বৃষ্টিসন্ধ্যার অভিযান

বৃষ্টিসন্ধ্যার অভিযান

দুদিন ধরে আকাশ মেঘে ঢাকা। টিপটিপিয়ে বৃষ্টি ঝরছে থেমে-থেমে। ঠাণ্ডাটা আচমকা প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। কর্নেল দা পলিটিক্যাল টারময়েল ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিওরিং সিক্সটিজ-সেভেনটিজ’ বইটা খুঁটিয়ে পড়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। ইনডেক্সে বাসুদেব, সুশোভন কিংবা শ্যামলকান্তিদের উল্লেখ নেই। তবু একটা চেষ্টা, যদি দৈবাৎ কোনো সূত্র মেলে। মিলছে না।

আসলে কোনো সময়ের ইতিহাস যিনি লেখেন, তারকাছে বিশিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বগুলিই ধর্তব্য হয়ে ওঠে। আর ইতিহাস লেখা হয় ভাষায়। ভাষার নিজস্ব একটা রূপরীতি, কাঠামো এবং গতি আছে। নিজের অজান্তে ইতিহাস লেখক সেগুলির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাছাড়া তার উপাদান সংগৃহীত হয় খবরের কাগজ, সরকারি দলিল দস্তাবেজ কিংবা সুযোগ থাকলে গোপন পুলিশ রিপোর্ট থেকে। এখন কথা হলো, এগুলি কতখানি নির্ভরযোগ্য? সংবাদদাতারা রং চড়িয়েই লেখেন, যাতে লোকে উত্তেজিতভাবে গিলে খায়। এদিকে সংবাদপত্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, স্বার্থ এসবও থাকে। বহু গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বেরোয় না–স্থানাভাব এবং আরও নানা কারণে। আর সরকারি রিপোর্টও তাই। আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুগত একটা যান্ত্রিক ও দায়সারা নীতি মাত্র। তদন্ত কমিশন বসে। তার মধ্যেও নানামুখী স্বার্থ কাজ করে। যারা কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেয়, নানা কারণে তা সত্যমিথ্যায় মেশা কথাবার্তা। পুলিশ রিপোর্ট তো আরও হাস্যকর। এই বইয়ে মুর্শিদাবাদের বিপ্লবী নেতা একরাম আলির কথা আছে। কর্নেলের মনে পড়ল, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা থেকে সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি গিয়েছিল সরেজমিন খবর আনতে। ফিরে এসে বলল, বোগাস। অজ গাঁয়ের এক নিরক্ষর খেতমজুর একরাম তার দাওয়ার ওপর দেয়ালে একটা লাল হরফে ছাপানো বিপ্লবীদের ইশতাহার সেঁটেছিল নেহাত দেয়ালের সৌন্দর্য আনতেই। দারোগাবাবু বিপ্লবীদের না পাকড়াও করতে পেরে রেগেমেগে ফিরে আসছিলেন। খোলামেলা ঘরের দেয়ালে ইশতাহার দেখামাত্র রোগাভোগা খেতমজুরটির বুকে নল ঠেকিয়ে রিভলবারের ট্রিগার টানেন। পরে তার প্রমোশনও হয়ে যায়। এই তো ব্যাপার।

না–পুলিশ রিপোর্ট মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়। আসলে ইতিহাসকাররা দূরে বসে প্রতীয়মান বাস্তবকেই লক্ষ্য করেন। প্রকৃত বাস্তবকে জানতে হলে ঘটনার মধ্যে থাকতে হয়।

কিন্তু ঘটনার মধ্যে থাকারও একটা ব্যাপার আছে। বিপ্লবী নিজে যখন তার বিপ্লবকাজের বর্ণনা করেন, তখন তিনিও ভাষার নিজস্ব নিয়মের অধীন হয়ে। পড়েন তো বটেই, উপরন্তু মানুষের সাধারণ স্বভাববশে তিনিও তার কীর্তির ওপররঙ চড়ান।

একরাম আলির বুকে আগ্নেয়াস্ত্রের নল ঠেকিয়ে দারোগাবাবুর ট্রিগারে টান এবং একরাম আলির মৃত্যু–তথ্য হলো এইটুকুই। বাকিটা গণ্ডগুলে। এই বইটাতে, সুতরাং, কর্নেল শুধু তথ্য–নিছক তথ্য হাতড়াচ্ছিলেন দুদিন ধরে। যে তথ্য তার এই কেসে কাজে লাগবে, সেই তথ্য কোথায়?

বইটা মুড়ে চুরুট ধরালেন। হাতের কাছে কফির পেয়ালা। বিকেল চারটেতেই কলকাতা অন্ধকার। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া বইছে তুখোড়। এইসময় কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠী এসে বলল, একজন মেয়েছেলে বাবামশাই! হাতে রাঙা ছাতি, কিন্তু যা বাতাস! ভিজে একশা।

কর্নেল আস্তে বললেন, আসতে বল্!

তপেশ বসাকের স্ত্রী হয়তো। কিছু কি ঘটেছে? সোজা হয়ে বসলেন। কিন্তু তাকে একটু চমকে দিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকল কেয়া রায়। চাদর ভিজে গেছে। খালি পা। জুতো ওয়েটিং রুমে খুলে এসেছে বোধ করি। মুখে প্রচণ্ড উদ্বেগ। নমস্কার করে বসে পড়ল। বলল, আমাকে চিনতে পারছেন!

হুঁ। তুমি কেয়া, প্রয়াত বাসুদেব রায়ের স্ত্রী।

কেয়া ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর বলল, ওর নাম বাসুদেব ছিল কি না জানি না। আপনাকে সেদিন বলেছি, ওকে তপেশ বলে জানতাম। ওই নামেই আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছিল।

কর্নেল একটু হাসলেন। অবশ্য ওর আসল নাম বাসুদেব রায় কি না তাও বলা কঠিন। হুঁ, বলো কী হয়েছে?

কেয়া একটু চুপ করে থাকার পর বলল, গতকাল শ্রীলক্ষ্মী ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বউবাজার ব্রাঞ্চ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি রেজেস্ট্রি ডাকে। লিখেছে, তপেশ বসাকের নামে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপজিট আছে এবং তার নমিনি করা আছে আমাকে–আমার ঠিকানাও দেওয়া আছে।

স্ত্রী হিসেবে?

হ্যাঁ। কেয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল। ব্যাংক লিখেছে, আরেক ভদ্রমহিলা তপেশ বসাকের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে টাকা ক্লেইম করেছেন। কিন্তু তপেশ বসাকের ডেথ সার্টিফিকেট দুবছর আগেকার। অথচ তারপরও গত আগস্ট পর্যন্ত তপেশ বসাক টাকা জমা দিয়ে গেছে নিয়মিত। কাজেই ব্যাংক তার ক্লেইম নাকচ, করেছে। আমাকেই তারা টাকা দেবে।

ভেরি ইন্টারেস্টিং! তারপর?

আমি হাথিয়াগড়ে গিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট আনব ঠিক করেছিলুম। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া টাকা তো ব্যাংক দেবে না। কিন্তু আজ সকালে এই বেনামী চিঠিটা লেটার বক্সে পেয়েছি। সাহস হচ্ছে না যেতে।

বলে কেয়া একটা ভাঁজ করা চিঠি দিল কর্নেলকে। কর্নেল চিঠিটা খুললেন। তাতে লেখা আছে :

তপেশ বসাকের টাকা তোমার প্রাপ্য নয়। তুমি ওর ব্যাংকের টাকা দাবি করলে মারা পড়বে। সাবধান।

কিন্তু হরফগুলো মুদ্রিত এবং নানা সাইজের হরফ। ছাপানো কাগজ থেকে কেটে আঠা দিয়ে সাঁটা শব্দগুলি। কর্নেল শুধু বললেন, হুঁ।

কেয়া বলল, আমি আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি, কর্নেল!

কর্নেল বললেন, হাথিয়াগড়ে না গিয়েও তুমি চিঠি লিখে এবং পুলিশের সাহায্যে ডেথ সার্টিফিকেটটা আনাতে পারো। বিয়ের রেজেস্ট্রি পেপার সাবমিট করতে পারো। কিন্তু

কিন্তু বেনামী চিঠিতে আমাকে শাসানো হয়েছে।

হা। তুমি মেয়ে। মাথার ওপর কোনো পুরুষ গার্জেন নেই। ভাববার কথা।

ষষ্ঠী ট্রেতে কেয়ার জন্য চা, কর্নেলের জন্য কফি এবং প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স রেখে গেল। কেয়া কর্নেলের কথায় অনিচ্ছার ভঙ্গিতে চায়ের কাপ তুলে নিল। একটু পরে কর্নেল বললেন, তুমি একটা ফ্ল্যাট কিনেছ বলছিলে। সেটার দাম কত?

আড়াই লাখ প্রায়। এর মধ্যে বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইনসিওরেন্স, মায়ের গয়না বেচে এক লাখ দিয়েছি। বাকিটা দু কিস্তিতে দেবার কথা। নইলে ফ্ল্যাটের দখল পাব না। সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি একেবারে। ট্রেডিং কনসার্নে টাইপিস্টের চাকরি করি।

কর্নেল ওর দিকে তাকালেন। গোপন কোরো না। তপেশ ওরফে বাসুদেব নিশ্চয় বাকি টাকা দেবে বলেছিল। না হলে ওই এক লাখ দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করতে না?

কেয়া মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, হ্যাঁ। ও প্রতিশ্রুতি না দিলে রিস্ক নিতুম না। ওকে অবিশ্বাস করার কারণ তো ছিল না। তাছাড়া

তাছাড়া?

কেয়া ধরা গলায় বলল, ও বলেছিল নতুন ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। আমার একটা বড় স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেল!

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। ফ্ল্যাটের দখল না পেলে বেচবেই বা কেমন করে? ভুইফোড় সব হাউসিং কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। তাদের জটিল ব্যবস্থা সরল লোকদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে।

কেয়া কেঁদে ফেলল। আমাকে আপনি বাঁচান, কর্নেল!

অধীর হয়ো না। দেখছি, কী করা যায়। কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন। .., চা খেয়ে নাও। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে আজ। ভেবো না, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।

কিছুক্ষণ পরে কেয়াকে লাল ল্যান্ডরোভারে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কর্নেল চললেন দক্ষিণে। মির্জাপুর স্ট্রিটে পৌঁছে তপেশ বসাকের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। সেই বারো ঘর এক উঠোন। দরজা খুললেন এক অচেনা ভদ্রলোক। কর্নেল বললেন, মিসেস রমা বসাকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ভদ্রলোক অবাক হয়েছিলেন। মুখে কেমন হাসি। বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো স্যার? তপেশ কে এমন কেউকেটা ছিল যে তার বউয়ের কাছে হর্দম গাড়ি। চেপে সায়েবসুবো লোকেরা যাতায়াত করছেন?

হু, রমার কাছে গাড়ি চেপে কেউ বা কারা যাতায়াত করেছে। কর্নেল বললেন, ইনসিওরেন্সের ব্যাপার। তদন্ত হচ্ছে। প্লিজ, রমা দেবীকে একটু খবর দিন।

একটু পরে রমা এসে কর্নেলকে দেখে থমকে দাঁড়াল। সেদিন যে তার ঘরে গিয়েছিল, এরমা যেন সেরমা নয়। বিরক্ত এবং বিব্রত। বলল, বলুন কী বলবেন।

কর্নেলের গায়ে বর্ষাতি। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হাসলেন।… এখানে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না। একটু সময় লাগবে।

রমা নির্লিপ্ত মুখে বলল, দেখেছেন তো মোটে একখানা ঘর। উনুন। জ্বেলেছি। ধোঁয়ায় ভর্তি!

রমা, ব্যাংকের টাকা তুমি পাবে না–সে তো জানোই। তবু কেন অন্যের প্ররোচনায় বিপজ্জনক ফঁদে পা দিতে যাচ্ছ?

রমা শক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। ঝাঝালো স্বরে বলল, সে আমি দেখব। মামলা লড়ব।

তোমাকে কে এসে লোভ দেখিয়েছে, রমা?

রমার চোখ জ্বলে উঠল। বলল, আমি কি কচি মেয়ে? আমার স্বামীর নামে। ডিপজিট-অন্য কেউ তার বউ সেজে দাবি করলেই হলো?

কর্নেল বুঝলেন, ওকে বোঝানো বৃথা। গাড়িওয়ালা কেউ এসে ওকে লোভ দেখিয়েছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে, সাহসে বাঘিনী হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে না, তার স্বামীর মৃত্যুর পরও একাউন্টে ক্রমাগত টাকা। পড়েছে এবং নমিনি কেয়া রায় কাজেই তার দাবি টিকবে না। হুঁ, কারুর মৃত্যুর পর সেই লোকটির নামে কেউ টাকা জমা দিতেও পারে-ধরা যাক, কোনো দেনাকারী দেনার টাকা তার পাওনাদারের মৃত্যুর পরও একাউন্টে জুলা দিতে থাকে। এই ছুতো ধরেই রমার মুরুব্বি লড়বে হয়তো। এমন কী সেই মুরুব্বি কেয়ার বিয়ের কাগজটাও জাল বলে প্রমাণ করতে চাইবে। ঘুষ দেবে। যথাস্থানে। আজকাল নয়কে ছয় করা কিছু কঠিন নয়। কিন্তু পরিণামে যদি মামলা জেতেও, টাকাটা রমা পাবে না, সেটা নিশ্চিত। তার মুরুব্বির হাতেই যাবে।

কর্নেল বললেন, যে তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে, তার নাম কী রমা?

রমা বলল, অত কথার জবাব দেবার সময় নেই আমার। কোর্টে যা হবার হবে।

সে চলে গেল। কর্নেল গাড়িতে গিয়ে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ মনে হলো, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের এক কাপ প্রখ্যাত কফি খেয়ে গেলে মন্দ হয় না।

সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেল তিনমূর্তির সঙ্গে। শ্যামলকান্তি, সুভদ্র আর সৌম্য। দুপক্ষই থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর শ্যামলকান্তি সহাস্যে বললেন, হ্যাল্লো কর্নেল!

কর্নেল বললেন, শীতের সন্ধ্যা এবং বৃষ্টি এক পেয়ালা কফি দাবি করে মিঃ মজুমদার।

আমাদের অবশ্য পুরনো অভ্যাস। ছাত্রজীবন থেকে এই কফিহাউসে আনাগোনা।

আমি কোনো প্রশ্ন করিনি, মিঃ মজুমদার।

শ্যামলকান্তি হাসতে হাসতে পাশ দিয়ে নেমে গেলেন। সৌম্য ও সুভদ্রের মুখে নির্লিপ্ততা। কর্নেল উঠে গেলেন দোতলায়। উঁকি মেরে ভিড় দেখে তিনতলায় গেলেন। ডানদিকে ব্যালকনির মতো অংশে একটা টেবিল খালি দেখে বসলেন সেখানে। তিনতলায় ভিড়টা কম। এখানে কফির দাম বেশি। কফির অর্ডার দিয়ে ঝুঁকে দোতলার ভিড়টা দেখছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল, দোতলার দরজা দিয়ে ফের শ্যামলকান্তি, সুভদ্র ও সৌম্য ঢুকছেন। তিনজনে মিলে কাকে খুঁজছে যেন। কর্নেলকে? কর্নেল দ্রুত টেবিল থেকে উঠে পড়লেন। দরজা দিয়ে বেরিয়ে সামনে একটা বই কোম্পানির অফিস। দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দুজন কর্মচারী টেবিলে কাজ করছিলেন। একজন বললেন, নিচে স্যার, দোতলায় যান।

কর্নেল বললেন, আমি ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

 তিনি তো চলে গেছেন একটু আগে।

কর্নেল চেয়ারে বসে আস্তে বললেন, আমার কয়েকটা বিদেশী বইয়ের অর্ডার দেওয়া ছিল গত অক্টোবরে। একটু খোঁজ করবেন কি, প্লিজ?

রসিদ?

এই রে! রসিদটা তো হারিয়ে ফেলেছি। তবে আপনাদের অক্টোবরের অর্ডার ফাইলটা যদি দেখেন দয়া করে। আমার নাম কর্নেল এন সরকার। দুশো টাকা জমা দেওয়া আছে। ওয়েস্ট জার্মানির মেকার অ্যান্ড উইনবার্গার কোম্পানির প্রকাশিত বই।

মণিদা, দেখ তো! ইনি কী অর্ডার দিয়েছেন। ওয়েস্ট জার্মানি!

মিনিট কুড়ি খুঁজেও পাওয়া গেল না। কর্নেল উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। বললেন, কী বিচ্ছিরি বৃষ্টি দেখুন তো!

নিচে শ্যামলকান্তি, সৌম্য ও সুভদ্র একটা কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়ির কাছে যাচ্ছে। তারা গাড়িতে ঢুকল। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে কর্নেল সরে এলেন। বললেন, বরং কাল ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে এসে দেখা করব। উনি চেনেন আমাকে। সরি, আপনাদের কষ্ট দিলুম।

না, না। আপনি কাল আসুন সন্ধ্যা ছটার মধ্যে। ম্যানেজারবাবু বলতে পারবেন।….

কর্নেল তিনতলার সেই ব্যালকনির কাছে গিয়ে দেখেন, পরিচারক ট্রেতে কফি নিয়ে বিরক্ত মুখে ফিরে আসছে। কর্নেলকে দেখে এবার হাসল।

ওদের নিশ্চয় কিছু বলার ছিল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবলেন। বলার ছিল–অথচ এ মুহূর্তে তিনি শুনতে চান না ওদের কথা। বলার তাগিদ কতটা; সেটাই আঁচ করা দরকার আগে। তাগিদ বা গরজ যখন ওদের, তখন কোনোসময় যোগাযোগ করবেই।

বিল মিটিয়ে বখশিস দিয়ে নেমে এলেন নিচে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইচ্ছে হলো, মির্জাপুর স্ট্রিট হয়ে ঘুরে যাবেন। উইন্ডস্ক্রিন তুলে দিলেন। কলেজ স্কোয়ার চক্কর দিয়ে মোড়ে গতি একটু কমালেন।

রমাদের বাড়ির নিচে কালো অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

কর্নেল চললেন বউবাজারের দিকে। ১৭/২ ফকিরচাঁদ লেনে তপেশ বসাক বা বাসুদেব রায় থাকত। পুলিশ তার ঘরে কেয়ার ছবি পেয়েছিল। প্রিন্টেড ম্যাটার লেখা খামে দশহাজার টাকার নোট ওই ঠিকানায় বুক পোস্টে মোতিগঞ্জ ডাকঘর থেকে পোস্ট করেছিল তপেশ ওরফে বাসুদেব।

বাড়িটা তিনতলা এবং তত বেশি পুরনো নয়। ছিমছাম, সুন্দর। নিচের তলায় একটা অফিস। দরজায় তালা। দোতলায় একটা ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল টিপলেন। একটু পরে এক ভদ্রলোক দরজার ফাঁক দিয়ে বললেন, কাকে চাই?

তপেশ বসাকের ফ্ল্যাটটা কোন তলায় বলতে পারেন?

 দরজা খুলে গেল। কর্নেলকে দেখে নিলেন ভদ্রলোক–আপাদমস্তক। তারপর একটু হেসে বললেন, স্যার কি থানা থেকে আসছেন?

কর্নেল তার আইডেন্টিটি কার্ডটা এগিয়ে দিলেন।

ভদ্রলোক ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কথাটা বোধ করি বুঝতে পারলেন না। বললেন, তপেশ আমারই ভাড়াটে ছিল। সে তো বিহারে কোথায় সুইসাইড করে মারা গেছে। সেদিন পুলিশ এসে ঘর সার্চ করে গেছে। ব্যাপারটা কী বলুন তো স্যার?

আপনার নামটা জানতে পারি?

সনৎকুমার বোস। বিজনেস-টেস করি। নিচে অফিস–দেখেছেন বোধ করি।

তপেশবাবু সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু জানতে চাই। নানা, আপনার বিব্রত হবার কারণ নেই। ওঁর একটা ইন্সিওরেন্সের ব্যাপারে ঝামেলা বেধেছে। তারই তদন্তে এসেছি।

একটু ইতস্তত করে সনৎবাবু বললেন, ভেতরে আসুন।

বসার ঘরটা ছিমছাম সাজানো। ভদ্রলোকের সৌন্দর্যবোধ আছে। সোফায় বসে কর্নেল বললেন, তপেশবাবু কোন ফ্ল্যাটে থাকতেন?

তিনতলার সিঙ্গলরুম একটা মোটে ফ্ল্যাট। কর্পোরেশন তিনতলায় পার্মিশান দেয়নি। সনৎবাবু কাচুমাচু মুখে হাসলেন। যাই হোক, ম্যানেজ-ট্যানেজ করে ওই সিঙ্গলরুম ফ্ল্যাটটা টিকিয়ে রেখেছিলুম। বছর দুই আগে আমার বড় ছেলে প্রণব অনুরোধ করল, ওর এক কলেজ লাইফের বন্ধু ফ্ল্যাট খুঁজছে। তো প্রণবের কথায় তপেশকে দিলুম।

প্রণববাবু আছেন কি?

বেরিয়েছে কোথায়।

কখন ফিরবেন?

বলা কঠিন। তবে রাত্তির নটার বেশি পর্যন্ত বাইরে থাকে না।

 প্রণববাবু বলেছিলেন তপেশ তার বন্ধু?

আজ্ঞে।

তপেশের ফ্ল্যাটে বাইরের লোকটোক আসত, জানেন?

সনৎবাবু একটু ভয় পেলেন যেন। গোঁফের একটা পাশ চুলকে বললেন, আমি তো বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাকি। লক্ষ্য করিনি কিছু। ও তেমন আজেবাজে প্রকৃতির ছিল বলেও শুনিনি। তবে লোকের কথা বলছেন। সব মানুষেরই জানাশোনা লোক আছে। তারা যাতায়াত করতেই পারে। এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করি?

ধন্যবাদ। এইমাত্র কফিহাউসে কফি খেয়ে আসছি।

এক ভদ্রমহিলা পর্দা তুলে উঁকি দিচ্ছিলেন। সনৎবাবু তার উদ্দেশে বললেন, তপেশের ইনসিওরেন্সের ব্যাপারে ইনি তদন্ত করতে এসেছেন। স্যার, প্রণবের মা।

কর্নেল তাকে নমস্কার করলে উনিও নমস্কার করে এ ঘরে এলেন। চেহারায় জাঁদরেল গিন্নির হাবভাব। সোফার একদিকে বসে বললেন, তপেশের কাছে লোক-টোক তত আসত না। এমনিতে মেজাজ ভাল কিন্তু খুব রগচটা আর খামখেয়ালি ছিল। হাওর এক পিসতুতো না মাসতুতো বোন মাঝে মাঝে আসতে দেখেছি।

রোগা ছিপছিপে চেহারা-ফর্সা রঙ?

 হ্যাঁ। তবে আমার কিন্তু বিশ্বাস হত না, জানেন?

কর্নেল বুঝলেন, মেয়েদের চোখ। ঠিকই ধরেছিলেন। কেয়া আসত মাঝে মাঝে। বললেন, তপেশ কোথায় চাকরি করত জানেন?

বিচক্ষণ ভদ্রমহিলা দ্রুত বললেন, সে তো আপনাদের রেকর্ডে লেখা থাকার কথা। ইনসিওরে কোম্পানি থেকে তদন্ত করতে এসেছেন বলছেন!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ভেরিফাই করা দরকার ম্যাডাম!

বলত তো কোথায় চাকরি করে। কিন্তু বিশ্বাস হত না। ভদ্রমহিলা কড়া মেজাজে বললেন। মাঝে মাঝে দুমাস-তিনমাস বেপাত্তা। আবার হঠাৎ করে এসে গেল।

সনৎবাবু বললেন, সে ধরো–কোম্পানির কাজে বাইরে যেতেই হয়। ওটা কোনো ব্যাপার নয়। তবে প্রণব ওর সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশি জানতে পারে। যদি ঘণ্টাখানেক ওয়েট করতে পারেন, এসে যাবে।

কর্নেল বললেন, তপেশবাবুর ঘরটা একটু দেখতে চাই।

সনৎবাবু স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলা চাপা ও ষড়যন্ত্রসংকুল কণ্ঠস্বরে বললেন, ঘরে একটা ক্যাম্পখাট আর বিছানা ছাড়া কিছু নেই। একটা জলের কুঁজো পর্যন্ত না। কিছু না। এটাই কেমন যেন লাগত আমার।

ঘরটা দেখতে চাই। ফের কথাটা কর্নেল শক্ত গলায় বললেন।

সনৎবাবু উঠে দাঁড়ালেন। …না, না। দেখাতে আপত্তি কী? আসুন, দেখাচ্ছি। কৈ গো, চাবিটা এনে দাও।

সনৎবাবুর স্ত্রীর কিন্তু খুব উৎসাহ লক্ষ্য করলেন কর্নেল। ঝটপট চাবি এনে দিলেন তিনি। দুপদাপ শব্দ করে পা ফেলে অনুসরণ করলেন। সনৎবাবু যখন তালা খুলছেন, ভদ্রমহিলা ফের চাপা স্বরে কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, বরাবর আমার কেমন একটা খটকা ছিল তপেশের ওপর। কিন্তু প্রণবের বন্ধু। কিছু বললেই প্রণব মেজাজ দেখাত। একদিন দেখি।

সনৎবাবু ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলেছেন। কম পাওয়ারের আলো। কর্নেল তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। সনৎবাবুর স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি। উনি হঠাৎ থেমে গেলে বললেন, বলুন ম্যাডাম!

সনৎবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, কী সব বলছ বুঝিনে! ছেড়ে দাও তো। পরের কথায় কাজ কী?

থামো! গৃহিণী প্রায় গর্জন করলেন। কর্নেলের দিকে ঘুরে তেমনি ষড়যন্ত্রসংকুল স্বরে বললেন, একদিন বিকেলে ছাদে ঘুরতে এসেছি, এই দরজাটা খোলা। হঠাৎ দেখি, তপেশ বিছানায় বসে নোট গুনছে। এই এত্তো একশোটাকার নোট! সেদিনই সন্দেহ হয়েছিল, ও লোক ভাল নয়।

সনৎবাবু খিক খিক করে হাসলেন। কী আশ্চর্য! টাকা গুনলে লোক ভাল হয় না! একেই বলে ফেমিনিন লজিক।

গৃহিণী চোখ কটমটিয়ে বললেন, অত্তো টাকা যার, সে এমনিভাবে থাকে। কোথায় পায় অত্তো টাকা? তোমায় বললুম তো উড়িয়ে দিলে!

সনৎবাবু বললেন, আহা! ওর কোম্পানির কালেকশানের টাকাও তো হতে পারে।

কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখছিলেন। দেয়ালে একটামাত্র ক্যালেন্ডার ঝুলছে। সেও গত বছরের ক্যালেন্ডার। ক্যাম্পখাটে শুধু একটা গুটানো বিছানা। . বিছানাটা খুলে বিছিয়ে দিলেন। পুলিশ সার্চ করে শুধু কেয়ার ছবি পেয়েছে। তবু তোশকটা টিপেটিপে কর্নেল তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করলেন। কর্তা-গিন্নি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল বালিশের ভেতরটাও খুঁজলেন। কিছু নেই। তারপর দেয়াল-ক্যালেন্ডারটার পাতা ওল্টাতে থাকলেন। দেখলেন কয়েকটা মাসের কিছু-কিছু তারিখের চারিদিকে গোল করে ডটপেনের বর্ডার। তারিখগুলি চিহ্নিত। ১৭ জুন, ২২ জুন, ৫ আগস্ট, ১২ অক্টোবর, ১৯ অক্টোবর, ১৫ ডিসেম্বর। ১৫ ডিসেম্বরে ঢ্যারাচিহ্ন। কর্নেল ভদ্রমহিলার দিকে ঘুরে বললেন, এই ক্যালেন্ডারটা পরীক্ষা করা দরকার। যদি অনুমতি দেন, নিয়ে যাব।

ভদ্রমহিলা উত্তেজিতভাবে বললেন, নিয়ে যান। পরীক্ষা করে দেখুন। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোক!

সনৎবাবু স্ত্রীর হাবভাব দেখে নীরস ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁও দিয়ে আর কী হবে? বিছানাটাও তো সরাতে হবে ঘর থেকে। নতুন ভাড়াটে আসবে সামনে মাসের পয়লা।

কর্নেল ক্যালেন্ডারটা খুলে জড়িয়ে হাতে নিলেন। বললেন, এনাফ! চলুন, নিচে যাই!

সিঁড়ির নিচে এক শক্তসমর্থ চেহারার যুবকের সঙ্গে দেখা হলো। ফিল্ম হিরোর আদলে পোশাক ও চুলের সাজ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে। সনৎবাবু একটু হেসে বললেন, প্রণব–আমার বড় ছেলে! পিন্টু, ইনি ইনসিওরেন্স থেকে তপেশের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করছেন। মোটা টাকার পলিসি আছে নাকি।

পলিসির কথাটা একটু বাড়িয়ে বললেন সনত্বাবু। কর্নেল বুঝলেন, সনৎবাবু স্ত্রীকে যেমন, তেমনি ছেলেকেও সমঝে চলেন। হুঁ, একটু দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ–অন্তত পারিবারিক ক্ষেত্রে। তবে এমন মানুষ ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্টোটি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতি জাঁদরেল সম্রাটও ও সম্রাজ্ঞী বা পুত্রের কাছে কাবু থাকার কথা ইতিহাসে বিস্তর আছে।

 কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, প্রণববাবু, আপনাকে আমার খুবই দরকার। কাল সকালে একবার সময় হবে কি? আমার কার্ড দেওয়া আছে আপনার বাবার কাছে।

সনৎবাবুর হাতেই ছিল কার্ডটা। প্রণবকে দিলেন। প্রণব দেখে নিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল। আস্তে বলল, আই সি! আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ?

তার বাবা-মা পরস্পর তাকাতাকি করলেন। ইনভেস্টিগেটর কথাটায় যে আসলে ডিটেকটিভ বোঝায়, জীবনে এই প্রথম জানতে পারলেন যেন। দুটি মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, ইয়ং ম্যান! শুনলুম, তপেশ আপনার বন্ধু ছিল। কাজেই আপনার সহযোগিতা আশা করি পাব।

প্রণব বলল, কিন্তু ব্যাপারটা কী? তপেশ তো সুইসাইড করেছে। পুলিশই বলেছে।

হ্যাঁ, সুইসাইড। কর্নেল চুরুট বের করে লাইটার জ্বাললেন। ধোঁয়ার সঙ্গে বললেন, বাট দেয়ার ইজ সামথিং কুয়্যার–কিছু গণ্ডগোল আছে। আপনি আপনার বন্ধুর জন্য আমাকে সাহায্য করুন।

প্রণব কার্ডটা মুঠোয় ধরে বলল, ওকে। কাল মর্নিংয়ে যাব।..