০৬. টোপিওয়ালা ও একটি খুনের গল্প

টোপিওয়ালা ও একটি খুনের গল্প

পুনা শহরে খুব শীত পড়ে না। কিন্তু যে কয়েক মাস শীত থাকে, সে-সময় খুব আরামের। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজীরাও কাঁধের উপর একটা শাল রেখে রোদ্দুর পোহাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ভাল ছিল না। পানের বাটা থেকে একটা আস্ত পান ও কয়েক টুকরো সুপুরি তুলে নিলেন। অপ্রসন্ন মুখে মন্ত্রী সদাশিব মানকেশ্বরকে বললেন, “টোপিওয়ালাদের কাণ্ড দেখলে? আবার গায়কোয়াড়ের হিসেব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেছে।”

সদাশিব মানকেশ্বর বললেন, “হুজুর, আংরেজদের কথা আর বলবেন না। এই হিসেবপত্তরের কাজ দশ বছর ধরে বেশ ঢিমেতালে চলছিল। তাতে কি কারুর কোনো ক্ষতি হয়েছে? আজ তড়িঘড়ি হিসেব মেলাতে হবে, এ কি সহজ!”

বাজীরাও একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। গলা দিয়ে একটা শব্দ বার করলেন; মনে হল তাঁর মেজাজ আরও খারাপ হয়েছে। তিনি বললেন, “একটা জিনিস দেখেছ সদাশিব? সেই নচ্ছার গঙ্গাধর শাস্ত্রীকে নাকি আবার গায়কোয়াড় এখানে পাঠাচ্ছে!”

সদাশিব হয়তো ভাবছিলেন, সে-সব দিন আর নেই। এখন আংরেজরা যা বলে তাই হয়। কিন্তু প্রভুর মেজাজ বুঝে কথাটা আর তুললেন না। বাজীরাও পানের বাটা আবার কাছে টেনে নিলেন।

নামে দ্বিতীয় বাজীরাও বটে, কিন্তু প্রথম বাজীরাওয়ের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের বিন্দুমাত্র মিল নেই। প্রথম বাজীরাও যেমন সাহসী ছিলেন, তেমনি ভবিষ্যৎ-দর্শী। তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় বাজীরাওয়ের তুলনা হয় না। ১৮০২ সালে ইংরেজের সঙ্গে এক সন্ধির ফলে, পেশোয়া আর ইচ্ছেমতো সৈন্যসামন্ত রাখতে পারেন না। অন্য মারাঠা রাজ্যের উপরেও প্রতিপত্তি কমে গিয়েছে। বাজীরাও বললেন বটে যে, তিনি গঙ্গাধর শাস্ত্রীর মুখদর্শন করবেন না, কিন্তু অল্প কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারলেন, রাগ দেখিয়ে লাভ নেই, পুরনো দিন আর ফিরে আসবে না। ঢিমিয়ে-টিমিয়ে আবার হিসেবপত্তরের আলোচনা চলতে লাগল। বাজীরাওয়ের মেজাজ খারাপ হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। গঙ্গাধর শাস্ত্রী অন্য মহারাষ্ট্রীয়দের মতো ছিলেন না। ধীরস্থির ভাবে কথা বলা বা চলাফেরা করার অভ্যাস তাঁর ছিল না। তড়বড় করে কথা বলতেন, তাড়াতাড়ি হাঁটতেন, দু’একটি ইংরেজি গালিগালাজও জানতেন। পেশোয়ার নাম উঠলেই বলতেন ‘সেই ড্যাম্ রাস্‌কেল’। এ অবস্থায় কাজ বেশিদূর এগোবার কথা নয়।

হিসেবও অনেক টাকার। ১৮০৬ সালে পেশোয়া বলেছিলেন, তিনি গায়কোয়াড়ের কাছ থেকে পাবেন দু’কোটি আটাত্তর লাখ ষাট হাজার টাকার বেশি। এ ছাড়াও অন্যান্য নানা খাতে আরও পঞ্চাশ লাখ টাকা। পুরনো ধারের নিয়মই হচ্ছে, যত দিন যায় টাকার অঙ্কও ততই বেড়ে চলে। পাঁচ বছর বাদ ১৮১১ সালে পেশোয়া বললেন এই দাবির প্রথম কিস্তি বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ছিয়াশি লাখ ছিয়াত্তর হাজার টাকার বেশি। তাছাড়া অন্যান্য খাতের দাবিও সেইরকম বেড়েছে। গায়কোয়াড়ও কম যান না। বললেন, পেশোয়ার কাছে তাঁরও অনেক টাকা পাওনা। কয়েক মাস এইভাবে গেল। ভবিষ্যতে যে মিটমাট হবে সে আশা কম। ইংরেজরা বলে পাঠালেন, আর আলোচনা চালিয়ে দরকার নেই, যথেষ্ট হয়েছে। কি হঠাৎ মনে হল, চাকা যেন অন্যদিকে ঘুরছে। পেশোয়া যেন অনেকটা নরম হয়েছেন। গঙ্গাধর শাস্ত্রীকে তো তিনি দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। গুজব উঠল, তিনি নাকি তাঁর শালীর সঙ্গে গঙ্গাধর শাস্ত্রীর ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করছেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! যাই হোক, বাজীরাও গঙ্গাধর শাস্ত্রীকে সঙ্গে করে নাসিকে তীর্থ করতে গেলেন। সেখান থেকে আবার পন্ঢারপুরে। পন্ঢারপুর তখনকার দিনের একটি বিখ্যাত তীর্থস্থান।

পন্ঢারপুরে যে-কয়দিন ছিলেন, গঙ্গাধর শাস্ত্রী প্রতি সন্ধ্যায় বিঠোবার মন্দিরে আরতি দেখতে যেতেন। বিঠোবাকে আমরা বলি বিষ্ণু। একদিন, ২০শে জুলাই, সন্ধ্যায় গঙ্গাধর শাস্ত্রী বললেন যে, তাঁর মন্দিরে যাবার ইচ্ছে নেই। শরীর ভাল নেই। পীড়াপীড়িতে অবশ্য শেষপর্যন্ত তিনি যেতে রাজী হলেন।

তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গঙ্গাধর শাস্ত্রীর একজন অনুচর শুনতে পেল কে একজন বলছে, “গঙ্গাধর শাস্ত্রী কোন্‌ লোকটি?” তার সঙ্গী উত্তর দিল, “ঐ যে, দেখছে না, গলায় সোনার হার রয়েছে।” নামকরা বিদেশী অন্য শহরে এলে এরকম জিজ্ঞাসাবাদ হয়েই থাকে। মন্দিরে আরতি শেষ হয়ে গেল। পেশোয়ার সহচর ত্র্যম্বকজি ডাংলে তখন মন্দিরে ছিলেন। গঙ্গাধর শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দু’ একটি কথা হল। শাস্ত্রী তার পর বাড়ির দিকে ফিরলেন।

পথে কী হল বলছি। মন্দির থেকে তাঁরা কয়েক পা এগিয়েছেন, এমন সময় হঠাৎ তিনজন লোক গঙ্গাধর শাস্ত্রীর পিছন থেকে তাঁর প্রায় গা ঘেঁষে দৌড়ে চলে গেল। প্রথমে মনে হল, তাদের ডান হাতে একটি করে চাদর ঝুলছে। মিনিটখানেক পরে বোঝা গেল যে শুধু কাপড় নয়, কাপড়ের তলায় ঢাকা তলোয়ার। প্রথমে যে লোকটি ছিল, সে তলোয়ার দিয়ে গঙ্গাধর শাস্ত্রীকে আঘাত করল। গঙ্গাধর শাস্ত্রী তখনও দাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করছিলেন। দ্বিতীয় লোকটি তাঁর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তৃতীয় লোকটি তলোয়ার দিয়ে মাথায় কোপ মারল। গঙ্গাধর শাস্ত্রীর জীবন শেষ হয়ে গেল। সঙ্গে কয়েকজন সৈন্যসামন্ত বরকন্দাজ ছিল। তাদের চোখের সামনে খুন হয়ে গেল।

হত্যা করা পাপ। সেই যুগে ব্রহ্মহত্যার মতো পাপ আর কিছু ছিল না। তা ছাড়া, যাঁকে খুন করা হল, তিনি তো সাধারণ লোক ছিলেন না। গায়কোয়াড়ের দূত। তাঁর মৃত্যুতে যে শোরগোল উঠবে, সে তো জানা কথা। তখন প্রতি মারাঠা রাজ্যে একজন করে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী থাকবার নিয়ম ছিল। পুনায় যিনি ছিলেন, তাঁর নাম মাউণ্টস্টুয়ার্ট এলফিন্‌স্টোন। তিনি কাজকর্মে সুদক্ষ বলে নাম ছিল। তা ছাড়া তিনি পণ্ডিত লোকও ছিলেন। এলফিন্‌স্টোনের দৃঢ় বিশ্বাস হল, এ্যম্বকজি ডাংলেই প্রধানত হত্যার জন্য দায়ী। পেশোয়াকে বলে পাঠালেন, ত্র্যম্বকজিকে এখনই বন্দী করা হোক। পেশোয়া অনেক ওজর-আপত্তি করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গভর্নর-জেনারেল লর্ড হেস্টিংসের ভাবগতিক দেখে বেশিদূর যেতে সাহস করলেন না। বড়োদা রাজ্যে গোবিন্দরাও বন্ধুজি ও ভগবন্ত রাওকে গ্রেপ্তার করা হল। সেই সঙ্গে ত্র্যম্বকজিকেও বন্দী করে বোম্বাইয়ের কাছে থানা কেল্লায় রাখা হল। সেখানে তাঁকে অবশ্য বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। ইংরেজরা ভেবেছিলেন, থানা কেল্লায় সৈন্যদের মধ্যে একজনও মহারাষ্ট্রীয় প্রহরী থাকবে না, তাহলে ষড়যন্ত্র হতে পারে। কিন্তু সৈন্যরা সবাই ইংরেজ। তারা মারাঠি ভাষা একেবারে বুঝত না। বিপদ সেই দিক থেকেই এল। প্রতিদিন দুপুরে শোনা যেত দুর্গের বাইরে একজন ঘেসেড়া মারাঠি গান গাইছে। সেটি আসলে পালাবার সঙ্কেত। কিন্তু একমাত্র ত্র্যম্বকজি তার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন। কয়েক বছর পরে ১৮১৯ সালে যখন পেশোয়া-রাজত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন একজন পাদরি, বিশপ হিবার, দাক্ষিণাত্যে ঘুরতে ঘুরতে এই গানটির হদিস পেয়েছিলেন। গানটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে গিয়েছেন। আসল মারাঠি গানটি এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হিবারের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা অনুবাদ করে দিয়েছেন ‘পাক্ষিক আনন্দমেলা’র সম্পাদক-মশাই। সেটি এইরকম:

ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে

তীরন্দাজ,

ঘোড়াগুলি আছে বৃক্ষতলে।

কোথা পাব আমি সেই বীর, বিনা

বাক্যে আজ

সঙ্গী হবে যে এ-জঙ্গলে?

যুদ্ধের ঘোড়া পঞ্চান্নটি

তৈরি এই,

যোদ্ধা কিন্তু চুয়ান্নের

বেশি নেই, বাদবাকিটি এখানে

এসে গেলেই

দাক্ষিণাত্য জাগবে ফের।

এ্যম্বকজি সেই পঞ্চান্নতম যোদ্ধা। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। সমুদ্রের খাঁড়ি পার হলেই তো পেশোয়া রাজ্য। ত্র্যম্বকজি কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিহারের চুনার দুর্গে নিয়ে যাওয়া হল। ভগবন্ত রাও, গোবিন্দরাও বন্ধুজি ও বড়োদার দেওয়ান সীতারামকেও অন্যত্র বন্দী করে রাখা হয়েছিল। চুনারে ত্র্যম্বকজি আরও পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। হিবার সাহেবও চুনারে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। গারদের ওদিকে ত্র্যম্বকজি; সপ্রতিভ চেহারা, ভেঙে পড়েননি, গায়ে ময়লা পোশাক। এই কি গঙ্গাধর শাস্ত্রীর হত্যাকারী? না হত্যার সূত্র খুঁজতে অন্যত্র, গায়কোয়াড়ের রাজ্যে, যেতে হবে? ভগবন্ত রাও, গোবিন্দরাও বন্ধুজি, না দেওয়ান সীতারাম? কে হত্যাকারী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *