বাজনা – ২

উঠোন কী আর একটুখানি যে এক কোণে বসে বসে কাজ হবে! এদিকে উঠোন, ওদিক উঠোন, মস্ত উঠোন। উঠোন ভরতি ধান বিছানো। ঘুঘুগুলোর তো মজা! দেখেছে বুড়ি নেই, একটা পুঁচকে ছেলের হাতে লাঠি। তাই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উঠোনে নেমে ধান খুঁটতে শুরু করে দিলে। বাজনাও লাঠি নিয়ে তেড়ে যায়। গেলে কী হবে! পাখিগুলোও উঠোনের আর একদিকে উড়ে যায়! আবার যেই বাজনা ওদিকে যায়, পাখিগুলোও এদিকে উড়ে আসে। আচ্ছা ফাঁসাদ তো! বাজনা খানিকটা হেঁটে, খানিকটা নেচে ঘুঘুর পেছনে লেগে রইল।

কতক্ষণ আর লাগবে! মানুষের শরীর তো! এতখানি পথ এসেছে হাঁটতে হাঁটতে। ক্লান্ত তো হবেই। তাই বাজনা বললে, ‘টাট্টু, টাট্টু, পা ব্যথা করছে।’

টাট্টু বললে, ‘পায়ের আর দোষ কী!’

বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘কী করি?”

‘বসে পড়। বসে বসে লাঠি ঠোক।’

 বাজনা বললে, ‘সেই ভালো। বসে বসেই লাঠি ঠুকি। পাখি তাড়াই।’ বলে দাওয়ায় বসে পড়ল।

বসতে হল না বেশিক্ষণ। ছুটোছুটি করছিল সে তবু ছিল ভালো। যেই বসেছে, অমনি হাই উঠতে লাগল বাজনার। চুল লাগছে। চোখ জুড়িয়ে ঘুম আসছে। থাকতে পারল না। বাজনা দাওয়ার খুঁটিতে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কাঠের টাট্টু হাত থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ল। টাট্টু চেঁচিয়ে উঠল। শুনতেই পেল না বাজনা।

ঘরের ভেতর দোর ভেজিয়ে বুড়ি ঘুমুচ্ছে নাক ডাকিয়ে। আর দাওয়ায় বসে, খুঁটিতে হেলান দিয়ে বাজনা ঘুমুচ্ছে চোখ বুজিয়ে!

আর বলতে! তাই না দেখে শয়ে শয়ে ঘুঘু উঠোনে নেমে এল। ধান খুঁটতে আরম্ভ করে দিলে

অর্ধেক ধান যখন পাখির পেটে, তখন বুড়ির ঘুম ভেঙেছে। ঘরের দোর ঠেলে বাইরে বেরিয়েছে। বেরিয়েই বুড়ির চক্ষু ছানাবড়া! একেবারে চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল বুড়ি, ‘ওরে আমার সববনাশ হয়ে গেল রে, সববনাশ হয়ে গেল!’

চেঁচামেচিতে চমকে উঠেছে বাজনা। আর ঘুম! চোখ চেয়েই বাজনা থ। ‘এই যাঃ!’ বলে লাফিয়ে উঠল। ‘হুস-হাস’ করে তেড়ে গেল পাখিগুলোর দিকে। অগুনতি পাখি তাড়া খেয়ে আকাশে ওড়া দিল। উড়তে উড়তে পগারপার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রাইল বাজনা আকাশের দিকে।

চেয়ে থাকবে কী! বুড়ি চিলের মতো চেঁচাতে-চেঁচাতেই তেড়ে এল বাজনার দিকে। বাজনা ধাঁ করে টাট্টুকে মাটি থেকে তুলে নিল। চটপট টাট্টুর দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘সববনাশ! কী হবে?’

টাট্টু বললে, ‘পালাও।’

বাজনাও চক্ষের নিমেষে ভোঁ-কাট্টা!

বুড়ি তো আর ছুটতে পারে না। তাই ধরতেও পারল না। ওইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাত পা ছুঁড়তে লাগল। চেঁচাতে লাগল।

বাজনা আর পেছন ফিরে দেখে! রামোচন্দর! ছুট-ছুট-ছুট।

তারপর?

বুড়ির বাড়ি যখন আর দেখা গেল না, বুড়ির গলাও আর শোনা গেল না, তখন বাজনা রাস্তা ছাড়িয়ে মাঠে পড়ল।

মাঠে ছাগল চরছে।

টাট্টা ডাকলে, ‘বাজনা, বাজনা, থেমে পড়।’

বাজনা ছুটতে-ছুটতেই জিজ্ঞেস করলে, ‘কেন?’

টাট্টু বললে, ‘আর ভয় নেই।’

বাজনা দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁপাচ্ছে। বললে, ‘বাবা! বাঁচা গেল! আরেকটু হলেই বুড়ির লাঠি পিঠে পড়ত। কিন্তু ঘুমেরও কী সময়-অসময় নেই? এমন বেআক্কেলে! সব মাটি! বদ্যির বাড়ি কোনদিকে এখন কে বলে দেবে! ছিঃ! ছিঃ!’ |

টাট্টু বললে, ‘বাজনা, দেখো, দেখো।’

বাজনা বললে, ‘কী? কী?’

টাট্টু বললে, ‘মাঠে কী দেখছ?’

বাজনা বললে, ‘ছাগল দেখছি একপাল।’

 ‘আর কী দেখছ?

 ‘লাঠি হাতে বুড়ো দেখছি। তোবড়া গাল।’

‘ওকে জিজ্ঞেস কর।’

 ‘জিজ্ঞেস করব? কিছু আবার বলবে না তো!’

‘কী বলবে?’

‘তবে জিজ্ঞেস করি। বলে বাজনা বুড়োর কাছে এগিয়ে গেল। একটু দূরে দাঁড়ানোই ভাল। হাতে আবার লাঠি। সকলের মতিগতি তো সব সময়ে বোঝা যায় না! তাই দূর থেকে দাঁড়িয়েই বাজনা ডাকলে, ‘ও বুড়ো, ও বুড়ো।’

বুড়ো বাজনার দিকে চেয়ে ফোকলা দাঁতে হাঁকলে, ‘কী ছেলে?কী ছেলে?’

‘বদ্যির বাড়িটা কোনদিকে গো?

‘হোই দিকে।’

‘একটু দেখিয়ে দেবে?’

‘এখন সময় নেই। এখন কাজের সময়।’

‘কখন সময় হবে?

‘যখন কাজ শেষ হবে।’

‘কখন কাজ শেষ হবে?’

‘যখন সময় হবে।’

বাজনা বুড়োর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মনটা কেমন চুপসে গেল। বলল, ‘বাবা, এ যে বড়ো গোলমেলে ব্যাপার!’

বুড়ো ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘গোলমেলেই তো!’

তবু বাজনা হাল ছাড়ল না। জিজ্ঞেস করলে, ‘কাজ শেষ হলে দেখিয়ে দেবে তো?’ বুড়ো দপ করে রেগে উঠেছে। বললে, ‘বদ্যির বাড়ি কী হেথা, যে গেলুম আর এলুম! ও বাছা আমি পারব না। বুড়ো মানুষ, কাজ সেরে ঘরে যাব। ঘরে শুয়ে তামুক খাব। শরীরটাকে জিরন দেব। সারাদিন খাটলে কষ্ট হয় না?

বাজনা তবু ছাড়বার পাত্র নয়। বললে, ‘ও বুড়ো, ও বুড়োনা, না, তোমায় কষ্ট দেব না। তার চেয়ে এক কাজ কর না?’

বুড়ো জিজ্ঞেস করলে, ‘কী কাজ?’

বাজনা এগিয়ে গেল বুড়োর কাছে। বললে, ‘ওই গাছের নীচে ছায়া দেখছ?

বুড়ো বললে, ‘ছায়া দেখছি।’

‘ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া পাচ্ছ?’ বুড়ো বলল, ‘হাওয়া পাচ্ছি।’

‘ঠান্ডা-ঠান্ডা হাওয়ায়, ওই গাছের নীচে ছায়ায় তুমি শুয়ে পড়ো। শুয়ে শুয়ে তামুক খাও। আমি বরঞ্চ তোমার ছাগল চরাই।’

বাজনার কথা শুনে বুড়োর অমন দপ করে জ্বলে ওঠা রাগটা যেন ফস করে নিভে গেল। বুড়োর মুখে হাসি ফুটল। ভাবল ছেলেটা ভালো। বলল, ‘তুই কি পারবি?

বাজনা ঘাড় নাড়লে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব পারব।’

‘শেয়াল আছে এদিক-ওদিক। ছাগল নিয়ে পালায় যদি!

‘শেয়াল আছে তো বয়ে গেছে। আমার হাতে লাঠি আছে।’ বলে বুড়োর হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল বাজনা।

 খুশি মনে বুড়ো জিজ্ঞেস করলে, ‘ঠিক পারবি তো?’

‘হুঁ, হুঁ, খুব পারব,’ বলে বাজনা এতখানি ঘাড় বেঁকাল।

 ‘তবে আমি একটু গড়িয়ে নিই।’ বুড়ো গাছের নীচে শুতে গেল। বললে, ‘বেলা পড়লে, ঘুম ভাঙলে বদ্যির বাড়ি পৌঁছে দেবখন।’

বাজনার মুখখানি হাসি-হাসি।

বুড়ো গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল।

বাজনা লাঠি নিয়ে মাঠে নামল।

বুড়ো তামুক খেয়ে একটু পরে নাক ডাকাল।

বাজনা চুপিসাড়ে ঘোড়ার মুখের দিকে তাকাল।

টাট্টু জিজ্ঞেস করলে, ‘কী?’

বাজনা মুখটা কাঁচুমাচু করে বললে, ‘খিদে।’

টাট্টু বললে, ‘ওই তো গাছ। দেখছ না ফল!’

বাজনা বলল, ‘কই?’ এগিয়ে গেল গাছটার দিকে। গাছের দিকে তাকিয়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল বাজনা। চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ-তো-রে! ও টাট্টু, ও টাট্টু, আম।’

টাট্টু বলল, ‘তাই নাকি! উঠে পড় গাছে।’

‘কেউ বকবে না তো!’

‘কাছে-পিঠে তো কাউকে দেখছি না।’

‘তবে উঠে পড়ি’, বলে বাজনা একবার পেছন ফিরে দেখে নিলে। না, ছাগলগুলো ঘাস চিবুচ্ছে। বুড়োটাও ঘুম দিচ্ছে। টাট্টুর দিকে চেয়ে বলল, ‘তোমায় নিয়ে গাছে উঠি কেমন করে?’

টাট্টু বললে, ‘আমি নীচে থাকি।’

‘সেই ভালো।’ বলে বাজনা টাট্টুকে গাছের নীচে রাখলে। রেখে চটপট গাছে উঠে পড়ল।

উরি বাবা! কত বড়ো বড়ো আম! পেকে টুসটুস করছে। ঝট করে একটা ছিঁড়ে নিল ডাল থেকে। খেতে আরম্ভ করে দিল। কী মিষ্টি!

গাছের ওপর থেকেই চাপা গলায় বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘ও টাট্টু, ও টাট্টু, খুব মিষ্টি! খাবে?’

টাট্টু উত্তর দিলে, আমি খেলনা ঘোড়া। খেতে জানি না।’

‘ও, তাও তো বটে! তবে তুমি বসে বসে দেখো,’ বলে বাজনা এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফ দিলে। মজাসে আম খেতে লাগল।

‘ব্যা-এ্যা-এ্যা-এ্যা।’ হঠাৎ একটা ছাগলছানা মরাকান্না কেঁদে চেঁচিয়ে উঠল যেন!

চমকে ওঠে বাজনা। ছাগলছানা চেঁচায় কেন? গাছের ওপর থেকেই উঁকি মারল বাজনা। ওঃ! যা-বলার ঠিক তাই। একটা শেয়াল! চক্ষুস্থির বাজনার! ছাগলছানার টুটি ধরে শেয়ালটা। ছুটছে। ছানাটা চেঁচাচ্ছে। ধাড়িগুলো পালাচ্ছে। গাছের ওপর থেকেই আচমকা চেঁচিয়ে উঠেছে বাজনা, ‘শেয়াল, শেয়াল।’

আর দেখতে হয়! বুড়োর ঘুম গেছে চমকে। ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠেছে। বাজনাও গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঝট করে টাট্টুকে গাছের নীচ থেকে তুলে নিয়ে শেয়ালের পিছু তাড়া লাগালে। চেঁচালে, ‘শেয়াল, শেয়াল!’

বুড়োও লাফিয়ে উঠে দৌড় মারল। চেঁচিয়ে হাঁকল, ‘আমার ছাগল, আমার ছাগল।’

বাজনা ছোটে। বাজনা চেঁচায়, ‘শেয়াল, শেয়াল।’

শেয়াল ছোটে, বাঁই বাঁই।

বুড়ো ছোটে। বুড়ো চেঁচায়, ‘ছাগল, ছাগল।’

 ছাগল ডাকে, ‘ব্যা-ব্যা।’

 বুড়োটা ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে বসে পড়ল।

 শেয়ালটা ছুটতে ছুটতে টুপ করে লুকিয়ে পড়ল।

ছাগলটা মুখে নিয়ে শেয়ালটা কোথা লুকাল? এ-বাড়িতে? না ও-বাড়িটায়?বাঁ গলিতে? না। ডান-রাস্তায়? ঠিক ঠাওর করতে পারল না বাজনা। বাজনার মনে হল যেন শেয়ালটা। সামনের বাড়িটাতেই টপকেছে। তাই ছুটতে ছুটতে এসে সামনে বাড়ির দরজা ঠেললে বাজনা, ‘কে আছে? দরজা খোল, দরজা খোল। শেয়াল!’

দু-চারবার ঠেলতেই, দু-একবার হাঁকতেই দরজা খুলে গেল।

 একটা লোক দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটা গেঁড়া, চোখটা ট্যারা, মুণ্ডু ন্যাড়া! বাজনাকে দেখে বললে, ‘কী চাই?

বাজনা হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচাল, ‘শেয়াল ঢুকেছে, শেয়াল!’

লোকটা ধমকে উঠল, ‘সে আবার কী? এখানে কেন শেয়াল ঢুকবে?

বাজনা তবু বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা শেয়াল ছাগল চুরি করে এ-বোড়িতেই ঢুকেছে।’

লোকটা এবার ভীষণ ক্ষেপে উঠল। হেঁকে বলল, ‘এটা শেয়ালদা নয়, এটা বদ্যিবাটি।’

বদ্যির নাম শুনে বাজনার বুকটা ছ্যাঁৎ করে চমকে উঠল। বদ্যি! এটা বদ্যিবাটি! এতক্ষণ ধরে সে যে বদ্যির বাটিই খুঁজছিল! কত কষ্ট! আনমনে বলেই ফেলল, ‘বদ্যি!’ ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল বাজনার।

‘হুঁ, হুঁ, বদ্যি। আমাদের বড়োবাবু।’ লোকটা ন্যাড়া-মাথা নেড়ে নেড়ে বললে।

মুখখানা ঝলসে গেল বাজনার খুশিতে। বললে, ‘আজ্ঞে আমি তো তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে চাই।’

‘কেন? কার বিয়ে?’ গেঁড়া লোকটা, ট্যারা চোখটা বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলে।

বাজনা যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘বিয়ে! না, না, বিয়ে নয়!’

‘তবে?’

‘আজ্ঞে অসুখ। আমার।’

লোকটা এবার তেড়েমেড়ে রেগে উঠল, ‘কোথাকার ছেলেরে তুই? বড়োবাবু রোগী দেখা ছেড়ে দিয়েছেন কবে, জানিস না?’

‘মানে!’ মুখ শুকিয়ে গেল বাজনার।

‘মানে বিয়ে।’ লোকটা যাচ্ছেতাই মুখ করে খেঁকিয়ে উঠল, ‘এখন বিয়ের পদ্য লেখেন বড়োবাবু।’ বলে সেই গেঁড়া-ন্যাড়া-ট্যারা লোকটা দুম করে দরজা বন্ধ করে দিল। একেবারে বাজনার নাকের ওপর। বাজনা চমকে উঠল।

বাজনা বলল, ‘টাট্টু, টাট্টু, সব গেল।’

টাট্টু বললে, ‘না, না কিচ্ছু যায়নি। তাড়াতাড়ি একটা উপায় বার করো। বদ্যির সঙ্গে দেখা করতেই হবে।’

‘কী উপায়?’

‘যা হোক। এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি ভাবো।’

ভাবতে লাগল বাজনা।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল বাজনা, ‘টাট্টু, টাট্টু, হয়েছে।’

টাট্টু বললে, ‘কী?’

‘বলছি,’ বলে আবার দরজায় ঠেলা দিলে। ডাক দিলে, ‘ও মশাই, ও মশাই, দরজা খুলুন।‘

‘কে? কে?’ তিরিক্ষি মেজাজে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আবার বিরক্ত করছিস।’ দরজা খুলে গেল। বাজনাকে দেখে তেড়ে এল, ‘কী? কী?’

বাজনা বললে, ‘আজ্ঞে বিয়ে। বিয়ের পদ্যের জন্যেই এসেছি।’

‘সে কী! এই বললি অসুখ?

‘আজ্ঞে অসুখ তো আমার নিজের। বিয়ে তো আমার ঘোড়ার।’

‘কার বিয়ে?’ শুনেও যেন লোকটা নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।

 ‘আজ্ঞে ঘোড়ার।’ বলে বাজনা নিজের হাতটা লোকটার চোখের সামনে ধরলে।

 লোকটা বাজনার হাতের ঘোড়াটা ট্যারা চোখে দেখতে দেখতে অবাক হয়ে বললে, ‘ঘোড়ার বিয়ে!

বাজনা উত্তর দিলে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

লোকটার মেজাজটা হঠাৎ যেন নরম হয়ে গেল। বললে, ‘রসো, রসো। ঘোড়ার বিয়ের পদ্য বড়োবাবু লেখেন কি না আমার তো জানা নেই। একটু দাঁড়াও, আমি চট করে জিজ্ঞেস করে আসি।’

লোকটা ভেতরে ঢুকে গেল।

বাজনা আর কথা বললে না। টাট্টুর চোখের দিকে চেয়ে দেখল। টাট্টু চোখ টিপে হাসল।

একটু পরেই লোকটা আবার হাজির। বললে, ‘বড়োবাবু ডাকছেন।’

‘কে ডাকছেন?’

‘বড়োবাবু। মানে বদ্যিমশাই।’

‘ডাকছেন! যেন হাতে চাঁদ পেল বাজনা। আর তর সইল না। এক লাফে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল দরজা ডিঙিয়ে। লোকটার পিছু পিছু হাঁটা দিলে।

যা ভেবেছিল তা তো নয়। বাবা! বাড়ির ভেতরটা কী সাংঘাতিক। অন্ধকার। তেমনি নীচু সুড়ঙ্গের মতো। মাথা উঁচু করে গেছ কী ঠক! অবিশ্যি বাজনার ভয় নেই। ওতো এমনিতেই ছোট্ট। তবু লোকটা বলল, ‘সাবধান, মাথা না ঠুকে যায়!’ বাজনাও মাথা নীচু করেই হাঁটল।

বেশিক্ষণ হাঁটতে হল না। ক-পা যেতেই অন্ধকার কেটে গেল। তকতকে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। বললে, ‘চল, এই ঘরে বড়োবাবু আছেন।’ ঢুকে গেল সেই | গেঁড়া-ন্যাড়া-ট্যারা লোকটা ঘরের ভেতর।

প্রথমটা বাজনা অবশ্য একটু দোনোমনো করেছিল। কিন্তু লোকটা বললে, ‘আরে ভয় নেই, ভয় নেই। চলে এস।’

সত্যি সত্যি বদ্যির ঘরে ঢুকে পড়ল বাজনা।

বাস রে বাস! কোথায় বদ্যি! একটা গোরু! গোরুটা কাপড় পরেছে কাঁচি-পাড়। গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, গিলে করা। ছোট্ট একটা লেখন-চৌকি। তাতে কাগজ, কলম, কালি সাজানো। তার সামনে আগডুম-বাগডুম হয়ে বসে। চোখ দুটো কড়িকাঠের দিকে। চোখের পলক পড়ে না। কিন্তু বাজনা দেখল কাছার ফাঁক দিয়ে ল্যাজটি ঠিক নড়ে নড়ে উঠছে। বাজনার তো চক্ষুস্থির!

লোকটা বাজনাকে ইশারা করে বললে, ‘ইনিই বড়োবাবু।’

বাজনা লোকটার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলে, ইনিই বদ্যি?’

 লোকটা ঘাড় নাড়লে, ‘হ্যাঁ, বড়োবাবু বিয়ের পদ্য লিখছেন। গড় করো।’

অ্যাঁ! গোরুকে গড় করতে হবে! বাজনার মনটা সিঁটিয়ে উঠল। এও ভাগ্যে ছিল! তারপর ভাবল, গরজ তো তারই। তাই চুপচাপ মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গড় করল। গড় করে আবার উঠে দাঁড়াল।

ওমা! কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ গোরু-গোরু বদ্যিমশাই গম্ভীর গলায় হুকুম করলে, ‘বসো।’ কিন্তু বাজনার দিকে চেয়েও দেখলে না।

সামনে একটা আসন ছিলই। বাজনা নিঃসাড়ে আসনটার ওপর বসে পড়ল। বেবাক হয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল বদ্যিমশাই-এর দিকে। একদম চুপচাপ। ন্যাড়া লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

হঠাৎ আবার হাম্বা-হাম্বা গলায় বড়োবাবু জিজ্ঞেস করলে, ‘কী নাম?’

বাজনা ধরা-ধরা গলায় উত্তর দিলে, ‘বাজনা।’

‘হো-হো-হো,’ কী বিচ্ছিরি চাপা গলায় আচমকা হেসে উঠল বদ্যিমশাই! যেমন আচমকা হাসল, তেমনি আবার চট করে গম্ভীরও হয়ে গেল। কিন্তু বাজনার স্পষ্ট মনে হল হাসিটা যেন সারা ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে, হো-হো-হো। কান দুটো লাল হয়ে উঠল বাজনার। ছিঃ! ছিঃ! তার নাম শুনে বদ্যিমশাইও হেসে উঠল! যতই হোক গোরু তো!

আবার চুপচাপ।

হঠাৎ আবার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলে বদ্যিমশাই, ‘কার বিয়ে?

‘আজ্ঞে, আজ্ঞে,’ বাজনা আমতা আমতা করে ঢোঁক গিলতে লাগল।

আরও একটু চড়া গলায় বদ্যি জিজ্ঞেস করলে ‘কার বিয়ে?”

বাজনা চমকে উঠল। কাঁপা-কাঁপা গলায় বললে, ‘আজ্ঞে বিয়ে নয়, অসুখ।’

‘অসুখ!’ বদ্যিমশাই হঠাৎ বাজনার মুখের দিকে তাকাল কটমট করে। বাজনার বুক শুকিয়ে গেল।

বাজনা কোনোরকমে উত্তর দিলে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, অসুখ, আমার।’

গোরু-গোরু বদ্যি এবার রেগে-রেগে বললে, ‘তবে যে শুনলুম ঘোড়ার বিয়ে। পদ্য লিখে দিতে হবে। রোগীর চিকিচ্ছা এখানে হয় না। শুধুমুধু বিরক্ত করতে এসেছিস কেন? যা এখান থেকে।’ ধমক দিয়ে উঠল বদ্যিমশাই।

বাজনা কিন্তু আসন ছাড়ল না। হাতজোড় করে কাকুতিমিনতি করে বললে, ‘আজ্ঞে, আমি অনেকদূর থেকে আসছি। আমায় দয়া করতেই হবে।’

‘যাঃ চ্চলে! রোগের চিকিচ্ছাই ছেড়ে দিয়েছি। বলে দয়া করতে হবে! দয়া-টয়া এখানে হবে না। রাস্তা দেখ। কাজ করতে দে আমায়। বিরক্ত করিস না।’

‘আজ্ঞে, আমার অসুখের কথাটা আগে শুনুন, তারপর যা বলার বলবেন।’

‘অসুখের কথা আমি শুনব না।’ যেন তেড়েমেড়ে উঠল বদ্যি বড়োবাবু। ‘অসুখের কথা শোনবার আমার সময় নেই। হাতির গল্প বল, শুনতে পারি। বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে বল, করতে পারি। কড়াই-এর ডাল মেখে আলু-পোস্ত দিয়ে ভাত খেতে বল, আমি খেতে। পারি। কিন্তু অসুখ, কিংবা রোগ বা ব্যামো এসব কথা শুনতে রাজি নই।’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল বদ্যিমশাই।

বাজনার কান্না পেয়ে গেল। ও আর বসে থাকতে পারল না। ঝাঁপিয়ে গিয়ে বড়োবাবুর পা দুটো জাপটে ধরল। ধরেই হাউহাউ করে কান্না জুড়ে দিল, ‘আজ্ঞে আপনি আমাকে। বাঁচান। আমার অসুখ সারিয়ে দিন।’

‘আরে ছাড়, ছাড়।’ বদ্যিমশাই ব্যস্ত হয়ে পা টানাটানি লাগিয়ে দিলে। বাজনাও আরও জোরে জোরে জোরে জাপটে ধরলে পা দুটো, ‘না, আমি ছাড়ব না, কিছুতেই ছাড়ব না। আগে আমাকে বাঁচান।’ আরও জোরে কেঁদে উঠল।

বদ্যিমশাই এবার একেবারে গলে জল। বলল, কাঁদিস না, কাঁদিস না বাবা! কান্না-টান্না আমি সহ্য করতে পারি না। যখন বদ্যিগিরি করতুম তখন একরকম ছিলুম। মনটা এত নরম ছিল না। কিন্তু যেদিন থেকে বিয়ের পদ্য লিখতে শুরু করেছি, সেদিন থেকে মনটাও আমার বড়ো দুর্বল হয়ে পড়েছে। ছেড়ে দে বাবা, পায়ে হাত দিস না।’

বদ্যির গলায় নরম সুর শুনে বাজনা বদ্যির পা দুটো ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

‘চুপ কর, চুপ কর।’ বাজনাকে আদর করল বদ্যিমশাই। ‘নারকেল নাড়ু খাবি?’ আহা! বদ্যির গলায় যেন আদর উপচে পড়ছে।

বাজনা মাথা নাড়লে, ‘না, নাড়ু খাব না।’

‘জিলিপি খাবি?’

‘না, চাই না জিলিপি।’

‘তবে? তবে কী খাবি? সেদ্ধ পিঠে?’

‘আমি কিছু খাব না। আপনি আমার অসুখ সারিয়ে দিন। আর আমার কিছু চাই না।’

বদ্যিমশাই বললে, ‘দেখ, তোর অসুখ সারিয়ে দিতে তো আমার আপত্তি কিছু নেই। কিন্তু বিদ্যেটা ভুলে গেলে কী করি বল! হ্যাঁ, ছিল, এক সময়ে আমার খুব নাম-ডাক ছিল। আমি কত বড়ো বড়ো অসুখ টুসকি মেরে ভালো করে দিয়েছি। কিন্তু যেদিন থেকে আমার চশমাটা হারাল, সেদিন থেকে আমারও সব গেল।’

বদ্যিমশাই-এর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বাজনা। ভাবলে, চশমা আবার

বাজনার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছে বদ্যিমশাই। নিজের কান দুটো দুবার সুট-সুট করে নেড়ে নিয়ে বললে, ‘হ্যাঁরে, চশমা। আমার দাদামশাইয়ের চশমা। কিছু নয়। রোগী এল। চশমা চোখে এঁটেছি। সঙ্গে সঙ্গে কী রোগ জেনে ফেলেছি। দাওয়াই দিয়েছি। ব্যস! একেবারে জাদু! মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে গেছে! উঃ! ভাবতেই কষ্ট হয় সেই চশমাটা হারিয়ে গেছে! তাও কী! সে আবার হারাল কেমন করে! সে এক ভয়ংকর কাণ্ড! একবার এক রাজার ছেলের হল ভীষণ ব্যামো। ব্যামো মানে কী আর যেমন-তেমন! সাংঘাতিক! ছেলেকে এমনি দেখলে কিচ্ছু বুঝবে না। ছেলে খেলছে, দৌডুচ্ছে, বসছে, উঠছে, খাচ্ছে, শুচ্ছে। কিন্তু যেই কথা বলছে, শোন, ছেলে যেন গান গাইছে। ছেলের কথাগুলোর মধ্যে সব গানের সুর ঢুকে পড়েছে। মা বলে ডাকছে, ওমা, গেয়ে উঠছে সা-রে-গা-মা! মামা বলে হাঁকছে, শোন, গেয়ে উঠছে, নি-ধা-মামা! তখন লোক চলল এ-দেশ, লোক হাঁটল সে-দেশ, লোক ছুটল বিদেশ। ডাক পড়ল বাঘা-বাঘা কবরেজ আর বদ্যির। তারা ছেলের অসুখ ভালো করবে কী! অসুখ দেখেই তো থ। কেউ কিছু রোগের হদিশই করতে পারল না। কেউ বললে, ছেলের পেটে ফড়িং ঢুকেছে। কেউ বললে, ছেলে গান গিলে ফেলেছে! এ কী আর এতই সোজা! অগত্যা ডাক পড়ল এই শর্মার। রাজার চৌদোলা একেবারে আমার ঘরের দোরে হাজির।

‘অনেকদূর রাজবাড়ি। একটি রাত পুরো পথে যাবে। তাও আবার সোজা পথ নয়, বনের পথ। বন পেরিয়ে রাজার দেশ। অন্ধকার রাত। চৌদোলা ছুটছে, দুলছে। আমারও চোখ। জুড়িয়ে চুল লাগছে, ঘুম পাচ্ছে। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়ালই নেই। যেখানেই যাই, চশমা কিন্তু সব সময় আমার চোখে! ঘুমুচ্ছি বটে, কিন্তু চশমা চোখ থেকে খুলিনি। পাগল! কেউ নিয়ে পালাক আর কী!

‘চৌদোলায় দুলতে দুলতে, ঢুলতে ঢুলতে কখন যে আমার ল্যাজটা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে, একদম বুঝতে পারিনি। ওমা! হঠাৎ আচমকা আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, আমার ল্যাজ ধরে কে টানছে আর বেদম পাক মারছে। উফ! কী সাংঘাতিক। পাক! কোথায় ঘুম, কোথায় চৌদোলা! মার লাফ চৌদোলা থেকে মাটিতে! চৌদোলা উলটে ছত্রাকার! লাফ দিয়েই মার ছুট। ছুটলে কী! ল্যাজ কিন্তু তেমনি পাক খাচ্ছে! আর কী কাতুকুতুই না লাগছে! কে যে পাক দিচ্ছে ফিরে দেখবার ফুরসত কই? প্রাণ নিয়ে ছুটব, না ফিরে দেখব? ছুটতে ছুটতে হিমশিম খেয়ে গেছি। কাপড়-টাপড় খুলে মাটিতে লুটোপুটি। চশমাটাও চোখ থেকে ছিটকে পড়ল। অন্ধকারে যে একবার খুঁজে দেখব, তারও সুযোগ পেলুম না। আমাকে ছুটতেই হল। ল্যাজে যা তাড়া! তাড়া খেয়ে দিশেহারা!

‘যখন ল্যাজের পাক ছাড়ল তখন সকাল। সারারাত তাড়া খেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।’

‘বাঁচলাম বটে, কিন্তু সে বেঁচে লাভ কী! যা নিয়ে আমি বেঁচেছিলুম তাই তো আমার চলে। গেল। আমার চশমা! হায়! হায়! আমার চশমাটা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল! আমি এবার কী করব!’

কথা বলতে বলতে বদ্যিমশাই-এর গলা ভার-ভার হয়ে এল। বাজনা স্পষ্ট দেখলে বদ্যির চোখে জল চিকচিক করছে। বাজনার চোখ দুটোও যেন ঝাপসা হয় এল তাই দেখে।

সামলে নিল বদ্যিমশাই। যেন একটু গম্ভীর হয়ে উঠল। চোখে রাগ। খুব জোরে ঝাঁকুনি দিলে মাথাটা। শিং দুটোও নড়ে উঠল। বললে, ‘আমি এখনও ঠিক-ঠিক জানতে পারিনি কে আমার ল্যাজ টেনেছিল। তবে যতদূর মনে হয় হুমচক্কা! জানিস হুমচক্কা কে?’ জিজ্ঞেস করে বাজনার মুখের দিকে তাকাল বদ্যিমশাই।

বাজনা ঘাড় নাড়লে, ‘আজ্ঞে না।’

 ‘একটা ডাইনি। এ বনেই থাকে। আমার চশমাটা সে-ই চুরি করেছে?

বাজনার মুখটা শুকিয়ে গেল।

‘কোনোদিন যদি সুযোগ আসে তো দেখে নেবে একবার! হুমচক্কার পিণ্ডি চটকিয়ে ছাড়ব! আমার ল্যাজে হাত দেওয়া! এত বড়ো অপমান!’ বলে বদ্যিমশাই নিজের ল্যাজটা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে দুবার পিঠের ওপর ঝাড়া দিলে। মাছি বসেছিল।

বাজনা শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলে, ‘তা হলে আমার কী উপায় হবে?’

বদ্যি বললে, ‘হবে। হবে না কেন! পারবি চশমাটা হুমচক্কার কাছ থেকে কেড়ে আনতে? পারিস যদি বুঝব বাহাদুর ছেলে। আর তা যদি না পারিস, এখানে তোর আসাই সার। আমার দ্বারা কিছু হবে না। আমি অবশ্য সেদিন যথেষ্ট খোঁজাখুঁজি করেছি। কিন্তু হুমচষ্কার পাত্তাই পাইনি। তবে জানিস খুঁজতে খুঁজতে সেই বন থেকে একটা চাবি কুড়িয়ে পেয়েছি। আমার স্থির-বিশ্বাস চাবিটা তারই। হুমচক্কার ঘরের চাবি। তুই যদি যাস, চাবিটা তোকে দিতে পারি।’

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বাজনা। বললে, ‘আজ্ঞে আমি তো ছোটোছেলে। এত বড়ো কাজ আমি কেমন করে পারব?’

এবার যেন ইচ্ছে করে অন্যমনস্ক হয়ে গেল বদ্যিমশাই। বললে, ‘আর বিরক্ত করিস না আমায়, যা!’

বাজনা এবার সত্যিই মুষড়ে গেল। বুঝলে, আর কোনো উপায় নেই। বদ্যিমশাইকে বিরক্ত করেও কোনো লাভ নেই। কিন্তু যেতেও ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এত কাণ্ড করে শেষ পর্যন্ত বদ্যির দেখা পেয়েও সব পণ্ড হয়ে গেল!

‘কী রে, উঠছিস না?’

চমকে উঠল বাজনা। হতাশ সুরে জিজ্ঞেস করলে, ‘আজ্ঞে আমার তা হলে আর কিছু করার নেই?’

‘বললুম তো না।’

 ‘যদি যেতে হয়, যাচ্ছি। কিন্তু আজ্ঞে আমি তো হুমচক্কার দেশ কোনদিকে জানি না।’

‘আমারও কি ছাই জানা আছে! শুধু নামটাই শোনা আছে! তবে হ্যাঁ, বেশ মনে আছে দক্ষিণদিকে গিয়েছিলুম। তুইও যা।’

খুবই মনমরা হয়ে বাজনা বললে, ‘আপনি যখন বলছেন তাই-ই যাই।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা! তুই পারবি। চশমাটা খুঁজে নিয়ে আয়, তোর একটা কেন দশটা রোগ সারিয়ে দেব। এই নে চাবিটা,’ বলে বদ্যিমশাই ট্যাঁক থেকে একটা ছোট্টমতো চাবি বার করে বাজনার হাতে দিল। বাজনা অবাক হয়ে চাবিটার দিকে চেয়ে রইল। ‘আর শোন, এই পুঁটলিটা নিয়ে যা, খাবার আছে। খিদে পেলে খাবি।’

বাজনা চাবিটা ট্যাঁকে খুঁজলে। খাবারের পুঁটলিটা নিতে দোনোমনো করল।

‘আরে! নে, নে! আমার কাছে লজ্জা করার কিছু নেই।’

বাজনা পুঁটলিটাও হাতে নিলে। যা খিদে পেয়েছিল! মনে হচ্ছিল তখনই খুলে কিছু মুখে পুরে দেয়। না বাবা, শেষে বদ্যিমশাই হয়তো মনে মনে ভাববে ছেলেটা ভীষণ হ্যাংলা! দরকার কী!

‘তবে আসি।’ বলে বাজনা বদ্যিকে আবার গড় করলে।

বদ্যি বললে, ‘নিশ্চয়ই আসবি।’ বলে বদ্যি ঠ্যাং দুটো বাজনার মাথায় এমন জোরে ঠেকিয়ে দিল, উঃ! বাজনার মাথা ঝনঝন করে উঠল। মুখে টু শব্দটি না করে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বেরিয়ে এল বাজনা। সুড়ঙ্গ পেরিয়ে রাস্তায় পড়ে টাট্টুকে বললে, ‘হয়েও হল না।’

টাট্টু বললে, ‘হবে, হবে, ঠিক হবে। চশমাটা পেলেই হবে।’

বাজনা উত্তর দিলে, ‘চশমা যদি পেয়েই যাই, তো এখানে আসার আর কী দরকার। চোখে দিয়ে নিজের রোগ নিজেই তো আমি সারিয়ে ফেলতে পারি!’

টাট্টু হাসল।

বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘হাসছ যে?’

 ‘না, ভাবছি তুমি তা পার। কিন্তু তার আগে চশমাটা তো তোমায় খুঁজে বার করতে হবে। চল পা চালিয়ে হুমচক্কার বনে।’

বাজনা টাট্টুকে হাতে নিয়েই দক্ষিণে হাঁটা দিল।

বিকেল গড়িয়েই চলেছে। আর একটু পরে সন্ধে নেমে আসবে। তখন কী হবে? বাজনার কিন্তু মায়ের কথা একটুও মনে পড়ছে না। মাকে ভুলে গেছে বাজনা। মা যে সারাদিন ধরে তাকে খুঁজছে, একবারও এ-কথা মনে এল না তার। না ভুলে উপায় কী! অমন যে গোরু, বদ্যিমশাই সেও পর্যন্ত তার নাম শুনে হেসে উঠল। না, নাম তাকে পালটাতেই হবে!

হাঁটতে হাঁটতে সত্যি সত্যি সন্ধে পালটাতেই হবে!

বাজনা ডাকলে, ‘টাট্টু।’

 টাট্টু সাড়া দিলে, ‘হু।’

‘সন্ধে হয়ে গেল।’

‘দেখছি তাই।’

‘আর একটু পরেই তো রাত আসবে অন্ধকার।’

‘হ্যাঁ। তার আগেই একটা আস্তানা খুঁজে বার করতে হবে। নইলে তোমার কষ্ট! আমার আর কী! আমি তো ঘোড়া, কাঠের।’

‘না, না, আমার কোনো কষ্টের ভয় নেই। কিন্তু রাতটা তো কাটাতে হবে। এমন কটা রাত কাটাতে হবে কে জানে! কোথায় হুমচক্কার বন, তুমিও জান না, আমিও জানি না। আমি তো কোনোদিন নামই শুনিনি।’

হঠাৎ টাট্টু বললে, ‘বাজনা, বাজনা, ওটা কী বল তো?’

সন্ধের আবছা অন্ধকারে মনে হল একটা ভাঙা-ভাঙা মন্দির। তাই বাজনা হাঁটতে হাঁটতে ওইদিকেই এগিয়ে গেল। বললে, ‘টাট্টু, মনে হচ্ছে মন্দির।’

টাট্টু বললে, ‘আজ রাতটা তবে ওখানেই থাকা যাবে চল।’

বাজনা জিজ্ঞেস করলে, ‘ভাঙা মন্দিরে?’

টাট্টু বললে, ‘হ্যাঁ, মন্দিরই তো ভালো। মন্দিরে ভয়ও নেই, ভাবনাও নেই।’

বাজনা উত্তর দিলে, ‘ঠিক বলেছ, তাই চল।’

অবশ্য মন্দিরে ঠাকুর নেই। বাইরে থেকে যতটা মনে হচ্ছিল ঠিক ততটা ভাঙাও নয়। মেঝেটা বেশ তকতকে। গরমের দিনে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লে আরামই লাগে।

অনেকক্ষণ আগেই খিদে পেয়েছে বাজনার। এখন আর থাকতে পারছে না। বদ্যির খাবারের বোঁচকাটা খুলতে খুলতে বাজনা বললে, ‘টাট্টু, বড্ড খিদে। খাচ্ছি।’

টাট্টু বললে, ‘রক্ষে! বদ্যি রোগ না সারাক এক বোঁচকা খাবার তো দিয়েছে। খাবার না। পেলে কী হত একবার ভাবো তো। খিদেয় ছটফট করতে তুমি। না, বদ্যি লোকটা ভালো!’

টাট্টুর কথা শুনে বাজনা এত কষ্টেও খিলখিল করে হেসে উঠল। বললে, ‘লোক! লোক কোথা দেখলে! ওমা! একটা আস্ত গোরু তো!’

টাট্টুও হেসে উঠল। বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভুল হয়ে যাচ্ছে!

হাসতে হাসতে বাজনা বদ্যির বোঁচকার গিট খুলতে বসল। মন্দিরের ভেতরটা এরই মধ্যে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ভালো করে কিছু দেখাই যায় না। তাই আন্দাজেই বাজনা বোঁচকার বাঁধন ধরে টানাটানি লাগিয়ে দিলে।

কিন্তু গিটটা যে অমন ফস করে খুলে যাবে, বাজনা ভাবতেই পারেনি। খুলে, বোঁচকা থেকে যেন কী একটাং করে ঘরের মেঝেয় পড়ল। তারপর ঠুং-ঠুং ঠুং-ঠুংকরে গড়াতে গড়াতে দেওয়ালের গায়ে গিয়ে আটকে গেল। যাঃ বাববা! এ আবার কী ধরনের খাবার!

বাজনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘টাট্টু, বোঁচকার ভেতর থেকে এ আবার কী খাবার বেরুল, ঠুনঠুনিয়ে গড়িয়ে গেল?’

 টাট্টু বলল, ‘খুঁজে বার করো।’

বাজনা বলল, ‘অন্ধকারে খুঁজি কোথা? তুমি আমার কাছে থাকো।’

টাট্টু উত্তর দিল, ‘বেশ তো আমাকে তোমার হাতেই রাখো। তাহলে অন্ধকারে আমার হারিয়ে যাবার ভয় থাকবে না।’

‘সেই ভালো।’ বলে বাজনা টাট্টুকে হাতে নিয়ে, হারিয়ে যাওয়া সেই ঠুং-ঠাং গড়ানে খাবারটা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল।

আরে! কই খাবার? এটা তো বেশ শক্ত! হাতে ঠেকতেই বাজনা বুঝতে পেরেছে। আর একটু পরখ করতেই বাজনা বুঝল, এটা খাবারই নয়, একটা বাঁশি! চেঁচিয়ে উঠল বাজনা, ‘টাট্টু, টাট্টু বাঁশি!

টাট্টু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাঁশি?’

‘হ্যাঁ, এই তো দেখোনা,’ বলে বাজনা ফুঁ দিল বাঁশিতে।

আর দেখতে! আচমকা কী জোর বেজে উঠল বাঁশিটা! কী ভয়ংকর শব্দ! বুক কেঁপে উঠল বাজনার! সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল! মনে হল চারিদিকে তুলকালাম চলেছে। বাঁশির সেই বিচ্ছিরি শব্দটা লক্ষ লক্ষ সাপের মতো ফোঁস করে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরের ভেতর, আর যেন সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। বাজনার কান ফেটে যাচ্ছে। চোখও চাইতে পারছে না। মনে হচ্ছে কাছেপিঠে আগুন লেগে গেছে। রাশ রাশ ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে। ছুটে ছুটে আসছে ঘরের ভেতর। বাজনার চোখে-মুখে-নাকে ঢুকে নিশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে! এতক্ষণ বাঁশিটা হাতেই ছিল বাজনার। ভয়েময়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের বাইরে! দুম! উঃ! কী শব্দ! কেঁপে উঠল চারিদিক! কড়কড়-কড়! যেন সারা পৃথিবীটাই টলে টলে কাঁপছে আর ভাঙছে!

কিন্তু দেখো, তারপরই হঠাৎ লক্ষ সাপের ফোঁসফোঁসানি থেমে গেল। রাশ রাশ ধোঁয়া মিলিয়ে গেল। অন্ধকারে আলো ফুটল!

সত্যিই তা, আলো! একেবারে দিনের আলো! কোত্থেকে এল দিনের আলো? এতক্ষণ তো অন্ধকার ছিল, হঠাৎ দিন হল কেমন করে! অবাক হয়ে চেয়ে দেখল বাজনা। চেয়ে থাকতে থাকতে আচমকা থতমত খেয়ে যায় বাজনা! আরি! মন্দিরটা গেল কই? ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তো মন্দির নেই! এটা তো একটা মস্ত তোরণ! তোরণের নীচ দিয়ে ইয়া চওড়া একটা রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে। তোরণের ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাজনা। আচ্ছা তাজ্জব ব্যাপার তো! হাঁদার মতো ফ্যালফ্যাল করে দেখতে দেখতে কাঁপতে লাগল বাজনা।

হঠাৎ টাট্টু চুপিসাড়ে কথা কয়ে উঠল, ‘কী হল বাজনা? ভয় লাগছে?

‘উঁ!’ চমকে ওঠে বাজনা। ‘না, না,’ সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল।

‘অবাক লাগছে?’ টাট্টু জিজ্ঞেস করল।

ধরা-ধরা গলায় বাজনা উত্তর দিল, ‘টাট্টু, দেখছ, মন্দিরটা কোথায় উড়ে গেছে! আমরা একটা তোরণের নীচে দাঁড়িয়ে আছি।’

টাট্টু বলল, ‘আশ্চর্য তো!’

‘আশ্চর্য বলে আশ্চর্য! দেখোনা তোরণের নীচ দিয়ে একটা কেমন ঝকঝক রাস্তা চলে গেছে।’

টাট্টু ফিসফিসিয়ে বাজনাকে বলল, ‘ওই রাস্তায় হাঁটা দাও।’

‘তারপর যদি আবার কিছু হয়?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল বাজনা। ‘যে-রাস্তা সামনে সে রাস্তাতেই এখন এগিয়ে যেতে হবে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে কোনো কাজ হয় না।’

ঠিক বলেছে টাট্টু। মনে মনে ভেবে নিয়ে হাঁটা দিল বাজনা সামনে।

ওমা! একটি পা ফেলেই থমকে দাঁড়ায় কেন বাজনা?

এতক্ষণ একটিও বাড়ি ছিল না চোখের সামনে, রাস্তার ধারে। যেই একটি পা পড়েছে বাজনার, অমনি একটি বাড়িও নজরে পড়েছে! কোথায় ছিল বাড়িটা?

না, হয়তো ভুল দেখেছে বাজনা! তাই আবার হয় নাকি! নিশ্চয়ই বাড়িটা ছিল। ও হয়তো নজর করেনি আগে। তাই আবার চারিদিক ভালো করে দেখে পা ফেলল। হাঁটা দিল।

ব্যস! ঠিক যা ভাবা, তাই! আবার একটা বাড়ি হুস করে একেবারে বাজনার চোখের ওপর থমকে দাঁড়াল।

এবার সত্যিই থতমত খেয়ে গেল বাজনা। তাই টাট্টুকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হচ্ছে এসব?

টাট্টু বলল, ‘চুপ! একদম কথা বলো না। তাড়াতাড়ি হেঁটে চল। যা হচ্ছে হতে দাও।’

‘সেই ভালো,’ বলে বাজনা খুব জোরে পা চালিয়ে এগিয়ে চলল।

দেখতে দেখতে সত্যিই চারিদিকে বাড়ি আর বাড়ি। বাজনা সামনের দিকে চেয়ে দেখল, অগুনতি ঝকঝকে বাড়ি! পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, অসংখ্য ফুটফুটে বাড়ি!

কোনো বাড়িটা ছোটো-ছোটো,

কোনো বাড়িটা বড়ো-বড়ো।

কোনো বাড়িটা উঁচু-উঁচু,

কোনো বাড়িটা নীচু-নীচু।

হাঁটতে হাঁটতে বাজনা ছোটো-বড়ো, উঁচু-নীচু, ঝকঝকে-ফুটফুটে অগুনতি বাড়ির মাঝখানে এসে পড়ল। সত্যিই বাড়ির চেহারা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। রং দেখলে মন ভরে যায়। তাই হাঁটতে হাঁটতে চোখ মেলে দাঁড়িয়ে পড়ল বাজনা। বাজনার মন বলছে। এখন দেখি। মন ভরে শুধু বাড়ির ছবি দেখি!

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘বাজনা, দাঁড়াও কেন?’

 বাজনা বলল, ‘আঃ! দেখতে বড্ড ভালো লাগছে। কত রং দেখো! আহা! কিন্তু টাট্টু, এত বাড়ি, রং-বাহারি, এত রাস্তা ঝকমকে, তকতকে অথচ দেখো, একটিও তো লোক নেই, জনমনুষ্যি নেই! কী ব্যাপার!’

টাট্টু বলল, ‘হ্যাঁ তাই তো দেখছি। আশ্চর্য! এগিয়ে চল তো। ভালো করে দেখি।’

বাজনা উত্তর দিল, ‘তাই চল।’

টাট্টু বলল, ‘খুব সাবধান। লুকিয়ে চল। বিপদ আসতে পারে!

টাট্টুর কথা শুনে তাই বাজনা সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হল। টাট্টুকে হাতে নিয়ে এ-বাড়ির আড়াল দিয়ে, ও-বাড়ির পেছন দিয়ে এগিয়ে চলল খুব চুপিসাড়ে! উঁকি মারল এদিক-ওদিক, কিন্তু কারো টিকিটি পর্যন্ত নজরে পড়ল না।

বাজনা তাই আবার অবাক-সুরে বলল, ‘টাট্টু, কেউ নেই কোত্থাও!’

টাট্টু জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে প্রাণও নেই, প্রাণীও নেই?

বাজনা বলল, ‘নজরে পড়ছে না তো।’

টাট্টু বলল, ‘চল একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখি।’

বাজনা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘না বাবা! কেউ দেখে ফেললে!’

‘দেখছি তো কেউ নেই।’

‘বাড়ির ভেতর তো থাকতে পারে।’

‘তা হলে এক কাজ করো,’ টাট্টু বলল, ‘একটা বাড়ির জানলা দিয়ে আগে উঁকি মেরে দেখো।’

‘ঠিক বলেছ,’ বলে বাজনা আলতে-পায়ের ডিঙি মেরে একটা বাড়ির জানলার সামনে এসে ঘাপটি মেরে দাঁড়াল। আড়চোখে এদিক-ওদিক দেখে সত্যি সত্যি জানলার ভেতর দিয়ে। উঁকি দিল। না, কেউ নেই! দরকার কী! সন্দেহ থাকে কেন! তাই জানালর গরাদ ধরে উঠে দাঁড়াল। আরও ভালো করে দেখল। না, সত্যিই কেউ নেই।

বাজনা চাপা গলায় টাট্টুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘টাট্টু, এ-বাড়িতে কেউ নেই।’

টাট্টু বলল, ‘কই দেখি তো আমি। আমায় একটু তুলে ধর।’

টাট্টুকে তুলে ধরল বাজনা।

টাট্টু এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে বলল, ‘হ্যাঁ-তো রে, কেউ নেই তো বাড়ির ভেতর! চল ভেতরে যাই।’

বাজনা দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।

 উরি বাবা! কী বিরাট বাড়ির ভেতরটা। কত ঘর! একটা ঘর, দুটো ঘর, ঘরের ভেতর ঘর। ছোটো ঘর, বড়ো ঘর। গোনা যায় না। বাগান দেখো কী সুন্দর!

একটা ঘরে উঁকি মেরে দেখল বাজনা। ওমা! কিচ্ছু নেই ঘরের ভেতর। না পালঙ্ক, না খাট, দেরাজ, না সিন্দুক!

তবে?

ঘরের দেওয়াল ভরতি পাখির ছবি খোদাই করা। লোক নেই, জন নেই, কে খোদাই করল এত পাখি! কী সুন্দর দেখতে পাখিগুলো। কত রকমের। কত রং ডানায়-ডানায়, পালকে! আবার দেখো, চোখে-চোখে মুক্তো বসানো! দেখলে মনে হয় যেন মিটমিট করে চাইছে!

বাজনা আবাক হয়ে ডাকল, ‘টাট্টু, টাট্টু!”

‘কী? কী?’

‘পাখিগুলো যদি দেওয়ালে খোদাই করা না থাকত, ক-টা সঙ্গে নিতুম।’

টাট্টু উত্তর দিল, ‘সঙ্গে নিতে হবে না। যখন লোকজন কেউ নেই, হয়তো গোটা বাড়িটাই তোমার হয়ে যেতে পারে!’

‘সত্যি!’ বাজনার মুখখানা খুশিতে উপচে গেল।

টাট্টু বলল, ‘দেখেশুনে তাই তো মনে হচ্ছে।’

তবে চল পাশের ঘরটা দেখি,’ বলে বাজনা পাশের ঘরে পা বাড়াল।