আজব বাঘের আজগুবি – ২

০৬.

মনে হল অনেকটা পথ বন ডিঙিয়ে পালিয়ে এসেছি। এবার বোধ হয় দাঁড়ানো যায়। সামনে একটা খাবলা-কাটা খাদ। তার ভেতর ঝটপট লুকিয়ে পড়লুম। জায়গাটা বেশ ঘুপচি। এখানে লুকিয়ে থাকলে আমায় নিশ্চয়ই কেউ খুঁজে পাবে না। যদিও মনে হচ্ছিল অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু কতটা যে পথ এসেছি, সেটা ভেবে বার করার মতো। বুদ্ধি তখন আমার ছিল না। কারণ, উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম কোনদিকের পথ ধরে এ যে কোথায় এলুম, এই অন্ধকার রাতে তা ঠাওর করার অবস্থাও আমার একদম ছিল না। পিঠের অসহ্য যন্ত্রণায় সারা শরীরটা তখন থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কী ভীষণ জ্বালা। আমি ওই খাদটার মধ্যেই লুটিয়ে পড়লুম। তারপর কখনো চিত হয়ে, কখনো উপুড় হয়ে খাদের মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে কাতরাতে লাগলুম

কতক্ষণ এমনি করেছি আমার মনে নেই। মনে নেই যন্ত্রণাটা আমার বাড়ছিল না কমছিল। কিন্তু আমি হঠাৎ শুনতে পেলুম, একটা যেন কীসের শব্দ, এই নির্জন বনে টুং টুং করতে করতে আমার কানে এসে বাজছে! আমি চমকে উঠলুম। আমি এতদিন বনজঙ্গলে বাস করছি, এ-রকম অদ্ভুত শব্দ আর কোনোদিন শুনিনি। কেমন যেন ভালো লাগছিল। ঠিক এই সময়ে আমি বুঝতে পারছিলুম না, পিঠের এই যন্ত্রণাটা আমায় বেশি জ্বালা দিচ্ছে, না ওই শব্দটা আমার মনকে বেশি খুশি করে তুলছে।

আমি গড়াগড়ি খেতে খেতে উঠে বসলুম। কান দুটো খাড়া করে শুনতে লাগলুম। আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, সেই অন্ধকার বনের গাছপাতার ফাঁক দিয়ে, ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে সেই টুংটুং শব্দটা ভেসে ভেসে আমার কানে এসে বেজে উঠছে। হঠাৎ গুলি খাওয়া যন্ত্রণাটা এত কম বলে মনে হচ্ছে কেন! আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলুম। এতক্ষণ যে যন্ত্রণার জ্বালায় আমি ছটফটিয়ে মরছিলুম, সেটা যে হঠাৎ এমন চট করে কমে যাবে, এ তো ভাবাই যায় না। পিঠের রক্তটা পেট দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গড়াচ্ছে। আমি চেটে-চুটে পরিষ্কার করে ফেলছি। একটু আগেও আমার মনে হয়েছিল, আমি বাঁচব না। এখন যেন সে ভয়টাও আমার কেটে যাচ্ছে। কেননা, আমি বেশ বুঝতে পারছি, বন্দুকের গুলি আমার। পিঠে ঢোকেনি। শুধু পিঠের ওপর ঠোক্কর মেরেছে। পিঠ ছুঁয়ে বাইরে ফসকে উড়ে গেছে। তাই আমি এখনও বেঁচে আছি। পিঠ ফুঁড়ে পেটে ঢুকলে এতক্ষণ আর আমার ট্যাঁ-ফু করতে হত না। যাক, এখন আমি সত্যিই মরছি না।

আমি মরতুম, নিশ্চয়ই, যদি ঠাকমা না থাকত! বুড়ি ঠাকমা আমাকে বাঁচাতে এসে নিজেই প্রাণ দিল। সেই গাবদা-গাবুস ভাল্লুটার যে কী হল, তা দেখার আর সুযোগ হল না। সেটাও হয়তো অক্কা পেয়েছে।

একদিন ঠাকমা বলেছিল, ‘আমি তো বুড়ি হয়েছি। আমার আর দাম কী বলো?’ কথাটা যে কত মিথ্যে, ঠাকমা আমায় বাঁচাতে এসে সেটাই প্রমাণ করে গেল। আজ আমি স্পষ্ট বুঝেছি, ছোটো থাকো কিংবা বুড়ো হও, যতদিন বেঁচে থাকবে, জীবনের দাম কোনোদিনই কমবে না।

ঠাকমার শেষ অবধি যে কী হল কে জানে! ওখানেই ছিটকে পড়ে রইল, না মানুষ তাকে বয়ে নিয়ে গেল নিজেদের আস্তানায়, জানি না! ঠাকমার ছালটা গা থেকে খুলে নিয়ে হয়তো নিজেদের ঘরে সাজিয়ে রাখবে। কী নিষ্ঠুর! আজই প্রথম, আমার জ্ঞানে আমি ঠাকমার কাছ থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলুম। চিরদিনের মতো। আর আমি ঠাকমাকে কোনোদিনই দেখতে পাব না।

সত্যিই, বনের এদিকটা আমার এক্কেবারে অচেনা। এদিকে কোনোদিন এসেছি বলে আমার মনেই হচ্ছে না। আমি বাঘ। এরকম একটা বেপট জায়গায় কতক্ষণ লুকিয়ে থাকা যায়! কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে। তখন আবার আর এক ঝামেলা। এক বিপদ। থেকে আর এক বিপদ! সুতরাং যা হোক করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে হবে। কিন্তু এখনই যদি তুমি আমার মুখখানা দেখতে পেতে, তাহলে তোমার বুঝতে এতটুকু কষ্ট হত না, ঘর যে আমার কোনদিকে তা আমি একদম ভুলে গেছি।

ভুলে গেছি ঠিক, তবু আমায় খুঁজে বার করতে তো হবে!

ঘরে ফিরলেও ঘরের ছেলেকে ছেলে বলে ডাকবার আর কেউ নেই। এখন আমি একা। সঙ্গীহীন। কী ভাগ্য আমাদের দেখো, একটা বংশের সক্কলে মানুষের কবলে পড়ে কেমন শেষ হয়ে গেল। এখন মনে হয়, ওই বন্দুক নামে গুলি ভরতি যন্ত্রটা যে বার করেছিল সে যতই বুদ্ধিমান হোক, তাকে আমি কোনোদিন ভালোবাসতে পারব না। এখন আমার ভাগ্যেই বা কী আছে, কে জানে!

ওই শোন সেই টুংটুং শব্দটা একটানা বেজে চলেছে। আঃ! ভারি মিষ্টি! কিন্তু কীসের শব্দ ওটা? আর কোথা থেকেই বা আসছে, এখান থেকে তো বোঝাই মুশকিল। কেমন যেন মন চাইছে শব্দটার কাছে চলে যেতে। কিন্তু আবার যদি কোনো বিপদ হয়!

আমি উঠে দাঁড়ালুম। গুটি গুটি পা-পা এগিয়ে চললুম। খুব সাবধানে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলুম। তবু রক্ষে, জঙ্গলটা এখানেও এতটুকু হালকা নয়। সুতরাং লুকিয়ে-ছাপিয়ে চলতে ফিরতে খুব অসুবিধে নেই। আমি ওই শব্দটার দিকে কান স্থির রেখে এগিয়ে চললুম। ঝরে পড়া শুকনো শুকনো পাতার ওপর মাঝে মাঝে আমার পা যখন পড়ছে, তখনই কেমন। খসখসানি আওয়াজটা আমায় থমকে থামিয়ে দিচ্ছে। থামছি, আবার আলতো পায়ের ডিঙি মেরে এগিয়ে চলছি। এখন মনে হচ্ছে ঠিক পথেই হাঁটছি। কেননা, শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়ে আমার কানে ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে, আর কপা হাঁটলেই নাগাল পেয়ে যাব।

সত্যিই নাগাল পেয়ে গেলুম। দৃশ্যটা দেখে আমি চমকে গেছি। হতভম্বের মতো থমকে দাঁড়িয়ে দেখি, ওই অন্ধকারে, ঘন জঙ্গলের একটা গাছের গোড়ায় চুপটি করে বসে বসে একটা ছোট্ট ছেলে হাত দিয়ে কী যেন বাজাচ্ছে! আর সেই বাজনাটা দিয়ে ওই মিষ্টি শব্দটা বেরিয়ে আসছে। আমি অবশ্য পরে জেনেছিলুম, ওই বাজনাটার নাম বেহালা। একটা মানুষকে এই সর্বপ্রথম চাক্ষুষ দেখেও, আশ্চর্য, আমার কিন্তু মনে হল না, ওর টুটিটা টিপে ওর কম্ম শেষ করে দিই! তার বদলে আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলুম আর থ হয়ে বেহালার সুর শুনতে লাগলুম! কিন্তু কে এই ছেলেটি একা, এই জঙ্গলে? আর একটু এগিয়ে যাই, আমার আর এমন সাহস হল না। কারণ, আমায় দেখতে পেয়ে ভয়েময়ে ছেলেটি যদি পালায়! তাহলে আমি তো আর ওই বাজনাটা শুনতে পাব না। তাই এখানেই হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়লুম। আর তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলুম।

তারপরেও অনেকক্ষণ বাজনা বাজল। অনেকক্ষণ ধরে আমি শুনলুম। ঠিক এই সময়ে কেন জানি আমার হঠাৎ মনে হল, আমিও যদি ওই বাজনাটা বাজাতে পারতুম! কিন্তু এমন চিন্তা আমার মগজে আসাই মিছে। বাঘ কখনো বাজনা বাজাতে পারে?

বাজাতে পারে না, কিন্তু শুনতে শুনতে বাঘ যে এমন মশগুল হয়ে যেতে পারে, তা জানা ছিল না। সত্যি, আমার তখন মনে হচ্ছিল, দিনের পর দিন যদি ওটা বেজে যায়, তাহলে দিনের পর দিন আমি চুপটি করে বসে বসে ওর সুর কান পেতে শুনে যাব!

মাঝে মাঝে গাছের ডালে এক-একটা পাখি হঠাৎ মিষ্টি সুরে ডেকে ওঠে। কিন্তু সে-ডাক আমায় এমন অবাক করে দেয় না। কারণ, ওরা তো ডাকেই। ডাকবেও। পাখির ডাক আমার কাছে কিছু নতুন বলে মনে হয় না। জন্ম থেকেই ওদের ডাক শুনে আসছি। আমার এতদিন জানা ছিল মানুষ খালি বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের মারবার জন্যে গুলি চালায়। কিন্তু তারা যে এমন বাজনা বাজাতে পারে, সে-কথা তো আমায় কেউ বলে দেয়নি। আশ্চর্য, যে হাত দিয়ে মানুষ ভয়ংকর অস্ত্র চালায়, সেই হাত দিয়েই আবার এমন সুর বেরোয়!

হঠাৎ চমকে উঠলুম। যে-শব্দটা এতক্ষণ একটানা বেজে যাচ্ছিল, সেটা আচমকা থেমে গেছে! কীরকম নিশ্চুপ হয়ে গেল চারিদিক। জমাট থমথমে। আমার চোখটাও থতমত খেয়ে সেই ছেলেটির দিকে তাকাল। দেখলুম, উঠে দাঁড়াচ্ছে। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। পাছে আমায়। দেখতে পায়, আমিও তাই চট করে আরও একটু আড়ালে সরে গেলুম। কানদুটোকে সজাগ রেখে, তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম।

হঠাৎ ঠং করে কী যেন বেজে উঠল। এ তো বাজনার শব্দ নয়! দেখলুম ছেলেটি হাঁটছে। আবার বাজল ঠং। তারপর ঠং ঠং। দেখছি যতবারই পা পড়ছে ততবারই ঠং ঠং করে শব্দ বেজে উঠছে। আমার দৃষ্টি যতটা স্পষ্ট করা যায়, সে-চেষ্টার কসুর করলুম না। আমি দেখতে পেলুম, এতক্ষণ যেটা সে বাজাচ্ছিল, সেটা হাতে নিয়ে পা দুটো টেনে টেনে সে হাঁটছে। তার পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, তার দুটি পা-ই বাঁধা। হাঁটতে পারছে না সে। তবু হাঁটছে। আর পায়ের বাঁধার শব্দটা ঠং ঠং করে বাজছে।

অমনি কষ্ট করেই খানিকটা এল সে। আমিও এক-পা এক-পা করে এগিয়ে এসেছি। দাঁড়াল সে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেখানে সে দাঁড়াল সেখানটায় একটা উঁচু মতো ঢিপি। সেই টিপিটার সামনে নুয়ে পড়ে মাথা ঠেকাল। তারপর নরম গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘মা, তুমি ঘুমিয়েছ মা? আর যে আমি পারছি না মা। আমার যে হাত ব্যথা করছে!’ বলতে বলতে ছেলেটি ডুকরে ডুকরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে সেই ঢিপিটার গা ঘেঁষে, বাজনাটা মাথার কাছে রেখে, নিজেও শুয়ে পড়ল।

আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, ওখানে কোথায় ওর মা! আর থাকলেও অন্তত একবারও তো আমি দেখতে পেতুম। আমি উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলুম। ভাবলুম, শুয়ে থাকলে যদি ওর মা আসে! আমার ঠাকমাও তো কতদিন আমার ঘুম পেলে আমায় আদর করত! আর ওর মা করবে না?

বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলুম। কিন্তু ওর মায়ের দেখা পেলুম না। না, ওর মা এল না। দেখলুম ছেলেটার চোখ দুটি বুজে গেছে। হাত দুটি কেমন নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়ল।

এখন কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্যেও যদি আমি বাঘ না হয়ে মানুষ হতে পারতুম, শুধু একটিবারের জন্যে ওর মতো আমিও বাজনা বাজিয়ে ওকে খুশি করতে পারতুম, তাহলে কী ভালই না হত! তখন আমি সাহস করে ওর সামনে যেতে। পারতুম। ওর সঙ্গে একটু গল্প করতে পারতুম। চাই কি, ওর মতো আমিও বাজনা বাজিয়ে ওকে খুশি করতুম। তা তো হবার নয়। বাঘ মানুষ হতে পারে না। বাঘ সে বাঘই। কিন্তু বলিহারি যাই মাকে! এত করে ডাকল ছেলেটি, কাঁদল, তবু সাড়া দিল না।

আমি বুঝতে পারছি না, ওর পা দুটো এমন করে বাঁধা কেন! ও হাঁটছিল আর ঠং ঠং করে বাজছিল, ওটা কি দিয়ে বাঁধা? ঠাকমা বলেছিল, লোহার খাঁচায় শেকল বেঁধে বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে মানুষ। তবে কি লোহার শেকল দিয়েই কেউ ওর পা দুটি বেঁধে দিয়েছে! একটি ছোট্ট ছেলে কী এমন দোষ করেছে যে, তার এই দুর্দশা! আমার মন কেমন-কেমন করছে! মনে হল, এক্ষুনি গিয়ে আমার থাবা দিয়ে ওই শেকলটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলি!

কিন্তু এখনই ওর সামনে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ, যতই হোক আমি বাঘ। আমায় দেখলে ভীষণ ভয় পেয়ে যেতে পারে। আর যাই হোক, অমন একটি ছোট্ট ছেলেকে আমি ভয় দেখাতে নারাজ। তাই এখানে চুপটি করে বসেই রইলুম।

.

০৭.

এর মধ্যে যে কী একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেছে, তা তোমাদের বলাই হয়নি। ছেলেটিকে দেখে, সে-কথা বলতে ভুলেই গেছলুম। শুনলে খুশি হবে কি না জানি না। তবু বলছি, বন্দুকের গুলি-লাগা আমার পিঠের জ্বালা এখন একদম থেমে গেছে। আর একফোঁটাও রক্ত পড়ছে না। কী মজার ভেলকিবাজি! আনন্দে চার ঠ্যাং ছুঁড়ে বনবন করে ঘুরপাক খেতে ইচ্ছে করছে। থাক বাবা! ঘুরপাক খেতে গিয়ে শেষে ঘোর-পাকে পড়লে, তখন আর দেখবার কেউ থাকবে না।

ছেলেটি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, এই সুযোগে ওর কাছে একবার যাই। ওর মুখখানি একটু ভালো করে চোখ মেলে দেখি। অন্তত ওর মায়ের মুখখানাও তো একবার দেখতে পারি! এ কেমন মা-বাবা, ছেলে ডাকলে সাড়া দেয় না!

আমি চারপাশটা খুব ভালো করে দেখে নিলুম। তারপর সত্যি-সত্যিই পা টিপে টিপে চোরের মতো এগিয়ে গেলুম। হুট করে একেবারে সামনে হাজির হওয়াটা ঠিক নয়। ওর মা দেখে ফেলতে পারে! কিংবা ছেলেটিরও ঘুম ভেঙে যেতে পারে! পেছনদিক দিয়ে গিয়ে, চুপি চুপি ওর মাথার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালুম। ওর মাকে উঁকি মেরে খুঁজতে লাগলুম। আশ্চর্য! কই ওর মা?কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না! যখন থেকে ছেলেটিকে দেখতে। পেয়েছি, সেই তখন থেকে একটিবারের জন্যেও আমি চোখ ফেরাইনি। তাহলে বলল ওর মা আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যাবে কোথায়? বাঘের চোখকে ঠকানো কি এতই সোজা! তাই খুব সাবধানেই আঁতিপাতি চোখ ফিরিয়ে উঁকিঝুঁকি মারলুম। ফোক্কা! ছেলেটির মাকে কাছে পিঠে দেখতে না পেয়ে তখন একটু সাহস করে ঘুমন্ত ছেলেটির মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। একদম কাছে, এত কাছ থেকে একটা মানুষের চেহারা এই সর্বপ্রথম আমি চোখ মেলে দেখছি। ছেলেটি যেন বড্ড ক্লান্ত। শত ছিন্ন একটা কাপড় পরে আছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো রুক্ষ। আর পায়ের লোহার শিকলটা ওর পায়ের তুলনায় অ-নে-ক– অনেক বড়। ছেলেটির বয়েস আমি বলতে পারব না। আমার নিজেরই বয়েস আমি জানি না। কিন্তু এটা বুঝতে কষ্ট হল না, ছেলেটির যত বয়েস তার চেয়ে আমি অনেক বড়ো। ছেলেটির গড়ন দেখে আমার বেশ মনে হল, এক সময়ে ছেলেটির স্বাস্থ্য ছিল সুন্দর। তুমি হয়তো জিজ্ঞেস করতে পার, ‘সুন্দর স্বাস্থ্য বলতে তুমি কী বোঝ হে ছোকরা?’ উত্তরে আমি শুধু বলতে পারি, তা জানি না। জানি শুধু ছেলেটিকে আমার ভালো লাগছে!

হঠাৎ ওর মাথার দিকে ওই বাজনাটার ওপর আমার নজর পড়ল। আমি আর একটু কাছে এগিয়ে গেলুম। ভালো করে এবার বাজনাটাই দেখতে লাগলুম। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, এই অন্ধকার রাত্তিরে হঠাৎ আমার মাথায় একটা আজগুবি চিন্তা গজিয়ে উঠেছে। আমার মন বলছে, আমিও তো বাজনাটা বাজাতে পারি! শুনে তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, আমার মতো গো-মুখখু এ-জগতে দুটি নেই। বাঘ আবার বাজনা বাজাবে কী! আমি গো-মুখখুকী অন্য কিছু, এ-সব ভাববার তখন আমার সময়ই হয়নি! তখন আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, বাজালে কেমন হয়! হয়তো ভালোই হয়, কিন্তু বাজাব কেমন করে!

মুশকিল আমার হাজারটা। প্রথমত ছেলেটির মতো ওই বাজনাটা আমি ধরতেই পারব না। আমার তো থাবা। তারপর যদিও ধরা যায়, বাজাবো কী ঠ্যাং দিয়ে?

যা কপালে আছে! লাগে তাক, না লাগে তুক! আমি মুখ দিয়েই বাজনাটা তুলে নিলুম ঝট করে। ছুট্টে, একটু দূরে, একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লুম! এইরে যা! সেই যে লম্বা ছড়িটা, যেটা দিয়ে টেনে টেনে বাজাচ্ছিল, সেটা যে আনতে ভুলে গেলুম! যাকগে, থাবার নখ দিয়েই বাজাই। দেখা যাক না!

সত্যিই, নখগুলো বাজনার ওই তারের ওপর বুলিয়ে দিতেই বেজে উঠল, টুংটুং-টুং! বুকের ভেতরটা কেমন শিউরে উঠল। ওঃ! আমি তাহলে বাজাতে পেরেছি! আর একবার দেখি! আবার বেজেছে, টুং-টুং-টুং! কী মজার কাণ্ড! তবে তো দেখছি ব্যাপারটা খুব শক্ত নয়। শক্ত নিশ্চয়ই। কেননা, ওই ছেলেটি যেভাবে বাজাচ্ছিল, আমি তো সেরকম পারছি না। ওর হাতে কেমন একটা টানা-টানা সুর বেজে বেজে কেঁপে উঠছিল। আর আমি বাজাচ্ছি, কাটা কাটা টুং-টুং-টুং! বেজেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে না। তবু কিন্তু বাজাতে ভালো লাগছে। আমি বাজাতে লাগলুম। একফাঁকে একবার উঁকি মেরে দেখে নিলুম ওদিকটা। না, না, ছেলেটি এখনও ঘুমুচ্ছে। তবে খুবসে বাজাই! ট্যাং-ট্যাং, টুং-টুং

আমি একটা আস্ত গাধা। দ্যাখো, একটু সাবধান তো হওয়া উচিত। তা নয়, একেবারে জ্ঞান হারিয়ে বাজনা বাজাচ্ছি! একবার মনেও হল না, ছেলেটির ঘুম ভেঙে যেতে পারে!

পারে মানে কী? ঘুম তো ভেঙেই গেছে। ওর পায়ে-বাঁধা শেকলটার ঠং ঠং আওয়াজ ওই তো শোনা যাচ্ছে! এই রে! কী হবে এবার!

ঝট করে বাজনা থামিয়ে উঁকি মেরে দেখি, সত্যিই তো ছেলেটি এদিকেই আসছে। আর থাকে এখানে! বাজনা-টাজনা ফেলে দে চম্পট। মার এক বোম্বাই লাফ! জঙ্গল বলে রক্ষে। এদিক-ওদিক ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়া সোজা। লুকিয়ে লুকিয়ে ঝোপের ভেতর থেকে একে-ওকে দেখাও খুব সোজা। আমিও ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখলুম, আমি যেখানে বাজনাটা ফেলে এসেছি, ছেলেটি ওই পায়ের শেকল টেনে সেইখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাজনাটা হাতে তুলে নিল। তুলে নিয়ে কেমন ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল। আমি নিশ্চিত জানি, ওর পায়ে যদি ওই ভারি শেকলটা বাঁধা না থাকত, তবে ও এ-ঝোপ ও-ঝোপ ছুটে ছুটে ঠিক আমায় খুঁজে বার করত। এখুনি আমি যদি ওর নজরে পড়ে যাই, তাহলে কী কাণ্ডটা হয় বলো? হয় এক্ষুনি আমায় ডাক ছেড়ে পালাতে হবে, আর তা না হলে ওর ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে, ওকে আঁচড়ে-কামড়ে শেষ করে ফেলতে হবে!

আমার ভাগ্যটা খুব ভালো। দুটোর কোনোটাই করতে হল না। আমায় দেখতে পেল না ছেলেটি। দেখতে না পেয়ে, বাজনাটা হাতে নিয়ে আবার পায়ের শেকল টানতে টানতে হাঁটা দিলে। ওকে ওভাবে হাঁটতে দেখে, সত্যি বলছি, আমার নিজের ওপর এমন রাগ হল! মনে হল, ছ্যাঃ ছ্যাঃ, আমার জন্যেই তো ওর ঘুম ভেঙে গেল। আমার জন্যেই এমন কষ্ট করে। ওকে মোটা শেকলটা টানতে টানতে এখানে উঠে আসতে হল!

আবার সেই নিজের জায়গায় গিয়ে বসল ছেলেটি। বসে, তেমনিভাবেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল এইদিকেই। আমি কিন্তু গুড়গুটি মেরে ঠায় বসে। না নড়ছি, না টু শব্দ করছি। কোন কিছুর সাড়া-শব্দ না পেয়ে কী আর করে ছেলেটি, আবার শুয়ে পড়ল। হয়তো আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

এক্ষুনি এখান থেকে বেরনো একদম বুদ্ধিমানের কাজ নয়! কারণ, ওর চোখে এখনও যদি ঘুম না এসে থাকে! তাই আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ ঝোপের মধ্যে অমনি করেই বসে রইলুম।

এখন ছেলেটি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিন্ত হয়ে আমি আবার বেরিয়ে এসেছি। আবার থমকে থমকে হেঁটেছি ওর দিকে। এবার ঝোপের আড়াল দিয়ে গা ঘেঁষিয়ে ওর সামনে। এসে দাঁড়ালুম। এবার আর বাজনাটার দিকে নজর না, ওর পায়ের দিকে নজর গেল। ওই ছোট্ট পা দুটিকে কে যে এমন করে লোহার শেকল দিয়ে বেঁধে দিয়েছে! তার কোনো দয়ামায়া নেই? দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছে, যে ওর পা দুটি বেঁধে দিয়েছে, সে হয়তো চেয়েছে, ওই পা চিরদিনের মতো থেমে যাক। ও যেন আর ছুটতে না পারে! এই বন পেরিয়ে হাঁটতে না পারে! থাক বন্দি হয়ে এই গভীর জঙ্গলে!

আমি ভালো করে দেখব বলে, আর একটু এগিয়ে গিয়েছিলুম। দেখব, শেকলটা খোলা যায় কি না! কিন্তু হঠাৎ এমন আচমকা খিলখিল করে হেসে উঠেছে ছেলেটি, আমি একেবারে থতমত খেয়ে গেছি! এত চালাক, আমায় ধরবে বলে, ঘুমের ভান করে চুপ মেরে শুয়েছিল! উঃ, আমায় ধরা তো অত সহজ নয়! আমিও মেরেছি এক ডিগবাজি। তাই দেখে ছেলেটি আরও জোরে হেসে উঠল। বলল, ‘কোন দেশের বাঘ বাবা, আমায় খেতে এসে পালাল!’

আমার মুখ দিয়ে কি আর কথা সরে? ঝোপের আড়ালে জুজু-বুড়িটির মতো নিজঝুম মেরে বসে রইলুম। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘পালাবে কোথায়! এক্ষুনি ধরছি!’

আমি তো জানি, ও ধরতে পারবে না। তাহলেও কিন্তু এবার আমার উঁকিঝুঁকি মারতে সাহস হল না। কেননা, একটা জ্যান্ত মানুষকে সামনে পেয়েও, বাঘ হয়েও আমি ভীতুর মতো পালালুম। পাঁচজনের পাঁচকান হলে একেবারে ছ্যাঃ ছ্যাঃ পড়ে যাবে চারিদিকে!

ছেলেটি কী সাবধানি দেখো! দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলুম! এবার যে সে হেঁটে হেঁটে এদিকেই আসছে, তা আমি বুঝতেই পারিনি! কারণ, পা টিপে টিপে এমন নিঃশব্দে হেঁটেছে যে, তার পায়ের ওই শেকলটার ঠং ঠং শব্দটি পর্যন্ত আমার কানে ঢোকেনি। আমার পেছনদিক দিয়েই এসেছিল সে। আর আমি হাঁদার মতো সামনে মুখ উঁচিয়ে বসে আছি। ছেলেটি করেছে কী, পেছনদিক দিয়ে এসে আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই ধরেছি!’

আমি যে তখন কী সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম, তা এখন মুখে বলা আমার কম্ম নয়। ভয় পেয়ে ছেলেটিকে এক ঝটকা দিয়ে আমি মারলুম লাফ। ছেলেটি মুখ থুবড়ে আছাড় খেল। আর আমি সিধে লম্বা!

সত্যি বলছি, আমি ভয় পেয়েছি, এই কথাটা ভাবতে এত লজ্জা করছে! বাঘের মুখে ভয়ের কথা শোভা পায়?কী বদনাম! না, না, চম্পট দিয়ে ভেঙ্গে পড়াটা একদম উচিত না। একটা মানুষের বাচ্চা-ছেলের কাছে আমি হেরে যাব! কক্ষনো না। আমি হার মানি না, মানবো না। আমি ছেলেটাকে আচ্ছা করে শিক্ষা দিয়ে দেব। আমাকে কী ঠাউরেছে! আমি কী ল্যাজ নাড়া কুত্তা!

আমি যেমন তিরের মতো লম্বা দিয়েছিলুম, ঠিক তেমনি তিরের বেগে ফিরেও এলুম। কিন্তু বললে হাসবে হয়তো, ছেলেটিকে শিক্ষা দেওয়া দূরে থাক, ওর তখনকার সেই অবস্থা দেখে আমি সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেলুম। দেখি, ছেলেটি আমার ঝটকা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। উঠতে পারছে না। পায়ের শেকলটা একটা আগাছার সঙ্গে প্যাঁচ লেগে জড়িয়ে গেছে। ভীষণ কষ্ট করে টানাটানি করছে। কিন্তু শেকলটা যে খুলবে তেমন সাধ্য ওর কী আছে?

আমি সামনে এসে দাঁড়াতে, অত কষ্টেও ছেলেটি মুখখানা হাসি হাসি করে বলল, ‘আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিলি বলে দেখ, আমার কী হল!’

আমি ভাবলুম, ও নিজে আরও যদি বেশি টানা-হ্যাঁচড়া করে, তবে পা কাটবে, রক্ত পড়বে। ওর কষ্ট দেখতে দেখতে আমার পায়ের থাবা চারটে নিশপিশ করে উঠল। আমার মনে হল, এখনই এই থাবা দিয়ে ওর পায়ের শেকলটা দুমড়ে মুচড়ে খান খান করে ফেলি। আমার দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠল। নিমেষের মধ্যে শেকলের আংটাটা দাঁতে চেপে ধরলুম। চেপে থাবা দিয়ে যেই চাপ দিয়েছি, ‘খটাং!’ খালি একটা আওয়াজ। তারপর টুকরো হয়ে শেকলটা ছিটকে পড়ল। এ তো একটা ভাঙল। আর কটা? একটা যখন ভেঙেছে আর একটা কি থাকে? সেটাকেও চুরমার করে দিলুম!

ওঃ! যাক এতক্ষণ ঠিক ঠিক কাজে লাগাতে পেরেছি আমার গায়ের জোরটাকে। ছেলেটিও অবাক হয়ে এতক্ষণ আমার দিকেই চেয়েছিল। এবার খুশিতে তার মুখখানি উছলে উঠল। আমাকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। চিৎকার করে উঠল। তারপর ছুটে পালাল। ছুটতে ছুটতে মায়ের কাছে চলে গেল। বলল, ‘মা, দেখো দেখো, বাঘ আমার পায়ের শেকল ভেঙে দিয়েছে মা। দ্যাখো, এখন আমি ছুটতে পারছি।, দ্যাখো, আমি লাফাচ্ছি।’

কিন্তু এবারও আমি ওর মাকে দেখতে পেলুম না। দেখলুম, ছেলেটি কেঁদে ফেলেছে। হয়তো আনন্দে কিংবা খুশিতে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মা, তোমাকে যারা মেরেছে তাদের আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না মা, কিছুতেই না। এবার আমি বাবাকে মুক্ত করে আনব। বলো না পারব না?’

আমি তখনও দূরে দাঁড়িয়েছিলুম। দূর থেকেই কথাগুলো আমার কানে এল। কী রকম গোলমাল হয়ে গেল আমার মাথাটা। আমি কিছু বোঝবার আগেই, অবাক হয়ে ও নিজের মনেই আবার বলে উঠল, ‘আমার গায়ে রক্ত কোথা থেকে লাগল!

হঠাৎ আমি নিজের গায়ের দিকে চেয়ে দেখি, আমার গায়েও রক্ত! গুলির আঘাত লেগে। যেখানটা আমার কেটে গেছে, সেখান দিয়ে আবার রক্ত পড়ছে। থেমে গেছিল। কিন্তু লাফালাফি করতে গিয়ে বোধ হয় আবার লেগে গেছে! মনে হচ্ছে, আমার গায়ের রক্ত ওই ছেলেটির গায়ে লেগেছে! ও আমায় যখন জড়িয়ে ধরেছিল, বোধ হয় তখন।

ছেলেটি ছুটে আমার কাছেই এল। এবার আমি কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। ও আমার পিঠে হাত দিল। আমার পিঠে গুলির আঘাত দেখে আঁতকে উঠল। তারপর নিজের ছোট্ট হাত দিয়ে, আমার পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তোকে গুলি মেরেছে রে? আহা!’

ছেলেটির মুখে এই মিষ্টি আদর-মাখানো কথা শুনে তখন যে আমার কী ভালো লেগেছিল, আমি এখন তা বলতে পারবো না। আমি বাঘ, নইলে আমি হয়তো কেঁদে ফেলতুম! কিন্তু কাঁদার বদলে তখন তো আমি একদম হাঁদা! বোকার মতো জুলজুল চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলুম। বলতে লজ্জা কি না জানি না, তখন আমি নিজেই নিজেকে বাঘ বলে মনে করতে পারছিলাম না। আমার যেন মনে হচ্ছিল, এই ঘুপ-চুপ নির্জন বনে এখন এই ছেলেটি আমার একান্ত বন্ধু। কিংবা বলা যায়, আমি ওর আপনজন।

.

০৮.

ঠিক এখনই আমি মনে করতে পারছি না, ছেলেটি কতক্ষণ আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। মনে করতে পারছি না, কী কথা তখন সে আমায় আদর করে বলেছিল। আমি সত্যিই বেবাক হয়ে গিয়েছিলুম। অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে ভেবেছিলুম এ-ও হয়? মানুষ আমাকে মারবে বলে তাক করে বন্দুক মেরেছে, আবার সেই মানুষ আমার পিঠের রক্ত মুছিয়ে দিয়ে, আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করছে!

হঠাৎ ছেলেটি বলল, ‘বোধ হয় ভেবেছিলি, আমি তোকে দেখে ভয় পাব? হুঃ! আমার আবার ভয় কীসের! আমাকে তো ওরা বাঘের পেটে দেবে বলেই, আমার পায়ে শেকল বেঁধে এই বনে ফেলে দিয়ে গেছে।’

আমি ওর কথা শুনলুম, কিন্তু কিছু বলতে পারলুম না।

ছেলেটি আবার বলল, ‘আমি কতদিন ধরে বনে বনে ঘুরছি, কেউ তো আমায় খেয়ে ফেলল না। তুই-ও এলি, অথচ আমায় মারলি না। আমার বেহালা নিয়ে বাজাতে শুরু করলি। কোন দেশের বাঘ রে তুই?কীরকম বাঘ?

আচ্ছা লজ্জায় পড়লুম তো! বলতে পারো, ছেলেটি আমায় ওই কথা বলে ভীষণ ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছে। সত্যিই তো! বাঘ কোথায় বনে বনে হাঁক ছেড়ে ঘুরে বেড়াবে, তা নয়, বেহালা নিয়ে বাজনা বাজাচ্ছে! কে শুনেছে এমন কথা! কিন্তু পালাবো যে, তাও তো পারছি না। বলতে লজ্জা নেই, এখন আমি ওই ছোট্ট ছেলেটিকে ছেড়ে পালাবার কথা ভাবতেই। পারছি না। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে, ভীষণ সাহসী। আমাকে একটুও ভয় পেল না! যাই বলো, তাই বলো, বীরের মতো মাথা উঁচিয়ে যে সাহস দেখায়, তাকে কে না ভালোবাসে? কারণ, বাঘও তো বীর। তবে আমাকে হয়তো বীর বলতে তোমার মন না-ও চাইতে পারে। ভাবতে পারো, বাঘ হয়ে একটা ছোট্ট ছেলের সঙ্গে ভাব করার জন্যে যে উসখুস করে, তাকে বীর বলবে না আর কিছু! তুমি যাই ভাব, আমার কিন্তু ছেলেটিকে বড্ড ভালো লেগেছে।

রক্ত থেমে গেছে। ছেলেটি আমায় ছেড়ে আবার ছুটে গেল। ছুটে গেল ওর মায়ের কাছে। ছুটতে ছুটতে বলল, ‘যাই, মায়ের ঘুম ভেঙে গেছে! আমার বাজনা শুনতে না পেলে মা ভাববে। মায়ের চোখে ঘুম আসবে না।’

ছোট্ট টিপিটার কাছে বসে বসে সে আবার বাজনায় সুর বাজাল। মিষ্টি সেই সুরের রিনিঝিনি হাওয়ার দোলনায় ভেসে ভেসে দোল খাচ্ছে। আর আমি মনে মনে ভাবছি, ও যদি ওইটা বাজাতে শিখিয়ে দেয়! আমি তো কথা বলতে পারি না। ওকে কেমন করে বোঝাব, আমি বাজনা শিখতে চাই।

কখন অজানতে আবার ছেলেটির কাছেই আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি! আমাকে দেখতে পেয়ে ও থামল। আমার কানের কাছে মুখ এনে নীচু গলায় বলল, ‘চুপ, কথা বলিস না যেন। মা ঘুমুচ্ছে, এইখানে, এই মাটির নীচে।’

আমি চোখ ফিরিয়ে দেখলুম। ভাবলুম, ‘বাববা! মানুষ মাটির নীচে ঘুমোয় কেমন করে? সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে কীরকম একটা রহস্য বলে মনে হচ্ছে। সবটার মধ্যে কী যেন গোলমেলে গন্ধ! আমি ওই ঢিবিটার দিকে আবার তাকালুম। কিছুই দেখতে পেলুম না।

ছেলেটিই বলল, ‘তুই দেখতে পাবি কী করে? আমি ছাড়া মাকে কেউ দেখতে পায় না। রোজ আমার মা এই মাটির নীচ থেকে উঠে এসে, আমার চিবুক ধরে আদর করে। আমার কপালে চুমু খায়। আমি ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে, মাকে আদর করে যেই জড়িয়ে ধরি, মা হারিয়ে যায়!’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে পড়ল ছেলেটি। আমি অন্ধকারেও লক্ষ করলুম, তার চোখ দুটি ছলছল করছে। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তারপর ঠোঁট দুটি ওর কেঁপে উঠল। আমার চোখের দিকে কীরকম অসহায়ের মতো তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে। বলল, ‘ওরা আমার মাকে মেরে এইখানে শুইয়ে রেখে গেছে।’ বলতে বলতে থামল ছেলেটি, কেমন মন আনমনা করা সেই নিস্তব্ধতা। সেই নির্জন নিস্তব্ধতায় সে আবার হঠাৎই চিৎকার করে উঠল, ‘শয়তান! শয়তান! নির্দয়, ভয়ংকর সেই শয়তান! সেই শয়তানের নাম হুড্ডা-গুড্ডা।’

আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালুম। চারিদিক নিস্তব্ধ! নিস্তব্ধ বনের অন্ধকারে আমি দেখতে পেলুম, ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছে। হয়তো রাগে। না কি আর কিছু আছে ওর মনে, আমি তা বুঝতে পারিনি। আমার শুধু মাথায় তখন একটা কথাই ফিরে ফিরে ঘুরে আসছে। আমি ভাবছি, হুড্ডা-গুড়া কী কোনো জন্তু, না মানুষ! হুড়া-গুড়া বলে কোনো জন্তুর নাম তো কখনো শুনিনি!

আবার ছেলেটি কথা বলল। বলল, ‘জানিস, আমার বাবা খুব ভালো বেহালা বাজাতে পারে! আমার হাতে এই যে বেহালাটা দেখছিস, এটা বাবাই আমায় কিনে দিয়েছে। আমি বাবার কাছেই এটা বাজাতে শিখেছি! আমার বাবা কে জানিস? আর আমি? আমার বাবা রাজা। আমি রাজপুত্র!’ এইটুকু বলে ছেলেটি থামল। একটুখানি ক্লান্ত হাসি ওর ঠোঁট দুটি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল।

আমি বোকার মতো ওর মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতে বসলুম, যাচ্চলে, ওর বাবাও রাজা! রাজা তো আমার বাবাও ছিল। তার মানে, যার যখন খুশি এখন-তখন যে কেউ রাজা হয়ে যেতে পারে!

তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুই শুনবি আমার কথা?’

আমি কী বলব!

‘তুই শুনেই বা কী করবি! তুই তো বাঘ! আমার কথা বুঝবি কিছু?’

আমি ঘাড় নেড়েছিলুম কি না জানি না। কিন্তু আমার ল্যাজটা অজানতে নেড়ে ফেলেছিলুম। হয়তো সেই নাড়ন্ত ল্যাজ দেখেই ও বুঝেছিল, আমি ওর কথা শুনতে চাই। ও তাই শুরু করেছিল।

.

০৯.

এখন তাই শোনা যাক সেই ছেলেটির গল্প।

‘আমার বাবা এই দেশের রাজা। কিন্তু আমার বাবাকে দেখলে রাজা বলে কেউ মনেই। করতে পারবে না। রাজার মস্ত প্রাসাদ, সোনার সিংহাসন, মণি-মুক্তা-সাজানো রাজমুকুট, হাতি-ঘোড়া সৈন্যসামন্ত সব ছিল। কিন্তু আমার বাবার ছিল না রাজার দেমাক। তাই গরিব বড়োলোক সবার বাড়িতে বাবা ছুটে যেত। রাজপ্রাসাদে তাদের ডেকে আনত। আদর করে বসিয়ে তাদের নিজের হাতে বাজনা শোনাত। চাই কি, যে শিখতে চাইত তাকে শিখিয়ে। দিত। বাবা ছিল খুব সুখী। বাবার রাজত্বে ছিল প্রচুর আনন্দ। কোনোদিন যুদ্ধ করতে হয়নি বাবাকে। কেন করতে হবে। কারুর সঙ্গে তো শত্রুতা ছিল না তার। অন্য কোনো রাজ্যের একমুঠো মাটিও বাবা কোনোদিন নিজের হাতে ছোঁয়নি। কিন্তু উলটে নিজের দেশের মাটি সোনায়-সোনায় উপচে গেছিল। বেহালা বাজানো এটা তো ছিল বাবার শখ। আর তাই শখ করে বাবা আমাকেও বাজনা শেখাত। আমি যখন শিখতাম, বাজনার তারে সুর ছড়িয়ে যখন মাথা নাড়লুম, তখন বাবা মাকে ডেকে বলত, ‘রানি, দেখো, দেখো, তোমার ছেলে। তার বাপকেও হার মানাবে।’ এ কথা শুনে আমার তখন ভীষণ লজ্জা করত। কিন্তু কী। আনন্দ যে লাগত! আমার বাবা জানতেই পারেনি, আমাদের এই সুখের রাজত্বে এক শয়তানের দৃষ্টি পড়েছে! কে জানত, এখানে এক শয়তান বাসা বেঁধেছে!

‘দলবল নিয়ে গভীর জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছিল এই শয়তানটা! মানুষ খুন হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, আমাদের রাজত্বে এই কথা কেউ কোনোদিন ভাবতেই পারে না। কিন্তু ঠিক তাই। হল। একদিন দেখা গেল, আমাদের এক সৈনিক বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে। রাস্তায় পড়ে আছে। আর একদিন খবর এল, এক প্রজার বাড়ি লুঠ হয়ে গেছে। কেমন করে লুঠ হল, আর কারাই-বা লুঠ করল, কেউ বলতে পারছে না। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য, একদিন বাবার নিজের আদরের হাতিটিকে কারা গুলি করে মেরে ফেলেছে! রাজপ্রাসাদের হাতিশালে ঢুকে, হাতিকে মারা তো সোজা কথা নয়! সবাই বুঝল, এমন দুঃসাহসের কাজ যে করতে পারে, সে এক ভয়ংকর শয়তান!

বাবা পড়ল ভীষণ ভাবনায়। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হল বাবার। হাতের বাজনা থেমে গেল। হুকুম হল, যে এ-কাজ করছে তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। তখন শুরু হয়ে গেল সেই শয়তানকে খুঁজে বার করবার জোর তোড়জোড়। বাবা নিজেও বাজনা ছেড়ে বন্দুক ধরল। অন্ধকার রাতে নিজের সেনাদের নিয়ে সেই শয়তানকে খুঁজে বেড়াতে লাগল।

কিন্তু কদিন হয়ে গেল, কিছু কিনারাই হল না। সেই শয়তান ধরা পড়ল না। অবাক কথা, সে যে কখন আসে, কোথা দিয়ে আসে, কেমন করে আসে, কেউ দেখতে পায় না, বুঝতেও পারে না!

হঠাৎ একদিন ধরা পড়ল! ধরা পড়ল বটে, কিন্তু সেই শয়তানটা নয়, তার দলের একটা লোক। এই লোকটা ছিল শয়তানটার খুব বিশ্বাসী। তাই তাকে পাঠানো হয়েছিল রানিকে খুন করে, তার গলায় যে মরকতের মালাটি রয়েছে, সেটি হরণ করে আনতে। আমি বলছি না, শয়তানের এই লোকটি খুব বোকা ছিল। কিন্তু আমার মা ছিল তার চেয়ে অনেক চালাক। অবাক লাগে, লোকটা ছদ্মবেশে পরে লুকিয়ে-ছাপিয়ে আসেনি! রাজপ্রাসাদের ভেতরমহলের চাকর সেজে সে সুযোগ খুঁজছিল। ঘরের চাকরকে কে আর সন্দেহ করবে? তা ছাড়া রাজবাড়ির অত দাসদাসির মধ্যে কে কোথায়, কোন মহলে কখন যাচ্ছে, কখন আসছে, তার হিসাব রাখা তো সোজা কথা নয়! কিন্তু আমার মা রাজরানি হলেও, ঘরকন্নার খুঁটিনাটি কাজ সব নিজের হাতে করত! আর সেইজন্যে মা ঝি-চাকর, দাসদাসি, সবাইকে। চিনত! ওই-লোকটা যে একদম অচেনা, সেটা মা তাকে এক নজরেই বুঝতে পেরেছে। তবু কিছু বলেনি। তার চলাফেরা, তার কাজকৰ্ম্ম, হাবভাব সব চুপচাপ লক্ষ করে যাচ্ছে।

তারপর তক্কে তক্কে এক সময় হঠাৎ মায়ের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছিল লোকটা। ঢুকে, পালঙ্কের নীচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে পড়ল। মা কিন্তু ঠিক দেখে ফেলেছে। যেন কিছু জানে না, মা মিথ্যে ভান করে কখনো ঘরে ঢুকছে, এটা ওটা খুঁটিনাটি নাড়ানাড়ি করছে, বেরিয়ে আসছে! এমনি করতে করতে এক সময় চট করে বাইরে থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে শেকল তুলে দিল মা! লোকটা ভেতরে আটকা পড়ে গেল! মায়ের সত্যি কী সাহস, কী বুদ্ধি!

লোকটা ধরা পড়ল। প্রাণের দায়ে সব কথা ফাঁস করে দিল। সে-ই বলল, তারা দস্যু। তাদের সর্দারের নাম হুড়া-গুড়া। তাদের আস্তানাটা সে বাতলে দেবে।

দিলও তাই। তার কথা মতো, একদিন রাজসেনাদের নিয়ে বাবা ঘোড়ার খুরে ধুলো উড়িয়ে গভীর জঙ্গলে সেই হুড্ডা-গুড়ার আস্তানায় হানা দিল। একটা পাহাড়ে, অন্ধকার গুহার মধ্যে তাদের আড্ডা। আচমকা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজসেনারা। কিন্তু তখন সেই দস্যু-সর্দার হুড্ডা-গুড়া সেখানে কোথায়? শুধু তার সাকরেদরা গুহা পাহারা দিতে সেখানে হাজির রয়েছে। চমক দিয়ে রাজসেনার বন্দুকের গুলি গর্জে উঠল। তারা তো হকচকিয়ে। গেছে। কিছু করবার সুযোগই পেল না। আগুনের ফুলকি ছুটে ছুটে হুড়া-গুড়ার গুহার আস্তানা তছনছ করে দিল। সব কটা লোক বন্দি হল। গুহার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হল হাজার হাজার মোহর। দামি দামি হিরে-জহরত আরও নানান জিনিস। সেইসব মালপত্তর দশটা হাতির পিঠে চাপিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসা হল। তারপর ঢোল-শহরৎ করে সেইসব জিনিস গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিল বাবা। লোকে রাজার জয়ধবনি দিতে দিতে ঘরে ফিরে গেল।

ধীরে ধীরে দেশের লোক হুড্ডা-গুড়ার কথা ভুলে গেল। কেননা, তারপর থেকে দেশে আর দস্যুর অত্যাচার রইল না। বাবা আবার বাজনা ধরল।

কিন্তু হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটল। সেদিনটা ছিল বাবার অভিষেকের দিন। যেদিন বাবা প্রথম সিংহাসনে বসে, প্রত্যেক বছর সেদিনটা খুব ধুমধামে উৎসব করা হয়। সারা শহরটা আলোর মালা, রঙিন পতাকা আর নানান ফুল দিয়ে সাজানো হয়। সে সময়ে শহরটা দেখতে লাগে যেন রঙিন আলোর দেশ। কত দূর দূর থেকে, কত মানুষ এই উৎসব দেখতে আসেন। কত রাজরাজড়া, কত গণ্যমান্য মানুষ, কবি-গায়ক উৎসবে যোগ দেন। তাঁদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়। দেওয়া হয় প্রচুর উপহার। আর সবশেষে রাজদরবারে আসর বসিয়ে বাবা তাঁদের শোনায় নিজের হাতে বেহালার বাজনা।

এবারেও অভিষেকের দিনে এসেছিলেন হাজার হাজার লোক। এবার আর বাবা নিজে বাজনা শোনাল না। বলল, এবার আপনাদের বাজনা শোনাবে আমার ছেলে।

রাজদরবার লোকে লোকারণ্য। অত লোক দেখে, আমার কিন্তু একটুও ভয় করেনি। আমি বেহালায় সুর ধরলুম। এখন আমি মনে করতে পারছি না, কতক্ষণ আমার বাজনায় সুর। বেজেছিল। আর কত লোক আমার বাজনা শুনছিলেন, কত লোক থেকে থেকে আনন্দ আর খুশিতে বাহবা দিচ্ছিলেন। আমি যেমন একমনে বাজনা বাজাচ্ছিআর সকলেও তেমনি একমনে শুনছেন। কেউ তখন জানতেও পারেননি সেই দস্যু শয়তান হুড্ডা-গুড়া আর তার দলবলও রাজদরবারে হাজির রয়েছে। ছদ্মবেশে ওই অগুনতি লোকের মধ্যে মিশে এখুনই যে তারা এক ভীষণ কাণ্ড করবে বলে ওত পেতে বসে আছে সে-খেয়াল কার আছে? দুম দুম! কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ রাজদরবারে অসংখ্য লোকের মধ্যে বোমা পড়ল। আগুনের ঝলকা এসে বাবার চোখে-মুখে লাগল। আবার দুম দুম। আগুনের ঝলকা থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী সারা দরবারে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমটা হঠাৎ আচমকা এই শব্দে দরবারের প্রতিটি লোক হকচকিয়ে গেছিল। তারপর প্রচণ্ড চেঁচামেচি আর হুড়োহুড়ি! কে আগে পালাবে, সেই নিয়ে ঠেলাঠেলি আর হট্টগোল। কেউ পড়ল, কেউ মরল, কেউ অজ্ঞান হয়ে গেল। তখন কে রাজা, কে প্রজা আর কেই-বা গণ্যমান্য। প্রাণ বাঁচাতে সবাই কান্নাকাটি জুড়ে দিল।

আমার চোখ দুটোও ভীষণ জ্বালা করছে। কিন্তু হাতের বাজনা আমি ছাড়িনি। ওই ধোঁয়ার কুণ্ডলী আমার চোখের ওপর যখন আছড়ে পড়ল, আমি ভেবেছিলুম, আমি বুঝি অন্ধ হয়ে গেছি। অন্ধ আমি হইনি। আমি আবছা চোখে দেখতে পেলুম, বাবা দু-চোখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি ভয়ে চিৎকার করে বাবাকে জড়িয়ে ধরলুম। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে ছুটতে গেল! কিন্তু পালাবে কোথায়? সেই সর্দার হুড়া গুড়া ওদিক থেকে ছুটে এসে বাবার পায়ে লাঠির বাড়ি এমন জোরে মারল, বাবা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে। আমিও পড়লুম। সঙ্গে সঙ্গে দস্যুরা ছুটে এল। আমার দিকে না তাকিয়ে বাবাকে ওরা বেঁধে ফেলল। বাবাকে বাঁধতে দেখে, আমি লাফিয়ে উঠে সর্দারের বুকে। মেরেছি এক ঘুষি। সর্দার চিৎকার করে আমার গলাটা টিপে ধরল। এমন টিপে ধরেছে, মনে হল, আমি এক্ষুনি দম আটকে মরে যাব। আমি মরলুম না। সে আমার গলায় ভীষণ জোরে এক ধাক্কা মারল। আমি চিতপাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলুম। আমার হাতের বাজনেটা আর একটু হলে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। খুব বরাত ভালো, অনেক কষ্টে বাঁচাতে পারলুম। কিন্তু বাবাকে ওদের হাত থেকে ছাড়াতে পারলুম না। ওরা বাবাকে বেঁধে নিয়ে কোথায় যে চলে গেল জানতে পারিনি। আর আমাকে ওরা চ্যাং-দোলা করে ঘোড়ার পিঠে তুলল। আমি উঠব না কিছুতেই। আমি কি পারি? সর্দার নিজেই ঘোড়া ছোটাল। ততক্ষণে রাজদরবার তছনছ হয়ে গেছে।

আমার মা এতক্ষণ কোথায় ছিল জানি না। সর্দার আমায় নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দেখে, ঘোড়ার পিঠে চেপে বন্দুক নিয়ে ছুটে এসেছে মা। এতদিন আমি মাকে দেখেছি রাজরানি বেশে। আশ্চর্য! আজ দেখলুম মায়ের অন্য মূর্তি। মায়ের বন্দুক গর্জে উঠল গুড়ুম! সর্দার আমাকে পাকড়াও করে ঘোড়ার পিঠে ছুটছে। মা-ও পেছনে ঘোড়ার পিঠে। হাতে বন্দুক। মা হয়তো ভেবেছিল, ঘোড়াটাকে যদি বন্দুক মেরে কোনোরকমে খোঁড়া করে দিতে পারে তাহলে আমি উদ্ধার পাব, দস্যু-সর্দারেরও দফা শেষ হবে। তাই গুলি চালাল মা ঘোড়ার পায়ের ওপর। ঘোড়া চিঁহিঁহিঁ করে ডেকে উঠে মাটিতে ছিটকে পড়েছে। আমিও পড়লুম, দস্যুটাও পড়ল ঘোড়ার ঘাড়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে সর্দার উঠে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়ল মায়ের দিকে। আমাকে ওই সর্দার-দস্যুটা এমনভাবে তার সামনে দাঁড় করিয়ে নিজে আমার আড়ালে দাঁড়াল যে, মা আর গুলি ছুঁড়তে পারে না। কারণ, ছুড়লেই আমার বুকে। লেগে যাবে। তাই মা ছুট্টে আড়ালে চলে গেল। মা হয়তো ভেবেছিল, নিঃসাড়ে সর্দারটার পেছনে চলে যাবে। পেছন থেকে গুলি মেরে সর্দারের পিঠটা ঝাঁঝরা করে দেবে। মা সর্দারের পেছনেই গেছিল। হয়তো বন্দুকও তুলেছিল। কিন্তু তার আগেই শয়তানের দল মায়ের বুকে গুলি চালিয়ে দিয়েছে। মা ঘোড়ার পিঠ থেকে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। তারপর আর কথা বলতে পারেনি মা।

রাজপ্রাসাদটা দখল করে নিলে শয়তানের দল। তারা বাবাকে বন্দি করে রাজপ্রাসাদের গারখানায় আটকে রাখলে। আমি যতদূর জানি, বাবা এখনও সেখানেই আছে। আমাকে আর আমার মায়ের নিস্তেজ দেহটা তারা এই জঙ্গলে নিয়ে এল। তারা আমাকে মারল না। আমার পা দুটো শেকল দিয়ে বেঁধে দিল। আমি যেন পালাতে না পারি। তারা ভেবেছিল, বনের বাঘ এসে আমায় জ্যান্ত খেয়ে ফেলবে। আর আমার মায়ের দেহটা ওরা এইখানে, এই মাটির নীচে পুঁতে রাখল আমার চোখের সামনে। কিন্তু তখন মাকে পুঁততে দেখে। আমার চোখ দিয়ে একটুও জল পড়েনি। আমি ভেবেছিলুম, তবু ভালো, আমি যদি মরি আমার মায়ের কাছেই মরতে পারব। এখন একটা কথা কিন্তু ভাবতে ভারি আশ্চর্য লাগে। আমি যেমন আমার হাত থেকে বাবার দেওয়া বেহালাটা ছাড়িনি, ওরাও যে কেন আমার হাত থেকে এটা কেড়ে নেয়নি, আমি তা আজও জানি না। তাই এটা আমার কাছেই আছে। আমি এই বেহালাটা বাজিয়ে রোজ মাকে জাগাই, ঘুম পাড়াই। আর ভাবি, এখন আমার বাবা কী করছে রাজপ্রাসাদের গারখানায়?’

কথা তার শেষ হল। ছেলেটি থামল। আমার মুখের দিকে চাইল সে। হয়তো ভেবেছিল, আমি কিছু বলব তাকে। তারপর যখন দেখল বাঘ হয়েও হাঁদার মতো আমি চুপ করে। আছি, ওর মুখে কেমন একটা দুঃখ-মেশানো হাসি ঝিলিক দিয়ে হারিয়ে গেল। নিজের মনেই বেহালাটা বুকে তুলে নিল। তারপর আবার বাজাতে শুরু করল। এখন ওর এই বাজনার সুরটা আমার মাথায় ঢুকছে কি না বুঝতে পারছি না। কিন্তু ওর কথাগুলো গুনগুন করে আমার সমস্ত মনটাকে নাড়া দিচ্ছে। আমি ভাবছি আর অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, মানুষ বন্দুক নিয়ে শুধু বাঘই মারে না। মানুষ বন্দুক দিয়ে মানুষকেও মারে!

আমার চোখে চোখ পড়তে ওর বাজনা থামল। আমায় বলল, ‘তুই তো জন্তু। মানুষের মতো কথা তো বলতে পারিস না! মানুষের মতো বাজনা বাজাতে পারবি? আমি শিখিয়ে দেব।’

আমার মনটা যেন ‘ধ্যাং’ করে উঠল।

তারপর বলল, ‘তুই তো বাজাচ্ছিলি। এই নে, আবার বাজা!’ বলে বেহালাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল।

আমি একটুখানি দোনোমনো করেছিলুম। তারপর সামনের একটা থাবা এগিয়ে দিলুম বাজনাটার দিকে। বাজনার তারে ঘা পড়ল, ‘টুং!”

ছেলেটি বলল, ‘বারে! বেশ তো পারিস!

আমি আর একবার আর একটা তার টানলুম, ‘টাং!’

তারপর আর একটা, ‘টিং!’

শেষকালে একসঙ্গে, ‘টুং-টাং-টিং!’

একবার দুবার, তারপর বারবার, ‘টুং-টাং-টিং!’

একবার, দুবার, তারপর বারবার, ‘টুং-টাং-টিং! টুং-টাং-টিং! টুং-টাং-টিং!’

ছেলেটি খুশিতে হেসে উঠল।

.

১০.

হঠাৎ চমকে উঠেছিলুম আমি। ছেলেটিও বোধ হয় চমকে গেছিল! একসঙ্গে অনেকগুলো ঘোড়া ছুটে এলে যেমন শব্দ ওঠে নির্জন বনে, আমি শুনলুম, তেমনি যেন শব্দ আমার কানে ভেসে আসছে। ছেলেটি চটপট উঠে দাঁড়াল। আমায় বলল, ‘দস্যু আসছে! তুই এখান থেকে পালা!’

পালাবো কেন? আমি কাকে ভয় পাই! ওখানে থেকে উঠে আমি একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। আমি আগে কখনো দস্যু দেখিনি। আমি ভাবলুম, যাক, ঝোপের আড়ালে বসে এবার তাহলে দস্যু দেখা যাবে! যে কখনো দস্যু দেখেনি, তার তো দস্যু জিনিসটা। কেমন দেখতে এটা জানার ইচ্ছে হবেই।

আমি লুকিয়ে পড়লুম, কিন্তু ছেলেটি যেখানে আগে বসেছিল, আবার সেখানেই বসে পড়ল। আবার বেহালাটা বাজাতে লাগল।

ততক্ষণে দস্যুরা সেখানে হাজির। ওদের চেহারা আমি দেখতে পেয়েছি। ঘোড়ার পিঠে ছুটে আসছে। আগাগোড়া বিচ্ছিরি কালো রঙের পোশাক পরে আছে। চোখগুলো কালোকাপড়ের ঢাকনি দিয়ে এমনভাবে মোড়া, তুমি শত চেষ্টা করলেও ওদের চোখ দেখতে পাবে না। কিন্তু ওরা তোমায় ঠিক দেখতে পাবে। সক্কলের কাঁধে একটা করে বন্দুক। দলে ক-জন আছে আমি বলতে পারব না। কিন্তু অনেকজন।

বাজনার শব্দটা শুনেই বোধ হয় ওরা ঘোড়া দাঁড় করাল। তারপর ঘুরে ঘুরে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে কতক্ষণ লাগবে? ছেলেটি তো সামনেই বসে আছে। একজন দস্যু ছেলেটিকে প্রথম দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেল। সবাইকে ডেকে বলল, ‘আরে! একে তো এখনও বাঘে। খায়নি! এখনও তো বেঁচে আছে!’

ছেলেটি কিন্তু ওদের কথা কানেই নিল না। সে যেমন বাজাচ্ছিল, তেমনিই বাজাচ্ছে!

একজন দস্যু ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে কাছে এগিয়ে গেল। ক্যারকেরে গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এই, এখানে কী করছিস?’

ছেলেটি তোয়াক্কাই করল না।

একজন হঠাৎ ওর পা দুটো দেখতে পেয়েছে। চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে! পায়ের শেকলটা তো পায়ে বাঁধা নেই! খোলা পড়ে আছে!’

সত্যিই শেকলটা ওর পাশেই পড়ে ছিল।

হঠাৎ দস্যুটা ওর হাত থেকে বাজনাটা কেড়ে নিয়ে, ছুঁড়ে ফেলে দিল। ভাঙেনি রক্ষে! তারপর ওর ঘাড়টা ধরে টেনে তুলল। জিজ্ঞেস করল, ‘পায়ের শেকল খুলেছিস কেন?

ছেলেটি এতক্ষণে কথা বলল। বলল, ‘বেশ করেছি!’

আমি অবাক হয়ে গেলুম ওর কথা শুনে। দারুণ তেজিয়াল ছেলে তো! একটুও ভয় পেল না! আমি বুঝতে পারলুম, দস্যুটা ওর কথা শুনে ভীষণ খেপে গেছে। ঘাড়টা ধরে খুব জোর ঝাঁকুনি দিল। বলল, ‘মুখের ওপর কথা! সাহস তো কম নয়! মেরে দাঁতগুলো উপড়ে ফেলব!

ছেলেটি উত্তর দিল, ‘আমিও দাঁত উপড়ে নিতে পারি!’

ছেলেটির কথা শুনে দস্যুটা কীরকম ঘাবড়ে গেল! থতমত খেয়ে গেছে! সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পিঠ থেকে আর একটা দস্যু চেঁচিয়ে বলল, ‘দে না, একদম খতম করে দে!’

‘তাই দেব,’ বলে যেই দস্যুটা ওর ঘাড় ছেড়ে, নিজের কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়েছে ছেলেটিও মাটি থেকে লোহার শেকলটা তুলে নিয়েছে। হাত ঘুরিয়ে চোখের নিমেষে ধাঁই করে ওর মুখের ওপর মেরে দিয়েছে। লোকটা ছিটকে পড়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। কী দুর্দান্ত সাহস!

কিন্তু এবার তো ওর নিশ্চয়ই বিপদ! এবার ওকে নিশ্চয়ই মারবে! কিন্তু মজা কী, মারবার আগে ও নিজেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আয়, আয়, দেখি তোদের কত সাহস!’ বলে সেই লোহার শেকলটা বনবন করে ঘুরিয়ে এগুতে লাগল। ঘোড়াগুলোও ভয়ে পিছু হটছে। তা বলে তো আর লোহার শেকল ঘুরিয়ে বন্দুকের গুলি আটকানো যায় না! দস্যুরা ঝটপট বন্দুক তুলল। আমি দেখলুম ওর এবার নির্ঘাত মরণ!

ওরা বন্দুক ছোঁড়ার আগেই ঝোপের ভেতর থেকে আমি হঠাৎ হুংকার ছাড়লুম, ‘হালুম!’

থমকে গেল ওদের বন্দুক। চমকে উঠল ওদের বুক। ওরা কিছু বুঝতে না বুঝতেই, আমি দস্যুদের ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়লুম। ওরা ভয়ে মরাকান্না কেঁদে উঠল। ঘোড়াগুলো চার পা তুলে লাফাতে লাগল। আমি এক-একটা থাবা মারি আর এক-একটা দস্যু মাটির ওপর চিতপাত হয়ে লুটিয়ে পড়ে! আমার গর্জন, ওদের চিৎকার আর ঘোড়াগুলোর চিহি-চিহি। ডাক, সব মিলিয়ে তখন যেন সেখানে কুরুক্ষেত্র! আমি বেশ মনে করতে পারছি, সেদিন সব ক-টা দস্যুকে আমি খতম করে দিয়েছিলুম। সব কটার বন্দুক হাত থেকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আর ঘোড়াগুলো, কোনোটা মরেছে, কোনোটা মাটিতে পড়ে ছটফট করছে আর কোনোটা এদিক-ওদিক ছুটে ছুটে পালাচ্ছে। এই সুযোগে একটা কিন্তু কাণ্ড ঘটে গেল। একজন দস্যু আমাকে ফাঁকি দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে দে চম্পট। আমার নজর এড়ায়নি। আর এই ব্যাপারটাই যে সাংঘাতিক বিপদ ডেকে আনবে, আমি সেটা তখনই। বুঝতে পেরেছিলুম। বুঝলে কী হবে! আমি তো কথা বলতে পারি না। আমি তো ছেলেটিকে বলতে পারিনি, এখানে আর থাকা উচিত নয়। আর যদিও বলি, ও আমার কথা শুনবে কেন? ও কি এখান থেকে মাকে ছেড়ে যাবে?

দস্যুগুলোকে হারিয়ে দিয়ে জেতার গর্বে আমার বুকটা ফুলে ফুলে উঠছিল। আর এমন একজন সাহসী ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে পেরে আমার যে কী আনন্দ, বলতে পারছি না। বীরের সঙ্গে বীরেরই পোয়! ল্যাদাডুস ল্যাংচা-মার্কাদের নিয়ে কাজ হয়!

আমি হাঁপাচ্ছিলুম। ঠিকই, একটু হাঁপিয়ে গেছিলুম। ছেলেটি ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। আমায় আদর করল। আমিও আমার এই হাঁড়ির মতো মস্ত মুখটা দিয়ে ওর গালটা ঘষে দিলুম।

ছেলেটা খুশিতে ছুটে গিয়ে ওই মরা দস্যুদের বন্দুকগুলো তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রাখল। বলল, ‘কোনোদিন আর যদি কেউ আসে, এই বন্দুক দিয়ে তাকে। শেষ করব।’

আমি জানতুম, যদি কেন, নিশ্চয়ই আসবে। কারণ, যে-দস্যুটা পালিয়েছে, সে কি তার দলবলকে এ-কথা বলবে না? দস্যুসর্দার হুড্ডা-গুড়া কি ছেড়ে কথা বলবে? ওই দস্যুটা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে আমার তাই এতো আফশোস হল! আমায় বোকা বানিয়ে দিল! আমিই বা কী করব! একা সক্কলের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। ব্যাপারটা তো চারডিখানি নয়! তার ওপর সবার হাতে বন্দুক। একবার চালিয়ে দিলেই হল! কিন্তু বন্দুক চালানোর সুযোগ কাউকে দেওয়া চলবে না। সুতরাং হাওয়ার মতো ছুটে ছুটে আমায় কাজ করতে হয়েছিল। এখন সেই ফাঁকে কেউ পালালে, আমার বরাত ছাড়া আর কী বলব!

বন্দুকগুলো যখন সব ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল ছেলেটি, তখন বেহালাটা আবার তুলে নিল। ভালো করে পরখ করল। নাঃ, ভাঙেনি। আমায় বলল, ‘আয়, এবার তোকে বেহালা বাজাতে শিখিয়ে দিই।’

সত্যি বলছি আমার তখন ওই বেহালা-টেহালা বাজাবার মতো মনের অবস্থা নয়। মন তখন পড়ে আছে অন্যখানে। ভয় হচ্ছে, দস্যুরা এবার না লুকিয়ে লুকিয়ে চলে আসে। কিন্তু ছেলেটির কথা না শুনলে ও যদি দুঃখ পায়! সত্যিই, ওকে দুঃখুদিতে কষ্ট লাগে! আর সেই কথা ভেবেই, ইচ্ছে না থাকলেও, বেহালা শিখতে আমি আপত্তি করলুম না। ওর পাশে গিয়ে বসলুম।

ছেলেটি বলল, ‘প্রথমে তোকে সা-রে-গা-মা শিখিয়ে দিই।’

তোমাকে তো আগেই বলেছি আমি বাঘ। ওই হাসি-টাসি ব্যাপারগুলো আমার ধাতে সয় না। কিন্তু সা-রে-গা-মা কথাটা শুনে আমার হঠাৎ এমন মজা লাগল! মনে হল, কে যেন হাসিয়ে দেবার জন্যে আমার পেটে কাতুকুতু দিয়ে দিল। যে হাসতে জানে না, তার কাতুকুতু লাগলে যে এমন দুর্দশা হবে, আমি তা মোটেই ভেবে পাইনি। আমার মনে। হচ্ছিল, হাসিটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবার জন্যে যতই আঁচড়-পাঁচড় করছে, ততই আমার পেটের ভেতরে সেটাকে কে যেন আঁকপাকিয়ে টেনে ধরে রাখতে চাইছে। সে এক ভয়ানক হেসুড়ে ব্যাপার! হাসি পাচ্ছে অথচ হাসতে পারছি না।

শেষকালে ফট করে পেটের ভেতর থেকে ফসকে হাসিটা মুখ দিয়ে হা-হা-হা শব্দে বেরিয়ে এল। আমি হেসে ফেললুম। বাঘের হাসতে সত্যি মানা কি না জানি না। কিন্তু একবার যখন হেসে ফেলেছি, তখন সেটাকে থামাবার চেষ্টা না করে, হাসতে-হাসতেই বেহালায় সা-রে গা-মা-পা-ধা-নি শিখতে লাগলুম।