1 of 2

ছিপ – অদ্রীশ বর্ধন

ছিপ – অদ্রীশ বর্ধন

কলোনির অন্যান্য লোকদের কাছে শুনেছিলাম, অতীতে বোম্বাইয়ের গোয়েন্দা-বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন বৃদ্ধ মৃগাঙ্কবাবু। এই কথা শোনার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার বাসনা আমার মনে জেগেছিল। বয়সেও বিরাট ব্যবধান থাকলেও তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পর্যায়ে আমি পৌঁছেছিলাম। আমার পরিচয় সম্বন্ধে তিনি শুধু এইটুকুই জানতেন যে আমি দেবব্রত ব্যানার্জি, কলকাতার ব্যাঙ্কের কেরানী, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আশায় এসেছি সমুদ্রতীরবর্তী এই স্বাস্থ্যকর কলোনিটিতে। কোনদিন ঘুণাক্ষরে অনুমান করতে পারেননি, বর্তমানে ভারতের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দাপ্রবরদের অন্যতম আমিই শ্রীপ্রশান্ত লাহিড়ী, ছদ্মনামে স্বাস্থ্য ফেরাতে এসেছি এখানে। শহরের কলরোল ছেড়ে এসেছিলাম শুধু শান্তি আর নির্জনতার লোভে—তাই নিজের নাম প্রকাশ করে সে আশাটুকু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইনি।

তারপর একদিন কথায় কথায় তাঁকে যে প্রশ্ন আমি করলাম, সে প্রশ্ন বোধ হয় সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে প্রত্যেক গোয়েন্দাকে শুনে আসতে হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা মৃগাঙ্কবাবু, আপনি কোন হত্যা-মামলায় কোনদিন কাজ করেছেন?’

আমার দিকে তিনি একটা বিদ্যুচ্চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন—অর্ধ-কৌতুকময়, অর্ধ-সন্দিগ্ধ সে দৃষ্টি। তারপর বললেন, ‘আমি সি-আই-ডি ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল ব্রাঞ্চে ছিলাম। যত রাজনৈতিক আর সন্দেহজনক বিদেশীদের নিয়েই ছিল আমার কর্মক্ষেত্র। তবে একবার একটা হত্যায় আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম—সেটা অবশ্য আত্মহত্যা····’ এই বলেই তিনি চুপ করে গেলেন, চোখের তারা দুটি ঝিকমিক করে উঠল, ‘আপনাকে সে সম্বন্ধে আমি পরে একটা অদ্ভুত কাহিনী বলব····!’

হপ্তাখানেক পরে অপরাহ্নে চা-পানের পর আমরা বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেছিলাম। তিনি বিষণ্ণ-শান্ত চোখে সমুদ্রের তরঙ্গ-নৃত্য দেখছিলেন। মুখটা বিযাদাচ্ছন্ন, চোখের দৃষ্টিতে কেমন জানি উদাস ভাব মাখানো। অধিকাংশ সময়েই উনি এইভাবে চুপ করে বসে থাকতে ভালবাসেন। আমিও বসেছিলাম চুপ করে।

এক সময় আস্তে আস্তে বললাম, ‘মৃগাঙ্কবাবু, আপনি একদিন বলেছিলেন একটা আত্মহত্যার কাহিনী বলবেন···· ।’

যেন চমক ভাঙল মৃগাঙ্কবাবুর। পাইপটায় তামাক ভরে নিয়ে আবার তাকিয়ে রইলেন স্থির চোখে। দৃষ্টিকে পাঠিয়ে দিলেন বহু দূরে আকাশের কোলে, যেখানে অস্তগামী সূর্যের অপূর্ব সুষমায় আকাশ রাঙা হয়ে আছে। সেখান থেকে যখন দৃষ্টি ফেরালেন, তখন বুঝলাম বিগত দিনের মালঞ্চ থেকে উনি চয়ন করে আনছেন একটি স্মৃতি-পুষ্প।

বললেন, ‘দেবব্রতবাবু, বোম্বাইতে কাজ করার সময়ে আমায় একবার বিশেষ কাজে বেশ কিছুদিন কলকাতায় থাকতে হয়েছিল। খিদিরপুরের দিকে আমার বাড়ি ছিল, আর ছিল আমার এক বন্ধু। নাম তার জয়ন্ত। সত্যিই, জয়ন্তর সঙ্গে আলাপ হলে তাকে আপনি পছন্দ না করে পারবেন না। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে মেশবার তার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল—সেটা তার বিশেষত্ব। আমরা দুজনে প্রায় প্রতি রোববারেই হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর পর্যন্ত চলে যেতাম—ফিরতে রাত হয়ে যেত।·····যে রাতের কথা আমি বলছি, সে রাতে বেশ এক চক্কর ঘুরে এসে জয়ন্তর বাড়িতেই আমি রাতের আহারটা সেরে নিলাম। ঘুমে আমার তখন দু-চোখ জুড়ে আসছে। ওর বাড়ি থেকে প্রায় শ’ খানেক গজ দূরেই আমার বাড়ি। জয়ন্ত কিন্তু বলে উঠল, ‘এস হে মৃগাঙ্ক, দু-এক পেগ খেয়ে যাবে না !’ নেশা ছিল না—তবে যে লাইনে ছিলাম, সেখানে অত্যধিক ক্লান্তির পর শরীরটাকে তাজা করবার জন্য মাঝে মাঝে রাম, হুইস্কি, ভারমুথের স্মরণ নিতে হত। জয়ন্তর অনুরোধ ঠেলতে পারলাম না—ঢুকে পড়লাম ওর ঘরে। ভেতর থেকে একে একে জানলাগুলোর ছিটকিনি তুলে দিতে লাগল জয়ন্ত।

‘ওর এই ব্যাপারটা নিয়ে ওকে নিয়মিত ঠাট্টা করতাম। সারাদিন যখন সে বাইরে থাকত, জানলাগুলো থাকত খোলা—আর রাতের বেলা যত কিছু ছিটকিনি, খিল আর তালা! একদিন নয়, দু’দিন নয়—প্রতি রাত্রে এই ছিল তার অভ্যাস। এমন কি শোবার ঘরেও সে জানলা-দরজা ভেতর থেকে এঁটে শুতো। যাই হোক, পেগ-বোতলগুলো তুলে রেখে যখন পথে বেরোলাম, শুনতে পেলাম জয়ন্ত আমার পেছনেই তালা লাগিয়ে দিল দরজায়।

‘জয়ন্তকে আমি সেই শেষবারের মত জীবিত দেখি।

‘পরের দিন সকালে ট্রাম ধরতে যাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম সামনের দিক থেকে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার দিকে হন হন করে এগিয়ে আসছে। শুনলাম, সকালবেলা ঠিকে ঝি’টা যথা সময়ে কাজ করতে এসে যখন দেখল দরজা বন্ধ, কোন সাড়া নেই আর গ্যাসের তীব্র গন্ধ—তখন সে ডেকে আনল পাহারাওলাকে। পাহারাওলা ইন্সপেক্টরকে ডেকে এনে জানলা ভেঙে বাড়িতে ঢুকল, তারপর শোবার ঘরে গিয়ে দেখলে, বিছানার ওপর শায়িত জয়ন্তর মৃতদেহ আর সব ক’টা গ্যাসের বুনসেন বার্নারের চাবি খোলা।

জয়ন্ত কেমিস্ট ছিল। ওর শোবার ঘরেই পার্টিশন-ঘেরা ছোট্ট একটা কাবার্ডে তাই সব সময় বুনসেন বার্নার, কেমিক্যালস্ আর অন্যান্য সরঞ্জাম মজুত থাকত। সব ক’টা বার্নার থেকে এত গ্যাস বেরিয়েছে, পাহারাওলাটা নাকি ঘরে ঢুকেই প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল।

‘যাই হোক, ইন্সপেক্টর আমায় চিনত, এ সংবাদও রাখত যে জয়ন্ত আমার বিশেষ বন্ধু। তাই সর্বপ্রথমেই ছুটে এসেছে আমার কাছে। তার সঙ্গে ঢুকলাম বাড়ির মধ্যে। মনে পড়ে যে, প্রথমেই সিঁড়ির নিচে খুপরি-ঘরটায় গ্যাসমিটারটার ওপর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। শুধালে, ‘আচ্ছা মৃগাঙ্কবাবু, আমার তো মনে হয় এটা নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না। ধরুন, উনি বার্নার জ্বালতে গিয়ে দেখলেন যে মেনকক্‌টা বন্ধ। অত রাতে আর কে নিচে নামে বলুন! উনি চাবিগুলো বন্ধ করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আচ্ছা, এই সময়ে যদি একটা বেড়াল ওই ঘুলঘুলিটার ভেতর দিয়ে লাফিয়ে পড়ে মেনকক্‌টার ওপর—’ খুপরি-ঘরটার প্রায় ছাদের কাছে, মিটার থেকে ফুট দশেক উঁচুতে একটা ভেন্টিলেটর ছিল। চার চৌকো গর্ত একটা, এবড়ো-খেবড়ো, কিন্তু মোটা মোটা শিক বসানো। কিন্তু তাও দেখছি সম্ভব নয়,’ হতাশ ভাবে মাথা নাড়তে থাকে ইন্সপেক্টরটি, ‘যদিও মেনকক্‌টা খুব আলগা—কিন্তু একে খুলতে হলে তো দেখছি ওপর দিকে পাক দিতে হয়।’

‘মৃতদেহটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। দুঃখিত ভাবে ইন্সপেক্টরটি বললে, ‘চমৎকার মানুষ ছিলেন জয়ন্তবাবু। শেষে আত্মহত্যা করলেন।’

‘তারপর যথারীতি পুলিশ তদন্ত হল। জয়ন্ত সব ক’টি জানলা-দরজা ভাল করে এঁটে বার্নারগুলোর চাবি খুলে দিয়েছিল—কাজেই যথা সময়ে করোনার তাঁর রায় দিলেন—আত্মহত্যা।’

‘পুলিশী তৎপরতার শেষ ওখানেই।······কিন্তু ব্যাপারটা এত সোজা ছিল না, কেননা জয়ন্ত মোটেই আত্মহত্যা করেনি—তাকে ধীর মস্তিষ্কে খুন করা হয়েছিল !’

আমি লাফিয়ে উঠলাম ; বৃদ্ধের বাচনভঙ্গিতে আমি এমনই বিস্ময়-চকিত হলাম যে মুখ দিয়ে অজ্ঞাতসারেই বেরিয়ে গেল : ‘খুন। কেমন করে?’

‘একটা ছিপ দিয়ে।’ বললেন মৃগাঙ্কবাবু।

বিস্ফারিত চোখে আমি তাকিয়ে রইলুম। ‘জয়ন্তবাবু গ্যাসে আত্মহত্যা করেননি—একটা ছিপ দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে! এ সংবাদ তাহলে পরে প্রকাশ পেয়েছিল—তাই নয় মৃগাঙ্কবাবু?’ বললাম আমি।

‘না, কোনদিনই প্রকাশ পায়নি।’

‘কিন্তু আপনি তো জানতেন? আপনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন·····’

‘তবু কেন আমি বললাম না? মাথাটা কাত করে আমার দিকে তাকালেন তিনি। অনেক কারণে মশাই—অনেক কারণে। অতবড় একটা সত্য কোন সি-আই-ডি অফিসারের চোখ এড়িয়ে যাওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার—আমারও যায়নি! কিন্তু জয়ন্ত মৃত। তার হত্যাকারীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলালে কি সে আর ফিরে আসবে? তাছাড়া আমি নিজেও একটা সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে তার যতটুকু প্রাপ্য ততটুকু সে পেয়েছে।’

‘কিন্তু আপনার ক্লু কি?’ প্রশ্ন করলাম আমি।

‘ক্লু খুঁজতে গেলে আরো ছ’ বছর পিছিয়ে যাওয়া দরকার। আর একজন লোকের প্রসঙ্গে তাহলে আমাদের আসা দরকার—তার নাম এখনো পর্যন্ত আমি উল্লেখ করিনি। জয়ন্তর বন্ধু সে, তার নাম·····না, তার নামের কোন প্রয়োজন নেই। তার সন্তান এখনো জীবিত। ধরা যাক, তার নাম ছিল তন্ময়।

‘আমার সঙ্গে জয়ন্তর আলাপ যতদিনের, তন্ময়ের সঙ্গেও জয়ন্তর ঘনিষ্ঠতা প্রায় ততদিনেরই। জয়ন্তর মৃত্যুর ছ’বছর আগে পর্যন্ত তাদের সে ঘনিষ্ঠতা অম্লান, অক্ষুন্ন ছিল। ওই সময়ে তন্ময়ের বিবাহ হয়। আর এরপর থেকেই আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হত ক্কচিত-কদাচিৎ।’

‘আমরা—’

মাথা নত করে সায় দিলেন মৃগাঙ্কবাবু। ‘আমরা মানে তিন বন্ধু-আমি, তন্ময় আর জয়ন্ত। ব্যবসার কাজে কখনো কখনো তন্ময়কে কলকাতার বাইরে গিয়ে বেশ কিছুদিন থাকতে হত। তা সত্ত্বেও সে সময়ে যখনই আমরা কোন ছুটি পেয়েছি—তিন বন্ধু মিলে একসঙ্গে উপভোগ করেছি সে ছুটি। এমনই নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল আমাদের। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই তন্ময় তার অবসর সময় কাটাতে শুরু করলে তার নব পরিণীতা তরুণী ভার্যার সঙ্গে। আর সত্যিই ভালবাসত বটে তন্ময়! সমস্ত হৃদয়টা সে যেন স্ত্রীর হাতে সঁপে দিয়েছিল—’ সংযত স্বরেই কথা বলছিলেন মৃগাঙ্কবাবু, তবুও শেষ শব্দগুলি উচ্চারণ করার সময় তাঁর গলা যেন ঈষৎ কেঁপে উঠল। বলে চললেন উনি, ‘নিজের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে এরকম গভীর ভালবাসা বড় একটা দেখা যায় না—স্ত্রীকে তার অদেয় কিছু ছিল না, স্ত্রীর সামান্য শরীর খারাপ হলে চিন্তায় তার নিজের শরীরও যেন হয়ে উঠত অসুস্থ। প্রথম যৌবনের সে ভালবাসায় কোন মলিনতা, কোন স্বার্থ তার ছিল না।’

‘আর তাঁর স্ত্রী?’

‘তিনিও ভালবাসতেন,’ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললেন মৃগাঙ্কবাবু, ‘ও, হ্যাঁ, সত্যিই স্বামীকে ভালবাসতেন তিনি। তবে তন্ময়ের মত নয়। তন্ময় যেন নিজের হৃদয় দিয়ে তাঁকে দেবীর মত আরাধনা করত, আর তিনি শুধু তাকে ভালবাসতেন। কি সুন্দর·····কিন্তু তবুও তাদের এই সুখের পথের শেষে অপেক্ষা করছিল এক শোচনীয় বিয়োগান্তক ঘটনা। একটি শিশু : আর সূত্রপাত হল যত অনিষ্টের। যমে-মানুষে টানাটানি চলল, ডাক্তাররা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনলেন তার স্ত্রীকে— কিন্তু শিশুটিকে বাঁচাতে পারলেন না। যাবার সময় ডাক্তাররা তন্ময়কে সতর্ক করে দিয়ে গেলেন, আবার যদি তিনি গর্ভবতী হন, তাহলে পৃথিবীতে তাঁকে আর কেউ ধরে রাখতে পারবে না। আপনার বোধ হয় শুনতে ভাল লাগছে না, নয়? জীবন আর মৃত্যু—অতি সাধারণ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা—আর তবুও····’

বললাম, ‘আপনি থামবেন না, আমার ভালই লাগছে।’

গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন মৃগাঙ্কবাবু। দূরে দিগন্তরেখার দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে ধরলেন। ‘আমার আর ক’টা বছরই বা পরমায়ু·····যাক, তন্ময় ডাক্তারের সতর্কবাণী কোনদিন ভোলেনি, কিন্তু তার স্ত্রীর ভালবাসায় বুঝি মালিন্য এসেছিল—তাই এর পরের শিশুটি তন্ময়ের ছিল না। সতর্কবাণীও ব্যর্থ হল না—’ চোখের ইঙ্গিতে মৃগাঙ্কবাবু বাকি কথাটা শেষ করে দিলেন।

‘তন্ময়বাবু জানতে পেরেছিলেন?’

‘প্রকৃত পিতা কে? না, তখনো নয়·····সে সময়ে ডাক্তাররা সমর্থ হল শিশুটিকে রক্ষা করতে। স্ত্রীর দেহ ছাই হয়ে যাবার পর তন্ময় একজন ভাল নার্স এনে শিশুটিকে সঁপে দিলে তার হাতে।’

বিষণ্ণভাবে মৃগাঙ্কবাবু একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। ‘এরপর সব গল্পে যে রকম লেখে, এ ক্ষেত্রে কিন্তু তা হল না। তন্ময়ের উচিত ছিল, শিশুটিকে দেখবামাত্র ঘৃণায় সরে যাওয়া, ও শিশু তো তার নয়—আর ওর জন্যেই তো তাকে হারাতে হয়েছে তার স্ত্রীকে। কিন্তু কেন জানি না, শিশুটিকে না দেখলে সে থাকতে পারত না। যত দিন যেতে থাকে, বয়স তার বাড়তে থাকে—আর বাড়তে থাকে তার ওপর তন্ময়ের স্নেহ।

‘আর তারপরেই ঘটল এক অদ্ভুত ব্যাপার। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেল যে শিশুর ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাতটি অধিক তৎপর অর্থাৎ সে লেটা। আপনি হয়তো বলবেন, এতে আর এমন কি হয়েছে। কিন্তু কিছু দিন বাদে দেখা গেল আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার—প্রশ্ন করবার সময়ে শিশুটি অদ্ভুতভাবে একটা ভুরুকে বেঁকিয়ে ওপর দিকে তুলছে। অনেকটা এই রকম ভাবে আর কি—না, আমার দ্বারা হবে না। যাই হোক, আমি কি বোঝাতে চাইছি, তা নিশ্চয় বুঝছেন আপনি।’

মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম আমি। ‘ওরকম সাধারণত দেখা যায় না। কতকগুলি স্নায়ু যদি একসঙ্গে মিলে-মিশে কাজ না করে—এরকম ভুরু বেঁকিয়ে প্রশ্ন করা দেখা যায় বটে। যাই হোক, ঘটনাটা রীতিমত ইন্টারেস্টিং কিন্তু!’

‘শিশুর মধ্যে এই দুটি লক্ষণ আবিষ্কার করার পর তন্ময়ের মনে নরকের আগুন জ্বলে উঠল। কারণ, সে জানত, তারই জানাশুনো একজন মাত্র লোকেরই ওই রকম ভুরু তুলে প্রশ্ন করার অভ্যাস আছে—আর, সে বাঁ হাতেই সব কাজ করে।····জয়ন্তই সে পুরুষ·····তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু।’

‘কিন্তু সেটা তো কোন প্রমাণ নয়—’

‘প্রমাণ নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করছি না,’ ঈষৎ উষ্ণ স্বরে বললেন মৃগাঙ্কবাবু, ‘বিষটা তন্ময়ের মনে কিভাবে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল—শুধু সেই ছবিটাই আপনার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা আমি করছি। এতদিন তার মনে সন্দেহের বাষ্পটুকুও ছিল না। কিন্তু নিতান্ত অকস্মাৎ বিশ্বাস তার দৃঢ় হয়ে গেল। শিশুর মাকে সে যেমন ভালবাসত, তেমনই ভালবাসত সেই বাচ্চাটিকে —দেখত তারই সামনে তাকে খেলাধুলো করতে—আর দিনের পর দিন এই দৃশ্য তাকে স্মরণ করিয়ে দিত শিশুর জন্ম-রহস্য। এই কথা চিন্তা করলেই তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো রক্তের চাপে যেন ফেটে পড়বার মত হত····মাঝে মাঝে মনে হত এবার বুঝি সে উন্মাদ হয়ে যাবে—অসহ্য, দুঃসহ সে চিন্তা····কিন্তু জয়ন্তর সাথে তার বন্ধুত্ব রইল আগের মতই নিবিড়, অম্লান। অপেক্ষা করতে লাগল তন্ময়, অপেক্ষা করতে লাগল উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত স্থানের জন্যে, অপেক্ষা করতে লাগল সেদিনের জন্য—যেদিন সে নেবে স্ত্রী-হত্যার নিষ্ঠুর প্রতিশোধ—’

পাইপটার আগুন নিভে গেছল। তামাক ভরে আবার জ্বালিয়ে নিলেন মৃগাঙ্কবাবু। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, খুনটার প্ল্যানটা এখনও ধরতে পারেননি আপনি?’

‘আপনি একটা ছিপের কথা বলছিলেন না?’

‘হ্যাঁ, সাধারণ ছিপ না—ফোলডিং ছিপ।’

‘পেরেছি। কিন্তু আপনার মুখেই শুনতে চাই।’

বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালেন মৃগাঙ্কবাবু। ‘আপনি প্ল্যানটা বুঝতে পেরেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ বললাম আমি।

চুপ করে রইলেন মৃগাঙ্কবাবু। তারপর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন, ‘ছিপটা বাগানের গুদামের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিল তন্ময়। আপনাকে তো আগেই বললাম, আমরা তিনজন বহু বছর ধরে মাইলখানেক জায়গার মধ্যে বাস করে এসেছি। বাড়ির বাইরে আর ভেতরে একজনের গতিবিধি আর একজনের কাছে অজানা ছিল না।·····যে সন্ধ্যাতে আমি আর জয়ন্ত বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, তখন তন্ময় জয়ন্তর বাড়িতে ঢুকে প্রথমে সিঁড়ির তলায় মেনকক্‌টা দিয়েছিল বন্ধ করে। তারপর শোবার ঘরে গিয়ে সব কটা বুনসেন বার্নারের চাবি খুলে দিল। অত রাতে ফিরে জয়ন্ত যে বার্নার জ্বালিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে যাবে না—তা সে জানত। আর তাছাড়া, ক’টা চাবি ঘোরানোর মধ্যে এমন কিছু অস্বাভাবিকতা নেই যে জয়ন্তর চোখে তা ধরা পড়বে। অত রাতে অ্যালকোহলের নেশায় বিছানায় শোওয়া মাত্র গভীর ঘুমে সে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল।

‘দরজার কাছ থেকে জয়ন্তর কাছে বিদায় নিয়ে আমি যখন চলে আসি, তখন বাগানে লুকিয়ে ছিল তন্ময়। শোবার ঘরের আলো না নেভা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে রইল, তারপরেও আধ ঘণ্টা রইল লুকিয়ে। তারপর যখন, আমার অনুমান—যখন জয়ন্তর নাসিকাধ্বনি শুনতে পেলে, তখন বেরিয়ে এল বাইরে। গ্রীষ্মকালের পরিষ্কার রাত—হাতে সময়ও রয়েছে প্রচুর। কাজেই ধীরে-সুস্থে কাজ শুরু করল তন্ময়। ছিপের টুকরো টুকরো অংশগুলো নিয়ে পর পর জুড়ে ফেলল····তারপর এসে দাঁড়াল জয়ন্তর শোবার ঘরের জানলার নিচে। জানলার সার্শিতে লম্বা ছিপটা দিয়ে দিলে ছোট্ট একটা টোকা।

‘তারপর অনুমান করে নিন, আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অপেক্ষা করল সে····অবশেষে সে নিশ্চিন্ত হল যে, অঘোরে ঘুমোচ্ছে জয়ন্ত। এরপর বাকি কাজটা খুবই সহজ—ছিপটাকে আবার টুকরো টুকরো করে ফেলা হল, খুপরির ঘুলঘুলি দিয়ে একটির পর একটি টুকরো গলিয়ে দিয়ে আবার জুড়ে ফেলতে লাগল তন্ময়। তারপর খুপরির অন্ধকারে ছিপটা কিছুক্ষণ নাড়লে এদিক ওদিক। শেষকালে ছিপের ডগায় যে গোল রিংটা ছিল, সেটা আটকে গেল মেনককে। ওপর দিকে ছোট্ট একটি টান—খুলে গেল গ্যাসের পথ, আস্তে আস্তে ছিপটাকে খুলে নিয়ে বাইরে বার করে আনল তন্ময়। অবশেষে ছিপের বাণ্ডিলটাকে রেন-কোটের তলায় রেখে বেড়াতে বেড়াতে ফিরে এল বাড়িতে। শেষ হয়ে গেল সব।’

‘জয়ন্তবাবুর যদি ঘুম ভেঙে যেত?’ বললাম আমি।

‘তাতে তন্ময়ের বিশেষ কিছু হত না। আধখানা জীবন পড়েছিল তাদের সামনে—একদিন না একদিন আর একটা উপায় খুঁজে বার করতই। কিন্তু বিচারের সেই রাতটিতে জয়ন্তর ঘুম ভাঙেনি—কোনদিনই আর ভাঙল না····.’

প্রায় হপ্তা দুয়েক পরে বিকেলের দিকে বেড়াতে বেড়াতে গেলাম মৃগাঙ্কবাবুর বাড়ি। কিন্তু চায়ের আসরে সেদিন তিনি আর একলা নন। একজন মধ্যবয়সী লাবণ্যময়ী সুশ্রী ভদ্রমহিলা তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সীমন্তে অঙ্কিত তাঁর সিদুর রেখা।

চলে আসছি, হঠাৎ পেছন থেকে সমস্বরে ডাক দিলেন মৃগাঙ্কবাবু, ‘আরে মশাই, চললেন কোথা! বসুন, বসুন!’

যেতে আর পারলাম না। উনি হাসিমুখে বললেন, আলাপ করিয়ে দেবার আর দরকার নেই, একটু আগেই আপনার কথাই বলছিলাম। এই আমার একমাত্র কন্যা—পদ্মিনী চ্যাটার্জি—শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে এসেছে আমায় দেখতে।’

উনি আমাকে একদিনও ওঁর কন্যার উল্লেখ আমার কাছে করেননি। কিন্তু দুজনে মিলে আমায় এমন আন্তরিক অনুরোধ করতে শুরু করলেন যে তাঁদের নিবন্ধ এড়াতে না পেরে থেকে গেলাম। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, পদ্মিনী চ্যাটার্জি শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায়ই চলে আসেন এখানে। বৃদ্ধের জরা-অঙ্কিত মুখে সেদিন সে কি অস্বাভাবিক উল্লাস আর আনন্দের প্রতিচ্ছবি দেখলাম! কন্যার সংস্পর্শে এসে যেন বেশ কয়েক বছর বয়স তাঁর কমে গেছে। অনর্গল তিনি কথা বলতে লাগলেন, মুহূর্তের জন্যও কন্যার ওপর থেকে দৃষ্টি সরালেন না। দেখলাম পদ্মিনী দেবীও পিতা-অন্ত প্রাণ!

নিঃশব্দে এই স্নেহ-মধুর দৃশ্য অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করছি, এমন সময়ে আমার ওপর চোখ পড়তেই হেসে ফেললেন পদ্মিনী দেবী।

‘আমাদের এই বকবকানি শুনে আপনি কিছু মনে করছেন না তো? অনেকদিন বাদে বাবার সঙ্গে দেখা হল কিনা, তাই। কিন্তু এখন তো দেখছি, বাবা একজন সত্যিকারের সঙ্গী পেয়েছেন—আমার পক্ষে সেটা খুব বিপদের কথা।’ কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তাই নয় বাবা?’

বলে একটা সুদৃশ্য ভুরু অদ্ভুত ভাবে বেঁকিয়ে তুললেন ওপর দিকে, আর তারপর লক্ষ্য করলাম, তিনি চা ঢালছেন বাঁ হাত দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *