শেষ চিৎকার – ২১

একুশ

অনড় দাঁড়িয়ে আছে মুসা। মূর্তির মত স্থির।

ফুটন্ত আলকাতরায় বুদ্বুদ উঠছে। এছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

মুসার মনে হচ্ছে সারাজীবন ধরে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যেই যেন পৃথিবীতে এসেছে ও।

সময় নড়ছে না।

থমকে গেছে।

সময়ের কাঁটা মহাকালের অদৃশ্য কোনও দেয়ালে ঠেকে গেছে,

নড়ছে না।

মদিনা অবাক হয়ে মুসার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

ডক্টর সায়েম মোর্শেদ তাকিয়ে আছেন।

কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া হাশমিও তাকিয়ে আছে।

দু’চোখ একটু একটু করে বিস্ফারিত হয়ে উঠছে তার। আহাম্মকের মত মশাল উঁচু করে জিনিসটা দেখছে সে। চরম বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়েছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে সে।

হঠাৎ গলার স্বর চড়ে গেল, যুবক দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল। তার কথা কেউ বুঝল না। হয়তো প্রাচীন মিশরীয় ভাষা।

পরমুহূর্তে এক পা পিছিয়ে গেল সে। তীব্র আতঙ্কে দু’চোখ কপালে উঠে গেছে। থরথর করে কাঁপছে।

প্রায় একই সময়ে হাশমির পেছনের দেয়ালে একটা নড়াচড়া দেখা গেল।

কী যেন নড়ছে। মানুষের মত দেখতে।

মদিনাও দেখল।ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

মামা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছেন।

দেখছে মুসা ও মদিনা।

পেছনে ঘটছে বলে মামুন হাশমি দেখতে পেল না।

পিছনের দেয়ালে একটা মমি ধীরে ধীরে সোজা হলো। আরেকটা শোয়া থেকে উঠে বসল। নড়ার ফলে ওদের হাড়ে কট্‌ট্ আওয়াজ উঠছে।

‘না!’ অস্ফুটে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ওদিকে মামা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। মমিরা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠেছে!

মদিনা চোখ বুজে ফেলল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে। ওর মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে।

ঘরের প্রতিটা মমি জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। চারদিকে তাদের নড়াচড়ার কট্‌ট্ আওয়াজ! আলকাতরার বাজে গন্ধ সুপ্রাচীন গন্ধে চাপা পড়ল।

আবছা আলো-আঁধারি। আতঙ্কিত মুসা দেখতে পেল, মমিগুলো এগিয়ে আসছে। প্রতি পদক্ষেপে চাপা গোঙানি ছাড়ছে ওরা, যেন হাঁটতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে।

কফিনে শোয়া মমিগুলো বেরিয়ে এল। সোজা হলো। শূন্য অক্ষিকোটর মেলে ওদের দিকে তাকাল।

তারপর পা বাড়াল।

বাইশ

মমিগুলো প্রতিবার পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাদের ব্যাণ্ডেজ থেকে ধুলো উড়ছে। হাড়ের সংযোগ মট্‌ট্ আওয়াজ তুলছে।

মৃতরা আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিয়েছে।

এগিয়ে আসছে।

খটর-মটর! খট খটর!!

হাশমি সবার চোখে বিস্ময় আর আতঙ্ক দেখেছে, এবার হাড়ের আওয়াজ শুনে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরল সে।

সঙ্গে সঙ্গে জায়গায় জমে গেল। ভয়াবহ চিৎকার দিল। একদম সামনের মমিটা দু’হাত বাড়িয়ে আসছে! হাশমি হাতের মশাল গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল। মমির বুকে লাগল।

মশালটা আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে মেঝেতে পড়ল।

ততক্ষণে মমির ব্যাণ্ডেজে আগুন ধরে গেছে। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে গেল। পেট-বুক, বাহু, সবখানে আগুন ধরে গেল।

কিন্তু থামল না মমি।

এগিয়ে আসছে।

মামুন হাশমি দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলছে, অনবরত মুখ দিয়ে খই ফোটাচ্ছে। হয়তো মন্ত্র পড়ছে ও। মমি ঠেকাবার চেষ্টা করছে।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।

মমিগুলো থামল না।

হাশমি এবার বিপদ টের পেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে পালাতে গেল। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। জ্বলন্ত মমিটা পৌঁছে গেছে। ওটা হাড়ের বাহু বাড়িয়ে হাশমির গলা চেপে ধরল। এবার তাকে টান মেরে শূন্যে তুলে ফেলল।

মুসা অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখছে। ওদিকে মামা হাঁ করে দেখছেন। মদিনা বাবার কাঁধে মুখ লুকিয়ে রেখেছে।

তীব্র ভয়ে চিৎকার করছে হাশমি, মরিয়া হয়ে মমির হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে যুদ্ধ করছে। কিন্তু কাজ হলো না। প্রথমটার সঙ্গে আরও কয়েকটা মমি এসে হাত লাগিয়েছে। সবক’টা মিলে হাশমিকে মাথার ওপর দোলাচ্ছে।

তারপর…

মমিগুলো হাশমিকে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিল। ফুটন্ত পিটের দিকে। উড়ন্ত হাশমি প্রলম্বিত আর্ত চিৎকার ছাড়ল—জীবনের শেষ চিৎকার।

পরক্ষণে সে ধপাৎ করে পিটের মধ্যে পড়ল। পলকে দাউদাউ করে মশালের মত জ্বলে উঠল।

একেবারে শেষমুহূর্তে যুবকের মুখে যে বিস্ময়-অবিশ্বাস, আতঙ্ক আর মৃত্যুভীতি দেখল মুসা, সে দৃশ্য জীবনে ভুলবে না। চোখ বুজে ফেলল ও। ভাবছে, এবার মমিগুলো ওদের ধরে…

কতক্ষণ পর মনে নেই, কানের কাছে মামা গলা শুনল ও, হাত নামাও, মুসা।’

তা-ই করল ও, তবে চোখ খুলল না।

একটু পর আবার বললেন তিনি, ‘চোখ খোলো।’

তাকাল ও। আশপাশে কোনও মমি নেই। অবাক হলো। দেখল ওগুলো আগের জায়গায় ফিরে গেছে।

‘তুমি সামোনার নামানো মাত্র জায়গায় ফিরে গেছে,’ ওকে ডানে- বাঁয়ে তাকাতে দেখে মামা বললেন, ‘আর কোনও ভয় নেই। আমরা এখন নিরাপদ।’

পিটের দিকে তাকালেন তিনি। হাশমি ফুটন্ত আলকাতরার পুকুরে তলিয়ে গেছে।

‘ছেলেটা লেখাপড়া করত,’ সায়েম মোর্শেদ বিষণ্ন চেহারায় মাথা দোলালেন, ‘কী দুঃখজনক!’

মুসার সামোনারটা নিলেন মামা। ওটার দিকে কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর ফিরিয়ে দিলেন। ‘আশ্চর্য!’ বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই শোনালেন।

.

‘উন্নত বিজ্ঞানের যুগে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটে ভেবে অবাক লাগছে, ডক্টর সায়েম মোর্শেদ আনমনে বললেন। ‘কী আশ্চর্য!’

নিজের ড্রইং রুমে বসে আছেন তিনি মুসা ও মদিনাকে নিয়ে। সন্ধের আঁধার তখন কায়রোকে গ্রাস করছে। মামুন হাশমির পরিণতির কথা ভেবে সবার মন খারাপ।

‘সত্যি,’ মৃদু কণ্ঠে সায় দিল মদিনা।

মুসা কিছু বলল না। মমির হাতটা মুঠোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আনমনা। কয়েক ঘণ্টা আগে যা ঘটেছে তা ভাবছে ও।

‘পরেরবার ওটা বুঝেশুনে ব্যবহার করতে হবে,’ বললেন মামা। ‘মুসা, তুমি যদি তখন চোখ বুজে না থেকে দৃশ্যটা দেখতে, সময়মত হাত নামিয়ে নিতে। তা হলে হয়তো হাশমি বাঁচত।’

‘ওরকম ঘটবে বুঝতে পারিনি আমি,’ মুসা বলল।

‘জানি,’ ভাগ্নের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। ‘ওরকম ঘটবে, তা আমিও বুঝিনি।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘বুঝলে তোমার হাত নামিয়ে দিতাম, হয়তো মমিগুলো থেমে যেত। হাশমি প্রাণে বেঁচে যেত।’

‘তাতেও বিশেষ লাভ হত না, মামা।’

‘কেন?’

‘ও ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। মমি জীবন্ত হয়েছে দেখে এমন ভয় পেয়েছিল, যদি বেঁচে থাকত, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেত।’

ভুরু কোঁচকালেন মামা। ‘তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছ, মুসা।’ মাথা দোলালেন তিনি। ‘তবু একটা জীবন!’

সামোনারটা নিল মদিনা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। ‘এটা না থাকলে আজ আমরা সবাই মরতাম,’ বলল ও বিড়বিড় করে।

কেউ কোনও মন্তব্য করল না।

কাছেই মসজিদ, আযানের সুরেলা ধ্বনি ভেসে এল।

***