ভয়ের বাঁশি- ১১

এগারো

বাইকে চেপে দ্রুত গতিতে বাড়ি ফিরে এলাম। তখুনি মুসাকে ফোন করে ফুটবল মাঠে দেখা করতে বললাম।

পোশাক পাল্টে ফুটবল জিন্স, শার্ট আর স্নিকার্স পরে নিলাম। বাড়ি থেকে যখন বেরোলাম, চাচার রেকিং তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।।

‘কীরে, আমি ভেবেছিলাম আজকে তোর খেলা নেই। এই পাতাগুলো ডাম্প করতে হয়তো তোর সাহায্য পাব,’ চাচা বলল।

‘সরি, চাচা, মুসার সাথে প্র্যাকটিস আছে। কালকে তোমাকে হেল্প করব।’

‘ঠিক আছে,’ হাসি মুখে বলল চাচা। পাতার বস্তা তুলতে গেল। রওনা দেব, ডনের ঘরের দিকে মুখ তুলে চাইলাম। অন্ধকার। শেড টানা, ব্লাইও নামানো। ও হয়তো বাঁশিভূতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে!

মাঠে পৌছে দেখি মুসা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ফুটবলটা আগে-পিছে ছুঁড়তে শুরু করলাম আমরা।

‘মুসা, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে,’ বললাম।

‘কী কাজ, বলে ফেলো!’

‘আমি ব্যাঙ্কের বেসমেন্টে যেতে চাই।’

মুসা বল ছোঁড়া বন্ধ করে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

‘রকি বীচ ব্যাঙ্ক? যেখানে আমার বাবা কাজ করে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বেসমেন্টে! কেন?’

‘সবটা এখন বলা যাবে না। তবে ব্যাপারটা সত্যিই খুব ইম্পর্ট্যান্ট। ওখানে কিছু কাগজ আছে যেগুলো আমার দেখা দরকার। না দেখলে হয়তো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যাবে।’

‘ভয়ঙ্কর ঘটনা? কীরকম?’

ইতস্তত করলাম। কতটা বলা যায় ওকে? ও আমাকে পাগল ঠাওরালে সাহায্য করবে না। কিন্তু কিছুই না বললেও সাহায্য করবে না। গভীর শ্বাস টানলাম।

‘মুসা, মনে নেই কালকে ফুটবল মাঠে তুমি কীরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়েছ?’

‘বলেছি তো ওটা কিছু না,’ বাধা দিয়ে বলল মুসা। ‘ডাক্তার বলেছে কোন সমস্যা নেই। হয়তো সামান্য অ্যালার্জি।’

‘আমি জানি কোন সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যাপারটা আবারও ঘটতে পারে।’

মুসা আমার দিকে হেঁটে এল। মুখের চেহারা উদ্বিগ্ন।

‘আবার ঘটতে পারে? এ কথা কেন বলছ, কিশোর?’

‘কারণ ও ঠিক কথাই বলেছে, মুসা, ওল্ড বয়,’ ইংরেজ উচ্চারণে এক কণ্ঠস্বর বলে উঠল।

বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালাম দু’জনেই। মাঠের পাশে ইঁটের গাদার উপরে ডন বসা। হাতে বাঁশি। ভয়ানক, ধীর ইংলিশ সুরটা বাজাতে লাগল। মুসার দিকে চাইলাম। ও এবার দৌড় দেয়নি। কিন্তু কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। নীল হয়ে যাচ্ছে মুসা। উপলব্ধি করলাম ব্যাপারটা কী

শ্বাস নিচ্ছে না মুসা!

বারো

মুসার কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম।

‘মুসা! মুসা! শ্বাস নিচ্ছ না কেন? শ্বাস নাও!’ চেঁচালাম।

মুখের দিকে আঙুল ইশারা করে, গোঙানির শব্দ করল ও। বুঝতে পারলাম শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।

ইঁটের গাদার দিকে ফিরে চাইলাম। ডন বাঁশিতে সুরটা বাজাচ্ছে। চোখজোড়া বিস্ফারিত।

‘ডন, বন্ধ করো, বাজনাটা এখুনি বন্ধ করো!’

কিন্তু আমি যে ওখানে রয়েছি তা-ই বোধহয় জানে না ডন। নিজের জগতে মগ্ন হয়ে রয়েছে সে, বাঁশির ফুটোয় আঙুল ওঠা-নামা করছে। উপলব্ধি করলাম অদ্ভুত এই সুরটা বাজাতে ক্রমেই আরও দক্ষ হয়ে উঠছে ও। কিন্তু এখন যদি ওর বাঁশি বাজানো বন্ধ করতে না পারি, তা হলে সত্যিকারের বিপদে পড়ে যাবে মুসা!

আমি ডনকে আঘাত করতে চাই না, কিন্তু ওকে মুসার ক্ষতি করতে দিতেও তো পারি না। কাজেই মাথায় যা এল তাই করলাম। ফুটবলটা তুলে নিয়ে পিছিয়ে এলাম, তারপর ছুঁড়ে দিলাম। লক্ষ্য ভেদ করল। বলটা ডনের হাত থেকে বাঁশিটা ফেলে দিল।

‘কিশোর ভাই, তোমাকে এর জন্যে পস্তাতে হবে,’ চিৎকার ছাড়ল ডন। মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। আবারও শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে ও।

‘খাইছে,’ বলে ঘাসে বসে পড়ল মুসা। ‘গলায় কী যেন আটকেছিল। মুখও খুলতে পারছিলাম না।’

মুসার স্বাভাবিক হতে আরও ক’মিনিট সময় লাগল। ডনকে কোথাও দেখলাম না। বাঁশি নিয়ে উধাও।

মুসার পাশে বসে পড়লাম।

‘মুসা, আমার কথা তোমার বিশ্বাস করতে হবে,’ বললাম। ‘কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, এবং আমার ধারণা এটা ক্রমেই আরও খারাপের দিকে যাবে। যদি না তুমি আমাকে ব্যাঙ্কের বেসমেন্টে পৌছতে সাহায্য করো।’

মুসা কাশল। সামলে উঠছে ও। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাইল।’

‘ঠিক আছে, কিশোর। ব্যাপারটা যখন ইম্পর্ট্যান্ট তখন আমি আছি তোমার সাথে।’

‘ধন্যবাদ,’ বললাম। ঠিক করলাম সোমবার, স্কুলের পর মিলিত হব আমরা, এবং সাড়ে তিনটেয় ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার আগেই ওখানে যাব।

সাপ্তাহিক ছুটির বাকি সময়টুকু নির্বিঘ্নেই কাটল। ডন ওর কামরায় বসে ওই একই সুর বারবার বাজাল। স্বীকার করতেই হচ্ছে, প্রতি বারই উন্নতি হচ্ছে ওর। কিংবা অবনতি। কারণ ও যত ভাল রাজাবে, ঘটনা ততই খারাপ ঘটতে থাকবে-সোমবার যদি কাগজগুলো হাতে না পাই।

সোমবার ক্লাসগুলো যেন আর ফুরোতেই চায় না। দশ মিনিট পর পর ঘড়ি দেখছি। তিনটা এক মিনিটে মুসার সঙ্গে স্কুলের সামনে দেখা হবে, তারপর ব্যাঙ্কের দিকে যাব আমরা। রবিনও থাকবে আমাদের সঙ্গে। ওকে সব ঘটনা জানিয়েছি।

এ নিয়ে ভাবছি এসময় অনুভব করলাম মি. অ্যামিস, আমাদের স্টাডি হল টিচার, একটা ঘোষণা দিচ্ছেন।

‘স্টুডেন্টস, আমি এইমাত্র প্রিন্সিপালের অফিস থেকে একটা নোটিশ পেয়েছি। কাল সন্ধেয় মিউজিক টিচার মিসেস পিয়ার্সের নেতৃত্বে ব্যাণ্ড দলের বিশেষ মার্চিং হবে, স্কুলের সামনে মূল গ্র্যাণ্ড স্ট্যাণ্ডে। সবাইকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তোমরা ইচ্ছা করলে অতিথি আনতে পারো।’

কালকে ব্যাণ্ড দলের মার্চিং? তারমানে গোটা শহর ডনের বাঁশি শুনবে। ঘড়ির দিকে চাইলাম। তিনটা বাজে না কেন?

তেরো

শেষমেশ ছুটির ঘণ্টা বাজল। বইয়ের ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলাম। রবিন দাঁড়িয়ে। মুসার দেখা নেই। অপেক্ষা করছি, দেখতে পেলাম মাঠে জড় হচ্ছে ব্যাণ্ড দল।

মিসেস পিয়ার্স ওদের সঙ্গে কথা বলছেন। ব্যাণ্ড এবার সারি বাঁধল। সবার সামনে ডন! ব্যাণ্ড বাজনা শুরু করে, মার্চ করতে লাগল।

‘এসে গেছি,’ বলে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল মুসা।

‘গ্রেট,’ বললাম। সিঁড়ি ভেঙে নেমে মেইন স্ট্রীটের দিকে হাঁটতে লাগলাম আমরা। ‘কালকে সন্ধেয় ব্যাণ্ড প্লে করবে জানো?’ বন্ধুদের উদ্দেশে প্রশ্ন করলাম।

‘হ্যাঁ, দারুণ হবে,’ বলল রবিন। ‘অ্যাই, দেখো, ডন ব্যাণ্ডকে লিড করছে,’ যোগ করল ও।

‘হুঁ, ও খুব দ্রুত শিখছে,’ বললাম। মুসার দিকে ঘুরে চাইলাম। ‘বেসমেন্টে যাওয়ার প্ল্যানটা কী?’

‘বাবাকে বলব আমরা সোশাল সায়েন্স প্রজেক্টের জন্যে কুখ্যাত ব্যাঙ্ক ডাকাতিগুলো স্টাডি করতে চাই। আমাদের দেখা দরকার ব্যাঙ্কের বেসমেন্টের ভল্ট কেমন হয়।’ মুসা বলল।

‘উনি বিশ্বাস করবেন?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘শীঘ্রি জানা যাবে,’ বলল মুসা। ‘এবার আসল কথায় এসো। আমাদেরকে যদি ওখানে নামতে দেয়ও, সিকিউরিটি গার্ড বা অন্য কেউ এসে পড়ার আগে আমরা বড়জোর মাত্র এক মিনিট সময় পাব। কাজেই যা করার এক মিনিটের মধ্যে করে ফেলতে হবে!’

ভাল। কী খুঁজছি তা-ই জানি না, তাও আবার মাত্র এক মিনিট সময়। যাকগে, এও মন্দের ভাল।

সোয়া তিনটেয় ব্যাঙ্কে পৌছলাম আমরা। কেরানী আর গার্ডদের কেউ কেউ মুসাকে চিনল। ওর বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মেইন ফ্লোরে এক অফিসে বসেন।

মেইন এলিভেটরের পাশে দাঁড়ানো নীল উর্দিপরা গার্ডের কাছে হেঁটে গেলাম আমরা।

‘হাই, জ্যাক,’ বলল মুসা।

‘কী খবর, মুসা?’ জবাবে বলল জ্যাক। ও বিশালদেহী লোক। চওড়া বাহু।

‘বাবার সাথে দেখা করব,’ বলল মুসা।

ভ্রূ কুঁচকাল জ্যাক।

‘সরি, মুসা।’

‘তারমানে?’

‘তোমার বাবা ক্রসভিলের এক ব্যাঙ্কে মীটিং করতে গেছেন। এখানে নেই। তবে সময় মত নিশ্চয়ই বাসায় ফিরবেন। বাসায় দেখা কোরো।’

জ্যাক ঘুরে দাঁড়িয়ে একজনকে এলিভেটরে ঢুকতে দিল। মুসা আমার দিকে ফিরে চাইল। পরস্পর মুখ তাকাতাকি করলাম তিন বন্ধু।

চোদ্দ

‘এখন কী করা?’ রবিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

‘এখন কী করা?’ পুনরাবৃত্তি করল মুসা। ‘বাড়ি যাই চলো।’

‘না!’ বললাম আমি, মুসার বাহু চেপে ধরে এলিভেটর এরিয়ার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনলাম। ‘মুসা, ব্যাপারটা জরুরী। আমাকে বেসমেন্টে নামতে হবে!’

‘বাবা আজকে নেই, জ্যাক আমাদেরকে পারমিশন ছাড়া এলিভেটরে চড়তে দেবে না। আমরা কাল আসব।’

‘কালকে দেরি হয়ে যাবে! মুসা, কিছু একটা বুদ্ধি বের করো, ‘ তাগিদ দিয়ে বললাম আমি।

মুসা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমার মুখের চেহারায় নিশ্চয়ই উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। কারণ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চারধারে নজর বুলিয়ে আমার সাথে ফিসফিস করে কথা বলল।

‘ঠিক আছে, আমি কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে জ্যাকের দৃষ্টি সরিয়ে রাখব। সেই ফাঁকে তুমি ওই পোলের পিছনের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে যাবে। ওটা সোজা বেসমেন্টে গেছে। কিন্তু কেউ যদি তোমাকে খুঁজে পায় তা হলে আমি কিছু জানি না। আর তুমি কিন্তু এক মিনিটের বেশি সময় পাবে না, কোন না কোন গার্ড চেক করতে চলে আসবে।

‘ধন্যবাদ,’ বললাম। সিঁড়ির পাশের পোলটার দিকে নিঃশব্দে এগোলাম। মুসা আর রবিন চলে গেল জ্যাকের কাছে। ওরা কথা-বার্তা বলতে শুরু করল। জ্যাক ঘুরে দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে কী যেন ইশারা করতে লাগল। এই-ই সুযোগ।

পোলটাকে পাক খেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। নীচে নামার পর প্রকাণ্ড এক ইস্পাতের দরজা দেখতে পেলাম। হাতল ঘুরালাম। বন্ধ। জোরে টান দিলাম। খুলল না। এবার হঠাৎই বাঁশির সুর শুনতে পেলাম। এবং দরজাটা খুলে গেল!

পনেরো

দরজাটা আমার পিছনে লেগে গেল। চারপাশে চোখ বুলালাম। এখানটা বেশ আলোকিত। বেসমেন্টটা আসলে অনেকগুলো তালাবন্ধ ভল্টের বিশাল এক কামরা। কয়েক ডজন। যেটা চাই সেটা খুঁজতে হবে।

প্রতিটা ভল্টে একটা করে ট্যাগ রয়েছে চেনার সুবিধার জন্য। আশা করছি ‘বাঁশির কাগজপত্র’। কিংবা সেরকম কোন ট্যাগ খুঁজে পাব। সে সঙ্গে আমাকে একটা চোখ খোলা রাখতে হবে গার্ড আসে কিনা দেখতে।

ঝটপট প্রথম সারির ভল্টগুলো দেখে নিলাম। বাঁশির কাগজপত্র ওগুলোতে নেই। পারের শব্দ পেলাম। এক কোনায় মাথা নুইয়ে বসে পড়লাম, সঙ্গে সঙ্গে একজন গার্ড চলে গেল পাশ দিয়ে।

এবার আবার খুঁজতে লাগলাম। বেশিরভাগ ভল্টে রয়েছে উইল, চুক্তিনামা, দলিলপত্র, টাকা, কিংবা অলঙ্কার। হতাশ হয়ে পড়ছি। দ্বিতীয় সারির উদ্দেশে এগিয়ে গেলাম। আর মাত্র একটা সারি বাকি।

শেষ সারিটা পরখ করতে লাগলাম। বড় এক দরজার কাছে এলাম। ভল্টের দরজায় একটা মাত্র শব্দ লেখা: ‘বাঁশি’।

চেয়ে রইলাম, শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। হাতলটা ঘুরালাম। খুলল না। টানলাম। বৃথা। ভল্টটা খুলব কীভাবে?

‘সমস্যা হচ্ছে? চিন্তা কোরো না, আমি হেল্প করব।’

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালাম। বেসমেন্টের দূর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ডন! ও বাঁশিটা বাজাতেই ভল্টের দরজা খুলে যেতে শুরু করল!

ষোলো

ভল্টের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। শিকলে বাঁধা এক বাতি ঝুলছে। শিকল ধরে টানতেই বাতি জ্বলে উঠল। ভল্টটা অতিকায়, প্রায় আমার শোবার ঘরের সমান।

কিন্তু গোটা জায়গাটায় একটা মাত্র জিনিস। পেল্লায় এক ধাতব বাক্স, দূর কোণে। পিছু ফিরে চাইলাম। ডনকে দেখলাম না। বাক্সটার দিকে এগোলাম।

ওটার কাছে পৌঁছতেই মাথাটা স্প্রিঙের মত খুলে গেল। যেন জাদুবলেই। এবং এক টুকরো পার্চমেন্ট কাগজ উড়ে বেরিয়ে এল, আর প্রায় আমার হাতের উপর পড়ল

যা পড়লাম তাতে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে এল। বাঁশিটা-যেটা নিলাম থেকে কেনা হয়েছে-এগারো বছর বয়সী এক ইংরেজ ছেলের ছিল। ছেলেটার নাম ছিল হ্যারিস। একশো বছর আগের কথা। গাঁয়ের বাইরে ঘোড়া চালানোর সময় বাঁশিটা বাজাত ও।

বিশেষ এক অনুষ্ঠান উপলক্ষে একদল ছেলে-মেয়েকে নেতৃত্ব দিয়ে গাঁ থেকে বনভূমির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল হ্যারিস। কিন্তু অনুষ্ঠানটা পণ্ড হয়ে যায় আচমকা ঘন কুয়াশার মধ্যে দলটা হারিয়ে যাওয়ায়।

তারপর থেকে হ্যারিস কিংবা অন্যদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় শুধু হ্যারিসের বাঁশিটা। কাগজে বলছে, বাঁশির মালিক যে-ই হোক সে ওটার বশ হবে এবং উধাও হওয়ার সময় হ্যারিস যে সুরটা বাজাচ্ছিল সেটা বাজাবে। এবং বাজনাটা যারা শুনবে তারা ধ্বংসের পথে যাবে!

কাগজে সই করেছেন হ্যারিসের মা। তারিখটা প্রায় একশো বছর আগের।

‘এটা মানুষকে দেখাব,’ বলে উঠলাম আপন মনে। ‘কালকের ব্যাণ্ড প্যারেডের আগেই।’

‘কিন্তু, কিশোর ভাই, তা হলে যে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে!’

মুখ তুলে চাইলাম। ভল্টের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে ডন।

‘ডন, বাঁশিটা আমাকে দাও, বললাম। ‘তোমার কাছে রেখো না। এতে শুধু বিপদই বাড়বে।’

‘বোকা ছেলে, নিখুঁত ইংলিশ উচ্চারণে বলল ডন। ‘তাই তো চাই!’

জোরে হেসে উঠল ও, বাঁশিতে ফুঁ দিল, এবং ভল্টের দরজা দড়াম করে লেগে গেল।

‘ভাল থেকো, কিশোর ভাই,’ ভল্টের বাইরে থেকে হাসির ফাঁকে বলল ডন। ‘কালকে এসে তোমাকে বের করব। যদি ইচ্ছে হয় আরকী। হা-হা-হা-হা!’

দরজার কাছে দৌড়ে গেলাম। হাতলটা যতভাবে সম্ভব ঘুরালাম। কিন্তু খুলতে পারলাম না। বন্ধ। আমি আটকে পড়েছি ভিতরে!

সতেরো

বেরনোর পথ নেই। কিন্তু ভয় পেলেও ক্ষতি। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কিন্তু কেউ তো আমার চিৎকার শুনবে না, জানবে না আমি এখানে। শুধু মুসা আর রবিন বাদে। কিন্তু ওরা যদি বলে আমি নীচে আছি জানে, তা হলে বিপদে পড়ে যাবে।

ওরা কি বন্ধুর জন্য এই ঝুঁকিটুকু নেবে? নাকি নিজেদের নিরাপদ রাখবে, ভাববে আমি এখানে থাকলে ওদের কী?

জবাবটা পেতে বেশিক্ষণ লাগল না।

‘কিশোর, কিশোর, কোথায় তুমি?’

মুসার গলা!

‘মুসা, আমি তিন নম্বর সারির শেষ প্রান্তের ভল্টটার ভিতরে। ওটায় ‘বাঁশি’ লেখা আছে!’ পাল্টা চেঁচালাম।

রবিন আর মুসা দরজার বাইরে। তালা ঘুরছে শব্দ পেলাম। এবার খুলে গেল দরজাটা। বন্ধুরা দাঁড়িয়ে।

টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম, কাগজটা ভাঁজ করে রাখলাম আমার বইয়ের ব্যাগে।

‘তোমরা এখানে নামলে কীভাবে? চাবি পেলে কোথায়?’

‘আমাদের কপাল ভাল। আমরা যখন উপরে তখন আমান আঙ্কল ফোন করেন। মুসা কথা বলে তাঁর সাথে। তারপর মুসা জ্যাককে বলে আঙ্কল ওকে ভল্টগুলোর চাবি দিতে বলেছেন। ওকে একটা জিনিস নিয়ে বাসায় যেতে হবে,’ জানাল রবিন।

‘তোমরা আমার জন্য ঝুঁকি নিয়েছ,’ বললাম।

শ্রাগ করল মুসা।

‘নেব না কেন?’

বেসমেন্টের দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম তিন বন্ধু। ‘যেটার জন্যে এসেছিলে সেটা পেয়েছ?’ প্রশ্ন করল রবিন।

‘হ্যাঁ, কিন্তু ও ব্যাপারে এখন কিছু বলব না। সময় হলেই সব জানতে পারবে।’

‘নো প্রবলেম,’ বলল মুসা।

ব্যাঙ্কের মেইন ফ্লোরে উঠে এলাম আমরা।

‘যাই বাড়ি গিয়ে প্ল্যান করি,’ বললাম।

‘ব্যাণ্ড শো-র জন্যে ইউনিফর্ম পরার ব্যাপারটাও যেন থাকে তার মধ্যে,’ বলল রবিন।

থমকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে চাইলাম।

‘তার মানে?’

‘টম ফিনের মা একটু আগে ব্যাঙ্কে এসেছিলেন। উনি বললেন স্কুল থেকে ঘোষণা করেছে ব্যাণ্ড প্যারেডের পর ফুটবল টিম তাদের পিছনে দৌড়ে যাবে। এক ধরনের প্রি-সিযন পেপ র‍্যালি আরকী।’

টম ফিন আমাদের এক টিমমেট। এই খবরের অর্থ আমি আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ভাল সুযোগ পাব। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হনহন করে বাসার পথ ধরলাম। বললাম, কালকে দেখা হবে।

চাচা-চাচী আর ডন বসে ছিল কিচেনে। চাচী ডিনার তৈরি করছে, চাচা খবরের কাগজ পড়ছে আর ডন এক কোণে প্রাচীন ইংরেজি গান- বাজনা সম্পর্কে এক বই নিয়ে বসে।

‘হাই, এভরিওয়ান,’ বললাম। চাচা-চাচী আমার দিকে মুখ তুলে চেয়ে হ্যালো বলল। ডনও তাকাল। খানিকটা বিস্মিত দেখাল ওকে। এবার আবার বইতে মন দিল।

চাচা-চাচীর দিকে চাইলাম।

‘ডন নিশ্চয়ই স্কুল থেকে ফিরে এখানেই ছিল?’

‘হ্যাঁ, কেন?’ চাচীর পাল্টা প্রশ্ন।

‘ভাবছিলাম কীভাবে ব্যাপারটা সামলাব, এখন হঠাৎই উপলব্ধি করছি সহজ রাস্তাই সেরা রাস্তা,’ বললাম।

‘কী বলছিস এসব!’ চাচা জিজ্ঞেস করল। ‘আবার স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?’

‘এবার আমার কাছে প্রমাণ আছে, চাচা,’ বললাম। কাঁধ থেকে বইয়ের ব্যাগটা নামিয়ে চেইন খুললাম। ভিতরে হাত ভরে দিলাম বাঁশির দলিলটা বের করার জন্য। কিন্তু উঠে এল একমুঠো ছাই!

আঠারো

হেসে উঠল ডন।

‘কিশোর ভাই মনে হয় চিমনি ঝাড়ু দিচ্ছিল!’ স্পষ্ট ইংরেজ উচ্চারণে বলল। এবার চেয়ার থেকে লাফিয়ে নামল। ‘ওপরে যেতে হবে বাঁশি প্র্যাকটিসের জন্য। কালকে অনুষ্ঠান। আসি।’

ডন উপরে চলে গেল। আমি চেয়ে রইলাম আমার হাতের দিকে। বাঁশির কাগজটার বদলে আমার হাতে এখন একমুঠো ছাই।

‘হাত নোংরা হলো কীভাবে?’ চাচী প্রশ্ন করল। ‘যা, ওপরে গিয়ে হাত ধুয়ে আয়। তোর কী হয়েছে জানি না। ইদানীং তুই কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছিস।’

‘আমি!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আর ডন? ও আর ওর বাঁশি! আর ওর ইংরেজ মার্কা উচ্চারণ। ও কীরকম অদ্ভুতভাবে কথা বলছে, আরচণ করছে লক্ষ করনি তোমরা?’

‘এটা বয়সের দোষ,’ চাচী বলল। ‘ও নিজেকে বড় ভাবতে চাইছে, তাই ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংরেজি বলছে। আমার কাছে তো ভালই লাগছে।’

‘আমার কাছেও,’ যোগ করল চাচা। হাতে মেখে থাকা ছাইয়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। আমার প্রমাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কালকের প্যারেডের ধ্বংস ঠেকাতে হলে যা করার আমার একারই করতে হবে।

সে রাতে হোমওয়র্ক শেষ করে তাড়াতাড়ি শুতে গেলাম। কালকের জন্য আমার পূর্ণ বিশ্রাম চাই। চোখ লেগে এসেছে, এসময় বাঁশির শব্দটা শুনলাম। মুখ তুলে চাইলাম।

আমার উপরে ভাসছে ছোট এক ছেলে। ভুতুড়ে এক অবয়ব। হাতে বাঁশি। চিবুক পর্যন্ত কভার টেনে নিলাম।

‘কে তুমি?’ কোনমতে প্রশ্ন করতে পারলাম। জানি কী জবাব হবে।

‘আমি হ্যারিস, কিশোর। কালকে তুমি কিছুতেই আমাকে বাধা দিতে পারবে না। আমার আর বাঁশিটার নিয়তি কালকে পূর্ণ হবে। একশো বছর আগে আমি যে বাজনাটা বাজিয়েছিলাম সেটা আমাকে আর আমার বন্ধুদেরকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিল। এবার অন্যরাও একই বাজনার মুখোমুখি হবে। মানে তোমার পরিবার আর বন্ধু-বান্ধবরা। বিদায়, কিশোর! হা হা হা হা!’

পরমুহূর্তে উবে গেল ছায়ামূর্তিটা। এখন আবার নিখাদ অন্ধকার।

উনিশ

পরদিন স্কুলে বলা হলো, ক্লাসের পর ফুটবল টিমের সদস্য হিসেবে জিমে রিপোর্ট করতে হবে আমাকে।

কোন ক্লাসেই মন বসল না আমার। দু’বার টিচারের বকা খেলাম মনোযোগ না দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার দোষ কী? আমাকে তো আজ সন্ধেয় অনেকের জীবন বাঁচাতে হবে ডনের হাত থেকে, এক অভিশপ্ত বাঁশি যার শরীর-মন দখল করে নিয়েছে!

বাঁশিটা। একটা বুদ্ধি মাথায় খেলে গেল। বাঁশটা হাতিয়ে ধ্বংস করে দিলে কেমন হয়? ডনের আজ মিউজিক ক্লাস নেই, কাজেই ওটা বাড়িতেই আছে। পরে বাঁশিটা প্যারেডে নিয়ে আসবে ও। এখন এক বন্ধুর বাসায় গেছে।

টিফিন পিরিয়ডে লাঞ্চরূমে না গিয়ে আলগোছে বাড়ির পথ ধরলাম।

চাচীকে অজুহাত দিতে হবে কেন টিফিন পিরিয়ডে বাড়ি এসেছি। কিছু একটা বানিয়ে বলে দেব।

বাড়ি পৌছলাম। দুটো গাড়িই নেই দেখে স্বস্তি পেলাম। তার মানে চাচা অফিসে আর চাচী সম্ভবত শপিঙে।

দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। সহসা এক আর্তচিৎকার কানে এল। আঁতকে উঠলাম। এবার টের পেলাম মাফিনের লেজ মাড়িয়ে ফেলেছি।

‘সরি, মাফিন,’ বললাম। বিড়ালটা কড়া চোখে এক ঝলক আমাকে দেখে নিয়ে, এক লাফে চেয়ারে উঠে শুয়ে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ডনের কামরার দিকে এগোলাম। ও আমাকে ঢুকতে মানা করার পর থেকে আর এ ঘরে আসিনি।

ডোরনব ঘুরাতেই দরজাটা খুলে গেল। সবকিছু স্বাভাবিক লাগল আমার চোখে। শুধু বাঁশিটা ছাড়া। বাক্সবন্দি হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে ওটা।

বিছানার দিকে সাবধানে এগোলাম। এত কাছ থেকে বাঁশিটাকে আগে আর দেখিনি। স্পর্শ করা তো দূরের কথা। বাক্সটার দিকে কাছিয়ে যেতেই, অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। অনেকটা মাথা ঝিম-ঝিম করার মত। বাঁশিটার উদ্দেশে হাত বাড়ালাম।

পরমুহূর্তে, সব কিছু উল্টে গেল। মেঝে মাথার উপরে, ছাদ পায়ের নীচে। আর বাঁশিটা আমার মাথার উপরে চক্কর কাটছে!

চোখের পলকে চারদিক আঁধার হয়ে গেল।

বিশ

চোখ মেললাম। আমি এখনও ডনের কামরায় দাঁড়িয়ে। ছাদ, মেঝে, সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ঝিমঝিমানি ভাবটা কেটে গেছে। বাক্সটার ভিতরে চাইলাম। বাঁশিটা নেই।

এখানে আর কিছু করার নেই, তাই স্কুলের উদ্দেশে ফিরে গেলাম। পথে রকি বীচ ক্লাব পড়ল। একটা জানালার পাশ দিয়ে যাচ্ছি, দেখলাম ডন এক ডেস্কে বসা। আমার দিকে মুখ তুলে চেয়ে হাসল। হাতে বাঁশিটা ধরা। আমি স্কুলের প্রবেশদ্বারের উদ্দেশে পা বাড়ালাম।

উপলব্ধি করলাম, প্যারেডের আগে কোন কিছু করা সম্ভব নয়। তবে যে করে হোক আমাকে আজ রাতের ধ্বংস ঠেকাতে হবে।

সারা দিন ক্লাসে বসে জানালা দিয়ে বারবার বাইরে চাইলাম। লোকজন বাড়তি আসন আর ব্যানার বসাচ্ছে। সন্ধেটা যাতে মানুষ উপভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করছে। কিন্তু ওরা তো জানে না একটা বাঁশি কীরকম বিপর্যয় ডেকে আনবে।

তিনটের ঘণ্টা বাজার পর জিমে গেলাম। ওখানে ফুটবল টিমমেটদের সঙ্গে মিলিত হলাম। কোচ কথা বললেন আমাদের উদ্দেশে।

‘ছেলেরা, আজ সন্ধেবেলায় আমরা রকি বীচের প্রশংসা আর হাততালি পাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আজকে একটা বিশেষ দিন। ব্যাণ্ড গ্র্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডের মাঝখান দিয়ে মেইন লেন ধরে মার্চ করবে। তারপর ওরা যখন ক্লাব সঙ্গীত বাজাবে তখন আমরা জিমের ভিতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে, লেন ধরে মাঠে ঢুকে পড়ব।’

‘আমরা কি বিশেষ কোনভাবে লাইন-আপ করব?’ একজন খেলোয়াড় জানতে চাইল।

‘ইউনিফর্ম নম্বর অনুসারে সারি বাঁধব আমরা। প্রথমে নম্বর এক, এভাবে। লিড প্লেয়ার হবে দলের ক্যাপ্টেন। কাজেই আমাদের এখন একটা ক্যাপ্টেন ঠিক করা দরকার। তোমরা কারও নাম বলবে?’

‘কিশোর,’ বলল মুসা।

‘আর কেউ?’ প্রশ্ন করলেন কোচ। অন্য কোনও নাম এল না। কোচ আমার দিকে ঘুরে চাইলেন।

‘কংগ্রাচুলেশন্স, কিশোর, এইমাত্র তুমি এবছরের রকি বীচ স্কুল ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পেলে।’

সহখেলোয়াড়রা হাততালি দিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দিল। আমার খুশি হওয়ার কথা, উত্তেজনা বোধ করার কথা। কিন্তু তার বদলে আতঙ্ক জেঁকে বসল মনে।

‘ঠিক আছে, ছ’টার সময় এখানে দেখা হবে। এখন বাড়ি গিয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাও,’ কোচ বললেন।

আমি কি বিশ্রাম নেব? আমাকে তো গোটা অস্বাভাবিক ঘটনাটা ঠেকাতে হবে!