আমার নাম টায়রা – ১

আমার নাম টায়রা – শৈলেন ঘোষ

আমার নাম টায়রা।

আমরা থাকি একটা ছোট্ট বাড়িতে। আমি, মা আর বাবা। আমাদের বাড়ি তো মাটির তৈরি, তাই খড় দিয়ে ছাওয়া। চারিদিকে গাছ। সবুজ-সবুজ ছায়া। ভারি শান্ত-শান্ত। এমনিতে আমাদের গ্রামটাও খুব ছোট্ট। আমাদের গ্রামে আছে নয়নকাকা, দাদু, রাঙাপিসি, আরও অনেকে। অনেক গাছ আর অনেক পাখি আমাদের গ্রামে। অনেক কাঠবিড়ালি আর বকুল ফুলের গন্ধ।

ফুলের গন্ধ আমার বড্ড ভালো লাগে। বকুল ফুল কুড়িয়ে এনে, মালা গেঁথে আমি গলায় পরি। জানো, মা আমায় খুব ভালোবাসে। মায়ের পায়ের রুপোর তোড়া আমার পায়ে সাজিয়ে আমি যখন ছুটে চলি, তখন আমার কী খুশিই না লাগে। আমায় গ্রামের সবাই বলে, ‘কী মিষ্টি মুখখানি তোর টায়রা। যার ঘরের বউ হবি, ঘর আলোকরবি।’

আমার আবার বিয়ে কী! আমি তো এখন কত ছোটো। মায়ের মতো হতে তো আমার। অনেকদিন বাকি। মায়ের মতো না হলে আমার বিয়ে হবে কেমন করে! বিয়ের কথা শুনলে না আমার ভীষণ লজ্জা করে। সেবার যখন রাঙাকাকার মেয়ের বিয়ে হল, রাঙাকাকার মেয়ে কী কান্নাই কাঁদছিল। গাল দুটি বেয়ে, কাজল পরা চোখদুটি দিয়ে টুসটুস করে জল। পড়ছিল। তার কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়ে গেল। কান্না পেলেই কেন জানি না, মায়ের মুখখানি আমার চোখে ভেসে ওঠে। মনে হয়, মায়ের বুকে লুকিয়ে পড়ি।

গ্রামের পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। আমাদের নদীর নাম টুংরি। শীতকালে টুংরির চেহারা দেখলে ভাববে, ভারি লক্ষ্মী একটি মেয়ে। তাই বইকি! টুংরি দুষ্টুর দুষ্টু! যখন খুব বিষ্টি আসে ঝমঝমিয়ে বর্ষাকালে, তখন তার কী রূপ! দেখলে শিউরে উঠবে। এ-পার থেকে ও-পার তোমার দিষ্টিই যাবে না। মনে হবে সমুদুর। কী তার ঢেউ! উঠছে, পড়ছে, আর আছাড় খেয়ে মাটিতে মিশে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।

আমি কিন্তু টুংরিকে একটুও ভয় পাই না। টুংরির ঢেউ জাগানো জলে দোল খেতে আমার কী মজাই না লাগে। আমি রোজ দোল খাই।

আমার বাবা মাছ ধরে। রোজ সকালে জাল নিয়ে বাবা নদীতে যায়। আমিও যাই, বাবার সঙ্গে। তবে রোজ না। এক-এক দিন। আমাদের একটা ছোট্ট নৌকো আছে। নৌকোয় চেপে জলের দোলায় দুলতে দুলতে আমি আর বাবা টুংরির বুকে হারিয়ে যাই! বাবা জাল ফেলে ফেলে মাছের খোঁজ করে। আর আমি চোখ মেলে মেলে চেয়ে থাকি বাবার মুখের দিকে। বাবাকে আমার খুব ভালো লাগে! বাবার জন্যে আমার বড় মায়া লাগে। ভাবি, আমাদের জন্যে বাবা কত কষ্ট করে। কিন্তু সে কষ্ট মুখ দেখে বুঝবে না তুমি। দেখবে, সব সময়ে বাবার মুখখানি হাসি-হাসি।

আমি গান শিখেছি বাবার কাছে। যখন সাঁঝ নামে আকাশে, টুংরির জলের আয়নায় রঙের ছবি ফুটে ওঠে, তখন আমাদের নৌকো ঘরে ফিরবে। তখন নদীর বুকে গান গাইবে বাবা। বাবার গান শুনতে শুনতে হঠাৎ যখন আকাশের দিকে চেয়ে ফেলি, আমার মনটাও কেমন আনমনা হয়ে যায়। আমিও বাবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে উঠি। কে জানে আমার গান, গান হয় কি না। কিন্তু নদীর দোলনায় দোল খেতে খেতে গানের সুর আমার ভেসে যায়। কোথায় যায়, আমি ভেবে পাই না।

সন্ধে এলে মনটা যেন আমার কেমন কেমন করে। মনে হয়, এক্ষুনি তো রাত্তির এসে পড়বে। রাত্তির এলে দিনের সবটুকু আলো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। আর ওই যে ছোট্ট। ছোট্ট পাখিরা গাছের ডালে রং-বাহারি ডানা ছড়িয়ে খেলছিল, ডাকছিল, ওরা আর ডাকবে না, খেলবে না। ঘুমিয়ে পড়বে।

আমারও ঘুমিয়ে পড়তে ভালো লাগে।

আমি দেখি ঘুমোয় না জোনাকিগুলো। ওরা সারারাত আলো জ্বেলে জ্বেলে উড়ে বেড়ায়। ওরা তো এইটুকু-টুকু। ওইটুকু প্রাণীর কতটুকু আলো আর। অমন যে আকাশ ভরে তারার চুমকি, তাদের কথাই ধরো। তারাই কি পারে অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দিতে? আমার যখন ঘুম পায়, তখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জোনাকির আলো দেখি। দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয়, আমি যেমন কপালে কাঁচ-পোকার টিপ পরি, তেমনি যেন জোনাকিগুলো অন্ধকারের কপালে আলোর টিপ পরিয়ে দিচ্ছে।

আমার না খুব রাজকন্যা হতে ইচ্ছে করে! হাসছ? সত্যি বলছি। ইচ্ছে করলেই তো আর হওয়া যায় না! রাজকন্যার কত বড়ড়া বাড়ি। কত সাজপোশাক। কত গয়নাগাটি। কত দাসদাসী। সোনার রথ। কত কী! আমার তো আর ওসব কিছু নেই। আমি শুধু রাজকন্যার গল্পই শুনি। গল্প শুনতে শুনতে আমার মনটা গল্পের রাজকন্যা হয়ে নীল আকাশের পরির সঙ্গে খেলে বেড়ায়। উড়ে যায়। গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে বলো? আর যদি সে-গল্প অন্ধকার রাত্তিরে মায়ের মুখে শুনতে পাই! মায়ের বুকের মধ্যে কত গল্প। আমার যখন। ঘুমছোঁয়া চোখ দুটি বুজে আসে, তখন দেখি সেখানে গল্প আর গল্প।

আমাদের এখানে যাত্রা হয়। তোমরা যাত্রা দেখেছ? সেবার হল অভিমন্যু পালা। বীর। অভিমন্যুকে সপ্তরথী ঘিরে ফেলেছে। বীর হার মানবে না কিছুতেই। কী সাংঘাতিক যুদ্ধ! বীর একা লড়তে লড়তে যখন মাটিতে পড়ে গেল, চোখ দুটি বুজে এল, তখন আমার কিন্তু একটুও কান্না পায়নি। উলটে আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি অভিমন্যু হতে পারি! বীরের মতো লড়াই করতে পারি! অমনি করে লড়তে লড়তে যদি সপ্তরথীর দর্প আমি ভাঙতে পারি! আচ্ছা, ওদের লজ্জা করল না? একটা ছেলেমানুষকে ওরা সবাই মিলে এমন করে মারল!

যাত্রা দেখে আমি কেঁদেছিলুম একবার। অন্ধমুনির গল্প তো আমি অনেক আগেই শুনেছি। তার ছেলে সিন্ধু। যখন দশরথের হাতের তির সিন্ধুর বুকে লাগল, চিরদিনের মতো তার চোখের আলো নিভে গেল, তখন আমি চোখের জল না ফেলে পারিনি। ছেলের শোকে অন্ধমুনির সে কী কান্না! সে-কান্না শুনলে কে থাকতে পারে? আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিলুম। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।

অন্ধমুনির যাত্রা আমি যেদিন দেখেছি, সেদিন থেকে মানার জন্যে আমার যে কী ভাবনা ধরে গেছে, আমি বলতে পারি না। তোমরা চিনবে না মানাকে। মানা আমার বন্ধু। ওর মা চোখে দেখতে পায় না। মানার তো বাবা নেই, তাই অন্ধ মায়ের কাছে মানা একা থাকে। মা আর ছেলে। বড় গরিব ওরা। হবেই তো। ওদের তো কেউ দেখে না। খেতেই পায় না সব দিন। আর যে-ঘরটায় থাকে, দেখলেই মনে হবে, এই বুঝি মাটির সঙ্গে মাটির ঘর ভেঙে পড়ে মিশে যায়।

কেন জানি না, মানাকে দেখলে আমার ভারি কষ্ট হয়। বলো, ওইটুকু ছেলে অন্ধ মাকে নিয়ে একা কী করে? আমি রোজ ওদের ঘরে যাই। এখান থেকে তো বেশিদূর নয় ওদের ঘরটা। দু-পা হাঁটলেই হল। আমার পায়ের শব্দ শুনলেই মানার মা ঠিক বুঝবে আমি এসেছি। ডাকবে, ‘কে রে, টায়রা এলি?’

আমি বলি, ‘মাসি, তুমি কোনোদিন পিঠে খেয়েছ?’

 আমার কথা শুনে মানার মায়ের অন্ধ চোখ দুটিও ছলছলিয়ে ওঠে।

আমি বলি, ‘কাঁদছ কেন মাসি, মা পিঠে করেছে। খাবে? আমি এনেছি।’

মাসি বলল, ‘আর-জন্মে তুই আমার মেয়ে ছিলি মা।’

আমি বললুম, ‘মানা আমার ভাই।’

তারপর মানার হাত ধরে আমি ছুট দিই। ছুটে যাই টুংরি নদীর ধারে। দু-জনে বসে গল্প করি। আর নয়তো ফড়িং-বনে সবুজ ঘাসের আড়ালে হারিয়ে যাই।

আমি বলি, ‘মানা, গান শিখবি?” মানা উত্তর দেয়, ‘আমি গাইতে পারি না।’

আমি বলি, ‘আমার সঙ্গে গা।’

আমার সুরে সুর মিলিয়ে গান গায় মানা। কিন্তু তেমন কী আর গাইতে পারে!

ও কতদিন এসেছে আমাদের বাড়িতে। আমি কতদিন মানাকে নিয়ে বাবার সঙ্গে নৌকো চেপে নদীর এপার ও-পার করেছি। আর নয়তো দু-জনে সাঁতার কাটতে কাটতে নদীর জলে হারিয়ে গেছি।

মানার মা-ও আসে আমাদের বাড়ি মানার হাতটি ধরে। অন্ধ মাকে ও পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। ওরা এলে আমার এত ভালো লাগে! ওর মাকে দেখলে আমার কেবলইমন বলে, আমার চোখ দুটি ওর মায়ের চোখে পরিয়ে দিই। হলুমই বা আমি অন্ধ। ওর মা তো দুচোখ ভরে তার ছেলেকে দেখতে পাবে। আহা! ছেলের মুখটি মা কোনোদিনই দেখতে পেল না। কোনোদিনই দেখতে পাবে না! হাত দিয়ে ছেলের চিবুকে চুমু খেলেই কি মা-র সব সাধ মেটে?

মানার মা আমাদের বাড়ি এলে আমার মা পেট ভরে খেতে দেয়। মা আর ছেলে খাবে আর কাঁদবে। কান্না দেখলে আমার চোখেও জল এসে যায়। আমি বলি ‘কাঁদছ কেন মাসি। মা তো তোমার বোন।’আমার কথা শুনে ওর মায়ের চোখে জল থামে না। আরও কাঁদে, আরও।

আমার মা একদিন একটি পাটভাঙা থান পরিয়ে দিয়েছিল অন্ধ মাকে। মা বলেছিল, ‘দিদি, এ-কাপড়টা তোমার জন্যে দোকান থেকে আনিয়েছি।’

নতুন কাপড় পরে মাসিকে কী সুন্দর মানিয়েছিল! আমি সেদিন মানার মুখেও হাসি দেখেছি। নতুন কাপড়ের মতো ওর হাসিটাও কেমন যেন আমার চোখে নতুন নতুন লাগছিল। সেদিন মানাকে এত ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল ওকে-ও আমি নতুন পোশাকে সাজিয়ে দিই।

বর্ষা এলে আমার এত ভালো লাগে। আমি জানি বর্ষায় যেদিন প্রথম চাঁদ ওঠে, সেদিন মানার জন্মদিন। আমি তাই কতবার মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘মাগো, কবে বর্ষা আসবে? প্রথম চাঁদ উঠবে?’

মা হাসবে। মা তো জানে আমি কেন বলছি। মানার জন্মদিনে আমি ওকে হাত ধরে ডেকে আনি আমাদের বাড়ি। মা পায়েস করে দেয়। আমি পায়েসের বাটি মানার হাতে তুলে দিয়ে বলি, ‘মানা, বর্ষায় আজ প্রথম চাঁদ উঠেছে। আজ তোর জন্মদিন।’

মানা আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ও হয়তো নিজেই জানে না কোন দিন তার জন্মদিন। আমি জানি বলে ও যেন অবাক হয়। অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আর তো কদিন পরেই আবার বর্ষা আসবে। আবার ওর জন্মদিন আসবে। এবারও কি মানা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে?

দেখো না, আমি এবার সত্যি মানাকে অবাক করে দেব। এই বর্ষায় আমি ওকে রেশমি সুতির জামা দেব। মাকে আমি বলেও রেখেছি। মা বলেছে, ‘বেশ তো, বর্ষা আসুক, কিনে দেব।’

আমার কানে এই যে সোনার ঝুমকো দুটো দেখছ, এ দুটো বাবা আমায় দিয়েছে। বলল, ভালো না? বাবা শহরে গেছল। কিনে এনেছে। সেদিন ছিল আমারও জন্মদিন। তাই বাবা যখন ঝুমকো দুটো আমার কানে সাজিয়ে দিয়ে আদর করেছিল, তখন লজ্জায় মরে যাই। আমি মায়ের কাছে ছুটে পালিয়েছি। মায়ের আঁচলে নিজের মুখখানা লুকিয়ে বলেছি, ‘মা, আমার কানে ঝুমকো। বাবা দিয়েছে।’ মা, ‘কই–কই’ বলে আমার মুখখানি দেখার আগেই, আমি মায়ের আঁচল ছাড়িয়ে ছুট দিয়েছি। ঘর ছেড়ে রাস্তায়।

পাখিওলা যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। বনের পাখি খাঁচায় পুরে সে প্রায়ই বেচতে আসে এখানে। আমার না পাখিগুলোকে দেখলে ভারি মন কেমন করে। কেন যে পাখিওলা ওদের এমন করে বন্দি করে বেচে বেড়ায়, আমি বুঝতে পারি না। ওদেরও তো মা আছে। আমি পাখিওলাকে বলেছিলুম, ‘পাখিওলা, আজ আমার জন্মদিন। আমায় একটি পাখি দেবে। আমি আকাশে উড়িয়ে দেব। এই দেখোনা, বাবা আমায় ঝুমকো দিয়েছে।’

পাখিওলা আমায় পাখি দেয়নি। মুখখানা কেমন শুকনো-মুকনো করে শুধু বলেছিল, ‘বাঃ! বাঃ! ঝুমকো দুটো বেশ তো!’ বলে পাখির খাঁচা মাথায় নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল।

যাকগে। আমার খারাপ লাগলে পাখিওলার বয়ে গেছে। ওর পয়সা হলেই হল।

আমি তারপর ছুটতে ছুটতে মানাদের বাড়ি গেছি। ওর মাকে বলেছি, ‘মাসি, মাসি, বাবা আমায় ঝুমকো দিয়েছে। দেখো।’

মাসি আমার গালটি ধরে আমায় কাছে টেনে নিয়েছিল। বলল, ‘কই দেখি।’ বলে আমার সারা মুখখানা দু-হাত দিয়ে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে আদর করল। সোনার ঝুমকো দুটো হাতে ধরে বলল, ‘কী সুন্দর হয়েছে!

আর একটু গেলেই ময়রা-দাদার দোকান। আমি মানাদের বাড়ি পেরিয়ে ময়রা-দাদার কাছে ছুটে গেছি। বলেছি, ‘ময়রা-দাদা, ময়রা-দাদা, এই দেখো না, বাবা আমায় ঝুমকো দিয়েছে।’

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ময়রা-দাদার মুখখানাও কেমন খুশিতে আর হাসিতে ভরে গেল। বলল, ‘বাঃ! বাঃ! বেশ হয়েছে তো! এবার টায়রার বিয়ে হবে। আমি রসগোল্লা। বানাব।’ বলে এমন হো হো করে হেসে উঠল যে, আমি লজ্জায় চোখ বুজে ছুট দিলুম।

অত কী, আমার নিজেরই নিজের মুখখানা দেখতে এত ইচ্ছে করছিল। কেমন সেজেছে। মুখখানা আমার ঝুমকো পরে? নিজের মুখ তো আর নিজে নিজে দেখা যায় না। তাই আমি ছুটে ছুটে নদীর ঘাটে গেছি। টুংরির জলে হেঁট হয়ে আমার মুখের ছায়া দেখেছি, দেখতে দেখতে আমি হেসে ফেলছি। তা বলে তো আর নদীর জল আয়না নয়। আয়নায় যেমন দেখা যায় স্পষ্ট স্পষ্ট, নদীর জলে তো তা হবে না। কিন্তু গয়না পরে, মায়ের সামনে নিজের মুখটা ঘরের আয়নায় কী করে দেখি বলো? মা দেখে ফেললে!

টুংরির জলে মুখের ছায়া দেখে, আঁজলা-ভরে চোখে আমার জল ছিটিয়ে, আমি যখন উঠতে গেছি, তখনই আমার কানে যেন কীসের ঘন্টা বাজল ঠুং ঠুং। আমার মনে হল, কে যেন ঘন্টা পরে হাঁটছে আর আসছে। আমি ফিরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখি, ও মা! গাধার পিঠে উলটোদিকে বসে রামুকাকা আসছে! আমার যে কী হাসি পেল তোমাদের কী বলব। রামুকাকাকে তোমরা তো কেউ দেখোনি। আমি বলতে পারি, দেখলেই হেসে ফেলবে। খুব মোটা তো। আমি তা বলে রামুকাকার মুখের সামনে কোনোদিন বলি না মোটা। বলব। কেন? আমি তো ছোটো। বলতে আছে? ভগবানের যা ইচ্ছে তাই তো হবে। যাকে যা করেন ভগবান

কিন্তু হাসি পেলে আমি কী করব! সত্যি বলছি, হাসি পেলে আমি চাপতে পারি না। আমায় দোষ দাও, দেবে! আচ্ছা, অমন একটা মোটা মানুষ যদি উলটো দিকে মুখ করে গাধার পিঠে বসে বসে চলে, কে বাবা না হেসে থাকতে পারে? তবু খুব কষ্টে হাসিটাকে সামলে রাখলুম। আমিও কম যাই! সামনে দিয়ে পা টিপে টিপে গিয়ে রামুকাকার কানে দিয়েছি কু। আঁতকে উঠে রামুকাকা এই বুঝি দুমফট হয়! আর একটু হলেই পড়ে যেত। বলতে হবে। গাধাটা খুব চালাক। ও যদি দাঁড়িয়ে না পড়ত, ঠিক একটা কাণ্ড হত। কিন্তু জানো, রামুকাকা একটুও রাগ করল না আমার ওপর। উলটে এমন হেসে উঠল যে, আমি নিজেই কেমন অবাক হয়ে গেলুম।

হাসতে হাসতে রামুকাকা বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।’

আমি অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলুম, ‘গাধার পিঠে? উলটো বসে?

রামুকাকা বলল কী, ‘রোদটা ভারি মিষ্টি।’

আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘উলটে পড়ে গেলে?’

‘পেটটা আমার দুমফট হয়ে যেত।’ বলে রামুকাকা নিজেই হেসে উঠল হো হো করে। কী রকম ছেলেমানুষটির মতো হাসে রামুকাকা! মনে হয়, রামুকাকা যেন আমার চেয়েও ছোটো।

ততক্ষণে আমিও হেসে ফেলেছি। আমি হেসেছি বলে আমার কানের ঝুমকো দুটোও হয়তো দুলে দুলে নেচে উঠেছিল। রামুকাকা দেখে ফেলেছে।

‘আরে! আরে! টায়রার কানে ও দুটো কী?’

আমি বললুম, ‘কাকা, কাকা, ঝুমকো। আজ তো আমার জন্মদিন, বাবা দিয়েছে।’

রামুকাকা কেমন খুশিতে আমায় জড়িয়ে ধরল। আমার চিবুক ধরে বলল, ‘বা, বা, বা, ভারি মানিয়েছে তো!’ অমনি দেখি গাধাটাও হেলে-দুলে তার ঘাড়টা নাড়ছে। গলার ঘন্টা ঠুংঠুং বেজে উঠছে।

জানো, রামুকাকার গাধার রংটা বাদামি। কানের কাছে সাদা-সাদা একটু ছোপ। আমার কিন্তু সাদা রংটা সবচেয়ে ভালো লাগে। সাদা ফুটফুটে ঘোড়াগুলো যখন চার পায়ে টগবগ করে ছোটে, কী সুন্দর দেখতে লাগে। আর সাদা ফুটফুটে হাঁসেরা যখন জলে সাঁতার কাটে, ভালো লাগে না? দুম্নাপুজোর সময় আমাদের এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে বক আসে। সাদা-সাদা বকগুলো কেমন উড়ে যায় দূর-আকাশে! কী ভালোই লাগে আমার। দুগ্নোপুজোর সময় দেখো, ওই নীল আকাশটার গায়ে একেবারে তুলোর মতো ধবধবে মেঘগুলো কেমন ভেসে বেড়ায়। তাইবলে কী বলবে, প্রজাপতি আমি ভালোবাসি না? খুউব। উঃ! কত রং প্রজাপতির পাখায়! আমি কুমোরকাকুকে দেখেছি, মাটির সরার ওপর মা-লক্ষ্মীর ছবি আঁকতে। কুমোরকাকু তুলি দিয়ে রং বুলিয়ে বুলিয়ে মা-লক্ষ্মীকে সাজিয়ে দিচ্ছে। লক্ষ্মীর ঠোঁট দুটি লাল টুকটুক। পায়ের পাতা আলতা-রাঙা। চোখ দুটিতে কাজল-টানা। কপালের। ঠিক মাঝখানটায় গোল নিটোল সিঁদুরের ফোঁটা। আচ্ছা, লক্ষ্মীঠাকুরকে রং দিয়ে না হয় কুমোরকাকু সাজায়। কিন্তু প্রজাপতির গায়ে রং দিয়ে কে আঁকিজুকি করে?

আমি না সেদিন রামুকাকার গাধার পিঠে চেপেছিলুম। অনেকক্ষণ থেকে ইচ্ছে করছিল একটু চাপি। কিন্তু ভয় লাগে তো! একেবারে নতুন মানুষকে পিঠে বসতে দেখলে যদি চার পা তুলে লাফায়! না, সেসব কিচ্ছুনা। গাধাটা ভারি ঠান্ডা। আমায় পিঠে নিয়ে ঠুকঠুক করে হাঁটতে লাগল। আমায় পিঠে নিয়ে ওর একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমি তো হালকা। বাববা, রামুকাকার মতো একটা হোঁৎকা মানুষকে পিঠে নিয়ে গাধাটা কী করে হাঁটছিল কে জানে! বাহাদুর বলতে হবে!

জানো, রামুকাকা না ভারি মজার মানুষ। শীতকালে করবে কী, মাথায় একটা পাগড়ি বাঁধবে। গায়ে কম্বল জড়াবে। রোদে পা দুটো ছড়িয়ে যখন সা-রে-গা-মা-পা-ধাকরে গান গাইবে, দেখলে তোমার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে। কত গল্প জানে। একবার রামুকাকার বাড়িতে একটা চোর ঢুকেছিল। তখন তো শীতকাল, আর নিশুতি রাত্তির। রামুকাকা কম্বল মুড়ি দিয়ে খুব ঘুমোচ্ছে। এদিকে চোরটাও ঘরে ঢুকেছে। ঢুকে, সিন্দুক হাতড়াচ্ছে। কিন্তু যা কিছু সম্পত্তি সব তো রামুকাকা একটা থলের মধ্যে পুরে, পেটের সঙ্গে কাপড়ে বেঁধে রাখে। চোর তো আর সে-কথা জানে না। সে সিন্দুক হাতড়াল। প্যাঁটরা-বাক্স ভাঙল। এটা ওটা উলটেপালটে দেখল, কিচ্ছু পেল না। না পেয়ে করেছে কী, রামুকাকা যে বিছানায় মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে, সেই বিছানায় উঠে বালিশের তলায় হাত দিয়ে খোঁজাখুঁজি লাগাল। ব্যস, রামুকাকার ঘুম ভেঙে গেছে। প্রথমটা কিছু বলেনি। চুপটি করে চোখ বুজে পড়ে রইল। চোরটা বালিশের নীচটা হাতড়াতে হাতড়াতে, কম্বলের ভেতর যখন হাত গলিয়ে দিল, তখনও রামুকাকা কিছু বললে না। মিথ্যে মিথ্যে নাক ডাকাতে লাগল। তারপর যেই চোরটা রামুকাকার পেটে হাত দিয়ে ফেলেছে, অমনি রামুকাকা খিলখিল করে হেসে ফেলেছে। কাতুকুতু লেগে গেছে তো! হাসতে হাসতে রামুকাকা চেঁচিয়ে উঠল, ‘পেট ছাড়, পেট ছাড়, হাসি পাচ্ছে।’ চোরটা তো হতভম্ব! তড়াং করে এক লাফ! রামুকাকাও। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে চোরকে জাপটে ধরেছে। চোরটা মাটিতে জিগবাজি মেরে রামুকাকার সঙ্গে ধস্তাধস্তি লাগিয়ে দিল। কিন্তু পারবে কেন রামুকাকার সঙ্গে? রামুকাকা একবার যদি চোরের ঘাড়ে চাপে তোরক্ষে আছে! পেট ফেটে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে চোরের কম্ম সারা! তাই রামুকাকা চোরকে জড়িয়ে ধরতে চোরের আর ট্যাঁ-ফু করার শক্তি নেই! দিলে ভ্যাঁ-অ্যাঁ করে কান্না জুড়ে।

রামুকাকার চেহারাটা অমন দত্যির মতো হলে কী হবে! মনটা একেবারে জলের মতো। চোরের কান্না শুনে ধমক দিল, ‘এই কাঁদছিস কেন?’

চোর তবুও কাঁদছে।

রামুকাকা এবার আরও চেঁচিয়ে উঠল, ‘কাঁদবি তো আমি তোকে কেটে ফেলব। আমি কান্না ফান্না সহ্য করতে পারি না।’ চোরটা বলল, ‘কাঁদব না? আমি ক-দিন কিছু খাইনি। ঘরে। বউ-ছেলে কিছু খেতে পায়নি।’

‘ঠিক আছে। এই নে, আর কাঁদবি না।’ বলে রামুকাকা চোরকে দেবে বলে ট্যাঁক থেকে থলিটা টেনে বার করল।

চোর তো থলি পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু কান্না থামল না। প্যানপ্যান করে কেঁদেই চলেছে।

রামুকাকা বলল, ‘ফের কাঁদছিস! ওই তো থলি দিয়েছি।’

চোর নাকি-সুরে বলল ‘শুধু থলিতে হবে না।’

‘তবে?

‘ঘাড়ে চাপব!’

রামুকাকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘাড়ে চাপবি? কার ঘাড়ে চাপবি?’

‘তোমার।‘

রামুকাকা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে! ভাবল, যাঃ বাবা, চোরটা ঘাড়ে চাপতে চায় কেন! দেখাই যাক। রামুকাকার গায়ে তো ভীষণ জোর। সঙ্গে সঙ্গে রোগা পটকা চোরটাকে চ্যাংদোলা করে ঘাড়ে তুলে নিল। জিজ্ঞেস করল, ‘এই তো ঘাড়ে তুলেছি। এইবার?’

‘এইবার বাইরে যাব।’

‘তাই চ।’ বলে রামুকাকা চোরটাকে ঘাড়ে নিয়ে, সেই কনকনে ঠান্ডা রাত্তিরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল।

বাইরে এসে চোরটা বলল, ‘নামব।’

‘কেন, ঘর যাবি না?

‘যাব। একা যাব। তোমায় আর কষ্ট দেব না।’

তখন রামুকাকা চোরটাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিল।

চোরটা কিন্তু বজ্জাতের হাড়! ঘাড় থেকে নেমে আচমকা রামুকাকার পেটে এমন গুঁতিয়ে দিল যে, রামুকাকা টাল সামলাতে পারল না। মাটিতে পড়ে গেল। চোরটাও রামুকাকার থলি নিয়ে পাঁই পাঁই করে মার ছুট। ছুটতে ছুটতে চেঁচল,

‘মোটা রামু বোকারাম, কেমন তোকে ঠকালাম!’

রামুকাকা একটি কথাও বলল না মুখ দিয়ে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল। যদিও কোমরটা টনটনাচ্ছে, তবু মুখে মুচকি মুচকি হাসি। মনে মনে বলল, ‘যা ব্যাটা, খুব বেঁচে গেলি। ঘরে গিয়ে বুঝবি আমি বোকারাম, না তুই ব্যাটা ঘুঘুর ডিম!

চোরটাকে কেন যে এ-কথা রামুকাকা বলেছিল, তখনও কেউ বোঝেনি। সেই রাত্তিরে আলো জ্বেলে যখন ভাঁড়ার ঘরে ঢুকেছিল, তখনও কেউ বুঝতে পারেনি। ভাঁড়ার ঘরে আনাজের চুপড়ি হাতড়ে, যখন টাকার থলিটা বার করে টাকা গুনতে বসল, তখন অবাক! আসলে কী হয়েছে, চোরের ভয়ে রামুকাকা রোজ রাত্তিরে শোবার সময় টাকার থলিটা আনাজের চুপড়িতে লুকিয়ে রেখে দেয়। আর অন্য একটা থলিতে ঠেসে খোলামকুচি পুরে। নিজের ট্যাঁকে বেঁধে রাখে। চোর আর অতশত জানবে কী করে? সে ভেবেছে ওইটাই বুঝি টাকার থলি।

উঃ! কী ঠকানই না ঠকিয়েছে রামুকাকা! রামুকাকাকে দেখতে অমন হলে কী হবে, এক নম্বরের চালাক।

জানো, কাল না মানার জন্মদিন। ক’দিন ধরে খুব বিষ্টি হচ্ছে আমাদের এখানে। মেঘের মুখখানা এখনও যেরকম গোমড়া হয়ে আছে, আমার ভয় করছে, কালও হয়তো মেঘ সরবে না। যদি চাঁদনা ওঠে! চাঁদ নাই বা উঠল, জন্মদিন তো ঠিক আসবে, বলো? রেশমি সুতির জামাটা কী সুন্দর! পরলে মানাকে ভারি ভালো লাগবে। মানা একটু রোগা। কিন্তু মুখখানা তো মিষ্টি। চন্দনের ফোঁটা দিয়ে যখন ওর গালের ওপর ফুল এঁকে দেব, তখন আরও ভালো লাগবে। আমি তা বলে তেমন আঁকতে পারি না। কিন্তু আমি ছাড়া ওর কপালে আর তো কেউ চন্দনের টিপ পরিয়ে দেবে না।

বর্ষা হলে মনটা আমার কেমন হয়ে যায়। তুমিও দেখো, আকাশ যখন মেঘে ভার হয়ে যায়, তখন, যাকে তুমি খুব ভালোবাসো, সে যদি অনেক দূরে থাকে, বার বার তার কথা তোমার মনে পড়বে। আমারও মনে পড়ছে। অন্য কারো কথা না। আমার মন কেমন করছে চাঁদের জন্যে। আকাশটা অমন মেঘে ঢাকা থাকলে, আর আকাশ ভেঙে অমন বিষ্টি হলে চাঁদ। উঠবে কেমন করে? চাঁদ না উঠলে আমার যে মনেই হবে না, এ দিনটা মানার জন্মদিন!

ব্যাংগুলো কী রা কাড়ছে বাবা! ওই তো থ্যাবড়া থ্যাবড়া একটু একটু চেহারা। কিন্তু গলার কী তেজ দেখো। কানের পর্দা যেন ফেটে যাচ্ছে। কাকগুলোও খুব জব্দ হয়েছে। বিষ্টিতে ভিজে চুপসে চুপটি করে বসে আছে।

আজ সারাদিন আমি মেঘের দিকে চেয়ে চেয়ে কাটিয়েছি। আজ মানাদের বাড়িও যেতে পারিনি। বাইরে একহাঁটু জল। আর এমন দমকা-দমকা হাওয়া দিচ্ছে! কে জানে, ঝড় উঠবে হয়তো।

সত্যি ঝড় উঠেছিল। মেঘ ডাকছিল। বাজ পড়ছিল আর এক নাগাড়ে আকাশ ভেঙে বর্ষা হচ্ছিল। আমি রাত্তিরবেলা যখন শুতে গেলুম তখন যেন বাইরে যুদ্ধ হচ্ছে।

শুয়ে শুয়ে কী ভাবনাই হচ্ছিল আমার। কী জানি ভাঙা ঘরে মাকে নিয়ে মানা এখন কী করছে! যতক্ষণ না চোখে ঘুম এসেছিল, ততক্ষণ আমি ভেবেছি। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি।

সকালবেলা যখন ঘুম ভেঙেছিল, তখনও ঝড় থামেনি, বৃষ্টিও ধরেনি। আমি রেশমি সুতোর জামাটা আমার কাপড়ের আঁচলে ঢেকে নিয়ে ভাবছিলুম, হয়তো ঝড় আর থামবে না। যাই, এখনই একবার দেখে আসি মানাকে। এখনই ওর গায়ে জামাটি পরিয়ে দিয়ে আসি!

আমার তো ছোট্ট একটা টোকা আছে। রথের দিনে মেলা বসে। কিনে দিয়েছে। প্রত্যেক বছর আমি রথ টানি। আমাদের রথটা তিনতলা। সেই ওপর তলায় জগন্নাথ, সুভদ্রা আর বলরামের আসন। কেমন বোনটিকে মাঝখানে আগলে রেখে দু-পাশে দু-ভাই বসে আছে। জগন্নাথের মাসির বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। কত লোক এ-গ্রাম ও-গ্রাম থেকে রথ টানতে আসে, আর জয় জগন্নাথ বলে জয়ধবনি দেয়। আমি জগন্নাথের জয় দিই খুব চেঁচিয়ে। কিন্তু অত লোকের মধ্যে আমার গলা কী আর কেউ শুনতে পায়। কেউ না পাক, জগন্নাথদেব তো পায়। মা বলে, ঠাকুর-দেবতাদের নাকি সব দিকে নজর। সবার কথা শুনতে পান। মন দিয়ে ডাকলে, সক্কলকে দয়া করেন।

রথের মেলার টোকাটা মাথায় দিয়ে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। জগন্নাথদেবের মুখখানি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি মনে মনে বললুম, ‘ঠাকুর, ঠাকুর একটু দয়া করো। আজ একবার চাঁদকে আকাশে উঠতে বলো। আজ মানার জন্মদিন।’

ঠাকুর আমার কথা শুনলেন কি না আমি কী করে বলব বলো! শুনলেও তো আমি জানতে পারব না। ওঁরা তো আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। চুপটি করে বসে থাকেন, আর পুজো হয়ে গেলে আমাদের পেসাদ দেন। ঠাকুরের মনের কথা ঠাকুরই জানেন।

মাথায় আমি টোকা রাখতেই পারছিলুম না। ঝড়ের হাওয়ায় বার বার উড়ে পড়ছিল। আমি মাকে বললুম ‘মা, আমি একটু আসছি, এ্যাঁ!’

মা জিজ্ঞেস করল, ‘ঝড়-জলে কোথায় যাচ্ছিস?’

আমি বললুম, ‘মানাদের বাড়ি। আজ তো মানার জন্মদিন।

মা আমার মুখের দিকে একবারটি তাকাল। শুধু একটিবার। তারপর বলল, ‘মানা নেই রে।’ বলেই মায়ের চোখ দুটি ছলছলিয়ে উঠল।

আমি কেমন চমকে উঠলুম। বললুম, ‘কেন, কোথা গেছে?”

মা বলল, ‘ওদের ঘর পড়ে গেছে।’ আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। আঁচল-চাপা মানার। রেশমি জামাটা আমার হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল। আমি আর কোনো কথা না বলে মায়ের সামনে দাঁড়িয়েই চেঁচিয়ে কেঁদে ফেললুম, ‘মানা-আ-আ।’ তারপর ছুট দিলুম। সেইবারই যেন প্রথম আমি মায়ের কথা শুনিনি।

ছুটতে ছুটতে জল থই থই রাস্তা পেরিয়ে কখন যে আমি মানাদের ভাঙা বাড়ির মাটির ওপর এসে দাঁড়ালুম, আমি নিজেই এখন জানি না। ছোট্ট কুঁড়েঘরটা ঝড়ের ঝাঁপটায় কোথায় যে হারিয়ে গেছে, আমি খুঁজেই পাচ্ছি না। আমার মনের ভেতরটা কী রকম কেঁদে উঠেছিল। কিন্তু চোখ দিয়ে একটুও জল পড়ছিল না। মনে হচ্ছিল, এখনই ছুটে যাই ঠাকুরের কাছে। বলি, ‘ঠাকুর, তোমায় যে এত করে ডাকলুম, কই, তুমি আমার কথা শুনলে না তো! তবে তুমি কার কথা শোনো?কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো?’

আমার আর ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। মানাদের ঘরের সামনে সজনে গাছটা এখনও আছে। কেন যে সেটা এখনও ঝড়ে মাটিতে উলটে পড়েনি, আমি কেমন করে বলব! গাছটাকে বড্ড ভালোবাসত মানা। নজর পড়তেই আমি ছুটে গিয়ে গাছের গুঁড়িটা দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলুম। তারপরেই আমায় কে যেন কাঁদিয়ে দিল। আমার দু-চোখ ফেটে জল এল। আমি গাছের গায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললুম। তারপর। ডাকলুম, ‘মানা-আ-আ।’ ডাকতে ডাকতে আমি ছুটতে লাগলুম। কোথায় ছুটছি আমি জানি না। মনে হচ্ছিল, এই ঝড়ের সঙ্গে আমি যুদ্ধ করি। মনে হচ্ছিল, এই রাক্ষুসির গলাটা টিপে দিয়ে ওকে শেষ করে দিই।

ছুটতে ছুটতে যে আমি টুংরি নদীর ধারে চলে এসেছি! এইখানটাই আমি আর মানা আগে কতদিন এসেছি। কতদিন এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোলামকুচি ছুঁড়ে আমরা দুজনে জলের বুকে ঝিলিমিলি খেলেছি। মানার সঙ্গে আমি পারতুম না। ও এমন হুঁড়ত, জলের ওপর লাফাতে লাফাতে খোলামকুচিটা কোথায় চলে যেত, আমি দেখতে পেতুম না।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন আমার মনে হয়, আমার মনের কথাটা কাউকে খুব চেঁচিয়ে বলি। কিন্তু এখানে তো কেউ নেই। কাকে বলব? কাকে জিজ্ঞেস করি মানার কথা? টুংরির বুকটা জলে জলে ছাপিয়ে গেছে। কী মস্ত মস্ত ঢেউ উঠছে ঝড়ের ঝাঁপটায়। আমার কিন্তু একটুও ভয় করছে না। আমার কেন মনে হল, এখন এখানে ও-ই আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু। আমি আনমনে কথা বলে ফেললুম। কথা বললুম টুংরির সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলুম, ‘নদী, নদী, মানাকে দেখেছ?’

নদী হঠাৎ কী রকম গর্জে উঠল। আমি দেখলুম, গর্জাতে গর্জাতে একটা মস্ত উঁচু আকাশছোঁয়া ঢেউ আমার দিকে ছুটে আসছে। আমি পেছন ফিরে পালাতে গেলুম। পারলুম না। ওই ঢেউটা একটা মস্ত অজগর সাপের মতন লকলক করতে করতে একেবারে আমার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল। আমি আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলুম। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলুম, ‘মা-আ-আ।’ তারপর গুড়গুড় করে ডাকতে ডাকতে একটার পর একটা ঢেউ এসে আমার ওপর আছড়ে আছড়ে পরতে লাগল। তখন আমার মনে হল টুংরি নদীটাই যেন। উপচে আমার ঘাড়ে এসে পড়ছে। আমি জলের সঙ্গে জল হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমি চেঁচাচ্ছি, পারছি না। আমি হাত তুলে যা পারছি ধরছি। ধরা যাচ্ছে না। খুব কষ্টে আবছা চোখে একবার ফুরসত পেয়েছিলুম আমি। তখন যেন আমার মনে হল, আমাদের গ্রামটাই টুংরি নদী হয়ে গেছে। কোথাও একটু ডাঙা নেই। আমার চারদিকে জল। আমার পেছনে, সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে, শুধু জল আর জল। ভয় হল, হয়তো এই জলের তলায় এক্ষুনি আমি তলিয়ে যাব। স্রোতের টানে হারিয়ে যাব। আমি মাকে বাবাকে কত ডাকলুম, কত কাঁদলুম, কেউ শুনল না। এবার আমি ঠিক বুঝতে পারছি, টুংরি আমায় টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। যতক্ষণ পেরেছি সাঁতার কেটেছি। যতক্ষণ পেরেছি আমার হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে বাঁচতে চেয়েছি। তারপর জলের তলায় তলিয়ে গেছি, না জলের ওপর ভেসে চলেছি আমি জানি না। আমার চোখ থেকে বাবার মুখখানা মনে পড়তে পড়তে কেমন ঝাপসা হয়ে গেল। মায়ের চোখ দুটি ভাবতে ভাবতে মিলিয়ে গেল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমাকে কে যেন জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। চেষ্টা করেও চোখের পাতা দুটি অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই।

কতক্ষণ আমার কিছু মনে ছিল না আমি জানি না। হয়তো অনেকক্ষণ। হয়তো অনেকক্ষণ পরেই হঠাৎ যেন টুং টুং করে বেজে বেজে একটি মিষ্টি সুর আমার কানে ভেসে আসছিল। ভোরবেলা পাখি ডাকলে দু-চোখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে যেমন তাদের আধো-আধো ডাক শুনতে পাই, শব্দটাও ঠিক তেমনি অস্পষ্ট, আবছা-আবছা। একবারটি মনে হল, আমি মায়ের পাশে ঘুমোচ্ছি। সকাল হয়ে গেছে, উঠতে হবে। তারপরই ভয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। মনে হল, টুংরি নদীর ঢেউ-এ আমি ঘুরপাক খাচ্ছি এখনও। আমি চমকে চোখ চেয়ে ফেললুম।

কী অন্ধকার! তোমায় বলব কী, আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলুম না। মনে হচ্ছে, আমি জলেকাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছি। হাঁপাচ্ছি আমি। আর ভীষণ কষ্টে ‘উঃ! আঃ,! করে খাতরাচ্ছি। ধড়ফড়িয়ে ওঠবার চেষ্টা করলুম। পারলুম না। উঠতে গিয়ে আমার গায়ে এমন ব্যথা লাগল যে, আমি তোমাদের তা বোঝাতেই পারব না। তখন আমি কী করে জানব বলো যে, টুংরির বানের জলে ভেসে এসে আমি একটা গভীর বনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি!

ওই টুংটুং শব্দটা আমার কানে যদি না আসত, আমি তা হলে নিশ্চয়ই ভাবতুম, হয়তো আমি অতল জলে ডুবে গেছি। আমি তো শুনেছি, জলের তলায় অন্ধকার। অন্ধকারের নীচে আরও অন্ধকার। তার নীচে নাকি পাতাল। পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদে হয়তো আলো আছে।

হঠাৎ আমার চোখে আলো পড়ল। ছোট্ট একটি ফোঁটার মতো এক টুকরো আলো। আর ঠিক তক্ষুনিই আমার যেন মনে হল, ওই টুং টুং শব্দটা মায়ের হাতের গয়নার ঝুনঝুনি। আর ওই আলোর ফোঁটাটি যেন মায়ের হাতে প্রদীপ। মা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে অমনি সন্ধে দেয় রোজ। শুনলে তুমি খুশি হবে কি না জানি না। তবু বলছি, আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি, একটুখানি ওই আলোটা আর মিষ্টি মিষ্টি এই শব্দটা দূর থেকে এদিকেই এগিয়ে আসছে। ঠিক আমার দিকে। যত কাছে এগিয়ে আসছে, আমার বুকের ভেতরে ততই কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। আমার মন বলছে, আমি চেঁচিয়ে ডাকি। কিন্তু কিছুতেই পারছি না। গলা আমার কথা বলছে না। শুকিয়ে গেছে।

আলোটা এত কাছে এসে গেল, যে, আমি এবার সব দেখতে পেলুম। দেখতে পেলুম, একটি লোক। তার মাথায় পাগড়ি। হাতে একটি লণ্ঠন। কাঁধে একটা বর্শা। বর্শার আগায়। একটি থলি বাঁধা। আমাকে দেখতে পেয়ে লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকে দেখে। আমার একটুও ভয় করল না। একবারও মনে হল না, লোকটা যদি ডাকাত হয়! আর ডাকাত হলেই বা কী! আমাকে মারবে? কিন্তু তাকে দেখে আমার একবারও তা মনে হল না। উলটে আমার যে কী আনন্দ হল, আমি সে-কথা এখন বলতেই পারব না।

আমাকে দেখে লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। আর একবার উঠে বসবার চেষ্টা করলুম, পারলুম না।

লোকটি আমার দিকে হেঁট হয়ে দেখল। আলোটা মাটিতে নামাল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?

আমি ঠোঁট নাড়লুম। কথা বলতে চেষ্টা করলুম। কিন্তু কথা আমার বেরুল না। আমার মনে। হল, সব কথা আমার গলায় আটকে গেছে। অনেক কষ্ট করেও কিছু বলতে পারছি না।

লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’ আমি পড়ে পড়ে বোবার মতো চেয়ে রইলুম। আর মনে মনে ভাবলুম, আহা! ও যদি আমায় একটু বসিয়ে দেয়!

‘তোমার বাড়ি কোথা?

আমি তবুও বলতে পারলুম না। এবার আমার চোখ দুটি কেঁদে ফেলল।

লোকটি আদর করে আমার কপালে হাত দিল। কপাল থেকে চুলগুলি সরিয়ে দিল। আমায় কোলে তুলে নিল। আমার এই ছোট্ট শরীরটা ওর হাতের ছোঁয়া লেগে খুশিতে কেমন যেন চমকে উঠল। আমি ওর বুকে মাথা রাখলুম। আমার অবশ হাত দুটি দিয়ে ওর গলাটি জড়িয়ে ধরতে চাইলুম। আমি পারলুম কি না, জানি না। কিন্তু ওর বুকে মাথা রাখতেই আমার চোখ দুটি আবার কেমন যেন বুজে গেল। আমি অনেক চেষ্টা করেছি চেয়ে থাকতে। পারিনি। কে যেন আমায় জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিল।

কতক্ষণ পর আমার আবার যে ঘুম ভাঙল তা আমি জানি না। আমি দেখলুম দিনের আলো ফুটেছে। আমি একটা বিছানায় শুয়ে আছি। একটা ছোট্ট ঘর। ঘরের জানলা দিয়ে রোদের আলো ছড়িয়ে আছে। আর সেই লোকটি আমার মুখের দিকে চেয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার ভীষণ জল তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছি না।

আমায় কিছু বলতেও হল না। লোকটি নিজেই এক বাটি দুধ নিয়ে এল। আমার মুখে একটু একটু করে ঢেলে দিল। আঃ! আমার যে কী ভালো লাগছে। আমার বুকটা শুকিয়ে গেছে। একটু জলের জন্যে। হয়তো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। তখন হয়তো আমি আর কোনোদিন চোখ চাইতে পারতুম না। সত্যি বলছি বিশ্বাস করো, তখন ওই লোকটির হাত দুটি ধরে। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, তুমি কত ভালো লোক। আর মনে হচ্ছিল খুব চেঁচিয়ে আমি কাঁদি, খুব কাঁদি!

আচ্ছা, বলো কাঁদব না? ওই লোকটি যদি না দেখত, আমায় কে বাঁচাত? কে আমায় ওই গভীর বন থেকে তুলে এনে এমন করে আদর করত? লোকটি আদর পেয়ে আমার মন। বলছে, আমি আবার উঠে দাঁড়াব। আমি ভালো হয়ে বাড়ি যাব। মা আর বাবাকে আমি আবার দেখতে পাব।

জানো, ক-দিন পরে না, আমি সত্যি ভালো হয়ে গেছি। আমার আর কিছু কষ্ট নেই। আমি এখন নিজে নিজেই বসতে পারি। একটু একটু হাঁটতে পারি। খুব যখন ইচ্ছে হয়, ওই লোকটির হাত ধরে বাইরে যেতে পারি। তবু আমি কাঁদি। রোজ রোজ কাঁদি। জানলায় মাথা রেখে বাইরের দিকে যখন চেয়ে থাকি আমি, আমারচোখ দুটি কান্নায় উপচে পড়ে। কেন জানো? আমি না আর কথা বলতে পারি না! আমায় কতবার ওই লোকটি জিজ্ঞেস করেছে, আমার নাম কী, আমার বাড়ি কোথায়? আমি বলতে পারি না। আমি বলতে পারি না– আমার নাম টায়রা। আমাদের বাড়ি টুংরি নদীর ধারে, আর সজনে গাছটা একা-একা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ওখানে মানাদের বাড়ি। আমি যদি কথা না বলতে পারি, লোকটি কী করে বলো?কী করে আমায় পৌঁছে দেবে আমাদের বাড়ি?বলল, কে আমার কথা কেড়ে নিল এমন করে? কেন কেড়ে নিল বলোনা! তবে কি টুংরি নদীটা কথা বলতে পারে না বলে, ওর হিংসে হয়েছিল আমার ওপর? তাই আমাকে এমন করে বোবা করে দিল! আমি এখন কেমন করে আবার মাকে ডাকব। আমি কেমন করে বলব, ‘বাবা, রুপো-রুপো ওই খয়রা মাছটা আমায় দেবে, আমি ভাজা করে দেব, মানা খাবে। খয়রা মাছ ভাজা খেতে ও খুব ভালোবাসে।’

আমি কবে আবার মাকে বাবাকে দেখতে পাব, জানি না। জানি না, সাঁঝেরবেলা নৌকো চেপে আমি বাবার পাশে বসে আবার গান গাইতে পারব কি না। জানি না এখন, কিচ্ছু জানি না। শুধু জানি ওই জানলাটা এখন আমার বন্ধু। ওর গরাদে গাল দুটি ছুঁইয়ে রেখে এখন বাইরে চেয়ে থাকতেই আমার ভালো লাগে। আর ভালো লাগে ভাবতে, বাবা যদি কোনোদিন এ-পথ দিয়ে যায়, আমি দেখতে পাব। তারপর ছুটে গিয়ে বাবার দু-হাতের মধ্যে হারিয়ে যাব।

ভারি ঝকঝকে এই ঘরটা। ছোট্ট কিন্তু আলোয় ভরতি। এটা তো বনের ধার। তাই তুমি যদি জানলা দিয়ে মুখ বাড়াও, দেখতে পাবে, সামনে খালি বন আর বন। থমথম করছে। দেখলে তোমার ভয় করবে কি না জানি না, আমার কিন্তু ভালো লাগে।

কত রং-বেরঙের পাখি আসে এদিকে। আমার এই জানলাটার সামনে, ওই যে মাধবী ফুলের গাছটা লতিয়ে লতিয়ে ছাতে উঠে গেছে, ওখানে ওরা লুকোচুরি খেলে কেমন! আমি যখন হাত বাড়াই, ওরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। ভাবে হয়তো, এ মেয়েটা কে আবার আমাদের পাড়ায় এসেছে! জানো, একদিন না একটা হরিণ এসেছিল। মা-হরিণ। কী মিষ্টি কচি দুটো বাচ্চা সঙ্গে! কী সুন্দর চোখগুলি! আর তাদের শিংগুলো যেন গাছের ডালপালা। আমার বাচ্চা দুটোকে এত আদর করতে ইচ্ছে করছিল! আমি জানলা। দিয়ে হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছিলুম। ও মা! মা-হরিণটা পালিয়ে গেল। আর বাচ্চা দুটো জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে, আমার হাতটা কেমন চেটে দিলে। আমি ছুট্টে বাইরে বেরিয়ে গেলুম। দুটোকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলুম। কিন্তু মা-হরিণটা এমন দুষ্টু! এমন তেড়ে এল আমায়, আমি ছুট্টে ঘরে ঢুকতে পথ পাই না। বাবা! একবার গুঁতিয়ে দিলে রক্ষে আছে!

লোকটি কিন্তু আমায় খুব ভালোবাসে। দেখলে মনে হয় ও যেন আমার বাবার চেয়েও অনেক বড়। বাবার তো একটিও চুল পাকেনি। আমি মনে মনে ভাবি, ও আমার দাদু। কিন্তু মুখে তো বলতে পারি না! তবু ভাবি, দাদু বলে যদি একবার ডাকতে পারি! একবার যদি বলতে পারি, ‘দাদু, তুমি এত ভালো লোক!’

ভালোই তো। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে, একটা কোথাকার-কে বোবা মেয়ের জন্যে কে এমন করে? কিন্তু দাদু তো জানে না, আমি কোনোদিনই এমন বোবা ছিলুম না। আমি তো বোবা হয়ে গেছি। দাদু আমার জন্যে কী সুন্দর শাড়ি এনে দিয়েছে। টুকটুকে আলতাপাতা কিনে দিয়েছে। চুড়ি এনে দিয়েছে। আমি কিন্তু সাজতে পারি না। কিছুতেই পারি না। সাজতে গেলেই মায়ের মুখখানি স্পষ্ট আমার মনে পড়ে যায়! তখন আমার চোখ দুটিও টুলটুল করে উপছে পড়ে। আমায় কাঁদতে দেখলে দাদু আমায় এত আদর করে। বলে, ‘ভয় কিরে!’ আমি তো আছি!’ কিন্তু কতদিন পরের ঘরের এমন বোঝা হয়ে থাকতে পারে মানুষ!

দাদুকে আর আমার পর মনে হয় না। এত হাসিখুশি মানুষ। আমাকে যেন কেমন করে আপন করে নিয়েছে। আমার ভারি দুঃখ হয় দাদুর জন্যে। জানো, দাদুর কেউ নেই। একটি ছেলে ছিল। যুদ্ধে গেছল, ফেরেনি। আচ্ছা, যুদ্ধ কেন হয় বলো তো? কেন বলো তো অত বড়ো বড়ো মানুষগুলো নিজেরা মারামারি করে, রক্তারক্তি করে? ওরা এত নিষ্ঠুর কেন? ওদের কি একটুও দয়ামায়া নেই? আমায় তো সক্কলে ভালোবাসে। তেমনি সবাই সবাইকে ভালোবাসে না কেন? ভালোবাসলে তো আর যুদ্ধ হয় না।

দাদু ডাক-হরকরা। রোজ রাত দুপুরে, কাঁধে বর্শা নিয়ে, তাতে চিঠির থলি বেঁধে, লণ্ঠন জ্বেলে দাদু ওই বন পেরিয়ে শহরে যায় চিঠি বিলি করতে। দেখে আমার কী রকম কষ্ট। লাগে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, ‘দাদু এ কাজটা তুমি ছেড়ে দাও।’ কিন্তু আমি তো বলতে পারি না। শুধু দাদুর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। দাদু হয়তো চোখ দেখে আমার মনের কথা বুঝতে পারে। তাই বলে, ‘আমার জন্যে তোর কষ্ট হয়, না রে?’

আমি মুখ বুজে ঘাড় নাড়ি–হ্যাঁ।

দাদু বলে, ‘না রে, আমার তা বলে কিছু কষ্ট হয় না, আমার তো অভ্যেস।’

আমি মুখ নেড়ে, হাত নেড়ে অনেক চেষ্টা করে যে কথাটা বোঝাতে চাই, দাদু ঠিক বুঝতে পারে। জিজ্ঞেস করে, ‘ডাকাত?’

ঠিক ধরেছে দাদু। আমিও ঠিক বুঝেছি, ডাকাতের নাম শুনে ভয়ে চোখ দুটো আমার চমকে উঠল!

প্রচণ্ড চিৎকার করে দরাজ গলায় হেসে ওঠে দাদু। হাসতে হাসতেই বলল, ‘এইটুকু বয়স থেকে আমি এ-কাজ করছি। ডাকাত আমার কী করবে! জানিস, আমি লাঠিয়াল। আমি একা একশোটা ডাকাতের সঙ্গে লড়তে পারি।’

বলতে বলতে দাদুর বুকটা সাহসে ফুলে উঠল। দাদুর সাহস দেখে, আমারও কেমন সাহস বেড়ে যায়।

রোজ রাত্তিরে দাদু যখন চিঠি বিলি করতে যায়, আমায় বলে যায়, ‘সাবধানে থাকবে। দরজা খুলোনা যেন।’