আলোর জীবন

আলোর জীবন

[অথচ কেউ কি তখন ভাবতে পেরেছিল যে এত দ্রুত সব ঘটে যাবে। জেমস জিনসের পরে অনেক অনেক বিজ্ঞানী বলেছিল–না, সূর্য মরবে না। আদি অনন্তকাল ধরে নিজে জ্বলবে আর সারা বিশ্বে আলো আর উত্তাপ ছড়াবে। হায় রে, সব আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করে বড় বড় ডিগ্রিধারী-ভবিষ্যদ্রষ্টাদের ভবিষ্যবাণীকে উপহাস করে সত্যি সত্যিই ধীরে ধীরে মৃত্যু হল সূর্যের। মহাবিশ্বের নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করল আমাদের সৌরমণ্ডলকে। কিন্তু মানুষ–যে মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে–অকল্পনীয়কে বাস্তবে রূপায়িত করেছে–সে কি হার মানল এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে? না, তারা হার মানেনি। বহু লক্ষ লক্ষ বছর ভবিষ্যতে আমাদেরই বংশধররা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। ওদের সেই অমিতবীর্য কার্যকলাপের গর্বে ভরে ওঠে আমাদের বুক। আমার স্থির বিশ্বাস, এই কাহিনি পড়ে আপনারাও মনে মনে ওদের আশীর্বাদ করবেন আর বলবেন চরৈবেতি চরৈ বেতি–এগিয়ে যাও এগিয়ে যাও]

মাটির তলার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সুউচ্চ অবজারভেটরির একেবারে উপরে এসে দাঁড়াল নিলয় আর তনিমা। পুবদিকের জানালাটা খুলে দিয়ে তনিমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল নিলয়। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠল ওরা। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল বরফ আর বরফ। তারাদের মিটি মিটি আলোয় মাঝে মাঝে চকচক করছে বরফগুলো। সময় হয়ে এসেছে। এইবারে সূর্য উঠবে। সূর্য? হ্যাঁ, এখনও লোকে সূর্য বলে ডাকে। সূর্যের আসল রূপ শুধু এরা কেন, এদের অনেক অনেক পূর্বপুরুষের সৌভাগ্য হয়নি দেখার। সূর্য এখন শুধু গোলাকার একতাল জমাট অন্ধকার।

বিজ্ঞানীরা যতই অভাবনীয়, অকল্পনীয় ইত্যাদি বলুন না কেন, তবুও কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই ঠান্ডা হতে শুরু করে জ্বলন্ত সূর্য। এর প্রভাব সবচেয়ে প্রথম লক্ষ করা যায় মঙ্গল আর বুধ গ্রহের উপর। কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় গ্রহ দুটি! আর ঠিক তখন থেকেই সাজো সাজো রব পড়ল পৃথিবীতে। নদ-নদী সমুদ্র প্রভৃতি সমস্ত জলাধারগুলো ধীরে ধীরে কঠিন বরফে রূপান্তরিত হল। বাতাসও জমাট বাঁধতে শুরু করল। রক্ত-জমানো ঠান্ডা আর বরফের মাঝে আটকে পড়ে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেল কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই। তার মধ্যে বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মাটির অনেক নিচে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত আধুনিক গুহায় নেমে গেল অল্প কিছু মানুষ। পৃথিবীর উপরে আরম্ভ হয়েছে তখন বরফ ঢাকা অনন্ত রাত্রি। ধ্যানমগ্না পৃথিবী আলোর তপস্যায় মগ্ন।

মাটির তলায় আণবিক শক্তির সাহায্যে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সূর্য। শুধু আলো জোগানোর ভার তার উপর। আর পৃথিবীর উত্তপ্ত অন্তঃস্থল থেকে আহরণ করা হয় প্রাণধারণের প্রয়োজনীয় উত্তাপ। এখানকার মাটিকে উর্বরা করে তোলা হয়েছে আইসোটোপ দিয়ে। সেই মাটিতে সবরকম চাষবাস চলেছে বছরের পর বছর। শুধু তা-ই নয়, হাইড্রোপনিক বাগানেও তরিতরকারি ফলফলাদি সবকিছুই হয়। বাতাসকেও পরিশ্রুত করার বন্দোবস্ত আছে জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায়। গৃহপালিত জীবজন্তু, পশুপাখি, পোকামাকড় প্রভৃতি সব কিছু নিয়ে মাটির তলায় গড়ে উঠেছে কৃত্রিম পৃথিবী।

বেশ ভালোভাবেই কেটে গেল অনেক অনেক বছর। পৃথিবীর উপরে সেই একই অবস্থা। বরফ ক্রমেই পুরু হয়ে জমছে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বোধহয় কোথাও নেই। এক ভয়ংকর বিপদের কালো মেঘ দেখা দিল একদিন। বংশপরম্পরায় রহস্যময় এক বন্ধ্যাত্ব বিপন্ন করে তুলল ওদের অস্তিত্ব। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি, জীবজন্তু এমনকী গাছ গাছালিও এই বন্ধ্যাত্বর হাত থেকে মুক্তি পেল না। মাত্র কয়েকশো বছরের মধ্যে মানুষের সংখ্যা দাঁড়াল কয়েকশোয়। বহু চেষ্টা করার পরও কোনও বিজ্ঞানীই এর সমাধান করতে পারল না। অবশ্য বিজ্ঞানীরা অনেক ভেবে-চিন্তে বলল যে পৃথিবীর উপরে মুক্ত আকাশের আর সূর্যের আলোর মধ্যেই এতকাল কাটিয়েছে মানবজাতি৷ সেটাই ছিল স্বাভাবিক পরিবেশ। তাই মাটির তলার কৃত্রিম আলো-বাতাস আর বন্দি জীবনকে কোনওরকমেই মানিয়ে নিতে পারেনি তারা। এরই ফলস্বরূপ অবশ্যম্ভাবী অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। সকলে।

একমাত্র ড. চন্দই একটিমাত্র পথের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি যেমন উদ্ভট আর তেমন বিপদজ্জনক। অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে গেলে এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। আবার পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ না হলে এই পৃথিবী নামে গ্রহটি সমেত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে সমস্ত সৌরজগৎ।

এই তথ্যগুলোই রোমন্থন করছিল নিলয় আর তনিমা। জানালার ফ্রেমে আঁটা কালো আকাশে জ্বলছে নিবছে তারাগুলো। আর কালো সূর্যের আবির্ভাব ঘটেছে দিগন্তের পারে।

তাহলে যেতেই হবে তোমাকে? তনিমার গলার সুরে বিষাদের ছায়া।

 এখনও তুমি এ-কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমিই বলো এটাই তো আমার পবিত্র দায়িত্ব। আর… আর এত বড় সম্মান… ফিজিসিস্টদের মধ্যে আমাকে বেছে নিয়েছে ওরা, আর আমার উপরই পড়েছে এক গুরু দায়িত্ব। নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক জায়গায় রাখতে হবে বোমাগুলোকে।

কিন্তু কী প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি তুমি! যদি সফল…

কথা শেষ না করে বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকাল তনিমা। আহত পাখির মতো থর থর করে কেঁপে উঠল ও। আরও… আরও জোরে নিজের কাছে ওকে টেনে নিল নিলয়।

কিছু বলবে নিলয়! তনিমার মুখটা দু-হাতে তুলে ধরল সে। রক্তাভ দুটো ঠোঁট তখনও কাঁপছে না-জানা কোনও এক আতঙ্কে৷ বুকের মধ্যে তোলপাড় করে উঠল। কিন্তু না, দুর্বল হওয়া চলবে না। শক্ত হতেই হবে। তাই একটু হেসে বলল, তনু, তনিমা, ছি, ছি, তুমি না সায়েন্টিস্ট। আর তুমিই কিনা অবুঝ হচ্ছ। আর…।

নিলয়! নিলয়! সব জানি সব বুঝি আমি। কিন্তু আমি যে মেয়ে। তোমাকে ঘিরে যে আমার অনেক অনেক স্বপ্ন।

আবার তুমি এমন করছ? আমি তো বলছি…।

কী আর বলবে নিলয়। বলো, বলো বিপদ নেই? ভয় নেই?

একেবারে যে নেই তা বলি কেমন করে। তা ছাড়া এরকম কাজ আগে তো আর কোনওদিনই হয়নি। তবে আমাদের হিসেব যদি নির্ভুল হয় তাহলে ফিসানেবল মেটিরিয়ালগুলোর একাধিক বিস্ফোরণের সঙ্গে অর্ধেকেরও বেশি সৌরপদার্থের মধ্যে একসঙ্গে শুরু হয়ে যাবে চেইন রিঅ্যাকশন। আর তার ফলেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে সূর্য। আবার এত দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটবে যার ফলে সূর্যের কাছাকাছি সব গ্রহগুলোর জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হওয়ার ভয়ও আছে। আমরা বিশ্বাস করি যে এত দ্রুত এবং বিস্ফোরণের এই প্রচণ্ডতা একমাত্র সম্ভব হতে পারে যদি একসঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে চুর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যায় সূর্যের সমস্ত মৌলিক উপাদানগুলো।

অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সকলে। নিলয় ওর সঙ্গীদের নিয়ে অনেক আগেই ধূমকেতুর উপরে উঠে পড়েছে। আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই কারুর মুখে। ধূমকেতুর উপরই নির্ভর করছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।

কাচের জানালা দিয়ে অবজারভেটরির খোলা জানালার আলো দেখতে পেল নিলয়। আর সঙ্গে সঙ্গে আগুনের নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সূর্যের দেশে পাড়ি দিল ধূমকেতু। কল্পনায় মনে হল বিস্ফারিত কাতর দুটো চোখও ছুটে আসছে ওদের পিছু পিছু। দু-চোখ জলে ভরে উঠল ওর। চাপা ব্যথায় হৃৎপিণ্ডটা ফেটে পড়তে চাইল। বরফ ঢাকা পৃথিবীর বুকে আলো ভরা খোলা জানালা যেন জীবনের প্রতীক। হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন গ্রহনক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্যকে। শবরীর প্রতীক্ষায় ধ্যানমগ্না পৃথিবী। সফল হবে কি না কে জানে। ওরাই কি প্রমিথিউসের মতো মৃত সূর্যকে প্রজ্বলিত করে আলো নিয়ে আসবে পৃথিবীতে। অথবা ওদের এই অবাঞ্ছিত কাজে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হয়তো ক্রোধে জ্বলে উঠবে। সেই প্রজ্জ্বলিত ক্রোধের হাত থেকে মুক্তি কি পাওয়া যাবে তখন? কে জানে! এমন আরও অনেক অনেক চিন্তা এল নিলয়ের মাথায়। কিন্তু সামনে কঠিন কঠোর বাস্তব। গুরু দায়িত্ব। মুষ্টিমেয় মানবজাতির অস্তিত্ব নির্ভর করছে ওদের উপর। ভাববিলাসের সময় কোথায় এখন।

রাত নেই দিন নেই এখানে। আছে কেবল আদি অন্ত মুহূর্ত। অখণ্ড মহাকাল। আর আছে সলমা চুমকির কাজ করা কালো ভেলভেটের শাড়ির মতো কালো আকাশের বুকে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মেলা। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে ওরা। কিন্তু বাইরে তাকালে মনে হয় বুঝি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। অথবা মহাকাশের বুকে জ্বলছে ধূমকেতু। কত হাজার বছর আগে ধূমকেতু তৈরি হয়েছিল নিলয় তা ঠিক জানি না। কিন্তু এতদিন পরেও নিখুঁত সুন্দর কাজ করে চলেছে জটিল যন্ত্রগুলো। বেশির ভাগই স্বয়ংক্রিয়। মহাকাশ যাত্রায় কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও নিলয়রা রকেটের যন্ত্রপাতির কলাকৌশল, জ্যোতির্বিদ্যা এবং জটিল অংকশাস্ত্রেও কিছুদিনের মধ্যেই পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে দু-জন নেভিগেটার, একজন রকেট ইঞ্জিনিয়ার আর বাকি দু-জন ইঞ্জিনিয়ার। ধূমকেতুর মধ্যে রয়েছে এক শক্তিশালী জেনারেটার। এই জেনারেটারই এমন এক শক্তির জন্ম দেবে যা ঠিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীত কাজ করবে। আর এর সাহায্যেই ওরা প্রচণ্ড শক্তিশালী সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পরাভূত করে সূর্যের বুক থেকে যাত্রা করতে পারবে পৃথিবীর দিকে। নিলয় আর রবার্টের উপর রয়েছে এক গুরু দায়িত্ব। সূর্যের বুকে ঠিক সময়ে নেমে বোমাগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা এবং প্রয়োজনমতো সময়ে ওদের বিস্ফোরণ ঘটানোই এদের প্রধান কাজ।

ধূমকেতু ছুটছে তো ছুটছেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। খাওয়া আর বিশ্রাম ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। নিলয়ের মাঝে মাঝে মনে হয় অন্তহীন কালো গুহার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে ওরা। তারাগুলো যেন দূর প্রান্তরে মরীচিকা মাত্র। চতুর্দিকে শুধু কালো আর কালো। ভূত ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব এক বিন্দুতে বিলীন। মাঝে মাঝে বিচিত্র এক অনুভূতিতে ভরে উঠছে ওর মন।

কত সব অদ্ভুত চিন্তা আসে মাথায়। পোর্ট-হোলের মধ্যে দিয়ে ছোট-বড় তারাজ্বলা সীমাহীন মহাকাশের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে নিলয়। একটার পর একটা চিন্তা আসে, মনকে দোলা দেয়, তারপর আবার কোথায় উধাও হয় কে জানে। কিন্তু তনিমাকে কিছুতেই ভুলতে পারে না ও। ওর সমস্ত জীবনই যেন তনিমাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। দূরে দু-একটা তারা মিটমিট করে। মনে হয় ওই তো তনিমার মুখ।

কিন্তু এরকমভাবে মৌলিক উপাদানগুলোকে চূর্ণ বিচূর্ণ করতে হলে প্রতিটি মৌলিক পদার্থের পরমাণুর সংযুতির জন্যে পৃথক পৃথক স্টার্টার দরকার। বিজ্ঞানের এত উন্নতি স্বত্ত্বেও কিন্তু সমস্ত মৌলিক পদার্থগুলোকে ব্রেকডাউন বা ভাঙতে পারা যায়নি। আর তা যদি যেত তাহলে অতীতের যে কোনও আণবিক যুদ্ধে পৃথিবী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত।

নির্বাক তনিমা। নিলয়ের এ রূপ আর কোনওদিনও দেখেনি ও। নিলয়ের দৃষ্টি খোলা জানালা পথে কোন সূর্যের দেশে চলে গেছে কে জানে। উত্তেজনায় মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে ও। কয়েক মুহূর্ত বাদে আবার বলতে শুরু করল নিলয়।

উঃ, আমাদের পূর্বপুরুষরা কি কল্পনা করতে পারত যে তাদেরই সৃষ্ট মারাত্মক আণবিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এক মহাজাগতিক পুনর্জন্মের কাজে লাগবে। স্পেসশিপ থেকে শুরু করে সমস্ত রকম বোমাই আছে এখানে। আর তারই মধ্যে অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি ম্যাগনেট লাগানো ফোটন রকেট ধূমকেতু চড়ে যাত্রা করব আমরা পাঁচ জন সূর্যের দেশে।

নিলয়ের কথা বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে গেল তনিমা। অনেক উপরে উঠে পড়েছে বগিথালার মতো কালো সূর্য। জ্বলজ্বলে তারাদের জগতে কালো সূর্য যেন এক মূর্তিমান বিভীষিকা। বৃশ্চিক নক্ষত্রকে ঢাকা দিয়ে ক্রমেই উপরে উঠছে ও। অন্ধ সূর্যের ঠিক মাঝখানে আবছা আগুনের আভা। ঠিক যেন সিন্ধবাদ নাবিকের গল্পের সেই একচক্ষু দৈত্য… মৃত সূর্যের বুকে এখনও অগ্নিভ্রমণ করে চলে কোনও এক আগ্নেয়গিরি। সূর্যের দিকে তাকালেই একটা উপমার কথা মনে পড়ে যায় তনিমার। মনে হয় যেন নিজের বুকের লাল রক্ত ঝরিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে সদ্যমৃত সূর্য। না, না, তনিমার কাছে এটা আর কল্পনা নয়। সত্যি তো নিলয়রাই বুঝি ছুটে চলেছে সাহায্য করতে।

তারপর তনু, এইখানে দাঁড়িয়ে এক নতুন সূর্যোদয় দেখবে তুমি। ধীরে ধীরে বরফ গলে জলের ঢল নামবে। আবার তৈরি হবে বইতে পড়া সেই সব নদ-নদী, সাগর, আরও কত কী। সূর্যের আলো রামধনু রঙে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। আলো আর বাতাসে ভরে উঠবে পৃথিবী। মাটির বুক ফুঁড়ে উঠবে প্রাণের স্পন্দন। সবুজ ঘাসে ছেয়ে যাবে চারদিক। আবার পাখি ডাকবে, ফুল ফুটবে, সকাল হবে, সন্ধ্যা হবে। আর আর গুহাবাসী মানুষ আবার ফিরে পাবে ওদের পুরোনো পৃথিবীকে। বলো বলো, ভালো লাগছে না ভাবতে! ভালো লাগছে না সেই পৃথিবীতে ফিরে যেতে!

উঃ কী সুন্দর! ঠিক যেন স্বপ্নের মতো। কিন্তু নিলয় তুমি তো আসবে আমার কাছে। স্বপ্নের মতো কথা বলে উঠল তনিমা।

তনিমাকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল নিলয়। তারপর ওর মুখে চুমু দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, হ্যাঁ তনু, কথা দিলাম ঠিক ফিরে আসব তোমার কাছে সূর্যালোকের পথ বেয়ে।

হিমালয়ের বিশাল এক গুহায় ফোটন রকেট ধূমকেতুর যাত্রার জন্যে গুহার উপরে প্রায় মাইলখানেক পুরু পাথর ফাটিয়ে বিরাট গোলাকার করা হয়েছে। আর তার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ধূমকেতু। চোখদুটো যেন কৌতুকে মিট মিট করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তনিমাকেই খুঁজে বেড়ায় তনিমা-পিয়াসী ওর চোখ। স্থান-কাল সব কিছুই যেন গোলমাল হয়ে যায় মাঝে মাঝে। একমাত্র রবার্টই জানে ওর বল্গাহীন কল্পনার কথা। কী বলবে ও, বলার কিছুই যে নেই। মনের উপর তো কারুর হাত নেই। মনের কথা বন্ধ করলেও তনিমার আসা যাওয়াকে ঠেকাতে পারে না নিলয়। আর ভাবনা… কয়েকশো রকমের প্রলয়ংকরী আণবিক বোমা রয়েছে এই রকেটে–আয়রন, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, হিলিয়াম, হাইড্রোজেন, স্টোনসিয়াম, সিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, কপার, বেরিয়াম, জিঙ্ক প্রভৃতি মারাত্মক বোমা। নিলয়ের পূর্বপুরুষরাই তৈরি করেছিল ওই সব মারাত্মক বোমাগুলো। কিন্তু ব্যবহার করার আগেই অনন্ত রাত্রি নেমে এসেছিল পৃথিবীর বুকে।

সূর্যের বুকে যেখানে যে ধাতু আছে ঠিক সেখানে সেই বোমা ফাটাবে বলে ঠিক করল নিলয়। কোথায় কতদূরে কত ধাতু আছে তা জানা যাবে বিশেষ রাডারের সাহায্যে। শুধু বোমা রাখলেই হবে না, যাতে সেগুলো একসঙ্গে ফাটে সেজন্য ফিউজগুলো বিশেষভাবে বাঁধতেও হবে নিলয়দের। যদি ঠিক ঠিক কাজ হয় তাহলে ধূমকেতু সূর্য থেকে নিরাপদ দূরত্বে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাবে সূর্যের বুকে। আর তার ফলেই দাউ দাউ করে আবার জ্বলে উঠবে সূর্য। ধূমকেতুও নিরাপদে ফিরে আসবে পৃথিবীর বুকে।

সূর্যের উপরের আগুন নিভে গেলেও সূর্যের ভেতর এখনও টগবগ করে ফুটছে। তারই প্রমাণ দিচ্ছে ওই আগ্নেয়গিরি। দূরবিন দিয়ে দেখলে অবশ্য ছোট ছোট অসংখ্য আগ্নেয়গিরি চোখে পড়ে। ক্রমেই সূর্যের দিকে এগিয়ে চলেছে ধূমকেতু। পৃথিবী থেকে দেখা আগ্নেয়গিরির সামান্য আলোকশিখাই লেলিহান হয়ে দেখা যাচ্ছে এখন। সূর্যের বুকে অগ্নিকুণ্ডের উপর ভাসছে ধূমকেতু। এক বিশাল রাক্ষসী যেন হাঁ করে গিলতে আসছে ওদের। আরও আরও নিচে নাবছে ওরা।

এবার অনেকগুলো অ্যান্টি গ্রাভিটি সুইচ বোর্ডের নব ঘোরাতে শুরু করল সুজন আর ওয়াংচু। ইন্ডাকশান কয়েল-সুষ্ঠু বিশাল জেনারেটার সচল হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল পৃথিবীর বহুগুণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সমান বিপরীত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। অতীতে এরই মাধ্যমে মানুষ জয় করেছিল বৃহস্পতির প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে। ধূমকেতুর ইনস্যুলেশন ও রেফ্রিজারেশন খুব ভালো কাজ করছে। সূর্যের এত কাছে এসেও কিছুই বুঝতে পারছে না ওরা।

হঠাৎ একটা মৃদু আওয়াজ উঠল ম্যাগনেটগুলোর মধ্য থেকে। থেকে থেকে কাঁপতে লাগল সমস্ত রকেটটা। জেনারেটারে লাগানো বড় বড় ডায়ালের ভুতুড়ে হাতগুলো ক্রমেই ডান দিকে সরতে আরম্ভ করল। এই জেনারেটারের উৎপন্ন বিপরীত মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর পনেরো গুণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সমান এখন। আরও আরও কাঁটা সরে যাচ্ছে, ১৬… ১৭… ১৮… ব্যাস। কাঁটা এখন স্থির। শুধু ১৮-র উপর দাঁড়িয়ে কাঁপছে থর থর করে। এই প্রচণ্ড মাধ্যকর্ষণের চাপে নিলয় দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল।

ধূমকেতুর নিম্নগতি কিছু কমল বটে কিন্তু একেবারে বন্ধ হল না। আবার একবার ঘোরাতে চেষ্টা করল নবগুলো। না, আর ঘোরানো যায় না। এখনও ঝড়ের বেগে সূর্য টানছে ধূমকেতুকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল সুজনের কপালে। আপন মনেই বলে উঠল সে–নিশ্চয়ই কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। মনে হয় কয়েলের উপর জড়ানো বিচিত্র ওই অ্যালয়টাই বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। অবশ্য এলিমেন্টগুলোও খারাপ হতে পারে। অথবা সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ হয়তো আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। তার ফলেই সুতো কাটা ঘুড়ির মতো টেনে নাবাচ্ছে ধূমকেতুকে।

ঠিক বলছ তুমি। সমস্ত রেট্রো রকেটগুলো চালালেও ১৯-এর বেশি অ্যান্টি গ্রাভিটি পাওয়া সম্ভব হবে না। অনেক ভেবেচিন্তে বলল ওয়াংচু।

আর কতক্ষণ সময় পাওয়া যাবে বলতে পার? খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করল নিলয়।

খাতা পেন্সিল নিয়ে কীসের হিসেব করল নেভিগেটর রমন। তারপর বলল, সমস্ত রেট্রো রকেট চালিয়েও দু-ঘণ্টার বেশি সময় পাওয়া যাবে না নিলয়। আর তার পরেই সূর্যের বুকে আছড়ে পড়বে ধূমকেতু।

মুহূর্তের মধ্যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। পরপর কয়েকটা লিভার টেনে দিল জেট ইঞ্জিনিয়ার পেড্রো। ধূমকেতুর সামনে আর দু-পাশের সমস্ত রেট্রো রকেটগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠল। আগুনের ফুলঝুরির মধ্যে ভাসতে লাগল ফোটন রকেট ধূমকেতু। এর ফলে আরও কিছু কমল নিম্ন গতিবেগ। তবুও সূর্যের টানকে অস্বীকার করবে কে?

ধীর পায়ে বোমা রাখার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল নিলয়। সঙ্গে গেল রবার্ট, ওয়াংচু আর সুজন। ঘরে ফেরা এখন শুধু স্বপ্ন। বাস্তব শুধুই মহাকাশের বুকে খসে পড়ার অপেক্ষায় কয়েক মুহূর্ত। ভয়, ভাবনা, কামনা, বাসনা–সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছে ওরা।

এখনও অনেক কাজ বাকি। প্রতিটি বোমায় লাগানো আছে একটা করে মিটার আর কয়েকটা বড় বড় নব। ঘরের শেষ প্রান্তের দেওয়ালে ঝুলছে মস্ত এক ক্রোনোমিটার। এই ক্রোনোমিটারের সাহায্যেই বোমার ফিউজগুলো সূক্ষ্মভাবে বাঁধছে ওরা। সূর্যের বুকে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমাগুলো ফাটবে একসঙ্গে। আর শুরু হবে সূর্যের সমস্ত এলিমেন্টের মধ্যে অবিস্মরণীয় চেইন রিঅ্যাকশান।

সূর্যের দিকে তাকানো যায় না। কেমন ভয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে দেহ-মন। ক্রমেই বিশাল হয়ে উঠছে সূর্য। এবড়ো-খেবড়ো উঁচু-নিচু আগুনে ভরা জিম দেখা যাচ্ছে। যতদূর তাকাও লাল আর লাল। ধিক ধিক করে জ্বলছে সূর্য। মাঝে মাঝে ড্রাগনের নিঃশ্বাসের মতো আগুনের ফোয়ারা বেরুচ্ছে আগ্নেয়গিরি থেকে। আরও আরও বড় হয়ে উঠছে আগুন মাখানো বিশাল বিশাল পাহাড়গুলো। হিমালয় তো এর কাছে শিশু। ছোট বড় অসংখ্য আগুনের স্তূপে সূর্য গেছে ঢাকা পড়ে। ঠিক মাঝখানে ভয়ংকরভাবে জ্বলছে পৃথিবী থেকে দেখা সেই আগ্নেয়গিরিটা। জোতির্বিদরা যার আদর করে নাম রেখেছে হেপেস্টাস। সেই উঁচু টাওয়ারের উপর থেকে একেই দেখছিল নিলয় আর তনিমা। কথাটা মনে পড়তেই চক্ষের নিমেষে ভেসে উঠল তনিমার মুখ। ওর প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনাও মনে পড়েছে এখন। অনেক অনেক নিচে নেমে পড়েছে ধূমকেতু। কয়েকশো মাইল লম্বা লম্বা আগুনে জিভ বাড়িয়ে ধুমকেতুকে ধরবার চেষ্টা করছে হেপেস্টাস।

.

সব কাজ শেষ। এখন শুধু মুহূর্ত গোনা, আর অপেক্ষা করা, আর অপেক্ষা করা… আর… মুহূর্ত এখন অন্তহীন। টিক টিক করে চলে ক্রোনোমিটার। শেষ রেডিয়ো মেসেজ পাঠানো হয়েছে পৃথিবীতে। হ্যালো, হ্যালো পৃথিবী.. বেশ কিছুক্ষণ আগে নিলয় বলছিল শেষ কথাগুলো। হ্যালো… হ্যালো পৃথিবী.. ফেরার পথ নেই। সূর্যের প্রেমে বাঁধা পড়েছে ধূমকেতু। তবে আমাদের কর্তব্য আমরা করে যাব। সূর্যের ঘুম ভাঙাবই আমরা। বিদায়, পৃথিবী বিদায়। শুধু মনে রেখো ধূমকেতুর সামান্য কয়েকজন ভাগ্যবান যাত্রীকে, যারা পৃথিবীর জন্যে ছুটে গিয়েছিল সূর্যের বুকে। বিদায়… বিদায়…!

আরও বিশাল আর ভয়ংকর লেলিহান শিখায় গর্জে উঠছে হেপেস্টাসের আগুনে জিভ। হাজার মন গলিত ধাতু শত শত মাইল লাফিয়ে উঠছে মহাশূন্যের বুকে।

নেভিগেটারের কাজ শেষ। ধূমকেতুর সামান্য একটু গতি পরিবর্তন হল। এবারে ঠিক হেপেস্টাসের বুকের মধ্যে আছড়ে পড়বে ওরা। মুহূর্তের মধ্যে ঘটবে অকল্পনীয় বিস্ফোরণ তারপরেই ঘুমন্ত সূর্যের ঘুম ভাঙবে। সত্যি কি ঘুম ভাঙবে?

তনিমা… তনিমা… তনিমা… নিলয়ের দেহই পড়ে রইল ধূমকেতুর মধ্যে। লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে তনিমার কাছে চলে গেল ওর মন। চারপাশে এখন আগুনের সমুদ্র। অসংখ্য সীমাহীন ঢেউ উঠছে আর পড়ছে। বোধশক্তি লোপ পেল নিলয়ের। ঠোঁট দুটো শুধু বিড় বিড় করছে, তনিমা–বলো বলো তুমি আমাকে ভুলবে না কোনওদিনও–তুমি যে আমার তনিমা–আমার আমার আমার

.

টাওয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে তনিমা। পুবের আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খোলা জানালা দিয়ে। গৃহবাসী সমস্ত মানুষ বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে প্রচণ্ড ঠান্ডাকে অস্বীকার করে। ওই তো, ওই তো রক্তাভ আলোকছটার স্পর্শ লেগেছে সীমান্ত পারে। রামধনু রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে চতুর্দিক। বরফ ঢাকা পৃথিবী শতসূর্য হয়ে ঝলসে উঠল ওদের সামনে। ফোঁটায় ফোঁটায় বরফ গলছে। অবসান ঘটেছে মহারাত্রির কালরাত্রির।

নির্বাক নিঃস্পন্দ তনিমা। আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে সূর্য। সূর্য তপস্যা সফল হয়েছে পৃথিবীর। কিন্তু নিলয়–কোথায় নিলয়–আর কোনওদিনই নিলয় আসবে না ওর কাছে। ডাকবে না তনু বলে–

শত শত বর্ষের পর নতুন সূর্যের আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে সর্বাঙ্গে। ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরে পড়ছে গাল বেয়ে। কানের কাছে বাজছে, তনু ঠিক ফিরে আসব আমি –সূর্যালোকের পথ বেয়ে। নরম কোমল আলোয় ওর সর্বাঙ্গ ভরে উঠেছে। ঠিক যেন নিলয়ের মতো জড়িয়ে ধরেছে ওকে। উত্তাপ জুড়িয়ে দিচ্ছে মনপ্রাণ। নিলয়ের স্পর্শ লেগে আছে ওই আলোয়। দু-হাতে সূর্যের আলোকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল তনিমা।

[প্রথম প্রকাশ: বিস্ময় সায়েন্স ফিকশন, জুন-জুলাই ১৯৭২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *