২০. সকালে নাস্তা প্রায় শেষ

২০.

পরদিন সকালে নাস্তা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় হোটেলের কফি শপে ঢুকলেন রাবাত। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন, রাত জেগে টেলিভিশনে নিজের ইন্টারভিউ দেখেছেন। লেট নাইট নিউজ দেখেছেন, লেট-লেট নাইট নিউজ দেখেছেন। মূসার পাশে হাসিমুখে বসতে বসতে জানালেন, সকালের খবরেও তার ইন্টারভিউ দেখানো হয়েছে।

কফি শপে হোটেলের আরও অনেক মেহমান নাস্তা খাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলেন, যেন সাংঘাতিক কেউকেটা কিছু হয়ে গেছেন। এখনই সবাই অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে সই নিতে ছুটে আসবে। খাতা না আনলেও মেনু হাতে এগিয়ে এল ওয়েইটার। তার মুখের দিকে তাকালও। তবে চিনতে পারার কোন লক্ষণ নেই তার চোখে।

রেগে গেলেন মনে হলো রাবাত। জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। আদেশ দিলেন, কফি। প্যানকেক। দুটো ডিম। আর গরুর মাংস ভাজা। এ চমকে গেল মুসা। নানা, তোমার না ডিম আর গরু খাওয়া বারণ। কোলেস্টেরল:..

চুলোয় যাক কোলেস্টেরল! ধমকে উঠলেন রাবাত। ময়লা জমলে, আমার শিরায় জমবে, তোর মাথাব্যথা কেন? আজ সারাদিনে অনেক ঘটনা ঘটবে, এনার্জি দরকার হবে আমার। সুতরাং সেটা এখনই জোগাড় করে নিতে, হবে।

কিন্তু খাওয়ার পর ঘটনা আর ঘটে না। এনার্জি খরচেরও প্রয়োজন পড়ছে রাবাতের। হোটেলের লবিতে বসে থাকার ব্যবস্থা করেছে তিন গোয়েন্দা। বার বার অহেতুক ক্যামেরা আর ক্যামেরার ব্যাগে হাত বোলাচ্ছে রবিন। এফ বি আইয়ের দুজনেই উপস্থিত। নীল ব্লেজার পরা লোকটা ঢুকেছে গিফট শপে, জিনিস দেখার ভান করছে। নিউজ কাউন্টারে ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছে বাদামী সোয়েটার।

আসছ না কেন, মিলার? বিড়বিড় করলেন রাবাত। আমরা তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।

তা কিন্তু তা-ও কিছু ঘটল না। আধঘণ্টা গেল। এক ঘণ্টা। ঘড়ির কাটা চলছে।

বেলা এগারোটায় মেজাজ গরম হতে আরম্ভ করল তার। সাড়ে এগারোটায় ফুটতে শুরু করল।

আশ্চর্য! বললেন তিনি। সেই কখন থেকে বসে আছি, মনে হচ্ছে বছর পেরিয়ে গেছে। গাধাটা সাক্ষাৎকার দেখেনি নাকি? ছাগল কোথাকার! খবরও দেখে না! ধূর্ত হাসি ফুটল ঠোঁটে। আজ বিকেলে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে একটা ডাবল গেম আছে। দেখতে যাবি নাকি, মুসা?

যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না, মুসা বলল। মিলার আর তার দোস্ত সাক্ষাৎকারটা দেখেছে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। দেখলে এখানে খুঁজতে আসবেই। তখন আমরা না থাকলে এতদিনের কষ্ট অহেতুক যাবে।

বাইরে থেকে একটু ঘুরে এলেও পারি, রাবাত বললেন। এখানে বসে থেকে ভুল করছি আমরা। হয়তো ঢোকার সাহসই পাচ্ছে না। বাইরে গিয়ে ওদের সুযোগ করে দেয়া উচিত।

আমার মনে হয় না, কিশোর বলল, আমরা বাইরে বেরোলেও ওদের হারাতে হবে। এসে আমাদের না পেলে অপেক্ষা করবে ওরা। কিংবা আবার। আসবে। এতদূর আমাদের পিছু ধাওয়া করে আসতে পেরেছে ওই ফিল্মের জন্যে। এত সহজে হাল ছাড়বে না।

সুতরাং বসে না থেকে বাইরে ঘুরে আসারই সিদ্ধান্ত হলো। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে মেসেজ ডেস্কে এসে দাঁড়ালেন রাবাত। ইয়াংকি স্টেডিয়ামে যেতে হলে কোন্ ট্রেন ধরতে হবে, এবং সেটা মাটির নিচ দিয়ে যায় কিনা, জিজ্ঞেস করলেন।

দুপুর বেলা সদলবলে হোটেল থেকে বেরোলেন রাবাত। হোটেলের দুই ব্লক দূরেই একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন। আধ ব্লক পেছনে লেগে রইল দুই এফ বি আই। প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রথম ট্রেনটা ইচ্ছে করে মিস করল গোয়েন্দারা, ওই দুজনকে আসার সময় দিল, ওরা এখনও এসে পৌঁছায়নি। পরের ট্রেনটায় চড়ল সবাই। এফ বি আইরা রইল কামরার এক প্রান্তে, গোয়েন্দারা আরেক প্রান্তে। ব্রংক্স বল পার্কের দিকে চলল ট্রেন। চতুর্দিকে কড়া নজর রাখলেন রাবাত। মিলাররা পিছু নিয়েছে কিনা দেখছেন।

 স্টেডিয়ামে এসে ভান করলেন যেন তারা নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা। তাতে খেলা দেখার সুবিধে আছে। খেলা দেখতে বসলে কোনও এক পক্ষকে সমর্থন করতে হয়। সেই পক্ষের দর্শকদের মধ্যে বসা ভাল। এবং সেটাই করলেন। তিনি। ইয়াংকিদের মধ্যে, বসলেন। প্রথম গেমে এক রান এগিয়ে রইল ইয়াংকিরা। সুতরাং প্রচুর চেঁচাতে পারলেন তিনি। আশেপাশে ইয়াংকি সমর্থক থাকায় চেঁচাতে কোন অসুবিধে হলো না।

বিরতির সময় হট ডগ খাওয়া হলো। নাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলেন তিনি। দুজনের কেউই জিততে পারলেন না। রবিন আর কিশোরও প্রচুর খেল, তবে নানা-নাতির ধারেকাছেও যেতে পারল না।

শুরু হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের খেলা। শুরুতেই ইয়াংকিদের হারিয়ে দিল বহিরাগত টীম। নিজের আর বাইরের দল, দুটোকেই গালাগাল শুরু করল ইয়াংকি সমর্থকরা। সিটি বাজিয়ে, নানা রকম কটু কথা বলে উত্তেজিত করে জেতানোর চেষ্টা করতে লাগল। খেলার উত্তেজনায় কখন যে তাদের দলে মিশে গেলেন রাবাত আর তিন গোয়েন্দা, খেয়ালই রইল না। শেষ পর্যন্ত যখন ব্রংক্স বহুবাররা হেরে গেল, শির উঁচু করে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে বেরোনোর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। ঘাড় কাত করে মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি, বলেছিলাম না ইয়াংকিরা জিতবে?

প্রচুর দর্শক হয়েছে। বেরোনোর গেটে ভিড়। ঠেলাঠেলি করে বেরোতে হচ্ছে। কনুইয়ের গুতো মেরে ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোলেন। রাবাত। স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে রেল স্টেশনে চলে এলেন। জনতার কোলাহল বিরক্তিকর, তবু বিকেলটা ভাল লাগল তার। সুন্দর বাতাস বইছে।

ম্যানহাটানের ট্রেন এসে দাঁড়াল। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। রাবাত যে কামরাটায় উঠলেন, তাতে বেজবল খেলার বেশ কিছু ভক্তও উঠেছে। দরজা বন্ধ হলো। চলতে শুরু করল ট্রেন। মুসার চোখে পড়ল বাদামী সোয়েটার পরা এফ বি আইকে, প্ল্যাটফর্মে জনতার ভিড়ে আটকা, পড়েছে সে, পাগলের মত তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, ওদেরকে খুঁজছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিল মুসা। দেখতে পেল লোকটা। গতি বেড়ে গেছে। ট্রেনের। বাদামী সোয়েটারকে ফেলে রেখেই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে চলে। এল।

মুসার দুপাশে চেপে আছে দুজন ভক্ত। একজন হোঁৎকা বিশালদেহী লোক, গায়ে স্পোর্টস কোট; আরেকজন মুসার চেয়ে দু-এক বছরের বড় হবে, কোন কিছু না ধরেই দাঁড়িয়ে আছে, একনাগাড়ে পিনাট খেয়ে চলেছে। শরীর মোড়ামুড়ি করে কোনমতে দুজনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে কিশোরের কাছে চলে এল মুসা। একটা ধাতব হ্যান্ড-স্ট্র্যাপ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।

বডিগার্ডকে খুইয়েছি, তাকে বলল মুসা। বাদামী সোয়েটার পরা লোকটাকে প্ল্যাটফর্মে দেখলাম, উঠতে পারেনি।

বডিগার্ড? হেসে উঠল হাড্ডি সর্বস্ব একটা মেয়ে। বয়েস ষোলো সতেরো হবে। মাথায় বেগুনী রঙের কাপড় অনেকটা পাগড়ির মত করে পেচিয়েছে। সেটে আছে প্রায় কিশোরের গায়ের সঙ্গে। অকারণ কথা বলে বলে তার কান পচিয়ে ফেলার জোগাড় করেছে। গায়ে মাংস না থাকলে কি হবে, গলাটা যেন মাইক। এমন করে ফাটা বাশে বাড়ি মারছে, কিশোরের ভয় হতে লাগল, কামরার সব লোকই শুনে ফেলবে। কিসের বডিগার্ড? ভি আই পি নাকি তোমরা! বাব্বাহ, বডিগার্ডও থাকে সঙ্গে! পরের বার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে দাঁড়াবে নাকি!

খুব সাংঘাতিক কোন রসিকতা করে ফেলেছে যেন মেয়েটা, এমন ভঙ্গিতে নিজের কথায় নিজেই পুলকিত হলো। তার কথায় মজা পেল আরও কয়েকজন যাত্রী। মুসার দিকে তাকাল।

 দুষ্টবুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল কিশোরের চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেবো না। ওকে আর দরকার হবে না। ইনকিউবেশন পিরিয়ড কালই শেষ হয়ে গেছে তোমার।

শক্ত হয়ে গেল মেয়েটা। সতর্ক হয়ে উঠল। ইনকিউবেশন! কেঁপে উল ফাটা বাঁশ। কিসের ইনকিউবেশন? ছোঁয়াচে রোগে ধরেছিল নাকি?

না না, মাথা নাড়ল মুসা, কিসের রোগ! ও এমনি এমনি বলছে! মিথ্যে বলা ওর স্বভাব!

মুসার বলার ভঙ্গিতে সন্দেহ আরও বাড়ল মেয়েটার। কিশোরের কাছ থেকে সরার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মুসার কাছে থাকাটাও বিপজ্জনক। কোন রোগ, কে জানে! চিকেন পক্সও হতে পারে! তাড়াতাড়ি সরে যেতে লাগল। সে। কামরার একেবারে আরেক ধারে চলে গেল। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেল। পক্সের ভয়ে তার সঙ্গে নামল আরও কয়েকজন।

ম্যানহাটানে পৌঁছার আগেই আরও অনেকে নেমে গেল। ভিড় আর আগের মত নেই। কামরার মাঝখানে প্রচুর জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে। তাদের কাছাকাছি আসতে ভয় পাচ্ছে লোকে।

রাবাতকে বলল কিশোর, এফ বি আইয়ের লোকটা ট্রেনে উঠতে পারেনি। প্ল্যাটফর্মে তাকে থেকে যেতে দেখেছে মুসা।

তাতে আর অসুবিধে কি? রাবাত বললেন। এখানে মিলারও নেই, তার দোস্তও নেই।

তা ঠিক। যাত্রীদের ওপর আরেকবার চোখ বোলাল তিন গোয়েন্দা। মিলার কিংবা ব্যালার্ডের সঙ্গে কারও সামান্যতম মিলও নেই।

ফোরটি-সেকেন্ড স্ট্রীটে এসে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ওরা। একটা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করলেন রাবাত, যেটা ধরে গেলে পথ বাঁচবে। অল্প সময়ে পৌঁছতে পারবেন হোটেলে। অন্ধকার সুড়ঙ্গমুখটা দেখতে ভাল লাগল না মুসার। মনে হলো, ওর মধ্যে ঢোকাটা উচিত হবে না। সমর্থনের আশায় রবিন আর। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিছু বলল না ওরা। নীরবে এগোল রাবাতের। পিছু পিছু। অগত্যা মুসাকেও যেতে হলো।

সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি পৌঁছে একটা ডাক কানে এল, দাঁড়াও, রাবাত!

পুরো সুড়ঙ্গটা নির্জন, নিজেদের বাদে আর কাউকে দেখেনি এত ক্ষণ। এবার দেখল। এগিয়ে আসছে আরেকজন। হাসি হাসি মুখ। বিচিত্র একটা রেনকোট পরা থাকায় আগের চেয়ে খাটোও লাগছে, মোটাও।

মিলার! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত।

যাক, দেখা তাহলে হলো, মিলার বলল। অনেক দিন পর, কি বলো।

নীরব সুড়ঙ্গ। এতটাই নীরব, কোথায় যেন টপ টপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে, তা-ও কানে আসছে।

পেছনে কথা বলে উঠল আরেকজন, ক্যামেরার ব্যাগটা আমি নিয়ে নিচ্ছি।

 মনটিরেতে এই লোককেই দেখেছে গোয়েন্দারা, মিলারের দোস্ত, ব্যালার্ড। হাতে উদ্যত পিস্তল, রবিনের দিকে ধরে রেখেছে।

প্রতিবাদ না করে ব্যাগটা দিয়ে দিল রবিন।

ফিল্মগুলো আছে কিনা, দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিল লোকটা। মিলারের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, ঠিকই আছে। রাবাত আর গোয়েন্দাদের আদেশ দিল, ভেতরে যাও। সবাই।

পিস্তল দিয়ে সুড়ঙ্গের একটা দরজার দিকে ইশারা করল সে। খিল খুলে দিল মিলার। তার ওপাশে একটা দেয়াল আলমারি। সেঁতসেতে। ঝাড়ু, মেঝে পরিষ্কার করার স্পঞ্জ আর জীবাণু ও কীট-পতঙ্গনাশক ওষুধের টিনে বোঝাই।

ঢোকো! পিস্তল নেড়ে আবার আদেশ দিল ব্যালার্ড।

ঢুকতে বাধ্য হলো চারজনে। দরজা লাগিয়ে দেয়া হলো বাইরে থেকে। খিলটাকে ভালমত আটকে রাখার জন্যে তার মধ্যে কাঠি জাতীয় কিছু ঢোকানোর শব্দ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে সরে গেল পদশব্দ।

বাঁচাও! চিৎকার করে উঠল মুসা। কে আছ, আমাদের এখান থেকে বের করো।

.

২১.

দীর্ঘ একযুগ পরে যেন রেলের একজন টিকেট বিক্রেতা এসে মুক্ত করল ওদের। রাবাতদের মতই সুড়ঙ্গ দিয়ে চলেছিল একজন পথচারী। আলমারির মধ্যে আজব আওয়াজ শুনতে পেয়ে সন্দেহ জাগে। রেলের অফিসে গিয়ে জানায়। একজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে এসেছে টিকেট বিক্রেতা। রাবাতকে প্রশ্ন শুরু করল পুলিশের লোকটা। কোন কথারই জবাব দিলেন না রাবাত। বিরক্ত হয়ে বরং এক ধমক লাগালেন তাকে। ছেলেদের নিয়ে সুড়ঙ্গ পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হোটেলে ঢুকেই হোগারসনকে ফোন করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল হোগারসন। আগের মতই শান্ত।

এতে রাগ আরও বেড়ে গেল রাবাতের। ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। চিৎকার করে বললেন, এত কষ্ট করে টাকা কামাই করে ট্যাক্স দিই, সেই ট্যাক্সের টাকায় বেতন পান আপনারা, আর সেবা করার এই নমুনা। রাস্তাঘাটে জান নিয়ে টানাটানি পড়ে আমাদের। দুটো:ডেঞ্জারাস স্পাইকে ধরার জন্যে আপনাদের সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাদের কাজ তো ঠিকমতই করেছি, আপনার লোক কোথায়? ঘুমোচ্ছিল নাকি?

অনেকটা সে-রকমই, মিস্টার রাবাত, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল। হোগারসন।

ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠলেন রাবাত। তাকে শান্ত করতে সময় লাগল হোগারসনের।

সারাদিন কোথায়, কি ভাবে কাটিয়েছেন, জানালেন তখন রাবাত। বার বার অভিযোগ করলেন দুর্গন্ধে ভরা, বাতাসহীন, ময়লা ঝাড়ুতে বোঝাই আলমারির মধ্যে আটকে থাকতে হয়েছে বলে।

জঘন্য! বলে বক্তব্য শেষ করলেন তিনি।

ঠিক, একমত হলেন হোগারসন। এ রকমটা ঘটা মোটেও উচিত হয়নি।

মেজাজ একেবারে নরম হয়ে গেল রাবাতের। এতক্ষণে বসলেন।

হোগারসন বলল, আমাদের এজেন্টরা সব ছড়িয়ে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক থেকে বেরোনোর সমস্ত পথে পাহারা দিচ্ছে ওরা–এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, সুড়ঙ্গমুখ, ব্রিজ, কোথাও বাদ নেই। শহর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলে ওই দুজন ধরা পড়বেই।

যদি না পড়ে? প্রশ্ন করলেন রাবাত। এখানে এ ভাবে অকর্মণ্য হয়ে বসে থাকব নাকি আমরা?

যা মোটেও না। আপনাদের কাজ শেষ। আপনাদের আর বিরক্ত করবে না ওরা। মিলার তার ফিল্ম পেয়ে গেছে। ব্যালার্ডকে দিয়ে দেবে। ব্যালার্ড যখন ফিল্মগুলো ডেভেলপ করে দেখবে কিছুই নেই, বুঝবে আসল ছবিগুলো আমাদের হাতে পড়েছে। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসার সাহস তার হবে না। গা ঢাকা দেবে। ধরে নিতে হবে, আমরাই জিতলাম। আপনাদের আর ভয় নেই।

দুই দুইজন স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার রেগে গেলেন রাবাত, আর আপনি বলছেন ভয় নেই! বাহ্, চমৎকার কথা!

 হাসল হোগারসন। আর কোনদিন স্পাই হতে পারবে না মিলার, সেই সুযোগই পাবে না। তার শয়তানি ফাঁস করে দিয়েছেন আপনারা। গর্বিত হওয়া উচিত আপনাদের। যে কোন ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে হলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট জমা দিতে হয়। যেখানে চাকরি করত, তার ধারেকাছেও আর যেতে পারবে না। নাম ভাড়িয়ে যদি আবার কোথাও চাকরির দরখাস্ত দেয়, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হবে, বাঁচতে পারবে না তখন আমাদের হাত থেকে। তবে আমার মনে হয় না এই বোকামি করার সাহস পাবে সে। আমেরিকায় থাকতে হলে চিরকাল পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে এখন থেকে। জানের শান্তি নষ্ট হবে। সেটা আরও বড় জেল।

সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রাবাত। কিন্তু তার সঙ্গের শুয়াপোকাটার কি হবে? ব্যালার্ড না ফ্যালার্ড? যদি সে আবার কিছু করার চেষ্টা করে? আমার তো মনে হয় না সে স্পাইগিরি ছেড়ে দেবে।

আমারও না, একমত হলো হোগারসন। তবে তার খোঁজে লোক লাগিয়ে রাখব আমরা। ভালমত খোঁজা হবে। মিস্টার রাবাত, আপনি আর। তিন গোয়েন্দাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক সাহায্য করেছেন আপনারা।

চলে গেল হোগারসন। দরজা লাগিয়ে দিয়ে এল রবিন। পরিস্থিতি সহজ হলো না, কেমন ভারী হয়ে রইল।

মুসা বলল, কোন কাজই হলো না!

ওই হোগারসনটা একটা অপদার্থ! নাক দিয়ে ঘোঁৎ-ঘোৎ করতে লাগলেন রাবাত। দুধের শিশু পেয়েছে আমাদের! একটা কিছু বোঝাল, আর অমনি বুঝে গেলাম!

গম্ভীর হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের অবস্থাটা হয়েছে, পিঠের নিচে ভাজ হয়ে থাকা এলোমেলো চাদর নিয়ে ঘুমানোর মত। রাতে বার বার ঘুম থেকে জেগে উঠে চাদর টানতে হবে।

তোমার এ সব মঙ্গলগ্রহের ভাষা ছাড়ো দেখি!

ব্যাখ্যা করতে গেল না কিশোর। গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। হোগারসন যা-ই বলে যাক, আসল ফিল্মগুলো না দেয়া পর্যন্ত মিলার বা ব্যালার্ডের হাত থেকে নিরাপদ নয় ওরা। দুজনকে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার আগে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। তিন গোয়েন্দাও আরাম করে নিউ ইয়র্ক দেখতে পারবে না, রাবাতও তার আবিষ্কার হাত বদল করার ব্যাপারে মন দিতে পারবেন না।

পরদিন সকালে উঠে অবশ্য বেরিয়ে গেলেন তিনি। সারাদিন পর ফিরে এসে জানালেন, যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। কাজ এগোচ্ছে।

 ফোর্ড গাড়িটা নিয়ে গেলেন একটা ওঅর্কশপে। সার্ভিসিং করাবেন। টুকিটাকি মেরামত থাকলে, সারিয়ে নেবেন। বাড়ি ফেরার পথে দীর্ঘ যাত্রায়। যাতে গোলমাল না করে ওটা। কি পরের কয়েকটা দিন খুব সকালে বেরিয়ে যান তিনি, ফেরেন সন্ধ্যায়। ছেলেরা থাকে নিজেদের মত। যেখানে ইচ্ছে ঘোরাফেরা করে। হাডসন নদীতে রাখা অনেক পুরানো একটা উভচর বিমান দেখতে গেল ওরা। টুরিস্টদের জন্যে রাখা হয়েছে ওটা দর্শনীয় বস্তু হিসেবে। গেল হেইডিন প্ল্যানেটোরিয়ামে। লিটল ইটালিতে পিজ্জা খেলো। মাথার অনেক ওপরে বসানো ট্রামলাইন ধরে বেড়াতে গেল রুজভেল্ট আইল্যান্ডে। রকফেলার সেন্টার দেখতে গেল। নানা জায়গার সুভনির কিনল। মিলারের সঙ্গে শেষ মোলাকাতের চারদিন পর সাক্ষাৎ হলো অর্কিড়ওয়ালা এক মহিলার সঙ্গে।

সিক্স অ্যাভেনু আর থার্টিয়েথ স্ট্রীটটা যেখানে মিলেছে, সেই মোড়ের কাছে ওদের পাশ কাটাতে গেল মহিলা। একটা ঝুড়িতে বসানো টবে অর্কিড নিয়ে চলেছে। গাছটা বেশ সুন্দর। ফ্যাকাসে সবুজ আর বাদামী রঙের, কাঁটাওয়ালা তিনটে চমৎকার ফুল।

শুনুন! ডাকল রবিন।

খাইছে! বলে উঠল মুসা। এ তো অর্কিড!

লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। বিনয়ের অবতার সেজে জাপানী কায়দায় মাথা নুইয়ে অভিবাদন করে বলল, সিমবিডিয়াম ফুল, তাই না?

উজ্জল হলো মহিলার মুখ। তুমি অর্কিড চেনো? সুন্দর ফুল, তাই না? চাষ করো নাকি?

আমার চাচা করে, নির্বিকার ভঙ্গিতে মিথ্যে বলে দিল কিশোর।

তাকে বিশ্বাস করল মহিলা। একটা জরুরী কাজ আছে আমার, ফুলটা আমার মেয়ের বাড়িতে রেখে সেখানে যাব। ফিরে এসে ফুলটা দেখাতে নিয়ে যাব। এইবার আর আমাকে পুরস্কার না দিয়ে পারবে না।

তাই নাকি? অর্কিড শো হচ্ছে নাকি শহরে?

ঠিক শো না। আমাদের স্থানীয় সৌখিন অর্কিড চাষীদের মাসিক সম্মেলন। প্রধান অতিথি হয়ে আসবেন স্যার ওয়ালথার মারিয়াট। বক্তৃতা দেবেন। অর্কিডে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ। এসো না তোমরাও? অর্কিডে আগ্রহী লোকদের বিনে পয়সায় অর্কিড বিতরণ করি আমরা। তোমাকেও দিতে পারব।, তোমার চাচাকে নিয়ে গিয়ে দেবে। নিউ ইয়র্কেই থাকো কোমরা?

না, ক্যালিফোর্নিয়ায়।

বাবা, অনেক দূর থেকে এসেছ! বেড়াতে?

 মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

অর্কিডের ঝুড়িটা মুসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পার্স খুলে কার্ড বের করল মহিলা। তাতে ঠিকানা লিখে কিশোরকে দিয়ে বলল, রাত আটটায় স্টেটলার রয়ালে আসবে। স্যার ওয়ালথার মারিয়াটের সঙ্গে দেখা করে তার অনুষ্ঠান থেকে অর্কিড় নিয়ে গেছ শুনলে খুব খুশি হবেন তোমার চাচা, আমি শিওর। আমাদের একজন সদস্য অনুষ্ঠানের ভিডিও করে রাখবে। ইচ্ছে করলে ক্যাসেটটার কপিও করিয়ে নিতে পারো। তার জন্যে অবশ্য পয়সা লাগবে।

মুসার হাত থেকে ঝুড়িটা নিয়ে নিজের পথে চলে গেল মহিলা।

কার্ডটার দিকে তাকাল কিশোর। নাম লেখা রয়েছে মিসেস স্নো জেলিমেয়ার। নিউ ইয়র্কের রিভারডেলের ঠিকানা। আর স্টেটলার রয়ালটা। পাওয়া যাবে থারটিজের সেভেন্থ অ্যাভেন্যুতে।

বন্ধুদের দিকে তাকাল সে। কি মনে হয় তোমাদের? সৌখিন অর্কিড। চাষীদের সম্মেলনের কথা পত্রিকায় দেখলে দেখতে যাবে মিলার? যেহেতু অর্কিডের ব্যাপার, তার চোখে পড়তেও পারে খবরটা।

মহিলার সঙ্গে যখন কথা বলছিলে, তোমার মতলব তখনই বুঝেছি, রবিন বলল। তোমার ধারণা মিলার এখনও নিউ ইয়র্কেই আছে। কিন্তু ওরকম একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার সাহস কি সে করবে? এফ বি আইয়ের ভয়ে তার। তো লুকিয়ে থাকার কথা।

এফ বি আই তো আর সমস্ত জায়গায় চোখ রাখেনি, ওরা রেখেছে। বিশেষ বিশেষ জায়গায়। নিউ ইয়র্ক থেকে মিলার বেরোতে গেলে ওদের চোখে পড়বে। সুতরাং অত তাড়াতাড়ি বেরোনোর সাহস করবে না সে। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে তখন চেষ্টা করবে। এতদিন সে বসে থেকে করবেটা কি? বিরক্ত হয়ে যাবে না? সময় কাটানোর জন্যে হলেও অনুষ্ঠানে যেতে চাইবে। বিশেষ করে অর্কিডের প্রতি তার যখন এত আগ্রহ।

তাহলে এটাই সুযোগ, মুসা বলল। ধরা যাক, সে যাবে। আমরাই বা বসে থাকি কেন?

রাবাতকে ওখানে নিয়ে যাবে কিনা, এটা নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেল ওরা। মুসা নেয়ার বিপক্ষে। বলল, নানার মেজাজের ঠিক-ঠিকানা নেই। মিলারকে দেখেই হয়তো জ্বলে উঠবে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে ক্ষিপ্ত হয়ে যা খুশি করে বসতে পারে। ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না আমাদের।

 আমরা যে গেছি পরে যদি জানে? প্রশ্ন তুলল রবিন।

নাক কুঁচকাল মুসা, জানলে জানবে।

কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারল না ওরা। হোটেলে ফিরে চলল। রিসেপশন ডেস্কে একটা মেসেজ পেল। রাবাত রেখে গেছেন। আসতে দেরি হবে। রাতের খাওয়া ছেলেদের সঙ্গে খেতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে। ওদেরকে খেয়ে নিতে বলেছেন। সময় না কাটলে সিনেমা দেখতেও যেতে পারে ওরা।

হয়ে গেল সমস্যার সমাধান। সন্ধ্যায় স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার খেলো ওরা। নিউ ইয়র্কের মধ্যে নাকি সবচেয়ে বড় এবং ভাল হিরো স্যান্ডউইচ বানায় ওখানে। কথাটা বোধহয় সত্যি। খাওয়া শেষ করার পর মুসারও মনে হলো তার পেট ঠাসাঠাসি হয়ে গেছে।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ক্রসটাউন বাস ধরে চলে এল স্টেটলার রয়ালে। লিফটে করে তেরোতলার গ্র্যান্ড বলরুমে পৌঁছল।

গ্র্যান্ড অর্থাৎ মহান বলরুমটা অত মহান নয়। গালভরা নামটাই যা। হোটেলটাও পুরানো। লাল কার্পেটের জায়গায় জায়গায় রঙ চটে গেছে। স্ফটিকের ঝাড়বাতিতে পুরো হয়ে জমে আছে ধুলো। লিফট থেকে নামতে তিন গোয়েন্দাকে স্বাগত জানাল মোটা এক লোক। গায়ে সাদা শার্ট। শার্টের বুকের কাছে তার নাম সুতো দিয়ে তোলা। কোন্ জায়গা থেকে এসেছে, তা ও লেখা আছে। তাতে জানা গেল তার নাম বিল কংকি, সাইয়োনেট থেকে এসেছে। ছেলেরা অর্কিডে আগ্রহী শুনে খুব খুশি হলো। স্যার মারিয়াটের বক্তৃতা সহ ভিডিও ক্যাসেটও যে তার অর্কিড়-বিলাসী চাচার জন্যে অবশ্যই নিয়ে যেতে চাইবে কিশোর, এ ব্যাপারেও নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করে দিল।

কি করে ভাল অর্কিড ফলাতে হয়, এ ব্যাপারে লেকচার দেবেন স্যার মারিয়াট, বিল বলল। এর জন্যে ঠিক মত প্যারেন্ট জোগাড় করতে হবে। ভয়ানক ইন্টারেস্টিং।

দৃষ্টি বিনিময় করল মুসা আর রবিন। মুসার পেট ফেটে হাসি আসছে।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল বিল, আরও কয়েকজন এসেছে, তাদের স্বাগত জানাতে। মুসা বলল, প্যারেন্ট মানে কি? অর্কিডেরও কি মাতাপিতা থাকে নাকি?

 কি জানি! ঠোঁট ওল্টাল রবিন। ইন্টারেস্টও যে কি করে ভয়ানক হয়, খোদাই জানে। সাংঘাতিক বলতে পারত। তা না, ভয়ানক।

থাক, খুঁত ধরা বাদ দাও, হাত নেড়ে বলল কিশোর। ওরকম ধরতে থাকলে বেশির ভাগ মানুষেরই ধরতে পারবে।

তেরোতলার ওই ঘরটা ঘুরে দেখতে শুরু করল ওরা।

প্রায় পুরো ফ্লোরটাই জুড়ে আছে গ্র্যান্ড বলরুম। প্রবেশমুখের বাইরে দুটো করিডর আছে। তাতে দুটো লিফট, হোটেলের গেস্টদের ওঠার জন্যে। লিফট শ্যাফটের পাশে একটা দরজা, তার ওপাশে সিঁড়ি। ডানের একটা হলঘরে রয়েছে কয়েকটা টয়লেট। বায়ের আরেকটা হলঘরে সার্ভিস লিফট, হোটেল কর্মচারীদের ওঠানামার জন্যে। লিফট ছাড়িয়ে গেলে পাওয়া যাবে ছোট প্যানট্রি অর্থাৎ ভাড়ার ঘর। প্যানটি থেকে বলরুমে সরাসরি ঢোকারও দরজা আছে। হলের শেষ মাথায় ভারী একটা দরজা, মুসার সন্দেহ হলো, ওটা দিয়ে বেরোলে আরেকটা সিঁড়ি পাওয়া যাবে। তবে নিশ্চয় সাধারণের চলাচলের জন্যে নয় ওটা। নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলল সে।সিঁড়ি দেখতে পেল। না। সরু এক চিলতে বারান্দার মত, ভারী রেলিঙ দিয়ে ঘেরা, তার ওপাশে খোলা।সে যে দরজাটা খুলেছে, সেটা ছাড়া বারান্দা থেকে বেরোনোর আর কোন পথ নেই। সরে এল সে। আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল ভারী পাল্লা, খুট করে জায়গামত লেগে গেল নবের প্রিঙ লক।

মিলার এলে হয় লিফট ব্যবহার করতে হবে, নয়তো মেইন করিডরের সিঁড়ি। পালাতে হলেও ওই একই পথে। আর কোন পথ নেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিল গোয়েন্দারা। সাইয়োসেটের বিল কংকলিন এখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে স্পীকারস টেবিলের সামনে। বিনীত ভঙ্গিতে অতিথিদের সীটে বসতে অনুরোধ করল।

ঘরের একধারে লম্বা টেবিলে নানা রকম অর্কিডের টব রাখা আছে। সেটার দিকেই আগ্রহ বেশি অতিথিদের। সেখানেই ভিড় করছে। বিলের। মোলায়েম স্বরে কাজ হলো না। জোরে জোরে বলতে হলো। তাতেও সুবিধে হলো না। শেষে চিৎকার করে টেবিল চাপড়ে কিছুটা রুক্ষ স্বরেই যখন বসতে বলল, তখন এক দুই করে সরে এল অতিথিরা। সারি দিয়ে রাখা খাটো পিঠওয়ালা চেয়ারে বসল। ছাতে ঝোলানো আলোগুলো ম্লান হতে হতে যখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল, তখন জ্বলে উঠল স্পটলাইট, আলো ফেলল স্পীকারস টেবিলের কাছে।

মাপা স্বরে বাছাই করা শব্দে অতিথিদের আরেকবার স্বাগত জানিয়ে, কি কারণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, জানাল বিল কংকলিন। ঘোষণা করল, স্যার মারিয়াট এখন আপনাদের তার চাষ করা কিছু অর্কিড দেখাবেন। কি করে বাজে প্যারেন্ট থেকেও উঁচু মানের অর্কিড জন্মানো যায়, সে-ব্যাপারে আলোচনা করবেন।

খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা। একেবারেই তো নীরস সাবজেক্ট! শুকনো, খটখটে! ঘুমিয়ে না পড়ি!

তার সামনের সীটে বসা মহিলা ফিরে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল।

চেয়ারের পিঠ খাটো হওয়ায় আরাম করে হেলানও দিতে পারল না মুসা। তার মনে হলো, ইচ্ছে করে এ রকম চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে বিরক্তিকর বক্তৃতার সময় শ্রোতারা ঘুমিয়ে পড়তে না পারে, শুনতে বাধ্য হয়। তবু যতটা সম্ভব কাধ নিচু করে গা এলিয়ে দিল সে।

স্পীকারের টেবিলের ওপাশে এসে দাঁড়ালেন রোগাটে, প্রায় কঙ্কালসার, আপেলের মত টুকটুকে লাল মুখওয়ালা এক ভদ্রলোক। হাডিসার হাতের তালু ক্রমাগত ডলছেন। যেন করজোড়ে মিনতি করছেন তার ভয়াবহ বক্তৃতা শোনার জন্যে। বক্তৃতা ভয়াবহই হবে, বিলের কথা থেকেই আঁচ করে নিয়েছে মুসা। ইনিই প্রধান অতিথি স্যার ওয়ালথার মারিয়াট, পরিচয় করিয়ে দিল কংকলিন।

পুরো তিন সেকেন্ড কোন কথা বললেন না মারিয়াট। আন্তরিক হাসিতে কেবল দাঁত দেখালেন অর্কিড় প্রেমিকদের। তারপর বললেন, সম্মানিত ভদ্রমহোদয়গণ।

বলেই চুপ। আবার কয়েক সেকেন্ড দাঁত দেখানোর পর বললেন, কয়েক মিনিট আগে মিস্টার কংকলিন আমাকে বললেন, বক্তা হিসেবে একজন ভেজা চাষীকে পেয়ে আজকের সভা নাকি খুবই আনন্দিত। এর আগের সম্মেলনের বক্তা নাকি ছিলেন শুকনো চাষী। ভেজা চাষী কাকে বলেছেন, বুঝতে পারছেন তো? আমাকে।

চাষী কি করে ভেজা কিংবা শুকনো হয় মাথায় ঢুকল না মুসার। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ল সে।

কনুই দিয়ে, তো মেরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল রবিন। তার মুখেও হাসি।

শব্দ করে হেসে ফেলার ভয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাতে পারছে না। কিশোর। জোর করে চোখ আটকে রেখেছে ভেজা চাষীর ওপর।

পেছনে দরজা খোলার মৃদু শব্দ হলো। ফিরে তাকাল সে।

দয়া করে কি কেউ আলোটা নিভিয়ে দেবেন? অনুরোধ করলেন স্যার। মারিয়াট।

প্রায় লাফাতে লাফাতে ছুটে গেল কংকলিন। মাথার ওপরের আলোগুলো আগেই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। স্পটলাইটটাও নিভে গেল। ক্ষণিকের জন্যে অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘর। একটা স্নাইড প্রোজেক্টর চালু হওয়ার হালকা গুঞ্জন শোনা গেল। পর্দায় আলো পড়ল। ছবি ফুটল। তাতে দেখা গেল, একটা গ্রীনহাউসে কাজে ব্যস্ত স্যার মারিয়াট। টেবিলে একের পর এক অর্কিড তুলে রাখছেন।

এখন শুনুন, কি করে ভাল, প্যারেন্ট বাছাই করব আমরা, আবছা অন্ধকারে আবার শোনা গেল তার কণ্ঠ। কুড়ি কিংবা ফুল দেখেই অনেক কিছু বোঝা যায়। যারা এর চাষ করে তাদের কাছে ওই জিনিস দুষ্প্রাপ্য নয়, ফুলের জন্যেই তো করে, তাই না? শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন তিনি।

করিডরের দিকের একটা দরজা খুলে গেল। দরজায় এসে দাঁড়ানো গাট্টাগোট্টা একজন মানুষের অবয়ব প্রোজেক্টরের আলোর আভায় চোখে, পড়ল। ঘরের অন্ধকার চোখে সইয়ে নেয়ার অপেক্ষা করছে মনে হলো।

ছবিতে টেবিলের সামনে দাঁড়ানো মারিয়াট তখন নানা রকম ফাস্ক, বীজ আর গাছের চারা নাড়াচাড়া করছেন। কোনটা বাছাই করে কি ভাবে লাগালে ভাল ফলন আশা করা যাবে, বোঝাচ্ছেন।

অন্ধকার ঘরে ঢুকল আগন্তুক। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

মুসার গায়ে খোঁচা দিল কিলোর। আস্তে উঠে রওনা হয়ে গেল ঘরের পেছন দিকে। তাকে অনুসরণ করল মুসা আর রবিন।

খানিকটা সরে এসে ফিসফিস করে কিশোর বলল, ঢুকল যে, ওই লোকটা মিলার, কোন সন্দেহ নেই আমার। হোগারসনকে ফোন করব, দেখি পাওয়া যায় কিনা।

দরজার পাল্লা যতটা সম্ভব কম ফাঁক করে পিছলে বেরিয়ে এল সে। পেছনে বেরোল অন্য দুজন। দাঁড়িয়ে গেল ওখানে। নীরব করিডরে ফোন। কোথায় আছে খুঁজছে ওদের চোখ।

কাছেই আরেকটা দরজা খুলে গেল।

করিডর আর বলরুমের সঙ্গে যোগাযোগকারী বড় দরজাটা নয়, অন্য আরেকটা ছোট দরজা, প্যান্ট্রির কাছে।

মিলার? তিন গোয়েন্দাকে দেখে ফেলে বলরুম থেকে পালাচ্ছে? করিডরে নিশ্চয় ওদের আবছা অবয়ব চোখে পড়েছে তার। ত্রিমূর্তিকে চিনতে অসুবিধে হয়নি মিলারের।

বাঁয়ের ছোট হলটাতে পদশব্দ শোনা গেল। তারপর বাসন-পেয়ালার ঠোকাঠুকি। এবং তারপর একটা গুঞ্জন, নিচতলা থেকে উঠে আসতে আরম্ভ করেছে সার্ভিস্ লিফটটা।

পা টিপে টিপে এসে হলে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। লিফটের দিকে তাকাল। গাঢ় রঙের স্যুট পরা একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অন্ধকারে তার কাপড়ের রঙ বোঝা যাচ্ছে না, কালো দেখাচ্ছে। ওদের দিকে পিঠ। দুহাতে ধরা ট্রেতে কাপ-পিরিচ।

কোন ওয়েইটার? ব্যবহৃত কাপ-পিরিচ নিয়ে নিচে নামতে যাচ্ছে সে?

 রবিন বলল, এই দেখো, ওর পায়ে লোফার?

চমকে গেল ওয়েইটার। সামান্য ঘুরে গেল মাথা, এদিকে তাকাল। মুখের একটা পাশ দেখা গেল।

 ওভাবেই থাকুন, মিস্টার মিলার। রবিন বলল, আপনার একটা ছবি তুলে নিই!

সঙ্গে ক্যামেরা এনেছে রবিন। বেড়াতে বেরোনোর পর থেকে এটা সব সময় সাথে থাকে তার, কখনও কাছছাড়া করে না। লোকটার দিকে করে শাটার টিপে দিল। ঝিলিক দিয়ে উঠল ফ্ল্যাশার।

রবিনের দিকে লাফ দিল মিলার। একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠল। হাত থেকে ট্রে-কাপ খসে পড়ে ঝনঝন করে ভাঙল।

ওই মুহূর্তে খুলে গেল সার্ভিস লিফটের দরজা। মিলারের পাশ দিয়ে ছুটে লিফটে ঢুকে গেল কিশোর আর মুসা। ইমারজেন্সি সুইচ টিপে দিল কিশোর। এটা টিপলে আটকে যায় লিফট, যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আর অ্যালার্মের লাল, বোতামটা টিপল মুসা। তীক্ষ্ণ শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। বাজতেই থাকল।

পুলিশ। পুলিশ! বলে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। খুন করে ফেলল! বাঁচাও!

রবিনের গলা টিপে ধরতে যাবে মিলার, এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল। বলরুমের দরজা।

আরেকটা ছবি তুলে ফেলল রবিন।

ছুটে বেরিয়ে এল কংকলিন। রাগে কুঁচকে গেছে মুখচোখ। চিৎকার করে বলল, এই, হচ্ছে কি এ সব! বন্ধ করো।

থমকে গেল মিলার দ্বিধায় পড়ে গেছে। চোখ প্রায় অন্ধ করে দিয়েছে। ফ্র্যাশারের তীব্র আলো।

পুলিশ। আবার চেঁচিয়ে উঠল রবিন, পুলিশ ডাকুন! আমাকে খুন করতে, এসেছে।

আবার টিপল শাটার একেবারে মিলারের মুখের কাছে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে।

ধাক্কা খেয়ে যেন পিছিয়ে গেল মিলার। চোখের সামনে নিয়ে গেছে। দুহাত তারপর ঘুরে দৌড় দিল সার্ভিস লিফটের দিকে।

মুসা আর কিশোর ওখানে অপেক্ষা করছে। ভাঙা কাপ-পিরিচ মাড়িয়ে উঠতে গিয়ে ওদেরকে লক্ষ করল মিলার। উঠল না আর। দৌড় দিল ভারী দরজাটার দিকে মুসার মত সে-ও ভেবেছে ওদিকে সিঁড়ি আছে। দুহাত সামনে বাড়িয়ে ছুটছে সে। নব ঘুরিয়ে একটানে পাল্লাটা খুলে চলে গেল। ওপাশের অন্ধকারে। পান্না ছেড়ে দিতেই আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল সেটা, তালা লেগে গেল। চাবি ছাড়া ওদিক থেকে খুলতে পারবে না।

বলরুম থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে কৌতূহলী মানুষেরা। মহিলাদের কেউ কেউ ভয় পেয়েছে। করিডরে এসে এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল অর্কিডপ্রেমীর দল।

লিফটের ঘণ্টা বাজা থেমে গেল।

অকস্মাৎ নীরব হয়ে গেল যেন সব কিছু, বড় বেশি চুপচাপ। এরই মাঝে কানে এল একটা চিৎকার। হলের শেষ মাথায় দরজার ওপাশ থেকে আসছে।

বাচাও! চিৎকার করছে মিলার, দরজায় কিল মারছে, দরজা খোলো! বের করো আমাকে! বাঁচাও!

কংকলিনের দিকে ফিরল কিশোর। শান্তকণ্ঠে বলল, মিস্টার কংকলিন, টেলিফোনটা কোথায় বলবেন দয়া করে? এফ বি আইকে ফোন করতে হবে।

.

২২.

রেস্টুরেন্টটা অবিশ্বাস্য রকমের বিলাসবহুল। সাদা মখমলের কাপড়ে ঢাকা টেবিলগুলো, জানালার পর্দায় এমব্রয়ডারি করা দামী কাপড়ের পর্দা। সবখানে তাজা ফুলের ছড়াছড়ি। কার্পেট এত পুরু, পা ফেললেই গোড়ালি অবধি দেবে যায়। মেন্যুর বদলে হেডওয়েইটার স্বয়ং এসে নরম, ভদ্রস্বরে কথা বলে খাবারের অর্ডার নিয়ে যায়। নীল টেলকোট আর ডোরাকাটা ভেস্ট পরা অন্য ওয়েইটাররা খাবার সরবরাহ করে। তিন গোয়েন্দার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হলো না। চিঙড়ির একটা বিশেষ ডিশের অর্ডার দিল ওরা। রান্না নাকি খুবই চমৎকার এখানে।

ওদের খাওয়াতে এনেছেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার ঘরের চারপাশে তাকাতে তাকাতে বললেন, সিনেমায় তখনও ঢুকিনি। প্রায় পথে পথেই ঘুরে বেড়াচ্ছি বলা চলে, বেকার, কাজ খুঁজছি। এখানে আসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না তখন হলে। সাধারণ কোন ফাস্ট ফুড শপের সাধারণ বার্গার পেলেই বর্তে যেতাম। তা-ও সব দিন জোগাড় করতে পারতাম না।

মিনারেল ওয়াটারের গেলাসে চুমুক দিলেন তিনি। হাসলেন। ধনী হওয়ার মজাই আলাদা। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না এ কথা। হ্যাঁ, এবার তোমাদের কেসের কথা বলো। কিশোর, পত্রিকায় হ্যারিস মিলারের খবরটা দেখে তোমার মেরিচাচীকে ফোন করেছিলাম। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি জানেন মুসার নানার সঙ্গে তোমরা ছুটি কাটাতে গেছ, বেড়াতে। কল্পনাই করতে পারেননি, স্পাই তাড়া করে বেড়িয়েছ।

হেসে ফেলল মুসা। ছুটিতে বেড়াতে বেরিয়েছি, এটাও যেমন ঠিক : একটা কেস হাতে নিয়ে বেরিয়েছি এটাও ঠিক। কেসটা দিয়েছিল আমার মা

বাবাকে কি করে ঝামেলা মুক্ত রাখার জন্যে তিন গোয়েন্দাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মিসেস আমান, খুলে বলল সে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। সেটা করতে গিয়েই স্পাইদের সঙ্গে জড়িয়েছিলাম।

সে-রকমই শুনেছি, পরিচালক বললেন। এ সময় নিউ ইয়র্কে তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি। ভাল লাগছে। একটা ছবির কাজে এসেছি। নিউ ইয়র্কে শুটিং করতে হবে। মনে হচ্ছে, সিনেমার আরও একটা ভাল গল্প পেয়ে গেলাম। পত্রিকায় তোমাদের কেসের খবরটা পড়ে তাই মনে হলো। এবার বলো সব। পুরো কাহিনীটা তোমাদের মুখ থেকে শুনতে চাই রবিন, এটা তো বাড়ি নয়, লিখে ফেলার কাজটা নিশ্চয় শুরু করোনি?

করেছি, স্যার, রবিন বলল। আজ সকালে আপনার ফোন পেয়ে তো চমকেই গিয়েছিলাম। আমরাও ভাবতে পারিনি আপনি নিউ ইয়র্কে আছেন, দেখা হয়ে যাবে।

কাহিনী শুরু করল রবিন। গোড়া থেকে বলতে লাগল। কি করে মুসার আম্মা ওদেরকে কাজটা দিয়েছেন। পিজমো বীচে মিলারের সঙ্গে গোলমালের সূচনা থেকে স্টেটলার রয়ালে তাকে পাকড়াও করা পর্যন্ত কিছুই বাদ দিল না। মাঝে মাঝে তাকে কথা জুগিয়ে দিল মুসা আর কিশোর।

চমৎকার! পুরোটা শুনে বললেন পরিচালক। হোটেলের ওয়েইটাররা যে কাজের সময় লোফার পরে না, শুধু এই সামান্য সূত্র দিয়ে কাউকে সন্দেহ করে ফেলাটা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। একটা ব্যাপার অবাক করছে আমাকে। সান্তা রোসায়ও তো গাড়ির নিচে উঁকি দিয়েছিলে তোমরা। পেট্রোল ট্যাংকে লাগানো সঙ্কেত পাঠানোর যন্ত্রটা তখন চোখে পড়ল না কেন?

অমন কিছু থাকতে পারে, তখনও ভাবিনি, জবাব দিল কিশোর। তা ছাড়া রাত দুপুরে চোখ তখন এমনিতেই ক্লান্ত, তার ওপর টর্চের ব্যাটারি গিয়েছিল ফুরিয়ে। নানা রকম উত্তেজনার মাঝে ব্যাটারি চেক করতে ভুলে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা, মিলার যে দুষ্ট লোক, মিস্টার রাবাতের এ কথায় তখনও গুরুত্বই দিইনি। তাই নতুন ব্যাটারি ভরে ভালমত আবার খোঁজার কথা মনে হয়নি।

আগেও এ ধরনের অপরাধ করেছে কিনা মিলার, জানতে পারিনি। এ সব গোপনীয়, ব্যাপার, তাই এফ বি আই আমাদের সামান্যই জানিয়েছে। হোগারসনের কাছে জেনেছি, বিমানের যন্ত্রপাতি তৈরির একটা কারখানায় কাজ করত মিলার। ইলেকট্রনিক এঞ্জিনিয়ার ছিল সে। সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ছিল তার, কারখানার মধ্যে যেখানে ইচ্ছে যখন তখন যেতে পারত। তবে কিছুদিন পর চাকরি থেকে বের করে দেয়া হলো তাকে–অন্যান্য টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অপরাধে। হয়তো প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে জেদের বশেই প্রাইয়ের কাজটা করেছে সে। চাকরি যাবে শোনার পর তথ্য চুরি করার সিদ্ধান্ত নেয়, বেরিয়ে আসার আগেই কাজটা সেরে ফেলে।

ছবি ডেভেলপ করার যন্ত্রপাতি ছিল না তার বাড়িতে। কোন ক্যামেরার দোকান থেকে করিয়ে আনারও সাহস করেনি, ঝুঁকি নিতে চায়নি। ক্যামেরাটা সহই দিয়ে দিতে চেয়েছিল ব্যালার্ডকে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, ক্যামেরাটা বদল হয়ে হাতছাড়া হয়ে গেল। অন্য কারণে তাকে সন্দেহ শুরু করেন মিস্টার রাবাত। মিলার ভাবল, তার তথ্য চুরির ব্যাপারটা নিয়ে তাকে সন্দেহ করছেন তিনি। চোরের মন পুলিশ পুলিশ!

হু, মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক। অপরাধী এ ভাবেই নিজেকে ধরিয়ে দেয়।

 মুসা বলল, যতই এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা, ক্যামেরাটার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল মিলার। ওটা যে বদল হয়ে গেছে, ধরতে পারেনি রবিন। সে বুঝতে পারার আগেই তার কাছ থেকে ওটা কেড়ে নিতে চেয়েছিল মিলার।

সে-সব তো আগেই শুনলাম। ব্যালার্ডের কি খবর? তাকে ধরেছে?

মুহূর্তের জন্যে কালো হয়ে গেল কিশোরের মুখ। ও পালিয়েছে। হোগারসনের কাছে শুনলাম, মিলার ধরা পড়ার পরদিন নাকি ভিয়েনায় দেখা। গেছে তাকে। এফ বি আইয়ের জাল কেটে বেরিয়ে গেছে সে।

তারমানে ওস্তাদ গুপ্তচর সে। অনেক দিন ধরে আছে এ লাইনে।

যতবড় ওস্তাদই হোক, মুসা বলল, আমাদের কাছে একটা মার খেয়ে গেছে। যে ফিল্মগুলো নিয়েছে রবিনের ব্যাগ থেকে, সব বাতিল জিনিস। ডেভেলপ করার পর দেখবে কিচ্ছু ওঠেনি। মুখটা তখন পচা ডিম হয়ে যাবে। হয়তো গালাগাল করবে আমাদের, কিন্তু লাভ হবে না কিছুই।

মৃদু হাসি ফুটল পরিচালকের ঠোঁটে। মাথা ঝাঁকালেন। তা বটে। তো, মুসা, তোমার নানার আবিষ্কারটা কি? বিক্রি করতে পেরেছেন?

হাসল মুসা। পেরেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সত্যিই কাজের জিনিস। গাড়িতে ওটা পাইনি আমরা তার কারণ, গাড়িতে ছিল না। আক্রমণ আসতে পেরে ভেবে ওটা আগেই ডাকে রিভারভিউ প্লাজায় পাঠিয়ে দিয়েছিল, নিউ ইয়র্ক এসে প্রথম যে হোটেলে আমরা উঠেছিলাম। ম্যানেজারকে বলে রেখেছিল, আমরা না আসা পর্যন্ত যেন খামটা নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়। রেখে দিয়েছিল ম্যানেজার। সেজন্যেই মিলার পিছে লাগায় আবিষ্কার খোয়া যাওয়ার ভয় ছিল না নানার, লোকটাকে দেখতে পারে না বলে ভীষণ খেপে গিয়েছিল।

কিন্তু আবিষ্কারটা কি? সামরিক বাহিনীর কাজে লাগবে এমন কিছু?

না, মহাকাশচারীদের কাজে লাগবে। গির্জার হলের জন্যে প্রিঙ্কলার। সিসটেম বানাতে গিয়ে এক ধরনের নতুন ভালভ আবিষ্কার করে বসে নানা। এর মধ্যে একটা অটোম্যাটিক সেনসর থাকবে। বর্তমানে যে সব ভালভ ব্যবহার করে নভোচারীরা তার চেয়ে অনেক ছোট আর হালকা বলে বহন করতেও সুবিধে। স্পেসস্যুটের ভেতরে বসানো এই জিনিসটা তাপমাত্রা আর চাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে অন্যান্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ছেটে ফেলা যাবে, তাতে স্যুটের আকার আর ওজন দুটোই অনেক কমানো যাবে। শিপ থেকে বেরিয়ে মহাকাশে ঘোরাফেরা করতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে নভোচারীরা।

তারমানে ভাল জিনিসই আবিষ্কার করেছেন!

হ্যাঁ। নানাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে এখন কয়েকটা ফার্ম, NASA-র অনেক জিনিস সাপ্লাই দেয় ওরা। একজন উকিল নিযুক্ত করেছে। নানা। তাকে নিয়ে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মাটিঙে বসছে। ভোরে বেরোয়, রাত করে ফেরে। সাংঘাতিক খাটুনি যাচ্ছে। সেই তুলনায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে না। রাতে এসেও হেসে হেসে কথা বলে আমাদের সঙ্গে। রসিকতা করে। আগে যেটা একেবারেই করত না। হয় চুপ করে থাকত, নয়তো খেউ খেউ করে উঠত।

আসল কথাটা হলো দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মানসিক চাপ থাকলে ভাল মেজাজ খারাপ হয়ে যায় হাসলেন তিনি হলে একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে, এই দীর্ঘ যাত্রায় একসঙ্গে থেকে থেকে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছেন তোমাদের। নিঃসঙ্গ জীবনে তিন তিনজন ভাল বন্ধু জুটিয়ে নিয়েছেন।

হাসল না কেবল মুসা।

এখন আসল কথা শোনো, পরিচালক বললেন, খাওয়াতে এনেছি। কোথাও আরামে বসে তোমাদের গল্পটা শোনার জন্যে। আরও একটা প্রস্তাব– দিতে পারি, হাতে কাজ না থাকলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। আমার নতুন ছবিটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে আজ রাতে। মিস্টার রাবাকে ফোন করে দাও। সম্ভব হলে যেন সন্ধ্যার দিকে চলে আসেন আজ তিনি। কয়েক ঘণ্টা সময় দেন আমাদের।

পরিচালকের প্রস্তাবে খুশি হলো কিশোর।

তবে মুসাকে তেমন খুশি দেখাল না। আমতা আমতা করে বলেই ফেলল, এ ধরনের অনুষ্ঠানে যেতে ভয় লাগে আমার, স্যার।

অবাক হলেন পরিচালক। কেন?

অর্কিডপ্রেমীদের অনুষ্ঠান তো দেখলাম। বাপরে বাপ! ঢাকায় গিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটা আলোচনা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম একবার। টিভির সামনে থেকে উঠে সোজা দৌড় দিতে ইচ্ছে করে। অর্কিডওয়ালারা। তার চেয়ে বিরক্তিকর!

হেসে ফেললেন পরিচালক। না, অতটা বিরক্তিকর লাগবে না আমাদের অনুষ্ঠান, কথা দিতে পারি তোমাকে, উত্তেজনা আর আনন্দের অনেক খোরাক পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রচুর খাবার সাজানো দেখবে টেবিলে, মুসার দিকে সরাসরি তাকালেন তিনি। চোখে মিটিমিটি হাসি। তোমার পছন্দ মত।

এইবার হাসি ফুটল মুসার মুখে। তাহলে স্যার আর কোন আপত্তি নেই আমার।