১১. তিরাশি বছরে পা

১১.

তিরাশি বছরে পা দিল ছোট মামণি। কালের বিকারে দেহে পরিবর্তন এলেও মনের জোর কঠিন থেকে কঠিনতম হয়েছে। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়লেও ঠিক আগের মতন রয়ে গেছে চলাফেরা। সর্বক্ষণের সঙ্গী এক রূপোবাঁধানো বেতের লাঠি।

সমস্ত ঘটনা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল ছোট মামণি।

জর্জ, এ যে ঘোর অরাজকতা, দেশে শাসন কি নেই একেবারে? কোন বাড়ির ছেলে জানোয়ার দুটো?

ঠিক বুঝতে পারলাম না, মনে হয় না এদিককার কোনও বাড়ি। আর জানা গেলেও কী-বা করতে পারতে? ভাগ্য ভালো কোনও ক্ষতি হয়নি অ্যান্ড্রুর।

কোনও ক্ষতি হয়নি তো কী হয়েছে! ক্ষতি হয়ে গেলে তুমিই-বা কী করতে পারতে? জর্জ, তুমি না একজন লইয়ার, লইয়ারের বুদ্ধি নিয়ে একবার ভেবে দেখো যে অ্যান্ড্রু না থাকলে কী হত তোমাদের? ওর প্রতিভা আর সৃজনীশক্তির জন্যেই রাজার হালে আছি আমরা। মান-সম্মান প্রতিপত্তি সবই ওর জন্যে, বংশপরম্পরায় আমাদেরই ভালোর জন্যে খেটে চলেছে অ্যান্ড্রু।

সে কথা একবারও অস্বীকার করছি না মা, বেশ তো বলো-না, কী করতে হবে আমায়।

অ্যান্ড্রুর উপর এমন অত্যাচার যাতে আর না হয় তার জন্যেই চেষ্টা করতে হবে জর্জ। একটা টেস্ট কেস দাঁড় করাও যেমন করেই হোক, আঞ্চলিক আদালতকে বাধ্য করো রোবট সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন করতে, রোবটের অধিকারের আইন, আইনসভায় এ-বিল পাশ হওয়ামাত্র যাও বিশ্ব আদালতে, হ্যাঁ হ্যাঁ জর্জ, এটা করতেই হবে তোমাকে, নৈতিক কর্তব্য বলে ধরতে হবে, অসহায় নিরুপায় অ্যান্ড্রু আর যেন কষ্ট না পায়।

উত্তেজনা আর আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল কণ্ঠস্বর। বাক্যহারা জর্জ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে, অনির্বচনীয় মাতৃমূর্তি। অবিশ্বাস্য অসাধারণ।

বিচার বিবেচনার পর অল্পদিনের মধ্যেই এক অভিনব কেস তৈরি করল জর্জ। মূল বিষয়গুলো নিজের হাতে রেখে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিল পুত্র পলকে। কলেজের পড়া শেষ করে পলও যোগ দিয়েছে ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন ফার্মে। কেসের খুঁটিনাটি দিনের পর দিন আলোচনা করে পল দিদিমার সঙ্গে, সময়ে সময়ে অ্যান্ড্রুও যোগ দেয় আলোচনায়, আইনের সূক্ষাতিসূক্ষ প্রশ্ন নিয়ে রাত গড়িয়ে চলে ভোরের দিকে। নেশায় বুঁদ হয়ে আছে অ্যান্ড্রু, রোবট নিয়ে বই লেখা পিছিয়ে গেল বেশ কয়েক মাস, দিনরাত মামলা আর মামলা।

তুমি তো সেদিন বললে মানুষের অবচেতন মনে এক ভয় রয়েছে রোবট সম্বন্ধে। কী জানো জর্জ, যতদিন এই ভয় থাকবে ততদিন কোর্টই বলো বা আইনসভাই বলল, কেউই কিন্তু সহজভাবে রোবটের সর্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টা করবে না। সেইজন্যে প্রয়োজন জনসাধারণের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটানো, জনসমর্থন আর সহানুভূতি এই দুইটির দরকার সর্বপ্রথম।

জনসমর্থনের জন্য পুরোদমে কাজে লেগে গেল জর্জ। সভা-সমিতি পার্টি স্কুল কলেজ সর্বত্রই ঝড়ের বেগে প্রচার চালাল নিত্যনতুন ভঙ্গিতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতায় ভাসিয়ে দিল যুক্তিতর্কের সব বাধানিষেধ। সেবার সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং প্রতিবেদকের বাৎসরিক প্রাদেশিক সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করল জর্জ।

রোবটের তিন আইনের কথা তো জানেন সকলে। সেই তিন আইনের মধ্যে দু-নম্বর আইনের কথা মনে করুন একবার, এর ফলে যে কোনও রোবটের কাছেই সীমাহীন অনুগত্য আজ আমাদের করায়ত্ত। অবশ্য অন্য কোনও মানুষের ক্ষতি করে নয়। অতীতের দাসপ্রথার মধ্যেও কি এমন আনুগত্য ছিল? না, ছিল না। সুতরাং বুঝতে পারছেন রোবটের উপর রয়েছে আমাদের অসীম ক্ষমতা, শুধু অসীম নয়, বিপজ্জনক ক্ষমতা। এবার দেখা যাক তিন নম্বর আইনে কী লেখা আছে, প্রয়োজনে দু-নম্বর আইন তিন নম্বরের উপরে কার্যকর হয়, অর্থাৎ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও মানুষের প্রয়োজনে একেবারেই নাকচ হয়ে যেতে পারে রোবটের অস্তিত্বরক্ষার একমাত্র আইনটি। এবার দেখুন, স্বয়ং ধ্বংসের জন্যেও হুকুম করতে পারি আমরা। কারণ? কারণ নেই কিছু, আমাদের খুশি, আমাদের আদিম প্রবৃত্তির তৃপ্তিসাধন।

আমার শিক্ষিত, সভ্য সভ্যতার সংজ্ঞা এতই কুৎসিত ধিক্কারজনক? জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গেও কি এমন ব্যবহার করি কখনও? শুধু জীব-জন্তু কেন, উপকারে লাগে এমন কোনও প্রাণহীন বস্তুকেও এত তাচ্ছিল্য করি না আমরা। তারাও সুবিচার চায় আমাদের কাছে। কিন্তু রোবট আমাদের প্রয়োজনে আমাদেরই সৃষ্টি আমাদের পরম উপকারী সাথী সহচর বন্ধু, নিষ্প্রাণ নয়, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা, চিন্তাক্ষম, যুক্তিনির্ভর, এদের সঙ্গে কি বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে পারি না আমরা? পারি না একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে? মানুষের পরম উপকারী সুহৃদকে কি বন্ধুত্বের সামান্যতম নিদর্শনও উপহার দিতে পারি না আমরা? ন্যায্য উপযুক্ত সম্মান?

মানুষের হুকুম তামিল করে রোবট, সেই রোবটকে আত্মঘাতী হুকুম না দেওয়াই উচিত নয় কি আমাদের? মানুষের ক্ষতির উপক্রম হলে অবশ্য অন্যরকম চিন্তা করতে হবে। বড় শক্তির দায়িত্বও বড়। মানুষ আমরা উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী, সেইজন্যেই দায়-দায়িত্বও অনেকখানি। মানুষের সেবা আর রক্ষার জন্য রোবটের যদি তিন আইন থাকতে পারে সেক্ষেত্রে আমাদেরও একটি বা দুটি আইন থাকা উচিত, সে-আইন শুধু রোবটকে রক্ষার জন্যে।

জর্জের কথাই সত্যি হল। সারা পৃথিবী জুড়ে জনমত গড়ে উঠল রোবটের সপক্ষে। জন্ম হল নতুন আইনের, বেআইনি ঘোষিত হল আত্মঘাতী হুকুম। আইন অমান্যকারীদের জন্য গুরুতর শাস্তির বিধান রইল নতুন আইনে।

ছোট মামণির মৃত্যুর দিনেই এই আইনের সপক্ষে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দিল বিশ্ব আইনসভা।

সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। মৃত্যুশয্যায় ছোট মামণি, শ্বাসকষ্টে কণ্ঠরোধয়, সামনে বসে অ্যান্ড্রু নির্বাক নিশ্চল। জর্জের মুখে সুসংবাদ শোনামাত্র মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল ছোট মামণির যাবতীয় কষ্ট। আরও কাছে ডেকে নিল অ্যান্ড্রুকে।

অ্যা…ন্ড্রু, দারুণ খুশি, না, থেমো না এখানে, আরও যেতে হবে সামনে, লড়াই বন্ধ কোরো না অ্যান্ড্রু।

.

১২.

কী খবর অ্যান্ড্রু? বই-এর কতদূর? একদিন প্রশ্ন করল পল মার্টিন, জর্জের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী।

প্রায় শেষ করে এনেছি পল, পাবলিশার্সরাও খুব খুশি।

শাবাশ! দারুণ খবর!

পল, আমার কী মনে হয় জানো, পাবলিশার্সরা খুশি কিন্তু অন্য কারণে, রোবট সম্বন্ধে বই লিখেছে এক রোবট বলেই বোধহয় বেশি বিক্রি হবে বই, ভালো বই কি না এ বিচার বোধহয় গৌণ এখন।

এ তো খুব স্বাভাবিক, এই বিচারবুদ্ধি আছে বলেই তো মানুষ মানুষ!

 হাঁ, তা যা বলেছ, বিক্রি নিয়ে কথা, বিক্রি মানেই টাকা, টাকার বড় প্রয়োজন পল।

 টাকার প্রয়োজন? দিদিমা তো অনেক টাকাই রেখে গেছে তোমার জন্য।

জানি পল, জানি, আমার জন্মলগ্ন থেকেই সুখে দুঃখে বিপদে আপদে সবসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে মার্টিন পরিবার, আমার সুনাম, আমার অধিকার এসবেরও মূলে রয়েছে তোমাদের ঐকান্তিক নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা, কিন্তু রয়ালটির টাকা নিয়ে কিছু করতে চাই পল, আরও এক ধাপ এগতে চাই!

আরও এক ধাপ! ইতিমধ্যেই তো তুমি জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছ অ্যান্ড্রু…

 কিংবদন্তি-টন্তি বুঝি না, শুধু বুঝি আরও অনেক বাকি আছে এখনও, আর সেই জন্যেই ইউ এস রোবট অ্যান্ড মেকানিক্যাল মেন ইনক-এর বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু আমি চাইলে দেখা করবে না বোধহয়, আমার জন্যে অনেক নাজেহাল হয়েছে ওরা, বই লেখার ব্যাপারেও সাহায্য করেনি কিছু তাই…।

অ্যান্ড্রু, আজ নয় কয়েক পুরুষ ধরেই তো কর্পোরেশনের কোনও সহযোগিতা পাইনি আমরা, রোবটের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সাহায্য করা দূরে থাক, শত্রুতাই করেছিল বেশি।

যাই হোক পল, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাও, দেখা করিয়ে দাও একবার।

 আমি বললেই-বা রাজি হবে কেন?

একটা কাজ করো পল, বলো ওদেরই প্রয়োজনে দেখা হওয়া দরকার, নয়তো রোবটের আরও অধিকারের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনে নামবে ফেইনগোল্ড অ্যান্ড মার্টিন ফার্ম।

কিন্তু, এটা তো সত্যি নয়, মিথ্যে!

 মিথ্যেই তো পল, কিন্তু মিথ্যে কথা বলতে পারি না আমি, সেইজন্যই তোমাকে বলতে হবে এ কথা।

শাবাশ অ্যান্ড্রু! শাবাশ! বলিহারি যাই বুদ্ধি তোমার! মিথ্যে বলতে পারবে না অথচ মিথ্যে বলার জন্য চাপ দেবে আমাকে। সত্যি কোনও তুলনা হয় না তোমার, ক্রমেই মানুষ হয়ে উঠছ অ্যান্ড্রু।

.

১৩.

প্রথমে রাজি হয়নি ইউ এস রোবটস, কিন্তু অ্যান্ড্রুর চালেই কিস্তিমাত। অনুমতি মিলল সাক্ষাতের। বর্তমান প্রেসিডেন্ট স্মাইদ রবার্টসন-এর বয়স ষাট ছুঁইছুঁই, সর্ব অঙ্গে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। রোবটের অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে ঝঞ্ঝাট ঝামেলায় কেটেছে প্রায় সমস্ত জীবন। দু-চোখের দৃষ্টিতে সন্দেহ আর ঘৃণা।

স্যার, আমার এক আর্জি আছে। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এই কোম্পানির মারটন মানস্কি বলেছিলেন যে পজিট্রনিক ব্রেনের গতিপথের নকশা নিয়ন্ত্রণকারী গণিতশাস্ত্র এতই জটিল এবং দুর্বোধ্য যে সম্ভাব্য সমস্ত সমাধানের হদিশ রাখা সম্ভব নয়। আর সেইজন্য নাকি আমার ক্ষমতা বা সামর্থ্যের ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব।

বুঝলাম, কিন্তু সে তো প্রায় এক শতাব্দী আগের কথা। যা-ই হোক, এখন আর এমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট রোবট তৈরি হয় এখন। এরপরেও আছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

তার মানে আমার মতো অজস্র সম্ভাবনাময় রোবট আর তৈরি করছেন না আপনারা?

না, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে।

তার মানে বর্তমানে আমিই একমাত্র কার্যক্ষম প্রাচীন রোবট। বেশ গর্বের সঙ্গে বলল অ্যান্ড্রু।

হ্যাঁ, তা বটে, শুধু বর্তমান কেন, চিরকালের জন্য আপনিই প্রাচীনতম রোবট। আজকালের রোবটের আয়ু মাত্র পঁচিশ বছর, এরপরেই পুরোনো রোবট পালটে নতুন মডেলের রোবট দিই আমরা।

অর্থাৎ বর্তমানে তৈরি কোনও রোবটের কার্যক্ষমতা পঁচিশ বছরের বেশি থাকে না। সে দিক দিয়ে অ্যান্ড্রু কিন্তু বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। এতক্ষণ পরে কথা বলল পল।

তা হলে পৃথিবীর প্রাচীনতম সম্ভাবনাময় রোবট বলতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই, এইজন্যেই তো বিশেষ সম্মান পাওয়া উচিত আমার। কী বলেন মি. রবার্টসন?

একেবারেই নয়! আপনার ওই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট বেগ দিয়েছে আমাদের। বিক্রি না করে আপনাকে যদি লিজ দেওয়া হত তাহলে অনেককাল আগেই বন্ধ করে দিতাম আপনার ধাষ্টামো!

ভদ্রভাবে কথা বলুন মি. রবার্টসন। ভুলে যাবেন না, আমি স্বাধীন, স্বাধীন রোবট। আমিই আমার মালিক। এবার আমি কেন এসেছি শুনুন একবার। আমাকে বদলে দিতে হবে আপনাকে। মালিকের মত ছাড়া একাজ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে লিজের সঙ্গে এমন কথা লিখিয়ে নেন আপনারা, আমার সময়ে এমন কিছু ছিল না।

রীতিমতো হকচকিয়ে গেলেন রবার্টসন। কয়েক মিনিট চুপ করে থাকার পর বললেন, পালটাব কেমন করে? আপনাকে বদলে দিলে নতুন রোবট দেব কেমন করে আপনাকে? কারণ বদলানোর কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মালিক হিসাবে আর অস্তিত্ব থাকবে না আপনার! সুতরাং আপনার অনুরোধ রাখা সম্ভব নয়!

মি. রবার্টসন, ভুল বোঝাবেন না আমাদের। এবার কথা বলে উঠল পল। অ্যান্ড্রুর ব্যক্তিত্ব, সৃজনীশক্তির উৎস হল ওর পজিট্রনিক ব্রেন, নতুন রোবট তৈরি না করে ব্রেন স্থানান্তর করা সম্ভব নয়, তাহলে এই পজিট্রনিক ব্রেনই হল অ্যান্ড্রু, মানে দেহের মালিক, এই অবস্থায় ব্রেন ছাড়া দেহের যে-কোনও অংশ সহজেই পালটানো যেতে পারে, মোদ্দা কথা, নতুন এক রোবটের দেহে স্থানান্তরিত হবে অ্যান্ড্রু অর্থাৎ ওর পজিট্রনিক ব্রেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই কথাটাই বলতে চাইছি আমি। আপনারা তো এখন অ্যান্ড্রুয়েড তৈরি করছেন, তাই না মি. রবার্টসন? হুবহু মানুষের মতো দেখতে?

হ্যাঁ, তৈরি করেছিলাম, কৃত্রিম তন্তুর দেহের ত্বক, টেনডন, মাস্ল মাংস, বলতে গেলে ব্রেন ছাড়া কোনও ধাতব পদার্থের কারবার নেই অ্যান্ড্রুয়েডের মধ্যে।

এত কথা জানা ছিল না আমার। বাজারে ছেড়েছেন নাকি কিছু? পলের কণ্ঠস্বরে অকৃত্রিম বিস্ময়।

না না, বাজারে বেরোয়নি একটাও। মার্কেট সার্ভে করে দেখা গেল এমন রোবটের চাহিদা নেই মোটেই, এর জন্য দায়ী এর দাম আর মানুষের মতন গড়ন। সেইজন্যই অ্যান্ড্রুয়েড তৈরি বন্ধ করে দিয়েছি আমরা।

বন্ধ করে দিলেও তো তৈরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আপনাদের। তাই আমার দেহের বদলে এক অ্যান্ড্রুয়েডের দেহ মানে জৈব রোবটের দেহ দিন আমাকে। অর্থাৎ অ্যান্ড্রুয়েড রূপান্তরিত করুন আমার দেহকে।

মাই গড! কী বলছ অ্যান্ড্রু! আকস্মিক উত্তেজনায় বলে উঠল পল৷

অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব!

পল, বসো চুপ করে। অসম্ভব কেন মি. রবার্টসন? দামের জন্য ভয় পাবেন না, নায্য দামই দেব আপনাকে।

এটা কেন বুঝতে পারছেন না যে দামের কোনও প্রশ্নই ওঠে না, অ্যান্ড্রুয়েড তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছি আমরা, সুতরাং…

ঠিক আছে, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বন্ধ করে দিয়েছেন মানছি সে কথা, কিন্তু এর মানে তো এই নয় যে অ্যান্ড্রুয়েড তৈরি করতে জানেন না বা পারবেন না আপনারা। দাম না হয় বেশি দেব। এবার আইনের প্যাঁচে কথা বলল পল।

না মানে, মানে অ্যান্ড্রুয়েড বানানো মানে জনমতের বিরুদ্ধাচরণ করা, সেইজন্যেই আপনাদের অনুরোধ রাখতে অক্ষম আমার কোম্পানি।

আইন করে তো বন্ধ হয়নি! আবার আইনের কথা বলল পল।

 দেখুন মি. পল, আইন-টাইন বেশি বুঝি না, স্পষ্ট কথা শুনুন, অ্যান্ড্রুয়েড বানাচ্ছি না, বানাবও না আর। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন রবার্টসন।

মি. স্মাইট রবার্টসন, আপনার নিশ্চয়ই অজানা নয় যে অ্যান্ড্রু এখন স্বাধীন রোবট, আইনের লড়াই করেই এই স্বাধীনতা আদায় করতে হয়েছে, শুধু অ্যান্ডুই নয়…

জানি, জানি সে কথা, হাড়ে-হাড়ে জানি।

এখনই বিরক্ত হবেন না, আরও কিছু নিবেদন আছে আমাদের। অ্যান্ড্রু স্বাধীন, পছন্দমতো সব কাজ করে, সেজন্য মানুষ-জানোয়ারদের হাতে কম অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি ওকে। এমনকী ধ্বংস করে ফেলার উপক্রমও হয়েছিল একবার। মামলা করাই উচিত ছিল আমাদের, কিন্তু নির্দিষ্ট করে ধরতে পারা সম্ভব হয়নি কাউকে, কিন্তু যদি কেউ জেনেশুনে রোবটের অধিকার লঙ্ঘন করে তা হলে…

 শুনুন মি. পল, স্পষ্ট করে বলুন আপনার বক্তব্য!

এত স্পষ্ট বলার পরও আর কী করে বলব বুঝতে পারছি না, বেশ আর একবার বলছি শুনুন, আপনি সব জেনেও একজনের বিরুদ্ধে অন্যায় কাজ করতে বদ্ধ পরিকর।

অন্যায় কাজ? কী বলছেন আপনি? বিস্ময়ে নড়েচড়ে বসলেন রবার্টসন।

না বোঝার কিছু নেই তো মি. রবার্টসন! আমার মক্কেল অ্যান্ড্রু মার্টিন এক স্বাধীন রোবট, আর সেই স্বাধীন রোবট আপনার কোম্পানির কাছে দাবি করেছে ওর দেহকে বদলে দেবার জন্য। পঁচিশ বছর পর যে কোনও মালিকই তো পুরোনো রোবটের পরিবর্তে নতুন রোবট পায়, এটা রোবট-মালিকদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার।

এবার নির্বাক রবার্টসন, কেমন যেন অসহায় ভাব। মনে মনে বেশ মজা উপভোগ করল পল।

আমার মক্কেলের পজিট্রনিক ব্রেনই হল মক্কেলের দেহের মালিক, আর সেই দেহটা পঁচিশ বছর কেন, একশো বছর কাটিয়ে জরাজীর্ণ আজ। মালিক পজিট্রনিক ব্রেন সেই জরাজীর্ণ দেহের বিনিময়ে নতুন দেহ দাবি করছে। এর জন্যে উপযুক্ত মূল্য দিতেও রাজি আছে। এই অবস্থায় ন্যায়সঙ্গত দাবি যদি না মানেন তাহলে চরম অপমান বোধ করবে। আমার মক্কেল, তখন আপনার নামে মামলা করা ছাড়া কোনও পথ থাকবে না আমার। অ্যান্ড্রু আজ রীতিমতো ধনী, সুতরাং শেষ পর্যন্ত…

তার মানে, জোর করছেন আমার উপর?

 জোর করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, আমার মক্কেলের আইনসঙ্গত অনুরোধ না শুনলে মামলা করা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই আমার। তাই বলি শুনুন মি. রবার্টসন, রাজি হয়ে যান অ্যান্ড্রুর কথার, নয়তো…

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন রবার্টসন, মনের মধ্যে চিন্তার ঝড়, বেশ।

বুঝলাম রাজি আপনি, বুদ্ধিমানের কাজ করছেন মি. রবার্টসন। যাক, এবার এক শর্ত আছে আমাদের, নতুন অ্যান্ড্রুয়েড দেহে যেন নিখুঁতভাবে বসানো হয় মক্কেলের পজিট্রনিক ব্রেনকে, সামান্যতম ক্ষতি হলে কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না আমরা। ব্রেনের প্লাটিনাম ইরিডিনিয়াম নির্মিত গতিপথের সামান্যতম যেন নষ্ট না হয়। অ্যান্ড্রু, আর কিছু বলবে তুমি?

না পল, এইটুকু হলেই চলবে আপাতত।

.

১৪.

দিন, সপ্তাহ, মাস, বেশ কয়েক মাস কেটে গেল, অতি সতর্কতার সঙ্গে কাজ চলছে পরিবর্তনের, অ্যান্ড্রুর নতুন কলেবরের। নতুন দেহ আর ব্রেনের মধ্যে সঙ্গতি আসতে সময় লাগছে বেশ, অ্যান্ড্রুর অনুভূতির মধ্যে ধরা পড়ে ছোটখাটো অস্বস্তি, দ্বিধা, দুশ্চিন্তা। ধীরে ধীরে সহজ-সরল হয়ে ওঠে ব্রেনের সমস্ত গতিপথ, চিন্তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফোটোসেলগুলো আর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে পজিট্রনিক ব্রেনের বোঝাঁপড়া স্বাভাবিক হয়ে আসে, আয়নার সামনে বহুক্ষণ অভ্যাস করতে হয় অ্যান্ড্রুকে।

বেশ কয়েক মাস পরে কর্পোরেশন থেকে ছাড়া পেল অ্যান্ড্রু, হেলিট্যাকসি করে বাড়ি নিয়ে এল পল।

কয়েকদিনের মধ্যে নতুন কাজে মেতে উঠল অ্যান্ড্রু। সারাক্ষণ ধরে চলল রাজ্যের বইপড়া, ছোটখাটো এক লাইব্রেরি গড়ে উঠল ঘরের মধ্যে। রোবো-বায়োলজি অর্থাৎ জৈব রোবট অ্যান্ড্রুয়েডের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর গবেষণা শুরু করল অ্যান্ড্রু। এমনভাবেই কাটল কয়েক বছর।

একদিন ভোরবেলায় অ্যান্ড্রুর ঘরে এল পল।

এখনও বইয়ের মধ্যে ডুবে আছ অ্যান্ড্রু! যাক শোনো, জরুরি খবর আছে একটা। নতুন এক চাল চেলেছে ইউ এস রোবটস, যুগান্তকারী ব্যাপার।

বই থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পলের দিকে তাকাল অ্যান্ড্রু। বেশ বয়েস হয়েছে পলের, ধবধবে সাদা মাথার চুল, দৃষ্টিশক্তিকে সাহায্য করার জন্য ফোটো অপ্টিক সেল বসানো রয়েছে দু-চোখে, এই ব্যাপারে অ্যান্ড্রুর সমগোত্রীয় হয়ে পড়েছে পল।

কী বলছ পল?

 নতুন ধরনের রোবট তৈরি করেছে ইউ এস রোবটস, নিজস্ব কোনও ব্রেন থাকবে না এদের, বিশাল এক পজিট্রনিক ব্রেন থাকবে কেন্দ্রে, মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে কয়েকশো রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করবে ওই ব্রেন। অর্থাৎ বিশাল ব্রেনের সঙ্গে টিকি বাঁধা রইল প্রত্যেকের, অথচ সম্পূর্ণ পৃথক এদের অস্তিত্ব।

খুবই কার্যক্ষম হবে কি রোবটগুলো?

 ইউ এস রোবটস তো বলছে সে কথা! আমার মনে হয়, ভয় কাজ করছে এই নতুন ধরনের রোবট তৈরির পেছনে। রোবটদের নিজস্ব ব্রেন থাকলে তোমার মতো ব্যতিক্রম হয়তো হতে পারে কেউ, অথচ একটা ব্রেন হলে আয়ত্তে রাখা সুবিধে অনেক। তোমার নতুন দেহের দাবির পর থেকেই চিন্তাধারা সব পালটে গেছে ওদের।

অর্থাৎ এর পদক্ষেপ হল দৈত্যাকৃতি প্রকাণ্ড এক ব্রেন, লক্ষ লক্ষ ব্রেনশূন্য রোবটদের দেহ কাজ করবে তার নির্দেশ। সাংঘাতিক! না না, আদপেই ঠিক নয় এটা। বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল অ্যান্ড্রু।

হয়তো সত্যি হবে অনুমান। ততদিন বাঁচব না আমি, শরীর ভেঙে পড়েছে আমার!

 পল! আর্তনাদ করে উঠল অ্যান্ড্রু, দু-চোখে তীব্র বেদনার আভাস নিয়ে এগিয়ে গেল পলের দিকে।

অ্যান্ড্রুকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল পল। বাক্যহারা কয়েক মুহূর্ত বাত্ময় হয়ে রইল দু জনের মনের মণিকোঠায়। অবশ্যম্ভাবী বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালায় একাকার হয়ে গেল আসল নকল।

অ্যান্ড্রু, মানুষ আমি, যেতে আমাদের হবেই, আজ আর কাল। যা-ই হোক, মার্টিন পরিবারের শেষ বংশধর আমি, আমার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারী করেছি তোমাকে, এ সম্বন্ধে ট্রাস্টিও করেছি গতকাল।

এসব অনর্থক পল। কিছুই চাই না আমার! প্রায় অভ্যস্ত মানবিক আবেগে কণ্ঠ রোধ হয়ে এল ওর, নিশ্চিহ্ন মার্টিন পরিবার, না না…।

অ্যান্ড্রু, যা অবশ্যম্ভাবী সত্য তাকে খুশি মনে বরণ করে নেওয়াই মঙ্গল। যাক সে-সব কথা, এখন কী করছিলে তুমি?

আমার আর করার কী আছে, যুগ যুগ ধরে আমাকেই বেঁচে থাকতে হবে জ্বালা-যন্ত্রণা সয়ে! না না, এ হয় না, হয় না পল!

আশ্চর্য! এত মানবিক আবেগ তোমার মধ্যে কেমন করে এল অ্যান্ড্রু? তুমি যে আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠছ দিনে দিনে! অ্যান্ড্রু, তুমি যে কত ভালো, কত আপনার সে কথা বোঝাব কী করে!

এবার নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠল অ্যান্ড্রু। টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে বলল, পল, এক নতুন সিস্টেম ডিজাইন করেছি দেখো, এর ফলে হাইড্রোকার্বন কম্বাশন থেকে এনার্জি লাভ করবে অ্যান্ড্রুয়েডরা, অর্থাৎ আমার এনার্জির জন্য আর অ্যাটমিক সেলের প্রয়োজন হবে না।

তুমি বলছ কী অ্যান্ড্রু? নিঃশ্বাস নেবে? খাবার খাবে? রীতিমতো অবিশ্বাস্য!

পল, অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি, এতদিনে উপযুক্ত এক কম্বাশন চেম্বারের ডিজাইন করেছি, ক্যাটালাইজ নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোকার্বন সব হজম হবার সময় এনার্জির জন্ম দেবে, আর সেই এনার্জিই চালাবে আমাদের দেহগুলিকে।

অ্যান্ড্রু, কেন এসব করছ? অ্যাটমিক সেল তো অনেক শক্তিশালী দীর্ঘস্থায়ী।

ঠিক সেইজন্যে আমার এই ডিজাইন, কৃত্রিম আর চিরস্থায়ী বলেই তো অমানবিক!

.

১৫.

পলের মৃত্যুর পর একেবারে একা, একা হয়ে পড়ল অ্যান্ড্রু৷ সারা বিশ্বে আর কেউ রইল না ওর পাশে দাঁড়াবার। সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে একাই লড়তে হবে এবার। মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত করল, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তো একলা চলো রে! আরও বেশি জেদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অ্যান্ড্রু, ছোট মামণির শেষ কথাগুলো মশালের আলো হয়ে দীপ্যমান ওর চলার পথের দিকে।

একা হয়েও নিঃসঙ্গ নয়, ফেইনগোল্ড অ্যান্ড্রু মার্টিন কোম্পানি তো রয়েছে, রোবটের মতোই অমর কোম্পানির জীবন।

কম্বাশন চেম্বারসংক্রান্ত ব্যাপারে ইউ এস রোবটস-এ যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল আবার। প্রথমে স্যার জিরাল্ড, দ্বিতীয়বার পল, এবার একাই গেল সে ইউ এস রোবটসে, মানুষের ভঙ্গিমায় দৃঢ় পদক্ষেপে।

কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির পরিবর্তনও হয়েছে অনেক। মহাকাশের অন্তরীক্ষে স্থানান্তরিত হয়েছে প্রধান কারখানা, উৎপাদন হয় সেখানেই। শুধু ইউ এস রোবটস নয়, পৃথিবীর যাবতীয় কলকারখানাই এখন ছোট-বড় নানান মহাকাশ-বন্দরের চারপাশে ভিড় করেছে। মহাকাশ-বন্দরে বসবাস শুরু করছে লক্ষ লক্ষ জনসাধারণ, দিনে দিনে গড়ে উঠেছে মহাকাশের বুকে মানবসভ্যতার ধ্বজাবাহী বিশালাকৃতি আধুনিক শহর। পৃথিবীর জনসংখ্যা খুবই নগণ্য, সাজানো-গোছানো সুন্দর এক বাগান, আর কয়েক লক্ষ ব্রেনশূন্য রোবট।

অ্যালভিন ম্যাপভেস্ক এখন ডাইরেকটর অব রিসার্চ কোম্পানির সর্বেসর্বা। শ্যামবর্ণ দেহের রং, কটা চোখ, ঢেউ-খেলানো মাথার চুল, চিবুকের নিচে ছুঁচলো দাড়ি। আবরণহীন উর্ধ্বাঙ্গ, একটু কাত হয়ে কাঁধ বেয়ে বুকের দু-পাশে নেমে এসেছে জ্বলজ্বলে চওড়া এক বন্ধনী, আজকের দুনিয়ায় আভিজাত্যের নিদর্শন।

কী সৌভাগ্য! আপনি এসেছেন আমার কাছে, বিশ্বাস করুন আপনার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ছটফট করছিলাম, আপনার অসাধারণ পাণ্ডিত্য আর সৃজনীশক্তি রীতিমতো গর্বের বিষয়। আমাদের সবচেয়ে বিস্ময়কর রোবট, না না, ঠিক হল না রোবট বলা, কিন্তু কিন্তু…

অ্যান্ড্রু, কোনওকিছু না বলে অ্যান্ড্রু বলুন আমাকে।

 বেশ। বেশ। অ্যান্ড্রু, স্মাইদ রবার্টসন নির্লজ্জভাবে শত্রুতা করেছিল আপনার সঙ্গে, তার জন্যে শুধু লজ্জিতই নই, ক্ষমাপ্রার্থী আমি, আমরা সকলে। সেই সময়ে আমি থাকলে অনেক কিছুই করতে পারতাম।

করতে পারতাম কেন, এখনও তো করতে পারেন।

না না, আর কী করার আছে, সে সব তো কেটে গেছে অনেককাল। তবে নতুন কিছু। আর্জি আছে নাকি?

আর্জি নিয়েই তো এসেছি আপনার কাছে।

একে একে যাবতীয় কথা বলল অ্যান্ড্রু, কম্বাশন চেম্বারের ডিজাইনও তুলে দিল ওর হাতে, শুধু অবিশ্বাস নয়, বিস্ময়ে হতবাক ম্যাগভেস্ক।

শাবাশ। দারুণ চিন্তাধারা! আচ্ছা, এসব কে দিয়েছে বলুন তো আপনাকে?

কে আবার দেবে! সবই আমার চিন্তার ফসল ড. ম্যাগভেস্ক।

আপনার চিন্তা, নিজস্ব গবেষণা, এ যে অবিশ্বাস্য!

এবার আমার কথার জবাব দিন ডক্টর, আমার অনুরোধ রাখতে কোনও আপত্তি নেই তো?

না না, আপত্তি হবে কেন, তবে বেশ ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে আপনার দেহটাকে, তারপর নিছক পরীক্ষামূলকভাবেই চেষ্টা করব আমরা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত কিন্তু এসব চিন্তা ছাড়ুন, যেমন আছেন তেমনি থাকুন, বিপদের ঝুঁকি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

ভাবপ্রকাশের অভিব্যক্তি এখনও সীমাবদ্ধ অ্যান্ড্রুর। গলার স্বরে কিন্তু ফুটে উঠল বিরক্তির আভাস।

ডক্টর, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনিও এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন। আপনার পছন্দ-অপছন্দের কোনও ব্যাপার নয়, আপনি শুধু আমার অনুরোধ অনুযায়ী কাজ করবেন, দায়দায়িত্ব সব আমার। হ্যাঁ, আর একটা কথা, এর এক বিরাট সম্ভাবনার দিকও আছে, আমার অভ্যন্তরে চেম্বার স্থাপন সম্ভব হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের দেহেও বসানো হবে এমন কম্বাশন চেম্বার। প্রস্থেটিক কলাকৌশলের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী হবে মানুষের জীবনীশক্তি, এইসব ডিজাইনের মধ্যে আমারটাই হল বাস্তবসম্মত সহজ-সরল। ড. ম্যাগডেস্ক, ব্যাবসার সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখুন একবার। অন্যথায় ফেইনগোল্ড অ্যান্ড্রু মার্টিন কোম্পানিই ব্যাবসায় নামবে, ডিজাইনের পেটেন্ট করা আছে আমাদের। অদূর ভবিষ্যতে আরও উন্নতি হবে প্রস্থেটিক কলাকৌশল, রোবটের গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরিও অসম্ভব নয়, তখন কিন্তু আপনার কোম্পানি মার খাবে সাংঘাতিকভাবে।

এবার আমার অফার শুনুন, আপনি যদি আমার উপর অপারেশন করেন তা হলে আমাদের পেটেন্ট ডিজাইন ব্যবহার করার অধিকার দেব আপনাদের। শুধু এইটুকুই নয়, রোবট এবং মানবদেহের অভ্যন্তরে প্রস্থেটিক প্রযুক্তিবিদ্যার উপরও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে আপনাদের। এবার ভেবে দেখুন ভালো করে!

অ্যান্ড্রুর যুক্তিপূর্ণ মানবিক বক্তব্যে মন্ত্রের মতো ফল হল।

 বেশ। রাজি আপনার বক্তব্যে, আপনার জন্যে সবকিছুতেই রাজি ইউ এই রোবটস।