১৫. শেষ পেশোয়ার অন্তিম

শেষ পেশোয়ার অন্তিম

১৮১৮ সালে লর্ড হেস্টিংস যখন বড়লাট তখন দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের পেশোয়াই শেষ হয়ে গিয়েছিল। মারাঠা যুদ্ধে হেরে গিয়ে তিনি স্যার জন ম্যালকমের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।

স্যার জন ম্যালকম তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপরের মহলে বিশ্বস্ত কর্মচারী। তিনি সরকারি দূত হয়ে দু’বার পারস্য দেশে গিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলিটিক্যাল এজেন্ট ছিলেন। ইতিহাসের দুটি বই লিখেছিলেন, একটি পারস্যের ইতিহাস, আর একটি ভারতবর্ষের ইতিহাস। দুটি বই-ই বিখ্যাত।

পেশোয়ার সঙ্গে কোম্পানির শর্ত হয়েছিল যে, তিনি আর দাক্ষিণাত্যে ফিরতে পারবেন না, উত্তর ভারতবর্ষে কোনো জায়গায় বসবাস করতে হবে। কোথায় থাকবেন এই প্রশ্ন নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলেছিল। একবার কথা হয়েছিল যে, তিনি বারাণসী কিংবা মথুরায় থাকতে পারেন। বাজীরাও রাজি হলেন না। তিনি বললেন, তীর্থস্থানে থাকলে তাঁকে দিনে দু’তিন বার স্নান করতে হবে। তাঁর যা শরীর, তাতে এতবার স্নান করে তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না।

শেষ পর্যন্ত বিঠুরে গিয়ে তিনি বাস করবেন ঠিক হল। বিঠুর কানপুর থেকে মাইল দশেক দূরে। সেখানে থাকবার জন্য তাঁকে একটি জায়গির দেওয়া হল। তাঁর সঙ্গে অনেক লোকজন এসেছিল। বাজীরাওয়ের ভাতা কী হবে? এই নিয়ে বহু আলোচনা করে ঠিক হল: বার্ষিক আট লক্ষ টাকা।

কেউ কেউ বললেন, এ তো অনেক টাকা। এত টাকা দেবার কোনো মানে হয় না। স্যার জন ম্যালকম বললেন, তা হোক, হাজার হলেও এক সময়কার পেশোয়া তো। আর তা ছাড়া আট লক্ষ টাকা শুনতে বেশি বটে, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে এমন কিছু বেশি নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ-টাকা দেওয়াই উচিত। তাঁর যা শরীরের অবস্থা, কদিনই বা বাঁচবেন। বাজীরাও তাঁর বন্ধুবান্ধব, অনুচরদের নিয়ে বিঠুরে এসে বাসা বাঁধলেন। বিঠুরের পুরনো নাম ‘ব্রহ্মাবর্ত’। পণ্ডিতরা বলতেন যে, বিঠুরের সামনে গঙ্গানদী হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। এ-কথা ভাল করে বোঝবার জন্য বিঠুরের ঘাটের কাছে জলের মধ্যে একটি জায়গা লোহার তার দিয়ে ঘেরা আছে। পেশোয়া এবার নদীতে স্নানে তাঁর আপত্তির কথা তোলেননি। পেশোয়ার সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাঁর পুরনো দেওয়ান রামচন্দ্র পন্ত। তিনি নিজেই প্রভুর সঙ্গে নির্বাসন নিয়েছিলেন।

নতুন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পেশোয়ার খুব অসুবিধা হয়নি। উচ্চ আকাঙক্ষাও তাঁর আর ছিল না। দান-ধ্যান করে তাঁর সময় কাটত। চারদিকের ব্রাহ্মণরা জানতেন যে, তিনি পেশোয়া না-থাকলেও তাঁর টাকাপয়সার অভাব নেই। ইচ্ছা করলেই অনেক টাকা দান করতে পারেন। ইংরেজরাও হয়তো চেয়েছিলেন যে, এই সব নিয়ে পেশোয়া তাঁর আগের জীবন ভুলে থাকতে পারবেন। ব্রাহ্মণদের অনেক টাকা দিতেন। নানারকম ধর্মীয় আচার পালন করতেন। কিন্তু তাই বলে তাঁকে পুণ্যবান মনে করা ঠিক হবে না। আসলে বাইরের ধর্মাচরণে ত্রুটি না-থাকলেও তাঁর নিজের চরিত্রে অনেক দোষ ছিল। তাঁর ধর্মীয় আচরণ কী রকম ছিল সে সম্বন্ধে একটি গল্প বলি। পেশোয়ার বৃত্তির টাকা কানপুর থেকে আসত মিছিল করে। পেশোয়ার একটি সুন্দর পালকি ছিল, মখমল কিংখাব এই সব দিয়ে ভিতরটা সাজানো। টাকা আনবার সময় এই পালকি ব্যবহার করা হত। একবার টাকা ভর্তি এই পালকি একজন ছুঁয়ে দিয়েছিল। বাজীরাও বললেন যদি নিচু হাতের ছোঁয়া লেগে থাকে তাহলে পালকি তো অপবিত্র হয়েছে। দোষ স্খলনের জন্য টাকাসুদ্ধ পালকিটিকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে রাখা হল। তারপর যখন উপরে তোলা হল, দেখা গেল পালকির সাজসজ্জা সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তখনকার টাকা তো রুপোর, কাজেই টাকার কিছু হয়নি। শুধু গঙ্গাজলে কিছুক্ষণ ডুবে থেকে পবিত্র হয়ে গিয়েছে।

পুজোআর্চা, দান-ধ্যান ছাড়া বাজীরাওয়ের আর কোনো কাজ ছিল না। নিরবচ্ছিন্ন আলস্য ও আরামে শরীর ভাল থাকে না। কিন্তু বাজীরাও এইভাবে থাকতেই ভালবাসতেন। পূর্বে দশহরার ঠিক পরে মারাঠি সৈন্যরা যুদ্ধ করতে বের হতেন। তখন বৃষ্টি থেমেছে, অশ্বারোহীর পথে অসুবিধা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ছত্রপতি শিবাজির সময় থেকে এই রীতি চলে আসছিল। এখনও যাঁরা ঐতিহ্য মেনে চলতে চান, তাঁরা দশহরার দিন বিকালে গ্রামের বাইরে হেঁটে যান। পুনের কাছে দেখেছি একরকম ছোট গাছ আছে, সেই গাছের পাতা ছিঁড়ে আনতে হয়। তার অর্থ: শত্রুর দেশ থেকে সোনা জয় করে আনা হল। বাজীরাও আস্তে-আস্তে এই প্রথাও ছেড়ে দিলেন। এমনকি, ঘোড়াও চড়তেন না। কোথাও যেতে হলে পালকি ব্যবহার করতেন।

বাজীরাওয়ের শরীর যখন ভেঙে পড়ছে, তখন কমিশনারের হুকুমে তাঁর জিনিসপত্রের একটা ফর্দ করা হল। ঠিক হল, পেশোয়ার মৃত্যু হবার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর প্রাসাদের যে-অংশে ধনরত্ন রাখা হয়, সেই অংশ বন্ধ করে রাখতে হবে, সেই সঙ্গে কড়া পাহারার ব্যবস্থা। তাঁর সম্পত্তি মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের বিতরণ করা হবে। এ তাঁর নিজের সম্পত্তি।

পরের বছর বাজীরাওয়ের পক্ষাঘাতের আক্রমণ হল, কিন্তু ক্রমে তিনি অনেকটা সেরে উঠলেন। ছ’বছর পরে, ১৮৪৭ সালে কমিশনার সরকারকে জানালেন, বাজীরাওয়ের বয়স এখন ৭৩ বছর পূর্ণ, খুব দুর্বল, দৃষ্টিশক্তি গিয়েছে। তবু আরও প্রায় চার বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কানপুর থেকে দু’জন ইংরেজ ডাক্তার তাঁকে দেখতে এলেন। তাঁরা পরীক্ষা করে বললেন, বাজীরাওয়ের অবস্থা খুব খারাপ। তবে ঠিকমতো চিকিৎসায় তিনি এবারও বেঁচে যেতে পারেন। সেই রাত্রে মনে হল বাজীরাওয়ের অন্তিম সময় উপস্থিত। কানপুর থেকে কমিশনার এলেন। তাঁর মনে হয়েছিল তখনই বিপদের আশঙ্কা নেই। তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি। পরদিন ২৮ জানুয়ারি সকালে বাজীরাও শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায় শেষ হয়ে গেল।

বিঠুরে শেষ পেশোয়ার জন্য যে ব্যবস্থা ছিল, তাড়াতাড়ি তা গুটিয়ে ফেলা হল। অল্পদিন পরেই বিঠুর খালি হতে আরম্ভ করল। বাজীরাওয়ের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তাই দুই দত্তকপুত্র নিয়েছিলেন: ধন্দুপন্ত নানাসাহেব ও দাদাসাহেব। নানাসাহেব আশা করেছিলেন, তাঁকে সরকার কিছু ভাতা দিতে পারেন। সে-আশা সফল হয়নি।

পেশোয়াকে যখন ভাতা দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তখন সবাই ভেবেছিলেন তিনি বেশি দিন বাঁচবেন না। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তিনি আরও ৩৫ বছর বেঁচেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা ভাবতে শুরু করলেন, এত বেশি টাকা বৃত্তি দেওয়াই ভুল হয়েছিল। কিন্তু কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন, তিনি যে এতদিন বেঁচে আছেন সেও যেন স্যার জন ম্যালকমের দোষ। তাঁর কথাতেই এত টাকা দিতে হল। অনেকদিন না-বাঁচলে কোম্পানির এত টাকা খরচ হত না। বাজীরাওয়ের খবরদারি করবার জন্য কমিশনার-পদের সৃষ্টি করা হয়েছিল। প্রথম কমিশনার ছিলেন স্যার জন লো। মারাঠা যুদ্ধের সময় বাজীরাওয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। প্রথম কমিশনারের কাজ কঠিন ছিল। কিন্তু অনেকটা তাঁর জন্যই বাজীরাওয়ের বন্দীদশা মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়েছিল।

স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, এই কারণে স্যার জন লো ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। প্রথমে গিয়েছিলেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে, যেখানে কিছুকাল আগে নেপোলিয়নকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেখানে যিনি নেপোলিয়নের খবরদারি করতেন, তাঁর নামও ছিল লো। স্যার হাডসন লো। তাঁকে নেপোলিয়ন একদম পছন্দ করতেন না। তিনি এলেই তাঁকে বলে পাঠানো হত, “এখন দেখা হবে না, সম্রাট স্নানের ঘরে আছেন।” জন লো’র সঙ্গে পেশোয়ার সম্পর্ক অবশ্য সে-রকম ছিল না।

জন লো ছুটি থেকে ফিরে এসে জয়পুরে রেসিডেন্ট হয়ে বদলি হয়ে গেলেন। পরে আরও দুজন কমিশনার আসেন। তারও পরে জেমস ম্যানসন বিঠুরের কাজের ভার নেন। বাজীরাওয়ের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বিঠুরের কমিশনার ছিলেন। ম্যানসনের মনে হয়েছিল, বাজীরাওয়ের দিন ফুরিয়ে এসেছে। বাজীরাওয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর দত্তকপুত্র বৃত্তির জন্য আবেদন করেন, কিন্তু তা অগ্রাহ্য হয়। ভাবখানা এই যে, অনেক দেওয়া হয়েছে, আর নয়। তবে বিঠুরের জায়গিরে নানাসাহেবকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁর প্রাসাদের শুধু ধ্বংসাবশেষই এখন আছে। সিপাহি-যুদ্ধের সময় বিঠুরে ইংরেজ সৈন্যর সঙ্গে নানাসাহেবের যুদ্ধ হয়েছিল। ইংরেজ সৈন্যরা কামানের গোলায় বাজীরাওয়ের প্রাসাদ চূর্ণ করে দেয়।

কুড়ি-একুশ বছর আগে বিঠুরে গিয়ে দেখেছি, অনেকটা জায়গায় ভাঙা ইঁটের স্তূপ। সেখানে কিছু কিছু জায়গায় চাষ হচ্ছে, বাকিটা জঙ্গল। এইরকম জায়গা সাপের খুব প্রিয়। সাপের জন্য গ্রামের লোক সেখানে ঢুকতে সাহস পায় না। একটু দূরে রামচন্দ্র পন্তের বাড়ি। গ্রামের লোকেরা বলেছিল, বাড়িটা ভূতুড়ে। আমি দেখলুম, বাড়ি তখন মেরামত হচ্ছে। সেখানে স্কুল বসবে। নদীর ধারে একসারি শিবমন্দির। দেখলে বাংলাদেশের মন্দির বলে মনে হয়। বাজীরাও কোথা থেকে লোক নিয়ে গিয়ে মন্দির বানিয়েছিলেন, জানি না। সব মন্দির পরিত্যক্ত। পূজা হয় না কোথাও, আলো জ্বলে না। গ্রাম থেকে দু’একজন লোক আমার সঙ্গে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, একটি মন্দিরেই শুধু পূজা হত। মন্দিরের পুরোহিত একটি সাপ পুষেছিল। তাকে দুধ খাওয়াত। একদিন সন্ধ্যায় সে দুধ খাওয়াতে এসে সাপকে দেখতে পায়নি, ভুল করে সাপের গায়ে পা লেগে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ সাপ তাকে কামড়ে দিল। বাঁচানো গেল না।

এই বলে লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাহেব, তুমি কিন্তু কখনও সাপ পুষো না। যতই পোষ মানুক না কেন, একদিন না একদিন সে তোমাকে কাটবেই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *