১. রান্নাঘরের দরজা

ডাকাতের পিছে – তিন গোয়েন্দা ভলিউম ২৮
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ১৯৯৫

০১.

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। দড়াম করে বন্ধ হলো। গটমট করে ভেতরে ঢুকলেন। মিসেস আমান। চোয়াল কঠিন। ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট চেপে বসা। হ্যান্ডব্যাগটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে।

আর সহ্য হয় না এই অত্যাচার! কপাল চাপড়ে বললেন তিনি। ইচ্ছে করছে গুলি করে শেষ করে দিই। তারপর আমার জেল-ফাঁসি যা হয় হোক!

কি হয়েছে, মা? শঙ্কিত হয়ে উঠেছে মুসা।

কি আর! তোর নানা! আবার একটা অঘটন ঘটিয়েছে!

আবার কি করল?

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রথমে মুসার দিকে তাকালেন মিসেস আমান। তারপর একে একে তার দুই বন্ধু কিশোর আর রবিনের দিকে। ডাইনিং টেবিলে বসে বিস্কুট খাচ্ছে ওরা।

পানি ছিটানোর জন্যে একটা ফোয়ারা বসিয়ে দিয়ে এসেছে গির্জার হলরুমে। নতুন ধরনের একটা স্প্রিঙ্কলার সিসটেম। ঘর ধোয়ার জন্যে। ভালমানুষী করে দান করেছে। করেছে, ভাল কথা, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের আরও একখান আবিষ্কার লাগিয়ে দিয়ে এসেছে। ফোয়ারা চালু করার একটা যন্ত্র। সুইচ টিপলে হালকা ধোয়া তৈরি করে যন্ত্রটা, সেই ধোয়া গিয়ে লাগে সিসটেমে, চালু হয়ে যায়। তাতেই হয়েছে সর্বনাশ। হলঘরটা ভাড়া নিয়ে মহিলারা ফ্যাশন শো করছিল। এই সময় জ্বালানো সিগারেট নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লেন পাদ্রী সাহেব। ব্যস, কোন দিক থেকে যে কি ঘটে গেল, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল ঘরের সমস্ত লোক। ফ্যাশন শো মাথায় উঠল। মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসেছে কোম্পানি। টাকাটা বাবাকে দিতে হবে। হুমকি দিয়েছে, নইলে কেস করে দেবে তার নামে। বাজারে গিয়েছিলাম। মিসেস গিলবার্ট আমাকে এ খবর জানাল। কেন বাপু, দুনিয়ায় এত জিনিস থাকতে ধোয়াকে ট্রিগার করার কুবুদ্ধি কেন? আর কি কিছু ছিল না?

হাসি দমন করার অনেক চেষ্টা করেও পারল না মুসা। বলল, নানা হয়তো ভেবেছিল এখন দুনিয়া জুড়ে সিগারেট বিরোধী আন্দোলন চলছে, ধোয়া কোন সমস্যা নয়। তা ছাড়া গির্জার ভেতর তো কেউ সিগারেট খায় না। স্বয়ং পাদ্রী সাহেবই যে এই কাণ্ডটা করে বসবেন, তা কি আর নানা ভেবেছিল।

দেখ, অত হাসবি না! গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা কর! ধমকে উঠলেন মিসেস আমান। কিন্তু বেশিক্ষণ তিনিও গভীর থাকতে পারলেন না। ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। আর ঠেকানো গেল না ছেলেদের। হাসির রোল পড়ে গেল।

 কিশোর বলল, কাজটা তিনি ভালই করতে গিয়েছিলেন। দোষটা তো। পাদ্রী সাহেবের।

মোটেও তা নয়, আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন মিসেস আমান। দোষটা আমার বাবারই। অত সেনসিটিভ একটা ট্রিগার কেন বানাতে গেল? আর সেটা বসাতেই বা গেল কেন ওরকম একটা জায়গায়, যেখানে পাবলিক মীটিঙ চলে? প্রার্থনার সময় কেউ খায় না বটে, কিন্তু অন্য অনুষ্ঠান চলার সময় যে কেউ সিগারেট খেতে পারে ওখানে। সরকারী চাকরিতে যতদিন ছিল, ভাল। ছিল। অকাজ করার সময় পেত না তখন। রিটায়ার করার পরই ধরেছে। ভূতে। খালি আবিষ্কারের চিন্তা। উদ্ভট সব ভাবনা মাথায় ঘোরে। একবার বানাল তেরপলের ছাতওয়ালা একটা বাড়ি। ভাজ করে সরিয়ে রাখা যায় ওই ছাত। কিন্তু তার নিচে আর বাস করার সাধ্য হলো না কারও। টানা-হেঁচড়ায় এত ছিদ্র হয়ে গেল, বাইরে বৃষ্টি পড়ার আগেই ভেতরে পড়ে।

আবার একচোট হাসাহাসির পর মিসেস আমান বললেন, আরও কত কাণ্ড যে করেছে, যদি জানতে! সারাজীবনে জরিমানা যা দিয়েছে, সেগুলো। জমিয়ে রাখতে পারলে এখন বড়লোক থাকতাম আমরা। বাবা ভীষণ বদমেজাজী। কথায় কথায় লোকের সঙ্গে ঝগড়া বাধায়, হাতাহাতি করতেও ছাড়ে না। আমাদের বাড়ির সামনে একটা এলম গাছ আছে। কি নাকি রোগ হয়েছে ওটার, রেখে দিলে আশপাশের অন্য গাছেরও হতে পারে এই ভয়ে একদিন পার্ক ডিপার্টমেন্টের লোকেরা এসে সেটা কাটতে চাইল। বেকে বসল বাবা। কিছুতেই কাটতে দেবে না। কথা কাটাকাটি হতে হতে একসময় ঘর থেকে গিয়ে হকি স্টিক নিয়ে এল। এলোপাতাড়ি পেটানো শুরু করল। পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরে দিল বাবাকে। উকিলের পেছনে অনেক টাকা খরচ করে শেষে বের করে আনা হলো। মোটা টাকা জরিমানা তো করলেনই জজ সাহেব, শাসিয়ে দিলেন, ফের এ রকম করলে জেল-জরিমানা কোনটাই আর মাপ হবে না।

চুপ করে দম নিলেন মিসেস আমান। তারপর বললেন, এখন ধরেছে নিউ ইয়র্ক যাবার বাতিক!

খাইছে! হাসি চলে গেল মুসার মুখ থেকে। রকি বীচ থেকে নাকি আর কোথাও নড়বে না?

একেবারে যাচ্ছে না তো। একটা বিশেষ কাজে যেতে চায়। তার মতে কাজটা খুবই জরুরী। কি একটা আবিষ্কার করেছে। জিনিসটা কি, এ ব্যাপারে কোন ধারণা দিতেও নারাজ। নিউ ইয়র্ক যাওয়া ছাড়া নাকি ওটার গতি করা যাবে না। অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি–না গিয়ে কিছু করা যায়। কিনা, শোনে না। বলে টেলিফোন কিংবা চিঠিতে কাজ হবে না, নিজেকেই যেতে হবে। সামনাসামনি প্রচুর আলোচনার দরকার।

গেলে যাক না। অসুবিধেটা কি?

অসুবিধে আছে। কার কাছে যাচ্ছে, কিছু জানি না। যাওয়ার পর সেই লোক যদি দেখা করতে রাজি না হয়? যদি কাউকে দিয়ে বলিয়ে দেয়-বাড়ি যান, চিঠিতে যোগাযোগ করুনগে? কাণ্ডটা কি করবে জানিস না? জোর করে ঢৈাকার চেষ্টা করবে!

দূর, বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করছ তুমি।

দেখ, আমার বাপকে আমি চিনি! না শব্দটা শুনতে রাজি নয় বাবা। তার হলো বদমেজাজ। যার কাছে যাচ্ছে যদি সে দেখা করেও, বাবার ধারণার সঙ্গে একমত হতে না পারে, তাহলেও যাবে রেগে। তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসতে পারে।

মা, তুমি শুধু শুধু…

মুসার কথায় কান দিলেন না মিসেস আমান। আমি জানি এইই ঘটবে! খেপে গিয়ে অনর্থ ঘটাবে বাবা। ওরা তখন পুলিশ ডাকবে। মনে নেই, সৌরশক্তির সাহায্যে পানি ফুটানোর যন্ত্র আবিষ্কার করে কি গোলমালটাই না পাকিয়েছিল? ঘরের আর্দ্রতা দূর করার যন্ত্র নিয়েও একই অবস্থা। যন্ত্রটা ঠিকমতই কাজ করছিল, ভাঁজ করা ছাতের মত হয়নি। তবে বাবার আগেই নাকি ওই যন্ত্র আবিষ্কার করে বসেছিল আরেকজন। বাবা গেল খেপে। বলে। বেড়াতে লাগল, তার ফর্মুলা চুরি করেছে ওই লোক। ভাবো একবার! সেই লোক থাকে আইওয়ায়। কোথায় রকি বীচ আর কোথায় আইওয়া। এত দূরে বসে কি করে চুরিটা করল? এ সব ফালতু কথা বলার কোন মানে আছে? সেই লোকের কানে গেলে নির্ঘাত কেস ঠুকে বসত, দিত মানহানির মামলা করে।

চুপ হয়ে গেল মুসা।

পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। বিস্কুট খাওয়া ভুলে গেছে।

মিসেস আমান বললেন, বুঝতে পারছি না, রওনা হয়েই না আরেকটা অঘটন ঘটিয়ে দেয়!

দেবে না, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল মুসা। অর্থাৎ তাকে করতে দেয়া হবে না। তুমি কিছু ভেব না, মা। আমরা পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে প্লেনে তুলে দিয়ে আসব।

প্লেনে গেলে তো! ঠিক করেছে, মোটরগাড়িতে যাবে। নিজে গাড়ি চালিয়ে। মনটানার ভেতর দিয়ে নাকি যায়নি কখনও। ওরিগন আর ওয়াশিংটনও দেখেনি। এবার সব দেখতে চায়। আরও যুক্তি আছে, গাড়ি চালানোর সময় নাকি তার মগজ সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তার বিশ্বাস, সাংঘাতিক কোন আবিষ্কারও করে বসতে পারে ওই সময়! এ সুযোগ। কোনোমতেই হারাতে রাজি নয়।

হেসে ফেলল মুসা। মা, এতই যখন দুশ্চিন্তা, নানার সঙ্গে তুমিও চলে যাও না কেন? ঘর নিয়ে ভেব না। আমি আর বাবা মিলে সামলে নিতে পারব।

আমি! মাথা খারাপ! ভাল করেই জানিস, বাবার সঙ্গে দশটা সেকেন্ডও বনে না আমার! গাড়িতেই খুনোখুনি বেধে যাবে! তার চেয়ে এক কাজ কর, তুইই চলে যা। বেড়াতে খারাপ লাগবে না।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। মা, সত্যি বলছ!

বলছি। যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব। তবে একটা শর্ত আছে–বাবাকে সব গোলমাল থেকে দূরে রাখতে হবে। পুলিশ তাকে ধরবে না, সে কারও মাথা ফাটাবে না, তুই সব ঠেকাবি।

আমার সাধ্যমত চেষ্টা আমি করব। কিন্তু নানাকে একা সামলানো…

খুব কঠিন, এই তো? আমিও সেটা জানি। সেজন্যেই ভাবছি, আরেক কাজ করা যেতে পারে–তোরা তিনজনেই চলে যা। ঘোষণা করলেন তিনি, তিন গোয়েন্দাকে ভাড়া করতে রাজি আছি। প্রয়োজনে খরচাপাতিও দেব। আমার বাবাকে পাহারা দিয়ে নিরাপদে নিউ ইয়র্ক পৌঁছে দিতে হবে। সেখানেও তার নিরাপত্তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

হাসল কিশোর। চকলেট মেশানো বড় একটা বিস্কুটের আধখানা কামড়ে কেটে নিয়ে বলল, কিন্তু, আন্টি, আমরা গোয়েন্দা, বডিগার্ড নই।

তা ঠিক, গোয়েন্দা আর বডিগার্ড এক নয়, মেনে নিলেন মিসেস আমান। কিন্তু গোয়েন্দারা আর কোন কাজ করতে পারবে না, এমনও কোন বিধিনিষেধ নেই। বডিগার্ডই ভাবছ কেন? বেড়াতে যাচ্ছ, সেই সময়ে একজন লোকের কিছুটা খেয়াল রাখছ, এই তো। বিনিময়ে বেড়ানোর খরচটা পাবে।

বডিগার্ডের চেয়ে খারাপ, ফোড়ন কাটল মুসা, মানুষের কেয়ারটেকার। তবে গাড়িতে করে নিউ ইয়র্ক যাওয়া সত্যি লোভনীয়। এ দিক বিবেচনা করে যে কোন কাজ করতে রাজি আছি আমি। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কি বলো?

কিশোর তাকাল রবিনের দিকে। নথি-গবেষকের মতামত চায়।

আমি রাজি, বলে দিল রবিন। মুসার নানা আমাদেরও নানা। তাঁর কেয়ারটেকার হতে আপত্তি নেই আমার।

 কিন্তু নানাটা কি জিনিস ভাবতে হবে! চিন্তায় পড়ে গেছে মুসা। বেরিয়ে না শেষে পস্তাতে হয়!

কেন? ভুরু নাচাল কিশোর।

নানার কেয়ারটেকার হওয়ার চেয়ে খেপা গণ্ডারের কেয়ারটেকার হওয়া অনেক সহজ। সব কিছুতে সন্দেহ। মেজাজের ঠিকঠিকানা নেই। এই ভাল তো এই খারাপ। প্রতি মুহূর্তে কত আর সামলানো যায়!

তা বটে, একমত হলেন মা। বাবার ধারণা, তার মত সৃষ্টিশীল মানুষদের পেছনে সব সময় লোক লেগে থাকে–বলে, পাগল, মাথায় ছিট। আড়চোখে তাকায়, ব্যঙ্গ করে, উল্টোপাল্টা কথা বলে। রেগে গিয়ে তাদের। সঙ্গে ঝগড়া বাধালে দোষ দেয়া যায় না। আরেক ধরনের লোক আছে, তারাও পিছে লাগে, তারা আবিষ্কারের ফর্মুলা ছিনিয়ে নিতে চায়। সেজন্যেই এত সন্দেহ…

টেলিফোন বাজল।

সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করলেন মিসেস আমান। কে আবার করল?

 উঠে দাঁড়াল মুসা। তুমি বসো। আমি ধরছি।

রিসিভার কানে ঠেকিয়ে হালো বলল সে। নীরবে শুনতে লাগল। ওপাশের কথা। তারপর বলল, মাকে বলছি!

 রিসিভার রেখে ঘুরে দাঁড়াল সে। মা, মিস্টার পেইত্রি। নানার বাড়ির। উল্টোদিকে যার বাড়ি। আজ নাকি নানার সঙ্গে তার দাবা খেলার কথা ছিল। গিয়ে দেখেন নানা নেই। সারা বাড়ি খুঁজেছেন, কোথাও পাননি। পেছনের দরজা খোলা। রান্নাঘরে সিঙ্কের কল খোলা, পানি পড়ছে। এখুনি পুলিশকে খবর দিতে বললেন।

হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছে। চলে আসবে। এত তাড়াতাড়ি পুলিশে খবর দেয়ার দরকার নেই।

মা, গাড়িটা নাকি ড্রাইভওয়েতেই আছে। হাঁটতে গেলেও কি দরজা খোলা রেখে যেত? কলই বা খোলা কেন?

হু! তা-ও কথা! চল, যাই!

উঠে দাঁড়াল কিশোর। আপনার যাওয়া লাগবে না, আন্টি, আগে আমরাই যাই। তিন গোয়েন্দার আসল কাজ পাওয়া গেছে, রহস্য। দরকার হলে আপনাকে ফোন করব।

.

০২.

মিস্টার রাবাতের বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন মিস্টার পেইত্রি। রোগাটে শরীর, চুলের অনেকখানি ধূসর হয়ে এসেছে, মুখের বাদামী চামড়া কুঁচকানো। বসন্তের এই উজ্জ্বল আলোকিত দিনেও মুখ বাদলের মেঘলা আকাশের মত অন্ধকার।

মুসাকে বললেন, তোমার নানার স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মেলে না! দাবা খেলার কথা দিয়ে কখনও মিস করেনি। তা ছাড়া আগের খেলায় হেরে গিয়ে খেপে আছে আমাকে হারানোর জন্যে। কোন ব্যাপারেই হার সহ্য করতে পারে না সে।

জানি, পেইত্রির সঙ্গে মুসাও একমত।

সামনের দরজায় তালা নেই। ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পেছন পেছন এলেন পেইত্রি। নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটেছে। এ ভাবে দরজা খুলে, কল ছেড়ে রেখে দূরে যাওয়ার কথা নয়। কোন কারণে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। হয়তো এমন কিছু চোখে পড়েছিল, কল বন্ধ করার কথাও মনে ছিল না।

রান্নাঘরে ঢুকল গোয়েন্দারা।

সিঙ্কের ওপরে কলটার দিকে তাকাল কিশোর। ভঙ্গি দেখে মনে হলো, তার প্রশ্নের জবাব চাইছে ওটার কাছে। বিড়বিড় করে বলল, পানি গরম। করতে যাচ্ছিলেন। কেটলির ঢাকনা খোলা। সিঙ্ক থেকে পানি নেয়ার সময়। জানালা দিয়ে সত্যি কিছু চোখে পড়েছিল তার? কি?

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ভাবছে, কি দেখেছিলেন রাবাত? লনের একটা অংশ চোখে পড়ছে। তার ওপারে সুন্দর করে ছাটা পাতাবাহারের বেড়া আলাদা করে দিয়েছে পাশের বাড়ির সীমানাকে। এ পাশটা যেমন পরিচ্ছন্ন, ওপাশটা তেমনি নোংরা। আগাছা হয়ে আছে, কেউ কাটে না। বাড়িটাও মেরামত হয় না কতদিন কে জানে। দরজার পাল্লা আর জানালার ফ্রেমের রঙ মলিন হয়ে গেছে, উঠে গেছে অনেক জায়গায়। ছাতের অবস্থা আরও খারাপ। বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে নাকি বাড়ির মালিক? নাহলে এত অযত্ন কেন?

ওটা কার বাড়ি? পেইত্রিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হ্যারিস মিলারের।

হাত নেড়ে মুসা বলল, নানা ওখানে যায়নি। ছায়া দেখতে পারে না। একজন আরেকজনের। দেখলেই ঝগড়া।

কিন্তু কেউ একজন গেছে ওই পাতাবাহারের বেড়া ফাঁক করে। দেখো, ডাল ভেঙে আছে। ভাঙা গোড়াটা এখনও সাদা, তারমানে গেছে যে বেশি দেরিও হয়নি।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠান দিয়ে বেড়ার দিকে এগোল ওরা।

বিড়বিড় করে নিজেকেই বোঝাল যেন কিশোর, বেড়াটা বেশি উঁচু না। মিস্টার রাবাতের পক্ষে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব। তার পায়ে লেগেই ডালগুলো ভেঙে থাকতে পারে।

গুঙিয়ে উঠলেন পেইত্রি। আবারও ঢুকল। আগের বার কি কাণ্ডটাই না। করল! গুলি করার জন্যে বন্দুক বের করে ফেলেছিল মিলার। পাশের বাড়ির মিসেস ডনিগান পুলিশকে ফোন না করলে খুনই হয়ে যেত একটা। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে রাবাত-মিলার নাকি তার ঘাস কাটার মেশিন চুরি করেছে। আর মিলার বলেছে, রাবাত তার গ্যারেজের তালা ভেঙে ঢুকেছে। পুলিশ একটা মিটমাট করে ক্রিয়ে গেছে বটে, তবে তাতে কোনই সমাধান হয়নি। শত্রুতা বন্ধ হয়নি দুজনের। হবেও না।

তাই নাকি! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আবারও ঢুকে থাকলে তো খুব খারাপ কাজ করেছেন। ধরে আনা দরকার।

গেলে তো আনবে।

 দেখি গিয়ে।

বেড়া ডিঙানোর সময় আরও কয়েকটা ডাল ভাঙল কিশোর। তার সঙ্গী হলো মুসা আর রবিন। দ্বিধা করতে লাগলেন পেইত্রি। তবে শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে তিনিও ঢুকলেন মিলারের বাড়িতে।

অনেক ঘুরে পুরানো বিল্ডিঙটার দিকে এগোল চারজনে।

বেশি দূর যেতে হলো না। বাড়ি ছাড়িয়ে একটা গ্যারেজ, তার ওপাশে কাচ আর কাঠের তৈরি একটা গ্রীনহাউস। বাড়িটার মত অবহেলার শিকার নয়। এটা। কাঠের ফ্রেমগুলোতে নতুন সাদা রঙ করা। দেয়াল আর ছাতের কাচগুলোও পরিষ্কার, তবে কুয়াশা পড়েই বোধহয় ঘোলা হয়ে আছে।

হঠাৎ গ্রীনহাউসের আরেক প্রান্ত থেকে দরাজ গলায় ছড়া গান শোনা গেল:

এবার তুমি কোথায় যাবে,
পাজির রাজা মিলার?
ঘাড়টি তোমার মটকে দেবে,
পুলিশ ক্যাপ্টেন ফ্লেচার!

 খাইছে! বলে উঠল মুসা, নানা!

কথা শুনে ওপাশ থেকে প্রশ্ন হলো, কে? গ্রীনহাউসের পাশ দিয়ে। বেরিয়ে এলেন রাবাত। লম্বা, ছিপছিপে শরীর। বয়েসের তুলনায় অনেক শক্ত সমর্থ এখনও। মুসার চুলের মতই খুলি কামড়ে আছে কুঁচকানো তারের মত কোকড়া চুল। তবে অত কালো নয়, বয়েসের রঙ লেগেছে তাতে, ধূসর হয়ে গেছে। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বললেন, আরি, তুই, মুসা! ও, তোমরাও এসেছ, রবিন আর কিশোরকে বললেন। পেইত্রি, মাপ করে দাও, ভাই। তোমার সঙ্গে দাবা খেলার কথা ছিল। দাঁড় করিয়ে রাখলাম।

দাড় করিয়ে রেখেছ তাতে কিছু মনে করছি না, কিন্তু ভয়টা পাওয়ালে কেন? আর কিছুক্ষণ না দেখলে পুলিশকে ফোন করতাম। তোমার মেয়েই দেরি করতে বলল। এখানে মরতে এলে কেন? আগের বারে আক্কেল হয়নি?

মরতে নয় মরতে নয়, মারতে, হাসিমুখে জবাব দিলেন রাবাত, মিলারকে। হাতের পেন্সিল কাটার ছুরিটা দেখালেন, এটা দিয়ে।

সর্বনাশ! খুন করতে এসেছিলে!

মাথা নাড়লেন রাবাত, না, গ্রীনহাউসের তালা খুলতে। জানালা দিয়ে দৈখলাম, ও বেরিয়ে যাচ্ছে। সুযোগটা ছাড়লাম না।

অদ্ভুত দৃষ্টিতে নানার দিকে তাকাল মুসা। মিলারকে খুন করার সঙ্গে গ্রীনহাউসের তালা খোলার কি সম্পর্ক, বুঝতে পারল না। ভাবল, নানার মাথাটা বোধহয় পুরোপুরিই গেছে। গ্রীনহাউস খুলতে গেছিলে কেন?

দেখে আয় উঁকি দিয়ে। তাহলেই বুঝবি।

গ্রীনহাউসে আর কি থাকবে? শাকসজি নয়তো অন্য কোন ধরনের উদ্ভিদ। দেখার আগ্রহ হলো না মুসার। যা-ই বললো, নানা, মিস্টার মিলার ইচ্ছে করলে এখন তোমাকে হাজতে পাঠাতে পারেন–চুরি করে তার বাড়িতে ঢুকে তালা ভাঙার অপরাধে।

কচু করবে! আমি কিচ্ছু ভাঙিনি। দরজাটা খোলার চেষ্টা করেছি কেবল, আমার জিনিসটা বের করে নেয়ার জন্যে। ওই টিনটা দেখেছিস? ওতে ম্যালাথিয়ন আছে। গত হপ্তায় বেকারের দোকান থেকে কিনেছিলাম। আমার। চীনা এলম গাছটাতে স্প্রে করার জন্যে। হঠাৎ দেখি টিন গায়েব। আরও একটা জিনিস নেই, একটা কর্নিক। ওই যে, গ্রীনহাউসের মধ্যে পড়ে আছে। আমারটাই। পুলিশের কাছে গিয়ে এখন বললে কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাবে না! আগের বার চুরি করেছিল ঘাস কাটার যন্ত্র, এবার করেছে কনিক আর পোকা মারার ওষুধ। এ সব কেনার টাকা তার যথেষ্ট আছে, শয়তানিটা করে শুধু আমাকে খেপানোর জন্যে। আমার কাজে অসুবিধা হতে দেখলে মজা পায়। অত্তবড় শয়তান, অথচ অর্কিড ক্লাবে গিয়ে কি ভালমানুষটিই না সেজে থাকে! আহাহা, যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না! বাড়ির বাগানে ঘাস হয়ে থাকে আধহাত লম্বা, কাটার নাম নেই, ওদিকে সারাদিন গ্রীনহাউসে পড়ে থেকে অর্কিড জন্মায়। ছাগল আর কাকে বলে!

ঘাস না কেটে অর্কিড জন্মালে দোষটা কোথায়, ছাগল হয় কি করে, সেটাও মাথায় ঢুকল না মুসার। নানার মাথার স্থিরতা সম্পর্কে সন্দেহ আরও বাড়ল। বলল, নানা, ওগুলো তোমার জিনিস কি করে বুঝলে?

রেগে উঠলেন রাবাত, তোর মত গাধা নাকি আমি নিজের জিনিস চিনব না। ছাউনিতে ঢুকে দেখি জিনিসগুলো নেই। তারপর দেখি পাতাবাহারের ডাল ভাঙা। মগজটা এখনও এত বুড়ো হয়নি যে কি ঘটেছে বুঝতে পারব না!

মিলারের ড্রাইভওয়েতে গাড়ির শব্দ হলো। থামল গাড়িটা। শঙ্কিত হলেন। পেইত্রি। রাবাতের হাত ধরে টানলেন, ওই বুঝি এলো! চলো, চলে যাই!

ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলেন রাবাত। যাব কেন? ওর মত চোর নাকি? আমার জিনিস না নিয়ে যাব না!

গ্যারেজের কোণ ঘুরে বেরিয়ে এল গাট্টাগোট্টা এক লোক। ঘন পুরু ভুরুর নিচে কোটরে বসা চোখে যেন আগুন জ্বলছে।

তাকে দেখেই বলে উঠলেন রাবাত, হ্যারিস মিলার, আবার চুরি করেছ। তুমি! গ্রীনহাউসে আছে। জলদি বের করে দাও! ম্যালাথিয়নের টিন আর কর্নিকটা আমার!

কি প্রমাণ আছে, তার? সমান তেজে জবাব দিলেন মিলার। তুমি বেরোও আমার বাড়ি থেকে, নইলে পুলিশ ডাকব!

 চাপ দিয়ে কটাত্ করে ছুরির ফলা বন্ধ করে ফেললেন রাবাত। বন্ধ ছুরির মাথা মিলারের দিকে তুলে ধরে শাসালেন, প্রমাণ, না? আবার যেয়ো চুরি করতে! বুঝবে মজা! এখন থেকে তক্কে তক্কে থাকব আমি। খালি ধরতে পারলে হয় একবার! ঘাস কাটার যন্ত্র দিয়ে তোমার চুল ছেটে না দিয়েছি তো আমার নাম রাবাত নয়!

আরে যাও যাও, যা পারো কোরো! এখন বেরোও! নইলে

  কি করবে? কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন রাবাত। কি করবে? চোর কোথাকার! চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুড়ি।

মিলারের চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেল কিশোর। বুঝল, মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, রাবাতকে ভয় পায় সে। অবশ্য সেজন্যে মিলারকে দোষ। দেয়া যায় না। খেপা মোষ বা গণ্ডারকে কে না ভয় পায়।

মারামারি বেধে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি নানার হাত ধরে টান দিল মুসা, নানা, দোহাই তোমার, থামো! এসো, যাই!

ঝাড়া দিয়ে আবার হাত ছুটিয়ে নিলেন রাবাত, এই, সর, কথার মাঝখানে কথা বলতে আসবি না!

মুসাও দমল না। তুমি আসবে, না মাকে ফোন করব?

ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রাবাত। হ্যাঁ হ্যাঁ, করগে না! তোর মাকে কি আমি ডরাই! তবে আর দাঁড়ালেন না তিনি। গটমট করে গ্রীনহাউসের কাছ থেকে সরে এসে বেড়ার দিকে এগোলেন। পিছু নিল তিন গোয়েন্দা।

পেইত্রি রয়েছেন সবার পেছনে। দুর্বল ভঙ্গিতে হাঁটছেন। খুনোখুনির ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। যা কাণ্ড করো না, তোমার কাছে আসাই বাদ দিতে হবে! অনুযোগ করলেন তিনি। আমি বলে দিলাম, এ রকম চলতে থাকলে খুনের দায়ে জেলে যাবে একদিন!

আমি কি ইচ্ছে করে করি নাকি? আশেপাশে বদ লোক থাকলে এই হবে! পাতাবাহারের বেড়া ডিঙিয়ে নিজের সীমানায় ঢুকলেন রাবাত। তাই তো বলি, একটা পড়শী-প্রতিরোধ সংগঠন করা উচিত আমাদের। তাহলে ভোটাভোটির মাধ্যমে ঠিক করা যাবে, কাকে রাখব, কাকে নয়।

তখন তোমাকে নিয়েও ভোট হতে পারে, মুখের ওপর বলে দিলেন পেইত্রি। নিজেকে অত ভাল ভাবার কোন কারণ নেই। ভোট দিয়ে তোমাকেও তাড়াতে পারে!

বাজে বোকো না! গজগজ করে বললেন রাবাত। খেললে এসো, নইলে ভাগো! অহেতুক সময় নষ্ট কোরো না!

কেটলিতে ফুসা বাষ্পের ফোঁস ফোঁস শব্দ বেরোল পেইত্রির নাক থেকে। তবে চলে গেলেন না। রাবাতের পিছু পিছু লিভিং রুমে ঢুকলেন।

রান্নাঘরে রাখা টেলিফোনের দিকে এগোল মুসা। রিসিভার তুলে বাড়ির নম্বরে ডায়াল করল।

 মাকে উৎকণ্ঠা মুক্ত করে রিসিভার রেখে দিল সে। কিশোরের দিকে তাকাল। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, কি বুঝলে? যাবে নানার সঙ্গে? তাকে সামলানো সম্ভব?

সন্দেহ ফুটল কিশোরের চোখে। তারপর উজ্জ্বল হলো। হেসে বলল, সহজ হবে না কাজটা। তবে একঘেয়েমিতে ভুগতে হবে না আমাদের, এটা বলতে পারি।

.

০৩.

 পরের হপ্তায় বাবাকে বাড়িতে, দাওয়াত করলেন মিসেস আমান। বাবার পছন্দের সমস্ত খাবার তৈরি করে তার সামনে দিলেন। কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বাবাকে পটানোর চেষ্টা করলেন। মুসা, কিশোর আর রবিন তার। সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বেড়াতে গেলে যে মন্দ হয় না ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন সে কথা। বোঝালেন, ওদের জন্যে এটাকে শিক্ষা সফর হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।

ওপরে পুরু করে মাখনের স্তর দেয়া চকোলেট কেকে বড় বড় কামড় বসাচ্ছেন রাবাত। কথা বলতে অসুবিধে। ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন।

অমন করো কেন, বাবা? কণ্ঠস্বর আরও কোমল করলেন মিসেস। আমান। ছোটদের জন্যে বেড়ানো একটা বিরাট শিক্ষা, তুমিই তো বলতে আমাকে। বই পড়ে এ জ্ঞান অর্জন করা যায় না। আমাকে নিয়ে যেতে। সবচেয়ে মনে পড়ে কার্লসব্যাড ক্যাভানে বেড়াতে যাওয়ার কথা। কি যে ভাল লাগে ভাবতে! আমার সঙ্গে, মার সঙ্গে কত ভাল ব্যবহার করতে তুমি, মনে আছে, বাবা? মা মারা যাওয়ার পরই তুমি গেলে বদলে। সেই আগের তুমি আর এখনকার তুমিতে যে কত তফাৎ, যদি বুঝতে! তখন তোমাকে ঋষি, মনে হত আমার, বাবা, আর এখন

পাগল!

না না, তা নয়! তাড়াতাড়ি বললেন মিসেস আমান। তবে মেজাজটা যে তোমার ভাল থাকে না, এটা ঠিক। শোনো, বাবা, আমার একটা কথা রাখো, ওদেরকে তুমি নিয়ে যাও। আমি কথা দিতে পারি, ওরা তোমার। বিরক্তির কারণ হবে না। খুব ভাল ছেলে ওরা। দায়িত্বশীল।

নীরবে কেক খাওয়া শেষ করলেন রাবাত। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন। চিনি হয়নি। আরও এক চামচ চিনি মেশালেন। তারপর তাকালেন মেয়ের দিকে।

কুঁকড়ে গেলেন মিসেস আমান। ওই দৃষ্টি তার চেনা। কারও মনের ভেতরটা পর্যন্ত দেখে নেয়ার ক্ষমতা আছে ওই দৃষ্টির। অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন তিনি।

তোর ধারণা দারোয়ান দরকার আমার? রাবাত বললেন, দারোয়ান। তুই ভালই জোগাড় করেছিস, নাক টিপলে এখনও দুধ বেরোয়! আমাকে কি পাহারা দেবে ওরা?

সে কি আমি জানি না? বিশ্বাস করো, পাহারা দেয়ার জন্যে ওদেরকে সঙ্গে দিচ্ছি না, বাবা। বরং ওদের দেখেশুনে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই তোমার। সঙ্গে দিতে চাইছি। গাড়িতে করে সেই নিউ ইয়র্ক যাওয়া, আমারই লোভ হচ্ছে! সংসারের ঝামেলা না থাকলে:

হাত নেড়ে মেয়েকে থামিয়ে দিলেন রাবাত। কাটা কাটা স্বরে বললেন, থাক, অত কথা বলতে হবে না! আমি বুঝে গেছি!

মিস্টার আমানের দিকে ফিরলেন তিনি।

একেবারে চুপ করে আছেন মুসার বাবা। শ্বশুরের সঙ্গে তর্ক করতে রীতিমত ভয় পান। তর্কটা শুধু তর্কে সীমাবদ্ধ থাকলে এতটা পেতেন না, কিন্তু লড়াই বেধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেজন্যে পারত পক্ষে কথা বলতে চান না শ্বশুরের সঙ্গে, এড়িয়ে চলেন।

এই মিয়া, তোমার কি বক্তব্য? জামাইকে প্রশ্ন করলেন রাবাত। দারোয়ান দরকার আছে আমার?

সেরেছে রে! এই ভয়টাই তিনি করছিলেন, তাকে না কোন প্রশ্ন করে বসেন। বড় করে ঢোক গিললেন। লম্বা দম নিলেন। সাবধানে শব্দ বাছাই করে বললেন, না না, দারোয়ান লাগবে কেন! তবে মাঝেমধ্যে সবারই কমবেশি অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়…

আমার হয় না! কর্কশ কণ্ঠে বললেন রাবাত। তোমরা ভাবছ রাস্তায় গণ্ডগোল করে আমি জেলে যাব, সেটা ঠেকাবে তোমাদের দারোয়ানেরা! তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, রোজই একবার করে জেলে যাই আমি। অ্যারেস্ট হয়েছিলাম যে সে-কথা মনে করিয়ে দিতে চাও। কিন্তু কেন গিয়েছিলাম? নিজের গাছ বাঁচাতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে। একে তুমি মারামারি বলতে পারো না। ধরো এখন তোমার সামনে থেকে জোর করে এই টেলিভিশনটা কেউ তুলে নিয়ে যেতে চাইল, বাধা দেবে না? সেই বাধাটাই আমি দিয়েছিলাম। পুরো দোষটা ছিল পার্ক ডিপার্টমেন্টের। আমার গাছ পোকায় খেয়ে মারুক, না ঝড়ে উড়ে যাক, তাতে ওদের কি? সেটাই বলতে গিয়েছিলাম। তাতে আমি হয়ে গেলাম পাগল, বদ্ধ উন্মাদ!

শ্বশুড়ের মারমুখো মূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেলেন আমান। চুপ করে রইলেন। এখন তর্ক করতে যাওয়ার ফল হবে ভয়ঙ্কর।

জ্বলন্ত চোখে মুসার দিকে তাকালেন রাবাত

দম বন্ধ করে ফেলল মুসা।

ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাবাত, এই, সত্যি করে বল, তোদেরকে দারোয়ান হিসেবে আমার সঙ্গে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না?

ঢোক গিলল মুসা।

আসল কথা ফাস হয়ে যাওয়ার ভয়ে রেগে গেলেন মিসেস আমান। গলা চড়ে গেল তাঁর, তাতে কি হয়েছে? তোমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই যদি ভাবা হয়, ক্ষতিটা কি? তোমার পাকা খেতে মই দেয়া হচ্ছে নাকি! তুমি ভেবেছ তুমি ধমকাতে থাকবে আর সবাই তা সহ্য করবে? আমি বলছি, ভাল করে শুনে রাখো, আমি বলছি ওরা যাবে তোমার সঙ্গে। হয় ওরা যাবে, নয়তো তোমার নিউ ইয়র্ক যাওয়া বন্ধ। এতক্ষণ ভাল ভাবে বলেছি, শোনোনি। এই আমি বাকা হলাম, দেখি তুমি কি করতে পারো!

আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। বাবা আর মেয়ে কেউ কারও চেয়ে কম যায়, না! মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল, আল্লাহরে, বাঁচাও! কি জানি কি ঘটে যায়! নানার মেয়ে খেপেছে!

কারও দিকে তাকালেন না আর রাবাত। চুপচাপ কাপের কফি শেষ করলেন। তারপর মুখ তুললেন। মেয়ের দিকে তাকালেন না। কণ্ঠস্বরও নরম। করলেন না। খসখসে গলায় বললেন, আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করব। কারও বাধা মানতে আমার বয়ে গেছে। আমি ঠিক করেছি, ছেলেগুলোকে আমি সঙ্গে নেব। তবে দারোয়ান হিসেবে নয়। এত লম্বা পথ, মুখ বুজে থাকা যাবে না। কথা বলার জন্যেও কাউকে দরকার। তার জন্যে ছোটরাই উপযুক্ত। বুড়োগুলোর নানা ফেঁকড়া, নানা ঝামেলা। তর্ক ছাড়া কিছু বোঝে না, বেশি পেকে যায় তো! আড়চোখে মেয়ে আর জামাইয়ের দিকে তাকালেন তিনি। পেইত্রি কিংবা কক বিলার্ডকে নিতে পারতাম। কিন্তু বেড়াতে বেরোলেই বিশাল এক সুটকেস সঙ্গে নেবে পেইত্রি, তাতে থাকবে। হাজার রকমের ওষুধপত্র। কক হলো বীমার লোক। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে, তবু শুধু বীমা, বীমা। দুনিয়ায় যেন এ ছাড়া আর কোন বিষয়ই নেই। সুতরাং মুসা এবং তার দুই দোস্ত আসতে পারে আমার সঙ্গে। মুসা, স্কুল ছুটি হতে আর কদ্দিন? দুই হপ্তার বেশি না নিশ্চয়? ঠিক আছে, অপেক্ষা করতে পারব আমি। তোদের স্কুল ছুটি হলেই রওনা হব। জুনের শুরুতে যাত্রা করব। আমরা। অতিরিক্ত গরম পড়ার আগেই খোলা অঞ্চল পেরিয়ে যেতে পারব। ফিরে আসব ক্যানাডার ভেতর দিয়ে। ভাবতে কেমন লাগছে রে তোর?

লাফিয়ে উঠল মুসা। আর বোলো না, নানা! দম আটকে আসছে। আমার! স্কুলটা যে কবে ছুটি হবে! সহ্য করতে পারছি না!

রবিন আর কিশোরকে সুখবরটা জানানোর জন্যে ফোনের দিকে প্রায় উড়ে গেল সে।

স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে এরপর দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি চলল। বাড়িতে জরুরী কোন কাজ নেই, তাই মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিতে রবিনের তেমন অসুবিধে হলো না। তবে কিশোরকে নিয়ে ঘাপলা বাধাতে চাইলেন মেরিচাচী। ইয়ার্ডে প্রচুর কাজ। তিনি ভেবেছিলেন, স্কুল ছুটি হলে বাড়তি কাজগুলো কিশোরকে দিয়ে করিয়ে নেবেন।

কিশোর তাকে বোঝাতে চাইল, শোনো, কাজ তো সারাজীবনই করা যাবে, করতে হবে। কিন্তু এ রকম সুযোগ আর আসবে না। তা ছাড়া এ সব ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। চিন্তাশীল হতে শেখায় মানুষকে।

তোর কি চিন্তা করার অসুবিধে নাকি? বুদ্ধিও কম না! যা আছে তাতেই একেক সময় ভয় হয়, মাথাটা না বিগড়ে যায়!

চিলেকোঠা থেকে একটা স্লীপিং ব্যাগ বের করে আনলেন মেরিচাচী। রোদে শুকাতে দিলেন।

সেটা দেখে আশা হলো কিশোরের। তারমানে যেতে দিচ্ছ তুমি আমাকে?

জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলেন চাচী, জুন মাসে মিনেসোটার আবহাওয়া কেমন থাকে জানিস?

বিউটিফুল! জবাব দিয়ে দিলেন কাছে দাঁড়ানো রাশেদ পাশা। দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরিয়ে বললেন, চমৎকার!

চাচার সমর্থন পেয়ে চোখ উজ্জ্বল হলো কিশোরের। চাচীকে বলল, তুমি হিসেবগুলোর কথা ভাবছ তো? যাও, বেড়াতে যাওয়ার আগেই সব শেষ করে দেব। আর কোন অসুবিধে আছে?

এতক্ষণে হাসি ফুটল মেরিচাচীর মুখে। কিশোর যখন কথা দিয়েছে, ধরে নেয়া যায় কাজটা হয়ে গেছে। হিসেব মেলানোটা সাংঘাতিক ঝামেলার কাজ মনে হয় তার কাছে।

অবশেষে ছুটি হলো স্কুল।

জুনের এক কুয়াশা ঢাকা সকালে নিজের গাড়িতে করে তিন গোয়েন্দাকে মিস্টার রাবাতের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেলেন আমান। সুটকেস এনেছে ওরা, তবে স্লীপিং ব্যাগ আনেনি। সাফ মানা করে দিয়েছেন রাবাত, বাইরে ক্যাম্প করে ঘুমানো চলবে না। বলেছেন, বাইরে রাত কাটানোর বয়েস আমার নেই। এটাই হয়তো জীবনের শেষ অ্যাডভেঞ্চার। অতএব কিপটেমি করে দীনহীনের মত দিনগুলো না কাটিয়ে হোটেলে থাকব, মোটেলে থাকব। যতটা সম্ভব আরামে কাটাব।

নানার মত অত বয়েস না হলেও বয়েস হয়েছে তার পুরানো, বিশাল বুইক গাড়িটার। তবে যথেষ্ট সমর্থ এখনও। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে।

রওনা হলো ওরা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন আমান। শেষবারের মত বাবাকে বিদায় জানানোর জন্যে পেছনে ফিরে হাত নাড়ল মুসা। কিশোরও তাকাল। দুজনেরই চোখে পড়ল, রাবাতের বাড়ির কোণ থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে আসছে গাট্টাগোট্টা একজন মানুষ। ঝোপের আড়ালে অর্ধেক শরীর আড়াল করে তাকিয়ে দেখছে রাবাত সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন কিনা।

হ্যারিস মিলারকে চিনতে পারল দুই গোয়েন্দা।

খালি পেয়েই ঢুকে পড়েছে। একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করেনি। বিড়বিড় করল মুসা। মতলবটা কি?

 কিশোর জবাব দেয়ার আগেই সামনের সীট থেকে গাঁক করে উঠলেন নানা, কি বলছিস?

কিছু না, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। ভাবছি, সান্তা বারবারার ওই রেস্তোরাঁটায় থামবে কিনা? ওই যে, যেটাতে ঘরের বাইরে টেবিল, পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

ভাল বলেছিস, খুশি হয়ে উঠলেন রাবাত। নাতির মতই খাওয়ার ব্যাপারে তারও প্রবল আগ্রহ। হয়তো তাঁর কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতাটা পেয়ে গেছে মুসা। আমার তো খিদেয় পেট জ্বলছে। নাস্তা না খেয়ে আর পারব না।

অবাক হলো মুনা নাস্তা না খেয়েই বেরিয়েছ!

 মনে নেই!

প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে নতুন উদ্যমে গাড়ি হাঁকালেন রাবাত।

মুচকি হাসল কিশোর। মেজাজ ভাল আছে রাবাতের। তবে বেশি আশা করা ঠিক না। কখন যে কি কারণে খেপে যাবেন, আন্দাজ করাও সম্ভব নয়।

.

০৪.

 নাস্তা নয়, ভরপেট ভোজন হলো সান্তা বারবারায় পৌঁছে। পুরানো একটা বাড়ির চত্বরে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। ক্যালিফোর্নিয়ার সেই স্প্যানিশ কলোনির যুগে, তৈরি হয়েছিল বাড়িটা। কুয়াশা তাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। রোদ। বাতাস পরিষ্কার, তাজা।

খুব সুন্দর! রাবাত বললেন। যতই এগোব, আবহাওয়া আরও ভাল। হবে।

যতই উত্তরে এগোল ওরা, শুধু আবহাওয়া নয়, প্রকৃতিরও রূপ বদল হতে থাকল। কখনও সাগরের কিনার দিয়ে গেছে পথ, তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একেবারে ধার ঘেষে; কখনও পাহাড়ের চূড়ার কাছ দিয়ে, ওখান থেকেও সাগর চোখে পড়ে। গ্যাভিয়োটা ছাড়িয়ে কয়েক মাইল এসে পাওয়া গেল একটা সুড়ঙ্গ, রাস্তা গেছে তার ভেতর দিয়ে। সুড়ঙ্গের অন্য পাশে বদলে গেল। প্রকৃতি। সাগরের ঢেউয়ের বদলে এখানে দেখা গেল গরু-বাছুরের পাল। শীতের বর্ষণের শেষে মাঠের ঘাস এখন সবুজ। ছড়ানো সর্ষে খেতে সবুজের মাঝে বিছিয়ে থাকা হলুদ ফুলকে লাগছে বিশাল হলুদ চাদরের মত। ঢালের গায়ে তৃণভূমিতে চরছে গরু-ঘোড়া, মহা আনন্দে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে বাছুর আর ঘোড়ার বাচ্চা।

দুপুরের পর, বিকেলের শুরুতে আবার সাগরের দেখা পাওয়া গেল।

ওই যে পিজমো বীচ! রাবাত বললেন। মুসা, তোর মা তখনও হয়নি, তোর নানীকে নিয়ে বেড়াতে আসতাম এখানে। সাগরের পাড়ে ঝিনুক খুঁজে বেড়াতাম। বহু বছর আগের কথা, অথচ মনে হচ্ছে এই সেদিন! এখন তোর নানী নেই, আছে শুধু ঝিনুক! একা একা কুড়াতে আর ভাল লাগে না রে, তবে সৈকতের পানিতে গাড়ি চালাতে এখনও মজা পাই।

পানিতে! বিশ্বাস করতে পারল না রবিন। পারবেন? চাকা আটকে যাবে না?

না, পিজমোতে যাবে না। কোন্ জায়গাটাতে নামতাম আমরা, দেখি বের করতে পারি কিনা?

হাইওয়ে থেকে একটা সরু রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে আনলেন রাবাত। সাগরের দিকে নামতে নামতে পথের শেষ মাথায় চলে এলেন। তারপরে রয়েছে একটা র‍্যাম্প। সেটার পর সৈকত।

বালির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, সত্যি বলছ, নানা, কাদায় চাকা দেবে যাবে না? চোরাবালি যদি থাকে?

দূর বোকা, এ সব জায়গায় থাকে না। ওই দেখ, আরেকটা গাড়ি নেমেছে।

একেবারে পানি ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে একটা ফোক্সওয়াগেন। তীরে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। কোন কোনটা এতবড়, গাড়ির চাকা আর নিচেটা ভিজিয়ে দিয়ে। এ পাশে চলে আসছে।

খাইছে! বলে উঠল মুসা, ফোক্সওয়াগন বলেই চলছে এখনও। বুইক পারবে না, ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যাবে।

থাম তো! অধৈর্য হয়ে নানা বললেন, দেখই না কি করি।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। অন্য কেউ এখানে গাড়ি চালালে ভয়। পেত না। কিন্তু তার নানাকে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। এত ঘনিষ্ঠভাবে কোনদিন মেশার সুযোগ পায়নি। বদমেজাজী বলে এড়িয়েই থেকেছে। নানার হাতে নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।

র‍্যাম্প পার হয়ে এসে বালিতে নেমে পড়ল বুইক। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল সৈকত ধরে। তীর থেকে খানিকটা দূরে পানির ওপরে কুয়াশা জমছে। রাবাত বললেন, এই এক যন্ত্রণা! খালি কুয়াশা পড়ে এখানে। ভৌগোলিক কারণ একটা নিশ্চয় আছে। কিন্তু কি, কে জানে!

গাড়ি থামিয়ে, হ্যান্ডকে সেট করে দিয়ে ফিরে তাকালেন তিনি। আমি এখানে নামব। পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তোরা?

নামব, একটানে পাশের দরজা খুলে ফেলল মুসা।

চোখের পলকে খুলে গেল চারটে দরজাই। গাড়ি থেকে প্রায় ছিটকে বেরোল চারজনে। দরজায় তালা লাগালেন রাবাত। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে সৈকত ধরে হেঁটে চললেন।

কয়েক মিনিটেই পিজমা বীচের শহর ছাড়িয়ে এল ওরা। লম্বা একটা দেয়াল ঘেঁষে প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো কয়েকটা বাড়ি-ঘর, এই হলো শহর। পাহাড়ের চূড়া আর ঢালে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল ও মোটেলগুলো।

কাছে এসে গেছে কুয়াশা। ধীরে ধীরে যেন জড়িয়ে ধরতে আরম্ভ করেছে ওদের। চোখের আড়াল করে দিয়েছে একপাশের সৈকত। কেমন ভূতুড়ে নীরবতা গ্রাস করছে সমস্ত পরিবেশকে। চুড়ার ওই হোটেলগুলোর ওপাশে রয়েছে হাইওয়ে। কাছেই। অথচ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও কানে আসছে না।

সামনে বিছিয়ে আছে প্রায় নির্জন সৈকত। একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ঘন হয়ে গেল কুয়াশা। তার মধ্যে হারিয়ে গেল। লোকটা। ওদের চারপাশে এখন শীতল, শূন্য, ধূসর এক পৃথিবী।

বিচিত্র অনুভূতি হলো কিশোরের। মনে হচ্ছে, ভয়ানক বিপজ্জনক কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। এমন কিছু, যা অক্টোপাসের মত উড় বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে নিয়ে চলে যাবে অজানা কোন জগতে, চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ারও ক্ষমতা হবে না ওদের।

মাথা ঝাড়া দিয়ে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করল সে। মনকে বোঝাল, অহেতুক ভয় পাচ্ছে। কিছুই নেই এখানে। কেবল ঘন কুয়াশা সূর্যকে ঢেকে দিয়ে জায়গাটাকে অন্ধকার, বিষণ্ণ আর অপার্থিব করে তুলেছে।

অনেক দূর চলে এসেছি আমরা, তাই না, নানা? জিজ্ঞেস করল রবিন।

কিশোরের আগে রয়েছে সে। মূসার সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্নটা করে জবাবের আশায় ডানে তাকাল সে। কিন্তু কোথায় রাবাত?

মুসাও থমকে দাঁড়াল। নানা! কোথায় তুমি?

জবাব নেই।

মিস্টার রাবাত! চিৎকার করে ডাকল কিশোর।

কয়েক সেকেন্ড কান পেতে রইল সে। রাবাত গেলেন কোথায়? কুয়াশার মধ্যে জলজ্যান্ত একজন মানুষ অদৃশ্য হতে পারে, গায়েব হয়ে যেতে পারে না!

মুসাও ভয় পেয়েছে। চাপা স্বরে বলল, এই, কাছাকাছি থাকো সবাই। রবিনের কাঁধে হাত রাখল। যেন তাকেও গায়েব হওয়া থেকে ঠেকাতে চায়।

নানা! গলা চড়িয়ে ডাকল আবার রবিন।

নানা, কোথায় তুমি? আরও জোরে ডাকল মুসা। জবাব দিচ্ছ না কেন?

চুপ! এতক্ষণে শোনা গেল একটা ভোতা, খসখসে কণ্ঠ।

এক ঝলক বাতাস আচমকা ফাঁকা করে দিল কুয়াশার খানিকটা। রাবাতকে চোখে পড়ল গোয়েন্দাদের। পাহাড়ের গোড়ায় বড় একটা পাথরের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছেন। সতর্ক, উত্তেজিত, কোন কিছুর দিকে নজর। রাখছেন মনে হচ্ছে।

নানা, কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মুসা।

তাকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করলেন রাবাত। খানিক পর রাগত স্বরে বলে উঠলেন, যা সন্দেহ করেছিলাম!

নিঃসঙ্গ সেই লোকটাকে দেখা গেল আবার, যে কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অনেক কাছে চলে এসেছে। ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে এখন। সাবধানে পা ফেলছে। যেন কুয়াশার জন্যে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকটার ওপর।

চিৎকার করে উঠল লোকটা।

লোকটার কলার চেপে ধরে চিৎকার করতে লাগলেন রাবাত, এত্তবড় সাহস তোমার, আমার পিছু নিয়েছ!

ছাড়ো, পাগল কোথাকার! নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল লোকটা।

খাইছে! দম আটকে যাবে যেন মুসার।

রাবাত, তুমি একটা উন্মাদ! বলল লোকটা। পুরোপুরি মাথা খারাপ! জলদি ছাড়ো বলছি, নইলে ভাল হবে না!

কণ্ঠ শুনেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে মুসা। হ্যারিস মিলার। তার নানার পড়শী, যার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক।

হুমকির পরোয়া করলেন না রাবাত। কলার তো ছাড়লেনই না, আরও জোরে চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। চোর কোথাকার! আমি জানি তুমি কিসের জন্যে এসেছ! রাতে চুরি করে আমার ঘরে ঢুকেছিলে, নতুন আবিষ্কারটার কথা জেনে গেছ। যন্ত্রপাতি চুরি করেই পেট ভরেনি, ফর্মুলাও চুরি করতে এসেছ…।

ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মিলার। পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার শুরু করল, বাঁচাও! বাঁচাও! পুলিশ! পাগলে খুন করে ফেলল আমাকে!

লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল মুসা। মিলারের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, চেঁচাবেন না, মিস্টার মিলার, প্লীজ! নানা এমনি কথার কথা বলেছে, সত্যি সত্যি খুন করতে চায়নি আপনাকে…

চুপ! গর্জে উঠলেন রাবাত। স এখান থেকে! আমার জন্যে মাপ চাইতে হবে না! যা বলেছি ঠিকই বলেছি, মোটেও কথার কথা নয়! মেরুদণ্ডহীন এই পোকাটা কি করতে চাইছে আমি জানি। কিছুতেই সেটা করতে দেব না ওকে। ল্যাঙ মেরে ফেলে ওর কোমর ভেঙে না দিয়েছি তো। আমার নাম…

আবার মিলারকে ধরার চেষ্টা করলেন রাবাত।

ঝট করে সরে গেল মিলার। আর চিৎকার করল না। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবাতের দিকে।

ইঁদুর! ছুঁচো! শুয়াপোকা! গাল দিতে লাগলেন রাবাত। এই জন্যেই, এতক্ষণে বুঝলাম! এই জন্যেই বিষবার থেকে কাজে যাচ্ছ না তুমি! বাড়িতে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ওপর চোখ রেখেছ। যেই আমি বেরিয়েছি, আমার পিছু নিয়েছ। কেন নিয়েছ, মনে করেছ বুঝব না! অত বোকা পাওনি!

পাগলের সঙ্গে কে কথা বলে! বলেই ঘুরে সৈকত ধরে প্রায় ছুটতে শুরু করল মিলার।

সত্যি কথা বলেছি তো, সহ্য করতে পারলে না, তাই না! পেছনে চিৎকার করে বললেন রাবাত।

 ফিরল না মিলার। জবাবও দিল না। খেপা মানুষটার কবল থেকে পালাতে পারলে যেন বাঁচে। আবার অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।

অসহ্য! নাক দিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করতে লাগলেন রাবাত। জঘন্য লোক! আবার যদি আসে, বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেব আমি ওর!

এতক্ষণে খেয়াল করল মুসা, কাঁপছে ও। একটা দুঃস্বপ্ন থেকে যেন জেগে উঠেছে। এ কার সঙ্গে এসেছে! মারাত্মক অবস্থা! স্যান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছার আগেই হয়তো ভয়ানক বিপদে ফেলে দেবে। উপকূলের কোন জেলখানায় হবে শেষ ঠাই। এমনও হতে পারে, নানার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে। তাকে সামলানো অসম্ভব ভেবে রকি বীচে ফিরে যেতে পারে কিশোর আর রবিন। নিউ ইয়র্ক যাওয়া আর হবে না।

নানা, বলল সে, আমার মনে হয় অহেতুক মিস্টার মিলারকে গালাগাল করছ। পিজমো বীচটা বেড়ানোর জায়গা, যে কেউ আসতে পারে এখানে। মিলারের আসতেও বাধা নেই। এমনও হতে পারে, এখানে কোন বন্ধু আছে তার, দেখা করতে এসেছে।

তোর মাথা! খেঁকিয়ে উঠলেন রাবাত। ওর আবার বন্ধু আছে নাকি! দুনিয়ায় কেউ ওর বন্ধু হবে না! শুনে রাখ, তার সঙ্গে এই শেষ দেখা নয় আমাদের। না হলে তখন বলিস। কিন্তু যেটার জন্যে এসেছে সেটা পাবে না সে। অত কাঁচা কাজ করি না আমি। ওর মত ছুঁচোরা যে পিছে লাগতে পারে, সেটা আগেই ভেবে রেখেছি।

কি নিতে এসেছে? এমন নিরীহ ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল কিশোর, যেন কথার পিঠে কথা, জানার কৌতূহল নেই।

আমার ফর্মুলা! জবাব দিলেন রাবাত।

যেটা আবিষ্কার করেছ? মুসার প্রশ্ন। যেটা নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাচ্ছ?

তোরাও এমন ভঙ্গি করছিস যেন আমি একটা পাগল! আবিষ্কার যেটা করেছি, জানলে নিউ ইয়র্কের বড় বড় বিজ্ঞানীরাও…

থেমে গেলেন তিনি। ফাস করে দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ খেয়াল হলো যেন। না, তোদের না জানাই ভাল। হয়তো মিলার একাই চায় না ওটা, আরও কেউ আছে। চল। আর দেরি করলে অন্ধকার হওয়ার আগে মনটিরেতে পৌঁছতে পারব না।

শান্ত ভঙ্গিতে বালি মাড়িয়ে হেঁটে চললেন তিনি। কয়েক মিনিট আগে যে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল বেমালুম ভুলে গেছেন যেন।

পেছনে এগোল তিন গোয়েন্দা। মনে ভাবনা। দীর্ঘ যাত্রায় বেরিয়েছে ওরা। শেষ হতে এক মাস কিংবা তারও বেশি লেগে যেতে পারে। এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে টিকতে পারবে অতদিন? শুধু কি খামখেয়ালী, না। আসলেই পাগল? একজন বদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে অজানা পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে না তো ওরা!