১. পিজ্জা কোভে

ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ – তিন গোয়েন্দা ভলিউম ২৮
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ১৯১১

০১.

আগে চলো পিজ্জা কোভে যাই, মুসা বলল। আজকাল ওদের পিজ্জাগুলো আরও ভাল হয়েছে। বীফ আর মাশরূম দিয়ে যা বানায় না!

ওর বলার ধরনই বুঝিয়ে দিল, জিভে পানি এসে গেছে।

হাসল রবিন, বেরিয়েই আগে খাওয়ার চিন্তা?

তো আর কার করবে? খাওয়াই তো জীবন, মুসার কথায় সায় দিয়ে বলল টনি হাওয়াই। ঝাড়ুর শলার মত খাড়া খাড়া চুলে আঙুল চালানোর চেষ্টা করল। হেঁটে এত খাটো করে ফেলেছে, আঙুল ঢোকেই না। ওদের পিজ্জা আমারও খুব ভাল লাগে। প্রায়ই খাই।

আবার মাথা ঝাঁকাল রবিন। সেটাও জানি। তোমাকে চিনতেও কি আর। বাকি আছে নাকি আমার।

পিজ্জা কোভ আমার মোটেও ভাল লাগে না, জানিয়ে দিল টনির ছোট বোন সিসি। বছর সাতেক বয়েস। কিন্তু পাকা পাকা কথা বলার ওস্তাদ। পিজ্জা তো আরও পচা।

স্কুলে গরমের ছুটি হতেই খালার বাড়ি বেড়াতে চলে গিয়েছিল সিসি। সেজন্যে বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে একসঙ্গে আসেনি। দুদিন হলো ওর খালাত ভাই রেখে গেছে ওকে স্যান্ডি হোলোতে।

এসেই ভাইয়ের পেছনে লেগেছে সিসি। ভাই যেখানে যায়, তারও সেখানে যাওয়া চাই। নিতে চায় না টনি। কিন্তু না নিলে মায়ের ধমক খেতে হয়। কি আর করে বেচারা। নিতে বাধ্য হয়।

 খেঁকিয়ে উঠল টনি, চুপ! তোকে কেউ জিজ্ঞেস করছে না। আইসক্রীমখোরের পিজ্জা কোভ ভাল লাগার কারণ নেই।

মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকাতে লাগল রবিন। সেই আগের মতই আছে স্যান্ডি হোলো৷ মিনি মার্কেটটা ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন পরিবর্তন নেই।

আজই রকি বীচ থেকে মুসার সঙ্গে এসে হাজির হয়েছে সে। জিনাকে ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে সাত দিন আগে। তার অবস্থা দেখে সেদিনই তাকে নিয়ে রকি বীচে ফিরে গেছেন তার বাবা-মা। সঙ্গে গিয়েছিল মুসা।

জিনার মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। কোন কথা মনে করতে পারে। উল্টোপাল্টা আচরণ করে। বাধ্য হয়ে তাকে মেন্টাল হোমে ভর্তি করতে হয়েছে। ডাক্তারের ধারণা, বিষাক্ত কোন কিছু রক্তে ঢুকে যাওয়াতে মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে জিনার। ভ্যাম্পায়ারের কথা ডাক্তার কিংবা জিনার আব্বা-আম্মাকে বলতে যায়নি মুসা, তাকেও যদি পাগল ভেবে হাসপাতালে আটকে রাখে, এই ভয়ে। জন আর লীলার কথাও গোপন রেখেছে।

তবে কিশোর আর রবিনকে সব ঘটনা খুলে বলেছে সে।

ভ্যাম্পায়ারের কথা বিশ্বাস করেনি দুজনের কেউই, তবে কোন একটা রহস্য যে আছে, এ ব্যাপারে কিশোর নিশ্চিত। মুসা আর রবিনের সঙ্গে আসতে পারেনি সে। জরুরী কাজে রাশেদ পাশার সঙ্গে কোথায় নাকি যেতে হবে। রবিনকে নিয়ে স্যান্ডি হোলোতে ফিরে যেতে বলেছে মূসাকে। তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেছে। সময় করতে পারলে সে নিজেও স্যান্ডি হোলোতে চলে আসবে।

গালে এসে লাগছে ভেজা নোনা বাতাস। লম্বা, বাদামী চুল উড়ছে রবিনের। কেঁপে উঠল, বাপরে, খুব ঠাণ্ডা! শীত লাগছে।

শীতই তো মজা, উনি বলল। খোলা সৈকতে অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসতে আরাম। ঠাণ্ডা পড়লে পার্টি জমে ভাল।

সবগুলো পাগল, সিসি বলল। নইলে শীতের মধ্যে কেউ করে এসব। ঘরে লেপের নিচে থাকা অনেক আরাম।

তাহলে সেটাই থাকতি, আমাদের সঙ্গে এলি কেন?

আমার ইচ্ছে।

তাহলে ওদেরও ইচ্ছে। কোনটা বেশি আরাম, তোর কাছে জিজ্ঞেস করবে নাকি?

করলে ভাল করত… কথা শেষ না করেই চিৎকার করে উঠল সিসি, দেখ দেখ, ওই যে আইসক্রীমের দোকান! নতুন হয়েছে, তাই না, টনি? আগের বার কিন্তু দেখিনি।

ভাইকে নাম ধরে ডাকে সিসি। ভাইয়া ডাকতে বললে ডাকে না, বলে ওসব পুরানো ঢঙ তার ভাল লাগে না। নাম ধরে ডাকাটা অনেক বেশি আধুনিক।

মুচকি হাসল রবিন। ভাইবোনের এই ঝগড়া ভালই লাগছে ওর। টনিকে বোকা বোকা লাগছে।

প্রিন্সেস-এর আইসক্রীম পারলার আর ভিডিও আর্কেডের দিকে তাকিয়ে চোখ চকচক করছে সিসির। ভাইয়ের হাত আঁকড়ে ধরে কো-কো শুরু করল, টনি, দে না একটা আইসক্রীম কিনে। বেশি করে যদি দিস, যা, আজ থেকে তোকে ভাইয়া ডাকাই শুরু করব।

ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উনি বলল, পরে।

দিবি তো?

দেখা যাক। তুই কতখানি জ্বালাতন করিস, দেয়া না দেয়া তার ওপর নির্ভর করবে।

মেইন স্ট্রীটের শেষ মাথায় গিয়ে ঘুরে আবার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে ফিরে চলল ওরা।

মিনি মার্কেটটায় লোকের ভিড় তেমন নেই। সৈকতে চলে গেছে সব। এখানে তো আর কেনাকাটা করতে আসে না ট্যুরিস্টরা, বেড়াতেই আসে।

গরমকালটা এখানে ভালই কাটত, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল মুসা, যদি না

থাক থাক, কি বলতে চায় মুসা বুঝে ফেলেছে রবিন, তাড়াতাড়ি বাধা দিল, এখন ওসব কথা…

কি কথা? জানতে চাইল টনি।

বললাম তো থাক। তারচেয়ে বরং নাটকের কথা বলো। হচ্ছে তো এবার?

হ্যাঁ, হবে। না হওয়ার কোন কারণ নেই। কবে লোক বাছাই করা হবে, দুএকদিনের মধ্যেই ঘোষণা দেবেন মিসেস রথরক…

নাটকের কথা শুনতে আমার ভাল্লাগে না, সিসি বলল।

তুই থাম! ধমক দিল টনি। কোনটাই তো তোর ভাল লাগে না, তাহলে এসেছিস কেন?

লাগে তো–বেড়াতে আর আইসক্রীম খেতে…

চুপ থাক! নইলে পাবি না।

মেইন স্ট্রীট থেকে বেরিয়ে ডানে মোড় নিল ওরা। এগিয়ে চলল সৈকতের দিকে। গোমড়া মুখে তিনজনের পিছে পিছে চলল সিসি। আইসক্রীম ছাড়া সৈকতে যেতে মোটেও ইচ্ছুক নয় সে।

একটা উঁচু বালিয়াড়ির গায়ে কাঠের সিঁড়ি আছে। সেটা বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। এতজনের ভারে মড়মড় করে উঠল পুরানো সিঁড়ি। ভেঙে পড়ার হুমকি দিতে লাগল।

চারপাশে তাকাল রবিন। ওরা বাদে আর কেউ নেই সৈকতে। তবে আসবে। রাত বাড়লে ভিড় বাড়ে।

চাঁদের আলোয় ঢেউয়ের মাথাগুলোকে লাগছে রূপালী মুকুটের মত। দূরে দেখা যাচ্ছে পাথরের জেটি। সাগরের মধ্যে বেশ অনেকখানি ঢুকে গেছে।

কিসের শব্দ!

আচমকা এমনভাবে কথাটা বলল রবিন, মুসা আর টনি দুজনেই চমকে উঠল। ভয় পেয়ে গেল সিসি।

শব্দটা কানে গেছে সবারই। অসংখ্য ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ।

ওই দেখো! আকাশের দিকে হাত তুলল সিসি। ওরিব্বাবা! কত বাদুড় রে!

মুসাও দেখছে। আতঙ্কের ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। তাকিয়ে আছে ওগুলোর দিকে।

অবিশ্বাস্য দৃশ্য! বিড়বিড় করল রবিন। আগের বার কিন্তু এত বাদুড় ছিল না এখানে।

কি বলেছিলাম! প্রায় ফিসফিস করে বলল মুসা। বিশ্বাস তো কয়রানি!

তুমি যা বলেছ, এখনও করছি না। পৃথিবীর বহু জায়গাতেই এ রকম বাদুড়ের ঝাক দেখা যায়। বাদুড়ের সঙ্গে ভূতের কাল্পনিক সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু বাস্তবেও আছে, এ আমি বিশ্বাস করি না।

ভাইয়ের গা ঘেঁষে বসল সিসি। শীতে না ভয়ে বোঝা গেল না। তবে যতদূর জানে মুসা আর রবিন, ভয়ডর একটু কমই আছে মেয়েটার।

আসছে তো আসছেই। বাদুড়ের ঝাক চাঁদ ঢেকে দিয়েছে। সৈকত অন্ধকার।

ধীরে ধীরে কমে এল বাদুড়। পেছনের পাহাড়ের দিকে চলে গেল। আবার বেরিয়ে এল চাঁদের মুখ।

কোত্থেকে এল ওগুলো? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল সিসি।

সাগরের মাঝের দ্বীপটা থেকে, মুসা বলল। বাদুড়ের অত্যাচার আর ভ্যাম্পায়ারের ভয়ে ওখানকার সব মানুষ পালিয়েছে। পোড়ো বাড়িগুলো এখন…

 প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে রবিন বলল, এতদিন হলো পড়ে আছে, সিনেমার লোকেরা দেখে না নাকি দ্বীপটাকে? হরর ছবির চমৎকার শূটিং করতে পারত।

তা পারত, টনি বলল। তেমন করে নজরেই পড়েনি হয়তো কারও। তাই আসেনি।

সিনেমা থেকে আবার নাটকের প্রসঙ্গ এসে পড়ল। স্যান্ডি হোলোতে একটা থিয়েটার আছে, সামার থিয়েটার। গরমের সময় প্রতি বছরই তাতে ছেলেমেয়েদের দিয়ে নাটক করানো হয়। এবারেও হবে। স্থানীয়রা তো থাকেই, যারা বেড়াতে আসে তাদের মধ্যে থেকেও অভিনয়ের জন্যে লোক নেয়া হয়।

কি নাটক করছে ওরা? জানতে চাইল রবিন। বই পড়া ছাড়াও নাটক, গান এ সবের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে তার। কিছুদিন একটা গানের কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরিও করেছে। আবার ওরা ডাকছে যাওয়ার জন্যে।

নাইট অভ দ্য ভ্যাম্পায়ার, নাটকের নাম বলল টনি।

কান খাড়া করে ফেলল মুসা, কাহিনীটা কি?

কি আর হবে, যে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে রাখতে চাইছিল রবিন, সেটা। আবার উঠে পড়ছে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, ভ্যাম্পায়ারের রক্ত খাওয়ার কাহিনী। ওরা তো ওই একটা কাজই পারে। এত কিছু থাকতে ভূতের গল্প। আর কোন কাহিনী খুঁজে পেলেন না মিসেস রথরক!

এটা সেরকম না, টনি বলল। নামটা ভয়ঙ্কর হলেও আসলে হাসির নাটক।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়াল মুসা, চলো, ওঠা যাক।

কোথায় যাব? জিজ্ঞেস করল টনি।

আর্কেডে। আমার খিদে পেয়েছে।

আমারও, বলেই বোনের দিকে তাকাল টনি। কিন্তু যত্ত মুশকিল এই, মেয়েটাকে নিয়ে। ঝামেলা! ওর জ্বালায় না পারব রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভালমন্দ কিছু খেতে, না পারব আর্কেডে খেলতে।

ও, আমি ঝামেলা। বিরক্তির কারণ! ঝাঁঝিয়ে উঠল সিসি, বেশ, আমি থাকবই না। গেলাম বাড়ি চলে।

আঁতকে উঠল টনি, না না, যাসনে! একা গেলে মা আর আমাকে আস্ত রাখবে না!

তাহলে আর উপায় কি? আমাকে নিয়েই যেতে হবে তোদর।

যাব। তবে ঝামেলা করতে পারবি না।

করব, আইসক্রীম কিনে না দিলে। বাড়ি ফিরে গিয়ে মাকে বলব, তুই আমাকে সারা পথ ধমকাতে ধমকাতে নিয়ে গেছিস…

কতবড় মিথ্যুক রে! ধমকালাম আবার কখন? তুইই তো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে পিত্তি জ্বালাচ্ছিস।

আবার গালাগাল! চ্যাটাং চ্যাটাং, না? বেশ, যাচ্ছি বাড়ি ফিরে।

খপ করে বোনের হাত ধরে ফেলল টনি। দেখ, সিসি, কাজটা তুই ভাল করছিস না। ব্ল্যাকমেইল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

কোন্ মেইল হচ্ছে তা বুঝিটুঝি না। তবে আমি সঙ্গে যাব, আমার যা। ইচ্ছে বলব, সাফ কথা। টীচার বলেছেন, স্বাধীনভাবে কথা বলা মানুষের। গণতান্ত্রিক অধিকার…

নাও, হয়েছে! হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল টনি। এবার ওনার কাছে রাজনীতিও শুনতে হবে..অপরাধ হয়ে গেছে, সিসি। মাপ করে দে। তোর মরিচ গোলানো কথার তীর বন্ধ করে এবার রেহাই দে। চল, দেব। তোকে আইসক্রীম কিনে।

হাসি ফুটল সিসির মুখে, যা, দিলাম মাপ করে। তবে একটা আইসক্রীমে। আর চলবে না এখন। যতগুলো বলব, দিতে হবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল টনি, চল, দেব। ঠাণ্ডা লেগে তোর টনসিল পচে মরলে আমার কি!

হাসতে হাসতে বলল সিসি, তখনও মা তোকেই বকবে। বলবে, আমাকে ভোগানোর জন্যে ইচ্ছে করে বেশি বেশি আইসক্রীম কিনে দিয়ে আমার টনসিল তুইই পচিয়েছিস।

.

০২.

সাত দিন পর।

ছায়ায় লুকিয়ে আছে মেয়েটা। ছোট্ট নাক। কালো চুলের লম্বা বেণি। গায়ের রঙ আমেরিকানদের মত ফর্সা নয়, বরং কিছুটা বাদামী দেখছে সে। অপেক্ষা করছে।

দুটো মেয়ে এগিয়ে আসছে। একজনের লম্বা লাল চুল। চাঁদের আলোয় চকচক করছে।

এগিয়ে আসতে আসতে দ্বিতীয় মেয়েটার দিকে তাকাল সে। এই মেয়েটার সোনালি, কোঁকড়া চুল। মুখের চামড়া মসৃণ, ফ্যাকাসে। হাঁটার সময় নাচে চুলগুলো।

খুব খিদে পেয়েছে, বলল সোনালি চুল মেয়েটা। আর সহ্য হয় না। কখন যে পাব কে জানে!

পাওয়া যাবে শীঘ্রি, দ্বিতীয় মেয়েটা বলল। লোকজন তো আর কম। নেই।

ইস, যা খিদে লেগেছে! আর সহ্য করতে পারছি না…

দেখা দেয়ার সময় হয়েছে, ভাবল বাদামী মেয়েটা। ছায়া থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল অন্য মেয়ে দুটোর দিকে।

হাই! চোখ চকচক করে উঠল লাল-চুল মেয়েটার।

দুজনেই দৌড়ে আসতে শুরু করল।

ওই যে এসে গেছে খাবার, সঙ্গের মেয়েটাকে বলল লাল-চুল মেয়েটা। বেশিক্ষণ আর না খেয়ে থাকতে হবে না।

দাঁড়িয়ে গেল বাদামী মেয়েটা। তার দুই পাশে এসে দাঁড়াল মেয়ে দুটো। ঠোঁট ফাঁক হলো। শ্বদন্ত দেখা গেল।

লাল-চুল মেয়েটার তাড়াহুড়া বেশি। শিকারের গলার শিরায় দাঁতের চোখা মাথা ফুটিয়ে দিতে মুখ বাড়াল।

ধমকে উঠল বাদামী মেয়েটা, গাধা কোথাকার! নিজের দলের লোককে চিনতে পারো না?

দ্বিধায় পড়ে গেল মেয়ে দুটো। মুখ সরিয়ে নিল লাল-চুল মেয়েটা।

কয়েক দিন আগে আমিও তোমাদের একজন হয়ে গেছি, বাদামী মেয়েটা জানাল।

অ, হতাশ ভঙ্গিতে বলল লাল-চুল মেয়েটা।

পেটের খিদে চোখে ফুটেছে ওদের।

তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করল সোনালি-চুল মেয়েটা। দলে ঢুকিয়েছে কে?

আমি কণিকা। বাড়ি ইন্ডিয়ায়। জন ঢুকিয়েছে আমাকে।

ও, জন। বেচারা! আগুনে পুড়ে মরল শেষ পর্যন্ত। বস্ তো ওর জন্যে রোজই দুঃখ করে,। দলের সেরা এজেন্ট ছিলখ কতজনকে যে ঢুকিয়েছে কিন্তু তোমার নাম তো কখনও শুনিনি ওর মুখে?

এতজনকে ঢোকাল, কজনের নাম আর বলবে।

তা ঠিক। তা ছাড়া আমরা এসেছি দিন তিনেক হলো। গতবছরের পর আর জনের সঙ্গে দেখা হয়নি আমাদের। ওর সঙ্গে লীলাও মারা গেছে। ওদের মৃত্যুটা রহস্যময়। কি করে মারা গেছে কাউন্টও জানেন না। যে বাড়িটাতে ছিল ওরা, আগুন লেগে পুরো বাড়িটাই পুড়ে গেছে। কোন সূত্রই পাওয়া যায়নি।

তোমাদের নাম কি?

আমি কিমি, পরিচয় করিয়ে দিল সোনালি-চুল মেয়েটা। ও ডলি।

শ্বদন্ত দেখিয়ে হাসল ডলি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কণিকার দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে, কণিকা সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে। জ্বলজ্বল করছে চোখ। তাতে রাজ্যের খিদে। কণিকাও চোখ সরাচ্ছে না ওর চোখ থেকে। হেসে নিজের শ্বদন্তও দেখিয়ে দিল।

এখানে দাঁড়িয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি আমরা, ডলি বলল। আমার রক্ত দরকার। খিদেয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। এক্ষুণি চলো।

হ্যাঁ, চলো, বলল কিমি।

রাস্তার সমতলে উঠে যাওয়া বালিয়াড়িটায় চড়ল ওরা।

বছরের এই সময়টায় আমার ভীষণ খারাপ লাগে, শুকনো গলায় বলল ডলি। খাবার নেই, কিছু নেই। শুধু রক্ত খেয়ে থাকতে হয়। মানুষকে পটিয়ে রক্ত জোগাড় করা যে কি কঠিন কাজ!

রাস্তায় উঠল ওরা। শহরের মেইন রোডের দিকে এগোল। সাইডওয়াক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেকে। দুজন তরুণ-তরুণী হাঁটছে, মাঝে একটা বছর চারেকের মেয়ে। দুদিক থেকে দুজনে হাত ধরে রেখেছে বাচ্চাটার। হার্ড রক, টি-শার্ট গায়ে দুটো মেয়ে হাঁটছে গা ঘেষাঘেঁষি করে। একজোড়া প্রৌঢ় দম্পতি হেঁটে যাচ্ছে দোকানগুলোর সামনে দিয়ে। দোকানের উইন্ডোর দিকে নজর। কিছু কিনবে বোধহয়।

ওদের কাউকে ধরা যায় কিনা ভাবছে ডলি, হাত চেপে ধরল কিমি, ওই দেখো! শিকার!

খানিক দূরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওদের সমবয়েসী তিনটে ছেলে। পেছন পেছন হাঁটছে সাত-আট বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে।

সবচেয়ে লম্বা ছেলেটা নিগ্রো। পেশী দেখে বোঝা যায় নিয়মিত ব্যায়াম করে, অ্যাথলিট। দ্বিতীয় ছেলেটাও লম্বা। মাথায় খাটো করে ছাঁটা চুল। আর তৃতীয় ছেলেটা হালকা-পাতলা, গোলগাল চেহারা, বাদামী-চুল।

মাথা নেড়ে চুল ঝাঁকিয়ে, মৃদু হেসে ডলি বলল, ওদের পটানো যেতে পারে, কি বলো?

চলো, চেষ্টা করে দেখা যাক, বলল কিমি।

.

০৩.

 ছেলেগুলোর দিকে এগোল তিন ভ্যাম্পায়ার।

কাছাকাছি এসে ডাকল কিমি, হাই।

ফিরে তাকাল ছেলেগুলো। মেয়েদের আসতে দেখে দাঁড়াল। বাদামী চুল ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, আমাদের বলছ?

অকারণেই খিলখিল করে হাসল কিমি, এখানে তোমরা ছাড়া আর কে আছে? বেড়াতে এসেছ বুঝি?

মোরগের মত ঘাড় কাত করে, লাল চুল নাচিয়ে হাসল ডলি। আমরাও বেড়াতে এসেছি। আমি লেবার ডে পর্যন্ত থাকব।

অ, হাত বাড়িয়ে দিল বাদামী-চুল ছেলেটা, আমি রবিন। রবিন। মিলফোর্ড।

কোন শহর থেকে এসেছ তোমরা?

রকি বীচ।

আমি হানিকম্ব থেকে।

শুনতে তো নামটা মিষ্টিই লাগছে। জায়গাটাও মিষ্টি নাকি?

আছে। মোটামুটি।

আমাদেরটাও মোটামুটি। খুব খারাপও না, খুব ভালও না।

সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দিল রবিন। নিগ্রো ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, ও মুসা আমান। আর এ হলো টনি হাওয়াই। ও সিসি। টনির বোন।

হাই, হালো, হাত মেলানো ইত্যাদি শেষ হলে কণিকা জিজ্ঞেস করল, যাচ্ছ কোথায় তোমরা?

শহরে, জবাব দিল রবিন। নাটকের জন্যে প্লেয়ার সিলেকশন করা হবে। আজ। টেস্ট দেব।

ও, ভালই হলো। আমরাও ওখানেই যাচ্ছি। চলো, একসঙ্গেই যাওয়া যাক।

মুসার বাহুর ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে দিল ডলি। শুধু শুধু হাসছে। এত দ্রুত আন্তরিক হতে চাওয়ার ব্যাপারটা মুসার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। এখানে অবশ্য অপরিচিত সবাইকেই তার সন্দেহ।

ওকে টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ডলি।

ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা। চিন্তিত।

 তর সইছে না। খিদেটা ডলির সত্যি খুব বেশি, বুঝতে পারল কণিকা।

যেতে চাইছে না মুসা। অস্বস্তি বোধ করছে।

মুচকি হাসল কণিকা। বুঝতে পারছে, মেয়েদের সঙ্গে সহজ হতে পারে ছেলেটা। ভাল বিপদে পড়েছে বেচারা। মেয়েমানুষের খপ্পর।

টনি মোটামুটি স্বাভাবিক। কিমি যখন ওর হাত ধরল, মুসার মত কুঁকড়ে গেল না। বরং হাসির জবাব দিল হাসি দিয়ে।

রবিনের সঙ্গী হলো কণিকা। রবিন টনির চেয়েও স্বাভাবিক। মুসার মত অস্বস্তি বোধ করছে না। সহজ ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগল কণিকার সঙ্গে। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে কোন অসুবিধে হয় না তার।

চলো, হটি, মুসার হাত ধরে টানল আবার ডলি।

মেইন স্ট্রীট ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। বীচ এমপোরিয়ামের উইন্ডোর সামনে দাঁড়াল কিমি। বিকিনিগুলো খুব সুন্দর।

ওর দিকে তাকিয়ে হাসল ডলি, কিনবে নাকি?

 নাহ, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল কিমি, পয়সা নেই।

স্যাভি হেলোতে এই প্রথম এলে বুঝি? মুসাকে জিজ্ঞেস করল ডলি।

 না, আরও এসেছি।

তাহলে তো তুমি সব জানো। গরমকালে নাকি এখানে অনেক লোক আসে, পার্টি-টার্টি, হই-চই হয় খুব?

হ্যাঁ, হয়। ভরে যায়। সৈকতে আগুন জ্বেলে কাবাব বানিয়ে খায়, আড্ডা দেয়, নাচাকোদা করে। পাগল হয়ে যায় যেন সব। বুড়োগুলোও ছেলেমানুষ। হয়ে যায়।

তাই নাকি! খুব মজা হবে এবার। খোলা জায়গার পার্টি আমার খুব ভাল লাগে। তোমরা সঙ্গে থাকলে আরও বেশি জমবে।

জবাব না দিয়ে হাঁটতে থাকল মুসা।

 মনে মনে হাসছে কণিকা। মুসাকে আগ্রহী করতে পারছে না ডলি।

রবিনের দিকে তাকাল কণিকা। তুমি এসেছ আর?

 মাথা নাড়ল রবিন, এসেছি।

কথা বলতে বলতে এগোল ওরা।

ডলি বার বার মুসাকে দল থেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। মুসাও সরতে নারাজ।

আমি বাড়ি যাব! আচমকা তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সিসি।

ফিরে তাকাল সবাই। ভুলেই গিয়েছিল যেন ওর কথা। এমনকি ওর ভাই টনিরও যেন মনে ছিল না।

এত তাড়াতাড়ি?

 কেন, আম্মা বলে দিয়েছে না এগারোটার পর যেন আর না থাকি।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিমির দিকে তাকিয়ে উনি বলল, তোমরা এগোও। আমি চট করে ওকে বাড়িতে রেখে আসি। সিলেকশনের আগেই চলে আসব। সিসির দিকে তাকাল, চল! জলদি! আর যদি রাতে কখনও সঙ্গে আসতে চাস তো ভাল হবে না বলে দিলাম।

রোজ রোজ দুটো করে কোন আইসক্রীম আর একটা করে চকলেট যদি। দিস, আসতে চাইব না।

অত পাবি না। একটা আইসক্রীম, আর একদিন পর পর একটা করে চকলেট।

কি ভেবে তাতেই রাজি হয়ে গেল সিসি।

*

মুসা কোন কথা জিজ্ঞেস করছে না দেখে ডলিই আগ বাড়িয়ে বলল, নাটকের প্লটটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। মেইন একটা চরিত্র যদি পাই…

জবাব দিল না মুসা।

থিয়েটারে পৌঁছে গেল ওরা।

মুসা আর রবিনকে বলল ডলি, তোমরা যাও। আমরা আসছি।

থিয়েটারের দরজার দিকে এগিয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ডলি। খিদেয় জ্বলে যাচ্ছে পেট। ভ্যাম্পায়ার হওয়ার যে এত যন্ত্রণা, আগে জানলে কে আসত!

খবরদার! চট করে কণিকার দিকে তাকাল কিমি। চোখে সন্দেহ। বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও ওদের নতুন সঙ্গীকে। আবার ফিরল ডলির দিকে। এসব কথা বোলো না। কে কোনখান থেকে শুনে ফেলবে, কাউন্ট ড্রাকুলার কানে চলে গেলে রক্ষা থাকবে না। ভ্যাম্পায়ার যখন হয়েই গেছি, মানুষের রক্ত খেয়ে ফেলেছি, এখন এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের।..কি বলো, কণিকা?

মাথা ঝাঁকাল কণিকা। তা তো বটেই!

যাই বলো, ডলি বলল, ওই মুসাটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। কি স্বাস্থ্য। অনেক রক্ত শরীরে। ওর গলায় দাঁত ফোঁটাতে পারলে… চুটকি বাজাল সে, আহ!

কিন্তু ও তোমাকে ভাল চোখে দেখছে বলে মনে হলো না, কণিকা। বলল।

তা ঠিক। অতিরিক্ত চালাক, ডলি বলল। সম্মোহনের অনেক চেষ্টা করেছি। চোখের দিকেই তাকাতে চায় না। এখানকার ভ্যাম্পায়ারের ব্যাপারে কিছু জানে নাকি কে জানে! জন আর লীলা মরার সময় কাউন্ট ড্রাকুলা এখানে ছিলেন না। তার ধারণা, ওদের মরার ব্যাপারে এখানকার কারও হাত থাকতে পারে।

মুসার কথা বলছ?

অন্য কেউও হতে পারে!

ভঙ্গিতে তো মনে হচ্ছে আমাকে সন্দেহ করছ! নাকি? তোমার সঙ্গে কিন্তু কাউন্টের পরিচয় হয়নি এখনও, ঘুরিয়ে জবাব দিল ডলি। কোথায় থাকো সেটাও জানি না আমরা…

কাউন্টের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা ছিল জনের। কিন্তু সে-ই তো নেই।…চলো, ভেতরে চলো। দেরি দেখলে মুসারা আবার অবাক হয়ে ভাববে আমাদের কি হলো।

থিয়েটারের দরজার দিকে পা বাড়াল কণিকা।

.

০৪.

 স্টেজের কিনারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সব মুসা। তিরিশ-বত্রিশজন ছেলেমেয়ে আছে ঘরে। একসঙ্গে কথা বলছে সবাই। হই-চই, হাসাহাসি করছে।

কোনজন? ভাবছে সে। ওদের মধ্যে ভ্যাম্পায়ার কে? আছে কি কেউ?

সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। সামনের সারির ওই চটপটে মেয়েটাই কি সারাদিন কফিনে শুয়ে কাটিয়ে রাতে বেরোয়? নাকি ওই ছেলে দুটো? চেঁচিয়ে, পরস্পরের পিঠে চাপড় মেরে উল্লাস করছে যারা?

ও নিশ্চিত, জন আর লীলাই শেষ নয়। ওদের দলে ভ্যাম্পায়ার আরও আছে। রিকি শরকে শেষ করেছে লীলা। জন দিচ্ছিল জিনাকে শেষ করে আরেকটু হলেই। অল্পের জন্যে বেঁচেছে জিনা।

বেটে, মোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা গটগট করে হেঁটে এসে ঢুকলেন স্টেজে। সোনালি চুল ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। কোলাহল ছাপিয়ে চিৎকার করে বললেন তিনি, অ্যাটেনশন, প্লীজ! আমার কথা শোনো তোমরা!

ধীরে ধীরে কমে এল চিৎকার-চেঁচামেচি, হট্টগোল। আমি মিসেস রথরক। স্যান্ডি হোলোর এই কমিউনিটি থিয়েটারের পরিচালক। একসঙ্গে তোমাদের এতজনকে দেখে খুব ভাল লাগছে আমার।

নাটকটা সম্পর্কে বলতে আরম্ভ করলেন তিনি। আগ্রহ হারাল মুসা। অডিটরিয়ামের সীটে বসা ছেলেমেয়েদের দিকে নজর ফেরাল আবার। ওসব। হাসিমুখের যে কোনটার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক শ্বদন্ত। সুন্দর চেহারাগুলোর যে কোনটা নিমেষে পরিবর্তিত হয়ে রূপ নিতে পারে। ভয়াবহ দানবে।

কেশে গলা পরিষ্কার করলেন মিসেস রথরক। আবার তার দিকে ফিরল মুসা।

শুরু করা যাক, বললেন তিনি। রবিন মিলফোর্ড, উঠে এসো। তোমাকে দিয়েই শুরু করি।

সীটের সারির পাশ দিয়ে মঞ্চের দিকে এগোল রবিন। চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। মঞ্চে উঠলে তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন মিসেস, রথরক। তাতে সংলাপ লেখা। পড়া আর অভিনয় একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে।

শুরু করল রবিন।

মুসার চোখ ওর দিকে। পাশ থেকে চমকে দিল ডলি, মুসা, আমি এসে গেছি।

ফিরে তাকাল সে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ডলি। বলল, দেরি করে। ফেললাম নাকি?

না, মাত্র শুরু করেছে। রবিনই প্রথম। যে রকম ঢিলামি শুরু হয়েছে, কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে দেবে। হয়তো দেখা যাবে আজ আর সবার টেস্ট নেয়াই হলো না।

তুমি কোন পার্টটা করছ?

ডলির গায়ের পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে মুসা। পরিচিত লাগছে গন্ধটা। মনে করতে পারছে না। আমার এসব নাটক-ফাটক ভাল্লাগে না। তবু যদি করতেই হয় সবচেয়ে ছোটটা নেব, ডেলিভারি বয়। মাত্র পাঁচ লাইনের সংলাপ। দিলে দিল দিলে নাই।

লেডি ভ্যাম্পায়ারের পার্ট করার ইচ্ছে আমার, গর্বের সঙ্গে বলল ডলি। ডায়লগ আগেই নিয়ে গিয়ে মুখস্থ করে ফেলেছি। আশা করছি পেয়ে যাব। চরিত্রটা।

পরীক্ষা দেয়া শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এল রবিন। ডলিকে জিজ্ঞেস করল, কণিকা আসেনি?

এসেছে, হাত তুলে দেখাল সে, ওই তো।

আমাকে খুঁজছ? এগিয়ে এল কণিকা। পেছনে কিমি।

কেন খুঁজছ? জানতে চাইল কণিকা।

 না, এমনি। এলে একসঙ্গে, তারপর আর দেখা নেই…

ও। চলো, বসি।

আগের সীটটায়ই গিয়ে বসল রবিন। পাশে কণিকা। কিমি বসল টনির পাশে।

মুসার দিকে তাকাল ডলি। লম্বা চুলে ঝাঁকি দিয়ে হেসে বলল, আবার সেই তুমি আর আমি। একা।

জবাব দিল না মুসা।

 মিসেস রথরক বললেন, টনি হাওয়াই, অভিনয় করবে? বলে ঘুরতেই ডলির ওপর চোখ পড়ে গেল, ও, ডলিও এসে গেছ। ভাল। তোমার কথাই ভাবছিলাম।

এখানকার ছেলেমেয়েদের অনেকেই তার পরিচিত।

হ্যাঁ, এসেছি, এক পা এগিয়ে গেল ডলি।

 টনির আগে তুমি টেস্ট দিতে চাও?

 অসুবিধে নেই। উনি আগে গেলেও হয়।

ঠিক আছে, তুমিই এসো আগে। তোমার চরিত্রটা বড়।

এগিয়ে গেল ডলি। মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে দর্শকের দিকে ফিরে হাসল।

অনেকের মত মুসাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

ভ্যাম্পায়ার হওয়া বড়ই কঠিন কাজ, সংলাপ বলার আগে লেকচার দিতে শুরু করল ডলি। যে না হয়েছে, সে বুঝবে না। গুঙিয়ে উঠল সে।

বাই ভাবল অভিনয় করছে ডলি, কিন্তু কণিকা আর কিমি বুঝতে পারছে, গোঙানিটা সত্যি। খিদেয় এমন করছে।

একটা বিশেষ দৃশ্য অভিনয় করে দেখাতে বললেন মিসেস রথরক।

 অভিনয় শুরু করল ডলি।

ভালই, বলে উঠল মুসার কাছে দাঁড়ানো একটা মেয়ে। তবে অতি অভিনয় করছে।

ফিরে তাকাল মুসা। মেয়েটা সুন্দরী। কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে বলতে পারবে না। মঞ্চের দিকে চোখ থাকায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ। মাথাভর্তি কালো চুল। এত নিঃশব্দে এল কি করে! ভ্যাম্পায়ার নাকি?

ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, কি বললে?

বললাম, অতি অভিনয়। নাটক না হয়ে কার্নিভলের যাত্রা হয়ে যাচ্ছে।

 আস্তে বলো। শুনতে পেলে দুঃখ পাবে।

 পায় পাক। ভুল তো আর বলিনি।

 খুব বেশি আত্মবিশ্বাস মনে হচ্ছে তোমার?

জবাবে হাসল মেয়েটা। ডান হাতটা মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি অ্যানি। ওই চরিত্রটার জন্যেই টেস্ট দেব আমিও।

কয়েক মিনিট পর ডলিকে বিদেয় করে দিয়ে মিসেস রথরক ডাকলেন, এনিড ক্যামেরন, এবার তুমি এসো।

নড়ে উঠল অ্যানি। মুসার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হেসে বলল, যাচ্ছি, দোয়া কোরো।

হালকা পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে মঞ্চে উঠল সে।

ভ্যাম্পায়ার হিসেবে কাকে বেশি সন্দেহ করা উচিত, ভাবতে লাগল মুসা। ডলি, না অ্যানি? অ্যানিই হবে। ডলি অতিমাত্রায় সরব। অ্যানি শান্ত। ছায়ার মত নিঃশব্দ চলাফেরা তার।

অ্যানি অভিনয় শুরু করতেই নীরব হয়ে গেল সমস্ত অডিটরিয়াম। যেন কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সে। নাক কুঁচকাল, মোরগের মত ঘাড় কাত করল, হাসল, ভ্রূকুটি করল।

তাকিয়ে আছে সবাই।

মুসা নাটক বোঝে না। কিন্তু অ্যানি আর ডলির অভিনয় দেখে এটুকু অন্তত বুঝল, দুজনের মধ্যে কে ভ্যাম্পায়ারের অভিনয় ভাল করতে পারবে।

ডায়লগ বলা শেষ হতেই তুমুল হাততালি পড়তে লাগল। লজ্জা পেল অ্যানি। লাল হয়ে গেল। মঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে এল মুসার দিকে।

তুমি দারুণ অভিনয় করো! প্রশংসা করল মুসা। সত্যি বলছ? পার্টটা পেলে খুব খুশি হতাম।

ওর চকচকে বাদামী চোখের দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। কোমল, কেমন যেন পুরানো ধাচের চোখ। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে ওর। ভ্যাম্পায়ারের বয়েসের কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। কোন্ আমলের মানুষ অ্যানি!

এখান থেকে বেরিয়ে কোন কাজ আছে তোমার? জানতে চাইল অ্যানি।

নাহ। চলো না তাহলে হেঁটে আসি কোনখান থেকে। সৈকতে যাবে?

তা যাওয়া যায়, ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভেবে বুকের মধ্যে কাপুনি শুরু হয়ে গেল মুসার। কিন্তু অ্যানি কি সতি, ভ্যাম্পায়ার? বাইরে নির্জনতার মধ্যে না গেলে সেটা বোঝা যাবে না। প্রমাণ করতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে। ভূতের সঙ্গেই বেরোতে হবে।

দাঁড়াও, আসছি, বলে বাথরূম সারতেই বোধহয় মঞ্চের পেছনের পর্দা। সরিয়ে ওপাশে চলে গেল অ্যানি।

বেশি মানুষের সঙ্গে জানাশোনা হবে, তত ভাল। ভ্যাম্পায়ারের খোঁজ পাওয়া সহজ হবে। কোনজন যে ভ্যাম্পায়ার, কাছাকাছি না এলে বোঝা যাবে না।

সীটের দিকে ফিরে দেখল রবিন আর কণিকা বেরিয়ে যাচ্ছে।

পেছনে এসে দাঁড়াল ডলি। বলল, কিছুক্ষণের মধ্যে কে কোন পার্টটা পাবে, ঘোষণা করবেন মিসেস রথরক।

তুমি যেটা চাইছ, পাবে বলে মনে হয়?

না পাওয়ার কোন কারণ আছে? চোখের পাতা সরু হয়ে এল ডলির।

না না, তা বলছি না, ডলির প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হলো মুসা। তুমি কি ভাবছ সেটা জানতে চাচ্ছিলাম। রাগার কিছু কিন্তু বলিনি।

সামলে নিল ডলি, পার্টটা আমিই পাব।

অভিনয় তেমন বুঝিটুঝি না। তবে আমার মনে হয়েছে ভাল অভিনয় করেছ তুমি।

চেহারা আবার স্বাভাবিক হয়ে এল ডলির। বাইরে যাবে? চলো না, ঘুরে আসি। বদ্ধ ঘরে ভাল লাগছে না।

তোমার সঙ্গে যেতে পারব না।

 কেন? ঘাড় বাকিয়ে তাকাল ডলি।

 ঘাবড়ে গেল মুসা। আবার রেগে যাবে না তো!

না, আর রাগল না ডলি। মুসার চোখের দিকে তাকাল। আঠার মত আটকে গেল যেন দৃষ্টি।

মুসার মনে হতে লাগল তাকে কোন অদ্ভুত জায়গায়, স্বপ্নের মধ্যে টেনে নিয়ে চলেছে মেয়েটা। নিচের অন্ধকার খাদের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

এমন লাগছে কেন! জোর করে চোখ সরিয়ে নিল।

অবাক হলো ডলি। সেই সঙ্গে হতাশ। অভিমানের সুরে বলল, আমার সঙ্গে যেতে পারবে না কেন?

অ্যানিকে কথা দিয়ে ফেলেছি-ওর সঙ্গে বেরোব।

 হতাশা ছেয়ে দিল ডলির চেহারা।

ওর অবস্থা দেখে মায়া লাগল মুসার। তুমি যেতে চাও আগে বললে না কেন? তাহলে অ্যানিকে আর…

অ্যাটেনশন প্লীজ! জোরে জোরে বলতে লাগলেন মিসেস, রথরক। আমার কথা শোনো! নাটকের জন্যে যারা যারা সিলেক্টেড হয়েছ, তাদের নাম ঘোষণা করছি। সবাই তোমরা ভাল অভিনয় করেছ। এত ভাল যে, কাকে বাদ দিয়ে কাকে নেব সেটা ঠিক করতেই বেকায়দায় পড়ে গেছি। সবাইকে নেয়ার মত এত চরিত্র আমাদের নাটকে নেই। তাই বাধ্য হয়ে কয়েকজনকে বাদ দিতে হয়েছে…

যারা বাদ পড়েছে তাদের দুঃখ ঘোচানোর জন্যে প্রচুর ভাল ভাল কথা বললেন তিনি। সান্ত্বনা দিলেন। শেষে নাম ঘোষণা করতে লাগলেন।

টনি, রবিন, মুসা তিনজনেই সুযোগ পেল। পেল কণিকা আর কিমি। অ্যানিকে মেইন রোলটা পেতে দেখে অবাক হলো না মুসা। ডলিকে দেয়া হলো একটা বড় চরিত্র। ডলি তাতে খুশি হতে পারল না মোটেও। অ্যানি যেটা পেয়েছে সেটা চেয়েছিল সে।

মুসা, রোলটা পেয়েই গেলাম শেষ পর্যন্ত! উল্লাসে ফেটে পড়ার উপক্রম হলো অ্যানির।

পাবে, সে তো জানা কথা। তোমার পাওয়ার ব্যাপারে একবিন্দুও সন্দেহ ছিল না আমার।

সত্যি বলছ?

মিথ্যে বলব কেন?

থ্যাংক ইউ, ঝলমলে হাসি উপহার দিল অ্যানি। চলো, বেরোই। নাকি আরও থাকবে?

না, আর কি? হয়েই তো গেল। টেস্ট দিলাম, চান্স পেলাম, ব্যস।

এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল মুসা। ধরে রাখল, অ্যানির বেরোনোর জন্যে।

বাইরে বেরিয়ে আগে আগে হাঁটতে শুরু করল অ্যানি। মুসাও পা বাড়িয়েছে, খুট করে শব্দ হলো পেছনে ফিরে তাকাল। সাৎ করে একটা ছায়া সরে গেল দরজার কাছ থেকে। ক্ষণিকের জন্যে আলো পড়ল ছায়াটার। মুখে। ডলিকে চিনতে ভুল হলো না তার।

একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ডলি। তারপর দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। রাগ দেখাল। মুসার সঙ্গে বেরোতে না পারার দুঃখ ভুলতে পারছে না।

কিছু করার নেই মুসার। অ্যানিকে কথা দিয়েছে আগে।

.

০৫.

সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদের দিক মুখ তুলে তাকাল অ্যানি। জ্যোৎস্নায়। অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছে ওকে।

 মেয়ে ভ্যাম্পায়াররা যে সুন্দরী মেয়ের রূপ ধরে আসে, ভোলেনি মুসা। কিন্তু অ্যানিকে ভ্যাম্পায়ার ভাবতে ভাল লাগল না। তবে অসতর্কও হলো না। ভ্যাম্পায়াররা নানা ছলনা জানে। ওদের মায়ার জালে জড়ালে রিকি আর জিনার অবস্থা হতে দেরি হবে না তারও।

পানির কিনার দিয়ে হাঁটছে ওরা। নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। ডানে পাথরের জেটিতে আছড়ে পড়ছে ঢেউ।

সামনের দিকে হাত তুলে অ্যানি জিজ্ঞেস করল, ওরা কি তোমার বন্ধু?

পানিতে নেমে পাশাপাশি হাঁটছে রবিন আর কণিকা। ঢেউ আছড়ে পড়ছে ওদের পায়ে।

মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদ। অন্ধকারে হারিয়ে গেল দুজন। আবার যখন বেরোল চাঁদ, আর দেখা গেল না ওদের।

অবাক হলো মুসা। এত তাড়াতাড়ি গেল কোথায় ওরা?

কয়েক মিনিট নীরবে হাঁটল মুসা আর অ্যানি। আবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। অনবরত চলতে লাগল চাঁদের এই লুকোচুরি খেলা।

অ্যানি বলল, রাত নিশ্চয় অনেক। কটা বাজে?

অন্ধকারে ঘড়ি দেখার চেষ্টা করল মুসা। দেখা যাচ্ছে না। এগারোটার বেশিই হবে।

বাড়ি যাওয়া দরকার। দেরি করলে আম্মা চিন্তা করবে।

বাহ, ভ্যাম্পায়ারের আবার আম্মাও থাকে!–ভাবল মুসা। যদিও এখন পর্যন্ত কোন রকম অস্বাভাবিক আচরণ করেনি অ্যানি। সময় নিচ্ছে আরকি। ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

কাল যাচ্ছ তো থিয়েটারে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

নিশ্চয়ই।

 চলো, তোমাকে দিয়ে আসি।

লাগবে না। আমি একাই চলে যেতে পারব। শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না তোমার।

শহরের দিকে রওনা হয়ে গেল অ্যানি। যতক্ষণ দেখা গেল ওকে, তাকিয়ে। রইল মুসা।

ধীরে ধীরে বালিয়াড়ির ওপাশে হারিয়ে গেল অ্যানি।

*

খুব ভাল লাগছে আমার, কিমি বলল। আজকের রাতটা খুব সুন্দর।

আমারও ভাল লাগছে, টনি বলল। সৈকতের কিনারে সাগরের দিকে মুখ করা বারান্দায় বসে আছে দুজনে। মস্ত কটেজটা ভাড়া নিয়েছেন টনির বাবা।

চলো না, সৈকতে হেঁটে আসি।

কি দরকার। এখানেই তো ভাল লাগছে।

তা লাগছে। গেলে আরও ভাল লাগত, সুযোগের অপেক্ষায় আছে। কিমি। টনিকে সম্মোহিত করে, ওষুধ শুকিয়ে কাবু করে রক্ত খাওয়ার অপেক্ষা। এভাবে বসে থাকলে সে-সুযোগ পাবে না। উঠে দাঁড়াল সে। রেলিঙের কাছে গিয়ে পেট ঠেকিয়ে দাঁড়াল।

খানিকক্ষণ বসে থেকে টনিও উঠে গেল।

ফিরে তাকাল কিমি। টনির মুখোমুখি হলো। জ্যোৎস্নায় খুব সুন্দর লাগছে ওকে। টনির চোখ আটকে গেল কিমির চোখে।

আরও কাছে চলে এল কিমি। হাত নাড়ল টনির নাকের সামনে। কিমির চাহনিতেই কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল টনি, মিষ্টি গন্ধে অবশ হয়ে আসতে লাগল শরীর।

ওর কাঁধে দুই হাত রাখল কিমি। ধীরে ধীরে মুখটা নামিয়ে আনতে লাগল। গলার কাছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে দপদপ করছে শিরাটা। মুহূর্তে খিদে চাগিয়ে উঠল। প্রবল হয়ে গেল রক্তের তৃষ্ণা। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল আপনাআপনি। বেরিয়ে পড়ল তীক্ষ্ণ মাথাওয়ালা শ্বদন্ত। কুটুস করে ফুটিয়ে দিলেই হলো এখন। রক্ত বেরিয়ে আসবে ফিনকি দিয়ে। চুষে চুষে খাবে সে।

সাবধান, অত উতল হয়ো না!–নিজেকে হুঁশিয়ার করল কিমি। লোভ সামলাও। রক্ত শুষে ওকে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলো না। ও মরে গেলে ভীষণ বিপদে পড়বে।

শিরাটার ওপর মুখ নামাল সে। দাঁত চেপে ধরল। ফুটিয়ে দিতে যাবে, ঠিক এই সময় শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার, অ্যাই, কি করছ তোমরা?

ঝটকা দিয়ে মুখ সরিয়ে একলাফে পিছিয়ে গেল কিমি। ঠোঁট দিয়ে চেপে ঢেকে ফেলল দাঁত দুটো। গলা শুনেই বুঝতে পারল টনির বোন সিসি। সর্বনাশ! শঙ্কিত হলো কিমি। বিন্দু মেয়েটা শ্বদন্ত দুটো দেখে ফেলেনি তো?

টনিরও ঘোর কেটে গেল। চিৎকার করে উঠল, সিসি, চেঁচাচ্ছিস কেন?

দেখতে এসেছিলাম, তোরা কি করছিস, বলে হি-হি করে হাসতে লাগল সিসি।

রাগ আগ্নেয়গিরির লাভার মত ফুটতে শুরু করল কিমির মগজে। সিসির ঘাড় চেপে ধরে ওর গলাতেই দাঁত ফুটিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সেটা করতে যাওয়া হবে চরম বোকামি। যতই ঝগড়া করুক, বোনকে প্রচণ্ড ভালবাসে টনি। মুসা আর রবিনও পছন্দ করে। সিসির কিছু হলে। ভ্যাম্পায়ারের পেছনে আদাজল খেয়ে লাগবে তিনজনে। সাংঘাতিক বিপদে ফেলে দেবে। স্যান্ডি হোলো ছাড়তে বাধ্য করবে।

নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালাল কিমি।

পারছে না কোনমতে। পেটে খিদে না থাকলেও এক কথা ছিল। এখানে থাকলে নিজেকে সামলাতে না পেরে শেষে কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে কে জানে! চলে যাওয়াই ভাল।

আমি যাই, টনি, বলে আর একটা মুহূর্ত দাঁড়াল না সে। দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করল। কানে এল, ওর চলে যাওয়ার জন্যে বোনকে দায়ী করে বকাবকি শুরু করেছে টনি।

*

রাত দুপুরে ঘনঘন কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। এতরাতে কে? আধো ঘুম নিয়ে বিছানা থেকে নামল সে। দরজা খুলতে চলল।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিশ অফিসার। মুসার নাম জানতে চাইল একজন।

মুসা।

 পুরো নাম?

মুসা আমান।

 আজ রাতে এনিড ক্যামেরনের সঙ্গে সৈকতে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ, ডলে ডলে চোখ থেকে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করল মুসা। কেন? কিছু হয়েছে নাকি?

কটার সময় শেষ দেখেছ ওকে?

এই….এগারোটা-সাড়ে এগারোটা হবে।

 তোমার আব্বা আছেন বাসায়?

না, মাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে হ্যাঁমারহেডে। বলে গেছে শনিবার নাগাদ আসবে। কেন, বাবাকে দরকার?

না, তোমাকেই দরকার।

পরস্পরের দিকে তাকাল দুই অফিসার। একজন পুরুষ। ছয় ফুটের বেশি লম্বা। মাংসপেশীর পাহাড় মনে হয়। দ্বিতীয়জন কঠোর চেহারার মহিলা। দুজনেই গম্ভীর।

অ্যানির কিছু হয়েছে? জানতে চাইল মুসা।

ওকে পাওয়া যাচ্ছে না, অফিসার জানাল।

কে খবর দিল আপনাদের?

 ওর আম্মা।

তারমানে সত্যি সত্যি আম্মা আছে অ্যানির। ভ্যাম্পায়ার নয় সে।

কোথায় তাকে শেষ দেখেছ? জানতে চাইল মহিলা অফিসার।

সৈকতে।

 সৈকতের কোনখানে?

শহরের কিনারে। একটা বালিয়াড়ির কাছে। কমিউনিটি থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ওখানে হাঁটতে গিয়েছিলাম আমরা।

জায়গাটা আমাদের দেখাতে পারবে?

 মাথা ঝাঁকাল মুসা।

কাপড় পরে তাহলে এসো একটু আমাদের সঙ্গে।

পেট্রলকারের পেছনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মুসা।? ভেসে ভেসে যেন সরে যাচ্ছে নির্জন, ঘুমন্ত শহরটা। খড়খড় করছে টু-ওয়ে রেডিওর স্পীকার। কথা হচ্ছে। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছে অফিসাররা, বুঝতে পারল না সে।

অ্যানির কথা ভাবতে লাগল। মনে পড়ছে ওর চকচকে চুল। উজ্জ্বল হাসি।

আস্তে চালান, শহরের কিনারে পৌঁছে অফিসারদের বলল সে। আরেকটু সামনেই। মসৃণ, রূপালী সৈকতটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁ, থামুন, এখানেই।

সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল অফিসার।

গাড়ি থেকে নামল মুসা। ছোট বালিয়াড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে গিয়ে ঠাণ্ডা বালি ঢুকছে জুতোর মধ্যে।

ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে দুই পুলিশ অফিসার। ওদের হাতের শক্তিশালী টর্চের রশ্মি হলুদ আলোর বৃত্ত সৃষ্টি করছে বালিতে।

এখানেই হাঁটছিলাম আমরা, মুসা বলল। গালে এসে লাগছে সাগরের। ফুরফুরে হাওয়া। নোনা গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে পচা শ্যাওলার গন্ধ।

পেছনে দুদিকে সরে গিয়ে আলো ফেলে ফেলে দেখতে শুরু করল দুই অফিসার।

সৈকতের এপাশ-ওপাশ, সামনে-পেছনে চোখ বুলিয়ে অনুমানের চেষ্টা করল মুসা, কোথায় যেতে পারে অ্যানি?

রাতে এই সৈকত ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সর্বক্ষণ চলে ভ্যাম্পায়ারের আনাগোনা।

বালিয়াড়ির সাদা বালিতে উঁচু হয়ে আছে কালোমত একটা কি যেন। শেষবার এই বালিয়াড়িটার আড়ালেই হারিয়ে যেতে দেখেছিল অ্যানিকে। কৌতূহল হলো। এগিয়ে চলল ওটার দিকে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল, টর্চ হাতে খুজতে খুজতে দূরে সরে যাচ্ছে দুই অফিসার। পানির কিনারে খুঁজছে দুজনে। হয়তো ভাবছে রিকির মত পানিতে ডুবে মারা গেছে অ্যানিও।

কালো ঢিবিটার কাছে চলে এল মুসা। ভালমত দেখার জন্যে নিচু হয়ে তাকাল। পরক্ষণে সোজা হয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল দুই অফিসারকে।