৫. কারও সঙ্গে একঘরে

০৫.

কারও সঙ্গে একঘরে থাকতে আমি পারব না, ঘোষণা করে দিলেন রাবাত, নিজের নাতি হলেও না! পোলাপানকে বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসবে ঠিক নেই। হয়তো দেখা যাবে রাত দুপুরে উঠে পনির দিয়ে রুটি খেতে বসল। হই-চই করে, শব্দ করে আমার ঘুমের বারোটা বাজাবে।

অতএব ঘুমের সুবিধার জন্যে মনটিরের ফিশারম্যান ওআর্য থেকে কয়েক ব্লক দূরে একটা মোটেলে দুটো কামরা ভাড়া করলেন তিনি। তারপর ক্যানারি রো-র একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন ছেলেদের। চমৎকার রান্না করা নানা রকম মাছের স্বাদ বহুদিন মনে থাকবে তিন গোয়েন্দার। খেতে খেতে মনটিরে আর স্প্যানিশ ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক ইতিহাস বললেন। মেজাজ একেবারে ফুরফুরে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মিলারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যেন বহুযুগ আগের ব্যাপার। কোনই গুরুত্ব নেই ওটার। মন থেকে দূর করে দিয়েছেন বেমালুম।

সে-রাতে সকাল সকাল ঘুমাতে গেল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল তিন গোয়েন্দা, আলাদা ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করে একটা কাজের কাজ করেছেন রাবাত। তাতে তার চেয়ে ওদের উপকার হয়েছে বেশি। একঘরে থাকলে সারারাত জেগে থাকতে হত। এত জোরে নাক ডাকাচ্ছেন, দুটো ঘরই কাঁপতে শুরু করল।

সাইনাসের সমস্যা আছে, অনুমান করল রবিন।

মা বলে ওসব কিছু না, মুসা বলল, রোগটোগ নেই। আসলে ঘুমের মধ্যেও নানা চান না তাকে অগ্রাহ্য করা হোক।

মাঝখানে একটা দেয়াল থাকলে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যেত তিন গোয়েন্দা। অন্য ঘর থেকে আসছে বলে রক্ষা। তা-ও যা শব্দ! তবে একবার ঘুমিয়ে পড়ার পর আর অসুবিধে হলো না, একটানা ঘুমাল সকাল পর্যন্ত।

জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকল সকালের রোদ। ঘুম ভাঙল ওদের। শুনতে পেল, উঠে পড়েছেন রাবাত। বাথরুমে তার শাওয়ারের শব্দ। পাওয়া যাচ্ছে। ওরাও উঠে পড়ল। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরে তৈরি হলো। দরজায় খটখটানির শব্দ। রাবাত ডাকছেন।

 জেটির ধারে একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে বসল ওরা। ভাজা মাংস, কেক আর এক জগ কমলার রসের অর্ডার দিলেন রাবাত। ঘুম ভাল হওয়ায় শরীরটা ঝরঝরে লাগছে কিশোরের। খাবারে আনন্দ পাচ্ছে তাই। খেতে খেতে সাগর দেখার জন্যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে একজন লোক। তাড়াতাড়ি আবার প্লেটের দিকে নজর ফেরাল, যাতে তার চমকে যাওয়া রাবাতের চোখে না পড়ে। কেকের একটা টুকরো ভেঙে সিরাপে চুবিয়ে মুখে পুরল।

নানার পাশে, কিশোরের মুখোমুখি বসেছে মুসা। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না তার। প্রশ্ন করার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল। ভ্রুকুটি করে আর সামান্য মাথা নেড়ে তাকে চুপ থাকতে ইশারা করেছে কিশোর।

তার দিকে তাকিয়ে রাবাত জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু খাবে তোমরা?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, অনেক হয়েছে। পেট ভরে গেছে।

 খুব ভাল খাবার, রবিন বলল।

চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। খাবারের দাম দেয়ার জন্যে ক্যাশিয়ারের ডেস্কের দিকে এগোলেন।

সামনে গলা বাড়িয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা, কি দেখেছিলে, কিশোর?

হ্যারিস মিলারকে, ক্যানারি রো-র দিকে যাচ্ছে।

ফিরে এলেন রাবাত। ওয়েইটারের জন্যে প্লেটে টিপস রেখে দিয়ে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন, পানির কিনারটা ঘুরে দেখতে চাও? বেশি দেরি করা যাবে না। আজ রাতেই স্যান ফ্রান্সিসকো পেরোতে চাই। সম্ভব হলে সান্তা রোজাতে চলে যাব। কালকের দিনটা তাহলে রেডউডের বনে ঘুরে। কাটাতে পারব।

তার পেছন পেছন রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এল ছেলেরা। রবিনের কাঁধে ঝোলানো একটা আনকোরা নতুন ক্যামেরা। রকি বীচে কেনার পর একটা ছবিও তোলা হয়নি ওটা দিয়ে। এখান থেকে শুরু করার ইচ্ছে তার।

সবাইকে নিয়ে জেটির কাছে চলে এলেন রাবাত। ঘাটে বাঁধা ছোট-বড় অনেক নৌকা ঢেউয়ে দুলছে। জাহাজ বেরিয়ে যাচ্ছে খোলা সাগরে।

 এখনও খুব সকাল, কিন্তু জেটিতে পুরোপুরি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। রাতে ধরে আনা মাছ নামাচ্ছে জেলেরা। দোকানে দোকানে টুরিস্টদের ভিড়। বিশেষ করে ঝিনুক-সামগ্রীর দোকানগুলোতে। খটাখট ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগল রবিন। মুসার চোখ আকাশে চক্কর দেয়া সী-গালের খেলা। দেখছে। অলস ভঙ্গিতে রাবাত তাকিয়ে আছেন একটা দোকানের দিকে।

ধীরে ধীরে নজর সরে গেল রাস্তার দিকে। মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি। শক্ত হয়ে গেল কাধ।

কি বলেছিলাম! শয়তানটা এখানেও এসেছে!

না তাকিয়েও বলে দিতে পারবে কিশোর কার কথা বলছেন রাবাত। হ্যারিস মিলার ছাড়া আর কেউ না। আবার এসেছে যেন রাবাতের হাসিখুশি মেজাজটাকে পলকে বিগড়ে দেয়ার জন্যে। আগুন বানিয়ে দেয়ার জন্যে।

নানা, তাড়াতাড়ি দুহাত তুলে এগিয়ে এল মুসা, দোহাই তোমার, চুপ করে থাকো! কিছু বোলো না!

ভয়ানক ভঙ্গিতে নাক দিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন রাবাত। বেশ! তবে এখানে আমি আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়াব না!

ঝিনুকের দোকানটায় ঢুকে পড়লেন তিনি। বিশাল এক দানবীয় ঝিনুকের খোলার ওপাশে মুখ লুকিয়ে ফেললেন। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে গোয়েন্দারা শুধু তার কোকড়া চুলগুলো দেখতে পেল।

ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল মিলার। তার ওপর যে নজর রাখা হচ্ছে, বুঝতে পারেনি। কাঁধে ঝোলানো নতুন ক্যামেরার ব্যাগ, ক্যামেরাটা হাতে। অবিকল রবিনেরটার মত, একটা Canon II. রবিনের মতই জেটির দৃশ্যের ছবি তোলায় আগ্রহী মনে হলো তাকে। তবে তুলছে না। সকালের ট্যুরিস্টদের ভিড়ে মিশে গেছে। সবই নতুন তার। গায়ের সাদা শার্টটা নতুন–গলার কাছে দুটো বোতাম খোলা, পরনে নতুন জিনসের প্যান্ট। পায়ে রবার সোলের নতুন জুতো। রকি বীচ থেকে বেরোনোর পর পথে কোনখান থেকে একটা নতুন স্ট্র হ্যাটও কিনেছে। হ্যাঁটের চওড়া কানা ছায়া ফেলেছে মুখে।

দ্বিধা করতে লাগল মুসা। তার নানা যে ওত পেতে আছেন ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে এ কথা বলে সাবধান করে দেবে মিলারকে? করতে গেলে এবং সেটা দেখে ফেললে তার ওপর খেপে যাবেন নানা। সেটা চায় না সে। মিলারের সঙ্গে আবার একটা বিচ্ছিরি এটে যাক, এটাও চায় না। কি করবে তাহলে? মুশকিলে পড়ে গেল।

ঘুরে তাকাল সে। দেখল, কিশোরও তাকিয়ে আছে। বুঝল, তার মত একই সমস্যায় পড়েছে কিশোরও।

কয়েক পা হেঁটে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসল রবিন। ক্যামেরাটা ব্যাগে ভরে পাশে রেখে সাগরের দিকে তাকাল। মিলারকে না দেখার ভান করল।

ক্যামেরা হাতে হেঁটে এল মিলার। মুসার এত কাছে দাঁড়াল, আরেকটু হলে কাঁধে কাধ ঠেকে যেত, অথচ লক্ষ করল না তাকে। ভয়ানক অন্যমনস্ক। বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। কারও আসার অপেক্ষা করছে বোধহয়।

মিনিট দুয়েক পর এল সে। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে দেখতে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, মিলার?

কেমন একটু বিস্ময় আর অবজ্ঞা প্রকাশ পেল লোকটার কণ্ঠে। ফিরে। তাকাল কিশোর। বয়েস চল্লিশের কোঠায়, মাথায় মসৃণ কালো চুল, মুখটাও মসৃণ। পরনে সিল্কের পাজামা, গায়ে নরম কাপড়ের দামী শার্ট। চোখে বিরাট সানগ্লাস মুখের অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। চোখা পাতলা নাক। পাতলা ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। ছোট ছোট কান মাথার সঙ্গে প্রায় লেপ্টে আছে। তার পাশে কেমন আড়ষ্ট আর নগণ্য লাগছে জিনস আর সাদা শার্ট পরা গাট্টাগোট্টা মিলারকে।

জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে মিলার বলল, এনেছি।

কিশোরের দিকে তাকাল আগন্তুক।

নিরীহ ভঙ্গি করে সাগরের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর।

আসুন, বলে হাঁটতে শুরু করল লোকটা।

নতুন জিনসের খসখস শব্দ তুলে তার পেছনে এগোল মিলার।

আবার ওদের দিকে ফিরল কিশোর। রবিনের কাছাকাছি চলে গেছে দুজনে। কেমন সন্ত্রস্ত লাগছে মিলারকে। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বার বার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যেন লক্ষকোটি চোখ রয়েছে তার। ওপর। সেগুলোকে এড়ানোর চেষ্টা করছে। অমন করছে কেন লোকটা?

রবিন যে বেঞ্চটায় বসেছে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সানগ্লাস পরা লোকটা। ফিতে ধরে ক্যামেরাটা ঝোলাতে ঝোলাতে তার সঙ্গে সঙ্গে গেল মিলার। তাকে লোকটা বলল, বসুন এখানে।

বসতে যাবে মিলার, এই সময় চোখ পড়ল রবিনের মুখের দিকে।

 কুকড়ে গিয়ে যেন নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলতে চাইল রবিন।

 কিন্তু চিনে ফেলেছে মিলার। চমকে গিয়ে বলল, তুমি!

 কিশোর দেখল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখ।

বসা আর হলো না মিলারের। সোজা হয়ে চারপাশে তাকাল। কিশোর আর মুসাকেও দেখতে পেল এতক্ষণে। তবে তার চোখ ওদের খুঁজছে না। কাকে খুঁজছে, বুঝতে পারল কিশোর। বিশাল ঝিনুকের খোলার ওপর দিয়ে সেই মুখটাকে দেখতে না পেলেও ধূসর কোকড়া তারের মত চুল বেরিয়ে থাকতে দেখল।

ধরা পড়ে গেছেন বুঝে আর লুকানোর চেষ্টা করলেন না রাবাত। সোজা হলেন। রাগে জ্বলছে চোখ।

মড়ার মুখের মত সাদা হয়ে গেল মিলারের মুখ।

খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। মিলারের দিকে ছুটল। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।

তীব্র গতিতে দোকান থেকে ছুটে বেরোলেন রাবাত। মুঠো করে ফেলেছেন হাত। পিটিয়ে বালির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন বুঝি আজ মিলারকে!

হাতের ক্যামেরাটা বেঞ্চে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে ফেলল মিলার। পিছিয়ে গেল বেঞ্চের কাছ থেকে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল যে লোকটা, বিপদ বুঝতে পারল সে-ও। যেন পিছলে বেরিয়ে চলে গেল।

তার দিকে নজর নেই তিন গোয়েন্দার, রাবাত আর মিলারকে দেখছে।

মিলারের কলার খামচে ধরলেন রাবাত। চেঁচাতে লাগলেন, দেখে ফেলব ভাবোনি, না! আশা ছাড়তে পারোনি। বলেছি না, পাবে না। আমার কাছ থেকে জিনিস নেয়া অত সহজ না।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল মিলার। কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বেরোল কেবল ঘড়ঘড় শব্দ। কণ্ঠনালীতে চাপ পড়ায় কাশতে শুরু করল। বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না, রাবাতকে ঠেলে সরাল না; এমনকি পিছিয়ে যাবার কিংবা দৌড় দেয়ার চেষ্টাও করল না–প্রচণ্ড ভয়েই বোধহয় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল মারমুখো কালো মুখটার দিকে। নিজের মুখের যে কি ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে জানতে পারল না।

মিলারকে ভয় দেখাতে পেরে সন্তুষ্ট হলেন রাবাত। শার্ট ছেড়ে দিয়ে বললেন, যাও, ছেড়ে দিলাম এবারও! আবার যদি পিছে লাগতে দেখি…! কথাটা শেষ না করে ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিলেন কি করবেন। ছেলেদের কাছে। সরে এসে বললেন, চলো, ভিড় জমে যাচ্ছে।

দম বন্ধ করে ফেলেছিল মুসা। বিপদ কেটে যেতে নিশ্বাস ছাড়ল।

গা ঘেষাঘেঁষি করে পড়ে আছে দুটো ক্যামেরার ব্যাগ। ছোঁ মেরে একটা তুলে নিয়েই রওনা হয়ে গেল উত্তেজিত রবিন। ভিড় জমে গেলে মিলার কি করবে, কে জানে! পুলিশ ডাকার জন্যে অনুরোধ করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাজটা ঠিক করেননি রাবাত। পুলিশ এলে তিনিই ফাসবেন। লোকে দেখেছে, মিলার কিছু করেনি, তিনিই দোকান থেকে ছুটে এসে তাকে আক্রমণ। করেছেন। অতএব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালানো দরকার।

রাবাতের পেছনে প্রায় উড়ে চলল তিন গোয়েন্দা। খুব জোরে হাঁটতে পারেন তিনি। পানির ধার ধরে পার্কিং লটের দিকে এগোলেন। বুইকটা আছে ওখানে।

গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে আপন মনে হাসলেন তিনি। স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসার পর বেড়ে গেল হাসি। মিলারের ভড়কে যাওয়া চেহারার কথা মনে করেই হয়তো হাসছেন।

পেছনে চিৎকার শোনা গেল। এত কিছুর পরও আবার এসেছে হ্যারিস মিলার। ছুটে আসছে পেছন পেছন। মনে হলো কিছু বলতে চায়। এক হাতে স্ট্র হ্যাট, আরেক হাতে ক্যামেরার ব্যাগ। চিৎকার করে বলল, রাবাত, প্লীজ, একটা মিনিট দাঁড়াও!

দাঁড়ানো তো দুরের কথা, গাড়ির গতিও কমালেন না রাবাত, বরং এক্সিলারেটর চেপে ধরলেন আরও। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি।

থামলে না কেন, নানা? মুসা বলল, কি বলতে এসেছে, শুনলে পারতে।

হু, কাজ নেই আর। থামি। ওই চোরটার সঙ্গে আবার কিসের কথা? নতুন কোন ফন্দি করে এসেছে নিশ্চয়। অত কাঁচা লোক নই আমি, আমার ফর্মুলা চুরির সুযোগ দেব তাকে। তার আগেই জেলে ঢোকাব!

রাগ হয়ে গেল মুসার। যা কাণ্ড শুরু করেছ, জেলে তো ঢুকবে তুমি, দেখতেই পাচ্ছি! মাথা গরম করে কখন মেরে বসবে বেচারাকে; সে মরবে, আর গোষ্ঠীসুদ্ধ আমাদেরকে নিয়ে জেলে ভরবে পুলিশ! তোমার সঙ্গে আসাটাই বোধহয় ঠিক হয়নি!

কিশোর আর রবিন মনে করেছিল রেগে যাবেন রাবাত। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে হাসলেন তিনি। বাকা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, এক্কেবারে দেখি তোর মায়ের মত কথা বলিস! নাকি নানীর মত!

.

০৬.

পাগলামি শুরু হলেই বিপদ! নইলে নানা এমনিতে মানুষ খারাপ না। যখন ভাল থাকে, তখন তো খুবই ভাল! মুসা বলল। কজন লোক আছে, আমাদের বয়েসী ছেলেদের সহ্য করতে পারে, বলো? তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া! আসলে আমাদেরকে ভাল লেগে গেছে তার।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মুসার নানাকে অনেক আগে থেকেই চেনে সে, তবে এ রকম ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। মুসারই হয়নি, তার আর কি হবে। তার আচরণে ক্রমেই অবাক হচ্ছে। ভাল না মন্দ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ভদ্রলোকের। এই ভাল তো এই খারাপ। তবে একটা কথা ঠিক, মিলারকে না দেখলে মেজাজ ভালই থাকে তার। অন্তত এতদিন থেকেছে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা যায় না।

দুপুর দেড়টা বাজে। বুইকের গায়ে হেলান দিয়ে কথা বলছে দুজনে। তাকিয়ে আছে রবিন আর রাবাতের দিকে। ঘাসে ঢাকা একটা ঢালের গা বেয়ে কিছু দূর উঠে গেছে ওরা। ক্যামেরা উঁচিয়ে ছবি তুলছে রবিন। স্যান ফ্রান্সিসকো বে আর গোল্ডেন গেট ব্রিজের দিকে তাকিয়ে আছেন রাবাত। মহাসুখী মনে হচ্ছে তাকে। মেজাজ অত্যন্ত ভাল। মুসা ভাবল, ইস, এ রকম মেজাজ যদি শেষ পর্যন্ত থাকত।

রাবাতের মেজাজ সেদিন খারাপ হচ্ছে না। সকালে মিলারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সামান্য একটুক্ষণ খারাপ ছিল, আনমনে বিড়বিড় করেছেন, ঘোৎ-ঘোৎ করেছেন। হাইওয়ে ১০১-এ ওঠার পর মিলারের কথা উধাও হয়ে গেছে তার মন থেকে। শিস দিতে আরম্ভ করেছেন। উত্তরে স্যান। ফ্রান্সিসকোয় পৌঁছে কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিলেন। লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে। কিছু সুভনিরও কেনা হয়েছে। লাঞ্চ খেতে খেতে শুনিয়েছেন ১৯০৬ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোর ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা।

পুরো শহরটাতেই আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল, তাই না? কিশোর বলেছে।

মাথা ঝাঁকিয়েছেন রাবাত। পানি আর গ্যাসের পাইপগুলো আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ভূমিকম্পে। তারপর যখন গ্যাসে আগুন ধরে গেল, নেভানোর জন্যে পানি আর পাওয়া গেল না।

বেলা দুটোয় গোল্ডেন গেট ব্রিজ পেরোল ওরা। সাউস্যালিটোতে এসে হাইওয়ে ছেড়ে পাহাড়ী রাস্তায় ঢুকে পড়লেন রাবাত। এক জায়গায় থেমে রবিনকে আরও কিছু ছবি তোলার সুযোগ দিলেন।

আড়াইটা বাজল। ফিল্ম শেষ হয়ে গেল রবিনের। অবাক হলো সে। এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হওয়ার কথা নয়! এত ছবি কি তুলেছে? সন্দেহ হতে লাগল।

 পাহাড় বেয়ে দৌড়ে নেমে এল সে। গাড়ির পেছন থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা বের করে নতুন ফিল্ম নিয়ে ক্যামেরায় ভরল। কি যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে কোথাও, ঠিক ধরতে পারছে না। চাপ লেগেই বোধহয় বেশি চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ব্যাগের ওপরটা, ময়লাও লেগেছে বেশ। চিন্তিত মনে ফিরে গিয়ে আরও কয়েকটা ছবি তুলল।

আবার হাইওয়েতে ফিরে এল ওরা। আরও উত্তরে এগিয়ে চলল। রাস্তার দুধারে সুন্দর অঞ্চল। আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করল সূর্য।

ডিনারের সময় সান্তা রোজাতে পৌঁছল ওরা। একটা মোটেলে উঠে দুটো রুম ভাড়া করলেন রাবাত। পাশাপাশি ঘর। মাঝের দরজা দিয়ে একঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া যায়। দরজাটার কোন প্রয়োজন পড়বে না ওদের, ভাল আর কোন ঘর পাওয়া গেল না বলেই নেয়া।

মোটেলের পুলে সাঁতার কাটার প্রস্তাব করলেন রাবাত। সাতারের পর মোটেলের ডাইনিং রুমে খাওয়া সারলেন। ঘরে এসে রবিন আর কিশোর টিভি দেখতে লাগল, মুসার পেল ঘুম।

এত তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে ইচ্ছে করল না তার। ঘুম তাড়ানোর জন্যে নিচে পুলের ধারে বসানো সোডা মেশিন থেকে একটা সোডা কিনতে চলল। জানালার ধার দিয়ে দরজার কাছে যেতে হয়। জানালার বাইরে চোখ পড়তেই সোডা খাওয়ার কথা ভুলে গেল সে।

ওদের ঘরটা দোতলায়। পার্কিং এরিয়াটা দেখা যায়। নিচে সারি সারি গাড়ি পার্ক করা আছে। নানার বুইকটাও আছে, ওদের ঘরের বেলকনির ঠিক নিচেই। পেছনে খানিক দূরে একটা চকচকে লিংকন গাড়ি। সেটা থেকে হ্যারিস মিলারকে বেরিয়ে আসতে দেখল মুসা।

দম বন্ধ করে ফেলল সে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল নিথর হয়ে। স্তব্ধ, বিস্মিত। তারপর চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে বলল, কিশোর, দেখে যাও!

চোখের পলকে তার পাশে চলে এল অন্য দুই গোয়েন্দা। জানালা দিয়ে ওরাও দেখতে পেল মিলারকে। রাবাতের গাড়িটার চারপাশে ঘুরছে। একটা জানালার কাছে থেমে কাঁচে নাক ঠেকিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। সরে গেল। পেছনে, বুটের ঢাকনা টেনে তোলার চেষ্টা করল। না পেরে ফিরে তাকাল। মোটেলের অফিস এবং তার ওপরের জানালাগুলোর দিকে।

ঝট করে নিচু হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা, যাতে চোখে না পড়ে।

দ্বিধা করল মিলার। চিন্তিত ভঙ্গিতে বুইকটার দিকে তাকাল আরেকবার। তারপর লিংকনে উঠে স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল তিনজনে।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, মুসা, মনে হচ্ছে তোমার নানার সন্দেহই ঠিক, তার ফর্মুলা চুরির চেষ্টা করছে মিলার।

মাথা নেড়ে মুসা বলল, বুঝতে পারছি না। তবে কিছু একটা যে খুজতে এসেছিল মিলার, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা হোক, মিলারের কথা নানাকে বলার দরকার নেই। কি ঘটাবে কে জানে। শেষে পুলিশ তাকেই ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরবে।

হু, আনমনে মাথা নাড়ল কিশোর।

মিলারের ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে, রবিন বলল, বিষ্যত্বর থেকে নাকি ছুটিতে আছে। হয়তো আমাদের মতই বেড়াতে বেরিয়েছে। এ দিকে এসেছিল মোটেলের খোঁজে। রাবুনানার গাড়িটা দেখেছে। ভাল করে দেখে যখন বুঝেছে এটা তারই, এই মোটেলে ওঠার সাহস করেনি আর, পালিয়েছে। পাগলকে সবাই ভয় পায়।

তোমার কথায় যুক্তি আছে। তর্জনী তুলল মুসা, কিন্তু একটা কথা। নতুন গাড়ি কোথায় পেল মিলার? তার তো একটা ঝরঝরে পুরানো শেভি গাড়ি ছিল দেখেছি।

ভাড়া নিয়েছে হয়তো, কিশোর বলল। অত পুরানো গাড়ি নিয়ে দূরের যাত্রায় বেরোনো ঠিক হবে না, তাই।

 জবাব না পেয়ে চুপ হয়ে গেল মুসা। তবে সন্তুষ্ট হতে পারল না। মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল।

আবার টেলিভিশন দেখায় মন দিল তিন গোয়েন্দা।

কিছুক্ষণ পর ছেলেরা কি করছে দেখতে এলেন রাবাত।

রাত সাড়ে দশটায় বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।

শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন রাবাত। তাঁর নাক ডাকানোর বিকট গর্জন পাশের ঘরে অন্যদের কানে এসে পৌঁছল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। রবিন। হেসে উঠল কিশোর। উঠে গিয়ে মাঝখানের দরজাটা লাগিয়ে দিল মুসা। তারপরেও পুরোপুরি বন্ধ হলো না শব্দ, পাল্লার ফাঁক দিয়ে আসতে লাগল এ পাশে। তবে ঘুমাতে আর অসুবিধে হলো না।

একটা আজব স্বপ্ন দেখল মুসা। হোটেলের লবিতে নানাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে সে। অনেক বড় লবি। সুদৃশ্য কাপড় পরা মানুষেরা সব ভিড় করে আছে সেখানে, নানা-নাতিকে দেখছে আর হো-হো করে হাসছে। কেন। হাসছে প্রথমে বুঝতে পারল না মুসা। নানার দিকে চোখ পড়তে দেখল তার। পরনে শুধু লাল গেঞ্জি আর লাল জাঙ্গিয়া। তারপর চোখ পড়ল নিজের দিকে। নানার তো তা-ও কিছু পোশাক আছে, তার পরনে একেবারেই নেই। পুরোপুরি দিগম্বর।

চমকে জেগে গেল মুসা। ঘামে নেয়ে গেছে। পানি খাওয়ার জন্যে উঠে বাথরুমের দিকে চলল সে। জানালা দিয়ে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়াল।

পার্কিং লটের উজ্জ্বল আলোগুলো নেভানো। পাশের প্যাসেজ থেকে এসে পড়া আলোয় দেখা গেল বুইকের কাছে ঘাপটি মেরে আছে একটা ছায়ামূর্তি।

কিশোরের বিছানার পাশে প্রায় উড়ে চলে এল মুসা। তাকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, বলল, কিশোর! জলদি ওঠো! গাড়ির কাছে আবার। এসেছে ও!

.

০৭.

 খালি পায়েই ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল তিনজনে।

দুপদাপ করে নামতে গিয়ে হোঁচট খেলো কিশোর। উল্টে পড়তে পড়তে কোনমতে রেলিঙ ধরে সামলে নিল।

গাড়ির পাশে ঝুঁকে থাকা মূর্তিটা ঝট করে সোজা হলো। সিঁড়িতে চোখ পড়তেই আর দাঁড়াল না, দৌড় মারল রাস্তার দিকে মুখ করে রাখা গাড়িগুলোর দিকে।

তাড়া করল তিন গোয়েন্দা। খালি পা বলে সুবিধে করতে পারল না। কিশোর তো খোঁড়াতেই শুরু করল। সবার আগে রাস্তায় পৌঁছল মুসা। কিন্তু লোকটাকে ধরতে পারল না!

ধূর! বিরক্তিতে বাতাসে থাবা মারল সে।

গেল! দাঁড়িয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন।

মিলারকেই দেখেছ তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

 কোন সন্দেহ নেই, জবাব দিল মুসা। পালাচ্ছিল যখন তখনও দেখেছি। বারান্দার আলো পড়েছিল তার মুখে।

বুইকের কাছে ফিরে এল ওরা। ঘুরতে শুরু করল চারপাশে। দরজা টান দিয়ে দেখল। তালা লাগানো। বুটের ঢাকনায়ও তালা। চার হাত-পায়ে ভর রেখে উবু হয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিল কিশোর। নিচেটা অন্ধকার বলে কিছু দেখতে পেল না।

টর্চ লাগবে, উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বালি ফেলল কিশোর।

এই সময় মাথার ওপরে একটা দরজা খুলে গেল। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন রাবাত। কি ব্যাপার? চারটেই বাজেনি এখনও, এত সকালে গাড়ির। কাছে কি?

সমস্ত হোটেল ঘুমিয়ে আছে। কেউ যাতে বিরক্ত না হয় সেজন্যে আস্তে করে বললেন তিনি। কিন্তু সেই আস্তেটাই আধ মাইল দূর থেকে শোনা গেল। গলা বটে একখান। পটাপট আলো জ্বলে উঠল জানালায়, দরজা খুলে উঁকি দিল কয়েকজন গেস্ট।

কে জানি ঘোরাফেরা করছিল এখানে, নানাকে জানাল মুসা।

মিলার না তো!

 জবাব দিল না মুসা।

তার চুপ করে থাকাকেই হ্যাঁ ধরে নিয়ে ওদেরকে ঘরে ফিরে আসতে বললেন রাবাত। ওরা এলে ঘোঁৎ-ঘোৎ করে বললেন, ও সন্দেহ করেছে, আমার কাছেই আছে জিনিসটা। খুঁজুক। যত ইচ্ছে উৎপাত করুক, নিতে আর পারবে না।

কি আছে তোমার কাছে, নানা? জানতে চাইল মুসা।

ও সব জেনে কাজ নেই তোদর। যত কম জানবি তত ভাল থাকবি। যা, শুয়ে পড়গে। রাত এখনও অনেক বাকি। ওই শেয়ালটার জন্যে ঘুম নষ্ট করার কোন মানে নেই। চেষ্টার কমতি করছে না, তবে ক্ষতি কিছু করতে পারেনি। কি বলিস?

তা পারেনি, জবাব দিল কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন রাবাত। পারবেও না। ওর স্বভাবই ওরকম। চোরের মত আসে যায়। মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।

নিজের ঘরে চলে গেলেন রাবাত। গোয়েন্দাদের অবাক করে দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নাক ডাকানো শুরু করলেন।

মুসা বলল, নানার কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে এখন। তার আবিষ্কারের পেছনেই লেগেছে মিলার। নিতে যখন পারেনি, আবারও আসতে পারে। তালা কিংবা জানালা ভেঙে গাড়িটার ক্ষতি করতে পারে। বাকি রাতটা আমি গাড়িতে ঘুমাব।

রাবাতের ঘরে ঢুকল সে। নাসিকা গর্জনের সামান্যতম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আলগোছে টেবিল থেকে গাড়ির চাবি তুলে নিয়ে ফিরে এল। নিজের বিছানা থেকে কম্বলটা তুলে নিয়ে কিশোরকে সহ নেমে এল নিচে, গাড়ির কাছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল দুজনে। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করল মুসা। কিন্তু সুইচ অনেক টেপাটেপি করেও আলো জ্বালতে পারল না।

দূর! ব্যাটারি শেষ মনে হয়। দেখা গেল না!

হতাশ খানিকটা কিশোরও হলো। বলল, যার জন্যে এসেছিল, নিতে পারেনি মিলার। আবার আসতে পারে। এলে একা কিছু করতে বেরিও না। আমাদের ডেকো।

মুসাকে গাড়িতে রেখে ঘরে ফিরে এল কিশোর।

পেছনের সীটে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিল মুসা। মনে হলো মুহূর্তের জন্যেও আর দুচোখের পাতা এক করতে পারবে না।

কিন্তু পারল। তবে গাঢ় হলো না ঘুম। একের পর এক দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল। আবার দেখল সেই স্বপ্নটান্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে আর তার নানা। লোকে হাসাহাসি করছে। সরে যাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, কিন্তু নানা তাকে যেতে দিচ্ছে না।

 ঘুম ভেঙে গেল তার। সবে সূর্য উঠছে তখন। গাছের ডালে কলরব করছে পাখিরা। মুসা দেখল, লাল জগিং স্যুট পরা মোটা এক মহিলা গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে তাকে।

মুসা চোখ মেলতেই জিজ্ঞেস করল, এখানে কি?

উঠে বসল মুসা। পরনে কেবল জাঙ্গিয়া। নামার সময় তাড়াহুড়োয় অন্য কাপড় না পরে কোমরে শুধু কম্বল জড়িয়ে বেরিয়েছিল। স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাচ্ছে দেখে ধক করে উঠল বুক। পিছলে সীট থেকে মেঝেতে নেমে গেল সে।

সন্দেহ হলো মহিলার। চোর-টোর নাকি? দরজার হাতল ধরে টান দিল।

খাইছে! ভাগ্যিস ঘুমানোর আগে তালা লাগিয়ে রেখেছিলাম। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বলল, আপনি যান! সরুন!

ভাল করে কম্বল টেনে শরীরের নিচের অংশ ঢেকে দিল সে। গেল না মহিলা। জানালার কাছে নাক ঠেকিয়ে আরও বেশি করে উঁকি দিতে লাগল। আর কোন উপায় না দেখে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল মুসা। কোমরে কম্বল জড়ানো।

গাড়িতে কি করছিলে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল মহিলা।

ঘুঘুমাচ্ছিলাম। এটা আমাদেরই গাড়ি!

কেন, হোটেলে কি জায়গার অভাব?

না, তা নয়… কোমরে পেঁচানো কম্বল চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করল। মুসা।

ভুরু কুঁচকে ফেলল মহিলা, ব্যাপার কি, অমন করছ কেন? তোমার বাবা-মা সঙ্গে আসেনি? এ ভাবে ছেলেকে গাড়িতে ঘুমাতে ছেড়ে দিল? কাজটা কি ঠিক করেছে?

না, ম্যাম, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে মোটেলের দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা।

হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল মহিলা। বিড়বিড় করে বলল, কি সাংঘাতিক কিপটেরে বাবা! পয়সা বাঁচাল! ছেলেকে গাড়িতে পাঠিয়ে নিজেরা ঘরে শুয়ে আছে আরাম করে! আরেকটা ঘর ভাড়া নিতে এমন কি-ই বা খরচ হত!

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ব্যাঙের মত লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠে এল মুসা। দরজায় ধাক্কা দিল। খুলে দিল রবিন।

ভেতরে ঢুকে সব বলল মুসা। শেষে বলল, নানাকে বলার দরকার নেই। শুনলেই যাবে মহিলার সঙ্গে ঝগড়া করতে!

হাসতে লাগল রবিন।

রেডউড হাইওয়ে ধরে সেদিন আরও উত্তরে এগিয়ে চলল ওরা। ফুরফুরে মেজাজে আছেন রাবাত। পথের দুই ধারে রেডউডের জঙ্গল তার স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে চলেছে। মনে পড়ছে বহুদিন আগের কথা। সেদিন এ পথে যাওয়ার সময় বয়েস ছিল অনেক কম, পাশে ছিল তরুণী স্ত্রী। আর আজ!

জিজ্ঞেস করলেন, মুসা, তোর নানীর কথা মনে আছে?

নানার এই আচমকা প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল মুসা। আছে, অল্প অল্প। খুব ভাল অ্যাপল কেক বানাতে পারত নানী।

আরও অনেক কিছু পারত, বিষণ্ণ হয়ে গেলেন রাবাত। আমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত থাকতে পারত না। আর এখন! মানুষ মরে গেলে কত দূর হয়ে যায়!

 স্থির দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। এক খোলসে যেন দুজন মানুষ। একজন অতি কোমল হৃদয়ের স্নেহপ্রবণ স্বামী এবং নানা, যিনি তার মৃত স্ত্রীর কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে যান, নাতিকে ভালবাসেন, ভালবাসেন তার বন্ধুদেরও। আরেকজন সাংঘাতিক বদমেজাজী পাগলাটে এক বৃদ্ধ, পড়শীকে যিনি সারাক্ষণ সন্দেহ করেন, দুচোখে দেখতে পারেন না, একবিন্দু সহ্য করতে পারেন না। যদিও সহ্য করার মত লোক নয় হ্যারিস মিলার। তারও দোষ আছে। বাগান করার যন্ত্রপাতি চুরি করে খামখেয়ালী একজন মানুষকে খেপানোর কি দরকার?

আচ্ছা, পেছনে লেগেছে কেন মিলার? কাকতালীয় ঘটনা বলে আর মেনে নিতে পারছে না কিশোর। রাতে দ্বিতীয়বার এল কেন মিলার? তবে কি রাবুনানার কথাই ঠিক? তার আবিষ্কারের ফর্মুলা কেড়ে নিতে চায় মিলার? আবিষ্কারটা কি? কোন সূত্র নেই, সুতরাং কি জিনিস হতে পারে আন্দাজও করতে পারছে না সে। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ইচ্ছে করে না বললে তার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারবে না।

মিলারের আচরণ যেহেতু সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে, তার ব্যাপারে জানা দরকার। আলোচনা শুরু করার জন্যে বলল, অর্কিডের কথা ভাবছি।

কিশোরের এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় অবাক হলো রবিন। অর্কিড! কিসের অর্কিড?

কেন, ভুলে গেছ, মিস্টার মিলার অর্কিডের চাষ করে?

হ্যাঁ, করে, জবাব দিলেন রাবাত। তার কথায় যোগ দেবেন তিনি, এটাই চাইছিল কিশোর। বলল, কিন্তু বাগান করার মত ধৈর্য তার আছে বলে তো মনে হয় না। লনের ঘাস কাটার ইচ্ছে হয় না যার, সে অর্কিডের চাষ করে, ভাবতে কেমন অবাক লাগে না?

লনের ঘাস কাটলে তো আর পয়সা আসে না, কাটবে কেন? গাছ, ফুল, কিংবা বাগানের প্রতি কোন আগ্রহ নেই মিলারের, তার একমাত্র আগ্রহ–টাকা। অর্কিডের পেছনে সময় ব্যয় করে টাকা আসে বলে। ফুল বিক্রেতারা তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যায়। একটা অর্কিড ক্লাবের সদস্য সে। মাসে একবার করে মিলিত হয় সবাই। তখন ওর মতই কিছু পাগলকে অর্কিড দেখাতে বাড়ি নিয়ে আসে মিলার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিনা লাভে আনে না। ওদের কাছ থেকেও কিছু না কিছু হাতিয়ে নেয় সে। অন্য কিছু আদায় করতে না পারলে কায়দা করে ওদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। মাঝেমধ্যেই দেখি অপরিচিত একজন ওর গ্রীনহাউসে কাজ করছে।

কারা ওরা?

 হবে ওর ক্লাবের কোন বোকা লোক।

এখন কেউ আছে নাকি? জানতে চাইল কিশোর।

কি জানি। ও সব নিয়ে মাথা ঘামাই না। অত পাজি মানুষ আমি জীবনে দেখিনি! অভদ্র! এই ব্লকে যখন প্রথম এল, কি করেছিল জানো? একবার আমার পানির পাইপে গোলমাল দেখা দিল। পানি সরবরাহ বিভাগকে খবর দিলাম। এসে দেখল মেইন লাইনে ছিদ্র হয়ে গেছে, সেটা দিয়ে সব পানি বেরিয়ে যায়। সারানোর সময় আমার বাড়িতে পানি সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। খাওয়ার পানি নেই ঘরে। ভাবলাম, কি আর হবে, পড়শীই তো, একটা কেটলি নিয়ে মিলারের বাগানের কলে গেলাম পানি আনতে। কি করল সে জানো?

নিশ্চয় পুলিশ ডাকল? অনুমানে বলল রবিন।

ডাকার হুমকি দিল। অবাক হয়ে গেলাম। আরও অভিযোগ করল, আমি নাকি তার লাইনের সঙ্গে হোস পাইপ লাগিয়ে পানি চুরি করে নিয়ে যাই বাগানে দেয়ার জন্যে। যেন ওই কটা টাকার পানি চুরি করার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছি আমি!

মিলারের কথা বলতে গিয়ে রেগে যাচ্ছেন রাবাত। এই প্রথম রেডউডের জঙ্গলের ওপর থেকে নজর সরে গেল তার।

মিলারটা একটা প্যারানয়েড, কোন সন্দেহ নেই, বললেন তিনি। এই জন্যেই ওরকম ভাবনা মাথায় ঢোকে। প্যারানয়েড কাকে বলে জানো? মগজের এক ধরনের রোগ। এ সব রোগীরা সব মানুষকেই সন্দেহের চোখে দেখে। ভাবে, এই বুঝি কেউ তার সব জিনিস চুরি করে নিয়ে গেল, তার ক্ষতি করতে এল। মিলার একটা প্যারানয়েড! কথাটা আবার বললেন তিনি।

রাবাতের রাগ চরমে পৌঁছার আগেই তাকে থামানো দরকার। আপাতত মিলারের ভাবনা তার মাথা থেকে দূর করতে না পারলে অবস্থা কোন দিকে গড়াবে বলা যায় না। তাই চুপ হয়ে গেল কিশোর। ও ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন করল না।

নীরবে গাড়ি চালালেন রাবাত। দিনটা চমৎকার, রেডউডের জঙ্গলেরও এক ধরনের আকর্ষণ আছে, যা খুব তাড়াতাড়িই রাগ কমিয়ে দিল তার।

পথে কোন অঘটন ঘটল না। ক্যালিফোর্নিয়ার সাগর তীরের ছোট্ট শহর ক্রিসেন্ট সিটিতে নিরাপদে পৌঁছল ওরা। সূর্য তখন দিগন্ত সীমার প্রায় কাছাকাছি নেমে গেছে। একটা মোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে আগে গোসল সেরে নিল সবাই। তারপর বেরোল শহরটা ঘুরে দেখতে।

মনটিরের ফিশারম্যান ওআর্ফ জেটির তুলনায় এখানকার জেটিটা অনেক ছোট। তবে বেশ ছিমছাম। পানির ধারে পার্কিঙের জায়গা আছে, কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আর গোটা দুই বড় ধরনের দোকানও আছে। রেস্টুরেন্টগুলোর কাছ থেকে কিছুটা দূরে নৌকা বাঁধার জায়গা। ছোট জেটি হলেও যথেষ্ট সরগরম। নৌকা পরিষ্কার করছে কয়েকজন মাল্লা। কেউ পরিষ্কার করছে, কেউ বা ছেঁড়া পাল মেরামতে ব্যস্ত। সী-গাল উড়ছে। বেড়াতে আসা দম্পতিরা অলস ভঙ্গিতে হাঁটছে পাকা চত্বরে, সূর্যাস্ত দেখছে।

মিলারকে বোধহয় এড়ানো গেল, আচমকা বলে বসলেন রাবাত।

এই রে, সেরেছে! শঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। ভেবেছিল, অর্কিড ব্যবসায়ীর কথা ভুলে গেছেন নানা। কিন্তু না, ভোলেননি। মেজাজ এখন কেমন হয়ে যায়, কে জানে!

আসার সময় রিয়ারভিউ মিররে চোখ রেখেছিলাম, রাবাত বললেন, কোন গাড়িকে আমাদের লেজে লেগে থাকতে দেখিনি। কাল রাতে তোদের তাড়া খেয়ে ভয় পেয়েছে শেয়ালটা, তাতেই মুরগী চুরির লোভ উবে গেছে।

হবে হয়তো, হেসে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনাটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করল মুসা।

রাস্তায় অনেকগুলো ইঞ্জিনের শব্দ আর হই-চই শোনা গেল।

সাতটা মোটর সাইকেল ছুটে আসছে জেটির দিকে। আরোহীরা সবাই তরুণ, কালো চামড়ার জ্যাকেট পরা।

হুমম! মাথা দোলালেন রাবাত। চালচলন ভাল মনে হচ্ছে না!

আসলেই ভাল নয় ওরা। বেশির ভাগেরই দাড়ি আছে। কারো ঘন চাপদাড়ি বিচিত্র ছাঁটে কাটা হয়েছে, কারও বা পাতলা ফিনফিনে, লম্বা লম্বা দাড়ি। সেগুলো এমনিতেই বিচিত্র, কাটার আর প্রয়োজন পড়েনি। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট, কব্জিতে রিস্টব্যান্ড, হাতে গ্লাভস–সব কিছুতেই ছোট বড় নানা আকারের লোহার কাটা বসানো। হলিউডের ছবিতে দেখানো। ভয়ঙ্কর মোটর সাইকেল গ্যাঙের এ যেন বাস্তব রূপ।

হাই, কালু নানা! কাছে এসে চিৎকার করে উঠল এক আরোহী। মোটর সাইকেলের সামনের চাকা রাবাতের গায়ে তুলে দেয়ার ভঙ্গি করে সরে গেল। হি-হি করে গা জ্বালানো হাসি হাসল।

তিন গোয়েন্দা ভাবল এখনই ভীষণ রাগে ফেটে পড়বেন রাবাত। কিন্তু। পড়লেন না। ওদের অবাক করে দিয়ে বরং দলটার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, এদের মধ্যে একটা ছেলেও ভাল নেই। সব পচা ডিম।

নানা, চলো চলে যাই! ঘাবড়ে গিয়ে বলল মুসা।

চত্বরের শেষ মাথায় চলে গেছে দলটা। প্রায় একসঙ্গে ঘুরে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াল। ক্লাচ চেপে ধরে, এক্সিলারেটর বাড়িয়ে দিয়ে ইঞ্জিনের বিকট গোঁ-গোঁ শব্দ তুলে রাবাতকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করল। তিন কিশোর আর একজন বুড়োর ক্ষমতা কতখানি আন্দাজ করছে।

হাত ধরে টানল মুসা, নানা, চলো!

ইইইই-ইআআআ! বলে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল এক আরোহী। দলটার দলপতি।

গর্জে উঠল তার ইঞ্জিন। সোজা ছুটে আসতে লাগল রাবাত আর ছেলেদের লক্ষ্য করে।

কাছাকাছি থাকো, ছেলেদের আদেশ দিলেন রাবাত, নড়বে না! আগে চলে গেলেন তিনি, লোকটার আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্যে।

ভয়ে পেটের ভেতরে খামচি দিয়ে ধরল যেন কিশোরের।

নেতার পেছনে ভয়ানক গতিতে ছুটে আসছে বাকি ছয়জন। দাঁত বের করে হাসছে। একটা জিনিস শূন্যে ছুঁড়ে দিল একজন। কাটা বসানো একটা বেল্ট। ওটার বাড়ি শরীরে পড়লে কি অবস্থা হবে কল্পনা করে শিউরে উঠল কিশোর।

গোয়েন্দাদের চারপাশে জেটির লোক আর ট্যুরিস্টরা ছুটাছুটি করে সরে যাচ্ছে। কে যেন চিৎকার করে বলল, পুলিশকে ফোন করো।

ইঞ্জিনের গর্জন তুলে রাবাতের পাশ কেটে চলে গেল মোটর সাইকেলগুলো। কয়েক গজ গিয়ে ঘুরে আবার ছুটে আসতে লাগল। আরোহীদের অট্টহাসি তুঙ্গে উঠেছে।

রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে ফেলল ওরা। ঘুরতে ঘুরতে ছোট করে আনছে বৃত্ত। ভেতরে আটকা পড়েছে ওদের শিকার। এক মারাত্মক খেলায় মেতেছে।

আচমকা বৃত্ত ভেঙে দিয়ে রাবাতের দিকে সাইকেলের নাক ঘোরাল দলপতি। তীব্র গতিতে ছুটে এল রাবাতের দিকে। মাত্র হাতখানেক দূরে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল। ওর ফিনফিনে দাড়ির ওপরে চৌকো একটা চোয়াল, বড় বড় দাঁত, কালো কুতকুতে চোখ। সাতটা ইঞ্জিনের গর্জনকে ছাপিয়ে হা হা করে হেসে উঠল সে।

 নড়ে উঠলেন রাবাত। নড়াটা এত সামান্য, প্রায় চোখেই পড়ল না গোয়েন্দাদের। মনে হলো, কি যেন ছুঁড়ে দিলেন।

পিস্তলের গুলি ফোঁটার মত টাসস করে শব্দ হলো। দেখা দিল এক ঝলক, কালো ধোয়া। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিতে লাগল মোটর সাইকেল আরোহীকে।

কুতকুতে চোখে ভয় দেখা দিল। হাসির বদলে মুখ থেকে বেরিয়ে এল চিৎকার। মেঘের ভেতর থেকে সরে যাওয়ার জন্যে এত জোরে মোটর সাইকেল ঘোরাতে গেল, চাকা পিছলে পড়ে গেল কাত হয়ে।

আবার নড়ে উঠলেন রাবাত। আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ শব্দ, এবং তারপর ধোয়া।

পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল বিমূঢ় আরোহীরা। দিশেহারা হয়ে গেছে। যেন। পাগলের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে অদৃশ্য রহস্যময় পিস্তলধারীকে। কার গায়ে গুলি লেগেছে বোঝার চেষ্টা করছে।

হাইওয়েতে সাইরেন শোনা গেল। পুলিশ আসছে।

ছাতের ওপরে আলো ঘোরাতে ঘোরাতে জেটির দিকে ছুটে এল। পুলিশের দুটো গাড়ি।

মোলায়েম হাসি হেসে রাবাত বললেন, চলো, ছেলেরা, খিদে পেয়েছে।

পানির কিনারের একটা রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা।

রেস্টুরেন্টের দরজায় লোকের ভিড়। রাবাত কাছাকাছি হতেই সরে গিয়ে ঢোকার জায়গা করে দিল।

তার কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করল একজন, কোথাও লাগেনি তো?

ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়া উচিত হয়নি আপনার, আরেকজন বলল। নরকের ইবলিস একেকটা। পুলিশ আসাতে বাচলেন!

পুলিশ আসাতে আমি নই, শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন রাবাত, ওরা বেঁচেছে। কতটা ক্ষতি যে করতে পারতাম জানেই না!

.

০৮.

রেস্টুরেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন রাবাত। মোটর সাইকেল গ্যাঙের লোকগুলোকে ধরেছে পুলিশ। লাইসেন্স দেখছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখাতে বাধ্য হচ্ছে আরোহীরা।

তাড়া না থাকলে ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করতাম, বললেন তিনি। জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তাম ব্যাটাদের। কিন্তু এখন ওসব করার সময় নেই। খাবারের একটা মেনু খুললেন।

একে একে স্টার্ট দিতে আরম্ভ করল লোকগুলো। একসঙ্গে দল বেঁধে। পাশাপাশি এগিয়ে চলল পানির কিনার ধরে। গাড়িতে উঠল পুলিশ অফিসারেরা। দলটার পেছনে চলল।

হাজতে নিয়ে যাচ্ছে নাকি? রবিনের প্রশ্ন।

মনে হয় না, রাবাত বললেন। শহর থেকে বের করে দিয়ে আসতে যাচ্ছে হয়তো।

নানা, শব্দটা কি করে হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল মুসা।

শব্দ? কিসের শব্দ? মেন্যুতে মনোযোগ রাবাতের, মোটর সাইকেল। আরোহীদের কথা যেন ভুলেই গেছেন।

ওদের দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে দিয়েছিলে তুমি। পিস্তল ফোঁটার মত শব্দ হয়েছিল। কিসের শব্দ? বাজি?

না না, বাজি হবে কেন! বাজি পোড়ানো অনেক শহরে নিষেধ। আমার খুদে আবিষ্কারগুলোর একটা ব্যবহার করেছি। বাজারে ছাড়লে খুব জনপ্রিয়তা। পাবে। চলবে ভাল। অতি সাধারণ একটা জিনিস, অথচ ভয়াবহ শব্দ করে, ধোয়া ছড়ায়, কিন্তু শরীরের ক্ষতি করে না; সুতরাং বেআইনী বলতে পারবে না পুলিশ। বরং অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে নিরীহ মানুষকে। দেখলেই তো, কি করে ভয় ঢুকিয়ে দিলাম শয়তানগুলোর মনে।

হাসল মুসা। দেখলাম। কিন্তু বাজারে ছাড়লেই তো অপরাধীদের জানা হয়ে যাবে ওটা কি জিনিস, আর ভয় পাবে না। তখন কি হবে?

তখন আমি ওগুলো ডাকপিয়নদের কাছে বিক্রি করব, হাসিমুখে জবাব দিলেন রাবাত। কল্পনা করতে পারবি না চিঠি বিলি করতে গিয়ে কি বিপদে পড়ে ওরা। জঘন্য সব কুত্তা পালে আজকাল লোকে।

আবার মেন্যুতে মন দিলেন তিনি।

পরদিন দুপুর একটা নাগাদ অরিগনের পোর্টল্যান্ড পেরোল ওরা। রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দেখে মুসা বলল, নানা, এখানে থামবে? সেইন্ট হেলেনস পর্বতমালা দেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের।

থামব তো বটেই, রাবাত বললেন। একসঙ্গে অতগুলো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি দেখার ভাগ্য কজনের হয়? সুযোগ যখন পাওয়া গেছে সেটা অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত।

হাইওয়ে থেকে সরে এলেন তিনি। মোচড় খেয়ে খেয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ী পথ ধরে উঠতে আরম্ভ করলেন। আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে আসতে লাগল দিনের আলো। ঝপাঝপ করে যেন গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। মেঘের ভেলা। আকাশময় এখানে উড়ে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ।

শেষ মাথায় উঠে এল ওরা। ভেবেছিল এখানে উঠলেই চোখে পড়বে। মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস। মেঘের ওপরে উঠে এসেছে, অনেক নিচে ভাসছে মেঘের ভেলাগুলো। পুবে তাকাল। পর্বতমালাটা ওদিকেই থাকার কথা। কিন্তু প্রচণ্ড বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। পর্বত চোখে পড়ল না। কেবল ঘন ধূসর ধোয়া ভলকে ভলকে ওপরে উঠছে, ছেয়ে দিয়েছে আকাশ।

খাইছে! কোনমতে বলল মুসা।

হেসে তার নিরাশা দূর করার চেষ্টা করলেন রাবাত, অত মন খারাপ করছিস কেন? পুরো দেশটাই আমাদের সামনে পড়ে আছে। ভাল ভাল দৃশ্য প্রচুর দেখতে পাবি।

গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নামতে লাগলেন তিনি। কিছুদূর নামার পর হঠাৎ নামল ঝমঝম করে বৃষ্টি। ভিজিয়ে দিল গাড়ির কাচ। অস্পষ্ট হয়ে গেল সামনের আর আশপাশের সব কিছু।

হাইওয়ে ফাইভ-এ পৌঁছে দেখা গেল অনেক গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে দিয়ে চলছে। বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলেন রাবাত, সেদিন এর বেশি আর এগোবেন না, ওয়াশিংটনের লঙভিউতে রাত কাটাবেন। নিজের পরিকল্পনা নিয়ে এতই মগ্ন রইলেন, রাস্তার ধারে থেমে থাকা লিংকন গাড়িটাকে শুরুতে খেয়াল করলেন না। আলো জ্বালেনি ওটা। ওয়াইপার চলছে। এগজস্ট থেকে একঝলক সাদা ধোয়া বেরিয়ে মিশে গেল ভেজা বাতাসে।

গাড়িটা চোখে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল কিশোর।

লিংকনের ড্রাইভিং হুইলে ঝুঁকে রয়েছে একজন লোক। কে? হ্যারিস মিলার? সান্তা মনিকায় এ রকম একটা গাড়ি দেখেছিল, ওটাই কিনা নিশ্চিত হতে পারল না। এ পথে ধূসর লিংকনের অভাব নেই। তার মধ্যে কোনটা মিলারের কে বলবে? নম্বর প্লেট একবার দেখেই মুখস্থ করে ফেলল নম্বরটা : 111-XTJ.

মিলার! আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে হিসহিস করে উঠলেন রাবাত। চোখে পড়ে গেছে লিংকনটা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন। বেজে উঠল একঝাক। হর্ন। তীব্র প্রতিবাদ জানাতে লাগল পেছনের গাড়িগুলো।

জলদি চালাও, নানা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

রাস্তার মাঝখানে এ ভাবে ব্রেক কষা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। ঠিক পেছনের গাড়িটা এসে বাম্পারে গুতো মারার আগেই আবার এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়ালেন রাবাত। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বুইক। অল্পের জন্যে গুতো খাওয়া থেকে বেচে গেল। দুর্ঘটনাটা ঘটল না। গায়ে কাপুনি উঠে গেছে ছেলেদের। কিন্তু রাবাতের কোন ভাবান্তর নেই, তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন।

ভয় পেয়েছ! সরি! বললেন তিনি। গাড়িটা দেখে আর সামলাতে পারলাম নাঃ শিওর ওটাতে মিলার বসে আছে।

ফিরে তাকাল ছেলেরা। রাস্তার পাশে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে লিংকন, বৃষ্টিভেজা ধূসরতার মাঝখানে ধূসর একটা অবয়বের মত।

থাকুক না, আমাদের কি? কিশোর বলল, অনুসরণ তো আর করছে না। রাস্তার ধারে পার্ক করে হয়তো রোড ম্যাপ দেখছে…গাড়ি খারাপ হয়েও থাকতে পারে।

আমাদের অনুসরণ করার জন্যে পিছে পিছে আসার দরকার পড়বে না তার। এই রাস্তা ধরে কতদূর যেতে পারব আমরা, জানে। সীটলের বেশি যে যেতে পারব না, তা-ও জানে। এ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হয়তো আমাদের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করছে, বোঝাতে চাইছে পেছনে আসছে না।

আর কোন কথা হলো না। উত্তরমুখো গাড়ির ভিড়ে মিশে রাবাতও এগিয়ে চললেন। লংভিউতে পৌঁছে শহরের গভীরে ঢুকে গেলেন। হাইওয়ে থেকে দরে একটা মোটেলের ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন। এখানে উঠলে তাদের খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে মিলারের। অবশ্য যদি সে আদৌ বের করতে চায়।

ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, রাবাত বললেন। জীবনে কখনও কোন লড়াই থেকে পালিয়ে আসিনি। এখন যে এড়িয়ে থাকতে চাইছি, সেটাও সামান্য সময়ের জন্যে। শিক্ষা ওকে আমি একটা দিয়েই ছাড়ব, তবে সেটা পরে। আপাতত নিরাপদে নিউ ইয়র্কে পৌঁছতে চাই; আর চলার পথে যতটা সম্ভব আনন্দ। এখনই ঝগড়া বাধিয়ে সব পণ্ড করতে চাই না।

সমস্যা আর বিপদ থেকে পালানোর স্বভাব তিন গোয়েন্দারও নয়, বরং মুখোমুখি হতেই ওরা ভালবাসে। কিন্তু এই কেসটাতে এখন পর্যন্ত কেবল পালিয়েই চলেছে ওরা। মিলার যদি পেছনে লেগে থাকে, সামনাসামনি এসে কিছু না করা পর্যন্ত ওদের কিছু করার নেই। আক্রমণটা আগে তার তরফ থেকেই আসতে হবে। মিলার পেছনে লেগেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও। কেবল সন্দেহের ওপর নির্ভর করে একজন। ভদ্রলোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করাটা ঠিক নয়।

মাঝরাতের পর হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কানে এল পাশের ঘরে রাবুনোর বিকট নাক ডাকানোর শব্দ। তবে এই শব্দ আর এখন বিরক্ত করে না ওকে, গা সওয়া হয়ে গেছে, এর জন্যে ঘুম ভাঙেনি ওর। ভেঙেছে জানালায় হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো পড়ায়। মোটেলের ড্রাইভওয়েতে ঢুকে চলতে চলতে যেন থেমে গেল একটা গাড়ি।

দরজা খোলার শব্দ হলো। ইঞ্জিন বন্ধ করল না ড্রাইভার। দ্রুত পদশব্দ থমকে গেল আচমকা, তারপর আবার শোনা গেল।

বিছানা থেকে নামল, কিশোর।

সে জানালার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, বড় একটা গাড়ি ঘুরে নেমে যাচ্ছে রাস্তায়।

লিংকনটাই? নিশ্চিত হতে পারল না।

বিছানায় ফিরে এল আবার সে বুঝতে পারছে, রাবুমানার মত সে-ও মিলারকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে। অথচ এখন পর্যন্ত মিলার কোন ক্ষতি করেনি ওদের। বুইকটার ক্ষতি করেনি। রাতের বেলা চুপি চুপি ঘরে ঢুকে খোঁজাখুজি করেনি। পিছু পিছু আসার ব্যাখ্যা সহজেই দেয়া যায় হয়তো সে ও বেড়াতে বেরিয়ে একই দিকে চলেছে।

আচ্ছা, কি জিনিস আবিষ্কার করেছেন রাবুমানা? কি নিয়ে চলেছেন নিউ ইয়র্কে? কোথায় রেখেছেন ওটা? ছোট জিনিসই হবে, যা সুটকেসে ভরে রাখা যায়। বড় কিছু লুকানোর জায়গা নেই, গাড়িটাতেও না, তাহলে ওদের চোখে পড়তই। আর গাড়িতে রাখার জায়গাই বা কোথায়?

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখল তার অনেক আগে উঠে পড়েছে মুসা আর রবিন। কাপড় পরে তৈরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করতে হবে ওকে।

ওয়াশিংটনের ভেতর দিয়ে সেদিন পুবে এগোল ওরা। ওপরে উঠছে পথ। কাসকেড মাউনটেইন রেঞ্জ পার হয়ে এসে পড়ল খোলা অঞ্চলে। দুই পাশে রুক্ষ ছড়ানো প্রান্তর।

হায় হায়, এ যে মরুভূমি! নিরাশা ঢাকতে পারল না মুসা। আমি তো। ভেবেছিলাম পুরো ওয়াশিংটনটাই শুধু পাইনের জঙ্গল।

বোকার মত ভাবলে তো কত কিছুই ভাবা যায়, নানা বললেন।

স্পোক্যানি পার হয়ে আবার পার্বত্য অঞ্চলে ঢুকল ওরা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না রাস্তার পাশ দিয়ে বইছে, থেকে থেকেই দুপাশ থেকে চেপে আসছে জঙ্গল।

ইডাহোর কয়েউর ডিঅ্যালিনিতে রাত কাটানোর জন্যে থামল ওরা। লংভিউতে শহরের অনেক ভেতরে অখ্যাত ছোট মোটেলটার মতই কোন মোটেলে ওঠার ইচ্ছে। অবশ্যই মিলারের ভয়ে। যাতে সে খুঁজে বের করতে না পারে।

সারাদিনে অবশ্য ছায়াও দেখিনি, বললেন তিনি। রিয়ারভিউ মিররে। পলকের জন্যেও দেখিনি গাড়িটাকে। তবু ঝুঁকি নেব না। লুকিয়েই থাকব। আমাদের খুঁজে না পেলে সে ভাববে হয় আমরা স্পোক্যানিতে রয়েছি, নয়তো আরও এগিয়ে মিসৌলাতে চলে গেছি।

যদি আমাদের পিছু নিয়ে থাকে, তবেই, মিলারের কথা শুনতে আর ভাল লাগছে না মুসার। মনেপ্রাণে চাইছে লোকটাকে নিয়ে আলোচনা বন্ধ হোক।

খাওয়ার টেবিলে পড়শীর কথা আর তুললেন না রাবাত। খাওয়ার পর গলফ খেলতে বেরোলেন। সামান্য সময় খেললেন। তখনও কিছু বললেন না। সবচেয়ে বেশি স্কোর করলেন তিনি। ছেলেদের নিয়ে মোটেলে ফিরে এলেন। বেশ হাসিখুশি লাগছে তাকে।

রাতের বেলা ওদের গভীর ঘুম ভাঙিয়ে দিল সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার। সারা বাড়িতে আলোড়ন তুলে বেজেই চলল, বেজেই চলল।

খাইছে! বিছানায় উঠে বসে মুসা বলল, ঘটনাটা কি?

থামছে না সাইরেন। কানের পর্দা ছিদ্র করে দিয়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে মগজে।

হঠাৎ জবাবটা পেয়ে গেল সে। চিৎকার করে উঠল, কিশোর, রবিন, জলদি ওঠো! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিচে নামল। স্মোক অ্যালার্ম! আগুন লেগেছে মোটেলে!

.

০৯.

রাতের নীরবতা চিরে দিয়ে যেন বেজে চলেছে ধোয়ার সঙ্কেত।

লোকের ছুটাছুটি আর হট্টগোল কানে এল গোয়েন্দাদের। দড়াম দড়াম করে বন্ধ হলো গাড়ির দরজা। ধোয়ায় ভারী হয়ে গেছে বাতাস।

দমকলকে ফোন করল কিশোর।

পাজামা পরেই ছুটে বেরোল মুসা। নানার দরজায় থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, নানা! নানা! ওঠো জলদি! মোটেলে আগুন লেগেছে!

কাশতে কাশতে টলোমলো পায়ে এসে দরজা খুলে দিলেন রাবাত।

সাইরেন বাজছে।

ইতিমধ্যে প্যান্ট পরে ফেলেছে রবিন। বেরিয়ে গিয়ে মোটেলের গেস্টদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলতে শুরু করল তাদের।

লাল গাউন পরা এক মহিলা দরজা খুলল। চোখ জ্বালা করছে। ডলতে ডলতে জানতে চাইল, কি হয়েছে?

মোটেলে আগুন লেগেছে, জানাল রবিন।

যেন আঁকুনি খেয়ে জেগে গেল মহিলা। ভেতরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, পিটার, জলদি ওঠো! তখনই বলেছিলাম এই খোয়াড়ের মধ্যে থাকার দরকার

রাবাত আর অন্য দুই গোয়েন্দাও কাপড় পরে ফেলেছে। একপাশ থেকে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল সবাই, বোর্ডারদের জাগিয়ে দিতে লাগল। ওদের চারপাশে ধোয়া উড়ছে। বাড়িটা U প্যাটার্নে তৈরি। মনে হচ্ছে U-র একটা মাথা থেকে আসছে।

কি যেন পড়ার শব্দ হলো। তারপর ঝনঝন করে কাচ ভাঙল। গাড়ির কাচ। চত্বরের পার্কিং লটে ইনডিয়ানার নম্বরপ্লেট ওয়ালা একটা গাড়ি তাড়াহুড়ো করে পিছাতে গিয়ে ওরিগনের প্লেট লাগানো একটা গাড়িকে গুতো মেরে দিয়েছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে উঠল ওরিগনের ড্রাইভার, এই গাধা, দেখও না নাকি!

জবাব দিল না ইনডিয়ানা। গাড়ি সরাতে ব্যস্ত।

 ঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে বোর্ডাররা। কাশছে, চোখ ডলছে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্যে বিছানার কম্বল তুলেই গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অনেকে। কেউ কেউ গাড়ির দিকে ছুটছে, গাড়িতে করে নিরাপদ জায়গায়। পালাতে চায়। অন্যেরা চত্বরে জড়ো হলো কি ঘটে দেখার জন্যে।

দমকলকে খবর দেয়া হয়েছে? জানতে চাইল এক মহিলা।

 দিয়েছি, জবাব দিল কিশোর, আসছে।

কিশোর, দেখো, হাত তুলল মুসা।

বাড়িটার শেষ মাথার একটা দরজায় লেখা রয়েছে: EMPLOYEES (ONLY. ধোয়া আসছে ওই দরজার ফাঁক দিয়ে।

ওই ঘরেই লেগেছে, বলে উঠল কিশোর। সরুন, সরুন সবাই; আগুনের কাছ থেকে সরে যান।

দরজাটার কাছ থেকে সবাইকে সরিয়ে দিতে লাগল মুসা আর রবিন।

দমকলের সাইরেন শোনা গেল। দেখতে দেখতে সেটা বেড়ে গেল, তার সঙ্গে যুক্ত হলো ভারী ইঞ্জিনের শব্দ। এসে গেছে দমকল।

কোথায় লাগল? পুরানো বাথরোব পরা টাকমাথা ছোটখাট একজন লোক জিজ্ঞেস করল। পরিচয় দিল, আমি মোটেলের ম্যানেজার। একহাতে চাবির গোছা, আরেক হাতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র।

ওই যে দেখুন দরজাটা, হাত তুলে দেখিয়ে দিল কিশোর।

দ্রুত এগিয়ে গেল ম্যানেজার। খুলে ফেলল তালা। পাল্লা খোলার জন্যে নব চেপে ধরতেই বাধা দিল কিশোর, দাঁড়ান! খুলবেন না!

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। টান দিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে ম্যানেজার। হাঁ হয়ে খুলে গেল পাল্লা। ভেতর থেকে ঝাঁপিয়ে এল যেন আগুনের চাদর, ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল ম্যানেজার, হাত থেকে খসে পড়ল ফায়ার এক্সটিংগুইশার। দুহাত উঠে গেল মুখ ঢাকার জন্যে। প্রচণ্ড গরম বাতাসের ঢেউ এসে লাগল। গোয়েন্দাদের ওপরও।

লোকটাকে সাহায্য করতে ছুটল মুসা। এক্সটিংগুইশার তুলে নিল রবিন। আগুনের দিকে তাক করে টিপে দিল ট্রিগার। তরল রাসায়নিক ফেনা ফিনকি দিয়ে বেরোল, পড়তে লাগল আগুনের মধ্যে।

দমকলের দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল মোটেলের সামনে। হুড়াহুড়ি করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ফায়ারম্যানেরা, মুহর্তে রবিনকে সরিয়ে দিল একপাশে। একজন একটা হোস তাক করে ধরল, তীব্র বেগে পানি গিয়ে পড়তে শুরু করল ঘরের মধ্যে। নিভে গেল আগুন। যেমন স্বয়ংক্রিয় ভাবে চালু হয়েছিল স্মোক অ্যালার্ম, আগুন নিভে যেতে ওটাও বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি। ছোট ঘরটা একটা স্টোররুম। তেমন কিছু ছিল না। কয়েকটা পোড়া ন্যাকড়া, ঝাড়, একটা প্লাস্টিকের বালতি–পুড়ে গলে বিকৃত হয়ে। গেছে, আর একগাদা কঙ্কল পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ হয়ে আছে।

ঘরে ঢুকল একজন ফায়ারম্যান। ভেজা ছাইয়ের স্তূপের দিকে তাকিয়ে রইল একটা সেকেন্ড, তারপর লাথি মেরে ছড়িয়ে দিল। পোড়া কম্বলের একটা টুকরো তুলে নিয়ে শুকল। আনমনেই বলল, তেল তেল গন্ধ। তারপিন হবে। রঙ করা হচ্ছিল নাকি এখানে? ম্যানেজারের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সে।

আগুনের আঁচ লেগে ম্যানেজারের একটা ভুরু পুড়ে গেছে। সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দিল, না, রঙ করবে কে! কয়েক মাস ধরে রঙের। কাজ হয়নি মোটেলে।

নাক কুঁচকে আবার শুকল ফায়ারম্যান। কাঠের জিনিস বার্নিশ করা হয়েছে?

না! প্রার্থনা করার ভঙ্গিতে এক হাতের সমস্ত আঙুল আরেক হাতে গুঁজে দিল ম্যানেজার। আর করলেও এ ভাবে তারপিন ভেজানো ন্যাকড়া এখানে ফেলতে দিতাম না।

কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল ফায়ারম্যানের কণ্ঠ। ফেলে দিল পোড়া টুকরোটা।

কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে শুনছেন রাবাত। নাক দিয়ে খেত-খোত করে বললেন, ফারগ্লো ব্যবহার করলেই আর এ সমস্যা হত না।

ফারগ্লোটা আবার কি জিনিস? জানতে চাইল রবিন।

নানার একটা আবিষ্কার, মুসা বলল। ফেলে দেয়া কাগজের প্যাড দিয়ে তৈরি। কাঠের জিনিস বার্নিশ করতে এর তুলনা হয় না। তারপর যেখানে ইচ্ছে ছুঁড়ে ফেলো, আগুন লাগার ভয় নেই। আগুন ধরে না ওতে।

আইডিয়াটা একটা সোপ কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছিলাম আমি, তিক্তকণ্ঠে বললেন রাবাত। ওরা কাজে লাগায়নি, আলমারিতে ভরে রেখে দিয়েছে। সেই রাগেই যেন দুপদাপ পা ফেলে ঘরে ফিরে এলেন। ঢুকেই এমন চিৎকার দিয়ে উঠলেন যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে।

চোর! বদমাশ! চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন তিনি, কিশোর! রবিন! মুসা! দেখে যা! চোরটার কাণ্ড দেখে যা!

ছুটে এল তিন গোয়েন্দা।

জলদি গিয়ে নিজেদের ঘর দেখো! কিছু নিয়েছে কিনা! দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে আছেন রাবাত। ম্যাট্রেস উল্টে ফেলা হয়েছে। চাদর আর কম্বলগুলো মেঝেতে। ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার কাপড়-চোপড়। মোজা আর আন্ডারওয়্যারগুলোও বাদ পড়েনি। শেভ করার আর দাঁত মাজার। সরঞ্জাম ছিল যে বাক্সটায়, সেটাও উল্টে ভেতরের জিনিস ঝেড়ে ফেলা হয়েছে।

হা হয়ে গেছে কিশোর। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নড়তে পারল না। তারপর রাবাতের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে বাথরুমে চলে গেল। পেছনের দেয়ালে বাথটাবের বেশ ওপরে একটা জানালা। সেটা খোলা। বাথটাবে জুতোর ছাপ দেখে বোঝা গেল জানালা দিয়ে এটাতে কেউ নেমেছিল।

টাবের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার হুড়কো পরীক্ষা করল সে। এক জায়গার রঙ চটে গেছে সামান্য।

হুড়কো সরিয়ে কেউ জানালা খুলে ঢুকেছিল, পেছনে দরজায় এসে দাঁড়ানো রাবাতকে বলল কিশোর। বেরিয়েছেও হয়তো একই পথে। দরজা। দিয়েও বেরোতে পারে। আগুনের দিকে খেয়াল ছিল সবার, তাকে কেউ দেখেনি নিশ্চয়।

পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এল রবিন। জানো কি কাণ্ড হয়েছে?

মুসা বলল, জানি, আমাদের ঘরেও ঢুকেছিল, সব তোলপাড় করে ফেলেছে।

মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ। কিন্তু যতটা দেখলাম, কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হলো না।

মিলার! মিলার! ওই ব্যাটা ছাড়া কেউ না! চেঁচিয়ে উঠলেন রাবাত। এখানেও এসেছে!

কি করে, নানা? প্রশ্ন তুলল মুসা। পিছুটা নিল কি করে? কাল রাস্তার ধারে যেটা দেখেছি সেটা কার গাড়ি জানি না। যদি মিলারেরও হয়, কালকের পর আর দেখা যায়নি ওটাকে। পিছে পিছে এলে আমরা যে এখানে আছি জানবেই বা কি করে?

পিছে আসাটা তেমন কঠিন না, রাবাত বললেন। লিংকনটা ভাড়া করা গাড়ি, ওর নিজের না। যেহেতু আমাদের চেনা হয়ে গেছে, ফেরত দিয়ে অন্য আরেকটা নিয়ে নিতে পারে। আমাদের একেবারে লেজে লেগে থাকলেও তখন আর চিনতে পারব না।

কিশোরের মনে পড়ল, লংভিউতে মোটেলে রাতে একটা বড় গাড়ি চলে যেতে দেখেছিল। কিন্তু বলল না রাবাতকে, চেপে গেল। শুনলেই খেপে যাবেন।

ঘরের ছড়ানো জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, নানা, তোমার আবিষ্কারটা খোয়া গেছে কিনা দেখছ না?

জবাব দিলেন না রাবাত। দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যেন তিনি। জানেন, খোয়া যায়নি। লম্বা লম্বা পা ফেলে আবার চত্বরে বেরিয়ে এলেন। অনুসরণ করল ছেলেরা।

 কিছু বোর্ডার তখনও আছে ওখানে। খেপে যাওয়া ম্যানেজারের লম্ফ ঝম্প দেখছে। আগুন লাগিয়েছে যে, তাকে হাতে পেলে এখন কি কি করত, গলাবাজি করে বলছে। নিষ্ফল আক্রোশ। রাস্তায় অপেক্ষা করছে দমকলের গাড়ি। ইঞ্জিন চলছে। ড্রাইভওয়েতে ঢুকেছে একটা পুলিশের গাড়ি। ছাতের বাতিটা ঘুরছে। ঝিলিক ঝিলিক করে কমলা আলো ছিটিয়ে দিচ্ছে যেন বাড়িটার সামনের দেয়ালে।

স্টোররুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ অফিসার। কথা বলছে। ফায়ারম্যানের সঙ্গে।

গটমট করে সেদিকে এগিয়ে গেলেন রাবাত। বললেন, কি করে লাগল সেটা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আগুনটা লাগানো হয়েছে, ইচ্ছে করে।

 ফিরে তাকাল অফিসার আর ফায়ারম্যান। চোখে কৌতূহল। ফায়ারম্যান জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করে জানলেন?

জানি!

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কিশোর, শুরু হলো আবার!

হ্যারিস মিলার লাগিয়েছে ওই আগুন, বলতে কোন রকম দ্বিধা করলেন না রাবাত। লাগিয়েছে যাতে আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাটতে পারে। আমার আর ওদের, তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন তিনি, ঘর দুটোকে তছনছ করে ফেলেছে। আগুন লাগালে যে সারা বাড়িতে লেগে যেতে পারে, এতগুলো লোক বিপদে পড়বে, ভাবলও না একবার; নিজের উদ্দেশ্য সাধনটাই তার কাছে বড়। ভীষণ স্বার্থপর। পুরো বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারত!

রাবাতের দিকে তাকিয়ে হাসল ম্যানেজার। সব দাঁত বেরিয়ে পড়ল। এই প্রথম একজনকে পেল, তার পক্ষে বলছেন। চেঁচিয়ে বলল, সেই তখন থেকেই বলছি, তেল লাগানো ন্যাকড়া আমি ফেলতে দিই না! কাজের লোকদের কড়া হুকুম দেয়া আছে। অসাবধানতার জন্যে লেগেছে এ কথা কিছুতেই বলতে পারবেন না। বাইরে থেকে কেউ এসে যদি লাগিয়ে দেয়, আমি কি করতে পারি বলুন?

স্টোর রুমে ঢুকল অফিসার। পেছনের দেয়ালে একটা জানালা। রাবাতের বাথরুমের জানালার মতই এটাও বাইরে থেকে খোলা হয়েছে, তবে খুলতে গিয়ে এটার হুড়কোটা ভেঙে ফেলেছে।

এটা এ ভাবে ভাঙা আছে কদ্দিন? জানতে চাইল অফিসার।

ভাঙা থাকবে কেন? জোর প্রতিবাদ জানাল ম্যানেজার, ভাঙা জিনিস আমি থাকতে দিই না! এটা ভাল ছিল। আজ রাতে খোলা হয়েছে। হুড়কো ভেঙেছে জানলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করিয়ে ফেলি। একটুও দেরি করি না।

রাবাতের দিকে তাকাল অফিসার, আপনার ঘরটা দেখব।

সানন্দে দেখাতে রাজি হলেন তিনি। নিয়ে এলেন অফিসারকে। তার ঘরটা দেখার পর গোয়েন্দাদেরটাও দেখল সে।

নোটবুকে লিখে নিল অফিসার। গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজায় নক করল তার সহকারী। দুজনে মিলে তখন বোর্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। তদন্ত শেষ করার পর জানা গেল, কেবল রাবাত আর গোয়েন্দাদের ঘরেই ঢুকেছিল চোর।

হোটেলের লোকও হতে পারে, অবশেষে অফিসার বলল। কিন্তু এ ভাবে ঢুকে কোন কিছু না নিয়ে চলে গেল কেন…

অফিসারের কথা শুনে রেগে গেলেন রাবাত। খসখসে গলায় বললেন, কারণ হোটেলের লোক নয় ও! আমি বলছি, হ্যারিস মিলার! রকি বীচ থেকে আমাদের অনুসরণ করে এসেছে ও!

রকি বীচ?

কেন, চেনেন না? নাম শোনেননি? ক্যালিফোর্নিয়াতেই তো। শুনুন, পিজমো বীচে ওর সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে আমাদের, তারপর মনটিরেতে। আমি এখন শিওর, মোটর সাইকেলওয়ালা গুণ্ডাবাহিনীকেও সে-ই আমাদের পেছনে লাগিয়েছিল। ওকে গিয়ে গ্রেপ্তার করুন। ভয়ানক লোক ও!

তাই নাকি! কিন্তু সে আপনাদের ফলো করবে কেন? আপনাদের ঘর তল্লাশি করবে কেন? কি খুঁজেছে?

আমার আবিষ্কার।

তাই! সেটা কি?

সতর্ক হয়ে গেলেন রাবাত। চোখের তারায় ধূর্ত একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে-কথা তো আপনাকে বলা যাবে না। কাউকেই বলা যাবে না এখন।

ও! এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অফিসার বলল, ঠিক আছে, হ্যারিস মিলারের চেহারার বর্ণনা দিন। কি গাড়িতে করে এসেছে…

প্রথম একটা লিংকনে করে পিছু নিয়েছিল। এখন সম্ভবত গাড়িটা বদলে ফেলেছে। তবে এখন আর ওসব আলোচনা করে লাভ নেই। ওকে ধরতে পারবেন না। পালানোর ইচ্ছে থাকলে বহুদূরে চলে গেছে!

মাথা ঝাঁকাল অফিসার। মসৃণ হাসি ফুটল ঠোঁটে। রাবাত আর তিন। গোয়েন্দার নাম আর বাড়ির ঠিকানা লিখে নিল। কিশোরের কাছ থেকে লিংকন গাড়িটার লাইসেন্স নম্বরও লিখে নিল। তারপর সহকারীকে নিয়ে গিয়ে পুলিশ কারে উঠল।

গাধা কোথাকার! বলে উঠলেন রাবাত। অহেতুক সময় নষ্ট করে গেল! কিছু করবে না ও! করার চেষ্টাও করবে না!

করবে কি, ও তো তোমাকে পাগল ভেবে গেছে! মুখ ফসকে বলে ফেলল মুসা। নানা রেগে যাচ্ছেন বুঝে তাড়াতাড়ি সামাল দিল, কারোর কিচ্ছু করা লাগবে না। মিলার যদি পিছু নেয়, আমরাই ওর ব্যবস্থা করব!