১৩২৬ সাল। এখন আমার বয়স প্রায় উনিশ বছর। পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘ পনরটি বছর বহু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মা আমাকে প্রতিপালন করছেন আর আমার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছেন ও বলছেন – “আমার কুড় বড় হলে এক দিন সুখ হবে”। এখন আমি কিছুটা বড় হয়েছি। কিন্তু আমার দ্বারা মা’র কোন দুঃখ-কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। এখনও আমাদের উভয়ের ভাতকাপড়ের চিন্তা মা-কেই করতে হচ্ছে। তবে আমি বড় হলাম কেন? কিন্তু এখন আমিই বা কি করতে পারি বা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
বলছিলাম যে, আমাদের নীলামী জমিটুকু পুনঃ পত্তন আনা হয়েছে। কিন্তু তা নামে মাত্র। রায় বাবুদের দাবীর টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল সব জমিটুকু বন্ধক রেখে। এতে জমিতে আমাদের স্বত্ব এসেছিল কিন্তু দখল আসেনি।
মোল্লা সাব এ সময় বাউফল থানার পুলিশ। চাকুরীতে বেশ উপার্জন করেন। তিনি টাকা দিয়ে আমাদের বন্ধকী জমিটুকু ছাড়ালেন। মা আমাকে বল্লেন- “মোল্লার পোয় চাকরী করে, তুই হালুট কর। দুই জনে খাটলে আমাগো আর অভাব থাকবে না”। আমি সম্মত হলাম।
মোল্লা সাব পনর টাকা মূল্যে একটি হালের গরু কিনে দিলেন এবং প্রতিবেশী “এক গরুওয়ালা” একজন কৃষকের সহিত আমি ভাগে হাল-চাষ শুরু করলাম (কার্তিক-১৩২৬)। প্রথম ফসল জনালাম- খেসারী, মশুর, কিছু মরিচ ও তিল ইত্যাদি। কৃষি কাজ চালাতে লাগলাম।
এ সময় পর্যন্ত মাচানে প্রাপ্ত বস্তাটির বইগুলো পড়া আমার প্রায় শেষ হচ্ছিল (ব্যাকরণ বাদে)। এখন আমি প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজীর নিকট গিয়ে পুথি পড়তে শুরু করলাম, অবশ্য রাত্রে। ফরাজী সাব সুর করে পুথি পড়তেন এবং আমি তার সাথে সাথে সুর মিলিয়ে কখনো বা একা একা পড়তাম। এরূপ বিভিন্ন পুথি পড়ে নানা রূপ কেচ্ছা-কাহিনী জ্ঞাত হয়ে আনন্দ পেতে লাগলাম। বিশেষতঃ এতে আমার (ভাষা) শিক্ষার অগ্রগতি হতে লাগল। অধিকন্তু – ছবি আঁকার মত আর একটা নেশায় আমাকে পেয়ে বসল। তা হ’ল – পুথির “পয়ার” ও “ত্রিপদী” জাতীয় ছন্দের অনুকরণে নূতন কিছু রচনা করা। চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম।
আমাদের গ্রামে তখন “পুথিগান” এর প্রচলন ছিল যথেষ্ট। “পুথিপড়া” হতে “পুথিগান” ভিন্ন। ওকে “সায়েরগান” ও বলে। সায়েরগান অনেকটা কবি গানের অনুরূপ। এতে একজন বয়াতী ও দু-তিন জন দ্বোহার থাকে। পুথিগত কোন কেচ্ছা-কাহিনী কিংবা দেখা বা শোনা কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বয়াতী গান রচনা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে গানের মজলিসের কোন আশু ঘটনার প্রেক্ষিতে যখন তখন গান রচিত হইয়া থাকে। প্রত্যেকটি গানের দুটি অংশ থাকে “ধুয়া ও লহর” । “লহর” অংশটা বয়াতী একাই গেয়ে যায় আর “ধুয়া” অংশটা দ্বোহার গণ পুনরোক্তি করে। গানের “ধুয়া” অংশটা যারা পুনরোক্তি করে অর্থাৎ দ্বোহরায়, তাদের “দ্বোহার” বলা হয় এবং গান বা কবিতাদি অর্থাৎ “বয়াত” রচনাকারীকে বলা হয় “বয়াতী” |
আমাদের পাড়ায় ঐ রকম একজন পুথিগানের বয়াতী ছিলেন মেছের আলী সিকদার। ১৯১৪ সালের প্রথম মহাযুদ্ধে বৃটিশ সৈন্য দলে চাকুর নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন বসরায়। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ বন্ধ হলে ১৯১৯ (বাং ১৩২৬) সালে অবসর প্রাপ্ত হয়ে তিনি বাড়ীতে এলেন এবং গ্রামের বিভিন্ন স্থানে আসর জমিয়ে পুথিগান গাইতে লাগলেন। যুব-বৃদ্ধ সকলেই গান শোনতে যেতেন, আমিও যেতাম। প্রথম কয়েকদিন গেলাম গানের শ্রোতা হিসেবে, পরে দ্বোহার হিসাবে।
সিকদার সাব যে সকল গান গাইতেন, আমি তার অনুকরণে গান রচনার চেষ্টা করতে লাগলাম এবং কয়েকটি গান রচনা করলাম। সিকদার সাবের গানের একজন দ্বোহার ছিলেন আমার প্রতিবেশী আঃ রহিম ফরাজী। আমার রচিত গান ক’টি তাকে দেখালাম এবং ধীরে ধীরে গেয়ে শোনালাম। শুনে তিনি বল্লেন- “হয়েছে ভাল, এগুলো আসরে গাওয়া চলে”। আমি আরো গান রচনা করতে লাগলাম।
১৩২৭ সালে আমি বয়াতী হয়ে পুথিগানের দল গঠন করলাম। আমার নেহার হলেন জাহান আলী, হোসেন মল্লিক ও আঃ রহিম খা। ওঁরা সকলেই আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ার নিবাসী। দিন দিন গানের উৎকর্ষ হতে লাগল।
পুথিগান, প্রতিযোগিতা মূলক গান। এতে একাধিক বয়াতী না হলে গান ভাল জমে না। শ্রোতাগণ বিচার করেন যে, প্রতিযোগীদের মধ্যে কোন বয়াতীর-গলার স্বর, গানের সুর ও ছন্দঃ ভাল; কে অপেক্ষাকৃত অধিক তার্কিক, বাকপটু, শাস্ত্রজ্ঞ ইত্যাদি।
দেশী ও বিদেশী অনেক বয়াতীর সহিত আমার পাল্লার (প্রতিযোগিতার) গান হতে লাগল। এতে দেখা গেল যে, সব সময় তর্কযুদ্ধে জয়ী হতে হলে যে পরিমাণ শাস্ত্রজ্ঞান থাকা আবশ্যক, তা আমার নাই। কাজেই আমার আরো বেশী পরিমাণ পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা আবশ্যক। সেজন্য সচেষ্ট হলাম।
এ সময় আমাদের সংসারের কর্তৃত্ব মা’র হাতে নেই, আমার হাতে। মোল্লা সব এসময় আমাদের পরিবারভুক্ত। তাই তিনি যে টাকা-পয়সা রোজগার করেন, তা আমার কাছে দেন এবং আমি উহা আবশ্যকীয় কাজে খরচ করি। হাতে নগদ পয়সা পেয়ে কিছু অযথা খরচ করতে লাগলাম, যাকে “সংসার খরচ” বলা চলে না। আলেপ-লায়লা, কাছাছোল আম্বিয়া, ফকির বিলাস, হযরতল ফেকা, তালে নামা, ছায়ত নামা ইত্যাদি কতগুলো পুথি এবং রামায়ন মহাভারত, মনসা মঙ্গল, গীতা, রাধাকৃষ্ণ বিলাস ইত্যাদি কতগুলো হিন্দু-শস্ত্র কিনলাম ও ওগুলো পড়তে লাগলাম।
রায় বাবুদের লামচরি তহশীল কাছাড়তে নীল কান্ত মুখাজী নামক একজন মোহরার ছিলেন, নিবাস পান বাড়ীয়া। তিনি ছিলেন হিন্দুশাস্ত্রে সুপন্ডিত। বিশেষতঃ সংস্কৃত ভাষা ভাল জানতেন। তার সাথে আলাপ-ব্যবহারে তিনি আমার বেশ বন্ধু হয়ে গেলেন। আমি তার ও পৌরাণিক গ্রন্থ দান করেন এবং ঋক বেদের কিছু অংশ বঙ্গানুবাদ করে দেন। “মনু সংহিতা” নামক বৈদিক গ্রন্থখানা দান করেন আমাকে চর মোনাই নিবাসী বাবু যামিনী কান্ত বিশ্বাস।
এ সময় আমি দিন ভর মাঠে কাজ করতাম আর রাত্রে – হয়ত কোথায়ও আসরে গান নচেৎ ঘরে বসে পুস্তকাদি অধ্যয়ন করতাম। সময়ের অপচয় করতাম না মোটেই। কৃষি ও গান, উভয়ের উন্নতি হতে লাগল। যে কোন বিষয় বা ঘটনা, দেখা বা শোনা মাত্র সে সম্বন্ধে তৎক্ষনাৎ গান রচনা করার ক্ষমতা আমার এ সময় অর্জিত হয়েছে।
মোল্লা সাব আমার বিবাহের জন্য উদ্যোগী হলেন এবং তার দোস্ত (বন্ধু) ময়জদিন গোলদারের একমাত্র কন্যা লালমন বিবির সহিত আমার বিবাহ স্থির করলেন। ১৩২৭ সালের ২২শে ফাল্গুন সরাজারী এবং ১৩২৯ সালের ২৯শে কার্তিক আমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল।
বিগত ১৩২৫ সালের অগ্রহায়ণ মাস হতে আমি নিয়মিত ভাবে সংসারের “জমা” ও “খরচ” এর হিসাব লিখে রাখতে শুরু করি। কেননা তৎপূর্বে আমার হাতে সংসারের কর্তৃত্ব ছিল না। মোল্লা সাব ট্রেনিং পাশ করে (ঐ সালে) কার্তিক মাসে বরিশাল এসে বাউফল থানায় বদলী হন এবং অগ্রহায়ণ মাস হতে সংসারের বাজার খরচ বাবদ আমার হাতে কিছু কিছু টাকা দিতে থাকেন। তিনি কখন, কত টাকা দিলেন এবং তা কিসে কত খরচ করলাম তা মোল্লা সাবকে বুঝায়ে দেওয়াই ছিল তখন জমা-খরচ লেখার উদ্দেশ্য। মোল্লা সাব সময় সময় হিসাব দেখতেন এবং বই পুথি কেনায় খরচ দেখলে অসন্তুষ্ট হতেন। এ জন্য এ যাবত আমি আমার আশানুরূপ পুস্তাকাদি কিনতে কুষ্ঠা বোধ করছি। বই-পুথি কেনা ও পড়া, এ দুটোই আমার যেন একটা নেশা। এ সময় আমার বই কেনার অসুবিধাটা দূর হল। কেননা এ সময় আমি পুথি গানে বেশ টাকা পেতে লাগলাম এবং তা সমস্তই খরচ করতে লাগলাম বই-পুথি কেনায় ।