টুইটুই – ২

আনমনে দেখতে দেখতে, হাঁটছে শান্ত। দেখছে, আর অবাক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেমন যেন লোকগুলো এখানকার? একটা নতুন মানুষ দেখলে জিজ্ঞেস তো করবে, কোথায় ঘর? কী নাম? যাঃ চলে! কথা বলবে কী, চেয়েই দেখে না। যাও-বা দেখে আড়চোখে। দেখেই চোখ ঘুরিয়ে চলে যায়! এত কী কাজ সবার?

আচ্ছা, ওই লোকটা কী করছে? রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে? আহা! কী সুন্দর সেজেছে দেখ? নীল-পোশাকে লালফিতে, কোমরে জড়ানো! লাল-পাগড়ি, তাতে পাখির পালক। জামার বোতাম, তাও সোনালি রং। ঝকমক। পায়ে জুতো, কালো কুচকুচ। খাপে ঢাকা তরোয়াল, কোমরে আঁটা। ইয়া লম্বা পাকানো-গোঁফ। গোঁফ দেখলে হাসি পায়।

লোকটা সিপাই।

নিজের দিকে তাকাল শান্ত। ঈশ! কী বিচ্ছিরি নোংরা হয়ে গেছে কাপড়টা। হবে না? এতখানি পথ হাঁটতে-হাঁটতে এসেছে সে। সেই কাল সকাল থেকে হাঁটছে এক কাপড়ে।

লোকটার সঙ্গে ভাব করতে ইচ্ছে করছে শান্তর। ইচ্ছে করল, তাই এগিয়ে গেল। সিপাইটার কাছে। কত লম্বা সিপাইটা! আর শান্ত কতটুকু! ঘাড় কাত করে দেখছে শান্ত।

‘হ্যাঁ গো, তোমার নাম কী গো?’ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল শান্ত।

শান্তর পেছনে একটা জুড়ি-ঘোড়ার এক্কাগাড়ি ছুটে আসছে।

সিপাইটা চোখ পাকাল।

থতমত খেয়ে গেল শান্ত। লোকটা তাকে দেখে হাসল না কেন?মুখটা কেন গোমরা হয়ে গেল।

তাই ভয়ে-ভয়েই শান্ত আবার বললে, ‘না, তোমার সাজটা কী সুন্দর! তাই বলছিলুম।’

‘হাটো’, সিপাইটা আচমকা চেঁচিয়ে উঠল।

সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেল শান্ত। তাকে কেউ কোনোদিন ধমকায়নি এমন করে। তাকেও না, চুমকিকেও না।

হয়তো শান্ত কেঁদে ফেলত। কাঁদবে কী! উরি বাবা! একী কাণ্ড! এক্কাগাড়িটা একেবারে শান্তর ঘাড়ের কাছে ছুটে এসেছে। হুড়মুড় করে।

 ‘হট যাও।’ সহিস চেঁচিয়ে উঠল। লাগাম ধরে টান দিল।

‘চি-হি-হি।’ চেঁচিয়ে উঠল দু-দুটো ঘোড়া। কী বিকট চিৎকার!

 ‘রোককে,’ চেঁচিয়ে উঠল সহিসটা আবার।

 ‘গেল-গেল-গেল’, হইহই করে উঠল রাস্তার লোক।

চাপা পড়ল নাকি শান্ত?

না। চাপা পড়েনি। তার আগেই সিপাইটা ছুটে এল। মারলে এক হ্যাঁচকা টান। শান্তর হাত ধরে। ছিটকে পড়ল শান্ত রাস্তার ধারে। চোখের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল এক্কাগাড়ি। সাঁই সাঁই করে। উঃ! খুব বেঁচে গেল শান্তা মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখে যেন সরষে ফুল দেখছে। কানটা ভোঁ ভোঁ করছে। যেন তালা লেগে গেছে।

কান ধরে তুলল তাকে, সেই সিপাইটা। ধমক দিল, ‘কী করছিস এখানে?’

‘কই? না তো। কিচ্ছু না।’ কেমন যেন হাঁদার মতো উত্তর দিল।

বেশ করে কানটা মলে দিল সিপাইটা।

উঃ লাগছে।’

‘লাগবার জন্যেই মলা হচ্ছে। ফের যদি আসবি, কান উপড়ে ফেলব। যাঃ পালা এখান থেকে।’ সিপাইটা একঠেলা দিল।

ঠেলা খেয়ে শান্ত সিপাইটার দিকে তাকাল। একবারটি। কেমন জুলজুল করে। তারপর মাথা হেঁট করে রাস্তা ধরল। সামনের রাস্তা। কাপড়টা ঠিক করল। লোকগুলো চেয়ে চেয়ে দেখছে তার দিকে। হাসাহাসি করছে। ঈশ কী লজ্জার কথা। ওদিকে আর যায়!

অন্য আর একটা রাস্তা ধরে হাঁটছিল শান্ত। ভয়ে ভয়ে। কী বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে গেল একটু আগে। লজ্জা করছে। ভারি লজ্জা করছে।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল শান্ত। এটা কার বাড়ি?

আঃ। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে তার দেখতে দেখতে। কত উঁচু বাড়িটা। যেন আকাশ পেরিয়ে যাবে। রোদের আলোয় ঝকমক ঝকমক করছে। একটা মস্ত বড়ড়া সিংদরজা। সিংদরজার গায়ে গায়ে সোনা-রুপোর পাত মোড়া। চুড়োয়-চুড়োয় হিরে জহরতের কাজ করা।

কে যেন মেঘ এনেছে হেঁকে। তুলতুল। তাই যেন ছড়িয়ে দিয়েছে বাড়ির গায়ে গায়ে।

কে যেন রং এনেছে সাতটি। ঝলমল। তাই যেন ঢেলে দিয়েছে মেঘের গায়ে।

সাতটি রঙের রামধনু যেন ছবি এঁকেছে।

শান্তর ভারি ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছে করছিল ভেতরে যেতে। ওই সোনার তোরণ পেরিয়ে। বাববা! যাবে কী করে? কত সিপাই! তরোয়াল উঁচিয়ে গটমট করে হাঁটছে। পা বাড়ালেই হয়তো আবার কান মলে দেবে। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল শান্ত।

একটা লোক আসছে। এ-দিকেই। তাকে দেখে শান্ত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁগো, এটা কার বাড়ি গো?’

লোকটা বলল, ‘সে কীরে? এখনও রাজার বাড়ি চিনিস না? কোথায় থাকিস? এটা রাজার বাড়ি।’

রাজার বাড়ি? অবাক হয়ে যাচ্ছে শান্ত। রাজার গল্প শুনেছে সে–অনেক। শুনেছে। রাজকন্যের গল্প। কিন্তু রাজবাড়ি তো সে কোনোদিন দেখেনি! তার চোখের সামনে রাজার বাড়ি!

ওই বাড়ির ভেতর রাজা আছে! তার মাথায় সোনার মুকুট। হয়তো রাজকন্যে এখন চুল আঁচড়াচ্ছে। সোনার কাঁকুই দিয়ে। না-জানি কতটুকু রাজকন্যে। হয়তো চুমকির

ভাবতে ভাবতে থামল শান্ত। হঠাৎ মনে পড়ে গেল চুমকির কথা।

ছোট্ট মাটির ঘর। আর তার ছোট্ট বোনটি। কতক্ষণ দেখেনি তাকে। কী করছে এখন চুমকি? হয়তো খুঁজছে তাকে। হয়তো কাঁদছে। আর বন্ধু? হয়তো তাকে ভোলাচ্ছে। কিন্তু এখন শান্ত কেমন করে ফিরে যাবে? পথ যে তার হারিয়ে গেছে। কোনদিকে তার গ্রাম? সেই পাহাড় ঘেরা গ্রাম?

আহারে! রাজার কাছে ও যদি যেতে পারত একবার? তাহলে রাজা কী ওর সঙ্গে কথা বলত না? ওকে আদর করে কাছে ডাকত না?

রাজাকে তখন সে সব বলত। বলত, ‘রাজামশাই আমার ছোট্ট বোনের হলুদ পাখি হারিয়ে গেছে। তুমি আমায় ধরে দাও। আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কত বড়ো আকাশ। এত বড়ো আকাশে কোথায় লুকিয়ে আছে আমার ছোট্ট বোনের পাখি। সে কাঁদছে। আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।’

হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়ল শান্তর। কই? এখানে তো একটাও পাখি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।

আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সান্ত্রি, ‘সামালকে।’

বুকটা ধড়াস করে উঠল শান্তর। আবার কী হল?

না। কিছু না। হাতি বেরোচ্ছে রাজবাড়ি থেকে, রাজবাড়ির সিংদরজা দিয়ে। রাজার হাতি।

দূর থেকে দেখল শান্ত।

কী সুন্দর পোশাক পরিয়েছে হাতিটার গায়ে। মখমলের ওপর সোনার কাজ পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। ঝুলে পড়েছে দুদিকে। একটা সোনার ঘন্টা গলায়। বেজে চলেছে ঢং ঢং। হেঁটে চলেছে হাতি থপথপ।

হাতির পিঠে মাহুত। মাথায় জরিদার পাগড়ি। গায়ে চুড়িদার জামা। হাতে রুপোর বালা। কানে বড়ো বড়ো মাকড়ি। কী সুন্দর দেখতে লাগছে। আহারে, ওই মাহুতটার সঙ্গে যদি ভাব থাকত শান্তর! তাহলে শান্তও হাতির পিঠে চেপে বেড়াতে যেত। হাতির কপালের ওপর শান্ত বসত। তার পেছনে মাহুত থাকত। মাহুতের কোলে চুমকি।

থাকতে পারল না শান্ত। নীচের থেকেই চেঁচিয়ে ডাকল, ‘ও মাহুতভাই, মাহুতভাই, কোথায় যাচ্ছ গো?’

মাহুত শুনতেই পেল না। হাতিও দাঁড়াল না।

হাতির পাশে পাশে শান্ত চলেছে। আবার ডাকল, ‘ও মাহুতভাই, আমায় হাতির পিঠে চাপাবে?’

মাহুত সাড়া দিল না।

শান্ত আরও কাছে এগিয়ে এল। একেবারে হাতির সামনে। ‘ও মাহুতভাই, তুমি কি কানে শুনতে পাও না? কালা? এত জোরে চেঁচাচ্ছি আমি?’

ওমা! সাঁ করে খুঁড়ে জাপটে ধরেছে হাতিটা শান্তকে। উরি ব্যস! কী ভীষণ ভয় পেয়ে গেল শান্ত। চিৎকার করে উঠেছিল প্রায়। মাহুতটা সঙ্গে সঙ্গে চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘রোক যা–রোক যা।’ মারলে ডাঙশের বাড়ি, হাতির মাথায়। কে কার কথা শোনে? হাতি যেমন চলছিল, তেমনিই চলেছে। শান্তকে দোল দিতে লাগল নরম তুলতুলে গুঁড়ে জড়িয়ে।

শান্ত দুলছে আর ভয় পাচ্ছে। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। পা ছুড়ছে। হাত ছুড়ছে। অমনি রাস্তার লোক ছুটল।

হাতি খেপেছে। ছেলে ধরেছে। মেরে ফেলেছে।

না তো। হাতি শান্তকে মারল না তো।

তবে?

হাতি শান্তকে আদর করে দোল দিতে দিতে খুঁড়ে জড়িয়ে তুলে নিল। নিজের মাথায়। একেবারে মাহুতের কোলের কাছে।

মাহুত ‘হা-হা-হা’ করে লাফিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল রেগেমেগে, ‘নেবে যা। যা, নেবে যা।‘

শান্ত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মাহুতের মুখের দিকে। এত উঁচু থেকে কী করে নামবে সে?

মাহুতটা কী করবে?

ছটফট করছে। লাফিয়ে উঠছে। হাতির মাথায় ডাঙশ দিয়ে মারছে। চেঁচাচ্ছে, ‘রোক যা।’

গ্রাহ্যি নেই। হাতি হেঁটেই চলেছে।

রাস্তায় লোক জড়ো হয়ে গেল। হইহই লাগিয়ে দিলে।

মাহুতটা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে তেড়ে উঠল শান্তকে, “উঠেছিস কেন?’

 শান্ত আমতা আমতা করে বললে, ‘আমি তো উঠিনি। হাতি তুলে নিলে।’

 মাহুত তেড়েমেড়ে উঠল, ‘নেবে যা। শিগগির নেবে যা।’

 শান্ত হাতির পিঠের ওপর থেকে তাকিয়ে দেখলে। নীচের দিকে। আরি ব্যস! কত উঁচু!

‘নাব।’ ধমকে উঠল মাহুতটা।

‘নামব কী করে?’ কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললে শান্ত।

‘এমনি করে,’ আচমকা এক ধাক্কা মারল মাহুতটা। শান্তর গলায়। শান্ত মারল এক ডিগবাজি। হাতির কপাল দিয়ে গড়িয়ে গেল।

একেবারে হাত পা ছরকুট্টে পড়ছিল শান্ত। অমনি চট করে হাতি থেমে গেল। টুপ করে শান্তকে লুফে নিল শুড়ের দোলনায়। দোল দিয়ে নামিয়ে দিল রাস্তায়। আস্তে আস্তে। যেন না লাগে।

শান্ত ভয় পেয়েছে ভীষণ। হাঁপাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে মিটমিট করে চোখের দিকে তাকাল। হাতিটার। কিন্তু একী! হাতির চোখের কোণে যেন সে দেখতে পেল দু-ফোঁটা জল। চকচক করছে। শুড়টা বাড়িয়ে দিল হাতি শান্তর দিকে। শান্তর গলা জড়িয়ে ধরল আলতো করে। শান্তর গাল চেটে দিল। হয়তো একটা চুমু খেল।

মাহুত আবার মারল হাতির মাথায় ডাঙশ। ধীরে ধীরে সে হাঁটল। ঘন্টা বাজল ঢং ঢং। শান্ত দাঁড়িয়ে রইল সেই দিকে চেয়ে। তারও যেন চোখ ছলছল করে উঠল। কিন্তু সে তো কোনোদিন কাঁদেনি।

চলতে চলতে হারিয়ে গেল হাতিটা রাস্তার একদিকে। ঘন্টা মিলিয়ে গেল সেইদিকে।

শান্তর মনটা কেমন করে উঠল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘কত ভালো রাজার হাতি।’

তারপর চলতে শুরু করল।

 চুমকি কাঁদছে। খুঁজছে দাদাকে। বন্ধুর হাত ধরে। সবুজ মাঠে মাঠে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে।

আর শান্ত পথ হারিয়েছে। শহরের ভিড়ের মধ্যে। অগুনতি মানুষ এখানে। পাখি নেই একটিও পাখি নেই। নেই তার হলুদ পাখি।

চলতে চলতে থমকে থামল শান্ত। আহা! কী সুন্দর সাজানো-গোছানো দোকান এদিকটায়। খালি সোনা-চাঁদি। মুক্তো-মোতি। হিরে-কমল।

কত দোকান। রঙিন-কাপড়। খেলনা-পুতুল, রংবেরঙের। চোখ ঝলসে যায়।

উঃ! কতবড়ো একটা খাবারের দোকান দেখো! কতরকমের খাবার সাজানো বড়ো বড়ো থালায়। যেন চোখ মিটমিট করছে। যেন চোখ টিপে ডাকছে শান্তকে, ‘এসোনা, খাবে। এসো।’ বড়ো বড়ো গামলায় ওগুলো কী? সাঁতার কাটছে!

বড্ড খিদে পেয়েছেশান্তর। ভারি জল তেষ্টা পেয়েছে। আহা! পাবে না? পুরো একটাদিন সে কিচ্ছু খায়নি। সেই যে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েছে, তারপর পেটে একদানা খাবার, একফোঁটা জল পড়েনি। তাই মুখে যেন আপনা থেকে জল এসে যাচ্ছে শান্তর। খিদের সময় চোখের সামনে খাবার দেখলে কার না নোলায় জল আসে?

দোকানিকে কী রকম দেখতে! দেখলেই হাসি পায়। ঠিক যেন একটা জালা। গোল-গাল নাদুসনুদুস। মাথাটা ছোট্ট। ইয়া বড়ো লম্বা টিকি। চোখ দুটো ড্যাবড়েবে। পেটটা ভুড়িদার। যেন ভাতের হাঁড়ি। কী নরম নিরীহ-নিরীহ গোবেচারিটি। বোধ হয় লোকটা ভালো। ভাব করলে হয় না?

 থাকতে পারল না শান্ত। দোকানিকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ গো, ওই খাবারটার নাম কী গো।’

‘রসমালাই।’

বাবা! অত বড়ো লোকটার কী রকম গলা। যেন ঘোড়ার মতো ডেকে উঠল। চি-হি-হি করে।

আবার জিজ্ঞেস করল শান্ত, ‘ওইটা?’

 ‘আবার খাবো।’

‘আর ওই পাশেরটা?’

‘রাজভোগ। কোনটা দেব?’

অবাক হয়ে গেল শান্ত। কী উদ্ভট্টি নাম। আবার খাবো!

‘কোনটা নেবে?’ লোকটা আবার চি-হি-হি সুরে জিজ্ঞেস করল।

শান্ত বলল, ‘সিঁড়ির নাড়ু নেই?’

‘না।’ লোকটা ব্যাজার হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

‘কটকটি?’

‘না।’ যেন রেগে উঠছে লোকটা।

‘নারকেল পুলি?’

ধাঁ করে রেগে গেল। খপ করে ধরে ফেলল শান্তকে। চি-হি, চি-হিঁ করে ধমকে উঠল, ‘কেনবার নাম নেই–বায়না। এটা নেই? ওটা নেই?ফুজুড়ি! নারকেল পুলি খাবে! আগে তোমার পিঠে নারকেল ভাঙি, তারপর পুলি খাওয়াব। আয় ইদিকে।’

লোকটা শান্তকে হিড়হিড় করে টান দিল। শান্তর ঘাড় ধরে মাথাটাকে নিজের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। গাঁট্টাগোট্টা হাত। বেঁটে বেঁটে আঙুল। আঙুল পাকিয়ে ঘুষি তুলল। পিঠের ওপর ঘুষি যেই মারতে যাবে–অমনি শান্ত মেরেছে এক টু দোকানির কুঁড়িদার পেটে। আর দেখতে হয়। দোকানি ‘কোঁক’ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিল শান্তর। নিজের নাক টিপে ধরে, কাতরাতে শুরু করে দিলে

বড্ড ভয় পেয়ে গেছে শান্ত। একেবারে সঙ্গে সঙ্গে তিরের মতো ছুট দিল। না, না, শান্ত ইচ্ছে করে তো অমন করেনি লোকটাকে। ও কেন শুধু-মুধু মারবে শান্তকে?

ছুটছে প্রাণপণে। যদি লোকটা তাড়া করে শান্তকে?

ওমা! লোকটা সত্যিই তাড়া করেছে। আয়ি ব্যস! কী মোটা! ছুটছে–আর কী জোর ভুঁড়িটা নাচছে। থুপ থুপ। আরে, ও কখনো শান্তর সঙ্গে পারে?শান্ত এ-দিক দিয়ে, এর-তার ফাঁক দিয়ে ভোঁ-কাট্টা।

ছুটতে ছুটতে লুকিয়ে পড়ল শান্ত। এদিকটা বেশ ফাঁকা। একটা বাড়ি। দরজা-জানলা সব বন্ধ। সামনে খানিকটা গাছ-বাগান-ঝোঁপ মতো। লুকিয়ে পড়ল সেই ঝোঁপের আড়ালে। চুপটি করে বসে রইল। কেউ না দেখতে পায়। হাঁপাচ্ছে তখনও। দম ফেটে যাচ্ছে। কিছুতেই পারছে না নিশ্বাস আটকাতে। কেউ যদি টের পেয়ে যায়।

এবার যেন ওর কান্না পাচ্ছে। সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছে। এ কোথায় এসেছে সে? কোথায় তার হলুদ পাখি। কোথায় তার ছোট্ট বোনটি–চুমকি। তার সব হারিয়ে গেল। ও কেমন। করে ফিরে যাবে? ও কেমন করে পাবে আবার সব? ভারি দুঃখ হচ্ছে মনে মনে। খাবারের কথা জিজ্ঞেস করলে মারতে আসে এরা। কে তাকে আদর করে একটু জল দেবে? ভারি যে তেষ্টা পেয়েছে শান্তর।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে সেই ঝোঁপের মধ্যে। হয়তো লোকটা এতক্ষণে শান্তর কথা ভুলে গেছে। হয়তো এতক্ষণে ফিরে গেছে দোকানে। দেখাই যাক না।

শান্ত বেরিয়ে এল ঝোঁপ থেকে পা টিপে টিপে। উঁকি মেরে দেখল এদিক-ওদিক। না, নেই। কেউ কোথাও নেই।

কিন্তু এটা কার বাড়ি? নিজঝুম চারিদিক। দরজা-জানলা সব বন্ধ। আঁটোসাঁটো। টু শব্দটি শোনা যাচ্ছে না। না বাইরে, না ভেতরে। কেউ নেই নাকি?

আশ্চর্য! অত বড়ো বাড়িটায় কেউ নেই। কোনো জন-মনিষি নেই। কী রকম অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল শান্ত।

ভেতরে কেউ আছে কিনা ডেকে দেখবে নাকি একবার? কী দরকার বাবা। শেষে কী করতে কী হয়ে যাবে।

কিন্তু পা দুটো যে বড় ব্যথা করছে শান্তর। পা দুটো বেশ করে ছড়িয়ে বসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বসবে কোথায়? বারান্দাটায়?

এগিয়ে গেল বারান্দার কাছে ভয়ে ভয়ে। এক-পা দু-পা করে। চেয়ে চেয়ে দেখছিল কোনখানটায় বসবে।

হুট। সঙ্গে-সঙ্গে দরজা খুলে গেল।

চমকে তাকাল শান্ত।

কে?

একটা লোক। বুড়ো থুথুড়ো। একেবারে শান্তর সামনে দাঁড়িয়ে শান্তর দিকে চেয়ে। চুলগুলো ধবধবে। একগাল দাড়ি। সাদা। সোনালি আভা। গায়ে একটা ফিকে নীল জামা। গলা থেকে পা অবধি ঢাকা। যেন ভার-ভার মুখটা। আঁতকে চেঁচিয়ে উঠল শান্ত, ‘না, না, আমার কিছু চাই না। আমায় মেরো না–’

ছুটে পালাতে গেল শান্ত। পালাবে কোথায়? লোকটা ঝট করে ধরে ফেলল শান্তকে। চটপট কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।

শান্ত হাত-পা ছুঁড়ে ককিয়ে উঠল, ‘ছেড়ে দাও, আমায় ছেড়ে দাও–’

দরজা বন্ধ হয়ে গেল। শান্তর গলা আর শোনা গেল না।

একী! বাড়ির ভেতর আসতেই শান্তর চমক লাগল! কেন! আর তো সে চেঁচাল না! ঝলসে গেল তার চোখ দুটি! কী দেখে?

আহা। কী চমৎকার বাড়ির ভেতরটা! কী সুন্দর সাজানো-সাজানো ছবি দেওয়ালের গায়ে গায়ে। কত রং–ছবির রং! এপাশ ওপাশ চারপাশ রঙিন হয়ে আছে। এ কোথায় এসে পড়েছে শান্ত! মন জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। আনন্দ-খুশিতে দুলে উঠছে তার ছোট্ট দুটি চোখ।

কিন্তু বুড়ো লোকটা তাকে ধরে আনল কেন?

লোকটা শান্তকে কোলে নিয়েই একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। শান্তকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। কী রকম ভারী ভারী গলায় বলল, ‘ভেতরে আয়!’

ভয়ে ভয়ে, সুড়সুড় করে শান্ত ভেতরে এল।

আহা! ঘরের ভেতর কত পুতুল। নানান পুতুল! মাটির পুতুল। কাঠের পুতুল। কাগজের পুতুল। কাপড়ের পুতুল।

কোনোটা পাখি। কোনোটা ছাগল। কোনোটা হাতি। কোনোটা ঘোড়া।

একটা নীল-তো চারটে লাল।

পাঁচটা হলুদ–তো দশটা সবুজ।

একশোটা বেগুনি-ততা চারশোটা খয়েরি, গোলাপি, রুপোলি। শেষ নেই যেন। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে শান্তর।

লোকটা গম্ভীর গলায় বলল, ‘এখানটায় বস!

একটা ছবি-আঁকা মাদুর। শান্ত কেমন কাঠের পুতুলের মতো সেটার ওপর বসে পড়ল।

লোকটা একটা উঁচু মতো টুলের ওপর গিয়ে বসল। টুকরো মতো একটা কাঠ নিল। তুলিতে রং নিল। কাঠটার ওপর তুলি বুলিয়ে রং দিতে লাগল।

চারদিক নিস্তব্ধ, চুপচাপ। শান্ত হাঁ করে সেইদিকে চেয়েছিল খালি। আহা! এখন যদি চুমকি কাছে থাকত?

হঠাৎ লোকটা গলা ঘেঁকারি দিলে। শান্ত চমকে চাইল, তার চোখের দিকে। লোকটা হঠাৎ কথা বলল, ‘শান্তর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে, ‘বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছিলি কেন?’

কী উত্তর দেবে শান্ত? চট করে বলে ফেলল, ‘না তো, জল তেষ্টা পেয়েছিল তাই।’ কথা বলতে গিয়ে শান্তর গলা যেন আটকে আসছে।

কথা নেই, বার্তা নেই লোকটা রঙের তুলি নামিয়ে রাখল। ঘরের বাইরে চলে গেল। এক গেলাস জল, এক থালা খাবার নিয়ে এল। উরি বাবা! কত খাবার। একসঙ্গে অত খাবার শান্ত কোনোদিন দেখেনি। নোলায় জল গড়িয়ে পড়ছে।

শান্তর সামনে থালাটা রাখল, ‘খা।’

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শান্ত লোকটার মুখের দিকে। তাকে সত্যি সত্যি খেতে বলছে?

আবার নিজের কাজ করতে লাগল লোকটা। রং দিতে লাগল ছোট্ট কাঠটায়।

থালায় আর হাত উঠছে না শান্তর। হতভম্বের মতো চেয়ে রইল তার দিকে।

আবার তাকাল লোকটা শান্তর দিকে, ‘নে খেয়ে নে।’

শান্তর মনে পড়ে গেল চুমকির কথা। চুমকি হয়তো এখনও খায়নি। সে কেমন করে খাবে।

‘খাচ্ছিস না কেন?’ এবার কেমন ধমক দিয়ে লোকটা বলল।

শান্ত ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আমার তো জল তেষ্টা পেয়েছে। খিদে–’

‘খিদেও পেয়েছে।’ শান্তর কথা শেষ হবার আগেই লোকটা বলল, ‘আমি তোর চোখদুটোয় খিদে দেখতে পাচ্ছি।’ বলেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল।

শান্ত চট করে নিজের চোখদুটো বুজে ফেলল। চোখে আবার খিদে থাকে নাকি? সে তো কোনোদিন চোখে খিদে দেখেনি কারো!

এবারে যেন সত্যি রেগে গেল লোকটা, ‘খেলি!’

শান্ত থতমত খেয়ে বলে ফেলল, ‘খাচ্ছি।’

একথালা খাবার। কোনটা খাবে? সেই দোকানটায় যেমন দেখেছিল তেমনি দু-দুটো। কী যেন নাম বলেছিল! ও হ্যাঁ, ‘আবার খাবো’। ওটাই খেতে ইচ্ছে করছে শান্তর। হাত বাড়াল থালায়।

এমন সময়–খট-খট-খট। বাইরে দরজা ঠেলার শব্দ। ‘দরজা খোলো-’

খাওয়া হল না শান্তর।

লোকটা চমকে চাইল। উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘খেয়ে নে তুই। আমি দেখি, বাইরে কে ডাকছে।’

আবার শব্দ, খট-খট-খট।

দরজা খুলে গেল। ওমা! একী! বাইরে সেই দোকানিটা! সেই গাবদাগোবদা পেট ঢাপুস লোকটা!

‘এই বুড়ো, এখানে একটা ছেলে এসেছে?’ দোকানি জিজ্ঞেস করল।

 ‘কেন? ছেলে কী করেছে?’

‘আমার দোকানে সে খাবার চুরি করতে গেছল।’

বুড়ো লোকটা কী ভাবল একটু। সঙ্গে-সঙ্গে ঝটপট বলল, ‘না, এখানে কেউ আসেনি।’

দোকানিটা বললে, ‘ছোট্টমতো দেখতে?’

উসকোখুসকো চুল?

ফর্সা ফর্সা মুখ?

ছেঁড়া ছেঁড়া কাপড়?

বুড়ো বললে, ‘না।’

দোকানিটা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘দেখেছ ভালো করে–ওপরটা-ছাতটা-গাছটা?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি।’

নীচেরটা-ঘরটা-দোরটা?’

‘তা-ও দেখেছি।’

‘সামনেটা-নাকটা-মুখটা?’

 ‘দেখেছি, দেখেছি, দেখেছি। আমার ঘরে কেউ ঢোকেনি। তুমি পথ দেখো।’ বলে লোকটা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।

চলে গেল দোকানিটা।

শান্তর খাওয়া হয়নি। কেমন করে হবে? কান পেতে শুনছিল সে। শুনছিল সেই দোকানির কথাবার্তা।

‘কীরে এখনও খাসনি?’ লোকটা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল শান্তকে।

‘না, খাব না।’ শান্তর যেন কেমন কান্না-কান্না গলা।

‘কেন, কী হল?”

‘না, আমি খাব না।’ উঠে পড়ল শান্ত, ‘আমায় ছেড়ে দাও!’

‘কোথা যাবি?’

‘ওই লোকটার কাছে। ও কেন আমায় চোর বলল। সিঁড়ির নাড়ু পাওয়া যায় কি না জিজ্ঞেস করতে, ও আমায় মারতে এল। আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি কি চুরি করেছি যে, আমায় চোর বলবে? তোমার খাবার আমি খাব না। তাহলে তুমিও আমায় চোর বলবে। আমায় ছেড়ে দাও, দরজা খুলে দাও!’ রেগে চেঁচিয়ে উঠল শান্ত।

লোকটা শান্তর মাথায় হাত দিল। শান্ত চুপ করে গেল। লোকটার মুখের দিকে তাকাল শান্ত। লোকটা শান্তর মাথায়-গালে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল। বলল, ‘নে খা।’ একটি সন্দেশ শান্তর মুখে তুলে দিল লোকটা। শান্ত কেঁদে ফেলল। ক-ফোঁটা চোখের জল ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। তাড়াতাড়ি শান্ত মুছে ফেলল চোখের জল–নিজে নিজেই। ছিঃ ছিঃ সে কাঁদছে? সে না বড়ো হয়ে গেছে। লোকটা দেখে ফেললে কী লজ্জার কথা।

লোকটা বোধ হয় দেখেই ফেলেছে। শান্ত তাই তাড়াতাড়ি নিজেই হাত দিয়ে খেতে লাগল। লোকটা আবার টুলের ওপর গিয়ে বসল। আবার কাঠের ওপর রং বুলোচ্ছে। যেন নজরই নেই শান্তর দিকে। আর শান্তর সঙ্গে কথাই বলে না। চুপচাপ।

শান্ত অবাক হয়ে ভাবছিল তার দিকে চেয়ে চেয়ে। লোকটা কে?শান্তকে এত আদর করল কেন? এত যত্ন করে খাওয়াল কেন? বেশি কথা বলে না। খালি ওই টুকরো কাঠটার ওপর রং দিয়ে কী করছে!

শান্ত ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়াল। কী করছে লোকটা দেখতে ইচ্ছে করছে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। না, কিছু বলল না সে।

উঃ! ভারি সুন্দর একটা কাঠের ঘোড়া তৈরি করছে লোকটা?শান্তর চোখদুটি খুশিতে চকচক করে উঠল। থাকতে পারল না। বলেই ফেলল ‘তুমি বুঝি পুতুল তৈরি কর?”

কোনো উত্তর দিল না বুড়ো লোকটা। কাজই করছে।

কথাটা আরেকবার জিজ্ঞেস করতে ভয় করছে শান্তর। যদি রেগে যায়। যদি বলে, ‘সরে যা এখান থেকে।’ তার চেয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখাই ভালো। আহা! কী ভালো লাগছে শান্তর।

আনমনে দেখছে শান্ত। ভাবছে, ঘোড়াটা যদি কাঠের ঘোড়া না হত। যদি জ্যান্ত হত। তাহলে সে ঘোড়ার পিঠে চেপে পাড়ি দিত, বাড়ির দিকে। চুমকিকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিত। দুজনে ঘোড়ার পিঠে চেপে ছুট দিত সেই রাজার কাছে। সেই রাজা–যে-রাজা পাখি মারে। কোমর থেকে তরোয়াল বার করে তার সঙ্গে লাগিয়ে দিত যুদ্ধ। রাজাকে হারিয়ে বন্দি করত। শেকল পরিয়ে দিত রাজার হাতে। তারপর হয়তো রাজার ছোট্ট মেয়ে, রাজকন্যে, ছুটে আসত কাঁদতে কাঁদতে। শান্তর হাতদুটি জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলত, ‘আমার বাবাকে ছেড়ে দাও, আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যেও না।’ কেঁদে লুটিয়ে পড়ত যখন, শান্ত তখন বুক ফুলিয়ে বলত, ‘আমার বোনের পাখি দাও, হলুদ পাখি, নীল পাখি।’ তখন?

‘কী দেখছিস?’ আচমকা লোকটা জিজ্ঞেস করল। শান্ত থতমত খেয়ে বলল, ‘ঘোড়া।’

“নিবি?’

‘না।’

‘কেন?’

‘তুমি অত কষ্ট করে তৈরি করছ।’

আবার লোকটা রং দিতে লাগল। শেষ হয়ে এল প্রায় ঘোড়াটা। যতই দেখছে ততই মনটা খুশি হয়ে উঠছে শান্তর। কী সুন্দর হচ্ছে।

হঠাৎ চট করে বুড়োর গায়ে হাত দিল শান্ত। নরম নরম হাত। ভাব করতে ইচ্ছে করছে। তার মুখের দিকে তাকাল। রঙের তুলি থামল। বুড়োও তাকাল শান্তর দিকে।

‘আমার নাম শান্ত।’ বুড়োর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত বলল।

 ‘তুমি তরোয়াল তৈরি করতে পার?’

‘কেন?’

‘এমনি বলছি৷’,

‘না।’ উত্তর দিয়ে বুড়ো রং দিতে লাগল ঘোড়র গায়ে।

‘জান, আমার একটা ছোট্ট বোন আছে–চুমকি। আমি অনেক দূরে থাকি। এখান থেকে

অনেক দূরে। আমি হারিয়ে গেছি। পথ হারিয়ে এখানে চলে এসেছি।’

 ‘অ।’ রং দিতে দিতেই বলল বুড়ো আনমনে। ‘তোমার কেউ নেই?

‘উঁহু।’

‘এত বড়ো বাড়িটায় তুমি একা থাক?

 ‘হ্যাঁ।’

‘ঘরের দরজা-জানলাগুলো বন্ধ রেখেছ কেন?’

‘ভয়ে।’

‘ভয়ে! এত বড়ো লোক ভয় পায় নাকি!’ হেসে ফেলল শান্ত হি-হি-হি করে। ওমা! অমনি সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেলল সেই বুড়ো লোকটা। চোখ মেলে চাইল শান্তর দিকে। ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে দুচোখ বেয়ে।

হাসতে হাসতে শুকিয়ে গেল শান্তর মুখ। সঙ্গে সঙ্গে কী রকম কুঁচকে গেল শান্ত। একী, লোকটা কাঁদছে কেন! মনটা কেমন করে উঠল। জিজ্ঞেস করল, ‘কাঁদছ কেন গো? আমি হাসলুম বলে?’

 ‘গান গাইতে পারিস?’ লোকটা ধরাধরা গলায় জিজ্ঞেস করল। ‘কতদিন গান শুনিনি।’ চোখে তখনও তার জল গড়াচ্ছে।

‘কে তোমায় গান শোনাত?

‘পাখি। গাছের পাখি। এরা সব মেরে ফেলেছে।’

চমকে উঠল শান্ত। জিজ্ঞেস করল ‘কারা?

‘এখানকার রাজা। রাজার লোকেরা। আমি পাখির কান্না শুনতে পাই। মরা পাখির কান্না। আমার বুক কেঁপে ওঠে। তাই দরজা-জানলা বন্ধ রাখি।’

‘এখানকার রাজা?’ শান্তর মুখটা লাল হয়ে উঠল। রাগে সমস্ত শরীরটা যেন কাঁপছে তার। চোখের ওপর ভেসে উঠছে রাজবাড়ির সিংদরজা। কী হল হঠাৎ, ছুটল সে। চোখের পাতা পড়তে-না-পড়তেই ছুটল।

বুড়ো লোকটা থমকে দাঁড়াল। হাত থেকে তার ঘোড়া ছিটকে পড়ল মাটিতে। চেঁচাল, ‘কোথা যাচ্ছিস?’

‘রাজার কাছে। আমার বোনের পাখি মেরেছে রাজা।’ দরজা খুলে ফেলল শান্ত। রাস্তায় বেরিয়ে এল। ছুটল সে রাজবাড়ির দিকে।

বুড়োও ছুটল শান্তর পেছনে। দুটি হাত বাড়িয়ে ছুটল, ‘ওরে যাস না। তোকে মারবে।’

ছুটছে শান্ত। এ-রাস্তা সে-রাস্তা দিয়ে ছুটছে। মারুক। তবু সে যাবে রাজার কাছে।

কিন্তু একী! রাজবাড়ির সিংদরজা বন্ধ যে। দুপুরের সোনার রোদে ঝকমক করছে বন্ধ। সিংদরজা। ছুটতে ছুটতে শান্ত এসে দরজায় ধাক্কা দিল, ‘দরজা খোলো।’ গলা কাঁপছে তার।

কত বড়ো সিংদরজা। আকাশ ছোঁয়া। কতটুকু শান্তর হাত। দরজা নড়ল না। দরজা খুলল না।

ছুটতে ছুটতে বুড়ো এসে জড়িয়ে ধরল শান্তকে, ‘ওরে যাস না। ফিরে চ।’

‘না, আমায় ছেড়ে দাও।’ আবার ধাক্কা দিল, ‘দরজা খোলো।’

এখনও খুলল না।

বুড়ো বুকের মধ্যে টেনে নিল শান্তকে, ‘ওরে চ, আমার সঙ্গে চ, আমি তোকে পাখি দেব, সব রং দিয়ে পাখি তৈরি করে দেব।’

শুনবে না শান্ত, চেঁচিয়ে উঠল, ‘দরজা খোলো, খোলো, খোলো৷’

‘ঘরে চ। আমার ঘরে। লক্ষ্মী সোনা।’

শুনল না কথা। কী ভাবল শান্ত, কী মনে হল তার, হঠাৎ ডেকে উঠল, ‘টুই-টুই-ই-ই।’ একবার। দুবার। বারবার। একটি পাখির মিষ্টি সুর শান্তর গলায় গেয়ে উঠল।

অমনি সিংদরজা খুলে গেল। রাজবাড়ির সিংদরজা। সামনে সিপাই। চল্লিশজন সিপাই একেবারে তরোয়াল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। রোদে ঝিলিক দিচ্ছে ঝকঝকে তরোয়াল।

আবার ডেকে উঠল শান্ত, ‘টুই-টুই-ই-ই।’

বুড়ো চটপট কোলে তুলে নিল শান্তকে। ছুট দিল উলটো দিকে। শান্ত হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ছেড়ে দাও, আমায় ছেড়ে দাও, আমি রাজার কাছে যাব।’

বুড়ো ছুটল। তার পেছনে চল্লিশজন সিপাই ছুটল।

বুড়ো ছুটছে! সিপাই ছুটছে। শান্ত চেঁচাচ্ছে।

বুড়ো আর পারছেনা। ছুটতে পারছেনা। পারছেনা শান্তকে তার কোলে ধরে রাখতে। শান্ত লাফিয়ে পড়ল তার কোল থেকে। ‘ওরে যাস না’ বলে বুড়ো হোঁচট খেয়ে পড়ল মাটিতে। লুটিয়ে পড়ল। চল্লিশজন সিপাই মাড়িয়ে চলে গেল তাকে। পিষে গেল রাস্তার সঙ্গে। ছুটল তারা শান্তর পেছনে।

আবার ডাক দিল শান্ত, ‘টুই-টুই-ই-ই।’

অমনি ঘোড়া ছুটল। টগবগ, টগবগ।

 শান্ত ছুটল, সাঁই সাঁই, পাঁই পাঁই।

ঘোড়ার পিঠে সিপাই আসছে–টগবগ, টগবগ। লোকে লোকারণ্য।

 ‘চোর।’ হঠাৎ কে চেঁচিয়ে উঠল অত লোকের মাঝ থেকে? ওমা! এ যে সেই দোকানিটা, পেট-ঢাপুস লোকটা!

‘চোর। চোর।’ সঙ্গে-সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল একটা লোক, দুটো লোক, তিনটে লোক, চারটে লোক, চারশো লোক, অগুনতি লোক

ছুট দিল শান্ত আরও জোরে। ছুটবে কোথায়?

সামনে ঘোড়া–টগবগ।

পিছন বাগে–টগবগ।

বাঁয়ে ঘোড়া-টগবগ।

 শান্তকে ঘিরে ফেলেছে।

 তবুও শান্ত ছুটছে। ছোট্ট-ছোট্ট শান্তর পা। কদম-কদম ঘোড়ার ছুট। কতক্ষণ ছুটবে?

‘সপাং।’ চাবুক পড়ল। শান্তর পিঠে। শান্ত ‘মাগো’ বলে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আর উঠতে পারল না।

অমনি চারশো সিপাই ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল। শান্তর পা বাঁধল। হাত বাঁধল।

মুখ বাঁধল। চোখ বেঁধে চ্যাংদোলা করে কোথায় নিয়ে চলে গেল, কেউ জানতেও পারল না।

সিপাইরা শান্তকে কোথায় যে ধরে নিয়ে গেল, চুমকিও জানতে পারল না। কেমন করে জানবে? কোথায় চুমকি আর কোথায় শান্ত। শান্ত বন্দি হয়েছে সিপাই-এর হাতে। অনেকদূরে, কোনো এক শহরে। আর চুমকি রাজার হাতটি ধরে দাদাকে খুঁজছে আঁতিপাঁতি করে। পথে-পথে, পাহাড়-ঘেরা ছোট্ট গ্রামে।

রাত হয়েছে। কাঁদছে চুমকি। দাদার জন্যে কাঁদছে। ছোট্ট মাটির ঘরে, রাজার কোলে মাথা রেখে কাঁদছে ‘আমার দাদা কই?দাদা আয়।’

রাজা চুমকির কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আদর করে। বলছে, ‘তোমার দাদা ফিরে আসবে। আমি আছি ভয় কী? কাল সকাল হলেই দাদাকে আমি ফিরিয়ে আনব।’

রাজার কথা শোনে না চুমকি। বলে, ‘এক্ষুনি দাদা আসছে না কেন? দেখছ না কত রাত হয়ে গেছে। সকাল যদি আর না হয়।’

 রাজা বলল, ‘সোনা মেয়ে, ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুমিয়ে পড়লেই সকাল হবে।’

‘দাদা নেই, কেমন করে ঘুমোব? কে আমায় ঘুম পাড়াবে? কে আমায় গল্প শোনাবে?’

রাজা বলল, ‘আমি গল্প বলি।’

পিলসুজের ওপর প্রদীপ জ্বলছে ঘরের মধ্যে। তার আলো কাঁপছে রাজার চোখে। সেই আলো দুলে দুলে ছড়িয়ে আছে চুমকির মিষ্টি মুখে। আর রাজা গল্প বলছে,

এক রাজা। তার এক রানি। একটি ছেলে। একটি মেয়ে। রাজার মনে কোনো হিংসে নেই। রাগ নেই। কোনো দুঃখ নেই। রাজার মনে খুশি। সারা রাজ্যে খুশি।

এমন যে রাজা, তার বেশিদিন সুখ সইল না।

একদিন সন্ধেবেলা। রানি গল্প করছিল রাজার সঙ্গে। গল্প করছিল খোলা আকাশের নীচে। আনমনে আকাশের দিকে চেয়ে।

হঠাৎ রানি বলল, ‘রাজামশাই, দেখো, দেখো, আকাশের কপালে খালি টিপ আর টিপ।‘

রাজা বলল, ‘আহা! মিষ্টি তারা!

রানি বলল, ‘কী সুন্দর! অমন একটি টিপ এনে দাও না, আমার কপালে পরি।’

রাজা বলল, ‘অমন টিপ পাইতো, তোমার কপালে পরাই। আলোর ঘরে আলোর নাচ দেখি। কিন্তু অমন টিপ পাই কোথা?’ অমনি সাজো-সাজো রব পড়ে গেল। ঘোড়া সাজল, হাতি সাজল। দশ হাজার লোক কোমর বাঁধল। রাজা ছুটল টিপ খুঁজতে। এল এক পাহাড়ের দেশে।

সাত দিন, সাত রাত কাটল। দশ হাজার লোক পাহাড় ভাঙছে। পাথর কাটছে। মাটি খুঁড়ছে। কিন্তু আকাশের টিপ মাটিতে মিলবে কেমন করে? তাইতো!

কিন্তু হঠাৎ একদিন অন্ধকার পাতালে আলো জ্বলে উঠল। একটুখানি আলো, এক টুকরো আলো। রাজা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী ওটা?’

দশ হাজার লোক চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী ওটা?কী ওটা?’

একটি হিরে। আহা! নীল হিরে!

সেই পাতালের অন্ধকারে দশ হাজার লোক আনন্দে পাগলের মতো নেচে উঠল। রাজা সেই হিরে কুড়িয়ে আনল। রানির কপালে পরিয়ে দিল।

ওমা! সত্যিই তো! আকাশের একটি তারা যেন ভালোবেসে রানির কপালে নেমে এসেছে! রানি ভারি খুশি। খুশিতে ডগমগ। বলল, ‘তুমি রাজার মতো রাজা।’

কিন্তু একী হল! দিন যায় আর যেন রানির কপালের নীল হিরের নীল-আলো নিবে আসে একটু একটু করে! কেন?রানির কপালে হিরের আলো সহ্য হল না। একদিন একেবারে নিবে গেল। আহা! সেইদিন রানিও মারা গেল।

তারপর অনেকদিন পরে আর এক কাণ্ড।

সেদিন রাজার মেয়ে চুপটি করে চেয়ে ছিল একটি গাছের দিকে। চেয়ে চেয়ে বলে, ‘বাবা, দেখো, দেখো, সবুজ পাতার ফাঁকে লাল-ফুল।’

রাজা বলল, ‘আহা! গোলাপফুল।’

মেয়ে বলল, ‘সকাল হলেই ফুলের পাপড়ি ঝরে যাবে। আহা রে? এমন কেন হয় না, ফুলের পাপড়ি একবছরেও ঝরে না? এমন যদি গোলাপ পাই, তো খোঁপায় সাজাই। বাবা, তুমি আমায় এমন একটি ফুল দাও না?’

রাজা ছুটল ফুলের খোঁজে।

আবার হাতি সাজল। ঘোড়া ছুটল। পাহাড় গেল। নদী পড়ল। বনের-পর-বন এল। এ-বন সেবন করে এক গভীর বনে দেখা হল একটি ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে। মিষ্টি মেয়ে। খোঁপায় সাজানো তার লাল গোলাপ। মেয়ে বলল, ‘কী চাও গো রাজামশাই?’

রাজা বলল, ‘ গোলাপ চাই। যে-গোলাপ লাল। যে-গোলাপের পাপড়ি একবছরেও ঝরে না।’

মেয়ে তার খোঁপায় আঁটা গোলাপ রাজার হাতে দিল। বললে, ‘তুমি রাজা তাই আমার গোলাপ তোমায় দিলুম। একবছরে এ গোলাপের একটিও পাপড়ি ঝরবে না। তুমি আমায় কী দেবে?

‘আমার গজমতির সাতনলিহার তোমার গলায় পরিয়ে দিলুম।’

বনের মেয়ে খুশি হয়ে বনের মধ্যে হারিয়ে গেল। আর রাজা সেই গোলাপ এনে রাজকন্যের খোঁপায় সাজিয়ে দিল!

রাজকন্যে খুশির আনন্দে রাজবাড়িতে নেচে নেচে ফুলের গন্ধ ভরিয়ে দিল। কিন্তু…

হায়! হায়! একটি বছর যেই পার হয়েছে, যেই গোলাপের পাপড়ি ঝরেছে, ওমা! রাজকন্যেও চিরদিনের মতো চোখ বুজেছে!

রাজবাড়িতে আবার কান্না। কান্না। রাজার একী হল! রানিও গেল, মেয়েও হারাল!

তারপর বছর গেল কেটে।

রাজবাড়িতে রাজার বলতে এখন শুধু ছেলেটি।

একদিন সকালবেলা রাজপুত্তুর ঘুম থেকে উঠেছে। গাছের দিকে চেয়ে পাখির নাচ দেখছে, গান শুনছে। হঠাৎ রাজাকে বলল, ‘বাবা, এমন যদি পাখি হয়?

রাজা বলল, ‘কেমন পাখি?’

ছেলে বলল, ‘তেমন পাখি, যে পাখি গান গাইলে আমি শুনতে পাব, একটি ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি গলা। এমন পাখি আমায় এনে দাও তো তার গান শুনি।’

অমনি রাজা ছুটল সেই পাখির খোঁজে।

কিন্তু এমন পাখি পাবে কোথা? যে-পাখির ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি গলা।

সে-পাখি গাছে নেই।

 গাছে নেই, মাঠে নেই।

 জলে নেই, স্থলে নেই।

কোথা আছে? আকাশে? নেই, নেই।

পাহাড়ে? নেই, নেই।

মরুতে? নেই, নেই।

তবে কোথা? বনে আছে।

কোন বনে! যে-বনেতে বাঘ নেই, সাপ নেই, জুজু নেই, ভয় নেই।

যে-বনেতে কালো নেই থমথম।

আলো আছে ঝলমল।

যে-বনেতে ফুল ফোটে তুলতুল,

 যে-বনেতে পাখি নাচে দুলদুল,

যেখানে হাওয়ার নাচন ঝুমকোলতায়।

ঝুমঝুমি ঝুম ঝুম পাতায় পাতায়।

এমন এক বনে রাজা হাজির হল। দেখা হল এক বুড়ির সঙ্গে। বুড়ি বলল, ‘কী গো ছেলে, একা একা বনে বনে কী খুঁজে বেড়াচ্ছ?’

রাজা বলল, ‘পাখি খুঁজছি। আমার ছেলে বলেছে, তার এমন একটি পাখি চাই, যে-পাখি গান গাইলে মনে হবে একটি মেয়ে গাইছে। এমন পাখি কোথা পাই?’

বুড়ি বলল, ‘দেখো বাপু, সে-পাখির খোঁজ আমি দেব। কিন্তু তার বদলে আমায় কী দেবে?’

রাজা বলল, ‘কী নেবে?’

‘তোমার গলার ওই মালাটি। মুক্তোমালা।’

রাজা সঙ্গে সঙ্গে গলার মালা বুড়ির হাতে তুলে দিল।

বুড়ি বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’

বুড়ি একটা বাঁশের খাঁচায় পুরে পাখি নিয়ে এল। আর অমনি পাখি রাজাকে দেখে গান গেয়ে উঠেছে। ওমা! সত্যিই তো। পাখির যেন একটি ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি গলা!

বুড়ি রাজার হাতে পাখির খাঁচা তুলে দিয়ে বলল, ‘দেখো, পাখি যেন কোনোদিন উড়ে না যায়, তাহলে কিন্তু বিপদ হবে।’

রোজ সকালে সোনার খাঁচায় পাখি গান গায়। রাজার ছেলের সে-গান শুনে ঘুম ভাঙে। রাজার ছেলে পাখির সঙ্গে খেলা করে।

একদিন রাজার ছেলে সোনার খাঁচায় হাত পুরে, পাখির গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছিল। পাখির সঙ্গে কথা বলছিল। অনেকক্ষণ। তারপর সাঁঝ এল। খেলা সাঙ্গ হল। রাজপুত্তুর ঘরে গেল। আর খাঁচার পাখি ঘুমিয়ে পড়ল। যাঃ! যাবার সময় রাজপুত্তুর ভুলেই গেল সোনার খাঁচার ডালা বন্ধ করতে। রাত্তিরবেলায় রাজার ছেলে ঘুমিয়ে পড়ল অঘোরে। আর সকালবেলায় সোনার খাঁচার মিষ্টি-সুরের মিষ্টি-পাখি ফুড়ুত করে উড়ে গেল আকাশে, খোলা খাঁচার দরজা দিয়ে।

আর? হায়! হায়! রাজপুত্তুরের রাতের ঘুম সকালে আর ভাঙল না।

সেই থেকে রাজা যেন পাগলের মতো হয়ে গেল। একটি তারার লোভে তার রানি গেল। একটি ফুলের জন্যে মেয়ে হারাল। একটি পাখির জন্যে ছেলে চোখ বুজল। সেই থেকে রাজা আকাশে তারা দেখলে চেঁচিয়ে উঠত, ‘ঘরের জানলা বন্ধ করে দাও!’ গাছে ফুল দেখলে হেঁকে উঠত, ‘গাছের ফুল ছিঁড়ে ফেলো!’ আকাশের পাখি দেখলে, পাগলের মতো চেঁচাত, ‘তাড়িয়ে দাও, মেরে ফেলো!’

তাই সে রাজ্যে আকাশে তারা দেখে না কেউ। গাছে ফুল ফোটে না। পাখি গান গায় না।

গল্প শুনতে শুনতে চুমকি ঘুমিয়ে পড়েছে। কখন ঘুমিয়েছে রাজা নিজেও জানে না। রাজা আপন মনে বলে গেছে গল্প। এ যে নিজের গল্প। নিজের কথা।

চুমকির ঘুম ঘুম চোখের দিকে তাকাল রাজা। কী সুন্দর চোখ দুটি! চোখের পাতার আড়ালে স্বপ্নের দেশ। চুমকি হয়তো স্বপ্ন দেখছে। কার? দাদার।

আর অন্ধকারে রাজা কীসের স্বপ্ন দেখছে চুমকির মুখের দিকে চেয়ে?

 চুমকি যেন তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। শান্ত যেন তার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে।

কিন্তু শান্ত গেল কোথা? কোথা গেল?

সকাল হতেই চুমকির হাত ধরে রাজা বেরিয়ে পড়ল। শান্তকে খুঁজতে। কত গ্রাম পেরিয়ে গেল। কত বন চলে গেল। কত পাহাড় পড়ে রইল। তবু শান্তকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পথে পথে একটি ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে একটি ছোট্ট ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে রাজা। হাঁটতে হাঁটতে ঘাম ঝরছে রাজার সারা শরীর বেয়ে। আর কাঁদতে কাঁদতে জল ঝরছে চুমকির দুটি চোখ দিয়ে, ‘দাদা আয়। দাদা আয়।’

পথ কি শেষ হবে না? পথে পথে কেঁদে কেঁদে সারা হয়েছে চুমকি। কিন্তু কই তার দাদা?

তাইতো! সত্যিই কি শান্তকে পাওয়া যাবে না খুঁজে? রাজার মন ভেঙে যাচ্ছে। শরীরও আর বইছে না। কী করবে রাজা? বসবে, না চলবে? চলবে, না থামবে?

একী! রাজা থামল কেন? অবাক চোখে চাইল যেন! চমকে উঠে থমকে গেল! কী হল?

রাজার কানে শব্দ এল।

কীসের শব্দ?

ঝড় উঠেছে আকাশে?

না তো। পাতা নড়ে না বাতাসে।

বাজ হাঁকছে মেঘে কী?

আকাশে মেঘ নেইতো বাজ কী।

রাজার মনে হল, অনেকদূরে কারা হাঁকাহাঁকি করছে। হইহই।

ছুটল রাজা সেইদিকে। সামনেদিকে। সামনেদিকে শহরতলি।

শহরতলির–অলিগলি

ছোট্ট বাড়ি

এক্কাগাড়ি

ছাগলছানা

কুকুর কানা

ছোট্ট মেয়ে

যাচ্ছে গেয়ে।

শহরতলি এড়িয়ে

ডাইনে নদী পেরিয়ে

আর কী এল? আর কী এল?

শহর এল। খাশ-শহর।

উরি বাবা! কত লোক! শহরের রাস্তা ধরে চলেছে। হাজারে-হাজারে, কাতারে-কাতারে। চেঁচামেচি, হুড়োহুড়ি চারিদিকে। ও, তাই বলো! রাজা এতক্ষণ শহরের হুল্লোড় শুনছিল! কিন্তু এটা কোন শহর?রাজার যেন চেনা-চেনা। খুব চেনা।

চুমকি কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, ‘বন্ধু, এ কোথায় নিয়ে এলে? এত লোক কেন? এখানে বুঝি আমার দাদা আছে?’

রাজা হাঁটছে আর অবাক হয়ে দেখছে! সত্যিই তো, এত লোক কেন? কোথা চলেছে? মেলা বসেছে কোথাও নাকি! এখন মেলা?কীসের মেলা?

রাজা চুমকির হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

 রাজা চিনে ফেলেছে। ফিরে এসেছে। এ তার নিজের রাজ্য। ওই দেখা যাচ্ছে রাজবাড়ির চুড়ো আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। সিপাইরা তকমা এঁটে তরোয়াল উঁচিয়ে ভিড় সামলাচ্ছে। রাজা ভিড়ের মধ্যে, চুমকির হাত ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে এগিয়ে চলল। সিপাইরা না দেখতে পায়! চিনে ফেললে?

রাজা ভিড়ের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ ভাই, তোমরা সব কোথায় যাচ্ছ?’

লোকটা ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ’ করে কী বিচ্ছিরি হেসে উঠল। বলল, ‘আচ্ছা বোকা তো হে তুমি। রাজার লোক তেঁড়া দিয়ে গেল! তুমি কি কানে ছিপি এঁটে বসেছিলে? চোর, চোর দেখতে যাচ্ছি। রাজ্যে একটা চোর ধরা পড়েছে।’

‘কী চুরি করেছে চোর?’

লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়ল, ‘ওমা! রাজবাড়িতে ঢুকতে গেছল, এ কথাটাও জান না! চোরকে শূলে চাপাবে। আমরা তাই দেখতে যাচ্ছি।’

কথা শুনেই চট করে চুমকিকে কোলে তুলে নিল রাজা। ছুটল রাজবাড়ির দিকে।

ছুটতে ছুটতে একেবারে রাজবাড়ির সিংদরজার সামনে। দাঁড়াল রাজা। প্রথমে চিনতে না পেরে দ্বারী রাজাকে তেড়ে উঠল, ‘ভাগ যাও!’ মুখ তুলে রাজার দিকে চোখ চাইতেই দ্বারীর মাথা হেঁট। ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে দ্বারী।

আর দেখতে হয়! এক নিমেষে খবর রটে গেল, ‘রাজা এসেছেন, রাজা এসেছেন।’

মন্ত্রী ছুটল। সান্ত্রি জুটল। পাত্রমিত্র সবাই তটস্থ। ‘রাজা এসেছেন, রাজা এসেছেন।’ রাজবাড়িতে হইহই পড়ে গেল। কিন্তু রাজার কোলে ওই যে মেয়ে ছোট্ট–কার মেয়ে! অবাক সবাই! কে মেয়েটি!

রাজা মন্ত্রীকে ডাকল। হুকুম দিল, ‘চোরকে শূলে চাপানো বন্ধ রাখো।’

সিংদরজার দত্যি-ঘন্টা বেজে উঠল, ঢং-ঢং-ঢং!

টগবগ-টগবগ ঘোড়া ছুটল।

টুং টাং টুং টাং হাতি নাচল।

সার সার উট বেরল।

রঙিন পতাকা পতপত।

সিপাই ছোটে গটমট।

ডুমডুমাডুম বাদ্যি বাজে।

ঘরে ঘরে ছেলে সাজে, মেয়ে সাজে, বউ সাজে। রাজাকে দেখতে যাবে। রাজার কোলে মেয়েকে দেখতে যাবে।

 রাজাকে রাজপোশাক পরানো হল। সোনার মুকুট মাথায় উঠল। সোনার মুকুট ঝলমল। হিরের মালা টলমল। আর চুমকির চোখ ছলছল।

অবাক লাগছে চুমকির। রাজাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে? এ কোথায় নিয়ে এলে আমায়? আমার দাদা কই?

রাজা চুমকিকে কোলে তুলে নিল। তার গলায় এক জোড়া মুক্তোর মালা পরিয়ে দিল।

হুকুম হল, ‘রাজদরবার সাজাও। নাচ হবে, গান হবে। রাজার কোলে ছোট্ট মেয়ে গান শুনবে, নাচ দেখবে।’

অমনি একশোজন গাইয়ে এল, দুশোজন নাচিয়ে এল। শহর ভেঙে লোক এল।

ভালো লাগছেনা চুমকির। ভালো লাগছে না গান। নাচ। চুমকির মন দাদার মনে। রাজার কোলে বসে-বসে আনমনে সে কাঁদছে। চোখের জল টলমল। টুপ করে রাজার হাতে পড়ল এক ফোঁটা জল। রাজা চুমকির চোখের দিকে তাকাবার আগেই মন্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ্ঞে আজকে এই আনন্দের দিনে চোরটাকে কী করব? ছেড়ে দেব কি?’

‘না, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ রাজা গম্ভীর গলায় হুকুম দিল।

অমনি নাচ থেমে গেল।

‘ঘড়ঘড়, ঘড়ঘড়’, বন্দি গাড়ির কাঠের চাকার শব্দ উঠল। ঘোড়া টানছে বন্দি-গাড়ি। সিপাই হাঁকছে ‘হেঁইও-হো।’

রাজদরবারের সামনে এসে গাড়ি থামল।

‘ক্যাঁচ,’ গাড়ির দরজা খুলছে। লোহার কপাট। চোর বেরল। চোরের পায়ে শেকল, হাতে শেকল। সিপাইরা সেই শেকল ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল রাজার সামনে।

থমথম করছে রাজদরবার। একটু আগে নাচে-গানে খুশি ছিল যে দরবার, হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেল।

চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়েছে চোর। হাত-পা তার অবশ হয়ে গেছে। না, না, সত্যি আর পারছে না সে। টান দিল সিপাই শেকল ধরে। চাবুক পড়ল ‘সপাং’ করে, পিঠের ওপরে।

‘উঃ!’ মুখ গুঁজড়ে পড়ে গেল চোর রাজদরবারের তকতকে শানের ওপর।

রাজা ধমকে উঠল, ‘থামো।’

 সিপাইরা সরে গেল। হাতের চাবুক নামিয়ে নিল।

শেকলের বোঝা নিয়ে মাটি থেকে উঠছে চোর। আহা! কত কষ্ট হচ্ছে। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। মুখ তুলল। হাতজোড় করে সামনে চাইল। রাজার দিকে।

‘দাদা।’ হঠাৎ কেঁদে উঠল চুমকি। চেঁচিয়ে উঠল। রাজার কোল থেকে লাফ মেরে ছুটে এল চোরের কাছে। চোরকে জড়িয়ে ধরে ‘হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে, ‘দাদা, দাদা, আমার দাদা। তোমায় কে বাধল চোর বলে!’

রাজা চমকে তাকাল চোরের দিকে, একী! শান্ত!

চোর চাইল রাজার দিকে, একী! বন্ধু!

শান্তর চোখ–চোখের জলে টলমল।

রাজার চোখ-চোখের জলে ছলছল। রাজা ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরল শান্তকে। হাউহাউ করে কেঁদে উঠল শান্ত। কেঁদে ফেলল রাজা। কাঁদছে চুমকি। রাজদরবারের অত লোক সবাই থ। ব্যাপার কী?কী। ব্যাপার?

আচমকা একটি পাখি ডেকে উঠল ‘টুই-টুই!’

রাজদরবারের অত লোক চমকে উঠল। পাখি! পাখি! রাজবাড়িতে পাখি ডাকছে!

পাখি আবার ডাকল ‘টুই-টুই!’

ওমা! এ যে সেই হলুদ পাখি। শান্তর সেই বন্ধুটি।

চুমকির সেই হলুদটি।

একী! একী! এ তো হলুদ নয়! তবে?

 নীল গাইছে, লাল ডাকছে, সবুজ পাখি তা-ও নাচছে।

কোত্থেকে হাজার হাজার পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে। আসছে খালি। আকাশে ডানা ছড়িয়ে। এত পাখি ছিল কোথা?

হলুদ পাখি উড়ে-উড়ে নেমে এল।

কোথা?

ওমা? একেবারে রাজার কাঁধের ওপর। রাজার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ডেকে উঠল, ‘টুই টুই।’

দুটি হাত দিয়ে পাখিকে জড়িয়ে ধরল রাজা আদর করে। পাখির গালে একটা চুমু খেল চুক করে। পাখির মিষ্টিচোখের দিকে তাকিয়ে রাজাও ডাকল, ‘টুই-টুই।’

হেসে ফেলল শান্ত। হেসে উঠল চুমকি। হেসে উঠল রাজবাড়ি।

তারপর?

তারপর সে রাজ্যে ছোট্ট ছোট্ট পাখি আবার একটি একটি রঙের ফোঁটার মতো আকাশ ভরিয়ে রাখল।

আর?

শান্ত আর চুমকি রাজবাড়িতে চিরদিনের মতো থেকে গেল।