শেষ চিৎকার – ১

এক

চুপ করে পিরামিডের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। তার মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় সমান উঁচু পিরামিড। শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে সব। চারদিকে এত শুকনো দেখে মুসার গলাও শুকিয়ে উঠল।

ঘুরে বাবা-মাকে দেখল ও। মা পিরামিডের একটার পর একটা ছবি তুলছেন। পাশে বাবা কোমরে দুই হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। মা’র ছবি তোলা আর পিরামিড, দু’দিকেই তাঁর নজর।

‘মা!’ ডাকল মুসা। ‘খুব তেষ্টা পেয়েছে।’

‘দাঁড়াও। একটু পর কোক খেয়ে নেব সবাই।’

‘হ্যাঁ,’ বাবা মাথা ঝাঁকালেন। ‘গলা শুকিয়ে গেছে আমারও। বাপরে, রোদের কী তেজ!’

একটু দূরে একটা খোলা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইল রেস্টুরেন্ট। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ওটাকে প্রায় ঘিরে আছে। গল্প করছে তারা, গলা ভেজাচ্ছে, খাচ্ছে। আর কিছু না থাক্, কোকের ক্যান একটা আছেই সবার হাতে। যা গরম, বেশিক্ষণ ঠাণ্ডা পানীয় ছাড়া টেকাই মুশকিল।

সবার হাতে ঠাণ্ডা পানীয় দেখে ঢোক গিলল মুসা। চারদিকে এত মানুষ, দেখে মনে হয় এবার দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ পিরামিড দেখতে এসেছে। খাইছে! মা’র ‘একটু পর’ শেষ হওয়ার আগেই ভ্যানের সব কোক সাবাড় করে দেবে সবাই!

‘তোমরা না হয় পরে খেয়ো, মা। আমি একটা খেয়ে আসি। গলা একদম শুকিয়ে কাঠ।

জবাব এল না। মা ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। বাবাকে দেখে মনে হয় পিরামিড দেখছেন, কিন্তু আনমনা। নিশ্চয়ই ফটোগ্রাফির চিন্তায় ডুবে আছেন, ভাবল মুসা। বাবাকে নিয়ে এই হচ্ছে এক মুশকিল। উঠতে- বসতে, খেতে-শুতে, এমন কী বেড়াতে বেরিয়েও কাজ নিয়ে থাকেন।

পিঠে গুঁতো খেয়ে ঘুরে তাকাল ও। ইয়া মোটা এক কালো মহিলা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হ্যাণ্ডব্যাগের ঘষা লাগিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় মুসাকে কী যেন বললেন তিনি। কিছুই বুঝল না ও।

দূর! ভাল্লাগছে না! ভাবল ও। মদিনা থাকলে ভাল হতো।

মদিনা ওর দূর-সম্পর্কের মামাতো বোন। প্রায়ই ই-মেইলের মাধ্যমে কথা হয় ওর সঙ্গে। এখানকার এক আবাসিক স্কুলে পড়ে ও। কাল ওর স্কুল ছুটি হবে। মদিনা কথা দিয়েছে, বাসায় ফিরে সঙ্গ দেবে ওকে।

আরেকবার ঘুরে ভ্যানটা দেখল মুসা। ‘কই, মা! হলো তোমার ছবি তোলা?’

‘এই পিরামিড কত একর জমির ওপর তৈরি, জানো তুমি?’ ঘুরে ওকে প্রশ্ন করলেন বাবা। ‘তেরো একর। বানিয়েছে লাইমস্টোন দিয়ে। ইতিহাসে আছে, এসব পাথরখণ্ডের কোনও কোনওটার ওজন হাজার টনেরও বেশি।’ ওর কাঁধে এক হাত রাখলেন তিনি। ‘বলো দেখি, প্রাচীন মিশরীয়রা এসব প্রকাণ্ড পাথর অত উঁচুতে তুলল কী করে?’

মুসা জবাব দিল, ‘কেউ জানে না সে-রহস্য।

আবারও আনমনা হয়ে গেলেন বাবা। ‘কী অদ্ভুত, না? মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছে! অথচ দেখো, আমাদের পূর্ব পুরুষরা এত বড় বড় পাথর কী করে ওপরে তুলল, তা কেউ এখনও জানতে পারল না। যারা এগুলো তৈরি করেছে, বা করিয়েছে, তাদের কথা ভাবো। হাজার হাজার বছর আগে তাদের কোলাহলে মুখর ছিল এই এলাকা।’

কয়েক মুহূর্তের জন্যে পানীয়ের কথা ভুলে গেল মুসা। হাত দিয়ে সূর্য আড়াল করে তাকিয়ে থাকল পিরামিডের দিকে। ‘মামা যেখানে কাজ করছেন, সেখানে আজ আমরা যাচ্ছি, না বাবা?’

‘না, আজ না। আজ তোমার মামা খুব ব্যস্ত, নতুন খোঁড়া কবরে পৌঁছানোর রাস্তা পরিষ্কার করছে। হয়তো আলেকজান্দ্রিয়া যাবার আগেই ওখানে যাওয়া যাবে।’

বেড়াতে এসেও কাজ ভোলেননি বাবা। লস অ্যাঞ্জেলেস ছাড়ার সময় কাজ জুটিয়ে এনেছেন। তিনি মাকে নিয়ে দু’একদিনের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ায় যাবেন। তখন মদিনা আর মামার সঙ্গে মজা করে নতুন সমাধি ক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াবে ও।

‘কবরটা কার, বাবা?’

‘সম্রাট কুফুর, খুব সম্ভব।’

‘ফারাও সম্রাট?’

‘হ্যাঁ।’

সমাধি ক্ষেত্রে ঢোকার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠল মুসার। ওকে ভিতরের অদ্ভুত অন্ধকার জগৎ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রহস্যময় এক জগৎ, যেখানে প্রাচীন বাতাস চার হাজার বছর ধরে স্তব্ধ হয়ে আছে। যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী কফিন-বন্দি হয়ে শুয়ে আছে অনড় মমি- ওখানে সম্রাট, সম্রাজ্ঞী আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা ঘুমাচ্ছে।

ভিতরে ঢোকার সুযোগ কখন আসবে, সেই ভাবনায় মুসা অধীর।

দুই

দুপুরের কড়া রোদ অসহ্য হয়ে ওঠায় ট্যাক্সি নিয়ে মামার কায়রোর বাড়িতে ফিরে এল ওরা। বেশ বড় বাড়ি, কিন্তু ফাঁকা। মিশরীয় একজন বাবুর্চি ছাড়া কেউ নেই। তিনদিন হলো এসেছে ওরা, এরমধ্যে মুসা মাত্র দু’বার দেখা পেয়েছে মামার।

একবার ওদের রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন ডক্টর সায়েম মোর্শেদ, আর কাল রাতে একবার এসেছেন। ভাগ্নের সময় কেমন কাটছে জানতে এসেছিলেন। বলে গেছেন, কাল-পরশুর মধ্যে হাতের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখন ওদের সময় দিতে পারবেন।

এরমধ্যে, আজ যদি না-ও হয়, মদিনা কাল সকালে এসে পড়বে। ও এলে বাঁচে মুসা। গল্প করা যাবে, একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো যাবে।

আসার পথে গাড়িতে একটা ঠাণ্ডা কোক খেয়েছে ও, কিন্তু একটুও কাজ হয়নি তাতে। তাই বাসায় ফিরেই ফ্রিজ খুলে আরেকটা ক্যান নিয়ে বসল মুসা। একটু পরে গোসল শেষে মিশরীয় বাবুর্চির রান্না খেল পেট পুরে। দারুণ রাঁধে লোকটা।

বাবা-মা পঞ্চমুখে তার রান্নার প্রশংসা করে বিশ্রাম নিতে গেলেন। একদম একা হয়ে গেল মুসা। শুয়ে খানিক গড়াগড়ি করল ও, কিন্তু ঘুম এল না। সময় কাটতেই চায় না। কী করা যায়? ড্রইং রুমে এসে টিভি খুলল। এখানেও আরেক মুশকিল। সবগুলো চ্যানেলে আরবি অনুষ্ঠান, তা-ও আবার আলোচনা অনুষ্ঠান। কী যে বলে, একটা অক্ষরও বোঝে না মুসা।

টিভি অফ করে সোফার ওপর শুয়ে পড়ল ও। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, কে জানে, কাউকে নিজের নাম ধরে ডাকতে শুনে চোখ মেলল। বাবাকে মুখের ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখা গেল। ‘কী হয়েছে, বাবা?’

‘ওঠো!’ বলতে বলতে ওর পাশে বসলেন তিনি। ‘আমাদের দু’দিন পর আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু…’ থেমে গেলেন কথা শেষ না করে।

‘কিন্তু কী, বাবা?’ চোখ রগড়ে বলল ও।

‘আজই যেতে হচ্ছে আমাদের।’

‘কেন?’

‘ওখানকার পার্টি প্রোগ্রাম এগিয়ে এনেছে।

‘কখন যেতে হবে?

‘একঘণ্টার মধ্যে এয়ারপোর্ট রওনা হতে হবে,’ মুসাকে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন তিনি। ‘তোমার মামাকে ফোন করে খবর জানিয়ে দিয়েছি, ও বলেছে সন্ধের আগেই বাসায় ফিরবে।’

‘তা-ই নাকি?’

মাথা দোলালেন বাবা। ‘ওর কাজও আগেভাগেই শেষ হয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, মদিনাও আসছে।’

‘অ্যাঁ?’ প্রায় লাফিয়ে উঠল মুসা। ‘কখন?’

‘যে-কোনও সময় এসে পড়বে।’

‘গুড!’

‘তুমি ভয় পাবে না তো?’

‘কেন?’ অবাক হলো মুসা।

‘বলছি, আমরা যদি গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়ি, তুমি একা একা বাসায় থাকতে পারবে?

‘হ্যাঁ। দিনের বেলা ভয় কীসের?’

‘গুড!’ ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন বাবা। ‘এ-ই তো চাই। অবশ্য রাতেও ভয়ের কিছু নেই। বাবুর্চি লোকটা বাজারে গেছে, এখনই ফিরবে।’

‘আমি ভয় পাব না, বাবা,’ জোর দিয়ে বলল মুসা। ‘তোমরা তৈরি হয়ে নাও।’

‘হ্যাঁ, যাচ্ছি।’

‘মামা-মদিনা সন্ধের আগেই….

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ ওকে থামিয়ে দিলেন বাবা। ‘এই তো এসে পড়ল বলে।’

‘তোমরা কবে ফিরবে?’ জানতে চাইল মুসা।

‘পরশু, কী তার পরদিন।

মা এসে ঢুকলেন রুমে। ‘তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে, মুসা?’

‘না। তোমরা যাও, মা।’

‘মন খারাপ করবে না তো আবার?’

‘নাহ্!’ দ্রুত মাথা ঝাঁকাল ও। ‘মন খারাপ করব কেন? মামা আর মদিনা তো আসছেই।’

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন বাবা-মা। গোছগাছ করে বেরিয়ে পড়লেন একটু পর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ওঁদের বিদায় জানাল মুসা। বাঁক ঘুরে চোখের আড়ালে চলে গেল ট্যাক্সি।

ড্রইং রুমে এসে বসল মুসা। খাঁ-খাঁ করছে বাড়ি। ভাষা বুঝুক আর না-ই বুঝুক, সময় কাটাবার জন্য টিভি খুলে বসে পড়ল। এ-ছাড়া এ- মুহূর্তে আর কিছু করার নেই ওর।

একদম নীরব হয়ে গেছে বাড়ি। বাবুর্চি লোকটা কখন আসবে? বাইরের আলোয় টান পড়েছে। সন্ধে হতে বেশি দেরি নেই। ফ্রিজ খুলে একটা কোক বের করে টিভিতে মন দেয়ার চেষ্টা করল মুসা।

হলো না। একটু একটু করে আঁধার জেঁকে বসছে। উঠে ঘরের আলো জ্বেলে দিল মুসা। কখন আসবেন মামা? জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল ও। সূর্য ডুবে গেছে। আলোর রেশ একটু আছে এখনও, তবে কিছুক্ষণ পর আর থাকবে না।

আমি কী ভয় পাচ্ছি? নিজেকে প্রশ্ন করল মুসা। নাহ্, কেন ভয় পাব? ভয় পাওয়ার কী আছে?

ঘড়ি দেখল ও। সাড়ে সাতটা বাজে। মামার আসতে আর কত দেরি? বাবুর্চিই বা আসছে না কেন?

এক চুমুক কোক খেল মুসা, টিভির সাউণ্ড বাড়িয়ে দিল। বাচ্চাদের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা উপস্থাপকের কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ওদের হাসি দেখে আপনমনে হাসল মুসা।

পরক্ষণে খেয়াল হলো বাড়িতে ও একা, অমনি শুকিয়ে গেল হাসি। ও জানে, এই বাড়িতে কয়েকটা মমি আছে!

‘আমি ভয় পাইনি, নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল মুসা। কিন্তু গলা যে শুকিয়ে আসছে, তা-ও পরিষ্কার টের পেল। মামা আর মদিনা এসে পড়লে বাঁচা যেত। কোথায় ওরা? এতক্ষণ লাগে আসতে?

হঠাৎ ভয়াবহ একটা চিন্তা পেয়ে বসল মুসাকে। এমন যদি হয়, শেষ মুহূর্তে কোনও জরুরি কাজে আটকে গেলেন মামা, রাতে আসতেই পারলেন না, তখন কী হবে?

জানে, এসব আসলে অহেতুক চিন্তা, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। একা থাকলে এ-ধরনের ফালতু চিন্তা আসে। তারপরেও মন থেকে অলক্ষুণে ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ দূর করতে পারল না মুসা।

হঠাৎ খেয়াল হলো, কখন যেন অজান্তেই পকেট থেকে মমির হাতটা বের করে মুঠোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ও। হাতটা ছোট, দেখে মনে হয় বাচ্চাদের। হালকা বাদামী রঙের গজ দিয়ে মোড়া। মামা দু’বছর আগে জিনিসটা ওকে উপহার দিয়েছিলেন। পিরামিড খোঁড়াখুঁড়ির সময় পেয়েছিলেন তিনি। মামা বলেছেন, হাতটার নাম ‘সামোনার’। আহ্বানকারী। ওটার না কী প্রাচীন অশুভ শক্তিকে ডেকে আনার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। অনেকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ওই জিনিস রাখে। বিশ্বাস করে হাতটা মুসা নিজের ঘরে রেখেছিল, যদি কোনও কাজে লাগে। এবার হাতটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে ও।

.

মানুষ বিশ্বাস করে, ওই হাতটা সবসময় জ্যান্ত মানুষের হাতের মত গরম থাকে। যখন বিপদ-আপদ আসে তার আগে ওটা একদম ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

বারবার হাতটা শূন্যে ছুঁড়ে ক্যাচ ধরতে লাগল মুসা। টিভির হাসাহাসি আর ভাল লাগছে না। তাই অফ করে দিল ওটা।

নার্ভাস লাগছে।

মুসা জিনিসটা মুঠোয় পুরে ঘরের এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি শুরু করল। কই, এখনও আসছেন না কেন মামা? মদিনা-ই বা কোথায়?

ঠিক তখনই সামনের বারান্দায় একটা আওয়াজ উঠল। পায়ের আওয়াজ।

মামা! খুশি হয়ে উঠল মুসা। পরক্ষণে খেয়াল হলো মামা এলে তো তাঁর গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যেত। শব্দ পাওয়া গেল না কেন? তা হলে কি অন্য কেউ? ও, বুঝেছি, নিশ্চয়ই বাবুর্চি। মদিনাও তো হতে পারে। খুশি হয়ে উঠল মুসা।

দরজার দিকে কয়েক পা এগোল মুসা, দ্বিধাগ্রস্তের মত থেমে পড়ল। শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। পরমুহূর্তে ওর দৃষ্টি সেঁটে গেল দরজার নবে। একটু একটু করে ঘুরছে ওটা।

আশ্চর্য! ভাবল ও। কে ওখানে? মামা নিশ্চয়ই নিজের বাড়িতে চোরের মত ঢোকার চেষ্টা করবেন না? বাবুর্চিও অমন কাজ করবে না। তা হলে…

ওর চোখের সামনে ঘুরেই চলেছে নব, দরজাটা চাপা ক্যা…চ শব্দে সামান্য ফাঁক হলো।

‘কে?’ আঁতকে উঠল মুসা। আরও কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না।

আস্তে আস্তে পুরো দরজা খুলে গেল। মনে ছিল না বলে বারান্দার আলো জ্বালেনি মুসা। অন্ধকারে আবছামত কী যেন ওখানে দাঁড়িয়ে, বুঝতে পারছে না ও।

বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। কোনও একটা মমি কি জ্যান্ত হয়ে উঠল? এবার আসছে ওকে ধরতে? জায়গায় জমে গেল মুসা, প্রাণপণে চেঁচাতে চাইল, কিন্তু আওয়াজ বের হলো না মুখ দিয়ে।

আবছা জিনিসটা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এক পা এগোল। ওটাকে চিনতে পারল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আতঙ্কে হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ।

মমি!

মুসার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যান্ত একটা মমি।

পুরু গজ ব্যাণ্ডেজের ফাঁক দিয়ে আগুন ঝরা চোখে তাকিয়ে আছে অপলক!

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এক পা এগোল ওটা। আরেক পা এগোল। মুসাকে ধরার জন্যে দু’হাত বাড়িয়ে দিল সামনে।

চিৎকার দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু পারল না।

তিন

এক পা পিছিয়ে গেল মুসা। তারপর আরেক পা। ‘সামোনার’ ধরা ডান হাতটা আপনাআপনি ওপরে উঠে গেল, যেন ওটা অনুপ্রবেশকারীকে ঠেকাবে।

আরেক পা এগোল মমি। ড্রইং রুমে ঢুকে থেমে দাঁড়াল। পরিষ্কার আলোয়। ওটার গাঢ় কালো দু’চোখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল মুসা।

একদম জ্যান্ত মানুষের চোখ!

পরক্ষণে চোখের মালিককে চিনে ফেলল।

‘মদিনা!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

গলা খুলে হাসিতে ফেটে পড়ল মদিনা।

‘তুমি হাসছ?’ বলল মুসা। ‘এটা কোনও হাসির ব্যাপার হলো?’ রেগে উঠেছে ও ভিতরে ভিতরে। মদিনার উদ্দেশে ধমক দিল, ‘বোকার মত হাসছ তুমি!’

‘মুসা, আমি জানতাম তুমি খুব ভীতু ছেলে, কিন্তু এতটা ভীতু, তা জানতাম না।’ হাসিতে ফেটে পড়ছে মদিনা। ‘ইস্, তোমার চেহারাটা যা হয়েছিল না!’

‘আমি মোটেই ভয় পাইনি,’ মুসা বলল। বুকের ধড়ফড়ানি যদিও একটুও কমেনি। ‘কারণ তোমাকে প্রথমেই চিনেছি।’

‘সত্যি?’ ফোড়ন কাটল মদিনা। ‘তোমার চেহারা দেখে আমার কিন্তু তা মনে হয়নি, মুসা।’

‘তোমার কৌতুক যাতে মাঠে না মারা যায়, সেজন্যে ভয় পাওয়ার অভিনয় করেছি,’ বলল মুসা। মনে মনে বলল, নিজেকে ভীতু প্রমাণ করার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। তা হলে পেয়ে বসবে। খেপিয়ে ত্যক্ত করবে সারাক্ষণ। এমনিতে কম জ্বালায় না ও।

‘নিজের একটু আগের চেহারাটা যদি আয়নায় দেখতে, মুসা,’ বলে আবার হাসল মদিনা। ‘আমার বান্ধবীরা অবশ্য নিষেধ করেছিল, ‘ সোফায় বসতে বসতে বলল মদিনা। মুখে হাসি লেগেই আছে। ভাবখানা, যত যা-ই বলো তুমি, আমি জানি ভয় পেয়েছ তুমি।

বাইরে হঠাৎ কারও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। আসন্ন বিপদ বুঝে মদিনা গজ ব্যাণ্ডেজ সহ পড়িমরি করে দৌড় দিল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন মামা। আফসোস করল মুসা, ছেমড়ি ভেগেছে, না হলে ধমকে সাইজ করে দিতেন মামা।

.

রাতে খাবার টেবিলে মামাকে বেশ উৎফুল্ল দেখতে পেল মুসা।

‘তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন, বাবা,’ বলল মদিনা।

‘ক’দিন আগে যে নতুন সমাধি ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছি, সেখানে ঢোকার পথ পেয়েছি।’ হাসতে হাসতে বললেন মামা।

‘সত্যি! কত বছরের পুরনো ওটা, মামা?’ খুশি হয়ে উঠল মুসা।

‘অনেক বছরের। হাজার হাজার বছরের পুরনো।’

‘ওরে বাবা!’ বলল মদিনা।

‘হ্যাঁ। দাঁড়াও, তোমাদের ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাব।’

উত্তেজিত হয়ে উঠল মুসা। ‘ভেতরে মমি আছে, মামা?’

‘এটা কেমন প্রশ্ন হলো?’ ভ্রূ কোঁচকাল মদিনা। পিরামিডের সমাধিতে মমি থাকবে না তো কী হাতি থাকবে?’

ওর ঠাট্টা গায়ে মাখল না মুসা। ‘গুপ্তধনও আছে নিশ্চয়ই, মামা! আর কী আছে, পেইণ্টিং আছে? বা…’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও,’ বললেন মামা। ‘বলছি। তোমরা নিশ্চয়ই বইতে পড়েছ,’ ডক্টর মোর্শেদ রোস্ট করা মুরগির রানের বড় এক অংশ কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে বললেন, ‘পিরামিড যিশু খ্রিস্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর আগে তৈরি হয়। ফারাও কুফু-র আমলে।’

মনে মনে দ্রুত হিসেব কষল মুসা। ‘তার মানে সাড়ে চার হাজার বছর আগে।’

‘হ্যাঁ, ঠিক,’ মাথা দোলালেন তিনি। ‘হিসেবে ভুল হয়নি তোমার।’ মুখ ভেঙাল মদিনা। বোঝাতে চাইল, এই সামান্য হিসেব ইচ্ছে করলে ও মুসার অনেক আগেই কষে ফেলতে পারত।

‘সে যুগে মানুষের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঠামো ছিল পিরামিড। মুসা, তুমি বলতে পারো পিরামিড কতখানি জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে?’

‘পারি।’

ভ্রূ কুঁচকে উঠল মদিনার। গলায় চ্যালেঞ্জের সুর ফুটল: ‘ঘোড়ার ডিম পারো তুমি।’

শ্রাগ করল মুসা। মুখের ভঙ্গি করল এমন, মনে হলো যেন বোঝাতে চায়-হিংসুটে মেয়েমানুষ! ‘তেরো একর, মামা।’

‘একদম ঠিক বলেছ তুমি।’

মুসা আড়চোখে মদিনাকে দেখল। সে অবাক চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ও যে সত্যি জবাবটা জানত, বিশ্বাসই করতে পারছে না যেন।

‘সে যাক,’ বলে চললেন মামা। ‘পিরামিড মাটির নীচের সমাধি ক্ষেত্রের ছাতা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ফারাও সম্রাটরা ওগুলো এত বড় বানিয়েছে তলার রাজকীয় সমাধিগুলো লুকিয়ে রাখার জন্যে।

‘সম্রাটরা চোরের ভয়ে অস্থির ছিল। সেকালে মৃত সম্রাটের সঙ্গে অগাধ ধন-সম্পত্তি দেয়া হত। ওসবের লোভে ভিতরে চোর, লুটেরা ঢুকবে, সব চুরি করে নিয়ে যাবে, এই ভয় ছিল। তলার সমাধি-ক্ষেত্রে ডজন ডজন টানেল তৈরি করা হত। এসব আসলে ভীষণ গোলকধাঁধা। ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যেন কেউ ঢুকে পড়লে গোলকধাঁধায় ঘুরে মরে, আসল জায়গায় পৌছাতে না পারে। এমন ব্যবস্থা ছিল, যেন আর বের হওয়ার পথ না পায়।

‘এখন আমি যে পিরামিডের তলায় কাজ করছি, এতদিন ভেবেছি তার সমাধি-কক্ষ আগেই খুঁজে পেয়েছি। সমস্ত টানেলের চার্টও এঁকে ফেলেছি। কিন্তু…’ থেমে রানে আরেক কামড় দিলেন তিনি।

‘কিন্তু কী, বাবা?’ মদিনা বলে উঠল

মামার কথাগুলো শুনছে মুসা। পিরামিডের ব্যাপারে পড়া কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে এখন ওর।

‘আজ ওখানে একটা নতুন টানেল খুঁজে পেলাম, যেটা চার্টে নেই।’

‘তার মানে?’ একটু ঝুঁকে বসল মুসা।

‘তার মানে, আসলে সমাধি-কক্ষে পৌঁছার পথ এটাই।’

‘এটা কার সমাধি, বাবা?’

‘স্বয়ং সম্রাট কুফুর।’

‘আরি সব্বোনাশ!’ ফিসফিস করে বলল মুসা। ‘আমাদের ভিতরে নিয়ে যাবেন, মামা? ‘

‘দেখা যাক কাল সকালে,’ খাওয়ায় মন দিলেন তিনি

মদিনা ঘুরে মুসাকে দেখল। ‘ভেতরে নিশ্চয়ই খুব অন্ধকার। তুমি ভয় পাবে।’

‘পাব না,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল মুসা।

.

কখন সকাল হবে, কখন পিরামিডে যাবে, সেই আশায় রাতে প্রায় ঘুম হলোই না মুসার। রাত যত গড়ায়, ওর উত্তেজনা ততই বাড়ে। অবশেষে একসময় প্রতীক্ষার অবসান হলো। সূর্য ওঠার সামান্য পর নাস্তা খেয়ে ওদের দু’ভাই-বোনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মামা।

বাইরে বেশ গরম। মিনিটে মিনিটে বাড়ছে রোদের তেজ। যেন অদৃশ্য আগুন ঝরছে।

‘ওই যে পিরামিড!’ আঙুল তুলে বাইরে নির্দেশ করল মদিনা।

ঘুরে তাকাল মুসা, মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকল আকাশছোঁয়া চুনাপাথরের বিশাল কাঠামোটার দিকে। হলুদ বালির বিস্তৃতির ওপর ভৌতিক এক অবয়ব যেন ওটা, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।

ওটার কাছের এক গার্ড-পোস্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন ডক্টর মোর্শেদ। ইউনিফর্ম পরা গার্ডকে নিজের গেট পাস দেখালেন। লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিল।

এবার সরু একটা রাস্তা ধরে সোজা পিরামিডের পেছনে চলে এল ওরা। জায়গাটা সাধারণ দর্শকদের জন্য নিষিদ্ধ। বিজ্ঞানী পিরামিডের নীলচে-ধূসর ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আরও কিছু কার-ভ্যানের মাঝে গাড়ি দাঁড় করালেন।

অধীর উত্তেজনায়, দুরু দুরু বুকে গাড়ি থেকে নামল মুসা ও মদিনা। মুসা মুখ তুলে সম্মোহিতের মত পিরামিড দেখছে। সাড়ে চার হাজার বছর বয়স এটার, ভাবছে ও। বাপরে! কী সাঙ্ঘাতিক!

‘মুসা, তোমার কেডসের ফিতে খোলা,’ বলল মদিনা।

কল্পনার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এল মুসা। তাকিয়ে দেখল, সত্যি। বাঁ পায়ের কেডসের ফিতে খোলা। রাঁধতে ভুলে গিয়েছিল বলে নয়, ফিতেটাই কেমন যেন। মুসা যতই কষে বাঁধুক, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেই খুলে যায়। দুটো গিঁট দিয়েও দেখেছে ও, কাজ হয় না। আর এবার বেড়াতে এসেছে মাত্র একজোড়া কেড্‌স্‌ নিয়ে।

ফিতেটা বাঁধল মুসা। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মেঝেতে হাতের তালু ছড়ে গেল। উফ করে উঠল ও। মামা বা মদিনা টের পেল না।

দু’জনের পিছনে হাঁটতে শুরু করল ও।

‘আমার ওয়ার্কাররা কাজে লেগে গেছে,’ সামনের একটা খোলা দরজা পার হলেন মামা। ‘তোমরা দু’জন আমাদের কাছাকাছি থেকো। বেশি ঘোরাঘুরি করতে যেয়ো না। ভিতরের টানেল সম্পর্কে যা বলেছি, মনে রেখো। একটু বেখেয়াল হলেই পথ হারিয়ে ফেলবে কিন্তু।’

‘মনে থাকবে,’ বলল মুসা। চাপা উত্তেজনায় গলা কেঁপে গেল ওর।

‘তুমি কিছু ভেবো না, বাবা,’ কণ্ঠে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে আশ্বাস দিল মদিনা। ‘আমি মুসার ওপর নজর রাখব।’

ভ্রূ কুঁচকে উঠল মুসার। ওর চেয়ে মাত্র দু’মাসের বড় মেয়েটা, অথচ ভাব দেখে মনে হচ্ছে পাকা বুড়ি, একেবারে ওর আসল গার্ডিয়ান।

ডক্টর মোর্শেদ ওদের দু’জনকে দুটো ফ্ল্যাশলাইট দিলেন। ‘এগুলো জিন্সের কোমরে ঝুলিয়ে নাও। পা ফেলার আগে আলো ফেলে দেখে নেবে ভাল করে। তোমরা কেউ মমির অভিশাপ বিশ্বাস করো নাকি?’

মাথা নাড়ল ওরা।

‘ভাল,’ সন্তুষ্ট দেখাল আর্কিওলজিস্টকে। ‘আমার সহকর্মীদের একজন অবশ্য বিশ্বাস করে। তার ধারণা, এই সমাধি আবিষ্কার করে আমি অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছি।’

‘আমি ওসব কেয়ার করি না,’ ঠোঁট ওল্টাল মদিনা। দরজার দিকে মৃদু ধাক্কা দিল মুসাকে। ‘চলো ভিতরে।’

কিছুক্ষণ পর পাথর কেটে তৈরি চার-কোনা দরজা দিয়ে পিরামিডের পেটের ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। সায়েম মোর্শেদের পেছন পেছন একটা সরু টানেল ধরে এগিয়ে চলল। গাঢ় অন্ধকার। টানেলটা ক্রমে নীচের দিকে এগিয়ে গেছে।

ডক্টর মোর্শেদ জোরাল একটা হ্যালোজিন ফ্ল্যাশলাইটে পথ দেখে এগোচ্ছেন। টানেলের মেঝে পুরু ধুলোয় ঢাকা। বাতাস ঠাণ্ডা, ভেজা।

‘চুনাপাথরের দেয়াল,’ বলে উঠলেন আর্কিওলজিস্ট। ‘প্রত্যেকটা টানেলের দেয়ালই তা-ই।’

হঠাৎ আরও ঠাণ্ডা হয়ে এল পরিবেশ। বাতাস আরও ভেজা- ভেজা। মুসার গায়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি জাগল।

‘ভয় লাগছে, মুসা?’ মদিনা প্রশ্ন করল।

‘মোটেও না,’ দ্রুত বলল ও।

ডক্টর মোর্শেদ থেমে পড়লেন। আচমকা টানেল শেষ হয়ে গেছে। একটা ফ্যাকাসে হলুদ দেয়াল সামনের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। মামার পায়ের সামনে মেঝেতে একটা চৌকো, গাঢ় অন্ধকার গর্ত দেখতে পেল মুসা।

‘এবার নীচে যেতে হবে আমাদের,’ কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললেন তিনি। ‘কিন্তু সিঁড়ি নেই। একটা দড়ির ম‍ই আছে, তাই বেয়ে নামতে হবে।’

‘আচ্ছা,’ মুসা মাথা দোলাল।

‘সাবধানে, আস্তে আস্তে নামবে। মই যেন বেশি না দোলে। প্রত্যেকবার নীচের ধাপে পা রাখার আগে ভাল করে দেখে নেবে। ঠিক আছে?’

একযোগে মাথা দোলাল মুসা-মদিনা। ‘নামার সময় নীচে তাকাবে ‘না,’ মুসাকে পরামর্শ দিল মদিনা। ‘মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারো।’

শুকনো স্বরে বলল মুসা, ‘আমি আগে নামব, মামা?’

‘না, আমি আগে,’ মামা বললেন। ‘আমি নীচে গিয়ে আলো ধরলে তোমাদের নামতে সুবিধে হবে।’

নিজেকে গর্তের মধ্যে গলিয়ে দিলেন তিনি। ওরা দু’জন কিনারায় ঝুঁকে বসে তাঁর নেমে যাওয়া দেখল। দড়ির মই স্থির থাকছে না, মামার দেহের ভারে বারবার সামনে-পেছনে দোল খাচ্ছে। সাবধানে নেমে গেলেন তিনি। নীচের মেঝেতে পা রেখে ওপরে তাকালেন। মাঝের দূরত্ব একটু বেশিই মনে হলো মুসার।

মদিনাকে দেখল ও। মনে হলো মেয়েটাও একই কথা ভাবছে। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। অধৈর্য ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁট

চুষছে। ‘ভয় করছে তোমার? তা হলে তুমি বরং থেকে যাও। নেমো না।’ মদিনাকে বলল মুসা।

জ্বলন্ত চোখে ওকে দেখল মদিনা। কিছু বলল না।

‘বেশ, আমি তা হলে আগে নামছি,’ গর্ত দিয়ে পা গলিয়ে দিল মুসা। ‘আমার নামা দেখলে হয়তো সাহস বাড়বে তোমার,’ দাঁত বের করে হাসল। ‘দেখা হবে।’

মইয়ের ধাপে দাঁড়িয়ে দু’হাতে দড়ি চেপে ধরল ও। সাবধানে এক ধাপ নামল। তারপর আরেক ধাপ। দড়িটা ভীষণ শক্ত, প্রায় লোহার মত। জায়গায় জায়গায় সুঁই-এর মত আঁশ জেগে আছে। কয়েক ধাপ নামতে না নামতে ওগুলোর খোঁচায় হাতের তালু কাটা জায়গায় ব্যথা পেল।

‘আউ!’ মুসা ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল। শূন্য গুহায় আওয়াজটা বিকট প্রতিধ্বনি তুলল।

‘কী হলো?’ বাপ-মেয়ে একযোগে প্রশ্ন করল।

এদিকে মুসার কথায় রেগে গিয়ে ওর পিছু পিছু নামতে শুরু করেছে মদিনা।

মুসা কোনও জবাব দেয়ার সুযোগই পেল না। কাটা জায়গায় আরেকটা মারাত্মক খোঁচা খেতে আপনাআপনি মুঠো আলগা হয়ে গেল। ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই দেহ পেছনদিকে হেলে গেল। শেষ মুহূর্তে থাবা দিয়ে দড়িটা ধরতে চাইল মুসা, কিন্তু কাজ হলো না।

পা ছুটে গেল।

রকেটের বেগে নীচে রওনা হলো ও।

চার

ওপর থেকে সাঁৎ করে একটা হাত নেমে এল। চেপে ধরল মুসার কব্জি। পতনের গতি থেমে গেল। মুসা পেণ্ডুলামের মত ডানে-বাঁয়ে দোল খেল।

‘দড়িটা ধরো, মুসা,’ চেঁচিয়ে উঠল মদিনা। ওর কণ্ঠেও আতঙ্ক। ‘জলদি! নইলে আমিও পড়ে যাচ্ছি।’

মুসা ততক্ষণে থাবা দিয়ে দড়ি ধরে ফেলেছে। মইয়ে দেহের ভর রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। এরইমধ্যে ঘেমে চুপচুপে হয়ে গেছে ও।

খাইছে! ভাবছে ও। বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে এতবড় বেইজ্জতি কাণ্ড ঘটালাম! তা-ও আবার মদিনাই বাঁচাল?

চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকল ও। হাত ব্যথা করছে।

মইয়ের উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আছে মদিনা, হাসল। ইস! আরেকটু হলে গিয়েছিলে।

মুসা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মাথা দোলাল। ‘সত্যিই, অনেক ধন্যবাদ।’

‘ঠিক আছে,’ স্বস্তির হাসি হাসল ও।

‘মদিনা-মুসা, কী করছ তোমরা? কী হয়েছে?’ নীচ থেকে ডেকে উঠলেন মামা, বোধহয় অন্ধকারে কিছু দেখতে পাননি।

‘হাত কেটে গেছে, মামা।’

‘ওহ্-হো! আস্তে আস্তে নামো, তাড়াতাড়ি নামার দরকার নেই।’

‘আচ্ছা।’

‘এবার সাবধানে,’ মদিনা বলল। ‘খেয়াল রেখো দড়িতে কাটা জায়গাটা যেন ঘষা না লাগে।’

লম্বা করে দম নিল ও, তারপর খুব সাবধানে নামতে শুরু করল। মুসা নীচের মেঝেতে পা রেখে সরে গেল, এবার মদিনাও নেমে এল।

ডক্টর মোর্শেদ সময় নষ্ট না করে ঘুরে দাঁড়ালেন। ‘এসো।’

মাথার ওপরের নিচু, এবড়োখেবড়ো সিলিঙের গুঁতো এড়াবার জন্যে ঝুঁকে হাঁটছেন তিনি। ধুলোমোড়া মেঝেতে তিনজোড়া কেডস্ মৃদু আওয়াজ তুলছে। হাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে তিনটে ফ্ল্যাশলাইটের আলো। টানেল একটু দূরে ডানে বাঁক নিয়েছে, তারপর আবার খানিকটা গিয়ে বাঁয়ে।

‘আমরা এখন সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো বদ্ধ বাতাসে দম নিচ্ছি,’ বলে উঠলেন আর্কিওলজিস্ট।

‘তা-ই মনে হচ্ছে,’ মদিনার উদ্দেশে ফিফিস্ করে বলল মুসা। মদিনা মাথা ঝাঁকাল।

সত্যিই তা-ই। বাইরের তাজা বাতাসের মত নয়, পুরানো, পোড়ো বাড়ির চিলেকোঠায়, ভাঁড়ার ঘরে এরকম গন্ধ পাওয়া যায়।

টানেল আবার ডানে বাঁক নিয়েছে। পথ এখানে একটু বেশি চওড়া। এবং ক্রমে নীচে নেমে গেছে। চাইলেও স্বাভাবিকভাবে হাঁটার উপায় নেই এখানে, গতি আপনাআপনি বেড়ে যায়।

অনেকটা দৌড় ও হাঁটার মাঝামাঝি গতিতে হাঁটতে হচ্ছে ওদের।

‘মনে হচ্ছে না পাহাড় থেকে নামছি আমরা?’ বললেন মামা।

‘হ্যাঁ,’ বলল মুসা।

‘আরও গভীরে যেতে হবে আমাদের, বুঝলে?’ একটু থামলেন তিনি। ‘কাল এই টানেলের মাথায় ছোট, চমৎকার একটা রুম খুঁজে পেয়েছি। বেশ পরিচ্ছন্ন রুম। ওর মধ্যে মমি রাখার কফিনও আছে।

‘মমি আছে ওটায়, মামা?’ ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল মুসা। ‘দেখা যাবে এখন?’

‘সরি, ভাগ্নে,’ এপাশ-ওপাশ মাথা দোলালেন তিনি। ‘নেই। ওটা খালি।’ কী ভেবে হাসলেন। ‘অন্তত আমি যখন দেখেছি, তখন খালি ছিল। মনে হয় বেড়াতে গিয়েছিল আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।’

হেসে ফেলল মুসা-মদিনা। পরক্ষণে মুসা হুমড়ি খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সামলে নিয়ে চট্ করে ঘুরে তাকাল। আলো ফেলে পেছনটা দেখল। কেউ নেই। ‘কী হলো!’ বিড়বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করল মুসা। ‘কে যেন ধাক্কা দিল মনে হচ্ছে?’

কথাটা কানে যেতে ঘুরে দাঁড়াল মদিনা। ‘হ্যাঁ,’ বলল ও। খালি কফিনের সেই মমিটা খুব সম্ভব। বুদ্ধু কোথাকার!

‘মানে?’

‘পায়ের দিকে তাকাও।’

তাকাল মুসা। বুঝল কী ঘটেছে। এক পায়ের কেডসের ফিতে আবার খুলে গেছে। হাঁটার সময় অন্য পায়ে তাই মাড়িয়ে দিয়েছিল ও, নিজেই নিজেকে আছাড় মারার কাজ করেছিল।

বোকার মত বলল মুসা। ‘ও, খেয়াল করিনি।’

‘তা করবে কেন?’ মুখ ঝামটা মারল মদিনা। ‘সারাক্ষণ তো আছ নিজেকে বীরপুরুষ প্রমাণ করার চিন্তায়।’

ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল মুসা। লজ্জায় বেগুনী হয়ে উঠল কান। তাড়াতাড়ি ফিতেটা বেঁধে সোজা হলো।

খানিকটা এগোতে আবার ডানে বাঁক নিল টানেল। বাঁক ঘুরেই ইংরেজি Y-এর মত দু’দিকে চলে গেছে দুটো টানেল। বাঁ দিকেরটা ধরে এগোল ওরা ডক্টর মোর্শেদকে অনুসরণ করে। একেবারে অপ্রশস্ত আর নিচু এটা। অনেক সময় লাগল টানেলটা পার হতে। তারপরই প্রকাণ্ড এক কক্ষ। ছাদ অনেক উঁচুতে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কক্ষের চারদিকে নজর বোলাল মুসা ও মদিনা।

ওপাশের দেয়ালে একদল ওয়ার্কার যন্ত্রপাতির সাহায্যে খোঁড়াখুঁড়ি করছে। তাদের মাথার ওপর জ্বলছে ফ্লাড লাইট।

ওয়ার্কারদের সঙ্গে এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। হাতে একটা ক্লিপ বোর্ড, পরনে সাদা শার্ট-প্যান্ট, গলায় লাল সিল্কের স্কার্ফ। মেয়েদের মত দীর্ঘ চুল রিবন দিয়ে পনিটেইল করে বেঁধেছে সে।

‘এ হচ্ছে মামুন হাশমি,’ তার সামনে পৌঁছে ওদের উদ্দেশে বললেন বিজ্ঞানী। ‘এদেশি। ভার্সিটিতে আর্কিওলজির ওপর পড়াশুনা করছে। হাতে কলমে শিখবে বলে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছে।’

যুবকের দিকে ফিরলেন মামা। ইংরেজিতে বললেন, ‘হাশমি, এ আমার মেয়ে, মদিনা। আর এ হচ্ছে আমার ভাগ্নে, মুসা।’

সামান্য মাথা ঝাঁকাল মামুন হাশমি, কিছু বলল না। কেবল মুসাকে নীরবে দেখল।

অস্বস্তি লেগে উঠল। ব্যাটা অমন করে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে? ভাবল মুসা।

‘তারপর?’ ওয়ার্কারদের দিকে ফিরলেন ডক্টর মোর্শেদ। ‘কাজের অগ্রগতি কতদূর?’

‘মনে হচ্ছে মূল সমাধি কক্ষে ঢোকার পথ আজই পেয়ে যাব, ‘ বলল এক লোক।

‘ধন্যবাদ, মুতাকী।’

মামা ঘুরে ঘুরে সবার কাজ তদারক করতে লাগলেন। এদিকে মুসা ও মদিনা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দিকে খেয়াল নেই এখন ডক্টর মোর্শেদের, এতই ডুবে গেছেন কাজে।

‘দেখলে?’ হতাশ কণ্ঠে বলল মদিনা। বাবার অবস্থা দেখলে? কেমন আমাদের ফেলে চলে গেলেন?’

ওর দিকে খেয়াল নেই মুসার। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে মুগ্ধ চোখে।

‘দেখো, প্রাচীন ধুলো,’ মদিনা মেঝের দিকে ইঙ্গিত করল।

‘হ্যাঁ,’ মেঝেতে মৃদু লাথি মারল মুসা। ধোঁয়ার মত ধুলো উড়ল। ‘ভাবছি এখানে শেষ কার পা পড়েছিল।’

‘হয়তো কোনও রাজার। হয়তো সম্রাট কুফুর। একদিন তিনি হয়তো এখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমাধি কক্ষ সীল করার কাজ দেখেছেন।’ হঠাৎ প্রস্তাব দিল মদিনা, ‘চলো, আমরা আশপাশটা একটু ঘুরে দেখি।’

‘কী?’

‘মনে আছে, পেছনে আমরা একটা টানেল ফেলে এসেছি? চলো যাই, দেখি কী আছে ওদিকে।’

বিস্মিত হলো মুসা। ‘কী বলছ! মামা না এদিক-ওদিক যেতে বারবার নিষেধ করলেন?’

দূরে কোথাও যাব না,’ মুখ ঘুরিয়ে পেছনের টানেল দেখাল মদিনা। ‘ওদিকে যে টানেলটা আছে, ওটা দেখেই ফিরে আসব।’

মুসা মাথা নাড়ল। ‘সেটা উচিত হবে না, মদিনা। মামা বারবার বলে দিয়েছেন এক পা-ও না নড়তে।’

মুখ তুলে বাবাকে দেখল মদিনা। ওয়ার্কারদের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত তিনি, এদিকে তাকাচ্ছেন না। মদিনা চেনে তার বাবাকে, জানে, যে কাজপাগল মানুষ, এখন আর তাকাবেন না। হয়তো এতক্ষণে এখানে তাদের উপস্থিতির কথা ভুলেই গেছেন।

‘বাবা কিছু টের পাওয়ার আগেই ঘুরে আসব আমরা,’ বলল ও। ‘চলো।’

‘কিন্তু যদি…’ থেমে গেল মুসা মাঝপথে।

‘কিন্তু কী?’

‘না, মানে যদি কিছু…’ মুসা এবারও থেমে পড়ল কথা শেষ না করে।

‘বুঝেছি, মদিনা মাথা দোলাল।

‘কী?’

‘তুমি ভয় পেয়েছ।’

‘না! কীসের ভয়? আমি বলছি, মামার কথা মেনে চলা উচিত আমাদের। নইলে উনি রাগ করবেন।’

‘ছাই করবেন,’ মদিনা ঝাঁঝিয়ে উঠল। ‘বাবা জানছেন কী করে?’ মুসা আমতা আমতা করতে লাগল। মন সায় দিচ্ছে না।

ওকে রাজি করাতে মোক্ষম খোঁচা মারল মদিনা। ‘আশ্চর্য! তুমি এত ভীতু ছেলে, জানতাম না তো!’

‘ঠিক বললে না কথাটা,’ শান্ত গলায় বলল মুসা। যদিও রেগে গেছে মনে মনে। ‘আমি মোটেই ভীতু নই। রকি বিচে অনেক কঠিন রহস্যের সমাধান…

‘হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি মেয়ে হয়ে যেটুকু সাহস রাখি, ছেলে হয়ে তার অর্ধেকও নেই তোমার।’

কিছুক্ষণ মদিনা চুপ করে থাকল খোঁচার ফল বোঝার জন্যে। তা ছাড়া আমি কী দূরে কোথাও যেতে চেয়েছি?’

‘কোথায় যাবে; কতদূরে?’ মুসা জানতে চাইল।

‘দূরে আবার কী? এই তো, কাছেই। এই টানেলে ঢোকার আগে যেটা ডানদিকে ফেলে এসেছি, সেটার শেষে কী আছে দেখেই চলে আসব।’

ইতস্তত করল মুসা। ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। যদি টানেলের গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলে, তা হলে সর্বনাশ। হয়তো জীবনেও আর কোনদিন সূর্যের মুখ দেখা হবে না।

‘কী হলো?’ মদিনা ধৈর্য হারাল এবার। ‘যাবে, না মুরগির মত ঠক্‌ঠক্ করে কেঁপেই সময় পার করবে?’

‘চুপ করো! বাজে কথা বলবে না।’

‘একশোবার বলব,’ মেঝেতে পা ঠুকল মদিনা। হাসতে হাসতে সুর করে বলল, ‘মু-উরগি!’

‘ফের?’ তেড়ে উঠল মুসা।

‘যদি না যাও আজ থেকে তোমাকে ওই নামেই ডাকব আমি। সবার সামনে। তখন বুঝবে মজা।’

আচ্ছা মুশকিলেই পড়া গেল, বিরক্ত হয়ে ভাবল মুসা। ‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। চলো যাই।’

খুশিতে ছোট্ট একটা লাফ দিল মদিনা। ‘এই তো সাহসী ছেলের মত কথা।’

‘কিন্তু মনে রেখো, দূরে যাওয়া চলবে না।’

‘আচ্ছা,’ হাসল মদিনা। ‘কোনও চিন্তা নেই। দূরে যাব না। তা ছাড়া পথ চিনে গেলে কী-ইবা হবে?’

‘হওয়া না হওয়ার কথা নয়; মামার নিষেধ আছে, কাজেই আমি দূরে যাচ্ছি না, ব্যস,’ বলল মুসা।

‘সে দেখা যাবে,’ ওর হাত ধরে টান দিল মদিনা। ‘এখন চলো।’

আরেকবার ব্যস্ত ডক্টর মোর্শেদকে দেখে নিল ওরা। কাজে মগ্ন তিনি। কথা বলছেন লাল চুলওয়ালা এক ওয়ার্কারের সঙ্গে। দেখে মনে হলো লোকটা ওয়ার্কারদের প্রধান।

‘চলো,’ বলে অপ্রশস্ত টানেলে ঢুকে পড়ল মদিনা। মুসা ওকে অনুসরণ করে চলল। মাথা ঝুঁকিয়ে এগোচ্ছে।

দুই টানেল যেখানে Y-এর মত দু’দিকে চলে গেছে, সেখানে পৌঁছে থামল ওরা, তারপর ডানের টানেল ধরে সামনে এগোল। এটা আগেরটার মত সরু নয়। কয়েক পা যেতে আবার নতুন করে দ্বিধায় পড়ে গেল মুসা। কী হবে যদি পথ হারিয়ে ফেলে?

যেন মুসার মনের কথা টের পেয়েই বলে উঠল মদিনা, ‘ভেবো না। এই টানেলের মাথায় কী আছে দেখে ফিরে আসব।’

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ও, সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ার দশা হলো। আবার খুলে গেছে কেডসের ফিতে। ফ্ল্যাশ লাইট মেঝেতে রেখে ঝুঁকে বসল মুসা। ‘মদিনা, এক মিনিট।’

কাজ সেরে মুখ তুলল ও, পরক্ষণে বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল।

মদিনা নেই!

সামনে ফাঁকা টানেল।

মুসা হতভম্ব হয়ে গেল। ‘মদিনা!’ গলা কেঁপে গেল ভয়ে। সাড়া নেই।

‘মদিনা!’ টানেলের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ওকে যেন ব্যঙ্গ করল ওরই কণ্ঠস্বর, কাঁপতে কাঁপতে মিলিয়ে গেল দূরে।

আলো নিয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল মুসা।

‘মদিনা!’

জবাব নেই।

উন্মাদের মত দৌড় লাগাল ও সামনের দিকে। ‘মদিনা, কোথায় তুমি?’

সামান্য আলোর আভাস দেখা গেল সামনে। ডানদিক থেকে। মদিনার ফ্ল্যাশ লাইটের আলো মনে হলো। আশান্বিত হয়ে ডাক দেয়ার জন্যে মুখ খুলল মুসা, কিন্তু ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে সে-আলো। দরদরিয়ে ঘামছে ও।

এটা বেশ চওড়া টানেল। এখানে বাতাসও হালকা। কেমন একটা গন্ধ ভাসছে বাতাসে। মনে হয় কেউ সিগারেট খেয়েছে এখানে বসে।

সামনে আরেকটা টানেল মনে হয়। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল মুসা- হ্যাঁ, তা-ই। ডানে চলে গেছে। তার মানে ও ঠিকই দেখেছে। এদিকে যখন আলো দেখা গেছে, তা হলে মদিনা নিশ্চয় এটায় ঢুকেছে। কিন্তু…সাড়া দিচ্ছে না কেন মেয়েটা?

মদিনা! কোথায় তুমি?’

পাঁচ

‘মদিনা!’

মুসার ডাক টানেলের এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু জবাব নেই।

আবার ডাকল ও। রেগে উঠছে ক্রমে। এর কোনও অর্থ হয়? অন্ধকারে কোনদিক যেতে কোনদিকে চলে যাবে, শেষে… নিশ্চয় ওকে ভয় দেখাবার জন্যে এসব করছে মদিনা, মুসা ভাবল।

কাছেই হয়তো ঘাপটি মেরে আছে অন্ধকারে। ওর সাহস পরখ করছে। ওকে ভয় পাইয়ে নিজের বাহাদুরি জাহির করতে চাইছে।

সত্যি তা-ই?

না আর কিছু?

আলো জ্বেলে সামনে এগিয়ে চলল মুসা। গলা শুকিয়ে কাঠ। সত্যিই যদি মদিনার কোনও বিপদ ঘটে থাকে, মামাকে কী জবাব দেবে ও? উনি বারবার করে বলেছেন, যেন কোথাও না যাই। তা তো অগ্রাহ্য করেছেই ওরা, তারওপর… আর ভাবতে পারল না মুসা।

অস্বস্তিকর সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে।

সত্যিই যদি ওর খারাপ কিছু ঘটে গিয়ে থাকে?

যদি পা পিছলে কোনও গুপ্ত গর্তে পড়ে? কিংবা পথ হারায় *টানেলের গোলক ধাঁধায়?

মুসার মাথা কাজ করছে না।

ধোঁয়াটে লাগছে সবকিছু।

টানেল ধরে সামনে ছুটে চলেছে ও। মেঝেতে কেডসের চাপা ধপধপ্ আওয়াজ উঠছে। ফ্ল্যাশ লাইটের আলো দুলছে দৌড়ের ছন্দে।

ডানে বাঁক নিয়ে মুসা বেশ কিছুটা পথ এগোল। সন্ত্রস্ত ইঁদুরের মত লাগছে ওর নিজেকে। তালগোল পাকিয়ে গেছে মাথার মধ্যে। একবার ভাবছে, আর গিয়ে কাজ নেই, পথ ভুল হয়ে যেতে পারে।

পরক্ষণেই ভাবছে, হোক না ভুল। মদিনাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

‘মদিনা!’ মরিয়া হয়ে ডাকল ও গলা চড়িয়ে।

থেমে পড়ল। নাহ্, যে ক্ষীণ আশা ছিল মনে, তা মিথ্যে। টানেলটা বেশি চওড়া নয়, লম্বাও বেশি না। এর মধ্যে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে না। নাকি ও নিজেই ভুল করে অন্য কোনও টানেলে ঢুকে পড়েছে?

না, তা হতে পারে না। ঠিক টানেলেই এসেছে ও। এই টানেলেই একটু আগে আলোর আভাস দেখা গেছে।

তা হলে? কোথায় গেল মদিনা?

জলজ্যান্ত একটা মেয়ে উধাও হয়ে গেল?

কী করে তা সম্ভব?

হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল টানেলটা। শেষ মাথায় একটা ছোট, চৌকো রুম। আলো ফেলে রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল মুসা। কেউ নেই।

ফাঁকা।

‘মদিনা!’

সাড়া নেই।

সামনে ফাঁকা। বাতাস কিছুটা গরম, কীসের যেন হালকা গন্ধ তাতে। আলো ফেলে মেঝেতে মদিনার পায়ের ছাপ খুঁজল মুসা। এদিকের মেঝেতে ধুলো অনেক কম, কোনও ছাপ নেই।

‘ওটা কী!’

আঁতকে উঠল মুসা আরেকটু এগিয়ে। দেখল, দেয়াল ঘেঁষে চৌকো, লম্বা কী যেন। বুকের খাঁচায় নতুন উদ্যমে গুঁতো মারতে শুরু করল হৃৎপিণ্ড।

ভয় করছে। পা কাঁপছে। তবু জোর করে এগোল মুসা। ওটার কয়েক ফুটের মধ্যে পৌছে বুঝল জিনিসটা কী।

একটা কফিন!

মমি রাখার!

বেশ লম্বা, কম করেও আট ফুট। পাথরের তৈরি। আয়তাকার কফিন, চারকোনা কেটে সুন্দর গোল করা। ঢাকনাও তেমনি। মসৃণ। আরেকটু এগিয়ে ওটার ওপর আলো ফেলল মুসা।

হ্যাঁ।

কফিনের মাথার দিকে, ঢাকনায় মানুষের মুখ খোদাই করা আছে। মেয়েমানুষের মুখ। মুখটা নিশ্চয় কোনও এক কালে ঝলমলে রঙ করা ছিল। এখন রঙের কোনও চিহ্ন নেই, সময়ের করাল গ্রাসে সব মুছে গেছে। ধূসর লাগছে এখন মুখটা, ঠিক মরা মানুষের মত ফ্যাকাসে।

ক্ষণিকের জন্য মদিনার কথা ভুলে গেল মুসা। ভাবল, মামা কি কফিনটা দেখেছেন? না কি ও-ই ওটার প্রথম আবিষ্কর্তা?

কিন্তু এটা এখানে কেন?

ভেতরে কিছু আছে?

অনেক চেষ্টায় সাহস অর্জন করল মুসা। কফিনের ভিতরে কেমন একটা শব্দ হচ্ছে। পাথরে পাথর ঘষা খাওয়ার শব্দ। মুসা বুঝতে পারছে পালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু পা উঠল না। একচুলও নড়তে পারল না। মূর্তির মত জমে গেছে।

কফিনের ঢাকনা উপরে উঠছে। ভেতর থেকে কেউ ঠেলছে। অজান্তেই মুসার ঠোঁটের ফাঁক গলে একটা দুর্বোধ্য আর্তধ্বনি বেরিয়ে এল।

মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইল ও। ঝেড়ে দৌড় লাগাতে চাইল। কোনওটাই হলো না। দাঁড়িয়েই থাকল খুঁটির মত।

কফিনের ঢাকনা উঠছে।

ভেতরে একটা চাপা হিস্ হিস্ আওয়াজ উঠল, কোকের বোতল খুললে যেমন হয়, অনেকটা তেমনি। তবে বেশ জোরাল।

আরেকটা দুর্বোধ্য আওয়াজ বেরোল ওর গলা চিরে।

বহু কষ্টে নড়ল, পিছিয়ে এল এক পা।

তারপর আরেক পা।

আলো খসে পড়ে গেল হাত থেকে।

আঁতকে উঠে হাত বাড়াল মুসা, কাঁপছে থরথর করে। পাগলের মত মেঝে হাতড়ে ফ্ল্যাশ লাইট তুলে নিয়েই জ্বালল আবার কফিনের দিকে।

এরমধ্যে ঢাকনা প্রায় ফুট খানেক উঠেছে।

দম আটকে গেল মুসার।

চিৎকার করতে চাইল, পারল না। আরেকবার দৌড় দেয়ার চেষ্টা করল, কাজ হলো না।

ওদিকে ঢাকনাটা উঠছে ক্রমেই।

কফিনের ভিতরে দুটো চোখ দেখতে পেল মুসা-প্রাচীন এক জোড়া চোখ।

সোজা মুসার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ছয়

নিঃশব্দে ঢোক গিলল মুসা। ওর মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা হিম স্রোত এঁকেবেঁকে নীচে নেমে গেল। ঢাকনা আরও এক ইঞ্চি উঠল।

চোখদুটো তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঠাণ্ডা দৃষ্টি, শীতল অভিব্যক্তি। অশুভ দুটো চোখ।

হাজার হাজার বছরের প্রাচীন।

একটু একটু করে হুঁশ ফিরল মুসার। আপনাআপনি মুখ খুলে গেল, গলার সমস্ত শক্তি এক করে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল।

একটা গাঢ় ছায়া ধীরে ধীরে উঠে বসল কফিনের মধ্যে। আলোয় ওটার চেহারা মুসা স্পষ্ট দেখতে পেল। এবং মুখ বুজে ফেলল হপ্ করে।

‘মদিনা!’

হাসি ফুটল দুষ্টু মেয়েটির মুখে। আলোয় দু’চোখ চক্‌চক্ করে উঠল। কফিন থেকে বেরিয়ে এল ও।

‘মদিনা!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা আবার। রাগে পিত্তি জ্বলছে। ‘এটা কী ধরনের কাজ হলো? সবকিছু নিয়ে বাঁদরামি?’ ওর তীক্ষ্ণ চিৎকার দেয়ালে বাড়ি খেয়ে জোর প্রতিধ্বনি তুলল।

পাত্তা দিল না মদিনা, বরং হাসি আরও বেড়ে গেল। সে- আওয়াজ মুসার কানে যেন বিষ ঢেলে দিল। ওর গা জ্বলে গেল, ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা ছুঁড়ে মারতে চাইল। পাওয়া গেল না কিছু। এক টুকরো মাটির ঢেলা বা নুড়িও নেই।

ফলে রাগ আরও বেড়ে গেল মুসার। ফুঁসতে লাগল অক্ষম আক্রোশে। মেয়েটা ওকে বোকা বানিয়েছে, ওকে ভয় দেখিয়েছে, চিন্তাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

এর রেশ বহুদূর গড়াবে, ও জানে। সহজে রেহাই দেবে না মদিনা, হাসি-ঠাট্টায় ওর প্রাণটা ভাজা ভাজা করে ছাড়বে।

অনেক সংগ্রাম করে হাসি ঠেকাল মদিনা। ‘ওহ্, মুসা! যা একখানা চেহারা হয়েছিল না তোমার! যদি ক্যামেরাটা থাকত, ছবি তুলে দেখাতাম।’

রাগের চোটে কথাই বলতে পারল না মুসা।

অপ্রতিভের মত পকেট থেকে মমির হাতটা বের করে নাড়াচাড়া করল। কিছু নিয়ে থাকলে, মনটা শান্ত হয়।

কিন্তু এখন পদ্ধতিটা কোনও কাজে এল না।

‘বাবা বলেছিলেন না… হি-হি! কাল একটা… হি-হি… কফিন দেখেছেন উনি? হি-হি!’ থেমে থেমে বলে চলেছে মদিনা। ‘এটাই সেই কফিন… হি-হি! মনে নেই?’

আগুন ঝরা চোখে তাকিয়ে থাকল মুসা। মুখে কথা নেই।

সত্যিই তো! ভাবছে, কেমন বুদ্ধু আমি? সময়মত কেন কথাটা মনে পড়ল না? ছি-ছি! কী লজ্জার ব্যাপার!

মুসা মনে মনে এর প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করল। যে করেই হোক, প্রতিশোধ নিতেই হবে।

হাসির বিরাম নেই মদিনার। হাসছে এখনও। ‘তোমার একটু আগের চেহারা যদি দেখতে, মুসা। সারা জীবন মনে থাকত।’

‘কাজটা আমি করলে….

মদিনা বাধা দিল, ‘লাভ হত না। আমি ভয় পেতাম না। সহজে ভয় পাই না আমি।’

চুপ করে থাকল মুসা, মনে মনে ফুঁসছে। ইচ্ছে করছে মদিনাকে ধরে কফিনে ঢুকিয়ে দেয়।

এমনসময় পেছনে পায়ের শব্দ উঠল। কেউ আসছে? মদিনার চেহারা থেকে হাসি উবে গেল। দু’জন একযোগে পেছনে তাকাল।

পায়ের আওয়াজ আরও কাছে চলে এসেছে। টানেলে একটা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। নাচছে, এগিয়ে আসছে।

কয়েক সেকেণ্ড পর বাঁক ঘুরে ওদের মুখোমুখি হলেন ডক্টর সায়েম মোর্শেদ। রেগে উঠলেন ওদের দেখতে পেয়ে।

‘বারবার করে তোমাদের এদিক-ওদিক যেতে নিষেধ করেছি আমি,’ থমথমে গলায় বললেন তিনি।

‘বাবা…’

‘থামো!’ ধমক দিলেন বিজ্ঞানী। ‘কোনও কৈফিয়ত শুনতে চাই না। অনেকবার সাবধান করেছি তোমাদের এই টানেলের গোলকধাঁধায় পড়লে জীবনেও বেরোবার পথ খুঁজে পাবে না। তারপরও কোন্ সাহসে আমাকে না জানিয়ে এলে তোমরা?’

‘বাবা,’ মদিনা কোনওমতে বলল, ‘আমরা এখনই ফিরে যাচ্ছিলাম।’

‘কোন পথে যেতে শুনি? পথ চিনতে কী করে? অনেক টানেল আছে এটায়, এখনও সব ঘুরে দেখিনি আমরা। কাজের চাপে এদিকে এখনও আসার সুযোগ হয়নি।’ একটু থামলেন তিনি। ‘মোটেই ভাল কাজ করোনি তোমরা।’

‘তুমি যে কফিনের কথা বলেছিলে, ওটা দেখতে এসেছিলাম, ‘ মদিনা মিনমিন করে বলল।

‘একা আসতে গেলে কেন? আমাকে বললেই তো হত, আমি নিয়ে আসতাম তোমাদের।’

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল মুসা। ভয় পেয়েছে। মামার এমন চেহারা আগে কখনও দেখেনি ও। উনি নিশ্চয় ওকে ভুল ভাবছেন ভেবে মদিনার ওপর রাগ আরও বাড়ল। মেয়েটা দুষ্টুমি করতে গিয়ে সময় নষ্ট না করলে এতক্ষণে ফিরে যেতে পারত ওরা, বকা খেতে হত না।

‘ভুল হয়ে গেছে বাবা,’ মদিনা বলল নতমুখে। ‘আর হবে না।’

‘চলো। আজকের মত তোমাদের পিরামিড দেখা শেষ।’ তাঁকে অনুসরণ করল ওরা গোবেচারা চেহারা করে। মুসার খুব খারাপ লাগছে। মদিনার ফাঁদে পা দিয়ে যে কতবড় এক অন্যায় করে বসেছে, এখন বুঝতে পারছে। মামা ওকে মুখে বকাবকি করেননি, কিন্তু ওর ওপরেও যে সমান বিরক্ত হয়েছেন, তা সহজেই বোঝা যায়।

.

দুপুরে খেয়ে মামা একাই কাজে চলে গেলেন, ওদের নিলেন না। তবে এরমধ্যে মেজাজ শান্ত হয়েছে তাঁর, এটাই যা সুখের কথা। খেতে বসে মুসা-মদিনার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। ফলে মুসার মনের অপরাধী ভাবটা দূর হয়ে গেছে।

দু’ভাই বোন ঘরে বসে মনোপলি খেলে, টিভি দেখে পানসে দিন কাটাল। পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে ছট্‌ফট্ করতে লাগল ওরা। আজও ঘরে বন্দি থাকতে হবে কি না বুঝতে না পেরে মনে মনে অস্থির। অবশ্য দু’কাপ কফি খাওয়ার পর মামার মধ্যে কোনও ব্যস্ততা দেখা গেল না। তিনি নিজে বের হবেন কি না, সে-সন্দেহ দেখা দিল। একসময় আর থাকতে না পেরে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করল মদিনা, ‘বাবা, তুমি বের হবে না আজ?’

‘হ্যাঁ। কায়রো মিউজিয়ামে যাব,’ ঘড়ি দেখলেন তিনি। ‘মিটিঙ আছে। ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পারো। ওখানে মমি আছে। আরও অনেক কিছু আছে। সব প্রাচীন।’

‘ওহ্, কী মজা!’ শাস্তি পর্ব তুলে নেয়া হয়েছে বুঝতে পেরে হাসল মদিনা। ‘তবে মমিগুলো কফিন থেকে উঠে আবার তাড়া করবে না তো?’ আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল মদিনা। কালকের ঘটনাটা বাবাকে জানিয়েছে ও।

কিছু বললেন না ডক্টর মোর্শেদ, পট থেকে আরেক কাপ কফি ঢাললেন। এসময় টেলিফোন বেজে উঠল। উঠে ফোন ধরলেন তিনি। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ‘হুঁ, হাঁ’ করে রেখে দিলেন।

‘কার ফোন, বাবা?’ তিনি টেবিলে ফিরে আসতে জানতে চাইল মদিনা।

‘অফিশিয়াল,’ বললেন তিনি। ‘সরি। আজ মিউজিয়াম যাওয়া হচ্ছে না আমাদের।’ চিন্তিত মনে হলো তাঁকে।

‘কেন বাবা?’ জিজ্ঞেস করল মদিনা।

‘মিটিঙ হবে না আজ। বাতিল করা হয়েছে।’ ডক্টর সায়েম মোর্শেদ কী যেন ভাবলেন। ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত। কাল রাতে আমার দুই ওয়ার্কার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা নাকি রহস্যজনক।’ আবার বিরতি দিলেন। ভুরু কুঁচকে আরেক দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ‘তাদের কায়রো হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। দেখতে যেতে হবে।’

উঠে ওয়ালেট আর গাড়ির চাবি নিলেন, আরও কিছু জরুরি এটা- ওটা গুছিয়ে নিলেন। ‘যাই, দেখি কী হয়েছে ওদের।’

‘আমরা?’ মদিনা বলে উঠল। আমরা কী করব?’

‘বাসায় থাকো তোমরা। আমার ফিরতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ো না।’ চলে গেলেন তিনি।

বাইরে গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ উঠল।

‘এখন কী করি?’ বলল মদিনা! ‘উহ্! কী যে গরম পড়েছে আজ, বাবারে বাবা!’

‘সত্যি,’ মুসা মন্তব্য করল। ‘গা চিড়বিড় করছে।’

‘আবহাওয়া বুলেটিনে বলেছে আরও কয়েকদিন এই অবস্থা থাকবে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ওরা।

‘চলো, মনোপলি খেলি,’ মুসা প্রস্তাব দিল।

‘নাহ্! ভাল্লাগে না,’ মদিনা উঠে পড়ল।

‘তা হলে?’

‘বাইরে কোথাও যাব ভাবছি,’ নানান শব্দ করে আড়মোড়া ভাঙল সে। ‘ঘরে মন টিকছে না।’

‘চলো তা হলে,’ মুসাও উঠল। ‘পেছনের বাগানে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসি।’

‘উঁহুঁ,’ মদিনা মাথা দোলাল।

বিস্মিত হলো ও। ‘ঘরেও থাকবে না, বাইরেও যাবে না, তা হলে করবে কী?’

‘বাইরেই যাব, তবে বাগানে নয়।’

‘তা হলে?’ বিস্ময় আরও বাড়ল মুসার।

মদিনা এর মধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করে দিয়েছে। ‘আর কোথাও যাব।’

‘কোথায়?’ শঙ্কিত হয়ে উঠল ও। মামা না বলেছেন বাসার বাইরে যাওয়া চলবে না?’

‘ভয় পেয়ো না, বেশি দূরে কোথাও যাচ্ছি না,’ মদিনা বলল। আয়নার মধ্য দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মিটিমিটি।

‘মিউজিয়াম!’

‘এই তো ঠিক ধরেছ। তোমার বুদ্ধি আছে স্বীকার করতেই হবে।’

‘কোথায় যেতে চাও বলবে, না বসে বসে কার কত বুদ্ধি তা-ই ওজন করবে?’

‘মিউজিয়ামেই যাব। জায়গাটা কাছেই।’

‘চলো তা হলে,’ দ্বিগুণ উৎসাহ দেখাল মুসা। ও চাইছে মদিনাকে দিয়ে নির্দেশ অমান্য করিয়ে আজ আরেকবার বকা খাওয়াবে। কালকের ভয় দেখানোর প্রতিশোধ নেবে আজ। নিষেধ করার পরও বাইরে যাওয়ার বুদ্ধিটা যে মেয়ের মাথা থেকে বেরিয়েছে, তা বুঝতে দেরি হবে না মামার। তিনি তাঁর মেয়েকে ভালই চেনেন।

‘কী ব্যাপার?’ চোখ কোঁচকাল মদিনা। তোমাকে যেন বেশি বেশি উৎসাহী মনে হচ্ছে?’

মুসা চেহারায় নিরীহ ভঙ্গি করল। ‘তুমিই না বললে…’

‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কালও পিরামিড ঘুরে দেখার বুদ্ধি আমিই দিয়েছি। কিন্তু কই, কাল তো এত সহজে তুমি রাজি হওনি।’ ভুরু নাচাল মদিনা। ‘ব্যাপার কী!’

‘কিছুই না,’ বলল মুসা। ‘যাবে কি না তা বলো।’

চুল পনিটেইল করে বেঁধে ঘুরে দাঁড়াল মদিনা। ‘চলো।’

‘আমাদের উচিত মামাকে একটা চিঠি লিখে রেখে যাওয়া,’ মুসা বলল। ‘উনি এসে যদি দেখেন আমরা নেই, আবার রেগে যেতে পারেন।’

‘রাগবেন না। মিউজিয়াম তো কাছেই, তা ছাড়া রাস্তা পিরামিডের টানেলের মত গোলকধাঁধা নয় যে পথ হারিয়ে ফেলব।’

‘কিন্তু …’

‘তুমি এক আজব ছেলে, মুসা। মিউজিয়ামে যেতেও ভয়?’

‘না, তা নয়। বলছি চিঠি লিখে রেখে গেলে সবচেয়ে ভাল হত। মামা চিন্তা করতেন না।’.

‘ঠিক আছে, তুমিই লেখো তা হলে।’

‘না, না! তুমি লেখো।’

কাগজ-কলম নিয়ে খখস্ করে দুই লাইন লিখল মদিনা। কাগজটা প্যাড থেকে ছিঁড়ে ড্রইং রুমের সেন্টার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখল। ওটা সহজেই চোখে পড়বে।

এই ফাঁকে মুসা নিজের চুল আঁচড়ে তৈরি হলো। মদিনাকে ফাঁদে ফেলতে পেরে মনে মনে হাসল মুসা। নিজ হাতে চিঠি লিখেছে মদিনা, কাজেই নির্দেশ অমান্য করার দুঃসাহস কার, তা মামা বুঝে নেবেন।

সাত

বাইরে রোদের এত তেজ, ভাবতেই পারেনি মুসা। মনে হচ্ছে কে যেন শত্রুতা করে সারা গায়ে বিছুটি পাতা ডলে দিয়েছে। সারা গা চিড়বিড় করছে, চুলকাচ্ছে। গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল ওরা। কড়া রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে হাত তুলে রাখল কপালে।

রাস্তায় প্রচুর মানুষ। তেমনি শব্দ। মুসার মনে হচ্ছে ভুল করে ঢাকার গুলিস্তানে এসে পড়েছে ও। সব গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে। থামছে না কেউ। একেক গাড়ির একেকরকম হর্ন। বিচিত্র শব্দ-তরঙ্গে কানে তালা লেগে যাওয়ার দশা।

এ দেশের ড্রাইভারদের গাড়ি চালাবার ঢংই আলাদা। যাত্রা করা মাত্র হর্ন বাজাতে শুরু করে, গন্তব্যে না পৌছানো পর্যন্ত থামে না। বাজাতেই থাকে।

মুসা আর মদিনা হাত ধরাধরি করে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে। দেশি- বিদেশি কত ধরনের মানুষ, নানা রঙের চামড়া। স্থানীয়দের পরনের ঢিলা ঢালা পোশাক। বিদেশিরা পরে আছে সুট। রাস্তায় স্কার্ট-জিন্স পরা প্রচুর মেয়ে আছে, আছে বোরখা পরা মহিলারাও।

মুসা ঘুরে ঘুরে স্থানীয়-অস্থানীয়দের দেখছে কৌতূহলী চোখে। বিচিত্র ভাষায় কথা বলছে তারা। ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিশ, আরও কত কী!

কয়েক মিনিটে কায়রো মিউজিয়ামের বিশাল ভবনের সামনে পৌছে গেল ওরা। গুরুগম্ভীর চেহারার প্রাচীন এক ভবন। পাথরে তৈরি। অনেকটা জায়গা নিয়ে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার।

পাথরের অনেকগুলো চওড়া ধাপ পেরিয়ে মিউজিয়ামের সামনের খোলা বারান্দায় উঠতে হয়। মুখ তুলে সিলিঙ দেখল ওরা। ওটা এত ওপরে যে মনে হলো আকাশে গিয়ে ঠেকেছে।

‘চমৎকার জায়গা!’ ফিফিস্ করে মুসা বলল। ‘কোনও হই-চই নেই, ভিড় নেই।’

সত্যিই তা-ই। একদম শান্ত, নিরিবিলি। গাড়ির হর্নের যন্ত্রণায় অস্থির কান একটু জিরিয়ে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

‘যাক্ বাবা,’ মদিনা বলল। ‘ভাল সময়ে এসেছি। বিকেল বেলা হলে ভিড় থাকত।’

মিউজিয়ামের বিশাল কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল ওরা, প্রকাণ্ড লবির মাঝখানে এসে চারদিক নজর বোলাল। লবির দু’দিকে দুটো পাথরের সিঁড়ি। যা কিছু দেখার ওপরে। ডানদিকের বিশাল দেয়ালের পুরোটা জুড়ে আছে এক মুরাল চিত্র। আকাশ থেকে নীল নদ ও পিরামিড যেমন দেখা যায়, তার প্রতিচ্ছবি। ওটার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরানো যায় না।

অনেকক্ষণ ধরে মুগ্ধ চোখে চিত্রটা দেখল ওরা। তারপর সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। ভিতরের সুনসান নীরবতা, পালিশ করা চক্‌চকে পাথরের মেঝেতে ওদের কেডসের মৃদু থপথপ আওয়াজ বেশ জোরালই শোনাল।

সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে ওপরে তাকাল দু’জন। মুসা এত দীর্ঘ সিঁড়ি আগে কোনওদিন দেখেনি। ওপরে পৌছতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে!

অর্ধেকটা উঠে জিরিয়ে নেয়ার জন্যে থামল ওরা। ‘খাইছে!’ মুসা বলে উঠল। মনে হচ্ছে পাহাড়ে চড়ছি।

‘চলো, বাকি পথ পাল্লা দিয়ে উঠি,’ প্রস্তাব দিল মদিনা। ‘দেখি কে আগে পৌঁছতে পারে।

কথা শেষ করতে না করতেই দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। প্রাণপণে তাড়া করেও হেরে গেল মুসা। হারারই কথা। ও শুরু করার আগেই মদিনা দশ ধাপ উঠে গেছে।

ওপরে পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রতিযোগিতা শুরু করার নিয়ম- কানুন সম্পর্কে বোনকে জ্ঞান দিতে যাচ্ছিল মুসা, কিন্তু থেমে গেল সামনে চোখ পড়তে।

সামনে বিশাল একটা রুম। এতই বড়, মনে হয় তেপান্তরের মাঠ। সিলিঙও আকাশছোঁয়া। হাতের ডানে বড় একটা কাঁচের শো-কেসে শোয়ানো আছে বিশাল একটা কাঠ ও চিনামাটির তৈরি ম্যাপ। ভবনের কোথায় কী আছে, তা দেখানো হয়েছে ওই ম্যাপে।

পাশে আরও একটা জিনিস আছে। পিরামিড কীভাবে তৈরি করা হয়েছে তা চিনামাটি দিয়ে দেখানো হয়েছে। দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে দেখছে মুসা। হাজার হাজার লিলিপুট সাইজের চিনামাটির শ্রমিক, তাদের তুলনায় হাজার গুণ বড় একেকটা চুনাপাথরের খণ্ড বালুর ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা একটা অসমাপ্ত পিরামিডের দিকে যাচ্ছে।

প্রাচীন মিশরীয়রা এত বড় পাথর কী করে উঁচুতে তুলেছিল, ভেবে অবাক হতে হয়। অনেকক্ষণ পর অন্যদিকে নজর দিল মুসা। অন্য সব সংগ্রহ ঘুরে দেখল ওরা।

বিশাল একেকটা পাথরের মূর্তি, মমির কফিন, কাঁচ ও চিনামটির তৈরি অদ্ভুত সুন্দর নকশা করা অজস্র ছোট-বড় জার, বড় বড় কাঁচের বাক্স ভর্তি চোখ ধাঁধানো অলঙ্কার, আরও কত কী!

দেখলে তাক লেগে যায়। জায়গা ছেড়ে নড়তে মন চায় না। যত দেখল ততই উত্তরোত্তর বিস্ময় বাড়ল মুসার।

পাশেই একটা পাথরের মূর্তি। আজব এক জন্তু, দেহটা সিংহের, মুখ ক্ষিপ্ত কুকুরের। জ্বলজ্বলে দু’চোখ মেলে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওটার ঠোঁট সরে দাঁত বেরিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হয় রাগে গজরাচ্ছে বুঝি। নিঃশব্দে। কেউ কাছে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। ছিঁড়ে ফেলবে কুটি কুটি করে।

ছবিতে এ ধরনের অদ্ভুত সব জন্তু অনেক দেখেছে মুসা। অতীতে পিরামিডের তলায় প্রতিটা সমাধির ভেতরে এ ধরনের বহু মূর্তি স্থাপন করা হত, চোর-ছ্যাচোরদের ভয় দেখাবার জন্যে। যাতে ওগুলোর ভয়ে মৃতদের মূল্যবান ধনরত্ন চুরি করতে সাহস না পায় কেউ।

‘ওগুলো কবরের পাহারাদার কুকুর,’ বলল মদিনা।

‘কী চেহারা!’ বিড়বিড় করে উঠল মুসা। ‘দেখলেই কলজের পানি ঠাণ্ডা হয়ে আসে।’

‘ঠিক বলেছ,’ সায় দিল মদিনা। একটু কাছে গিয়ে ভালমত লক্ষ করল জন্তুটাকে। ‘অ্যাই মুসা, এদিকে এসো।’

‘কী?’ মুখ না ঘুরিয়ে বলল ও।

‘একটা মমি।’

‘তা-ই?’ ওর দিকে এগিয়ে গেল সে।

মেঝেতে শোয়ানো একটা কফিনের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে মদিনা, মুসাও তার সঙ্গে যোগ দিল। ওটা বেশ ছোট। বড়জোর চার ফুট লম্বা হবে।

হলদে হয়ে আসা লিনেনে শক্ত করে মোড়া দেহটার দিকে চেয়ে থাকল ওরা। বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে মুসা বলল, ‘এত ছোট কেন এটা?’

‘মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষরা গলদা চিংড়ি সাইজের ছিল,’ একটু চুপ করে থাকল মদিনা। ‘এটা ছেলে ছিল, না মেয়ে?’

কফিনের সঙ্গে লাগানো মৃতের পরিচয় লেখা কার্ডটা পড়ল মুসা। .লেখা আছে ছেলে।’

‘বয়স্ক না বাচ্চা ছেলে?’

‘তা লেখা নেই।’

‘মৃতের দেহ সংরক্ষণে যেমন ওস্তাদ ছিল মিশরীয়রা,’ মদিনা বলল। ‘তেমনি ওস্তাদ ছিল দেহগুলো ব্যাণ্ডেজ দিয়ে প্যাচাতে। দেখো, কত হাজার বছরের পুরনো ব্যান্ডেজ, অথচ এখনও কেমন মজবুত। কোথাও একটুও ঢিলেঢালা ভাব নেই।’

ওর দিকে তাকাল মুসা। তুমি জানো ওরা কীভাবে মমি তৈরি করত?’

‘না,’ মাথা দোলাল সে। ‘তুমি জানো?’

‘জানি। আমার বন্ধু রবিন একটা বই দিয়েছিল, ওটায় পড়েছি।’

‘কী করে করত ওরা কাজটা?’ মদিনা আগ্রহী হয়ে উঠল।

‘প্রথমে মৃতের মগজ বের করে নেয়া হত।’

চেহারা বিকৃত হয়ে উঠল মদিনার, শোনার আগ্রহ মিটে গেছে। ‘আর বলতে হবে না।’

‘আরে শোনোই না, মজার ব্যাপার।’

‘না, প্লিজ! শুনতে চাই না।’ :

গম্ভীর হয়ে মুসা বলল, ‘প্রশ্নটা যখন করলেই তখন শুনতেই হবে। ওরা প্রথমে মৃতের মগজ বের করে নিত বিশেষ কায়দায়। এ-কাজের জন্যে বিশেষ যন্ত্রপাতি ছিল। লম্বা হুকের মত দেখতে, লোহার তৈরি। ওই জিনিস নাকের মধ্যে ভরে হুকের মাথা মগজ পর্যন্ত পৌছানোর জন্য আস্তে আস্তে চাপ দেয়া হত। তারপর খোঁচাতে শুরু করত ওরা যতক্ষণ না মগজ গলে পানি হয়ে যায়।

ঘৃণায় মদিনা শিউরে উঠল। চোখ বুজে দু’হাতে কান ঢাকল ও। ‘প্লিজ, মুসা! থামো!’

শুনেও না শোনার ভান করল ও। ‘তারপর হুক বের করে লম্বা হাতলওয়ালা সরু একটা চামচ ভিতরে ভরে দিয়ে একটু একটু করে বের করে আনত গলা মগজ।

হাত দিয়ে ব্যাপারটা অভিনয় করে দেখাল মুসা। ‘এইভাবে বের করে আনত, বুঝলে? কফিতে ঢালার জন্যে তুমি যেমন বয়েম থেকে চিনি বের করো, প্রাচীন মিশরীয়রা তেমনি নাক দিয়ে ওসব বের করে আনত। তাতে সুবিধে না হলে একটা চোখ উপড়ে নেয়া হত মৃতের, তারপর কোটরের গর্ত দিয়ে….

‘মুসা, থামবে তুমি!’ পরিবেশ ভুলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মদিনা। চেহারা দেখে ভয় হলো, এখনই বুঝি পেটের সব উগরে দেবে।

‘আচ্ছা, বেশ,’ নিরীহ ভঙ্গি করে মাথা ঝাঁকাল মুসা। ‘তুমি নিজেই শুনতে চাইলে বলে…’

‘থাক্, বলেছি তো আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না।

শ্রাগ করল মুসা। মনে মনে হাসছে। ‘এ-দেশে জন্ম তোমার, অথচ এসব সম্পর্কে জানো না, কী আশ্চর্য!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি। এবার থামো।’

‘রাখো, আরেকটু আছে।’

‘পকেটে রেখে দাও,’ দ্রুত বলে উঠল মদিনা।

‘ইতিহাস জেনে রাখা উচিত,’ মুসা হাসল। ‘সবসময় এসব পদ্ধতিতে কাজ হত না। তখন মৃতের গলা কেটে মুণ্ডু আলাদা করে ফেলা হত, তারপর…’

‘মুসা!’

দেখল ও একটু একটু করে ফ্যাকাসে হয়ে উঠছে মদিনা। অবস্থা সত্যি সত্যি খারাপ ওর, ভাবল মুসা। এবার থামা উচিত।

‘এমা! কী জঘন্য পদ্ধতি,’ মদিনা বলল।

‘দেহ সংরক্ষণ করার আর কোনও উপায় ছিল না।’

‘হুঁহ্!’ অস্ফুটে বলল ও।

‘মৃতদের…’ মদিনাকে বিস্মিত চোখে আরেকদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে থেমে গেল ও। মুসাকে দেখছে না সে, দেখছে ওর পেছনের আর কাউকে। দু’চোখে বিস্ময়ের ছাপ।

মদিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘুরে তাকাল মুসা।

এক লোক দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির গোড়ায়। এইমাত্র ওপরে উঠেছে। মিউজিয়ামের ম্যাপের কেসটার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনকে দেখছে। তাকে চিনতে মুসার কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল।

মামুন হাশমি!

মামার সহকারী, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই মেয়েদের মত লম্বা চুলঅলা যুবক। মুখে কথা নেই। নির্বাক। আজ নিয়ে দু’বার দেখল ওরা হাশমিকে। প্রথম দেখা হয়েছে গত কাল, পিরামিডে।

যুবক একই পোশাক পরে আছে আজও। সাদা ঢোলা প্যান্ট, সাদা শার্ট। গলায় সিল্কের স্কার্ফ। দু’হাত বুকে বেঁধে একভাবে মুসা ও মদিনার দিকে তাকিয়ে আছে গম্ভীর মুখে। তার চাউনি ভাল ঠেকল না ওদের। রেগে আছে যেন হাশমি। ঘাবড়ে গেল ওরা দু’জন। লোকটা ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন?

মদিনার এক হাত মুঠো করে ধরল মুসা। হাশমির চোখে চোখ রেখে সাবধানে এক পা পিছাল। চোখজোড়া সঙ্কুচিত হয়ে উঠল হাশমির। সে-ও এগোল এক পা। যেন মাঝের দূরত্ব বাড়তে দেবে না।

মুসা,’ ফিফিস্ করে বলল মদিনা, ‘লোকটাকে সুবিধের মনে হচ্ছে না।’

‘আমারও না,’ সায় দিল মুসা।

‘ও বোধহয় আমাদের ধরতে এসেছে।’

‘কিন্তু কেন?’

‘জানি না, চলো, পালাই।’

ইতস্তত করল মুসা। কেন শুধু শুধু ওদের ধরতে আসবে মামুন হাশমি? ওরা তার কী ক্ষতি করেছে?

‘মুসা, চলো!’ উত্তেজনায় চড়া গলায় বলে উঠল মদিনা। ওর মতলব খারাপ।

যুবকের ক্রুদ্ধ চাউনি দেখে নিশ্চিত হলো মুসা। ‘চলো।’

একযোগে ঘুরে দাঁড়াল ওরা। দ্রুত পা চালাল ও-মাথার সিঁড়ি লক্ষ করে। কয়েক পা এগোতে না এগোতে পেছনে ভারী পায়ের আওয়াজে ঘুরল দু’জন। দৌড়ে এদিকেই আসছে যুবক।

কী যেন বলল সে চেঁচিয়ে, মুসা বুঝতে পারল না। গলার স্বর রূঢ়, হুমকিপূর্ণ। মনে হলো দাঁড়াতে বলছে।

‘দৌড় দাও!’ মদিনা চেঁচিয়ে উঠেই ছুটতে শুরু করল।

মুসাও দৌড় লাগাল। মার্বেল পাথরের মেঝেতে তিন জোড়া ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ উঠল। ঝেড়ে দৌড় লাগাল দু’ভাই-বোন।

কফিন-মূর্তি ইত্যাদির মধ্যে এঁকেবেঁকে ছুটছে প্রাণের তাগিদে। পেছনে মামুন হাশমির পায়ের আওয়াজ ক্রমেই এগিয়ে আসছে। পূর্ণ এক যুবক সে, তার সঙ্গে দৌড়ে ওরা পারবে কী করে? তবে হাল ছাড়তে রাজি নয় মুসা ও মদিনা-প্রাণপণে ছুটছে। পালিশ করা মেঝেতে কেসের ঘষার কিচকিচ্ আওয়াজ উঠছে।

‘থামো!’ মোটা গলায় হাঁক ছাড়ল হাশমি। ‘ফিরে এসো!’

বুনো মোষের মত ভোঁশ-ভোঁশ নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। তার জুতো কিকিচ্ আওয়াজ তুলছে আরও জোরে।

‘থামো!’ রাগে বিস্ফোরিত হলো সে। উঁচু সিলিঙের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে বিকট প্রতিধ্বনি তুলল তার হাঁক।

‘ও…ও ধরে ফেলবে আমাদের,’ মুসা কোনওমতে উচ্চারণ করল। ‘আরও জোরে, মদিনা।’

‘চেষ্টা তো করছি,’ তটস্থ কণ্ঠে বলল মদিনা। ‘পারছি না।’

ওরা বেশ অনেকক্ষণ দৌড়েও সিঁড়ির দেখা পেল না। হঠাৎ মুসা এর কারণ বুঝতে পারল। এঁকেবেঁকে ছুটতে গিয়ে পথ ভুল করে অন্যদিকে চলে এসেছে ওরা, সিঁড়ির দিকে যায়নি। এজন্যেই সিঁড়ির দেখা নেই।

ভুল যা হবার হয়ে গেছে, হতাশ হয়ে ভাবল মুসা।

এখন আর শোধরানোর উপায় নেই। দেরি হয়ে গেছে। ওদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের নিরেট দেয়াল। সিঁড়ি নেই। দরজা নেই। এ ফাঁদ থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।

তবু পাগলের মত কয়েকবার ওরা উদ্ধার পাওয়ার আশায় এদিক- ওদিক করল। কিন্তু ছোটাছুটিই সার হলো।

আর উপায় নেই।

পাহাড় সমান উঁচু স্ফিঙসের প্রতিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা ও মদিনা। হাঁপাতে লাগল ঝড়ের বেগে।

চোখ তুলতেই হাশমিকে একদম সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।

বিজয়ীর দৃষ্টিতে ওদের দেখছে সে।

ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।

আট

ওদের তিন হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মামুন হাশমি। কামারের হাপরের মত শব্দ করে হাঁপাচ্ছে। হাঁ করে দম নিচ্ছে। চাউনি বদলে গেছে, দু’চোখে যেন আগুন ঝরছে।

মুসার দিকে তাকাল মদিনা। রক্ত সরে গিয়ে মরার মত ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে ওর চেহারা। ভীষণ ভয় পেয়েছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

সশব্দে ঢোক গিলল মুসা। চৈত্র মাসের খটখটে জমির মত শুকিয়ে আছে গলা। হাত বাড়াল ও। মদিনার হাত শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল। হাতের শিরা দপদপ করে লাফাচ্ছে ওর।

কী চায় লোকটা? মুসা ভাবছে।

সে কি ওদের পিছু নিয়েছে?

‘তোমরা দৌড় দিলে কেন?’ গমগমে কণ্ঠে জানতে চাইল হাশমি। তার গলা শুনে চমকে উঠল মুসা ও মদিনা। কী কৰ্কশ!

কেউ জবাব দিল না। ও চোখে তাকিয়ে আছে যুবকের দিকে। ভয় হচ্ছে এখনই বুঝি সে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের ওপর।

‘কেন দৌড় দিলে?’ ধমকে উঠল হাশমি।

জবাব নেই।

সে মদিনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার বাবার মেসেজ নিয়ে এসেছি।’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল। ‘কেন এসেছি না জেনেই দৌড় দেয়ার মত কী দেখলে তোমরা?’

এতক্ষণে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরল দু’ভাই বোনের। ‘মেসেজ।’ মদিনা বলল। ‘কীসের মেসেজ?’

‘হ্যাঁ, মেসেজ, পরের প্রশ্নটা মনে হলো ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেল হাশমি। ‘তোমরা আমাকে চেনো, গতকাল পরিচয় হয়েছে আমাদের। তবু কেন দৌড় দিলে বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘দুঃখিত,’ মদিনা বলল। বোকা বোকা চোখে মুসার দিকে তাকাল এক পলক। ‘বুঝতে পারিনি…’

‘কী বুঝতে পারোনি?’ বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল যুবক।

মদিনাকে উদ্ধার করতে মুসা মুখ খুলল, ‘আমরা মমি নিয়ে কথা বলছিলাম। এই সময় হঠাৎ আপনাকে দেখে জ্যান্ত মমি ভেবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছি….

‘হ্যাঁ,’ মুসার চালাকি বুঝতে পেরে সায় দিল মদিনা। ‘ও অনেকক্ষণ থেকে মমি নিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল। হঠাৎ এমন সময় আপনাকে দেখে ঘাবড়ে যাই। সরি। কিছু মনে করবেন না।’

পালা করে ওদের দু’জনকে দেখল হাশমি। চেহারায় বেশ লজ্জা পাওয়া ভাব ভাইবোনের। ওরা যে ভুল বুঝেছে, সে কথা একযোগে বারবার প্রকাশ করছে। নরম হলো যুবক।

‘তোমার বাবা তোমাদের নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন আমাকে,’ বলল সে। দৃষ্টি মদিনার ওপর স্থির। ‘খবরটা দিতে এসে যে এমন শেয়াল দৌড় দিতে হবে, আমিও তা আগে ভাবিনি।’

‘আমরা দুঃখিত,’ একযোগে বলল মদিনা ও মুসা।

নিজেকে আস্ত একটা গবেট মনে হলো মুসার। ছি ছি, কী দরকার ছিল দৌড় দেয়ার? লোকটা ওদের কী ভাবছে কে জানে!

‘বাবা হসপিটাল থেকে ফিরেছেন?’ বলল মদিনা।

‘হ্যাঁ,’ ওপর-নীচে মাথা দোলাল হাশমি।

‘মামা মদিনার নোট দেখে আপনাকে পাঠিয়েছেন?’

মুসার প্রশ্নের জবাব দিল সে নীরবে মাথা দুলিয়ে।

‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?’ নিজের ছোট্ট হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে আপনমনে বলে উঠল মদিনা।

‘হ্যাঁ,’ মামুন হাশমি নিজেও হাতঘড়ি দেখল। ‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্রফেসর অপেক্ষা করছেন।’ ঘুরে পা বাড়াল।

ওরা তাকে নীরবে অনুসরণ করল। পাশাপাশি হাঁটছে। সিঁড়ির মাঝপথে পৌঁছে মদিনার দিকে তাকাল মুসা। সে-ও তাকাল ওর দিকে। দারুণ লজ্জা পাওয়া চেহারা দু’জনেরই। অনর্থক পালাবার চেষ্টা করে হাশমির কাছে নিজেদের ভীরু, বোকা প্রমাণ করেছে ওরা।

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে ফুটপাথের জনস্রোতে পড়ল ওরা। হাশমি আগে আগে হাঁটছে। গরম, মানুষের কোলাহল আর গাড়ির হর্নের আওয়াজে যা-তা অবস্থা। আগুনের গোলার মত সূর্যটা প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে। রোদের তেজে গা জ্বালা করছে ওদের।

‘এই যে!’ ডেকে উঠল মুসা। ‘দাঁড়ান।’

কাঁধের ওপর দিয়ে ঘুরে তাকাল মামুন হাশমি, কিন্তু দাঁড়াল না। চোখে প্রশ্ন।

‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?’ বলল ও। ‘বাসা তো এদিকে।’ হাত দিয়ে উল্টো দিক দেখাল।

‘জানি,’ মাথা ঝাঁকাল যুবক। ‘কিন্তু আমার গাড়ি ওদিকে রেখে এসেছি। চলে এসো।’

‘গাড়ি!’ বিস্মিত হলো মদিনা। ‘এই সামান্য পথ যেতে গাড়ির কী দরকার? হেঁটেই তো যাওয়া যায়।’

‘হ্যাঁ,’ মুসা সায় দিল। ‘তাই তো! আমরা না হয় হেঁটে যাই, আপনি গাড়ি নিয়ে আসুন।’

পিছিয়ে এসে ওর কাঁধে এক হাত রাখল সে। ‘কোনও অসুবিধে নেই,’ বলে আরেক হাত মদিনার কাঁধে রাখল। ‘গাড়ি যখন আছেই সঙ্গে, কেন শুধু শুধু হাঁটতে যাবে? যা গরম পড়েছে! এসো।

ভিড় ঠেলে এগোল ওরা তিনজন। মুসা ও মদিনার কাঁধ থেকে হাত সরায়নি যুবক। বেশ অযাচিতভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, কিন্তু ব্যাপারটা খেয়াল করল না ওরা। রাস্তা পার হয়ে হেঁটে বেশ কিছুদূর এগোল, কিন্তু হাশমির গাড়ির দেখা নেই।

বিরক্ত হলেও মনের ভাব চেপে মদিনা মন্তব্য করল, ‘সেই হাঁটাই তো হাঁটলাম, তবে উল্টোদিকে। গাড়ির খোঁজে না এলে এতক্ষণে বাসায় পৌঁছে যেতাম।’

ওদের কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে আবার ঘাম মুছল হাশমি। হাসল। ‘এই তো, এসে গেছি।’

সত্যি তা-ই। আট-দশ কদম এগিয়ে একটা পার্ক করা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চার দরজার এক স্টেশনওয়াগন ওটা। ছোট। ধুলোর পুরু চাদর মুড়ি দিয়ে আছে গাড়িটা। সামনে, ড্রাইভারের দিকের ফেন্ডার তুবড়ে ভেতরদিকে দেবে আছে খানিকটা। কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল বোধহয়।

পেছনের দরজা খুলে দিল মামুন হাশমি। ‘ওঠো।’

মুসা আগে উঠল। চামড়ামোড়া সীটে বসেই সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। ‘উ-উ-উ! কী গরম রে বাবা!’ হাত দিয়ে জোরে জোরে পেছনদিক ডলল। ‘উহ্, ছ্যাঁকা লেগেছে!’

‘সরি,’ হাশমি বলল। ‘চামড়ার সীট তো!’

মুসার লাফ দেখে নিঃশব্দে হাসল মদিনা। হাত দিয়ে সীট ঝেড়েমুছে সাবধানে আলতো করে বসল। হাশমি বসল চালকের আসনে। বসেই ‘উহ্!’ করে উঠল। ‘সত্যিই খুব গরম হয়ে আছে।’

হাসিমুখে পেছনে তাকাল সে সীট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে। ‘গাড়ি তৈরির কারখানাগুলোকে আফ্রিকার জন্যে বিশেষ গাড়ি আবিষ্কার করার কথা বলতে হবে।’ যেন আপন মনে বলল সে।

দ্বিতীয় চেষ্টায় স্টার্ট নিল স্টেশনওয়াগন। চলতে শুরু করল। একই সঙ্গে হর্ন টিপে ধরল হাশমি। মুসা ও মদিনা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পথ করে এগোচ্ছে গাড়ি।

‘বাবা নিজেই কেন এলেন না বুঝতে পারছি না, ধুলোমোড়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মদিনা বলল। ‘কী দরকার ছিল অনর্থক আপনাকে পাঠানোর?’

‘তাতে কী?’ বলল যুবক। আমাকে এমনিতেই আসতে হত।’

বুঝতে না পেরে সামনে তাকাল মদিনা। ‘মানে?’

জবাব দিল না সে। বাঁক নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে গতি বাড়িয়ে দিল। বেশ দ্রুত ছুটছে এখন গাড়ি।

ওরা যে অচেনা পথ দিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছে, ব্যাপারটা টের পেতে বেশ সময় লাগল মদিনার। বিস্মিত চোখে এদিক-ওদিকে তাকাল সে। সব অচেনা লাগছে।

‘মিস্টার হাশমি, আমরা বোধহয় ভুল পথে যাচ্ছি,’ বলল ও। ‘এটা আমাদের বাসার রাস্তা নয়।’

হাসি ফুটল যুবকের মুখে। ‘তোমারই ভুল হয়েছে। আমরা ঠিক পথেই চলেছি।’

‘না,’ জোর দিয়ে মদিনা বলল। ‘আমার ভুল হয়নি।’

মুসা ঘুরে তাকাল। মদিনার চেহারায় উদ্বেগের ছাপ দেখতে পেল। ‘সত্যি না কী?’ মদিনাকে প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ।’

‘তোমরা সীট বেল্ট বেঁধেছ?’ হাশমি শান্ত গলায় বলল। ‘না বেঁধে থাকলে এখনই বেঁধে নাও। আমি জানি কোন্ পথে তাড়াতাড়ি জায়গামত পৌছানো যায়।’

তার হাসি, কথা-সব কেমন হুমকির মত শোনাল মদিনার কানে। ব্যস্ত হয়ে উঠল ও। ‘মিস্টার হাশমি, গাড়ি রাখুন! আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি।’

সাড়া নেই যুবকের। গাড়ির গতি কমারও কোন লক্ষণ নেই। সোজা ছুটছে চওড়া হাইওয়ে ধরে। দু’পাশের বাড়িঘর ক্রমে পাতলা হয়ে আসছে। উঁচু দালানগুলো আর চোখে পড়ছে না।

হাশমি ওদের নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে!

‘বলেছি তো চুপ করে বসে থাকো, আগের মতই শান্ত কণ্ঠে বলল সে। ‘আমি জানি কোন্ দিকে যাচ্ছি। সীট বেল্ট বাঁধো।’

মুসা ও মদিনা ভয়ে ভয়ে এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। বুঝে ফেলেছে মামার সহকারী কী জন্যে ওদের গাড়িতে এনে তুলেছে।

ওদের অপহরণ করেছে সে। নিয়ে চলেছে অচেনা কোথাও।

বাঁক নিল গাড়ি। আবার ছুটল। বেশ কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল দু’পাশে দালানকোঠার পরিমাণ বাড়ছে। গাড়িঘোড়া, মানুষের কোলাহল বাড়ছে।

নিশ্চয়ই অন্য কোনও শহরে নিয়ে এসেছে ওদের হাশমি।

কোন্ শহর এটা? কী নাম? অস্থির হয়ে ভাবছে মুসা।

নয়

রিয়ারভিউ মিররে চোখ পড়ল মুসার। দেখল হাশমি ওটার ভেতর দিয়ে একদৃষ্টে ওকেই দেখছে। তার সাপের মত স্থির চাউনি দেখে মনে মনে আঁতকে উঠল ও। তাড়াতাড়ি সীট বেল্ট টেনে নিয়ে যেন বাঁধছে, এমন ভাব দেখাল।

আয়না থেকে হাশমি চোখ সরাতে মুখ নিচু করে মদিনার উদ্দেশে ফিসফিস করে বলল, ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলেই দরজা খুলে লাফ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তারপর কপালে যা আছে হবে। চেহারা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করো।’

‘ঠিক আছে,’ মদিনাও বেল্ট বাঁধার ভান করল। তারপর চুপ করে সামনে তাকিয়ে থাকল।

বুকের মধ্যে ভয় আর উৎকণ্ঠার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, অথচ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ওরা। ভাবটা এমন, হাশমি যে ঠিক পথেই চলেছে তাতে কোনওই সন্দেহ নেই ওদের।

‘সাবধান!’ আবার সতর্ক করল মুসা। ‘ডোর হ্যাণ্ডেল কোথায় আছে দেখে রাখো, প্রথম চোটেই ওটা থাবা দিয়ে ধরতে হবে। ভুলে আবার কাঁচ ওঠানো-নামানোর হাতল ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়ো না। তা হলে দেরি হয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা,’ আড়চোখে জিনিসটার অবস্থান দেখে নিল মদিনা। অবাক হলো আজ এই কঠিন বিপদে মুসা সাহস হারায়নি। অথচ কাল পিরামিডের টানেলে কী ভয়টাই না পেয়েছিল ও।

ব্যাপারটা নিয়ে মুসা নিজেও মাথা ঘামাচ্ছে। ওরও বেশ আশ্চর্য লাগছে। ছেলেমানুষ, সীমিত জ্ঞান, তাই বুঝতে পারছে না এসব ঘটে আলো-আঁধারের কারণে। আঁধারে মানুষ ছোটখাট ব্যাপারেও ভয় পেয়ে যায়, অথচ দিনের আলোয় সহজে অনেক বড় সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে।

নীরবে বসে আছে ওরা। উত্তেজনায় ভিতরে ভিতরে টানটান হয়ে আছে। এরমধ্যে দু’পাশে ঘরবাড়ি, মানুষের সংখ্যা আরও বেড়েছে। গাড়ির গতি বেশ কম এখন। আরও কমে এল। মুসা সামনে তাকাতে বুকের মধ্যে নিঃশব্দ উল্লাস অনুভব করল।

সামনের ট্রাফিক পোস্টে লাল আলো জ্বলছে। তার মানে হাশমি এখন গাড়ি দাঁড় করাতে বাধ্য। শামুকের গতিতে আরও গজ বিশেক এগোল ওরা, তারপর মৃদু দোল খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। সামনে অজস্র গাড়ি।

‘লাফ দাও!’ বলেই এক ঝটকায় নিজের দিকের দরজা খুলে ফেলল মুসা। প্রায় একই সঙ্গে নড়ে উঠল গাড়ির মিছিল। এক লাফে বেরিয়ে পড়ল ও রাস্তায়। পেছন থেকে অনেকগুলো হর্ন ধমকে উঠল, রাস্তা থেকে সরে যেতে বলছে।

হাশমির বিস্মিত চিৎকার ও মদিনার দরজা খোলার শব্দ একই সঙ্গে কানে এল মুসার। ওর সামান্য পরে হলেও নিরাপদেই নেমে আসতে পেরেছে মদিনা। নেমেই দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা। মুসা সে-সবের ধারেকাছেও গেল না। ওর দিকের দরজা খোলাই থাকল।

বোনের হাত ধরে টান দিল সে। ধীরগতির গাড়ির স্রোতের মধ্যে দিয়ে তাড়া খাওয়া খরগোশের মত লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলল দু’জন। একযোগে হর্ন বাজাচ্ছে অসংখ্য গাড়ি, তবু ঘাবড়াল না। ওরা চলমান গাড়ির নাকের সামনে দিয়ে ছুটে রাস্তা পার হলো। অনেকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।

ফুটপাথে মুহূর্তের জন্যে উঠে ঘুরে তাকাল মুসা। না, হাশমিকে দেখা যাচ্ছে না। ওদের তাড়া করেনি সে। একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়ল দু’জন। ভিড়ের চাপে ভিতরে পা রাখা যায় না। এটা নিশ্চয় কোনও বাজার। দু’পাশে নানান ফল আর সবজির দোকান। দরদাম করছে মানুষ।

কোনওদিকে নজর দেয়ার সময় নেই মুসা আর মদিনার। ভিড় ঠেলে পথ বের করে সামনে এগোচ্ছে। ঘামছে দরদর করে। ভেজা মুখ আয়নার মত চক্‌চক করছে।

‘হাশমি… হাশমি আসছে নাকি?’ কোনওমতে বলল মদিনা।

জবাব দেয়ার আগে মুসা আরেকবার পেছনটা দেখে নিল। ‘না। দেখা যাচ্ছে না ওকে।’

তবু থামল না ওরা। দৌড়াতে থাকল। এত ভিড়, এরমধ্যে কাউকে চেনা কঠিন। বলা যায় না হাশমি হয়তো ধারেকাছেই আছে, ওদের পাকড়াও করতে আড়ালে আড়ালে এগিয়ে আসছে। দৌড়ের ফাঁকে মাঝে মাঝে পেছনে তাকাচ্ছে ওরা। সাদা শার্ট-প্যান্ট পরা কাউকে দেখলে পালাতে হবে।

ওরা নিরাপদে গলির শেষ মাথায় পৌছে গেল। সামনেই বড় রাস্তা। গিগিজ্ করছে গাড়ি। তবে পায়ে চলা মানুষের ভিড় এখানে কম, কাজেই গাড়ি জোরেই চলছে। মানুষ চাপা দেয়ার ভয়ে বার বার ব্রেক চাপতে হচ্ছে না।

বিশাল এক ট্রাক ছুটে গেল ওদের সামনে দিয়ে। ওটার পেছনে অনেকগুলো ঘোড়াসহ একটা ট্রেইলার জোড়া আছে। ঘোড়াগুলো নির্বিকার চোখে দালান-কোঠা দেখতে দেখতে যাচ্ছে।

ফুটপাথ ধরে কিছুদূর হেঁটে এগোল মুসা ও মদিনা। অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে এখনও। শেষবারের মত আরেকবার পেছনে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে থামল। না, নেই মামুন হাশমি। বাঁচা গেল।

দম ফিরে পেয়ে হাসির ভঙ্গি করল মদিনা। ‘শয়তানটাকে খসিয়ে দেয়া গেছে।’

‘আর ভয় নেই,’ মুসা বলল। ‘উফ্! ঘুম থেকে উঠে কার মুখ যে দেখেছিলাম!’

কার আবার!’ ঝাঁঝিয়ে উঠল মদিনা। ‘নিশ্চয়ই নিজের মুখ দেখেছ…বাথরুমের আয়নায়।

মুসা খেয়াল করল না, ও অন্য কথা ভাবছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ঘন ঘন। ‘হাশমির হাত থেকে তো বাঁচলাম, কিন্তু এলাম কোথায়? বাসায় যাব কী করে?’

‘তা-ই তো!’ মদিনাও চিন্তায় পড়ল। ‘হারিয়ে গিয়েছি আমরা। এখন কী হবে?’ ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল।

চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুসার। ‘ইউরেকা! ‘

‘মানে?’

‘বুঝলে না? ইউরেকা একটা গ্রীক শব্দ, মানে পেয়েছি। বুদ্ধি পেয়েছি বাসায় যাওয়ার।’

‘কী?’

‘চলো খুঁজে দেখি ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড কোথায় আছে। ট্যাক্সি নিয়ে ফিরব। কায়রো যাব বললেই ড্রাইভার পৌঁছে দেবে। কী বলো?’

‘হ্যাঁ,’ মদিনা দ্রুত মাথা দোলাল। ‘আমিও তা-ই ভাবছিলাম।’

মুসা কপাল কোঁচকাল। ‘এরমধ্যেও জেতার চেষ্টা? কখন ভাবছিলে শুনি? আমি তো দেখলাম ভয়ে মাছের মত খাবি খাচ্ছিলে।’

ওর পাঁজর সই করে কনুই চালাল মদিনা। ‘জ্বি না, মদিনা এত সহজে ভয় পাওয়ার মেয়ে নয়।’

‘হ্যাঁ, তা ঠিক। আমার ক্যামেরা ফেলে এসেছি, নইলে গাড়ির ভেতর যে নূরানী চেহারা হয়েছিল তোমার, তার একটা ছবি তুলে রাখতাম।’

‘বাজে বোকো না তো, মুসা। চলো, ট্যাক্সি খুঁজতে হবে।’

ততক্ষণে আরেক সমস্যার কথা মনে পড়েছে মুসার, তাই নড়ল না ও।

‘কী হলো?’ দু’পা গিয়ে থেমে দাঁড়াল মদিনা।

‘একটা কথা মনে পড়েছে,’ বলল ও চিন্তিত মুখে।

‘কী?’

‘আমাদের হাতে একটা টাকাও নেই। ট্যাক্সি ভাড়া দেব কী করে?’

‘তা-ই তো!’ বলে কয়েক মুহূর্ত ভাবল মদিনা। হেসে উঠল। ‘কোনও সমস্যা নেই। বাসায় পৌঁছে বাবার কাছ থেকে নিয়ে দেব।

‘আচ্ছা,’ মুসা মাথা দোলাল। ‘চলো তা হলে। …কিন্তু মামা যদি এতক্ষণে বাসায় না এসে থাকেন?’

কোনও একটা উপায় খুঁজতে খুঁজতে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটতে লাগল ওরা। হঠাৎ মুসা বলল, ‘আচ্ছা, মদিনা, আমরা বাবুর্চির কাছ থেকে টাকা ধার নিতে পারব।’

‘চলো তা হলে।’

ফুটপাথ ধরে বেশ কিছুদূর যেতে পাওয়া গেল ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড। বেশ কয়েকটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাণ্ডে। মদিনা এগিয়ে গেল প্রথমটার দিকে। ওকে অনুসরণ করার ফাঁকে মুসা চারদিকে নজর বুলিয়ে নিল। জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে না? ভাবল ও, পর মুহূর্তে সে-সম্ভাবনা হেসে উড়িয়ে দিল। একে বিদেশ, তার ওপর এখন ওরা কোথায় আছে তা-ই জানা নেই, চেনা জায়গা হয় কী করে?

‘মুসা!’ ডাকল মদিনা।

‘অ্যাঁ?’

‘চলে এসো।’

ট্যাক্সির পেছনের দরজা ততক্ষণে খুলে ফেলেছে মদিনা। মাথা ঝাঁকাল। ‘ওঠো।’

ড্রাইভারের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল মুসা। এ-ও যুবক, শুকনো পাতলা দেহ। নাকের নীচে বেমানান চওড়া গোঁফ।

‘কায়রো মিউজিয়ামের কাছে যাব আমরা,’ তাকে বলল মদিনা।

বিমূঢ় চেহারা হলো ড্রাইভারের। ‘কোথায় বললে?’

‘কায়রো মিউজিয়ামের কাছে।’

‘কায়রো মিউজিয়াম!’

‘কানে কম শোনে নাকি?’ নিচু কণ্ঠে বলল মুসা।

মদিনা মাথা ঝাঁকাল। ‘হ্যাঁ, কায়রো মিউজিয়াম।’

লোকটা হা-হা করে হেসে উঠল

ওরা আহাম্মকের মত তাকিয়ে থাকল। ভেবে পাচ্ছে না এর মধ্যে লোকটা এত হাসির কী দেখল।

দশ

হাসছে লোকটা। ধারেকাছে আর যত ড্রাইভার ছিল, সবাই হাঁ করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

খপ্ করে মুসার হাত চেপে ধরল মদিনা। ‘লোকটা মনে হয় হাশমির হয়ে কাজ করছে,’ ফিফিস্ করে বলল। ‘ভুল করে ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি আমরা। আর রক্ষা নেই।’

এ কিছুতেই সত্যি হতে পারে না, ভাবল মুসা।

হুঁশ হলো মদিনার ধাক্কা খেয়ে। ‘জলদি নামো!’ বলল সে। ‘পালাতে হবে!’

এসময় ড্রাইভারের কথা বলার ক্ষমতা ফিরল। ‘মিউজিয়াম?’ বলল সে। ‘কায়রো মিউজিয়াম যাবে তোমরা?’ আঙুল তুলে রাস্তার ওপাশের বিশাল ভবনটা দেখাল। ‘ওই যে দেখো!’

তার নির্দেশিত ভবনটা দেখল ওরা।

দ্বিতীয়বারের মত তাকাল। বোকার মত তাকিয়ে থাকল।

এতবড় আহাম্মক কখনও হয়নি আগে মুসা-মদিনা, কেউ হয়েছে বলেও শোনেনি। রাস্তার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রকাণ্ড গুরুগম্ভীর চেহারার ভবনটা, অথচ ওদের কারও চোখেই পড়েনি। ভয়ে সব এমনই গুলিয়ে ফেলেছে! তা হলে হাশমি ওদের খুব বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারেনি। ওদিকে ড্রাইভার ফের হাসতে শুরু করেছে।

লজ্জায় নাক-মুখ লাল হয়ে উঠল মদিনার। ড্রাইভারের হাত থেকে না হয় বাঁচা যাবে, কিন্তু মুসার খোঁচার হাত থেকে কীভাবে বাঁচবে? বাড়ির কাছের এতবড় এক বিখ্যাত জায়গা চিনতেই পারেনি ও, এ কেমন কথা?

ওরা মুখ কাঁচুমাচু করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার,’ মুসা বলল। মদিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। এমনিতেই মুখ কালো হয়ে আছে মদিনার, মুসাকে হাসতে দেখে আরও কালো হয়ে উঠল।

‘এতে এত হাসির কী আছে, আমি বুঝি না,’ থমথমে গলায় বলল ও।

‘আমি হাসছি ড্রাইভার লোকটার কাণ্ড দেখে। ভুলটা সোজা ধরিয়ে দিলেই হত।’

বাসায় ফিরে অবাক হলো ওরা দু’জনেই। বিজ্ঞানী বাসায় নেই। মদিনার চিঠিটা তেমনি পড়ে আছে। উনি ফিরলে ওটা অবশ্যই টেবিলে পড়ে থাকত না। তা হলে?

ঝুঁকে চাপা দেয়া চিঠিটা তুলে নিয়ে মদিনা বলল, ‘বাবা ফেরেননি।’ কাগজটা দলা করে বল তৈরি করল। তার মানে হাশমি আগাগোড়া মিথ্যে বলেছে। সত্যিই আমাদের কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল ও।’

‘কেন?’ সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়ল মুসা। কপালে চিন্তার ভাঁজ। ‘আমাদের কিডন্যাপ করে তার কী লাভ? কেন এ-কাজ করবে সে, আমার মাথায় ঢুকছে না।’

ওর কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, আচমকা সশব্দে খুলে গেল সামনের দরজা। মুসা ও মদিনা চমকে গেল।

‘অ্যাই, কী হলো?’ ওদের অবস্থা দেখে থতমত খেয়ে গেলেন ডক্টর সায়েম মোর্শেদ। ভিতরে এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

‘বাবা!’ পরম স্বস্তি ফুটল মদিনার চেহারায়। ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল সে। ‘আমরা ভেবেছি বুঝি…’ থেমে গেল কথা শেষ না করে।

ওদিকে মামাকে দেখে মুসার পেশিতে টান পড়ল।

‘মামা, আজব ঘটনা…’

‘হ্যাঁ,’ বাধা দিয়ে বললেন তিনি। ‘ঘটনাটা সত্যি আজব।’ এক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সোফার দিকে এগোলেন তিনি। ধপ্‌ করে বসে পড়লেন সোফায়। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘ওরা দু’জনই কোনও কারণে খুব ভয় পেয়েছে। মানসিক আঘাত পেয়েছে। ডাক্তার তা-ই বললেন। কেন ভয় পেল ওরা, বুঝতে পারছি না।’

‘কোথায় ভয় পেয়েছে, মামা?’ প্রশ্ন করল মুসা। ‘পিরামিডের ভিতরে নাকি?’

জবাব দেয়ার আগে চোখ বুজে কিছুক্ষণ মাথা চুলকালেন তিনি। ‘তা-ও ঠিক বলতে পারছি না। জানতে পারিনি। কথাই বলছে না ওরা, একদম বোবা হয়ে গেছে। মনে হয় ওরা এমন কিছু দেখেছে যা ভয় পাওয়ার মত। নয়তো কেউ ইচ্ছে করে ভয় দেখিয়েছে। ডাক্তার নিজেও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।

‘বাবা!’ ডাকল মদিনা।

‘বলো।’

‘একটা জরুরী কথা বলব তোমাকে।’

‘কী কথা?’

‘তোমার সহকারী হাশমি….’ কথাটা কীভাবে শেষ করবে বুঝতে না পেরে থেমে গেল মদিনা।

‘কী, হাশমি কী?’

‘হাশমি আমাদের কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল।’

‘কী?’ ডক্টর মোর্শেদ চমকে উঠলেন। ‘কী বললে?’ চোখ সরু করে একবার মেয়ে, আরেকবার ভাগ্নেকে দেখলেন। ‘হাশমি কী করেছে?’

‘মদিনা ঠিকই বলেছে, মামা,’ মুসা বলল। ‘মামুন হাশমি আমাদের কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল। কাল যার সঙ্গে পিরামিডে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লোক। ভার্সিটিতে পড়ে।’

‘হ্যাঁ। কী করেছে সে?

‘আপনি তাকে পাঠিয়েছিলেন? সে মিউজিয়ামে গিয়ে…’

‘মিউজিয়াম!’ বোকার মত তাকিয়ে থাকলেন মামা।

‘হ্যাঁ, বাবা,’ মদিনা বলল এবার। বাসায় ভাল লাগছিল না বলে আমরা দু’জন মিউজিয়াম দেখতে যাই। ওই লোক ওখানে গিয়েছিল, বলল, তুমি নাকি…..

‘মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলে তোমরা?’ চেহারা পাল্টে গেল তাঁর। ‘আমি তোমাদের বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করিনি?’

‘বাসায় ভাল লাগছিল না, বাবা। ওটা কাছে বলেই সাহস করে দেখতে গিয়েছিলাম। মুসার খুব মমি দেখার ইচ্ছে ছিল, তাই।

ভাগ্নের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে মেয়ের ওপর স্থির হলো বিজ্ঞানীর চোখ। ‘তারপর?’

মদিনা বলল, ‘একটু পর হাশমি গিয়ে হাজির ওখানে। বলল, তুমি নাকি আমাদের নিয়ে আসতে পাঠিয়েছ।’

‘কিন্তু এদিকে না এনে গাড়িতে করে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছিল সে, যোগ করল মুসা। ‘সুযোগ পেয়ে আমরা পালিয়ে এসেছি।’

‘হাশমি!’ অবিশ্বাসের সুরে বললেন মামা। ‘হাশমি এমন কাজ করেছে! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’

‘হ্যাঁ, বাবা, সত্যি!’

‘কিন্তু … কী আশ্চর্য! ও এমন করবে কেন?’

ঘুরে ওদের দিকে তাকালেন তিনি। অন্যমনস্ক। ‘কায়রো ভার্সিটির এক প্রফেসর, আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাশমিকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। ওঁর কথায় হাশমিকে কাজে নিয়েছি। সেই ছেলে…’

‘ও তোমার সঙ্গে কী কাজ করত, বাবা?’

‘তেমন কিছু না। বেশির ভাগ সময় ও আসলে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকত। ক্রিপটোগ্রাফির ওপর পড়াশুনা করছে ও। প্রাচীন মিশরীয়দের দেয়াল লিখন নিয়ে গবেষণা…’ থেমে গেলেন তিনি।

‘কাল যখন পিরামিডে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন,’ মুসা বলল, ‘তখন তাকে কেমন যেন মনে হয়েছে আমার। সুবিধের মনে হয়নি। বেশ গম্ভীর ছিল।’

‘হাশমি ওরকমই,’ বললেন মামা। ‘কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না। তা অবশ্য দোষের কিছু নয়। মেধাবী ছাত্রদের একটু আধটু গাম্ভীর্য না থাকলে বরং বেমানান লাগে।’

‘তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমাদের কেন মিথ্যে বলে মিউজিয়াম থেকে বের করে আনল লোকটা?’ মদিনা বলল। ‘কেন গাড়িতে করে… বাবা! তোমার সঙ্গে হাশমির কোনও ঝগড়া হয়নি তো?’

‘নাহ্! এ-কথা কেন?’

‘না, এমনিই। ভাবছিলাম প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এসব করে থাকতে পারে।’

‘আজব কাণ্ড! দাঁড়াও, জানতে হবে ও কী চায়।’ উঠে পড়লেন মামা। ‘আমাকে পিরামিডে যেতে হবে। খুব জরুরি। না গেলেই নয়। দু’জন অসুস্থ হয়ে পড়ায় আজকের জন্যে অন্যদের ছুটি দিয়েছি। ওরা দু’জন কেন ভয় পেল জানতে হবে।’

বলতে বলতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ডক্টর মোর্শেদ। উঁকি দিয়ে দেখলেন আকাশে মেঘ জমেছে, ঢাকা পড়ে গেছে সূর্য। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে এল।

‘তোমরা দু’জন বাসায় থাকতে পারবে তো?’

‘না, বাবা!’ আঁতকে উঠল মদিনা। ‘তুমি যেয়ো না।’

‘কিন্তু আমার যে জরুরী কাজ আছে!’

‘তা হোক, আজ যেয়ো না।’

মুসা বলে উঠল, ‘না হয় আমাদেরও নিয়ে চলুন।’

‘হ্যাঁ,’ লাফ দিয়ে উঠে পড়ল মদিনা। ‘সেটাই ভাল হবে।’

এপাশ-ওপাশ মাথা দোলালেন বিজ্ঞানী। ‘ওখানে কী ঘটছে না জেনে তোমাদের নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বিপদ ঘটে যেতে পারে।’

‘কিন্তু তুমি যাওয়ার পর আবার যদি আসে হাশমি? একবার ওকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পেরেছি, বারবার নিশ্চয় আমরা সে সুযোগ পাব না।’

মেয়ের চোখে ভয়ের ছাপ দেখে মাথা দোলালেন প্রবীণ আর্কিওলজিস্ট। ‘তা-ই তো!’ বললেন বিড়বিড় করে। বাবুর্চি লোকটাও আগে থেকে ছুটি চেয়ে রেখেছে। দুপুরের পর ওকে যেতে না দিয়ে উপায় নেই। উম্‌ম্‌! ঠিক আছে, চলো তা হলে, যা শুনলাম, তারপর তোমাদের বাসায় একা রেখে যেতে সাহস হয় না। চলো।’

মুসা-মদিনাকে হাসতে দেখে গম্ভীর হয়ে উঠলেন তিনি। তবে একটা শর্ত আছে।’

‘কী শর্ত, মামা?’ বলল মুসা।

‘আমার বিনা অনুমতিতে এক পা-ওঁ নড়তে পারবে না তোমরা। যেখানে বসে থাকতে বলব, সেখান থেকে সরতে পারবে না। ঠিক আছে?’

অবাক চোখে মামার নতুন এক চেহারা দেখল মুসা। জগৎ বিখ্যাত এক বিজ্ঞানী তিনি, বিজ্ঞান ছাড়া বোঝেন না কিছু। সেই তাঁকেই এ- মুহূর্তে কেমন যেন চিন্তিত, ভীত মনে হচ্ছে।

দুই ওয়ার্কার অজানা কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কী এক দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাঁকে। সঙ্গে যোগ হয়েছে হাশমির রহস্যজনক আচরণ। দুইয়ে দুই মিলে ভয় পাইয়ে দিয়েছে তাকে। ঘাবড়ে গেছেন মামা। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

‘ঠিক আছে, বাবা।’

মুসা ছোট্ট করে মাথা দোলাল। ‘আচ্ছা।’

‘গুড।’

সায়েম মোর্শেদ দুপুরে খেয়ে ওদের নিয়ে পিরামিডের উদ্দেশে রওনা হলেন। ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। মেঘের আড়ালে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। ভয়ঙ্কর ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। দু’পাশে মরুভূমি, তার মাঝখানে চওড়া হাইওয়ে ধরে গিজার দিকে দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছেন মামা।

গম্ভীর।

একটু পর তাঁর চেয়েও গম্ভীর চেহারার পিরামিড দেখা দিল দিগন্তে। না আলো না অন্ধকারে সেদিকে চেয়ে গা ছমছম করে উঠল মুসার। কেমন এক অশুভ কাঠামোর মত লাগছে ওগুলো। যত এগোচ্ছে ওরা, তত বড় হচ্ছে।

বিস্ময়কর, ভীতিকর সুপ্রাচীন এক সৃষ্টি।

মেঘের ঘনত্ব আরও বেড়ে গেছে। ভর দুপুরেই রাতের আঁধার গ্রাস করেছে গিজার মরু প্রান্তর।

মামা গার্ডকে পারমিট দেখিয়ে পিরামিডের পেছনে চলে এলেন, খোলা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করালেন। নেমে পড়ল মুসা ও মদিনা। হাওয়া ওদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। বালি উড়ে আরও আঁধার করে তুলেছে। বেরিয়ে এসে মামা গাড়ি লক করলেন। ওদের নিয়ে টানেলে ঢুকে পড়লেন।

ভেতরে ঢুকতেই ছোটখাট একটা কক্ষ। এখানে পিরামিডের কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রাখা হয়। কোনার দিকে একটা লকার থেকে ছোট ম্যাচবক্সের মত পেছনে আংটাওয়ালা কী যেন দুটো বের করলেন তিনি, একটা করে তুলে দিলেন মুসা ও মদিনার হাতে।

‘এগুলো প্যান্টের কোমরে আটকে নাও তোমরা।’

‘কী এটা?’ মুসা জানতে চাইল।

‘জিনিসটাকে রীপার বলে। যদি পথ ভুলে যাও, এই বোতামটা টিপে দেবে। তা হলে যন্ত্রটা আমাকে সঙ্কেত দেবে যে কোন দিকে তোমরা আছ।’

অবাক হলো মদিনা। ‘কীভাবে?’

‘বেতারতরঙ্গের সাহায্যে। বোতাম টিপলে এটা সঙ্কেত দিতে থাকবে। আমার সঙ্গের রিসিভার সেই সঙ্কেত অনুসরণ করবে। আমি সহজেই তোমাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারব।’

একটু থেমে আবার বললেন, ‘যদিও কোনও দরকার হবে না। কারণ তোমরা আমার কাছ থেকে দূরে কোথাও যাচ্ছ না।’

‘ঠিক আছে,’ সুবোধ মেয়ের মত মাথা দোলাল মদিনা।

দু’জনকে দুটো ফ্ল্যাশলাইট দিলেন তিনি। ‘আমার সঙ্গে আসবে, কেমন?’

‘ঠিক আছে, মামা,’ বলল মুসা।

গম্ভীর মুখে বললেন মামা। ‘যা বলছি ঠিক সেইমত কাজ করবে।’

‘জ্বি।’

‘এসো,’ ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় পথ দেখে টানেল ধরে এগিয়ে চললেন।

পা বাড়াবার আগে মুসা প্যান্টের পকেট থেকে মমির খুদে হাতটা বের করে দেখে নিল।

‘কী করবে ওটা দিয়ে?’ মদিনা জানতে চাইল।

‘বিপদে পড়লে কাজে লাগতে পারে, তাই দেখে নিলাম সঙ্গে আছে কি না। বলা তো যায় না!’

‘হুঁহ্, ভারী আমার কাজের জিনিস!’ মদিনা মুখ বাঁকাল।

‘নিশ্চয় কাজের জিনিস।’

‘ঘোড়ার ডিম! এতই যদি কাজের জিনিস, তা হলে সকালে কেন কোন কাজে এল না? হাশমি আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল!’

‘সহজ কারণ। তখন এটা পকেট থেকে বের করিনি আমি।’

‘কেন করোনি? চ্যালেঞ্জ করল যেন মদিনা।

‘ভুলেই গিয়েছিলাম যে এটা সঙ্গে আছে, তাই,’ মুসা হাসল। ‘তুমি ভয়ে হার্টফেল করতে চলেছ দেখে আসলে আমার মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। একদম মনে ছিল না।’

‘কী!’ তেড়ে এল মদিনা। ‘আমি হার্টফেল করতে চলেছিলাম?’

‘প্রায়,’ বলেই চট্ করে বসে পড়ল ও, মদিনার চড় এড়াতে। ওকে ব্যর্থ হতে দেখে হেসে উঠল।

ও আবার তেড়ে আসছে দেখে মুসা হাত তুলে থামতে ইশারা করল।

‘আমি কিন্তু মামাকে বলে দেব সব।’

থমকে গেল মদিনা। হাত নামিয়ে নিল চট করে। মুখে লজ্জা পাওয়া হাসি ফুটল। কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে গিয়েছিল, থেমে গেল বাবার ডাক শুনে।

‘তোমরা দেরি করছ কেন?’ সামনে থেকে হাঁক ছাড়লেন তিনি। ‘এসো তাড়াতাড়ি।’

ছুটল ওরা তর্ক থামিয়ে।

কয়েক মিনিট পর, আগের দিনের সেই দড়ির মই বেয়ে পিরামিডের গভীরে নেমে পড়ল সবাই।

আগে আগে হাঁটছেন মামা। তাঁর ফ্ল্যাশলাইটের জোরাল আলো নাচছে সামনের মেঝেতে-দেয়ালে। বাবার কয়েক পা পেছনে রয়েছে মদিনা, মুসা সবার পেছনে। আগের দিনের চাইতে টানেল আজ আরও নিচু, আরও সরু লাগছে মুসার।

মামার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে ও। আলো জ্বেলে ভাল করে দেখে নিচ্ছে কোথায় পা ফেলছে। মাথা সিলিঙে গুঁতো খাওয়ার ভয়ে নিচু করে রেখেছে।

কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে ঘুরল টানেল, নীচের দিকে নামতে শুরু করল। একটু পর Y-এর মত দু’দিকে ছড়িয়ে থাকা দুই বাহুর ডানদিকেরটা ধরে এগোলেন মামা। বালুমোড়া, শুকনো মেঝেতে তিনজোড়া কেডসের মৃদু আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

মৃদু কাশি দিলেন সায়েম মোর্শেদ। মদিনা কিছু বলল, শুনতে পেল না মুসা। টানেলের সিলিঙে সেঁটে আছে ওর দৃষ্টি। ওখানে কয়েকটা মাকড়সা ঝুলছে। সেগুলোর ওপর আলো ধরল ও, সতর্ক নজর রাখল।

হঠাৎ বাঁ পায়ে হ্যাঁচকা টান পড়ল। ফিতে খুলে গেছে।

‘খাইছে!’ অস্ফুটে বলে উঠল মুসা। ‘আবারও!’

ওটা বাঁধতে ঝপ্ করে বসে পড়ল। আলোটা পাশে রাখল অটো সুইচ টিপে, যাতে নিভে না যায়।

‘মদিনা, দাঁড়াও!’ ডেকে উঠল মুসা। ‘এক মিনিট।’

আওয়াজটা মামা বা মদিনা কারও কানে পৌঁছাল না। দু’জন কী নিয়ে যেন আলোচনায় মগ্ন, শুনতে পায়নি। দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল। তবে ঘাবড়াল না মুসা। কারণ বাপ-মেয়ের গলা শুনতে পাচ্ছে ও। অর্থাৎ বেশি পিছিয়ে পড়েনি সে। তার ওপর আলো আর বীপার যখন আছে, চিন্তা কী?

তবু আরেকবার ডাকল মদিনার নাম ধরে। জবাব এল না। কাজ সেরে আলো নিয়ে উঠে পড়ল মুসা, এবং তখনই খেয়াল করল মামা বা মদিনা, কারও গলাই আর শুনতে পাচ্ছে না ও।

‘মামা!’

টানেলে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল ওর ডাক, আর কোনও লাভ হলো না। প্রায় দৌড়ে এগোল মুসা।

‘মামা, দাঁড়ান!’

সাড়া নেই। সামনে টানেল একদম নীরব।

যতটা না ভয় পেল, তার চেয়ে বেশি হলো রাগ। এ কেমন ব্যাপার? তিনজনের দল থেকে একজন পিছিয়ে পড়েছে, খেয়ালই নেই কারও? কী এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত মামা-মদিনা?

‘মামা! মদিনা!!’

শূন্য

টানেল যেন মুসাকে বিদ্রূপ করল। এবার ভয় পেল ও। আরও জোরে ছুটল। ‘মদিনা, কোথায় তোমরা!

সাড়া নেই।