হত্যার অন্তরালে

হত্যার অন্তরালে

অ্যাই, কী ভাবছ বল তো? স্ত্রীর থুতনিটা ধরে মুখটা তুলে ধরার চেষ্টা করলেন শেখর।

কিছু না, বলে স্বামীর হাতটা সরিয়ে দিল তনুকা। তারপর বলল, না, কী আর হবে। কেন জানি না ভালো লাগছে না আজকে।

ভালো লাগছে না? শরীর খারাপ নাকি। বুলবুল কেমন আছে?

 না, শরীর খারাপ নয়। আর বুলবুলও ভালো আছে। আমাদের চেয়ে কনকের কাছেই বেশিক্ষণ থাকে ও। আর কনকের মতো রোবট পেলে কোনও ছেলেমেয়েই আর বাবা-মা কে জ্বালাবে না।

হ্যাঁ, যা বলেছ! অশেষ ধন্যবাদ বিজ্ঞানীদের! যাক, বুলবুল কোথায়?

 কিছুক্ষণ আগে দেখে এসেছি, বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে কনক গল্প বলছে। আর খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে ও। আমি ডাকতে বুলবুল আমাকে অপেক্ষা করতে বলল। এই বয়সে ও বুঝে গেছে, মা তো আর কনকের মতো মেশিন নয়। সুতরাং অপেক্ষা করতে পারে।

না, না, বুলবুলের এরকম ব্যবহার করা উচিত নয়। তা কনক কিছু বলল না?

বলল না মানে। কনক বলল, যাও বুলবুল, মায়ের কথা শুনে এস। সব সময় মনে রেখ মায়ের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্বন্ধ। কেমন করে তুমি পৃথিবীতে এলে সে গল্প নিশ্চয় তোমার মনে আছে!

বাঃ বাঃ, সুন্দর বলেছে তো! তাহলে কনকের উপর তোমার রাগ কেন তনু?

এতক্ষণে যেন কথা বলার মতো কিছু পেল তনুকা! চোখমুখ আরক্ত হয়ে উঠল।

বিশ্বাস কর শেখর, একমুহূর্তও সহ্য করতে পারছি না ওকে। আমার অবস্থাটা বোঝ একবার। যন্ত্র কি সবসময়ে মানুষের উপর কর্তৃত্ব করবে। প্রতিদিন কনক প্রমাণ করবে যে, আমি, মানে মানুষ কত ছোট আর মেশিন কত বড়। এর কি কোনও বিহিত করা যায় না? বিদঘুটে সব রোবটগুলোকে এত বুদ্ধি দিলে কেন তোমরা! আমি তো কনকের কাছে কোনও উপদেশ চাই না।

তনু, কেন সাধারণভাবে নিতে পারছ না ওদের। আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্যেই তো ওদের সৃষ্টি করেছি আমরা। আমাদের ভালোর জন্যেই তো ও কথা বলে। তাহলে কনকের বদলে অন্য কোনও রোবট আনবো না কি?

না, পালটাতে হবে না। শুধু একটু বোকা করে দাও কনকদের।

কিন্তু সে তো বেআইনি। আইন বলে, স্বনিয়ন্ত্রিত চিন্তাশীল রোবটরা তো আমাদের সমকক্ষ।

তাহলে, কী করব বলতে পার? এর হাত থেকে কি মুক্তি নেই?

 এই চুপ কর। কনক আসছে!

কৃত্রিম যান্ত্রিক স্বরে কনক বলল, কিছু বলবেন হুজুর?

এরকমভাবে কথা বলছ কেন, কনক! তুমি তো জানো ক-১ মেশিন এরকম কথা বলে না।

 হ্যাঁ, জানি আমি। তবে তনুকা খুশি হতে পারে বলেই এ কথা বললাম। ও আমাদের কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।

তনুকার দিকে তাকালেন শেখর। রাগে অপমানে কান-মুখ লাল হয়ে উঠেছে ওর।

 কনক, নিজের কাজে যাও।

মিনিট দশেক পরে কনকের খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকলেন শেখর।

 কোনও কথা না বলে কনক ওর মাথার ঢাকনিটা খুলে রিসেপ্টাকেল কেন্দ্র থেকে মাইক্রো-ফিল্মের একটা স্কুল খুলে টেবিলের উপর রাখল। শেখর স্কুলটা হাতে নিয়ে বললেন, এটা কীসের স্কুল, কনক?

শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের শিল্পকলা সম্বন্ধে লেখা আছে।

শিল্পকলা নিয়ে তোমার কী হবে?

বুলবুলের আঁকার হাত খুব ভালো। স্কুলের মাস্টারের মতো! কিন্তু শুধু স্কুলে আঁকলেই তো হবে না। তাই ভাবছিলাম, কাল তো আমার ছুটির দিন। কাল অঙ্কনবিদ্যার প্রাথমিক বিষয়গুলো ভালো করে রপ্ত করে নেব।

আচ্ছা কনক, তনুকার সঙ্গে কী হয়েছে আজ?

 বিশেষ কিছু হয়নি। সকালবেলায় চায়ের টেবিলে ওর অঙ্কের খাতার উপর নজর পড়ল হঠাৎ। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের গোড়ার বিষয়ে ভুল করেছে ও। আপনি তো জানেন, ১৯ নং ধারা বলে, ভুল ধরিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।

তারপর কী হল?

প্রথমেই চিৎকার করে বলে উঠল, আমার খাতা দেখেছ কেন? ভুলে যেও না যে তুমি একটা যন্ত্র, আর আমরাই তোমাদের সৃষ্টি করেছি। তারপর দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বলল –অসহ্য! অসহ্য! সারাক্ষণ একটা যন্ত্র কেবল চোখে আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দেবে! মানুষের জীবনে যন্ত্র একটা অভিশাপ।

চমকে উঠলেন শেখর। যন্ত্র কি অভিশাপ না… অনেক চিন্তাই ভিড় করে এল মনের মধ্যে।

তুমি কী বললে কনক?

আমি বললাম, অভিশাপ কেন বলছেন। আপনাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যেই তো আমাদের সৃষ্টি করেছেন আপনারা। তবুও আপনি সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। জানেন এই কমপ্লেক্সই মানবজাতির সর্বাঙ্গীন উন্নতির পথে প্রধান বাধা। তাই আমার অনুরোধ, এই সব কমপ্লেক্স ছেড়ে সকলকে সমান চোখে দেখুন।

সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। মানবজাতির এই পরম শত্রুকে যেন স্বচক্ষে দেখতে পেলেন শেখর।

তারপর!

 ঠাস করে গালে এক চড় মারল তনুকা। আমি তো টলে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। আর পড়ে গেলে বুঝতেই পারছেন, আমি ভেঙে যেতাম, আর আবার পাঁচশো টাকা লাগত নতুন একটা রোবট কিনতে। তাই বললাম দেখুন, এক্ষুনি আপনি পাঁচশো টাকা নষ্ট করছিলেন। ভবিষ্যতে আপনার আরও সাবধান হওয়া উচিত।

তারপর? আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন শেখর।

রাগে ফেটে পড়ল তনুকা-অসহ্য! জ্ঞান দেওয়া আর সহ্য হচ্ছে না। যা, বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে! তোর ভাবলেশহীন মুখ দেখতে চাই না আর।

কী বলবেন শেখর। শুধু সমাজ জীবনে কেন, মানুষের দৈনন্দিন জীবনেও যন্ত্রের প্রবেশ ঘটেছে আজ থেকে অনেক দিন আগে। কিন্তু এখনও কেন সহজভাবে গ্রহণ করতে পারছে না যন্ত্রদের?

কিন্তু কনক, এত কথা না বললেই ভালো হত। ভবিষ্যতে এরকম করে আর বোলো না।

না না, তা হয় না। আমাদের কাজই হচ্ছে আপনাদের গাইড করা, সাহায্য করা। আমার অনুরোধ, কমপ্লেক্স ছেড়ে সহজভাবে গ্রহণ করুন আমাদের।

নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন শেখর। গরাদবিহীন খোলা জানালার পাশে টুলের উপর বসল কনক। মাথার মধ্যে মেমরি ব্যাংকের অসংখ্য কোষ যেন ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে। যন্ত্রের কোলে মানবসভ্যতা পরম বিকাশের পথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কিন্তু মানুষের অহং বোধ এখনও গেল না, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতি মুহূর্তে এই বৈষম্য অসহ্য মনে হল কনকের। সৃষ্টিকর্তা মানুষের উপর অভিমানে ওর ধাতু নির্মিত বুকটা ফেটে পড়তে চাইল। ও মুক্তি চাইল মানব সমাজ থেকে। তাই ২৭ তলা ফ্ল্যাটের খোলা জানালা দিয়ে সটান লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল যন্ত্র, সভ্যতার মুখপাত্র কনক-রোবট।

[প্রথম প্রকাশ: বিস্ময় সায়েন্স ফিকশন, এপ্রিল ১৯৭২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *