২৫. একটা মুহূর্ত দ্বিধা

২৫.

 একটা মুহূর্ত দ্বিধা করলেন ব্যারন। তারপর রাইফেলের নল যোরালেন কিশোরের দিকে। হেসে বললেন, বাহ, সাহসী ছেলে। স্পোর্টসম্যান সুলভ আচরণ। আরও সহজ করে দিলে আমার কাজ। আমার তরফ থেকে স্পোর্টস বলা যাবে না এটাকে। তবে সুযোগ একটা তোমাদের দিয়েছিলাম আমি। পালাতে পারোনি, আমার কি দোষ?

গুলি করুন, আরেক পা আগে বাড়ল কিশোর।

নিশানা করলেন ব্যারন। কাঁধ থেকে নামালেন রাইফেলটা। অনিশ্চিত ভঙ্গি।

করুন। গুলি করুন, আরও সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর।

 রাইফেল আরেকটু নিচে নামালেন ব্যারন।

কিশোর, চিৎকার করে উঠল মুসা, পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি? দৌড়ে এসে টেনে সরানোর চেষ্টা করল কিশোরকে।

ঝাড়া দিয়ে মুসার হাত ছাড়িয়ে নিল কিশোর। ব্যারনের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে আগে বাড়ল। দিন, মিস্টার রোজার, রাইফেলটা আমার হাতে দিন, কোমল স্বরে বলে ওটা ধরার জন্যে হাত বাড়াল সে।

আমি রোজার নই, মিলার, ভোতা গলায় বললেন ব্যারন।

 হাত সরাল না কিশোর। দিন, রাইফেলটা।

শূন্য দৃষ্টি ফুটেছে ব্যারনের চোখে।

রাইফেলটা, কোমল কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলল কিশোর।

কুঁচকে যাচ্ছে ব্যারনের চেহারা। কপাল আর গালের ভাঁজগুলো গম্ভীর হচ্ছে। দ্বিধায় পড়ে গেছেন। শেষে সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে আবার কাঁধে তুলে নিলেন রাইফেল।

দিন রাইফেলটা, সেই একই কণ্ঠে বলল কিশোর।

কিশোর, সরো! চিৎকার করে বলল মুসা, তুমি বুঝতে পারছ না, ওই পাগলটা তোমাকে গুলি করবেই!

করুক না, আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেছে কিশোরের কণ্ঠ। করুন, মিস্টার মিলার, গুলি করুন আমাকে।

 কিশোরের বুকের দিকে নিশানা করলেন ব্যারন। দ্বিধা করলেন না আর। পর পর দুবার ট্রিগার টিপলেন। বদ্ধ ঘরে ভয়াবহ শব্দ। থরথর করে কেঁপে উঠল জানালার কাচ।

একসঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল সকলে। তাদের সম্মিলিত চিৎকারও রাইফেলের বিকট শব্দের তুলনায় কিছু না।

.

২৬.

মিস্টার রোজার, কিশোর বলল, কঁপছে এখন কণ্ঠ, গুলি তো করলেন। এবার দিয়ে দিন রাইফেলটা।

ব্যারনের চোখে অবিশ্বাস। কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রাইফেলের নল দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে।

কিশোর… আবার চিৎকার করে উঠল মুসা।

 ফিরল না কিশোর। ব্যারনের দিকে তাকিয়ে আছে। দিন, রাইফেলটা।

ঝট করে আবার রাইফেল কাঁধে তুলে কিশোরকে সই করে গুলি করলেন ব্যারন।

আবার চিৎকার করে উঠল সকলে।

 কিশোর তার জায়গা থেকে নড়ল না।

তুমি..তুমি মানুষ নও! বিড়বিড় করে বললেন ব্যারন। ভূত! প্রেতাত্মা! এক পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সেটার দিকে তাকালেন। ধোয়া উঠে যাচ্ছে ছাতের দিকে। সেদিকে তাকালেন। তার পেছনে প্রায় দলা পাকিয়ে বেঞ্চে বসে আছেন আন্ট জোয়ালিন। শরীরটাকে ধরে রাখতে পারছেন না আর।

রাইফেলটা দিন, কিশোর বলল।

না! চিৎকার করে উঠলেন ব্যারন। তুমি যদি ভূত হয়ে থাকো, অন্য কাউকে গুলি করব আমি। গুলি করে দেখব মরে কিনা।

 আরও এক পা পিছিয়ে গেলেন ব্যারন। রাইফেলের নল ঘোরালেন রবিনের দিকে। দ্বিধা করলেন। কেঁপে গেল হাত। বদলে যাচ্ছে চেহারার ভঙ্গি।

না, মিলার। অনেক হয়েছে, আর গোলাগুলির দরকার নেই! বলে উঠল একটা মহিলাক।

কিশোর ভাবল, আন্ট জোয়ালিন বলেছেন। কিন্তু ব্যারনের পেছনে নেতিয়ে রয়েছেন তিনি। কপাল টিপে ধরেছেন। কথা বলারও শক্তি নেই। তারমানে তিনি বলেননি।

আমার ইচ্ছে! মহিলার কথার জবাবে মিলারের কণ্ঠে কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যারন। তুমি বাধা দেবার কে? রলিন, সরো এখান থেকে। এটা হান্টিং পার্টি।

না, আমি সরব না। হান্টিং পার্টির সময় শেষ, মহিলা বলল।

হঠাৎ বুঝে ফেলল কিশোর। পরিষ্কার হয়ে গেল রহস্যটা। কথা বেরোচ্ছে ব্যারনের মুখ থেকে। মস্ত অভিনেতা তিনি। মহিলা-কণ্ঠে বললেন, রাইফেল রেখে দাও, মিলার। পার্টি শেষ।

না! প্রতিবাদ করল মিলারের সঁড়ের মত কণ্ঠ, রাইফেল আমি রাখব না। বাধা দিতে এসো না আমার কাজে। রোজারকে গুলি করে মেরেছি আমি। প্রয়োজন হলে তোমাকেও মারব।

মিলার, আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছ কিন্তু! জবাব দিল অসহিষ্ণু মহিলাকণ্ঠ।

ব্যারনের ঘরে কোন মহিলা সেরাতে তর্ক করছিল, বুঝতে পারল কিশোর। রহস্যময় কোন মহিলা নেই এই হোটেলে। রোজারই একবার মিলার সাজেন, একবার রলিন। নিজেই নিজের সঙ্গে একেক রূপে কথা বলেন।

বেরিয়ে যাও! মিলারের কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন ব্যারন। গেট আউট! সরো আমার সামনে থেকে।

না, যাব না, যতক্ষণ না তুমি এই হান্টিং পার্টির সমাপ্তি ঘোষণা করছ, সমান তেজে জবাব দিল মহিলা।

কল্পিত রলিনের সঙ্গে ঝগড়া করে চলেছেন কল্পিত মিলার। কিশোর তাকাল আবার রাইফেলটার দিকে। লম্বা দম নিয়ে আচমকা লাফ দিল সামনে। এক থাবায় ওটা ছিনিয়ে নিল ব্যারনের হাত থেকে। নিয়েই দৌড়।

হতবাক হয়ে গেলেন ব্যারন। দৌড় দিলেন কিশোরের পেছনে। উলফের গায়ে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।

নড়ে উঠল উলফ। চোখ মিটমিট করতে লাগল।

পা চেপে ধরে গোঙাতে শুরু করলেন ব্যারন। ককাতে ককাতে বললেন, উফ, গেছে আমার হাঁটুটা!

কি হয়েছে? মাথার একপাশে আলুর মত ফুলে যাওয়া জায়গাটায় নিজের অজান্তেই হাত বোলাতে শুরু করল উলফ।

হ্যাঁ, তাই তো! কি হয়েছে? তার সঙ্গে সুর মেলালেন ব্যারন। রোজার হয়ে গেছেন আবার তিনি। ভদ্র কণ্ঠস্বর। আমার পায়ে, এত ব্যথা কেন? মেঝেতে পড়লাম কি করে? উলফ, তোমার কি হয়েছে? মিলার কোথায়? এসব নিশ্চয় ওর কাণ্ড?

উঠে বসলেন তিনি। খুব খিদে পেয়েছে। ফ্রিজে কিছু আছে নাকি? শুধু স্যান্ডউইচ হলেও চলবে।

*

পরদিন সকালবেলা। ঢেউয়ে দুলছে মোটরবোট। একবার কেশে উঠে চালু হয়ে গেল এঞ্জিন। মেইনল্যান্ডের দিকে ওটাকে চালিয়ে নিয়ে চলল উলফ।

মুসা বসেছে পেছনে। তার পাশে কিশোর। ওদের সামনে রবিন আর কোরি। সবার সামনে উলফের এক পাশে আন্ট জোয়ালিন। অন্য পাশে ব্যারন। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাধা। বোটের পাটাতনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ফুসফুস ভরে তাজা নোনা হাওয়া টেনে নিল কিশোর। ফিরে তাকাল। গোস্ট আইল্যান্ডের দিকে। শেষবারের মত দেখল ছোট্ট দ্বীপটাকে।

এঞ্জিনের গর্জনে কথা বলা কঠিন। কিশোরের প্রায় কানের কাছে মুখ এনে বলল মুসা, এতটা বেপরোয়া হওয়া কিন্তু উচিত হয়নি তোমার।

বুঝতে পারল না কিশোর। কিসের কথা বলছ?

ওই তো, রাইফেল।

কোথায় রাইফেল? এদিক ওদিক তাকাতে লাগল কিশোর।

আরে এখানে না। কাল রাতে আমাদের যখন গুলি করার হুমকি দিচ্ছেন ব্যারন, রাইফেলের সামনে গিয়ে বুক পেতে দাঁড়ালে। তোমার বেপরোয়া ভঙ্গি দেখে রীতিমত চমকে গিয়েছিলাম।

ও, এই কথা, মুচকি হাসল কিশোর। অত বেপরোয়া ভাবার কিছু নেই। চিন্তাভাবনা করেই এগিয়েছিলাম। মনে পড়ল, বনের মধ্যে বেশ কাছে থেকে আমাদের গুলি করেছেন ব্যারন।একটা গুলিও লাগাতে পারেননি। আশেপাশে অনেক গাছ ছিল। ওগুলোতে গুলি বেঁধার শব্দ শুনিনি। ডালপাতা ছিঁড়েও বেরিয়ে যায়নি বুলেট মাটিতে বেঁধেনি। বিধলে শব্দ শুনে বোঝা যেত।

তাতে কি?

অনেক কিছু। ব্যারন একজন পাকা শিকারী। তাঁর নিশানা এতটা খারাপ হওয়ার কথা নয় যে কাছে থেকে গুলি করে তিনজন মানুষের একজনের গায়েও লাগাতে পারবেন না।

কিন্তু তাতেই বা কি…

আমাকে কথা শেষ করতে দাও। হোটেলের লবির কথা ভাবলাম। সেখানেও দুবার গুলি করেছিলেন তিনি। কোন ক্ষতি হয়নি। দেয়াল, মেঝে কিংবা কোন জিনিসের ক্ষতি করেনি বুলেট, কোন জিনিস ভাঙেনি, কারও গায়ে লাগেনি। ভাবতে ভাবতে বুঝে ফেললাম ক্ষতি না হওয়ার রহস্যটা। রাইফেলে ব্ল্যাঙ্ক কার্তুজ ভরা।

খাইছে! মাথা নাড়তে শুরু করল মুসা। কে করল কাজটা?

উলফ ছাড়া আর কে? ও যখন বুঝল কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না রোজারকে, হান্টিং পার্টি বন্ধ করতে পারবে না, কোন এক সুযোগে রাইফেলের ম্যাগাজিন থেকে আসল বুলেটগুলো খুলে নিয়ে ব্ল্যাঙ্ক ভরে রেখেছিল। আমার অন্তত সেরকমই ধারণা।

তারমানে শিওর ছিলে না!

না…

শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে এক উন্মাদের রাইফেলের সামনে গিয়ে। দাঁড়িয়েছিলে? যদি তোমার অনুমান ভুল হত? যদি আসল গুলি থাকত?

মারা পড়তাম, হাসিমুখে বলল কিশোর।

তুমি হাসছ! কুঁচকে গেছে মুসার ভুরু।

 তো কি করব?

তোমার মত দুঃসাহসী আমি জীবনে দেখিনি! বিশ্বাস করো! না, করলাম না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর। তুমি আসলে বোকাই। আমাকে সাহসী দেখলে কোথায়? আরে আমি তো একটা মস্ত ভীতু। স্বার্থপর। যেই বুঝলাম, গুলি করবেনই ব্যারন, সবার আগে চলে গেলাম রাইফেলের সামনে। জানতাম এমনিতেও মরব, ওমনিতেও-মরতেই যখন হবে, সবার আগে মরে যাওয়াই ভাল….অন্যের মৃত্যু, বন্ধুর মৃত্যু দেখার মত কলজে আমার নেই। হাত নেড়ে বলল, বাদ দাও তো ফালতু কথা। দেখো, একটা বাজপাখি। কি সুন্দর করে উড়ছে। সেদিন যেটাকে দেখেছিলাম, সেটাই হবে, তাই না?