আজব বাঘের আজগুবি – ৩

১১.

বেশিক্ষণ হাসতে হল না। সা-রে-গা-মা-ও শিখতে হল না। যা ভেবেছি তাই! আবার ঘোড়া ছুটে আসছে! শব্দ পাচ্ছি! এইবার নির্ঘাত বিপদ! ছেলেটিও শুনতে পেয়েছে। এবার যেন অনেক ঘোড়ার পায়ের শব্দ। ছেলেটি চটপট বেহালাটা অন্ধকারে সরিয়ে রেখে আমায় বলল, ‘ওরা নিশ্চয়ই আবার আসছে! তুই লুকিয়ে পড়!’ বলে নিজে ছুটে চলে গেল দস্যুদের সেই বন্দুকগুলো যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই ঝোপের মধ্যে। আর আমিও লুকিয়ে পড়লুম একটা মস্ত ঝাঁকড়া গাছের আড়ালে।

দেখতে দেখতে দস্যুর দল সেখানে হাজির। এবার একজন-দুজন নয়। অগুনতি। এবার ওদের সঙ্গে লড়া, আমার একার কম্ম নয়। কারণ, এবার ওরা তৈরি হয়ে এসেছে। বাহাদুরি দেখাতে গেলে, নিস্তার নেই!

দস্যুগুলো সামনে এসে দাঁড়াল। অন্ধকার রাত্তির বলে ঠাওর করতে ওদের মুশকিল হচ্ছে। ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝটপট নেমে পড়ল। একটু আগে যে-দস্যুগুলোকে আমি মেরে ফেলে রেখেছি, সেগুলোকে নেড়েচেড়ে দেখল। যদি কেউ বেঁচে থাকে! যখন দেখল কেউ বেঁচে নেই, তখন বন্দুক উঁচিয়ে সেই জায়গাটা ঘিরে ফেলল। খোঁজাখুঁজি করতে লাগল।

‘গুডুম!’ হঠাৎ বন্দুক গর্জে উঠল। আমি ঠিক দেখতে পেলুম, ছেলেটি যে ঝোপটার ভেতরে বসে আছে, সেখান থেকে গুলি ছুটে এসে একটা দস্যুর বুকে বিঁধেছে। চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল দস্যুটা। সঙ্গে সঙ্গে আর সকলে ঝপাঝপ মাটিতে শুয়ে পড়ল। বন্দুক উঁচিয়ে, হামাগুড়ি দিতে দিতে ওই ঝোপের দিকে এগিয়ে চলেছে তারা। আবার ঝোপের ভেতর থেকে শব্দ এল, ‘গুড়ুম!’

‘গুড়ুম! গুড়ুম!’ দস্যুরাও বন্দুক ছুড়ল।

তারপর ঝোপের ভেতর থেকে আর দস্যুদের বন্দুক থেকে শব্দ আর শব্দ, ‘গুড়ুম! গুড়ুম!” সত্যিকারের একটা যুদ্ধ লেগে গেল দস্যুদের সঙ্গে ছেলেটির।

কতক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলেছিল, আমি বলতে পারব না। জানি না, যুদ্ধে কটা দস্যু মরেছিল। কিন্তু খানিক পরেই ছেলেটির বন্দুক থেমে গেল। তখনই আমার ভয় হয়েছিল, বন্দুকের গুলি বোধ হয় ফুরিয়ে গেছে!

আমার কথা মিথ্যে নয়। এবার দস্যুর দল আগের মতোই মাটি কামড়ে গুঁড়িশুড়ি মেরে চারদিক থেকে ওই ঝোপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ঝোপ ছেড়ে ছেলেটি ছুটতে গেল, কিন্তু পারল না। ছেলেটিকে দস্যুর দল হ্যাঁচড়া-টানে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে, ছুট দিল। ছেলেটি হাত-পা ছুঁড়ে ছটফটিয়েও আর ছাড়ান পেল না। একবার মনে হয়েছিল, আমি লাফিয়ে পড়ি ওদের ওপর। সাহস হল না। ভেবেছি, হট করে এমন কাজ করাটা ঠিক না। তাহলে আমাকেও মরতে হবে। তুমি হয়তো আমার এ-কথা শুনে ভাবছ, আমি এক নম্বরের ভীতু। ভীষণ স্বার্থপর। ভাবতে পারো। কিন্তু একটা কথা শুনে রাখলে ভালো করবে। অনেক সময় খামোকা গাজোয়ারি করার চেয়েও বুদ্ধির জোরে কাজ হয় অনেক বেশি। তাই ওরা যখন ছেলেটিকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে ছুট দিল, আমিও তখন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছি। ওই যে বেহালাটা মাটিতে পড়েছিল, ওটা মুখে নিয়ে নিঃসাড়ে ঘোড়ার পিছনে আমিও ছুট দিয়েছি।

একটা যে বাঘ ওদের পেছনে পেছনে ছুটছে, এটা কিন্তু ওরা খেয়ালই করেনি। ওরা জানতে পারল না, ওদের পেছনে যম। জানতে পারা সম্ভবও নয়। কারণ, ওরা তখন শিকার ধরে জয়ের আনন্দে দিশেহারা। আর আমি তখন শিকার ধরবার জন্যে সাবধানে তাদের পেছনে। লাফিয়ে ছুটছি।

.

১২.

ছুটতে ছুটতে ওরা বন পেরিয়ে গেল। বোধ হয় শহরে পড়ল। বিপদ আমার। কেননা, বন জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু শহরে তো তা হবার যো নেই। পরিষ্কার ঝরঝরে রাস্তাঘাট। লুকোবার জায়গাই নেই। আমি চেয়ে দেখি, ঠাকমা যেমন আমায় বলেছিল, শহরটা ঠিক তেমনি। এ-পাশে ও-পাশে বড়ো বড়ো কোঠাবাড়ি। কিন্তু রক্ষে এই, তখন নিজঝুম রাত্তির। লোকজন সব ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা।

আমি দেখলুম, ছেলেটিকে জাপটে ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে দস্যুর দল একটা মস্ত বাড়ির ফটক। পেরিয়ে ঢুকে গেল। বাইরে থেকে বাড়ির চেহারা দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না, এইটা রাজপ্রাসাদ। ওরা তো ঢুকে গেল গটগটিয়ে। কিন্তু বাঘ কেমন করে ঢুকবে? চোরের মতো আর সকলের চোখ এড়িয়ে টুপ করে তো আর ঢুকে পড়তে পারবো না! আমার চেহারাটা। যদি ছোটোখাটো হত তা হলে ভাবনা ছিল না। এই পেল্লাই দেহটা নিয়ে অন্যের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুখের কথা নয়! তার ওপর আবার ফটকের সামনেও বন্দুক উঁচিয়ে দু-দুজন দস্যু-পাহারাদার দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় আমি বাঘ না হয়ে, বাঘের মাসি হলে ভালো। হত!

আমার মাসিকে আমি কখনো দেখিনি। শুনেছি, আমার মাসির চেহারাটা খুব ছোট্টখাট্টো! মাসি আমার রান্নাঘরে, ভাঁড়ারঘরে হুট হুট করে ঢুকে পড়তে পারে। মাছটা, দুধটা উলটে পালটে খেয়ে ফেললেও কেউ জানতে পারে না। আমার মাসিকে অবশ্য তোমরা সবাই চেনো। অনেকে আদর করে ঘরে পোষ মানাও। ভালোবেসে ডাক দাও, ‘মিনি-মিনি-মিনি!’

কিন্তু সে তো হল। এখন তো যা-হোক করে আমাকে রাজপ্রাসাদের ভেতরে যেতেই হয়। দেরি হয়ে গেলে, ছেলেটিকে হয়তো আর আস্তই রাখবে না। যেমন করে হোক তাকে বাঁচাতেই হবে। এখন ঝঞ্ঝাট আমার এই বেহালাটা নিয়ে। বাজনাটাকে কোথাও লুকিয়ে না রাখলে বাজনাটাও যাবে আর আমারও অসুবিধে। কিন্তু রাখি কোথায়?

এখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তে দেখি, রাজপ্রাসাদের প্রায় সামনা সামনি একটা বেশ উঁচু বাড়ি। ইচ্ছে করলে, এই বাড়িটার ছাতে উঠে পড়া যায়। সেই ভাল! রাতদুপুরে বাড়ির লোকজনেরাও সবাই ঘুমিয়ে আছে। এই তাল। আমি এগিয়ে গেলুম। সাঁই করে বাড়ির পাঁচিলে লাফ দিলুম। পাঁচিলের ওপর ডিঙি মেরে ছাতের ওপর টপকে উঠে পড়লুম। ছাতের এইখানে, এই কোণে বেহালাটা লুকিয়ে রাখলে কেউ দেখতে পাবে না। বেশ ঘুপচি। আমার মুখ থেকে নামিয়ে বেহালাটা এইখানেই রেখে দিলুম।

ছাতটা সত্যিই বেশ নির্ঝঞ্ঝাট। আমি এখানে দিনের পর দিন যদি ঘাপটি মেরে বসে থাকি তা হলেও কেউ দেখতে পাবে না। অথচ আমার সব কিছু দেখতে অসুবিধা নেই। অন্ধকারেও রাজপ্রাসাদটা বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রাজপ্রাসাদের গা বরাবর একটা মস্ত ঝিল। জল চিকচিক করছে। অবশ্য দেখতে পাচ্ছি রাজপ্রাসাদের বাইরেটা। ভেতরে কী হয় না-হয় মা ভগাই জানে। কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। ছেলেটিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে কী করল কে জানে!

ঝটপট আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। মনে হল, অন্তত ওই ফটকের পাহারাদার দুটোকে যদি শেষ করে ফেলতে পারি, তাহলে ফটক পেরিয়ে প্রাসাদের ভেতরে তো ঢাকা যায়! কিন্তু আমি জানতুম না, ভেতরেও অগুনতি পাহারাদার। না-জেনেই আমি আবার ছাত থেকে লাফ মেরেছি। গুঁড়িগুঁড়ি মেরে ফটকের সামনে হাজির হয়েছি। ওরা তো আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখতে পাওয়ার সুযোগই দিলুম না। ধাঁই করে একটার ওপর মেরেছি লাফ। একটি থাপ্পড়েই বাছাধন ছিটকে পড়ে অক্কা গেল। আর একজন সেই দেখে পালাতে যাবে কী, আমি তার উঁটিটা টিপে ধরতেই, তিনি আর মা বলবার সময়ই পেলেন না। দুটোকেই ওখান থেকে চটপট সরিয়ে ফেললুম। পাশের ঝিলটার মধ্যে টেনে নিয়ে ফেলে দিলুম। জলের ভেতর দুজনেই ডুবে রইল। দেখলুম, ঝিলের জল ওদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। ওদের যেখানে মেরেছিলুম সেই রাস্তাটা, ফটকের সামনেটাও যে তাদের রক্তে লাল হয়েছিল, সেটা অবশ্য আমি দেখবার সময় পাইনি। কেননা, ওদের ঝিলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেই আমি রাজপ্রাসাদের ফটকের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। 

ফটক ডিঙিয়েই দেখি, সামনে ইয়া লম্বা একটা চত্বর। এমন খোলামেলা যে গা-ঢাকা দেওয়া অসম্ভব। তার ওপর চত্বরেও দেখি, জনা পাঁচেক দস্যু বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। দেখে মনে হল, আমি যে ওদের দুজন সঙ্গীকে খতম করে ফেলেছি, ওরা সেটা টেরই পায়নি। রাতটা অন্ধকার বলে তাই। তা না হলে জেনে রাখো, ওরা আমায় নির্ঘাত দেখে ফেলত! তারপর কী হত, সে তো বুঝতেই পারো! এগিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হল না। অগত্যা আমি চত্বরের একটি কোণে জুজুবুড়ির মতো বসে রইলুম! দেখতে পেলুম রাজবাড়ির ওপর দিকে বারান্দাটা একদম ফাঁকা। ইচ্ছে করলে লাফ মেরে উঠে পড়তে পারি। ওখানে উঠে, লুকিয়ে থাকলে কেউ কিসসু বুঝতেই পারবে না। কিন্তু, আসলে আমি তো লুকিয়ে থাকতে আসিনি। ছেলেটিকে উদ্ধার করতে এসেছি। আশ্চর্য, তার তো কোনো পাত্তাই নেই!

এমন সময় হঠাৎ যেন বাইরে একটা কাক ডেকে উঠল। একটা ডাকল বলে সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ডাকল। তারপর এমনি করে একটি দুটি ডাকতে ডাকতে অনেক ক-টি কা কা শুরু করে দিল। আমি একদম বুঝতে পারিনি, এতো তাড়াতাড়ি রাত কেটে ভোর হয়ে আসছে। এইরে! এইবারেই তো বিপদ! আমি এক্কেবারে বুদ্ধ বনে গেছি। আমার মাথায়। একবারও এল না, রাতের অন্ধকার চিরটাকাল ধরে আকাশের গলা জড়িয়ে বসে থাকবে না। আলো আসবেই। না, আর বোধ হয় ছেলেটিকে বাঁচাতে পারলুম না। দিনের আলো স্পষ্ট ফোঁটার আগেই এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। কিন্তু কোথায় যো কাটবো, জানি না।

ঠাকমার মুখে শুনেছি, শহরটা গাঁ-ঘরের মতো নয়। গাঁ-ঘরে লোকজন কম। গাছপালা, ঝোপঝাড় আছে। তবু লুকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু শহরে সেটি হবার যো নেই। এক্ষুনি ঘুম ভাঙলেই সব হইহই করে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। মাঠে, বাজারে লোকে লোকে ছয়লাপ হয়ে যাবে। আমি বেরিয়ে পড়লুম রাজপ্রাসাদ থেকে। ভাবলুম কী করি! ছুট দেব! কিন্তু ছুটবো কোনদিকে, কোথায় ছুটবো? রাস্তাঘাট কিছু চিনি না। আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন ভীষণ প্যাঁচে পড়ে গেছি।

বলতে বলতেই হাত-পা কেঁপে উঠল। সাংঘাতিক ব্যাপার। দেখি, রাস্তায় একটি-দুটি লোক হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়েই বা থাকি কী করে?

মাথায় যখন কোনো বুদ্ধি আসছে না, তখন যে বিপদ আমার ঘাড়ের ওপর এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে, সেটুকু বুঝতে পারছি। তাই আগু পিছু না ভেবে, যে-ছাতে বেহালাটা লুকিয়ে রেখে এসেছি, সেইখানেই আবার লাফিয়ে উঠে লুকিয়ে রইলুম। অন্তত এখনকার মতো তো থাকা যাক। তারপর দেখা যাবে।

ভাগ্যি ভালো যে, এই বাড়ির এখনও কারো ঘুম ভাঙেনি। তাই আমিও নিঝাটে উঠতে পেরেছি। ছাতের ওপর উপুড় হয়ে বসে রইলুম।

.

১৩.

দেখতে দেখতে আকাশ ফরসা হয়ে গেল। চারিদিকে লোকজন চলাফেরা শুরু করে দিল। কথা-কওয়া, চান-খাওয়া, অফিস-যাওয়া চালু হয়ে গেল। বোঝো এখন কাকে বলে ঠেলার নাম বাবাজি! তুমি হয়তো বলবে, ‘কী দরকার ছিল তোমার অমন বাহাদুরি দেখানোর? ছেলেটার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে লাভটা কী হল? বাঘের ছেলে, বাঘের মতো, বাঘের বনেই থাকলে পারতে! এখন কেমন জব্দ!’

তা বলতে পারো জব্দ হয়েছি। তা নইলে বাঘ বলে বাঘ, সে কিনা ছাতের কোণে লুকিয়ে বসে আছে! লোকে শুনলে থুথু করবে না? তা ছাড়া এই চৌদিক ফাঁকা ছাতের ওপর, একটা ধুমসো বাঘ কতক্ষণই বা চোরের মতো বসে থাকতে পারে? নিজেরই এখন। নিজেকে ছ্যাঃ ছ্যাঃ বলে ভ্যাংচাতে ইচ্ছে করছে। ওদিকে যার জন্যে এতখানি ছুটে আসা, ধড়িবাজ দস্যুর দল এখনও তাকে আস্ত রেখেছে বলে মনে তো হয় না। কারণ, এখান থেকে বসে বসে রাজপ্রাসাদের মধ্যে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা জানার তো কোনোই উপায় নেই। তবে এখন এটাকে রাজপ্রাসাদ না বলে সিধেসিধি দস্যুপ্রাসাদ বলা ভালো। কেননা, প্রাসাদটা তো এখন রাজার নয়। রাজাকে বন্দি করে, রাজপ্রাসাদটা কেড়ে নিয়ে, গোটা রাজত্বটাই এখন হুড্ডা-গুড়া দখল করে বসে আছে। তাই বলতে পারো, এখন হুড়া গুড়া এখানকার রাজা। তাই-ই হয়! তুমি ভালো হও, চাইনাই হও, তোমার বুদ্ধি থাকুক আর নাই থাকুক, তোমার কাছে বন্দুক, গোলা, কামান থাকলেই হচ্ছে। দুম-দাম, গুড়ুম গুড়ুম ছুড়বে, দেখবে জবরদস্ত রাজা-উজিরও ল্যাজ নাড়তে নাড়তে তোমায় খাতির করবে। তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচানাচি করবে।

এ-সব মানুষের বেলায়। তবে আমাদের ওটি পাবে না। ওই তো আমার বুড়ি ঠাকমা, ইচ্ছে। করলে তো গায়ে পড়ে মানুষের সঙ্গে ভাব করতে পারত। করলে তার উলটে মানুষের গুলিতে বীরের মতো প্রাণ দিল। আর আমি? আমার কথা ধরো। এইতো আমার পিঠে গুলির দাগটা এখনও দগদগে হয়ে আছে। ঠিক কথা, রক্ত পড়া থেমেছে, কিন্তু এখনও তো একটু একটু জ্বালা আছে। তাই বলে কি আমি পা জড়িয়ে মানুষের খোসামোদি করতে গেছি! বয়ে গেছে! আমি বাঘের ছা। ও ধাতুতে আমরা গড়া নই।

একটু একটু ঘুম পাচ্ছে। তার মানে আমার ভয় কেটে গেছে। তুমি দেখো, ভয় যখন পায়, তখন ঘুম পায় না। আর ঘুম যখন পায়, তখন ভয় পায় না। ঘুমের আর দোষ দেব কী! কাল রাত থেকে যা ধকল যাচ্ছে। মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে, শেষে ছেলেটার পাল্লায় পড়ে এমন। জড়িয়ে গেছি! জড়ানো উচিত ছিল না। কিন্তু বাঘ হলেও আমার তো একটু-আধটু দয়া-মায়া থাকতে পারে! মোদ্দা কথাটা ভুলো না কেউ, আমার জন্ম একটা খাঁটি আর সত্যিকারের রাজবংশে! তার মানে, আমাকে তুমি জানোয়ার বলতে পারো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে হবে, আমি বনের রাজা!

‘দুম’-কী সাংঘাতিক শব্দ! ভাবা যায় না, এই সক্কালবেলা এমন একটা শব্দ আচমকা অমন করে ফেটে পড়বে। সত্যি বলছি, আমি চমকে উঠেছি। আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল ভয়ংকর। ছাতের আলসের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, ঘোড়ার পিঠে দস্যু। একটি বোমা ফেটেছে ঠিক রাজবাড়ির ফটকের সামনে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেতে খেতে আকাশে উঠছে। সারাটা জায়গায় অন্ধকার। দেখো, রাস্তার লোকগুলো চিল-চেঁচাতে চেঁচাতে কী রকম পাঁই পাঁই করে ছুট দিয়েছে। আবার বোমা ফাটাল, ‘দুম! দুম!’ দস্যুর দল ঘোড়া ছুটিয়ে হল্লা শুরু করে দিল, ‘হাট যাও হাটো, হাটো।’ রাস্তার লোকেরা কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পগারপার! কী, ব্যাপারটা কী? তাহলে কি কাল রাতে যে দুটো পাহারাদারকে মেরেছি, তার খবর পেয়ে দস্যুর দল খেপেছে!

চক্ষের নিমেষে রাস্তাঘাট সব খাঁ খাঁ। যে যেদিকে পারল ভেগে পড়ল। ঘরদোর সব বন্ধ হল। ঘোড়সওয়ার দস্যুগুলো ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে তাণ্ডব নাচ শুরু করে দিল। ওদের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে, যদি কেউ এদিকে আসে কিংবা যদি কেউ ঘরের জানলা দরজা খোলে তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। এ তো আচ্ছা রাজার রাজত্ব! বটেই তো! রাজত্বটা এখন কার দেখতে হবে তো! রাজার নাম, দস্যুসর্দার হুড্ডা-গুড়া

আমি তো এতক্ষণ ধরে ছাতের ওপর চুপটি করে বসে ঘোড়ার পিঠে দস্যুগুলোর ছোটাছুটি দেখছিলুম আর ওই বোমা ফাটানো ধোঁয়ার হাত থেকে নিজের চোখ দুটোকে সামলাচ্ছিলুম। কিন্তু হঠাৎ দেখি কী, ওই ফাঁকা রাস্তার ওপর কটা দস্যু বন্দুক-টন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। কী রে বাবা! আমায় দেখতে পেল নাকি! আরও দেখি কী, দুজন ষণ্ডা-মার্কা দস্যু সেই ছেলেটিকে বেশ করে বেঁধে, টানতে টানতে রাজপ্রাসাদের ফটকের বাইরে নিয়ে আসছে। এতক্ষণ যে এতো বোমা ফাটাফাটি হল, কিংবা ঘোড়া ছোটাছুটি করল তাতে আমি একটুও ঘাবড়াইনি। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটিকে অমনি করে ফটকের বাইরে আনতে দেখে, আমার পা থেকে মাথা অবধি ঠকঠক করে কেঁপে উঠল। আমি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লুম। আমার একটিবারের জন্যেও খেয়াল হল না, কেউ আমায় দেখে ফেলতে পারে। কিন্তু ভাগ্য বলতে হবে, তখনও পর্যন্ত আমায় কেউ দেখতে পায়নি। ছেলেটিকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ওরা খোলা রাস্তায় দাঁড় করাল। আমি দেখলুম একজন বেশ। লম্বা-চওড়া দস্যু ভীষণ হম্বিতম্বি করে ছেলেটির সামনে এগিয়ে আসছে। সবাই তাকে দেখে তটস্থ হয়ে সরে যাচ্ছে, সেলাম ঠুকছে। আমার মনে হল, ইনিই বোধ হয় হুড্ডা-গুড্ডা। ইনিই এখন রাজা।

রাজাই তো। তবে দস্যুরাজা। রাজার ইশারা মতো ছেলেটির সামনাসামনি, একটু তফাতে, একজন বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়াল। এবার আমার কাছে সব ব্যাপারটা জলবৎ তরলং। এখন ওরা ছেলেটিকে এই খোলা রাজপথে গুলি করে মারবে।

লোকটা বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়াতেই হুড়া-গুড চেঁচিয়ে উঠল, মানে হুকুম চালাল, এক, দো– আমি তিন বলতে দিলুম না। আমি জানি, তিন বললেই বন্দুকে ছুটবে–গুড়ুম! আমার মাথায় নিমেষের মধ্যে একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। তিন বলার আগেই পড়িমরি বেহালাটা তুলে নিয়ে বজিয়ে দিয়েছি, টুং-টাং-টিং! বেশ জোরেই তারে টান পড়েছে! হুড্ডা-গুড়া থমকে গেছে। মুখে কোনো কথা না বলে মিটমিট করে এদিকে-ওদিকে দেখতে লাগল। কিন্তু দেখবেই বা কাকে আর বুঝবেই বা কী! তাই আবার হাঁক দিল, এক, দো–

টুং-টাং-টিং।

হুড্ডা-গুড্ডার গলায় এবার মেঘ ডাকল, ‘কৌন হ্যায়! বাজনা বাজায় কে?’

সেই ডাক শুনে তো ওর সাঙ্গোপাঙ্গদের মুখ শুকিয়ে আমচুর। সবাই ভয়ে ভয়ে এ-ওর চোখ। চাওয়াচাওয়ি করছে। কিন্তু কিছুর হদিশই পাওয়া গেল না। হুড্ডা-গুড়া ভাবল, তার বোধ হয় নিজেরই শুনতে ভুল হয়েছে। তাই সে আবার হাঁক পাড়ল, এক, দো–

‘হুজুর, বাঘ!’ হঠাৎ একজন দস্যু ছাতের দিকে চেয়ে চিৎকার করল।

এই রে! আমায় দেখতে পেয়েছে!

আর দেখতে আছে! ওর মুখের কথা শেষ হতে দিলুম না। ছাতের ওপর বেহালাটা ফেলে রেখেই নিমেষের মধ্যে মেরেছি লাফ একেবারে সিধে হুড্ডা-গুড়ার ঘাড়ের ওপর। ওর উঁটিটা কামড়ে ধরে ঘাড়টা মটকে দিয়েছি। হুড়া-গুড়া মাটির ওপর চিতপটাং। তাই-না দেখে আর সব দস্যুগুলো, ‘মারে,’ ‘বাপরে’ বলে যে যেদিকে পারল ছুট দিল। আমার সঙ্গে পারবে কেন? টপাস টপাস করে একটি একটি ধরছি, আর শেষ করছি। একেবারে লণ্ডভণ্ড। এমন হুংকার ছাড়ছি যে, বাছাদের সেই ভয়েই হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আমি সব তছনছ করে দিয়েছি। কিন্তু সব কটাকে একসঙ্গে শেষ করি কী করে? এতো আর আমার একার দ্বারা সম্ভবও নয়। তখন দেখি কি, ছেলেটি নিজের বাঁধনটা কষ্টেসৃষ্টে খুলে ফেলেছে। একটা দস্যুর হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে, দুমদাম সেও লেগে পড়ল। তাই না-দেখে যে পারল, পালালো। যে সামনে পড়ল সে মরল। আমার কী লম্ফঝম্ফ তখন যদি দেখতে! সে যেন একটা সত্যি-সত্যি যুদ্ধক্ষেত্র। অন্তত হাজারটা দস্যুর দেহ মাটিতে পড়ে রক্তগঙ্গায় হাবুডাবু খাচ্ছে। আমিও ভীষণ হাঁপিয়ে গেছি। হাঁপাতে হাঁপাতেই তেড়েমেড়ে ছোটাছুটি করে খোঁজাখুঁজি করছি।

.

১৪.

না, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। আর কাউকে দেখছি না। তবু আর একবার হুড়া-গুড়ার দেহটার কাছে এগিয়ে গেলুম। বিশ্বাস নেই, বেঁচেও তো থাকতে পারে! পা দিয়ে ওর গলাটা চেপে ধরতেই, চোখ দুটো ঠিকরে এল। লোকটা একদম খতম।

কতক্ষণেরই বা ব্যাপার! এইটুকু সময়ের মধ্যে এখানে যে এমন সাংঘাতিক তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে, এটা আগে কে ভেবেছিল? দস্যুগুলো তো জানতই না। আমি-যে-আমি, ভাবতে পেরেছিলুম? এ যেন সেই বিনা মেঘে বাজ পড়ার মতন।

হঠাৎ এদিক ওদিক চেয়ে দেখি, ছেলেটি তো নেই! বোঁ করে আমার মাথাটা ঘুরে গেল। তা হলে কি ছেলেটিকে ওরা ছিনতাই করে নিয়ে পালালো! রাস্তাঘাট ফাঁকা। থাকলে দেখতেই পেতুম। এদিক ওদিক ব্যস্ত হয়ে খুঁজলুম। দেখতে পেলুম না। একবার রাজবাড়ির ভেতরটা তো দেখা দরকার! ভেবে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছি।

কিন্তু তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, দিনের আলোয় রাজবাড়ির ভেতরটা দেখে আমি এক্কেবারে ট্যারা হয়ে গেছি। কী বিরাট আর কী চমৎকার! এক-একটা চত্বর পেরিয়ে এক একটা মহল। এক-একটা মহলে অগুনতি ঘর। সুন্দর সাজানো-গোছানো! ওরই মধ্যে হন হনিয়ে হেঁটে হেঁটে আমি ছেলেটিকে খুঁজতে লাগলুম।

খুঁজে পেলুম না। খুঁজে পাওয়া সম্ভবও না। তবু খুঁজতে খুঁজতে যে-জায়গায় গিয়ে পড়লুম, দেখলুম সেখানে কয়েদখানা! সারি সারি গারদে দেখি, রাজার সেনারা বন্দি হয়ে আছে। আমি দূর থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। সামনে গেলে বাঘ দেখে যদি ওরা ভয় পায়!

হঠাৎ আবার বন্দুকের আওয়াজ–’গুড়ুম!’

আমি হকচকিয়ে গেছি! কী হল আবার! আবার বন্দুক ছোটে কেন? তখনই আমি হঠাৎ ছেলেটিকে দেখতে পেলুম। দেখলুম সে ছুটছে। হাতে বন্দুক। ছুটতে ছুটতে ও কয়েদখানার দস্যু পাহারাদারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার বুকে বন্দুক চালালো। ছেলেটি পাহারাদারের ট্যাঁক থেকে ঝটপট চাবির গোছাটা টেনে বার করে নিল। গারদের ফটকটা খুলে ফেলে ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠল। ওই গারদে দস্যুর দল ওর বাবাকে বন্দি করে রেখেছিল! ওর বাবার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেটি। আমি দূরেই ওদের চোখের আড়ালে দাঁড়িয়ে। আমি দেখতে পেলুম ওর বাবা ওকে বুকে তুলে নিয়ে গারদ। থেকে বেরিয়ে আসছে। ছেলেটি বাবার গলা জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। আমি এতটা দূর থেকে ঠিক দেখতে পাইনি, ছেলের কান্না দেখে ওর বাবার চোখেও জল এসেছিল কি না। তবে দেখলুম, ওর বাবা ছেলের হাত থেকে সেই চাবির গোছটা নিয়ে একটি করে কয়েদখানার সব কটি ফটক খুলে ফেলল। অমনি সেই বন্দি সেনারা আনন্দে চিৎকার করে কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে এল দলে দলে। রাজপুত্তুরের জয়ধবনি দিতে দিতে খুশিতে নাচতে লাগল।

ওরা যখন আনন্দে দিশেহারা, আমি তখন মনে মনে ভাবলুম, আর তো এখানে থাকা ঠিক নয়! মানে মানে কেটে পড়তে হয়! নইলে মান রাখতে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতে পারে।

আমি কেটেই পড়লুম। আমি আবার পাশের বাড়ির ছাতে উঠে পড়েছি। বেহালাটা নিলুম। নিয়ে ভাবছি এখন কী করা যায়! ঝট করে একটা বুদ্ধি এসে গেল আমার মাথায়। আচ্ছা, এখন এ-বাড়ির ছাতে লুকিয়ে না থেকে রাজবাড়ির ছাতে উঠে পড়ল তো হয়! আমি তো জানি, এক্ষুনি ছেলেটি আমায় খুঁজবে!

বাঘ দেখে, দস্যু দেখে আর বোমা-গুলির দুমদাম আওয়াজ শুনে শহরের লোকেরা সেই যে ঘরে খিল এঁটেছে, আর বেরুবার নামটি নেই। রাস্তাঘাট খাঁ খাঁ করছে। যেন মরুভূমি! আমিও তাই এই তালে এই ছাত থেকে লাফ দিয়ে রাজবাড়ির পেছনদিকে ছুটে গেছি। রাজবাড়ির পেছনদিকের পাঁচিল বেয়ে, এক তালা, দো তালা টপকে টপকে যখন ছাতে পৌঁছোলুম, ভাগ্যি ভালো, আমায় কেউ দেখতে পায়নি! দেখবেই বা কেমন করে! তখন কয়েদখানা থেকে মুক্তি পেয়ে রাজার সেনারা, রাজবাড়ির দাসদাসিরা আনন্দে মশগুল যে! বাঘ নামে এই মস্ত জন্তুটার চেহারা তখন ওদের নজরেই পড়ল না। তা ছাড়া আমিও কী। অত বোকা যে, চট করে ওদের দেখা দিয়ে বসে থাকি! আমি জানি কেমন করে খুব। সাবধানে সবার নজর এড়িয়ে কাজ করতে হয়।

.

১৫.

ছাতে উঠে কান পেতে শুনি রাজবাড়ির ভেতরে তখনও ভীষণ হইহল্লা চলছে। আমার তখন মনে হল, এখন একটু মজা করলে তো হয়! এই কথাটা ভেবেই আমি আবার বেহালা। বাজাতে শুরু করে দিলুম। এবার টুং-টাং-টিং নয়। তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে, আমি রীতিমতো সা-রে-গা-মা বাজাতে শুরু করে দিয়েছি। আর সেই সা-রে-গা-মা যতই ছড়িয়ে। পড়তে লাগল, রাজবাড়ির হইহল্লাটা ততই থমকে থমকে থিতিয়ে এল। তারপর একেবারে চুপ! আমি তখন ঠিক শুনতে পেলুম, বাজনাদারকে খুঁজে না পেয়ে ছেলেটি চিৎকার করছে, ‘আমার বাঘ বাজনা বাজাচ্ছে। আমার বাঘ কোথায় গেল?’

আমি তো পাকা ওস্তাদের মতো একমনে বাজনায় মশগুল। এদিকে কখন যে বাবার হাত ধরে শহরের রাজপুত্তুর বনের রাজপুতুরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমি তা টেরই পাইনি। ও ছুটে এসে, আনন্দে আমার পিঠের ওপর লাফিয়ে বসল। আমার পিঠের সেই গুলিবেঁধা জায়গাটা যদিও হঠাৎ একটু ব্যথিয়ে উঠেছিল, তবু আমি তাকে নিয়ে নাচতে শুরু করে দিলুম। তার হাতে বেহালাটা তুলে দিলুম। সে আমার পিঠে বসেই বাজনার সুর ধরল। আমি তাকে পিঠে নিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ছাত থেকে নেমে এলুম। রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছি। ছেলেটি আমার পিঠে বসে বাজনা বাজায় আর আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকি।

এতো চেনা বাজনার জানা সুর। এ শহরের সবাই তো আগে রাজপুরের বাজনা শুনেছে। তাই চেনা-চেনা বাজনা শুনে, চেনা মুখটি দেখার জন্যেই সবাই একটু একটু, দরজা ফাঁক করল। সবার চোখে বেবাক চাউনি! বাঘের পিঠে বসে রাজপুত্তুর! নিজেদের চোখকে নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না! এতদিন তারা হুড়া-গুড়ার কবলে পড়ে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছিল। তাই আজ বাঘের পিঠে রাজপুত্তুরকে দেখে তারা বিশ্বাস করে কী করে?

তবু তাদের বিশ্বাস করতে হল। সর্বপ্রথম একটি ছোট্ট ছেলে বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। আমার পিঠে রাজপস্তুরকে দেখে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘মা, বাঘের পিঠে রাজপুত্তুর!’ চেঁচাতে চাঁচাতে সে ছুটে এসেছিল রাজপুরের কাছে। অবাক কথা, বাঘ দেখে সে একটুও ভয় পায়নি! রাজপুত্তুর তাকে আমার পিঠে তুলে নিয়ে আবার বাজনা বাজাতে শুরু করল। সেই ছোট্ট ছেলেটি আমার পিঠেবসে বাজনার তালে তালে হাততালি দিতে লাগল।

দেখতে দেখতে চারদিক থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে এল। কাতারে কাতারে মানুষ সেই বাজনার তালে তালে নচাতে শুরু করে দিল। নাচতে নাচতে আমার পিছু পিছু হাঁটা দিল। আমি দেখতে পেলুম, গোটা শহরটাই যেন আনন্দে উপচে পড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে আর আমার সঙ্গে নেচে নেচে হেঁটে চলেছে।

তারা আমার সঙ্গে রাজবাড়িতেই ফিরে এল। আবার তারা দেখতে পেয়েছে তাদের রাজাকে। আবার তারা রাজার গলায় মালা পরিয়ে দিল। রাজাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠল।

রাজা সিংহাসনে বসলেন। দরবার ডাকলেন। দরবার ডেকে রাজা নিজের গলায় মালা আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ মালা আমার গলায় মানায় না। এ-মালা কেউ যদি পাবার যোগ্য হয় তো সে শহরের এই রাজা নয়, বনের এই রাজপুত্তুর। এই বাঘই আমাদের শত্রু হুড্ডা-গুড়াকে খতম করে, আমাদের সম্মান ফিরিয়ে এনেছে। সুতরাং মালা দিন এই বাঘকে।’

রাজার মুখের কথা শেষ হল না। বলব কী, অমন শয়ে শয়ে মানুষ ফুলের মালা নিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দেবার জন্যে ছুটে এল। অত মালা আমার গলায় ধরবে কোথায়? একজন। সিপাই ছুটে এল আমার কাছে। আমার গলায় একটি-একটি মালা পরিয়ে দিচ্ছে দেশের মানুষ, ও তখন একটি-একটি মালা খুলে নিয়ে পাশে রাখছে। আর কী হাততালি!

শেষ, আমি নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেছি। যখন মালা দেওয়া শেষ হল, দেখলুম, দরবার ঘরটা উপচে গেছে ফুলে-ফুলে। আমার বেশ মনে আছে, সব-প্রথম আমার গলায় মালা পরিয়ে। দিয়েছিল রাজা আর সব শেষে আমায় মালা দিয়েছিল রাজপুত্তুর। শ্বেত গোলাপের গুচ্ছ। ভারি মিষ্টি!

শুনলে অবাক হয়ে যাবে, রাত্রে আমার সম্মানে বসল এক বিরাট সভা। কত মানুষ সেখানে। জমায়েত হল। কত জ্ঞানীগুণী, কত গণ্যমান্য। সক্কলে আমার গুণগানে পঞ্চমুখ। আমার। এত তারিফ করতে লাগল তারা, মনে হল, আমি কি ঠিক অতটা পাবার যোগ্য!

সভার শেষে, আমাকে শোনাবে বলে রাজা নিজেই সেদিন বাজনা ধরল। সক্কলে গদগদ হয়ে বাজনা শুনছে আর থেকে থেকে ‘আহা, উঁহু, ওহো’ করে সভাকে মাতিয়ে রাখছে। আমিও বোকার মতো চেয়ে চেয়ে, তাদের সঙ্গে মনে মনে ‘উঁহু, উঁহু’ করতে লাগলুম।

কী সুন্দর করে সাজিয়েছে এই সভাটা! কত ফুল, কত রঙিন পতাকা। কত ফানুস উড়ছে, কত আলোর তারা! কেমন সব রং-বেরঙের পোশাক পরে সক্কলে এসেছে! কী রঙের বাহার! কী সুন্দর সুন্দর পোশাক! চোখ ধাঁধিয়ে যায়!

ধাঁধিয়ে গেল সত্যিই। আমার চোখ না, আমার মন। সকলের গায়ে ওই অমন সুন্দর সুন্দর পোশাক দেখে আমার এমন লজ্জা করে উঠল! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমার তো গায়ে পোশাক। নেই! রংচঙে না-ই বা হল, সাদামাটাও তো একটা থাকবে! এত সব রং-ঝলমল পোশাকপরা গণ্যমান্য মানুষের মধ্যিখানে আমি নির্লজ্জের মতো বসে আছি! আমি ন্যাং–

ছিঃ ছিঃ! কী লজ্জা, কী লজ্জা!