জামায় রক্তের দাগ

জামায় রক্তের দাগ

 কিছুক্ষণ পরে।

হোটেলের বাইরে পুলিশের দঙ্গল দেখে কিছু ভিড় জমেছে বটে, কিন্তু পাশেই বিস্তীর্ণ গঙ্গার জল ছুঁয়ে উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা দিচ্ছে। তাই ভিড় নিশূপ। হোটেলে কী ঘটেছে, জানার আগ্রহটাও মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিছু লোক রাস্তার ধারে রবার পুড়িয়ে তাপ সংগ্রহের চেষ্টা করছে। দুর্গন্ধ ছুটেছে। হোটেলে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না কনস্টেবলরা। একটা জিপ এবং অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কাছে গেলেই লাঠি উঁচিয়ে গুতো মারতে আসছে পুলিশ। তবে দিনের বেলা হলে ভিড়টা প্রচণ্ডই হত।

দোতলার আটনম্বর ঘরে বসে পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা, এস আই রাকেশ পাণ্ডে, ডিটেকটিভ দপ্তরের ইন্সপেক্টর সুরেশ চতুর্বেদী কথা বলছিলেন। সাত নম্বর সিঙ্গলবেড রুমে দুজন কনস্টেবল এবং একজন এস আই বডি পাহারা দিচ্ছেন। একজন ফোটোগ্রাফার এবং একজন ডাক্তারও আছেন সেখানে। ডাক্তারের নাম হরিনাথ মুখার্জি, বাঙালি। তিনপুরুষ বিহার মুল্লুকের এই হাথিয়াগড় শহরে বসবাস করেছেন।

ডাঃ মুখার্জি আট নম্বরে এসে ঢুকলেন। আস্তে বললেন, ইন্সট্যান্ট ডেথ। সুইসাইড।

মোহন শর্মা বললেন, সুইসাইড তো বটেই। পিস্তলটাও পড়ে আছে। মেঝেয়। বলে সেই বৃদ্ধের দিকে ঘুরলেন। একটু হেসে বললেন, গতবার দিল্লিতে একটা কনফারেন্সে গিয়ে আপনার কথা উঠলো হঠাৎ কে যেন। বললেন, একটা প্রবাদ চালু হয়েছ ভারতব্যাপী, জানেন তো! হোয়্যার ইজ কর্নেল, এ ডেডবডি ইজ দেয়ার! কর্নেল যেখানে, মৃতদেহ সেখানে!

সুরেশ চতুর্বেদী হাসলেন। নিছক মৃতদেহ বললে ভুল হবে। হোয়্যার ইজ কর্নেল, দেয়ার ইজ এ মার্ডার। অবশ্য এক্ষেত্রে মার্ডারটা সুইসাইড! তাহলেও মার্ডার বলা চলে। কারণ আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে খুন করা।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক–স্বনামধন্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বিষণ্ণ মুখে বসেছিলেন। মাথার টুপিটি টেবিলে। প্রশস্ত টাকে আলো টকটক করছে। সাদা দাড়িতে আঙুলের চিরুনি টানছিলেন অভ্যাসে–চোখ দুটি বন্ধ। মুখ তুলে এবার বললেন, আমার জীবনে এই এক অভিশাপ মিঃ চতুর্বেদী! কেন এমন হয়, এ রহস্যের অর্থ খুঁজে পাইনে। দিব্যি খুশমেজাজে বেড়াতে এলুম মোতিগঞ্জে। ওখানে গঙ্গার চরে পাখিটাখি দেখলুম। প্রজাপতি ধরার বিস্তর চেষ্টা করেও পারলুম না। দুপুরে ফিরে পোস্টাপিসে গেলুম একটা টেলিগ্রাম করতে। তারপর–

 মোহন শর্মা জিগ্যেস করলেন, কাকে টেলিগ্রাম?

জয়ন্তকে–আই মিন, জয়ন্ত চৌধুরি, কালকাতার দৈনিক সত্যসেবকের : স্পেশাল রিপোর্টার।

চতুর্বেদী বললেন, হ্যাঁ–তাকে চিনি।

কর্নেল বিষণ্ণভাবে বললেন, জয়ন্তকে আসার জন্য টেলিগ্রাম করতে গেলুম। জায়গাটা তার ভাল লাগত। তো পোস্টাপিসে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল। ওই যুবকটি কাউন্টারের এককোণে পিছু ফিরে এক তাড়া একশো টাকার নোট–অন্তত হাজার দশেক টাকা হবে বোধ করি, একটা পাতলা ছোট্ট পত্রিকায় জড়িয়ে পুরু খামে পুরল। গ্রিটিং কার্ডস যেসব খামে পাঠানো হয়, সেইরকম খাম। খামের মুখটা ভেতরে ঢুকিয়ে ডগাটুকু এঁটে দিল আঠা দিয়ে। তারপর আরও অবাক হয়ে দেখি, ওপরে লিখছে প্রিন্টেড ম্যাটার।

শর্মা চমকে উঠলেন। …বলেন কী!

চতুর্বেদী বললেন, আশ্চর্য রিস্ক নেওয়া। পত্রিকায় জড়ানো দশ হাজার টাকা! প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে!

কর্নেল বললেন, অর্ডিনারি বুক পোস্টে অত টাকা ওভাবে পাঠাল দেখে-~ জানেন তো, আমি একটু নাকগলানে স্বভাবের মানুষ–টেলিগ্রামের লাইন না দাঁড়িয়ে ওকে ফলো করলুম। ওর হাতে স্যুটকেস। এই স্যুটকেসটা। তখনই রাস্তার ধারের দোকানে ঝটপট অবিকল এরকম একটা স্যুটকেস কিনে নিলুম। ফলো করতে অসুবিধে ছিল না। কারণ সামনেই স্টেশন। সে স্টেশনে ঢুকলে তখনই আমার হোটেলে ফিরে বাসি কদিনের খবরের কাগজ ভরে

বাধা দিয়ে শর্মা বললেন, ওর সুটকেসটা সম্পর্কে আপনার সন্দেহ হলো কেন?

ইনটুইশান! কর্নেল আস্তে বললেন। কিংবা হয়তো সে যেভাবে স্যুটকেসটা নিয়ে যাচ্ছিল, যেন ভেতরে কিছু মূল্যবান জিনিস আছে হয়তো সে নিষিদ্ধ মাদকের কারবারি! ঠিক এরকম কিছু ভেবেছিলুম।

ডাঃ মুখার্জি আগ্রহে শুনছিলেন। বললেন, তারপর, তারপর?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, মোতিগঞ্জ স্টেশনে স্যুটকেসটা বদল করলুম এক সুযোগে তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। তাই খুঁটিয়ে স্যুটকেসটা লক্ষ্য করেনি। তাছাড়া সন্ধ্যাবেলা। আলো কম ছিল ওখানে। শীতও একটা ফ্যাক্টর। মানুষকে আপনাদের বিহারী শীত বড় কুঁড়ে করে দেয়।

অফিসাররা হেসে উঠলেন। শর্মা সুটকেসটা টেনে নিয়ে বললেন, কিন্তু এটার মধ্যে তো এমন কিছু দেখছি না, যার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে। নো ড্রাগস হাশিশ অর ওপিয়ামনাথিং! কিছু কাপড় মাত্র।

কর্নেল বললেন কাপড়গুলো ভাল করে দেখুন, মিঃ শর্মা!

মোহন শর্মা কাপড়গুলো বের করলেন। যেমন-তেমনভাবে ভাজ করা। পুরনো একটা শার্ট, একটা প্যান্ট, একটা সোয়েটার। শার্টটা খুলেই চমকে। উঠলেন। বললেন, মাই গুডনেস! এই ছোপগুলো কিসের?

কর্নেল বললেন, রক্তের।

তার মানে?

মিঃ শর্মা, কবে কাউকে খুন করা হয়েছিল, এ তারই পরনে ছিল। শার্টের কলারে দর্জির দোকানের নামঠিকানা লেখা আছে। আমার ধারণা, এই প্যান্ট শার্ট-সোয়েটার সুশোভন রায়ের কাছে মূল্যবান সম্পদ হয়ে ছিল। অবশ্য এই আত্মহত্যাকারী সুশোভনের’ আসল নাম সম্পর্কেও আমার সন্দেহ আছে। কারণ বুকপোস্টে পাঠানো খামে আমি দেখে নিয়েছিলুম, নাম ঠিকানা লেখা আছে : তপেশ বসাক। ১৭/২ ফকিরচাঁদ লেন, কলকাতা-১২।

ডাঃ মুখার্জি বললেন, তাহলে রীতিমতো রহস্যজনক ঘটনা!

মোহন শর্মা বিড়বিড় করছিলেন, সুশোভন রায়তপেশ বসাক! দশহাজার টাকা। রক্তমাখা পোশাক। তারপর আত্মহত্যা। আচ্ছা কর্নেল? কর্নেলের দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলেন এবার।

বলুন।

তপেশ বসাকের নামে ডাকে পাঠানো খামটা পৌঁছতে দু-তিনদিন লেগে যাবে। মোহন শর্মা বললেন। এখনই কলকাতা পুলিশকে রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে পোস্টাপিস থেকে ওটা যথাসময়ে সিজ করতে বলা যাক। কী বলেন?

কর্নেলকে এখনও বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। গলার ভেতর বললেন, না।

 কেন?

খামটা অন্য কারুর হাতে পৌঁছুচ্ছে কি না জানা দরকার। আর যদি আপত্তি না থাকে, রেডিও মেসেজ আমিই পাঠাই-কলকাতা পুলিশের ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর হাতে একটু দায়িত্ব দিলে আশা করি সে তা পালন করবে।

মোহন শর্মা মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেও মুখে বললেন, ওকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুশোভন ওরফে তপেশ মোতিগঞ্জ কেন এসেছিল, সেটা জানার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।

ঠিক তাই। কর্নেল চুরুটে টান দিয়ে ধোঁয়ার ভেতর বললেন। তবে আমার ধারণা, সেটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল। বরং

কর্নেল হঠাৎ থেমে গেল শর্মা বললেন, বলুন।

 বরং হাথিয়াগড়ে সে কেন এল, এটা আগে জানা দরকার।

সুরেশ চতুর্বেদী স্যুটকেসের ভেতর তন্নতন্ন খুঁজছিলেন। জামা, সোয়েটার, প্যান্টের সমস্ত ভাজ ও পকেট খোঁজা শেষ করে বললেন, আশ্চর্য! একটুকরো কাগজ পর্যন্ত নেই! শুধু রক্তমাখা তিন টুকরো পোশাক।

মোহন শর্মা একটু হেসে বললেন, হাথিয়াগড়ে আসাটাও খড়ের গাদার সুচ খোঁজা, কর্নেল!

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, হয়তো না।

কেন?

কর্নেল এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন, কাল খুব সকালে হাসপাতালের মর্গে আমি উপস্থিত থাকতে চাই। আপনি এবং মিঃ চতুর্বেদীও থাকবেন। এবার চলুন, পাশের ঘরে যাই। বডিটা আবার সার্চ করতে হবে।

পুলিশ অফিসাররা উঠলেন। চতুর্বেদী বিরক্তভাবে বললেন, সার্চ তো অলরেডি করেছি। প্যান্টের পকেটে একটা রুমাল, স্যুটকেসের চাবি, একটা চিরুনি আর পনের টাকা পঞ্চাশ পয়সা ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হেঁটেলের ওই ঘরটার চার্জ চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পঁচাত্তর টাকা। এ ছাড়া খাওয়া খরচ আছে। অথচ পেলেন মাত্র পনের টাকা। পঞ্চাশ পয়সা।

মোহন শর্মা ও সুরেশ চতুর্বেদী পরস্পরের দিকে তাকলেন। দুজনেই অগত্যা হাসলেন। চতুর্বেদী বললেন, হ্যাঁ–এটা একটা পয়েন্ট।

মোহন শর্মা বললেন, ইমপর্ট্যান্ট পয়েন্ট।

পাশের ঘরে তখন হাসপাতালের দুজন ডোম এসে গেছে স্ট্রেচার নিয়ে। বডি ওঠাচ্ছে। কর্নেল বললেন, এক মিনিট! বলে সুশোভন ওরফে তপেশের মৃতদেহের পিঠের দিকে জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে কী একটা বের করলেন।

সেটা একটা আইডেন্টিটি কার্ড। তাতে এই মৃতেরই ছবি। কার্ডটি পারিজাত ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির। হেড অফিস কলকাতার একটা ঠিকানায়। শাখা ভারতের বড়-বড় শহরে। কিন্তু মোতিগঞ্জ বা হাথিয়াগড়ে কোন শাখা নেই। কার্ডে লেখা আছে : তপেশ বসাক, রিপ্রেজেন্টেটিভ।

ডাঃ মুখার্জি আবার বলে উঠলেন, রীতিমতো রহস্যজনক! পিঠের দিকে আইডেন্টিটি কার্ড!

কর্নেল বললেন, এটা তত কিছু রহস্যজনক নয়, ডাঃ মুখার্জি! এই চামড়ার জ্যাকেটগুলো সিঙ্গাপুরে তৈরি হয়। পিঠের দিকে ভেতরে একটা পকেট থাকে। আমারও এরকম একটা জ্যাকেট ছিল। যাই হোক, বডি মর্গে চলে যাক। এবার চলুন মিঃ শর্মা, নিচের ডাইনিং হলে গিয়ে এক পেয়ালা করে কড়া কফি খাওয়া যাক। কফি না খেলে আমার মাথা খোলে না।

সিঁড়িতে নামার মুখে ডিটেকটিভ অফিসার চতুর্বেদী বললেন, জামায় রক্তের দাগ ব্যাপারটা খুব জট পাকিয়ে দিয়েছে। আগে ওটার একটা খেই খুঁজে বের করা উচিত। কী বলেন, মিঃ শর্মা? কর্নেল?

কিন্তু এই প্রচণ্ড শীতে গরম কফির চিন্তা শর্মা ও কর্নেলকে ততক্ষণে আবিষ্ট করে ফেলেছে। ওঁরা কোনো জবাবই দিলেন না।…