০২. নীলাদ্রির ঘুম ভাঙল

০২.

নীলাদ্রির ঘুম ভাঙল কান্নার আওয়াজে। হইচই করে কান্না নয়, চাপা ফোঁপানি। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে। নীলাদ্রি মাথার বালিশটা টেনে কানে চাপা দিল। পাঁচ বছর ধরে এই একই জিনিস চলছে। এ বাড়িতে সকাল হয় কান্নার আওয়াজ দিয়ে। রান্নাঘরে মা চা করে আর কাঁদে। কাপ, ডিশ, চামচের টুং-টাং শব্দের সঙ্গে সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে-ভেসে বেড়ায়।

দরজা ঠেলে কিঙ্কিনি ঘরে ঢুকল। এত সকালে সে ঘুম থেকে ওঠে না। আজকাল তার বিছানা ছাড়তে অনেক বেলা হয়। মাত্র উনিশদিন হল তার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার শেষদিন কিঙ্কিনি তার বন্ধুদের কাছে ঘোষণা করেছিল–

রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আমি বিছানা থেকে নামব না। বিছানায় বসে খাব, গল্পের বই পড়ব, টিভি দেখব, কম্পিউটারে চ্যাট করব, আর মাঝেমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ব। আমার খাটের পাশে চেয়ার থাকবে। তোরা এলে সেই চেয়ারে বসবি। আড্ডা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলবি, চল কিঙ্কি, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিবি। আমি বলব, সরি, আমি যেতে পারছি না। রেজাল্ট বেরোনো পর্যন্ত আমার খাট থেকে নামা বারণ। পলিটিক্যাল নেতারা যেমন গৃহবন্দি হয়, আমি তেমন খাটবন্দি হয়েছি।

শুধুমাত্র পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলেই যে কিঙ্কিনি বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে এমন নয়। অনেক সময় ভোরে তার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে। যামিনী কখন স্কুলে বেরিয়ে যাবে তার জন্য অপেক্ষা। যতটা মায়ের মুখোমুখি না হওয়া যায়। যামিনীর ছুটিছাটার দিনগুলোয় সে পারতপক্ষে বাড়ি থাকতে চায় না। বন্ধুর বাড়ি, সিনেমা হলে চলে যায়। কিছু না থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। সবদিন অবশ্য দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। কদিন হল নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। কম্পিউটার ক্লাস। সপ্তাহে দুদিন করে। সকালে উঠে যেতে হয়। দাদার জোরাজুরিতে ভরতি হতে বাধ্য হয়েছে কিঙ্কিনি। আড়াল থেকে মায়ের চাপ থাকতে পারে। পারে কেন? নিশ্চয় ছিল। কিঙ্কিনির একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। তার কম্পিউটারে চ্যাট করতে, গান শুনতে ভালো লাগে। কোর্স শিখতে ইচ্ছে করে না। অঙ্কের কিছু থাকলে তো একেবারেই নয়। ছোটবেলায় তার অঙ্ক নিয়ে যে সমস্যা ছিল। তা কাটেনি, বরং বেড়েছে। সেই কারণেই আর্টস নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পড়া। কিঙ্কিনি জানে তাতেও খুব কিছু লাভ হবে না। তার রেজাল্ট বেশ খারাপই হবে। মাঝারি ধরনের সেকেন্ড ডিভিশন পেতে পারে। পড়াশোনা তার মাথায় ঢোকে না এমন নয়, কিন্তু পরীক্ষার জন্য যতটা পড়ার দরকার তা সে পড়েনি। যত দিন যাচ্ছে বুঝতে পারছে, লেখাপড়া তার বিষয় নয়। পড়তে তার ভালো লাগে না। তার বিষয় অন্য কিছু। সেই অন্য কিছুটা কী?

কিঙ্কিনি নীলাদ্রির খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। ঝুঁকে পড়ে ডাকল, দাদা, অ্যাই দাদা।

নীলাদ্রি কোনও উত্তর দিল না। নড়েচড়ে শুল মাত্র। কিঙ্কিনি মশারির ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে নীলাদ্রির মাথার বালিশ ধরে টান দিল। নীচু গলায় আবার ডাকল, কীরে উঠবি তো!

চোখ বোজা অবস্থাতে নীলাদ্রি বিরক্ত গলায় বলল, কী হয়েছে?

আগে ওঠ, তারপর বলছি।

উঠতে পারব না। কী হয়েছে বল।

কিঙ্কিনি খাটের একপাশে বসল। এক ঝলক দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসে গলায় বলল, আড়াইশো টাকা দিতে পারবি? ঠিক আছে আড়াইশো দিতে হবে না, দুশো কুড়ি পঁচিশ হলেই হবে। আছে?

নীলাদ্রি এবার বালিশ সরিয়ে চিত হয়ে শুল। চোখ খুলল। আড়াইশো টাকা! কিঙ্কিনি তার কাছে মাঝেমধ্যে টাকা চায় বটে, কিন্তু সে তো পাঁচ দশ। খুব বেশি হলে পঞ্চাশ। কোনও কোনও সময় মোবাইল রিচার্জ করিয়ে দিতে হবে। একসঙ্গে এত টাকা তো কখনও চায়নি!

কিঙ্কিনি হেসে বলল, কেন চাইছি জানতে চাইবি না কিন্তু।

কিঙ্কিনি দেখতে সুন্দর হয়েছে। তবে যামিনীর মতো নরমসরম সুন্দর নয়। কিঙ্কিনির চেহারার মধ্যে একটা ঝকঝকে ছাপ রয়েছে। দেবনাথের মতো। চোখমুখ শার্প। হাঁটাচলা, হাবভাবের মধ্যেও দেবনাথের মতো চাপা কনফিডেন্স। ভাবটা এমন যেন আমি যা করি ভেবেচিন্তে করি, ঠিক করি। দেখলে মনে হয়, এই মেয়ের বুদ্ধি বেশি। শুধু দেখতে নয়, কথাবার্তাতেও সে তার বাবার মতো রসিকতা তৈরি করতে শিখেছে।

কিঙ্কিনি এই সাতসকালেই বাইরে বেরোনোর জন্য তৈরি। স্নান সেরে জিনস আর কালো টপ পরেছে। মেয়েদের পছন্দের রং কালো নয়। তবু কিঙ্কিনি মাঝেমধ্যেই কালো রঙের পোশাক পরে। কারণ সে জানে তার গায়ের ফরসা রঙে কালো ঝলমল করে। নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে। বেশি মাত্রায় সচেতন কিঙ্কিনি। সে বুঝতে পারছে, শুধু নিছক সৌন্দর্য নয়, তার চেহারা ইতিমধ্যেই একধরনের আকর্ষণ তৈরি করতে শুরু করেছে। সম্ভবত একেই বলে শরীরী আকর্ষণ। খুব জোরালো নয়, কিন্তু তৈরি হয়েছে। অতি সাধারণ সাজগোজ করলেও রাস্তাঘাটে ছেলেরা তার দিকে না তাকিয়ে পারে না। বন্ধুরাও বিষয়টা জানে। ঠাট্টা করে বলে, তোর সঙ্গে বেরোতে ইচ্ছে করে না। আমাদের দিকে কেউ তাকায় না। বৈদভটিা অসভ্য। একটু গোলমেলেও আছে। একদিন আড়ালে ফট করে বুকে হাত দিয়ে বসল। বলল, হাউ নাইস কিঙ্কি! আউচ! কত বড় হয়ে গেছে!

নীলাদ্রি ভুরু কুঁচকে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বোনকে সে ভালোবাসে। দেবনাথের নিরুদ্দেশ হওয়ায় সেই ভালোবাসা খানিকটা আশকারার চেহারা নিয়েছে। শুধু দেবনাথের নিরুদ্দেশ হওয়া নয়, আশকারার অন্য কারণও আছে। স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মেয়ের প্রতি যামিনী ক্রমশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে। যত দিন। গেছে সেই ভাব বেড়েছে। মেয়েদের কোনও কিছু যেন তার পছন্দ হয় না। আচার-আচরণ, কথাবার্তা সবেতেই বিরক্ত হয়! ছোটখাটো বিষয়ে বকাঝকা করে, খোঁচা দিয়ে কথা বলে। একটা সময় মারধোরও করেছে। কঠিন মার। কিঙ্কিনি প্রথম প্রথম মায়ের এই ব্যবহারে অবাক হত। অভিমান করত। মা তার সঙ্গে কেন এমন করে! কই দাদার সঙ্গে তো করে না! সে কী দোষ। করল? তাকে বলার জন্য মা কেন খুঁজে খুঁজে কারণ বের করে? কারণ না পেলে, বানিয়ে বানিয়ে কারণ তৈরি করে। স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে চুলের মুঠি চেপে ধরেছে। কিঙ্কিনি বলার চেষ্টা করেছে, দেরি সে করেনি, তার স্কুলবাস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মা শোনেনি। টিভি দেখলে রেগে যেত। টিভিতে সিনেমা বা সিরিয়াল নয়, ছোটবেলা থেকেই কিঙ্কিনির চ্যানেল ঘুরিয়ে খবর দেখার নেশা। দেবনাথের মতো। খবর কিছু বুঝত না। তবু দেখত। যামিনী রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে চড় মারত। পাড়ার কোন বখাটে ছেলে দুদিন বাড়ির সামনে সাইকেলের বেল বাজিয়ে চলে গেছে, কিঙ্কিনি জানেও না। বেধড়ক মার খেয়েছে কিঙ্কিনি। অপমানের মার। পায়ের চটি খুলে মেরেছে যামিনী। তখন মাকে ভয় পেত কিঙ্কিনি, লুকিয়ে কাঁদত। একটা বয়সের পর যামিনী মেয়েকে মারধোর বন্ধ করল, কিন্তু বকাঝকা চলতে লাগল। কিঙ্কিনি খানিকটা বড় হয়ে কান্নাকাটি, মান অভিমান সব বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ের বকাঝকা, বেঁকা কথা এখন আর তার গায়ে লাগে না, সে ভয়ও পায় না। হয় অবজ্ঞা করে, নয় মুখে মুখে কথা বলে। কিছুদিন আগেও মেয়ের তর্ক শুনলে যামিনী চিৎকার করে উঠত। কিঙ্কিনি শান্ত গলায় বলত, মা, তুমি যদি চিৎকার কর আমি তোমার ডবল চিৎকার করব। তুমি চিৎকার করতে করতে হাঁপিয়ে যাবে। আমি হাঁপাব না, কারণ আমার বয়স তোমার থেকে কম। আমার দম বেশি।

তারপর থেকে যামিনী চিৎকার করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলাই কমিয়ে দিয়েছে। যেটুকু না বললে নয়। গত সোমবারের কথা কাটাকাটির পর থেকে তা-ও বন্ধ। এখন পরোক্ষ ভাবে খাবার দেওয়া হয়েছে, ড্রেসিং টেবিলের ওপর টাকা রইল, ছাদ থেকে জামাটা তুলতে হবে গোছের কথা চলে। বাকিটুকু ভায়া নীলাদ্রি।

মা-মেয়ে একসঙ্গে খেতে বসে না আজকাল। হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকেই কিঙ্কিনি এই নিয়ম চালু করেছে। পড়ার চাপ। সময় ধরে খাওয়াদাওয়া সম্ভব নয়। কোনওদিন ভাত খেতে বেলা গড়িয়ে যায়, কখনও ডিনারে বসতে রাত হয়। সুতরাং যে যার মতো খেয়ে নিতে হবে। তবু গত সোমবার দুজনে একসঙ্গে টেবিলে বসেছিল। মা-মেয়ে দুজনেরই তাড়া। কিঙ্কিনি শালিনীর সঙ্গে কলকাতায় যাবে। শালিনীর বড়মামা হাসপাতালে, ভাগনিকে দেখতে চেয়েছেন। সে একা যাবে না, বন্ধুকে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে হাসপাতালে যাওয়ার আগে সিনেমা দেখবে দুজনে। ফেরা নিয়ে চিন্তা নেই। শালিনীর বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে ওদের নিয়ে আসবে। চুপচাপই খাচ্ছিল দুজনে। টেবিলের দুদিকে বসে। মেনু নিয়ে আপত্তি তুলল কিঙ্কিনি। নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল। ছাপোষা ডাল-ভাত আর মাছের ঝোল তার আর সহ্য হচ্ছে না। অরুচি ধরে গেছে। তারওপর রান্নাও খারাপ। স্বাদ নেই। নীচু গলায় কিঙ্কিনি একটানা বলতে থাকে

এগুলো মানুষ খায়? নিজেকে গরুর মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘাস খাচ্ছি। রোজ রোজ এই অখাদ্যগুলো খাওয়ার থেকে না খাওয়া ভালো।

যামিনী জানে, নীচু গলায় বললেও মেয়ে তাকে শুনিয়ে কথাগুলো বলছে। এতদিন পরে হঠাৎ এসব কথা কেন! যামিনী কথার উত্তর দেয় না। মাথা নামিয়ে দ্রুত খেতে থাকে। আর উত্তর দেবারই বা কী আছে? মেয়ে তো ভুল বলছে না। সত্যি তো খাবার স্বাদহীন। বিজলীকে অনেকদিন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। না দিয়ে উপায় ছিল না। এই সংসারে আলাদা করে রান্নার লোক রাখার সামর্থ্যও কোথায়? যামিনী নিজেই রান্না করে। সেই রান্নায় যত্ন, মন কিছুই থাকে না। করতে হয় তাই করা। দু-একদিন মন দেওয়ার চেষ্টা করেছে, পারেনি। মনে হয়েছে, ঠিকমতো রান্না করা সে ভুলেই গেছে। আর কোনওদিনও পারবে না। মাঝেমধ্যে ভয় করে। যদি দেবনাথ ফিরে আসে? তখনও কি রাঁধতে পারবে না?

যামিনী চুপ করে থাকলেও কিঙ্কিনি বলে চলে–

একেই তো মেনু জঘন্য, রোজই এক খাবার, তারওপর কোনওদিন নুন থাকে না, কোনওদিন গাদাখানেক চিনি। আজ মাছের ঝোলে নুন চিনি কিছুই নেই। বমি আসছে।

যামিনী আর পারল না। মুখ না তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, কাল থেকে নিজে রান্না করে নিও।

কিঙ্কিনি নাক মুখ কুঁচকে বলল, জানলে তাই করতাম।

শিখে নাও। ঘর সংসারের কাজ শেখার বয়স তোমার হয়ে গেছে। সারাদিন তো হয় ঘুমোচ্ছ, নয় টইটই করে বেড়াচ্ছ।

কিঙ্কিনি মুখ দিয়ে বিদ্রুপের আওয়াজ করল। বলল, হ্যাঁ, এখন সব ছেড়েছুঁড়ে রান্নাঘরে। ঢুকে হাঁড়ি ঠেলি আর কী। বয়ে গেছে। আমার কোনও বন্ধু রান্না করে না।

যামিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে না।

কিঙ্কিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কেন মেলাব না কেন? তারা কি আলাদা?

যামিনী চোয়াল শক্ত করে বলল, হ্যাঁ, তারা আলাদা। তাদের বাবারা কেউ বউ-ছেলেমেয়ে ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়নি। তোমার বাবা গেছে।

কিঙ্কিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মা, তুমি এমন বলছ যেন বাবা আমাদের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। পানিশমেন্ট হিসেবে আমাকে রান্না করতে হবে, দাদাকে বাসন মাজতে হবে।

যামিনী মুখ তুলে বলল, আমি সেকথা বলিনি। তুমি এমন ভাবে কথা বলছ কেন?

আমি বলিনি, তুমি বলছ। আমি ডালের কথা বললাম, তুমি বাবার কথা বলছ। বাবার চলে যাওয়ার কথা। রান্না খারাপের সঙ্গে বাবার কথা আসে কীভাবে?

গলায় ঝাঁঝ এনে যামিনী বলল, তোমার বাবা গেছে বলেই বলছি। সব কথাতেই আসবে।

কিঙ্কিনি ঠোঁটের কোনায় বেঁকা হেসে বলল, বাবা আমার জন্য তো বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি। আমি কোন দুঃখে ঘাস পাতা খাব? কথাটার মধ্যে চাপা ইঙ্গিত ছিল।

যামিনী স্থির চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কার জন্য গেছে?

কিঙ্কিনি মায়ের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। গলা নামিয়ে বলল, আমরা কী জানি? আমি দাদা দুজনেই তখন যথেষ্ট ছোট ছিলাম। যদি জানার হয় তুমি জানবে। যদি কেন? বাবার বিষয়টা তোমারই জানা উচিত।

যামিনী থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই কী বলতে চাইছিস?

কিঙ্কিনি গ্লাস তুলে জল খেল। তারপর টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে হালকা ভঙ্গিতে বলল, কী বলতে চাইছি তুমি ভালো করেই জানো মা। আমি কেন সবাই তোমাকে এই কথাটাই বলে। বলে না?

যামিনী কিছু বলতে গিয়ে থেমে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর হিসহিসিয়ে বলে উঠল, চুপ কর কিঙ্কি, চুপ কর। খুব সাহস হয়েছে তোর, খুব সাহস, মুখে যা আসছে বলে ফেলছিস।

যামিনীর ধমক কিঙ্কিনি পাত্তা দিল না। হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমের দিকে যেতে যেতে সহজ গলায় বলল, সাহস হওয়া তো খারাপ নয় মা। যখন ছোট ছিলাম তখন অনেক কিছু বলতে পারিনি, অনেক কিছু অজানাও থেকে গেছে। এখন তো আর ছোট নেই। তারওপর অনেকে অনেকরকম বলে। সেটাই বলছি।

যামিনী উঠে দাঁড়ায়। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে, কী বলে?

বাথরুম থেকে কিঙ্কিনি চিৎকার করে বলে, কী বলে তুমি ভালো করেই জানো। জানো না?

এরপর থেকে যামিনী মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। নীলাদ্রি শান্তপ্রকৃতির ছেলে। সে ঝগড়াঝাটি সহ্য করতে পারে না। পরদিন সকালে বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করে।

মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করিস না।

দাদার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কিঙ্কিনি বলল, মা তোকে লাগিয়েছে?

নীলাদ্রি বলল, এর মধ্যে লাগানোর কী আছে? মায়ের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কাল রাতে খায়নি। উফ তোরা কি একটুও চুপ করে থাকতে পারিস না?

কিঙ্কিনি মুখ নামিয়ে বলল, আমি কিছু করিনি।

যে-ই করুক, দয়া করে ঝামেলা বন্ধ কর।

কিঙ্কিনি বলল, থামা বললেই কি থামবে দাদা? ঝামেলা তো শুধু আজ হচ্ছে না, বহুদিন ধরেই হচ্ছে। মা আমাকে সহ্য করতে পারে না। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই এই কাণ্ড চলছে। আমাকে দেখলেই তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। মনে আছে দাদা, একবার সকালে বাবার মতো গরম চায়ের কাপ হাতে পেপার পড়ছিলাম বলে মা টেনে তুলে দেওয়ালে মাথা। ঠুকে দিয়েছিল? মনে আছে? এই দেখ এখনও দাগ রয়েছে। কপালের চুল সরায় কিঙ্কিনি। সত্যি বাঁদিকে ভুরুর পাশে দাগ রয়ে গেছে।

নীলাদ্রি জানে কিঙ্কিনি যা বলছে ভুল বলছে না। মায়ের ওপর তার রাগ আর শুধু রাগে আটকে নেই। খানিকটা যেন ঘৃণার চেহারা নিয়েছে। মা যে কেন কিঙ্কির ওপর এত বিরক্ত, এতদিনেও বুঝতে পারে না নীলাদ্রি। তবু সে বলল, জানিসই তো মায়ের মনমেজাজ সবসময় খারাপ হয়ে থাকে।

কিঙ্কিনি চুল বাঁধছিল। তার চুলের ব্যান্ড হারিয়ে গেছে। সামনে ছড়িয়ে থাকা বইখাতা, কাগজপত্র সরিয়ে ব্যান্ডটা খুঁজতে লাগল। আলগোছে বলল, কেন? মনমেজাজ খারাপ কেন?

নীলাদ্রি বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, জানিস না কেন? ঠাট্টা করছিস? বাবার ঘটনাটার পর থেকেই তো এরকম হয়ে গেছে। সেটাই নরমাল।

কিঙ্কিনি ব্যান্ড খুঁজে পায়। চুলে লাগাতে লাগাতে বলল, জানবো না কেন? আমি তো আর ছোট খুকি নই, কিন্তু মা এমন ছোট খুকির মতো ব্যবহার করে কেন বলতে পারিস? মা কি মনে করে দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় নামের মানুষটা শুধু তার স্বামী ছিল? আমাদের বাবা ছিল না? মানুষটা হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের মনমেজাজ খারাপ হতে নেই? দুঃখ অপমান হতে পারে না? বাবা শুধু তার সম্পত্তি? তার মানুষ?

নীলাদ্রি চুপ করে এই অভিমানের কথা শোনে। এগিয়ে এসে বোনের পিঠে হাত রেখে বলল, এইটুকু বয়েসে খুব পাকাঁপাকা কথা শিখেছিস।

কিঙ্কিনি চুপ থেকে শান্ত গলায় বলল, শিখতে বাধ্য হয়েছি। যেসব ছেলেমেয়ের বাবা কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তারা সবাই কম বয়েসে পাকা কথা শিখে যায়। তুইও শিখেছিস। তুই ভালো ছেলে তাই বলিস না। আমি বলে বিপদে পড়ি।

না বললেই পারিস। ওসব বলে মাকে রাগিয়ে দিস কেন?

কিঙ্কিনি দাদার কথার উত্তর না দিয়ে বলে, আমি জানি মা কেন আমার ওপর এত খাপ্পা। নীলাদ্রি ভুরু কোঁচকালো। কিঙ্কিনি বলল, আগে বুঝতে পারতাম না, এখন বুঝি।

নীলাদ্রি বলল, কেন?

কিঙ্কিনি দাদার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল। বলল, থাক, শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।

নীলাদ্রি সেদিন অবাক হয়েছিল। মেয়েটা এই কম বয়সেও কত ম্যাচিওরড হয়ে গেছে। রাগ অভিমানের মধ্যেও গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছে। বাবাও এরকম গুছিয়ে কথা বলত।

আজও অবাক হল নীলাদ্রি। এই সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে টাকা চাইছেও কেমন সুন্দর করে!

কিঙ্কিনি মাথা কাত করে বলল, কীরে দাদা টাকা হবে?

কত হবে জানি না। পার্সটা দেখ, যা থাকে নিয়ে নে।

কিঙ্কিনি খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, সব নিয়ে নিলে তোর চলবে কী করে।

নীলাদ্রি এবার উঠে বসল। আড়মোড়া ভেঙে বলল, সে আমি বুঝব।

নীলাদ্রিকে তার বাবা-মা কারও মতোই দেখতে হয়নি। তাকে চট করে সুন্দর বলা যাবে না। একজন সাধারণ চেহারার যুবক। ভিড়ে মিশে যাওয়া ধরনের। একসময় আত্মীয়রা বলত, নীলাদ্রি নাকি তার মামার মতো চেহারা পেয়েছে। রোগা আর লম্বাটে গড়ন। শুধু চেহারায় সাধারণ নয়, শান্তস্বভাবের এই ছেলে লেখাপড়াতেও সাধারণ হয়ে গেছে। যে ছেলে চারটে লেটার নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেছিল, সে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় তেমন কিছু করতে পারল না। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার, হল না। হওয়ার কথাও নয়। তখন সবে কদিন হল দেবনাথ নিরুদ্দেশ হয়েছে। গোটা পরিবার বিপর্যস্ত, দিশেহারা। সাজানো গোছানো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। যেন নাটক শেষ হওয়ার আগে মঞ্চের সামনে কেউ কালো, ভারী পরদা টেনে দিল। কদিন পরেই যে নীলাদ্রি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষায় বসবে সেকথা কারও মাথায় রইল না। এমনকী নীলাদ্রিরও নয়। তখন বেঁচে থাকাটাই একটা পরীক্ষা। যেন প্রতিটা মুহূর্তে কঠিন প্রশ্নপত্রের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

হায়ার সেকেন্ডারির মতো গ্র্যাজুয়েশনেও সাধারণ, মাঝারি রেজাল্ট। তাও যামিনী চেয়েছিল, ছেলেটা আরও পড়ুক। আজকাল রেজাল্ট খারাপ হলেও টাকা খরচ করে কেরিয়ার করবার অনেক ব্যবস্থা হয়েছে। ম্যানেজমেন্টে পড়া যায়। নীলাদ্রি সে পথে যায়নি। সে বুঝেছিল, এ-বাড়ির পক্ষে আর টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। উলটে টাকা রোজগার করতে হবে। ছোটখাটো একটা ট্রেনিং করে আই টি সেক্টরে কাজ করছে। প্রজেক্ট অ্যাসিটেন্ট গোছের কাজ। আরও পাঁচজনের সঙ্গে বসে ডাটাবেস তৈরি করতে হয়। সবসময় কাজ থাকে না। এজেন্সির কাছে নাম লেখানো রয়েছে। তারা দরকার মতো খবর দেয়। তখন ছুটতে হয় সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। তবে কাজ থাকলে পেমেন্ট খারাপ নয়। টানা কাজ থাকাটাই সমস্যা। আই টি সেক্টর বাইরে থেকে শুনতেই গালভারী। নীচের দিকে ভিড় বাড়ছে। অনেকটা সময় হাত গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এখন যেমন বেশ কিছুদিন হল নীলাদ্রির বেকারদশা চলছে। নীলাদ্রি বুঝতে পারছে এভাবে চলবে না, একটা অন্য কিছু দেখতে হবে। পাকাপাকি কিছু। চেষ্টাও করছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো কয়েকটা দিয়েছে। এখনও লাগেনি।

নীলাদ্রির ব্যাগে দুশো তিরিশ টাকা মতো পড়ে আছে। একশো টাকার নোটদুটো নিয়ে কিঙ্কিনি বলল, আজ আমাদের বন্ধুদের পিকনিক। আড়াইশো করে চাঁদা।

নীলাদ্রি বলল, পিকনিক! এখন তো শীত নয়, পিকনিক কীসের?

কিঙ্কিনি হেসে বলল, শুধু শীতেই পিকনিক করা যায় এমন কোনও কথা আছে নাকি? আর থাকলেও সে আমরা ভাঙছি। কোথায় যাচ্ছি জানিস দাদা?

কোথায়?

কিঙ্কিনি ঘাড় কাত করে নীলাদ্রির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিটিমিটি হেসে বলল, উঁহু, বলব না। বললে তুই চিন্তা করবি। সবাই পিকনিক করতে সুন্দর জায়গায় যায়, আমরা একটা ভয়ংকর জায়গায় যাচ্ছি। সেখানে আমাদের ভয়ঙ্কর পিকনিক হবে।

কিঙ্কিনি হাসি ঠাট্টা করলেও নীলাদ্রির বিষয়টা পছন্দ হচ্ছে না। যতই গুছিয়ে সুন্দর করে হাসি মুখে কথা বলুক আজকাল এই মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হয়। কিঙ্কিনির মধ্যে কেমন একটা বেপরোয়া ভাব এসে যাচ্ছে। ধুম ধাড়াক্কা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। মা বলেছে, দু-একদিন রাত করেও নাকি বাড়ি ফিরেছে। কখনও আবার টানা তিনদিন নিজের ঘরেই দরজা আটকে বসে থাকে। শুধু খেতে আর স্নান করতে বেরোয়। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কিছু বলতে গেলে রেগে যায়। মায়ের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়াও করে। খারাপ কথা বলে। বাইরে থেকে কেউ দেখলে মনে করবে, শাসন নেই। মেয়েটা বিগড়ে যাচ্ছে। মাও তাই বলে। নীলাদ্রির সেরকম মনে হয় না। তার মনে হয়, ছোটবেলায় মায়ের অতিরিক্তি বকাঝকা গোলমাল করে দিয়েছে। এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। মায়ের প্রতি একটা প্রতিশোধ। কই তার সঙ্গে তো কিঙ্কি খারাপ ব্যবহার করে না। পরীক্ষার পর কম্পিউটার ক্লাসে ভরতি হতে বলেছিল, হয়েছেও। মনে হচ্ছে, এবার একদিন মা-কিঙ্কি দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে বসতে হবে। ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে। মায়ের ওপর রাগ করে এই বয়েসে বড় কিছু গোলমাল করে ফেললে সর্বনাশ হবে। তবে কাজটা করতে হবে খুব সতর্ক হয়ে। এই মেয়ে যদি মনে করে দাদাও তাকে শাসন করতে চাইছে, তখন তার হাত থেকেও বেরিয়ে যাবে।

নীলাদ্রি আড়মোড়া ভেঙে বলল, ভয়ঙ্কর না সুন্দর আমার জানার দরকার নেই, যেখানেই যাবে সাবধানে থাকবে। সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরবে আর ফোন করলে ধরবে।

কিঙ্কিনি হাত জোড় করে বলল, প্লিজ দাদা, তুই অন্তত আর গার্জেনগিরি করিস না। গার্জেনগিরি অনেক হয়েছে। কপালে স্টিচ, পিঠে জুতোর দাগ নিয়ে আই অ্যাম টায়ার্ড। আমাদের পিকনিকের আজ নিয়ম কেউ মোবাইল অন করতে পারবে না। যে করবে তার ফাইন হবে। অতএব নো কল।

কিঙ্কিনি ঘর থেকে বেরোতে গেল। নীলাদ্রি ডাকল, অ্যাই কিঙ্কি শোন একবার। কিঙ্কিনি ঘুরে দাঁড়াল।

ইস পিছনে ডাকলি তো, কী হল?

নীলাদ্রি ফিসফিস করে বলল, মা, কাঁদছে না?

কিঙ্কিনি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, কাঁদছে! কই না তো, দেখলাম টেবিলে বসে আরাম করে চা খাচ্ছে। মনে হয় সেকেন্ড কাপ। তোর আবার বেশি বেশি।

কিঙ্কিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরও নীলাদ্রি বেশ খানিকটা সময় চুপ করে শুয়ে রইল। মা কাঁদছে না! তা হলে কোন কান্নার আওয়াজে আজ তার ঘুম ভাঙল? স্বপ্নে কিছু শুনছে? অথবা কে জানে হয়তো অভ্যেস হয়ে গেছে। কেউ না কাঁদলেও মনে হয়, এ বাড়ির সকাল হয় কান্না দিয়ে। মনটা খারাপ হয়ে গেল নীলাদ্রির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *