1 of 2

ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোম্পানি – মোহিতমোহন চট্টোপাধ্যায়

ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোম্পানি – মোহিতমোহন চট্টোপাধ্যায়

ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোম্পানি – মোহিতমোহন চট্টোপাধ্যায়

সে-আওয়াজের কাছে কলকাতা আকাশবাণীর আকাশ ফাটানো বিচিত্র চিৎকারও ম্লান হল—

সে-আওয়াজ এমনই হঠাৎ, এমনই তীব্র আর ভীষণ যে ভোম্বলদাসের স্নায়ুগুলো ঝনঝন করে উঠল, পলকে প্রলয় ঘটল—

রোজনামচার পাতায় রোজের হিসেব-নিকেশের জের টানছিল সে, হাত থেকে কলম ছিটকে পড়ল, বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠল, চোখের নিমেষে তড়বড় করে চেয়ারের ওপর উবু হয়ে বসল।

দর্শন আর শ্রবণ ছাড়া আর সব ইন্দ্রিয়গুলির সাময়িক বৈকল্য ঘটল যেন।

আবার বদ্ধ ঘরকে শিউরে ছড়িয়ে পড়ল সে-আওয়াজ।

সে-আওয়াজে রান্নাঘর থেকে ছুটে এল কেবলরাম,—এগোয়ও দরজার দিকে ; কিন্তু যেমন দরজা খুলবে অমনি ভোম্বলদাস মুখে বিশ্রী একটা শব্দ করে উঠল, শস্-স্-স্—

চমকে থমকে দাঁড়াল কেবলরাম।

সামনের দিকে একটু ঝুঁকে চোখদুটো বড় বড় করে চাপা গলায় বলল সে, কোথায় যাচ্ছ?

তার রকম সকম দেখে কেবলরাম ভড়কে গিয়ে বলল, দরজা খুলতে।

কেন?

কে ডাকছে যে।

দরজা যে খুলবে তুমি তৈরি?—বাধা দিয়ে ভোম্বলদাস বলল।

তৈরি!

হ্যাঁ। কে ডাকছে তুমি জানো?

না-জানার ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে কেবলরাম বলল, কিন্তু একজন কেউ তো ডাকছে—

এবং সে শত্রু হওয়াই নেচারাল। আমাদের যা প্রফেশন, ভুলো না তাতে পদে পদে বিপদ।

ভীমবিক্রমে আবার কলিং বেল বেজে উঠল!

আওয়াজটাকে ফলো করেছ? কেমন অস্থির, ফিক্‌ল্‌? তার মানে যে এসেছে সে আর অপেক্ষা করতে রাজী নয়।

তাই তো দরজাটা খুলে দেখছিলুম।—ঘাড়ের কাছটা চুলকোতে চুলকোতে বলল কেবলরাম।

খুলে হয়তো দেখবে পিস্তল উঁচিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে কিংবা স্টেনগান কি ব্রেনগান বাগিয়ে রয়েছে—

তাহলে?—নিরুপায় ভঙ্গিতে বলল কেবলরাম।

তাই বলছিলুম তৈরি হতে হবে। শত্রুই হোক মিত্রই হোক, কারুর কাছে নিজের এ্যাকোয়েন্টেন্স দেবে না—

কলিংবেলে কাজ হল না দেখে আগন্তুক এবার দুম দুম করে আঘাত করতে শুরু করল।

প্রথম আঘাতেই ভোম্বলদাস ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতন লাফিয়ে চেয়ার থেকে নেবে তড়বড়ে ফিসফিসিনির সঙ্গে বলল, কেবলরাম, শিগগির কেমুফ্লেজ—দরজা ভাঙার আগে—

কেবলরাম সারা ঘরে বোঁ বোঁ করে কয়েক পাক ঘুরে বলল, কোথায় কেমুফ্লেজ ভোম্বল—

ভোম্বলদাস খিঁচিয়ে উঠল, এই বুদ্ধি নিয়ে তুই আমার অ্যাসিসটেন্ট হবি! ছদ্মবেশ পর হাঁদারাম! শিগগির একটা গোঁফ চড়িয়ে নাও, আর গগল্স্—

তার দিকে আর না তাকিয়ে ঝড়াৎ করে ড্রয়ার খুলে রিভলবার বের করল সে। তখন গোঁফ আর গগলস শোভিত তাকে দেখে বোঝাই যাবে না, সে ভোম্বলদাস অ্যান্ড কম্পানির ভোম্বলদাস।

গোঁফ এঁটে কাঁপা গলায় কেবলরাম বলল, ভোম্বল, ওদের কাছে যদি সত্যিই পিস্তল কি স্টেনগান থাকে, তাহলে—

কোন ভয় নেই।—দরজা টিপ করে রিভলবার বাগিয়ে বরাভয় দিয়ে বলল ভোম্বলদাস, দরজা খুলে দাও এবার কেবলরাম।

খুলব?

হ্যাঁ, খুলবে। নইলে এবার ভেঙে ফেলবে—

কিন্তু তোর ওটা যে টয় রিভলবার!—কাঁদো কাঁদো গলায় বলল কেবলরাম।

খিঁচিয়ে উঠল ভোম্বলদাস, আসল রাখি আর পুলিশে চালান দিক,—কী বুদ্ধি তোর!

তাহলে?

হস্তীমূর্খ! হাজার বার বলেছি না যে, গোয়েন্দাদের কাজ উদ্ধার করতে হয় ছলে-বলে-কৌশলে, তাদের নেসেসারি রিভলবার নয়, বুদ্ধি—ট্যালেন্ট। যাও, এগোও

এগিয়েও পিছিয়ে এল কেবলরাম। প্রায় কেঁদে ফেলে সে, ভোম্বল, আমার হাত কাঁপছে—

কাওয়ার্ড!—তাকে চাবকে দিয়ে ভোম্বলদাস বুক চিতিয়ে এগিয়ে গেল।

সারা পৃথিবীটা তখন নিস্তব্ধ—

অতি সাবধানে ভোম্বলদাস যেমন খিলে হাত দিয়েছে, অমনি—

দুম্ দুম্—

লাফিয়ে পিছিয়ে এল সে। একটু দাঁড়াল, মনে মনে বোধ হয় ভেবে নিল, এরপর গোয়েন্দাদেরকী কর্তব্য!

ঠিকও করে ফেলল সে, কেননা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে এগিয়ে এবার দরজাটা খুলে একপাশে সরে গেল—

হুড়মুড় করে প্রবেশ করল একজন কিশোরী। স্বল্পালোকিত ঘরের কিছু দেখতে পায় না বলে বারকতক চোখ পিট পিট করে।

কিন্তু মাঝপথে তা থেমে গেল ভোম্বলদাসের হুঙ্কারে, হ্যান্ডস্ আপ—

হকচকিয়ে হাত তুলল সে।

ভোম্বলদাসের তীব্র প্রশ্ন শোনা গেল আবার, ফ্রেন্ড অর ফো?

অ্যাঁ?

শত্রু না মিত্র?

কিশোরীটি হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল, ভোম্বলদাস অ্যান্ড কম্পানি এইটা?

হ্যাঁ। কী চাই আপনার?

আমি ভোম্বলদাসবাবুকে চাই—মানে আমার ভয়ানক বিপদ—

কয়েক সেকেন্ড এক্সরে চোখে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর গুরুগম্ভীর গলায় জিগ্যেস করল ভোম্বলদাস, আপনি ছিয়ানব্বুয়ের জজ চন্দ্ৰমাধববাবুর কে হন?

আমি তাঁর মেয়ে মণি—মণিকুন্তলা। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?—অবাক গলায় কলকলিয়ে উঠল সে।

গোয়েন্দাদের অনেক কিছুই জানতে হয়।—ভারিক্কি চালে বলল ভোম্বলদাস।

আপনিই তাহলে—

হ্যাঁ আমিই ভোম্বলদাস, সত্যের সন্ধানী।

আপনিই!—মণির ঘোর যেন কাটে না।

ভোম্বলদাস বলল, এখন বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি?

চোখ কুঁচকে সলজ্জ হাসির সঙ্গে মণি বলল, আপনিই ভোম্বলদাসবাবু—কেমন অবাক লাগে····হাতদুটো নাবাব?

হ্যাঁ,হ্যাঁ—নিশ্চয় নাবাবেন। ওটা কি জানেন, আমাদের একটা ইয়ে।

একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে মণি কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকার পর বিশ্বাসভরা গলায় বলল, হুঁ, আপনি পারবেন—আমার কুমারকে নিশ্চয় উদ্ধার করতে পারবেন। আমার মন বলছে—

স্-উ-উ।—তাকে মাঝপথে থামিয়ে ভোম্বলদাস হাঁক পাড়ল, কেবলরাম—

কেবলরাম টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে এল।

মণি হাঁ করে চেয়ে থাকে তার দিকে। গোঁফটা একপাশে ঝুলছে। গোয়েন্দাদের সবই কি অদ্ভুত!

কেবলরামের দিক থেকে জ্বলন্ত চোখদুটো টেনে এনে একটু হেসে ভোম্বলদাস বলল,আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন মণিকুন্তলা দেবী! তা একটু হবেন—অসাধারণ কিছু দেখলে সাধারণ মানুষ অবাকই হয়। আপনি হয়তো জানেন না, আমার অ্যাসিসটেন্ট কেবলরাম বাই দি বাই আপনার ফুটপ্রিন্ট এঁকে নিয়েছে—

কেন—আমার কেন?—সভয়ে বলে উঠল মণি।

কিছুই বলা যায় না, কখন কী সূত্র থেকে বিরাট একটা ইয়ে ধরা যাবে। সামান্য একটা চুল, নখের একটু কাটা পার্ট নিয়ে জানেন ক্রিমিনালকে আমরা ধরি····থাক, ওসব কথা থাক। কেবলরাম—এক নম্বর।

কেবলরাম পটাপট দরজা-জানলা বন্ধ করতে লাগল।

ভয়ে মণি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল। বলল, একি! সব বন্ধ করছেন কেন?

অভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলে ডোম্বলদাস বলল, অ্যাফ্রেড হবেন না। আমাদের দেশের—আমাদের দেশের কেন, পৃথিবীর সব চাইতে বড় ডিটেকটিভ কে ছিল জানেন? জানেন না। আপনাদের না-জানারই কথা। চাণক্য। চাণক্য কী বলে গেছে জানেন? দেওয়ালেরও কান আছে। তাই আমার এই কেয়ারফুল ব্যবস্থা—

এর ভেতর দরজা-জানলা সব বন্ধ করে কেবলরাম খাতা-পেন্সিল নিয়ে টেবিলে বসেছে।

মণিও এদিক-ওদিক একবার চেয়ে আবার চেয়ারে বসল।

আর এক মিনিট মণিকুন্তলা দেবী।—রিভলবারটা ড্রয়ারে রাখল, গোঁফ খুলল, গগল্স্ নামাল—

ভোম্বলদাস একটি একটি করে ছদ্মবেশ ত্যাগ করে, আর মণির বড় বড় চোখ দুটি আরও বড় হতে থাকে—

তা লক্ষ্য করে একটু হেসে ভোম্বলদাস বলল, এতক্ষণ আমাকে যে-রূপে দেখছিলেন, তা হচ্ছে আমার কেমুফ্লেজ! এরও প্রচলন চাণক্য করে এদেশে। মানে কী জানেন, আমাদের লাইন খুব ইয়ের, মানে, ডিফিকাল্টি—যেমন উত্তেজক তেমনি বিপজ্জনক। কাজেই আমাদের খুব কেয়ারে কেয়ারে চলতে হয়····কেবলরাম, রেডি—

ইয়েস স্যার।

গদিয়ান হয়ে বসে মুখে চোখে বিকট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে ডোম্বলদাস বলল, ব্যস, এইবার আরম্ভ করুন। হ্যাঁ, খুব আস্তে আস্তে কথা বলবেন—কিচ্ছু বলা যায় না, হয়তো এই ঘরেই আপনার ক্রিমিনাল ডিক্টোফোন বসিয়ে রেখেছে, কিংবা হয়তো ঠিক সময়টিতে একটি টাইম বোমা ঝেড়ে দেবে—

ও মাগো!—চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল মণি।

ভয় পেলেন?—মৃদু মৃদু বিজ্ঞের হাসি হেসে ভোম্বলদাস বলল, ভয় নেই, মনে রাখবেন এটা ভোম্বলদাসের ডেরা—এখানে সেঁধোবার মত বুকের পাটা খুব কম লোকেরই আছে। তবে কি জানেন, সাবধান—মানে, সব সময় প্রিপেয়ার্ড। আমাদের সব সময় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বার জন্য তৈরি থাকতে হয়। তবু একটা সুবিধে আমাদের দেশের বাড়িগুলোয় চিমনি থাকে না····কেবলরাম বী প্রিপেয়ার্ড।

মণি একমনে তার কথা শুনছিল, ভোম্বলদাস হঠাৎ মিলিটারী কায়দায় চেঁচিয়ে উঠতে সিধে হয়ে বসল।

কেবলরাম পেন্সিল বাগিয়ে বলল, ইয়েস স্যার।

ভোম্বলদাস ফিরল মণির দিকে, আপনাকে একটা করে কোশ্চেন করব আর আপনি তার রিপ্লাই দেবেন, বুঝছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু আমি বলছিলুম—

ব্যস। দেখুন আমাদের একটা লাইন অফ ইয়ে আছে ; আমাদের এগোতে হয় স্টেপ বাই স্টেপ, আমার কাছে গোঁজামিল পাবেন না ; কেসবুকে প্রত্যেকটি বিষয় লিখে নিয়ে লিঙ্ক করার পর আমি এগোই—

বেশ একটু ভারিক্কি কায়দায় টেনে টেনে হেসে ভোলদাস একটা চুরুট ধরাল।

মণি হাঁ করে চেয়ে থাকে তার দিকে।

ভোম্বলদাস চোখ বুজে চুরুট টানে আর ভাবে····ভাবে আর ভাবে····

কেবলাম সশব্দে হাই তুলতে তার ভাবনার খেই হারিয়ে গেল, কটমট করে তাকাল সে তার দিকে।

কেবলরাম আড়মোড়া ভাঙল এবার।

মণি খুক খুক করে বার কতক কেশে বলল, দেখুন, একটা জানালা যদি খুলে দেন—

ভোম্বলদাস এমনভাবে খাড়া হয়ে বসল যে মণি মাঝপথে থেমে গেল। তারপর সে বলল, আমার পলিসি শোনার পরও আপনি—

অপ্রস্তুত মণি বলল, মানে চুরুটের ধোঁয়ায়····থাক-না,বন্ধই থাক-না, খোলার কী দরকার—

ক’মিনিটেরই-বা ব্যাপার! আচ্ছা, আমি এবার কোশ্চেন করতে আরম্ভ করছি। আপনি বেশ ভেবে চিন্তে রিপ্লাই দেবেন। আপনার নাম?

নাম? নাম তো এসেই বললুম।

সে-বলায় এ-বলায় তফাৎ না থাকলে কি আর জিগ্যেস করি। এসব ইয়ে আপনি বুঝতে পারবেন না—এ হচ্ছে কেসবুকের ব্যাপার। বলুন, আপনার নাম?

মণিকুন্তলা বসু।

ব্যস। তারপর লেখ কেবলরাম, চন্দ্রমাধব বসু জজ মশায়ের মেয়ে, ছিয়ানব্বুই নম্বরে বাস করেন। হ্যাঁ, আপনার কেস?

কেস।

হ্যাঁ। মানে, আপনি কেন এসেছেন?

মণির চোখেমুখে আগের উত্তেজনা ফুটে উঠল, আমার কুমারকে চুরি করেছে, তাকে আপনি উদ্ধার করে দিন।

আস্তে আস্তে। তাহলে আপনার কেস হচ্ছে কোথাওকার কুমার এবং আপনার ফ্রেন্ড কাউকে কোন গ্যাংস্টার গায়েব করেছে—এই তো?

হ্যাঁ।—উত্তেজিত কণ্ঠে মণি জবাব দিল।

আচ্ছা, এখন কথা হচ্ছে····কেবলরাম বি অ্যাটেনটিভ, মন দিয়ে লেখ····কোথাকার কুমার?

কোথাকার মানে?

মানে কোন্‌ দেশ থেকে এসেছিলেন?

ও, তাই বলুন। বাবার এক বন্ধু পারস্যে থাকেন, তিনিই—

ব্যস, ওইতেই হবে। কেবলরাম, স্পেশাল আইডেন্টিফিকেশন····এবার তাঁর চেহারা ডেসক্রাইব করুন।

চেহারা, মানে—

গায়ের রং?

ধবধবে সাদা। কপালের কাছে শুধু একটা কালোর ছোপ আছে—

কোনদিককার কপালে?

ঊঁ—ডানদিককার।

কালো ছোপ মানে জড়ুল তো?

তা ঠিক বলতে পারছি না, তবে আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে জড়ুলই হবে।

নাক-চোখ?

নাকটা একটু ইয়ে।—মণি সলজ্জ একটু হাসল, নাকটা একটু, খাঁদা ঠিক নয়, চাপা ; কিন্তু চোখদুটো যা আপনায় কী বলব?—মণি-কলকল করে উঠল, তার চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে কখনও আপনার মনে হবে যেন গভীর নীল সমুদ্রের পানে চেয়ে আছেন, কখনো মনে হবে যেন আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘের ছায়া খেলা করছে, কখনো বিদ্যুৎ কখনো শান্তিবারি—

খুক খুক করে কেশে উঠল কেবলরাম।

মণির উচ্ছাসে বাধা পড়ল না তাতে, বলে চলল; আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু তার দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছি, কিন্তু তার গভীর রহস্যের কিনারা পাইনি।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই, কুমারের চোখদুটি টাইপ—চোখ দেখলেই বোঝা যাবে এই কুমার, কেমন তো?

হ্যাঁ। আপনি হাজার ভিড়ের ভেতরও শুধু দুটি চোখ দেখে তাকে চিনতে পারবেন।

কেবলরাম—

আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার, নোট হয়েছে।

গুড। আচ্ছা মণিকুন্তলা দেবী, কুমারের শরীরে কোন স্পেশাল মার্ক কিছু আছে কি না জানেন?

স্পেশাল মার্ক কিছু—

হ্যাঁ, এই কাটা-ছেঁড়া এই সব আর কি! তবে কিছু না থাকলেও যায়-আসে না, জড়ুল তো পেয়ে গেছি। তবে কি জানেন, আজকাল সায়েন্স খুব ফরোয়ার্ড হয়েছে কিনা, তাই কিছুই বলা যায় না;হয়তো আপনার ক্রিমিনাল কেমিক্যাল দিয়ে জড়ুলটাকে বিলকুল তুলে দেবে—

অ্যাঁ!—মণি যেন তার কথা বিশ্বাস করতে পারে না।

অ্যাঁ নয়, হাঁ।—গাম্ভিরি চালে হেসে ভোম্বলদাস বলল, আপনাদের আশেপাশে দিনরাত অনেক কিছুই হচ্ছে, আপনারা তার কিছুই জানেন না। যাক্‌, এসব কথা আমি পরে সব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দোব’খন। এখন ওই স্পেশাল মার্ক—

স্পেশাল মার্ক—!—একটু চিন্তা করে মণি বলল, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না। তেমন····হয়েছে, হয়েছে!—হৈ হৈ করে উঠল মণি, তার মতন গোঁফ আপনি আর দেখবেন না—

কী রকম? আজকালকার ডগলাস না আগেকার পঞ্চম জর্জ্জি?

কোনটাই নয়। তার গোঁফ····আপনাকে যে কী করে বোঝাই—

থাক, ওটা খুব আর্জেন্ট পয়েন্ট নয়। কেননা, গোঁফ তো যে কোন মোমেন্টে কামিয়ে ফেলা যায়। কেবলরাম, পরিচয় স্যাটিসফ্যাক্টরি?

আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।

যাক,আইডেন্টিফিকেশন গেল। এবার মণিকুন্তলা দেবী, আপনাকে একটি খুব প্রাইভেট প্রশ্ন করব। উত্তর দিতে আপনার হয়তো একটু প্রেজুডিস হবে, কিন্তু জানেন তো ডাক্তার আর গোয়েন্দাদের কাছে কিছু কনফিডেনসিয়াল রাখতে নেই।

তার কথার ধরণে মণি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে ভোম্বলদাস বলল, কুমার ভিনদেশী—তার জন্যে আপনি এত, কিছু মনে করবেন না, উতলা—

আপনি জানেন না ভোম্বলদাসবাবু, তাকে আমি ক-ত ভালবাসি।—আবার কলকলিয়ে উঠল মণি, তেরো ঘণ্টা তাকে দেখিনি, কিন্তু মনে হচ্ছে তেরো যুগ। আর সে-ও কি আমায় কম ভালবাসে,হয়তো সে কত কাঁদছে আমার কাছে আসবার জন্যে—

হতভম্বের মতন তার দিকে চেয়ে কেবলরাম তার কথা শোনে আর চোখের ভঙ্গি দেখে, পেন্সিল চলে না—

র্ভৎসনা করে উঠল ডোম্বলদাস, কেবলরাম, গোয়েন্দাদের কোনরকম ফিলিংস থাকা উচিত নয়। আচ্ছা মণিকুন্তলা দেবী, আপনি একটু বসুন, আমি একবার গোড়া থেকে কেসটা ভেবে নিই। কেবলরাম, তুমি পড়—

কেবলরাম পড়তে আরম্ভ করল আর ভোম্বলদাস চোখ বুজে চুরুট টানার সঙ্গে ভাবতে বসল।

গরমে, ধোঁয়ায় মণি উসখুস করে আর এদিক-ওদিক তাকায়—

হঠাৎ একসময় ভোম্বলদাস বলল, আপনার কী মনে হয়?

কিসের?—না-বোঝার সুরে প্রতিপ্রশ্ন করল মণি।

কুমারকে কেন কিডন্যাপ করা হল?

কেন বুঝতে পারছেন না? গোটা দেশ খুঁজে আপনি কুমারের মতন চেহারা—অমন সুন্দর, অত মিষ্টি চেহারা—

ওটা অবশ্য রিলেটিভিটি। আচ্ছা, আপনার কাউকে ডাউট হয়?

একটি পলক চোখ কুঁচকে কী ভেবে উত্তর দিল সে, আমার সন্দেহ হয় ঘটোৎকচবুকে। কুমারকে তিনি দুচক্ষে দেখতে পারতেন না, এমন কি তার নামে বাপীর কাছেও কম লাগাননি, কিন্তু আমার জন্যে লাগসই কিছু করে উঠতে পারেননি—

আচ্ছা, কখন আপনি জানতে পারলেন কুমারকে পাওয়া যাচ্ছে না?

রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর। কুমার আমার পাশের ঘরেই শুতো—কাল রাত্তির এগারোটা বাজল, বারোটা বাজল, তখনও দেখি কুমার আসে না ; তখন আমার সন্দেহ হল—

ঘটোৎকচবাবুকে সন্দেহ হল?

প্রথমে হয়নি, কেননা মাঝে-মাঝে কুমারের ফিরতে রাত্তির হত—

হুঁ। তাহলে ঘটোৎকচবাবুকে ডাউট করলেন কেন?

ওই তো বললাম আপনাকে।—স্বর নিচু করে বলল মণি, ওরকম লোক পারে না এমন কাজ নেই। মুখে এমনি কত ভদ্রলোক, কথা কী মিষ্টি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জিলিপির প্যাঁচ। আমার মামাতো ভাই ওঁর কী নাম দিয়েছে জানেন? কিং অব ক্যাপিটালিস্ট।

কেবলরাম এটা নোট করে নাও—

ইয়েস স্যার।

আবার ভোম্বলদাস ফিরল মণির দিকে, ঘটোৎকচবাবুকেই তাহলে আপনার ডাউট! আচ্ছা; ওঁর সম্বন্ধে আর কিছু বলতে পারেন? মানে ওঁর পাস্ট হিস্ট্রিতে কোনরকম মিষ্ট্রি কিছু—

বেশ আড়ম্বর করে মণি ভাবতে বসল—

ভোম্বলদাস একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অনেকক্ষণ পরে মণি বলল, সেরকম কিছু মনে পড়ছে না। তবে কিন্তু ভীষণ লোক। পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে সেদিন আফ্রিকা থেকে ঘুরে এলেন, কী করে এলেন তিনিই জানেন, পাড়ার কারুর সঙ্গে মেশেন না—মানে ডেঞ্জারাস লোক—

কিন্তু তিনি কুমারকে কিডন্যাপ করতে পারেন কিনা?

নিশ্চয় পারেন—তাঁর চেহারা দেখলেই বুঝতে পারবেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল ভোম্বলদাস। খানিকক্ষণ পায়চারি করল, খানিকক্ষণ উর্ধ্বমুখে দাঁড়িয়ে রইল, কখনো চেয়ারে এলিয়ে পড়ে চুল টানল—

মণির নীরব চোখদুটি তার সঙ্গে প্রতীক্ষা করে ফেরে֯—

শেষে বলল সে, মণিকুন্তলা দেবী, আপনার কেস খুবই জটিল। কিন্তু আমার মনে হয়, যেদিন আমি এই রহস্যজটের নট খুলতে পারব, সেদিন সারা দেশ বিস্ময়ে ডাম হয়ে যাবে। উফ! সমাজের মাঝে কী ভীষণ ব্যাপার—আমাদের আশেপাশে কী ভয়ানক মানুষ ঘুরে বেড়ায়। হরিব্‌ল্‌!

আপনি তাহলে—

আপনার কুমারকে ফিরিয়ে এনে দোব। আপনার কেস আমি নিলুম, এইরকম জটিল কেসেই আমার আনন্দ—

তাহলে আমি—

সসঙ্কোচে হাতব্যাগ খুলে একশো টাকার একটি নোট বার করে সলজ্জগলায় বলল মণি, সামান্য কিছু দিয়ে যাচ্ছি, আপনার ফী—

কিছু দরকার নেই, সত্যের অনুসন্ধান আমার পেশা নয়, নেশা।—নোটটা সযত্নে ব্যাগে ভরতে ভরতে ভোম্বলদাস বলল, আচ্ছা, আপনি এখন যেতে পারেন—আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনার কুমারকে আমি ফিরিয়ে এনে দোব।

কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে তাকে নমস্কার জানিয়ে মণি উঠল।

দরজা অবধি তাকে এগিয়ে দিয়ে ভোম্বলদাস ফিরল। সারা শরীর উত্তেজনায় ভরপুর। কেবলরামের কাঁধে প্রচণ্ড একটা চপেটাঘাত করে বলল, ক্যাবলা, এতদিনের সাধনা সফল হল। দেখলি, শুরু হল একশো দিয়ে? এবার অ্যাকশন—স্ট্যান্ড আপ মাই বয়, রেডি, ঘটোৎকচ-ভোম্বলদাস সংগ্রামের বাঁশি বেজেছে—

এইটা কি ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোং?—দরজার বাইরে থেকে কে একজন এমন আচমকা জিজ্ঞেস করল যে, ভোম্বলদাস রীতিমত চমকে উঠল।

ঘর প্রায় অন্ধকার ; আগন্তুক বোধহয় তাদের ঠিক ঠাহর করতে পারে না, তাই আবার জিগ্যেস করল, ভেতরে কেউ আছেন?

হ্যাঁ, আছি। আপনার কী দরকার?—সাহস করে এগিয়ে এল ভোম্বলদাস।

দরকার পরে বলছি, আগে জানলা-টানলাগুলো খুলুন দেখি।

খোলা না-খোলা আমার ওপর নির্ভর করছে, সে-বিষয়ে কারুর কনসাল্টের দরকার নেই। আপনার পরিচয়টা কী জানতে পারি কি?

হুঁ।—আমার নাম চন্দ্রমাধব বসু

ও, আপনিই চন্দ্ৰমাধবাবু! আসুন—আসুন। কেবলরাম, জানলাগুলো রি-ওপন করে দাও, অ্যাফ্রেডের কিছু নেই।—ব্যস্তভাবে কেবলরামকে আদেশ জানিয়ে ভোম্বলদাস চন্দ্রমাধববাবুর দিকে ফিরল, এসবগুলো হচ্ছে স্যার আমাদের কেয়ারফুল হওয়া, যাতে কেউ ওভারহার্ড না করে, মানে আমাদের অনেক কিছু প্রাইভেট ব্যাপার····এই চেয়ারটায় বসুন স্যার। বড় চেয়ার, আরাম করে বসতে পারবেন—

ভুরু কুঁচকে চন্দ্ৰমাধববাবু তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলেন, এখন তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ভোম্বলদাস কে?

আজ্ঞে আমিই ডোম্বলদাস নামে সাধারণে ইনট্রোডিউসড্—

থামো!—বিরক্ত হয়ে একটি মৃদু ধমক দিলেন চন্দ্রমাধববাবু।

আজ্ঞে—

গোয়েন্দাগিরি করে কে?

আজ্ঞে—আ-আমি।—ভোম্বলদাস তখন ঘামতে আরম্ভ করেছে আর আড়ে আড়ে কেবলরামের দিকে চাইছে।

চুরুট খায় কে?

আ-আমি—

তাই এইরকম প্যাঁকাটির মতন চেহারা।

মানে মগজ খোলার পক্ষে চুরুটের ধোঁয়া—

থাম ইয়ার ছোকরা।—থাবা মেরে তাকে থামিয়ে চন্দ্ৰমাধববাবু বললেন, আমাদের যেন মগজ নেই, মগজ ওনাদের আছে—

আজ্ঞে ঠিক তা নয়—মানে ক্লু-টুলুগুলো ঠিকমতন ফলো অন করার জন্যে····মানে আমেরিকা আর বিলেতের সব ডিটেকটিভরা—

থাক, ওদের কথা আর তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই না। যৌবনকালে কোন ডিটেকটিভ বই পড়তে বাকি রাখিনি—

না, তাই বলছিলুম—

দেখ, বাজে কথা শোনার সময় আমার নেই। চুরুট যদি খেতেই হয় তো সের কতক করে দই-রাবড়ি খেয়ো, নইলে অক্কা পাবে—বুঝেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমাকে এই দেখছ? সত্তর বছর বয়েস হতে চলল, এখনও লোহা খেয়ে হজম করি····তুমিই তাহলে ডিটেকটিভ! বেশ, আমার একটা কেস আছে। টাকাকড়ি নাও?

অ্যাঁ, টাকাকড়ি? আগে অবশ্য প্রফেশনাল ছিল না, এখনও নয়, তবে কি—

আঃ, বাজে কথা ছেড়ে দিয়ে সোজা কথায় টাকা নাও কিনা বলতে পারছ না?

আজ্ঞে কিছু কিছু নিই, তবে আপনার কাছ থেকে—

থাক। আমি কিছু পীর-পয়গম্বর নই। শোন, আমার মেয়ে মণি—

আজ্ঞে তিনি একটু আগেই আমায় এনগেজমেন্ট করে গেছেন—

হুঁ—তিনি আগেই এসে গেছেন! শোন, ও ভয়ানক জেদী মেয়ে, যা ধরবে তা না করে ছাড়বে না—তাড়াতাড়ি ওর কুমারকে খুঁজে বের করে দাও—

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি হোল হার্টেডলি তাকে সার্চ করব—

সার্চ করব নয়, তাকে আজকের ভেতরই যেখান থেকে পারো ধরে নিয়ে এস—ওর ঘ্যাঙানি শুনতে শুনতে প্রাণ যাবার দাখিল—

আজ্ঞে হ্যাঁ—

আজ্ঞে হ্যাঁ নয়, ওঠো, বেরিয়ে পড়—

এই প্রিলিমিনারিজগুলো সেরেই—

ওসব পরে হবে।

আজ্ঞে ওইগুলোই আমাদের পার্টিকুলার জিনিস—

হুঁ, মোট কথা কাল সকালের ভেতর সেই অকালকুষ্মাণ্ডটাকে আমি চাই।

একটা কথা ছিল স্যার।

কী?

বিশেষ কিছু নয়—ঘটোৎকচবাবুকে আপনার কিরকম মনে হয়?

একটা বদ্ধ পাগল—ওর ধারে-কাছে যেও না।—ঘটোৎকচের উল্লেখে চন্দ্ৰমাধববাবু রেগে উঠলেন যেন, ও জানে কেবল ওর ব্যবসা।

ভোম্বলদাস মিটিমিটি হাসতে লাগল।

আরও রেগে গেলেন চন্দ্রমাধববাবু, খিঁচিয়ে উঠলেন, দাঁত বার করে হাসছ কেন? যখন পড়বে ওর পাল্লায়, তখন হাসি বেরিয়ে যাবে—

আজ্ঞে না, তা নয় ; রহস্যের যেন একটা থ্রেড পেয়েছি মনে হচ্ছে।

এর ভেতর আবার থ্রেড পেলে কোথায়?—যাকগে, যা খুশি কর, মোট কথা সাবধান! আজ রাত পোয়ালে যদি কুমারকে হাজির করতে না পার, তাহলে তোমার নামে ফোর-টোয়েন্টি রুজু করিয়ে ছাড়ব—

চন্দ্ৰমাধববাবু উঠলেন।

কেবলরাম ক্যাবলার মতন মিনমিন করে বলল, স্যার, আজকের ফী—

ফী? ও প্রফেশনাল না কী বললে যেন তখন····এই নাও। কিন্তু মনে থাকে যেন, কুমারকে যদি না পাই, তাহলে তোমায় ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়ব—

তার জন্যে আমি প্রস্তুত থাকব স্যার—

তীব্র দৃষ্টিতে ভোম্বলদাসের দিকে একবার তাকিয়ে তিনি চলে গেলেন।

ভোম্বলদাস পাথরের মূর্তির মতন কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল—নিশ্বাস ফেলছে কিনা তাও বোঝা যায় না।

কেবলরাম এক সঙ্গে অতগুলো টাকা পাওয়ায় খুশিতে আনন্দে কলকল করে কত কথা বলে গেল, কিন্তু অত কথাতেও যখন ভোম্বলদাসের দিক থেকে কিছু শুনতে পেল না, তখন তার দিকে ফিরল।

তাকে ওরকম পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকল, এই ভোম্বল—

কোন উত্তর দিল না সে।

তখন সে দু’হাতে তাকে ঝাঁকানি দিয়ে ডাকল, ভোম্বলদাস—

ভোম্বলদাস একটি বম্‌শেল ঝাড়ল, ব্রেনলেশ স্টুপিড়! তোকে না হাজারবার বলেছি, আমি যখন ডেডিকেশনে থাকব, আমায় বিরক্ত করবি না? না, তখন থেকে কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে—

আমি বলছিলুম—

থাক, আর অ্যামপ্লিফিকেশন করে বলতে হবে না। এসব বোঝার মেরিট যদি তোর থাকত, তাহলে আমার কাছে মরতে আসিস! উফ, কী হার্ড কেস! মাথার ঘিলুটা স্প্রিং করে করে উঠছে—

তাই বলছিলুম—

উফ, তুই কী আমায় থিঙ্ক করতে দিবি না? আমি বলে হাতড়ে মরছি কোথা থেকে স্টার্ট করি—

ঘটোৎকচবাবু—

আঃ, সেটা আমি অনেকক্ষণ আগেই বুঝেছি। কিন্তু বুঝলেই তো আর হল না, ফরওয়ার্ড করব কী করে? এ তো আর ছিচকে খুন-জখম নয়, এ একেবারে ইন্টারনেশান ব্যাপার—পারস্যের কুমার আর ভারতবর্ষের ঘটোৎকচ····কত দিক ভাবতে হবে—

চুরুট ধরিয়ে ভাবতে বসল ভোম্বলদাস।

কেবলরাম ক্যাবলার মত দাঁড়িয়ে রইল।

ভাবতে ভাবতে ভোম্বলদাস কখনো ভোঁস ভোঁস নিশ্বাস ফেলে, কখনো কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, কখনো দু’হাতে চুল টানে আর বিড় বিড় করে বকে; কখনো উত্তেজনায় ঘরময় দাপাদাপি করে।

কেবলরামের গোল গোল চোখদুটো তার সঙ্গে ফেরে।

হঠাৎ চাপা গলায় ভোম্বলদাস বলল, অ্যাটেনশন—

কেবলরাম কাঠ হয়ে দাঁড়াল।

রেডি হও, আমাদের এখুনি বেরোতে হবে।

কোথায় যেতে হবে?—ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল কেবলরাম।

উফ, তোকে আর মানুষ করতে পারলুম না।—হতাশ রাগে ফুঁসে উঠল ভোম্বলদাস, কোথায় যেতে হবে সেটা বলে দিলে মিষ্ট্রির কোন মানেই হয় না—

তা নয় ; বলছিলুম, সেরকম জায়গায় যেতে হলে পুলিশকে একটা খবর—

তুই একেবারে কাউডাং। পুলিশকে খবর দিয়ে যাই আর আমার ক্রেডিটটি তারা ডেবিট করে নিক। উফ, অসম্ভব—এই কেসের পর তোকে বরখাস্ত করবই।

তোরই ভালর জন্যে বলছিলুম ; সেবার গ্যাঁড়াতলার কথা—

তার জন্যে দায়ী তুমিই ক্যাবলারাম!—খিঁচিয়ে উঠল ভোম্বলদাস, একাউন্টে গোলমাল করেছিল কে?····যাকগে ওসব কথা, এখন দয়া করে যাবে কি?

যাব-না কি বলেছি?—অভিমানের সুরে বলল কেবলরাম।

তাহলে দয়া করে কেমুফ্লেজ করে নাও·····

জবরদস্ত পশ্চিমী মুসলমানের ছদ্মবেশ ধরে দুজনে ঘটোৎকচবাবুর বাড়ির সামনে যখন পৌঁছল, পাড়াটা তখন নিঝুম হয়ে এসেছে।

ভোম্বলদাস এদিক-ওদিক তাকিয়ে লুকিয়ে ঘটোৎকচবাবুর বাড়ির ওপর চোখ রাখার কোন সুবিধেমতন জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে বলল, নাঃ, একটু শান্তিতে যে কাজ করব, তার উপায় নেই—

আমি তো—

আঃ, তুই ফ্যাচ ফ্যাচ করছিস কেন? আমি কি তোকে বলেছি? বলছি কর্পোরশনকে। কেন রে বাপু, এখানে একটা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছ রাখলে লসটা কী হত? এখন ঘটোৎকচকে কোথা থেকে ওয়াচ করি!

কেবলরাম অনেকক্ষণ ভেবে বলল, ভোম্বল, ওই ডাস্টবিনটার আড়ালে থাকলে হয় না?

চোখ-মুখ কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ভোম্বলদাস বলল, হেল্পলেস তাই করতে হবে, কিন্তু আমাদের শাস্ত্রে ডাস্টবিনের কথা নেই, তাই ভাবছি—

হঠাৎ কোথায় দরজা খোলার শব্দ হল—

ভোম্বলদাসের কানে যেন অ্যাটম বোমার আওয়াজ ধাক্কা মারল। পিটপিটিয়ে বলল, কেবলরাম, শেলটার—

কেবলরাম দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে।

ভোম্বলদাস তার কলারটা চেপে ধরে দাঁতে দাঁতে কষে হিসিয়ে উঠল, ব্রেনলেশ স্টুপিড! ডাস্টবিন ছাড়া শেলটার কোথায়—

তাকে চেপে ধরে ডাস্টবিনের আড়ালে বসিয়ে দিল।

সেখানটা বেশ একটু অন্ধকার—

কেবলরাম বসল একটা কুকুরের ওপর—

কেঁউ কেঁউ করতে করতে তীরবেগে ছুটল সেটা, আর কেবলরাম হাঁউমাউ করে উঠল, ওরে বাবারে—

চকিতের মধ্যে ভোম্বল তার গলা টিপে ধরল, আর একটি আওয়াজ বেরিয়েছে কি কিল করে ফেলব। একেবারে তীরের কাছে এসে নৌকো সিঙ্ক করাতে চাও—

কেবলরামের দম বন্ধ হয়ে আসে, তবুও গোঁ গোঁ করে কী বলল।

ভোম্বল আবার শাসালো, একটি ওয়ার্ড নয়—

বলার সঙ্গে সঙ্গে তার গলা ছাড়ল।

কেবলরাম কিছুক্ষণ নেতিয়ে বসে রইল। তারপর বলল, বোধ হয় কামড়ে দিয়েছে, যা জ্বলছে—

জ্বলতে দাও, কাল হাসপাতালে গেলেই হবে—

ভোম্বল, ভয়ানক—

তার মুখটা থাবা মেরে বন্ধ করে দিল ভোম্বল।

সে টাল সামলাতেই দেখল, ঘটোৎকচবাবুর দরজা দিয়ে রাস্তার ওপর চওড়া একফালি আলো এসে পড়েছে। সেই আলোকরেখার মাঝে প্রথমে একটি লম্বা ছায়া জাগল, তারপর এলেন ছোটখাটোমানুষ ঘটোৎকচবাবু। রাস্তার ওপর এসে দরজাটা বাইরে থেকে টেনে দিলেন তিনি—আলো সরে গিয়ে আবার ফ্যাকাশে অন্ধকার জাগল। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘটোৎকবাবু কী ভাবেন, বারকতক এদিক-ওদিক তাকান—

তাঁর ওপর চোখ রেখে ফিস ফিস করে ভোম্বলদাস বলল, নিশ্চয়ই কুমারকে সরিয়ে ফেলার মতলব করছে····এখন কী করি?

ওকে গিয়ে জিগ্যেস করলে হয় না?

আর অমনি তোমায় বলে দেবে—উফ, কী ক্লিয়ার মাথা!

তাহলে?

সেই কথাই ভাবা হচ্ছে। ফলো আপ ওকে করতেই হবে, অথচ একটা গাড়িঘোড়া নেই এদিকে—

চটাস করে পাশেই কিসের আওয়াজ হল—

ভোম্বলদাস এমন ভীষণভাবে চমকে উঠল যে, আর একটু হলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত। সামলে নিয়ে জ্বলন্ত চোখে কেবলরামের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় হিসিয়ে উঠল সে, কিসের আওয়াজ হল?

নির্বিকার জবাব দিল কেবলরাম, আমিও তো ভাবছি—এত জোর আওয়াজ হল—

শু-স্-স।—ঘটোৎকচ বোধ হয় আমাদের কথা জানতে পেরেছে।

কী হবে ভোম্বল?—বলার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুর কাছে চটাস করে একটা চাপড় মারল সে।

ভোম্বলদাস খিঁচিয়ে উঠল, উফ, এমন জানলে কোন ব্রাদার-ইন-ল তোকে অ্যাসিস্ট্যান্ট করত····ওই, ঘটোৎকচ এদিক পানেই আসছে। এখন—

বাকি কথাগুলো আর তার মুখ দিয়ে বেরোল না।

ঘটোৎকচবাবু সত্যিই তখন হাঁটতে শুরু করেছেন—তবে তাদের দিকে এলেন না, সিধে এগিয়ে চললেন—

তিনি বেশ কিছুটা চলে যাবার পর ভোম্বলদাস বলল, স্ট্যান্ড আপ কেবলরাম, ঘটোৎকচকে ফলো আপ করতে হবে—

যদি দেখে ফেলে?—সভয়ে বলল কেবলরাম।

দেখে ফেললেও ক্ষতি নেই, বুঝতে পারবে না। আমরা মাতালের কেমুফ্লেজে এগোব।—বুক ফুলিয়ে বলল ভোম্বলদাস।

কী আর করে, কেবলরাম উঠে দাঁড়াল।

তাকে ঢালের মতন সামনে রেখে টলতে টলতে এগোল ভোম্বলদাস, আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে গান ধরল, গিন গিন তারে ম্যয় হার গ্যয়ে রাতকো, না আয়ে—

তার ওপর গলা চড়িয়ে কেবলরাম ধরল, চোখে চোখে রাখি হায় রে, তবু তারে ধরা যায় না—

তাদের দ্বৈত গানের সুর ঘটোৎকচবাবুর কানে পৌঁছতে একটি সেকেন্ডও দেরি হল না, তিনি একবার পেছু ফিরে দেখে আবার এগোলেন—

এরাও পাড়া সরগরম করে সারেগামা সাধতে সাধতে তাঁকে অনুসরণ করল—

নেহাৎ রাত্তির হয়েছিল তাই রক্ষে, নইলে সেদিন পাড়ার লোকের হাতে তাদের দুর্গতির শেষ থাকত না।

কিছুটা যাবার পর হঠাৎ ডোম্বলদাসের খেয়াল হল কেবলরাম বাংলা গান গাইছে, অমনি গর্জে উঠল সে, এই-ও ব্রেনলেশ স্টুপিড! বাংলা সং গাইছিস কেন?

কেন?—থমকে বলল কেবলরাম।

বলি কেমুফ্লেজটা কিসের নিয়েছ—ওয়েস্ট মুসলমানের না? হিন্দি গান গাও এলিফ্যান্ট-ফুল—

হিন্দি গান যে জানি না—

ওইটাই হিন্দি করে গাও—

অমনি কেবলরাম ধরল, চোখমে চোখমে রাখি হায়রে, তবু তিসকো পাকড় না যায় রে—

ঠিক আছে।

আবার সারা পাড়া কাঁপিয়ে তাদের অনুসরণ-পর্ব শুরু হল····

প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর ঘটোৎকচবাবু একটা মাঠকোঠার সামনে থামলেন, তারপর এদিক-ওদিক একবার দেখে নিয়ে কড়া নাড়লেন।

দূর থেকে ভোম্বলদাসরা সব লক্ষ্য করে—

একটু পরেই মাঠকোঠার দরজা খুলে একজন ভীষণাকৃতির লোক বেরিয়ে এল। ঘটোৎকচবাবুকে দেখে বলল সে, একি! এত রাত্তিরে আপনি—

ভোম্বলদাস সেখান থেকে কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পায়।

ঘটোৎকচবাবু জবাব দিলেন, কাল জাহাজ ছাড়ার দিন, তাই একবার খবর নিতে এলুম সব ঠিক আছে কিনা। বুঝতেই তো পারছ কালু, কত টাকার ব্যাপার, মার খেলে আর দাঁড়াতে পারব না। গেলবারের গোলমালের জন্যে, ধর না কত্তাদের কাছে দৌড়তে হল—

ভোম্বলদাস উত্তেজনায় কেবলরামকে জাপটে ধরল। ফিস্ ফিস্ করে বলল, একটা বিরাট গ্যাঙের লীডার—উফ্!

কালু তখন বলছে, আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না বাবু, কালু যখন ভার নিয়েছে, তখন ধরে নিতে পারেন মালও পৌঁছে গেছে—

শিউরে উঠল ভোম্বলদাস। বলল, কেমন, বলেছিলুম না, কুমারকে অন্য কোথাও রাখা হয়েছে? এইখানে রাখা হয়েছে তাকে, ট্রান্সপোর্ট করার ব্যবস্থা হচ্ছে। কাল জাহাজে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে গেলেই ফ্যাট টাকার ব্যাপার—

ঘটোৎকচবাবু তখন বলছেন, তাহলে কালু আমি চললুম, দেখো, যেন কোন গোলমাল না হয়—

কিচ্ছু গোলমাল হবে না—আপনি বাড়ি গিয়ে আরাম করুন। কালু আপনার পাঁচু সেখের মতন নেমকহারামি করবে না।

অস্ফুট গলায় কী একটা বলে ঘটোৎকচবাবু ফিরে চললেন।

কেবলরাম বলল, ভোম্বল, ঘটোৎকচ চলে যাচ্ছে যে—

যাক—ওকে এখন থ্রেড ছেড়ে দিলুম, পরে খেলিয়ে তুললেই হবে। এখন কুমারকে উদ্ধার করতে হবে—

কোথা থেকে?

হাঁদারাম!—বেশ খুশির ভাব লেগেছে তখন ভোম্বলদাসের মনে। বলল, কুমার রয়েছে ওই মাঠকোঠায়—

মাঠকোঠায়?

আমি লিখে দিতে পারি। এখন রেডি হও কেবলরাম, ওই মাঠকোঠা আমাদের সেন্টার, ওকেই প্রথমে রেড করতে হবে—

বেশ।—শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে চেটে বলল কেবলরাম।

শেষে আর পারল না কেবলরাম, বলল, ভোম্বল আমার মাথা ঘুরছে—

চমকে উঠল ভোম্বলদাস। বলল, মাথা ঘুরছে! তবে কি পয়জন গ্যাস ছাড়ল নাকি—

বিরক্ত হয়ে কেবলরাম বলল, গ্যাস-ট্যাস নয়, তোমার ঘুরুনির চাপে শুধু মাথা কেন, সমস্ত শরীরটা এবার বনবন করে ঘুরবে—

তার মানে? কথা বললেই হল না, তার একটা ফিলজফি থাকার দরকার—

দুত্তোর ফিলজফির নিকুচি করেছে! মাঠকোঠাটার চাদ্দিকে সেই কখন থেকে চরকির মতন ঘুরছি—

শ্লোলি কেবলরাম, শ্লোলি।—গাম্ভিরি চালে বলল ভোম্বলদাস, শুধু ইন্ করলেই হবে না, আউটের কথাটাও ভাবতে হবে। আর এটা হচ্ছে গোয়েন্দাগিরি, বাজারে বসে আলু-পটল বিক্কিরি নয়—

এর চেয়ে সে ছিল ভাল।—কেবলরাম মরিয়া, এইভাবে যদি কেউ দেখে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছিস?

ওসব ভাবলে এ রোড ছেড়ে দিতে হত—

যাকগে, তোর সঙ্গে তক্ক করতে চাই না ; এখন কী করতে চাস, বল।

ভেতরে ইন করতে হবে।—গম্ভীর ভোম্বলদাস বলল, আমার ডাউট হচ্ছে কুমার এইখানেই আছে, তাই মাঠকোঠাটার উইক পয়েন্ট খুঁজছি—

যা দেখছি, তাতে সারা রাত্তিরেও খুঁজে পাবে বলে মনে হচ্ছে না।

ডোন্ট অ্যাফ্রেড। ভোম্বলদাস হেঁজিপেঁজি নয়, মরে গেলে তার মাথা ইংলন্ডের মিউজিয়ামে থাকবে, এই তোকে বলে দিলুম—

তা না হয় থাকবে, কিন্তু এখন—

রোড গট অলরেডি—এখন কেবল আউট নিয়ে হেড ঘামাচ্ছি ; তা তুই যখন অ্যাংরি হয়ে যাচ্ছিস, তখন জয় গড বলে ইন করা যাক, তারপর দেখা যাবে—

তাই কর তাহলে—ঘুমে চোখ চাইতে পারছি না—

ব্রেনলেশ ঘুমঅল স্টুপিড····আচ্ছা, এখন মন দিয়ে হিয়ার কর। আমার লুকিং কত তীক্ষ্ণ এইবার বুঝতে পারবে। সারা মাঠকোঠাটার প্রায় সব ঘরেই আলো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এই ঘরটায় কোন আলো নেই—

তা নেই—

কান পেতে হিয়ার কর, এই ঘর থেকে কোন আওয়াজ আসছে?

আওয়াজ?

ফোঁস ফোঁস আওয়াজ? যেন বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসের সাউন্ড?

হ্যাঁ, একটা আওয়াজ হচ্ছে।

আরও একটা সাউন্ড আছে—কিন্তু মাইন্ড করতে পারছি না—

হ্যাঁ, আরও একটা কী শব্দ হচ্ছে—

এ থেকে কী প্রমাণ হচ্ছে? কী প্রূফ? কুমার এই ঘরে রয়েছে।

কী করে?—হতভম্বের মতন বলল কেবলরাম।

কী করে? এইটা তোকে বলতে হবে? উফ, গড ফরবিড হিম, ও জানে না কী বলছে।—একটু চুপ করে থাকার পর আবার বলল সে, কুমার মণিকুন্তলা দেবীকে গভীরভাবে লভ করে, কেমন কিনা?

তা হয়তো করে—

হয়তো নয়, নিশ্চয়। নইলে মণিকুন্তলা দেবী কুমারের উদ্ধারের জন্যে হন্যে হয়ে রান করে আসত না—এসব হচ্ছে উইলফোর্সের কথা, বুঝেছ কাউডাংগণেশ? কুমার এদিক থেকে উইলফোর্স ছাড়ছে, ওদিকে মণিকুন্তলা দেবী ফোঁস ফোঁস করছে ; আবার ওদিকে মণিকুন্তলা দেবীর মাইন্ড ছটফট করছে, এদিকে কুমার—

কিন্তু তার সঙ্গে এর—

ডিটেকটিভদের সব কিছুর রিসার্চ করতে হয় এই জন্যে। এই যে সিচুয়েশনের কথা বললুম, এর নাম হচ্ছে লভ। সেই লভের লদকানিতে কুমার এখানে ফোঁস ফোঁস করছে, ওখানে মণিকুন্তলা দেবী হাঁসফাঁস করছেন। কুমার কালুর ক্ল্যাসিকাল বাঁধন কেটে পালাবার জন্যে ফক্সট্রট করছেন—

এসব শব্দ—

নিঘ্যাত। যাক, তাহলে আমরা নিশ্চিত ডেফিনিট হলুম যে, এই ঘরে কুমারকে তালাচাবি দিয়ে কীপ করা হয়েছে, কাল সকালেই শিপ করা হবে বলে,—অল রাউন্ড প্রমাণ এইটাই বলে। তাহলে কেবলরাম, অ্যাটেনশন—

কেবলরাম হ্যাঁচ্চো করে একটা হেঁচে বলল, ইয়েস স্যার—

ইয়েস স্যার!—ভেংচে বলল ভোম্বলদাস, স্টার্টের মুখে হাঁচিটা না ছাড়লে চলছিল না? এখন লাকে কী আছে কে জানে।

কে হাঁচল কে বুঝবে—

তোমার মতন তো আর সবাই ব্রেনলেশ নয়। খবর নাওগে, তোমার হাঁচির খবর হয়ত ওদের হেড-কোয়ার্টরে পৌঁছে গেল—

হঠাৎ নাকটা সুড়সুড় করে উঠল—

বেশ করেছ ইন্টেলিজেন্ট। এখন যাবে, না এখানে দাঁড়িয়ে হেক্‌ল্‌-পেক্‌ল,করবে?

যাব না কেন, তবে—

তবেটা এখনকার মতন শিকেয় কীপ করে রাখ। নাও চল····কিন্তু খুব কেয়ারে যেতে হবে·····শ্লোলি, খুব শ্লোলি, এমনভাবে ফুট ফেলতে হবে যাতে সাউন্ডটি কেউ না পায়····আঃ ও কী হচ্ছে? একটু দেখে পা ফেলতে পার না? উফ, তোমায় অ্যাসিস্টেন্ট টেক করে কী রং যে করেছি····আবার অত ফোর্স দিয়ে ব্রিদিং ফেলছ কেন? ওআর্ল্ডের সব লোককে রাইজ করে তুমি কালপ্রিট ধরবে? ব্রেনলেশ—

এরকম ফ্যাচর ক্যাচর করলে আমি যাব না ভোম্বল বলে দিচ্ছি। একে বলে আমার পা কাঁপছে, গা বমিবমি করছে—

কথাটা হল কি জানিস ক্যাবলা, আমাদের, মানে ডিটেকটিভদের এমনভাবে ফরোয়ার্ড করতে হবে যাতে কাকবার্ড কেউ না জানতে পারে—

তুই-ই তো গোলমাল বাধাচ্ছিস—

বেশ, এই আমি সাইলেন্স নিলাম আর তুই রেসিন্টেন্স নিসনি। কিন্তু আমার হেডস দিব্যি, একটু কেয়ার হয়ে চল, নয়তো সব হচ্পচ্ হয়ে যাবে—

প্রচণ্ড ধাক্কায় রামপুরিয়া ঘুম ভেঙে চমকে বসল। গলা দিয়ে ঘড় ঘড় আওয়াজের সঙ্গে বেরুল, অ্যাঁ, কা ভইল-বা?

ফিসফিস করে লছমিয়া বলল, ডাকু—রামখেলওআনকা—

ক্যা!—ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতন রামপুরিয়া ছিটকে খাটিয়া ছেড়ে নাবল, এ শালা কালুকা কাম—শালা—

বাকি খিস্তি মুখে নিয়ে দৌড়ল সে রামখেলওআনের ঘরের দিকে।

তার চিৎকারে মাঠকোঠার আর সব ঘরের লোকজন উঠে পড়ল—পলকের মধ্যে প্রচণ্ড হৈচৈ জাগল, নানান গার্হস্থ্য অস্ত্র নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল ডাকু মারার জন্যে

ভয়তরাসে গলায় কেবলরাম ককিয়ে উঠল, ভোম্বল পালা—সবাই মার মার করে ছুটে আসছে—

লেট দেম গো—তুই চলে আয়—

কেবলরাম তখন ভয়ে ভড়কে গেছে, নিজের বুদ্ধি ঘুলিয়ে গেছে। পালাতে চায় পা ওঠে না—

কঠিন ভৎসনার সঙ্গে ভোম্বলদাস বলল, কুমারকে উদ্ধার না করে আমি এখান থেকে মুভ করব না—রিভলবার নিয়ে তুই দাঁড়া—

দুত্তোর রিভলবারের নিকুচি করেছে—একটা খেলনার পিস্তল—

ডোন্ট টক। আমাদের সাইলেন্সে কাজ করতে হবে। তুই ওদিক গার্ড দে। কেউ এসে পড়লেই গুলি করবি, আমি এদিকে দরজা ব্রেক করে কুমারকে ওপন করি—

নানা জাতের চিৎকারের কনসার্ট আর খিস্তির লিস্টি শুনে কেবলরাম বাঁশপাতার মতন ঠক ঠক করে কাঁপছে তখন—তবুও শেষ ভরসা হিসেবে কাঁপা হাতে রিভলবারটা উঁচিয়ে ভূতগ্রস্তের মত মাঝে মাঝে বলে, হলো ভোম্বল—

গম্ভীর গলায় প্রত্যেকবারই ভোম্বল জবাব দেয়, থ্রেডটা খুঁজছি—গেট করলেই—

ভয়ে রাগে শেষকালে চেঁচিয়ে উঠল কেবলরাম, তোর থ্রেড তুই সারাজীবনেও পাবি না, দরজা ভাঙ।

বলার সঙ্গে ভোম্বলদাসকে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল সে ; সে-ধাক্কা সামলাতে না পেরে ভোম্বল ক্যানেস্তারার দরজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

দরজা সে-ধাক্কা সামলাতে পারল না, ভেঙে পড়ল—

ভোম্বলদাস টাল সামলাতে পারল না, টলে পড়ল—

কিন্তু মাটি নেবার আগেই····একটা ছায়ামূর্তি চারপায়ে নক্ষত্রবেগে ছুটে এসে মারল একটা ভীষণ ঢুঁ—

ভোম্বলদাস কোঁক করে আওয়াজ করল, তারপর প্রায় দশ হাত দূরে ধপাস করে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ল।

সচমকে একবার তার অবস্থাটা দেখে কেবলরাম উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল—

ছায়ামূর্তি তখন মাথা নিচু করে ভূপতিত ভোম্বলদাসের দিকে তাগ নিয়ে আবার ছুটেছে—

কিন্তু কোথায় পালাবে কেবলরাম!

চারদিকে তখন মারমার রব উঠেছে। মাঠকোঠার যোলোখানা ঘরের একশো ষোলোর বাহিনী তখন তৈরি—অস্ত্রশস্ত্রও তাদের বিবিধ, আঁশবটি থেকে জাঁতি, লাঠি থেকে প্যাঁকাটি, ঝ্যাঁটা আর খুন্তি—

কেবলরামের পশ্চিমী মুসলমানের পোশাক ঘামে জবজবে, মোগলাই গোঁফ অদৃশ্য, পঞ্চম জর্জ্জি দাড়ির অর্ধেক ঝোঝুল্যমান—

পালাতে গিয়ে পড়ল সে মারমুখী মানুষগুলোর ঝাঁকের মাঝে।

বিচিত্র চিৎকার করে তারা কেবলরামের দিকে এগোল।

কেবলরাম ক্যাবলার মতন একটি পলক তাদের দিকে চেয়ে থাকার পর প্রাণের ভয়ে পাগলা কুকুরের মতন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—

মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত মানুষগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল অমন ভয়ানক চিৎকাবের সামনে—

থমকে দাঁড়িয়ে জনকতক চুপি চুপি কী বলে নিজেদের মধ্যে। ছোঁয়াচে রোগের মতন সেটা একটা সেকেন্ডের মধ্যে সকলের ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। সকলেই কেমন সতর্ক চোখে কেবলরামের দিকে তাকায়—

কেবলরাম তখন সব কিছু বোধের বাইরে। তবুও তার মনে হয় কী যেন একটা হয়েছে—

হঠাৎ তার চোখ পড়ল অসাড় হাতের দিকে, পিস্তলটা তখনও ঝুলছে, আর থেকে থেকে কাঁপছে—

সবাই তার ওপর চোখ রেখে চাপা উত্তেজিত গলায় কথা বলে আর পায়ে-পায়ে পেছোয়—

প্রাণ বাঁচাবার দায় বড় দায়—মগজ সবসময় মোতায়েন তাকে বাঁচাবার জন্যে। কেবলরামের বেলাতেই-বা আলাদা বিধি হবে কেন! অসাড় হাতে ঝাঁকানি দিয়ে পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরল সে—

সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিকট হূলস্থূল পড়ে গেল পালাবার।

এইসময় আবার কাঁপা আঙ্গুলের ধাক্কা লেগে পিস্তলের ঘোড়া গেল ছুটে—ফটাস করে একটা আওয়াজ হল, আর অমনি সবাই ফাঁক—

প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে কেবলরাম দৌড়ল।

কিন্তু আক্রমণ এলো অন্তরীক্ষ থেকে। তাকে কাবু করার জন্যে কত কী যে বর্ষিত হতে লাগল—

কেবলরাম আপন সঙ্কল্পে অচল। মাথা নিচু করে, পিস্তল বাগিয়ে তারই ভেতর দিয়ে দৌড়ল সে····

মাঝে মাঝে ঝিমুনি ধরে তার, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট আর্তনাদ করে চোখ খোলে।

উঠে গিয়ে এঁটে বন্ধ জানলা-দরজার ছিটকিনি দেখে এসে আবাব চেয়ারে বসে।

এইভাবে কতক্ষণ কেটেছে কে জানে—

হঠাৎ দরজায় সতর্ক আওয়াজ শুনে ঝিমতে ঝিমতে লাফিয়ে উঠল কেবলরাম।

নাঃ, দরজা খুলবে না—কিছুই বলা যায় না ; হয়তো তারাই। আলোটা নিভিয়ে দেবে? কিন্তু ভাবতেও শুকনো বুকের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে।

এমন সময় বাইরে থেকে ভোম্বলদাসের গলা এল, কেবলরাম—

আবার চমকে উঠল কেবলরাম।

কেবলরাম—দরজাটা ওপন কর—

কিন্তু কেবলরাম সাহস পায় না,—মানে সাহস পায় না তার মগজ—

ক্লান্ত অবসন্ন গলায় ভোম্বলদাস বলল, কেবলরাম দরজাটা খোল ভাই, আমি আর স্ট্যান্ড করতে পারছি না।

এবার নিঃসন্দেহ হল কেবলরাম। ছায়ামূর্তির যে গুঁতো খেতে সে ভোম্বলদাসকে দেখেছে তাতে কোন মানুষেরই দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকে না। তবুও ফ্যাঁশফেঁশে গলায় জিগ্যেস করল, ভোম্বল?

দরজাটা খুলেই দেখ আমি পিওর ভোম্বলদাস কিনা—

আরও একটু ইতস্তত করে কেবলরাম দরজা খুলল।

ধুঁকতে ধুঁকতে ঢুকল ভোম্বলদাস। কপালটা ঢিপি হয়ে ফুলে উঠেছে, গালের কাছটা কেটে গেছে—শুকনো রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে, মুসলমানের দাড়ি গোঁফ অদৃশ্য হয়েছে, পোশাক ছিন্ন-ভিন্ন, ডান হাঁটুতে চওড়া ফেট্টি বাঁধা—দুহাতে পেট চেপে ধরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে একটা চেয়ারে নির্জীব হয়ে বসল সে।

কেবলরাম তার পেছু পেছু এসে সামনের আরেকটা চেয়ারে বসল। বসতে গিয়ে যন্ত্রণায় একবার চোখমুখ কুঁচকোল।

ভোম্বলদাস বিস্ফারিত চোখে তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বলল, কী করে? হাউ?

কেবলরাম ফুলো ফুলো চোখে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে চেয়ে ছিল, সে ভোম্বলদাসের প্রশ্নেরই প্রতিধ্বনি করল, হাউ?

হ্যাঁ। এ-অবস্থা তোর কী করে হল? তুই তো স্রেফ কেটে পড়লি—

কেটে পড়লি?—বোমার মতন ফেটে পড়ল কেবলরাম, এতক্ষণকার সব রাগ একজোট হয়ে ছিটিয়ে পড়ল, তুমি তো মাটি নিলে আর আমি শালা প্রাণ নিয়ে পালাতে পারি না। এদিক থেকে ইঁট, ওদিক থেকে কাঠ, এপাশে ঝ্যাঁটা, ওপাশে

বুঝেছি।—লম্বা নিশ্বাস টেনে বলল ভোম্বলদাস, এবারও একাউন্টে ভুল হয়ে গেল। উফ—

একটু নড়তে গিয়ে যন্ত্রণায় গঙিয়ে উঠল ভোম্বলদাস।

সেটা সামলে নিয়ে নিজের মনে বলল সে, অবশ্য আমাদের লাকে এটা কিছু নিউ নয়—

থাক।—খিঁচিয়ে উঠল কেবলরাম, শালার না পারছি বসতে না পারছি শুতে—সমস্ত শরীরটায় যেন ছুঁচ ফুটছে।

আমার কথাটা একবার থিঙ্ক করে দেখ ভাই। উফ, এক-একটা ঢুঁ নয়তো যেন অ্যাটম বোমা। ওরকম হবে জানলে কোন ব্রাদার-ইন-ল ও ঘরে স্টেপ দিত।

কেবলরাম চুপ করে বসে রইল, কোন কথা বলল না।

মুখ কুঁচকে, ফোলা কপালে আলগোছে হাত বুলিয়ে ডোম্বলদাস বলল, উফ, মেড়াগুলো যে এরকম হয় জানতুম না—নাঃ, হেডটাকে একেবারে বেহেড করে দিলে—এখনও যেন চোখের সামনে মাস্টার্ড ফ্লাওয়ার দেখছি।

দুজনেই চুপচাপ। দুজনে নিঃশব্দে শুধু ঘামে।

একসময় গম্ভীর গলায় কেবলরাম বলল, ভোম্বল, একটা কথা শুনবি?

কী?—আচ্ছন্ন গলায় জিগ্যেস করল ভোম্বলদাস।

তোর এই ডিটেকটিভগিরি ছাড়—এ কচুয়া ধোলাই খেলে আর বাঁচতে হবে না—

ভোম্বলদাস ফাঁকা চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে।

এর চেয়ে চুরি ডাকাতি করে জেলে যাওয়া ভাল—সেখানকার ভাত কেউ মারতে পারবে না। তাও না পারি, পকেট কাটব, রিক্সা টানব—

আমিও তাই ভাবছি কেবলরাম।—

লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল ভোম্বলদাস, এ রোড আমাদের জন্যে নয়। কিন্তু ছাড়তেও যেন বুকের মাঝে পেন লাগে।

তবে পিটুনি খেয়ে মর। আমি এর ভেতর নেই, আমি আজই গুডবাই।

একটু—এক মিনিট কেবলরাম। এ রোড আমিও ছেড়ে দোব, বছরের ভেতর ছ’মাস বেড নিলে চলবে কী করে! কিন্তু তার আগে একটা কথা থিঙ্ক করার আছে। চন্দ্রমাধববাবু কী বলে গেছে মনে আছে?

কী?

সকালের ভেতর কুমারকে না আনতে পারলে ফোর-টোয়েন্টি সিওর। চন্দ্রমাধববাবু জজ, ফোর-টোয়েন্টি নিয়ে তিনি বাজ হয়ে দেখা দেবেন—

তাহলে?

দুজনে গালে হাত দিয়ে সেই ‘তাহলে’ ভাবতে বসল।।

শেষে ভোম্বলদাস বলল, আমার মন বলছে আমি এ-কেসে ফেঁসে কিছুতেই যাব না—কুমারকে আনবই কিন্তু টাইম চাই, কোথায় পাই?

চল—দেখি কী হয়। অতি কষ্টে কেবলরাম উঠে দাঁড়াল।

কোথায়?—ফুলো চোখে অবাক হয়ে তাকাল ভোম্বলদাস।

ঘটোৎকচবাবুর ওখানে।

ঘটোৎকচ?—ভয়ে ভোম্বলদাসের কথাগুলো জড়িয়ে যায়, সেটা একেবারে লায়নের হোল মনে থাকে যেন

মরেছি, না মরতে বাকি আছে। আমি খোলাখুলি বলব ঘটোৎকচকে, কুমারকে ফিরিয়ে দেবে কিনা—

হ্যাঁ, আমরা খোলাখুলি জানতে চাই কুমার কোথায়—

কুমার কোথায় মানে·····দেখুন আপনাদের কোন কথাই আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, সেটা হয়তো আমার বোঝার শক্তির অভাব আর নয়তো আপনারা ঠিক বোঝাতে পারছেন না ; দয়া করে যদি গোড়া থেকে আরেকবার বলেন—

আগা গোড়া বুঝি না আমরা, সোজা উত্তর চাই, কুমার কোথায়?—কেবলরাম তখন মরিয়া, ভোম্বলদাস নিশ্চুপ।

হাসার কায়দায় মুখটা একটু কুঁচকে ঘটোৎকচবাবু বললেন, দেখুন, আপনাদের নিশ্চয় কোথাও গোলমাল হয়েছে। কে কুমার, কোথা থেকেই-বা সে এল—

ভোম্বলদাস এতক্ষণ তাঁর মুখের মাপজোক আর ভাবভাষা নিশ্চুপ হয়ে অপরাধ প্রবণতার মাপকাঠিতে ফেলে মিলিয়ে দেখছিল। এখন তাঁকে বাধা দিয়ে বলল, শুনুন আমরা পুলিশের ম্যান—আমরা একটা ঘোরতর ষড়যন্ত্রের রুট ফাউন্ড করতে এসেছি। আপনি যদি উইশ করে আমাদের সাহায্য না করেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমাদের স্ট্রেংথের আশ্রয় নিতে হবে।

কেবলরাম পোঁ ধরে বলল, আমি বলছিলুম স্যার, এঁকে থানায় নিয়ে গিয়ে তিন ডিগ্রি চড়ালেই সব বেরোয়—

আশা করি তার ইউজ হবে না। উনি নিজেই সব কথা বলবেন।

ঘটোৎকচবাবু অনেকক্ষণ তাদের দুজনকে খুঁটিয়ে দেখবার পর বললেন, আপনাদের কথা শুনে মনে হলো আপনারা খুবই যোগ্য লোক—

ভোম্বলদাস খুশি হয়ে একটু হাসতে গিয়ে কোথাকার আঘাত এমন চিড়িক মারল যে হাসি মুখখানা কান্নার মতন দেখাল।

তবে আমার মনে হচ্ছে আপনাদের কোথায় ভুল হয়েছে।—আগেকার কথা টানেন ঘটোৎকচবাবু, বেশ, আপনাদের কী জানবার আছে তা আমায় বুঝিয়ে বলুন ; আমার জানা থাকলে নিশ্চয় তা জানাব। তার আগে, আপনাদের দেখে যেন অসুস্থ মনে হচ্ছে, একটু যদি চা-টা খান—

কেবলরামের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভোম্বলদাস বলল, না, এখন আর চা-টা ড্রিঙ্ক করব না, সকাল হতে তো সামথিং লেট নেই—

কেবলরাম জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটদুটো একবার চেটে নিল।

বেশ, তাহলে আপনাদের কী জানবার আছে বলুন। কিন্তু একটু চা খেলে আমি খুব খুশি হতুম।

ভোম্বলদাস বলে উঠল, আমাদের প্রফেশনে যেখানে-সেখানে চা খাওয়া যায় না—

কেবলরাম আবার হতাশ হল। এতক্ষণ ছিল বেশ, চায়ের নাম হতেই সমস্ত শরীরটা এককাপ চায়ের জন্যে যেন চিল চেঁচায়।

কিন্তু ভোম্বলদাস তখন আরম্ভ করেছে, জজ চন্দ্ৰমাধব বসুকে আপনি চেনেন?

হ্যাঁ, চিনি বৈকি। তিনি আমার বহুদিনকার বন্ধু। কেন, তাঁর কোনরকম—

তাঁর মেয়ে মণিকুন্তলা দেবীকে চেনেন?

দেখুন মশাই, আপনার এসব কথার কোন মানে হয় না। বলছি চন্দর আমার বন্ধু—

যাক, তাহলে আপনি মণিকুন্তলা দেবীকে রেকগনাইজ করেন। কুমারকে চেনেন?

কী আশ্চর্য, ওদের বাড়িতে আমার দুবেলা যাতায়াত, আমি কুমারকে চিনি না? কুমার হচ্ছে মণিমার—

ব্যস ওইতেই হবে। ক’ঘন্টা আগে আপনি বাড়ি থেকে আউট হয়েছিলেন, কোথায় গেছলেন?

মুহূর্তের জন্যে ঘটোৎকচবাবু ভুরু কুঁচকে তার দিকে চেয়ে থাকার পর জবাব দিলেন, নিজের বৈষয়িক কাজে।

আমরা যতদূর জানি আপনি গেছলেন কোন একটি বস্তিতে—

সেখানকার অভিজ্ঞতা মনে পড়াতেই বোধ হয় ভোম্বলদাস থেমে গেল।

হ্যাঁ গেছলুম এবং সেটা বৈষয়িক ব্যাপারেই।

গলার আওয়াজ করে ভোম্বলদাস একটু হাসল, ব্যাপারটা কতদূর ইয়ে আমরা তা জানি। শুনুন ঘটোৎকচবাবু, যে বস্তিতে আপনি গেছলেন সেই বস্তি····একটু আগে আমরা সার্চ করেছি।

সার্চ করেছেন? কেন?

এখনও বলছি কুমার কোথায় আছে বলুন। কেউ কিছু জানবে না, আপনিও কোন ডেন্জারে পড়বেন না।

চেয়ার ঠেলে ধীর শান্ত ভঙ্গিতে ঘটোৎকচবাবু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনার আর কিছু জানার আছে—?

বেশ কায়দা করে ভোম্বলদাস বলল, জানার নেই জানাবার আছে। যদি স্ট্রেট ফিংগারে ঘি লিফট না হয় তাহলে—

দয়া করে এবার কি বেরোবেন না আমায় লোক ডাকতে হবে?

অ্যাঁ—

থতমত খেয়ে দুজনেই দাঁড়াল।

ও, আপনি আবার বাংলা বেশ বুঝতে পারেন না। ওয়েল, উইল য়ু প্লীজ গেট আউট?

গেট আউট মানে—

বেরোও আমার বাড়ি থেকে—অ্যাটওআন্স—

তাঁর ওপর নজর রেখে পায়ে পায়ে পেছতে পেছতে কেবলরাম বলল, কিন্তু সাবধান শয়তান, কুমারকে দক্ষিণ-আফ্রিকায় চালান—

আই সে ক্লীয়ার আউট—

তাঁর কণ্ঠস্কুরের তীব্রতায় তারা দুজন ছিটকে একেবারে রাস্তায় এসে পড়ল।

অনেকক্ষণ পর একটা নিশ্বাস ফেলে ভোম্বলদাস বলল, তোর কথা মতন ডাইরেক্ট অ্যাকশন করতে গিয়ে সব ডেভলাপমেন্ট গুবলেট হয়ে গেল। সাটার্ন ঘটোৎকচ এখন যদি কুমারকে সরিয়ে ফেলে—

ভোম্বল, আমার কথা শোন, চল আমরাও সরে পড়ি।

হ্যাঁ, সরে পড়ি আর ফোরটোয়েন্টিতে ছটি মান্থ ঘানি ঘুরই।—খিঁচিয়ে উঠল ভোম্বলদাস।

তাহলে যা করবার চটপট কর, আমি এর পর আর তোমার কোম্পানিতে থাকছি না—

ওসব নেকস্টের কথা লেটে হবে। শোন, আমাদের এখুনি চন্দ্ৰমাধববাবুর হাউসে যেতে হবে—

তার চেয়ে থানায় গিয়ে হাতদুটো বাড়িয়ে দিলেই হয়।

উঁহু, তা নয়।—বেশ ভারিক্কি কায়দায় ভোম্বলদাস বলল, হেডে একটা আইডিয়া এসেছে।

তোমার কোন আইডিয়াতে আমি আর নেই। এক্স-রে করলে হয়তো দেখবে একশ’টা হাড় গুঁড়িয়ে গেছে—

এবারে একেবারে এন্ড ব্লো কেবলরাম। ঘটোৎকচের জাহাজ কাল সকালেই ছাড়বে, কেমন কিনা?

ছাড়বে। কিন্তু তাতে—

ওখানেই তো হেড। আমি এখুনি কুমারের হান্ড্রেড ছবি প্রিন্টিং করে পুলিশকে গিভ করে দেব, তারা সঙ্গে সঙ্গে মুভ করবে, জাহাজে জাহাজে সার্চ হবে—ঘটোৎকচের কেমুফ্লেজ সুড় সুড় করে ওপন হবে—

কেবলরাম চকচকে চোখে বলে উঠল, এতদিন পরে মনে হচ্ছে তোর যেন একটু বুদ্ধি হচ্ছে ভোম্বল—। এতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। কুমারও ফিরবে, টাকাটাও পাব—

বুদ্ধি ভোম্বলদাসের অল টাইম রয়েছে, কেবল তাকে প্লে করিয়ে বের করতে হয়।—আত্মপ্রসাদে ভরপুর হয়ে বলল ভোম্বলদাস।

তাহলে তাড়াতাড়ি চল।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলেন চন্দ্ৰমাধববাবু, কী, কী হয়েছে—এরকম চেঁচামেচির মানে কী? তোমাদের আমি পুলিশে দোব—

ভোম্বলদাস ভড়কে যায়। তোৎলাতে তোৎলাতে বলল, আজ্ঞে আমরা ভোম্বলদাস অ্যান্ড কোং—

বেরোও-বেরোও—ভোর হতে-না-হতে—!

আজ্ঞে আমরা কুমারের কেসে—

কুমার কে আবার?

এমন সময় মণিকুন্তলা চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে হাজির। ভোম্বলদাসকে দেখেই বলে উঠল, আমার কুমারকে এনেছেন?

এতক্ষণে মাটি পেল ভোম্বলদাস। বলল, আজ্ঞে সব ব্যবস্থা করে এসেছি। আপনার অনুমানই ঠিক, ঘটোৎকচবাবু কুমারকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সরিয়ে দিচ্ছেন। জাহাজ রেডি, তাই—

দেখেছ বাপী, আমি বলিনি?—ফুঁসে উঠল জজসাহেবের মেয়ে।

জজসাহেব সঙ্গে সঙ্গে নরম, তা বলেছিলে বটে—

ডেঞ্জারাস লোক—নাম শুনলেই তো বোঝা যায়। উঃ কী বুদ্ধি, লাইভস্টকের ব্যবসা করেন, ওঁর ভেড়াগুলোর সঙ্গে কুমারকেও চালান দেবেন, লোকের সাধ্য কী বুঝতে পারে? আপনাদের বুঝি ধরে মেরেছে ভোম্বলদাসবাবু?

না, ঠিক তা নয়। মানে ডিটেকটিভদের এসব হচ্ছে ব্রেকফাস্ট—

ভোম্বলদাসবাবু—

বলুন।

আপনি কুমারকে ওইরকম একটা ভীষণ লোকের হাতে রেখে এলেন?

আজ্ঞে তাছাড়া উপায় ছিল না। জাহাজে আমরা যেতে পারি না, ওসব ইন্টার নেশন আইনে পড়ে। তবে আপনার ভয় নেই, আমার লোক জাহাজকে লুক করছে।

আপনি এখানে এলেন কেন?—অস্থির গলায় মণিকুন্তলা জিগ্যেস করল।

কুমারের একটা পিকচারের জন্যে। কেননা পুলিশ তো থিক হেড, ছবি না পেলে কিছুই করতে পারে না—

আপনি এক মিনিট দাঁড়ান আমি এখুনি ছবি এনে দিচ্ছি। ছুটে চলে গেল মণিকুন্তলা।

জজসাহেব কটমট করে তাকালেন ভোম্বলদাসের দিকে, ভোম্বলদাস ঘাড়ের কাছটা চুলকোতে গিয়ে শিউরে উঠল। কী টাটিয়েছে রে বাবা!

ছুটতে ছুটতেই ফিরে এল মণিকুন্তলা। হাতে একটা বড় ছবি।

সাগ্রহে তার হাত থেকে ছবিটা নিল ভোম্বলদাস, কিন্তু ছবির দিকে তাকাতেই তার হাতটা থর থর করে কেঁপে উঠল—

ঘাড়ের পাশ দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আদুরে গলায় মণিকুন্তলা বলল, দেখেছেন কী চমৎকার দেখতে! গোটা ভারতবর্ষ খুঁজেও আপনি এর জুড়ি আরেকটি পাবেন না—খাঁটি পারস্য দেশের।

ভোম্বলদাসের মরা গলা দিয়ে মিউ মিউ করে বেরল, আজ্ঞে হ্যাঁ

ন্যাজটা দেখেছেন—কী লাভলি—

ভোম্বলদাস তখন ধোঁয়া দেখছে! মাথা বনবন করে ঘুরছে। ধরার কিছু না পেয়ে জজসাহেবের কাঁধটাই চেপে ধরল। হাত থেকে ছবিটা সশব্দে পড়ে গেল।

ছবির বেড়ালও যেন তাকে বিদ্রূপ করেই মিটি মিটি হাসে····

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *