এক সেকেন্ডের জন্য

এক সেকেন্ডের জন্য

জিপগাড়িটা প্রচণ্ড গতিতে এগোচ্ছিল।

বাঁদিকে সুভদ্র ড্রাইভার, ডানদিকের সিটে কর্নেল। শ্যামলকান্তি বসেছে পেছনে, ভেতরদিকে। রাস্তা তত ফাঁকা না হলেও ঝকঝকে নতুন। দক্ষিণে পনের কিমি এগিয়ে এবার চড়াই-উৎরাই শুরু। ছোটনাগপুর পাহাড়ের একটা রেঞ্জ এখানে উঁচিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে দুধারে টিলা, শালের জঙ্গল। গঙ্গা ক্রমশ দূর উত্তরে সরে যাচ্ছে। সমতল মাটির উর্বরতা চোখে পড়ছে না আর।

রাস্তা বাঁক নিয়ে পূর্বমুখী হলে শ্যামলকান্তি বললেন, সুভদ্র, এক কাজ করলে হত!

সুভদ্র বলল, বলুন শ্যামলদা!

একটা শর্টকাট করলে মন্দ হয় না। শ্যামলকান্তি পরামর্শ দিলেন। আর দশ কিলোমিটার পূর্বে যে চৌমাথাটা পড়বে, ডাইনে ঘুরে দুমকা রোড পাবে। কিন্তু সোজা এগোলে রেললাইন ক্রশ করার ঝামেলা। তাছাড়া মুর্শিদাবাদে ঢুকে চৌত্রিশ নম্বর হাইওয়ে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। হাইওয়েটাও যাচ্ছেতাই। তার চেয়ে দুমকা রোড ধরে চলো।

সুভদ্র হাসল। আরও সাউথে গিয়ে জি টি রোড ধরতেও আপত্তি নেই। বাট মাইন্ড দ্যাট, আরও দুতিনটে ডিস্ট্রিক্ট পেরুতে হবে।

কর্নেল মন্তব্য করলেন, তার মানে প্রায় পুরো বিহারের পূর্বাঞ্চল সফর হয়ে যাবে। আমার অবশ্য আপত্তি নেই।

সুভদ্র বাঁ হাতে একটা রোড-ম্যাপ বের করল। দেখে নিয়ে বলল, এক কাজ করা যায়। তিরিশ কিমি শর্টকাট রাস্তাটা যদিও ভাল না, পাহাড়পুরের কাছে গেলে দিল্লি রোডে।

শ্যামলকান্তি উৎসাহ দিলেন। তাই চলো, সুভদ্র! চৌত্রিশ হাইওয়ে বড় বাজে রাস্তা।

জিপ দুমকা রোড ধরে ফের দক্ষিণে ছুটল। পথে শ্যামলকান্তির তাগিদে একখানে থেমে ছোট্ট বাজারে চা খাওয়া হলো। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে প্রকৃতি দেখতে ভুললেন না। হিম ক্রমশ বাড়ছে। আবার জিপ স্টার্ট দিল। ঘণ্টা খানেক পরে, তখন সাড়ে চারটে বাজে, সুভদ্র জানাল, সামনে সেই শর্টকাট।

রাস্তাটা সত্যিই খারাপ। কোন যুগে পাথরকুচি ও পিচ পড়েছিল। উপড়ে এবং ভেঙেচুরে ছত্রখান। এখানে-ওখানে গর্ত। দুধারে ঘন জঙ্গল। শীতের শেষ বেলায় এখনই গাঢ় ছমছমে ছায়া পড়েছে। কিন্তু সুভদ্র চমৎকার ড্রাইভ করে। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। শ্যামলকান্তি তার উদ্দেশে বকবক করছিলেন। বাঁদিকে একটা পাহাড়ি নদী আছে। তারই বন্যায় রাস্তাটার এ অবস্থা। দেহাত অঞ্চল বলে পূর্ত দপ্তর নিষ্ক্রিয়। ব্যবসার বাজার খুঁজতে শ্যামলকান্তিকে সবখানে ঘুরতে হয়। তাই এ অঞ্চলেরও নাড়িনক্ষত্র চেনেন।

কিছুদূর চলার পর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, রোখো! রোখো।

সুভদ্র ব্রেক কষল। ঝাঁকুনি খেযে কর্নেল চোখ খুললেন। হাতের চুরুট নিভে গেছে।

শ্যামলকান্তি বললেন, এখানে একটা বিউটিফুল সাইট আছে। কর্নেলকে দেখাতে চাই। উনি শুনেছি প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ! আসুন কর্নেল! জাস্ট এ ফিউ মিনিটস ডিসট্যান্স।

শ্যামলকান্তি পেছন দিয়ে নামলেন। কর্নেল বললেন, কী ব্যাপার?

বাঁদিকে এই পায়েচলা রাস্তাটা দেখছেন, একটু এগোলে নদীর প্রপাত আছে একটা। অসাধারণ, কর্নেল! একধারে কোন রাজার পুরনো কেল্লা। সব মিলিয়ে এতে সুন্দর ন্যাচারাল স্পট সচরাচর দেখা যায় না। এলুমই যখন, একবার দেখে। যাই! আসুন, আসুন! মুগ্ধ হয়ে যাবেন। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে নিয়ে আসুন। ওখানে এখনও যথেষ্ট আলো আছে।

কর্নেল নামলেন। ক্যামেরাও নিলেন সঙ্গে। শ্যামলকান্তিকে অনুসরণ করলেন। পায়েচলা রাস্তায় একটু এগিয়ে ঝরঝর শব্দ কানে এল।

সত্যিই অসাধারণ সুন্দর একটা প্রপাত। ওধারে ন্যাড়া পাথরের টিলার মাথায় একটা পোড়া দুর্গ। প্রপাতটা অন্তত দেড়শো ফুট খাড়াই। নদীতে জল অল্প। পাথরের ফাঁক দিয়ে স্বচ্ছ জল ঝরঝরিয়ে দেড়শো ফুট নিচে পড়ছে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে আসা লালচে রোদ্দুরে জলকণা ঝিলমিলিয়ে উঠছে। তারপর চোখে পড়ল একটা রামধনু। কর্নেল মুগ্ধ দৃষ্টে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন।

শ্যামলকান্তি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, রামধনু! পৃথিবীর বুকে নেমে আসা রামধনু! ভাবা যায়?

কর্নেল কালারফিল্মে প্রপাতের গায়ের রামধনুটিকে প্রতিফলিত করার জন্য একেবারে খাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে শ্যামলকান্তি অসম্বদ্ধ প্রলাপের মতো আওড়াচ্ছেন, ভাবা যায় না! ঈশ্বর পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর জিনিস রেখেছেন। আর নির্বোধ হারামজাদা মানুষ খালি ঝগড়াঝাটি করে–কর্নেল! সাপ!

আচমকা কর্নেল শ্যামলকান্তির প্রচণ্ড ধাক্কা খেলেন।

 বাঁদিকে ফুটখানেক দূরে একটা তরুণ গাছ। কর্নেলের বাঁ হাত বিদ্যুৎগতিতে সেই গাছের গায়ে পড়ল। ধাক্কাটা সামলে নিলেন। ঝুঁকে পড়েছিলেন, সোজা হলেন। জুতোর ডগার চাপে ছোট-বড় একঝক পাথর সশব্দে দেড়শোফুট প্রপাত-খাদে গিয়ে পড়ল।

ঘুরে তাকালেন শ্যামলকান্তির দিকে। অপ্রস্তুত, বিব্রত মুখে শ্যামলকান্তি আস্তে বললেন, সরি!

কর্নেল শুধু একটু হাসলেন।

শ্যামলকান্তি গলার ভেতর বললেন, ওই কালো লতাটা দেখে—

 মিঃ মজুমদার! এখন শীতকালে সাপেদের হাইবারনেশন পিরিয়ড। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন। মুখে তেমনি হাসি। ওরা এখন সারা শীতকাল ঘুমুবে।

সরি! ভেরি সরি! ওই আঁকাবাঁকা লতাটা আপনার পায়ের কাছে হাত তুলে কর্নেল বললেন, নেভার মাইন্ড!

শ্যামলকান্তিকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তারপর কর্নেলও গম্ভীর হলেন। জিপে গিয়ে যখন বসলেন, তখন কর্নেলের উরু ভারী, বুকের ভেতর স্পন্দন বেড়েছে। মাত্র একচুলের জন্য বেঁচে গেছেন। আত্মরক্ষার সহজাত বৃত্তিতে নাকি বরাবরকার মতো ইনটুইশনবশে বাঁ হাতটা উঠে গিয়েছিল গাছটার দিকে? মাত্র একটা সেকেন্ডের জন্য! নইলে দেড়শো ফুট নিচের ভিজেপাথরে পড়ে শরীর গুঁড়িয়ে যেত।

নাকি এমন কিছু ঘটতেও পারে ভেবে তার অবচেতনায় একটা প্রস্তুতি ছিল?

কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।..