৬. কলেজজীবন : ১৯৫৯-১৯৬১

ষষ্ঠ অধ্যায় – কলেজজীবন : ১৯৫৯-১৯৬১

ঢাকা কলেজ

প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য নবীনগরের বাইরে যেতে হয়। নবীনগরে তখন কোনো কলেজ ছিল না। এ সময়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আমাকে সহায়তা করেন সনাতনদা। সনাতন সাহা আমার বড় চাচা ফজলে আলী খাঁর মুহুরি ছিলেন। পরে তিনি সমবায় বিভাগে কাজ করেন। বড় চাচা নবীনগর সমবায় ব্যাংকের সম্পাদক ছিলেন। বড় চাচা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা সমবায় ব্যাংকের সম্পাদক হন। সনাতনদা বাবার সঙ্গেও কাজ করেন এবং তারপর সমবায় বিভাগে পদোন্নতি পেয়ে নবীনগরের বাইরে চলে যান। কিন্তু সনাতনদা আমৃত্যু আমাদের পরিবারের সব সদস্যের খোঁজখবর নিতেন এবং সবাইকে তাঁর ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। আমরা যেসব আত্মীয়স্বজনকে চিনতাম না, সনাতনদা তাঁদেরও চিনতেন এবং তাঁদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতেন। শুধু আমাদের পরিবারেরই নয়, সমবায় বিভাগের উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সনাতনদা যখন সমবায় বিভাগের থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা, তখন সমবায় বিভাগের সারা প্রদেশের নিবন্ধক ছিলেন সলিমুল্লাহ ফাহমি নামের একজন জ্যেষ্ঠ সিএসএস কর্মকর্তা। তার গুণাবলির পরিচয় পেয়ে সলিমুল্লাহ ফাহমি অনেক বিষয়ে তার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। আমরা যে রকম তাঁকে সনাতনদা বলে ডাকতাম, তেমনি সলিমুল্লাহ ফাহমির ছেলেমেয়েরাও তাঁকে সনাতনদা বলে ডাকতেন।

সৌভাগ্যবশত আমার প্রবেশিকা পরীক্ষা যখন শেষ হয়, তখন ঢাকায়। আমার চাচাতো ভাইদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে। শকুদা তখন মেজর হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন এবং খুলনায় একটি জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন। আরেক চাচাতো ভাই মন্টুদা (মোস্তাফিজুর রহমান খান) তখন ঢাকার এডিশনাল এসপি। মিল ব্যারাকে থাকতেন এবং তার আম্মা তার সঙ্গে থাকতেন। তাঁর ছোট ভাই শহীদদা (আমান উল্লাহ খান) এসো (Esso) নামক একটি তেল কোম্পানির কোভিন্যানটেড অফিসার হিসেবে কাজ করতেন এবং বকশীবাজারে সস্ত্রীক সংসার পেতে বাস করতেন। সবচেয়ে ছোট ভাই ঝুনুদা (আহসান উল্লাহ খান) তখন বিলাত যাওয়ার বৃত্তি পেয়ে গেছেন এবং বিলাত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বড় ভাই শকুদা ছাড়া আর চার ভাই দ্বিতীয় ভাই আনুদার সঙ্গে জয়কালী মন্দিরে এক বাড়িতে থাকতেন। প্রত্যেক ভাই আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আনুদা জয়কালী মন্দিরের বাড়ি ছেড়ে এলিফ্যান্ট রোডের রওশন মঞ্জিল নামে একটি একতলা বাড়িতে চলে আসেন। এই একতলা বাড়িতে একটি শোবার কক্ষ আর একটি ড্রয়িংরুম ছিল। শোবার কক্ষে আনুদা, ভাবি ও তাদের একমাত্র ছেলে লুডু থাকত আর ড্রয়িংরুমে আমি থাকতাম। রান্নাঘরের পাশে একটু জায়গা ছিল, যেখানে আমার পড়ার টেবিল এবং বইপত্র রাখা হতো। সনাতনদা-ও তখন অবসর গ্রহণ করে আনুদার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আনুদা তখন গণস্বাস্থ্য বিভাগে নলকূপের ‘বাকেট’ (Bucket) সরবরাহ করতেন। এই বাকেট সরবরাহ করার জন্য আনুদার বাসা থেকে সামান্য দূরে একটি টিনের ঘরে বাকেট কারখানা স্থাপন করা হয়। সনাতনদা সেই কারখানাতেই থাকতেন। তবে আমরা সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতাম।

প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সনাতনদা আমাকে ঢাকায় আনুদার বাসায় নিয়ে যান। এলিফ্যান্ট রোডের কাছেই ছিল ঢাকা কলেজ এবং কলেজ হিসেবে সেটি তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে সুপ্রতিষ্ঠিত। তখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া সহজ ছিল। বিজ্ঞান বিভাগে যারা প্রথম শ্রেণিতে প্রবেশিকা পাস করত, তাদের ভর্তি ছিল নিশ্চিত। কলা এবং বাণিজ্য বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে যারা নম্বর পেত, তাদের সহজেই ভর্তি করা হতো। নবীনগর স্কুল থেকে আমার সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে আমার বন্ধু মোজাম্মেল হক। সে-ও ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হয়।

আমার মা আমার কলা বিভাগে পড়ার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন আমি বিজ্ঞান পড়ে হয় প্রকৌশল, নয় চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করি। কিন্তু কলা বিষয় পড়ার জন্য আমার আগ্রহের ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর আপত্তি প্রত্যাহার করেন। তখন কলা বিভাগের ১০টি পত্র ছিল বাধ্যতামূলক। দুটি পত্র বাধ্যতামূলক বাংলা, দুটি পত্র বাধ্যতামূলক ইংরেজি। ছাত্ররা পছন্দমতো তিনটি বিষয় বেছে নিত। আমি বেছে নিয়েছিলাম তর্কশাস্ত্র বা লজিক, ইতিহাস, পৌরনীতি এবং অর্থনীতি। আরেকটি বিষয় বাধ্যতামূলক ছিল না, তবে ওই বিষয়ে যে নম্বর পাওয়া যেত, তা থেকে ৬০ নম্বর বাদ দিয়ে বাকি নম্বর মোটের সঙ্গে যোগ করা হতো। এর ফলে যারা বাধ্যতামূলক বিষয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির নম্বর পেত না, তারা এ অতিরিক্ত নম্বর যোগ করে উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারত। অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে আমি বেছে নিই বাংলা সাহিত্য।

ঢাকা কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী

১৯৫৯ সালে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এম ইউ আহমদ বা মোফাসসল উদ্দিন আহমদ। তিনি একজন মনস্তত্ত্ববিদ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ পাস করার পর তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া পাগলদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি অবসর সময়ে পাগলদের চিকিৎসা করতেন। তিনি Hypnosis বা সম্মোহন করতে পারতেন। ঢাকা কলেজে নতুন ক্যাম্পাসে তখনো অধ্যক্ষের বাড়ি নির্মাণ করা হয়নি। তাই তিনি মূল ভবনে শিক্ষকদের কমন রুমের পাশে তিনটি রুম নিয়ে থাকতেন। কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন শফিকুর রহমান। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন। পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে তার একটি বই বিএ ক্লাসের ছেলেরা পড়ত। তিনি ক্লাসে পড়াতেন না। প্রশাসনের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

ঢাকা কলেজে তখন বাংলা বিভাগ খুবই শক্তিশালী ছিল। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন সৈয়দ হিসামুদ্দিন আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি খুবই হাস্যরসিক ছিলেন, রসাত্মক গল্প বলে ক্লাসের সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। নিজামউদ্দিন আহমদ পড়াতেন বাংলা কথাসাহিত্য। পড়াতেন ভালো, তবে গাম্ভীর্যের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন না। এই সময়ে ঢাকা কলেজে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বদলি হয়ে আসেন শওকত ওসমান। শওকত ওসমান আমাদের শরৎচন্দ্রের দত্তা পড়াতেন। বাংলা সাহিত্য কোর্সে তিনি আবুল ফজলের চৌচির পড়াতেন। শওকত ওসমান বইগুলোর কোনোটিই ভালো করে পড়াতেন না। বইগুলোর সামাজিক বিশ্লেষণ করতেন। এর ফলে সবাই তার বক্তৃতায় উপকৃত হতো না। তবে আমার কাছে তার পড়ানো ভালো লাগত। কবিতা পড়াতেন আবদার রশীদ। তিনি ছন্দ খুব ভালো বুঝতেন। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরে বাংলা বিভাগে যোগ দেন অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী আমাকে মানসী কাব্যগ্রন্থ পড়ান। তিনি অত্যন্ত চমৎকার শিক্ষক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের খণ্ড ও অখণ্ড সৌন্দর্যের ধারণা নিয়ে তিনি ‘সুরদাসের প্রার্থনা’, ‘অনন্ত প্রেম’ এবং ‘মেঘদূত’ কবিতা সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তা আজও আমার মনে আছে। আশরাফ সিদ্দিকীর কাছে পড়ার ফলেই আমি রবীন্দ্রসাহিত্যে আরও অনুরক্ত হয়ে পড়ি। ওই সময়ে ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রথম মহিলা শিক্ষক রওশন আরা রহমান যোগদান করেন। তাঁর কাছে আমি বাংলা টিউটোরিয়াল করেছি।

তর্কশাস্ত্র আমাদের পড়াতেন দুজন শিক্ষক। আবদুল ওহাব পড়াতেন অবরোহ তর্কশাস্ত্র (deductive logic) এবং আবদুল মান্নান পড়াতেন আরোহ তর্কশাস্ত্র (inductive logic)। দুজনই ভালো পড়াতেন, তর্কশাস্ত্রের অনেকগুলো পদ্ধতি যে অন্যান্য শাস্ত্রেও ব্যবহৃত হতো, তাই এ শাস্ত্র পড়ে আমি আনন্দ পাই। আইএ পরীক্ষার ফলও ভালো হয়েছিল। আমি ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে তর্কশাস্ত্রে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাই।

ইতিহাস বিভাগে দুজন শিক্ষক ছিলেন। একজনের নাম নুরুল করিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান। কিন্তু তখন সরকারি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে বেতনের হার ছিল বেশি। তাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সরকারি কলেজে চলে আসেন। ইতিহাসের অনেক বই তাঁর মুখস্থ ছিল। কোরআন তিলাওয়াতের মতো ক্লাসে গলগল করে তিনি এসব বই থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে পড়াতেন। তিনি ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা ছাড়াও ঢাকা কলেজের দক্ষিণ ছাত্রাবাসের দায়িত্বে ছিলেন। অনেক ছাত্র যথাসময়ে হোস্টেলের টাকা শোধ করত না। এতে তার প্রায়ই অসুবিধা হতো। সে জন্য যখনই কোনো ছাত্রের সঙ্গে তার দেখা হতো (তা কলেজের ভেতরেই হোক বা নিউমার্কেটে হোক), প্রথমেই তিনি প্রশ্ন করতেন, ‘তোমার বাবা কেমন আছেন? বেশির ভাগ ছাত্রের বাবাই তার ছাত্র ছিলেন। ছাত্র উত্তর দিত, বাবা ভালো আছেন। তারপরে বলতেন, পড়াশোনা ঠিকমতো করো, পড়াশোনায় কিন্তু ফাঁকি দিলে চলবে না। তারপর যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করতেন, বাবা, হোস্টেল ডিউজ ক্লিয়ার আছে তো?’ এ হোস্টেল ডিউজের প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের এক সহপাঠী বলেছিল, ‘স্যার, নিউমার্কেটেও কি হোস্টেল ডিউজের প্রশ্ন করতে হয়? অধ্যাপক মাহবুবুল করিম আমাদের প্রাচীন সভ্যতা’ পড়াতেন। প্রাচীন নামসমূহ তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করতেন। এ ব্যাপারে অনেকে তাঁকে পেছন থেকে ভেংচাত। পরবর্তীকালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বাংলাদেশে প্রায় পনেরো বছরের বেশি সময় সরকারি মহাফেজখানার পরিচালক ছিলেন।

পৌরনীতিতে আমাদের দুজন শিক্ষক ছিলেন। সৈয়দ আহমদ বেশ ভালো পড়াতেন। পরবর্তীকালে তিনি সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন সালেহ আহমদ। তিনি জোরে পড়াতে পারতেন না, এর ফলে কোনো কোনো সময় ছাত্ররা তার ক্লাসে গন্ডগোল করত। অর্থনীতির দুজন শিক্ষক ছিলেন। গোলাম রহমান ছিলেন মেধাবী ছাত্র এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ইপিসিএসে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরির কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাই তিনি প্রশাসন থেকে শিক্ষকতায় চলে আসেন। দৃষ্টিশক্তির অসুবিধা সত্ত্বেও তিনি প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসতেন এবং এর ফলে তার পড়াতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আরেকজন অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন বরিশালের ইমদাদুল হক। মজুমদার। তিনি পরবর্তীকালে বিএম কলেজে অনেক দিন অধ্যক্ষ পদে কাজ করেছেন। তিনি ইংরেজি ইফ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতেন না। তিনি ইফকে বলতেন এফ। ছাত্ররা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।

ইংরেজি বিভাগে বেশ কয়েকজন অধ্যাপক ছিলেন। সর্বজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন আবু রুশদ মতিন উদ্দিন আহমদ। তিনি বাংলায় বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন। আমাদের তিনি ইংরেজি কবিতা পড়াতেন। বিশেষ করে ‘The Rhyme of the Ancient Mariner’ নামে কবিতাটি আমাদের অনেক যত্ন নিয়ে পড়িয়েছেন। ইংরেজির আরেকজন শিক্ষক ছিলেন সৈয়দ রফিকউদ্দিন আহমদ। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে কিছুটা জড়তা ছিল। এ নিয়ে ছাত্ররা হাসাহাসি করত। আরেকজন উর্দুভাষী ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মোটামুটি ভালোই পড়াতেন, তবে তাকে নিয়ে ১৯৬০ সালের আইএ পরীক্ষায় একটি বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। ১৯৬০ সালে তার ছেলে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেয়। সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক ইংরেজিতে আইএ পরীক্ষার প্রশ্নকর্তা ছিলেন তিনি। তার ছেলের কাছে তিনি প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়েছেন–এ রকম একটি গুজব ছিল। কোনো কোনো ছাত্র তাঁর ছেলের সঙ্গে সুসম্পর্ক করে প্রশ্ন ফাঁস করে দেয় বলে বাজারে গুজব রটে যায়। এই গুজব যখন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, তখন তারা ঢাকা কলেজের সমস্ত ইংরেজির খাতা একজন বিশেষ পরীক্ষককে পরীক্ষা করতে দেন। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন খাতাগুলোকে সর্বোচ্চ মানের দিক থেকে বিচার করা হয়। ঢাকা কলেজ থেকে সে বছর প্রায় দেড় শ ছাত্র আইএ, আইএসসি এবং আইকম পরীক্ষা দেয়। তার মধ্যে মাত্র ১০ জন ইংরেজিতে পাস করে। আর বাকি সবাই অল্প নম্বরের জন্য ফেল করে। যারা সর্বমোট দ্বিতীয় শ্রেণির নম্বর পেয়েছে, তাদের মোট নম্বর থেকে নম্বর কেটে ইংরেজিতে তাদের পাস করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা পরীক্ষায় যে স্থান পাওয়ার কথা সে স্থান পায়নি। আমাদের আগের বছর রাশেদ খান মেনন ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সর্বমোট নম্বরের ভিত্তিতে তিনি আইএ পরীক্ষাতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ২ নম্বরের জন্য ইংরেজিতে তিনি ফেল করাতে তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস ঘোষণা করা হয় এবং চতুর্থ স্থান তাঁকে দেওয়া হয়নি।

ঢাকা কলেজে তিনজন তরুণ ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। মাসুদ আহমদ দুই বছর চাকরি করে পরবর্তীকালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন। এনামুল করিম, তিনিও পিএফএসের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু চোখের ত্রুটির জন্য তাঁকে পিএফএসে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। রুহুল আমিন মজুমদার নামের আরেকজন ইংরেজির শিক্ষক পুলিশ সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন। পরে পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি বাংলাদেশ টোব্যাকোতে ব্যবস্থাপক পদে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ভালো বইয়ের সন্ধান

প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফল আশানুরূপ না হওয়ায় আমি আইএ পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উচ্চ স্থান অধিকার করব–এ ধরনের কোনো বাসনা নিয়ে লেখাপড়া করছিলাম না। কিন্তু ঢাকা কলেজে আসার পর পড়াশোনায় আমার আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। নবীনগর স্কুলে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন যথেষ্ট পড়ার বই পেতাম না। ঢাকা কলেজের ছাত্র হওয়ার পরে দেখলাম যে পড়ার। বইয়ের কোনো অভাব নেই। ঢাকা কলেজের পাঠাগার তখন প্রায় ৯০ বছরের পুরোনো। পাঠাগারের জন্য প্রতিবছরই সরকার থেকে মঞ্জুরি দেওয়া হতো। এর ফলে সব বিভাগেই প্রচুর বই ছিল। এই পাঠাগারেই আমি Bury-এর লেখা প্রাচীন গ্রিস সম্বন্ধে বই পড়ি, মমসনের প্রাচীন রোমের ইতিহাস পড়ি, বার্নসের ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশন সম্পর্কে বই পড়ি, হেগেনের ফরাসি বিপ্লবোত্তর আধুনিক ইউরোপ সম্পর্কে ও হেইজের আধুনিক ইউরোপ সম্পর্কে বই পড়ি। তেমনি বাংলায় প্রচুর উপন্যাস এবং কবিতার বই পড়ি।

পাঠাগার থেকে আমরা একসঙ্গে দুটি বই ধার করতে পারতাম। তবে ঢাকা কলেজে আমার কোনো দিনই পরপর দুটি ক্লাস ছিল না। দুটি ক্লাসের মধ্যে ফাঁক থাকত। এই ফাঁকের সময়টুকুতে আমি পাঠাগারে বসে পড়াশোনা করতাম। যেহেতু পাঠাগারের কর্মচারীরা আমাকে চিনত, তাই তারা মূল পাঠাগারে বই পড়তে আমাকে কোনো বাধা দিত না। এভাবে বই পড়তে পড়তে একদিন দৈনিক আজাদ-এর একটি বাঁধানো ঈদসংখ্যা আমার নজরে আসে। সেখানে দেখতে পাই আমার শিক্ষক শওকত ওসমানের লেখা জননী নামক উপন্যাস। উপন্যাসটি পড়ে আমার ভালো লাগে। একদিন ক্লাসে আলোচনা করার সময় আমি শওকত ওসমান স্যারকে জিজ্ঞেস করি, ‘তাঁর জননী উপন্যাসটি বাজারে পাওয়া যায় কি না?’ শওকত ওসমান বললেন, ‘না, এই বই প্রকাশ করতে পারিনি। আজাদ পত্রিকায় উপন্যাস প্রকাশের পরই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এই উপন্যাসের কোনো কপিও আমার কাছে নেই।’ আমি বললাম ঢাকা কলেজ পাঠাগারে এর একটি অনুলিপি আছে। শুনে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, ‘বাবা, আমাকে দেখাও কোথায় ওই বই আছে।’ আমি তাকে পাঠাগারে নিয়ে যাই এবং সেখানে গিয়ে তিনি পত্রিকাটি নিজের নামে ইস্যু করে নেন। কয়েক বছর পর জননী উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

কলেজ যখন খোলা থাকত, তখন কলেজের পাঠাগারে পড়াশোনা করতাম। কলেজ যখন বন্ধ থাকত, তখন পড়তে যেতাম কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। তখন সবেমাত্র কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি চালু হয়েছে। সেখানে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার একটি সেট ছিল। যখনই কোনো কিছু জানতাম না, তখনই সে সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে খোঁজ করতাম। তা ছাড়া ওই পাঠাগারে অক্সফোর্ডের মূল ইংরেজি অভিধান ছিল। সুতরাং কোনো শব্দের অর্থ জানতে হলে অভিধান বের করে দেখে নিতাম। ওই পাঠাগারে পাকিস্তানের ওপর অনেক ভালো বই ছিল। সেসব বই ব্যবহার করে আমি পৌরশাস্ত্রের বিভিন্ন প্রশ্নের ওপর নোট তৈরি করি।

এ ছাড়া যখন রোজার ছুটি হতো, তখন আমি ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন বিভাগ পরিচালিত জিন্নাহ অ্যাভিনিউয়ে তাদের পাঠাগারে পড়তে যেতাম। সেখানে বিশেষ করে সুকুমার সেনের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং বাংলা উপন্যাসের ধারা সম্পর্কে শ্রীকুমার চক্রবর্তীর একটি বই পড়ে উপকৃত হই।

এই সময়ে আমি বই কেনা শুরু করি। আমি বিভাগীয় বৃত্তি মাসে ১০ টাকা করে পেতাম। উপরন্তু আমার বড় বোন বীণা আপা খুলনা থেকে আমাকে মাসে ১০ টাকা মানি অর্ডার করতেন। এই ২০ টাকা দিয়ে মাসে আমি অনেক বই কিনতে পারতাম। তখন মহিউদ্দিন অ্যান্ড সন্সের পেঙ্গুইন এবং পেলিকেনের প্রকাশিত অনেক বই সস্তায় কিনতে পাওয়া যেত। আমার মনে আছে মহিউদ্দিন অ্যান্ড সন্স থেকে টি এস ইলিয়টের একটি সমালোচনা গ্রন্থ মাত্র দেড় টাকায় কিনি। এই বইয়ের বর্তমান মূল্য কমপক্ষে চার-পাঁচ শ টাকা হবে। এ ছাড়া তখন অনেক বাংলা সিনে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হতো উল্টোরথ এবং সিনেমা জগৎ। পূর্ব পাকিস্তান। থেকে প্রকাশিত হতো সচিত্র সন্ধানী। এসব পত্রিকা আমি কিনতাম এবং গোগ্রাসে গিলতাম। অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তবে বিশেষ কোনো বিষয়ের ওপর সেটি কেন্দ্রীভূত হয়নি।

আইএ পরীক্ষার ফলাফল

আইএ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছি এবং স্টার মার্ক পেয়েছি। এই স্টার মার্ক পাওয়া ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের পূর্ববর্তী বছরে যিনি আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, তিনি স্টার পাননি। আমাদের পরবর্তী বছরেও যিনি আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, তিনিও স্টার পাননি। অথচ আমি আইএ পরীক্ষায় স্টারের চেয়ে ১৫ নম্বর বেশি পেয়েছিলাম। আমাদের বছর আইএ পরীক্ষায় প্রথম হন আবু আহমদ আবদুল্লাহ। তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করে ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। ইংরেজিতে তার ভালো দখল ছিল এবং ইংরেজি পরীক্ষায় আমার চেয়ে প্রায় ৩০ নম্বর বেশি পান। এর ফলে আমি ৭ নম্বর কম পেয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করি। আমি বাধ্যতামূলক ইংরেজি এবং বাংলায় খুব ভালো নম্বর পাইনি। এ দুটি বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ও কবিতা বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয়েছে। তবে সব প্রবন্ধ আমার ভালো লাগেনি। তাই সেগুলো আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। আমি ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাই। ইতিহাস প্রথম পত্রে আমি ৭৫ নম্বর এবং দ্বিতীয় পত্রে ৮৩ নম্বর পাই। সাধারণত ইতিহাসে ৮০ শতাংশ নম্বর দেওয়া হতো না, আমিও পাইনি। দুটি পত্র মিলিয়ে। পেয়েছিলাম ৭৯ শতাংশ নম্বর। তর্কশাস্ত্রে আমি ৮৫ শতাংশ নম্বর পাই। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর ছিল। পৌরবিদ্যা ও অর্থনীতি দুটি বিষয় নিয়ে একটি পত্র নিয়েছিলাম। পরীক্ষায় পৌরবিদ্যায় খুবই ভালো উত্তর দিয়েছিলাম। ঢাকা কলেজে টেস্টে প্রায় একই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম। আমি আশা করছিলাম যে পৌরনীতিতে হয় লেটার পাব, হয় তার কাছাকাছি নম্বর পাব। অন্যদিকে অর্থনীতিতে আমার পরীক্ষা খুবই খারাপ হয়। পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে দেড়টি প্রশ্ন সম্পর্কে আমার ভালো প্রস্তুতি ছিল। বাকি সাড়ে তিনটি প্রশ্নের উত্তর পরীক্ষার হলে বসে আমি তৈরি করেছি। আমার উত্তর পছন্দ না হলে খুবই খারাপ নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যখন ফল পেলাম, তখন দেখলাম অর্থনীতিতে আমি ৮৩ নম্বর পেয়েছি এবং আরও জানলাম সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি সর্বোচ্চ নম্বর। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জানতে পারি আমার অর্থনীতির পরীক্ষক ছিলেন চৌমুহনী কলেজের অর্থনীতির একজন তরুণ অধ্যাপক। আমার উত্তরে অর্থনীতির প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে সমাজে ধনবৈষম্যের সমস্যাকে বড় করে দেখাই। এটি তার কাছে ভালো লাগে। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন অর্থনীতির প্রধান পরীক্ষক। তিনি নিজে এ খাতা দেখেছেন এবং তার কাছেও উত্তর ভালো লেগেছিল। অথচ পৌরনীতিতে ভালো উত্তর দিয়েও কেন মাত্র ৫৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম, সেটা আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। একটি কারণ হয়তো হতে পারে, সে বছর যদি ঢাকা কলেজের কোনো শিক্ষক প্রশ্ন করে থাকেন এবং প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কোনো গুজব রটে থাকে, তাহলে সে বছরের পৌরনীতির খাতা হয়তো বিশেষভাবে দেখা হয়ে থাকতে পারে। এখানে উল্লেখযোগ্য, শুধু আমিই নই, ঢাকা কলেজের আইএ ক্লাসের কোনো ছাত্রই পৌরনীতিতে ভালো নম্বর পায়নি। কারণ যা-ই হোক না কেন, পৌরনীতির নম্বরে আমি হতাশ হই এবং পরবর্তীকালে সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান না পড়ে সমাজবিজ্ঞান পড়ি।

১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা কলেজের ফলাফল ছিল খুবই ভালো। আইএ পরীক্ষায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে ৬ জনই ছিল ঢাকা কলেজের। প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আবদুল্লাহ, দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম আমি, তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন শাহ মোহাম্মদ ফরিদ, চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন মিজানুর রহমান, নবম স্থান অধিকার করেছিলেন ফজলুল হক এবং দশম স্থান অধিকার করেছিলেন এ কে নাসিমুল কামাল। আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে চারটি স্থান পায় ঢাকা কলেজ। আইকম পরীক্ষায় প্রথম ১০টি স্থানের মধ্যে দুটি স্থান পায় ঢাকা কলেজ।

পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম

ঢাকা কলেজে লেখাপড়া ছাড়াও আমি বিভিন্ন কো-কারিকুলার বা পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, গল্প বলা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। এতে ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে আমার পরিচিতি বেড়ে যায়।

ঢাকা কলেজে ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রের অনুসরণে কলেজ ইউনিয়নে বুনিয়াদি গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক ক্লাস থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নির্বাচন করা হতো এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কলেজ ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে নির্বাচন করতেন। আমি অতি সহজেই আইএ ক্লাসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হই। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদকের জন্য নির্বাচনে অংশ নিই। এখানেও আমি নির্বাচিত হই। এই সময়ে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় জমির আলীর সঙ্গে। জমির আলী একজন এনএসএর নেতা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সদস্য হয়েছিলেন। কলেজের সংসদের মধ্যে জমির আলীর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাঁর সমর্থন নিয়ে আমি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করি। তখন কলেজে আমি দুটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করি। একটি অনুষ্ঠান ছিল মিলাদ মাহফিল, আরেকটি অনুষ্ঠান ছিল আল্লামা ইকবালের মৃত্যুবার্ষিকী। মিলাদ মাহফিলে প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমি অধ্যক্ষের চিঠি নিয়ে ড. শহীদুল্লাহর পুরান ঢাকার বাসায় দেখা করতে যাই। দরজার ঘণ্টা বাজালে ড. শহীদুল্লাহ নিজেই বেরিয়ে আসেন। তাকে ঢাকা কলেজে মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি রাজি হন। তবে একটি শর্ত প্রদান করেন। তিনি বলেন যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেন কিন্তু ছাত্ররা সেই বক্তৃতা কিছুই মনে রাখতে পারে না। তাই তিনি কিছু সহি হাদিসের বাংলা অনুবাদ করেছেন। এই অনুবাদগুলো ছাত্রদের মধ্যে যদি বিতরণ করা হয়, তাহলেই তিনি যাবেন। তবে এ হাদিসগুলোর অনুবাদ তিনি নিজেই ছাপিয়েছেন এবং প্রতিটি বইয়ের হাদিয়া হলো আট আনা। সুতরাং তাঁকে ৫০টি হাদিসের বই কিনে ২৫ টাকা দিতে হবে। তখন সাংস্কৃতিক সপ্তাহ চলছিল এবং আমাদের প্রচুর বই কেনার বাজেট ছিল। আমি হিসাব করে দেখলাম ৫০টি পুরস্কারের সঙ্গে একটি করে তার অনূদিত হাদিসের বই দিয়ে দিলে কোনো অসুবিধা হবে না। তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম। মিলাদের নির্ধারিত দিনে আমার এক বন্ধুকে তাকে ঢাকা কলেজে নিয়ে আসার জন্য পাঠাই। তিনি যথাসময়ে আসেন। তার বক্তব্যে তিনি ধর্মকর্মের চেয়ে ছাত্রদের আধুনিক জীবনযাত্রার তীব্র সমালোচনা করেন। বিশেষ করে টেডি প্যান্ট পরা ছাত্রদের কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করেন।

পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ইকবাল সম্পর্কে অনুষ্ঠানে কিছু বলার জন্য প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবকে। তিনি তখন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট। তার বাড়িতে তাঁকে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন। তবে আমরা যখন ফিরে আসছিলাম, তখন আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে তার বাড়ির আশপাশে যেসব ঝোঁপঝাড় রয়েছে, সেসব জায়গায় পাকিস্তানি গোয়েন্দায় ভরে আছে। তিনি আমাদের পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেন। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনি শাহাদতবরণ করেন।

জমির আলী ঢাকা কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে রাজনীতিতে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায় যে লেখাপড়া কিছুই করেনি। এর ফলে পরীক্ষা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে আমার কাছে পরামর্শ চায়। আমি তাকে বলি রাজনীতি করতে হলে তার পক্ষে আইএসসি পড়া সম্ভব নয়। সুতরাং তাকে আইএ পড়তে হবে। আইএ পড়তে হলে সে যত শীঘ্র সম্ভব অন্য কলেজে আইএ দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলে এক বছর পরই পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হতে পরামর্শ দিই। আমার পরামর্শ অনুসারে সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে পরের বছর প্রথম বিভাগে আইএ পাস করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়।

ঢাকা কলেজ ইউনিয়নের মন্ত্রিসভার আরেকজন সদস্য ছিলেন খন্দকার শহিদুর রব। ঢাকা কলেজে যখন রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয়, তখন দুই কবির গান নির্বাচন এবং উপস্থাপনের জন্য বক্তব্য রচনা করি আমি ও শহিদুর রব। আমি নজরুলগীতি সম্পর্কে লিখি এবং রবীন্দ্রসংগীত সম্বন্ধে লেখেন শহিদুর রব। বর্তমানে শহিদুর রব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন।

নতুন বন্ধু

ঢাকা কলেজে আমার অনেক নতুন বন্ধু হয়। প্রথমে যার নাম উল্লেখ করতে হয়, সে হলো মরহুম কাজী মতলুব হোসেন। মতলুব এলিফ্যান্ট রোডে আমাদের প্রতিবেশী ছিল। শুধু তাই নয়, সে ছিল আমার ভাবির ফুফাতো বোনের ছেলে। ক্রিকেট খেলায় তার নেশা ছিল। দেশে রাজনীতি নিয়েও সে আলোচনা করতে ভালোবাসত। পরে ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, তখন মতলুব সলিমুল্লাহ হলে অনাবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়। আমি তখন সলিমুল্লাহ হলে আবাসিক ছাত্র। কাজেই এই নিবিড় সম্পর্ক পরবর্তী চার বছর ধরেও চলে। এরপর দুই বছর সে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস পড়ার জন্য বিলাত যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। সে সময়ে আমি সিভিল সার্ভিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এই সময়ও আমাদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল।

কলেজ হোস্টেলেও অনেক বন্ধু ছিল। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় আসেন মিজানুর রহমান। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ভালো জমে ওঠে। আনিসুর রহমান নেত্রকোনা থেকে প্রবেশিকা পাস করে আসে। তার সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজন ছাত্র ছিল অনাবাসিক। ফজলুল হক চাঁদপুরের ছেলে–ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় থাকত। নাসিমুল কামালের বাবা ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তখন তিনি ঢাকায় পদস্থ। নাসিমুল কামাল। বাড়ি থেকে কলেজে আসত। কামাল ও ফজলুর সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিশেষ করে ফজলুকে আমি খুবই পছন্দ করতাম। নবীনগর স্কুল থেকে। আমার সহপাঠী মোজাম্মেল হকও ঢাকা কলেজের আবাসিক ছাত্র ছিল। তার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

আইএ ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীর মধ্যে ছিলেন হুজ্জতুল ইসলাম লতিফি (তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন এবং বর্তমানে গ্রামীণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক), আবু আহমদ আবদুল্লাহ (বিআইডিএসের মহাপরিচালক হয়েছিলেন), শাহ মোহাম্মদ ফরিদ (পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হয়েছিলেন), আনিসুজ্জামান (তিনি পাকিস্তান। অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট সার্ভিসের সদস্য ছিলেন এবং ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন), নুরুজ্জামান (তিনি সেনাবাহিনীর শিক্ষা কোরের কর্নেল ছিলেন এবং কয়েকটি ক্যাডেট কলেজ ও রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন), মোক্তাদির এবং আবদুল মোতালিব (এরা দুজনই সম্ভবত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন) ও আব্দুল কাইয়ুব ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। নজরুল ইসলাম ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। প্রেম করতে গিয়ে অনার্সের পরে আর পড়াশোনা করেননি। তিনি মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। নাসিমুল কামালও অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে লেখাপড়ার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে নির্বাহী হিসেবে যোগ দিয়ে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। আরেকজন সহপাঠী ছিল নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তার একটি পা খোঁড়া ছিল। সে কলেজে থাকতেই কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিল। তবে উপন্যাসের মান ভালো ছিল না। সর্বদাই সে আমাদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। এয়ারফোর্স থেকে বাদ পড়া শরিফ এসে আমাদের সঙ্গে আইএ ক্লাসে ভর্তি হয়। তবে আমাদের সঙ্গে পাস করেছিল কি না, তা মনে নেই। আইএসসি ক্লাসে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ছাত্ররা ভর্তি হয়েছিল। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল কম। পরবর্তীকালে তৌফিকে এলাহী চৌধুরী (যিনি আইএসসি পাস করে অর্থনীতি পড়েছেন) এবং ফজলুল আজিম (যিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করে এখন একজন বড় শিল্পপতি)–এ রকম কয়েকজনের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। বন্ধুদের সংখ্যা আরও অনেক বাড়ে, যখন সলিমুল্লাহ হলে আমি আবাসিক ছাত্র ছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *