মলাটের মুখ

মলাটের মুখ

সুজিত, অমিত আর আমি। চেহারা লেখাপড়া পেশায় কোনও মিল নেই কোনওখানে। তবুও কেমন করে জানি না বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মিল শুধু এক জায়গায়। বিস্ময়-কে বাঁচাতে হবে, বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্যের প্রচলন করতে হবে বাংলা ভাষায়। মাঝে মাঝে হাসি পায়। মনে হয় ভগবান কি এসএফ-এর সোল এজেন্ট করে দিয়েছে নাকি আমাদের। সে যাই হোক, রোজকারের মতো সেদিনও আমরা বসেছিলাম বিস্ময় অফিসে। বাইরে সন্ধের অন্ধকার। সৌরজগৎ ছাড়িয়ে মহাবিশ্বের প্রতিটি বিষয় ছিল আমাদের আলোচ্য। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে অনায়াসেই বিচরণ করছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল একটা গল্প লিখলে হয় না। মলাটের ছবি নিয়ে?

আমি বললাম, আচ্ছা, এমন তো হতে পারে যে কুমেরু অভিযান হয়েছে, সেখানে বরফের স্তর ড্রিল করতে করতে হঠাৎ ধাতব কোনও কিছুতে লেগে ভেঙে গেল ড্রিলের মুখটা। তারপর বরফের স্তর সরিয়ে ফেলতেই বেরিয়ে পড়ল এক বিচিত্র দর্শন স্পেসশিপ। কত বছর আগে তা অনুমান করা কঠিন। এয়ার লক খুলতেই বহু পুরোনো ভ্যাপসা গন্ধ ভেসে এল। ভেতরে একটা স্পেস স্যুট পড়ে আছে। স্পেস স্যুটের আই পিসের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল শুধু একটা কঙ্কালের মুখ। তার পাশে পাওয়া গেল একটা মোটা ডায়েরি আর লগ বুক। এমন করে লিখলে কেমন হয়?

বাঃ, সুন্দর প্লট। তাহলে রণেনদা তুমিই লিখে ফেল গল্পটা। একটু জোর দিয়ে বলে উঠল অমিত।

হ্যাঁ হ্যাঁ তাই করে ফেল। তবে সময় মাত্র সাত দিন। আর সাত-আট পাতার বেশি যেন না হয়। সুজিতের সেই হিসেব।

না হে অমিত, আমি বললেও প্লটটা কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না।

তাহলে ওঠ এখন। বাড়িতে ভাবা যাবে। রাত অনেক হয়ে গেছে। অমিত উঠে পড়ল। দেখাদেখি আমিও উঠলাম। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল গল্পের প্লটটা। আরও কীভাবে বলা যায় গল্পটাকে। আরও সুন্দর করা যায়।

বাড়িতে এসেও এক চিন্তা। ওই ছবিটাকে ঘিরে একে একে আরও অনেক প্লট ভেসে চলেছে মনের পর্দায়। কিন্তু ঠিক করতে পারছি না কোনটা ভালো হবে।

সারাদিনের ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। বিছানায় শুয়েও নিস্তার পেলাম না। চিন্তা যতই করছি ততই নতুন নতুন প্লট আসছে। আসার শেষ নেই।

..এতক্ষণ আপনাদের আমার ধারণার কথা সব বললাম। এবার আমার আসল কথায় আসছি। আমাদের স্পেসশিপ নিয়ে আমরা অনায়াসে চাঁদের বুকে পাড়ি জমিয়েছি। সেই স্পেসশিপ নিয়ে আমরা আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলোতে যেতে পারব মাত্র। আর শুধু গ্রহের সীমানায় পৌঁছতে গেলে যে প্রারম্ভিক ঊর্ধ্বচাপের প্রয়োজন তার জন্যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানির আবশ্যক। আবার সুন্দর নক্ষত্রলোকে পাড়ি জমাতে গেলে নিরবিচ্ছিন্ন ঊর্ধ্বচাপের প্রয়োজন। নয়তো আমাদের কয়েক পুরুষ কেটে যাবে নক্ষত্রলোকে পৌঁছতে। তা ছাড়া তরল জ্বালানি নিয়ে নক্ষত্রলোকে পাড়ি জমানো অসম্ভব। তাই আমি মনে করি এই বিপুল দূরত্ব অল্প সময়ে অতিক্রম করতে হলে চলার পথে মহাজাগতিক ধূলিকণা সঞ্চয় করেই নিরবিচ্ছিন্ন শক্তির সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। এবং সে কৌশল আমাদের আয়ত্ব করতে হবে।

আপনারা নিশ্চয় জানেন যে নিরবচ্ছিন্ন ভেলোসিটির জন্য নিরবচ্ছিন্ন নিউক্লিয়ার পাওয়ারের প্রয়োজন। আবার নিরবচ্ছিন্ন নিউক্লিয়ার পাওয়ারের জন্য অনেক বেশি নিউক্লিয়ার টেস্টের প্রয়োজন। আমরা জানি এবং আমি বিশ্বাস করি যে বিশেষ কোনও আকরিক ধাতু ছাড়াই যে কোনও বস্তুকেই নিউক্লিয়ার পাওয়ারে রূপান্তরিত করা যায়। চেষ্টা করলে হয়তো এই রূপান্তরিত হওয়ার গতিকে আমরা কনট্রোল করতে পারব। এসব তো আমাদের জানা থিয়োরি। এখন থিয়োরিকে বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

কিন্তু পৃথিবীতে এ পরীক্ষা করা যাবে না। এমন কি চাঁদেও না। অদূর ভবিষ্যতে নক্ষত্রলোকে যাত্রার জন্যে চাঁদ থেকে রওনা হওয়ার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। কারণ চাঁদের কম মাধ্যাকর্ষণের জন্য জ্বালানি কম লাগবে। তাই নক্ষত্রলোকে যাতায়াতের জন্য চাঁদ অপরিহার্য। তাই এই পরীক্ষা করে চাঁদকে তেজস্ক্রিয় করতে চাই না আমি।

তাহলে কোথায় পরীক্ষা করা হবে? পৃথিবী আর চাঁদ ছাড়া অন্য কোনও জায়গা বাছতে হবে।

হ্যাঁ, সে জায়গাও আমরা পেয়েছি। সেটা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ। আপনারা তা জানেন যে পরপর কয়েকটা অভিযান পাঠানো হয়েছিল মঙ্গলে। তার ফলে আমরা জানতে পেরেছি যে মঙ্গল গ্রহ প্রাণহীন। জীবন ধারণের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। আবার ওখান থেকে খনিজ ধাতু নিয়ে আসতে যে খরচ পড়বে তাতে খরচে পোষাবে না। পাতলা বাতাস আর জলশূন্য হওয়ার জন্যে চাষ-বাসও সম্ভব নয় মঙ্গলে। তাই সব কিছু বিচার করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে মঙ্গলের কোনও স্থান নেই আমাদের জীবনে।

অথচ এই পরীক্ষা চালাবার পক্ষে মঙ্গল গ্রহ এক অমূল্য স্থান। মঙ্গলের সাধারণ পাহাড় আর ধুলিকণার মধ্যেই আমরা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন শুরু করতে পারি। আর সেই রিঅ্যাকশনকে কনট্রোল করে ধারাবাহিক শক্তির যোগান দেওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। অবশ্য একটা ভয়ও আছে। এই রিঅ্যাকশন যদি খুব দ্রুত হয় তাহলে আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়ে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা খুবই কম।

এই পরীক্ষার ফলে হয়তো সমস্ত গ্রহটাই তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারে অথবা ধীরে ধীরে একেবারেই লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তবে একটা অকেজো গ্রহ ধ্বংস হলেও আমাদের জ্ঞানের সীমা বেড়ে যায় অনেকখানি।

সাধারণ পাহাড় ধূলিকণার মধ্যে স্লো-বার্ন পদ্ধতিতে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশান শুরু করা গেলেও এই রিঅ্যাকশনকে থামানোর কোনও উপায়ই জানা নেই আমাদের। তবে আজ জানা না থাকলেও আমি বিশ্বাস করি আমাদের বংশধররা নিশ্চয়ই এই প্রসেসকে থামানোর কৌশল আয়ত্ত করবে। শুধু তাই নয়, তেজস্ক্রিয়ার হাত থেকেও গ্রহটাকে বাঁচাতে পারবে ওরা।

এ অসুবিধা সত্ত্বেও এই পরীক্ষা শুরু না করলে আমাদের নিউক্লিওনিক বিজ্ঞানের কোনও অগ্রগতি হবে না। তাই অকেজো গ্রহের বিনিময়ে এই পরীক্ষা করতেই হবে।

বেশ উত্তেজিতভাবে শেষ করলাম আমার লম্বা বক্তৃতা। বিশ্ব সরকারের মন্ত্রণাকক্ষ লোকে লোকারণ্য। সবাই বাক্যহারা, স্তব্ধ। গলা শুকিয়ে উঠেছে। টেবিল থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম জলটা।

তারপরের ঘটনা ছোট। এক বিপুল শক্তি আজ আমাদের করায়ত্ত হতে চলেছে। তাই অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কার্যকর হল আমার পরিকল্পনা। তৈরি হল প্রোজেক্ট স্নো-বার্ন।

বিজ্ঞানের সব শাখা থেকে লোক নেওয়া হল। মোট কুড়ি জন। যুগান্তকারী প্রোজেক্ট স্লো বার্নের নায়ক আমি। আমার দায়িত্ব অনেক। সফল হলে…

বিশালকায় স্পেসশিপে রওনা হলাম আমরা চাঁদের বুক থেকে। পুরো ছ-মাসের রসদ আছে আমাদের সঙ্গে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সবকিছু।

মঙ্গলে নামলাম আটাশ দিন পরে। পাহাড়-পর্বতসঙ্কুল মঙ্গল। কেবল লাল আর লাল। যতদূর দৃষ্টি যায় এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়, রুক্ষ অসমতল ভূমি। সবুজের চিহ্ন নেই কোনওখানে। জল তো মঙ্গলে মরীচিকা। থেকে থেকে ধুলোর ঝড় বইছে।

চাঁদও রুক্ষ এবড়ো-খেবড়ো। তবুও চাঁদ থেকে পৃথিবীকে দেখায় বিরাট গোলাকার বলের মতো। মনে হয় এই তো একটুখানি গেলেই তো পৃথিবী। যে পৃথিবীতে আমাদের বাড়ি সেই পৃথিবী এত কাছে… চেষ্টা করলেই যাওয়া যায়। মনটা অন্তত শান্তি পায় এই চিন্তায়। দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ পাওয়া যায় পৃথিবীর।

কিন্তু মঙ্গল? অমঙ্গলের আশংকা জাগায়। পৃথিবী এখন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বই আর কিছু নয়। কত দূরে পৃথিবী? ভাবলেও মনটা হতাশ হয়ে পড়ে। কোনওদিনও কি ফিরতে পারা যাবে পৃথিবীতে? আবার কি দেখতে পাওয়া যাবে প্রিয়জনদের? মনের মধ্যে ভিড় করে এল এখন কত শত চিন্তা। মনে হত হলামই বা নামকরা বিজ্ঞানী, তাই বলে সুদেষ্ণা আমার কেউ নয়, রানা আমার কেউ নয়, বাবা, মা, ভাই, বন্ধু-বান্ধব… এদের কি কোনও দাবি নেই আমার উপর। উত্তেজনার বশে কোথায় চলে এলাম। আবার পরক্ষণেই যখন মনে হত ভবিষ্যৎ সাফল্যের কথা, তখনই ফের ঝুঁদ হয়ে পড়তাম নেশায়।

না, একটুও অত্যুক্তি করেনি পূর্বের অভিযানকারীরা। একেবারে মানুষের অনুপোযোগী অকেজো এই মঙ্গল গ্রহ। জীবন স্পন্দনহীন এক মরুভূমি। বোধহয় আমার পরীক্ষার জন্যেই তৈরি হয়েছিল মঙ্গল।

মাটির তলায় মঙ্গলের বুকের ভেতর আমাদের বাসস্থান তৈরি হল। এক মাসের মধ্যেই আমরা এ-সব ব্যবস্থা করে ফেললাম। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল ফলালাম আমরা মাটির তলাতে। কোনও কিছুই রইল না মাটির উপর, কয়েকটা শুধু উঁচু টাওয়ার ছাড়া। আমাদের বাসস্থানের একটু দূরেই স্পেসশিপটা দাঁড়িয়ে রইল প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো। ইতিমধ্যে মঙ্গলের বুকের উপর প্রাথমিক কাজ চলেছে পুরোদমে। টিভি ক্যামেরা মারফত এখানকার সমস্ত ছবি প্রথমে চাঁদের রিসিভিং সেন্টারে, তারপর সেখান থেকে রিলে সিস্টেমে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে।

আমাদের কাজে বাধা আসে মাঝে মাঝে। হঠাৎ একদিন লাল ধুলোর ঝড় উঠল। যতদূর তাকাও কেবল লাল ধুলোর অচ্ছেদ্য প্রাচীর। পুরো একমাস ধরে ঝড়ের তাণ্ডব চলল। ঝড়ের গতিবেগও মারাত্মক। ঘণ্টায় দু-শো নব্বই মাইল।

পাহাড়সর্বস্ব মঙ্গল গ্রহ। বেস থেকে কুড়ি মাইল দূরে একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। কয়েক দিন আগেও প্রচুর ধোঁয়া দেখা গিয়েছিল পাহাড়ের মাথায়।

সমস্ত প্রস্তুতিপর্ব শেষ। আর কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হবে বিশ্বের যুগান্তকারী বিস্ময়কর পরীক্ষা–প্রোজেক্ট স্লো-বার্ন।

কেন জানি না দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অজানা আশংকায় মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে উঠছে মনটা। এই বিপজ্জনক পরীক্ষায় ক্ষতি হবে না তো কারুর! আমার সারা জীবনের সাধনা অভিশাপ ডেকে আনবে না তো কারুর জীবনে! রানার মুখটা বার বার করে ভেসে উঠছে চোখের সামনে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, রানাদের জীবনকে সুখের করে তুলতেই তো আমার এই বিপজ্জনক পরীক্ষা।

কয়েকটা বড় পাহাড় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিম দিকে। এই পাহাড়গুলির উপরে পরীক্ষা শুরু করব বলে ঠিক করেছি।

এখানে আসার পরেই আর্কিয়োলজিস্ট ড. নায়ার এই পাহাড়গুলো নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ড. নায়ারের মতে এগুলো এক অমূল্য সম্পদ। তাই পাহাড়গুলোর উপরে পরীক্ষা শুরু করব শুনে পাগলের মতো ছুটে এলেন আমার কাছে।

আপনি কেন বুঝছেন না যে এই পাহাড়গুলো প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠেনি। এর গঠনশৈলী দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এগুলো আলাদাভাবে তৈরি।

কী যে বলো নায়ার, শখ করে কে পাহাড় তৈরি করতে যাবে মঙ্গলের বুকে। হালকাভাবে বললাম নায়ারকে।

বেশ বুঝতে পারছি আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস কেউ না কেউ তৈরি করেছে এই পাহাড়গুলোকে। ঠিক যেন পিরামিড। বহুকাল আগের তৈরি বলে ক্ষয়ে গেছে এখানে সেখানে। মনে হয় ভেতরে কিছু নিশ্চয় আছে। তাই আমি অনুরোধ করছি আপনি অন্য কোনও পাহাড়ের উপর পরীক্ষা শুরু করুন! এই পাহাড়গুলো আমাকে ছেড়ে দিন আরও কিছুদিনের জন্যে।

না না, তা হয় না, নায়ার। সবদিক থেকে এটাই উপযুক্ত। ওই যে ওই পাহাড়ের চূড়ার নিচে একটু সমতল জায়গার মাঝখানে যে গর্ত রয়েছে ঠিক করেছি ওইখানে শুরু করব নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন। আর চারপাশে পাহাড়ের চূড়ার ওপর বসানো থাকবে টেলিভিশন ক্যামেরা। আমরাও পাহাড়ের ওপর থেকে লক্ষ করব রিঅ্যাকশন।

আর একবার চিন্তা করে দেখুন আপনি। শেষ মিনতি জানাল ড. নায়ার।

 না চিন্তার আর কিছু নেই। তুমি বরং অন্য পাহাড় নিয়ে রিসার্চ করো।

মঙ্গলের বুকে সেই অভিশপ্ত সকাল। ভোর না হতেই ছুটে গেলাম পাহাড়ের ওপর। গর্তের ঠিক ওপরে পাহাড় চূড়ায় আমি একা থাকব বলে ঠিক করেছি। সঙ্গে রইল প্রয়োজনীয় ইনসট্রুমেন্ট। আমার ঠিক সামনের পাহাড়-চূড়ায় বাকি সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সমস্ত ক্যামেরার মুখগুলো নিচের দিকে নামানো।

পৃথিবীর সময় সাতটা। শুরু হল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন।

প্রথমে কোনও পরিবর্তনই নজরে পড়ল না। শুধু যন্ত্রের মাধ্যমে জানা গেল শুরু হয়ে গেছে রিঅ্যাকশন। স্পেসস্যুটের ভারি হেডপিসের মধ্যে আমার চোখদুটো আরও বড় বড় হয়ে উঠল। ঝুঁকে পড়লাম সামনের দিকে। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটা ছোট গর্ত। তারপর ক্রমেই গর্তটা গভীর ও চওড়া হতে শুরু করল।

উপরকার মলিকিউলার স্তরটা পুড়ছে প্রথমে, তারপর রিঅ্যাকশন ছড়িয়ে পড়ছে নিচের স্তরে। চওড়া আর গভীরতা দুই-ই বাড়ছে গর্তটায়। ইলেকট্রন আর প্রোটনদের সর্বশেষ এনার্জি ক্ষরণ করে শেষ হয়ে যাচ্ছে অ্যাটমগুলো।

তেজ ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে।

আজ আমি সার্থক। আজ আমি ধন্য। বাবা, মা, সুদেষ্ণার কথাই মনে পড়ল প্রথমে। ওরা যদি আজ কাছে থাকত।

পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেল। ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে গর্তটা। এখন গর্তটা বড় এক পুকুরের আকার নিয়েছে। আমার অনুমানমতো রিঅ্যাকশন কাজ করে চলেছে। কিন্তু ক্রমেই যদি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয় রিঅ্যাকশন, তাহলে কিছুই করার থাকবে না আমার। কারণ রিঅ্যাকশনের গতিকে তো থামাতে বা কমাতে জানি না আমরা।

সেদিনও আমরা যে যার জায়গায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনের চূড়ায় সহকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। স্পেসস্যুট পরা দেহগুলো নড়াচড়া করছে ঘন ঘন।

ওদের পাহাড়-চূড়ার ঠিক নিচেই অদৃশ্য হয়ে গেল একটা পাথরের দেওয়াল। বেশ তাড়াতাড়ি হয়ে উঠেছে রিঅ্যাকশন। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম।

এ কী! এ কী দেখছি! পাথরটার নিচেই প্রকাণ্ড এক ঘর। মঙ্গলের জীবন্ত মানুষগুলো ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে ঘরের মধ্যে। কিন্তু নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনের হাত থেকে রেহাই পাবে কী করে! আস্তে আস্তে কুঁকড়ে কালো হয়ে গেল দেহগুলো। ক্রমেই আরও অনেক ঘর দেখা গেল ক্রম অদৃশ্যমান পাথরের তলায়। অত্যন্ত তাড়াতাড়ি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে পাথরের স্তরগুলো। হাজারে হাজারে ক্ষুদ্র আকারের মানুষগুলো প্রাণ হারাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওরা চিৎকার করছে। কিন্তু স্পেসস্যুট ভেদ করে সে শব্দ পৌঁছচ্ছে না আমার কানে।

এই অকল্পনীয় ভয়াবহ দৃশ্যে স্থাণুর মতো হয়ে গেলাম। বেশ বুঝতে পারছি। সামনের পাহাড়ে আমার সহকর্মীরাও বাক্যহারা হয়ে গেছে। হঠাৎ ওদের পাহাড়ের তলাটা অদৃশ্য হতে শুরু হল৷ স্পেসস্যুটের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু হায়, চক্ষের নিমেষে সঙ্গীদের নিয়ে পুরো পাহাড়টাই অদৃশ্য হয়ে গেল আমার সামনে।

কী করব? মানব সমাজের উপকার করতে গিয়ে ধ্বংস করে ফেললাম আর একটা মানব সমাজকে। আমার সমস্ত সহকর্মীদের। এই ধু ধু করা মঙ্গলের বুকে আমি এখন একা। বেতার যোগাযোগের সমস্ত যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে গেছে সর্বগ্রাসী রিঅ্যাকশনে। পাহাড়ের পর পাহাড় পাথর জমি সব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। গর্ত যত গম্ভীর হচ্ছে ততই আমার সামনে উঘাটিত হচ্ছে মঙ্গলের সভ্যতা। স্তরের পর স্তর কেবল বড় বড় ঘর। আর বামনাকার অমূল্য সেই মঙ্গলের বাসিন্দারা। ওঃ, কী ভয়াবহ দৃশ্য। যুদ্ধক্ষেত্রেও বোধহয় এত প্রাণ ধ্বংস হয় না। এ কী অভিশাপের বন্যা নামিয়ে দিলাম মঙ্গলে!

খুব ভালো করে লক্ষ করলাম। উচ্চতায় বোধ হয় এক ফুট হবে। অবিকল যেন আমাদেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ। তাহলে সুদূর অতীতে কি মঙ্গলের সঙ্গে কোনও গভীর যোগাযোগ ছিল পৃথিবীর। আমাদের পূর্বপুরুষরাই কি বাস করত মঙ্গলে। তারপর মঙ্গলে পরিবেশ অনুযায়ী কি বিবর্তনের ধারায় বামন হয়ে গেছে ওরা। মঙ্গলই হয়তো আমাদের আদি বাসস্থান। মঙ্গলের আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে কলোনি করে বসবাস করতে শুরু করেছিল হয়তো আমাদের কিছু পূর্বপুরুষরা। তারপর ক্রমাগত মিউটেশন বা বিকৃতির ফলেই আমরা সেই ক্ষুদ্রাকার থেকে বড় হয়ে আজকের মানুষ হয়েছি। যারা মঙ্গলে রয়ে গেল তার প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বাঁচবার জন্যে মাটির তলায় বসবাস করতে শুরু করল। মাটির নিভৃতে গড়ে ওঠে মঙ্গল সভ্যতা! কিন্তু কে আমার কথায় বিশ্বাস করবে। মঙ্গলের গোটা সভ্যতা তো আমার চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ড. নায়ারের অনুমানই সত্যি। তখন নায়ারের কথা শুনলে আজ একটা গোটা সভ্যতা ধ্বংসের জন্য দায়ী হতে হত না আমাকে। আণবিক ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে গেছে মঙ্গলে। ক্রমেই তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ছে সমস্ত গ্রহ। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল শূন্যতা আর শূন্যতা। প্রচণ্ড বেগে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সবকিছু, মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে প্রচণ্ড তেজে।

পাগলের মতো তাড়াতাড়ি নেমে এলাম আমি। অনেকক্ষণ আগেই আমাদের বাসস্থান বিলীন হয়ে গেছে সর্বগ্রাসী ধ্বংসের মুখে। একটু পরে হয়তো কোনও চিহ্ন থাকবে না স্পেসশিপটার। এয়ার লক খুলে উঠে পড়লাম তাড়াতাড়ি। কেন উঠলাম জানি না। এক মুহূর্ত আর বাঁচার ইচ্ছে নেই। এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে ফিরতে চাই না পৃথিবীতে। কী জবাব দেব মানব সমাজের কাছে! কতকগুলো প্রশ্ন কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার মধ্যে।

কোথা থেকে খাবার তৈরি করত মঙ্গলের মানুষরা। পাথর থেকে খাবার তৈরির কৌশল কি আয়ত্ত করেছিল ওরা! তা-ই যদি হবে তবে কেন ওরা থামাতে পারল না আণবিক ধ্বংসের তাণ্ডব লীলাকে? কেন বাঁচাতে পারল না নিজেদের গ্রহকে? কেন প্রথমেই যোগাযোগ করল না আমাদের সঙ্গে? কেন ধ্বংস করল না আমাদের মতো শক্রদের?

আগুনের ঢেউ তুলে মহাশূন্যের বুকে উঠে পড়ল স্পেসশিপ। মঙ্গলের কক্ষপথেই আবর্তন করতে লাগলাম। স্পেসশিপের ভার তুলে দিলাম অটো পাইলটের হাতে। পুরো গ্রহটা মহাশূন্যের বুকে বিলীন হতে লাগবে পুরো এক বছর। ঠিক এক বছর পরে পৃথিবীতে ফিরতে নির্দেশ দিয়ে দিলাম অটোপাইলটের মেমারি ব্যাংকে। ভিউপোর্টের সামনে স্থাণুর মতো বসে রইলাম। আমার চোখের সামনে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রক্ত-লাল মঙ্গল গ্রহ। সৌরজগতের রক্তচন্দনের টিপ আর দেখবে না কেউ কোনও দিনও। এর অনেক আগেই মৃত্যু ঘটবে আমার। স্পেসস্যুটের মধ্যে আমার কঙ্কালটা পৌঁছুবে পৃথিবীর বুকে এক বছর পরে। কঙ্কাল দেখে কেউ কি চিনতে পারবে আমায়? সুদেষ্ণা, রানা কি চিনতে পারবে ওদের প্রিয়জনকে? না কি নাম না জানা কঙ্কাল হিসেবে হয়তো স্থান পাব কোনও এক যাদুঘরে। হয়তো তলায় লেখা থাকবে এই লোকটাই দায়ী সৌরজগতের সিঁদুরের টিপকে মুছে দেবার জন্যে। রানা যেন আমার দিকে তার ছোট ছোট আঙুল তুলে বলছে, বাপি, কেন তুমি নষ্ট করলে একটা সভ্যতাকে। এ কী? স্পেসস্যুটের একটা হেড পিস কেন ভেসে আসছে আমার সামনে। এ কার মুখ! আমার মুখ! আস্তে আস্তে সব মাংস খসে পড়ছে মুখ থেকে।

আমার শেষ পরিণতি! অস্থিসর্বস্ব আমার মুখটা যেন বলছে–তুমি! তুমি! তুমি নষ্ট করেছ একটা সভ্যতাকে! তুমিই দায়ী।

না–না… আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমি বলতে চাইলাম…

..অ্যাই কী বলছ তুমি? সুদেষ্ণার ঠেলাতে ঘুমটা ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, মঙ্গল গ্রহ-কঙ্কাল-স্পেসশিপ কিছুই নেই। ঘড়িতে ভোর পাঁচটা। এক্ষুনি ফোন করতে হবে অমিতকে। বলতে হবে সত্যি এবারের মলাট নিয়ে গল্প লিখব আমি।

[প্রথম প্রকাশ: সেরা বিস্ময় সায়েন্স ফিকশন, ১৯৯৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *