প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

২.৩ মিথুন ॥ রাজেন্দ্র সিংহ বেদী / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

মিথুন ॥ রাজেন্দ্র সিংহ বেদী / ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

মিথুন – রাজেন্দ্র সিংহ বেদী

বাজার হয়ে উঠেছিল মন্দা অথবা কারবার ছোট। মনে হচ্ছিল পশ্চিম দিকে যেখানে সড়ক কিছুটা উপরে উঠে আকাশকে ছুঁয়েছে আর শেষ পর্যন্ত একেবারে নিচে নেমে গেছে, ওখানেই দুনিয়ার শেষ প্রাপ্ত, সেখান থেকে এক লাফ দিতে হবে, এই জীবনকে বাঁচাবার জন্যেই এবার প্রাণটা দিতে হবে।

সারাদিন মাথা চাপড়ানোর পর মগন টকলা (রকমারি চিজ বিক্রিঅলা) মাত্র দুটো জিনিস হাতে পেল। এক, ফ্লোরেনটিন আর দুই, জেমিনি রায়। ফ্লোরেনটিনের মূর্তি হয়তো কোনো মাথা-মোটা ফিল্ম প্রডিউসার ভাড়া করে নিতে যেতে পারে, কিন্তু জেমিনি রায়? কোনো আপসোস নেই, আজ সে ওটিকে লুকিয়ে রেখে দিলে কাল তার নাতি-পুতিরা তা থেকে কোটি টাকা উপার্জন করবে–যেমন পশ্চিমি দুনিয়ায় আজও কারো কাছ থেকে লিওনার্দোর স্কেচ বেরুলে আর্টের বাজারে তার নিলাম-মূল্য লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। এই লাখ আর কোটি টাকার চিন্তায় মগন লালের দুচোখে বিজলি চমকায়। সে এ-কথা ভুলে গিয়েছিল যে, তার বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হয়ে গেছে। তাছাড়া তার মাথায় নেই একগাছি চুল, এমনকি তার বিয়েও হয়নি। সে-কারণে নাতি-পুতির কথাই ওঠে না। মগন করেই-বা কী? সে এক সাধারণ হিন্দু। সাধারণত তার চিন্তাগুলো এরকমই। তাছাড়া তার মন থেকে বেনে-ভাব যায়নি। কথায় সে ‘পয়সা-এ-তো মায়া’–এ-কথা বলে তা দূরে ঠেলে দেয়, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে পয়সার প্রতি তার প্রচণ্ড আসক্তি। দুনিয়ায় যদি কেউ পয়সার পূজা করে তো সে হিন্দু। আজ তার সামনে দেওয়ালির দিনের আলোকিত পূজাপাত্র থেকে দুধ-জলে স্নাত, সিঁদুর-চর্চিত টাকা পাওয়া যাবে। দশহরার দিনে তার গাড়ি গাঁদাফুলের মালায় ভরে যাবে আর সব স্ত্রী-পুরুষ মিলে লক্ষ্মী-মন্দিরে পূজা দিতে যাবে। পয়সার জন্যে সে ইউসুফের মতো ভাই আর পদ্মিনীর মতো পত্নীকেও বিক্রি করে দিতে পারে।

তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সিরাজা–ইবজ ব্যাটারির এজেন্ট। সিরাজার দোকান অশ্বথগাছের ঘেরের পেছনে। গরিব ল্যাৎপেতে হিন্দুরা সকালবেলায় অশ্বথের গোড়ায় জল-মেশানো দুধ ঢালত। দোকান আর সড়কের মাঝখানটা তাতে কাদা-কাদা হয়ে থাকত। দেশ-বিভাগের পরে হিন্দুস্থানে থেকে-যাওয়া সিরাজাকে গরিব হিন্দুদের এই থাকে খাতির করে চলতে হত। হ্যাঁ, না-করলে তো সে হয়ে যেত সেইসব বর্ণশংকর কুকুর, যেগুলো সারাদিন ঠ্যাঙ তুলে-তুলে ওই গাছের গায়ে পেচ্ছাব করত। এই গাছ সম্পর্কেই ভগবান বলেছেন, ‘গাছের মধ্যে আমি হলাম অশ্বথ।’ ওই কুকুর নিশ্চয়ই গতজন্মে ছিল মুসলমান–সাতচল্লিশ সনের দাঙ্গায় যে হিন্দুদের হাতে মারা গেছিল।

দেখা যেত সিরাজা হামেশা অশ্বথের ফল খাচ্ছে। তার কারণ মন্দা বাজার নয়, ক্ষুধাও নয়। সিরাজা সব সময় সেই জিনিস খেত যা বীর্যকে গাঢ় করে। হ্যাঁ, তার কাজই হল খাওয়া-দাওয়া আর ভোগ করা। মনের দিক থেকে সে ছিল ফালতু লডুয়ে যাযাবর যারা হিন্দুস্থানে থেকে পাকিস্তানের কথা বলে। আবার পাকিস্তানে থাকে তো বলে, ‘হে মোর প্রভু, আমায় মদিনায় ডেকে নাও।’ তার কোনোকিছুতেই আসক্তি নেই। মগন টকলা এ-নিয়ে কয়েকবার ভেবেছে, সিরাজার আল্লা দুনিয়ায় খুব আরাম করেন। আর মগনের আছে এক ভগবান যিনি নিচের দুনিয়ার বদলে উপরের ত্রিকূট পর্বতের আশপাশে দরবার লাগান। বোধ হয় সিরাজা না-জেনে-শুনেই এক তান্ত্রিক হয়ে বসে আছে, যে বীর্যবক্ষার জন্য কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগায় আর ঊর্ধ্বগামী পথ তৈরি করে। সে গর্বের সঙ্গে নারীসমাজের মাঝে থাকে, কিন্তু কোনোভাবেই জীবনের পরম তত্ত্বকে (অমৃতরূপ বীর্যকে) স্মলিত হতে দেয় না। ইচ্ছামতো উপায়ে মোক্ষপ্রাপ্তিকারী, নারীকে কেবল এক মাধ্যমরূপে ব্যবহারকারী এই ব্যক্তি কখনো ভেবে দেখেছে কি এর ফলে ওই বেচারি নারীদের হাল কী হতে পারে? তাদের অতৃপ্ত রুদ্যমান অস্থির অবস্থায় রেখে কেউ কি এ-ভাবে মোক্ষে পৌঁছতে পারে? আর বীর্য পতিত না-হওয়াতে যে মোক্ষ, তাতে পুরুষের বা নারীর কোনো মুক্তি ঘটবে? স্বাতী নক্ষত্রের জল তো মোতি নয়। ঝিনুকও মোতি নয়। ঝরে-পড়া জল যখন ঝিনুকের মধ্যে মুখবদ্ধ অবস্থায় থাকে, তখনই মোতির জন্ম হতে পারে।

রাত আসে দ্রুতগতিতে। বাইরের দুনিয়া আঁধার। তার সঙ্গে গুঁড়ি মেরে আসে আরো কিছু। রেশমওয়ালা বিলায়তিরাম, কাশ্মিরী বড়শাহ, এখানকার উড়পির চক্রপাণির দোকান পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। হতে পারে, মাসের দ্বিতীয় শনিবার হবার ফলে চক্রপাণির সব ইডলি দোসা, সাম্ভর, রওয়া কেসরি বিক্রি হয়ে গেছে। কেবল খোলা ছিল সিরাজার দোকান। কে জানে সে কোন মতলবে ছিল। বোধহয় এর জন্যে যে ব্যাটারির প্রয়োজন তা তো রাতেই হয়। কিন্তু ঝুটমুট সে সকালেই দোকান খুলে ফেলত–সকাল তো রাতেরই অংশ–তার শেষ অংশ, তা না-হলে সকাল কোথায়-বা কার। বোধহয় সিরাজা ট্যুরিস্ট এজেন্ট মাইকেলের অপেক্ষায় ছিল; ওরা দু’জনে মিলে আগামী কোনোদিনে আগ্রা বা খাজুরাহোর ভ্রমণসূচি তৈরি করে নেবে, আর তাতে কিছু পয়সাও উপায় হবে। না, সিরাজা পয়সার পেছনে দৌড়ত না। সে দৌড়াত পশ্চিমি মেয়েদের পেছনে। অনেক বিয়ে আর তালাকের কারণে ওইসব মেয়েরা ছিল অতৃপ্ত। এখানে এসে মমতাজের প্রেম নিয়ে এখানে-ওখানে কোনো শাহজাহান-চেহারাওয়ালা মরদের ওপর ভাগ্য পরীক্ষা করত। খাজুরাহোর মিথুনমূর্তিকে জীবন্ত করে তুলতে চাইত।

তখনই সিরাজার আওয়াজ মগনলালকে চমকে দিল, ‘হ্যালো সুইটি পাই।’

এমনিতে সিরাজা প্রায় অশিক্ষিত। কিন্তু ট্যুরিস্টের সঙ্গে থেকে থেকে সে এইসব ইংরেজি শব্দ শিখে ফেলেছিল। তার আওয়াজে মগন বুঝে নিল যে কীর্তি এসে গেছে।

সত্যি সত্যিই কীর্তি এসেছিল। বেঁটে, আঁটসাট বাঁধুনি, গভীর ভাঁজযুক্ত দেহ, বিষণ্ণ চেহারার যুবতী। তার রঙ ছিল পাকা। জাম রঙের শাড়ি পরত কীর্তি। সে এলে মনে হল আঁধারের কোনো টুকরো সাকার হয়ে সামনে এসেছে। কীর্তি সচরাচর রাতেই আসত। সে নিজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইত। সিরাজা দাঁড়িয়েছিল তার দোকানের সামনে। কীর্তি প্রায়ই তার দিকে না-তাকিয়ে কথা না-বলে চলে যেত। তা সত্ত্বেও সিটি বাজাত সিরাজা।

কিন্তু কীর্তি কথাই-বা বলত কোথায়। এর সঙ্গে, ওর সঙ্গে, তার সঙ্গে–কারুর সঙ্গেই না। কথা বলার জন্যে সে এমনি সওয়াল গড়েপিটে নিত্য যার জবাব হত হা’ বা না’। কেবল উপর থেকে নিচে অথবা ডাইনে থেকে বায়ে মাথা হেলিয়ে কথা সেরে নিত কীর্তি। তাকে সিরাজার বিরক্ত করা মগনলালের পুরোপুরি অপছন্দ ছিল। সিরাজা কয়েকবার মগনকে বলেছিল–

‘ইয়ার, তুমি প্রেমের গোলকধাঁধায় পড়ে যাওনি তো? যুবতী মেয়েটাকে টেনে নাও। যদি বেশি এদিক-ওদিক কর তো কবুতরের মতো মেয়েটি উড়ে যাবে।’

কিন্তু মগন তাকে ধমকে দিয়েছে।

আসলে মগন টকলার ধান্দা ছিল বড় ঝামেলার। কীর্তি কাঠের কাজ বা মূর্তি তৈরি করে বিক্রির জন্য তার কাছে নিয়ে এলে মগন লাল তাতে অনেক খুঁত বের করত। কখনো বলত, এই ধরনের জিনিসের চাহিদা আজকাল নেই। আবার কখনো বলত, শিল্পকলার কষ্টিপাথরের বিচারে এ কাজ নিখুঁত হয়নি। কীর্তি মুখ আরো নামিয়ে নিত। যদিও এইসব কথায় মগন লালের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যাতে একশ’ টাকার জিনিস পাঁচ-দশ টাকায় কীর্তি দিয়ে যায় আর তা রেখে দিয়ে সে একশ টাকায় বেচে।

কোনো আর্ট স্কুলে কীর্তি এই কাজ শেখেনি। তার বাপ নারায়ণ ছিল শিল্পী। ভাউ দাজী আর জেমস বর্গের্স প্রভৃতির সঙ্গে সে নেপাল আর হিন্দুস্থানের নানান জায়গায় শিল্প-উত্তরাধিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। সেসব শিল্পকীর্তি এখন লন্ডনের যাদুঘর, নিউইয়র্ক আর শিকাগোর অ্যান্টিক-দোকানগুলোকে অলঙ্কৃত করছে। প্রতিবছর আমাদের মন্দির আর মূর্তিঘরের শত-শত মূর্তি গায়েব হয়ে যেত আর হাজার-হাজার মাইল দূরে কিউরিও প্রভৃতির দোকানে দেখা যেত। বিরতিহীন সফরে বিরক্ত হয়ে নারায়ণ ফিরে এসে ঘরে বসেই শিল্পকর্ম নির্মাণ শুরু করে দিল এক সময়। কীর্তি গভীর মনোযোগে তার কাজ দেখত আর কাজের মাঝে হাতে খোদাইযন্ত্র এগিয়ে দিয়ে ‘রাফ ওয়ার্কে সাহায্য করত। ঘরে বসে গিয়ে নারায়ণ ভুলেই গিয়েছিল যে, লুপ্ত প্রাচীন শৈলীর শিল্পকর্ম বেশি দামে বিক্রি হয় আর সেসবের মূল্য দু’গুণ-চৌগুণ নয়, শতগুণ পাওয়া যায়। হয়তো সে তা জানত কিন্তু নারায়ণ ছিল সেই দলের মানুষ যারা পয়সার আশু প্রয়োজনই কেবল বুঝতে পারে, তাকে জীবনের প্রসারিত পটে দেখতে পারে না। সে শিল্পকর্ম তৈরি করে কষ্টে-সৃষ্টে রুটির পয়সা উপার্জন করত। শেষে একদিন রুটির পয়সা জোগাড় করতে-করতেই মৃত্যু হল নারায়ণের। তখন সে জগদম্বার মূর্তি বানাচ্ছিল। সে হঠাৎ ভুল করে তার খোদাইযন্ত্র দিয়ে নিজের হাতে আঘাত করায় তার ধনুষ্টঙ্কার হয়ে যায়। সে মারা যায় কাছেরই সামরিক হাসপাতালে। লোকেরা কানাকানি করত এই বলে যে সে নাকি কুকুরের মতো মরেছে। এইরকম মৃত্যু তার হবে নাই-বা কেন? সে যখন দেবীমূর্তি বানিয়েছে তখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস দেবীর স্তনযুগল, নিতম্ব আর জঙ্ঘার ওপর-নিচে আটকে থেকেছে। ছোট মূর্তিতে স্তনযুগল শূন্যে ঘূর্ণায়মান লাটুর মতো দেখায়, কিন্তু বড় মূর্তিতে পা আর স্তনযুগল এক রকম ছোট ঘড়ার মতো দেখায়। আসল কথা, দুধের বড়-বড় বাটি যেন বুকের পরে রাখা হয়েছে, আর হস্তিনীর মাথার মতো নিতম্ব, যার নিচে একটি শুড়ের বদলে দুটি শুড় বেরিয়েছে। সে দুর্গামূর্তি বানাচ্ছিল। দুর্গা বড় জাঁকজমকভরা দেবী। এইরকম দেবীর মূর্তি যে বানাতে যাবে সে কুকুরের মতো মরবে না তো কি আমার-আপনার মতো মরবে?

‘কী এনেছ?’ মগন টকলা কীর্তিকে জিজ্ঞেস করল। কীর্তি শাড়ির আঁচল থেকে কাঠের কাজ’ বের করে মগনের সামনে টেবিলের ‘রোল টপে’র উপর ধীরে-ধীরে রাখল। উপরের ল্যাম্পের আলো ওখানেই কেন্দ্রীভূত ছিল বলে রাখল। কাজটা দেখার আগে মগন কীর্তির দিকে এক পুরনো কাজ-করা চেয়ার এগিয়ে দিল, কিন্তু কীর্তি আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।

‘তোমার মা কেমন আছে?’

কীর্তি কোনো জবাব দিল না। সে একবার পেছন ফিরে যেখানে সড়ক নিচের দিকে নেমে গেছে, সেদিকে তাকাল। তারপর যখন মগনের দিকে ফিরে দাঁড়াল তখনও তার চোখদুটি আনত।

কীর্তির মা তখন সামরিক হাসপাতালে। সেখানেই তার বাপ নারায়ণ মারা গিয়েছিল। বুড়ির ‘কিডনির রোগ ছিল। তার পেট ঘেঁদা করে নল লাগিয়ে একটা বোতল বেঁধে দেয়া হয়েছিল যাতে করে মলমূত্র নিচে যাবার বদলে ওপরের বোতলে চলে যায়। বোতল কোনো কারণে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন অন্য বোতলের জন্য পয়সা চাই। যদি সে মগনকে এ-কথা বলে দিত তো মগন অন্যভাবে কথা শুরু করত, কিন্তু ওই কাঠের কাজ দেখে সে চমকিত হয়ে গেল।

‘আবার ওই জিনিস?’ সে বলল–’আমি তোমাকে কয়েকবার বলেছি আজকাল এইসব জিনিস কেউ পছন্দ করে না… এই শায়িত বিষ্ণু, ওপরে শিষনাগ, আর তার পদসেবারত লক্ষ্মী…।’

কীর্তি বড়-বড় চোখে মগনের দিকে তাকাল–ওই দৃষ্টিতে কৌতূহলী প্রশ্ন–তবে কী বানাব?’

‘ওই সব যা আজকাল হচ্ছে।’

আজকাল কী হচ্ছে?’ কীর্তি শেষ পর্যন্ত মুখ খোলে। তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনাই যায় না, যেমন ক্যানারি পাখি ঠোঁট বাঁকিয়ে ডাকে কিন্তু তার আওয়াজ অস্ফুট।

মগন কথা বলার রাস্তা খুঁজে পেয়ে বলল, ‘আর কিছু না হয় তো গান্ধী বানাও… নেহরু বানাও…। ফের তার যেন কোনো ত্রুটি হয়ে গেছে এ-ভাব কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কোনো ন্যুড।’

‘ন্যুড?’

‘হ্যাঁ,… আজকাল লোকে ন্যুড পছন্দ করে।’

কীর্তি চুপ করে গেল। কুমারী বলে সে সংকুচিত হতে পারত, লজ্জা পেতে পারত, কিন্তু এইসব লজ্জা-সংকোচ তার মতো মেয়ের কাছে নেহায়েত বিলাসিতা। তার একমাত্র চিন্তা মগন ওই উডওয়ার্ক কিনবে কি-না, পয়সা দেবে কি-না? কিছুটা ভেবেচিন্তে সে বলল

‘আমি ঐ মূর্তি বানাই না…’

তফাত কী এদের মধ্যে?’ মগন টকলা বলল–’দেবীও তো নারী… তুমি ওই মূর্তিই বানাও, কিন্তু ভগবানের দোহাই, কোনো দেবমালা ওর সঙ্গে জুড়ে দিয়ো না… এইসব কারণেই তোমার বাবা ওভাবে মৃত্যুবরণ করেছে… স্বর্গবাসী হয়েছে…।’

কীর্তি নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকাল। সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কোনো এক বিপদাশঙ্কায় তার সারা শরীর কাঁপছিল। সেই বিপদের কথা সে ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না। সে চেয়ারে বসেনি। সেটাকে ধরে দাঁড়িয়েছিল। সেদিক থেকে তার শরীরের সুন্দর রেখাগুলো দেখাচ্ছিল এক আকর্ষণীয় ছবির মতো। এ কেমন শিল্প যা উপরের নয়, নিচের নারায়ণ বানিয়েছিলেন। মগনলালের হৃদয়ে তখন পছন্দ আর অপছন্দের দ্বন্দ্ব। সে

জানত-না যে, সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির হৃদয়ে বশ আর বিশের মধ্যে আপসে লড়াই চলছে। কীর্তির মুখখানি শুকিয়ে গিয়েছিল। থুতু গিলে নেবার চেষ্টা করে কীর্তি বলল,

‘আমি?…আমার কাছে তো মডেল নেই…’

মডেল?’ মগন তার কাছে এগিয়ে আসে।

‘শত-শত পাওয়া যায় … আজ কোনো যুবতী সুন্দরী মেয়েকে পয়সার ঝলক দেখাও তো সে একদম…’

কীর্তি কিছু বলেনি কিন্তু মগন শুনল, ‘পয়সা…’ মগন নিজেই বলল– ‘পয়সা খরচ করলে তবে তো পয়সা উপায় করবে…’

এই কথা কীর্তিকে আরো বিষণ্ণ করে তুলল। তার আত্মা জীবনের শক্ত চোয়ালের মধ্যে পড়ে ধড়ফড় করতে লাগল। তার চোখদুটি অশ্রুতে ভিজে উঠল। মেয়েদের এমনি দশা হয় যা দেখে পুরুষের অন্তরে পিতা আর স্বামীকে জাগিয়ে দেয়। সারকথা এই যে, মগনের ইচ্ছে হচ্ছিল হাত বাড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বুকে নিয়ে নেয়–

‘আমার প্রাণের পুতুল, তুমি চিন্তা করো না… আমি তো আছি।’

কিন্তু কীর্তি তাকে ধাক্কা দিল। বিব্রত হয়ে গেল মগন। সে এমন ভাব দেখাল যে, কিছুই ঘটেনি। তরুপের তাস তো তারই হাতে। টেবিলের ‘রোলটপ’ থেকে সে ওই ‘উড-ওয়ার্ক’টি তুলে নিল আর কীর্তির দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরে বলল–

‘আমার এ-জিনিসের দরকার নেই।’

কীর্তিও কিছু-একটা ভেবে নিয়েছিল। সে প্রথমে নিচের দিকে দেখল তারপর সহসা . মাথা তুলে বলল–

‘আসছে-বার নুডই নিয়ে আসব। এখন তুমি এটাই নিয়ে নাও’…

শর্ত রইল। মগন মুচকি হেসে বলল।

কীর্তির মাথা নিচের দিকে নোয়ানো। মগন টকলা ভেবেছিল যে, কীর্তি হেসে উঠবে, কিন্তু সে আরো কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। মগন ‘রোলটপ’ তুলে টেবিলের ভেতর থেকে একটা দশ টাকার চকচকে নোট বের করে কীর্তির দিকে বাড়িয়ে ধরল, নাও…’

দশ টাকা…’ কীর্তি বলল।

‘হাঁ, তুমি বলছ তাই, আমার কাছে এ মূর্তি বেকার। আমি আর দিতে পারব না…’

‘এতে তো…’ কীর্তি তার বাক্য শেষ করতে পারল না। তার ভেতরে কথা বলার শক্তি, শব্দ সব রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার অভিপ্রায় ছিল স্পষ্ট। মগন বুঝে নিল।

‘এতে তো ওষুধের বোতলও আসবে না… ওষুধের খরচ পুরো হবে না… রুটিও চলবে না…।’ এই ধরনের কথাই সব অসহায় আর গরিবরা বলে থাকে। তাদের সব কথাই বৃথা। মগন কীর্তির দিকে তাকিয়ে বলল–

‘আমাকে খুশি করে দাও, আমি তোমায় ভালো পয়সা দেব’…

আর এই কথা বলতে গিয়ে সে দু’আঙুল দিয়ে বৃত্ত বানাল। সে চোখ মারল যেমন করে ডোমেরা সজ্জিতা বেশ্যাদের তারিফ করে চোখ মারে।

কীর্তি দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরে বাইরে চলে এল। ফেরার সময়ে সর্বদাই কীর্তি উল্টোদিকের পথে যায় যদিও এতে তাকে দেড় মাইল পথ ঘুরে যেতে হয়। সে চাইত না সিরাজার সঙ্গে তার দেখা হোক, কিন্তু আজ সেদিক দিয়েই সে গেল যেন তাতে তার বিপদাশঙ্কা সমাধানের অভিপ্রায় বলবতী হয়। এর মধ্যে মাইকেল চলে এসেছে আর সিরাজার সঙ্গে মিলে কিছু খাচ্ছে। এই সময় কীর্তি মুখ উপরে তুলে নাক ফুলিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। সিরাজা কী একটা কথা বলল যা মগন শুনতে পেল না। কীর্তির মনে এক ধরনের বিদ্রোহের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে সেইসব দুঃখ-পীড়িতদেরই একজন–যাকে দুশমন পরিবৃত অবস্থায় বেঁচে থাকতে হচ্ছে। বোধহয় দুশমন থেকে কোনো উপকার আসতে পারে–অথবা হয়তো-বা নারীপ্রকৃতির এটাই বিশেষত্ব যে, নিজের পেছনে সে এমন একটা পুরুষকে লাগিয়ে রাখবে যার সঙ্গে তার কোনো লন-দেন নেই, তবু সে তা করবে কেবল এ-কারণেই যে, ওই পুরুষ তাকে দেখে একবার ‘সিটি’ বাজাবে আর সে নিজের বুকে হাত রেখে ঠাণ্ডা দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে।

সিরাজা নিশ্চয় কোনো আফ্রোডিজিয়া খাচ্ছিল। হতে পারে মাইকেল তার জন্য ওটি নিয়ে এসেছে। হয়তো ওরা দু’জনে মিলে মগন টকলার কাছে এসে তার সঙ্গে ছদ্মব্যঙ্গে কথার ঘাত-প্রতিঘাত চালাত, কিন্তু ঠিক সেই সময় মগন বন্ধ করে নিল দোকান। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে কীর্তির সেই উড-ওয়ার্কটিকে দেখল। শিল্পীকর্মটি বেশ উঁচু দরের। শেষনাগের নিম্নাংশ খুব সুন্দর, কিন্তু তার উপরাংশের চিত্রিত দেহচর্মে কীর্তি উল্কির ছাপ ও রঙে ভরে দিয়েছিল। বিষ্ণুমূর্তিটির মধ্যে এমন একটা ভাব ফুটে রয়েছে যা যে কোনো রমণী আস্থাবান পুরুষের মধ্যে দেখতে চায়। হ্যাঁ লক্ষ্মী হেলে পড়েছিল, তার শরীরের রেখাগুলোও স্পষ্ট ছিল না। বোধহয় কীর্তি লক্ষ্মীর আর কোনো রূপকে জানত না, যদিও তাকে রুচিগ্রাহ্য রূপে বানানো খুবই সোজা। যখন রমণী পা টেপবার জন্য ঝুঁকে পড়ে তখন তার হাতের বাজু দেখা যায়, শরীর থেকে তা আলাদা হয়ে আসে; ফলে তা রমণীকে তার বিশেষত্ব নিয়ে স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তোলে। আবার পাশের দিকে উপবিষ্টা উপরাসীন রমণীকে নিম্নাসীনার চেয়ে কত তফাত বলে মনে হয়। পুরুষের দৃষ্টিতে নারীশরীর কতই-না উঁচুনিচু রেখাময়। আবার এ-কথাও বলা যায়, কীর্তি নিজে রমণী বলেই হয়তো রমণীর তুলনায় সে পুরুষের প্রতি বেশি আগ্রহী, সে-কারণেই লক্ষ্মীমূর্তি নির্মাণে তার এই ক্রটি। রমণী আপন সৌন্দর্যের ব্যাপারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মরতিতে ডুবে থাকে আর যখন তার এই আত্মরতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন কোনো পুরুষের সহায়তায় তা থেকে মুক্তি পায়।

কীর্তির ঐ ‘উড-ওয়ার্ক’ মগন এক হাতে ধরে অন্য হাতে ছুরি নিয়ে তার উপর ‘সিদ্ধম নমঃ’ অক্ষর খোদাই করে পেছনের ঘরে চলে গেল। সেখানে জমি কাঁচা মাটির। মাটি খুঁড়ে সে তার মধ্যে উড-ওয়ার্ক’টিকে রাখল। মাটির ভেতর থেকে আরেকটি মূর্তি বের করল সে, সেটাও কীর্তির বানানো। গর্তের মধ্যে মাটি দিয়ে তার মধ্যে খয়েরের জল ছিটিয়ে দিল। পুরনো মূর্তির ধুলো ঝেড়ে সে দেখতে পেল তাতে বড়-বড় ফাটা-দাগ হয়ে গেছে আর তা কয়েক শতাব্দীর পুরনো বলে মনে হচ্ছে। পরের দিন যখন সেটিকে নিয়ে মগন ট্যুরিস্টদের কাছে গেল তখন তারা খুশি হল খুব। মগন তাদের জানাল যে এই মূর্তির উল্লেখ কালিদাসের রঘুবংশে আছে। রঘু কোঙ্কণ দেশে ত্রিকূট নামে এক শহর স্থাপন করেছিলেন, সেখান থেকে ওই মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। এ-ধরনের কিছু মূর্তি মহীশূরের চামরাজা ওয়াডিয়ারের কাছে আছে। আর কিছু তার কাছে। এইভাবে মগন টকলা ঐ মূর্তিটিকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকায় বেচে দিল। এটার জন্যে সে কীর্তিকে দিয়েছিল মাত্র পাঁচটি টাকা।

এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে কীর্তি ন্যুড’ নিয়ে এল। তার মুখে আগের মতোই চিন্তার ছাপ। ওর মা অসুস্থ। সে নিজেও অসুস্থ বোধ করছিল। ওর প্রায় নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। সে খকখক করে কাশছিল আর বারবার নিজের গলা ধরছিল। তুলোর পট্টি গলায় রেখে তা এক ফাটা-ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বেঁধেছিল সে।

কীর্তি অন্যান্য দিনের মতোই মগন টকলার সামনে মূর্তিটি রেখে দিল। এই মূর্তি সে কাঠ দিয়ে নয়, পাথর দিয়ে বানিয়েছিল। আশা আর আশঙ্কার সঙ্গে কীর্তি মগন টকলার দিকে তাকিয়েছিল। মগন যদি অপছন্দ করে তবে তা অমার্জনীয় মিথ্যা কথা হবে। এ-কারণে মগন কেবল তা পছন্দই করেনি, পরন্তু প্রাণভরে তারিফ করেছিল। নিন্দা করেছিল এইমাত্র যে মূর্তিটি খুব ছোট হয়েছে। তার আফসোস এই যে, মূর্তিটি যদি প্রমাণ মানুষের উচ্চতাবিশিষ্ট হতো তবে কেবল কীর্তির নয়, মগনেরও অনেক উপকার হতো।

মগন যক্ষীমূর্তি হাতে নিয়ে সযত্নে দেখছিল। কীর্তি সত্যিসত্যি ন্যুড’ বানাতে পারেনি। মূর্তির মুখের উপর ছিল ভেজা কাপড়। আশ্চর্য ওই কাপড় থেকে এখনো পর্যন্ত জলবিন্দু ঝরে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। সেই জলবিন্দুর কিছুটা মুখের সঙ্গে লেগে আছে, কিছুটা অন্যান্য জায়গায়। উপর থেকে মুখ ঢাকার চেষ্টায় ওই রমণীর দেহ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

মূর্তি থেকে নজর তুলে নিয়ে মগন টকলা কীর্তির দিকে তাকাতেই হঠাৎ তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল–’বাহ’। কীর্তি লজ্জিত হয়ে নিজের জামদানি শাড়িটিকে কিছুটা সামনে টানল, কিছুটা দিয়ে পেছন দিকে ঢাকতে লাগল। কিন্তু মগন ঠিক বুঝে নিয়েছিল। যে, আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে ওই মূর্তি সে বানিয়েছে। এতবার তাকে কাপড় ভিজিয়ে নিজের মুখের উপর রাখতে হয়েছে যার ফলে তার ঠাণ্ডা লেগে গেছে আর সে এখন পর্যন্ত কাশছে। এ কেবল পয়সার কথা নয়। নারীর মধ্যে আত্মপ্রদর্শন আর আত্মসমর্পণের ভাবও তো আছে। মগন সবকিছু বুঝে ফেলেছিল। কিন্তু জেনে-বুঝে না-জানার ভান করে তাকে শুধিয়ে নিল–

মা কেমন আছে?’

এ-কথায় খুব চটে গিয়েছিল কীর্তি। তার কাশির দমক এসেছিল আর নিজেকে সামলাতে তার লেগেছিল বেশখানিকটা সময়। মগন ঘাবড়ে গিয়েছিল, আর লজ্জিতও হয়েছিল। তারপর মাথা হেলিয়ে যে প্রশ্ন সে করেছিল তা-ও জরুরি ছিল না–

‘তা হলে তুমি মডেল পেয়েছিলে?’

কীর্তি প্রথমে দৃষ্টি নত করেছিল, তারপর দোকানের বাইরে তাকিয়ে সেই দিকে দেখেছিল যেদিকে সড়ক আকাশ ছুঁতে গিয়ে হঠাৎ নিচে নেমে গেয়েছে। মগন চেয়েছিল কীর্তির দুর্বলতা ধরে ফেলে আর প্রাপ্য তারিফ তাকে দেয়, আর বোধহয় দিতে চেয়েছিলও। কিন্তু মগন ভাবল এতে মূর্তির দাম বেড়ে যাবে। সে মনে-মনে স্থির করেছিল এবার সে কীর্তিকে একশ’ টাকা দেবে। ওষুধের বোতল আর বাকি জিনিসপত্রের দাম একশ’ টাকা না-হলেও সে একশ’ টাকাই দেবে। ভেতরে-ভেতরে সে ভয় পাচ্ছিল, কীর্তি আরো বেশি টাকা-না চায়।

কী দাম দেব এর জন্য?’ সে হাল্কাভাবে প্রশ্ন করল।

কীর্তি চকিত নজরে তার দিকে দেখল আর বলল, ‘এবার আমি পঞ্চাশ টাকা নেব।’

‘পঞ্চাশ?’

‘হাঁ, এক পাই কম না…’

মগন হতাশভাবে ‘রোলটপ’ তুলল আর চল্লিশ টাকা বের করে কীর্তির সামনে রাখল আর বলল–

যা তুমি বল, কিন্তু এখন আমার কাছে চল্লিশ টাকাই আছে…দশ টাকা পরে নিয়ে যেয়ো…’।

কীর্তি টাকা হাতে নিল আর বলল—

‘আচ্ছা।

সে চলে যাচ্ছিল মগন তাকে থামাল–’শোনো।’

কীর্তি চলার মাঝে থেমে গিয়ে তার দিকে আমাকে সাহায্য কর’ এই ঢঙে। তাকিয়ে দেখল। কীর্তির চেহারায় বিষণ্ণতা, কিন্তু তা যখন ছড়িয়ে যাবার বদলে স্থির হয়ে গেল ঠিক তখনই মগন টকলা শুধাল–এই টাকায় তোমার কাজ হয়ে যাবে তো?

কীর্তি মাথা হেলিয়ে হাত ছড়িয়ে দিয়েছিল, যার অর্থ আর কী করা যায়?’–সে মুখে বলল, ‘মা’র অপারেশন এসে গেল, একশ’ টাকা লাগবে।’

কিছুক্ষণ পর কীর্তি ফের বলল, আমি তো বলেছি’; একটু থেমে বলল, মা যত শীঘ্র মরে যায় ততই ভালো।’ সেখানে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল কীর্তি।

শেষে কীর্তি নিজেই বলে উঠল, ‘এইভাবে ছুটে বেড়ানোর চেয়ে মরণও ভালো।

যতক্ষণ মগন চোখ খুলে না-তাকায় ততক্ষণ কীর্তিকে তার আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ের বদলে পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের ভরন্ত রমণী বলে মনে হয়, সে জীবনের প্রত্যেক আঘাত নিজের ওপরে নিয়ে তাকে ব্যর্থ করে ফেলে দিচ্ছে।

একটা কথা বলি। টকলা কাছে এসে বলল, ‘তুমি মিথুন বানাও… অপারেশনের সব খরচ আমি দেব।’

‘মিথুন?’ কীর্তি বলে কেঁপে উঠল।

‘হ্যাঁ। ওর খুব চাহিদা আছে। টুরিস্টরা ওগুলোর জন্যে পাগল হয়ে ওঠে।

‘কিন্তু…’

বুঝতে পারছি।’ মগন মাথা হেলিয়ে বলল।

তুমি না-জানো তো একবার খাজুরাহো চলে গিয়ে দেখে এস। আমি তার জন্য তোমাকে রাহা-খরচ নিতে রাজি আছি…’

‘তুমি!’ কীর্তি ঘৃণার সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে বলল, তুমি তো বলেছ, তোমার কাছে আর পয়সা নেই…’

মগন ঝটপট মিথ্যা তৈরি করে নিল–

আমার কাছে সত্যি পয়সা নেই’, সে বলল, আমি দোকানের ভাড়া দেয়ার জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রেখেছিলাম।’

সে ফের টাকা দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কীর্তি আপন অহংকারে তা না-নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। মগন টকলা ঘুরে দাঁড়িয়ে যক্ষী-মূর্তিটি দেখল। ছোট হাতুড়ি দিয়ে তার নাক ভেঙে দিল, ঠ্যাং ভেঙে দিল আর মূর্তির শিরের আভরণের উপর লঘুভাবে এমন করে আঘাত করল যাতে কিছু অংশ ভেঙে পড়ে যায়। তারপর ভেতরের ঘরে গিয়ে সে মূর্তিটিকে দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে লবণের অ্যাসিড-জলে ডুবিয়ে রাখল। ফলে ধোয়া উড়ল খানিকটা। মগন দড়ি ধরে টেনে যক্ষীকে বার করে জলে ডুবোতে লাগল। তারপর যখন জল থেকে তাকে তুলে নিল তখন যক্ষীর সাজ-আভরণ মলিন হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে কোথাও হঠাৎ দেখা দিয়েছে গর্ত। এখন এই মূর্তি হাজার টাকায় বিক্রির জন্য তৈরি।

এবার কীর্তি যে মূর্তি নিয়ে এল তা মিথুন-মূর্তি। তা ছিল প্রমাণ মানুষের উচ্চতাবিশিষ্ট। মূর্তি একটি বস্তায় বাঁধা অবস্থায় ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে সে নিয়ে এল। কয়েকজন মজুর তা মগন টকলার দোকানে তুলে দিয়ে রেখে মজুরি নিয়ে চলে।

কীর্তি আর নিজেকে একা পেয়ে এক নিঃশ্বাসে মগন টকলা বস্তার দড়িদড়া কেটে ফেলল। কৌতূহলের সঙ্গে খুলে নিল মূর্তির আবরণ। এখন মূর্তিটি তার সামনে। ‘পারফেক্ট’–মগন মূর্তিকে দেখল, শুকিয়ে গেল তার গলা। সে ভেবেছিল যে কীর্তি তাকে নিজের সামনে ওই শিল্পমূর্তিকে দেখতে দেবে না। কিন্তু কীর্তি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তার সামনে, কোনোরকম আবেগ ছাড়াই শিল্পের নারীমূর্তি পূর্ণতাপ্রাপ্ত হল, আর পুরুষমূর্তি আত্মবিস্মৃত হয়ে তার দুই কাধ ধরে দাঁড়িয়ে রইল–মগন টকলা এই যুগলমূর্তিকে যত্নের সঙ্গে দেখল–সে বোধহয় নিভৃত অবসরে মূর্তিটাকে আরো ভালো করে দেখতে চাইছিল।

মগন দ্রুত জিজ্ঞেস করল।

অপারেশনের জন্যে কত টাকা চাই?

অপারেশনের জন্য নয়–নিজের জন্য।

‘নিজের জন্যে? … মা…’

কয়েক সপ্তাহ হল মারা গেছেন।

মগন তার নিজের চেহারায় দুঃখ আর আফসোসের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কীর্তি তা চায়নি। তার দুই ঠোঁট চেপে বসেছিল। ওই রকমই বিষণ্ণভাবে সে বলেছিল, ‘আমি এর জন্যে হাজার টাকা নেব…’

মগন চকিত হয়ে গিয়েছিল। তার কথায় ছিল তোতলামি–এর জন্যে কেউ হাজার টাকা দিতে পারে?

‘হ্যাঁ।’ কীর্তি জবাব দিয়েছিল–’আমি কথা বলে এসেছি… বোধহয় আমি আরো বেশিই পাব … আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তাই…।

‘আমি তো…আমি তো পাঁচশ’ টাকার বেশি দিতে পারব না।’

না।’ কীর্তি মজুরের সন্ধানে বাইরের দিকে দেখতে লাগল। মগন টকলা তাকে থামাল–’আর দুশ’ নিয়ে নাও।’

‘হাজারের চেয়ে কম এক টাকা নেব না।’

মগন হয়রান হয়ে কীর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। আজ কীর্তির মেজাজ অন্যরকমও। ও কি খাজুরাহো গিয়েছিল? দেখা হয়েছিল ট্যুরিস্টদের সঙ্গে? যে-কোনো মূল্যে কলাকারকে তার মার্কেট থেকে দূরে সরিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু… কিন্তু… সে ‘রোলটপ’ তুলে আটশ’ টাকার নোট গুণে কীর্তির সামনে রাখল। কীর্তি তাড়াতাড়ি তা গুণে দেখে মগনের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলল।

‘আমি বলেছি–হাজার টাকার কম নেব না।’

‘আচ্ছা, নয়শ’ টাকা নাও…’

‘না।’

‘সাড়ে নয়শ’… নয়শ’ পঁচাত্তর..।’ কীর্তির দৃষ্টিতে অহংকারের ভাব দেখে সে এক শ’ টাকার দশখানা নোট তার হাতে দিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো মিথুন-মূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে ছিল কীর্তি। সে তার আপন শিল্পকর্মের তারিফ শোনার জন্য থেমে গিয়েছিল। মগন মিথুন-মূর্তির মধ্যে রমণী-মূর্তির দিকে তাকাল। সে মূর্তি কীর্তি নিজেই। তার চোখে জল কেন? সে কি আত্মতোষের গভীর অনুভূতির ফল অথবা কোনো জীবন-পীড়নের প্রতীক? তা কি দুঃখ আর সুখ, বেদনা আর বেদনা-উপশমের সম্পর্ক-জাত, যা থেকে পুরো সৃষ্টি উপস্থিত? মগন আবার পুরুষ-মূর্তির দিকে তাকাল–যে মূর্তি ওপর থেকে সুন্দর কিন্তু ভেতরে ছিল পুরো অসুন্দর। কীর্তি কেন পুরুষমানুষের কঠোরতার ওপর জোর দিল … এই মূর্তি হল মিথুন-মূর্তি, কিন্তু এ তো সে মিথুন নয় যা পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনে হয়… ঠিক আছে … বিপরীত মূর্তিতে বেশি টাকা পাওয়া যাবে…।

মগন টকলা ওপরের দীপদান টেনে এনে পুরুষ-মূর্তির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল–

‘এই… আমি এই মূর্তিকে কোথায় যেন দেখেছি?

কীর্তি কোনো জবাব দিল না।

‘তুমি।’ মগন যেন সবটাই বুঝে ফেলেছে—

‘তুমি সিরাজার সঙ্গেই বাইরে গিয়েছিলে?’

কীর্তি এগিয়ে এসে মগন টকলার মুখের ওপর সজোরে এক থাপ্পড় মেরে নোটগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *