প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

২.৮ মা ॥ কুদরতুল্লাহ শাহাব / শহিদুল আলম

মা ॥ কুদরতুল্লাহ শাহাব / শহিদুল আলম

মা – কুদরতুল্লাহ শাহাব।

মায়ের জন্মতারিখ সঠিক জানা যায়নি।

যে সময় লায়ালপুর জেলায় নতুন আবাদি বসেছিল, পাঞ্জাবের প্রত্যেক গাঁও থেকে ভূমিহীন লোকেরা জমি পাওয়ার আশায় এই নতুন কলোনির দিকে দলে-দলে ছুটে এসেছিল তখন। সাধারণ লোকেরা তখন লায়ালপুর এবং সারগোদা প্রভৃতি অঞ্চল বার এলাকা নামে চিনত। সে সময়ে মায়ের বয়স ছিল দশ-বারো বছর। এই হিসাবে মায়ের জন্মতারিখ গত শতাব্দীর শেষভাগের দশ-পনেরো বছরের যে-কোনো এক সময়ে হয়ে থাকবে।

মায়ের বাপের বাড়ি আম্বালা জেলার রুপোড় মহলকুমার মেনিলা গ্রামে। সেখানে তাদের কিছু জমি-জমা ছিল। তখন রুপোড়ে শ থেকে সেরহিন্দ খাল খনন করা হচ্ছিল। নানাজির জমি পড়ে গেল সেই খালের মধ্যে। রুপোড়ের ইংরেজ কর্তৃপক্ষের দফতর থেকে এ-সব জমির ক্ষতিপূরণ দেয়া হত। নানাজিও দু’-তিনবার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য শহরে গেলেন; কিন্তু সোজা লোক ছিলেন তো, জানতেন না কর্তার। দফতর কোথায় আর ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হলে কী করতে হয়। শেষে খোদাকে শোকর জানিয়ে চুপ করে বসে রইলেন এবং খাল খননে মজুরের কাজ করতে লাগলেন।

এই সময়ে খবর পাওয়া গেল যে, বার এলাকায় নতুন আবাদি হচ্ছে আর বিনামূল্যে জমি দেয়া হচ্ছে নতুন বসতি স্থাপনকারীদের। নানাজি তাঁর স্ত্রী, দুটো ছোট ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে লায়ালপুর রওনা হলেন। যানবাহনের সংস্থান ছিল না, তাই হেঁটেই চললেন।

পথ চলতে কায়িক পরিশ্রম করে পেট চালাতেন। পথে যেতে-যেতে নানাজি এখানে ওখানে কুলির কাজ করতেন কিংবা কারো কাঠ কেটে দিতেন। নানি আর মা কারো সুতো কেটে দিতেন অথবা বাড়ির উঠান, ঘরের দেয়াল লেপে দিতেন। লায়ালপুরের সোজা পথ কারো জানা ছিল না। তাই ঘুরে-ফিরে জিজ্ঞাসাবাদ করে দিনের পথ সপ্তায় অতিক্রম করে চললেন তারা। অবশেষে দেড়-দু’মাস চলার পর তারা জিরানওয়ালায় পৌঁছলেন। একে পায়ে হেঁটে চলা, তার ওপর দৈহিক পরিশ্রম সব মিলে সকলেরই শরীর নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। পা ফুলে উঠেছিল কারো-কারো। ফলে কয়েক মাস তারা এখানে থাকলেন। নানাজি সারাদিন শস্যের গুদামে বস্তা বইতেন, নানি চরকায় সুতো কেটে বিক্রি করতেন। আর মা চালাতেন সংসার–যে সংসার একটা ছোট কুঁড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তখন।

বকরা ঈদের উৎসব এল। নানাজির কাছে টাকা জমেছিল কিছু। তিনি মাকে তা থেকে তিন আনা পয়সা দিলেন। ঈদের উপহার। জীবনে মা এই প্রথম হাতে এত পয়সা পেলেন; অনেক ভাবলেন তিনি। কিন্তু এই পয়সা খরচ করার কোনো উপায় বের করতে পারলেন না। দিনে এক-আধটা রুটিনুন-লঙ্কার চাটনি দিয়ে খাবার ব্যবস্থা থাকলে অতিরিক্ত পয়সার আর দরকার কী? এই প্রশ্নের জবাব সারা জীবনেও মা খুঁজে পাননি। মৃত্যুকালে তার বয়স আশি বছরেরও বেশি হয়েছিল। কিন্তু তখনো একশ’ টাকা, দশ টাকা এবং পাঁচ টাকার নোট তিনি ঠিক চিনে উঠতে পারতেন না।

ঈদ উপলক্ষে পাওয়া তিন আনা পয়সা কয়েকদিন পর্যন্ত মায়ের ওড়নার কোণায় বাধা রইল। যেদিন জিরানওয়ালা থেকে বিদায় হলেন সেদিন মা এগারো পয়সার তেল কিনে মসজিদের চেরাগে ঢেলে দিয়ে এলেন। বাকি পয়সাটা রাখলেন নিজের কাছে। এরপর যখনই তাঁর কাছে পুরো এগারো পয়সা হত অমনি তিনি তেল কিনে পাঠিয়ে দিতেন মসজিদে। জীবনভর তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই নিয়ম পালন করে গেছেন। ক্রমে অনেক মসজিদে বৈদ্যুতিক আলো এল। কিন্তু লাহোর ও করাচির মতো শহরেও কোনো কোনো মসজিদের তেলের প্রদীপ জ্বলত সেকথা জানা ছিল তাঁর। মৃত্যুর রাতেও তার শিয়রে মলমলের রুমালে বাঁধা ছিল কয়েক আনা পয়সা! সম্ভবত এগুলোও তিনি কোনো মসজিদে তেল দেয়ার জন্য রেখেছিলেন। যেহেতু সে রাতও বৃহস্পতিবারের রাত ছিল।

এই কয়েক আনা ছাড়া মায়ের কাছে আর কোনো টাকা-পয়সা বা গয়না ছিল না। সংসারের আসবাবপত্রের মধ্যে যা ছিল তা অতি সামান্য। তিন জোড়া সুতি কাপড়, এক জোড়া দেশি জুতো, এক জোড়া রবারের চপ্পল, একটা চশমা, একটা আংটি–তাতে তিনটে ছোট-ছোট ফিরোজা বসানো, একটা জায়নামাজ, একটা তসবিহ আর বাকি আল্লাহ্ আল্লাহ্।

তিন জোড়া পরিধেয় তিনি বিশেষ যত্নের সঙ্গে রাখতেন সব সময়। এক জোড়া তিনি পরতেন, দ্বিতীয় জোড়া ধুয়ে বালিশের নিচে ভাজ করে রাখতেন, যাতে চাপ খেয়ে ইস্তিরি হয়ে যায়। তৃতীয় জোড়া ধোয়ার জন্য তৈরি থাকত। যদি চতুর্থ জোড়া তার কাছে আসত কখনো–তিনি সেটা গোপনে কাউকে দিয়ে দিতেন। তাই সারাজীবনে তাঁর স্যুটকেসের কোনো প্রয়োজন হয়নি। যত দূরের যাত্রা হোক-না কেন, তার তৈরি হতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগত না! কাপড় পুটুলি করে জায়নামাজ দিয়ে পেঁচিয়ে রওনা হয়ে যেতেন। শীতে গরম চাদর আর গ্রীষ্মে মলমলের পাতলা ওড়না–এই নিয়েই যেখানে খুশি যেতেন তিনি। জীবনের শেষ যাত্রাও তিনি সাদাসিদেভাবেই সম্পন্ন করেছেন। ময়লা কাপড় নিজহাতে ধুয়ে বালিশের নিচে রেখেছেন তিনি, নেয়ে-ধুয়ে চুল শুকিয়েছেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই জীবনের সবচেয়ে শেষ ও সবচেয়ে লম্বা সফরে রওনা হয়ে গেছেন। যেমন নীরবতার সঙ্গে এই দুনিয়ায় বাস করতেন তেমনি নীরবেই তিনি পরপারে রওনা হয়েছেন। সম্ভবত এজন্যেই তিনি প্রায়ই প্রার্থনা করতেন, ‘আল্লা, হাত-পা সচল থাকতে উঠিয়ে নিও। আন্না, কখনো কারো মুখাপেক্ষী আমায় করো না।’

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তিনি কাপড়-চোপড়ের চেয়েও সরল ও নিরাসক্ত ছিলেন। তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাদ্য ছিল মকাই-এর রুটি ও ধনে বা পুদিনার চাটনি। আর সব খাবারও আনন্দের সঙ্গে খেতেন; প্রায় প্রতি গ্রাসেই তিনি আল্লার শুকরিয়া আদায় করতেন। কেউ ফল খাওয়ানোর জন্য খুব জেদ করলে, তিনি কোনো-কোনো সময় কলার কথা বলতেন। তবে নাশতার সময় দু’পেয়ালা চা এবং বিকেলবেলা এক পেয়ালা লাল চা তার চাই। একবার মাত্র খাবার খেতেন তিনি–তা-ও বেশিরভাগ দুপুরবেলা– রাতের বেলা প্রায় খেতেনই না। গরমের দিনে সাধারণত মাখন-তোলা দুধের হাল্কা লোনা লাচ্ছির সঙ্গে এক-আধটা চাপাতি তার প্রিয় খাদ্য ছিল। কাউকে আগ্রহের সঙ্গে কোনো কিছু খেতে দেখলে খুব খুশি হতেন তিনি। সব সময় দোয়া করতেন। সকলের ভালো হোক–সকলের পরে আমারো ভালো হোক। নিজের জন্য বা নিজের সন্তানের জন্য তিনি সোজাসুজি কোনো প্রার্থনা করতেন না। প্রথমে অপরের জন্য দোয়া করতেন, তারপর খোদার সৃষ্ট জীবসমূহের সুখ-সমৃদ্ধি কামনার মাধ্যমে নিজ সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের মঙ্গল কামনা করতেন। নিজ পুত্র-কন্যাদের তিনি, কখনো আমার ছেলে’ বা ‘আমার মেয়ে’ বলতেন না–সব সময় তাদের বলতেন আল্লাহর দান।

কাউকে দিয়ে কোনো কাজ করানো মায়ের কাছে খুব কঠিন মনে হত। নিজের সব কাজই তিনি নিজ হাতে করতেন–যদি কোনো চাকর-বাকর এসে জবরদস্তি করে তার কাজ করে দিত, তাহলে এক অভূতপূর্ব লজ্জা আর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সমস্ত দিন দোয়া করতেন তাকে।

সরলতা ও তিতিক্ষার এই বৈশিষ্ট্য কিছুটা প্রকৃতিগতভাবেই মায়ের চরিত্রে ছিল, কিছুটা এসেছিল জীবনের ঘাত-সংঘাত থেকে।

জিরানওয়ালায় কিছুদিন অবস্থানের পর তিনি যখন তার বাপ-মা ও ছোট ভাইদের নিয়ে জমির খোঁজে লায়ালপুর রওনা হলেন, তখন তাদের জানা ছিল না যে, তাদের কোথায় যেতে হবে এবং জমি পেতে গেলে কী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। মা বলতেন, সেকালে তার মনে কলোনির কল্পনা একজন ফেরেশতা স্বভাবের মহাত্মার চিত্র হয়ে ভেসে উঠত, যিনি উঁচু বেদীর উপর বসে জমি-জিরাত বণ্টন করছেন।

কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ছোট্ট কাফেলাটা লায়ালপুর এলাকায় ঘুরে বেড়াল; কিন্তু কোনো পথচারীর চেহারায় কলোনির মহাত্মাসুলভ চিত্র ফুটে উঠল না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ৩৯২ নম্বর চকে–সে সময় সেখানে নতুন আবাদি বসছিল–ডেরা ফেলল তারা। দলে-দলে লোক এসে সেখানে ঘর বাঁধছিল–নানাজি তার সোজা বুদ্ধিতে বুঝলেন যে, কলোনিতে বসবাস করবার হয়তো এটা একটা নতুন নিয়ম। সুতরাং তিনি খানিকটা জায়গা ঘিরে নিয়ে ঘাসপাতা দিয়ে একটা কুড়ে তৈরি করে ফেললেন এবং পতিত দেখে এক টুকরো জমি খুঁজে নিয়ে চাষ করবার বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। সেই সময়ই রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মচারী পর্যবেক্ষণের জন্য এসে দেখলেন যে, নানাজির কাছে এলটমেন্টের দলিলপত্র নেই। ফলে তাঁকে চক থেকে বের করে দেয়া হল : অধিকন্তু সরকারি জমিতে বে-আইনিভাবে কুঁড়েঘর বানানোর জন্য তাঁর বাসন-কোসন ও বিছানা-পত্র ক্রোক করা হল। কর্মচারীদের একজন মায়ের কানের দুটো রুপোর বালি খুলে নিয়ে গেল। একটা বালি খুলতে দেরি হওয়ায় সে এমন জোরে টান মারল, যার ফলে মায়ের বা কানের লতিটা সাংঘাতিকভাবে কেটে গেল।

৩৯২নং চক থেকে বিতাড়িত হয়ে যে রাস্তা ধরে সামনে পেলেন সেই রাস্তা বেয়ে চললেন। গরমের দিন তখন–সারাদিন লু-হাওয়া বইছে। পানি রাখবার জন্য একটা মাটির ভাঁড়ও ছিল না তাদের। কোথাও কোনো কুয়া দেখলেই মা তার ওড়না ভিজিয়ে নিতেন, যাতে তৃষ্ণা পেলে ছোট ভাইদের চোষানো যায়। এভাবে চলতে-চলতে তারা ৫০৭ নম্বর চকে পৌঁছলেন। সেখানে একজন চেনাশোনা বসতি স্থাপনকারী নানাজিকে কামলা রাখল। নানাজি হাল বাইতেন, নানি গরু-মোষ চরাতেন, মা ক্ষেত থেকে ঘাস আর চারা কেটে জমিদারের গরু-মোষের খাবার জোগাতেন, তখন তাঁদের এতটুকু সঙ্গতিও ছিল না যা দিয়ে পেটভরে একবেলার খাবার খেতে পারেন। কখনো বুনো ফল খেয়ে থাকতেন সবাই। কখনো খেতেন কুড়িয়ে পাওয়া তরমুজের খোসা। কখনো বা কারো ক্ষেতে পড়ে থাকা টক ফুল কুড়িয়ে এনে তার চাটনি করা হত। একদিন কোত্থেকে যেন কলতা শাক পাওয়া গেল, নানা কাজ-কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। মা চুলোয় শাক চাপিয়ে যখন একেবারে সিদ্ধ করে এনেছেন, এবার শাকটা নেড়ে-চেড়ে ঘাঁটতে হবে, সেই সময় হাতা দিয়ে নাড়তে গিয়ে হাড়িতে এত জোরে ঘা লাগল যে হাঁড়ির তলাটা গেল ভেঙে। সব শাক পড়ে গেল চুলোর মধ্যে। নানি এসে মাকে ধমকালেন এবং মারলেনও। সে-রাতে গোটা পরিবার চুলোর ভেতরে পোড়া কাঠে লেগে থাকা শাক কোনোমতে আঙুল দিয়ে চেটে-চেটে খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করল।

৫০৭ নম্বর চকে নানাজির ভাগ্য ফিরে গেল। কয়েক মাস কঠোর পরিশ্রমের পর পুনর্বাসনের সূত্রে সাজে কিস্তিতে তিনিও একখণ্ড জমি পেয়ে গেলেন। আস্তে-আস্তে সুদিন আসতে লাগল এবং দু’তিন বছরের মধ্যেই নানাজি গ্রামের সচ্ছল লোকদের মধ্যে গণ্য হয়ে গেলেন। এমনি দিন-দিন যখন সচ্ছলতা বেড়ে চলল পিতৃভূমির কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। সুতরাং সচ্ছলতার চার-পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর সমস্ত পরিবার নিয়ে রেলে চড়ে মেনিলা রওনা হলেন। রেল-ভ্রমণে মা খুব আনন্দ পেলেন। সারা পথ তিনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়েছিলেন; এর ফলে বেশ কিছু কয়লার গুঁড়ো তাঁর চোখে পড়ে। কয়েকদিন চোখের পীড়ায় ভুগতে হয় তাকে। এই অভিজ্ঞতার কারণে তিনি সারাজীবনে তার ছেলেদের কোনোদিনই রেলগাড়ির জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরে দেখবার অনুমতি দেননি। মা রেলের তৃতীয় শ্রেণীতে সফর করতে পারলেই খুব সন্তুষ্ট থাকতেন। সহযাত্রিনী মেয়ে ও ছোট ছেলেদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিতেন খুব তাড়াতাড়ি। পথের ক্লান্তি আর ধুলোবালিতে তার কোনো অসুবিধা হত না। প্রথম শ্রেণীতে বরং ভ্রমণেই তিনি কষ্ট পেতেন বেশি। দু’একবার যখন তাঁকে এয়ারকন্ডিশন্ড গাড়িতে ভ্রমণে বাধ্য হতে হয়েছিল, তখন তিনি ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছিলেন। মনে হয়েছিল সারাক্ষণ যেন জেলখানার কষ্ট ভোগ করছেন।

মেনিলায় পৌঁছে নানাজি তার পরিত্যক্ত পৈতৃক বাড়ি ঠিকঠাক করলেন। আত্মীয় স্বজনদের নানা উপহার দিলেন, দাওয়াত করে খাওয়ালেন সবাইকে। তারপর মায়ের জন্য বর খোঁজা শুরু করলেন।

সে-যুগে জমিওয়ালাদের প্রভূত সম্মান ছিল। ভাগ্যবান এবং সম্মানিত বলে পরিগণিত হতেন তারা। সুতরাং চারদিক থেকে মায়ের জন্য বিয়ের খবর আসতে লাগল। এমনিতেও মায়ের জাঁকজমক ছিল; তার ওপর বরপক্ষের আকর্ষণ বাড়াবার জন্য নানি তাকে রোজ নতুন-নতুন কাপড় পরিয়ে নতুন বউ-এর মতো সাজিয়ে রাখতেন।

কখনো-কখনো মা স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে বলতেন, ‘সে-সময় তো আমার বাড়ি থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। যে-পথ দিয়ে আমি যেতাম সে পথের লোকজন আমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে যেত এবং পরস্পর বলাবলি করত, ‘ঐ যে, খেয়াল বখৃশ জমিদারের মেয়ে যাচ্ছে। না জানি কোন ভাগ্যবান তাকে বিয়ে করবে।’

‘মা, আপনার নজরে এমন কোনো ভাগ্যবান ছিল না?’ আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতাম।

‘আরে বাপ, তউবা, তউবা।’ মা হাত দিয়ে কান ঢাকতেন, ‘আমার নজরে কেউ কী করে থাকবে। তবে হ্যাঁ, আমার অন্তরে এই সামান্য আশাটুকু ছিল যে, যেন আমি এমন কাউকে পাই, যে কিছুটা লেখাপড়া জানে–তা হলেই খোদার অপার অনুগ্রহ মনে করব।’

সারাজীবন এই একটি আকাক্ষাই মায়ের মনে তার নিজের জন্য রক্ষিত ছিল; সে আকাক্ষা খোদা এমনভাবে পূর্ণ করলেন যে, সেই বছরেই আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে মায়ের বিয়ে হয়ে গেল।

সেকালে ওই অঞ্চলে আব্দুল্লাহ্ সাহেবের খুব নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান। কিন্তু পাঁচ-ছ বছর বয়সেই তিনি পিতৃহীন হয়ে পড়েন। অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে পড়ে। বাপ মারা যাওয়ার পরই জানা গেল যে, তার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক দেয়া আছে। সুতরাং আবদুল্লাহ সাহেব তার মাকে নিয়ে একটা কুঁড়েঘরে আশ্রয় নিলেন। ধন-সম্পদের এই পরিণতি দেখে তিনি এমন এক সম্পদ আহরণ করতে দৃঢ় সংকল্প হলেন, যা কোনো মহাজনের কাছে বন্ধক দেয়া সম্ভব নয়। তাই আবদুল্লাহ্ সাহেব মনপ্রাণ দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগলেন। বৃত্তির পর বৃত্তি লাভ করে, দু বছরের পরীক্ষা এক বছরে পাস করে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম হলেন। সেকালে সম্ভবত এই প্রথমবার কোনো মুসলমান ছাত্র ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় রেকর্ড স্থাপন করে।

উড়তে-উড়তে এই খবর স্যার সৈয়দের কানে গিয়ে পৌঁছল। তিনি তখন আলিগড় কলেজ পত্তন করেছেন। তিনি তার একজন বিশিষ্ট কর্মচারীকে গ্রামে পাঠালেন এবং আব্দুল্লাহ্ সাহেবকে বৃত্তি দিয়ে নিয়ে এলেন আলিগড়ে। এখানে এসে আবদুল্লাহ্ সাহেব অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিএ পাস করে সেখানেই ইংরেজি, আরবি, দর্শন ও অঙ্কের অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন।

স্যার সৈয়দের কামনা ছিল মুসলমান যুবকরা অধিকতর সংখ্যায় উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হোক। তাই তিনি আবদুল্লাহ সাহেবের জন্য বৃত্তি আদায় করে আইসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য বিলেত যাবার বন্দোবস্ত করে দিলেন।

গত শতাব্দীর মুরুব্বিরা সাত সমুদ্র পারের যাত্রাকে খুব বিপজ্জনক মনে করতেন। সঙ্গত কারণে আবদুল্লাহ সাহেবের মা-ও তাকে নিষেধ করলেন বিলেত যেতে। আবদুল্লাহ্ সাহেবের ভাগ্য হল অপ্রসন্ন, তিনি বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন।

এ-কথা শুনে স্যার সৈয়দের রাগ এবং দুঃখ হল। তিনি অনেক করে বোঝালেন, ভয় দেখালেন, ধমক দিলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ সাহেব না’ থেকে ‘হ্যাঁ’-তে এলেন না।

.

তুমি কি জাতীয় স্বার্থের চেয়ে তোমার বুড়ি মা’র কথাকে বড় মনে কর। স্যার সৈয়দ গর্জে উঠলেন।

‘জী হা।’ জবাব দিলেন আবদুল্লাহ সাহেব।

জবাব শুনে স্যার সৈয়দ রাগে আর সংযত রাখতে পারলেন না নিজেকে। কামরার দরজা বন্ধ করে প্রথমে তাকে চড় থাপ্পড় মারলেন। তারপর কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়ে বললেন, এখন তুমি এমন জায়গায় গিয়ে মর, যেখান থেকে আমি আর তোমার নামও যেন শুনতে না-পাই।’

আবদুল্লাহ সাহেব যেমন সুবোধ ছেলে ছিলেন, তেমনি ছাত্র হিসেবেও ছিলেন প্রতিভাবান। ম্যাপে তিনি সবচেয়ে দূরে গিলগিট শহর দেখতে পেলেন। সুতরাং, নাক বরাবর চলে গিয়ে সেখানে হাজির হলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে গভর্নর নিযুক্ত হলেন।

.

যে সময়ে মায়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, সে-সময়ে আবদুল্লাহ্ সাহেবও ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। অদৃষ্টের লেখন ছিল, তাই তার সঙ্গেই বিয়ের বাগদান হয়ে গেল। এক মাস পর বিয়ের তারিখও ঠিক হল, যাতে আবদুল্লাহ সাহেব বউ নিয়ে গিলগিট যেতে পারেন।

বাগদানের পর একদিন মা তার সইদের সঙ্গে নিয়ে পাশের গায়ে এক মেলায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে কিংবা সম্ভবত জ্ঞাতসারে আবদুল্লাহ্ সাহেবও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

মায়ের সইরা তাঁকে ঘিরে ধরল। সবাই তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে পাঁচ টাকা করে আদায় করল। আবদুল্লাহ্ সাহেব মাকেও অনেক টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু তিনি নিলেন না। যখন খুব অনুরোধ করা হল, তখন নিরুপায় হয়ে মা এগারো পয়সার ফরমাশ করলেন।

‘এত বড় মেলায় এগারো পয়সা দিয়ে কী করবে?’ আবদুল্লাহ্ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

‘আগামী বৃহস্পতিবারে আপনার নামে মসজিদে তেল পাঠাব।’ মা জবাব দিলেন।

জীবনের মেলায়ও আবদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে মায়ের লেনদেন মাত্র বৃহস্পতিবারের এগারো পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার চেয়ে বেশি পয়সা তিনি কোনোদিন চাননি এবং নিজের কাছে রাখেননি।

গিলগিটে আবদুল্লাহ সাহেবের খুব শান-শওকত ছিল। সুন্দর সাজানো বাংলো, প্রশস্ত বাগান, চাকর-বাকর, দরজায় প্রহরী। যখন আবদুল্লাহ্ সাহেব বাইরে টুরে যেতেন বা ফিরে আসতেন, তখন সাতটা তোপধ্বনি করে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হত। এমনিতেও গিলগিটের গভর্নর হিসেবে সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি কিন্তু মায়ের ওপর এসব ক্ষমতা ও পূর্বের কণামাত্রও প্রভাব পড়েনি। কোনো প্রকারের ছোট-বড় পরিবেশও তাঁকে প্রভাবিত করতে পারত না। বরং মায়ের সরলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রত্যেক পরিবেশকেই গাম্ভীর্যমণ্ডিত করে তুলত।

সে সময়ে স্যার ম্যালকন হ্যাঁলি গিলগিটের রুশ ও চীন সীমান্তের ব্রিটিশ পক্ষীয় পলিটিক্যাল এজেন্ট নিযুক্ত হন। একদিন লেডি হ্যাঁলি ও তার কন্যা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের পরনে ফ্রক ছিল। হাঁটু থেকে গোড়ালি খোলা। এই নির্লজ্জতা মা পছন্দ করলেন না। তিনি রেডি হ্যাঁলিকে বললেন, ‘তোমার জীবন তো যেভাবে হোক কেটেই গেছে। এখন মেয়েটার জীবনটা তার নষ্ট কর না।’ এ-কথা বলে তিনি মিস্ হ্যাঁলিকে তার কাছে রেখে দিলেন। তাকে রান্না, বাসন মাজা, কাপড় সেলাই করা সব শিখিয়ে তার বাপমায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

যখন রুশ বিপ্লব শুরু হয়, তখন লর্ড কিসেজ গিলগিট সীমান্ত পরিদর্শনে আগমন করেন। তার সম্মানার্থে গভর্নরের পক্ষে থেকে এক ভোজসভার আয়োজন করা হয়। মা নিজের হাতে দশ-বারো রকমের খাবার তৈরি করেন। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। খাওয়ার শেষে লর্ড কিসেজ তার বক্তৃতায় বলেন, ‘মিস্টার গভর্নর, যে খানসামা এই খাবার রান্না করেছে অনুগ্রহপূর্বক আপনি আমার তরফ থেকে তার হাত চুম্বন করুন।’

ভোজ শেষে আবদুল্লাহ্ সাহেব খুশি মনে বাড়ি ফিরে দেখলেন মা রান্নাঘরের এক কোণে একটা মাদুর পেতে বসে লবণ ও মরিচের চাটনি দিয়ে মকাই-এর রুটি খাচ্ছেন।

একজন গভর্নরের মতোই আবদুল্লাহ সাহেব মায়ের হাতে চুমু দিলেন এবং বললেন, ‘যদি লর্ড কিসেজ এই আদেশ দিতেন যে, তিনি স্বয়ং খানসামার হস্ত চুম্বন করবেন, তাহলে তুমি কী করতে?’

‘আমি?’ মা ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘আমি তার গোঁফ হেচকা টানে ছিঁড়ে নিতাম। তারপর আপনি কী করতেন?’

‘আমি?’ আবদুল্লাহ সাহেব নাটকীয় ভঙিতে বললেন, ‘আমি সেই গোঁফ তুলো দিয়ে বেঁধে ভাইসরস-এর কাছে পাঠিয়ে দিতাম। তারপর পালিয়ে যেতাম তোমাকে নিয়ে। যেমন করে পালিয়ে এসেছি স্যার সৈয়দের কাছ থেকে।’

মা এ-সব কথা গ্রাহ্যও করতেন না। কিন্তু একবার, শুধু একবার তিনিও হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরেছিলেন–যা মেয়েদের একমাত্র উত্তরাধিকার।

গিগিটের আইন সংক্রান্ত আদেশাবলিকে ‘গভর্নরি’ বলা হতো। এ-কথা যখন মায়ের কানে গেল, তখন তিনি আবদুল্লাহ্ সাহেবকে অভিযোগ করলেন :

‘রাজত্ব তো করছেন আপনি; কিন্তু লোকে ‘গভর্নরি’, ‘গভর্নরি’ বলে আমাকে খামোখা মাঝখানে টানাটানি করে কেন?’

আবদুল্লাহ্ সাহেব ছিলেন আলিগড়ের ছাত্র। রসিকতা করবার জন্য মেতে উঠলেন তিনি। সরস কণ্ঠে বললেন : ‘ভাগ্যবতী, এ গভর্নরি তোমার নাম নয়। গভর্নরি হল তোমার সতীনের নাম–যে সব সময় আমার পেছনে ধাওয়া করছে।’

রসিকতার চূড়ান্ত। আবদুল্লাহ্ সাহেব বুঝলেন, কথার সমাপ্তি হয়ে গেল এখানেই। কিন্তু মায়ের মনে দুঃখ দানা বেঁধে গেল। তিনি কথাটা নিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন।

কিছুদিন পর কাশ্মীরের মহারাজা প্রতাপ সিং মহারানীকে সঙ্গে নিয়ে গিলগিট বেড়াতে এলেন। মা তার মনের ব্যথা মহারানীকে শোনালেন। মহারানীও ছিলেন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। তিনি উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন : ‘হায়-হায়, আমার রাজ্যে এই অত্যাচার? আমি আজই মহারাজাকে বলব, তিনি আবদুল্লাহ্ সাহেবকে দেখে নেবেন।’

ব্যাপারটা যখন মহারাজার কানে গেল, তিনি আবদুল্লাহ সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আবদুল্লাহ্ সাহেবও স্তম্ভিত হয়ে ভাবলেন এ কী বিপদ। কিন্তু ব্যাপারটা সম্বন্ধে যখন আরো খোঁজ নেয়া হল, তখন উভয়েই খুব করে হাসলেন। দু’জনেই বুদ্ধিমান। সুতরাং মহারাজা আদেশ দিলেন যে, এবার থেকে গিগিটের গভর্নরপত্নীকে ভবিষ্যতে ওজারত ও গভর্নরকে উজিরে ওজারত বলে সম্বোধন করা হবে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত গিলগিটে এই সরকারি নির্দেশই প্রচলিত ছিল।

এই হুকুমনামা শুনে মহারানী মাকে ডেকে সুসংবাদ দিলেন যে, মহারাজ ‘গভর্নরি’কে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছেন।

মহারানীর কোনো সন্তান ছিল না। এজন্যে প্রায়ই তিনি মাকে দোয়া করতে বলতেন। মা নিজে অবশ্য বলতেন তাঁর মতো সৌভাগ্যশালী মা পৃথিবীতে কমই আছে। কিন্তু ধৈর্য, তুষ্টি এবং সব কিছু মেনে নেয়ার, সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা, চশমাজোড়া খুলে ফেলে যদি দেখা যেত তা হলে সেই সৌভাগ্যের পর্দার অন্তরালে কত দুঃখ, কত বিষাদ এবং কত আঘাত যে লুকানো ছিল তা প্রকট হয়ে ধরা পড়ত।

আল্লাহতালা মাকে তিনটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে দান করেন। দুই মেয়ে বিয়ের কিছুকাল পরে একে-একে মারা যায়। বড় ছেলেও যৌবনের প্রারম্ভে বিলেতে গিয়ে মারা যায়।

মুখে অবশ্য বলতেন যে, আল্লাহ্র মাল, আল্লাহ্ নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি কি একা-একা কোনো সময়ই লুকিয়ে তাদের কথা মনে করে অশ্রুপাত করতেন না? যখন আবদুল্লাহ্ সাহেব ইন্তেকাল করেন, তখন তার বয়স ছিল বাষট্টি বছর ও মায়ের বয়স পঞ্চান্ন বছর। আবদুল্লাহ সাহেব দড়ির খাটে রোজকার মতো বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মা পায়ের কাছে বসে চাকু দিয়ে আখ কেটে-কেটে তাঁকে দিচ্ছিলেন। তখন বিকেল। আবদুল্লাহ্ সাহেব মজা করে আখ চুষছিলেন আর মেতে ছিলেন হাসি-তামাশায়। তারপর অকস্মাৎ তিনি গম্ভীর হয়ে মাকে বললেন, ‘হায় আল্লা, বিয়ের আগে মেলায় তুমি যে আমার কাছ থেকে এগারো পয়সা নিয়েছিলে, তা কি শোধ দেয়ার সময় এখনও হয়নি?’

মা নববধূর মতো মাথা নামিয়ে আখ কাটতে লাগলেন। তাঁর বুকে একসঙ্গে অনেক কথা গুমরে উঠল।

‘সময় এখনো হল কোথায় প্রিয়? বিয়ের আগের এগোরো পয়সার ঋণ তো বইছিই। কিন্তু বিয়ের পরে যেমন করে তুমি আমাকে আদর-যত্ন করেছ সেজন্য তোমার পা ধুয়ে পানি খেতে হয়। আমার গায়ের চামড়া দিয়ে জুতো বানিয়ে তোমাকে পরানো উচিত। আমার। এখনই কি শোধ করবার সেই সময় এসেছে!’

কিন্তু আজরাইলের খাতায় সময় এসে পড়েছিল। মা যখন মাথা তুললেন, তখন আবদুল্লাহ সাহেব আখের টুকরো মুখে নিয়ে পাশবালিশের উপর ঢলে পড়েছেন। মা তাঁকে ডাকলেন, নাড়া দিলেন, সুড়সুড়ি দিলেন; কিন্তু আবদুল্লাহ্ সাহেব এমন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, তা থেকে জাগানো কিয়ামতের আগে কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

.

মা তাঁর অবশিষ্ট দুই ছেলে ও এক মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিলেন : ‘বাছারা, কেঁদো না–তোমাদের আব্বা যেমন শান্তিতে এই দুনিয়ায় বাস করতেন, তেমনি শান্তিতেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। কেঁদো না, কাঁদলে তার আত্মা কষ্ট পাবে।’

মুখে তো মা বললেন, তোমাদের আব্বার কথা মনে করে কেঁদো না, তাহলে তাঁর কষ্ট হবে। কিন্তু তিনি কি তার স্বামীর কথা স্মরণ করে বাকি জীবনে একটুও কাঁদেননি?

যখন তিনি নিজেও বিদায় নিলেন, তখন তার সন্তানদের মনে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মনের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।

যদি মায়ের নামে কিছু দান করতে যাই, তাহলে এগারো পয়সার বেশি দিতে সাহস হয় না, অথচ মসজিদের মোল্লা তো বিস্মিত হয়ে বলেন যে, বিজলির রেট বেড়ে যাচ্ছে– তেলের দামও বাড়ছে।

মায়ের নামে যদি ফাতেহা দিতে চাই, তাহলে মকাই-এর রুটি আর লবণ-মরিচের চাটনির কথা মনে পড়ে। যাকে খাওয়াই সে বলে ফাতেহা দরুদে তো পোলাও-জরদা হওয়াই উচিত।

মায়ের কথা মনে এলেই বাঁধ ভেঙে কান্না আসে। কিন্তু যদি কাঁদি তাহলে ভয় হয়, পাছে মায়ের রুহের কষ্ট হয়, আর যদি কান্না দমন করতে যাই–খোদার কসম, কান্না থামানো যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *