০১. দক্ষিণ মেরু বা কুমেরু

কুমেরুর বিভীষিকা – উপন্যাস – রণেন ঘোষ

০১.

দক্ষিণ মেরু বা কুমেরু। কমলা লেবুর মতো চেপটা পৃথিবীর এক প্রান্তভাগ। যতদূর দৃষ্টি যায় সাদা সাদা দুধের মতো সাদা বরফের রাজত্ব। বাতাসে ঝরে পড়ছে বরফ। জনমানবহীন তুষার রাজত্বে স্তব্ধ হয়ে গেছে জীবনের স্পন্দন।

সামনে বেশ বড় নিচু জায়গা দেখা যাচ্ছে। আধুনিক সাজ সরঞ্জাম সমন্বিত একটা বড় তাঁবু পাতা হয়েছে ওখানে। কুড়ি মাইলের মধ্যে আরও কয়েকটা তাঁবু রয়েছে। তাঁবুগুলোর চার ধারে পুরু তুষার জমে রয়েছে। কাছাকাছি তাঁবুগুলোর মধ্যে বরফের ওপর দিয়ে কোনও যোগাযোগ নেই। মাটির নিচে সুড়ঙ্গপথেই যাতায়াত করা হয়। বেশ চওড়া আর উঁচু সুড়ঙ্গপথগুলো। দু-জন পাশাপাশি হাঁটা যায়।

মানুষের গায়ের গন্ধের সঙ্গে জান্তব চর্বির গন্ধ মিশিয়ে এক উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধর সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় লোমওয়ালা ফারের পোশাক থেকে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ বেরুচ্ছে। পাশের ঘর থেকে মাংস রান্নার সুগন্ধ ভেসে আসছে।

মাঝে মাঝে ঠান্ডা বরফ-হাওয়া ঝাপটা মারছে। মাঝে মাঝে এক দুর্গন্ধে তাঁবুর মধ্যে সকলের গা গুলিয়ে উঠছে। পার্থিব কোনও গন্ধের সঙ্গে মিল নেই। সামনের বড় টেবিল থেকেই ভেসে আসছে গন্ধটা। আষ্টেপৃষ্ঠে তিরপল দিয়ে জড়ানো একটা বিরাট বস্তু পড়ে আছে টেবিলের ওপর। তেরপল বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে টেবিলের নিচে একটা বালতির মধ্যে। জলের ফোঁটাগুলো ঝকঝক করে উঠছে উজ্জ্বল আলোয়।

প্রাণীতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ম্যাকডেভিড এগিয়ে এলেন টেবিলের দিকে। মাথা জোড়া চকচকে টাক। লম্বা চওড়া চেহারা। অস্থির হাতে খুলে ফেললেন দড়ির বাঁধনটা। তারপর হ্যাঁচকা টান মারতেই তেরপলের সামনের দিকটা খুলে গেল। ম্যাকডেভিডের ছায়াটা বিরাট বড় হয়ে তাঁবুর উলটোদিকে পড়ছে। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার গর্জন শোনা যাচ্ছে। চতুর্দিকে থমথমে নিস্তব্ধতা।

দলপতি ডক্টর অরুণ রায় উঠে দাঁড়ালেন। পেশিবহুল বলিষ্ঠ গড়ন। চোখে-মুখে বুদ্ধির প্রাচুর্য। পরনে চামড়ার জ্যাকেট আর চোস্তের মতো গরম পায়জামা। অনেকক্ষণ একভাবে বসে থাকার জন্যে ডান পা-টা বোধহয় ধরে গেছল। সামনের দিকে ঝাঁকানি দিয়ে পা-টাকে ঠিক করে নিয়ে ম্যাকডেভিডের পাশে দাঁড়ালেন। অভিযাত্রীদলের সকলে জড়ো হয়েছে এই বড় তাঁবু স্বর্গপুরীর মধ্যে। সমস্ত তাঁবুগুলোর পছন্দমতো এক-একটা নামকরণ করা হয়েছে।

তোমরা সবাই এসেছ। চারদিকে তাকিয়ে বললেন ডক্টর রায়। গম্ভীর স্বরে গমগম করে উঠল তাঁবুটা, এই দুঃসাহসিক অভিযানের উদ্দেশ্য তো তোমরা জানো। সামগ্রিকভাবে কুমেরু অনুসন্ধান করাই আমাদের কাজ। যাক, এখন আসল কথায় আসি। এখানকার জমাট বরফের নিচে ভূ-স্তর পরীক্ষার সময় ওই জীবটাকে পাওয়া যায়। আমি অবশ্য সহনেতা কাইবুলুস্কি এবং বিশ্বনাথ কুমারের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা করেছি। ম্যাকডেভিড ও ডাক্তার লিমও উপস্থিত ছিলেন তখন। কিন্তু বহুক্ষণ আলোচনা করেও একমত হতে পারিনি আমরা। তা ছাড়া এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। সকলের ভালো মন্দ জড়িত এর মধ্যে। সুতরাং সকলের মতামত নিয়েই এগোতে হবে আমাদের।

কাইবুলুস্কি এখন সমস্ত ঘটনা খুলে বলবে। অবশ্য অল্প অল্প করে তোমরা সবাই জেনেছ। কিন্তু আমার মনে হয় সমস্ত ঘটনাটা তোমাদের জানা উচিত। এবার বলো কাইবুলুস্কি।

টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন কাইবুলুস্কি। রূপকথার নায়কের ছাপ আছে ওর চেহারায়। যেন ব্রোঞ্জে গড়া নিটুট দেহ। চোখ দুটো ভাসা ভাসা। প্রশস্ত ললাট। কোঁকড়ানো মাথার চুল। দৃঢ়তাব্যঞ্জক চাপা ঠোঁট। পুরো ছ-ফুট উঁচু। জ্যাকেটে চওড়া বুকটা আরও ফুলে উঠেছে। ওপরের দিকে একবার তাকালেন কাইবুলুস্কি। থরথর করে কাঁপছে তাঁবুর শীর্ষভাগ। প্রচণ্ড ঝড় বইছে বাইরে। টপটপ করে দু-এক ফোঁটা জল পড়ছে মাঝে মাঝে। দুঃসহ জিজ্ঞাসা নিয়ে পড়ে আছে বস্তুটা। টেবিলটাকে কয়েকবার শক্ত করে ধরে ছেড়ে দিলেন। অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন কাইবুলুস্কি।

এই জীবটা যে আমাদের পৃথিবীর নয়, সে বিষয়ে ম্যাকডেভিড, আর বিশ্বনাথ একমত। এই জীবটা থেকে এক মারাত্মক বিপদের আশঙ্কা করে বিশ্বনাথ। কিন্তু ম্যাকডেভিড, এ কথায় বিশ্বাস করেন না। যাক, এসব কথায় পরে আসছি। কেমন করে জীবটাকে পাওয়া গেল সেই কথাই বলি আগে।

গুরুগম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করলেন কাইবুলুস্কি। আমরা জানি যে এই স্থানটা পৃথিবীর দক্ষিণ ম্যাগনেটিক পোলের ওপর অবস্থিত। কম্পাসের কাঁটাও সোজাসুজি নিচের দিকেই নেমে যেতে চায়। কিন্তু তোমরা বোধহয় জান যে, কম্পাস ছাড়াও এক সূক্ষ্ম শক্তিশালী যন্ত্র আছে আমাদের কাছে। এই অভিযানের জন্যেই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে ওটাকে। আর এখান থেকে আশি মাইল দক্ষিণে এক ক্ষুদ্র শক্তি ম্যাগনেটিক পোলের অস্তিত্বও ধরা পড়েছিল যন্ত্রে।

অনুসন্ধানের জন্যে একটি ছোট দল গিয়েছিল সেখানে। বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তাই সংক্ষেপে বলি। জায়গাটা খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি আমাদের। অনেক পরীক্ষার পর জানা গেল যে, এই দ্বিতীয় ম্যাগনেটিক পোলটা খুবই ছোট। এত ছোট যে, কী করে অত দূরে ওর প্রভাব ধরা পড়ল, সেটাই আশ্চর্য। পার্থিব কোনও ম্যাগনেটের এত শক্তি নেই। প্রায় একশো ফুট বরফের নিচে এর উৎপত্তিস্থান। এই জায়গার গঠনরীতি বোধহয় তোমাদের জানা আছে। এই জায়গাটা একটা বিরাট উপত্যকা। প্রায় দেড়শো মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। অবশ্য তেলের অভাবে অর্জুন সিংয়ের চেয়ে বেশি দূর উড়ে যেতে পারেনি। তবে তার মতে উপত্যকাটা আরও দক্ষিণে বিস্তৃত। ঠিক আশি মাইলের মাথায় একটা বরফের পাহাড় আছে। পাহাড়টা অবশ্য গ্রানাইটের উঁচু ঢিবি ছাড়া আর কিছু নয়। তার ওপর বরফ জমে পাহাড় হয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও কতকগুলো প্রাকৃতিক অসম্ভব ব্যাপারের কথা বলি এখন। আবহাওয়া বিজ্ঞানের মতে মাইনাস ৭০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ঝড় বওয়া অসম্ভব। মাইনাস ৫০ ডিগ্রীতে মাত্র ৫ মাইল বেগে হাওয়া বইতে পারে। কিন্তু সমস্ত অসম্ভবকে সম্ভব করে প্রচণ্ড বেগে ঝড় বয়ে যায় এখানে। এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করব আমরা। জানি না বর্তমান সমস্যায় কতদূর সম্ভব হবে।

সেই বরফ পাহাড়ের কাছে তাঁবুর মধ্যে পুরো বারো দিন-বারো রাত কাটাতে হয়েছিল। এই বারো দিন ধরে প্রচণ্ড তুষার ঝঞ্ঝায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল চতুর্দিক।

এবার আসল কথায় আসি। এই জীবটা সম্বন্ধে এক বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। অবশ্য কল্পনা করা ছাড়া কোনও গতি নেই এখন। সুদূর নভোমণ্ডল থেকে এসেছিল এক স্পেসশিপ। সেই স্পেসশিপটাকে দেখেছি আমরা। কনিং টাওয়ার ছাড়া ঠিক যেন এক সাবমেরিন। স্পেসশিপটার আয়তন যথাক্রমে লম্বায় ২৮০ ফুট এবং চওড়ায় ৪৫ ফুট।

এখানে একবার থামলেন কাইবুলুস্কি। থমথম করছে স্বর্গপুরী। বাইরে হাওয়ার গর্জন ভেসে আসছে। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করলেন তিনি।

আমাদের অনুমান স্পেসশিপটা বিকল হওয়ার মূলে আছে এই কুমেরুর ম্যাগনেটিক ফিল্ড। ঠিক কুমেরুর ওপর আসার ফলে এখানকার ম্যাগনেটিক পোলের চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে মহাকাশযানটা। আরও ভয়াবহ তখন কুমেরুর অবস্থা। অবিরাম ধারায় চলত তুষারপাত, তুষারঝঞ্ঝা। তুষারের পর তুষার জমে জমে বরফ-পাহাড়ের জন্ম হচ্ছে তখন। আর এই বরফের স্তর পরীক্ষা করে জানা যায় যে আজ থেকে দু-কোটি বছর আগে প্রথম বরফ জমতে শুরু করেছিল এখানে।

শক্ত কঠিন গ্রানাইট পাথরে ধাক্কা লাগার ফলে ভেঙে যায় স্পেসশিপটা। এর ফলে বেশির ভাগ যাত্রী বোধহয় মারা পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, এত উন্নত স্পেসশিপ একটা গ্রহের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের আকর্ষণে ধ্বংস হয়ে গেল কেন?

কল্পনা করা যাক, সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত স্পেসশিপ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল একজন যাত্রী। বাইরে তখন অবিরাম তুষারপাত আর প্রচণ্ড ঝড় চলেছে। তাই দশ গজের মধ্যেই অবসন্ন হয়ে পড়েছিল সেই হতভাগ্য যাত্রীটি।

কথার রেশটুকু গমগম করতে লাগল ঘরের মধ্যে। টগবগ করে জল ফুটছে বড় ইলেকট্রিক স্টোভে। অদ্ভুত বর্ণনাভঙ্গি কাইবুলুস্কির। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই অন্তিম মুহূর্ত।

মাথার ওপর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। পাতলা কুয়াশার মতো তুষারের স্তর জমে উঠেছে তাঁবুর বাইরে। মাটির নিচে সুড়ঙ্গপথ ছাড়া তাঁবুর বাইরে এখন বেরোলেই জমে বরফ হয়ে যেতে হবে। তাঁবুর বাইরে ৩০০ ফুট উঁচু এরিয়েল ছাড়া আর কিছু নেই। মাথার ওপর শীতের নিষ্করুণ অনন্ত আকাশ। মধ্যরাত্রির সূর্যের আলোয় উত্তর দিগন্তরেখা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় কেঁপে কেঁপে উঠছে উজ্জ্বলতা। কুমেরুর ৩০০ ফুট ওপরেই অনন্ত বসন্ত।

কিন্তু নিচে শুভ্ৰমৃত্যু নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। হাজার হাজার সুচীমুখ বয়ে নিয়ে আসছে কুমেরু তুষারঝঞ্ঝা। নিঃশব্দে পান করছে পৃথিবীর উষ্ণতা। অনন্ত উষ্ণ পিপাসায় হু হু করে বয়ে চলেছে কুমেরুর নিষ্করুণ ঠান্ডা জীবন। এ তৃষ্ণর যেন কোনও সীমা নেই।

সুন্দরমের চোখের সামনে ভেসে উঠল পাঁচদিন আগের এক ঘটনা। এই অভিযানের প্রধান পাঁচক সুন্দর। পাঁচদিন আগে মাংস আনার জন্যে তাঁবুর বাইরে বেরিয়েছিল সে। মাংস নিয়ে কয়েক পা আসতে না আসতেই প্রবল তুষারঝঞ্ঝা আরম্ভ হয়েছিল। মৃত্যুর মতো ঠান্ডা বরফস্রোত সাময়িকভাবে অন্ধ করে ফেলেছিল ওকে। একই জায়গায় চক্রাকারে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল সে। প্রায় আধঘণ্টা পরে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় সুন্দরমকে।

আজ থেকে দু-কোটি বছর আগে আরও হাজারগুণ জোরে তুষারঝা বয়ে যেত। অকল্পনীয় ছিল তখনকার অবস্থা।

কাইবুলুস্কির গলার স্বরে সম্বিত ফিরল সুন্দরমের। অতীতের তুষারঝঞ্ঝার ভয়াবহ দৃশ্য থেকে ফিরে এল সে তাঁবুর উষ্ণ গরমের মধ্যে।

বরফের স্তূপ থেকে আমরা খুঁজে বের করেছি স্পেসশিপটাকে। আর বরফ খোঁড়ার সময়েই ওই হতভাগ্য জীবটিকে পাওয়া গেছে। কিন্তু স্মিথের বরফ কাটা কুঠারের আঘাতে একটা গভীর ক্ষত হয়েছে জীবটির মাথায়।

ম্যাকডেভিড ও লিমের আসার আগেই জীবটিকে বরফের চাঁই সমেত তুলে ফেলেছিলাম। তারপর বরফের চাঁইটাকে তেরপল দিয়ে জড়িয়ে ট্রাকটারে ফিরে এসেছিলাম আমরা।

স্পেসশিপটাকে খুঁড়ে বের করার জন্যে আমরা আবার ফিরে গিয়েছিলাম। স্পেসশীপের ধাতুটা সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাদের কাছে। বেরিলিয়াম ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি নন্-ম্যাগনেটিক কোনও যন্ত্র দিয়েও একচুলও কাটা যায়নি। খাঁটি স্টিলের অস্ত্র দিয়েও চেষ্টা করেছিল স্মিথ। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। এমনকী অ্যাসিডেও চেষ্টা করেছিলাম।

কিন্তু সেই ধাতুর মধ্যে যে শতকরা ৯৫ ভাগ ম্যাগনেসিয়াম সে বিষয়ে নিশ্চিত আমরা। স্পেসশীপের সামনের দরজাটা সহজেই খুলে ফেলেছিলাম। ভেতরটা কিন্তু কঠিন চাপ চাপ বরফে ভরতি। বরফ গলাবার জন্যে বোমার সাহায্য ছাড়া কোনও গত্যন্তর ছিল না আমাদের।

তোমরা বোধহয় জানো যে ডিকামাইট আর থারমাইট বোমা ছাড়া আর কোনও কিছু নেই এখানে। শক্ত বরফ গলানোয় থারমাইট বোমার তুলনা নেই। ডাক্তার লিম, বিশ্বনাথ আর আমি–এই তিনজনে মিলে একটা ২৫ পাউন্ডের থারমাইট বোমা রেখে ছিলাম কেবিনের খোলা দরজাটার মধ্যে। তারপর কানেকটারটা ঠিকমতো লাগিয়ে লম্বা তারটাকে নিয়ে সটান গর্ত থেকে বেরিয়ে ট্রাকটারের কাছে চলে এসেছিলাম আমরা। আমাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল বোধহয় ২০০ গজ।

তীব্র আওয়াজ আর প্রচণ্ড আলোর ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভেসে গেল নিস্তব্ধ শুভ্র রাজত্ব। বিস্ফোরণের ফলে ম্যাগনেসিয়াম ধাতুতে আগুন ধরে গেছল। তাড়াতাড়ি ট্রাকটারের মধ্যে উঠে পড়েছিলাম আমরা। ক্রমে ক্রমে উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল সমস্ত জায়গা। সেই আলোয় সমস্ত স্পেসশিপটা বরফের তলা থেকে ভেসে উঠেছিল আমাদের সামনে। বোধহয় কয়েক মিনিট ধরে জ্বলেছিল আলোটা। তারপরেই সমস্ত বরফ-পাহাড়টা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল।

ট্রাকটারের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল বরফের ছোট ছোট কুঁচোয়। আমাদের পেছন থেকে হু হু করে হাওয়া বইছিল। সেই হাওয়ার জোরেই আগুনের স্পর্শ লাগল না আমাদের। নতুবা সেদিন যে কী হত বলা যায় না।

বিশ্বনাথের মতে এই অচেনা ভিনগ্রহের জীবটির গায়ে অনেক মারাত্মক জীবাণু থাকতে পারে। শীতকালে কিছু কিছু জীবাণু বরফে জমে গেলেও গ্রীষ্মকালে বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে আবার বেঁচে ওঠে। সুতরাং ম্যাকডেভিডের কথামতো জীবটিকে পরীক্ষা করার মধ্যে অনেক বিপদ থাকতে পারে। এই জীবটিকে বরফের মধ্যে থেকে বের করে আস্তে আস্তে উত্তপ্ত করে তুললেও হয়তো কোনও মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। হয়তো এমন রোগ দেখা দিতে পারে যা পৃথিবীর মানুষের কল্পনার বাইরে।

 কিন্তু ম্যাকডেভিড বলেছেন, হ্যাঁ, হয়তো কোনও জীবাণু বেঁচে উঠতে পারে। তবে সেই জীবাণুদের অতি সহজে ধ্বংস করা সম্ভব। কিন্তু এই জীবটির বেঁচে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই। কারণ এককোষী জীবরাই কেবল এমন করে বেঁচে উঠতে পারে। বহুঁকোষী প্রাণীর বেলায় এ নিয়ম খাটে না। এই তো সাইবেরিয়াতে বরফে জমা ম্যামথের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সুতরাং যাই হোক, এই বিচিত্র জীবটির বেঁচে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই। আবার জীবাণুগুলো হয়তো নন্-ইমিউনও হতে পারে। আমাদের শরীরের গঠন পদ্ধতি সম্ভবত…

সম্ভবত! মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন ম্যাকডেভিড, সম্ভবত কেন? নিশ্চয়ই। আপনারা স্বচক্ষে দেখেই…

আমি জানি, ম্যাকডেভিড। কথায় সায় দিলেন কাইবুলুস্কি, আমি জানি যে, এই জীবটা আমাদের পৃথিবীর নয়। সুতরাং এই জীবটার শরীর গঠন পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের আকাশ পাতাল তফাত। আর সেই জন্যেই হয়তো ওর দেহের কোন জীবাণু আমাদের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তা ছাড়া আমি বিশ্বাস করি যে এর থেকে কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ডাক্তার লিমের দিকে তাকালেন কাইবুলুস্কি। ডাক্তার বললেন, না, কোনও ভয় নেই। সাপের সমগোত্রীয় কোনও জীবাণু থেকে মানুষের কোনও বিপদ হতে পারে না। তাই আমিও তোমার সঙ্গে একমত।

ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন বিশ্বনাথ কুমার। মোটাসোটা বিশ্বনাথ কুমারকে বেশ ছোটখাটো দেখায়। মাথার চুলগুলো শক্ত শক্ত। স্টিলের তারের মতো। তার ওপর ছোট ছোট করে ছাঁটা। শুধু চেহারায় নয়, চলনে বলনে সমস্ত হাবভাবে বিশ্বনাথ কুমার স্টিলের মতো শক্ত অনমনীয়। কোনও বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে মোটেই বিলম্ব হয় না।

চুলোয় যাক বিভিন্ন শরীর গঠন পদ্ধতি। ওই দৈত্যটার বেঁচে থাকায় বা মরে যাওয়ায় কোনও কিছু আসে যায় না আমার। কথার ফুলঝুরি বন্ধ করুন এবার। সবাই এগিয়ে আসুন। দেখুন, কী ভয়াল ভয়ংকর এই জীবটা। কী রক্ত হিম-করা চাউনি। দৈত্য ছাড়া কোনও কিছু নয় এটা। কথায় ভুলবেন না আপনারা। শুধু ভালো করে দেখুন একবার। তারপর নিজেরাই স্থির করুন যে বরফ গলিয়ে দৈত্যটাকে বাইরে আনা উচিত হবে কী না। নাটকীয় ভঙ্গিতে সকলের মুখের দিকে তাকালেন বিশ্বনাথ কুমার। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলেন, বেশ, ধরা যাক বরফ থেকে বের করে আস্তে আস্তে গরম করা হবে দৈত্যটাকে। তাহলে সারারাত্রি ধরে একটা তাঁবুর মধ্যে রাখতে হবে একে। কিন্তু কে পাহারা দেবে? বোধহয় সৌরেন পাহারা দেবে। কারণ একে গরম করে তুলতে কসমিক রে-র দরকার। দু-কোটি বছরের এ বীভৎস মমির সঙ্গে রাত কাটাতে রাজি তো, সৌরেন? ম্যাকডেভিড, ঢাকাটা খুলে ফেলুন তো। বেশ ভালো করে নারকীয় দৃশ্যটা দেখতে দিন এদের। শুধু ওর মুখের দিকে তাকান একবার। অপার্থিব জীব বলেই কি এমন বীভৎস চাহনি হবে? মৃত্যুভয়ের সময় কি এরকম ভয়াল দৃষ্টি হয় কারুর?

সকলে একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। একটা অস্থির ভাব দেখা দিল সকলের মনে।

ওরকম করে নয়, ওরকম করে নয়, আরও কাছে এগিয়ে আসুন। দেখুন ওই টকটকে লাল তিনটে চোখ। মাথার চুলগুলি সাপের মতো কেমন কিলবিল করছে। কল্পনা করুন, দু-কোটি বছর আগের সেই দিনটি। স্পেসশীপের ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল দৈত্যটা। তিনটে বীভৎস চোখে ছিল রক্তাক্ত বিস্ময়! উঃ, কী ভয়ংকর!

আরও একটা কথা আছে আমার। দৈত্যটাকে দেখার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনও রাতে ঘুমুতে পারিনি। তিনটে হিংস্র লাল চোখ যেন তাড়া করে ফিরছে আমাকে। স্বপ্নে দেখলাম, বরফ গলে যাচ্ছে। জীবন্ত হয়ে উঠছে দৈত্যটা। দু-কোটি বছরের মমির দেহ নড়েচড়ে উঠছে। কোটি কোটি বছর ধরে আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে।

যাক, এবার সৌরেন, কসমিক রে বিশারদ সৌরেন ঘোষের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন বিশ্বনাথ কুমার। এই ভয়ংকর দৈত্যটার সঙ্গে রাত কাটাতে তুমি রাজি তো? হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া বইবে মাথার ওপর দিয়ে। ধীরে ধীরে বরফ গলে যাবে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসবে দৈত্যটার হাত পা…

না থাক, আমি জানি আমি যা বলছি তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু সাইকোলজি কি বিজ্ঞান নয়? মনে হয় টান মেরে বাইরে ফেলে দিই বরফের চাঁইটাকে। আরও দু-কোটি বছর ধরে জমে থাক বরফের মধ্যে। আমার মন বলছে ইচ্ছামতো রূপ পালটাতে পারে দৈত্যটা। দৈত্যটার প্রতিটি মাংসকণার নিজস্ব বাঁচবার ক্ষমতা আছে।

ম্যাকডেভিড, আর একটা প্রশ্ন আছে। ওটার দেহে তো ভাইরাস থাকতে পারে। এটা তো এনজাইম মলিকিউল ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং যে কোনও প্রোটিন মলিকিউল দেহেই তো বাসা বাঁধতে পারে ভাইরাসরা?

আবার, আমাদের জ্ঞানের বাইরে তো অনেক জীবাণু থাকতে পারে। জলাতঙ্ক রোগের কথাই ধরা যাক না কেন। যে কোনও উষ্ণ রক্তবাহী দেহেই তো জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে?

উত্তেজিতভাবে একটানা বকে গেলেন বিশ্বনাথ কুমার। কেউ কেউ উসখুস করলেও বিশ্বনাথ কুমারকে বাধা দিতে সাহস করল না কেউ। কিন্তু ম্যাকডেভিড কথা বলে উঠলেন।

স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ফারাক সেই কথাটাই ভুলে যাচ্ছ, বিশ্বনাথ। স্বপ্নের কোনও দাম নেই বাস্তবে। এবার তোমার অন্য বক্তব্য বিষয়ে আসি। ভাইরাস সম্বন্ধে তোমার ধারণা ঠিক নয়। তোমার এনজাইম মলিকিউল থিয়োরি সম্পূর্ণ নতুন ঠেকছে। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসি। তুমি তো সিগারেট খাও। ফুলও ভালোবাস। কিন্তু এদের মধ্যে তো নানা রকম মারাত্মক জীবাণু থাকতে পারে, সেকথা কি ভেবেছ কখনও? আর জলাতঙ্কের কথা বলছ! খুব অল্প লোকের মধ্যে সংক্রমিত হয় এই রোগ। মাছ বা গাছের মধ্যে এ রোগ হয় না। কিন্তু মাছ বা গাছ তো এক হিসাবে আমাদের পূর্বপুরুষ। তাই না, বিশ্বনাথ।

বেশ, ঠিক আছে। আপনার কথাই ঠিক। তাহলে বড় গামলায় ফরমালিন ঢেলে গরম করা হোক দৈত্যটাকে…

এখনও আমার কথা শেষ হয়নি, বিশ্বনাথ। দেখো, তোমার কথার মধ্যে কোনও যুক্তি নেই। কোন যুক্তিতর্কের ধার ধারো না তুমি। কিন্তু এবার আমার একটা প্রশ্ন আছে। ম্যাগনেটিজম পরীক্ষা করতে কেন গেলে সেখানে। এ অভিযানে না আসলে কী ক্ষতি হত তোমাদের? নিরীহ ভালো ছেলের মতো দেশে থাকলেই তো হত। আমি বুঝতে পারছি না যে কীসের জন্যে এখানে এসেছি আমরা? আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় কী? বৈজ্ঞানিক সূত্র না কুসংস্কার আর স্বপ্নতত্ত্ব? একটা কথা তোমরা কেন বুঝছ না যে, হয়তো অনেক নতুন তথ্য জানা যাবে ওই জীবটাকে পরীক্ষা করে। একে ধ্বংস করে ফেললে আর হয়তো কোনদিনও পৃথিবীর মানুষ ভিনগ্রহের জীব বা জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারবে না। এ ছাড়া আরও একটা দিক আছে। দু-কোটি বছর আগে এসেছিল এই জীবটা। ধরা যাক, এটা মঙ্গলের অধিবাসী। কিন্তু এতযুগ পরে বিবর্তনের ধারায় হয়তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে সেখানকার জীবদের চেহারায়। সুতরাং এর ঠিক অনুরূপ দ্বিতীয় সংস্করণ আর কখনওই পাওয়া সম্ভব নয়।

আত্মবিশ্বাসে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল ম্যাকডেভিডের। সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, তাই সমস্ত মানবজাতির পক্ষ থেকে একটা অনুরোধ আছে। মানবজাতির উন্নতির পথে একটু সাহায্য করো তোমরা। ধীরে ধীরে বরফের মধ্যে থেকে বার করতে হবে জীবটাকে। তারপরে আস্তে আস্তে গরম করতে হবে। আর তা হলেই… আর তোমরা বাধা দিও না। অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছে। এবার একটু সাহায্য করো আমাকে।

ডক্টর অরুণ রায় এগিয়ে এলেন সামনের দিকে। কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন বিশ্বনাথ কুমার।

আমার মনে হয় ম্যাকডেভিডের কথাই ঠিক। আর কিছু বক্তব্য আছে তোমাদের?

সৌরেন ঘোষ বলে উঠল, ঠিক কথা বলেছেন আপনি। মড়ার সঙ্গে সারা রাত থাকতে কোন আপত্তি নেই আমার। মড়া তো মড়াই। তবে ভিনগ্রহের অজানা জীব বলেই ভয় হচ্ছে।

মৃদু হাসলেন ডক্টর রায়। তারপর সবাই রাজি হলেন।

 দু-কোটি বছর পরেও যদি বেঁচে ওঠে জীবটা তবে না খেয়ে না খেয়ে তাকে মরতে হবে এখানে। আর আয়রনম্যান সৌরেন তো একাই একশো। সৌরেনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ডক্টর রায়। উৎসাহিত হয়ে সম্পূর্ণ তেরপলটা খুলে ফেললেন ম্যাকডেভিড। সকলে এগিয়ে এল সামনের দিকে। এবার পরিষ্কার হয়ে উঠল সম্পূর্ণ দৃশ্যটা। বরফের চাঙরটা ইতিমধ্যে গলতে আরম্ভ করেছে। স্বচ্ছ নীল কাচের মতো দেখাচ্ছে বরফটাকে। তাঁবুর উজ্জ্বল আলোয় ককঝক করে উঠল। মনে হল প্রকাণ্ড একটা হীরের টুকরো রয়েছে টেবিলের ওপর।

এক মুহূর্তে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এল তাঁবুর মধ্যে। বরফের মধ্যে চিত হয়ে রয়েছে দেহটা। কুড়লের ভাঙা অংশটা এখনও মাথায় গেঁথে আছে। তিনটে উদ্ৰান্ত রক্তলাল চোখে যেন নরকের আগুন জ্বলছে। অপার্থিব বীভৎস জিঘাংসা মাখানো সারা মুখে। মাথায় লম্বা নীল চুল যেন সাপের মতো কিলবিল করছে।

অর্জুন সিং দাঁড়িয়ে ছিল সামনে। বিরাট চেহারা। ওজন প্রায় ২০০ পাউন্ড। সেই অর্জুন। সিং সভয়ে পিছিয়ে গেল চোখে হাত চাপা দিয়ে। এক মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল ঘর। মুষ্টিমেয় ক-জন ঘরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল।

টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে সকলের হাবভাব দেখতে লাগলেন কাইবুলুস্কি। ডক্টর রায় সকলকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করতে লাগলেন।

এবার স্টিলের একটা হাতুড়ি নিয়ে এলেন ম্যাকডেভিড। দু-কোটি বছরের পুরোনো বরফ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করল। ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল দুশো লক্ষ বছর আগের ভিনগ্রহের ভয়াল ভয়ংকর এক জিঘাংসা।

.

০২.

আমি জানি সৌরেন এই জীবটাকে কেউ তোমরা ভালো চোখে দেখতে পারছ না। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে নিশ্চয় তুমি ঘেন্না কর। তোমরা একে বলো দৈত্য। তিনটে চোখ হলেই কি দৈত্য হয়? তাহলে তো ভিনগ্রহের জীবমাত্রই তোমাদের কাছে দৈত্য। কিন্তু যা-ই বলো না কেন, খুব আস্তে আস্তে গরম করে তুলতে হবে একে। না, না, সৌরেন, তুমি বেঁকে বসে না। আস্তে আস্তে বরফ ভাঙতে ভাঙতে নিজের মনেই বলতে শুরু করলেন ম্যাকডেভিড।

সৌরেনের বলার আগেই উত্তর দিল সুন্দরম, এক কাজ করুন না আপনি। খাবার মাংসের বাক্সে পুরে দিন এটাকে। তারপর এক সময় রান্না হয়ে যাবে দৈত্যটা। চুকে যাবে সমস্ত গণ্ডগোল। যাক, খাবার টেবিলটা খালি করে দিন তো এখন!

সুন্দরম, তুমি জানো এইটাই এখানে একমাত্র বড় টেবিল। আর বড় টেবিল ছাড়া এ কাজ করা অসম্ভব। তা ছাড়া সকলকে জানিয়ে এ টেবিলটা নিয়েছি আমি। হাতের কাজ থামিয়ে জবাব দিলেন ম্যাকডেভিড।

না, এরকম করলে আমার দ্বারা আর রান্না করা চলবে না। যখন যার দরকার পড়বে, তক্ষুণি সে এই টেবিলটা নিয়ে আসবে। রাগে গজগজ করতে লাগল সুন্দর।

ডক্টর রায় বললেন, কথা কাটাকাটি করে তো কোন লাভ নেই। তাতে কাজেরই ক্ষতি হবে। ম্যাকডেভিড, মন দিয়ে নিজের কাজ করুন। আপনি চুপ করে থাকলেই আর কোনও কথা বাড়ে না। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।

চুপ করে গেল সবাই। বরফ ভাঙার ঠুকঠুক আওয়াজ শোনা গেল কেবল। বরফের শক্ত বাঁধন থেকে দৈত্যটাকে বাইরে বার করে আনলেন ম্যাকডেভিড। লম্বা লম্বা নীলচে চুলগুলো যত্নের সঙ্গে ঝেড়ে খোঁপার মতো করে বেঁধে দিলেন।

কসমিক তাঁবুতে আমি থাকলে ভীড় বেড়ে যাবে নিশ্চয়। আর সৌরেনের অসুবিধা হবে বোধহয়। ম্যাকডেভিডের সুরে অভিমানের রেশ। বাইরে থেকে বরফ ভেঙে বার করে আনলেই হত। তারপর ঠ্যাং দুটো ধরে বয়লারের ওপর ঝুলিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। সময়ও বেশি লাগত না, কাউকে কষ্ট করতেও হত না। আর খুব তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে যেত।

হাত থেকে হাতুড়িটা ফেলে দিলেন ম্যাকডেভিড। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ ডক্টর রায়ের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন।

কিন্তু কেন ধীরে ধীরে কাজ করলাম জানো, অরুণ? আমার জীবনে এই ভিনগ্রহের জীবটাকেই বড় বলে মনে করি। একে যে খুঁজে পেয়েছি সেটাই আমাদের পরম সৌভাগ্য। তাই পাছে নষ্ট হয়ে যায়, এইজন্যে তাড়াহুড়ো করিনি আমি।

তুমি নিশ্চয় জানো সুইডেনে প্রচণ্ড শীতে মাছ ধরার কথা। জল থেকে মাছ তোলার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডায় জমে যায়। কিন্তু আবার তাকে আস্তে আস্তে গরম করলে বেঁচে ওঠে। অবশ্য সবাই বেঁচে ওঠে না। নিচুস্তরের প্রাণীদের বেলায় শতকরা ৫০ ভাগের বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। আমি তো…

ভগবানের দোহাই, কী বলছেন আপনি? আবার বেঁচে উঠবে নাকি দৈত্যটা? চিৎকার করে বলে উঠল সৌরেন। ম্যাকডেভিড, আপনি সরে যান ওখান থেকে। বেঁচে ওঠার আগেই টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলব ওকে।

না, না, না। এ সর্বনাশ তুমি কোরো না, সৌরেন। লাফিয়ে উঠে সৌরেনের হাত দুটো ধরে ফেললেন ম্যাকডেভিড, না, ভুল বুঝো না, সৌরেন। ভালো করে শোনো কথাটা। নিচুস্তরের প্রাণীদের কথাই বলেছি আমি। জমে যাবার পর আবার গরম করলে মাছ যে বেঁচে ওঠে, তার কারণ এই যে মাছ এমন একটা নিচুস্তরের প্রাণী যে ওর শরীরের প্রতিটি সেল বা কোষ বেঁচে উঠতে পারে, আর তার ফলেই জীবন ফিরে পায় মাছেরা। কিন্তু উঁচুস্তরের প্রাণীদের বেলায় এ নিয়ম খাটে না। অবশ্য উঁচু স্তরের জীবদের কিছু কিছু সেল প্রাণ ফিরে পায়। তবুও প্রত্যেকটি সেলের সমবেত প্রচেষ্টার অভাবে জটিল প্রাণশক্তি কিছুতেই ফিরে আসে না। তার মানে পুনর্জীবিত সেলগুলো পূর্বের নিয়ম শৃঙ্খলা আর ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে না। এই জীবটি বিবর্তন ধাপে বোধহয় আমাদের চেয়েও উচ্চস্তরের জীব। সুতরাং আমাদের মৃতদেহের সঙ্গে কোনও তফাত নেই এর।

কেমন করে জানলেন যে দৈত্যটা আর বেঁচে উঠবে না? বরফ কাটা কুড়লটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল সৌরেন।

সৌরেনের কাঁধে একটা হাত রাখলেন ডক্টর রায়। বললেন, আমার কথা শোনো, সৌরেন। সোজা কথা বলতে ভালোবাসি আমি। আর এ কথা আগেও বলেছি। এই জীবটার বেঁচে ওঠার সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলে কোনও রকমেই আস্তে আস্তে গরম করা হবে না। তবে এ কথা বিশ্বাস করি যে, দু-কোটি বছর আগের এক মমি দেহে প্রাণসঞ্চার হওয়া অসম্ভব। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এই আশঙ্কা।

মোটা একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করলেন ডাক্তার লিম। তামাক পোড়া কটু গন্ধে ভরে উঠল ঘরটা। বেশ কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন, ম্যাকভেভিডের কথাগুলো খুবই টেকনিক্যাল। আমিও বিশ্বাস করি দৈত্যটা মরে গেছে। ইট কাঠ পাথরের মতো ওটা এখন। আর ঠান্ডায় জমে যাওয়ার পর গরম করলে বেঁচে ওঠার কথা চিৎ শোনা যায়। এমনকী মাছেদের বেলায় এ কথা খাটে। তা ছাড়া, উঁচু স্তরের জীবদের জীবন ফিরে পাবার কোনও নজীর নেই। যাক, আর কিছু বলার আছে, ম্যাকডেভিড?

ডাক্তার লিমের দিকে এগিয়ে এলেন ম্যাকডেভিড। উত্তেজনায় বাঁ চোখের নিচে একটা মাংসপেশি থিরথির করে কেঁপে উঠল।

আমি তো অন্য কিছু বলিনি, ডাক্তার। আমি বলতে চেয়েছিলাম ঠিকমতো গরম করলে কোনও কোনও সেল জীবন্ত হয়। মৃত দেহের মাংসপেশিও মারা যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত জীবন্ত থাকে। মানুষের চুলের নখের সেলগুলোর বেলায়ও এ নিয়ম খাটে। কিন্তু তাই বলে মানুষের মৃতদেহ কখনওই প্রাণ ফিরে পায় না।

এখন কথা হচ্ছে কি, এই জীবটাকে ঠিকমতো গরম করে তুললে জমে পাথর হয়ে যাওয়া মাংসগুলো নরম হয়ে আসবে। আর সেই মাংস নিয়ে পরীক্ষা করলে অনেক তথ্য জানতে পারা যাবে। এইভাবে জানতে পারা সম্ভব যে কোথা থেকে এল জীবটা। মঙ্গল, শুক্র–না আমাদের সৌরজগতের বাইরের কোনও নক্ষত্র থেকে। তা ছাড়া আর একটা কথাও ভেবে দেখা দরকার। মানুষের মতো দেখতে নয় বলেই একে ভয়ংকর বীভৎস বলা উচিত নয়। ওদের দেশে এই ভাবটাই হয়তো অসহায়ভাবে নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের অভিব্যক্তি। একবার মনে করে দেখো, আমাদের পৃথিবীতেই দেশ-দেশান্তর ভেদে দুঃখ প্রকাশের নানান রকমের অভিব্যক্তি আছে।

হেসে উঠল সৌরেন। ব্যঙ্গের সুরে বলল, অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ! ওই জঘন্য চোখগুলো এ কথাই বলছে না কি? বেশ বুঝতে পারছি দৈত্যটাকে আপনি ভালোবেসে ফেলেছেন। কিন্তু ভালোবাসার একটা সীমা থাকা দরকার। বিশ্বনাথের কথাই ঠিক। বিরাট এক অমঙ্গল ডেকে এনেছি আমরা। দেখুন ডাক্তার দেখুন, কী দারুণ প্রতিহিংসা ফুঠে উঠেছে ওর মুখে!

একথা বলার কোনও অধিকার নেই তোমার। জোর করে সৌরেনকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন ম্যাকডেভিড, অপার্থিব জীবের অভিব্যক্তি সম্বন্ধে কতটুকু জ্ঞান আছে তোমার? প্রকৃতির এক ভিন্ন সৃষ্টি এই জীবটি। প্রকৃতির এক ভিন্ন সৌন্দর্যই রূপায়িত হয়েছে এর মধ্যে। আর তা ছাড়া তুমি যদি এই জীবটির গ্রহে গিয়ে পড়, তবে তারাও তো তোমার যথেষ্ট সমালোচনা করতে পারে। তারা হয়তো বলবে, দুটো চোখ দিয়ে কী করে দেখে জীবটা, বা পেটটা এত মোটা কেন, অথবা এত ফ্যাকাশে কেন গায়ের রং…

বিশ্বনাথ কুমার উত্তেজিতভাবে বললেন, পাগল, পাগল, নির্ঘাত পাগল! হতে পারে ভিনগ্রহের জীব। তাই বলে এর থেকে যে আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না এ গ্যারান্টি কে দেবে?

আঃ, আবার ঝগড়া। টেবিলটা খালি করে দিন তাড়াতাড়ি। নয়তো তিরপল দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিন ওকে। বড় বিশ্রী দেখাচ্ছে। বলল সুন্দরম।

আর কোনও কথা নয়। যে যার নিজের কাজে যাও। আপনি নিজের কাজ করুন, ম্যাকডেভিড। আর সৌরেন, কসমিক রে-র যন্ত্রগুলো ঠিক করো।

.

০৩.

ক্লিক। ক্লিক। সর্… র… র… ক্লিক। এক ছন্দে আওয়াজ উঠছে কসমিক রে যন্ত্র থেকে। হাতের কলম থামিয়ে সামনের দিকে চেয়ে দেখল সৌরেন। উঃ, পাগল করে দিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। একটু দূরে গাইগার কাউন্টার বসানো আছে। ঠিক তার সামনে টেবিলের ওপর ভিনগ্রহের জীবটা শোয়ানো। না, সব ঠিক আছে। মাঝে মাঝে এমন চমকে উঠতে হয়, ভাবল সৌরেন। শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। না, ভয়ের কিছু নেই। মড়া তো মড়াই। আবার চেয়ারে বসল সৌরেন। গাইগার কাউন্টারের শব্দে বারে বারে একাগ্রতা নষ্ট হচ্ছে। হিহিস্ আওয়াজ উঠেছে প্রেসার ল্যাম্প যেকে। মনে হয় কেউ যেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে। পাশের তাঁবু থেকে একটানা নাক ডাকার ঐক্যতান শোনা যাচ্ছে। পাশেই একটা বড় ড্রামে টগবগ করে জল ফুটছে। গনগনে কয়লার আগুন থেকে ফটফট আওয়াজ উঠছে। এ সমস্ত কিছু ছাপিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ তন্ময় করে রেখেছে। ওকে। একটা অদ্ভুত আওয়াজ উঠছে কসমিক রে-র তলায় রাখা দু-কোটি বছরের পুরোনো মমি থেকে। ড্রিপ… ড্রিপ… ড্রিপ..

পকেট থেকে একটা সিগারেট প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল সৌরেন। বারবার চেষ্টা করেও আগুন জ্বলল না লাইটারে। বিরক্ত হয়ে দূরে ছুঁড়ে দিল সেটা। তারপর লম্বা চিমটে দিয়ে একটা জ্বলন্ত কয়লা বার করে সিগারেট ধরাল। জ্বলন্ত আগুনের আভায় চোখটা কেমন যেন ধাঁধিয়ে গেল।

কয়েক সপ্তার নানান রকম স্ট্যাটিসটিক্যাল ফিগার ছড়ানো টেবিলে। যে রকম করেই হোক শেষ করতে হবে আজকে।

না, আর ভালো লাগছে না। মস্ত একটা হাই উঠল। জীবটাকে একবার দেখে আসাই ভালো। প্রেসার ল্যাম্পটা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। না, একভাবে পড়ে আছে দৈত্যটা। অন্যমনস্কভাবে চিমটে দিয়ে একটু খোঁচা দিল। এখন আর লোহার মত শক্ত ঠেকল না। কীরকম যেন রবারের মতো নরম নরম। এবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল সৌরেন। সারা গা যেন ভিজে ভিজে। নীল রবারের গায়ে মুক্তোর মতো দু-এক ফোঁটা জল চিকচিক করছে। ঘৃণায় সারা শরীর রী-রী করে উঠল। মনের মধ্যে এক উদগ্র বাসনা ছটফট করে উঠল। প্রেসার ল্যাম্পের সমস্ত গ্যাসোলিনটা ঢেলে একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে দিলে কেমন হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুড়ে শেষ হয়ে যাবে দৈত্যটা। কিন্তু তিনটে লাল চোখ যেন ভর্ৎসনা করে উঠল। রক্তলাল মণির মতো চকচকে বীভৎস দৃষ্টি ভয় দেখানো ভঙ্গিতে যেন ঝিলিক মেরে উঠল। একটা প্রেসার ল্যাম্প তিনটে প্রেসার ল্যাম্প হয়ে ঠিকরে পড়ল তিনটে চোখে। না না, প্রশ্রয় দিতে নেই মনের ভয়কে। মমি আবার বেঁচে ওঠে নাকি?

স্বস্থানে ফিরে এল সৌরেন। টেবিলে ছড়ানো নানানরকম অংকের সংখ্যাগুলো হিজিবিজি হয়ে উঠল চোখের সামনে। একটানা ক্লিক ক্লিক ড্রিপ ড্রিপ আওয়াজ আচ্ছন্ন করে ফেলছে মনকে। বিলুপ্তির পথে ডুবে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। সমস্ত চিন্তাশক্তি যেন ভোঁতা হয়ে এল।

ক্লিক ক্লিক… ড্রিপ ড্রিপ… হিস্ হিসসস ..

আস্তে আস্তে জীবনের স্পন্দন ফিরে আসছে তিনটে লাল চোখে। সরু সরু চুলগুলো টেবিলের নিচে ঝুলছিল। সেগুলো এবার নড়তে আরম্ভ করল কিলবিল করে। টেবিলের পায়াটাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। দু-কোটি বছর পরে এই প্রথম হাঁ করল সেই বীভৎস মুখটা। হাড়-সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। সাপের মতো সরু জিভটা শুকনো ঠোঁট দুটোকে ভিজিয়ে সরস করে তুলল। টানটান হয়ে গেল সমস্ত শরীরের কুঁচকে যাওয়া চামড়া। নরকের আগুন যেন ঝলসে ঝলসে উঠতে লাগলো তিনটে রক্ত লাল চোখে। ভিনগ্রহের ভয়ংকর জীবটা প্রাণ ফিরে পেল ঠিক দু-কোটি বছর পরে।

সর-র-র। কাঠের পাটাতনের ওপর একটা আওয়াজ উঠল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সৌরেন। দপদপ করে নিবে গেল প্রেসার ল্যাম্পটা। অন্ধকারে ডুবে গেল সমস্ত তাঁবু। সেই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে শুধু তিনটে লাল চোখ অস্বাভাবিক দীপ্তিতে ধকধক করে জ্বলতে লাগল। তারপর তিনটে লাল আলো ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

হু হু করে একটানা ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে তাঁবুর বাইরে। পুরু তুষারপাত হচ্ছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন সমস্ত পৃথিবী। এক অশুভ আতঙ্কে দিন গুনছে মহাকাল।

.

০৪.

দারুণ দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল ম্যাকডেভিডের। সামনে ভেসে উঠল সৌরেনের মুখখানা। তন্দ্রাচ্ছন্ন ম্যাকডেভিড। উঃ, কী সাংঘাতিক দুঃস্বপ্ন! স্বপ্ন না সত্যি?

ম্যাকডেভিড, ম্যাকডেভিড, তাড়াতাড়ি উঠুন!

অ্যাঁ, এত চেঁচাচ্ছ কেন? কী হল কী? দু-হাতে চোখ রগড়াতে লাগলেন ম্যাকডেভিড। অন্যান্য বাঙ্ক থেকে অনেকগুলো উৎসুক মুখ ঝুঁকে পড়ল।

বাঙ্ক থেকে জোর করে টেনে নামাল ম্যাকডেভিডকে সৌরেন। বলল, দেরি করার সময় নেই আর। জ্যান্ত হয়ে পালিয়ে গেছে দৈত্যটা।

পালিয়েছে! কে পালাল? কোথায় পালাল? চিৎকার করে উঠল প্রধান বৈমানিক অর্জুন সিং। সুড়ঙ্গপথে অনেকগুলো পায়ের শব্দ উঠল। স্বর্গপুরীর সমস্ত বাসিন্দা ঘিরে দাঁড়াল সৌরেনকে। লম্বা ঢলঢলে উলের জামা গায়ে দিয়ে স্মিথ একটা ফায়ার এক্সটিনগুইসার নিয়ে ছুটে এল।

কী কী, হয়েছে কী? এত চেঁচামেচি কেন?

 হবে আবার কী। যা হবার তাই হয়েছে। ভয়ংকর দৈত্যটা জ্যান্ত হয়ে পালিয়ে গেছে। বোধহয় ২০ মিনিট আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখি ঘর অন্ধকার। টেবিল খালি। ডাক্তার, ডাক্তার, আপনি না বলেছিলেন মমিটা জ্যান্ত হওয়া অসম্ভব! উঃ, আপনাদের কথায় বিশ্বাস করে কী মারাত্মক ভুল করেছি।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন ডাক্তার লিম। এ কি সত্যি? বেশ কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হিসাবে একটু ভুল হয়েছিল আমার। জীবটা তো পৃথিবীর নয়। পৃথিবীর নিয়ম খাটবে কেন ওর ওপর।

আপশোস করে এখন আর কোনও লাভ নেই। যেমন করেই হোক ধরতে হবে দৈত্যটাকে। খুব ভাগ্য ভালো আমার। অন্ধকারের মধ্যে অনায়াসে আমাকে মেরে ফেলতে পারত।

কিন্তু আমি যে এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না কেমন…

বাজে কথা রাখুন এখন। আপনারই আগে ধরতে যাওয়া উচিত। আপনারই তো পুষ্যি ওটা। আমি একা জেগে রইলাম আর আপনারা মজাসে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন। আশ্চর্য!

কোমরে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন ডক্টর রায়। বললেন, বাইরে খুঁজতে যেতে হবে না কাউকে। আমাদের প্লেনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু কোথায় যাবে দৈত্যটা?

কোথায় যাবে তার আমি কী জানি? শেষ যখন দেখেছি তখন দৈত্যটার ফাটা মাথা দিয়ে সবুজ রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। উঃ, মাথা ফাটা এক ভয়ংকর দৈত্য তিনটে লাল চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে! ভাবতেও শিউরে ওঠে গা-টা।

কাইবুলুস্কি আর বিশ্বনাথ কুমারকে দেখা গেল দরজার সামনে। পেছন থেকে অনেকগুলো উত্তেজিত স্বর শোনা গেল।

কোন দিকে গেছে কেউ দেখেছ নাকি? জিজ্ঞাসা করলেন বিশ্বনাথ কুমার।

নিশ্চয়ই কেউ দেখেনি। আর দেখামাত্র তো চেনা যাবে। চার ফুট উঁচু, তিনটে ড্যাবড্যাবে লাল চোখ, ফাটা মাথা দিয়ে সবুজ রক্ত বেরুচ্ছে…

হাসি ঠাট্টার ব্যাপার নয় এটা। সৌরেনের কণ্ঠস্বরে ভয়ের আভাস।

কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে একটা অমানুষিক চিৎকার শোনা গেল। সুড়ঙ্গপথগুলো ভয়ে যেন শিউরে উঠল।

চিৎকার করে উঠল সৌরেন। পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে দৈত্যটাকে। এক দৌড়ে স্বর্গপুরী থেকে একটা ৪৫ বোরের রিভলভার নিয়ে এল। তারপর সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সোজা কুকুরের ঘরের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল।

এক সঙ্গে বিকটভাবে চিৎকার করে উঠল কুকুরগুলো। আর তার পরেই এক অপার্থিব তীক্ষ্ণ আর্তনাদে কুমেরুর তুষার শুভ্র নীরবতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। গমগম করে উঠল মাটির নিচের সুড়ঙ্গপথগুলো।

সৌরেনের পেছনে পেছনে কাইবুলুস্কি, ডাক্তার লিম আর ডক্টর রয় ছুটতে আরম্ভ করলেন। অন্যান্য সকলে হাতের কাছে যে যা পেল তাই নিয়ে অন্য একটা পথ দিয়ে ছুটে চলল কুকুর ঘরের দিকে। নেহাল সিংয়ের হাতের বর্শাটা স্বল্প আলোয় ঝকঝক করে উঠল।

কিছু দূর গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্তার লিম। সামনের একটা বাঁকের আড়ালে ঝড়ের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল কাইবুলুঙ্গি। ফায়ার এক্সটিনগুইসার হাতে স্মিথও দৌড়াল সেই দিকে।

ঠিক কুকুর ঘরের সামনে কে যেন সৌরেনকে জোর করে থামিয়ে দিল। এক অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। হে ভগবান, কী ভয়ানক, কী বীভৎস! দ্রুম দ্রুম দ্রুম। রিভলভারের আওয়াজে চাপা সুড়ঙ্গপথটা কেঁপে কেঁপে উঠল। আরও তিনবার গর্জে উঠল রিভলভার। তারপর সজোরে রিভলভারটা সামনের দিকে ছুঁড়ে মারল সৌরেন। চক্ষের পলকে বরফ-কাটা কুড়ল তুলে ধরল সে। পেছন থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখতে পেল না স্মিথ। একটা তীক্ষ্ণ মিউ মিউ আওয়াজে আকাশ বাতাস ভরে উঠল। কোণঠাসা কুকুরগুলো ঘ-র ঘর-র করে চিৎকার করে উঠল। পায়ের নখ দিয়ে শক্ত বরফ আঁচড়াচ্ছে কুকুরগুলো। টুং টুং করে ছেঁড়া চেনগুলোয় এক বিচিত্র শব্দ উঠছে শক্ত কঠিন বরফের ওপর।

সাঁৎ করে একপাশে সরে গেল সৌরেন। এবার স্পষ্ট দেখতে পেল স্মিথ। মুহূর্তে যেন অবশ হয়ে গেল সমস্ত দেহ। সৌরেনকে আক্রমণ করতে উদ্যত দৈত্যটা। কিন্তু পলকের মধ্যে সৌরেনের কুড়ুল নেমে এল দৈত্যটার মাথায়। ঘ্যাঁচ করে শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে একতাল মাংস ছিটকে পড়ল বরফের ওপর। তৎক্ষণাৎ সামনের দিকে এগিয়ে এল কুকুরগুলো। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল দৈত্যটা। ধকধক করে জ্বলছে লাল চোখ তিনটে। এক ভয়ংকর অপার্থিব প্রতিহিংসায় এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। মাথার শতসহস্র চুলগুলো সাপের মতো ছোবল মারার জন্যে এগিয়ে এল সামনের দিকে। ফায়ার এক্সটিনগুইসারটাকে বাগিয়ে ধরল স্মিথ। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বেগে অন্ধ-করা রাসায়নিক ফেনায় ঢাকা পড়ে গেল দৈত্য। কুকুরগুলো যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। একসঙ্গে সকলে এবার আক্রমণ করল দৈত্যটাকে।

বিরাট ব্লো-টর্চ হাতে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন কাইবুলুস্কি। অবস্থা বুঝে সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ শুরু করলেন। এক বিকট চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল দৈত্যটা। তিন ফুট লম্বা নীলচে আগুনের হল্কায় পেছিয়ে গেল কুকুরগুলো।

স্মিথ স্মিথ, একটা ইলেকট্রোকিউটার নিয়ে এস তাড়াতাড়ি। পুড়িয়ে মারতে হবে দৈত্যটাকে।

পাওয়ার প্ল্যান্টে লাগানো একটা মোটা কেবল নিয়ে কাইবুলুস্কির কাছে চলে এল স্মিথ। সাবধান! চিৎকার করে উঠল অর্জুন সিং। সঙ্গে সঙ্গে আপৎকালীন ব্যবহারের জন্য রাখা গ্যাসোলিন ডায়নামোটা গর্জন করে উঠল। বিশ্বনাথ কুমার কেবলটাকে ইলেকট্রোকিউটারের মধ্যে লাগিয়ে দিলেন।

রক্তলাল চোখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বেলে হিসহিস করে হতে লাগল ভিনগ্রহের দৈত্যটা। দূরে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে কুকুরগুলো। আবছা অন্ধকারের মধ্যে কুকুরদের সাদা সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠছে। দৈত্যটার মতো এরাও প্রতিহিংসায় পাগল। ব্লো-টর্চ থেকে ঝলকে ঝলকে আগুন বেরুচ্ছে। হ্যাঁন্ডেলসুদ্ধ ইলেকট্রোকিউটার কেড়ে নিলেন কাইবুলুস্কি।

ইলেকট্রোকিউটারের সামনে ১৮ ইঞ্চি তফাতে মোটা কন্ডাকটর দুটো ঝকঝক করছে। ২২০ ভোল্ট কারেন্টে হিসহিস করে উঠল যন্ত্রটা। ইলেট্রোকিউটার দেখে একটু পিছিয়ে গেল দৈত্যটা। স্মিথকে ইশারা করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন কাইবুলুস্কি। চকিতের মধ্যে কুচকুচে কালো প্রকাণ্ড একটা আলস্কার কুকুর লাফিয়ে পড়ল দৈত্যটার ওপর। কুকুর আর দৈত্যটার চিল্কারে ভরে উঠল সুড়ঙ্গ পথ।

ইলেকট্রোকিউটারটা গায়ে ঠেকার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভৌতিক আর্তনাদ করে উঠল দৈত্যটা। মাংস পোড়া চামসে গন্ধে ম ম করে উঠল সমস্ত ঘর।

মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল লাল চোখের দপদপানি। হাত-পা-গুলো অসহায়ের মতো দাপাদাপি করতে লাগল। আরও কাছে এগিয়ে এল কুকুরগুলো। ইলেকট্রোকিউটারটা আরও জোরে চেপে ধরলেন কাইবুলুস্কি। বরফের ওপর যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল দৈত্যটা। সাদা সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে এল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে।

.

০৫.

ঘরের চারদিকে তাকালেন ডক্টর রায়। সবাই এসেছে। কয়েকজন আহত কুকুরদের পরিচর্যায় ব্যস্ত। মনে হয় সকলে এসে গেছে। সকলে না হোক তিন-চারজন অন্তত স্বচক্ষে দেখেছে ঘটনাটা। বাকি সবাই টেবিলের ওপর রাখা দৈত্যটাকে দেখে অনুমান করতে পার। আচ্ছা, সকলের দেখার জন্যে ঢাকাটা খুলে দিচ্ছি আমি। ঢাকা দেওয়ার তিরপলটা সরিয়ে দিলেন ডক্টর রায়। দুর্গন্ধময় আধপোড়া মাংস গলে গলে পড়ছে। তীব্র উৎকট গন্ধে ভরে গেল সারা ঘর।

আর কিছুক্ষণ বেঁচে থাকলে দুর্দান্তর কী হত বলা যায় না। অবশ্য এই নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন ম্যাকডেভিড। কিন্তু দৈত্যটার সম্পূর্ণ পরিচয় কী! এটা যে সম্পূর্ণ মৃত তারই বা প্রমাণ কী। কী বলো তোমরা?

সৌরেন তিক্তস্বরে বলল, কারুর সন্দেহ হলে দৈত্যটার সঙ্গে একরাত কাটাতে পারে সে।

ম্যাকডেভিড, এবার আপনি কিছু বলুন। কতটুকু জানতে পেয়েছেন দৈত্যটার সম্বন্ধে? দৈত্যটার বর্তমান চেহারাটাই ওর নিজস্ব রূপ কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। টেবিলের ওপর আধপোড়া মাংসপিণ্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন ম্যাকডেভিড। হয়তো স্পেসশীপের অন্য কোনও যাত্রীর অনুকরণ করেছিল সে। আবার আমার অনুমান মিথ্যে হতেও পারে। ধরা যাক এইটাই ওর আসল চেহারা। এবার প্রথম থেকে বলি। জীবন্ত হয়ে বোধহয় অবাক হয়ে তাকিয়েছিল দৈত্যটা। দু-কোটি বছর আগের দেখার কুমেরুর সঙ্গে কোনও তফাত নেই এখন। সেই বরফ, তুষার ঝড় আর নিষ্করুণ ঠান্ডা। অবশ্য আমি বেঁচে ওঠার আগে দৈত্যটার একটু মাংস নিয়ে পরীক্ষা করেছিলাম। আর তখনই জেনেছিলাম যে আমাদের চেয়েও এক উত্তপ্ত গ্রহের বাসিন্দা এই জীবটা। সুতরাং নিজস্ব চেহারায় এই প্রচণ্ড ঠান্ডা সহ্য করা অসম্ভব। অবশ্য পৃথিবীর যে কোনও জীব এই ঠান্ডায় মরে যেতে বাধ্য। কিন্তু কতকগুলো কুকুর এর ব্যতিক্রম। কুকুরদের দেখতে পেয়েছিল এই দৈত্যটা আর দুর্দান্তও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর। আচ্ছা, মাংসপিণ্ডটাকে ভালো করে দেখেছে তোমরা? মাংসপিণ্ডের অর্ধেকটা দুর্দান্তের মতো। তাই না? কারণ দুর্দান্তের বাকি দেহটা হজম করে ফেলেছে দৈত্যটার দেহের প্রটোপ্লাজমগুলো। আক্রমণ করার সময় নিজের গ্রহের কোনও মারাত্মক জীবের রূপ ধরেছিল সে।

রূপ পালটেছিল! কেমন করে? একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল ডক্টর রায়ের কণ্ঠস্বরে।

 তাহলে প্রথম থেকে বলি, বুঝতে সুবিধে হবে। প্রত্যেক জীবন্ত দেহ সেল বা কোষের সমষ্টি। সেগুলো আবার প্রটোপ্লাজম দিয়ে তৈরি। আবার প্রটোপ্লাজমের মধ্যে প্রত্যেক সেলে একটি করে নিউক্লিয়াস থাকে। এই নিউক্লিয়াসই সেলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দৈত্যের মতো জীবটা আমাদের চেয়েও অনেক উন্নত। ওহে সৌরেন, পদার্থবিদ্যায় তো তোমার ভালো জ্ঞান আছে। এক-একটা সেলকে তুমি অ্যাটমের সঙ্গে তুলনা করতে পার। অ্যাটমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও নির্ভর করে নিউক্লিয়াসের ওপর।

প্রকৃতির সৃষ্টি যখন, তখন প্রকৃতির প্রধান নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য। তাই এই দৈত্যটার দেহ সেল এবং সেলগুলোও প্রটোপ্লাজম দিয়ে তৈরি।

কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে ওর পার্থক্য আছে। দৈত্যটার দেহস্থিত সেলের নিউক্লীয়াসগুলো নিজস্ব সেলগুলোকে সম্পূর্ণ ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। আর এই জন্যেই অবিশ্বাস্য ক্ষমতার অধিকারী ওই জীবটি। দুর্দান্তকে হজম করার সঙ্গে সঙ্গে তার সেলগুলোর বৈশিষ্ট্যও জানা হয়ে গেছল দৈত্যটার। আর তারপর নিজের সেলগুলোকে ওই সেলের অনুকরণে রূপান্তরিত করতে মোটেই দেরি করেনি ও। কিন্তু রূপান্তরিত সেলে আসল কুকুর-সেলের নিউক্লিয়াস নেই। তিরপলের একাংশ তুলে ধরলেন ম্যাকডেভিড। মাংসপিণ্ডের মাঝখান থেকে হলদে লোমওলা একটা কুকুরের পা উঁচু হয়ে আছে। এই পা-টা কিন্তু দুর্দান্তের নয়। দুর্দান্তের পায়ের অনুকরণ মাত্র। তবে পায়ের কতটা আসল বা নকল তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয় এখন। অবশ্য সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে গেলে আসল নকলের তফাত কোনও শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপেও বোধহয় ধরা পড়বে না।

বিশ্বনাথ কুমার জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা যদি আরও বেশি সময় পেত জীবটা?

 তাহলে সম্পূর্ণ দুর্দান্ত রূপান্তরিত হয়ে যেত দৈত্যটা। নকলকেই তখন আসল বলে মনে হতো। অন্যান্য কুকুরগুলোও ধরতে পারত না। এর থেকেই অনুমান হয় এক অকল্পনীয় বুদ্ধিমান জীবগোষ্ঠীর বংশধর এই দৈত্যটা। জীববিজ্ঞানের দুরূহতম রহস্যও করায়ত্ত তাদের। আর তার সদ্ব্যবহারও তারা সাফল্যের সঙ্গে করে।

 কিন্তু দৈত্যটার উদ্দেশ্য কী? বলল স্মিথ।

একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে উঠলেন ম্যাকডেভিড। চকচকে টাকের মধ্যে ফুরফুর করে দু-একটা সাদা চুল উড়ছে। কিছুক্ষণ স্মিথের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, যদি বলি পৃথিবী জয় করার উদ্দেশ্য ছিল!

কী বলছেন আপনি? একজনের পক্ষে পৃথিবী জয় করা সম্ভব নাকি? তারপর জনমানবশূন্য পৃথিবী শাসন করত নাকি দৈত্যটা?

না না, তা হবে কেন, মাথা নেড়ে বললেন ম্যাকডেভিড। চকচকে সুতীক্ষ স্ক্যাপেলটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। নিচু হয়ে মাটি থেকে তুলতে বললেন, আস্তে আস্তে পৃথিবীর সমস্ত লোকই রূপান্তরিত হয়ে যেত।

কী পাগলের মতো বকছেন? একলা একলাই বংশবৃদ্ধি করতে পারে নাকি দৈত্যটা?

না, সেরকম করে করত না নিশ্চয়। এখনকার কথাই ধরা যাক না কেন। দৈত্যটার প্রথম ওজন ছিল ৮৫ পাউন্ড। আর দুর্দান্তের ওজন ৯০ পাউন্ড। আমরা দুজনকেই ওজন করে দেখেছি। ওজন করার পর দেখা গেল মাত্র ৫ পাউন্ড কমেছে দৈত্যটার। আর ওই ৫ পাউন্ডেই দুর্দান্তর সমস্ত দেহটা রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রায় অ্যামিবার মতো বংশবৃদ্ধি করে এরা। আরও সময় পেলে টাইগার, বিদ্যুৎ বা অন্যান্য কুকুরগুলোও রূপান্তরিত হয়ে যেত। তারপর একবার সমুদ্রে পৌঁছুতে পারলেই একটা বা দুটো সিল মাছে রূপান্তরিত হত। তারপর এরকম করে রূপান্তরিত হতে হতে সোজা চলে যেত ভারতবর্ষে, দক্ষিণ আমেরিকায় বা…

কথা শেষ করার আগেই জিজ্ঞাসা করলেন বিশ্বনাথ কুমার, তাহলে যে কোনও কিছুতে রূপান্তরিত হতে গেলে প্রথমেই সেই প্রাণীর কিছু অংশ আত্মসাৎ করা প্রয়োজন। ঠিক বলছি না, ম্যাকডেভিড?

ঠিক ধরেছ, বিশ্বনাথ। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়, আরও আছে। দৈত্যটার একটা মাত্র সেল যে কোনও বিরাট প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে পারে। বুঝতে পারছ কী অসীম ক্ষমতা এদের। অমর এরা। এদের হত্যা করা সহজ নয়।

দৈত্যটার মৃত্যু সম্বন্ধে কি আপনি নিশ্চিত, ম্যাকডেভিড? শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন ডক্টর রায়।

হ্যাঁ, অরুণ, আমি নিঃসন্দেহ এ বিষয়ে। কুকুরদের তাড়িয়ে দেবার পরও পুরো পাঁচ মিনিট ইলেকট্রোকিউটারটা চেপে রেখেছিলাম ওর দেহে। প্রায় আধসিদ্ধ হয়ে গেছে।

উঃ, নিশ্চিন্ত হলাম। ভাগ্যিস এটা জনমানবশূন্য কুমেরু। কেবল কুকুর আর গোরুগুলো ছাড়া আর কোনও জ্যান্ত প্রাণী নেই এখানে। তা না হলে…

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। পাগলের মতো হেসে উঠলেন ম্যাকডেভিড, কী, কী বললে, অরুণ? আর কোনও জ্যান্ত প্রাণী নেই? আমরা, আমরা কি জ্যান্ত নই? আমাদের অনুকরণ করতে অসুবিধে কোথায়? তা ছাড়া পৃথিবী জয় করার উদ্দেশ্য থাকলে কুকুরের চেয়ে মানুষের রূপ নেওয়াই বেশি লাভজনক। পুরো চারশো মাইল দূরে লোকালয়। খাবার ছাড়া কুকুরের পক্ষে এত পথ চলা সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও কিছুর সাহায্য না নিয়েও অনেক দূর যেতে পারে মানুষ। তা ছাড়া মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। সুতরাং দৈত্যটার পক্ষে আমাদের কাউকে রূপান্তরিত করাই বাঞ্ছনীয়। তার পর প্লেনে মাত্র দু-ঘণ্টার পথ। পৃথিবীর জনসংখ্যা তো তখন হাতের মুঠোর মধ্যে। পৃথিবীর রাজা। তোমরা তো কেউ দেখোনি। সব দেখেছি আমি। তাই তোমাদের একজনকেও বাঁচতে দেব না। একটা প্লেনও উড়ে যেতে পারবে না এখান থেকে। তোমরা, তোমরা, কেউ আর মানুষ নয়। দৈত্য হয়ে গেছ সবাই। আমি… আমি বাঁচাবো পৃথিবীকে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ… হাসতে হাসতে মাটিতে পড়ে গেলেন ম্যাকডেভিড।

ম্যাকডেভিডকে পাঁজাকোলা করে তোলার চেষ্টা করলেন ডাক্তার লিম। কিন্তু পারলেন না। বাধ্য হয়ে মরফিয়া ইনজেকশান করলেন।

এবার কাইবুলুস্কি আর লিম দু-জনে ধরে একটা বাঙ্কের ওপর শুইয়ে দিলেন ম্যাকডেভিডকে।

কাইবুলুস্কি বললেন, দৈত্যটা যে আমাদের কাউকে রূপান্তরিত করেনি, এই কথাটাই যে রকম করেই তোক বোঝাতে হবে ম্যাকডেভিডকে।

 এত বড় বিজ্ঞানী! কী করে যে কী হয়ে গেল!

রেডিয়োতে কোনও সংবাদ না পাঠানোই ভালো। সংবাদ পেলেই হয়তো আরও লোক পাঠাবে ওরা। তাতে বিপদ বাড়বে বই তো কমবে না।

আপনি কী বলেন ডক্টর রায়?

হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো কাইবুলুস্কি। তবে আমার কী মনে হয় জানো, ম্যাকডেভিডের হিসেবে ভুল আছে। অনুকরণ করলেও নিজের দেহের মৌলিক কেমিক্যাল সাবস্ট্যান্সগুলো লুকোবে কোথায়? তা ছাড়া নিজের মেটাবলিজম, আছে। আপনার অভিমত কী, ডাক্তার লিম?

আপনার অনুমান ঠিক, ডক্টর রায়। তাই মনে হয় সিরাম টেস্ট করলে আসল নকল ধরা পড়বে। অন্য গ্রহের জীব বলে ওর দেহের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াও নিশ্চয় অনেক তফাত হবে আমাদের চেয়ে। সুতরাং পৃথিবীর যে কোনও প্রাণীদের দেহে ভিনগ্রহের প্রাণীর সেলগুলো সংক্রামক জীবাণু বলে গণ্য হওয়া উচিত।

তাহলে রক্ত–রক্তকেও তো অনুকরণ করতে পারে?

নিশ্চয়ই। রক্তও তো সেল দিয়ে তৈরি। জলীয় পদার্থের পরিমাণই হল মাংসপেশি আর রক্তের মধ্যে প্রধান তফাত।

হঠাৎ বাঙ্কের ওপর উঠে বসলেন ম্যাকডেভিড। চিৎকার করে বলে উঠলেন, সৌরেন, সৌরেন কোথায়?

এই তো এখানে আমি। বড় বড় পা ফেলে ওর দিকে এগিয়ে গেল সৌরেন।

 তুমিই সৌরেন নাকি? হ্যাঁ, তুমি সৌরেন? পাগলের মতো হাসতে আরম্ভ করলেন ম্যাকডেভিড। হাসির গমকে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল সমস্ত শরীর।

সৌরেন অবাক। বলল, আমিই তো সৌরেন। আমাকে অন্য কিছু ভাবছেন নাকী?

 না না, ভাববার তো কিছু নেই। কী সুন্দর অভিনয়! আবার হাসিতে ফেটে পড়লেন, সৌরেন, সৌরেন তুমি? ঠিক তো? মানুষ হতে চেয়েছিল দৈত্যটা। কুকুর নয়, কুকুর নয়… হাঃ হাঃ হাঃ…