১৬. নানারকম নানাসাহেব

নানারকম নানাসাহেব

সিপাহি-যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ১৮৫৮ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন নানাসাহেব, তাঁর ভাই বালাসাহেব, অযোধ্যার বেগম হজরতমহল ও আরও কয়েকজন নেতা নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রধান সেনাপতি ক্লাইডের সৈন্যরা রাপ্তি নদীর কাছে নানাসাহেবকে তাড়িয়ে নিয়ে এলেন। ইচ্ছা ছিল ধরে নিয়ে আসবেন। কিন্তু কোম্পানির সৈন্যের তাড়া খেয়ে নানাসাহেব, তাঁর সঙ্গীরা ও কয়েক হাজার লোক নেপালে ঢুকে পড়লেন। নানাসাহবের সঙ্গে আটটি হাতি ধনরত্নে বোঝাই।

নেপালে ঢুকে যাবার পরে নানার কী হল? বলা খুব মুশকিল। নেপালের মন্ত্রী রানা জঙ্গবাহাদুর নাকি নানাকে বললেন, তোমাকে আমি ধরিয়ে দেব না। কিন্তু তোমার স্ত্রী কাশীবাঈকে, ও যা গয়নাগাঁটি এনেছ, সব আমার কাছে রেখে যেতে হবে। নানাসাহেব প্রথমটায় ইতস্তত করছিলেন। তারপর দেখলেন, তাঁর রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নানাসাহেব যত ধনরত্ন, গহনা ইত্যাদি নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে দামি ও বিখ্যাত ছিল ‘নওলখা হার’; খুব দামী হীরে, মণি, মুক্তো, পান্না এইসব দিয়ে তৈরি। তার বদলে রানা কাশীবাঈকে একটা বাড়ি তৈরি করিয়ে দিলেন। কিছু সম্পত্তিও দিয়েছিলেন।

বছরখানেক আর বিশেষ কিছু শোনা যায়নি। নেপালের তরাই অঞ্চলে খুব ম্যালেরিয়া। ইংরেজরা খবর পেতে লাগলেন, নানাসাহেবের ভাই বালাসাহেব ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগে মারা গেছেন, তার মাসখানেকের মধ্যে নানাসাহেবও গত হয়েছেন। এ-রকম হওয়া অসম্ভব ছিল না। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজে মিটল না। মাঝে-মাঝে খবর আসতে লাগল, নানাসাহেব অথবা নানাসাহেবের মতো একটি লোককে নেপালের এখানে-ওখানে দেখা যাচ্ছে। নানারকম খবর। কেউ বলছে, নানাসাহেবের তখন খুব দুরবস্থা, সঙ্গে মাত্র একটি লোক। কেউ বলেছে, নানাসাহেবকে দেখলাম, সঙ্গে ত্রিশ-চল্লিশ জন গেরুয়া-পরা লোক, তারা কিন্তু আসলে সন্ন্যাসী নাও হতে পারে। আর একজন বলেছিল, সে নানাসাহেবকে দেখেছে, সঙ্গে কয়েক হাজার লোক, কয়েকটি হাতি আর ত্রিশটি কামান। আর একজন বলেছিল, লোকটি খুব দানধ্যান করেন। দিনে কয়েকবার পুজো-আচ্চা করেন। তাঁর পুজোর বাসন সোনা তার রুপো দিয়ে তৈরি। এইসব গল্প কতটা সত্যি কতটা মিথ্যে, বুঝে ওঠা মুশকিল। নেপালের রানা জঙ্গবাহাদুর প্রথম-প্রথম বলতেন, নানাসাহেব বেঁচে নেই। পরে তাঁরও মত বদলে গেল। তিনি ইংরেজদের বলে পাঠালেন যে, নানার ভাই যে মারা গিয়েছে, তাতে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নানা সম্বন্ধে তিনি জানেন না কী হয়েছে। হয়তো বেঁচে আছেন, অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন।

১৮৬২ সাল থেকে নানারকম গোলমেলে খবর শোনা যেতে লাগল। হরজি ব্রহ্মচারী নামে একজন করাচিতে ধরা পড়লেন। সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু, নাম ব্রজদাস। কারও কারও ধারণা হল, হরজি ব্রহ্মচারী আর কেউ নন, নানাসাহেব স্বয়ং। ছদ্মবেশে ঘুরছিলেন হরজি ব্রহ্মচারীর শরীরের অবস্থা তখন খুব খারাপ। তাঁকে জাহাজে করে কলকাতায় নিয়ে এসে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হল। হরজি ব্রহ্মচারী কয়েকদিন ভুগে সেখানে মারা গেলেন। এটা যে ইংরেজ পুলিশের মারাত্মক ভুল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। পরে জানা গেল, হরজি ব্রহ্মচারী ধর্মীয় বই লিখতেন। হরজি ব্রহ্মচারীর বন্ধু ছাড়া পেয়ে গেলেন।

এরপরে যে ঘটনা ঘটল, সে আরও বেশি চমকপ্রদ। আজমিঢ়ে আবার আর-এক ‘নানাসাহেব’ ধরা পড়লেন। সেখানকার ডেপুটি কমিশনার মেজর ডেভিডসন সাহেবের কাছে খবর এল যে, নানাসাহেব আজমিঢ়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এক হাজার সৈন্য ছিল। তারা অন্যত্র চলে গিয়েছে। আজমিঢ় থেকে একটি লোককে নানা মনে করে ধরে নিয়ে আসা হল। নানাসাহেবকে গ্রেপ্তার করবার জন্য যে হুলিয়া বের করা হয়েছিল, তার সঙ্গে লোকটির চেহারা মিলিয়ে নিয়ে ডেভিডসন ও আজমিঢ়ের সিভিল সার্জন দু’জনেরই বিশ্বাস হল, এ ব্যক্তি নানাসাহেব না হয়ে যায় না। চেহারায় কিছু গরমিল আছে বটে, কিন্তু এতদিন ধরে নেপালের পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরলে ওরকম তো হতেই পারে। আগে বেশ মোটাসোটা ছিলেন, এখন রোগা হয়ে গিয়েছেন। নানাসাহেবের ফোটোগ্রাফ তুলে তিনজনের কাছে পাঠানো হল। তাঁরা আগে নানাকে ভাল করে চিনতেন। একজন হলেন বারাণসীর ডঃ চিক্ আর দু’জন হলেন মিরাট ও ফৈজাবাদের সামরিক কর্মচারী। ডঃ চিক্ নানাকে অনেকবার দেখেছেন, তিনি ফোটোগ্রাফ দেখে বললেন, এ কখনও নানাসাহেব হতে পারে না। তারপর বন্দীকে যখন কানপুরে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হল, তখন বললেন, এঁর গলার স্বর আলাদা, নানার চেয়ে গায়ের রং কালো, এবং নানার তখন যে বয়স হওয়া উচিত ছিল, এঁর বয়স তার চেয়ে বছর-পনেরো বেশি। কানপুরের আগেকার সিভিল সার্জন নানাসাহেবকে এক সময় চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি বললেন, নানার সঙ্গে এঁর চেহারার কিছু মিল থাকতে পারে, কিন্তু এই লোক নানাসাহেব নন। খবরের কাগজে কিছুদিন উত্তেজিত আলোচনা চলবার পর ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল।

আবার শোনা গেল, মেবারে একজন নানাসাহেবকে পাওয়া গিয়েছে। কিছুদিন পর শোনা গেল, কানপুরে। সেখানে তিনি নাকি সিন্ধিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সিন্ধিয়া তাঁকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে এলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে সিন্ধিয়ার বিশ্বাস হল, তিনি নানাসাহেব। তিনি তাঁকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আবার কানপুরে নিয়ে এসে নানাকে পরীক্ষা করা হল। সেখানে একজন ইংরেজ ডাক্তার বললেন যে, যদিও তিনি নানাকে আগে চিকিৎসা করেছেন, তাহলেও ঠিক চিনতে পারছেন না। আসল নানাসাহেবের চেয়ে এঁর বয়স তো অনেক কম মনে হচ্ছে।

মওব্রে টমসন নামে কানপুরে একজন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক নানাকে বার দুয়েক দেখেছিলেন। আগেকার আর-এক ইংরেজ সাক্ষীর সঙ্গে তাঁর মতের মিল হল। তিনিও বললেন, এঁর গলার স্বর অন্যরকম। নানাসাহেবের সুখের দিনে তিনি যাঁকে নানাসাহেব বলে জানতেন, তাঁর চেয়ে এঁর চেহারা তো অন্য রকম। তার উপর এঁর মুখে বড় দাড়িগোঁফ, কামিয়ে ফেললে বোধহয় চেনার সুবিধা হবে। নাপিত ডেকে দাড়ি কামিয়ে ফেলা হল, তারপরে মহারাষ্ট্রীয় পোশাকও পরিয়ে দেখা হল। মওব্রে টমসন নিজের মন বুঝতে পারেননি। কামাবার পর বললেন, চেহারার তো বেশ কিছু মিল আছে দেখছি, একটা কাটা দাগও মিলে যাচ্ছে, কিন্তু একথা কী করে বলব যে, এই লোক নানাসাহেব? অনেকেই সিন্ধিয়ার প্রাসাদে এসে বন্দীকে দেখেছিলেন। একজন বললেন, “আরে, এঁকে আমরা চিনি, এঁর নাম তো যমুনা দাস। যমুনা দাস আবার কী করে নানাসাহেব হবেন?”

অন্য উদাহরণও আছে। আপ্টে পরিবারের সঙ্গে নানাসাহেবের পরিবারের কুটুম্বিতা ছিল। সম্পর্কে বাবা আপ্টের ছেলে ছিলেন নানাসাহেবের জামাই। তাঁরও তখন বয়স হয়েছে। তাঁকে নানাসাহেবের কাছে নিয়ে আসা হল। তিনি পকেট থেকে চশমা বার করে পরলেন ; তারপর কিছুক্ষণ বন্দীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আরে, তুমিই তো নানাসাহেব!” ব্যাপারটা খুব নাটকীয়। পরে আপ্টেই বলেছিলেন, লোকটি নানাসাহেব হতে পারেন না। তাঁর বুঝবার ভুল হয়েছিল।

এ-গল্পের এখানেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এর পরেও আর একটি ছোট কাহিনী আছে। ল্যানডন নামে এক সাহেব সিপাহি-বিদ্রোহের পঞ্চাশ বছর পরে নেপালের একটি ইতিহাস লেখেন। নেপাল সরকার তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ে একটি উপসংহার আছে। সেটি বলে এ-কাহিনী শেষ করব। ল্যানডন লিখছেন, রাজকোট থেকে মাইল-ত্রিশ দূরে একটি ছোট শহরে এক ভিখিরি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার বেশ বয়স হয়েছে। গায়ের পোশাক জীর্ণ। বিড়বিড় করে বলছে, “আমি নানাসাহেব। নেপালের জঙ্গবাহাদুর আমার সব কেড়ে নিয়েছে। এর বিচার চাই।” তার পিছনে একদল ছেলে। কেউ কেউ চলতে চলতে তার গায়ে ঢিল ছুঁড়ছে। আরও নানা রকমে তাকে উত্ত্যক্ত করছে। এই অবস্থা দেখে একজন পুলিশের দয়া হল। ছেলেদের অত্যাচার আরও বাড়তে পারে এই মনে করে তাকে রাত্তিরের মতো গারখানায় রেখে দেওয়া হল। রাত্রে ভিখিরিটির খুব জ্বর এল। জ্বরের মধ্যে সে বলতে থাকে, “আমি নানাসাহেব, বিঠুরের নানাসাহেব।” ১৮৫৭-৫৮ সালে যেসব ঘটনা সিপাহি-যুদ্ধের সময় হয়েছিল, তার টুকরো টুকরো বিবরণ সে জ্বরের ঝোঁকে বলতে লাগল। এই যদি সত্যি নানাসাহেব হয়, এই কথা ভেবে প্রহরীরা তাদের উপরওলাকে ডেকে নিয়ে এল। উপরওলা একজন অল্পবয়সের ইংরেজ। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভিখিরির কথাবার্তা শুনতে লাগলেন। শুনে বিশ্বাস হল, এতদিন পরে সত্যিকারের নানাসাহেব ধরা পড়লেন। কলকাতায় ভারত সরকারের কাছে টেলিগ্রাম করা হল। কর্মচারীটির মনে অনেক আশা: পুরস্কার খ্যাতি চাকরির উন্নতি। কলকাতায় পাঠানো টেলিগ্রামে ছিল, “নানাসাহেবকে গ্রেপ্তার করেছি, এখন কী করব?” পরদিন টেলিগ্রামে যে জবাব এল, তাতে তিনি মুষড়ে পড়লেন। জবাবে লেখা, “তাকে ছেড়ে দাও।”

এই হচ্ছে নানাসাহেব সম্বন্ধে বোধহয় শেষ কাহিনী। সরকার অনেকদিন থেকেই নানাসাহেবের গ্রেপ্তারের ভুল খবরে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। নানাসাহেব সম্বন্ধে অনেক ভুল খবর পেতে পেতে এক উঁচুতলার কর্মচারী বলেছিলেন, “ইচ্ছা হয় নানাসাহেবের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে এদেশ থেকে চলে যাই!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *