১০. দুই দিন পর

১০.

দুই দিন পর। ইডাহোর ভেতর দিয়ে চলেছে ওরা, মনটানার লিভিংস্টোনের দিকে। আরও দক্ষিণে এগোলে পড়বে ওয়াইয়োমিঙের ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। টুরিস্ট মৌসুম এখনও শুরু হয়নি। রাস্তায় যানবাহনের ভিড় তাই কম।

ইয়েলোস্টোনে পৌঁছে মাটিতে ফাটল থেকে ধোয়া উঠতে দেখল ওরা। এখানে ওখানে ফোয়ারার মত পানি ছিটকে উঠছে ওপরে, কোন কোনটা একশো ফুটের বেশি ওপরে উঠে যাচ্ছে। পানির রঙ লোহার মরচের মত লাল। তাজ্জব হয়ে দেখল, রাস্তার ধারে ডোবা, তাতে গলিত কাদা থেকে বুদ্বুদ উঠছে–যেন ওগুলোর তলায় বিশাল সব চুল্লিতে আগুন জ্বলছে, কাদা। ফুটতে শুরু করবে খানিক পরই। সুন্দর সুন্দর লেক আর ঝর্নার ছড়াছড়ি। এক সময় এটা ছিল আগ্নেয়গিরির এলাকা, এখন সেগুলো মরে গেছে। এত সুন্দর দৃশ্য কিছুক্ষণের জন্যে মিলারের ভাবনা ওদের মন থেকে মুছিয়ে দিল।

তারপর পার্ক রোড ধরে এগোতে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকাল রবিন আর মুসা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। নীরবে শত্রু খুঁজছে মুসার চোখ।

মাউন্ট সেইন্ট হেলেন পেরোনোর পর থেকে সন্দেহজনক আর কিছু দেখিনি, রবিন বলল।

জানানোর সময় এসেছে, ভাবল কিশোর। লংভিউর মোটেলে ড্রাইভওয়েতে বড় গাড়িটা দেখার কথা বলল সে। হ্যারিস মিলারই গাড়িটা চালাচ্ছিল কিনা, বলতে পারব না।

হয়তো এতক্ষণে রকি বীচে চলে গেছে মিলার, রবিন বলল, অর্কিড গাছে পানি দিচ্ছে। মোটেলে আগুন লাগাটা হয়তো নেহায়েত কাকতালীয় ঘটনা। কোন ছিঁচকে চোর স্টোর রুমে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ঘর থেকে। আমাদের বের করেছিল…

আরে দূর! মুসা যে ভঙ্গিতে বলে, সেভাবে বলে উঠলেন রাবাত। সাধারণ চোর হতেই পারে না। হলে চুরি করল না কেন? প্রচুর জিনিস ছিল, সুযোগও ছিল। আমার মানিব্যাগটাই তো পড়ে ছিল টেবিলের ওপর। দুয়েও দেখেনি। তোমার ক্যামেরাটা দামী, ওটাও নিতে পারত।

পেলে হয়তো নিত। কাল রাতে গাড়িতে ছিল ওটা। ঘরে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

কিন্তু টাকা? সামনে পেলে টাকা নেয় না এমন চোরের কথা শুনিনি। চালাকি করে স্টোর রুমে আগুন লাগিয়ে বোর্ডারদের বের করে জিনিস চুরি করার কথাও ভাবে না সাধারণ চোর। সুযোগ পেলে চট করে ঘরে ঢুকে পড়ে। কিছু পেলে নিয়ে চলে যায়।

পুরানো হয়ে এল ফোয়ারা। প্রথম দেখার পর যেমন লেগেছিল, অতটা ভাল লাগছে না আর। উত্তেজনাও কমে গেল।

রাবাত বললেন। জায়গাটা বেশি খালি! অত শূন্যতা ভাল লাগে না!

নানার অস্বস্তিটা মুসার মাঝেও সঞ্চারিত হলো। মনে করিয়ে দেয়ার পর এখন কেমন ভূতুড়েই লাগছে এলাকাটা তার কাছে। বলল, তাড়াতাড়ি করো, নানা, সরে যাই! দেখার কিছু আর নেই এখানে!

শেষ বিকেলে মনটানা-ওয়াইয়োমিং সীমান্তের কাছে একটা ছোট শহরে ঢুকল ওরা। মোটেল খুঁজে বের করল। মালপত্র ঘরে রাখার পর বুইকটা নিয়ে চলে গেলেন রাবাত। পার্কিং লট থেকে দূরে রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে এলেন। ইচ্ছে করেই রাখলেন, মিলারের জন্যে টোপ। দেখতে চান, সে আসে কিনা, খোলার চেষ্টা করে কিনা। বাকি বিকেলটা কাটালেন গাড়ির কাছে যাতায়াত করে।

পঞ্চমবার যখন গাড়িটা দেখতে চললেন তিনি, আর থাকতে পারল না মুসা। বলল, এ ভাবে গিয়ে লাভটা কি হচ্ছে? ক্ষতি করছ আরও। মিলার এলে তোমার এই ঘনঘন যাওয়া-আসা দেখলে সতর্ক হয়ে যাবে। জেনে যাবে আমরা কোথায় উঠেছি। রাতে এসে হানা দেবে।

মুসার কথায় যুক্তি আছে। আর গেলেন না রাবাত। ঘরে ফিরে এলেন। খানিক পরই তার নাক ডাকানোর শব্দ কানে এল।

জেগে রইল তিন গোয়েন্দা। কয়েউর ডিঅ্যালিনির মোটেলে আগুন লাগার ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।

মিলারকে সন্দেহ করতে পারছি না আমি, মুসা বলল। সে এল কি করে মোটেলে? জানল কি করে আমরা ওটাতে উঠেছি? আমাদের পিছে আসতে দেখিনি তাকে। অন্য গাড়ি নিয়ে অনুসরণ করলেও চোখে পড়ে যেত আমাদের। এত দীর্ঘ পথ কিছুতেই লুকিয়ে থাকতে পারত না।

আচ্ছা, হেলিকপ্টারে করে আসেনি তো? রবিনের প্রশ্ন।

নাহ! সম্ভাবনাটা একেবারেই ঝেড়ে ফেলে দিল মুসা। হেলিকপ্টার পাবে কোথায়? ভাড়া করতে অনেক টাকা লাগে। তা ছাড়া অতিরিক্ত শব্দ করে হেলিকপ্টার। নিঃশব্দে অনুসরণ করা একেবারে অসম্ভব।

চুপ হয়ে গেল রবিন।

হঠাৎ বিছানায় সোজা হয়ে বসল কিশোর। ওকে ফোন করব! ইস, আরও আগে এ কথাটা ভাবলাম না কেন? রকি বীচে ওর বাড়িতে ফোন করলে যদি জবাব দেয় তাহলে বুঝব আমাদের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাওয়াটা কাকতালীয় ঘটনা ছিল। আবার ফিরে গেছে। আমাদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

কি করে করবে? নম্বর জানো? রবিনের প্রশ্ন।

না। তবে আনলিস্টেড নাম না হলে ডিরেক্টরি এনকয়ারিতে ফোন করলেই বলে দেবে।

বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ফোনের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। মিনিট খানেকের মধ্যেই জেনে নিল মিলারের নম্বর। ফোন করল।

ও পাশে ফোন বাজতে লাগল।

এত রাতে বিছানা থেকে ডেকে তুলছ, হেসে বলল রবিন, রেগে আগুন হবে।

রকি বীচে এখন রাত এক ঘণ্টা কম। পার্বত্য এলাকায় রয়েছি আমরা, এখানে ওখানকার তুলনায় সময় বেশি।

তিনবার রিঙ হওয়ার পর খুট করে একটা শব্দ হলো, যেন কেউ রিসিভার তুলেছে ওপাশে। কয়েকটা মুহূর্ত সব শূন্য, তারপর আবার খুট। রেকর্ড করা একটা কণ্ঠ বলল, হ্যারিস মিলার বলছি। সরি, এখন ফোনের কাছে আসতে পারছি না। আপনার নাম আর ফোন নম্বর রেখে দিন। পরে যোগাযোগ করব। মেসেজ দেয়ার আগে টোন আসার অপেক্ষা করুন। কথা শেষ হওয়ার পর পরই ভেড়ার ডাকের মত একটা চিৎকার শোনা গেল।

ঝট করে কানের কাছ থেকে রিসিভার সরিয়ে ফেলল কিশোর। উফ, আরেকটু হলেই কান ফাটিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্র! অ্যানসারিং মেশিন জবাব দিয়েছে।

তারমানে আছে কি নেই জানা গেল না, মুসা বলল।

সকালে আবার করব। দেখা যাক, তখন কি বলে?

সকাল আটটায় আবার মিলারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল কিশোর। সেই একঘেয়ে জবাব দিল অ্যানসারিং মেশিন। হাল ছেড়ে দিল কিশোর। মিলার বাড়ি আছে কিনা, রোঝা গেল না।

সেদিন ওয়াইয়োমিঙের ভেতর দিয়ে চলল ওরা। পরিষ্কার, সুন্দর দিন, যদিও নীল আকাশের এখানে ওখানে পেঁজা মেঘ ভাসছে। সেই মেঘে বৃষ্টি হবে না। দুধারে ঘাসে ঢাকা মাঠ, তাতে গরু চরছে। দক্ষিণ ডাকোটার র‍্যাপিড সিটিতে পৌঁছে রাবাত ঘোষণা করলেন, তাদের ছুটি মাটি করতে দেবেন না মিলারকে।

ওই ড্রামটার কথা মাথায়ই আনব না আর, বললেন তিনি। ওর কথা ভেবে দুশ্চিন্তা আর টেনশনের মধ্যে থেকে দেখার আনন্দ মাটি করব না।

এতে অস্বস্তি কমল ছেলেদের। র‍্যাপিড সিটিতে লাঞ্চ খাওয়ার সময় অনেক হই-হুঁল্লোড় করল। সেখান থেকে দক্ষিণে এগোনোর সময় একটিবারও আর পেছনে ফিরে তাকাল না। তবে কিশোর লক্ষ করল, বার বার রিয়ারভিউ মিররের দিকে চোখ যাচ্ছে রাবাতের।

মাউন্ট রাশমোরে পৌঁছল ওরা। পাহাড়ের ওপরে খানিকটা জায়গা সমতল করে চারপাশের দৃশ্য দেখার জন্যে পর্যবেক্ষণ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ। কয়েক মাইল পেরিয়ে এসে পার্কিং লট দেখা গেল। ওখানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। চওড়া পথ। সিকি মাইল পর রয়েছে মঞ্চ। সহজেই পৌঁছানো যায়। পঞ্চাশটা রাজ্যের পতাকা উড়ছে ওখানে।

মঞ্চে এসে দাঁড়াল ওরা। পাইনে ছাওয়া ঢাল নেমে গেছে নিচে। গাছের ফাঁকে মাথা তুলে আছে আমেরিকার মহান চার প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিংকন, থিয়োডোর রুজভেল্ট। দক্ষিণ ডাকোটার পর্বতের পাথর কেটে তৈরি হয়েছে ওই বিশাল মুখগুলো।

খাইছে! কি জিনিস বানিয়েছে! অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বলল মুসা।

সঙ্গে গাইডবুক এনেছে কিশোর। কিন্তু সেটা দেখার প্রয়োজন হলো না। আগেই পড়ে নিয়েছে। বলল, গুটজন বরহ্লামের নির্দেশে তৈরি হয়েছে ওগুলো। একেকটা মুখ ষাট ফুট উঁচু।

হেসে ফেলল মূসা, গুম যখন ছোট ছিলেন, নিশ্চয় তার মা বলেছিলেন–বড় হয়ে বিশাল কোন কাজ করবে বাবা, যা তোমাকে স্মরণীয় করে রাখবে। সেই বিশাল কাজটাই করেছেন তিনি।

বাহ, খুব মজার কথা বলে তো ছেলেটা! পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।

ফিরে তাকাল মুসা।

রাবাতও তাকালেন।

মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা। পরনে আঁটো জিনসের প্যান্ট। রাবাতের দিকে তাকিয়ে হাসল। এরা আপনার নাতি?

একজন।

বাচ্চারা বড় মজার জিনিস! ঝর্নার বহমান পানির মত কলকল করে হাসল মহিলা। সব সময় তাজা। নতুন নতুন কথা খেলে মাথার মধ্যে, কখনও পুরানো হয় না।

এমন ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকালেন রাবাত, যেন তাজা আর নতুনত্ব সত্যি আছে কিনা দেখতে চাইছেন। মুসার চোখ উজ্জল। রবিন লাল হয়ে গেল।

নিজেকে বাচ্চা ভাবতে মোটেও ভাল লাগে না কিশোরের। কঠিন। দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে। বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের শার্টে এমব্রয়ডারি করা বড় বড় গোলাপী রঙের ফুল। কানে ম্যাচ করা গোলাপী, রঙের দুল, ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক। হেসে রাবাতের দিকে দুই কদম এগিয়ে এল।

কখনও সন্তান হয়নি আমার, মহিলার কণ্ঠে খুব হালকা হতাশা আছে। কি নেই। সবাই বলে, ডরোথি, খুব ভাল মা হতে পারতে তুমি। কিন্তু কারও কথায় কান দিইনি। অন্যের বাচ্চাকে আদর করতেই ভাল লাগে আমার।

সরাসরি মহিলার চোখের দিকে তাকালেন রাবাত। তাঁর চোখের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে চোখজোড়া। মহিলার অন্তর ভেদ করে ঢুকে গেল তার দৃষ্টির ছুরি। এক পা পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। টান লাগল হাতে। দেখেন, শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরেছে মহিলার আঙুল। বড় বড় নখে গোলাপী রঙের নেলপলিশ।

নানার বিপদ বুঝতে পারল মুসা। ঘড়ি দেখল। খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল। বলল, নানা, জলদি চলো। ভুলে গেছ, নানীকে বসিয়ে রেখে এসেছ মোটেলে? দেরি দেখলে রেগে কাঁই হবে, আস্ত রাখবে না আর।

চমৎকার একটা মিথ্যে বলেছে মুসা। মনে মনে বাহবা না দিয়ে পারল না। কিশোর। এই মুহূর্তে নানাকে বাঁচানোর এর চেয়ে ভাল কোন বুদ্ধি সে-ও বের করতে পারত না। পলকে উধাও হয়ে গেল মহিলার গোলাপী হাসি। রাবাতের হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল, যেন বিদ্যুতের শক খেয়েছে। শুকনো গলায় বলল, ও, তাই নাকি, তাই নাকি! যান, তাড়াতাড়ি যান! আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল!

হু, আমারও! ভদ্রতা করার জন্যে কোনমতে বলে তাড়াতাড়ি পার্কিং লটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন রাবাত। তার তিন পাশে বডিগার্ড হয়ে এগোল তিন গোয়েন্দা।

গাড়িতে উঠে মুসা যখন বুঝল এতক্ষণে নিরাপদ, নানার দিকে চেয়ে হেসে। বলল, নানা, মহিলা তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছিল। আমরা না থাকলে মরতে! সোজা ধরে নিয়ে যেত।

নিলে নিত, রসিকতার জবাব রসিকতা দিয়েই দিলেন রাবাত, আরেকটা নানী পেয়ে যেতি। চিবুকটা সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন, তাহলে বুঝলি তো, এখনও বুড়ো হইনি। মেয়েরা তাকায়।

হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছরের মেয়ে।

এ কথার আর জবাব দিলেন না নানা।

পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এল আবার ওরা। গাড়ি ঘুরিয়ে কাস্টার স্টেট পার্কের দিকে এগোলেন রাবাত।

কাস্টার পার্কে বাইসন থাকে, কিশোর বলল। একসঙ্গে এত নাকি খুব। কমই দেখা যায়। চিড়িয়াখানার বাইসন আর বুনো বাইসনে অনেক তফাৎ। বুনোগুলো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এড়িয়ে চলা ভাল।

হেসে রাবাত বললেন, কিশোর, বেরোনোর আগে গাইড-বুকটাকে গুলে খেয়েছ নাকি? রাতে বসে বসে পাতা মুখস্থ করো?

মুখস্থ করা লাগে না, রবিন বলল, একবার পড়লেই যথেষ্ট। কম্পিউটারের মেমোরি ওর, কখনও ভোলে না।

আমারও এ রকম থাকলে ভাল হত। কাজে লাগত। মাঝে মাঝে তো মনে হয় নিজের নামই ভুলে যাচ্ছি। বললেন রাবাত।

বেশি ব্যস্ত থাকো বোধহয়, ফোড়ন কাটল মুসা। মহিলার কথা দিয়েই বলি–সব সময় তাজা, নতুন নতুন বুদ্ধি খেলে মাথার মধ্যে। সেজন্যে পুরানো কথা আর ধরে রাখতে পারো না, ভুলে যাও।

মেজাজ ভাল আছে নানার। মুসার কথায় কিছু মনে করলেন না।

ঢালু হয়ে গেছে এখন পথ। পথের মাথায় গেট পেরিয়ে কাস্টার স্টেট পার্কে ঢুকল গাড়ি।

হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন রাবাত, আরি, ওগুলো কি! গাড়ি থামি?, দিলেন।

রাস্তার ধারে জটলা করছে কতগুলো বুনো গাধা। গাড়িটাকে দেখে পাকা রাস্তায় খুরের খটাখট আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল। নাক বাড়িয়ে দিল জানালার কাছে।

মনে হয় খাবার চায়! মুসা বলল।

রাবাত বললেন, খাবার দিয়ে দিয়ে অভ্যাস খারাপ করে ফেলেছে লোকে। বাইসনেরাও এসে চাইবে না তো? তাহলেই সর্বনাশ। না দিলে হয়তো রেগেমেগে শিং দিয়ে গুতানোই শুরু করবে।

কিন্তু গাধার মত হ্যাংলামি করল না বাইসনেরা। রাস্তা থেকে বেশ দুরে রইল। গাড়ি থামিয়ে ভাল করে দেখার জন্যে নামলেন রাবাত, তখনও ফিরে তাকাল না জানোয়ারগুলো। আপনমনে ঘাস খেতে থাকল।

 এক সময় এত বাইসন ছিল এখানে, মাঠই দেখা যেত না, কালো হয়ে থাকত, কিশোর বলল। দল বেঁধে রেললাইনের কাছে চলে আসত। দাঁড়িয়ে থাকত লাইনের ওপর। গাড়ি আটকে দিত।

ক্যামেরা তুলে খটাখট শাটার টিপে যাচ্ছে রবিন। যতটা কাছে যাওয়া সভব, যাব। এতদূর থেকে লম্বা ঘাসের মধ্যে বাইসনগুলোকে আর বাইসন। মনে হচ্ছে না, পাথরের চাঙড়ের মত লাগছে।

খবরদার, সাবধান করল মুসা, ওই কাজও কোরো না। সাংঘাতিক বদমেজাজী জানোয়ার।

হ্যাঁ, মুসার কথায় সুর মেলালেন রাবাত, প্রায়ই অ্যাক্সিডেন্টের খবর শোনা যায়। সাহস দেখিয়ে ওগুলোর কাছে চলে যায় লোকে, বোকামির জন্যে মরে। শিঙের গুতোয় ভর্তা হয়। যে ভাবে আছে ওভাবেই থাকতে দাও, বিরক্ত করার দরকার নেই। কোন বুনো জানোয়ারকেই অতটা বিশ্বাস করা উচিত না।

বাইসনের পালকে পেছনে ফেলে এল ওরা। পথের পাশে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া গেল।

রাবাত বললেন, আমি একটু ঘুরে আসতে চাই। একটা রাস্তা দেখালেন তিনি। পাইন-ছাওয়া পাহাড়ের ঢালের দিকে চলে গেছে। পথের মাথায় কোন রাজপুরী, দেখার ইচ্ছে আছে কারও? এতদূর এসে না দেখে চলে যাওয়াটা বোকামি হয়ে যাবে।

আপত্তি নেই, জবাব দিল রবিন, যদি রাজপুরীতে রাক্ষস না থাকে।

ইগনিশন থেকে চাবি খুলে নিলেন রাবাত। কিশোরের দিকে তাকালেন, তুমি?

আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই থাকি।

রবিন আর মুসাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন রাবাত। কয়েক মিনিটেই হারিয়ে গেলেন ঘন বনের মধ্যে।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে কান পাতল কিশোর।

আরেকটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়েছে। এগিয়ে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। মনে হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে গাছপালার ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসবে একটা ধূসর লিংকন।

কিন্তু লিংকন নয়, এল একটা ক্যাম্পার। হুইলে বসা একজন বুড়ো লোক। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিশোরের উদ্দেশে হাত নাড়ল।

হাসল কিশোর। অতি-কল্পনা করে ফেলেছিল। কেউ অনুসরণ করছে না ওদের। মিলার পিছু নিয়ে থাকলে সারাক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারত না, এক না একসময় বেরিয়ে আসতেই হত। দেখা দিত। কিন্তু গত কয়েকশো মাইলের মধ্যে মিলারের চেহারাও দেখেনি ওরা। তারপরেও লোকটার কথা কেন যে মন থেকে তাড়াতে পারছে না, কে জানে! আসলে সন্দেহ করার মত আর কেউ নেই বলেই হয়তো এ রকম হচ্ছে।

কিশোরের মাথার ওপরে একটা গাছে পাখি ডেকে উঠল, ডানার শব্দ তুলে বেরিয়ে এল ওটা। বসতে বসতে বিরক্ত হয়ে গেল কিশোর। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। থেকেছে আসলে দেখার জন্যে, ওদের গাড়িটার কাছে কেউ আসে কিনা। সেই কেউটা আর কেউ নয়, মিলার। কিন্তু এখন ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হচ্ছে। প্রয়োজন ছিল না। এই অতি সন্দেহের কোন মানে নেই। মুসার আসতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। তাড়াতাড়ি গেলে এখনও ওদের ধরা যায়।

প্রায় দৌড়াতে শুরু করল কিশোর। চারপাশ থেকে ঘিরে এল জঙ্গল। প্রথম মোড়টার কাছে এসে ফিরে তাকাল। পেছনে রাস্তাটা দেখা যায় না। হারিয়ে গেছে গাছের ওপাশে।

আবার কানে এল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। থামল গাড়িটা। দরজা খুলে বন্ধ হলো। রাস্তার পাশে বুইকটার কাছে গাড়ি রেখেছে কেউ।

তবে কি তার সন্দেহই ঠিক ছিল? মিলারই এসেছে? শ্বাস টানা বেড়ে গেল কিশোরের। ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেছে। খানিকটা পিছিয়ে পাশে সরে গেল সে। এখন দেখা যাচ্ছে রাস্তাটা। রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। আগন্তুক। ভয় পেয়ে গেল কিলোর। মনে হলো খামচি দিয়ে ধরেছে কেউ হৃৎপিণ্ডটাকে। লুকিয়ে পড়তে হবে।

গাছপালার কারণে পাহাড়ের গোড়ায় বেশ ছায়া, অন্ধকারই বলা চলে। প্রচুর ঝোপঝাড় আছে। তবে ওগুলো বেশ দূরে। সে যেখানে রয়েছে সেখানে পথের ডান পাশে কয়েক গজ দূরে ম্যানজানিটা জাতীয় একধরনের গাছের ঝোপ, দেখতে পেল। বেশি বড় না। কাছাকাছি আর কিছু না দেখে ওটার দিকেই দৌড় দিল সে। প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। লুকিয়ে গেল ডালপাতার আড়ালে। আস্তে করে ডাল সরিয়ে ফাঁক করে উঁকি দিল রাস্তার দিকে।

লোকটার মুখ দেখতে পেল না। পা চোখে পড়ল কেবল। শোনা যাচ্ছে নিঃশ্বাসের খসখসে শব্দ। দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। পাহাড়ের দিকে মুখ। পায়ে বাদামী রঙের লোফার, পরনে জিনস। পাহাড়-জঙ্গলে আসার অভিজ্ঞতা নেই বোধহয়–অনুমান করল কিশোর, তাহলে এই পোশাক পরে আসত না। লোফারটা নতুন, জিনসেও ভাজ নেই তেমন, রঙ জ্বলেনি।

এখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল কেন? এগোচ্ছে না কেন? কিছু দেখেছে? রাস্তা। থেকে সরে আসার আগে কোন চিহ্ন রেখে এসেছে কিশোর?

ঘাবড়ে গেল সে। মনে হতে লাগল, বড় বেশি খোলামেলা জায়গায় রয়েছে। কেউ আছে সন্দেহ করে যদি ঘুরে ভাল করে ঝোপের দিকে তাকায়। লোকটা, তাকে দেখে ফেলবে।

বাঁ পাশের ঝোপের ভেতর শব্দ হলো। ঘুরে তাকাল লোকটা। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল একটা বুনো জানোয়ার।

কি বেরোল দেখতে পেল না কিশোর, তবে সুযোগটা কাজে লাগাল। হাতের থাবা আর হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করল লোকটাকে দেখার জন্যে।

ধক করে উঠল বুক। দম বন্ধ করে ফেলল। লোকটার হাতে পিস্তল!

হাই! ডাকল কে যেন রাস্তা থেকে।

পথের দিকে তাকাল আগন্তুক। চওড়া কানাওয়ালা ঐ হ্যাঁটের নিচে তার চেহারা এখন দেখতে পাচ্ছে কিশোর। হ্যারিস মিলারকে চিনতে ভুল করল না।

মাথা নামিয়ে ফেলল কিশোর। আগের চেয়ে বেশি। মাটিতে শরীর। মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করল, যাতে মিলারের চোখে না পড়ে। ঘামছে। উঠে দৌড় দেবে? না, উচিত হবে না। বেরোলেই তাকে দেখে ফেলবে মিলার।

হাই, আবার বলল মহিলা, আমাকে মনে আছে? কাছে চলে এসেছে।

নীরবে হাসল কিশোর। গলা শুনেই চিনতে পেরেছে। সেই মহিলা, ডরোথি, মাউন্ট রাশমোরে রাবাতকে পাকড়াও করেছিল যে।

আমি ভেবেছি আর দেখা হবে না আপনার সঙ্গে, মহিলা বলছে। লাঞ্চের পর দেখি আপনি নেই! কত খোঁজা খুঁজলাম। নেই তো নেইই। যেন হাওয়া! এখানে কি করছেন? পাহাড় দেখতে এসেছেন বুঝি?

মিলারের হাত দেখতে পাচ্ছে না কিশোর। পিস্তলটা কি করেছে বুঝতে পারল না। নিশ্চয় পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। মহিলা দেখেনি। দেখলে প্রশ্ন শুরু করে দিত। বিড়বিড় করে কি যেন বলল মিলার, ঠিক বোঝা গেল না–পেট্রল ফুরিয়ে গেছে, এ রকমই কি যেন বলল। মহিলা বকবক করতে লাগল। মিলারকে আবার খুঁজে পাওয়ার আনন্দে বিভোর। নিজের গাড়িতে তাকে লিফট দেয়ার প্রস্তাব দিল। মিলার যদি পাহাড়ের দিকে হাঁটতে যেতে চায়, তাহলে সঙ্গ দেবে। হাঁটার ব্যাপারেই আগ্রহ বেশি মহিলার।

রাজি হলো না মিলার। বলল, অনেক ঘোরাফেরা করেছে, এবার ফিরে যেতে চায়। গাড়ির দিকে এগোল সে। মহিলা ছাড়ল না। সঙ্গে সঙ্গে চলল। কথা বলার নেশায় পেয়েছে যেন। অনর্গল বকছে।

আবার মাথা তুলল কিশোর।

মিলারের হাত চেপে ধরেছে মহিলা। শক্ত করে ধরেছে, যেন আর হাওয়া। হতে না পারে মিলার।

হাসি পেল কিশোরের। মিলারের মনের অবস্থা কল্পনা করে হাসিটা বাড়ল। ভাল বিপদেই পড়েছে বেচারা। ওই মহিলার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া বড় কঠিন ব্যাপার।

গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল দুজনে।

মিনিট দুই পরে প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ কানে এল। চলে গেল গাড়ি দুটো।

ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। মুসাদের পিছু নেয়ার সময় নেই আর এখন। একটা পাথর দেখে তাতে বসে পড়ল। সঙ্গীদের আসার অপেক্ষা করতে লাগল।

.

১১.

 মুসারা এসে তাকে ওভাবেই পথের পাশে বসে থাকতে দেখল।

কি ব্যাপার, এ ভাবে বসে আছ কেন? মুসার প্রশ্ন।

ভ্রূকুটি করল রবিন। কিছু ঘটেছে? তোমার মুখ অমন শুকনো কেন?

পিস্তল নিয়ে ও আমাদের পিছে পিছে আসবে কল্পনাও করতে পারিনি, মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। রাবুনো, আপনার। কাছে আমাদের সবার মাপ চাওয়া উচিত।

তাই নাকি? কেন?

এখানেও এসে হাজির হয়েছে মিলার। পিস্তল আছে তার কাছে। একটু আগেও আপনার কথায় বিশ্বাস ছিল না আমার। কিন্তু এখন হয়েছে। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের পিছু নিয়েছে সে।

সব খুলে বলল কিশোর।

মহিলার কথায় আসতেই হাসতে শুরু করলেন রাবাত। চমৎকার! অচেনা কাউকে দেখলেই খাতির করতে আসে মেয়েমানুষটা। যাক, কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চিন্ত, মিলারকে আটকে রাখবে সে।

নানার দিকে তাকাল মুসা। নানা, অত হাসার কিছু নেই। ওর কাছে। পিস্তল আছে। পেছন থেকে গুলি মেরে দিলে গেছি। পুলিশকে জানানো দরকার।

আরও যাব পুলিশের কাছে মাথা নাড়লেন রাবাত। মোটেলে আগুন লাগলে যে অফিসারটা এসেছিল, মনে নেই? কি ভঙ্গিটাই না করল? যেন আমি একটা পাগল! নিজের চামড়া নিজেদেরই বাঁচাতে হবে আমাদের, কারও সাহায্য পাব না। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে অহেতুক আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল, যাই।

বড় করে দম নিলেন তিনি। বনের তাজা বাতাস টানলেন বুক ভরে। এই প্রথম তাকে নিশ্চিন্ত মনে হলো। এতদিনে ভার নামল আমার। মিলার যে পিছু নিয়েছে, এখন আমরা শিওর। তোদের সবার হাবভাব দেখে আমিও কিন্তু ভয় পেতে আরম্ভ করেছিলাম, সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো!

পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কিশোর। দুজনের চোখেই বিস্ময়।

আগে আগে চললেন রাবাত। পেছনে ছেলেরা।

গোধূলি বেলায় র‍্যাপিড সিটিতে পৌঁছল ওরা। একটা মোটেলে ঘর নিল। কাছের একটা ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে বার্গার খেয়ে এসে বিছানায় শুয়ে মহা আনন্দে নাক ডাকাতে শুরু করলেন রাবাত।

বিছানায় চিত হয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কি করে কাজটা করছে?

কার কথা বলছ? জানতে চাইল মুসা, মিলার, না নানা?

মিলার। যেখানেই যাচ্ছি ঠিক পিছে পিছে লেগে আছে। বের করে নিচ্ছে কোথায় আছি আমরা। কি ভাবে?

জবাব দিতে পারল না কেউ।

এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।

পরদিন সকালে সবাই উত্তেজিত হয়ে রইল। রাস্তায় কড়া নজর। সামনে পেছনে দুদিকেই চোখ রেখেছে। সাউথ ডাকোটা ব্যাডল্যান্ড ধরে চলার সময় পথে দর্শনীয় কিছু দেখার জন্যে যেখানেই নামছে, গাড়ির কাছাকাছি থাকছে ওরা, চোখে চোখে রাখার জন্যে। ব্যাডল্যান্ডের নানা রকম পাথরের স্তূপ। মুসার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে, অন্য কোন গ্রহে এসে হাজির হয়েছে, এটা পৃথিবী হতে পারে না! সব কিছুতেই যেন ভূতের ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছে সে। অস্বস্তির আরও একটা বড় কারণ, তার সন্দেহ, ওসব পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে গুলি চালাতে পারে মিলার।  

নানা, কি এমন আবিষ্কার করলে, যার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে সে? এই নিয়ে শতবার প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছে মুসা।

খুব জরুরী জিনিস, একই জবাব দিলেন রাবাত। না জানবি যতক্ষণ, ততক্ষণ নিরাপদ। নইলে বলতে আর অসুবিধে কি ছিল।

ছোটবড় নানা আকারের, নানা ধরনের পাথরের চাঙড় আর আলগা পাথরের স্তূপ পেরিয়ে এল গাড়ি। প্রেইরি ডগ নামে এক ধরনের প্রাণীর এলাকায় এসে ঢুকল। মাটিতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ওদের গর্ত। মুখের কাছে শুয়ে, রোদ পোয়াচ্ছে বিশাল ইঁদুরের মত দেখতে প্রাণীগুলো। গাড়িটাকে আসতে দেখলে বিচিত্র ভঙ্গিতে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে সটান সোজা করে দিচ্ছে শরীরটাকে, তীক্ষ্ণ টিইং টিইং ডাক ছেড়ে সতর্ক করছে একে অন্যকে, গাড়ি বেশি কাছে চলে এলে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ছে গর্তের ভেতর। পরক্ষণেই আবার মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে।

.

বেলা বারোটার মধ্যেই ব্যাডল্যান্ড দেখা হয়ে গেল ওদের। হাইওয়েতে ফিরে এসে পুবে রওনা হলো। ভূমি এখন সমতল। সামনে মাইলের পর মাইল রাস্তা লম্বা হয়ে পড়ে আছে। বাঁক নিয়েছে খুবই সামান্য, ওঠানামা নেই। বললেই চলে। সামনেও গাড়ি আছে প্রচুর, পেছনেও আসছে অনেক, কিন্তু লিংকনটাকে দেখা গেল না। দ্রুত চালাচ্ছেন রাবাত। একের পর এক গাড়িকে ওভারটেক করে পিছে ফেলে আসছেন। পাশ কাটানোর সময় দেখছেন ড্রাইভারের চেহারা।

বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। পেছনের গাড়িগুলোকে আগে চলে যেতে দিলেন। ড্রাইভারদের চেহারা দেখলেন। ওদের মধ্যে হ্যারিস মিলার নেই।

বুঝলাম না, অবশেষে বললেন তিনি, সামনেও নেই, পেছনেও নেই; আমরাও ওর পাশ কাটিয়ে আগে যাইনি, সে-ও আমাদের পাশ কাটিয়ে পেছনে যায়নি। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি আশেপাশেই কোথাও আছে। কোথায়?

পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে মুসা। হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। খাইছে! মোটরসাইকেল! নানা, ক্রিসেন্ট সিটির সেই গ্যাঙটা আসছে!

রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকালেন রাবাত। ক্রিসেন্ট সিটি এখান থেকে বহুদূর। কোথায় চলেছে ওরা? বখাটেদের সভা হচ্ছে নাকি কোথাও, যোগ। দিতে চলেছে?

সামরিক শৃঙ্খলায় দুই সারিতে এগিয়ে আসছে ওরা। পিঠ সোজা, দৃষ্টি সামনে স্থির। ক্রিসেন্ট সিটির সেই দলটাই। পরনে কালো চামড়ার পোশাক, বেল্ট আর দস্তানায় কাটা বসানো।

দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা। বুইকটাকে ধরে ফেলছে।

নানা, জোরে চালাও না কেন? উদ্বিগ্ন হয়ে বলল মুসা।

কারও ভয়ে পালাতে যাচ্ছি না আমরা, শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন রাবাত।

এত সাহস কেন? আগের বার দলটাকে কি করে নাকানি-চোবানি খাইয়েছেন রাবাত, মনে করে হাসল রবিন। এবারও তেমন কোন খেল দেখানোর অপেক্ষায় আছেন নাকি?

আমাদের ক্ষতি করতেই আসছে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই, রাবাত বললেন। ক্রিসেন্ট সিটির দলটা হলেও এতদিনে নিশ্চয় আমাদের কথা ভুলে গেছে।

কাছে চলে এল বাইকগুলো। ইঞ্জিনের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বুইকটাকে পাশ কাটানোর জন্যে বায়ে সরল দলপতি।

নানা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা, এই লোকটাই তোমাকে সেদিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল।

নাক দিয়ে শব্দ করলেন রাবাত। হুঁ! চেহারাটা কি করে রেখেছে। সারামুখে দাড়িগোফ! এগুলো মানুষ না বনমানুষ, তাই কেবল ভাবি!

গাড়ির পাশ কাটানোর সময় ফিরে তাকাল দলপতি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকেও তাকালেন রাবাত। চোখে চোখ আটকে গেল দুজনের। চোখ বড় বড় হয়ে গেল লোকটার। গোল হয়ে গেল মুখ। ধীরে ধীরে বিকৃত হাসিতে রূপ নিল সেটা। রাবাত আর ছেলেদের দেখিয়ে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু বলল।

হয়েছে কাজ, বলে উঠল রবিন, ধরবে এবার আমাদের! সেদিন হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ নেবে আজ!

বুইকটাকে ঘিরে ফেলল সাইকেলগুলো। গতি কমিয়ে ফেলেছে।

আচমকা গতি বাড়িয়ে দিলেন রাবাত। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বুইক। তোয়াক্কাই করল না সামনের সাইকেলগুলো। গতি বেড়ে গেল ওদেরও। আগে আগে চলেছে। যেন ওদেরকে ধরার চ্যালেঞ্জ করেছে গাড়িটাকে।

ওরা জানে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে পারব না ওদেরকে, তিক্তকণ্ঠে বললেন রাবাত, ঠিকই আন্দাজ করছে।

ব্রেক চেপে গতি কমিয়ে ফেললেন তিনি। বাঁয়ে তাকালেন। ধীরে ধীরে পাশে সরতে লাগলেন। জায়গা করে দিল পাশের সাইকেলটা। আরও সরালেন তিনি। আরেকটু জায়গা দিল সাইকেল। তাঁর মতলব বুঝতে পারল না।

হাইওয়ের পাশে মাঠ থেকে ধোয়া উঠছে। শুকনো ঘাস পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বাতাস প্রায় নেই, তাই উড়ে না গিয়ে জমির ওপরই স্থির হয়ে আছে ধোয়া, রাস্তার ওপরেও উঠে এসেছে একটা অংশ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার ভেতরে ঢুকে যাবেন রাবাত। ছেলেদের বললেন, শক্ত হয়ে বোসো!

কি করতে যাচ্ছেন বলার সময় নেই। ধোয়ার মধ্যে ঢুকে গেল গাড়ি। অদৃশ্য হয়ে গেল মোটরসাইকেল আরোহীরা। চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না কেবল কুণ্ডলী পাকানো ধূসরতা ছাড়া। এক মোচড়ে স্টিয়ারিঙের অনেকখানি বায়ে ঘুরিয়ে দিলেন রাবাত।

রাস্তা থেকে প্রায় উড়ে সরে এল গাড়িটা। একটা মুহর্তের জন্যে শূন্যে ঝুলে রইল যেন। তারপর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। রাস্তার ডিভাইডারের মাঝে নেমে এসেছে গাড়ি। মুসার মনে হলো, উল্টে যাবে। চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু অহেতুক ভয় পেয়েছে। গাড়ি ওল্টাল না। নিরাপদেই নেমে দাঁড়িয়ে গেল।

ভারী দম নিলেন রাবাত। পায়ের চাপ বাড়ালেন অ্যাক্সিলারেটরে। বনবন করে ঘুরতে লাগল চাকা। কয়েকবার পিছলে গিয়ে অবশেষে মাটি কামড়ে ধরল। ডিভাইডারের সমান্তরালে খাদের পাড় ধরে ছুটতে শুরু করল নাক বরাবর। ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।

আবার স্টিয়ারিং অনেকখানি ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। কঁকুনি খেতে খেতে রাস্তায় উঠে এল গাড়ি। আগের রাস্তা থেকে সরে চলে এসেছে আরেকটা রাস্তায়।

চিৎকার করে বলল মুসা, নানা, তুমি একটা জিনিয়াস!

এখনই চেঁচাবি না, সতর্ক করলেন রাবাত, আমরা কি করেছি বুঝতে দেরি হবে না ওদের। চলে আসবে তখন।

সামনে একটা এগজিট র‍্যাম্প দেখা গেল। সেটার দিকে ছুটলেন তিনি। সোজা নিচে নেমে এসে ছুটলেন আধ মাইল দূরের একটা গাছের জটলার দিকে। জটলার কাছে পৌঁছে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। রাস্তা থেকে আর দেখা যাবে না এটাকে।

আমাদের দেখবে না ওরা, বললেন তিনি। ওরা ভাববে ধোয়া পার হয়ে সোজা সামনে চলে গেছি আমরা, সেদিকেই নজর দেবে।

ভারী হয়ে এসেছে তার নিঃশ্বাস। তবে মৃদু হাসি ফুটেছে ঠোঁটের কোণে। হাইওয়ের দিকে চোখ।

 মিনিটখানেক পরেই দেখা গেল ওদের। সারি দিয়ে চলেছে পশ্চিমে। নজর সামনের দিকে। বুইকটাকে খুঁজছে।

খুব খারাপ লোক, রাবাত বললেন। আরও জ্বালাবে মনে হচ্ছে!

 কিন্তু আমাদের পেছনে লেগেছে কেন? রবিনের প্রশ্ন।

বর্ণবাদী হতে পারে, অনুমানে বলল মুসা।

মাথা নাড়ল কিশোর, আমার তা মনে হয় না। ওদের দলে কালো। লোকও আছে। শিওর, মিলার লাগিয়েছে। আমাদের কাবু করতে বলেছে ওদের। তারপর সে এসে ফর্মুলাটা কেড়ে নেবে। এর জন্যে নিশ্চয় টাকাও দিয়েছে ওদেরকে।

দূরে হারিয়ে গেল দলটা।

হঠাৎ হাত তুলল কিশোর, ওই, দেখুন! বললাম না, সব শয়তানি মিলারের!

ধূসর একটা লিংকন গাড়ি। কিশোর বলার মুহূর্ত পরই গতি কমিয়ে ফেলল।

বাহ, এসে গেছে, রাবাত বললেন।

 রবিন বলল, আর কোন সন্দেহ নেই, গ্যাঙকে টাকা খাইয়েছে মিলার।

তাকে সামনে চলে যেতে দেয়া উচিত, মুসা বলল। ও এগিয়ে গেলে আমরা এগোব। পেছনে থেকে যাব তখন।

কিন্তু তাকে সে-সুযোগ দিল না লিংকন। গেল না। পথের ধারে কাঁচা জায়গায় নেমে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। মুসারা যেখানে রয়েছে তার থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

.

১২.

 পার্কিং লাইট জ্বেলে দিয়ে অপেক্ষা করছে লিংকন।

শয়তানটা জানে আমরা এখানে আছি, রাবাত বললেন। কি করে জানল?

একটা পেট্রল কারকে আসতে দেখা গেল। লিংকনের কাছে গিয়ে থামল গাড়িটা। ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এল। দরজা খুলল মিলার। অফিসারের সঙ্গে কথা বলল। দুজনে এগিয়ে গেল লিংকনের সামনের দিকে। হুড তুলে ইঞ্জিন দেখতে লাগল।

ওসমস্ত অভিনয়, কিশোর বলল। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার ভান করছে। মিলার। গাড়ি থেকে বেরোল সে। কি করে আমাদের পেছনে লেগে রয়েছে, বোঝা দরকার।

কি করে? মুসার প্রশ্ন।

কোন ধরনের যন্ত্র রয়েছে আমাদের গাড়িতে, যেটা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। সেই সঙ্কেত ধরে জেনে যাচ্ছে সে, আমরা কোথায় আছি। সামনে না এসে আড়ালে থেকেও আমাদের অনুসরণ করতে পারার এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।

কিশোরের কথা বুঝে ফেললেন রাবাত। তারমানে বলতে চাইছ কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র লাগিয়ে দিয়েছে গাড়িতে!.

সোজা গাড়ির ট্রাংকের দিকে রওনা দিলেন তিনি। সুটকেসগুলো বের করে এনে মাটিতে ফেললেন। হ্যাঁচকা টানে সীটগুলো সরিয়ে নিয়ে এলেন সামনের দিকে।

সামনের সীটের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। তারপর হাত দিল ড্যাশবোর্ডের নিচে।

জিনিসটা খুঁজে বের করল অবশেষে রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল গাড়ির নিচে। সাবানের সমান একটা প্লাস্টিকের বাক্স বের করে আনল। পেট্রোল ট্যাংকে টেপ দিয়ে আটকানো ছিল।

ওর একটা দাঁতও রাখব না আমি! ভীষণ রাগে একটা পাথর তুলে নিলেন রাবাত। আমার ওপর গুপ্তচরগিরি!

যা দাঁড়ান, দাঁড়ান! বাধা দিল কিশোর। একটা গাছের ডালে রেখে দিল। যন্ত্রটা। হেসে বলল, থাক এটা এখানে, সঙ্কেত পাঠাক মিলারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, থাকুক ব্যাটা ওখানে বসে।

সুটকেসগুলো আবার আগের জায়গায় তুলে রাখল তিন গোয়েন্দা। গাড়ি স্টার্ট দিলেন রাবাত। রাস্তায় উঠলেন না। মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললেন উত্তরে। ক্রমে সরে যেতে থাকলেন হাইওয়ে থেকে

ফিরে তাকাল রবিন। এখনও অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে মিলার মাথা চুলকাচ্ছে অফিসার। মনে হচ্ছে, কোন কিছু অবাক করেছে তাকে।

কিছুদূর এগিয়ে একটা রাস্তা দেখা গেল। সেটাতে উঠে পড়লেন রাবাত। কয়েকটা গায়ের ভেতর দিয়ে গেছে পথটা। দুই ধারে মাঝে মাঝেই পড়ছে বিস্তৃত পশুচারণভূমি। গরু-ঘোড়া চরছে। দক্ষিণ ডাকোটার পিয়েরিতে পৌঁছে মিসৌরি নদী পার হয়ে এল ওরা। তারপর কয়েকটা ছোট ছোট শহর। পশুচারণভূমি অনেক আছে এখানেও।

মিনেসোটা সীমান্তের মাইল পঞ্চাশেক দূরে একটা ছোট সরাইয়ে রাত কাটাতে উঠল ওরা। গ্যারেজ আছে। তাতে তালা দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। গাড়ি ঢুকিয়ে রাখলেন রাবাত। সরাইয়ের মালিক এক হাসিখুশি মহিলা। নাম মিসেস আরগন। প্রচুর কথা বলে। সারাক্ষণ বকবক করে গেল। একাই কথা বলল। তার প্রশ্নের জবাব দিল কিনা কেউ, সেটাও লক্ষ করল না।

রাতে চমৎকার রান্না করে খাওয়াল মহিলা। সকালে দিল আঞ্চলিক নাস্তা।

আবার বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাতাস কোমল, ভেজা ভেজা। গালে এসে লাগছে।

মিনেসোটা পেরোনোর সময় হাইওয়ে থেকে দূরে রইল। তবে রোচেস্টারে এসে আবার হাইওয়েতে উঠল। উইসকনসিনের লা ক্রসের দিকে এগোল।

রাবাতের মেজাজ ভাল বললেন, মিলার আসুক আর না-ই আসুক, লা ক্রসে থামব আমরা। এখানে বড় হয়েছিল মুসার নানী। এত সুন্দর শহর খুব কমই আছে।

তা থাকা যায়। মিলারের চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিলেই পারি, মুসা বলল। তার যন্ত্রটা খুলে ফেলে দিয়েছি। আর পিছু নিতে পারবে না সে।

ওই শেয়ালটাকে বিশ্বাস নেই। আরেকটা বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারবে। পিছু নেয়ার জন্যে তৈরি হয়েই বেরিয়েছে সে। আমার বাড়িতেও নিশ্চয় ওধরনের যন্ত্র অনেক লাগিয়েছে। তাতে করে জেনে গেছে, আমি কি করছি।

আগে হলে এ সব কথায় গুরুত্ব দিত না কিশোর। কিন্তু এখন বিশ্বাস করল। মিলার ওদের পিছু নিয়েছে রাবাতের আবিষ্কৃত জিনিসটা ছিনিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই।

জিনিসটা কি? অনুমানও করতে পারল না কিশোর। কারণ করার মত কোন সূত্রই নেই তার হাতে। যন্ত্রটা খোঁজার সময় আবিষ্কারটাও পাওয়ার আশায় ছিল সে। নজর রেখেছিল। কিছুই চোখে পড়েনি। তবে কি রাবাতের পকেটে আছে? নাকি মাথায়? মাথায় থাকলে মিলার ওটা চুরি করবে কি করে?

মনটিরেতে ওই লোকটার সঙ্গে কি জন্যে দেখা করেছিল মিলার? ফিশারম্যান ওআর্ষে সেই যে লোকটা, দামী পোশাক ছিল যার পরনে, গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখেই যে কেটে পড়েছিল, উধাও হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তে। রাবাতের প্রতি তার তেমন নজর ছিল বলে মনে হয়নি, কোন আকর্ষণ ছিল না। মিলারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কেন?

ওই যে! রাবাতের আচমকা চিল্কারে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল কিশোর।

সামনে একটা নদী। ওপরে ব্রিজ। রাবাত জানালেন, নদীটা মিসিসিপি। নদীর মাঝখানে অনেক চড়া, দ্বীপের মত হয়ে আছে। ঘন গাছে ছাওয়া। নদীর অন্য পাড়ে একটা শহর।

ওইটাই লা ক্রস, বললেন তিনি। আজ রাতে ওখানে থাকব।

বিকেলে সেদিন নদীর পাড়ের একটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেলো ওরা। বেরিয়ে এল আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্যে। কাদার মধ্যে খোঁচাখুঁচি করছে মাড সোয়ালো পাখি। একটা দ্বীপের ধারে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে একটা বড় বক।

মার্ক টোয়েনের সময়ও নিশ্চয় এমনই ছিল মিসিসিপি, রাবাত বললেন। মনে আছে, হাকলবেরি ফিনের সঙ্গে একটা দ্বীপে গিয়ে লুকিয়েছিল টম সয়্যার? নিশ্চয় ওরকমই কোন দ্বীপ ছিল সেটা।

একটা কাজ করলে তো পারি, রবিন বলল, একটা জাহাজে চড়ে বসি। মোটেলের ডেস্কে লেখা দেখলাম এক ঘণ্টা পর পরই লা ক্রস থেকে বোট ছাড়ে, ভাটির দিকে যায়।

ঠিক! তুড়ি বাজালেন রাবাত। আমরাও যাব! তবে রাতে নয়, কাল সকালে।

পরদিন সকাল পৌনে এগারোটায় লা ক্রস কুইন নামে একটা জাহাজে চড়ে বসল ওরা। ওটা ডিজেল ইঞ্জিনে চলবে শুনে হতাশ হলেন রাবাত। তিনি আশা করেছিলেন, পুরানো ধরনের বাষ্পীয় ইঞ্জিনে দুই পাশে বড় বড় গরুর গাড়ির চাকার মত হুইল দিয়ে চালানো হবে। মিসিসিপির পুরানো ঐতিহ্য। যাত্রাটাই না বাতিল হয়, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি মুসা বোঝানোর চেষ্টা করল, ডিজেল ইঞ্জিন অনেক বেশি নিরাপদ। আগের বাষ্পীয় ইঞ্জিনগুলো তো দুর্ঘটনা ঘটাত। বিস্ফোরিত হয়ে গিয়ে কত বোট ডুবিয়ে দিয়েছে নদীতে।

খুশি করা গেল না রাবাতকে। তবে জাহাজ থেকে নেমে গেলেন না। ছেলেদের নিয়ে ওপরের ডেকে রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ালেন। বন্দরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। প্রচুর লোকজন নানা কাজে ব্যস্ত। একটু দূরের একটা পার্কে খেলা করছে বাচ্চারা। খুব উপভোগ করছিলেন তিনি। হঠাৎ একটা দৃশ্য রাগিয়ে দিল তাকে।

হাত তুলে চিৎকার করে উঠলেন, দেখো! দেখো, ওই দ্বিতীয় লোকটা!

তার নির্দেশিত দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। বন্দরে জেটির কাছে রেখে আসা বুইকটা দেখা যাচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। কৌতূহলী হয়ে গাড়িটা দেখছে।

চোখ বড় বড় করে ফেলল কিশোর। সেই লোকটা, মনটিরেতে যার সঙ্গে দেখা করেছিল মিলার।

ওই ব্যাটাই, তাই না? রাবাত বললেন। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!

মেইন ডেকে নামার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলেন তিনি। কিন্তু লোকজন। ভিড় করে উঠে আসছে। ইঞ্জিনও চালু হয়ে গেছে। কাঁপতে শুরু করেছে লা ক্রস কুইন। রাবাত মেইন ডেকে নেমে আসার আগেই চলতে শুরু করল জাহাজ। দূরত্ব বাড়ছে জেটির সঙ্গে।

.

১৩.

 জাহাজটার আবার জেটিতে ফিরতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। সবার আগে নামলেন রাবাত আর তিন গোয়েন্দা। দৌড় দিলেন বুইকের দিকে।

গাড়ির কোন ক্ষতি করা হয়নি। তালা ভেঙে দরজা খোলারও চিহ্ন নেই। হামাগুড়ি দিয়ে নিচে ঢুকে গেল মুসা, আবার যন্ত্রটন্ত্র কিছু লাগিয়ে দিয়েছে কিনা। দেখার জন্যে। ট্রাংক খুলে সুটকেসগুলো বের করে আনল রবিন আর কিশোর। ওগুলোর ভেতরও দেখল। রাবাত দেখলেন সীট আর ড্যাশবোর্ডের নিচে। হুড তুলে ইঞ্জিনের চারপাশের খালি জায়গায়ও দেখলেন।

নেই! ঘোষণা করলেন তিনি। তাহলে ওই ইবলিসটা এসেছিল কেন? আবার আমাদের খুঁজে বের করল কি ভাবে? যন্ত্রটা তো খুলে ফেলে দিয়েছি!

হয়তো অপেক্ষা করে করে, রবিন বলল।

অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল অন্যেরা।

আমার কথাই বলি। ধরা যাক, যাকে ধরতে চাই তার গন্তব্য জানা আছে আমার। পথের মাঝে তাকে হারিয়ে ফেললাম। বুঝলাম অন্য কোন ঘুরপথে পালিয়েছে। তখন তাকে ধরতে হলে কি করব? তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে এমন কোথাও বসে থাকব, যেখান দিয়ে ট্যুরিস্ট যাতায়াত করে। টুরিস্ট স্পট। অপেক্ষা করতে থাকব। নজর রাখব। লা ক্রসে এসে অবশ্যই আমি জাহাজঘাটায় খোঁজ নেব, আমার লোকটা জাহাজে উঠে বেড়াতে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্যে। কারণ বেশির ভাগ ট্যুরিস্টই এখানে এসে এই কাজ করে। এ মাথা ঝাঁকালেন রাবাত। ঠিক। এটাই ঘটেছে। চালাক ছেলে তুমি, রবিন। তোমরা তিনজনই খুব চালাক।

এখান থেকে কেটে পড়া উচিত আমাদের, রবিন বলল। এখন থেকে টুরিস্টরা যে সব জায়গায় যায়, সে-সব এড়িয়ে চলব আমরা। মেইন রোডে যাব না পারতপক্ষে। তাহলেই আর খুঁজে পাবে না আমাদের।

হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তাড়াতাড়ি কেটে পড়া উচিত এখন। একবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছে গেলে আর কিছু করতে পারবে না মিলার। ওর সুযোগ শেষ হয়ে যাবে।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই লা ক্রস থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বেশ কিছু ছোট ছোট রাস্তা দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে গেছে। সেগুলো ধরে এগোল। রাত কাটাল ইলিনয় রাজ্যের রকফোর্ড শহরের বাইরে একটা সরাইখানায়।

পরদিন সকালে শিকাগো শহরে পৌঁছল ওরা। ছেলেদের লেক শোর ড্রাইভ দেখাতে নিয়ে গেলেন রাবাত। লেক মিশিগানের দিকে মুখ করা প্রচুর। দামী দামী সৌখিন বাড়ি আর বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং দেখা গেল।

বাড়ি ফিরে বলতে পারবে এখন, মিশিগান হ্রদ দেখতে গিয়েছিলাম, হেসে বললেন রাবাত।

শহরের সবচেয়ে লম্বা একটা বাড়ির ওপরের তলার রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া সারল ওরা। তারপর পাড়ি জমাল ইনডিয়ানার ভেতর দিয়ে।

রাত কাটাতে থামল স্টারজিসে। রবিনের ক্যামেরার ফিল্ম ফুরিয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়কের ধারে ক্যামেরার দোকান আছে, তবে বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা। সুপারমার্কেটে গেল রবিন।

দোকানে ঢুকে কোণের দিকে একটা কাউন্টার দেখতে পেল। যে লোকটা তার কাছে ফিল্ম বিক্রি করল, সে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার। টাকা। দিয়ে দরজার দিকে এগোল রবিন। হঠাৎ পথরোধ করা হলো তার।

সেই সুবেশী লোকটা, মনটিরেতে মিলারের সঙ্গে দেখা করেছিল যে, লা ক্রস বন্দরে ওদের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল।

 চোখে চোখে তাকিয়ে রইল রবিন। কথা বেরোল না। নড়তে পারল না।

তোমার সঙ্গে নেই ওটা, ভোতা, খসখসে গলায় বলল লোকটা। তবে। অসুবিধে নেই। আদায় করে নিতে পারব।

রবিনের হাত চেপে ধরল সে। এসো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।

সরে যাওয়ার চেষ্টা করল রবিন। পারল না। কব্জিতে ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে চেপে বসেছে লোকটার আঙুল। স্বয়ংক্রিয় দরজার দিকে ওকে টেনে নিয়ে চলল লোকটা। দরজার কাছাকাছি আসতেই হুশ করে খুলে গেল পাল্লা। দরজার ওপাশে পার্কিং লট, তার ওপাশে…

ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে রবিনের মাথায়। লোকটার সঙ্গে নিশ্চয় মিলারও এসেছে। লুকিয়ে আছে কোথাও। রবিনকে আটকে রেখে দুজনে মিলে মুক্তিপণ হিসেবে রাবাতের কাছ থেকে তার আবিষ্কারটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। যদি দিতে অস্বীকার করেন রাবাত? ওকে কি করবে ওরা?

চিৎকার করে উঠল রবিন। লোকটার পায়ে গোড়ালি দিয়ে লাথি মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। লাগাতে পারল না। ঝট করে পা সরিয়ে নিয়েছে লোকটা। তারমানে জুডো-কারাত জানা আছে তারও। সহজ লোক নয়।

দরজার কাছে একটা ওয়াটার কুলার দেখতে পেয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রবিন। পানি বের করার হাতলটা চেপে ধরল। তাকে সরানোর জন্যে টানাটানি শুরু করল লোকটা। পারল না। টান লেগে পানি বেরিয়ে আসতে লাগল। পানি পড়তে লাগল রবিনের মুখে, গলায়; শার্ট ভিজে গেল। কিন্তু বোতাম ছাড়ল না। চিৎকারও বন্ধ করল না।

দেখো, ধমক দিয়ে বলল লোকটা, বন্ধ করো এ সব! জোরে বলল না সে, কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখল। যেন অবাধ্য ছেলেকে শাসন করছে বাবা।

চেঁচামেচি শুনে সেখানে এসে হাজির হলো অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার। কি হয়েছে?

না, কিছু না, শান্তকণ্ঠে বলল লোকটা। রবিনের কব্জি ছাড়েনি। তার হাতল ধরা হাতটাও ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। ম্যানেজারকে বলল, রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ছেলেটা…

মিথ্যে কথা! আরও জোরে চিৎকার করে উঠল রবিন। এই লোক আমার বাবা নয়! জীবনে চোখেও দেখিনি একে! ও একটা ডাকাত! হোটেলে আগুন লাগিয়েছে! কিডন্যাপার! জলদি পুলিশ ডাকুন!

ছোটখাট ভিড় জমে গেল। চার-পাঁচজন দোকান-কর্মচারী ঘোট ঠেলাগাড়িতে করে মাল নিয়ে চলেছিল, দাঁড়িয়ে গেল। ওদের মধ্যে একজন তরুণ ক্লার্কও রয়েছে, লাল জ্যাকেট পরা।

হ্যারি, ওকে বলল ম্যানেজার, যাও তো, শেরিফের অফিসে ফোন। করো। এখানে কি হয়েছে বলবে। ওরা এসে যা করার করুক।

আশ্চর্য! ধমকে উঠল মিলারের সঙ্গী। এর মধ্যে আবার পুলিশ ডাকাডাকি কেন? গলার স্বর খাদে নামিয়ে ম্যানেজারকে বলল, আসল কথা। কি জানেন? নেশা ধরেছে ও। বাড়ি থেকে পালিয়েছে। শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ছেলেটাকে…

ও আমার বাবা নয়! জোরে চিৎকার করে উঠল রবিন। আমার নাম পর্যন্ত জানে না, জিজ্ঞেস করে দেখুন?

লোকটার দিকে তাকাল ম্যানেজার।

জিজ্ঞেস করুন ওকে! আবার বলল রবিন। আমার নাম বলতে বলুন। বলতে পারবে না।

 মসৃণ হাসি হাসল লোকটা। নিজের ছেলের নাম আবার বলতে পারে না কেউ? বনেট। ওর নাম বনেট।

কুলারের হাতল ছেড়ে দিল রবিন। পকেট থেকে বের করে আনল মানিব্যাগ। তার ভেতর থেকে স্টুডেন্ট আইডেনটিটি কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিল ম্যানেজারের দিকে, দেখুন, আমার নাম আসলে কি? ছবিও আছে। চিনতে অসুবিধে হবে না আপনার।

কার্ডটা হাতে নিল ম্যানেজার।

মিলারের সঙ্গী ভাবেনি রবিনের সঙ্গে কার্ড আছে। আর একটা মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। দোকান থেকে বেরিয়ে পালাল।

.

১৪.

 সুপারমার্কেটের ডেইরি সেকশনের পেছনে সেঁতসেঁতে ছোট ঘরটায় বসে ডেপুটি শেরিফের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে রবিন। কিন্তু বোঝানো সহজ হচ্ছে না।

কেন তোমাদের পেছনে লোক লাগবে? জিজ্ঞেস করল অফিসার।

মিস্টার রাবাত বলেছেন, তার আবিষ্কৃত একটা জিনিসের ফর্মুলা নিয়ে। চলেছেন। সেটাই ছিনিয়ে নিতে চাইছে লোকটা।

রাবাত কে জানতে চাইল অফিসার। তার বন্ধুর নানা, জানাল রবিন। কি জিনিস আবিষ্কার করেছেন রাবাত, জানে না সে। তাদেরকে বলেননি তিনি। নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাবেন। বিশেষ কারও কাছে বিক্রি করবেন ওটা। সেই বিশেষ লোকটি কে, তা-ও জানে না সে। শেষে বলল, মিস্টার রাবাত বলেন, আমাদের জন্যে জানাটা নাকি বিপজ্জনক। না জানলেই ভাল।

কিন্তু বিপদটা তো এড়াতে পারলে না, অফিসার বলল।

মাথা ঝাঁকাল রবিন। অফিসার তাকে মোটেলে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দিলে খুশি হয়েই রাজি হলো।

গাড়িতে করে তাকে পৌঁছে দিল অফিসার।

কি ঘটেছে শুনে রেগে আগুন হলেন রাবাত। কি আবিষ্কার করেছেন, অফিসারকে জানাতে রাজি নন মোটেও। রকি বীচ থেকে যে তাদের পিছু নেয়া হয়েছে, সব খুলে বললেন। কোন কথা বাদ দিলেন না। মোটেলে আগুন লাগার কথাও নয়। পেট্রোল ট্যাংকের নিচে যন্ত্র আটকে দেয়ার কথা বললেন। এমনকি লা ক্রসে লোকটা যে বুইকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল সে-কথাও।

চুপচাপ শুনল অফিসার। শৈষ দিকে অবিশ্বাসের ভঙ্গি দেখা দিল তার চোখেমুখে। বলল, তাই নাকি? আর কিছু ঘটেছে?

কেন, যথেষ্ট হয়নি? আরও কিছু ঘটুক, চান নাকি? রেগে উঠলেন রাবাত।

না না, তা বলিনি।

মাউন্ট সেইন্ট হেলেনে দেখা গাড়িটার নম্বর অফিসারকে জানাল কিশোর। রিপোর্ট লিখে নিল অফিসার। তার নিচে সই করলেন রাবাত আর রবিন।

বেরিয়ে গেল অফিসার। চেহারা দেখেই বোঝা গেল, ওদের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি সে।

ওই দুই ব্যাটাকে ধরতে পারবে না পুলিশ, রাবাত বললেন। এতক্ষণে শহর ছেড়ে পালিয়েছে ওরা।

তার কথার প্রতিবাদ করল না কেউ।

রাতে বিছানায় শুয়ে কিশোর বলল, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না।

 মুসা কেবল গোঙাল। ঘুমে ভারী হয়ে এসেছে চোখ।

রবিন জিজ্ঞেস করল, কি?

তোমাকে কিডন্যাপ করতে চাইল কেন?

রাবুনানার আবিষ্কার আদায় করার জন্যে।

সেটা তো বুঝেছি। আমি বলতে চাইছি, তোমাকে কেন? আমাকে আর মুসাকে নয় কেন?

কি জানি। হয়তো তক্কে তক্কে ছিল, যাকে একা পেয়েছে তাকেই ধরেছে। আমাদের আগে তোমাদের পেলে তোমাদেরও ধরত।

তন্দ্রা টুটে গেছে মুসার, শান্তশিষ্ট দেখেছে তো, হয়তো, ভেবেছে ওকে ধরাটাই নিরাপদ।

হাসল কিশোর। শান্ত যে কি পরিমাণ, সেটা তো বুঝিয়ে দিয়েছে। চিন্তায় ডুবে গেল সে। আনমনে বিড়বিড় করতে লাগল, লোকটা বলেছে–তোমাদের সঙ্গে জিনিসটা নেই। আমরা ধারণা করছি, জিনিসটা রাবুনোর আবিষ্কার। কিন্তু অন্য কিছুও হতে পারে।

কিশোর, রবিন বলল, ব্যাপারটা নিয়ে কালও আলোচনা করা যাবে। এখন আর পারছি না। আমার ঘুম পাচ্ছে।

আমারও, মুসা বলল। আমি ভেবেছিলাম, ছুটি কাটাতে বেরিয়েছি। কিন্তু ছুটি যে এত টেনশনের, কল্পনাও করিনি।

এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। বলল, ঠিক আছে, তোমরা ঘুমাও। ঘুমিয়ে পড়ল রবিন আর মুসা। চুপচাপ ছাতের দিকে তাকিয়ে রইল। কিশোর। কোন শব্দ নেই। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে কেবল রাবুনানার নাসিকা গর্জনের শব্দ।