এ যাবত আমরা ওতেই বসবাস করছি। কিন্তু এখন আর ওতে চলছে না। বিগত ৩/৯/২৯ (বাং) তারিখে স্থানীয় আয়শা বিবির নিকট হতে কিছু জমি কিনেছি এবং বাড়ীর পূর্বদিকে চর পড়িয়া কিছু জমি বৃদ্ধি হয়েছে। এতে কৃষি কাজের কিছু উন্নতি হচ্ছে ও পশার বাড়ছে। ধান, চাল, পাট, তিল, মরিচ ইত্যাদি নানা ফসলের রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বর্তমান কুঁড়ে ঘরখানা এখন অনুপযোগী। ভাবলাম – ছোটখাট একখানা টিনের ঘর তুলব। কিন্তু ছুতার লাগাব না, কাজ সব করব নিজে।
আমাদের ঘরে বহুবছর যাবত একটি হাতুর ও একটি বাটালী ছিল। ওদুটো সংগ্রহ করছিলেন মোল্লা সাব। আমি বরাবরই ওর দ্বারা কাঠকুটাে কাটাকুটি করতাম। গৃহ নির্মাণের জন্য আরো যে সব হাতিয়ার আবশ্যক, তা চাইলাম প্রতিবেশী আঃ কাদির আকনের কাছে, তিনি দিতে সম্মত হলেন। আকন সাব ছিলেন একজন সুনিপুণ ছুতার মিস্ত্রী, তবে পেশাদার নহেন।
একদা চর মোনাই নিবাসী কাজেম আলী হাওলাদারের একখানা ঘর দেখে আমার খুব ভাল লাগছিল। তখন ভাবছিলাম যে, কখনো পারলে এই রকম একখানা ঘর তুলব। সেখানে গিয়ে সেই ঘরখানার একটা নক্সা এঁকে ও তার বিভিন্ন অংশের মাপ ঝোক লেখে আনলাম।
বরিশাল হতে কিনে আনলাম- শাল কাঠের খাম ও বাইন কাঠের আড়া, পাইর, রুয়া, চেড়া ইত্যাদি এবং টিন তক্তাদি ঘরের আবশ্যকীয় কাঠ সংগ্রহ করছিলাম একটা খরিদা কড়ই গাছ চিড়িয়ে।
১৩৩১ সালের ১১ই কার্তিক, আমাদের পুরান খড়ের ঘরখানা ভেঙ্গে (১৩ X ১০ হাত) নুতন ঘরের খাম পুতলাম এবং যথা নিয়মে কাজ করতে লাগলাম। খাম পুতিয়ে আড়া-পাইর লাগিয়ে, চাল বানিয়ে ছাউনী দিতে প্রায় মাস দেড়েক কেটে গেল।
২৫শে অগ্রহায়ণ নতুন ঘর সঞ্চার করলাম (নতুন বেড়া বাকি)। অতঃপর মাঠের কাজের ফাকে ফঁাকে ত্রিকাঠ, চৌকাঠ, বেড়া, কবাট, জানালা ইত্যাদি তৈরী করতে বছর খানেক কেটে গেল এবং গৃহ সরঞ্জাম যথা- খাট, চেয়ার, টেবিল, বাক্স, আলমারী ইত্যাদি তৈরী করতে সময় লাগল আরো বছর খানেক। অতঃপর আমার যখন যেটুকু ছুতারের কাজ আবশ্যক হতে থাকল, তখন তা নিজেই করতে লাগলাম।
(১৩৩৪ সালে মোল্লা সাব আমাকে -করাত, বুরুম, রেদা, সারাশী, ভ্যানা, মাতুল, কুরুল ইত্যাদি ছুতার কাজের যাবতীয় যন্ত্রপাতি কিনে দিলেন এবং ওর বিনিময়ে আমি তার এক খানা (১৩ X ১০ হাত) নুতন টিনের ঘর তুলে দিলাম (মোল্লা সাব আমার সংসার হতে ১৩৩২ সালের ১০ই আষাঢ় ভিন্ন হচ্ছিলেন।)
এ সময় হতে ছুতার কাজের যন্ত্রপাতি সমূহ হল আমার নিজস্ব। তাই পরবর্তি জীবনের যাবতীয় গৃহ ও গৃহসরঞ্জামাদি নিজেই তৈরী করেছি ও করছি, এমন কি লাঙ্গল-জোয়াল এবং নৌকাও। আমার সংসার জীবনে কখনো কোন কাজ “জানিনে” বলে অন্যের শরণাপন্ন হইনি। অথচ অর্থ-উপার্জনের জন্য কখনো অন্যের কোন কাজ করিনি। আমার ছুতার কাজ শিক্ষার উদ্দেশ্য হল-অর্থে পার্জন বা অর্থ বাচানো নয়, স্বাবলম্বী হওয়া। ফলতঃ যে কোন ধরনের কাজ – “করতে জানা” এবং তা “নিজ হাতে করা”, এ দুটোতেই আমার মনের আনন্দ। রশি পাকানো, শিশি-বোতলের গলে “যোত” লাগানো এমন কি ঝাটা নির্মাণকেও আমি গৌরবের কাজ মনে করি।