1 of 2

ঘড়িচুরি – সরলাবালা দাসী (সরকার)

ঘড়িচুরি – সরলাবালা দাসী (সরকার)

সকাল ছয়টা। আকাশটা তেমন পরিষ্কার ছিল না, এজন্য সকালবেলা বাড়ি হইতে বাহির হই নাই। শেখরবাবু তখন রাস্তার দিকের জানালার কাছে ইজিচেয়ারখানি সরাইয়া লইয়া একখানি বই হাতে করিয়া একমনে পড়িতেছিলেন ; আমি তাঁহার সোফাখানি অধিকার করিয়া ছিলাম। তখন সবেমাত্র চায়ের পিয়ালা খালি হইয়াছিল, সেটি আমার সম্মুখের টিপায়ার উপর পড়িয়াছিল।

ঘরখানি ইংরাজি ফ্যাসানের। ঘরের মেঝে মাদুর মোড়া, চেয়ার টেবিল কৌচে ঘরখানি পরিপূর্ণ, একপাশে একটি আলমারি, সেটি নূতন পুরাতন নানাবিধ পুস্তক সংবাদপত্র প্রভৃতিতে পরিপূর্ণ। এই ঘরটি শেখরবাবুর বসিবার ঘর।

শেখরবাবুর পূর্ণ নাম সুধাংশুশেখর বসু। আমরা উভয়ে বাল্যকালে একত্র খেলা করিয়াছি, একই বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছি, এবং আজ পর্যন্ত তাঁহাকে যেমন ভালবাসি এমন আর কাহাকেও বাসি কিনা সন্দেহ। কিন্তু তাঁহার প্রকৃতি এমন দুর্বোধ যে, আমি এতদিনেও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। তিনি যখন স্কুলে পড়িতেন তখন কাহারও সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠভাবে মিশিতেন না, কিন্তু সকলের সঙ্গেই অমায়িক ভাবে ব্যবহার করিতেন। তাঁহার অসাধারণ বুদ্ধি ও স্মরণশক্তি দেখিয়া শিক্ষকগণ চমৎকৃত হইতেন, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যে সকল বালক বিদ্যা বুদ্ধিতে তাঁহার অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট, (তার মধ্যে আমি একজন) তাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট স্বাস্থ্য বিসর্জন ও উপাধি অর্জন করিয়া বিদায় লইল, কিন্তু তিনি তাহার কিছুই করিতে সমর্থ হন নাই। তারপর শেখরবাবু পুলিশের ডিটেকটিভ বিভাগে প্রবেশ করিয়াছিলেন ; যে কয়েক বৎসর তিনি কাজ করিয়াছিলেন, তাঁহার খ্যাতির সীমা ছিল না, কিন্তু কেন জানি না, অবশেষে তিনি স্বেচ্ছায় কাজ ছাড়িয়া দিয়াছেন।

শেখরবাবু বইখানি রাখিয়া দিয়া আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘মহেন্দ্রবাবু আসছেন দেখছি। তুমি বোধ হয় ওঁকে চেনো।’

শেখরবাবু মধুর হাস্যের সহিত মহেন্দ্রবাবুর সম্বর্ধনা করিলেন, তাহার পর তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘মহেন্দ্রবাবু, আজিকার সকালটা বড়ই বাদ্‌লা, খানিকটে চা আনিতে বলিব কি ?’

মহেন্দ্রবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘তাহাতে আমার বিশেষ আপত্তি নাই। কিন্তু সম্প্রতি একটা বড় দরকারী কাজের জন্য আপনার নিকট আসিয়াছি। আপনি বোধ হয় জানেন আমি এখন পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের ডিটেক্‌টিভ। এই ভদ্রলোকটি একটি ঘড়ি পার্শ্বেল করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, সেটি চুরি গিয়াছে, এ পর্যন্ত তাহার কোনই সন্ধান পাওয়া যায় নাই।’

শেখরবাবু আগন্তুক ভদ্রলোকটির দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘বসুন মশায়, ব্যাপারটি কি ঘটিয়াছে সমস্তই আপনি বিস্তারিত করিয়া বলুন।’

‘ব্যাপার এমন বিশেষ কিছু নয়। যেটি হারাইয়াছে সেটি অতি উৎকৃষ্ট ও মূল্যবান ঘড়ি, কিন্তু তাহা অপেক্ষাও অধিক ক্ষতির কথা এই যে, সেটি আমার স্বর্গীয় পিতৃদেবের স্মৃতিচিহ্ন। আপনি ঘড়িটি উদ্ধার করিয়া দিতে পারিলে আমি চিরদিন আপনার নিকট ঋণী থাকিব।’

শেখরবাবু তাঁহার কথায় বাধা দিয়া বলিলেন, ‘ঘড়ি চুরি সম্বন্ধে কি বলিতেছিলেন ?’

‘ঘড়িটি আমার দাদার নিকট থাকিত। সম্প্রতি দাদা রাজবাড়ি যাইবার সময় ঘড়িটি একটু খারাপ হইয়া গিয়াছিল বলিয়া মেরামত করিয়া পাঠাইয়া দিবার জন্য আমার কাছে রাখিয়া যান। ঘড়ি মেরামত হইয়া গেলে, আমি তাঁহার নিকট ডাকে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। ফেরৎ ডাকে তাঁহার যে পত্র আসিল, তাহা পড়িয়াই আমি অবাক হইলাম। তিনি লিখিয়ছেন যে, ‘তুমি ঘড়ি পাঠাইয়াছ এবং আমিও ঘড়ি পাইয়াছি বটে, কিন্তু সে ঘড়ির বদলে একটি অতি অল্পদামের বাজে ঘড়ি পাইয়াছি।’ এই দেখুন, তাঁহার পত্র।’ বলিয়া ভদ্রলোকটি একখানি খামে ভরা পত্র শেখরবাবুর হাতে দিলেন।

শেখরবাবু খামখানি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে বলিলেন, ‘আপনার দাদা বোধ হয়। রেলওয়ে অফিসে কাজ করেন ? ’

‘হ্যাঁ, তিনি রাজবাড়ির স্টেশন মাস্টার। আপনার সঙ্গে কি তাঁর পরিচয় আছে ? ’

‘না, খামখানি দেখে এই রকমই অনুমান হচ্ছে।’ মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘খাম দেখে অনুমান হচ্ছে ? ’

শেখরবাবু খামখানি তাঁহার হাতে দিয়া বলিলেন, ‘দেখুন না, খাম দেখে কিছু বুঝা যায় কিনা ?’

মহেন্দ্রবাবু অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে খামখানির চারিদিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তাহার পর বলিলেন, ‘ভায়োলেট কালিতে লেখা নাম ও ঠিকানা, আর এখানকার ও রাজবাড়ির পোস্টমার্ক, ইহা ভিন্ন খামে এখন কোন চিহ্ন নাই, যাহা হইতে পত্রপ্রেরক কি কাজ করেন, তাহা বুঝা যায়।’

‘পোস্টমার্কটি ভাল করিয়া দেখিয়াছেন ? ’

‘হ্যাঁ, পোস্টমার্কে রাজবাড়ির পর R. S. লেখা আছে বটে, কিন্তু অন্য লোকেও তো স্টেশনে চিঠি দিয়া যাইতে পারে।’

‘চিঠিখানা কোন সময় সেখান থেকে রওনা হয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছেন ?’

‘ঠিক কথা, চিঠিখানা দেরিতে রওনা হয়েছে, কিন্তু ‘লেট ফি’র ছাপ নাই।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘এর থেকেই অনেকটা অনুমান হয় নাকি যে, যিনি চিঠি লিখেছিলেন, তিনি লেট ফি না দিয়েও চিঠিখানা পাঠাতে পারেন ?’

‘তিনি স্টেশনের কর্মচারী না হয়ে পোস্টাল কর্মচারী তো হতে পারেন।’

‘ঠিক কথা। ভায়োলেট রংয়ের কালি সচরাচর কোথায় ব্যবহার হয় বলুন দেখি।’

মহেন্দ্রবাবু আশ্চর্য হইয়া শেখরবাবুর মুখের দিকে চাহিলেন, বলিলেন, ‘শেখরবাবু আপনি ঠিক বলিয়াছেন, এই কালি কপিংইঙ্ক নামে রেলওয়ে স্টেশনে ব্যবহারের জন্য আজকাল চলিত হইয়াছে।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘রেলের স্টেশনে দরকারী কাগজপত্রের নকল রাখিবার জন্য যে কালির ব্যবহার, তাহা ডাকঘরে লইয়া গিয়া তাহাই পত্রে ব্যবহার করিয়াছে, এরূপ যুক্তি নিতান্ত অসার।’

চিঠিখানি এতক্ষণ খামের মধ্যেই ছিল, এখন শেখরবাবু খামের ভিতর হইতে চিঠিখানি বাহির করিয়া পড়িবার পূর্বে একবার নাকে আঘ্রাণ লইলেন,তারপর কাগজখানি মহেন্দ্রবাবুর হাতে দিয়া বলিলেন, ‘কাগজটা দেখে আপনার কি মনে হয় ?’

বেশ মোটা রুলটানা কাগজ, হাফসিট। কাগজখানি ছিঁড়িবার সময় বোধহয় তাড়াতাড়ি ছেঁড়া হইয়াছিল, কেননা পরিষ্কার ছেঁড়া হয় নাই। চিঠির এক পৃষ্ঠা ভায়োলেট কালিতে লেখা, অপর পৃষ্ঠায় কালো কালো দাগ আছে। কাগজখানি দেখিয়া বোধ হয়, কোন একখানা লেখা চিঠির এক পৃষ্ঠা সাদা ছিল, সেই সাদা কাগজখানি ছিঁড়িয়া লইয়া এই চিঠিটা লেখা হইয়াছে ।’

শেখরবাবু সন্তুষ্ট হইলেন, বলিলেন, ‘বেশ মহেন্দ্রবাবু, আপনি ঠিক ধরিয়াছেন। এখন বলুন দেখি, যে চিঠির এক পৃষ্ঠা ছিঁড়িয়া লইয়া হইয়াছে সেই চিঠিখানি স্ত্রীলোকের কি পুরুষের ? আপনার কি বোধ হয় ?’

‘চিঠির অপর পৃষ্ঠায় লেখার যে দাগ পড়িয়াছে সেটা বাংলা লেখার ছাপ বলিয়া বোধ হয় বটে, কিন্তু তাহা হইতেই স্ত্রীলোকের চিঠি বলিয়া ঠিক করা অনেকটা কষ্টকল্পনা। পুরুষেও তো বাংলায় পত্র লিখিয়া থাকে।’

‘নিশ্চয়ই লেখে, কিন্তু চিঠিখানি যে পুরুষের লেখা নয়, সে বিষয়ে কষ্টকল্পনা ব্যতীতও অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। চিঠিখানি একবার নাকের কাছে ধরুন দেখি।’

‘বাঃ, চমৎকার গন্ধ।’

‘গন্ধটি দেল্‌খোসের গন্ধ । ডিটেক্‌টিভ বিভাগে কাজ করিতে হইলে ভিন্ন ভিন্ন সুগন্ধের পার্থক্য অনুভব করিবার ক্ষমতা বিশেষ আবশ্যক । দেল্‌খোস প্রভৃতি যে সকল গন্ধদ্রব্যের সচরাচর ব্যবহার, সেগুলির সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করা নিতান্ত প্রয়োজন। এখন ভাবিয়া দেখুন, স্ত্রীলোকের পক্ষেই হাতবাক্সে এসেন্স রাখিবার অধিক সম্ভাবনা। লিখিবার সময় কালি ব্লট না করার জন্য কাগজের অপর পৃষ্ঠায় ছাপ পড়িয়াছে, এরূপ অপরিষ্কার লেখাও পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকের পক্ষেই অধিক সম্ভব। তাহার পর হাতের লেখা সম্বন্ধে আমি অনেক সমালোচনা করিয়াছি। তাহাতেই লেখার এই উল্টা ছাপ দেখিয়া নিশ্চয় বলিতে পারি ইহা স্ত্রীলোকের লেখা।’

হরিভূষণবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘হ্যাঁ, এই ডাকের কাগজ দেখে এখন আমার মনে হচ্ছে, বৌদিদি এই রকম ডাকের কাগজ ব্যবহার করেন। সম্ভবত তাঁহারই চিঠির আধখানা কাগজে দাদা এই চিঠি লিখে থাকবেন। কিন্তু আপনার এই অদ্ভুত ক্ষমতা এই সমস্ত বৃথা বিষয় লইয়া অপব্যবহার হইতেছে, ইহাতে চুরির কোন সন্ধান হইতেছে না।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘চুরির সম্বন্ধেও কতক সাহায্য হইল বৈকি ! এই সমস্ত দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি রাজবাড়ি স্টেশনে পার্শ্বেল পৌঁছিয়াছে ও সেখানে আপনার দাদাও উপস্থিত ছিলেন, অতএব সেখান হইতে চুরি যাইবার সম্ভাবনা খুব অল্প। আপনি ঘড়ি কিরূপে কাহাকে দিয়া পাঠাইয়াছিলেন ? ’

হরিভূষণবাবু বলিলেন, ‘ঘড়িটি রেজিস্ট্রি কি ইন্‌সিওর করিয়া পাঠাই নাই, বেয়ারিং পার্শ্বেল কখনো খোওয়া যায় না জানিতাম, তাই বেয়ারিং পাঠাইয়াছিলাম। ঘড়ি আমি নিজে হাতে প্যাক করিয়া আমাদের বাড়ির বিশ্বাসী ঝির হাতে দিয়া পোস্টাফিসে পাঠাইয়াছি। পার্শ্বেলে যে ঘড়ি আছে তাহা ঝির জানিবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। তারপর ঘড়ির সঙ্গে আর আমার কোন সম্বন্ধ নাই।’

শেখরবাবু হরিভূষণবাবুর কথা শুনিতে শুনিতে তাঁহার দাদার চিঠি দেখিতেছিলেন। বলিলেন, ‘আপনার দাদা লিখিয়াছেন চলন্ত ঘড়ি পাইয়াছিলেন, আপনি কি এখানে ঘড়িতে চাবি দিয়া দিয়াছিলেন ? ’

‘হ্যাঁ, আমার মনে কেমন একটা খেয়াল হইয়াছিল যে এখান হইতে দম দিয়া পাঠাইলে ঘড়ি চলন্ত অবস্থায় পৌঁছায় অথবা কোন সময় বন্ধ হয় তাহা পরীক্ষা করিব, সেইজন্য আমি ঠিক দশটার সময় দম দিয়া দিই, এবং দাদাকেও ঘড়ি চলিতেছে অথবা কয়টা বাজিয়া বন্ধ হইয়াছে তাহা জানাইতে লিখিয়াছিলাম।’

মহেন্দ্রবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘শেখরবাবু, আপনি বোধ হয় ঝির উপরেই সন্দেহ করিতেছেন, কিন্তু আমি ঝির ও তাহার আত্মীয়গণ কলিকাতায় যে যেখানে আছে তাহাদের এমনভাবে অনুসন্ধান করিয়াছি যে তাহারা চুরি করিলে নিশ্চয় ধরা পড়িত।’

হরিবাবু বলিলেন, ‘আমারও মনে হয় না যে বামা চুরি করিয়াছে। সে আমাদের অতি বিশ্বাসী ঝি। বিশেষত পার্শ্বেলে যে ঘড়ি আছে তাহাই সে জানিত না।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘অবশ্য আপনি কাহাকেও বলিয়া দেন নাই যে পার্শ্বেলের ভিতর ঘড়ি পাঠাইতেছেন, কিন্তু পার্শ্বেলের ভিতর একটা চলন্ত ঘড়ি পাঠাইলে যাহার হাতে পড়ে সে কি আর বুঝিতে পারে না?

‘ঘড়িটি প্যাক করার পর ওকথা আমার মনে হইয়াছিল, সেই জন্য পাঠাইবার আগে কানের নিকট ধরিয়া খুব মনোযাগের সঙ্গে শুনিতেছিলাম, কিন্তু দেখিলাম কিছুই শুনা যায় না।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘ঘড়ির শব্দ অনেক সময় কানে শোনা অপেক্ষা স্পর্শের দ্বারা বেশি বুঝা যায়। আপনি যদি পার্শ্বেলটা চারিদিকে ফিরাইয়া ঘুরাইয়া দেখিতেন তাহা হইলে কোন না কোন অবস্থায় ঘড়ির শব্দ বুঝিতে পারিতেন। এই দেখুন, এই ঘড়িটির উপর এই ছড়িখানি ছোঁয়াইয়া রাখিলাম, অন্য দিকটা আপনি দাঁতে করিয়া ধরুন। শব্দ পাইতেছেন?’

হরিবাবু মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানাইলেন। তাহার পর দাঁতের ছড়িটি ফেলিয়া দিয়া বলিলেন, ‘একটা কথা আপনাকে আগে বলি নাই, ঘড়ির সঙ্গে আমি একটা থার্মোমিটারও পাঠাইয়াছিলাম।’

‘তাহা হইলে তো এ বিষয়ে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, থার্মোমিটারের খাপের একদিক ঘড়িতে ও অন্যদিক টিনের কৌটার গায়ে লাগিয়াছিল, সেই দিকে হয়তো হঠাৎ চোরের হাত পড়িয়াছিল, এবং তাহাতেই সে চুরি করিতে প্রবৃত্ত হইয়া থাকিবে।’

মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘এই সব প্রমাণে বামার উপরেই সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু বামা ঘড়ি পাওয়ার ১৫ মিনিট পরেই পোস্টাফিসে দিয়া আসিয়াছে এ খবর আমি ঠিক জানিতে পারিয়াছি। যদিও ঘড়ি ডাকে দিতে যাইবার সময় তাহার ভাইপোর সঙ্গে দেখা হইয়াছিল, তথাপি তাহার দ্বারা এ কাজ হয় নাই সে বিষয়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’

শেখরবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার তবে কাহার উপর সন্দেহ হয়?’

‘আমার অনেকটা এইরকম বিশ্বাস হইয়াছিল, আর এখনও মনে হয় হরিবাবুই পাঠাইবার সময় একটা গোলমাল করিয়াছেন।’

হরিবাবু ম্লান ভাবে হাসিলেন, বলিলেন, ‘আজ কাল পুলিশে যাওয়া বিষম বিড়ম্বনা। যিনি অভিযোগ করিতে যাইবেন পাকে প্রকারে তাঁহাকেই অভিযুক্ত হইতে হইবে। মহেন্দ্রবাবু যেরূপ ভাবে আমাদের বাড়িখানা তল্লাসী করিয়াছিলেন তাহাতে উনি যদি আমার বিশেষ বন্ধু না হইতেন, তবে উঁহার সঙ্গে আমার বিষম মনোবিবাদ হইত।’

মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘কর্তব্যের অনুরোধেই আমাদের এই সব অসন্তোষকর কার্য করিতে হয়।’

‘যে ঘড়িটি পাওয়া গিয়াছে সেটি কোথায়?’

হরিবাবু পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া বলিলেন, ‘এই ঘড়িটি দাদা ফেরৎ পাঠাইয়াছেন।’

‘কবে পাঠাইয়াছেন?’

‘তিনি ঘড়ি পাইয়াই যখন দেখিলেন তাঁহার ঘড়ি নয়, তখন যে ট্রেনে তাঁহার চিঠি ফেলিয়াছিলেন সেই গাড়ির গার্ডের হাতে আমার নিকট ফেরৎ দিবার জন্য ঘড়িটি দিয়াছিলেন। গার্ড আমাদের বাড়ি পাঠাইয়া দিয়াছে।’

‘পোস্টাফিসে সন্ধান করে কি জানিতে পারিলেন?’ মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘পোস্টাফিস থেকে চুরি যাওয়া সম্ভব নয়, তাহা অবশ্য বুঝিতে পারিতেছেন। পোস্টমাস্টার রাজকৃষ্ণবাবুর নিকট জানিতে পারিলাম যে তিনি দুটার সময় দার্জিলিং মেলে দিবার জন্য পার্শ্বেল রওয়ানা করিয়া দিয়াছিলেন।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘তিনি ১২টার সময়েও তো ডাক রওনা করিয়া নির্দোষ হইতে পারিতেন।’ তাহার পর আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের বড় ছেলের নাম রাজকৃষ্ণ নয়?’

আমি বলিলাম, ‘হ্যাঁ, তিনি তো পোস্টাফিসে কাজ করেন।’

শেখরবাবু ভাবিতে ভাবিতে ঘড়িটি চারিদিক মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, অবশেষে একটু চিন্তিত ভাবে হরিবাবুকে বলিলেন, ‘আপনার ঘড়িটি পাইলেই আপনি বোধ হয় সন্তুষ্ট হন। চোরকে ক্ষমা করিতে বোধ হয় আপনার আপত্তি নাই। কারণ যে চুরি করিয়াছে তাহার বয়স অতি অল্প, এ সময় তাহাকে জেলে দিলে তাহার ভবিষ্যৎ চিরদিনের জন্য নষ্ট হইয়া যাইবে।’

মহেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘আপনার কথা শুনিয়া আমার বড়ই আশ্চর্য বোধ হইতেছে। চোর ধরা না পড়িলে ঘড়িটি কি করিয়া পাইবেন বুঝিতে পারিতেছি না, আর আপনি কোন অনুসন্ধান না করিয়া এ সমস্ত কি প্রকারে জানিলেন!’

শেখরবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘এই ঘড়িটাই চোরকে দেখাইয়া দিতেছে।’

মহেন্দ্রবাবু এই কথা শুনিয়া ব্যগ্র ভাবে ঘড়িটি হাতে লইলেন ও খুব মনোযোগের সঙ্গে দেখিতে লগিলেন।

‘ঘড়ির উপর কতকগুলি দাগ পড়িয়াছে এবং ঘড়ির রিংয়ে একটু সূতা বাঁধা আছে দেখতে পাচ্ছি, চিহ্নের মধ্যে তো এই!’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘উপরের দাগ কিছুই নয়, ঘড়ির সঙ্গে এক পকেটে টাকা কি অন্য পদার্থ ছিল দাগ দেখিয়া তাহাই বুঝা যায়। বরং ঘড়ির ভিতরে যেখানে ঘড়িতে চাবি দেওয়া হয় সেখানে যে দাগ পড়িয়াছে তাহা দেখিয়া অনুমান করিতে পারেন যে ঘড়ির অধিকারীর মদের প্রতি অনুরাগ জন্মিয়াছে। মাতালদের হাত কাঁপে বলিয়া চাবি দিবার সময় ঘড়িতে এইরূপ দাগ হয়। তবে রিংয়ে যে সূত্র আছে সেটিও একটি সূত্র বটে, কিন্তু সর্বপ্রধান সূত্র এখনও আপনি ধরিতে পারেন নাই। যাহা হউক, পোস্টমাস্টারবাবুকে কাল চারিটার সময় পাঠাইয়া দিবেন। আমি তাঁহার নিকট অনুসন্ধান করিয়া ঘড়ির সম্বন্ধে মীমাংসা করিব। আপনাদের কাহারও তাঁহার সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন নাই।’

পরদিন বেলা ৪টার সময় পোস্টমাস্টার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শেখরবাবুর সদাপ্রসন্ন মুখখানি আজ একটু বিমর্ষ বোধ হইল। রাজকৃষ্ণবাবুকে বাড়ির সংবাদ প্রভৃতি জিজ্ঞাসা করিতে করিতে পকেটে হাত দিয়া যেন আশ্চর্যভাবে বলিলেন, ‘আমার ঘড়িটা কোথায় গেল?’ তারপর রাজকৃষ্ণবাবুকে বলিলেন, ‘আপনার ঘড়িটি দিন তো সময়টা দেখি।’ রাজকৃষ্ণবাবু ঘড়িটি বাহির করিয়া দিলেন। ঘড়িটা একটা কালো রংয়ের কারে বাঁধা ছিল। শেখরবাবু ঘড়ি না দেখিয়া ম্যাগ্নিফাইং গ্ল্যাস দিয়া কারের গিরা বাঁধা জোড়ার জায়গাটি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন।

পরীক্ষা শেষ হইলে রাজকৃষ্ণবাবুকে বলিলেন, ‘আপনার পিতা আমাদের সকলের সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন, আপনি সেই দেবতুল্য পিতার সন্তান। কলিকাতায় আসিয়াও নূতন চাকরিতে প্রবেশ করিয়া আপনার স্বভাবের এইরূপ অধঃপতন হইয়াছে দেখিয়া বড়ই দুঃখিত হইয়াছি। এ কথা নিশ্চয় জানিবেন যে পাপ কখনো লুকানো থাকে না। আমাদের কর্তব্য আপনাকে রাজদ্বারে সমর্পণ করা, কিন্তু আপনার বয়স অল্প, ক্ষমা পাইলে আপনার স্বভাব ক্রমশ সংশোধিত হইতে পারে এইরূপ বিবেচনা করিয়া এবার আপনাকে ক্ষমা করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু ফণিভূষণবাবুর ঘড়িটি অবশ্যই আপনি ফিরাইয়া দিবেন।’

পোস্টমাস্টারবাবু ইতস্তত করিতে লাগিলেন, একটু পরে বলিলেন, ‘আপনারা আমাকে কেন যে এরূপ বলিতেছেন বুঝিতে পারিতেছি না।’

শেখরবাবু বলিলেন, ‘আমি বুঝাইয়া দিতেছি। এই ঘড়িতে যে রেশমটুকু বাঁধা আছে সেটা ওই কারের, আর ঘড়ি পাঠাইবার সময় তাড়াতাড়িতে আপনি খুলিতে না পারিয়া কারটি কাটিয়া ফেলিয়াছেন। তার পর দেখুন, ফণিবাবু যে ঘড়ি পাইয়াছেন সেটি তখন চলিতেছিল, চলন্ত অবস্থাতেই তিনি ফেরৎ পাঠান, এখানে আসিয়া একটা বাজিয়া ঘড়িটি বন্ধ হয়, কাল আমি ঘড়িটিতে চাবি দিয়া দেখিয়াছি ঘড়িটি ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা সময় রাখে। অতএব একটার সময় ঘড়িতে চাবি দেওয়া হইয়াছিল বেশ বুঝা যাইতেছে। মহেন্দ্রবাবু আমাকে বলিয়াছেন পোস্টাফিসের খাতাপত্রেও প্রকাশ এবং আপনিও স্বীকার করিয়াছেন ঘড়ি দুটা পর্যন্ত আপনার কাছেই ছিল, তাহার পর তাহা মেলে পাঠাইয়াছেন, অতএব আপনি একটার সময় চাবি দিয়া ঘড়িটি প্যাক করিয়া পাঠাইয়াছেন। এই প্রমাণ যে-কোন আদালতে আপনাকে দোষী করিবে তাহা বোধ হয় এখন বুঝিয়াছেন।’

পরদিন বৈকালে মহেন্দ্র ও হরিবাবু উপস্থিত হইলেন। মহেন্দ্রবাবু একটু বিদ্রূপের সহিত বলিলেন, ‘শেখরবাবু, ব্যাপার কি? সেই অল্পবয়স্ক চোর ও চোরাই ঘড়ির কোন সন্ধান পাইয়াছেন নাকি?’

শেখরবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘চোরটির সন্ধান আপাতত দিতে পারিতেছি না, ঘড়িটির সন্ধান পকেটেই আছে।’ —বলিয়া পকেট হইতে ঘড়িটি বাহির করিয়া দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *