শীতসন্ধ্যার একটি মৃত্যু

শীতসন্ধ্যার একটি মৃত্যু

 জানুয়ারি মাসের এক দিনশেষে সকলের অলক্ষে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটছিল।

বাংলা-বিহার সীমান্তে ছোট্ট শহর মোতিগঞ্জ। হাওড়া-সাহেবগঞ্জ লুপ রেললাইনের একটি মাঝারি স্টেশন এটি। সিঙ্গ লাইন হওয়ার দরুন রেলগাড়ির চলাচল কম। সামান্য দূরে একটা হাইওয়ে থাকায় দিনভর রাতভর এক্সপ্রেস বাস চলে অগুনতি। তাই রেলের যাত্রীসংখ্যাও কমে গেছে।

বিহার মুল্লুকের শীত অতি তুখোড়। দিনশেষে সেই তুখোড় শীত এবার হিংস্র হয়ে উঠেছিল। স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে হলঘরের মতো চওড়া ঘরটিতে একটি চায়ের স্টল কাম খাবারের দোকান। সামনে ও পাশে বেঞ্চ। একটু তফাতে মেঝেয় কয়েকজন দেহাতি পুরুষ ও স্ত্রীলোক কাচ্চাবাচ্চা ঘিরে তুলোর নোংরা কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করছিল। চা ও খাবারের দোকানটির বেঞ্চে জনা তিনেক লোক বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। তাঁরা ভদ্রজন। নিঝুম শীতের সন্ধ্যায় বাইরের কুয়াশা এই স্টেশনেও ওতপ্রোত ঢুকে পড়ায় বাতিগুলো ম্লান, ঝিমন্ত।

এই তিন যাত্রীর একজন অন্য বেঞ্চে, বাকি দুজন একই বেঞ্চে হাতখানেক তফাত রেখে বসে চা খাচ্ছিলেন। এ দুজনের মধ্যে একজনের গায়ে ওভারকোট, গলায় পুরু করে মাফলার জড়ানো, মাথায় বিদেশী টুপি। তার মুখে সাদা একরাশ দাড়ি। বয়সে বৃদ্ধ, কিন্তু তার হাবভাবে তারুণ্যের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তার পাশে বেঞ্চের ওপর একটি সিন্থেটিক চামড়ার স্যুটকেস। এ ধরনের স্যুটকেস সর্বত্র দেখা যায় ইদানীং। তত কিছু দামীও নয়। তবে তার দুই উরুর ওপর রাখা মোটাসোটা কিটব্যাগটা বিদেশী এবং দামীও বটে। বৃদ্ধ চা শেষ করে বেঞ্চের তলায় কাপ প্লেট রেখে ওভারকোটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা চুরুট বের করলেন। সেটি লাইটারে জ্বেলে চোখ বুজে মৃদু-মৃদু টান দিতে থাকলেন। নীল ধোঁয়া আরও নিষ্প্রভ করে ফেলল চায়ের স্টলের বাতিকে।

দ্বিতীয় জন একটু রোগাটে গড়নের এবং বয়স তিরিশের বেশি নয়। কিন্তু চেহারায় রাগীব আর নির্লিপ্ততার অদ্ভুত সংমিশ্রণ। চোখদুটো ভীষণ উজ্জ্বল, অথচ মুখের চামড়া পোড়া খাওয়া, তামাটে, যেন মমির মুখ। তার গায়ে চামড়ার জ্যাকেট; পরনে জিনসের বেরঙা প্যান্ট, পায়ে নীল-সাদা জীর্ণ কেডস জুতো। তার দু পায়ের ফাঁকে একটি স্যুটকেস। সেটিও সিন্থেটিক চামড়ায় তৈরি এবং পাশের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের স্যুটকেসটির অনুরূপ। যুবকটি চা শেষ করে কাপপ্লেট সামনে বাড়িয়ে ধরল, চাওলার বয় এসে সেটা নিয়ে যাক এই তার ইচ্ছা। কিন্তু কেউ এল না দেখে বিরক্তভাবে সে উঠে কাপপ্লেট চাওলার চায়ের সরঞ্জামের ভেতর রাখতে গেল। চাওলা এতে রেগে গেল। এঁটো কাপপ্লেট ধোয়া কাপপ্লেটের সঙ্গে রাখা তার কাছে অসঙ্গত। সে বলল, কা করতা বাবুজি? উধার রাখিয়ে–উধার। ঝুটা কাপ রাখনেকা জাগাহ্ নেহি দেখতা?

অন্য বেঞ্চের যাত্রীটি মুখ নামিয়ে চা খাচ্ছিলেন। পরনে দামী স্যুট। হাতে অ্যাটাচি কেস। মাথায় হনুমান টুপি। কাপপ্লেট পাশে রেখে উঠে গেলেন ট্রেনের সময় জানতে। ঠিক এসময় ঘটনাটি ঘটল।

যুবকটি এঁটো কাপপ্লেটের জায়গায় এদিকে পিছন ফিরে কাপপ্লেট রেখে কড়া কিছু বলতে চাইল। সেই সময় বৃদ্ধ, ওভারকোট পরা লোকটি নিজের স্যুটকেসটি ওই যুবকের স্যুটকেসের পাশে রেখে তার স্যুটকেসটি তুলে নিঃশব্দে এবং অতিদ্রুত নিজের পাশে রাখলেন। এইসময় টিকিটের ঘণ্টা বেজে উঠল।

এই ঘটনা কারুর চোখে পড়ল না। স্যুটকেস-বদল ঘটে গেল একমুহূর্তেই।

যুবকটি রাগ চেপে সিগারেট ধরাল। তারপর স্যুটকেসটি তুলে নিয়ে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। টিকিট কাউন্টার খুলেছে। সম্ভবত সে চায়ের দোকানীর ওপর এমনই ক্রুদ্ধ যে হাতের স্যুটকেসের দিকে লক্ষ্যও নেই।

বৃদ্ধ ভদ্রলোকও স্যুটকেস নিয়ে ছোট্ট কিউয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার আগে যুবকটি। বৃদ্ধ শুনলেন, সে আপে পরবর্তী জংশন স্টেশন হাথিয়াগড়ের টিকিট চাইল। বৃদ্ধের পালা এলে টিকিটবাবুকে আস্তে বললেন, হাথিয়াগড়।

টিকিট কেটে বৃদ্ধ প্ল্যাটফর্মে গেলেন। প্ল্যাটফর্ম খাঁ খাঁ। বাতিগুলো কুয়াশায় জুগজুগ করছে। কনকনে হাওয়ায় হাড় অব্দি কেঁপে উঠছে। যুবকটি করগেট শিটে ঢাকা প্ল্যাটফর্মের একটি থামে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছিল। দুপায়ের ফাঁকে সেই স্যুটকেস।

দীর্ঘ-সুদীর্ঘ সময় মনে হয় শীত সন্ধ্যায় কোনো ট্রেনের জন্য এই প্রতীক্ষা। অবশেষে ট্রেনটি এল। একদঙ্গল যাত্রী নামল। ব্যস্ততা, কোলাহল, ভিড়, ইঞ্জিনের শব্দ–সবকিছু যেন গিলে নিচ্ছিল তুখোড় ঠাণ্ডা হিম শীতসন্ধ্যার প্রকৃতি।

একই কামরায় বৃদ্ধ ও যুবকটি উঠেছেন। কামরায় তত ভিড় নেই। দুজনে দুই কোণে বসেছেন। ট্রেন ছাড়লে বৃদ্ধ নিভে যাওয়া চুরুটটি জ্বেলে কিটব্যাগ থেকে একটি বই বের করে পাতা খুললেন।

যুবকটি চেইন-স্মোকার। একটার পর একটা সিগারেট টানছে। ভুরু কোঁচকানো। দৃষ্টি উজ্জ্বল, অথচ একই সঙ্গে নির্লিপ্ততাময়। বৃদ্ধের একটা চোখ তাকে লক্ষ্য করছিল।

দুটি ছোট্ট স্টেশন পরে হাথিয়াগড় জংশন এসে গেল। যুবকটি স্যুটকেস হাতে দরজার কাছে গেলে বৃদ্ধও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ট্রেন থামলে দুজনে নামলেন। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে বাইরে রিকশা ও টাঙ্গা গাড়ির ভিড়, ট্যাক্সি, বাস ও প্রাইভেট কারও প্রচুর। যুবকটি একটি সাইকেল রিকশা নিল। বৃদ্ধও একটি সাইকেল রিকশা নিয়ে মৃদুস্বরে রিকশা চালককে বললেন, উও রিকশোকি পিছা চন্না ভাই! বখশিস মিলেগা।

তিনি যুবকটিকে অনুসরণ করছিলেন।

শহরের ভেতর তত বেশি ভিড় নেই। শীতের রাত্রি। আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। এগিয়ে যুবকের রিকশা থামল একটি সুদৃশ্য হোটেলের সামনে। হোটেলের নাম প্রিয়দর্শী। শহরের সবচেয়ে খরুচে হোটেল। সাহেবি কেতাদুরস্ত। যুবকটি বৃদ্ধকে লক্ষ্য করছিল না। তার মুখে এখন চাঞ্চল্য আর অন্যমনস্কতার সংমিশ্রণ। রিসেপশন কাউন্টারে গিয়ে সে দে ৩লায় সাত নম্বর সিঙ্গল বেডরুম বুক করল। বৃদ্ধ ঝুঁকে খাতায় লেখা তার নাম ঠিকানা দেখছিলেন। ম্যানেজার আঁকাবাঁকা ইংরেজি হরফে লিখেছেন : সুশোভন রায়। ঠিকানা : ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন, কলকাতা-৬। হাথিয়াগড় আসার উদ্দেশ্য : বিজনেস পারপাস’। যুবকটিকে রুমে নিয়ে গেল একজন পরিচারক।

ম্যানেজার বললেন, বোলিয়ে সাব!

বৃদ্ধ বললেন, ফার্স্ট ফ্লোর নাম্বার এইট খালি হ্যায়?

 জি। লেকিন আঠ ডাবল বেড।

ঠিক হ্যায়। আঠ। ….

একটু পরে আট নম্বরে ঢুকে বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করলেন! স্যুটকেসটিতে তালা আটা। কিটব্যাগ থেকে একটি মাস্টার কি’ বের করলেন, যার সাহায্যে সবরকমের সাধারণ তালা খেলা যায়। তালা খুললেন, কিন্তু স্যুটকেসটি খুলতে যেন একটু বিব্রত দেখাল তাঁকে। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন সেটির দিকে।

তারপর ওভারকোট খুলে রেখে দুপাশের চেনদুটো টেনে খুললেন। আবার একটু ইতস্তত করে ডালাটা একটু তুলে ধরলেন। ভেতরে কিছু ভাঁজকরা পোশাক। ভাজকরা কিন্তু যেমন তেমন ভাবে জড়িয়ে রাখার মতো। আর সেই পোশাকগুলোও নোংরা, বেরঙা, ময়লার ছোপে ভরা। আলতো হাতে তুলে ভেতরটা দেখেই রেখে দিলেন। আর কিছুই নেই, শুধু জামাকাপড়!

এইসময় পাশের সাত নম্বর ঘরে চাপা কীসব শব্দ হলো। বৃদ্ধ দ্রুত, কিন্তু নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন। করিডর জনশূন্য। এখন তার গলা থেকে ঝুলন্ত একটি বাইনোকুলার দেখা যাচ্ছিল। সাত নম্বরের দরজার কি-হোলে বাইনোকুলারের একটি আই রেখে এক চোখ বুজে দেখার চেষ্টা করলেন। ভেতরে কী ঘটছে।

দেখেই চমকে উঠলেন। টেবিলের উপর সেই স্যুটকেসটি খোলা। ভেতরে একগাদা পুরনো খবরের কাগজ দলাপাকানো এবং আরও কিছু ওইরকম কাগজ মেঝেয় ছড়ানো।

যুবকটি হিংস্র চোখে তাকিয়ে সেগুলো দেখছে।

তারপর সে বাকি কাগজগুলোও তুলে মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলল। এবার স্যুটকেসটা ফেলে দিয়ে লাথি মারল। তাকে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। সে চেয়ারের কাছে। দাঁড়িয়ে টেবিল আঁকড়ে ধরল। ক্রমশ তার চোখের হিংসার উজ্জ্বলতা ক্ষয়ে যেতে থাকল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর ধপাস করে চোরে বসে পড়ল।

সেকেন্ড তিন-চার পরে সে জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পিস্তল বের করল, এবং অতিদ্রুত-এক মুহূর্তের মধ্যেই সে হাঁ করে পিস্তলের নল মুখে ঢুকিয়ে ট্রিগার টানল। চাপা-খুবই চাপা কটাস্ করে একটা শব্দ এবং সে সশব্দে চেয়ারসুদ্ধ উল্টে পড়ে গেল।

বৃদ্ধ হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই দ্বিতীয় ঘটনাটি প্রথম ঘটনার চেয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘটে গেল।…