মৃত্যুর ডাক – ২১

একুশ

ঘুরেই পেছনে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল ওরা একযোগে।

কেউ নেই! শূন্য সুড়ঙ্গ!

‘কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম মনে হলো!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে মদিনা বলল।

‘আমারও তা-ই মনে হয়েছে,’ কাঁপা, নিচু গলায় বলল মুসা। ‘কিন্তু কই! কাউকে দেখতে তো পাচ্ছি না!’

‘কিন্তু… কিন্তু,’ আমতা আমতা করতে লাগল মদিনা, ‘ভুল একজনের হতে পারে, দু’জনের হয় কী করে? তুমি শোনোনি পায়ের আওয়াজ?’

‘সেরকমই একটা শব্দ কানে এল,’ মুসা বলল। ‘কিন্তু কার পায়ের শব্দ হতে পারে? কেউ যদি এসে থাকে, গেল কোথায়?’

‘মমি!’ প্ৰায় কেঁদেই ফেলল মদিনা। ‘ওটা তা হলে নিশ্চয়ই মমি! মমিকে জীবন্ত করার মন্ত্র পাঁচবার উচ্চারণ করেছিলে তুমি!’

ছ্যাৎ করে উঠল মুসার বুক। ভীষণ ঘাবড়ে গেল ও। যদিও মুখে বলল অন্য কথা, ‘তাতেই কী মমি জীবন্ত হয়ে গেছে? আমি ওসব বিশ্বাস করি না।’

‘কিন্তু প্রাচীন মিশরীয়রা করত।’

‘তা করুক গে! এটা প্রাচীন মিশর নয়-আধুনিক মিশর। আমরাও ওদের মত আবোল-তাবোল কুসংস্কারে বিশ্বাসী নই।’

আবার এগোতে শুরু করল ওরা।

‘বাবা! বাবা! কোথায় তুমি?’ যতই ভেতরে ঢুকছে ততই উতলা হচ্ছে মদিনা। গলার কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছে।

সামনে অনেকটা পথ প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। তারপর সমতল হয়েছে।

হঠাৎ মদিনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন থেকে মুসার হাত টেনে ধরল। আরেকটু হলে ওর হাত থেকে ফ্ল্যাশলাইট পড়ে যেত।

‘দেখো!’ পায়ের কাছে আলো ফেলে উত্তেজিত গলায় বলল মদিনা। ‘পায়ের ছাপ!’

মাথা নুইয়ে আলোর বৃত্তটার দিকে তাকাল মুসা। সুড়ঙ্গের ধুলোমলিন মেঝেতে বুটের ছাপ দেখা যাচ্ছে। কাঁটাওয়ালা বুটজুতোর গভীর ছাপ।

‘ওয়ার্ক বুট!’ ফিসফিস করে বলল মুসা।

মদিনা মেঝের ওপর আলো ঘোরাতে লাগল। ওরা যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই গেছে ছাপগুলো।

এক জোড়া নয়, কয়েক জোড়া ছাপ।

‘তার মানে আমরা ঠিক পথেই চলেছি, তা-ই না?’ আনমনে নিজেকে প্রশ্ন করল মদিনা।

‘বলা যায় না,’ তীক্ষ্ণ চোখে ছাপগুলো পরখ করল মুসা। ‘এগুলো নতুন নাকি পুরনো, বোঝার উপায় নেই।

‘বাবা!’ আবার চিৎকার করে উঠল মদিনা। ‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, বাবা?’

জবাব নেই।

আবার মুসাকে অনুসরণ করল মদিনা।

পায়ের ছাপগুলো আশান্বিত করে তুলেছে ওদের। আগের চেয়ে দ্রুত এগোচ্ছে। নিজেদের রক্ষা করার জন্যে দেয়াল ধরে ধরে এগোচ্ছে ওরা।

সামনেই আরেকটা চৌকোমত ফাঁকা জায়গা। এক দেয়ালে দরজা দেখা গেল একটা।

দরজার সামনে থমকে দাঁড়াল দু’জন। বুঝতে পারছে না, এটাই প্রিন্সের সমাধি-ক্ষেত্রের দরজা কি না।

ঢুকতে যাবে সেই মুহূর্তে পেছনে আবার পায়ের শব্দ শুনতে পেল ওরা। ___ ফেলল দু’জন একসঙ্গে।

না, কেউ নেই! কেউ অনুসরণ করছে না ওদের!

‘ভয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছি আমরা,’ যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করল মুসা। ‘তাই বারবার ভুল হচ্ছে।’

‘হতে পারে, কাঁপা কাঁপা গলায় ভাইকে সমর্থন জানাল মদিনা। ‘কিন্তু মনে হলো যে…’

‘বাজে কল্পনা,’ ওর কথা কেড়ে নিয়ে বলল মুসা। ‘চলো, ভেতরে ঢুকি। মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায় এসেছি।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল দু’জন।

শূন্য কক্ষ।

ফ্ল্যাশলাইটের আলো ঘুরে বেড়াল। দেয়ালের নীচ থেকে সিলিঙ পর্যন্ত প্রাচীন হায়রোগ্লিফ।

‘বাবা? বাবা?’ মদিনার চিৎকারে থমথমে নীরবতা ভেঙে খান-খান হয়ে গেল।

সামনে দরজা দেখে বুঝল, পাশে আরেকটা চেম্বার আছে। সম্ভবত ওটাই প্রিন্স খোর-রো’র সমাধি-ক্ষেত্র।

দ্রুত পা বাড়াল ওরা দরজার দিকে। পাশের চেম্বারে ঢুকতেই বুঝল ঠিক জায়গাতেই এসেছে।

‘বাবা?’ উতলা কণ্ঠে ডাকল মদিনা। ‘এখানে আছ, বাবা?’

মুসাও ডাকল এবার, ‘মামা? শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?’

সাড়া নেই।

খোর-রো’র রত্নরাজির ওপর আলো নাচাচ্ছে। বিশাল চেস্টগুলোর ওপর। সিংহাসনের ওপর। এক কোণে সাজিয়ে রাখা গলা উঁচু জারগুলোর ওপর।

‘এখানে বাবা নেই!’ হতাশায় মুষড়ে পড়ল মদিনা।

‘তা হলে মামাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন ডক্টর ওমর?’ মদিনার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল মুসা। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে সে। ‘ওঁরা দু’জন এই জায়গা ছাড়া আর কোথায় যাবেন?’

ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল মদিনা পাথরের মমি কেসের ওপর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকাতেই চাউনি সঙ্কুচিত হয়ে উঠল মদিনার।

‘মামা!’ মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল এবার মুসা। ‘সাড়া দিন, প্লিজ! চুপ করে থাকবেন না!’

আচমকা মুসার বাহু আঁকড়ে ধরল মদিনা। ‘দেখো!’ বলে উঠল চাপা, উত্তেজিত গলায়। মমি কেসের ওপর স্থির হয়ে আছে ওর ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

কী দেখাতে চাইছে মদিনা? কিছু বুঝতে পারল না মুসা।

‘কী?’

‘ঢাকনা!’

মমি কেসের ঢাকনার দিকে তাকাল মুসা। কেসটা পাথরের ভারী স্যাব দিয়ে ঢাকা রয়েছে।

‘ঢাকনাটা বন্ধ!’ ওটার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেল মদিনা। ঢাকনার ওপর আলো ফেলছে।

‘তাতে কী হয়েছে?’ মুসা এখনও বুঝতে পারেনি মদিনা কী বোঝাতে চাইছে।

‘বিকেলে আমরা যখন এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম,’ বলে চলেছে মদিনা, ‘ঢাকনাটা খোলা ছিল। পরিষ্কার মনে আছে বাবা ওয়ার্কারদের ওটা খোলা রাখতে বলেছিলেন।’

‘ঠিক!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন! খোলাই ছিল ওটা!’

‘তাড়াতাড়ি এসো, মুসা,’ আকুতি জানাল মদিনা। ফ্ল্যাশলাইট রেখে দিল পায়ের কাছে। ‘মমি কেসটা খুলতে হবে।’

কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল মুসা। তারপর এগোল মমি কেসটার দিকে।

এরমধ্যে মদিনা একাই পাথরের ঢাকনাটা দু’হাত দিয়ে টানাটানি করছে। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। হাত লাগাল মদিনার সঙ্গে।

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভারী স্যাবটা সরাবার চেষ্টা করল ওরা। মুসার ধারণা ছিল ওটা খুব ভারী হবে। আসলে তা নয়। দু’জন শরীরের সব শক্তি এক করে ঠেলল ওটা। অল্পক্ষণে প্রায় একফুট সরে গেল ঢাকনা।

মাথা নিচু করে মমি কেসের ভেতরে উঁকি দিল ওরা। এবং পরমুহূর্তে তীব্র আতঙ্কে শিউরে উঠল। ওদের ঘাড়ের খাটো খাটো চুলগুলো সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল!

বাইশ

‘বাবা!’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠল মদিনা।

চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন ডক্টর সায়েম মোর্শেদ! দু’হাঁটু ওপরে তোলা! হাত দুটো শিথিল ভঙ্গিতে পড়ে আছে দেহের পাশে! চোখ বন্ধ!

ওরা ধাক্কা দিয়ে ঢাকনাটা আরও একফুট সরাল।

‘বাবা না? বাবাই তো!’ অস্পষ্টভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল মদিনা। মামার বুকের ওপর কম্পিত হাত রাখল মুসা। তাঁর মৃদু হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে।

‘মামা দম নিচ্ছেন!’ মুসা বলল। মামার মুখের ওপর ঝুঁকে এল ও। ‘মামা? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন, মামা?’

নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ নেই সায়েম মোর্শেদের।

মামার এক হাত নিজের মুঠোয় নিল ও। ঝাঁকি দিল কয়েকবার। হাতটা গরম, তবে নিস্তেজ। ‘মামা, উঠুন!’ বলল মুসা। ‘উঠুন, মামা!’

চোখ খুলল না ডক্টর মোর্শেদের।

নিস্তেজ হাতটা নামিয়ে রাখল মুসা।

মুসার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মদিনা। থুতনি ডলছে সে চিন্তিত ভাবে। ভয়ার্ত চোখে চেয়ে আছে বাবার দিকে। ‘বিশ্বাস হচ্ছে না,’ বিড়বিড় করে বলল। ‘ডক্টর ওমর বাবাকে এখানে ফেলে গেছেন, এই অবস্থায়! যদি আমরা না আসতাম…’

একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এল মামার গলা দিয়ে।

আশান্বিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল ওরা একসঙ্গে।

পুলিশে খবর দিতে হবে,’ মুসা বলল। ‘ডক্টর ওমরের কথা পুলিশকে জানাতে হবে।’

‘কিন্তু বাবাকে এখানে ফেলে রেখে বেরোই কী করে?’ দ্বিধার সঙ্গে জবাব দিল মদিনা।

কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল মুসা। আচমকা ভয়াবহ একটা কথা মনে পড়েছে ওর। ভয়ে কণ্ঠতালু শুকিয়ে গেল ওর। সারাশরীর কাঁপল ঠকঠক করে।

‘মদিনা!’ রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল ও, ‘মমির কেসে যদি মামা থাকবেন, তা হলে… তা হলে… মমিটা কোথায়?’

ইঞ্চিদুয়েক হাঁ হয়ে গেল মদিনার মুখ। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল মুসার মুখের দিকে। মুখে কথা জোগাল না কোনও।

সে-মুহূর্তে আবার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল ওরা।

মেঝেতে পা ঘষে এগিয়ে আসছে কেউ।

ওরা একযোগে ঘুরে দরজার দিকে তাকাল।

না, এবার ভুল শোনেনি।

কেউ আসছে!

তেইশ

খোর-রো’র খুদে মমির ওপর চোখ পড়ল ওদের। আড়ষ্ট পায়ে কক্ষে এসে ঢুকল ওটা। দুলছে!

হাঁ হয়ে গেছে মুসা!

মদিনা পেছনে দাঁড়িয়ে মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখছে অকল্পনীয় দৃশ্যটা। ভয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। ভয়ে ওদের মুখ নীল হয়ে গেল।

চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলল মুসা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। টু শব্দটি বের করতে পারল না ও গলা দিয়ে।

এক লাফ দিয়ে কক্ষের ভেতরে এসে দাঁড়াল মমিটা। সোজা সামনে তাকিয়ে আছে অন্তঃসারশূন্য টার মোড়া কালচে চোখে। সুপ্রাচীন ব্যাণ্ডেজের নীচে তার মুখটা যেন ভেঙচে উঠল ওদের উদ্দেশে।

পা ঘষে আরও দু’পা এগোল ওটা। মেঝের জঞ্জালের ওপর দিয়ে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে। মলিন ব্যাণ্ডেজের কাপড় খসে খসে পড়ছে পেছনে। খুব ধীরে দু’হাত তুলল ওটা। বিচ্ছিরি, কলজে হিম করা শব্দে আরও দু’পা এগোল!

প্রচণ্ড ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওদের। থরথর করে কাঁপছে।

মমি কেসের দিকে পিছিয়ে গেল মুসা। মদিনা নড়ল না।

এখনও মূর্তির মত গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে চোয়াল ডলছে মদিনা।

হাত ধরে ওকে পেছনে টেনে নিয়ে এল মুসা।

‘পিছিয়ে এসো, মদিনা! কুইক!’

এগিয়ে আসা মমির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মদিনা। মুসার কথা তার কানে ঢুকেছে বলে মনে হলো না। মনে হচ্ছে ভয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে সে।

মদিনার হাত ধরে আরেক টানে আরও পেছনে সরিয়ে আনল মুসা।

দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে এখন ওদের।

এগিয়ে এসেছে মমি!

ওটা কালচে চোখে চেয়ে আছে ওদের দিকে। দু’হাত বাড়িয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করছে।

অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে এল মদিনার মুখ দিয়ে।

‘পালাও!’ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুসা। ‘মদিনা, জলদি পালাও!’ কিন্তু ওদের পেছনে সমাধি-কক্ষের শক্ত দেয়াল। সামনে পথ আগলে রয়েছে চার হাজার বছরের পুরানো এক মমি। জীবন্ত!

কীভাবে পালাবে ওরা?

উপায় নেই!

পালানোর পথ নেই!

মনের পর্দায় বাবা-মার চেহারা ভেসে উঠল মুসার। মনে পড়ল রকি বিচের কথা। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বেঘোরে মরতে হচ্ছে আজ ওকে। মরতে হচ্ছে একটা জীবন্ত মমির হাতে।

আসছে ওটা ওদের ধরতে!

এলোমেলো পায়ে!

অলঙ্ঘ্যনীয় নিয়তির মত ক্রমেই এগিয়ে আসছে!

‘সব দোষ আমার!’ কম্পিত গলায় বলে উঠল মুসা। ‘মন্ত্রটা পাঁচবার উচ্চারণ করেছিলাম আমি। মমিটাকে আমিই জীবন্ত করে তুলেছি!’

‘এ-এখন কী হবে?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল মদিনা।

জবাব দিতে পারল না মুসা। ‘মামা!’ মমি কেসটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল ও, ‘আমাদেরকে বাঁচান, মামা! ‘

কিন্তু নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না তাঁর মধ্যে।

মুসার চিৎকারে জেগে ওঠেননি মামা।

কক্ষের কর্কশ দেয়ালে পিঠ ঘষে জান্তব বিভীষিকাটার সামনে থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ওরা। নজর সেঁটে আছে ওটার ওপর।

মেঝেতে ব্যাণ্ডেজ মোড়া পা ঘষে এগোচ্ছে খোর-রো। প্রতি পদক্ষেপে ধোঁয়ার মেঘের মত ধুলো ছড়াচ্ছে। টক-টক গন্ধে ভরে উঠেছে চেম্বার। চার হাজার বছরের এক মৃতদেহের গন্ধ। জীবন্ত হয়ে উঠছে গন্ধটাও!

ঠাণ্ডা দেয়ালে হেলান দিয়ে জমে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

মমিটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে নিজের কেসের সামনে থেমে থাকল। তারপর আবার এগোল ওদের দিকে।

‘ইশ্! মনেই ছিল না!’ একটা কথা মনে পড়তে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল মুসা।

মমির ছোট্ট হাতটা! সামোনারটা!

হাতটার কথা আরও আগে কেন মনে পড়ল না?

জিনিসটা কী পারবে ওদের বাঁচাতে? পারবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে?

সামোনারটা যদি পকেট থেকে বের করে মমির সামনে উঁচিয়ে ধরে? ওটা কী ওদের বাঁচতে পারবে?

মমির হাত কী এই মমিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে?

মমিটা আর মাত্র কয়েক পা দূরে আছে। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই ওদের ধরে ফেলবে। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? মুসা প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল, এবং প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল!

মমির হাতটা নেই! পকেট শূন্য!

চব্বিশ

‘হায় আল্লাহ!’ মহা বিস্ময়ের ঘোরে পাগলের মত অন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মুসা।

নাহ! নেই!

মদিনা কম্পিত গলায় জানতে চাইল,’কী হলো?’

‘মমির হাতটা নেই!’ তীব্র হতাশা ঝরল মুসার কণ্ঠে। ‘হারিয়ে ফেলেছি।’

দু’পা এগোল মমি। ওটা যত কাছে আসছে, বদ গন্ধটাও ততই তীব্র হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওদের।

মরিয়া হয়ে মমির হাতটা খুঁজল মুসা, যদিও জানে, ওটা নেই। অহেতুক সময় নষ্ট করছে ও।

‘আমাদের এখন ছুটে পালানো ছাড়া করার কিছুই নেই,’ মদিনাকে বলল মুসা। ‘মমিটা বেশ ধীর, আড়ষ্ট। জোরে দৌড়ালে বেঁচেও যেতে পারি এ যাত্রা।

মদিনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘কিন্তু বাবার কী হবে? তাঁকে একা ফেলে পালিয়ে যাব?’

‘আপাতত তা-ই করতে হবে,’ মুসা বলল। ‘কারও সাহায্য দরকার আমাদের। সাহায্য নিয়ে আবার ফিরে আসব আমরা।’

মুখ দিয়ে ভয়াবহ এক আওয়াজ করল মমি। ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসছে! পা আড়ষ্ট হলেও চলা থেমে থাকেনি ওটার। দু’হাত বাড়িয়ে ক্রমেই কাছে চলে আসছে!

‘পালাও, মদিনা!’ চেঁচিয়ে বলল মুসা। জোরে মদিনাকে খোলা দরজার দিকে ঠেলে দিল ও। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে ওর।

আরেকটা বিকট শব্দ করল মমি। সামনে ঝুঁকে এগিয়ে আসছে। ওদের ছুটতে দেখে হাত বাড়িয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল ওটা।

মমির প্রসারিত হাতের নীচ দিয়ে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু ঘাড়ের পেছনে ওটার প্রাচীন আঙুলের কর্কশ ছোঁয়া অনুভব করল ও। বরফের মত ঠাণ্ডা আঙুল! পাথরের মত শক্ত!

জীবনে এই ছোঁয়ার কথা ভুলবে না মুসা। শিরশির করে উঠল ওর গা। মমির থাবা থেকে বাঁচার জন্যে মাথা আরও নিচু করল ও। লাফ দিল সামনে।

দৌড়ের মধ্যে নিচু কণ্ঠে প্রলাপ বকছে মদিনা। মুসা হাঁপাতে হাঁপাতে ওকে ধরার জন্যে তীরবেগে ছুটল। কিন্তু গতি যথেষ্ট না। দু’পা ভীষণ ভারী ঠেকল ওর। যেন পাথর দিয়ে তৈরি।

দরজার কাছাকাছি পৌঁছে আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওদের। দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থেমে পড়ল। চোখেমুখে তীব্র আলোর ছটা এসে পড়ল।

আলোর পেছনে মানুষের একটা কাঠামো। মুসা হাত তুলে চোখ বাঁচিয়ে পেছনের মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করল।

‘মিস নী-নীলা!’ সিলিঙের দিকে ফ্ল্যাশলাইট উঠে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘আমাদেরকে বাঁচান!’

মদিনা চেঁচিয়ে বলল, ‘জীবন্ত হয়ে উঠেছে মমিটা! ওটা আমাদের মারতে আসছে। বাঁচান!’ পেছনে জীবন্ত মমির দিকে আঙুল নির্দেশ করল মদিনা। ‘বাঁচান!’

‘আমি কী করব?’ অদ্ভুত কণ্ঠে বলে উঠল নীলা সুমাইয়া। মুসা আর মদিনাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ ভীষণ রেগে উঠেছে সে। ‘তোমাদের জন্যে আমি কী করতে পারি? এখানে তোমরা কেন এসেছ? সবকিছু বরবাদ করতে?’

‘জ্বি?’ বিস্ময় ঝরে পড়ল মুসার কণ্ঠে।

কয়েক পা এগিয়ে এল নীলা সুমাইয়া। ডান হাত তুলল ধীরে ধীরে।

মুসা তার হাতে কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে।

হ্যাঁ, সেই মমির হাত!

মমির দিকে ওটা উঁচিয়ে ধরল নীলা।

‘এগিয়ে এসো!’ জীবন্ত মমিকে ডাকল সে। ‘এগিয়ে এসো, আমার

পঁচিশ

‘আমার হাতটা কীভাবে পেলেন আপনি!’ বিস্মিত হয়ে বলল মুসা। মনে হয় নীলার কথা শুনতে পায়নি। কী করতে চাইছেন এখন আপনি?’

নীলা সুমাইয়া পাত্তা দিল না। একহাতে ফ্ল্যাশলাইট ধরে আছে সে। অন্য হাতে মমির হাত! উঁচিয়ে ধরে ধীরে ধীরে দোলাচ্ছে সে খোর-রো’র দিকে চেয়ে।

‘এসো, ভাই!’ হাতটা দোলাতে দোলাতে বলল সে মোলায়েম কণ্ঠে। ‘আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি প্রিন্সেস নীলা!

মমির পায়ের হাড় ভাঙার আওয়াজ উঠল। ব্যাণ্ডেজের ভেতরে হাড়গোড় ভাঙছে। তবু ওটা পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে।

‘থামুন!’ চেঁচিয়ে বলল মদিনা। ‘কী বলছেন এসব?’

কিন্তু নীলা সুমাইয়া পাত্তাই দিচ্ছে না, মমির সঙ্গে কথা বলে চলেছে। ‘হ্যাঁ, আমি তোমার বোন!’ তার অপরূপ মুখে খেলে যাচ্ছে বিজয়ীর হাসি। সবুজ দু’চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখতে পাচ্ছে মুসা- মদিনা।

‘এই দিনটির জন্যে দীর্ঘকাল ধরে অপেক্ষা করেছি আমি,’ বলে চলেছে নীলা সুমাইয়া। ‘এই দিনটির জন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করেছি, আমার ভাই! জানতাম কেউ না কেউ একদিন তোমার কবর উন্মোচন করবে। এবং তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার!’

উত্তেজনায়, আনন্দে ঝকমক করছে নীলার সারা মুখ। ছোট্ট মমির হাতটা দোলাচ্ছে সে ধীরে ধীরে। ‘আমার লক্ষ্মী ভাই, তোমাকে আবার জীবন্ত করে তুলেছি আমি। এ-জন্যে আমাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই ধনরত্ন সব শুধু তোমার আর আমার। কেউ এতে ভাগ বসাতে পারবে না। আমরা আমাদের ক্ষমতার বলে আবার এ-দেশ শাসন করব, যেমন করেছি অতীতে!’

মুসার দিকে তাকাল নীলা। ‘অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে,’ বলল সে। ‘সামোনারটার জন্যে ধন্যবাদ। তোমার কাছে এটা দেখেই বুঝেছিলাম আমি অনেকদূর এগিয়ে গেছি। আমি জানতাম এটাই আমার ভাইকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে! শুধু ওই প্রাচীন শব্দ দুটোই আমার ভাইকে ফিরে পেতে যথেষ্ট ছিল না। ঠিক এই সামোনারটাই দরকার ছিল।’

‘ফিরিয়ে দিন ওটা,’ মুসা বলল, হাত বাড়াল। ‘ওটা আমার!’

‘ফিরিয়ে দিন, প্লিজ!’ বলল মদিনা।

অদ্ভুত হাসি খেলে গেল নীলার মুখে। ‘এটা তোমার আর দরকার নেই,’ নরম কণ্ঠে বলল।

নীলা সামোনারটা উঁচিয়ে ধরে জীবন্ত মমির দিকে দুলিয়ে যাচ্ছে। ‘ওদের মেরে ফেলো, লক্ষ্মী ভাই আমার,’ হুকুম দিল। ‘ওদের মেরে ফেলো। আমাদের শত্রু ওরা। কোনও সাক্ষী নেই এখানে। জলদি ওদের মেরে ফেলো।’

‘না-আ-আ-!’ চিৎকার দিয়ে উঠল মদিনা।

দরজার দিকে এগোতে গিয়ে বাধা পেল ওরা। পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে নীলা সুমাইয়া। তাকে ধাক্কা দিল মুসা। কিন্তু একচুল নড়াতে পারল না।

অলৌকিক শক্তি যেন ভর করেছে নীলার শরীরে। দরজায় পাথরের মত অনড় দাঁড়িয়ে আছে সে।

দুই ভাই-বোন তাকে প্রাণপণ ঠেলেও এতটুকু নড়াতে পারল না।

‘প্লিজ!’ আকুতি ঝরল মদিনার কণ্ঠে, ‘আমাদেরকে যেতে দিন!’

মাথা নাড়িয়ে হাসল নীলা।

অদ্ভুত হাসি!

‘কোন সাক্ষী নেই!’ বিড়বিড় করে বলল সে।

‘বাবাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাই আমরা,’ মদিনা বলল। ‘প্লিজ! আমরা চলে গেলে আপনার যা খুশি করতে পারেন। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে নীলার চোখের দিকে তাকাল ও।

পাত্তা না দিয়ে মমির দিকে তাকাল নীলা সুমাইয়া। ‘ওদের মেরে ফেলো!’ আবারও হুকুম দিল। ‘ওরা যেন তোমার সমাধি-ক্ষেত্র থেকে জীবিত ফিরে যেতে না পারে!’

চরকির মত আধপাক ঘুরে মমির দিকে তাকাল ওরা একসঙ্গে। এগিয়ে আসছে ওটা!

নীলার ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ওটার কালচে চোখ জ্বলে উঠল। পেছনের ধুলোমোড়া মেঝেতে পড়ে আছে হলদেটে ব্যাণ্ডেজের দীর্ঘ কাপড়ের ফালি।

এগিয়ে আসছে!

দরজার দিকে ঘুরল আবার মুসা। এখনও পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে নীলা সুমাইয়া।

দ্রুত সমাধি-কক্ষের চারদিকে চোখ বোলাল মুসা। পালিয়ে যাওয়ার কোনও পথ নেই। পালানো যাবে না।

এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত!

ওটা হাত বাড়াল। বরফের মত ঠাণ্ডা হাত। নীলার নিষ্ঠুর নির্দেশ পালন করতে চলেছে ওটা!

ছাব্বিশ

এগোতে গিয়ে নীলার সঙ্গে ধাক্কা খেল ওরা। পেছনদিক থেকে এগিয়ে আসছে খোর-রো। ওটার শূন্য কোটর ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে ভীতিকর হাসি।

দু’হাত সামনে বাড়াল ওটা। দু’দিকে প্রসারিত। আচমকা খোর- রো মরিয়া হয়ে সামনে লাফ দিল।

ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।

বিজয়ের আনন্দে উত্তেজিত নীলা সুমাইয়ার হাত থেকে পড়ে গেল মমির হাতটা। এক মুহূর্ত দেরি না করে মুসা ডাইভ দিয়ে তুলে নিল ওটা। পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে মদিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ও মমির নাগাল থেকে। নিজেও সরে গেল।

ওটা নীলাকে সামনে পেয়ে তার গলাই টিপে ধরল অপ্রত্যাশিতভাবে। কোনদিক দিয়ে কী ঘটে গেল বুঝে উঠতে পারল না নীলা। ভয়ার্ত আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার গলা চিরে।

মমির হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

মাথা সামান্য পেছনে হেলিয়ে নীলার গলা ধরে ঝাঁকাচ্ছে খোর-রো। কালো ঠোঁট সরে গেছে ওটার দাঁতের ওপর থেকে। শুকনো গলায় কেশে উঠল জীবন্ত মমি। গলা দিয়ে উঠে এল অদ্ভুত গম্ভীর, অথচ নিচু কণ্ঠের কয়েকটা শব্দ, ‘আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও!!’

নীলার গলা ভেঙে গেল চেঁচাতে গিয়ে। গলায় শক্তভাবে এঁটে বসেছে মমির বজ্রমুঠি।

আতঙ্কে কাঁপছে মদিনা।

কম্পিত পায়ে মুসা এগিয়ে এসে মমির হাত জাপটে ধরল। ওকে ছেড়ে দাও! ওকে ছেড়ে দাও!’

মমির কণ্ঠ থেকে দীর্ঘশ্বাসের মত একটা আওয়াজ বেরোল। বিরক্তি প্রকাশ করছে হয়তো।

নীলার গলায় হাতের চাপ আরও এঁটে বসছে। সামনে ঝুঁকল ওটা। নীলাকে ঠেসে মেঝেতে বসাতে চেষ্টা করল।

চোখ বুজল নীলা। পরাজয় মেনে নিয়েছে মনে মনে। অসহায়ভাবে হাত ছুঁড়ছে সে।

‘ছাড়ো ওকে,’ অনুনয় করল মুসা।

‘ছাড়ো, প্লিজ! মেরো না!’ বলল মদিনা।

মমিকে ধাক্কা দিল মুসা। নীলার গলায় জন্মের মত এঁটে বসেছে মমির হাত। মুসা ব্যাণ্ডেজ মোড়ানো হাত দুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করল।

মুসার বাড়াবাড়িতে ক্রুদ্ধ হলো মমি, চাপা গলায় পিলে চমকানো এক হুঙ্কার ছাড়ল। সামান্য সোজা হয়ে কাঁধ দিয়ে ভয়ঙ্কর গুঁতো মারল মুসাকে।

কাঁধের ব্যথায় দম আটকে এল ওর। মমির গায়ে এত শক্তি থাকতে পারে কল্পনা করেনি।

কিন্তু ছাড়ল না মুসা। পেছন থেকে লাফ দিয়ে ওটার পিঠের ওপর চড়ে বসল। ওকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করল মমি। সফল হলো খানিক চেষ্টার পর।

পড়ে যাচ্ছে মুসা, এই সময় স্বাভাবিক আত্মরক্ষার তাগিদে কিছু একটা অবলম্বনের আশায় হাত ছুঁড়ল শূন্যে। তখনই নীলার গলার লকেটটা মুঠোয় চলে এল ওর।

‘আরে! আরে!’ মুসা মেঝেতে আছড়ে পড়ল। নীলার লকেট রয়ে গেছে মুঠোয়। ছিঁড়ে এসেছে।

আছড়ে পড়ামাত্র হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল লকেটটা। ওটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল।

‘না-আ-আ-আ-আ-!’ নীলার বিকট চিৎকারে কেঁপে উঠল পুরো সমাধি-কক্ষ!

মমিটা স্থির হয়ে গেল আচমকা। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে। নড়ছে না।

আগের অবস্থায় ফিরে গেছে ওটা, বুঝল মুসা।

বাটকা মেরে নিজেকে ওটার হাত থেকে মুক্ত করল নীলা। পিছিয়ে গেল দু’পা। কোটরে থাকতে চাইছে না তার দু’চোখ, লাফিয়ে বেরিয়ে পড়তে চাইছে

চেঁচিয়ে উঠল সে আবার, ‘আমার আত্মা! আমার আত্মা! কুঁকড়ে গেল সে। ঝুঁকে পড়ে মরিয়া হয়ে মেঝে থেকে তুলে নিতে চেষ্টা করল সে স্বচ্ছ অ্যাম্বারের টুকরোগুলো।

কিন্তু ভেঙে ওগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।

‘আমার আত্মা! পাগলের মত ভাঙা লকেটের কয়েকটা টুকরো তুলে নিল সে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এই লকেটের ভেতরে থাকতাম আমি! রাতে এটার মধ্যে ঢুকে যেতাম। দিনের বেলায় আবার বেরিয়ে আসতাম। এটাই আমাকে চার হাজার বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন… এখন… কী… হবে?’

কথা শেষ হয়েছে কী হয়নি, আরও কুঁকড়ে গেল নীলা সুমাইয়া। ক্রমেই আরও ছোট হয়ে গেল!

ওর মাথা, হাত, সারা শরীর-একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে!

মদিনা ও মুসা হতভম্ব হয়ে গেল।

মেয়েটা মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে!

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর মুসা-মদিনার বিস্ফারিত চোখের সামনে ঝুপঝুপ করে মেঝেতে নেতিয়ে পড়ল নীলার পরনের পোশাক।

নীলা সুমাইয়া নেই ওর ভেতরে! হাওয়ায় উবে গেছে যেন সে কর্পূরের মত!

হঠাৎ তার পোশাকের তলা থেকে একটা গুবরে পোকা বেরিয়ে এল। প্রথমে এলোমেলো পায়ে অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোল ওটা। তারপর খুব দ্রুত মেঝের ওপর দিয়ে ছুটল, দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

‘ওই গুবরে পোকাটা,’ মদিনা বলল ভয়ার্ত গলায়। ‘ওটাই কি নীলা?’

মাথা দোলাল মুসা। ‘মনে হয়। ধুলোমোড়া মেঝেতে পড়ে থাকা নীলার কাপড়-চোপড়ের দিকে চেয়ে থাকল ও।

‘তোমার কী মনে হয়, নীলা সত্যিই এক প্রাচীন মিশরীয় রাজকুমারী ছিল?’ জিজ্ঞেস করল মদিনা। ‘সত্যিই কী প্রিন্স খোর-রো’র বোন ছিল সে?’

‘অবিশ্বাস্য!’ মুসা বলল। ‘তবু এখন মনে হচ্ছে সেটাই সত্যি!’ গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে ও। ছাড়া ছাড়া ঘটনাগুলোকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করছে। নীলা যা যা বলেছে তার অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। অবশেষে মুখ খুলল, ‘মনে হয় সত্যি কথাই বলেছে নীলা সুমাইয়া। ওই লকেটের মধ্যেই থাকত সে। আশ্চর্য!’ আপনমনে মাথা দোলাল। ‘ওর মধ্যে রাত কাটাত, দিনে মানুষের রূপ ধরে বেরিয়ে আসত। ওটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, যতক্ষণ…’

‘ওর আশ্রয়টা চুরমার করে ফেলেছ তুমি,’ নিচু স্বরে মদিনা বলল।

‘হ্যাঁ,’ মাথা ওপর-নীচ করল মুসা। ‘ওটা ছিল একটা দুর্ঘটনা…’ ঘাড়ে হাতের ছোঁয়া পড়তেই গলায় কথা আটকে গেল মুসার। চমকে উঠল, বুঝতে পারল পেছন থেকে মমিটা ওকে জাপটে ধরছে!

সাতাশ

কেউ ওর কাঁধে একটা হাত রেখেছে। আতঙ্কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল মুসার। পেছনে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।

‘চলো, পালাই!’ পেছন থেকে বলে উঠল হাতের মালিক।

চট করে ঘুরে তাকাল মুসা। পরপর দুটো বিট মিস করল ওর হৎপিণ্ড।

‘মামা!!’ বিস্মিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ও।

‘বাবা!’ ছুটে এসে সায়েম মোর্শেদকে জড়িয়ে ধরল মদিনা। ‘তুমি ঠিক আছ তো, বাবা?’

মুসার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিজের মাথার পেছন দিকটা ডলতে লাগলেন ডক্টর মোর্শেদ। একটা চোখ টিপলেন ওদের উদ্দেশে। যদিও ভঙ্গিটা অনিশ্চিত। মাথা ঝাঁকালেন। মনে হলো ব্যথাটা দূর করতে চাইছেন।

মুসা মামার পেছনে খোর-রো’র মমিটাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ওটা জমে গেছে।

‘বাপরে!’ বললেন মামা। ‘এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব!’ এক হাত ভরে দিলেন ঘন, কালো চুলের মধ্যে। ‘কী সাঙ্ঘাতিক!’

‘সব দোষ আমার,’ অকপটে স্বীকার করল মুসা। ‘প্রাচীন শব্দগুলো পরপর পাঁচবার উচ্চারণ করেছিলাম আমি। তাতে মমি জীবন্ত হয়ে উঠবে বিশ্বাস করিনি…’

হাসি ফুটল মামার ঠোঁটে। মুসার কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। তুমি মমিকে জীবন্ত করোনি, মুসা,’ নরম গলায় বললেন। ‘কাজটা করেছে নীলা।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মামা। ‘তাও ভাল যে এতকিছুর পরও আমরা প্রাণে বেঁচে আছি। …আরেকটু হলে গিয়েছিলাম।

মামা কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। ‘ওসব মন্ত্র-টন্ত্র বিশ্বাস করতাম না আমি,’ বলে চলেছেন। ‘কিন্তু এখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি। নীলা তোমার মমির হাতটা চুরি করেছিল। প্রাচীন শব্দগুলো পরপর উচ্চারণ করেছিল সে পাঁচবার। মমিকে জীবন্ত করতে শুধু ওই শব্দ দুটো যথেষ্ট ছিল না। সামোনারটা ব্যবহার করেছে সে। ওমর আর আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল নীলাকে।’

‘তা-ই নাকি?’ মুসা অবাক হয়ে বলল। ‘কিন্তু আমি তো ভেবেছি…’

‘আজ রাতে ডিনার করার সময় নীলাকে আমার সন্দেহ হয়েছিল, ‘ ব্যাখ্যা দিলেন মামা। ‘মনে আছে, শব্দ দুটো কী সেটা জানতে চেয়েছিল ও! তখনও আমি বলিনি কয়টা শব্দ উচ্চারণ করতে হবে মমিকে জীবন্ত করতে হলে। শুধু বলেছিলাম কয়েকটা প্রাচীন শব্দ উচ্চারণ করলে মমি জীবন্ত হয়ে ওঠে। তা হলে সে কীভাবে জানল দুটো শব্দই উচ্চারণ করতে হবে?’

মেয়ের কাঁধে অন্য হাত রাখলেন সায়েম মোর্শেদ। দেয়ালের কাছে নিয়ে এলেন ওদের। তারপর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আনমনে মাথার পেছনটা চুলকালেন কিছুক্ষণ

‘সেজন্যে ডিনার সেরেই কমিউনিকেশন টেন্টের দিকে ছুটেছিলাম। ওখান থেকে কায়রো সান পত্রিকায় টেলিফোন করি আমি। জানতে পারি নীলা সুমাইয়া নামে তাদের কোন সাংবাদিক নেই। তখনই বুঝলাম, ও ভুয়া সাংবাদিক।’

‘কিন্তু বাবা,’ বলে উঠল মদিনা, ‘আমরা দেখলাম ওমর আঙ্কেল তোমাকে কমিউনিকেশন টেণ্ট থেকে ঠেলতে ঠেলতে পিরামিডের দিকে নিয়ে গেলেন!’

শব্দ করে হেসে উঠলেন সায়েম মোর্শেদ। ‘বোঝা যাচ্ছে তোমরা মোটেই ভাল স্পাই নও। ওমর কোনও ব্যাপারেই আমাকে জোরাজুরি করেনি। ও নীলাকে পিরামিডের ভেতরে ঢুকতে দেখেছিল। তারপর আমার খোঁজে তাঁবুতে গিয়ে আমাকে না পেয়ে কমিউনিকেশন টেণ্টে যায়। রাতে নীলা পিরামিডে ঢুকে কী করছে সেটা দেখার জন্যেই আমরা এসেছিলাম। … কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।’ মাথা নাড়লেন মামা। ‘আমরা আসার আগেই নীলা মমিকে জীবন্ত করে তুলেছে। আমরা এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করি। ফ্ল্যাশলাইট দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মারে সে। মমি কেসে বন্দি করে ফেলে।’

মামা আবার মাথা ডললেন। ‘তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর উঠে বসলাম। দেখলাম নীলা সুমাইয়া একটা গুবরে পোকা হয়ে গেল।

‘আঙ্কেলকে এখান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি আমরা, জানাল মদিনা। ‘আমাদের সামনে দিয়েই দৌড়ে যান তিনি। তোমার কথা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি। পাত্তা দিলেন না উনি। মনে হচ্ছিল যেন ভূতের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছেন। আমরা…’ কথা শেষ করতে পারল না মদিনা। চোয়াল ঝুলে পড়ল।

সবাই শুনতে পেয়েছে বাইরের সেসব শব্দ।

পায়ের আওয়াজ! সমাধি-কক্ষের বাইরে থেকে আসছে।

একলাফে হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেল মুসার। মামার হাত আঁকড়ে ধরল।

এগিয়ে আসছে পায়ের আওয়াজ!

নিশ্চয়ই আরও মমি! আরও মমি জীবন্ত হয়ে উঠেছে, পা ঘষে ঘষে এগিয়ে আসছে প্রিন্স খোর-রো’র সমাধি-ক্ষেত্রের দিকে!

আটাশ

মুসা মমির হাতটার খোঁজে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল, বের করে আনল ওটা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা তুলে তাকাল দরজার দিকে। আরও অনেক জীবন্ত মমি দেখার অপেক্ষায় আছে।

কিন্তু সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ডক্টর আসাদ ওমর ঢুকলেন সমাধি-ক্ষেত্রে। তাঁর পেছন পেছন ভেতরে ঢুকল ইউনিফর্ম পরা চার পুলিশ অফিসার। সবার হাত অস্ত্রের হোলস্টারের কাছে।

‘তুমি ঠিক আছ তো, মোর্শেদ?’ মামার দিকে চেয়ে ব্যস্ত হয়ে বললেন ওমর। ‘কোথায় গেল সেই মেয়েটা?’

‘পালিয়ে গেছে,’ মুহূর্তখানেক দ্বিধা করে বললেন মামা।

কীভাবে তিনি বলবেন জলজ্যান্ত একটা মেয়ে একটা গুবরে পোকায় রূপান্তরিত হয়েছে?

সমাধি-কক্ষের চারদিকে নজর বোলাচ্ছে পুলিশ অফিসাররা। দরজার কাছে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা মমিটার ওপর এসে স্থির হলো ওদের চোখ।

‘তুমি ঠিক আছ দেখে আমি ভীষণ খুশি, মোর্শেদ,’ ওমর বললেন। আন্তরিকতার সঙ্গে হাত রাখলেন মামার কাঁধে, তারপর মদিনার দিকে ফিরলেন, ‘আমি জানি তোমাদের কাছে আমার ক্ষমা-প্রার্থনা করা উচিত, মদিনা।’ কপাল ভাঁজ করলেন তিনি। ‘সে-সময় যখন এখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, তখন খুব সন্ত্রস্ত ছিলাম। মনে আছে, তোমাদের দেখেছি আমি। কিন্তু তখন কথা বলার অবস্থা ছিল না।’

‘ঠিক আছে, আঙ্কেল,’ শান্ত গলায় জবাব দিল মদিনা। ‘আমরা কিছু মনে করিনি।’

‘তোমাকে যদি আমি ভয় পাইয়ে দিয়ে থাকি, সেজন্যে দুঃখিত, ‘বললেন ডক্টর ওমর। ‘ওই উন্মাদ মেয়েটা তোমার বাবাকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। তখন পুলিশ ডাকার চিন্তা ছাড়া আর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না। তা-ই তোমাদের দেখেও দেখিনি।’

‘বাদ দাও, ওমর,’ বললেন মামা, ‘সে-সব এখন অতীত। এবার আমরা এখান থেকে বেরোব। রাত কম হলো না।’

সবাই দরজার দিকে এগোল।

একজন অফিসার হঠাৎ বলে উঠল, ‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা মমির ওপর চোখ সেঁটে আছে তার। ‘মমিটা কী হাঁটতে পারে?’

‘অবশ্যই না,’ জবাব দিলেন মামা। হাসি ঝুলল তাঁর ঠোঁটে। —হাঁটতেই যদি পারবে, তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন ও?’

ঘুরে দাঁড়ালেন সায়েম মোর্শেদ। মুখে মৃদু হাসি ফুটে আছে। বীরদর্পে বেরিয়ে এলেন সুড়ঙ্গ ছেড়ে। তাঁবুতে ফিরে মুখ টিপে হাসাহাসি করলেন-মেয়েকে রাগানোর জন্যে বললেন, মদিনা আসলে ভিতু।

মদিনার কিছুই করার নেই, সহ্য করতে হবে। এ-যাত্রায় মুসার কাছে হার হয়েছে ওর। আসল সময়ে আসল কাজগুলো মুসাই করেছে, মদিনা নয়।

‘তবু ভাল যে তুমি গর্ব করার মত তেমন কিছু করোনি,’ চোখ কচলাতে কচলাতে বলল মদিনা। আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল।

হাসছে মুসা।

‘হেসো না,’ মুখ ঝামটা মারল মদিনা। ‘ভেবো না গুবরে পোকাটা একেবারে চলে গেছে। তোমার অপেক্ষায় আশপাশেই আছে। হয়তো তাঁবুতে তোমার কটে উঠে বসে আছে। হয়তো তোমাকে কামড়ে দেয়ার অপেক্ষায় আছে।’

হেসে উঠল মুসা। ‘সবসময় আমাকে ভয় দেখাতে চাও তুমি। এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারছ না যে সাহস তোমার থেকে আমার বেশি।’

‘ঠিক,’ বলল মদিনা শুকনো গলায়। ‘মেনে নিতে পারছি না। চলি এখন। খুব ঘুম পেয়েছে।’

দুপদাপ পা ফেলে তাঁবুর দিকে এগোল মদিনা। কয়েক মিনিট পর।

রাতের পোশাক পরে মুসা নিজের বিছানায় বসল। কী একটা এক রাত গেল, ভাবছে ও। কী বিস্ময়কর রাত!

বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। ওর মধ্যেও ভাবছে, আজকের রাতটা সবার স্মৃতির ভাণ্ডারে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশে ফিরে বন্ধুদের যখন ঘটনাটা বলবে, বিশ্বাস করবে ওরা?

***