মৃত্যুর ডাক – ১

এক

‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কায়রো ল্যাণ্ড করব আমরা,’ মুসার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল বিমানের স্টুয়ার্ডেস ফারজানা। ‘তোমাকে রিসিভ করতে কেউ থাকবেন নিশ্চয় এয়ারপোর্টে?’

মুখ তুলল মুসা। হাসল মৃদু। ‘হ্যাঁ, থাকার কথা।’

পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স হবে ফারজানার। মিষ্টি চেহারা, হাসিখুশি মেয়ে। মুসার মত এক খুদে যাত্রী একা একা আমেরিকা থেকে চলেছে সুদূর আফ্রিকা মহাদেশে, পিরামিডে এক বিশেষ অভিযানে অংশ নিতে, শুনে বেশ অবাকই হয়েছিল ফারজানা। মুগ্ধ হয়েছিল ওর সাহস দেখে। তাই সারা পথ মুসার ওপর বিশেষ নজর ছিল তার। সুযোগ পেলেই এসে এটা-ওটা নিয়ে গল্প করেছে ওর সঙ্গে, সুবিধে-অসুবিধে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছে। বুদ্ধিদীপ্ত মুসাকে তার যেমন ভাল লেগেছে, ওরও তেমনি ভাল লেগেছে ফারজানাকে। বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওরা পরস্পরের। মুসা বন্ধু কিশোরের কাছে বেশ কিছু শব্দ শিখেছে, সেগুলোর মধ্যে একটা ‘আপা’। ফারজানাকে আপা ডেকে চমকে দিয়েছিল ও। দু’জনই খুশি।

‘কার থাকার কথা?’

মুসার চোখে দুষ্টুমির হাসি নেচে গেল। ‘প্রাচীন মিশরীয় ফারাওদের কেউ একজন,’ বলল গম্ভীর স্বরে। ‘নয়তো কোনও জ্যান্ত মমি।’

ভ্রূ কোঁচকাল ফারজানা। ‘ঠাট্টা হচ্ছে?’ হেসে উঠল।

‘হুঁ,’ বলল মুসা। ….আমার মামা থাকবেন এয়ারপোর্টে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর সায়েম মোর্শেদ।’

পাশের খালি সিটে বসল ফারজানা। একের পর এক প্রশ্ন করছে। ‘তোমার মামা তা হলে বিজ্ঞানী? কেমন মানুষ তিনি?’

‘খুবই ভাল,’ বলল মুসা, ‘এত ভাল যে মানুষ এরকম হয় না।’

‘এদেশে আগে কখনও এসেছ?’

‘নাহ!’

‘মামার সঙ্গে বেড়াবে?’

‘জ্বি।’

‘তুমি খুব সাহসী ছেলে,’ বলল ফারজানা। ‘আমেরিকার ছেলেরা এই বয়সে একা একা কোনও স্টেট থেকে অন্য স্টেটে যেতে সাহস করে না। আর তুমি এসেছ আরেক মহাদেশে। খুব ভাল। এবার কেন এলে মামার কাছে?’

‘পিরামিডে অনেকদিন থেকে খোঁড়াখুঁড়ি করছিলেন মামা। হঠাৎ একটা প্রাচীন কবর আবিষ্কার করে বসেছেন কিছুদিন আগে। ওটার কফিন খোলার সময় আমাদের সবাইকে থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বাবা-মা আসতে পারবেন না, আমি বারবার করে বলায় আসতে দিলেন।’

‘গুড! ভেরি গুড!’ বলল ফারজানা।

মুসা জানাল, ‘একটু পর ল্যাণ্ড করব আমরা, তারপর মামার সঙ্গে মজা করে ঘুরে বেড়াব।’

সিট থেকে উঠে পড়ল ফারজানা, ‘দেখো, কফিনের কঙ্কাল দেখে ভয় পেয়ে যেয়ো না যেন।’

এদিক-ওদিক মাথা দোলাল মুসা। ‘মনে হয়, ভয় পাব না।’

মুসার এই মামা বহু বছর ধরে পিরামিড নিয়ে গবেষণা করছেন, নতুন নতুন কবরের সন্ধানে খনন করছেন। পত্র-পত্রিকায় তাঁর গবেষণার ওপর আর্টিকেলও বেরিয়েছে প্রচুর।

তরুণ বয়সে কায়রোর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতে এসেছিলেন সায়েম মোর্শেদ। সেই যে এসেছেন, আর ফেরা হয়নি দেশে। এক স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করেন। তিনিই মদিনার মা।

কয়েক বছর আগে মারা গেছেন তিনি। মামা আর বিয়ে করেননি।

মদিনা আর পিরামিড, এ-ই নিয়ে পড়ে আছেন তিনি এ-দেশে। মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কার করে চলেছেন। এ-কাজ ছেড়ে আর দেশে ফেরার ইচ্ছে নেই ডক্টর সায়েম মোর্শেদের।

মুসা জানালা দিয়ে নীল আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছে, মদিনা কী ওর বাবার কাছে থাকবে এবার?

মনে হয় থাকবে। তা হলে ওর সঙ্গে দেখা হবে।

ওর বার্ষিক পরীক্ষা তো শেষ। এখন ওর বাবার কাছেই থাকার কথা।

মদিনাকে ভাল লাগে মুসার। প্রায় সমবয়সী ওরা। মদিনা ওদের বাড়িতে বেড়িয়ে গেছে। আমেরিকায় গিয়ে খুব মজা করেছে। মৃদু হাসল মুসা, এবার ওর পালা মিশর ঘুরে দেখার। বিশেষ করে পিরামিড! মদিনা ওকে ঘুরিয়ে দেখাতে পারবে।

অবশ্য এক জায়গায় হলে সারাক্ষণ খোঁচাখুঁচি লেগে থাকে দুই ভাই-বোনে। তা ছাড়া মদিনার রয়েছে সমবয়সীদের সঙ্গে সব বিষয়ে প্রতিযোগিতা করার মানসিকতা। সেটা যদি মুসার সঙ্গে হয়, তা হলে তো কথাই নেই।

কাজে-কর্মে, শক্তিতে, মেধায়, এমনকী খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও মুসাকে তার পেছনে ফেলা চাই-ই চাই। যতবার বেড়াতে এসেছে মুসা, ততবারই পালা দিয়ে খেয়েছে ওরা তিনবেলা।

মদিনার গপাগপ রাক্ষুসে খাওয়া দেখে হেসে খুন হয়েছে মুসা। খাওয়া ভুলে তাকিয়ে থেকেছে ওর দিকে। সে-কথা মনে হতে হাসল ও আপনমনে।

মুসা ককপিটের দরজার ওপরে একটা প্যানেলে বড় বড় অক্ষরের একটা লেখা ভেসে উঠতে দেখল।

FASTEN YOUR SEAT BELTS PLEASE.

একটু পরে স্পিকারে শোনা গেল ক্যাপ্টেনের ধাতব কণ্ঠ: ‘সম্মানিত যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। আপনারা দয়া করে যার যার সিট বেল্ট বেঁধে নিন। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে কায়রো বিমানবন্দরে অবতরণ করব আমরা। অবতরণ না করা পর্যন্ত দয়া করে ধূমপান বন্ধ রাখুন। ধন্যবাদ।’

বেল্ট বেঁধে তৈরি হলো মুসা। জানালা দিয়ে সামনে তাকাল। বিমান নামতে শুরু করেছে। ডানদিকে, কায়রো শহর এখনও অনেক দূরে। শিশুদের খেলনা শহরের মত লাগছে।

কালো সাপের মত আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে চলেছে অজস্র গাড়ি, থেকে থেকে রোদের আলোয় চিকচিক করে উঠছে ওগুলোর কোনও কোনওটার ছাদ।

শহরের পাশ দিয়ে চওড়া, রুপোলি ফিতের মত বয়ে চলেছে নীল নদ।

আরেকটু নামতে নীচের দৃশ্যটা পরিষ্কার হলো। আগাগোড়া কাঁচমোড়া অসংখ্য আকাশচুম্বী ভবন ঝিলিক মারছে।

উঁচু-নিচু দালানকোঠা ও মসজিদের গম্বুজ আর মিনারে মিনারে গিজগিজ করছে কায়রো শহর।

শহরের ও-মাথা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে গিজাহ মরুভূমির শুরু। চারদিকে শুধু হলুদ বালি আর বালি।

বুক ধক ধক করছে মুসার।

ওই মরুভূমিতে রয়েছে প্রাচীন মিশরীয় সম্রাটদের কবর, পিরামিড। হয়তো দু’তিনদিন পর ওগুলোর কোনও একটার মধ্যে ঢুকবে ও মামার সঙ্গে। এমন একটা কবরের দিকে এগিয়ে যাবে ওরা, যেটা কয়েক হাজার বছর পর মানুষের সামনে উন্মুক্ত হবে।

কী পাওয়া যাবে ওখানে?

মমির ছোট্ট হাতটা বের করার জন্যে শার্টের পকেটে হাত ঢোকাল মুসা।

জিনিসটা খুব ছোট। দেখেই বোঝা যায় শিশুর হাত।

আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে ওকে উপহার দিয়েছিলেন মামা। বলেছিলেন, এটার নাম ‘সামোনার’ আহ্বানকারী। এটার নাকি অলৌকিক ক্ষমতা আছে। প্রাচীন প্রেত বা অশুভ শক্তিকে আহ্বান করে।

একেবারে মমির হাতের মতই এটা।

বিবর্ণ গোউয ব্যাণ্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। ভেতরের কোঁকড়ানো, কালচে হয়ে যাওয়া খুদে আঙুলগুলো দেখা যায় একটু একটু। মুসা প্রথমে মনে করেছিল সত্যিকারের মমির হাত নয়, পাস্টিক বা রবারের।

কিশোর-রবিন-রেমন-শ্যারন ছাড়া মুসার অন্য কোনও বন্ধু অবশ্য বিশ্বাস করেনি যে ওটা সত্যিকারের মমির হাত। এসব লোকদের হাজার বলেও বোঝানো যায়নি যে এই ছোট্ট হাতটার বিশেষ ক্ষমতা আছে। এরা বন্ধু? এরা মন্তব্য করেছে, এটা কোনও স্যুভেনিয়র। সম্ভবত তাইওয়ানে তৈরি।

যে-যাই বলুক, জিনিসটা সঙ্গে এনেছে ও। ওটা সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে হচ্ছে। অনেকে বলে ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন-তারা যা খুশি বলুক। মুসা মনে করে, ও অবিশ্বাসী না- এ পর্যন্তই।

কই, ও তো মইয়ের নীচ দিয়ে হেঁটে যায় নির্দ্বিধায়। যাত্রার আগে কলা খেতে আপত্তি নেই। এমনকী তেরো সংখ্যাটা সৌভাগ্যের সংখ্যা বলে মনে করে। এসব থেকে বোঝা যায় ওর সাহস আছে-ঠিক কি না?

অথচ, বাজে লোকরা বলে মমির হাতটা ওকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করবে না।

কিন্তু তা ঠিক না, মমির হাতটা সব সময় উষ্ণ থাকে—এটা কম বড় প্রমাণ? ছুঁলেই বোঝা যায় ওটা পাস্টিকের তৈরি না। ওটা সবসময় মানুষের হাতের মতই গরম থাকে। শুধু বিপদের সময় ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ছোঁড়াগুলো এসব বোঝে?

বিমানের ঢাকা যখন এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁয়েছে ঠিক তখনই পকেটের ভিতর হাতটা স্পর্শ করল মুসা। এবং চমকে উঠল।

বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে আছে হাতটা! চট করে শার্টের পকেট থেকে হাত বের করে আনল মুসা।

আশ্চর্য!

এমন তো হওয়ার কথা নয়!

দুই

হঠাৎ করে হাতটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কেন? এটা কী কোনও অশুভ লক্ষণ? কোনও সতর্কবাণী? বিপদে পা দিচ্ছে ও?

এ নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর সময় নেই।

ল্যাণ্ড করেছে বিমান। দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। যাত্রীরা একে একে নামছে।

জিনিসটা প্যান্টের পকেটে পুরে উঠে দাঁড়াল মুসা। নিজের ব্যাকপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে সামনে এগোল।

বের হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে আছে ফারজানা আপা। তার কাছ থেকে বিদায় নিল মুসা। শেষবারের মত ওর কোঁকড়া চুল নেড়ে দিল সে আদর করে। সাবধানে থাকার পরামর্শ দিল।

তরতর করে গ্যাংওয়ে বেয়ে টারমাকে নেমে এল মুসা।

অনেক মানুষ! সবার মাঝে ব্যস্ততা। সবাই আগেভাগে বের হতে চায়।

পুরুষদের বেশিরভাগের পরনে বিজনেস স্যুট। মহিলাদের পরনে লম্বা, ঢিলেঢালা গাউন। নেকাব দিয়ে মুখ ঢাকা তাদের। জিন্স আর টি- শার্ট পরা কিছু তরুণীকেও দেখা যাচ্ছে। সাদা স্যুট পরা গম্ভীর চেহারার কিছু লোক দেখতে পেল মুসা। ওর সামনে তিন শিশুসহ এক পরিবার। তিনটে শিশুই কাঁদছে।

অস্বস্তিতে ভুগছে মুসা। মামা কোথায়? কীভাবে তাঁকে খুঁজে পাবে ও?

ব্যাক-প্যাকটা খুব ভারী মনে হচ্ছে। ওর দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক। দুর্বোধ্য সব শব্দ কানে আসছে। ইংরেজি বলছে না কেউ।

‘উফ!’ হঠাৎ পায়ে চোট পেয়ে গুঙিয়ে উঠল মুসা।

এক মহিলার লাগেজবাহী ট্রলি ওকে ধাক্কা দিয়েছে

শান্ত হও, মুসা, নিজেকে বলল ও। দেখেশুনে, ধীরেসুস্থে হাঁটো। ব্যস্ত হয়ো না।

কিন্তু মামা যদি এয়ারপোর্টে না এসে থাকেন?

খেয়ালী মানুষ, যদি ভুলে গিয়ে থাকেন যে আজ ওর আসার কথা?

তিনি যদি তাঁর কাজে ব্যস্ত থেকে থাকেন?

ওর পৌঁছার সময় ভুলে গিয়ে থাকেন যদি?

অহেতুক দুশ্চিন্তা করার কোনও মানে হয় না, ভাবল মুসা।

আগে এই ভিড় ঠেলে বের হওয়া যাক, তারপর দেখা যাবে। সময় পালিয়ে যাচ্ছে না, কাজেই আগের কাজ আগে।

মামা না এলে টেলিফোন করবে, সিদ্ধান্ত নিল মুসা।

অবশ্যই।

টেলিফোন অপারেটরকে গিয়ে বলবে, ‘পিরামিডে কর্মরত আমার মামাকে কি টেলিফোন করতে পারি, পীজ?’

হঠাৎ একটা ব্যাপার মনে পড়তেই জমে গেল মুসা ভয়ে।

মামার টেলিফোন নাম্বার জানে না ও।

তা ছাড়া, মামা এখন যেখানে আছেন, সেখানে তাঁর টেলিফোন আছে কিনা কে জানে!

মুসা যতদূর জানে, পিরামিডের যেখানে তিনি খননকাজ চালাচ্ছেন তার পাশেই এক তাঁবুতে তিনি থাকেন। ওখানে টেলিফোন থাকার কথা নয়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুসা জনাকীর্ণ অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জে। ভিড় ঠেলে মামার মত লম্বা, তাগড়া এক লোক এগিয়ে এল ওর দিকে।

লোকটার মুখ দেখতে পেল না মুসা। লম্বা, সাদা, মুখ-ঢাকা রোব পরেছে লোকটা। পোশাকটাকে বলে বারনূজ। হুডের আড়ালে রয়েছে তার মুখ।

‘ট্যাক্সি?’ লোকটা গম্ভীর গলায় বলল মুসাকে, ‘ট্যাক্সি?’

হেসে ফেলল মুসা। ‘মামা!’

‘ট্যাক্সি? ট্যাক্সি? ট্যাক্সি রাইড?’ বলেই চলেছে লোকটা।

‘মামা! ওহ, কী যে খুশি হয়েছি আপনাকে দেখে,’ উত্তেজিত গলায় বলল মুসা। দু’পা এগিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরল ও লোকটার। হুড সরিয়ে আশান্বিত চোখে তার চেহারা দেখল।

পরক্ষণে চমকে উঠল হুডের নীচে চকচকে টাক দেখে!

তার নাকের নীচে ইয়া মোটা গোঁফ! কটমট করে চেয়ে আছে লোকটা!

জীবনে এই প্রথম তাকে দেখল মুসা!

তিন

‘মুসা! মুসা! এই যে এখানে আমরা!’

নিজের নাম শুনে চটকা ভাঙল মুসার।

অপরিচিত লোকটার একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন মামা, সঙ্গে মদিনা। রিসেপশন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে মামা হাত ইশারায় ডাকছেন ওকে।

এদিকে অপরিচিত লোকটার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। আরবি ভাষায় বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে মুসার দিকে চেয়ে।

তার কথা বুঝতে না পেরে মনে মনে খুশিই হলো মুসা।

বারনূজের হুড সরানোর জন্যে যে সে মুসার ওপর রেগে টং হয়ে গেছে, বোঝাই যায়।

‘দুঃখিত, ভুল হয়ে গেছে!’ বলেই লোকটাকে পাশ কাটিয়ে রিসেপশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল।

‘যাক ঠিকমত পৌচেছ, মুসা,’ বললেন মামা।

ঢিলেঢালা সাদা খাটো হাতার স্পোর্টস শার্ট আর ব্যাগি চিনো পরেছেন তিনি।

মদিনার পরনে ডেনিম কাটঅফ আর উজ্জ্বল সবুজ টপস। মুসার দিকে চেয়ে হাসছে সে।

‘ওই লোকটা কে? তোমার বন্ধু?’ বলল মদিনা।

‘না… মানে, ভুল হয়ে গেছে,’ আমতা আমতা করে বলল মুসা।

পেছন ফিরে তাকাল ও। লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কটমট করে চেয়ে আছে মুসার দিকেই।

ঠোঁট নড়ছে। নির্ঘাত মুসাকে গালাগালি করছে।

‘লোকটাকে তোমার মামা মনে করেছিলে বুঝি?’ মদিনা বলল। মুখের হাসি কানে গিয়ে ঠেকেছে।

জবাব দিল না মুসা। লজ্জা পেয়েছে।

মুসার সমবয়সী হলেও ওর চেয়ে ইঞ্চি খানেক লম্বা মদিনা। মাঝ পিঠ পর্যন্ত ঘন-কালো চুল। চওড়া একটা বেণি করে বাঁধা।

মদিনার উজ্জ্বল দু’চোখে উত্তেজনা ঝিলিক দিচ্ছে। মুসাকে পেয়ে বেশ খুশি সে। আর শুরুতেই মুসা বোকা বনেছে-এ তো রীতিমত আনন্দের ব্যাপার!

মুসা ব্যাগেজ এরিয়ার দিকে এগিয়ে প্লেনের ছোটখাটো ঘটনাগুলো বলল ওদের। বলল ফারজানা আপার কথা।

কায়রোর এক আবাসিক স্কুলে পড়াশুনো করে মদিনা। খুবই মেধাবী। ক্লাসে ফার্স্ট হয় প্রতিবার। টেনিসও ভাল খেলে।

মদিনার কথা ভেবে কখনও কখনও খুব খারাপ লাগে মুসার। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে ও। প্রতি গ্রীষ্মের ছুটিতে বা বার্ষিক পরীক্ষার পরের ছুটির দিনগুলো বাবার কাছে পিরামিডে চলে আসে মদিনা। বাবার সঙ্গেই কাটায় ছুটি।

কিন্তু এই মুহূর্তে ওর জন্যে খারাপ লাগছে না মুসার। মদিনা এখন পিরামিড সম্পর্কে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছে। এবার মুসা যে পিরামিডে ঢুকবে গতবারেরটার চেয়ে এটা নাকি দ্বিগুণ বড়। গর্বের সঙ্গে জানাল মদিনা, এরমধ্যে ওখানে সে বেশ কয়েকদিন কাটিয়েছে। মুসা যদি ভয় না পায়, ওকে সেখানে নিয়ে যাবে।

কনভেয়র বেল্টে চড়ে ওর সুটকেস বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে মুসা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মদিনার বড়াই শুনছে।

অবশেষে ওর নীল সুটকেসটা দেখা দিল।

ওটা অনেক কষ্টে তুলে নিয়ে পায়ের কাছে ধপাস করে ফেলল মুসা।

ওজনও বটে! ষাট কেজির কম হবে না।

আবার সুটকেসটা ওঠাবার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু একটুখানি ওঠাতেই জিভ বেরিয়ে পড়ার দশা।

‘সরো দেখি,’ মুসাকে ঠেলে সরিয়ে দিল মদিনা। এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল সুটকেসের হ্যাণ্ডেলে। ঝাঁকি দিয়ে অবলীলায় তুলে ফেলল ওটা শূন্যে। ‘চলো, বাবা,’ বলল সে, ‘এসো, মুসা। করুণার চোখে মুসাকে দেখল এক পলক।

মামাও মুসার দিকে চেয়ে আছেন।

মুচকি হাসছেন। ‘ভালই শক্তি আছে ওর, কী বলো, মুসা?’

হাঁ করে মদিনার দিকে চেয়ে থাকল মুসা। ‘তা-ই তো দেখছি!’

মামা-ভাগ্নে অনুসরণ করল মদিনাকে।

চার

মামা একটা জিপ নিয়ে এসেছেন। জিপের পেছনে তোলা হলো মুসার সুটকেস। এগিয়ে চলল শহরের দিকে।

‘আজকাল দিনের বেলায় অসম্ভব গরম পড়ে,’ ডক্টর সায়েম মোর্শেদ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘অথচ রাতে অসম্ভব ঠাণ্ডা।’

রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ব্যস্ত সড়ক। প্রচুর গাড়ি ছুটছে। হর্নের ঘন-ঘন শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড় হলো মুসার।

‘কায়রোয় থামব না আমরা,’ মামা বললেন। ‘সোজা পিরামিডে অর্থাৎ আল-গিজায় যাব।’

মদিনা হেসে বলল, ‘স্প্রে কিনে নেয়া ভাল, বাবা। ওখানকার মশাগুলো খুব বড় বড়, প্রায় ব্যাঙের সমান।’

‘আরে দূর!’ হেসে উঠলেন সায়েম মোর্শেদ। ‘মুসা নিশ্চয় মশাকে ভয় পায় না? কী বলো, ভাগ্নে?’ মুসার দিকে তাকালেন তিনি।

মুসা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘ঠিক!’

‘কাঁকড়াবিছেকেও ভয় পাও না?’ মদিনা প্রশ্ন করল। গলার সুরে বোঝা গেল মুসাকে ভয় দেখাতে চাইছে সে।

রাস্তা নির্জন হয়ে আসছে।

জিপ শহর ছাড়িয়ে মরুভূমির দিকে এগিয়ে চলেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সামনে হলদেটে মরুভূমি দেখতে পেল মুসা। বিকেলের নিস্তেজ সূর্যের নীচে সোনার মত চকচক করছে।

হলুদ বালির রাজ্যে প্রবেশ করতেই গরম বাতাসের হলকা এসে লাগল ওদের নাকে-মুখে।

মরুভূমির বুক চিরে দুই লেনের রাস্তা সামনে এগিয়ে গেছে।

বেশ কিছুক্ষণ এগোবার পর একটা পিরামিডের অস্পষ্ট অবয়ব দেখা গেল। মরুভূমির অদৃশ্য, কাঁপা-কাঁপা উত্তাপের ওপাশে ওটাকে প্রকাণ্ড এক ভূতের মত দেখাচ্ছে। সারাক্ষণ নড়ছে ভূতটা। গিজার সবচেয়ে বড় পিরামিড ওটা।

শিহরন জাগল মুসার শরীরে।

পিরামিড সে এর আগেও কয়েকবার দেখেছে। টিভিতে। তারপরও উত্তেজনা আর শিহরনের অদ্ভুত এক দোলায় দুলছে ও এখন।

‘মামা, আমার বিশ্বাস হয় না ওগুলো চার হাজার বছরের পুরনো। সত্যিই?’

সায়েম মোর্শেদের গলায় কৌতুক ঝরে পড়ল, ‘হ্যাঁ, আমার চেয়েও প্রাচীন।’ মামা বলে চলেছেন, ‘পিরামিড দেখলেই যে-কারও বুক গর্বে ভরে ওঠে, মুসা। প্রাচীন মিশরীয়রা কত বুদ্ধিমান আর স্মার্ট ছিল, পিরামিডগুলো তার প্রমাণ।’

পিরামিডের আবছা কাঠামোটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সামনে। ওটার ত্রিভুজ আকৃতির বিশাল ধূসর ছায়া পড়েছে মরুভূমির হলুদ বালিতে।

আশপাশে আরও অনেকগুলো ছোট পিরামিড।

পার্কিঙে দাঁড়িয়ে আছে কায়রো পর্যটন বিভাগের প্রচুর বাস আর কার। গাড়িগুলোর একপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে জিন চাপানো উট।

পিরামিডের চারপাশে ঘোরাফেরা করছে দেশি-বিদেশি ট্যুরিস্টরা। ছবি তুলছে প্রায় সবাই। জানা-অজানা নানান ভাষায় কথা বলছে তারা। পিরামিডের দিকে আঙুল নির্দেশ করে সঙ্গীদের এটা-ওটা বোঝাচ্ছে কেউ কেউ।

মুসাদের জিপ সরু একটা সাইড রোডে বাঁক নিল, ওরা কোলাহল পেরিয়ে নির্দিষ্ট পিরামিড পাশ কাটিয়ে পেছনে চলে এল।

‘আইসক্রিম না পেলে মারা পড়ব,’ জানান দিল মদিনা। ‘জীবনে কখনও এত গরম মনে হয় লাগেনি আমার।’

‘গরমের কথা ভুলে যাও,’ মামা বললেন। ‘কয়েক মাস পর বাবার সঙ্গ পাচ্ছ তুমি, তা-ই এখন আনন্দ করা উচিত।’

‘তোমার হাতে আইসক্রিম দেখলে আমি আরও বেশি আনন্দ করব, বাবা,’ বলল মদিনা।

হেসে উঠলেন সায়েম মোর্শেদ। রাস্তার ফটকের সামনে জিপ থামালেন।

খাকি পোশাক পরা এক গার্ড এগিয়ে এল। তাকে নিজের পরিচয়পত্র দেখালেন মামা। শরীরে ঢেউ খেলিয়ে গার্ড সামনে এগোবার অনুমতি দিল।

পিরামিডের পেছনের সরু পথ ধরে আরও কিছুটা এগোবার পর সাদা ক্যানভাসের একসারি তাঁবু চোখে পড়ল মুসার।

‘পিরামিড হিলটনে তোমাকে স্বাগতম, মুসা,’ কৌতুকের সুরে বলল মদিনা। ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে আমাদের বিলাসবহুল বাসস্থল।’

সবচেয়ে কাছের তাঁবুটার দিকে আঙুল নির্দেশ করলেন মামা। ‘ওটা।’ নির্দিষ্ট তাঁবুর পাশে জিপ দাঁড় করালেন মামা।

‘খুব আরামদায়ক,’ হেসে বলল মদিনা, ‘অবশ্য রূম-সার্ভিস খুব বাজে, পছন্দ হবে না তোমার। এবং তুমি তাঁবুতে ঢুকতেই একদল বেলে কাঁকড়াবিছে ওয়েলকাম জানাবে তোমাকে।’

মুসাকে ভয় দেখাতে সবসময় সচেষ্ট থাকে সে।

ডক্টর সায়েম মোর্শেদ জিপ থেকে নেমে মুসা আর মদিনাকে পিরামিডের পায়ের দিকে নিয়ে গেলেন।

একটা ক্যামেরা ইউনিটের ওপর চোখ পড়ল ওদের। মুভিক্যামেরা ইত্যাদি প্যাক করছে তারা। হয়তো কাজ শেষ, চলে যাচ্ছে।

লাইমস্টোন স্কোয়ারের একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণ। তার সারা শরীরে ধুলোর পরত জমেছে। মামার দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে হাসল সে। তারপর তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল।

‘আমার একজন ওয়ার্কার,’ মামা বললেন। পিরামিডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ‘ইউ.এস.এ. থেকে অনেক দূরে এখন তুমি, মুসা, তা-ই না?’

‘দারুণ লাগছে, মামা,’ মাথা দোলাল মুসা। পিরামিডের চুড়োয় সেঁটে আছে ওর দৃষ্টি। ‘মানুষ এত উঁচু পিরামিড কীভাবে তৈরি করেছে, ভাবতেই অবাক লাগে।’

সন্ধে হতে আর দেরি নেই। একটু একটু করে আঁধার নামছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও ক্রমেই ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

‘কাল তোমাদের আমার নতুন কবরে নিয়ে যাব,’ চোখ মটকে বললেন ডক্টর সায়েম মোর্শেদ। ‘ঠিক সময়েই এসেছ তুমি, মুসা। মাসের পর মাস কবরের খোঁজে মাটি খুঁড়েছি আমরা। অবশেষে খোঁজ পেয়েছি, এবার ওটার সীল ভেঙে ভিতরে ঢুকব।’

‘দারুণ!’ উত্তেজনা চেপে রাখতে চেষ্টা করছে মুসা। অন্তত মদিনার সামনে ধীর-স্থির থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভেতরের ব্যাপারটা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে বারবার।

‘কবরটা ওপেন করার পর তুমি আরও অনেক বিখ্যাত হয়ে যাবে, তা-ই না, বাবা?’ মদিনা বলল।

‘অবশ্যই! তখন তোমাকে কামড়াতে ভয় পাবে মাছিরা,’ বললেন সায়েম মোর্শেদ। ‘যাই হোক, প্রাচীন মিশরীয়রা মাছিকে কী বলত, জানো তোমরা?’

নিঃশব্দে মাথা ডান-বাঁ করল ওরা।

‘আমিও জানি না,’ কৌতুক ঝরে পড়ল তাঁর গলায়। হাসছেন। মন ভাল থাকলে কৌতুক করেন তিনি। হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। মুসার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, একটা উপহার আছে তোমার জন্যে।’

‘উপহার!’ অস্ফুট স্বরে বলল মুসা।

‘হ্যাঁ,’ ব্যাগি চিনোর পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেন মামা।

মামা যখন পকেট হাতড়াচ্ছেন, সে সময়ে তাঁর পেছনে একটা ছায়ামূর্তি নড়ে উঠতে দেখল মুসা।

মামার কাঁধের পেছনে পিরামিডের প্রবেশ-পথে নড়ে উঠেছে ওটা। তীক্ষ্ণ চোখে ওটার দিকে তাকাল মুসা। আবছা আঁধারে দেখা যায় না ঠিকমত। নড়ছে ওটা। এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। প্রথমে মুসার মনে হলো চোখের ভুল। কিন্তু চোখ ডলে আবার তাকাতেই বুঝল ভুল দেখেনি ও।

পিরামিড থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ছায়ামূর্তিটা। এখন মুসা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হলদেটে ব্যাণ্ডেজ দিয়ে জড়ানো ওটার হাত-মুখ, সারা দেহ। চোখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত।

গায়ে কাঁটা দিল মুসার। চিৎকার করার চেষ্টা করল ও। কিন্তু গলায় শব্দ আটকে গেছে। বেরোচ্ছে না!

আশ্চর্য!

মমি নড়ছে? জ্যান্ত হয়ে উঠেছে ওটা?

মামাকে সতর্ক করার সুযোগ পেল না মুসা। তার আগেই জীবন্ত মমিটা বিশ ফুটের মধ্যে এসে দাঁড়াল।

পাঁচ

পরিষ্কার দেখতে পেল মুসা ভয়ে জমে গেছে মদিনাও। অস্ফুট এক আর্তনাদ করে উঠল মদিনা।

‘মামা!’ অবশেষে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারল মুসা। ‘আপনার পেছনে! ম-ম-ম-’

অবাক হয়ে চোখ সরু করে ভাগ্নের দিকে তাকালেন সায়েম মোর্শেদ।

মমির দু’হাত ধীরে ধীরে যন্ত্রের মত উপরে উঠছে।

‘জীবন্ত মমি!’ আচমকা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

ঝড়ের বেগে ঘুরে দাঁড়ালেন সায়েম মোর্শেদ। চোখ বড় হয়ে গেল তাঁর।

‘ওরে বাবা!’ আজব এক আর্তনাদ ছাড়ল মদিনা।

ঘুরে দৌড়াতে গেল মুসা।

ঠিক সে সময় শব্দ করে হেসে উঠল জীবন্ত মমি। দু’হাত তুলে ধীরে ধীরে নাড়াচ্ছে ওটা রোবটের মত। ‘গোঁ-ওঁ-ওঁ…’ গর্জন ছেড়ে হেসে উঠল।

থতমত খেয়ে গেছেন মামা। তারপর মৃদু হাসলেন।

পিছনের ওই লোকটা একান-ওকান হাসছে। আরও দু’জন একটা

তাঁবুর কোনা থেকে বেরিয়ে এল। ক্যামেরা ম্যান।

সম্ভবত আজ সন্ধ্যার মত তাঁদের শূটিং শেষ।

অবাক হয়ে একবার মামার দিকে, একবার জীবন্ত মমির দিকে তাকাচ্ছে মুসা। বুক কাঁপছে এখনও।

একটু আগের মমিটা এসে মামার পাশে দাঁড়াল।

‘ওঁর নাম গিবসন,’ হুস করে শ্বাস ফেললেন মামা। ‘টিভির জন্যে একটা বিজ্ঞাপন চিত্রে অভিনয় করছেন। স্টিকার ব্যাণ্ডেজের বিজ্ঞাপন।

‘স্টিকার বার্ড ব্যাণ্ডেজ,’ বললেন গিবসন। ‘জিনিসটা কত ভাল, তা ক্রেতাদের বোঝানোর জন্যে তৈরি হচ্ছে ছবিটা।’

ওদিকে গিবসনদের ক্যামেরা ক্রুরা ছোট্ট একটা ভ্যানে সব যন্ত্রপাতি তুলছেন।

‘আজকের মত কাজ শেষ,’ গিবসন বললেন। ‘এখন যেতে হয়। হোটেলে ফিরেই সুইমিং পুলে ঝাঁপ দিতে হবে। পানির নীচে থাকতে হবে পুরো এক হপ্তা।’ ব্যাণ্ডেজ মোড়ানো হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। ‘আসি!’ ভ্যানের দিকে এগোলেন, তাঁর হাতঘড়ি চকচক করে উঠল।

‘বুঝতে পারছি খুব ভয় পেয়েছ তোমরা,’ বললেন মামা। ‘আমিও চমকে…’

‘কিন্তু, বাবা,’ হেসে বলল মদিনা, ‘আমি মোটেই ভয় পাইনি। তবে মুসার জন্যে এই-ই যথেষ্ট ছিল। আমি ভেবেছিলাম এই বুঝি জ্ঞান হারাল।

‘দূর!’ মুসা বলল। বেগুনী হয়ে গেছে। ‘বাজে কথা! ভয় তুমিও পেয়েছ।’

দারুণ গুল মারতে পারে মদিনা, ভাবল মুসা। জীবন্ত মমি দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিল ও। ওর চেয়ে একটুও কম ঘাবড়ায়নি।

‘তুমিও চেঁচিয়ে উঠেছিলে,’ রাগ রাগ গলায় মুসা বলল। ‘ভুলে গেলে এর মধ্যেই?’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল মদিনা। ‘তুমি যাতে ভয় পাও, তা-ই চেঁচিয়েছিলাম।’

গিবসনের কব্জিতে হাতঘড়ি ছিল! আফসোস করল মুসা, ওটার ওপর আগে কেন চোখ পড়ল না? রাগ হলো ওর। আগে জানলে অতটা ভয় পেত না।

আর যা-ই হোক, জ্যান্ত মমি হাতঘড়ি পরে না।

মামার দিকে চেয়ে বলল মুসা, ‘অনেক ভয় পাওয়া হয়ে গেছে! আমাকে আর কেউ ভয় দেখাতে পারবে না।’

‘মুসার উপহারটা কোথায়, বাবা?’ প্রসঙ্গটা পাল্টাল মদিনা। ‘বাবা, বের করো না ওটা।’

পকেট থেকে কিছু একটা বের করে সামনে মেলে ধরলেন মামা।

একটা চেইন।

লকেট ঝুলছে তার সঙ্গে।

স্বচ্ছ কমলা রঙের কাঁচের মত লাগছে লকেটটা। থেকে থেকে ঝিলিক মারছে ওটা।

মুসার হাতে তুলে দিলেন ওটা মামা। হাতে নিয়ে লকেটটা পরখ করে দেখল মুসা।

খুবই মসৃণ।

‘এটা কী, মামা?’ মুসা জানতে চাইল। ‘কী ধরনের কাঁচ এটা?’

‘কাঁচ নয়,’ মামা বললেন। ‘এটা একটা স্বচ্ছ পাথর। নাম অ্যাম্বার। চোখের সামনে ধরে ওটার ভেতরে ভাল করে তাকাও।

মামার কথা মত কাজ করল মুসা। চোখের সামনে ধরে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ওটার দিকে।

ভেতরে একটা বড়সড় পোকা দেখা যাচ্ছে। ‘ভেতরে একটা পোকা দেখতে পাচ্ছি,’ অবাক হয়ে বলল মুসা।

‘হ্যাঁ, গুবরে পোকা,’ জানালেন মামা লকেটটার দিকে চেয়ে। ‘এটা একটা প্রাচীন গুবরে পোকা। চার হাজার বছর আগে পোকাটাকে এই পাথরের মধ্যে ঢোকানো হয়েছিল। এবং দেখতেই পাচ্ছ কী সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।’

‘অদ্ভুত তো!’ বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল মদিনা। এক পা এগিয়ে এল। ‘দারুণ জিনিস, বাবা! একটা মরা গুবরে পোকা! আমার আগামী জন্মদিনে এমনই একটা উপহার চাই।’

ডক্টর সায়েম মোর্শেদ হাসলেন। তারপর ঘুরে তাকালেন মুসার দিকে। ‘প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল গুবরে পোকা, ‘ বলে মুসার হাত থেকে লকেটটা নিয়ে চেয়ে রইলেন ওটার দিকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর ফিরিয়ে দিলেন। ‘মিশরীয়রা গুবরে পোকাকে অমরত্বের প্রতীক মনে করত।’

তীক্ষ্ণ চোখে লকেটের গুবরে পোকাটার দিকে তাকাল মুসা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটার ছয়টা পা। মনে হচ্ছে এইমাত্র মরেছে ওটা। কী চমৎকার ভাবে একটা পাথরের মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়েছে পোকাটাকে!

এত বছর পরও কিছুই হয়নি।

‘গুবরে পোকাকে অমরত্বের প্রতীক মনে করত ওরা,’ আবারও বললেন মামা। ‘তবে গুবরে পোকা কামড়ালে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় বলেও মনে করা হত।’

মদিনা ফিসফিস করে বলল, ‘অদ্ভুত তো!’

‘দারুণ লাগছে দেখতে লকেটটা,’ খুশি হয়ে মুসা বলল। ‘সত্যিই পোকাটা চার হাজার বছর ধরে এই পাথরের মধ্যে আছে?’

মাথা নাড়লেন মামা। ‘গলায় পরো.’ বললেন। ‘এটার প্রাচীন ক্ষমতা এখনও থাকতে পারে।’

মাথা গলিয়ে দিল মুসা চেইনটার ভিতর। শার্টের নীচে ঢুকিয়ে দিল লকেট। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ঠাণ্ডা এক অনুভূতি জাগল।

‘ধন্যবাদ, মামা,’ মুসা বলল। ‘উপহারটা খুব সুন্দর!’

ডক্টর সায়েম মোর্শেদ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। ‘চলো, তাঁবুতে যাওয়া যাক।’

কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল মুসা। মদিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকল অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।

সারা শরীর কাঁপছে মদিনার! হাঁ হয়ে গেছে মুখ! মুসার বুকের দিকে আঙুল তাক করে আছে সে!

‘কী হলো?’ উত্তেজিত গলায় বললেন আর্কিওলজিস্ট।

‘গুবরে পোকাটা!’ চাপা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল মদিনার মুখ দিয়ে। ‘ওটা… ওটা… পালিয়ে গেছে, নেই! আমি দেখেছি পাথর থেকে বেরিয়ে চলে যেতে!’ মুসার পায়ের দিকে আঙুল দেখাল সে। ‘ওই যে, ওখানে!’

‘কী!!’ আর্তনাদ করেই বসে পড়ল মুসা। ঘুরে দেখতে গেল পোকাটাকে।

কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।

কুট করে কামড়ে দিয়েছে কিছু একটা ওর পায়ে!

বুঝতে পারল মুসা, গুবরে পোকাটা ওর পায়ে কামড় দিয়েছে

ছয়

সারা শরীর কাঁপছে মুসার! কণ্ঠতালু শুকিয়ে গেছে! মামার বলা কথা দুটো বাজছে ওর কানে, ‘গুবরে পোকাকে অমরত্বের প্রতীক মনে করত ওরা। তবে মনে করত গুবরে পোকা কামড়ালে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়!’

তাৎক্ষণিক মৃত্যু?

আর্তনাদ চেপে উঠে দাঁড়িয়ে মদিনার দিকে ঘুরল মুসা।

হাসছে সে!

মুসা বুঝতে পারল ওর পায়ে চিমটি কেটেছে মদিনা।

এখনও বুক ধকধক করছে মুসার। লকেটটা তুলে চোখের সামনে ধরল। গুবরে পোকাটা দেখা যাচ্ছে ভেতরে।

আগের মতই!

চার হাজার বছর ধরে যেভাবে আছে, ঠিক সেভাবেই নিথর হয়ে আছে।

অদ্ভুত একটা শব্দ বেরোল মুসার মুখ দিয়ে। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ওর। এত বোকা আর ভীতু ও!

মদিনা এবার কি ওর সঙ্গে শুধু কৌতুকই করবে? ভাবল মুসা। তা-ই যদি হয়, সামনে অনেক দুর্ভোগ আছে কপালে।

মামাতো বোনটাকে ভালই লাগে মুসার। অবশ্য সে যখন সবকিছুতে প্রতিযোগিতা করতে চায়, যে-করে হোক জয়ী হতে চায়, তখনকার সময়টা ছাড়া। এসময় খুব বাজে লাগে মদিনাকে।

যেমন এখন।

এখন মদিনাকে চিমটি কাটতে ইচ্ছে করছে মুসার। গাল দিতে ইচ্ছে করছে।

কিন্তু চট করে মুসা মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল। লকেটটা শার্টের নীচে ঢুকিয়ে রাখল।

‘দারুণ ভয় দেখালাম তোমাকে,’ হেসে বলল মদিনা। ‘কী বলো?’

.

অনেক রাত হয়েছে।

নিজের বিছানায় শুয়ে তাঁবুর ছাদের দিকে চেয়ে আছে মুসা।

বাইরে মরুভূমির বুকে বাতাসের শোঁ-শোঁ গর্জন।

বাতাসের ঝাপটায় তাঁবুর ক্যানভাসে ফতফত শব্দ উঠছে।

লম্বা ভ্রমণ শেষে ক্লান্তিতে আরও আগেই ঘুম আসার কথা ছিল।

কিন্তু আসছে না। চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছে না ও।

পাশ ফিরল মুসা।

তাঁবুর দরজা দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে।

তাঁবুর ছাদে, দেয়ালে কুয়াশা জমছে। ঠাণ্ডা লাগছে।

কিছুতেই ঘুম আসছে না মুসার। বুঝতে পারছে আজ আর ঘুম আসবেও না।

বালিশ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ও। পিঠের নীচের কম্বলটা শক্ত ঠেকছে।

বাসায় থাকলে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ত মুসা। কিন্তু ওর ঘর এখন হাজার হাজার মাইল দূরে। রুক্ষ মরুভূমির বুকে তাঁবুর নীচে ঘুমানো যে কত কঠিন, আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে।

এখন ভয় পাচ্ছে না ও। ভয়ে ঘুমাতে পারছে না, তা নয়। একটু দূরে ঘুমিয়ে আছেন মামা আর মদিনা।

কেন যেন নিজের অজান্তেই সতর্ক হয়ে রয়েছে মুসা এই মুহূর্তে। এত সতর্ক যে, বাইরে বাতাসে খেজুর গাছের মৃদু নড়াচড়ার শব্দও কানে আসছে। অনেক দূরে মরুভূমির সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচলের শব্দ হচ্ছে।

একটা কিছু বুকের ওপর নড়ে উঠতেই পিলে চমকে উঠল মুসার।

খুব সতর্ক ও। পরিষ্কার টের পাচ্ছে নড়াচড়া।

কিছু একটা খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে বুকের ওপর।

একটা ব্যাপারই ঘটতে পারে শুধু, ভাবল ও। অ্যাম্বার লকেটের ভেতরে নড়ছে গুবরে পোকাটা।

এবং এখন এটা কারও ঠাট্টা নয়।

সত্যি!

চট করে উঠে বসল মুসা। ধুকপুক করছে বুক। গলা শুকিয়ে আসছে। ভয়ে কাঁপছে।

বুকের ওপর থেকে লকেটটা তুলে চাঁদের আলোয় চোখের সামনে ধরল। গুবরে পোকাটা দেখতে পেল। ওটা কমলা রঙের ফাঁদের মধ্যে বন্দি।

‘তুমি কী নড়ছ?’ পোকাটার দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ও। ‘তোমার পাগুলো কি নড়ছে?’

নিজের বোকামিতে রাগ হলো ওর ভীষণ।

চার হাজার বছর আগের মরা একটা গুবরে পোকার সঙ্গে পাগল ছাড়া আর কে কথা বলে?

পাগল ছাড়া আর কে ভাববে ওটা এখনও জ্যান্ত?

নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে লকেটটা শার্টের নীচে ঢুকিয়ে দিল মুসা।

জানে না সে, জিনিসটা তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

জানে না মুসা, ওটা তাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে, নাকি মেরে ফেলবে।

সাত

পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল মুসার, সূর্যের তাপে গরম হয়ে উঠেছে তাঁবু। টেণ্ট-ফ্ল্যাপের ফাঁক দিয়ে রোদের আলো ভেতরে এসে পড়ছে। * উঠে চোখ ডলল মুসা। মামা আর মদিনা নেই।

কম্বলের ওপর শোয়ার কারণে পিঠ ব্যথা করছে।

কিন্তু ওর উত্তেজনা ব্যথাটাকে দূর করে দিল। আজ সকালেই ওদের যাওয়ার কথা নতুন আবিষ্কৃত কবরে।

রাতের পোশাক খুলে টি-শার্ট আর জিন্স পরে নিল মুসা। অ্যাম্বার লকেট শার্টের নীচে ঢুকিয়ে দিল, তারপর মমির হাতটা সাবধানে রাখল জিন্সের পকেটে।

মমির হাত আর অ্যাম্বার লকেট আমার সঙ্গে আছে, সুতরাং ভয় কি? নিজেকে সাহস জোগাল ও। বিপদ-আপদ আমার ধারে-কাছে আসতে পারবে না।

চুল আঁচড়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল ও।

খেজুর গাছের মাথার ওপর উঠে গেছে সূর্য। এর মধ্যেই তেতে উঠেছে পরিবেশ। ঝকঝক করছে হলুদ মরুভূমি।

বিশুদ্ধ বাতাসে লম্বা করে একটা দম নিল মুসা। ভাবল, এই গরমে হাঁটতে হবে না। উটের পিঠে চড়ে যাওয়া যাবে জায়গামত।

মেস টেণ্টের লম্বা টেবিলের এক কোণে মামা আর মদিনা বসা।

মামা তাঁর প্রিয় ব্যাগি চিনো আর খাটো হাতার সাদা স্পোর্টস শার্ট পরেছেন। সামনে রাখা কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে।

কালো, লম্বা চুল পনিটেইল করে বেঁধেছে মদিনা। সাদা টেনিস শর্টসের ওপর টকটকে লাল টপস পরেছে।

ভেতরে ঢুকল মুসা। হাসি উপহার দিলেন মামা। মদিনাও হাসল।

ঢকঢক করে একগাস অরেঞ্জ জুস গিলল মুসা।

ডক্টর সায়েম মোর্শেদের তিন ওয়ার্কার টেবিলের ও-মাথায় বসে নাস্তা করছে। তারা নিজেদের কাজ সম্পর্কে উত্তেজিত গলায় আলোচনা করছে। ‘আজ আমরা ভেতরে ঢুকব,’ একজনকে বলতে শুনল মুসা।

‘কিন্তু সীলটা একদিনে ভাঙা যাবে কিনা সন্দেহ,’ আরেকজন বলল।

মদিনার পাশে বসল মুসা। ‘কবরটার ব্যাপারে কিছু বলুন, মামা, ‘ বলল। ‘ওটা কার কবর? কোথায় ওটা?’

তার আগে তোমাকে গুড মর্নিং তো বলতে দেবে,’ হেসে বললেন সায়েম মোর্শেদ।

মুসার নাস্তার পেটের ওপর ঝুঁকে এল মদিনা। ‘দেখো, মুসা, তোমার চেয়ে আমার পেটে খাবারের পরিমাণ কত বেশি।’

তিনবেলা প্রতিযোগিতা করে খাওয়া মদিনার অভ্যেস।

উত্তরে মুসা বলল, ‘তাতে কি? আমার গাসে অরেঞ্জ জুসের পরিমাণ বেশি।’

মুসা কৌতুক করে কথাটা বলেছে। কিন্তু মদিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে নিজের জুসের গাসটা পরীক্ষা করে তারপর সন্তুষ্ট হলো।

সায়েম মোর্শেদ ন্যাপকিনে মুখ মুছলেন। কালো কফির কাপে লম্বা একটা চুমুক দিলেন।

‘যদি আমার ভুল না হয়,’ শুরু করলেন মামা, ‘যে কবর আবিষ্কার করছি আমি, ওটা একজন প্রিন্সের কবর। সম্রাট তুতেনখামেনের কাজিন সে।’

‘কিং তুত নামে তিনি পরিচিত,’ মুসাকে বলল মদিনা।

‘জানি,’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা।

‘১৯২২ সালে কিং তুতের কবর আবিষ্কৃত হয়,’ বলে চলেছেন মামা। ‘তাঁর বিশাল সমাধি-কক্ষের ভেতরটা ধন-সম্পত্তিতে ভর্তি ছিল। ওটা ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে উলেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার।’ তাঁর মুখে ফুটে উঠল একটুকরো হাসি। ‘অবশ্য আমার আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত।’

‘তার মানে আপনি ওটার চেয়েও উলেখযোগ্য কিছু আবিষ্কার করেছেন, এই তো?’ জিজ্ঞেস করল মুসা। খাচ্ছে না কিছু সে। মামার গল্পে ডুবে গেছে, খাওয়ার কথা মনে নেই।

কাঁধ উঁচালেন মামা। ‘চেম্বার উন্মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না কবরের মধ্যে কী আছে। অবশ্য আমি আশাবাদী। আমার ধারণা প্রিন্স খোর-রো’র সমাধি-ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছি আমি। কিং-এর কাজিন ছিল সে। এবং শোনা যায়, খোর-রো কিং তুতের মতই সম্পদশালী ছিল।

‘এবং তোমার ধারণা রাজপুত্রের সঙ্গে তার সব ধন-সম্পত্তিও সমাধিস্থ করা হয়েছে, তা-ই না, বাবা?’ জিজ্ঞেস করল মদিনা।

কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের ওপর রাখলেন সায়েম মোর্শেদ। ‘কে জানে? ওখানে মাথা ঘুরে যাওয়ার মত ধন- সম্পত্তি থাকতে পারে। অথবা শূন্য একটা রূমের মতই সম্পূর্ণ শূন্য থাকতে পারে। হয়তো কিছুই নেই। খুলে দেখা যাবে ফক্কা!’

‘কিন্তু কেন, মামা?’ জানতে চাইল মুসা। ‘পিরামিডের ভেতরে শূন্য কবর থাকবে কেন?’

‘কবর চোর,’ কপাল কুঁচকে জবাব দিলেন মামা। ‘প্রিন্স খোর- রোকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন থেকে কবর চোররা পিরামিডে সমাধি-ক্ষেত্রগুলো ভেঙে ধনরত্ন চুরি করছে।’

উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস ছাড়লেন সায়েম মোর্শেদ। ‘এতগুলো মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর হয়তো শূন্য একটা কক্ষ উন্মুক্ত করতে চলেছি আমি।’

‘না, মামা,’ আশান্বিত গলায় মুসা বলল। ‘আমার মনে হয় ওখানে আমরা প্রিন্সের মমি পাব। আর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তিও।

মুসার দিকে চেয়ে হাসলেন ডক্টর মোর্শেদ। ‘অনেক কথা হলো। তাড়াতাড়ি নাস্তা সারো, কাজে যেতে হবে।’

নাস্তা শেষ করে মামা ও মদিনার সঙ্গে মেস টেণ্ট থেকে বেরিয়ে এল মুসা।

সাপ্লাই টেণ্ট থেকে খনন করার সাজসরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে এল দু’জন লোক। তাদের দেখে হেসে হাত নাড়ালেন মামা, কথা বলার জন্যে এগিয়ে গেলেন।

মুসা আর মদিনা তাঁবুর দিকে হাঁটতে লাগল।

মদিনা ঘুরে তাকাল মুসার দিকে। গম্ভীর হয়ে গেছে সে হঠাৎ করে।

‘মুসা,’ নরম গলায় বলল মদিনা, ‘খুব খারাপ লাগছে আমার।’

‘কেন?’ ঘাবড়ে গিয়ে মুসা বলল। ‘কী হলো আবার? গুবরে পোকা কামড় দিয়েছে?’

‘দূর, না,’ বিরক্তি ঝরল মদিনার গলায়। ‘বাবার কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগছে আমার।’

ঘাড় ফিরিয়ে মামার দিকে তাকাল মুসা। কথা বলছেন তিনি লোকদুটোর সঙ্গে।

‘কেন?’ অবাক হলো মুসা। ‘মামা তো ভাল আছেন।’

‘সেই জন্যেই ভয় করছে আমার,’ চাপা গলায় মদিনা বলল। ‘বাবা যেমন খুশি, তেমনি উত্তেজিত। তাঁর আবিষ্কার তাঁকে আরও বিখ্যাত করে তুলবে এমনটি আশা করছেন তিনি।’

‘খুব স্বাভাবিক,’ মুসা বলল। ‘তাতে খারাপ লাগার কী হলো?’

‘কিন্তু ওটা যদি একটা শূন্য চেম্বার হয়?’ গভীর উদ্বেগ নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল মদিনা, ‘যদি কবর চোরেরা কবরটা আগেই লুট করে থাকে? অথবা ওটা যদি প্রিন্স খোর-রো’র কবর না হয়? সীল ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর যদি দেখা যায় ওটা সাপ-খোপে ভর্তি ধুলোমলিন প্রাচীন একটা ঘর ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন?’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মুসা।

‘খুব ভেঙে পড়বেন বাবা, আমি শিয়োর,’ বলে চলেছে মদিনা। ‘ওটার ওপর খুব নির্ভর করে আছেন উনি। সেরকম কিছু যদি ঘটে, সেটা সামলে উঠতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।’

‘খারাপ দিকটা ভেবে মন খারাপ করছ কেন, মদিনা?’ জবাবে বলল মুসা। ‘যদি…’

ও কথা শেষ না করে থেমে গেল।

ওদের দিকে এগিয়ে আসছেন সায়েম মোর্শেদ। ‘চলো, চেম্বারে যাওয়া যাক,’ উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘ওয়ার্কাররা ধারণা করছে আমরা কবরটার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আজই হয়তো পৌঁছে যেতে পারব সমাধি-কক্ষের ভেতর।’

তিনি মুসা ও মদিনার কাঁধে দু’হাত রাখলেন, ওদের নিয়ে পিরামিডের দিকে চললেন।

পিরামিডের ছায়ায় এসে পৌঁছতেই মুসা শীতল বাতাসের ছোঁয়া পেল। আরেকটু এগোতে নিচু করে খোঁড়া সমাধি-কক্ষের প্রবেশ পথটা দেখা গেল। খুব সহজেই ওটা দিয়ে একজন মানুষ ভেতরে ঢুকতে পারবে।

ভেতরে উঁকি দিয়ে মুসা দেখল একটা সুড়ঙ্গ অন্ধকার ভেদ করে সামনে চলে গেছে। ভাবল, হোঁচট খেয়ে পড়ে না গেলেই হয়। ভয়ের শক্ত একটা গিঁট অনুভব করল ও পাকস্থলীতে।

কল্পনায় দেখতে পেল, গর্ত দিয়ে নীচে পড়ে যাচ্ছে ও। পড়ছে তো পড়ছেই।

আসলে মদিনার সামনে পড়ে যেতে চায় না ও। পড়লে সারাজীবন ওর খোঁচা খেতে হবে।

মামা ওদেরকে হলুদ রঙের দুটো হেলমেট দিলেন। খনি শ্রমিকদের হেলমেটের মত। এগুলোর সামনে আলো জ্বলছে।

‘কাছে কাছে থেকো,’ বললেন মামা।

‘ঠিক আছে, মামা,’ বলল মুসা। মদিনার দিকে তাকাল ও।

হেলমেট মাথায় অ্যাডজাস্ট করছে সে। মুসার মনে হলো ও রীতিমত শান্ত। ওর আত্মবিশ্বাস আছে।

মামা হেলমেটের স্ট্র্যাপ থুতনির নীচে এঁটে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।’ ঘুরে গর্তের মুখে পা রাখলেন তিনি।

সেই মুহূর্তে পেছন থেকে কে যেন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাঁড়ান! পীজ, দাঁড়ান! আগেই ভেতরে ঢুকবেন না!’

ঘুরে তাকাল সবাই একযোগে।

আট

এক তরুণী তীর বেগে দৌড়ে আসছে। দৌড়ের তালে তার লম্বা, কালো চুল পিঠের ওপর দুলছে। একহাতে একটা ব্রিফকেস ঝুলছে তার। গলায় ক্যামেরা।

কাছে এসে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল তরুণী। মিষ্টি হাসি উপহার দিল সায়েম মোর্শেদকে। লম্বা একটা দম নিয়ে জিজ্ঞেস করল সে, ‘ডক্টর মোর্শেদ?’

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলালেন মামা। তাকে আরেকটু সুস্থির হওয়ার সময় দিলেন।

মেয়েটা খুব সুন্দরী। দীঘল কালো চুল। খাড়া নাক। দুধে আলতায় মেশানো গায়ের রঙ। কপালের মাঝ পর্যন্ত ঝোলানো চুল সুন্দর করে ছাঁটা। অমন সুন্দর সবুজ চোখ কখনও দেখেনি মুসা।

তরুণী সম্পূর্ণ সাদা পোশাক পরেছে। সাদা সুট-জ্যাকেট। তবে, মেয়েটা বেশ খাটো। মদিনার চেয়ে বড়জোর এক-দেড় ইঞ্চি লম্বা হবে।

সিনেমার অভিনেত্রী হতে পারে, ভাবল মুসা। সত্যিই অপরূপ সুন্দরী। বয়স বড়জোর পঁচিশ কি সাতাশ।

ব্রিফকেসটা পায়ের কাছে রাখল তরুণী। হাত দিয়ে সামনে চলে আসা অগোছাল চুল ঠেলে দিল পেছনে। ‘চেঁচিয়ে ডাকতে হয়েছে বলে দুঃখিত, ডক্টর মোর্শেদ। আসলে আপনারা পিরামিডে ঢোকার আগেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তা-ই চেঁচিয়েছি।’

মামা কিছুক্ষণ চোখ সরু করে তরুণীকে লক্ষ করলেন। মাথা থেকে হেলমেট খুললেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘সিকিউরিটি গার্ডরা আপনাকে ঢুকতে দিল? এটা তো সাধারণের জন্যে নিষিদ্ধ এলাকা।

‘আমি সাংবাদিক,’ জবাব দিল তরুণী। ‘আমার প্রেস কার্ড দেখিয়েছি ওদের। ‘কায়রো সান’ পত্রিকার সাংবাদিক আমি। আমার নাম নীলা সুমাইয়া। আশা করছি…’

‘সুমাইয়া!’ তরুণীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন মামা। ‘চমৎকার নাম!’

মুচকি হাসল নীলা সুমাইয়া। ‘ধন্যবাদ, ডক্টর। নামটা আমার মা রেখেছেন, নীল নদের সঙ্গে মিল রেখে।’

‘ওয়েল, নামটা খুব সুন্দর,’ আবারও বললেন সায়েম মোর্শেদ। চিন্তা করলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, ‘আমি চাই না এই মুহূর্তে আমার কাজ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হোক।’

নীলা সুমাইয়ার নীচের ঠোঁট কামড়াল কয়েকবার। ‘ডক্টর আসাদ ওমরের সঙ্গে কয়েকদিন আগে কথা হয়েছে আমার।’

‘অ্যা?’ বেশ অবাক হলেন যেন মামা।

‘হ্যাঁ, ডক্টর ওমর আপনার আবিষ্কার নিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছেন।’ সুমাইয়া গভীর আগ্রহ নিয়ে মামার মুখের দিকে তাকাল।

‘আবিষ্কার?’ বিস্ময় আরও বাড়ল ডক্টর মোর্শেদের। ‘আসলে এখনও কিছুই আবিষ্কার করিনি আমি। সীল ভেঙে ভেতরে ঢুকে হয়তো দেখব ওটা একটা সাধারণ শূন্য চেম্বার, কবর-টবর কিছুই নেই।’

‘ডক্টর আসাদ ওমরের মুখে তেমন কিছু শুনিনি তো!’ জবাব দিল নীলা। ‘তাঁর ধারণা আপনি গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়ার মত কিছু আবিষ্কার করতে চলেছেন।’

হাসলেন আর্কিওলজিস্ট। নীলাকে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার পার্টনার কখনও কখনও উত্তেজিত হয়ে ওরকম কথা বলে বসেন।’

নীলা সুমাইয়া মামার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ‘আপনার সঙ্গে আমি কি পিরামিডে ঢুকতে পারি?’ অনুরোধ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে। মুসা আর মদিনার ওপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবার মামার দিকে তাকাল। ‘তা ছাড়া, আপনার সঙ্গে আরও ভিজিটর আছে, দেখতে পাচ্ছি।’

‘আমার মেয়ে মদিনা,’ জবাব দিলেন ডক্টর মোর্শেদ। ‘আর ভাগ্নে, মুসা।’

‘আমিও কী আপনার সঙ্গে ভেতরে যেতে পারি?’ আবারও জানতে চাইল সুমাইয়া। ‘কথা দিচ্ছি, আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার কাজ সম্পর্কে একটা শব্দও লিখব না।’

চিবুক চুলকাচ্ছেন সায়েম মোর্শেদ। গভীরভাবে যখন কিছু চিন্তা করেন, তখন চিবুক চুলকানো তাঁর স্বভাব। হেলমেটটা আবার মাথায় চাপিয়ে বললেন তিনি, ক্যামেরার দিকে তাঁর চোখ। ‘ছবিও তোলা যাবে না।’

‘অর্থাৎ আমি যেতে পারছি আপনার সঙ্গে?’ ভীষণ উত্তেজিত, মনে হলো নীলা সুমাইয়াকে।

‘স্রেফ দর্শক হিসেবে,’ বললেন মামা। নীলার সঙ্গে কথা বলার সময় বারবার গলায় তিক্ততা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু মুসা বেশ বুঝতে পারছে, তরুণীকে অপছন্দ হয়নি মামার।

‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, সার,’ বলেই মামাকে ভুবনমোহিনী হাসি উপহার দিল নীলা সুমাইয়া।

মামা তরুণীকে স্টোরেজ কার্ট থেকে আরেকটা হলুদ হেলমেট বের করে দিলেন। ‘আজ হয়তো আমরা শিহরন জাগানো কোনওকিছু আবিষ্কার করতে পারব না,’ সতর্ক করে দিলেন তিনি। তবে কিছু একটা আবিষ্কারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারব।’

হেলমেট মাথায় চাপিয়ে মুসা আর মদিনার দিকে ফিরল নীলা। ‘নিশ্চয়ই এটা তোমাদের প্রথম পিরামিডে ঢোকা?’ জিজ্ঞেস করল।

‘না,’ মদিনা গর্বের সঙ্গে জানাল। ‘এই পিরামিডেই আরও তিনবার ঢুকেছি আমি।

‘আমি গতকাল আমেরিকা থেকে মিশরে এসেছি,’ মুসা জানাল। ‘সুতরাং…’

কথা শেষ করতে পারল না মুসা।

নীলা সুমাইয়ার মুখভঙ্গি পুরো বদলে গেছে। কেমন অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে মুসাকে দেখছে সে।

কেন ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে নীলা সুমাইয়া? নিজেকে প্রশ্ন করল মুসা। এবং বুঝতে পারল, আসলে তরুণীর নজর কেড়েছে ওর অ্যাম্বার লকেটটা। কখন লকেটটা শার্টের ওপরে চলে এসেছে, খেয়াল করেনি ও।

বিস্ময়ে হাঁ করে চেয়ে আছে তরুণী। চাপা স্বরে আর্তনাদ করে বলল, ‘সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না! তা কি করে হয়!’

নয়

‘কী হলো!’ ঘাবড়ে গিয়ে মুসা বলল।

নীলা সুমাইয়া কিছু না বলে নীরবে জ্যাকেটের নীচ থেকে নিজের লকেটটা টেনে বের করল।

ঠিক মুসার লকেটের মতই আরেকটা অ্যাম্বার লকেট!

‘আজব তো!’ রুদ্ধশ্বাসে বললেন মামা।

এগিয়ে এসে মুসার লকেটটা হাতে নিয়ে পরখ করল নীলা। ‘তোমারটার ভেতরে গুবরে পোকা আছে দেখছি!’

মুসার লকেট ছেড়ে নিজেরটা উঁচিয়ে ধরল সে। ‘দেখো মুসা, আমারটা শূন্য। গুবরে পোকা নেই।’

তীক্ষ্ণ চোখে ওটার দিকে তাকাল মুসা। কমলা রঙের স্বচ্ছ অ্যাম্বার পাথর। ভেতরে কিছুই নেই।

‘আপনারটাই বেশি সুন্দর,’ মদিনা বলল নীলাকে। ‘একটা, মরা গুবরে পোকা কখনোই আমি গলায় ঝোলাব না।’

মদিনার কথায় অবাক হলো মুসা। প্রথমে লকেটটা দেখে জন্মদিনে এমন একটা লকেট উপহার চেয়েছিল মদিনা। অথচ এখন বলছে অন্য কথা! আশ্চর্য!

‘কিন্তু শুনেছি ওই পোকা সৌভাগ্যের প্রতীক,’ নীলা বলল। সাদা জ্যাকেটের নীচে ঢুকিয়ে দিল সে নিজের লকেট। তবে শূন্য অ্যাম্বার পাথরের লকেট যে দুর্ভাগ্যের প্রতীক, তা মনে করি না আমি।’

‘আমিও না’ মামা বললেন শুকনো গলায়। গর্তের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

.

পাঁচ মিনিট আগে কীভাবে হারিয়ে গেল এখনও বুঝে উঠতে পারছে না মুসা।

মামা আর নীলার পেছন পেছন হাঁটছিল ও আর মদিনা। পাশাপাশি।

শুনতে পাচ্ছিল মামা বলছিলেন সুড়ঙ্গের দেয়াল গ্র্যানেট আর লাইমস্টোনের তৈরি।

সবার হেলমেটের আলো জ্বলছিল।

হলুদ আলোর লম্বা বীমগুলো সুড়ঙ্গের ধুলোমলিন মেঝে আর দেয়ান আলোকিত করে তুলছিল। সে আলো ধরে এগিয়ে চলেছিল ওরা।

সুড়ঙ্গের মাথার ওপর সিলিঙ খুব নিচু, এবড়োখেবড়ো।

যতটা সম্ভব সামনে ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে, একটু অসাবধান হলে বিপদ হবে। সুড়ঙ্গটা আঁকাবাঁকা। ডানে-বাঁয়ে অজস্র তার শাখা- প্রশাখা। এভাবেই তৈরি করা হয়েছে। এগুলো সম্ভাব্য রত্নচোরদের গোলক-ধাঁধায় ফেলে হয়রান করার জন্যে। ওর মধ্যে একবার পা ফেললে আর রক্ষে নেই। প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। অনেক চোর, এমনকী বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত, এই গোলক-ধাঁধায় পথ হারিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছে।

‘এগুলো ফাঁদ, হাঁটতে হাঁটতে মন্তব্য করেছিলেন একবার মামা। ‘শুরু আছে, শেষ নেই। ঢুকলেই মরণ।’

-হেলমেটের আলোয় সামনে তেমন ভাল দেখা যাচ্ছিল না। কয়েকবারই হোঁচট খেয়েছে মুসা। দেয়ালের কর্কশ পাথরে ঘষা খেয়ে ছড়ে গেছে কনুই।

জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডাও।

আবহাওয়া শীতল।

শীত করছিল ওর। ভাবছিল, একটা গরম কিছু পরে এলে ভাল হত।

সামনে মামা কিং তুত আর প্রিন্স খোর-রো সম্পর্কে বলছিলেন নীলাকে। কেন যেন মুসার মনে হচ্ছিল মামা মেয়েটার ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। মেয়েটাকে কী পছন্দ হয়ে গেল তাঁর?

‘ঘটনাটা খুবই থ্রিলিং,’ নীলাকে মন্তব্য করতে শুনেছিল মুসা। ‘ডক্টর ওমর আর আপনি আমাকে এরকম একটা দৃশ্য দেখার সুযোগ দিয়েছেন ভাবতেই আনন্দ লাগছে।’

‘ডক্টর আসাদ ওমরটা কে?’ মদিনার কানে কানে ফিসফিসিয়ে জানতে চেয়েছিল মুসা।

‘বাবার পার্টনার। কিন্তু বাবা লোকটাকে পছন্দ করেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত লোকটাকে দেখতে পাবে তুমি। বাবার আশপাশেই থাকেন সবসময়। আমার ভাল লাগে না তাঁকে।’

সুড়ঙ্গের দেয়ালে আজব এক চিত্র দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল মুসা। কোনও জন্তুর মাথার চিত্র।

‘দেখো দেখো, মদিনা,’ উত্তেজিত চাপা স্বরে বলেছিল ও। ‘প্রাচীন চিত্র!’

চোখ ডলে সেদিকে তাকিয়েছিল মদিনা। ‘নিশ্চয়ই বার্ট সিম্পসনের কাজ,’ বলেছিল সে। ‘বাবার এক ওয়ার্কার, সে-ই হয়তো ওটা এঁকেছে।’

‘জানতাম,’ মিথ্যে বলেছিল মুসা হেসে। ‘তোমাকে পরীক্ষা করলাম আর কি

ফালতু চিত্র থেকে চোখ সরিয়েই অবাক হয়ে গিয়েছিল মুসা।

মদিনা কোথায়?

হঠাৎ একটা সরু আলো মাথার ওপর দিয়ে সরে যেতে দেখেছিল মুসা। বুঝতে পেরেছিল ওটা মদিনার হেলমেটের আলো।

‘অ্যাই মদিনা, দাঁড়াও,’ চেঁচিয়ে উঠেছিল মুসা। কিন্তু আলোটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সুড়ঙ্গের একটা বাঁক ঘুরে।

.

আরেকটা হোঁচট খেল মুসা।

হেলমেট সুড়ঙ্গের দেয়ালে বাড়ি খেল। নিভে গেল আলো।

‘অ্যাই মদিনা! মামা!’ গলা ছেড়ে ডেকে উঠল ও। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আলকাতরার মত অন্ধকারে সামনে এগোতে ভয় পাচ্ছে।

‘মদিনা! তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না?’ সরু সুড়ঙ্গের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল মুসার চিৎকার।

কিন্তু জবাব এল না।

মাথা থেকে হেলমেট খুলে ফেলল মুসা। লাইট জ্বালতে চেষ্টা করল। নব ডানে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে ঝাঁকিঝুঁকি দিয়ে অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু আলো জ্বলল না।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওটা আবার মাথায় চাপাল আতঙ্কিত মুসা। কী হবে এখন? ভয়ে নীল হয়ে গেছে ওর মুখ। বুকের ভেতরে লাফালাফি শুরু করেছে হৃৎপিণ্ড। গলা শুকিয়ে কাঠ।

‘কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?’ আবার চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘এখানে অন্ধকারে আটকে গিয়েছি আমি একা। এগোতে পারছি না।’

জবাব নেই।

কোথায় মদিনারা? ও হারিয়ে গেছে, টের পায়নি এখনও ওরা?

‘বেশ, এখানে চুপ করে বসে থাকি তা হলে ওদের ফিরে আসার অপেক্ষায়,’ নিজেকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করল ও।

বসে পড়ে সুড়ঙ্গের দেয়ালে কাঁধ ঠেকাল মুসা।

কিন্তু কোথায় দেয়াল?

আচমকা ভারসাম্য হারিয়ে কাৎ হয়ে গেল ও। টাল সামলাতে পারল না। আঁকড়ে ধরার মত কিছুই পেল না। পড়ে যাচ্ছে ও!

আঁধারের রাজ্যে যেন তলিয়ে যাচ্ছে!

মাথার ওপর দু’হাত নাড়ছে মুসা উন্মত্তের মত। মরিয়া হয়ে কিছু একটা ধরে নিজেকে ঠেকাতে চাইছে। কিন্তু লাভ হলো না। কিছুই বাধল না হাতে।

সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে চেঁচানোর সময়টাও পেল না ও। দড়াম করে শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ল সে, গুঙিয়ে উঠল তীব্র যন্ত্রণায়।

চারদিকে শুধু আঁধার আর আঁধার।

দম নিতে কষ্ট হচ্ছে মুসার। হঠাৎ একটুকরো লাল আলো দেখতে পেল ও। কিন্তু জ্বলেই নিভে গেল সে আলো। টেনে টেনে দম নিচ্ছে ও বদ্ধ বাতাসে।

ফুটবল খেলায় বল খুব জোরে এসে বুকে আঘাত করলে যেমন দম আটকে আসে, এ মুহূর্তে ঠিক তেমনি লাগছে মুসার।

হঠাৎ মৃদু নড়াচড়ার শব্দ কানে এল ওর। কিছু একটা ঘষটে ঘষটে সুড়ঙ্গের শক্ত মেঝেতে হাঁটছে।

‘অ্যাই, আমি এখানে!’ চেষ্টা করেও বেশি জোরে চেঁচাতে পারল না মুসা। ‘কেউ শুনতে পাচ্ছেন?’

আছাড়ের ব্যথা কমেছে, তবু স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছে না ও।

‘আমি এখানে!’ আরেকটু জোরে চেঁচাতে চেষ্টা করল মুসা।

সাড়া নেই কারও! মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল ও, ওরা আমাকে খোঁজাখুঁজি করছে না?

হঠাৎ মুসার ডান হাতটা চুলকে উঠল। কিছু একটা নড়ছে ওখানে। জিনিসটা ধরার জন্যে হাত বাড়াতে কর্কশ কিছু একটার সঙ্গে ঘষা লাগল। একই মুহূর্তে বুঝতে পারল, পা-ও চুলকাচ্ছে। বাঁ কব্জি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে কিছু একটা।

ভীষণ জোরে হাত, ঝাড়া দিল ও। ‘কী এসব?’ ফিসফিস করে নিজেকে প্রশ্ন করল। জমে গেছে তীব্র আতঙ্কে।

সারা শরীর শিরশির করছে। মনে হলো হঠাৎ হাতে-পায়ে দানা- দানা ঘামাচি উঠে গেছে।

চুলকাচ্ছে!

দু’হাত শূন্যে ছুঁড়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। পাশের দেয়ালে বাড়ি খেল হেলমেট। বাতিটা ওকে অবাক করে দিয়ে জ্বলে উঠল।

সরু আলোর বীমটার দিকে চাইতেই মুসার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড় হলো। মাকড়সা! হাজার হাজার পেটমোটা, সাদা মাকড়সা পুরু হয়ে আছে মেঝেতে।

ছেঁকে ধরেছে ওকে! মেঝেতে কিলবিল করছে ওগুলো। একটার ওপর আরেকটা, তার ওপর আরেকটা!

মাথা তুলতেই আলোটাও ওপরে উঠে গেল। পাথুরে দেয়াল যেন মাকড়সার চাদর দিয়ে ঢাকা! মনে হচ্ছে দেয়ালটাই যেন নড়ছে, জীবন্ত ওটা!

সিলিঙ থেকে ঝুলছে শত শত মাকড়সা! অদৃশ্য জালের সঙ্গে ঝুলছে ওগুলো। এই বুঝি পড়বে মাথায়!

ডান হাত ঝাড়া দিল মুসা। পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠল। অজস্র মাকড়সা উঠে আসছে ওর পা বেয়ে! হাতেও মাকড়সা! পিঠেও! সারা শরীরে!

‘খাইছে, খাইছে! বাঁচাও!’ বহু কষ্টে চিৎকার করে উঠল মুসা। ‘তোমরা কেউ আছ? বাঁচাও!’

মাথার ওপর একটা মাকড়সা পড়েছে, বুঝতে পারছে মুসা। উন্মত্তের মত থাবা দিয়ে ওটাকে ফেলে দিল।

‘খাইছে রে, আলাহ! বাঁচাও!’ আবার আর্তনাদ করল। ‘বাঁচাও!’

সেই মুহূর্তেই আরও ভয়াবহ কিছু একটা দেখতে পেল সে।

আরও ভয়াবহ!

সিলিঙে একটা পিলে চমকানো চেহারার সাপ ঝুলছে। ক্রমেই এঁকে বেঁকে মাথাটা এগিয়ে আনছে ওর দিকে।

দশ

সাপটা আরেকটু এগিয়ে আসতেই সভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল মুসা।

‘ওটাকে ধরো!’ একটা চেনা কণ্ঠ বলল। ‘জলদি ওটাকে ধরো!’ অস্ফুটে কিছু বলে উঠল মুসা। ওপরে তাকাল।

হেলমেটের আলো ওপরে উঠে গেল। এবং বুঝতে পারল ওটা আসলে সাপ নয়। একটা দড়ি! নেমে এসেছে ওপর থেকে।

‘তাড়াতাড়ি দড়িটা ধরো, মুসা!’ মদিনার গলা। শক্ত করে ধরো। আমরা তোমাকে টেনে তুলছি।’

হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, লাথি মেরে জঘন্য প্রাণীগুলোকে নিজের গা থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে লাভ হলো না। চেষ্টা বাদ দিয়ে দড়িটা শক্ত করে ধরল মুসা। ঝুলে থাকল প্রাণপণে।

ধীরে ধীরে উঠে যেতে লাগল ও। আঁধার ভেদ করে ওপরে উঠছে। কয়েক সেকেণ্ড পর নাগালে পৌছতে হাত ধরে মামা টেনে তুললেন ওকে। ওপরে উঠে মুসা বুঝতে পারল মদিনা আর নীলা মামাকে সাহায্য করেছে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে দড়ি ওপরদিকে টেনেছে ওরা এতক্ষণ।

পায়ের নীচে মাটির স্পর্শ পেতে ধড়ে প্রাণ ফিরল মুসার। খুশি হয়ে উঠল। কিন্তু ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মনে হলো সারা শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে। জ্বলছে ভীষণ!

পাগল হয়ে গেল মুসা, লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে গা থেকে মাকড়সাগুলো ছাড়াবার চেষ্টা করল। মরিয়া হয়ে গেল। ওগুলো মাটিতে পড়লেই পা দিয়ে চটকে ভর্তা করে দিল।

এরই মাঝে মদিনার ওপর চোখ পড়ল মুসার। দেখল হাসছে সে। ‘একে কী নাচ আখ্যা দেয়া যায়, মুসা?’ বলল মদিনা। ‘তুর্কী নাচ? নাকি উদ্বাহু নাচ?’

সায়েম মোর্শেদ মাকড়সা চেম্বারের দিকে ঝুঁকে জানতে চাইলেন, ‘ওখানে পড়ে গেলে কীভাবে, মুসা?’

‘দেয়ালটা হঠাৎ সরে গেল,’ মুসা বলল। পা চুলকাচ্ছে জোরে জোরে।

‘আমার পাশে ছিলে তুমি,’ মদিনা বলল। ‘হঠাৎ ঘুরে তাকিয়েই দেখি…’ থেমে গেল সে।

ঝুঁকে গর্ত দিয়ে নীচের চেম্বারের দিকে চেয়ে আছেন মামা। ‘চেম্বার ফ্লোর তো অনেক নীচে,’ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘বেশি জোরে কোথাও চোট লাগেনি তো, মুসা?’

মাথা নাড়ল মুসা। ‘না, লাগেনি। অবশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্যে দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর মাকড়সা ….

মামা নীলা সুমাইয়ার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ ধরনের আরও শত শত গোপন চেম্বার আছে। পিরামিড নির্মাতারা সুড়ঙ্গ আর চেম্বারের আজব এক গোলক-ধাঁধার সৃষ্টি করেছে। কবর চোরদের ফাঁকি দিতে চেয়েছে।’

‘ওরে বাবা! কত বড় বড় মাকড়সা!’ বলেই সভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল মদিনা।

‘নীচের ওই চেম্বারে হাজার হাজার মাকড়সা আছে,’ মুসা বলল। ‘দেয়ালে, মেঝেতে, সিলিঙে সবখানে ঝুলছে। লেপটে আছে।’

‘আজ রাতে মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখব,’ বলে মামার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল নীলা সুমাইয়া।

‘তুমি ঠিক আছ তো, মুসা?’ পুরো নিশ্চিত হতে চাইলেন মামা।

জবাব দিতে গেল মুসা। কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় থেমে গেল।

মমির হাতটা! ওর প্যান্টের ব্যাক পকেটে ছিল ওটা। ও যখন পড়ে গিয়েছিল, তখন ওটা পকেট থেকে পড়ে যায়নি তো? ধক করে উঠল ওর বুক।

মিশরে এসে হাতটা হারাতে চায় না ও। ওটা সৌভাগ্যের প্রতীক। এখন মনে হচ্ছে হাতটা ওর পকেটে ছিল বলেই অত নীচে পড়ে গিয়েও তেমন ব্যথা পায়নি। পকেটে হাত ঢোকাতেই ধড়ে প্রাণ ফিরে এল ওর।

আছে ওটা। পড়ে যায়নি।

মুসা জিনিসটা পকেট থেকে বের করে আনল। হেলমেটের আলোয় ধরে পরীক্ষা করে দেখল।

না, কোনও ক্ষতি হয়নি। হাতটা আস্তই আছে। তবে এখনও ঠাণ্ডা।

‘ওটা কী?’ কাছে এসে ঝুঁকে ভাল করে হাতটার দিকে তাকাল নীলা। মুখের ওপরে নেমে আসা চুলগুলো ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দিল। ‘এটাকেই কী সামোনার বলা হয়?’

‘কীভাবে জানলেন?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মুসা। আরেকটু ওপরে তুলল হাতটা, যাতে নীলা আরও ভালভাবে দেখতে পারে।

তীক্ষ্ণ চোখে হাতটা দেখল নীলা সুমাইয়া। ‘প্রাচীন মিশর সম্পর্কে অনেক কিছু জানি আমি,’ জবাব দিল সে। ‘সারাজীবন এ নিয়েই চর্চা করেছি।’

‘এটা হয়তো প্রাচীন কোনও কঙ্কালের হাত,’ মামা বললেন।

‘অথবা স্রেফ একটা স্যুভেনিয়র,’ যোগ করল মদিনা।

‘এটার বিশেষ ক্ষমতা আছে,’ জোর দিয়ে বলল মুসা। ‘চিৎ হয়ে নীচের ওই চেম্বারে পড়ে গিয়েছিলাম,’ গতটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল। ‘হাতটা আমার প্যান্টের ব্যাক পকেটে ছিল, ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার কথা। আমিও তেমন ব্যথা পাইনি।’

‘সৌভাগ্যের প্রতীক এটা,’ নীলা বলল। ঘুরে ডক্টর মোর্শেদের দিকে তাকাল।

‘তা হলে ওটা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও পড়ে গেল কেন মুসা?’ মদিনা জানতে চাইল।

জবাব দেয়ার আগেই হাতটাকে নড়ে উঠতে দেখল মুসা! আঙুলগুলো নড়ে উঠেই স্থির হয়ে গেল।

সশব্দে আঁতকে উঠল মুসা। আরেকটু হলে হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল ওটা।

মামা ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আবার কী হলো?’

‘কিছু না,’ জবাব দিল মুসা।

সত্যি কথা বললেও বিশ্বাস করবেন না মামা, সুতরাং বলে কী লাভ? অযথা মদিনার সামনে আর হাসির পাত্র হওয়ার কোনও মানে হয় না।

‘অনেক হলো,’ বললেন ডক্টর মোর্শেদ। ‘আজ ফিরে যাওয়া যাক, এবার চলো।’

দলটা সুড়ঙ্গের মুখের দিকে এগিয়ে চলল।

মমির হাতটা এখনও মুসার হাতে। চেয়ে আছে ও হাতটার দিকে।

ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাস্য! ভাবছে ও হাঁটতে হাঁটতে। চার হাজার বছরের প্রাচীন একটা মমির হাত নড়ে উঠবে কেন?

কিন্তু মুসা পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে আঙুলগুলো নড়েছে। কোনও ভুল হয়নি ওর।

কিন্তু কীভাবে! কোন শক্তির বলে? হাতটা কী ওকে সতর্ক করতে চাইছে? কোনও বিপদের আভাস দিচ্ছে?