্যই। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি সেই কথা বলেছেন। তিনি নিজেই ওর চিকিৎসা জ্ঞানে বিস্মিত। সবই যেন ওর করাও। সে ভেবে পায় না একে কিভাবে রাখবে। কালিদাস বিরহ কাব্য লিখেছিলেন। সে কি তাহলে মিলনকাব্য লিখবে? সঙ্গে সঙ্গে তার মন থেকে কে যেন বলে ওঠে, বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে চল। স্ত্রীকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভেবে ভালোবাস।

অমরু স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মা একটু হেসে বলেন—কিসের অনুমতির প্রয়োজন?

দু’জনেই হেসে ফেলে। অমরু বলে—মা, শ্রীমতী রাজাকে একটু দেখতে যেতে চায়।

মা চমকে ওঠেন—রাজাকে? কেন?

–ও তো চিকিৎসাবিদ্যা জানে।

—হ্যা। কিন্তু রাজাকে কেন?

—তিনি খুবই আহত। তুমি তো জানই।

—দেবদাসী সরস্বতীর কথা মনে আছে?

এবারে শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ মা, খুব মনে আছে। কিন্তু এই রাজা সেই রাজা নন্। উনি অসুস্থ, যন্ত্রণাকাতর।

—কিন্তু যখন নিরাময় হয়ে যাবেন?

—তখন আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। আমি জানি। মঞ্জরীকে আপনি তো দেখেছেন। তাকে আমি রাজার কক্ষের পাশে দিন রাত থাকার ব্যবস্থা করছি। অমরু একথা শুনে চমকে ওঠে। তার জানা ছিল না শ্রীমতীর এই পরিকল্পনার কথা।

মা একটু চুপ করে থেকে বলেন—আমার মনে হয় আমি আজকাল অনেক কিছু বুঝতে পারি না। বয়সে এমন হয় জানি। তোমরা যা ভালো বুঝবে করবে। রাজার শুভ আমি চাই। তবে অতীশের অনুমতি নিও।

ওরা রাজবাড়িতে যায়। কবি সকালে এসেছিলেন, ওরা দেখেছে। কিন্তু সঙ্গে অবগুণ্ঠিতা একজন নারী।

অমরু বলে—ইনি আমার স্ত্রী। ইনি চিকিৎসকও বটে। রাজাকে দেখতে এসেছেন। প্রহরীরা নির্বাক। অবগুণ্ঠনের মধ্যেও শ্রীমতীর সৌন্দর্য ঢাকা পড়েনি। প্রহরীরা নত হয়ে অভিবাদন জানায়।

অমরু প্রহরীকে প্রশ্ন করে—এখন আপনাদের প্রধান কে?

মহারাজা আপাতত আমাকে নির্বাচন করেছেন, পরে ভেবে দেখবেন।

—অতীশকে আসতে বলা হয়েছে?

—লোক চলে গিয়েছে।

—কিন্তু ওকে আর একটা খবর দেওয়ার ছিল যে।

–বলুন, এখন রাজার পক্ষে বলার যে কেউ নেই। আপনার কথাই মহারাজের আদেশ।

প্রহরীর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

অমরু বলে—তাহলে আর একজন অশ্বারোহীকে পাঠান। সে যেন গিয়ে বলে, তিনি সঙ্গে করে তাঁর স্ত্রীকেও অবশ্যই আনেন এবং তাঁরা যেন এই প্রাসাদে এসে ওঠেন। এখানে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি গিয়ে রাজাকে বলছি। আপনি আয়োজন করুন।

অমরু জানে, মা বলেছেন, রাজার কক্ষে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার আগে অতীশের অনুমতি নিতে। কিন্তু বাধ্য হয়ে মায়ের অবাধ্য হতে হচ্ছে। কারণ চিকিৎসা বিষয়ে স্ত্রীর ওপর তার অগাধ আস্থা। গুরুদেবের আস্থাই তার একমাত্র কারণ। শ্রীমতীকে নিয়ে অমরু মহারাজার কক্ষের দিকে যায়। নারীরক্ষীরা পথ ছেড়ে দাঁড়ায়। এখানে কোনো পুরুষ নেই। শ্রীমতী অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়। রক্ষীরা নারী হয়েও বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে।

শ্রীমতী তাদের একজনকে মৃদুস্বরে বলে—মহারাজের শুশ্রূষাকারিণী কয়জন রয়েছে?

-একজন রয়েছে কক্ষের ভেতরে। বাকি তিনজন বাইরে রয়েছে।

—ঠিক আছে।

রাজার কক্ষে প্রবেশ করতে শুশ্রূষাকারিনী উঠে দাঁড়ায়। সে রূপবতী শ্রীমতীর সঙ্গে কবিকে দেখে তার পরিচয় বুঝতে পারে। কিন্তু অবগুণ্ঠন ছাড়া রাজার দিকে তাকে এগিয়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়। মহারাজের চক্ষুদ্বয় নিমীলিত। মুখমণ্ডল রক্তশূণ্য। তাতে একটা বেদনার আভাষ। যে বস্ত্রদ্বারা বুকের কাছে ক্ষত স্থান বাঁধা রয়েছে, সেখান থেকে রক্ত পড়ছে।

কবি মৃদুস্বরে ডাকে—মহারাজা, আপনি কি জেগে আছেন?

মহারাজা চোখ খুলতে খুলতে দুর্বল কণ্ঠে বলেন—নিদ্রা পেলে স্বস্তি পেতাম। পায় না।

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে শ্রীমতীর দিকে তাঁর দৃষ্টিনিবদ্ধ হয়। তিনি একদৃষ্টে চেয়ে ভাবেন, ইনি কি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন? কিংবা তাঁর মৃত্যু হয়েছে? মৃত্যু হলে তো যন্ত্রণার অবসান হয়। তাঁর যন্ত্রণা যে রয়েছে। ইনি কে তবে? আমার কক্ষে, এমন কি রাজপ্রাসাদের সীমানায় কোনো রূপসী নারী তো আসতে সাহস পায় না। তাকে যে অন্তঃপুরে নিয়ে রাখা হয়।

অমরু বলে—ইনি আমার স্ত্রী। আপনাকে দেখতে এসেছেন।

-আমাকে? আপনার সাহস হল কি করে? অবশ্য আপনি জানতেন, আপনার স্ত্রী সম্পূর্ণ নিরাপদ। ক্রিয়াশক্তিও সেকথা জানতেন। তাই বলে আমার কক্ষে? অমরু বলে—উনি চিকিৎসক রূপে এসেছেন। আমার পত্নীরূপে নয়।

—উনি চিকিৎসক?

এবারে শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ, মহারাজ।

সে ঝুঁকে পড়ে মহারাজের ললাট স্পর্শ করে। তারপর তাঁর শয্যাপার্শ্বে দ্বিধাহীনভাবে বসে ডান হাত তুলে নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করে।

মহারাজা শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকেন, ভাবেন কবির স্ত্রী সাক্ষাৎ দেবী। কবি ভাগ্যবান। মনের মধ্যে তিনি এক অনাস্বাদিত পুলক অনুভব করেন। আহা, একেই বলে বোধহয় নারীর রূপ, এই রূপ এতদিন চোখে পড়েনি।

হাত ছেড়ে দিয়ে শ্রীমতী বলে—মহারাজ, বুকের ডানদিকে বড়ই যন্ত্রণা আপনার।

—হ্যাঁ, ঠিক তাই। এদের সেকথা বললেও বোঝে না, বলে—ওদিকে তেমন আঘাত নেই।

—বাইরে দেখলে তাই মনে হয়। কিন্তু ওখানে আসল আঘাত। আপনি একটুও ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনাকে যে ভালো হতেই হবে, নইলে সাম্রাজ্য চলবে কি করে? নতুনভাবে সব গড়ে তুলতে হবে।

অমরু ভাবে এসব কি বলছে শ্রীমতী? এটা কি ধরনের চিকিৎসা। মহারাজা বলে ওঠেন—তবে? আমার শুয়ে থাকলে চলবে?

তিনি উঠে বসতে চান। শ্রীমতী তাড়াতাড়ি তাঁকে চেপে ধরে বলে—কয়েকদিন সময় লাগবে।

—কতদিন?

—ঠিক বারোদিন। বারোদিনের পরে আপনি রাজসভায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে পারবেন। আপনার সেবিকাকে কয়েকটা ঔষধ দিয়ে যাচ্ছি। সে খাইয়ে দেবে।

–আপনি আবার কবে আসবেন?

-আসব। তার আগে একজন বোধহয় আগামীকালই এসে পড়বে।

–কে সে?

সে আপনার সেবার ভার নেবে। আপনার শুশ্রূষাকারিণীদের পরিচালনা করবে। তার স্বামী আপনার অপরিচিত নন।

-কে।

অমরু বলে—অতীশ। আমার স্ত্রীর সখী তিনি। মন্দিরে একই সঙ্গে থাকতেন।

—বুঝেছি। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তির দান।

—ঠিক বলেছেন।

বাড়ি ফেরার পথে শ্রীমতী বলে—আমাদের মহারাজা অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি। অমরু হেসে বলে—সে কথা দেশের সবাই জানে।

–সে কথা বলছি না। বলছি—

—বুঝেছি। মহারাজের ভাই-এর মতো বহু মানুষই রাজ পরিবারে কিংবা উচ্চপদে আসীন রয়েছে। তাই কুমন্ত্রণা দেবার লোকের কোনো অভাব নেই। এবারে মহারাজ এক এক করে সবাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবেন। তুমি জান, এই রাজ্যের শাস্তি কত কঠোর, কত নির্মম।

—তুমি কোনো শাস্তিপ্রদান কখনো দেখেছ?

—আমি! তুমি পাগল হলে নাকি? ওসব দিকে আমি নেই। আসলে আমি অকর্মণ্য। মা সেকথা সব চেয়ে ভালো জানেন। তুমিও জানবে আস্তে আস্তে। শ্রীমতীর ইচ্ছা হল স্বামীর কণ্ঠলগ্না হতে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ওই নয়ন দুটো দেখলে তার ভিতরটা যেন কেমন করে ওঠে। একজন নিষ্পাপ ব্যক্তি, যাকে শুধু ভালোবাসা যায়।

এই নিষ্পাপ ব্যক্তি হঠাৎ প্রশ্ন করে—চিকিৎসা করতে গিয়ে রাজ্যের অবস্থার কথা বলতে শুরু করলে কেন?

–ওতে উনি কত উৎসাহ পেলেন দেখলে না? উনি বড় নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন, আমি উসকে দিলাম। দেখো, পরের দিন কত স্বাভাবিক দেখাবে। যন্ত্রণার কথা ওঁর মুখে আর শোনা যাবে না।

-তা বটে। আমার একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।

-কি?

—আমার বেশ অসুখ হয়। খুব অসুখ।

শ্রীমতী গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর বলে—একথা বললে কেন?

—আমাকেও ওভাবে দেখবে। মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠবে।

—তুমি জান কি তোমার জন্য আমার কত চিন্তা। তাছাড়া আমি তো তোমাকে আমার সব কিছুই দিয়েছি। অদেয় যে কিছু নেই।

—তুমি এখনো বালিকা। লোকে যতই বলুক তোমার অনেক জ্ঞান, অনেক বুদ্ধি

—আর তুমি হলে পরিপক্ক বৃদ্ধ। কথা বন্ধ।

—কী বললে?

শ্রীমতী মুখের উপর তর্জনী চেপে ধরে ইঙ্গিত করে, আর কোনো কথা নয়।

.

মঞ্জরী এসেই তাকে ডেকে পাঠায়। শ্রীমতী যে তার জন্য এমন সুন্দর ফাঁদ পেতে রেখেছে সে ভাবেনি। তার চেয়েও অপ্রস্তুত অতীশ। কিন্তু সে অমরুর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। রাজপ্রাসাদে যে পুরনো কোনো ব্যক্তিই প্রায় নেই, সে ভাবতে পারেনি। রাজার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারছে না। শুনেছে তিনি খুবই আহত। অমরু আর শ্রীমতীর কথাও সে শুনেছে। তাই দু’জনে মিলে ওদের ডেকে পাঠিয়েছে।

শ্রীমতী এসেই অতীশকে প্রশ্ন করে—রাজার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

—এখনো যাইনি।

—ভালো হয়েছে। আমি তাঁর শরীরের কথা ভেবেই এটা বলছি। আপনি দেখা করার সময় এতটুকুও উৎসাহের অভাব দেখাবেন না। শুধু এই কথাই বলতে হবে যে যা হয়েছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার জন্য ভেঙে পড়ার কিছু নেই। বড় বড় যুদ্ধেও এমন হতে পারে। তাই বলে সাম্রাজ্য ভেঙে যায় না।

অতীশ মন দিয়ে শুনল। মঞ্জরীও শুনল। অতীশ অমরুকে বলে—তোমরাও আমার সঙ্গে যাবে তো?

অমরু বলে-আগে তোমরাই যাও। আমরা একটু পরে যাচ্ছি। তুমি তোমার স্ত্রীর পরিচয় দিও। তাকে আনার উদ্দেশ্যে বলবে।

অতীশ মঞ্জরীকে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। মহারাজা জেগে ছিলেন। তিনি সেবিকাকে প্রশ্ন করে কবি-পত্নী এলেন বুঝি?

সে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলে—না।

মহারাজার মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। বলেন—কে এল?

ততক্ষণে অতীশ সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে—আমি অতীশ।

উৎসাহিত মহারাজা বলেন—এসেছ? যাক্ এবারে তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে, শিখতে হবে।

মহারাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই মঞ্জরীর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সে শুশ্রূষাকারিণীকে নতুন বস্ত্রখণ্ড আনতে বলে। বাঁয়ের দিকের বুকের কাছে ক্ষতস্থানে রক্ত দেখা দিয়েছিল, সেবিকা সামান্য উষ্ণ জল তাড়াতাড়ি এনে দিতেই মঞ্জরী সযত্নে স্থানটি মুছিয়ে দিতে থাকে। মহারাজা নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। অতীশকে প্রশ্ন করেন এই বালিকা তোমার সঙ্গে এসেছে? আমি তো লক্ষ্য করিনি। এ যে সেবার প্রতিমূর্তি। এ কে?

-আমার স্ত্রী।

–তোমার স্ত্রী? বালিকা?

সেই সময় অমরু এবং শ্রীমতী আসে। মহারাজের কথা শুনে শ্রীমতী বলে—ও বালিকা নয় মহারাজা, আমার চেয়ে একটু বড়ই।

—কিন্তু—

-ওকে দেখতে কচি কচি। আমার তাই ওকে খুব ভালো লাগে।

মহারাজের মুখে সামান্য হাসির রেখা ফোটে যেন।

তিনি বলেন—আমার একজন প্রধান এবং নিকটতম সামন্তের স্ত্রী ইনি? ভাবাই যায় না। আপনি কিছু মনে করবেন না।

—না মহারাজ আমি তো আপনার চেয়ে ছোটই। ঈশ্বর আমার মুখখানা বিশ্রীভাবে গড়েছেন—

—বিশ্রীভাবে কে বলল? এমন মুখ পাওয়া তো ভাগ্য বলতে হবে। আমার যদি আপনার মতো একজন ছোট বোন থাকত—

অমরু আর অতীশ খুব আনন্দিত হয়ে ওঠে। অমরু বলে—ছোট বোনই তো। আপনাকে ওর হাতে ছেড়ে দিন, দুদিনেই ভালো হয়ে যাবেন। তবে ওঁর সেবা কিন্তু রাজা, প্রজা, দুঃখী, ভিখারী সবার ক্ষেত্রেই এক।

—কবি, আমার বিশ্বাসঘাতক ভাই যে ঘোর বিপদ, আমার ও আমার সাম্রাজ্যের ঘটিয়েছে তার ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গুরুদেবের আশীর্বাদে বোধহয় আমার আত্মার কল্যাণ হয়েছে। আমি একটা নতুন দৃষ্টি ফিরে পেয়েছি।

মঞ্জরী শ্রীমতীকে বলে—তুই মহারাজকে পরীক্ষা করে নে। আমার আরও কাজ বাকি রয়েছে।

মহারাজের মনে হল একটা গোটা পরিবার যেন তাঁকে ঘিরে রয়েছে। তিনি নিশ্চিন্ত।

সেই মুহূর্তে এক সুন্দরী নারী যার নাসারন্ধ্র ক্রোধে স্ফূরিত তিনি কক্ষে এসে একটু উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন—দু’দিন ধরে আমি এখানে আসতে পারছি না। ওরা বলছে আপনি নাকি খুবই অসুস্থ। সংকটাপন্ন নাকি আপনার অবস্থা। দিব্যি কথা বলছেন এদের সঙ্গে। কারা এরা জানি না। তবে দুই সুন্দরী রয়েছে বটে। আমার চেয়ে এদের বয়স কম। তাই বোধহয় অবাধ গতি।

কারও মুখে কোনো কথা ছিল না কিছুক্ষণ।

তিনি বলেন—মহারাজা আমাকে ভুলে গিয়েছেন? একসময়ে আমি আপনার পাটরানী ছিলাম বলে জানতাম। গৌরীর স্থান ছিল আমার পরেই। আপনার মস্তিষ্কও কি আমার দেবরের আঘাতে বিবশ?

মহারাজা এবারে নিজেকে সামলে নেন, তারপর বলেন—রানী আমার মস্তিষ্ক খুবই সুস্থ রয়েছে। মনে হয় এত সুস্থ আগে কখনো ছিল না। যে দুজন পুরুষকে এখানে দেখছ, তাঁদের একজন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সভাকবি আর অপরজন বিজয়নগরের নিকটতম সামন্তরাজ্যের অধিপতি আর দুইজন নারী এঁদের দুইজনের স্ত্রী। তবে স্ত্রী রূপে এঁরা আসেননি। একজন হলেন আয়ুর্বেদজ্ঞ। আমার ধারণা এই মুহূর্তে রাজ্যের মধ্যে ইনি সর্বশ্রেষ্ঠ। অপরজন শুশ্রষা কার্যে দক্ষ। তিনি মমতাময়ী। আমার ভগিনীস্বরূপা। তবে হ্যাঁ, এঁদের রূপ রয়েছে। এত রূপ প্রথম যৌবনেও তোমার ছিল না। কারণ রূপ দেখে তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়নি। উড়িষ্যা রাজের ভগিনী হওয়ার দৌলতে বিজয়নগরের অধিপতির সহধর্মিনী হয়েছিলে।

মহারাজ একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

মাল্লাদেবী কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কক্ষ ত্যাগ করেন।

.

১৪৪৩ খৃষ্টাব্দের দ্বিতীয়ার্ধের কথা উল্লেখ করে আবদার রজ্জাক বলেছেন, এই সময়ে মন্ত্রী দানায়িক কুলবার্গা রাজ্যের দিকে অভিযান শুরু করে। যে জন্য এই অভিযান তার কারণগুলি হল, সুলতান আলাউদ্দিন বিজয়নগরের নরপতিকে হত্যার জন্য বিশ্বাসঘাতকতার প্রচেষ্টা এবং সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিও অমাত্যদের নিহত হওয়ার কথা শুনেছিলেন। তিনি মহারাজার নিকট “সাত লক্ষ বরাহ” দাবি করলেন। তিনি ভাবলেন, সাম্রাজ্যটিকে ধ্বংস করার এটি প্রকৃষ্ট সময়। বিজয়নগরের অধিপতি এই সংবাদ পেয়ে খুবই বিব্রত ও বিরক্ত হলেন। কিন্তু তিনি একটি সাহসী জবাব পাঠিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।

“দুই পক্ষ সৈন্য প্রেরণ করল, যার ফলে দুই রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক কিছু ধ্বংস হল। দানায়িক কুলবর্গার সীমান্তে আক্রমণ চালিয়ে বহু হতভাগ্য বন্দিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলেন”…..

.

অমরু মাতৃহারা হল। পুত্রবধূ চিকিৎসা শাস্ত্রে পারদর্শিনী হয়েও কিছু করতে পারল না। হৃদপিণ্ড সম্পৰ্কীয় খুবই পুরনো ব্যাধি ছিল তাঁর। শ্রীমতী এসেই বুঝতে পেরেছিল। স্বামীকে বলে রেখেছিল। তাই তারা কখনো নিজেদের বিবাহের পরে মাকে একা রাখত না। শুধু মহারাজা যখন অসুস্থ ছিলেন তখন দু’একদিন দুজনে একসঙ্গে রাজপুরীতে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যু ঘটল খুবই শান্তিতে, নিদ্রিত অবস্থায়। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, শান্তিতে ঘুমিয়ে রয়েছেন। শ্রীমতী অশ্রুসিক্ত অবস্থায় স্বামীকে বলে—দেখো, মুখে হাসি লেগে রয়েছে।

—এখন কি হবে? মা যে নেই।

—এ আঘাত সবাই পায়। তোমার কিছু করার নেই। তুমি তো ভাগ্যবান, মায়ের মৃত্যু-যন্ত্রণা দেখতে হয়নি। এই রোগে এত শ্বাসকষ্ট হয় যে চোখে দেখা যায় না। মা দেবী ছিলেন। তিনি হাসি মুখে বিদায় নিলেন।

শ্রীমতীর নিজের মায়ের কথা আজ বারবার মনে পড়ে। কিন্তু তিনি তো জীবিত থাকতে পারেন না। তবু এক এক সময় মনে হয় থাকতে তো পারেন। সে স্বার্থপর, তাই নিজের সুখের দিনে তাঁর কথা বিস্মৃত হয়েছে। মায়ের সধবা অবস্থার চেহারার কথা তার মনে পড়ে না। কিন্তু যে বেশে তিনি তার হাত ধরে মন্দিরের প্রবেশ পথের মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই মুখের স্পষ্ট ছবি তার হৃদয়ে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে। মৃত শ্বশ্রূমাতার জন্য অশ্রু ধারার সঙ্গে তার নিজের মায়ের জন্য হৃদয়-মথিত ক্রন্দনের ধারা মিলে অবিরলভাবে ঝরে পড়তে থাকে।

তাকে এত অস্থির দেখে অমরু বুঝতে পারে না কিভাবে সান্ত্বনা দেবে। সে উত্তরীয় দিয়ে স্ত্রীর অশ্রু মুছিয়ে দেয়। তাকে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়। মায়ের বিচ্ছেদ বেদনা মনের মধ্যে চেপে বসতে পারে না। শ্রীমতী, দুঃখের সময়েও যে এমন সান্ত্বনা পাওয়া যায়, তার আস্বাদ কখনো পায়নি। সে স্বামীর বুকে মুখ লুকোয়। ভাবে তার তো একবারও মনে হচ্ছে না যে তার স্বামী একজন বাস্তব বুদ্ধি বিবর্জিত কল্পনাপ্রবণ মানুষ। তাহলে এঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য এত নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল বলে মনে হত না।

—শ্রীমতী, এবারে আমাকে ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবেশীরা একটু দেরিতে খবর পেল। সঙ্গে সঙ্গে তারা এসে জড়ো হয়। অমরুর রাজপুরীতে খবর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। রাজা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। রাজসভা শুরু হয়েছে। অধিকাংশ নতুন সদস্য। অতীশের ফিরে যাওয়া হয়নি। রাজা তার উপর বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। দানায়িকের পরই তার স্থান। রাজা দানায়িককে মন্ত্রীরূপে অতীশের যোগ্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন।

দানায়িক উত্তরে বলেছিল—যাঁরা ছিলেন, তাঁরা স্বর্গে গিয়েছেন। বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্বের সেখানেই স্থান। তবে একথা বলতে পারি, অতীশ তাঁদের অনেকের চেয়েই যোগ্য।

রাজার খুব আনন্দ হয়। এর ফলে অতীশকে স্থায়ীভাবে রাজধানীতে থাকতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মাকে দেখতে মঞ্জরীকে নিয়ে দু-একদিন ঘুরে আসে। তাই আজকের দিনে অতীশকে না বলে তো উপায় নেই। ফলে মহারাজাও শুনবেন। তিনি কি কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন জানা নেই। নিজের মায়ের সব কিছু অনাড়ম্বরে হওয়া তার একান্ত বাসনা। তবু রাজা এবং অতীশকে সে খবর পাঠাল এবং অতীশকে জানাতে ভুলল না যে খুব সাধারণভাবে সে মায়ের কাজ করবে। প্রতিবেশীরা সবাই সঙ্গে রয়েছে। তারাই তার হিতাকাঙ্খী।

অতীশ বুঝল এবং মহারাজাকে বোঝাল। অতীশ আর মঞ্জরী এল শুধু। রাজা সমবেদনা জানালেন অতীশের মাধ্যমে।

.

অমরু কেমন যেন শান্ত হয়ে গিয়েছে। মায়ের মৃত্যু প্রায় ছয়মাস হয়ে গেল, কিন্তু হাতে লেখনী ওঠেনি। তবে বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে।

–তুমি আজকাল লেখনা কেন?

শ্রীমতীর মুখে এই প্রশ্ন শুনে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বলে—আমিও তাই ভাবি। সরস্বতী দেবী কি আমার প্রতি বিরূপ?

–একটা কথা বলব?

—তার জন্যে অনুমতির প্রয়োজন?

– হ্যাঁ।

-কেন?

—আমার স্বার্থ রয়েছে বলে।

-সে তো আরও জরুরি। এখনি বল।

–বলছিলাম, আমার মনে হয় রাজধানীর বাইরে দু-একদিন ঘুরে এলে নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। তাতে একঘেয়েমী ভাব কাটবে। উপকার হবে।

—আমি তোমার স্বার্থের কথা আগে শুনতে চাই।

–আমাদের একটা গ্রাম ছিল, যেখান থেকে মা আমাকে পশুপতি মন্দিরে নিয়ে এসেছিলেন।

—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তো সব ভুলে গিয়েছ।

শ্রীমতী মনে মনে দুঃখের হাসি হাসে। এগারো বছরের একটি মেয়ে কখনো সব ভুলতে পারে? এতে অমরুর কোনো দোষ নেই। তার ধারণা সে খুব শিশু ছিল। কিন্তু তা তো নয়। মা শৈশবে তাকে আদর করে বলতেন, বিজয়নগরে তারকেশ্বরের মন্দির রয়েছে শুনেছি, সেখানে শিবের কোলে রয়েছে ছোট্ট দুর্গা। তুই হলি সেই দুর্গা। মা বেঁচে থাকলে তাঁর আনন্দের সীমা থাকত না। তিনি স্বচক্ষে দেখতে পেতেন তাঁর আদরের দুর্গা সত্যই শিব পেয়েছে এবং তাঁর কোলে বসতে পারে ইচ্ছেমতো।

অমরু আবার বলে—ভুলে যাও নি?

–আমি এগারো বছর বয়সে গ্রাম ছেড়েছি।

অমরু রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে—তাহলে সব কিছুই তো মনে আছে। এতদিন বলনি কেন? গুরুদেব বলেননি কেন? তুমি কেন লুকিয়ে রেখেছিলে এতদিন? আমি জানতাম, তুমি কোনো অন্যায় করতে পার না। এখন দেখছি নিজের উপর সব চেয়ে বেশি অন্যায় করে ফেলেছ। কোথায় তোমার গ্রাম? এখুনি বল। শ্রীমতী স্বামীর পাশে বসে তার গায়ে হাত রেখে বলে—অমন করো না। সে ধীরে ধীরে সব বলে। প্রথমেই বলে যেরকম দ্রুত তার ভাগ্যের পরিবর্তন হল তা কল্পনার অতীত। সে নিজেই মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল। মনে হয়েছিল গুরুদেব তাকে স্বর্গ থেকে দেবতাকে এনে দিলেন। তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল বোধহয়। এমনকি মনে হয়েছিল, সে কি স্বার্থপর হয়ে পড়েছিল? মা তার মনের মধ্যে সব সময়েই রয়েছেন ইষ্ট দেবতার মতো। অথচ সংসারে তাঁর মূল্য রয়েছে বলে হয়তো মনে হয়নি।

–ঠিক আছে আর কোনো কথা নয়। তোমার গ্রাম কোথায়?

—হেমকূট পর্বতের পেছনে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম, নামও তার বিচিত্র—নুটি। আখ হত খুব। চলে আসার সময় আখের জমি ফেটে চৌচির। সবুজের চিহ্ন ছিল না কোথাও। ঘাসও মরে গিয়েছিল।

—মা বৃদ্ধা ছিলেন?

—না। বাবা কম বয়সে মারা যান। আমি তাঁর একমাত্র সন্তান।

—তুমি করেছ কি শ্রীমতী? আমাকেও তোমার পাপের ভাগীদার করে নিলে? তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি নেই। বরং তোমার পাপ হ্রাস করতে প্রায়শ্চিত্তও করতে পারি। কিন্তু আর দেরি নয়। আগামীকাল ভোরবেলা রওনা হব। দেখতে হবে সত্যি তাঁর মৃত্যু হয়েছে কিনা।

শ্রীমতীর দৃঢ় বিশ্বাস মা বেঁচে থাকতে পারেন না। মেয়েকে কোনোরকমে কিছুটা খাদ্য যোগাড় করে দিতে দিতে কংকালসার হয়ে পড়েছিলেন। মন্দিরে আসার পথে কতবার বসে বিশ্রাম নিয়েছেন। তবু সত্যি যদি অসম্ভব সম্ভব হয়? তার ভাগ্যে তেমনই ঘটে চলেছে যে একের পর এক।

.

সূর্য উঠতে কিছুটা বাকি। পূব আকাশে আলোর অতি সামান্য আভাস। শ্ৰীমতী দ্বার খুলে স্বামী সহ বাইরে পদার্পণ করতেই দেখে সেখানে একটি শকট এসে থামে। দু’জনেই বিস্মিত হয়। অমরু বুঝল অতীশ এসেছে। কিন্তু এখন কেন? তাছাড়া সস্ত্রীক এসেছে নিশ্চয়ই। সে একা এলে অশ্ব নিয়ে আসত। একটা কিছু ঘটেছে। কারণ মঞ্জরীর মুখ থমথমে। সহজেই বোঝা যায়, সে ইতিমধ্যেই চোখের জল ফেলেছে। শকট থেকে নেমে সে শ্রীমতীর বাহু ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়।

অতীশ ইশারায় অমরুকে কাছে ডাকে। সে কাছে যাওয়ার আগেই ভোরের নৈঃশব্দের মধ্যে চাপা ক্রন্দন-ধ্বনি শোনা যায়। অতীশ বলে—মুক্তি নামে কাউকে চিনতে?

–নামে চিনি না কাউকেই, তবে এ নাম ওর মুখে অনেক শুনেছি। ওদের সবার নামই নিশ্চয়ই শুনেছি। শোনা তো স্বাভাবিক।

—মুক্তি নাম কেন শুনেছ?

—অদ্ভুত প্রশ্ন করছ। কেন আবার শুনব? ওর একজন বান্ধবী বলে, ওর মতো দেবদাসী বলে।

—অনেক সময় খুব পরিচিত ব্যক্তি সম্বন্ধে বলতে গেলে তার কিছু বৈশিষ্ট্যের কথাও লোকে বলে।

—বুঝেছি। কিন্তু কি হয়েছে? এটুকু বুঝেছি মুক্তি আর নেই। এও বুঝেছি স্বাভাবিকভাবে তার মৃত্যু হয়নি। ও হ্যাঁ, ওর একটা বৈশিষ্ট্য কথা মনে পড়েছে।

অতীশ ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে।

—সোনালি চুলের বিদেশিদের ওর ভালো লাগত। তাই বলে—

—আশ্চর্য!

এবারে বিস্মিত হওয়ার পালা অমরুর। সে বলে—কোনো সোনালি চুল—

-হ্যাঁ।

–কি হয়েছে সব বল।

—কাল সন্ধ্যায় মন্দিরের পাশের জঙ্গলে গাঁয়ের লোকেরা একজন বিদেশিকে দেখতে পায় মুক্তিকে তাড়া করেছে আর মুক্তিও প্রাণভরে মন্দিরের দিকে ছুটছে। গ্রামের কিছু লোক দেখতে পেয়ে অনেককে জুটিয়ে তাকে তাড়া করে ধরে ফেলে। তারা রেগে যার যা অস্ত্র ঘরে ছিল হাতে নিয়ে সেই বিদেশিকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। গুরুদেব খবরটা আমাকে পাঠান। আমি রাজাকে বলতে তিনি বিচলিত হন। কারণ বিদেশিদের সঙ্গে তাঁর বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব ভালো ৷ অন্যদিকে এর সঙ্গে তাঁর রাজধানীর এক বিখ্যাত মন্দিরের দেবদাসী জড়িত। তবে গ্রামবাসীদের তিনি প্রশংসা করেন। দেশের দেবালয়গুলির প্রতি তাদের সজাগ দৃষ্টির তুলনা নেই।

—তারপর?

—মুক্তি অক্ষত অবস্থায় মন্দিরে রুদ্ধশ্বাসে ঢুকে পড়ে। কিন্তু দেবদাসীদের মুখে ঘৃণার কুঞ্চন। মুক্তি হয়তো তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিল যে সে নিরপরাধ। কেউ নিশ্চয় বিশ্বাস করেনি। সে নীরবে সরে গিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। গুরুদেব জীবনের সায়াহ্নে এই আঘাত পেয়ে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছেন। সেই সময়ে শ্রীমতীরা বাইরে আসে। শ্রীমতীকে এত অস্থির হতে অমরু কখনো দেখেনি। শ্রীমতী কাছে এসে বলে—মন্দিরে যাব।

-নিশ্চয় যাবে। আমরা সবাই যাব।

—কৌতুক প্রিয়তা ওর সর্বনাশ ডেকে আনল। ওর একমাত্র দোষ, ওর অনুকরণ-প্রিয়তা। যে কোনো মানুষকে একটু দেখেই তাকে হুবহু নকল করতে পারে। তোমাদের দুজনকে কতটুকুই বা দেখেছে? তোমাদের কথাবার্তা ভাবভঙ্গি সব নিখুতভাবে আমাদের সামনে বলে আমাদের হাসিয়েছে। নিশ্চয় ওই বিদেশিকে ও অনুকরণ করেছিল। সেটা তার চোখে পড়ে যায়। তাতে হয়তো সে প্রশ্রয় পেয়ে পেছনে এসেছিল।

অমরু বলে—শ্রীমতী সবাই তোমার মতো গভীরভাবে চিন্তা করে না। মনে হয়, মুক্তির ওপর ভুল ধারণা থেকেই যাবে।

—অন্তত দেবদাসীদের বোঝাতে পারব।

গুরুদেবকে বললে, তিনি বুঝবেন। তিনি সান্ত্বনা পাবেন।

–সেকথা ঠিক।

শুধু গুরুদেব ক্রিয়াশক্তি নন গ্রামবাসীরা আরও সহজে বিশ্বাস করল, কারণ তারা প্রত্যক্ষদর্শী। অবলা দয়াবতীরাও মনে হয় মুক্তির স্বপক্ষে ভাবতে শুরু করেছে। ওদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না যে মেয়েটি কত সরল ছিল। তবু সব কিছু কি মুছে ফেলা যায়? এই ঘটনার কথা গল্পের আকারে ভেসে বেড়াবে বহুদিন ধরে। শ্রীমতী সেটা বুঝতে পারে।

গ্রামবাসীরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তির দাহকার্য সম্পন্ন করতে গেল। দেবদাসীরা কেউ গেল না। এমন কি শ্রীমতী আর মঞ্জরীও নয়। তারা নিম্নস্বরে নিজেদের মধ্যে মুক্তির নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে থাকে। তারা নিজেরাই জানে না মুক্তি তাদের মুখ দিয়ে তার কথাটা বলিয়ে নিয়েছে। কেউ মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে।

নগরীতে বাস করে বলে সব পর্বতের মতো হেমকূট পর্বতকেও সে কয়েকবার দেখেছে। যে কয়েকবার পর্বতটি তার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ততবার তার মন কেমন করে উঠেছে। ওখান থেকে কি যেন টানছে তাকে। ওই টান বড় প্রবল বেদনাদায়ক। যতদূর মনে পড়ে পর্বতটি পার হয়ে দু-একটি গ্রামের পরে গ্রাম তার সীমান্তে একটি বিশাল নিমগাছ। দুর্ভিক্ষে নিমগাছের হরিদ্রাভ প্রায় বিনষ্ট হয়েও জীবিত ছিল। মা ওদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলেছিলেন, ওটাই আমাদের গ্রাম। এখনো নিজেকে কোনোরকমে বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো বেঁচে যাবে। কিন্তু গাছটি তার পরিচিত অনেককেই আর দেখতে পাবে না। তোকেও নয় আমাকেও নয়।

কোমল স্বরে অমরু জিজ্ঞাসা করে—কি ভাবছ শ্রীমতী?

স্বামীর কণ্ঠ খুবই কোমল এবং দরদভরা। বুক জুড়ায়। গত জন্মে সে যতখানি পাপ করেছিল পুণ্যি করেছিল বোধহয় তার চেয়েও বেশি। কিংবা সমান-সমান? বুঝতে পারেন সে। ক্ষেতে ফসল ভর্তি। একটি গ্রামে প্রবেশ করে তারা। ওখানে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নানা বর্ণের সবজী। নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী। এতদিনে মনে পরে এইসব দৃশ্য তার খুব পরিচিত। বুকের মধ্যে বাষ্প জমে ওঠে। সেই নিমগাছটি কি এখনো রয়েছে? থাকলেও সে চিনতে পারবে কি? পারলেও তার বাড়ি চিনতে পারবে কি। বাড়িটি কি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে? থাকলেও মা রয়েছেন কি? সে অস্থির হয়ে ওঠে। নিরালা পথ হলে অমরু তাকে কাছে টেনে নিত। ওর অমন চাহনির অর্থ সে জানে। ওই চাহনিতে ফুটে উঠছে শ্রীমতীর প্রতি তার বুকভরা ভালোবাসা, আর গভীর করুণা। এই করুণা পৃথিবীর সবার প্রতি রয়েছে তার। এই করুণা পংক্তি হয়ে তার কবিতায় ফুটে ওঠে।

সহসা শ্রীমতী উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে—ওই-ওইটা।

–কী !

—ওই সেই নিমগাছ। এখনো রয়েছে। আমি চিনতে পেরেছি।

অমরু খুশি হয়ে বলে ওঠে—ভালো তো। কত আনন্দের। এতদিন পরে নিজের গ্রামে এসেছ। সুন্দর গ্রাম। আমারও একটা গ্রাম ছিল। কিন্তু খুঁজে পাব না। বাবা চিরকাল নগরবাসী ছিলেন।

—ভালোই করেছেন।

–কেন?

—না হলে তোমাকে পেতাম না।

—তুমি খুব স্বার্থপর

—খুব না হলেও একটু তো বটেই। আমার মনে হয় সব মেয়েরাই। তবে হেমাঙ্গিনীদি একটু অন্যরকম।

—চিনি না।

—সুযোগ পেলে চিনিয়ে দেব।

শ্রীমতী লক্ষ্য করে একটি গ্রাম্যবধূ পথের ধারে ছেলেকে কাঁখে নিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। বধূটির ভঙ্গি খুব পরিচিত। তা কি হতে পারে? তার দু’জন বাল্যসখী ছিল। একজন হল সরলা। সে সত্যই সরল। অন্যজনের নাম ছিল বাসন্তী। সে ছিল নাদুসনুদুস। শ্যামলা রঙ। তার প্রতি হিংসা ছিল। অথচ তাকে ভালোবাসত। বলত আমি যদি তোর মতো দেখতে হতাম তাহলে তোকে আরও ভালোবাসতাম। কথা শুনে শ্রীমতী খুব হাসত। বলত, এটুকু ভালোবাসাই যথেষ্ট। তাতে বাসন্তী রেগে যেত। বলত, তোর যেন কুৎসিত স্বামী হয়। স্বামীর ব্যাপার শ্রীমতী অত বুঝত না। সে ওকে খুশি করার জন্য বলত, ঠিক আছে। কিন্তু ছেলে কোলে বউটি বড্ড রোগা। বাসন্তী হতে পারে না ও।

একেবারে কাছে এলে বধূটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলে ওঠে—শ্রী? শ্রীমতীর বুকে ঝড় ওঠে। ছুটে গিয়ে ছেলে সমেত বাসন্তীকে জড়িয়ে ধরে বলে—বাসন্তী? তুই এত রোগা হয়েছিস্। এতদিন বুঝিনি, এখন বুঝছি তোকে

কত ভালোবাসতাম। তোর ছেলে? আমার কোলে দে।

ছেলেটি কাঁদে না। দুই সখী কাঁদতে থাকে। শ্রীমতী বলে ওঠে—মা?

—আজ আছেন কিনা জানি না, কালও ছিলেন।

–মা বেঁচে রয়েছেন? শুনছ, মা বেঁচে আছেন।

—চল, শিগগির চল। আপনি একটু পথ দেখিয়ে দেবেন?

–দেব না কেন। আপনি তো আপনজন।

কথাটা অমরুর খুব ভালো লাগে। এ পরিবেশে থেকেই শ্রীমতী এমন হয়েছে। শ্রীমতী একা এলে নিজের বাড়ি চিনতে পারত না। একটি মাত্র কুটির দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারপাশের প্রাচীর নেই। উঠোন নেই, অন্য কুটিরগুলোও নেই। কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি পড়ে না। সে দেখতে চায় মা বেঁচে রয়েছেন কিনা। একটি কিশোরী ঘর থেকে বাইরে এসে তাদের দেখে থতমত খায়।

তাকেই শ্রীমতী বলে—মা বেঁচে আছেন?

সে বুঝতে পারে না। শ্রীমতী ছুটে ভিতরে ঢুকতে যায়। অমরু তার হাত চেপে ধরে বলে—না, ও ভাবে নয়। একটু ধৈর্য ধর।

সে কিশোরীকে প্রশ্ন করে—উনি বেঁচে আছেন?

–হ্যাঁ।

—কথা বলতে পারেন?

—খুব আস্তে।

—খেতে পারেন?

—কিছুই খেতে চান না।

—তুমি এই কাজ করছ কেন?

–মা বাবা বলেছেন, আমরা এঁদের কাছে চিরঋণী। তাই আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আমি এঁর সেবার ভার নিতে পারব কি না।

বাসন্তী বলে ওঠে—অনন্ত কাকাকে চিনতিস শ্ৰী?

—মনে পড়ছে না।

–এ তাঁরই মেয়ে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে।

শ্রীমতী অধৈর্য হয়ে বলে—এবারে মায়ের কাছে যেতে পারি?

—যাও। আস্তে আস্তে যাও। এঁদের দুজনাকে সঙ্গে নাও।

শ্রীমতী গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে মনে মনে প্রণাম করে তারপর পশুপতি নাথকে স্মরণ করে।

সে এগিয়ে যায়। ঘরের ভেতর মোটেই অন্ধকার নয়। জানালাগুলি খোলা। হালকা হাওয়া বইছে। বিছানায় অতি শীর্ণ মাকে শায়িত দেখতে পায় শ্রীমতী। মাকে সে এইভাবে অবহেলা করেছে? দেবদাসী থাকার সময় হয়তো কোনো কোনো দিন একবারও মাকে মনে পড়েনি অথচ মা প্রতিনিয়ত তার কথা ভেবেছেন। এখনো ভাবছেন। তার বুক ফেটে কান্না এসে যায়। দুহাত দিয়ে কণ্ঠ চেপে ধরে। কিশোরী তার হাত সজোরে ছাড়িয়ে নেয়।

–মা।

অমরু তাড়াতাড়ি এসে দাঁড়ায়। বাসন্তীর ছেলে কেঁদে ওঠে। এই থমথমে পরিবেশে সে ভয় পেয়ে যায়।

শায়িতা মা মাথা ঘুরিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন—কে যেন কাঁদছে না, ওতো

অনেক বড় এখন ৷

বাসন্তী বলে—কাকিমা, আমার ছেলে কাঁদছে।

-ও।

মা নিশ্চিন্ত হন। বাসন্তীর কণ্ঠস্বর চিনতে পেরেছেন। শ্রীমতী আশান্বিত হয়। বাসন্তী তাঁর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে—কেমন আছেন কাকিমা।

মা অতি ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন—ভালো, খুব ভালো।

—শ্রীমতীর কথা মনে হচ্ছে?

—এ্যাঁ। ওকথা কেন? সে নেই?

এবারে শ্রীমতী মাকে যতটা আলগোছে সম্ভব জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে মুখ এনে বলে—আমি এসেছি আম্মা।

–আম্মা?

এ নামে ডাকছ কেন?

—আমি শ্রীমতী আম্মা। তোমার মেয়ে আম্মা আম্মা আম্মা–

মা শ্রীমতীকে ধরতে চান। অমরু তাড়াতাড়ি ওঁর হাত তুলে নিয়ে বলে—আপনি একটু স্থির হোন, একটু সবল হোন, সব দেখতে পাবেন, সব শুনতে পাবেন। অমরু একটু দূরে সরে গেলে সেই সুযোগে শ্রীমতী মায়ের কানে কানে বলে—অমরু শতকের অমরু তোমার সঙ্গে কথা বললেন। তোমার জামাই।

মা বড় বড় চোখে চেয়ে থাকেন। কিছুই বুঝতে পারেন না।

ছেলেকে কিশোরীর কোলে দিয়ে বাসন্তী শ্রীমতীকে বলে-মায়ের কানে কানে কি বললি রে? মনে হয়, আমাকে বলিস্ নি।

—পরে বলব।

–কেন? আমাকে পরে বলবি কেন?

শ্রীমতী হাসতে হাসতে বলে—তুই দেখছি আগের মতোই হিংসুটে আছিস।

তার কথার ধরনে বাসন্তী হেসে ফেলে। বলে—পরেই বলিস।

ওদের দু’জনার হৃদ্যতা দেখে কিশোরীর ভালো লাগে। তার এদের মতো সখী নেই ৷

শ্রীমতী বাসন্তীকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের স্বামীর পরিচয় দেয়।

বাসন্তী স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর বলে—তোর সুখে আমি যে কত সুখী বলে বোঝাতে পারব না।

—জানিরে।

—আমার মন আনন্দে ভরে উঠছে। যাই সবাইকে গিয়ে বলে আসি।

—এখনি যাবি? তোকে যে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

-আমারও কি ইচ্ছে করছে? কিন্তু এত আনন্দ একা একা উপভোগ করা যায় না। ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হয়। আমি সবাইকে গিয়ে বলে, আবার আসছি। আমার সুবিধা হল এতবড় ছেলেকেও তোলা দুধ খাওয়াতে হয় না।

শ্রীমতী হেসে ওঠে।

–ওসব হাসি বেরিয়ে যাবে। সময় আসুক।

শ্রীমতীর মুখে হাসি ফোটে, কারণ সে বুঝতে পারে তার মাকে বাঁচানো যাবে। তবে, মা এখনো সব কিছু বুঝতে পারছেন না। এখনো স্বপ্নের মধ্যে রয়েছেন যেন। হয় তাঁর শ্রীমতীর উপস্থিতির কথা এখন মনে নেই। হয়তো অমরু শতকের কবির কথা মন থেকে সরে গিয়েছে। তবু তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁকে সে মরতে দেবে না। তেমন অবস্থা তাঁর নয়। আয়ুর্বেদ তাকে এটুকু জ্ঞান দিয়েছে। আজ মঞ্জরী থাকলে বড় ভালো হত। কিন্তু এই মেয়েটি প্রাণ দিয়ে তাঁর সেবা করেছে। এক নজরেই সেটা বুঝতে পেরেছে সে। অথচ মেয়েটির নাম এখন পর্যন্ত জানতে চায়নি।

সে মেয়েটি বলে—তুমি এত সুন্দরভাবে সেবা করছ, আমার মাকে দেখে আসছ, অথচ তোমার নাম অবধি জানতে চাইনি। আমার অন্যায় হয়েছে। তুমি ক্ষমা কর।

মেয়েটি বলে ওঠে—একি বলছেন আপনি! এযে আমার কর্তব্য। আমার বাবা, আপনাদের কাছে চিরঋণী। আপনি অন্যায় একটুও করেননি। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

-তোমার বাবা কিজন্যে কতখানি ঋণী আমি জানি না, জানতেও চাই না। বাসন্তী আবার বলে, আমি বাড়ি যাই শ্রী। তোরা তো অনাহারে থাকবি না। জামাই এসেছেন এই প্রথম। কাকিমার খাওয়ার ব্যবস্থা পার্বতীদের বাড়িতে হয়ে থাকে।

শ্রীমতী মেয়েটিকে বলে—তোমার নাম পার্বতী। সুন্দর নাম।

অমরু ঘরের বাইরে আঙিনায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। তার মনের মধ্যে অনেক ভাবনার উদয় হচ্ছিল। সেগুলির মধ্যে একটা ভাবনা প্রবল। শ্রীমতীর মা এতদিনে একবারও কেন নিজের মেয়ের খবর নেননি। দারিদ্র্য এর কারণ হতে পারে না। কারণ প্রথম সুযোগ আসার পরে ওঁর জমি অকর্ষিত হয়ে পড়ে নেই আর। লোকবল যথেষ্ট রয়েছে। নইলে মৃতপ্রায় ব্যক্তির সেবার জন্য কাউকে পাওয়া যেত না।

মেয়ের চিকৎসায় মা পাঁচ দিনের মধ্যে অনেক সুস্থ হয়ে ওঠেন। নিজের মেয়েকে ভালোভাবে চিনতে পারেন। অজস্র অশ্রুপাত করেন। বারবার এই বলে আক্ষেপ করেন যে তিনি ঘোরতম পাপ করেছেন। তাঁকে কিছুতেই শান্ত করা যায় না। কী পাপ যে তিনি করেছেন, তাও বলতে পারছেন না। শুধু জামাতার উপস্থিতি টের পেলে তিনি তাড়াতাড়ি নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।

ইতিমধ্যে শুধু নিজেদের গ্রামেই নয়, চারদিকে ছড়িয়ে যায় যে শ্রীমতী আগের চেয়ে শতগুণ সুন্দরী হয়েই শুধু আসেনি সে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান নিয়ে ফিরেছে। নিজের মাকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছে। বাড়িতে মানুষের ভীড় জমতে শুরু করল।

অমরু একসময় বলে, তোমার সময় তো ভালোই কাটছে। আমি একবার বিজয়নগর ঘুরে আসি।

শ্রীমতী নিরালায় তার গ্রীবাবেষ্টন করে বলে—তাকি হয়? তুমি না থাকলে আমি হলাম দিনের চাঁদ।

—সেটা কেমন কথা

–বুঝে নাও। তুমি তো কবি।

–তা না হয় বুঝে নিলাম। কিন্তু ভুলে যেও না আমি সভাকবি। সভায় আমার উপস্থিতি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। বলতে পার অপ্রয়োজনীয় শোভা।

শ্রীমতীর সম্বিত ফেরে। ভাবে, তাই তো। স্বামীকে আটকে রাখা উচিত নয়। অথচ তাঁর অনুপস্থিতে সব কিছু তার বিস্বাদ বলে মনে হবে। সে বলে—মাকে সঙ্গে করে নেওয়া যায় না?

কবি মৃদু হেসে বলে—সে কথা বলার যোগ্যতা একমাত্র তোমারই রয়েছে।

-না না, মাকে আরও অন্তত দশ দিন এখানে রাখতে হবে।

–তাহলে আমি আগামী কালই রওনা হব।

এতক্ষণ কথা হচ্ছিল একটু আড়ালেই। কিশোরী মেয়েটি সেখানে গিয়ে বলে—আপনার মা ডাকছেন, আপনার নাম ধরে।

মেয়েটির চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কারণ এভাবে কখনো কারও নাম ধরে তিনি ডাকেননি। মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত আহ্বানে তাড়াতাড়ি মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শ্রীমতী।

ইতিমধ্যে বাসন্তীও ছেলে কোলে নিয়ে এসে গিয়েছিল। এসেছিল শ্রীমতীর কাছে চিকিৎসা করাতে আরও দু-একজন। সবাই জেনেছে মা শ্ৰীমতীকে ডেকেছেন।

মায়ের কাছে সে গিয়ে দেখে মায়ের মুখে হাসি। তিনি সোজা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

অমরুও শ্রীমতীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়ের চোখের দৃষ্টির মধ্যে সে শ্রীমতীর দৃষ্টির মিল খুঁজে পায়। তিনিও তবে সুন্দরীই ছিলেন।

শ্রীমতী মায়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে—আম্মা। মা বলেন—তুই এত সুন্দরী হলি কি করে? —তুমিই জান। আমি যে তোমার মেয়ে। –তোর খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না?

-কেন?

–তোকে ওভাবে রেখেছিলাম।

মা কেঁদে ফেলেন। শ্রীমতী তাঁকে চেপে ধরে বলে—থাক্, পরে শুনবে। আমার কোনো কষ্ট হয়নি আম্মা।

এবারে বাসন্তী গলা ছেড়ে বলে ওঠে—তুমি ঠিক বলেছ কাকিমা, ও খুব সুন্দরী হয়েছে। ও ভালো বৈদ্য হয়েছে। ও না এলে তুমি ভালো হতে না। সবাই জেনে গিয়েছে। আজও রোগী এসেছে।

মা কোনোরকমে কান্না চেপে বলেন—সত্যি? ওর স্বামীরও শুনলাম নাম-ডাক আছে। কি যেন করে, ভুলে গিয়েছি।

বাসন্তী বলে-অমরু শতকের কবি।

কথাটা শুনেই শ্রীমতীর মন খারাপ হয়ে গেল। স্বামী চলে যাবেন বলছেন।

মা বলেন—এত অল্প বয়স।

শ্রীমতী স্বামীর খ্যাতির কথা না বলে থাকতে পারে না। বলে—হ্যাঁ, উনি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সভাকবি।

অমরু সংকুচিত হয়। শ্রীমতীর মুখে তার সম্বন্ধে এভাবে বলতে শোনেনি। তারপরে শ্রীমতী যা করে বসল তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের হাত ধরে বলে—তুমি ওকে যেতে দিও না আম্মা ও কিছু জানে না। আমি না থাকলে খাওয়াও হবে না।

বাসন্তী মজা পায়। সে বলে—সে কি রে খিদে পায় না?

–সে বোধও নেই। আমি যা দি, তাই খায়।

সবাই এবার অমরুর দিকে তাকায়। এমন মানুষ তারা জন্মে দেখেনি।

শ্রীমতী মাকে বলে—তুমি ওকে যেতে মানা কর আম্মা।

সবার মুখে এবারে হাসি ফুটে ওঠে। অমরু কল্পনাও করতে পারেনি এমন পরিস্থিতির মধ্যে তাকে পড়তে হবে। কি করবে এখন? ছুটে তো চলে যেতে পারে না। সে শ্রীমতীর মাকে বলে—ও মিছিমিছি ভাবে। আমি অত ভুলি না।

শ্রীমতী বলে ওঠে—আম্মা ওকে তুমি জান না। আমি না থাকলে ও না খেয়ে থাকবে। আমি ঠিক জানি। তুমি একটু ভালো হলে তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু নাড়ি দেখে বুঝলাম আরও ছ—দিন না গেলে তুমি যেতে পারবে না।

মায়ের খুব আনন্দ হর। গুরুদেব ক্রিয়াশক্তিকে মনে মনে প্রণাম জানান তিনি। এমন ষোলকলা পূর্ণ হবে তাঁর স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। কি করে সম্ভব হল, তিনি পরে নিজে জানবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি কি করে সামলাবেন?

বাসন্তী বলে ওঠে—বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস তুই শ্রী। তুই যতই চিকিৎসা করিস, তোর চেয়ে ওঁর জ্ঞান অনেক বেশি, দেখলেই বোঝা যায় ৷

—তুই বুঝবি না বাসন্তী। সেটিই তো হয়েছে মুশকিল। খাওয়ার কথা মনেই থাকে না। আমি ওকে একা ছেড়ে দিতে পারব না।

সবাই মজা দেখছে। মা অসহায়। এবারে অমরু নিজেই শ্রীমতীকে বলে— আমি তবু সাবালক। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি ছোট্ট মেয়ে।

মা বলেন-আমারও তেমনই মনে হচ্ছে।

অমরু বলে—আমার জন্য ওর এত দুশ্চিন্তার কারণই নেই। ওর সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী আমার বন্ধুর স্ত্রী। আমার বন্ধু বিজয়নগরের খুব কাছের একটি রাজ্যের সামন্ত রাজা। সে প্রতিদিন নিজে এসে আমার খোঁজ নেয়। ওর স্ত্রীও অনেক সময়ে সঙ্গে আসেন। ওকে জিজ্ঞাসা করুন, সত্যি বলছি কিনা।

শ্রীমতী বলে—হ্যাঁ, হ্যাঁ সব সত্যি। তুমি মিথ্যা বল না, সবাই জানে ৷ রাজাও জানেন।

—তাহলে?

বাসন্তী খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে—এবারে বুঝেছি কাকিমা।

-কি?

—মেয়ে স্বামীকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকতে পারে না। এ হল ওর ছুতো। শ্রী

মতীর মুখ’রাঙা হয়ে ওঠে।

মা হেসে বলেন—ও।

অমরু অপ্রস্তুত। সে বলে—না না, তেমন কিছু নয়। আমি তো জানি না। বাসন্তী বলে ওঠে—আপনি কিছুই বোঝেন না। দরকারও নেই। আপনি বরং কবিতা লিখুন। তাতে দশের উপকার।

সবাই হেসে ওঠে।

একজন অসুস্থ ব্যক্তি ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে বলে ওঠে—আর তো পারি না। কতক্ষণ অপেক্ষা করব? আমার পেটের ব্যথা শুরু হয়েছে রোজকার মতো।

শ্রীমতী তার মুখের দিকে চেয়ে বলে—কতক্ষণ খাওয়া হয়নি।

—সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি।

—সঙ্গে খাবার আছে?

—তা আছে। তোমাকে দেখিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় খাব।

—এখনি খেয়ে নিন, ব্যথা থাকবে না। আপনার না খেয়ে থাকা চলবে না। কোনো অসুখ নেই

একথা শুনে সবাই অবাক। দেখা গেল, খাওয়ার পর সত্যই ব্যথা কমে গেল। সে বলে ওঠে—তুমি মা ধন্বন্তরী।

শ্রীমতী হেসে বলে—ধন্বন্তরী নই। আমি নুটি গাঁয়ের মেয়ে শ্রী। আপনি কখনো বহুক্ষণ খালি পেটে থাকবেন না। নাড়িতে ঘা হবে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *