৯. সাম্রাজ্য (c. ৩০০ – ২২০ )

. সাম্রাজ্য (সি. ৩০০ থেকে ২২০ বিসিই

তৃতীয় শতকের শুরুতে অন্যান্য এলাকায় সমাপ্তির দিকে চলা অ্যাক্সিয়াল যুগ তখনও চীনে বিকশিত হয়ে চলছিল, তবে এমনকি এখানেও আদি আদর্শগুলোর কিছু কিছু কঠোর হয়ে উঠছিল। প্রজন্মান্তরে ওয়েই ও কিন এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ছিল। ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো টিকে থাকার অন্তহীন সংগ্রামে একটি থেকে আরেকটিকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অন্তহীন এই বিরোধিতার কারণে সাধারণ জনগণ ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। অনেকেই ইয়াও ও শানের আমলের মতো একটি ঐক্যবদ্ধ চৈনিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী একজন শাসকের প্রত্যাশা করছিল। শান্তির পক্ষে আকাঙ্ক্ষা যেন টের পাওয়া যাচ্ছিল। চীনারা গ্রিকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক, অধিবিদ্যিক এবং যৌক্তিক প্রশ্নে আগ্রহী ছিল না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে এই জাতীয় বিষয়আশয়কে তুচ্ছ মনে হতো। আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই তাদের অগ্রাধিকার ছিল; সেই লক্ষ্যে চীনা দার্শনিক, নীতিবিদ ও অতীন্দ্রিয়বাদীরা সরকারের সমস্যা সমাধানের দিকে বেশি দৃষ্টি দিয়েছেন। এই সময় নাগাদ একটি নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন হয়ে পড়ার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এত দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল যে, সাধারণ মানুষ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মেই প্রধান পরিবর্তনগুলো ধরতে পারছিল। যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর কাল থেকে একটি নতুন সাম্রাজ্য আবির্ভূত হলে সেটা ইয়াও ও শানের প্রাচীন সাম্রাজ্যের মতো কিংবা এমনকি আদি ঝোউদের মতোও নয়-পরিচালিত করা যাবে না বলে ক্রমবর্ধমানহারে বিশ্বাস জন্মেছিল। বৃহত্তর, ক্রমসম্প্রসারমাণ রাজ্যগুলোতে রাজকুমাররা আর তাঁদের ক্ষমতার জাদুকরী ক্ষমতায় ( দাওদে) বিশ্বাস করছিলেন না। বাস্তববাদী হওয়ায় তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অর্থনীতিই সাফল্যের চাবিকাঠি। যাদের হাতে বৃহত্তর এলাকা, শক্তিশালী মানবসম্পদ, প্রচুর সম্পদ এবং সেরা শস্য ভাণ্ডার রয়েছে বিজয় সেই শাসকদের পক্ষে যাবে। 

চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ শাসকরা এমনকি কনফুসিয় বা মোহিস্ট উপদেষ্টাদের কথা শোনার ভণিতাটুকুও বিসর্জন দিয়েছিলেন। তার বদলে তাঁদের কট্টর বাস্তববাদের অংশীদার নতুন বণিক শ্রেণীর লোকদের শরণাপন্ন হয়েছেন। বণিকরা হিসাব বিজ্ঞানের হিসাব ও বিধিবিধানের উপর নির্ভরশীল ছিল। পথ-এর ধ্যান করার বদলে লাভ ও বিলাসিতার আকাঙ্ক্ষার অনুমান করত এবং অর্থ ও লিখিত চুক্তির ভাষায় চিন্তাভাবনা করত। কিন্তু অন্য একটি দার্শনিক মতবাদ সামনে উঠে আসছিল। একের পর এক রাষ্ট্রে শাসকরা ‘পদ্ধতির অনুসারী’ রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হচ্ছিলেন। চীনা ইতিহাসবিদরা সমবেতভাবে তাদের প্রায়শঃই ‘আইনি মতবাদপন্থী” হিসাবে অনূদিত ফাজিয়া নামে উল্লেখ করেন। তবে এটা বিভ্রান্তিকর ঠেকতে পারে। পদ্ধতির অনুসারীরা নিশ্চিতভাবেই আইনে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু বিচারপদ্ধতি নিয়ে মগ্ন হয়ে ছিলেন না। ফা-র মানে ছিল ‘মান, আদর্শ’। কাঁচামালকে কোনও একটি নির্দিষ্ট নকশার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে একে নতুন আকৃতি দেওয়া প্লাম্ব লাইন বা ছুঁতোরের স্কয়ারের মতো যন্ত্র বোঝাতে এটা ব্যবহৃত হতো। আইনবিদরা সাধারণ মানুষকে তাঁদের আদর্শের সঙ্গে অভিযোজিত করে তুলতে চেয়েছিলেন বলে শব্দটির অর্থ সম্প্রসারিত করে সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের আদেশমূলক পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সুতরাং ফাকে প্রায়শঃই যিঙ (শাস্তি)-এর সঙ্গে জুটিবদ্ধ করা হতো। এল-স্কয়ার যেমন অসমান বস্তুকে রেখায় নিয়ে আসে ঠিক সেভাবে রাষ্ট্রকে অবশ্যই নারী-পুরুষকে সংস্কার করার জন্যে কঠিন শাস্তি আরোপ করতে হবে বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তাঁরা। মোহিস্ট ও কনফুসিয়বাদীরা কেবল নৈতিকতা ও ঔদার্য্যে ভরপুর একজন সাধু রাজার পক্ষেই সমাজ সংস্কার করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করত। আইনবিদরা রাজকুমারের নৈতিকতায় আগ্রহী ছিলেন না। ঠিকমতো প্রণয়ন করা গেলে এবং কঠোর দণ্ড ও কঠিন শাস্তি বিধান দিয়ে সমর্থন যোগানো হলে তাদের পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে বলে বিশ্বাস করতেন তাঁরা। 

পদ্ধতির পুরুষরা সম্ভবত সবসময়ই সরকারে তৎপর ছিল। এমনকি আদর্শায়িত সামন্ত যুগেও রাজনীতিতে নিশ্চয়ই এক ধরনের নিপীড়নের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সময় পাল্টে গিয়েছিল। শেষ শতকের সময় বিশাল সমতলে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, আর সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধের কারণে সামন্ত ক্ষুদেরাজ্যগুলোর চেয়ে বিভিন্ন রাজ্য অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। এইসব বিরাট রাজ্য পরিচালনার জন্যে একজন রাজকুমারের রেন ও আচারের চেয়ে বেশি কিছু প্রয়োজন ছিল। সত্যিকার অর্থে কাজ করবে, এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন আইনপন্থীরা। ইতিহাসকে স্বর্ণযুগ থেকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলার মতো অধঃপতন হিসাবে দেখেননি তাঁরা। তাতে কেবল অতীতের জন্যে স্মৃতিকাতরতাই সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে বর্তমানের স্বাভাবিক মূল্যায়নেই মুক্তি নিহিত থাকতে পারে। ওয়েই ও কিনের মতো সফল রাষ্ট্রগুলো ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছিল এবং সে-কারণে অসন্তুষ্ট পরাজিত জাতির উপর তাদের শাসন চাপিয়ে দিতে শাসকের ক্যারিশমার উপর নির্ভরশীল নয় বরং ধনী, দরিদ্র, চীনা বা বর্বর সব প্রজার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে এমন একটি দক্ষ প্রশাসনের প্রয়োজন ছিল। 

আইনপন্থীরা আইনের ক্রিয়াকে মানসম্পন্ন মাপের ব্যবস্থা করা দাড়িপাল্লার দুটি দাড়ের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করতেন। বণিক ও দোকানিরা ক্রেতাদের কাছ থেকে আরও বেশি টাকা আদায় করে নিতে চেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু দাড়িপাল্লা জানিয়ে দিত তারা ঠিক কতটা দাবি করতে পারবে। ‘লোকে পাল্লা বদলাতে চায় না, কারণ তারা জানে সেটা হবে অর্থহীন,’ লিখেছেন চতুর্থ শতাব্দীর একজন লেখক। 

তো একজন সঠিক দৃষ্টিসম্পন্ন শাসক যখন সিংহাসনে অবস্থান করেন, কর্মকর্তারা আইনকে বিকৃত করার কোনও সুযোগই পান না, ম্যাজিস্ট্র্যাটরা পক্ষপাতিত্ব দেখানোর কোনও সুযোগ পান না। লোকের জানা থাকে যে ম্যাজিস্ট্র্যাটদের প্রভাবিত করার চেষ্টা হবে অর্থহীন; দাড়িপাল্লা ঠিক মাপ দেখিয়ে স্থির হয়ে থাকে, অপেক্ষা করে পণ্যের। তো বিশ্বাসঘাতক ও বাজিগররা তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ পায় না।৩

প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ঠিকই স্বয়ংক্রিয় ও নিরপেক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে। আইনপন্থীরা সামন্তবাদের ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সরকারের বদলে বাস্তব আইন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ উত্তোরণের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন সম্ভব করেছিলেন, আধুনিক পশ্চিমের আইনের ধারণার চেয়ে সেটা ভিন্ন ছিল না, তবে প্রাচীন চীনে ব্যক্তিকে রক্ষার জন্যে নয় বরং উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ লাভের লক্ষ্যেই আইন পরিকল্পিত হয়েছিল। ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ ছাড়াই পদ্ধতি ক্রিয়াশীল থাকতে পারবে বলে শাসকের বুদ্ধিবৃত্তিক বা নৈতিক অবস্থান অপ্রাসঙ্গিক ছিল। চুপচাপ বসে থেকে ‘কিছুই না করে’ (উউ ওয়েই) থাকতে পারবেন তিনি-থাকবেন। 

যথেষ্ট বিস্ময়করভাবেই আইনপন্থীরা ‘কিছুই না করা’র গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দানকারী এবং স্বর্গের পথ মানবীয় হস্তক্ষেপের বাইরে থেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করে বলে জোর দেওয়া ঝুয়াংঝির মতো দাওবাদী ব্যক্তিদের সঙ্গে এক ধরনের নৈকট্য বোধ করেছিলেন। আদি আইনপন্থীরা একমত ছিলেন। এভাবে জিক্সিয়া একাডেমিতে মেনসিয়াসের সমসাময়িক শেন দাও একটি সুশৃঙ্খলিত রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে একক ব্যক্তির ইচ্ছা বা অবস্থা দিয়ে প্রভাবিত করা যায় না এমন স্বর্গীয় পথের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পথ-এর কাজে বাধা সৃষ্টি করে বলে সাধুরা যেভাবে উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা (ইউ ওয়েই) থেকে বিরত ছিলেন, ঠিক সেভাবে রাজাকেও অবশ্যই ব্যবস্থার যান্ত্রিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন যে কোনও ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। শেন দাও তাঁর সম্পূর্ণ বাস্তববাদী সরকারের দর্শনের একটি আদর্শ প্রেক্ষিতের খোঁজ করছিলেন, এবং আইনপন্থীদের নিষ্ক্রিয়, তৎপরতাহীন রাজার আদর্শ চীনের গভীরে প্রোথিত ছিল। সামন্ত যুগের আচরিক আইনও বিধান দিয়েছিল যে, রাজকুমারও অবশ্যই ‘কিছুই করবেন না’, বরং পথ-এর জাদুকরী শক্তিকে নিজের মাঝে কাজ করে যেতে দেবেন। 

প্রথম শতাব্দীর গোড়ার দিকে পুরোনো জিন রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ওয়েই, হান ও ঝাও রাজ্যে প্রথম আইনবাদের বিকাশ ঘটেছিল। দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ছিল এগুলো, তো এদের শাসকরা ঐতিহ্যের সঙ্গে কম সম্পর্কিত ছিলেন, এবং সরকারের বিভিন্ন অধিকতর বৈপ্লবিক তত্ত্বের প্রতি উন্মুক্ত ছিলেন। ৩৭০ সালের দিকে শ্যাঙ ইয়াং (সি. ৩৯০–৩৩৮) নামের এক উচ্চাভিলাষী যুবক ওয়েইতে বসতি করে স্থানীয় রাজনীতি বিজ্ঞানীদের আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। এদের কোনও আধ্যাত্মিক কর্মসূচি ছিল না, তাঁরা স্রেফ সামরিক বাহিনীর সংস্কার, বর্ধিত কৃষিজ উৎপাদন, স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ষমতা হ্রাস করে শাসকের শক্তি বৃদ্ধি এবং একটি স্পষ্ট ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ওয়েই-এর রাজার আনুকূল্য পেতে ব্যর্থ হন শ্যাঙ, কিন্তু ৩৬১ সালে কিনের রাজকুমারের প্রধান মন্ত্রকে পরিণত হতে সক্ষম হন তিনি। এক বিরাট সুযোগ ছিল এটা। কিনের বিশাল বর্বর জনগোষ্ঠী ছিল, ঝোউ ঐতিহ্য সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানা ছিল না এদের, অভিজাত গোষ্ঠীও ছিল খুবই দুর্বল; শ্যাঙ-এর বিপ্লবী কর্মসূচির বিরোধিতা করার মতো শক্তি তাদের ছিল না। অ্যাক্সিয়াল যুগের বহু নীতিমালাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা তাঁর সংস্কার পশ্চাদপদ, বিচ্ছিন্ন কিন রাজ্যকে চীনের সবচেয়ে অগ্রসর ও শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেছিল। তৃতীয় শতাব্দীর শেষদিকে শ্যাঙ-এর দুরদর্শী ব্যবস্থার ফলে কিন অন্য সব রাজ্য দখল করে নেবে এবং ২২১ সালে চীনের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাটে পরিণত হবেন এর শাসক। 

অতীতের ঐতিহ্যের প্রতি কোনও আনুগত্য বোধ করেননি জমিদার শ্যাঙ। ‘জনগণের পরিচালক নীতিমালা তাদের অবস্থার সঙ্গে বেমানান হয়ে উঠলে, ‘ যুক্তি দিয়েছেন তিনি, ‘তাদের মূল্যবোধের মান [ফা] অবশ্যই বদলে যাবে। বিশ্বের অবস্থা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন নীতি অনুসৃত হয়।” সাধু রাজাদের সহানুভূতিময় স্বর্ণযুগের স্বপ্ন দেখার কোনও অর্থ নেই। রেন-এর চর্চা করার কারণে নয় বরং কম জনসংখ্যা আর চলার মতো যথেষ্ট খাবার ছিল বলেই অতীতে মানুষ অনেক বেশি উদার ছিল। একইভাবে যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর কালে অসততার পরিণতি হিসাবে বিরোধ ও দুর্নীতি দেখা দেয়নি, সেটা ঘটেছিল সম্পদের ঘাটতির কারণে। অহিংসার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার বদলে জমিদার শ্যাঙ চেয়েছিলেন কিনের জনগণ ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো যুদ্ধ ও রক্তপাতের জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করবে। একটাই উদ্দেশ্য ছিল তাঁর: ‘রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলা।” এইসব লক্ষ্য অর্জনে সরকারগুলোকে অবশ্যই জনগণের ভীতি ও প্রলোভনকে কাজে লাগাতে হবে। খুব অল্প সংখ্যক লোকই আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করতে চায়, কিন্তু পলাতকদের জন্যে শ্যাঙ এমন শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুকেই যেন কাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে। কৃষিজমির বরাদ্দের মাধ্যমে ক্ষেতমজুর ও অভিজাতদের অনন্য সেনা তৎপরতার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। 

জমিদার শ্যাঙ-এর অধীনে থাকার সময় মারাত্মক দক্ষ যুদ্ধ মেশিনে পরিণত হওয়া কিনের দৈনন্দিন জীবনকে তাঁর পদ্ধতিগত যৌক্তিক সংস্কার সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। জোর করে সেনাবাহিনী এবং কর্ভিতে নিয়োগ দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক, গোটা দেশের উপর সেনা জীবনের কঠোর শৃঙ্খলা আরোপ করা হয়েছিল। কৃষি উৎপাদনকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত করা ছিল জমিদার শ্যাঙ-এর সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। সফল ক্ষেতমজুর সৈনিকরা ভূস্বামীতে পরিণত হতো এবং তাদের পদবী ও অবসর ভাতা দেওয়া হতো, অন্যদিকে পুরোনো অভিজাত গোষ্ঠীকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। অভিজাতদের যারা যুদ্ধে ভালো কাজ দেখাতে পারত না তাদের পদাবনতি ঘটানো হতো, সাধারণে পরিণত হতো তারা; যারা শ্যাঙ-এর উচ্চাভিলাষী ভূমি পরিষ্কার করার প্রকল্পে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারত না দাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হতো তাদের। সবাই একই আইনের অধীন ছিল: এমনকি তুচ্ছ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় যুবরাজকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। 

জমিদার শ্যাঙ কেবল রাজকুমারের নৈতিকতার ব্যাপারেই নিরাসক্ত ছিলেন না; রাজা হিসাবে একজন গুণবান সাধু বিপর্যয়কর হয়ে উঠবেন বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। দুর্বৃত্তদের শাসন করার জন্যে ভালো মানুষদের কাজে লাগানো হলে রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে,’ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। ‘ভালো লোকদের শাসন করার জন্যে দুর্বৃত্তদের কাজে লাগানো একটি রাষ্ট্র সবসময় শৃঙ্খলা ভোগ করে ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।” শান্তির বাণী প্রচারকারী কনফুসিয়রা বিপজ্জনক। সবাই লি-র চর্চা করলে তারা এমনই মিতাচারী ও সংযমী হয়ে উঠবে যে একজন রাজকুমার কোনওদিনই কাউকে যুদ্ধে রাজি করাতে পারবেন না। স্বর্ণবিধির সরাসরি বিপক্ষে ছিলেন জমিদার শ্যাঙ। একজন সত্যিকারের কার্যকর রাজকুমার নিজের বাহিনীর বেলায় যেটি হতে দিতে চাইবেন না, প্রতিপক্ষের সৈন্য বাহিনীর উপর ঠিক সেটাই চাপিয়ে দেবেন। ‘যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু যা করতে চাইবে না আপনি সেটা করতে গেলে আপনি হবেন শক্তিশালী,’ কর্মকর্তাদের বলেছেন তিনি। ‘এই উদ্যোগে শত্রু যা করতে গ্লানি বোধ করবে সেটা করলেই আপনারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। 

দারুণ সফল ছিল তাঁর কঠোর সংস্কার। ৩৪০ সালে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়েই-এর উপর বিরাট পরাজয় চাপিয়ে দিয়েছিল কিন, পরিণত হয়েছিল সাম্রাজ্যিক শক্তির অন্যতম প্রতিযোগীতে। জমিদার শ্যাঙ তাঁর সেবার বিনিময়ে উদার জমির অনুদান পুরস্কার হিসাবে পাওয়ার আশা করেছিলেন, কিন্তু তার বদলে পরিণত হয়েছিলেন নতুন নিষ্ঠুরতার শিকার। ৩৩৮ সালে তাঁর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকের মৃত্যুর পর প্রতিদ্বন্দ্বীরা নতুন রাজকুমারের কান ভারি করে তোলে। শ্যাঙকে কিনের জন্যে তাঁরই সংগৃহীত যুদ্ধ রথের সাহায্যে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। কিন্তু আইনপন্থীদের একটি নতুন প্রজন্ম কিনের নজীর অনুসরণ করতে শুরু করেছিল। 

হান ফেই (২৮০-২৩৩) অন্যতম অনন্য আইনপন্থী ছিলেন; কিনের রাজা হুয়াঙ-দি’র মন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। জমিদার শ্যাঙ-এর চেয়ে কম হতাশাবাদী ছিলেন তিনি এবং মানবজাতিকে সাহায্য করার তাঁর এক মহান ব্রত রয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ‘সলিটারি ইনডিগনেশন’ নিবন্ধে নিজেকে তাঁর চোখে অর্থহীন, অবাস্তব ধারণা ফেরি করে বেড়ানো অন্যান্য ভবঘুরে শি-দের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখেছেন তিনি। তাঁকে এবং অন্যান্য আইনপন্থীদের দুর্ভেদ্য নৈতিকতার মানুষ হতে হবে, নিজেদের অবশ্যই নিরবচ্ছন্নভাবে রাজকুমারের সর্বোচ্চ স্বার্থের প্রতি নিবেদিত হতে হবে। হান ফেই জানতেন, কোনও রাজার গুণের সর্বোচ্চ অবতার হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে একটি দক্ষ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষকে কার্যকর শাসকে পরিণত হতে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন তিনি। শাসককে তাঁর পক্ষে কাজ করার জন্যে অবশ্যই সঠিক কর্মকর্তাদের বেছে নিতে হবে এবং তাঁর জনগণের সেবা করার আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত হতে হবে। ‘তিনি শুধু কিসে তাঁর জনগণের উন্নতি হবে সেদিকেই লক্ষ রাখবেন। সুতরাং শাস্তি আরোপ করার সময় জনগণের প্রতি ঘৃণা থেকে নয়, বরং স্রেফ তাদের জন্যে উদ্বেগ থেকে কাজটি করবেন তিনি।১০ প্রয়োজনে বন্ধু ও পরিবারকে শাস্তি এবং শত্রুকে পুরস্কার দিয়ে নিরপেক্ষ ও স্বার্থপরতাহীন হতে হবে তাঁকে। হান ফেইকে উৎসর্গ করা এক কবিতা শাসকের উউ ওয়েই-কে প্রায় অতীন্দ্রিয় তাৎপর্য দেওয়া হয়েছে: 

না জেনে কাজ করে তিনি স্পষ্ট দৃষ্টি ধারণ করেন,
বিনা মূল্যে কাজ করে তিনি ফল পান
বিনা সাহসে কাজ করে তিনি শক্তি অর্জন করেন।১১ 

আইনের শাস্তি ও দমনের কৌশল হওয়ার কথা ছিল না। এটা ছিল রাজা ও প্রজাদের ভিন্নভাবে আচরণে অভ্যস্ত করে তোলার মতো এক ধরনের শিক্ষা। সংস্কার সম্পন্ন হয়ে গেলে শাস্তির আর দরকার থাকবে না। সবাই রাষ্ট্রের সেরা স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু সদিচ্ছা সত্ত্বেও সহিংস পরিণতি লাভ করেছিলেন হান ফেইও; সম্মান হানি করে কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল তাঁকে এবং ২৩৩ সালে মৃত্যুদণ্ড মেনে নেওয়ার বদলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। 

আইনবাদীতে পরিণত হওয়ার আগে তাঁর সময়ের সবচেয়ে সম্মানিত কনফুসিয় দার্শনিকের অধীনে শিক্ষা নিয়েছিলেন হান ফেই এবং সম্ভবত গুরুর কাছ থেকে তাঁর আদর্শবাদের অনেকটাই অর্জন করেছিলেন। আবেগময় কাব্যিক হলেও দারুণ যুক্তিবাদী চিন্তক ছিলেন যুনযি (সি. ৩৪০-২৪৫)। নিজস্ব কনফুসিয় দর্শনে অন্য দার্শনিকদের অন্তর্দৃষ্টি আত্মস্থঃ করতে পেরেছিলেন তিনি, সৃষ্টি করেছিলেন একটি শক্তিশালী সংশ্লেষ।১২ মোহিস্ট, ইয়াংবাদী ও আইনপন্থীদের ভ্রান্ত মনে করেননি তিনি; কেবল এক জটিল তর্কের একটি দিকই তুলে ধরেছেন তাঁরা; তাদের সবার কাছ থেকেই কিছু শেখার সম্ভাবনা রয়েছে। দাওবাদী ধারণায়ও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যুনযি। অ্যাক্সিয়াল যুগ চীনের অন্য যেকোনও গ্রন্থের চেয়ে ঢের বেশি অকাট্য ও সুবিন্যস্তভাবে যুক্তি উত্থাপন করেছে তাঁর গ্রন্থটি, কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁর গদ্য অনায়াসে কবিতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং যুক্তি পরিণত হয়েছে অতীন্দ্রিয় দর্শনে। 

নৈতিক মানের অবনতির কারণ হয়েছে মনে করে নতুন বাস্তববাদীতায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন যুনযি। যেখানে গেছেন সেখানেই ‘ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত’ এবং সম্পদ, ক্ষমতা ও বিলাসিতার স্বার্থপর অন্বেষা লক্ষ করেছেন তিনি।১৩ রাজকুমাররা নিজেদের লি দিয়ে সংযত থাকতে দিতে রাজি না হওয়ার কারণেই নিষ্ঠুরভাবে নিজস্ব লক্ষ্য অনুসরণ করেছেন এবং সহিংসতা ও যুদ্ধ বিগ্রহ মহামারীতে পরিণত হয়েছে। আইনপন্থীদের বাস্তববাদ মেনে নেননি যুনযি; তখনও একজন সহানুভূতিময় রাজাই শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারার মতো একমাত্র ব্যক্তি বলে বিশ্বাস করছিলেন। এমনকি ঐতিহ্যবাহী কনফুসিয় নীতিমালা থেকে বিচ্যুত হলেও স্বস্তি নিয়ে আসবে এমন যেকোনও ব্যবস্থাকেই বিবেচনায় নিতে তৈরি ছিলেন। অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন যুনযি; সরকারী পদের আকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তবে কনফুসিয়াস ও মেনসিয়াস থেকে খুব বেশি সফল হতে পারেননি। তিনবার জিক্সিয়া একাডেমির প্রধান হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু স্বৈরাচরী রাজা মিন পণ্ডিতদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করলে কি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২৫৫ সালে চু-তে চলে আসেন তিনি; এখানে প্রধান মন্ত্রী ম্যাজিস্ট্র্যাট নিয়োগ দেন তাঁকে, কিন্তু ২৩৮ সালে আততায়ীর হাতে পৃষ্ঠপোষক নিহত হলে পদ খোয়ান। দুঃখজনকভাবে প্রকাশ্য জীবন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন যুনযি, নিজের রচনাসঙ্কলনের সম্পাদনা করেন। 

এইসব রচনার একটিতে কিন সফরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আইনপন্থীদের ধারণা তাঁর নিজস্ব ধারণা থেকে খুব বেশি দূরবর্তী না হওয়ার কথা থাকলেও যুনযি যা দেখেছেন তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কর্মকর্তারা দক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করছিল, দুর্নীতি বলে কিছু ছিল না, প্ৰশাসনে কোনও অন্তর্কলহের অস্তিত্ব ছিল না আর সাধারণ মানুষ ছিল সরল, দুর্নীতিমুক্ত! সরকারকে হয়তো ভয় পেত তারা, কিন্তু মানতও; আর নতুন আইনের স্থিতিশীলতা ও নিরপেক্ষতার তারিফ করত। অবশ্য, কিন নিখুঁত ছিল না, যুনযি বুঝতে পেরেছিলেন যে, উন্নত সভ্যতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনও ধারণা না থাকার কারণেই কেবল সংস্কার সম্ভব হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, কঠোর শাস্তি বিধান হয়তো প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু এও লক্ষ করেছিলেন যে, কিন একটা সমস্যাপূর্ণ দেশ; এখানকার লোকজন সারাক্ষণ ‘গোটা পৃথিবী একে ধ্বংস করার জন্যে একাট্টা’১৫ হওয়ার কথা ভেবে ভয়ে তটস্থ থাকত। এর কঠোর শাসন ব্যবস্থা অন্যান্য রাজ্যের প্রজাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে বলে কিন কোনওদিনই গোটা চীনকে শাসন করতে পারবে না; কেবল একজন পরিপক্ক ও মানবিক শাসক জুনযির নির্দেশনা মেনে চললেই এর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে। যুনযি একাধারে সঠিক ও ভুল ছিলেন। কিন অন্য রাজ্যের উপর পরাজয় চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, সক্ষম হয়েছে সাম্রাজ্য সৃষ্টিতে, কিন্তু এর সরকার পরিচালনার নিষ্ঠুর কায়দা রাজবংশের পতন ডেকে এনেছে, মাত্র চৌদ্দ বছর পরে এর পতন ঘটেছিল। 

তাসত্ত্বেও কিন ছিল কনফুসিয়দের প্রতি চ্যালেঞ্জ বিশেষ। রাজা ঝাও-এর সঙ্গে এক সাক্ষাতের সময় যুনযি তাঁকে কিন প্রশাসনে আচারবিদের অস্তিত্ব নেই দেখে দুঃখ পাওয়ার কথা বলেছিলেন। রাজা সোজাসাপ্টা জবাব দিয়েছিলেন: ‘কনফুসিয়দের [রু রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনও কাজ নেই।” তাদের দুঃখজনক অতীত কর্মকাণ্ডের ফলে যুনযির পক্ষে তর্ক করার উপায় ছিল না। এমনকি উচ্চাভিলাষী তরুণ শিষ্য লি সি-র প্রশ্নেরও কোনও জবাব ছিল না তাঁর কাছে। একজন জুনযি ক্ষমতায় এলে তাঁর নৈতিকতা (ইই) এবং ঔদার্য (রেন) ভালোর পক্ষে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হয়ে ওঠায় শান্তি ফিরে আসবে বলে ধারণা দিয়েছিলেন যুনযি। চমৎকার কনফুসিয় দর্শন ছিল এটা। সাধু রাজাদের মতো রাজকুমারের সহানুভূতি তাঁর কাছ থেকে উৎসারিত হবে, ব্যাখ্যা করেছেন যুনযি; তিনি যেখানে যাবেন, অনায়াসে তাঁরা প্রতিবেশ বদলে দেবেন। এমন একজন রাজকুমার কোনওদিনই একান্ত ব্যক্তিগত উচ্চাশা পূরণের লক্ষ্যে অন্য একটি রাজ্যে হামলা চালাবেন না। 

লুটের মালের জন্যে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্যে নয়, সহিংসতা দূর করতে এবং সবরকম ক্ষতি দূর করার জন্যে অস্ত্র তুলে নেন তিনি। সুতরাং এই উদার মানুষের সৈনিকরা যখন শিবির ফেলে তারা দেবতার মতো সম্মান দাবি করে; এবং তারা যে পথ দিয়ে যায়, সেখানকার মানুষজনকে বদলে দেয়। এরা মৌসুমের বৃষ্টির মতো, যার ধারায় লোকে আনন্দে মেতে ওঠে। 

‘স্বপ্ন দেখে যান!’ বলে উঠেছিলেন লি সি। কিভাবে চার প্রজন্ম ধরে বিজয়ী হয়ে থাকা কিনের সাফল্যের ব্যাখ্যা দেবেন যুনযি? ‘এর সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী, এর কর্তৃত্ব অন্য সামন্তবাদী জমিদারদের টলিয়ে দেয়। রেন আর ইই দিয়ে নয় বরং প্রতিপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এটা করেছে-ব্যস।১৭ এর খুব বেশি দিন পরে নয়, লি সি যুনযিকে ত্যাগ করে আইনবাদে দীক্ষা নেন এবং কিনে অভিবাসন করে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীতে পরিণত হন, ২২১ সালে কিনের চূড়ান্ত বিজয় এনে দেওয়া ঝটিকা অভিযানে নেতৃত্ব দেন। 

২৬০ সালে যুনযির সফরের অল্প কয়েক বছর পর কিনের সেনাবাহিনী যুনযির দেশ ঝাও দখল করে নেয়। রাজকুমার আত্মসমর্পণ করলেও কিন বাহিনী চার লক্ষ ঝাও সৈন্যকে হত্যা করে। একজন জুনযি যেখানে প্রশাসনে একটি সামান্য পদও ধরে রাখতে পারলেন না, সেখানে তিনি কিভাবে এমন নিষ্ঠুর শাসকের বিরুদ্ধে কোনও প্রভাব রাখতে পারবেন? কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক রাজ্য আইনপন্থীদের ব্যবস্থা গ্রহণ করে, কিন্তু যুনযি কোনওদিনই বিশ্বাস হারাননি। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আচারের ‘নমনীয় চেতনা’ আর রেন-এর সহানুভূতির নীতি চীনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে বলে বিশ্বাস করে গেছেন, যদিও এই কঠিন সময়ে হয়তো কঠিন শাস্তি এবং পুরস্কার দিয়ে এদের সমর্থন যোগানোর প্রয়োজনের কথা স্বীকার করেছেন। সন্ন্যাস্ত্রত কঠিন আদর্শ ছিল না। নিজেকে পরিবর্তনের আবেগময় ও অঙ্গীকারাবদ্ধ প্রয়াস পেলে রাস্তার যেকোনও লোকও ইয়াও-এর মতো হয়ে বিশ্বকে বাঁচাতে পারে। 

গোটা যুনযি জুড়ে আমরা ইউ ওয়েই-এর জন্যে অবিরাম আবেদন, শৃঙ্খলিত, সচেতন প্রয়াস দেখতে পাই। কিন সফর থেকে যুনযি জানতে পেরেছিলেন যে, জোর চেষ্টা চালালে মানবজাতি তাদের চারপাশের সমাজকে পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু তাদের অবশ্যই নিজেদের হাতে দায়িত্ব তুলে নিতে হবে। স্বর্গ জাগতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপকারী কোনও দেবতা নয়। সাহায্যের জন্যে স্বর্গের উপর নির্ভর করে থেকে কোনও লাভ হবে না। কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী বিচার করে স্বর্গকে নত করার চেষ্টা করেও লাভ নেই। এসব প্রাচীন উদ্দেশ্যমূলক কুসংস্কারকে ঘৃণা করতেন যুনযি। স্বর্গ হচ্ছে খোদ প্রকৃতি; স্বর্গীয় বস্তুর শৃঙ্খলা আর বিভিন্ন ঋতুর আবর্তনে স্বর্গের পথ লক্ষ করা যেতে পারে। স্বর্গের পথ মানুষের রীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা তাদের কোনওরকম নির্দেশনা বা সাহায্য করতে পারবে না। তবে তাদের নিজেদের পথ তৈরির জন্যে এটা বিভিন্ন সম্পদকে প্রাপ্য করে তুলেছে। এটাই ছিল জুনযির ব্রত। মানবীয় ব্যাপারস্যাপারকে অবজ্ঞা করে ঝুয়াংঝির মতো স্বর্গের পথ-এর ধ্যান করা অর্থহীন। সমাজ থেকে প্রত্যাহার হওয়া ভুল। সভ্যতা মানবজাতিকে স্বর্গীয় মর্যাদা দেওয়া এক অসাধারণ সাফল্য; এটা তাদের স্বর্গ ও মর্ত্যের সমান অংশীদারে পরিণত করেছে। ‘কোনটা ভালো, স্বর্গের নির্দেশ পালন আর তার উদ্দেশে শ্লোক গাওয়া?’ প্রশ্ন করেছেন যুনযি। ‘নাকি স্বর্গের নির্দেশনা উপলব্ধি করে তাকে কাজে লাগানো?’ দাওবাদীদের মতো স্বর্গের আকাঙ্ক্ষা করা ভালো নাকি স্বর্গের যোগানো সম্পদ ব্যবহার করা এবং ‘তাদের সম্পূর্ণতা দেওয়া’ ভালো?’১৮ কেবল স্বর্গের দিকে মনোযোগ দিয়ে মানুষের যা সাধ্যে আছে তাকে অবহেলা করলে, বারবার জোর দিয়েছেন যুনযি, ‘জগতের প্রকৃতি অনুধাবনে আমরা ব্যর্থ হবো। ১৯ 

কিন্তু এজন্যে কঠোর, নিবেদিতপ্রাণ প্রয়াস প্রয়োজন। যুনযি আইনপন্থীদের কাছে শিখেছিলেন, মানুষকে সংস্কার করতে হয়। মেনসিয়াসের বিপরীতে মানবীয় প্রকৃতি ভালো নয়, বরং একে অশুভ বলেই বিশ্বাস করতেন তিনি। প্রত্যেকেই, বলেছেন তিনি, ‘ঘৃণা আর ঈর্ষার বোধ নিয়ে জন্ম নেয়, এসবকে প্রশ্রয় দিলে তাকে সহিংসতা ও অপরাধের দিকে টেনে নিয়ে যাবে, আনুগত্য আর শুভবিশ্বাসের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে যাবে। ২০ আইনপন্থীদের মতো একই চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তিনি: ‘একটি বাঁকানো কাঠের টুকরোকে আবার সোজা হয়ে ওঠার আগে অবশ্যই সোজা করার বোর্ডের পাশে স্থাপন করতে হবে, ভার দিয়ে আবার ওটাকে সোজা করতে হবে।২১ তবে যথেষ্ট কঠোর পরিশ্রম করলে যেকেউই সাধূ হতে পারে। একা সেটা অর্জন করতে পারবে না সে। প্রথমে একজন গুরু খুঁজে নিজেকে আচারের (লি) কাছে সমর্পণ করতে হবে: কেবল তখনই সৌজন্য ও বিনয়ের নির্দেশনা মানতে পারবে, সমাজের নিয়মকানুন পালন করবে এবং শৃঙ্খলা অর্জন করবে।২২ ইয়াংবাদী ও দাওবাদীদের মতো স্বাভাবিকভাবে যা আসে সেটাই করা উচিত নয়। ভালোত্ব ছিল সচেতন প্রয়াসের ফল। জুনযি নিজের আবেগকে গঠনমূলক পথে চালিত করার জন্যে দক্ষতার ব্যবহার করে। এটা মানব প্রকৃতিকে বিকৃত করবে না, বরং এর পূর্ণ সম্ভাবনাকে বের করে আনবে। 

বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তির ক্ষমতা খাটালে একটি নৈতিক সমাজ গড়ে তোলাই যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারবে বলে নিশ্চিত ছিলেন যুনযি। শিক্ষা যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ। আইনপন্থীদের বই থেকে একটি পাতা তুলে নিয়ে কম বুদ্ধিমত্তার মালিকরা এটা বুঝতে পারবে না এবং আইন ও শাস্তির একটি বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে নেতিক শিক্ষার একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে তাদের বাধ্য করার বিষয়টি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু অধিকতর প্রাজ্ঞ লোকেরা স্বেচ্ছায়ই অতীতের প্রজ্ঞা নিয়ে গবেষণার ভেতর দিয়ে নিজেদের বদলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। ইয়াও শান ও ইউ জগৎ নিয়ে ধ্যান করে কেবল তাদের নিজেদের সত্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে সূচিত হওয়া সম্ভব একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াসের ভেতর দিয়ে তাদের পক্ষে চারপাশে প্রত্যক্ষ করা অসহনীয় ভোগান্তির অবসান ঘটানো সম্ভব বলে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সমীহ, সৌজন্য আর ‘নমনীয়তা’ (রাং) আচার সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। অভ্যন্তরীণ শান্তি অর্জন সম্ভব করতে এগুলো তাঁদের উচ্ছৃঙ্খল আবেগকে সংযত করেছে। নিজেদের মনের ভেতর নজর ফিরিয়ে সমালোচকের চোখে নিজেদের আচার-আচরণ এবং জীবনের ব্যথা বেদনার প্রতি নিজেদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে সামাজিক সম্পর্ককে বিন্যাসের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন সাধুরা। ২৩ এভাবে লি শু-র নীতির- ‘কাউকে পছন্দ করা’—উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। শাসক যখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন তখনই সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজের জন্যে শাস্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেন। 

সাধুরা তাদের প্রজাদের উপর কতগুলো অচেনা নিয়মকানুনের বোঝা চাপিয়ে দেননি, সুতরাং, মানবজাতি সম্পর্কে তাদের বিশ্লেষণ থেকে লি অনুপ্রাণিত ছিল। একজন চিত্রশিল্পী যেভাবে সম্ভাবনাহীন উপাদান থেকে আকার ও সৌন্দর্য বের করে আনেন সেভাবে আচার আবেগকে মানবিক করেছে: এগুলো ‘যেটা বেশি দীর্ঘ সেটাকে ছেঁটে দেয়, আর বেশি ছোটটিকে প্রসারিত করে, বাড়তিটুকু বাদ দেয় এবং ত্রুটি দূর করে, ভালোবাসা আর সমীহের অনভূতি প্রসারিত করে একটু একটু করে সঠিক আচরণের ভেতর দিয়ে সৌন্দর্যের পূর্ণতা দেয়।২৪ এক ধরনের প্রাকৃতিক বিধান ছিল লি। খোদ মহাবিশ্বকেই সম্ভাবনাময় বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা নিয়ে আসা নিয়ম মেনে চলতে হয়েছে। এমনকি স্বৰ্গীয় বিভিন্ন বস্তু ও চারটি ঋতুকেও পরস্পরের উপর আগ্রাসীভাবে আক্রমণ হানার বদলে ‘পরাস্ত’ হতে হয়েছে। ‘স্বর্গ ও মর্ত্য লি-র কারণে সামঞ্জস্য পেয়েছে, সূর্য ও চাঁদ এ থেকে আলোকিত হয়েছে; চার ঋতু বিন্যাস লাভ করেছে; তারামণ্ডলী আর গ্রহনক্ষত্র এ দিয়েই চলমান,’ যুক্তি দিয়েছেন যুনযি। তাই যদি না হতো, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো। মহাবিশ্বে সকল বস্তু যার যার সঠিক স্থান ধারণ করবে বলে দাবি করা সেই একই লি মানবীয় আবেগকে পরিশুদ্ধ করবে।২৫ অপ্রাকৃত তো নয়ই বরং লি-ই মানুষকে বাস্তবতার প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে যাবে। ‘আচারের অর্থ আসলেই গভীর, আবেগের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করেছেন যুনযি। ‘ব্যবস্থা-সৃষ্টিকারীর অমার্জিত এবং অর্থহীন তত্ত্ব নিয়ে এর মাঝে প্ৰবেশ প্ৰয়াসী সেখানে ধ্বংস হয়ে যাবে। ২৬ 

স্বর্গের বদলে মর্ত্যের দিকে মনোযোগ দিলেও সেক্যুলার মানবতাবাদী ছিলেন না যুনযি। সকল চীনার মতো প্রকৃতিকে ‘দেবতার মতো’ (শেন) সম্মান করতেন। অতীন্দ্রিয়বাদী নীরবতার উপর করে ভিত্তি করে তাঁর ধর্মীয় যুক্তিবাদ সৃষ্ট। তিনি তাঁর ভাষায় ‘বিকার’–একক মতবাদগত অবস্থানের উপর আহমবাদী জোর প্রদান-এর নিন্দা করেছেন। কারও সমাজ সংস্কারের কাজে হাত দেওয়ার আগে তাকে অবশ্যই পথ উপলব্ধি করতে হবে, নিজের মতই ঠিক আর বাকি সবাই ভুল বলে জোর করে সেটা করতে পারবে না। কেবল ‘শূন্য, একীভূত ও অটল’ হৃদয়ের পক্ষেই পথ উপলব্ধি করা সম্ভব। যুনযি এখানে ঝুয়াংঝির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। নিজের মতামত আঁকড়ে না থেকে নতুন নতুন অনুভূতির প্রতি উন্মুক্ত থাকলে মন ‘শূন্য’ হবে; জীবনের জটিলতাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ আত্মসেবী ব্যবস্থায় বাধ্য না করলে এটা ‘একীভূত’ থাকবে; সত্যিকারের উপলব্ধিকে বাধাগ্রস্ত করা ‘স্বপ্ন আর শোরগোলময় কল্পনায়’ আর পরিপক্ক উচ্চাভিলাসী ‘পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে’ মগ্ন না হলে ‘অটল’ থাকবে।২৭ ‘শূন্যতা, ঐক্য, আর অটলতা’ ব্যাখ্যা করেছেন যুনযি, ‘এগুলো মহান ও খাঁটি আলোকনের গুণ।’ 

অহমবাদী বিকার থেকে মুক্ত একজন সাধারণ মানুষ সাধুর ছবির মতো দিব্যদর্শন লাভ করতে পারে। একটি সংকীর্ণ স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে থাকার বদলে সরকারের গভীরতম নীতিমালার স্বজ্ঞাপ্রসূত উপলব্ধি অর্জন করেছে সে। 

সে এমন আলোকনের অধিকারী নিজের ঘরে বসেই চার সাগরের সমস্ত এলাকা দেখতে পারে, বর্তমানে অবস্থান করেই প্রাচীন কাল নিয়ে আলোচনা করতে পারে। সকল সত্তার প্রকৃতি বোঝার, শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা যুগ যাচাই করে এবং সেগুলোর পেছনের নীতি অনুভব করে সেগুলোর ব্যাপারে তার তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি ও উপলব্ধি রয়েছে। সকল স্বর্গ ও মর্ত্য জরিপ করে সে, সকল সত্তাকে পরিচালনা করে এবং মহান নীতিমালা ও মহাবিশ্বে যা কিছু আছে তার উপর প্রভুত্ব করে। 

তার বুদ্ধিমত্তা ‘দেবসুলভে’ (শেন) পরিণত হয়েছে। আইনপন্থীরা যথেষ্ট উচ্চভিলাষী ছিলেন না। একজন সংস্কৃত ব্যক্তি আর্থনৈতিক বা সামরিক যন্ত্রে স্রেফ একটি যন্ত্রাংশ মাত্র নন। ‘প্রসারিত ও বিশাল-এমন একজন মানুষের সীমা জানা আছে কার? ছায়াময় চিরপরিবর্তনশীল-তার রূপ জানে কে? কেবল সূর্য আর চাঁদের সঙ্গেই তার ঔজ্জ্বল্য মানানসই; তার মাহাত্ম্য অষ্টদিগন্ত পূর্ণ করে রাখে। মহৎ ব্যক্তি এমন। ২৯ এভাবে যে ব্যক্তি তার মনুষত্বের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণ করেছে সে জগৎ-কে রক্ষা করতে পারে। 

যুনযির রাজনৈতিক ধারণাকে খুব বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি কেউ, তবে তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি সবাই রাষ্ট্রপরিচালনার অন্য একটি অতীন্দ্রিয়বাদী সারগ্রন্থ নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছেল, চট করে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল সেটা। বিশেষ করে আইনবাদীরা এই নতুন টেক্সটের প্রতি উষ্ণ আকর্ষণ বোধ করেছেন। আদিতে একান্ত ব্যক্তির জন্যে নয় বরং ছোট রাজ্যের শাসকের জন্যে রচিত হলেও দাওদেজিং (ক্লাসিক অভ দ্য ওয়ে অ্যান্ড ইটস পোটেন্সি) পশ্চিমে জনপ্রিয় ভক্তিমূলক ক্লাসিকে পরিণত হয়েছে। ছদ্মনাম লাওযি-’প্রবীণ গুরু’-নামে লেখা এর রচয়িতা সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষেই খুব কম জানি আমরা। তাঁর সম্পর্কে নানা গল্প চালু আছে, কোনওটারই তেমন একটা ঐতিহাসিক বৈধতা নেই, এবং এই লেখক, নামহীনতা ও পরার্থপরতা যার থিম, আমাদের কাছে অধরা রয়ে গেছেন, যেমনটা হয়তো বা চেয়েছিলেন তিনি। 

ছোট ছোট একাশিটি হেঁয়ালিময় পঙক্তিতে রচিত অধ্যায়ের সমাবেশ দাওদেজিং। লাওযি আইনপন্থীদের চেয়ে ঢের বেশি আধাত্মিক হলেও তাদের মাঝে একটা নৈকট্য ছিল, আইনপন্থীরা সেটা চট করে ধরতে পেরেছিলেন। উভয়ই কনফুসিয়দের ঘৃণা করতেন; বিশ্বজগৎ সম্পর্কে উভয়েরই আপাতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যেখানে কেবল বিপরীত বিষয়ের পিছু নিয়েই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব; এবং উভয়ই শাসকের ‘কিছুই না করা’ এবং রাষ্ট্রের জীবনে যত কম সম্ভব হস্তক্ষেপ করা উচিত বলে বিশ্বাস করতেন। আইনপন্থীদের বিপরীতে লাওযি চেয়েছিলেন তাঁর রাজা হবেন গুণবান, তবে নিজের জাতির জন্যে অন্তহীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করে যাওয়া কনফুসিয় সাধুর মতো নয়। তার বদলে উউ ওয়েই-এর আত্মবিলোপ ও সামগ্রিক নিরপেক্ষতার চর্চাকারী একজন রাজকুমার যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর কালের সমাপ্তি ঘটাবেন। বলা হয়ে থাকে যে, প্রাচীন রাজারা কতগুলো বাহ্যিক আচার পালনের ভেতর দিয়ে স্বৰ্গীয় পথ প্রতিষ্ঠা করা জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে শাসন করেছেন। এইসব প্রাচীন আচারকে লাওযি আত্মস্থঃ করেছেন এবং রাজকুমারদের পথ-এর সঙ্গে একটি অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিক সমরূপতা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন। 

কিনের হাতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে থাকা ক্ষুদে রাজ্যগুলোর পক্ষে ভীতিকর কাল ছিল এটা। দাওদেজিং-এর ভেতর সহসা বিনাশের ভীতি আক্রম্য রাজকুমারদের বেঁচে থাকার জন্যে এক ধরনের রণকৌশলের যোগান দেওয়া লাইটমোটিফের মতো বয়ে গেছে। আগ্রাসী ভাব না করে তাঁকে অবশ্যই পিছু হটতে হবে এবং নিজেকে ক্ষুদ্র করতে হবে। ষড়যন্ত্র আর কুমন্ত্রণার বদলে অবশ্যই চিন্তাভাবনা বিসর্জন দিয়ে মনকে শান্ত করতে হবে, দেহ শিথিল করে নিজেকে জগতের দিকে তাকানোর প্রচলিত রীতি থেকে মুক্ত করতে হবে। উউ ওয়েই-এর চর্চার ভেতর দিয়ে সমস্যাকে নিজে থেকেই সামাধান হতে দিতে হবে।১ তবে কেবল অটলতা আর শূন্যতায় প্রোথিত নিজের হৃদয়কে সংস্কার করলে এটা অর্জন করা সম্ভব হবে। একারণেই লাওযি প্রাচীন রাজাদের মতো রাজকুমারের অন্তস্থঃ জীবনকে পাল্টে দিয়ে বিশ্বকে নতুন করে পূর্ণ করে তুলে পুনঃস্থাপনে সক্ষম করে তোলার অতীন্দ্রিয় অনুশীলনের পেছনে তাঁর গ্রন্থের তিরিশটি অধ্যায় ব্যয় করেছেন। 

একেবারে শুরুর অধ্যায়টি লাওযির পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। সাধু শাসককে অবশ্যই সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে চিন্তা করা শিখতে হবে। সাধারণ যৌক্তিক ভাবনা হবে অর্থহীন: তাঁকে ভাষা ও ধারণার অতীতে অবস্থান করা এক মাত্রায় প্রবেশ করতে হয়েছে বলে মতবাদ, তত্ত্ব এবং ব্যবস্থা কেবল তাঁর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। একারণে লাওযি শুরু করেছেন: 

যে পথের কথা বলা যেতে পারে সেটা স্থির পথ নয়; যে নাম উচ্চারণ করা যেতে পারে সেটা স্থির নাম নয়। নামহীনতাই স্বর্গ ও পৃথিবীর সূচনা। 

এই জগতের সবকিছুরই নাম আছে, কিন্তু জাগতিকতার অতীত ও আমাদের উপলব্ধি করার মতো যেকোনও কিছুর চেয়ে আরও মৌলিক কিছুর কথা বলছেন লাওযি: সুতরাং এটা নামহীন ও অদৃশ্য। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এই গুপ্ত মাত্ৰা সম্পর্কে অজ্ঞ। কেবল আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে চিরকালের জন্যে বিচ্ছিন্নকারী ব্যক্তিই একে দেখতে পারে। যে লোক নিজের মন ও হৃদয় থেকে কোনওদিন আকাঙ্ক্ষা দূর করেনি, কেবল নামহীন বাস্তবতার দৃশ্যমান, ঘটনাবহুল বিশ্ব-প্রকাশই দেখতে পাবে সে। অবশ্য অদৃশ্য ও দৃশ্যমান দুটিই সকল বস্তুর গোপন সুর, সত্তার রহস্যের উপর রহস্যময় আরও গভীরতর স্তরে প্রোথিত। একে কি বলতে পারি আমরা? হয়তো, উপসংহার টেনেছেন লাওযি, এর গভীর অস্পষ্টতার কথা মনে করিয়ে দিতে একে আমাদের অন্ধকার বলা উচিত: ‘অগনন গোপন বিষয়ের তোরণ!৩২ 

পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতোই বাস্তবতার আরও গভীর স্তর উন্মোচিত করেছেন লাওযি। অন্বেষণ শুরুর আগে সাধু শাসককে ভাষার অপর্যাপ্ততা উপলব্ধি করতে হয়েছে; ঠিক যেভাবে অদৃশ্যের ঝলক দেখেছেন বলে ভেবেছেন তিনি, আরও গভীর রহস্য সম্পর্কে সজাগ করে তোলা হয়েছে তাঁকে। এরপর এই জ্ঞান গোপন তথ্য জানার বিষয় নয় বলে তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে; এখানে মহান অ্যাক্সিয়াল সাধুদের গুরুত্ব আরোপ করা কোনোসিসের দাবি রয়েছে। সারাক্ষণ ‘আমি চাই!’ বলে শোরগোল করে চলা ‘আকাঙ্ক্ষাকে’ বিসর্জন দিতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি এটা উপলব্ধি করলেও কেবল চূড়ান্ত রহস্যের ‘তোরণে’ই রয়ে গেছেন তিনি। দৃষ্টির কেন্দ্রে পথ-কে স্থাপন করতে গিয়ে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রবহমানতার উপর জোর দিয়েছেন লাওযি; লক্ষ্য ছিল গোপন এবং দুর্ভেদ্য, এবং পথ-এর সবসময়ই ক্রমাগত আমাদের আরও সামনে যাওয়ার তাগিদ দেওয়া আবার যুগপৎ দূরে মিলিয়ে যাওয়া নতুন নতুন বাঁক বা মোড় ছিল : 

স্বর্গ মর্ত্যের আগে জন্মানো
বিভ্রান্তিকরভাবে রূপ নেওয়া নীরব ও শূন্য
একটি বস্তু আছে,
একা দাঁড়িয়ে থাকে, বদলায় না,
ঘুরে বেড়ায় কিন্তু ক্লান্ত হয় না।
এটা বিশ্বজগতের মাতা হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
আমি এর নাম জানি না
তাই আমি একে বলি ‘পথ’।
একে আমি বানোয়াট নাম দিয়েছি ‘মহান’।
মহান বলেই একে মিলিয়ে যাওয়া বলেও বর্ণনা করা হয়। ৩৩

এই অধরা, অপসৃয়মান ‘জিনিস’টির নাম দেওয়ার বেলায় লাওযির নিরাসক্তি ছিল, যাকে কেবল একটি ‘বানোয়াট’ নামই দিতে পারেন তিনি। আমরা এই ‘বস্তু’টি সম্পর্কে কথা বলতে পারি না, তবে নিজেদের এর আদলে গড়ে তুলতে পারলে এটা-কোনওভাবে-আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। 

লাওযির শব্দ বর্জন করা কবিতা যৌক্তিক কোনও অর্থ বহন করে না। ইচ্ছা করেই পাঠকদের আপাতবিরোধিতা দিয়ে বিভ্রান্ত করে দ্বিধায় ফেলে দেন তিনি। সূক্ষ্ম সত্তাকে নামহীন বলেছেন তিনি, কিন্তু তারপরেও কয়েক ছত্র পরেই বলছেন ‘নামধারী’ ও ‘নামহীন’ একই উৎস থেকে এসেছে। সাধু শাসকের এইসব স্ববিরোধিতাকে হৃদয়ে ধারণ করে সাধারণ চিন্তা প্রক্রিয়ার অপর্যাপ্ততা সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠার কথা ছিল। লাওযির অধ্যায়গুলো আঁচ-অনুমান নয় বরং ধ্যনের বিন্দু ছিল। তিনি কেবল উপসংহার লিপিবদ্ধ করেছেন, এইসব অন্তর্দৃষ্টির দিকে চালিতকারী পর্যায়গুলো উল্লেখ করেননি, কারণ সাধু শাসককেই পথ ধরে প্রকাশ্য থেকে অদৃশ্যের দিকে ভ্রমণ করতে হবে এবং সবশেষে অন্ধকার থেকেও অন্ধকারে এগিয়ে যেতে হবে। পথ সম্পর্কে অন্য লোকদের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে অন্য কারও কাছ থেকে এইসব অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারবেন না তিনি। চীনাদের বাইরের জগৎ-কে রুদ্ধ করে চিন্তার চালু পদ্ধতিকে বন্ধ করতে শেখানো নিজস্ব ধরনের যোগ ব্যবস্থা (যুও-ওয়াঙ) ছিল। ঝুয়াংঝি একে ভুলে যাওয়া’, জ্ঞানের বিসর্জন বলেছিলেন। লাওযি কদাচিৎ এইসব যোগ সাধনার কথা উল্লেখ করেছেন”, কিন্তু বিস্তারিত বর্ণনা দেননি; অবশ্য তাঁর বর্ণিত অতীন্দ্রিয় প্রক্রিয়ায় এগুলো অবিশ্যিক ছিল। পাঠক কেবল যাত্রা করেই তাঁর সিদ্ধান্তগুলোকে মূল্যায়ন করতে পারত। 

সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলে লাওযি প্রায়শঃই অদৃশ্য বাস্তবতাকে ‘শূন্যতা’ বলতেন, শূন্যতা বোঝানো কোনও নাম যাকে ব্যস্ত উই ওয়েই মন ভয় পায়। আমাদের প্রকৃতি শূন্যতাকে ভয় পায়, জীবন দিয়ে পরিপূর্ণ বলে মনে হয় কিন্তু আমাদের কোথাও নিয়ে যায় না আমরা এমন বিভিন্ন ধারণা, শব্দ আর ভাবনা দিয়ে নিজেদের মনকে ভরে রাখি। নতুন জীবন নিয়ে আসে বলে দাওদেজিঙ-এ অবশ্য শূন্যতাকে আবার সকল সত্তার জঠরও বলা হয়েছে।” লাওযির শূন্যতা, উপত্যকা আর গহ্বরের ছবি অস্তিত্ব নেই, এমন কিছুর কথা বলে। একবার অহম হারিয়ে যাওয়ার পর সত্তার বর্ণনার অতীত রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করা ছাড়াও এগুলো উউ ওয়েই মনের কেনোসিসের দিকে ইঙ্গিত করে। সাধু শাসকের ভেতর অস্তিত্বের এক ধরনের শূন্যতা থাকতেই হবে। লাওযির মতে ধ্যানের ঘোরে জীবনে মেকি কৌশল যোগ করা সভ্যতায় আক্রান্ত হওয়ার আগে মানুষের উপভোগ করা প্রকৃত মানবসত্তায় প্রত্যাবর্তন ‘শূন্যতাকে’ অনুভব করতে পারবেন তিনি। প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ করে মানবজাতি তার পথ হারিয়ে ফেলেছে। 

অন্য প্রাণীরা যেখানে তাদের জন্যে পরিকল্পিত পথ রক্ষা করেছে, মানুষ অবিরাম ব্যস্ত ইউ ওয়েই ভাবনা দিয়ে নিজেদের দাও থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে: অস্তিত্বহীন পার্থক্য সৃষ্টি করেছে, কর্মতৎপরতার গম্ভীর নীতি গঠন করেছে যা আসলে স্রেফ অহমবাদী অভিক্ষেপ। এব্যাপারে ঝুয়াংঝির সঙ্গে একমত হয়েছেন লাওযি। সাধু এইসব মানসিক স্বভাব একপাশে ঠেলে ফেলতে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তোলার সময় মূল স্বভাবে ফিরে যেতে পারেন, ফিরে আসতে পারেন সঠিক পথে। 

শূন্যতাকে অর্জন করতে সাধ্যমতো করি আমি;
অটলতাকে শক্ত করে আঁকড়ে থাকি।
নানা রকম প্রাণী একসঙ্গে জেগে ওঠে
আমি তাদের ফিরে আসা দেখি।
অসংখ্য প্রাণী
সবাই যার যার ভিন্ন খোঁয়াড়ে ফিরে যায়।
কারও শেকড়ে ফিরে যাওয়াই অটলতা নামে পরিচিত। ৩৬ 

যেভাবে পাতা গাছের শেকড়ের কাছে ঝরে পড়ে, পচে গিয়ে আবার জীবন চক্রে ফেরে সেভাবে সবকিছুই মূলে ফিরে যায়। অদৃশ্য জগৎ থেকে দেখা দিয়েছিল পাতা, কিছু সময়ের জন্যে দৃশ্যমান ছিল, তারপর আবার অন্ধকারে ফিরে গেছে। আলোকিত সাধু রাজা স্বয়ং এই পরিবর্তন থেকে একাকী বিচ্ছিন্ন ছিলেন। একবার নিজেকে অদৃশ্যের সঙ্গে মেলানোর পর পূর্ণ প্রজ্ঞা ও নিরপেক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি। তিনি নিজেকে পথ-এর সঙ্গে একাত্ম করতে পারেন; কবিতা শেষ হয়েছে এভাবে: ‘তিনি সহ্য করতে পারেন, এবং জীবনের শেষদিনগুলোয় কোনও বিপদের মুখোমুখি হবেন না।৩৭ 

শূন্যতা দাওদিজিঙকে ঘিরে রাখা ভয় থেকে মুক্তি নিয়ে এসেছিল। নিশ্চিহ্নতার ভয়ে ভীত শাসক অলীক কল্পনায় সন্ত্রস্ত থাকেন। শূন্যতাই বাস্তবতার প্রমাণ হওয়ায় একে ভয় পাওয়া উচিত হবে না আমাদের। ‘চাকার তিরিশটি পাখি একটা চক্রনাভী ভাগাভাগি করে,’ যুক্তি তুলে ধরেছেন লাওযি, কিন্তু যেখানে কিছুই নেই [অক্ষদণ্ডের ফোকর} ঠেলাগাড়ির দক্ষতা লুকিয়ে থাকে সেখানেই।” তেমনি একটি পাত্র তৈরির সময় আমরা কাদাকে টিপে টিপে আকর্ষণীয় রূপ দিই, কিন্তু যেখানে কিছুই নেই সেই জায়গাটিই পাত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ [রেইজন দ’এতরে]। লাওযি উপসংহার টানছেন: 

এভাবে আমরা ভাবি স্পর্শযোগ্য বস্তু থেকে সুবিধা পাই
কিন্তু আসলে যেখানে আমরা
কিছুই দেখি না ফলপ্রসুতা রয়েছে সেখানেই। ৩৯ 

সরকারী নীতির বেলায়ও একই কথা খাটে। নিজের ভেতর উর্বর শূন্যতা আবিষ্কার করার পর রাজকুমার শাসন করার জন্যে তৈরি হয়ে যেতেন। স্বর্গ ও দাও-এর আদর্শে এক ধরনের ‘রাজস্বভাব’ অর্জন করেছিলেন তিনি। সাধু শাসককে অবশ্যই অন্য প্রাণীদের ধারায় কোনও রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজের দুর্বোধ্য পথ ধরে আগ্রসর হওয়া স্বর্গের মতো আচরণ করতে হবে। এভাবেই সবকিছু হওয়ার কথা, এবং এটাই-বিরতিহীন, উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা নয়-বিশ্বে শান্তি নিয়ে আসবে। 

সর্বত্র শাসক, রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ষড়যন্ত্র আর কূটচাল দিয়ে চলেছেন। বহু দার্শনিকই উপকারের চেয়ে ক্ষতি করেছেন বেশি। মোহিস্টরা বিশ্লেষণ, কৌশল, আর তৎপরতার উপর জোর দিয়েছেন। কনফুসিয়রা সংস্কৃতিকে মাহাত্ম্য দিয়েছেন, যা দাও-এর ধারাকে ব্যাহত করেছে বলে বিশ্বাস করেছেন লাওযি। কনফুসিয় নায়ক ইয়াও, শান ও ইউ অবিরাম-নদীর ধারাকে প্রবাহিত করে, বনে আগুন দিয়ে আর চাষযোগ্য জমি বের করে আনতে পাহাড় কেটে-প্রকৃতির কাজে নাক গলিয়েছেন। সমাজের উপর নিজেদের আচার চাপিয়ে দিয়ে কনফুসিয়রা মানুষকে একেবারেই বাহ্যিক আধ্যাত্মিকতার প্রতি মনোযোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছেন। এরচেয়ে অনেক বেশি লক্ষ্য-নির্দেশিত ইউ ওয়েই তৎপরতা রয়েছে; এটা প্রাণীসমূহকে একা থাকতে দেওয়া পথ-এর কোমল, অনিশ্চিত, স্বতঃস্ফুর্ত ধারার সঙ্গে বেমানান 

পথ কখনও কাজ করে না, কিন্তু তারপরেও
কোনও কিছুই অসমাপ্ত ফেলে রাখে না।
জমিদার ও রাজকুমাররা একে আঁকড়ে থাকতে পারলে,
নানা সৃষ্টি তাদের নিজেদের ইচ্ছাতেই বদলে যাবে। 

এবং দাওবাদী শাসক উপসংহারে বলেছেন: ‘আমি আকাঙ্ক্ষা বাদ দিয়ে অটল থাকলে সাম্রাজ্য নিজের ইচ্ছাতেই শান্তিতে থাকবে।৪১ 

স্বজ্ঞার পাল্টাভাবে কাজ করাই বেঁচে থাকার গোপন কথা ৪২ রাজনৈতিক জীবনে লোকে সবসময় কিছুই না করার চেয়ে উন্মত্ত তৎপরতায়, অজ্ঞতার চেয়ে জ্ঞান আহরণে আর দুর্বলতার চেয়ে শক্তি অর্জনে বেশি তৎপর থাকে, কিন্তু-এই নতুন ধারণায় কৌতূহলী হয়ে ওঠা সমসাময়িকদের বিস্মিত করে —লাওযি জোর দিয়ে বলেছেন, তাদের ঠিক উল্টোটাই করা উচিত। 

জগতে পানির চেয়ে বেশি বশ্য ও দুর্বল কিছুই নেই কিন্তু তবু কঠিন কিছুকে আক্রমণের বেলায় 

একে হারানোর মতো কিছু নেই।
কারণ এর জায়গা দখল করার মতো কিছু নেই।
দুর্বল শক্তিমানকে পরাস্ত করে,
আর বশ মানা পরাস্ত করে কঠিনকে,
বিশ্বের সবাই জানে, তবু কেউই এই জ্ঞানকে
কাজে লাগাতে পারে না।৪৪

সকল মানবীয় প্রয়াস নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, তো আগ্রাসীভাবে ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিবিদের প্রত্যাশার বিপরীত কাজটি করার মানে হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পথ-এ ফিরে আসা।” যা উপরে ওঠে তা আবার নিচে নেমে আসবে, এটা প্রকৃতিরই বিধান; তো সমর্পণের মাধ্যমে আপনার শত্রুকে শক্তিশালী করে আসলে তার পতনকেই ত্বরান্বিত করছেন আপনি। স্বর্গ ও মর্ত্য চিরকাল টিকে থাকার কারণ তারা নিজেদের অস্তিত্ব দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যে সংগ্রাম করেনি: 

সুতরাং সাধু তাঁর সত্তাকে শেষে স্থান দেন এবং আগে আসেন…
তার কারণ এই নয় যে আত্মচিন্তা রহিত বলেই তিনি
নিজের একান্ত উদ্দেশ্য অর্জন করেছেন? 

এই ধরনের আত্মশূন্যকরণের জন্যে দীর্ঘ অতীন্দ্রিয়বাদী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়েছে, কিন্তু সাধু শাসক নিজের অন্তস্থঃ শূন্যতা লাভ করার পর জীবনের তথাকথিত দুর্বলতর বস্তুগুলোর মতোই সজীব, প্রবহমান ও উর্বর পরিণত হবেন। 

শক্তি ও নিপীড়ন ছিল সহজাতভাবেই আত্ম-বিধ্বংসী। লাওযি এখানে যোদ্ধাদের শত্রুর কাছে ‘হার মানার’ তাগিদ দেওয়া প্রাচীন আচরিক যুদ্ধবিগ্রহের চেতনায় ফিরে গেছেন। অস্ত্র কুলক্ষণা সরঞ্জাম, সন্ন্যাসীর সরঞ্জাম নয়,’ বলেছেন লাওযি। ‘কেবল উপায়ন্তর না থাকলেই সে তা কাজে লাগায়’, ‘ অনেক সময় যুদ্ধ দুঃখজনক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, যুদ্ধ করতে বাধ্য হলে সাধুকে অবশ্যই দুঃখের সঙ্গে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। কোনও রকম অহমবাদী বিজয়বাদ থাকতে পারবে না, থাকবে না নিষ্ঠুর বীরত্ব আর ঠুনকো দেশপ্রেম। সাধু অবশ্যই অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে জগৎ-কে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলবেন না, কারণ এই ধরনের ঔদ্ধত্য প্রায় নিশ্চিতভাবেই তার কাছে ফিরে আসবে। সাধুকে সবসময় অবশ্যই সামরিক অভিযানের অবসান ঘটাতে হবে। ‘একে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাও, কিন্তু গলাবাজি করো না; একে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাও, কিন্তু গর্ব করো না; একে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাও, কিন্তু উদ্ধত হয়ো না; কেবল যেখানে আর কোনও উপায় থাকবে না একে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাও; একে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাও, কিন্তু অবিলম্বে সেটা করো। 

সুতরাং, উউ ওয়েই-এর মানে কাজ থেকে সামগ্রিক অনুপস্থিতি নয়, বরং ঘৃণার বৃদ্ধিকে রোধ করবে এমন এক ধরনের অনাগ্রাসী, অনিশ্চিত প্রবণতা ছিল। 

যুদ্ধে ভালো নেতা যুদ্ধবাজ নন
ভালো যোদ্ধা উদ্ধত নয়;
শত্রুর সেরা বিজয়ী তিনিই যিনি কখনওই আক্রমণে যান না।
মানুষের সঙ্গে যিনি মানবিক আচরণ করেন তিনিই
তাদের সেরাটা বের করে নেন।

লাওযি উপসংহারে পৌঁছেছেন, ‘এটা আমি যাকে বলি সহিংসতাহীনতার গুণ [দে],’ এবং এভাবে কাজ করে সাধু যোদ্ধা ‘স্বর্গের সূক্ষ্মতার সঙ্গে মানিয়ে যায়। ৫০ 

আমাদের কাজ নয়, বরং আমাদের প্রবণতাই আমরা যা করি তার ফল স্থির করে দেয়। লোকে সবসময় আমাদের কথা ও কাজের পেছনের অনুভূতি ও প্রণোদনা বুঝতে পারে। সাধুকে অবশ্যই বৈরিতাকে আত্মস্থঃ করতে শিখতে হবে; সে কোনও নিষ্ঠুরতার বদলা নিলে তাতে নিশ্চিতভাবেই নতুন হামলার সৃষ্টি হবে। চ্যালেঞ্জকে অবশ্যই অবজ্ঞা করতে হবে। ‘পরাজয় মানা মানে সমগ্রকে রক্ষা করে…কারণ [সাধু] প্রতিযোগিতায় মাতেন না, এই পৃথিবীর কেউই তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার মতো অবস্থায় নেই।৫১ স্বৈরাচারীরা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়েছিলেন, কারণ একজন রাজকুমার অন্য মানুষের উপর কাজ করতে গেলে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁকে প্রতিহত করে এবং পরিণামে প্রত্যাশার উল্টোটাই ঘটে। উউ ওয়েই-কে অবশ্যই বিনয়ের সঙ্গে মেশাতে হবে। সাধু ছাদের উপর থেকে নিজের নীতিমালাকে প্রচার করেননি; প্রকৃতপক্ষে তার কোনও নির্দিষ্ট মত ছিল না। সাধু অন্য লোকদের যেমন চেয়েছে তেমন করার চেষ্টা করেননি, বরং ‘লোকের মনকেই নিজের করে নিয়েছে।৫২ লাওযির বিশ্বাস ছিল যে, মানব প্রকৃতি আদিতে দয়ালু ও ভালো ছিল। কেবল ব্যাপক আইন ও নৈতিক বিধিবিধানে নিজেদের নিপীড়িত বোধ করার পরেই সহিংস হয়ে উঠেছে। একজন সাধু শাসক কোনও বৃহৎ দেশের হামলার মোকাবিলা করার সময় তাঁকে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে ঘৃণা আরও ঘৃণার জন্ম দিচ্ছে, নাকি সহানুভূতির প্রতি সাড়া দিয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে: যে গুণটির কথা লাওযি যেটিকে খুব কমই স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন, তবে নিজেকে অন্যের জায়গায় স্থাপন করার প্রয়াসে সেটা পরোক্ষে ফুটে উঠেছে: 

ব্যাপক দুর্ভোগ থাকার কারণ আমার একটা সত্তা আছে।
সত্তা না থাকলে, আমার আর কি দুর্ভোগ থাকত?
সুতরাং বিশ্বকে নিজের সত্তার মতো সম্মান করে তার কাছে
বিশ্ব তুলে দেওয়া যেতে পারে,
কিন্তু যে বিশ্বকে নিজের সত্তার মতো ভালোবাসে
তাকে বিশ্বকে ন্যাস্ত করা যেতে পারে। ৫৪
চীনের অ্যাক্সিয়াল যুগের শেষ মহান সাধু ছিলেন লাওযি। আবিশ্যিকভাবেই তাঁর আদর্শ ইউটোপিয় ছিল। ‘শূন্যতা’র এই পর্যায়ে আসা একজন সাধু কিভাবে কখনও ক্ষমতায় আসবেন, বোঝা কঠিন, কারণ ক্ষমতা পাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় হিসাব করতেই অপারগ হবেন। মেনসিয়াসের মতো লাওযি তাঁর কালের সন্ত্রাস লোকজনকে একজন অতীন্দ্রিয় প্রবণতার অধিকারী শাসকের দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টেনে নিয়ে যাবে, এমন কোনও ধরনের মেসিয়ানিক আশা পোষণ করে থাকতে পারেন। কিন্তু, অবশ্যই, দাওবাদী সাধু নন, বরং আইনপন্থী কিন রাজ্যই যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর সহিংসতা থামিয়ে সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। দর্শনীয় এই সাফল্য যেন প্রমাণ করেছিল যে সামরিক শক্তির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া সর্বজনীন রাজশক্তি অর্জন সম্ভব নয়। এটা এক ধরনের শান্তি স্থাপন করেছিল, কিন্তু নৈতিকতার প্রতি অ্যাক্সিয়াল যুগের আশা, ঔদার্য ও সহিংসতাহীনতার প্রতি মৃত্যুবাণ ছুঁড়ে দিয়েছিল। সাম্রাজ্যের অধীনে অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতা এক ধরনের সংশ্লেষ ঘটাবে ও সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুতে রূপান্তরিত হবে। 

চীনারা অন্য অ্যাক্সিয়াল জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় অ্যারিস্টটলের পুরোনো শিষ্য অ্যালেক্সান্দার দ্য গ্রেটের অসাধারণ জীবন সম্পর্কে কিছুই জানত না। ৩৩৩ সালে তৃতীয় দারিউসের সেনাবাহিনীকে সিলিসিয়ায় ইসাস নদীর পাড়ে ছত্রভঙ্গ করে পারসিয় সাম্রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর নিজ বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে এশিয়ার অভ্যন্তরে ধ্বংসলীলা চালিয়ে পরিচিত পৃথিবীর প্রায় সম্পূর্ণটুকু নিয়ে এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অগ্রযাত্রা সহিংস ও নিষ্ঠুর ছিল। বিরোধিতাকে তিলমাত্র প্রশ্রয় দেননি তিনি বরং তাঁর পথে এসে দাঁড়ানোর মতো স্পর্ধা দেখানো সব রাজ্যকে নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন, জনগণের উপর চালিয়েছেন হত্যালীলা। ভয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল তাঁর সাম্রাজ্য, তবু আলেক্সান্দারের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একতার একটা দর্শন ছিল। কিন্তু ৩২৩ সালে বাবিলোনিয়ায় তাঁর অকাল মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য টিকতে পারেনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নেতৃস্থানীয় জেনারেলদের ভেতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, পরের দুই দশকে আলেক্সান্দারের অধিকার করা দেশগুলো ছয় দায়াদোচয় (‘উত্তরাধিকারী’)-এর যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের ‘শান্তি’ বিধ্বংসী যুদ্ধবিগ্রহের পথ খুলে দিয়েছিল। সবশেষে শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে দায়াদোচয়দের দুজন অন্যদের নিশ্চিহ্ন করে আলেক্সান্দারের এলাকা নিজেদের ভেতর ভাগবাটোয়ারা করে নেন। আলেক্সান্দারের অন্যতম ধূর্ত জেনারেল টলেমি নেন মিশর, আফ্রিকান উপকূল, প্যালেস্তাইন ও দাক্ষিণ সিরিয়া; বাবিলোনিয়ায় আলেক্সান্দারের নিয়োগপ্রাপ্ত সাত্রাপ সেলুকাস ইরানসহ প্রাচীন পারসিয় সাম্রাজ্যের বৃহত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে ওঠায় ভারতীয় এলাকা ছেড়ে দিয়ে দূর পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা স্থির করেছিলেন সেলুকাস। 

ভারতীয় জনগণের উপর আলেক্সান্দার তেমন একটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেননি। অল্প কিছু ছোটখাটো গোত্রকে জয় করতে পেরেছিলেন তিনি, এমনকি ভারতীয় আদি ইতিহাসবিদদের হাতে তাঁর আগ্রাসন উল্লেখও পায়নি। ভারত বিজয় নয় বরং সেখানে যাওয়াই ছিল তাঁর সাফল্য এবং ভারতে তাঁর দুই বছরের অবস্থান সামরিক অভিযানের চেয়ে ঢের বেশি ভৌগলিক অভিযান ছিল। আলেক্সান্দার যেন গ্রিক রেওয়াজেরই প্রতিমূর্তি ছিলেন বলে মনে হয়। হোমারিয় মিথের মাঝে বেড়ে উঠেছেন তিনি, অ্যাথেন্সের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং শিক্ষা পেয়েছেন অ্যারিস্টটলে কাছে। অন্যান্য অঞ্চালের মতো গ্রিক অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মীয় দর্শনে পুরোপুরি অংশ নেয়নি। এর কিছু চমকপ্রদ ‘অ্যাক্সিয়াল’ সাফল্য ছিল সামরিক। ভারতে আলেক্সান্দারের দুবছরের অ্যাডভেঞ্চার ছিল এমনি আরেকটি মুহূর্ত: গ্রিক সেনাবাহিনী তাদের চোখে দুনিয়ার শেষপ্রান্তে এসে হাজির হয়েছিল। চরমের বিরুদ্ধে যোগীদের মানবীয় মননের সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের সংগ্রামের মতোই নিজেদের খাড়া করেছিল তারা। অতীন্দ্রিয়বাদীরা যেখানে অন্তস্থঃ স্থান জয় করেছেন, অ্যালেক্সান্দার সেখানে ভৌত জগতের দূরবর্তী প্রান্তে অভিযান চালিয়েছেন। বহু অ্যাক্সিয়াল সাধুর মতো অবিরাম ‘আরও বেশি কিছুর’ জন্যে যুদ্ধ করে গেছেন তিনি। পারস্য রাজাদের চেয়ে ভারতের আরও গভীরে, তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীকে ঘিরে রাখা সাগরের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। পাশ্চাত্য অভিযাত্রীদের কাছে সবসময় আবেদন সৃষ্টিকারী ‘আলোকন’৫৭ ছিল এটা, তবে ভারতীয় সাধুদের প্রত্যাশিত আত্মঃশূন্যকরণ, অহিংসা আর সহানুভূতিতে বৈশিষ্ট্যায়িত নিব্বানা বা মোক্ষের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

ভীতিকর বর্ষা মৌসুম, বিস্ময়কর যুদ্ধ-হাতি, প্রচণ্ড গ্রীষ্ম আর বন্ধুর পাহাড়ী পথ নিয়ে ভারতের অনন্য সৌন্দর্য দেখে গ্রিক সৈনিকরা একাধারে রোমাঞ্চিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ‘নাঙা দার্শনিকদের’-সম্ভবত তারা ছিল জৈন- দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল তারা। তবে গ্রিকদের ব্যাপারে ভারতীয়দের তেমন স্থায়ী কৌতূহল না থাকলেও আলেক্সান্দার ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই গ্রন্থে আমাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া কিছু মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছিলেন। অসংখ্য পুরোহিত আর পণ্ডিতকে হত্যা করায় এবং তাদের অগুনতি পবিত্র অগ্নি নষ্ট করেছেন বলে ইরানের জরাথ্রুস্টীয়রা আলেক্সান্দারকে জগতের সেরা পাপী হিসাবে মনে রেখেছে। তিনি ছিলেন ‘অভিশপ্ত’ (গুযুস্তাগ), বৈরী আত্মার সঙ্গে কেবল তিনিই এই খেতাব ধারণ করেন। পুরোহিতদের হত্যাকাণ্ড অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। জরাথুস্টীয় টেক্সট তখনও মৌখিকভাবে প্রচারিত হতো; অনেক কিছুই স্রেফ নিহত পুরোহিতদের মনেই ছিল, এবং কোনওদিনই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। 

স্বয়ং আলেক্সান্দারের চেয়ে বরং দিয়াদোচোয়-এর কারণে ইহুদিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নেহেমিয়ার আমল থেকেই জেরুসালেম পশ্চাদপদ স্থান ছিল। প্রধান কোনও বাণিজ্য পথের ধারেকাছে ছিল না এটা: পেত্রা বা গাযায় যাত্রাবিরতিকারী কারাভানের জেরুসালেমে যাওয়ার কোনও কারণ ছিল না, নিজস্ব শিল্পের উন্নতি ঘটানোর মতোই কাঁচামাল ছিল না তার। কিন্তু দিয়াদোচয়- এর যুদ্ধের সময় জুদিয়া মালসামান, সরঞ্জাম, পরিবার আর দাস নিয়ে ক্রমাগত এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, এবং মিশরের হাতে আক্রান্ত হতে থাকে। ৩২০ সাল থেকে ৩০১ সালের ভেতর কমসে কম ছয়বার হাত বদল হয় খোদ জেরুসালেম। জেরুসালেমের ইহুদিরা গ্রিকদের বিধ্বংসী, সহিংস এবং নাস্তিবাদী হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছে। ৩০১ সালে জুদিয়া, সামারিনা, ফোনেশিয়া ও সম্পূর্ণ উপসাগরীয় সমতল প্রথম টলেমি সোতারের সেনাবাহিনীর অধিকৃত হয়, এবং পরবর্তী তিরিশ বছর জেরুসালেম টলেমিদের নিয়ন্ত্রণে থাকে; অবশ্য স্থানীয় ব্যাপার-স্যাপারে তেমন একটা হস্তক্ষেপ করেননি তাঁরা। 

কিন্তু এলাকা বদলে যাচ্ছিল। আলেক্সান্দার ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা নিকট প্রাচ্যে হেলেনিস্টিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে ওঠা নতুন নতুন শহরের পত্তন করেছিলেন: মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া, সিরিয়ার অ্যান্টিওক ও এশিয়া মাইনরের পারগেনাম। হেলেনিক বিশ্বে এর আগে অস্তিত্ব ছিল না এমনি মাত্রায় নির্মিত সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দাদের বাদ দেওয়া গ্রিক পোলিস ছিল এগুলো। কসমোপোলিস, ‘বিশ্ব নগরী’ ছিল এটা। ছিল অভিবাসনের মহাযুগ। গ্রিকরা নিজেদের আর জন্মভূমির ক্ষুদে শহরগুলোর সঙ্গে একাত্ম মনে করছিল না। আলেক্সান্দারের বীরত্বপূর্ণ অভিযান তাদের দিগন্ত প্রসারিত করে দিয়েছিল এবং অনেকেই পোলিসগুলোকে তুচ্ছ ও প্রাদেশিক ভাবতে শুরু করেছিল। কেউ কেউ নিকট প্রাচ্যে নতুন পোলিস স্থাপন করেছিল। সামারিনায় মেসিদোনিয়ায় বসতি করেছিলেন আলেক্সান্দার এবং পরে গ্রিক উপনিবেশবাদীরা সিরিয়াতেও এসে পৌঁছায় এবং গাযা, শেচেম, মারিসা এবং আম্মানের মতো প্রাচীন শহরগুলোকে পাল্টে ফেলে। নতুন সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্যে গ্রিক সৈনিক, বণিক ও ব্যবসায়ীরা এইসব গ্রিক ছিটমহলে বসতি গড়েছিল। গ্রিক ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে শেখা স্থানীয় জনগণই পরিণত হয়েছিল ‘হেলেন্স’-এ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের নিম্নস্তরের সারিতে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছিল তাদের। একারণেই সভ্যতার সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল এখানে। স্থানীয়দের কেউ কেউ গ্রিকদের সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পোলিস জীবনের সেক্যুলার ধারা, গ্রিক দেবতাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং জিমনাসিয়ামে তরুণদের নগ্ন দেহে শরীরচর্চা করতে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল অন্যরা। গ্রিকদের প্রতি সাড়া দেওয়ার বেলায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল ইহুদিরা। আলেক্সান্দ্রিয়ায় টলেমিরা মিশরিয়দের জিমনা-সিয়ামে প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু বিদেশীদের ঢুকতে দিয়েছেন, ফলে স্থানীয় ইহুদিরা এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রিক ও ইহুদি সংস্কৃতির অসাধারণ সংশ্লেষ অর্জন করেছে। অধিকতর রক্ষণশীল জেরুসালেমে দুটো উপদল গড়ে উঠেছিল। একটির নেতৃত্বে ছিলেন নেহেমিয়াকে দারুণ ঝামেলায় ফেলে দেওয়া তোবিয়ার বংশধর তোবিয়াদ। গ্রিক বিশ্বে স্বস্তিতে আছে মনে করেছে তারা এবং জেরুসালেমে নতুন নতুন ধারণার অগ্রদূতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু অন্যরা এই বিদেশী প্রভাবকে সম্পূর্ণ হুমকি মনে করে আত্মরক্ষামূলকভাবে প্রাচীন ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থেকেছে। পুরোনো আইন-কানুন টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর এক পুরোহিত পরিবার ওনায়েদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল তারা। জেরুসালেমের ইতিহাসে তৃতীয় শতাব্দী এক ছায়াছন্ন পর্ব, তবে এই সময়ে দুই শিবিরের ভেতরকার টানাপোড়েন নিয়ন্ত্রণেই ছিল বলে মনে হয়। পরে অবশ্য, অ্যাক্সিয়াল যুগের শেষে কোনও কোনও ইহুদি জেরুসালেমকে ‘অ্যান্টিওক অভ জুদিয়া’ নামে পোলিসে পরিণত করার চেষ্টা করার সময় মারাত্মক বিরোধ দেখা দিয়েছিল। 

উত্তাল এই বছরগুলো ভিন্নভাবে জেরুসালেমের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। সাম্রাজ্যবাদী পারস্যের বিরুদ্ধে খুব বেশি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। পারসিয় রাজারা চিরদিন টিকে থাকবে, এমন একটি সাম্রাজ্যের অধিকার লাভ করেছেন বলে পুরাণ চালু করেছিলেন; অসিরিয়দের হাতে এর সূচনা ঘটেছিল, তারপর বাবিলোনিয়দের হাতে গেছে এবং সবশেষে এসেছে সাইরাসের অধিকারে। সুতরাং যেকোনও ধরনের বিদ্রোহই ছিল অভিশপ্ত। কিন্তু নিকট প্রাচ্যের মানুষ দিয়াদচোয়কে এলাকার নিয়ন্ত্রণ লাভের লক্ষ্যে যুদ্ধ করে একের 

পর একজনকে ক্ষমতা দখল করতে দেখার পর তাদের মনোভাব বদলে গিয়েছিল। জগৎ উল্টে গেছে, কোনও কোনও ইহুদি তাদের নিজেদের মেসায়ার অধীনে মুক্তির আশা লালন করতে শুরু করেছিল। ২০১ সালে টলেমিরা সেলুসিয়দের হাতে জুদিয়া থেকে বিতাড়িত হলে এই আশা ফের চাঙা হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে সেলুসিয় রাজা চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের আচরণ প্রাচীন ডেভিডিয় রাজবংশের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইহুদিদের প্রলয়বাদী আবেগকে জোরাল করে তুলেছিল। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগে এই মেসিয়ানিক ধার্মিকতার কোনও শেকড় ছিল না, ইহুদিবাদকে তা অ্যাক্সিয়াল পরবর্তী ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়েছিল। 

গ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্যের তুঙ্গ অবস্থায় সাম্রাজ্য অর্জন করেছিলেন আলেক্সান্দার এবং তাঁর জীবন এক নতুন যুগের সূচনা চিহ্নিত করেছে। তাঁর মৃত্যুর পর অ্যাথেন্সসহ গ্রিক মূল ভূখণ্ডের কিছু পোলিস মেসিদোনিয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে; আদি ছয় দিয়াদোচোয়ের অন্যতম আন্তিপাতার ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এর সঙ্গে অবসান ঘটে অ্যাথেনিয় গণতন্ত্রের। গ্রিক অভিবাসী ও উপনিবেশবাদীরা নতুন নতুন এলাকায় বসতি স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক সভ্যতা পুবের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর পণ্ডিতরা এই ফিউশনকে বলেছেন ‘হেলেনিজম’। এই সাক্ষাতের চ্যালেঞ্জ সমৃদ্ধকারী হলেও এই প্রক্রিয়ায় গ্রিক পরীক্ষানিরীক্ষার প্রাবল্য হ্রাস পায়। এমন বিশাল এলাকাজুড়ে এমনি ক্ষীণভাবে বিস্তৃতি ঘটায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পুরোপুরি গ্রিক থাকার বদলে গ্রিকিশ হয়ে ওঠে সেটা। যেকোনও সামাজিক পরিবর্তনের সময়ই ঝামেলাপূর্ণ। প্রাচীন ব্যবস্থার পতন ও অনিবার্য রাজনৈতিক বিঘ্ন অস্বস্তিকর।৫৮ ব্যাপক বিস্তৃত বিস্ময় ও অস্থিরতা ছিল। গ্রিক পরিচয় অনভূতিতে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু এখন তাদের জগৎ এতটাই নাটকীয়ভাবে প্রসারিত হয়ে উঠেছিল যে, লোকে তাদের নিয়তি বিশাল নৈর্ব্যক্তিক শক্তিতে নিয়ন্ত্রিত হবে বলে মনে করছিল। 

তৃতীয় শতকে তিনটি নতুন দর্শন কালের বেদনায় প্রোথিত এই বিচ্ছিন্নতার বোধকে প্রশমিত করার প্রয়াস পেয়েছে।৫৯ উদাহরণ স্বরূপ, এপিকিউরাস (৩৪১-২৭০) তাঁর জীবনের প্রথম তিরিশটি বছর খুব সামান্যই নিরাপদ বোধ করেছিলেন। মেসিদোনিয়দের হাতে সামোস থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে। ৩০৬ সালে অ্যাথেন্সে পৌঁছানোর আগে এক পোলিস থেকে আরেক পোলিসে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। এখানে একাডেমির কাছে বাগানঅলা একটা বাড়ি কেনেন তিনি, বন্ধুদের একটা গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। মানবীয় অস্তিত্বের প্রধান লক্ষ্য আনন্দ, শিক্ষা দিয়েছেন তিনি, কিন্তু তাঁর নিন্দুকরা যেমন মনে করেছেন, তার মানে এটা ছিল না যে, তিনি নিজেকে ফুর্তিবাদের উচ্ছ্বাসে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। গোষ্ঠীটি আসলে ‘উদ্যানে একটি শান্ত, সহজ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। আমোদ ইন্দ্রিয়জ সুখ ও আত্ম-প্রমোদের মিশেল ছিল না, বরং আতাক্সিয়া (‘বেদনা থেকে মুক্তি’) ছিল। এপিকিউরিয়রা সব মানসিক দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলেছিল। পোলিসের জীবন এতটাই উত্তেজনাময় ও দুর্বোধ্য ছিল যে, যাদের সাধ্য আছে তাদের উচিত প্রকাশ্য জীবন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে আন্তরিক লোকজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অস্তিত্ব উপভোগ করা। এমনকি অসহায় নারী-পুরুষের উপর প্রবল দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া কুসংস্কারমূলক প্রায়শঃ পরিবর্তনশীল দেবতাদের ধারণাসহ তাদের কষ্টের কারণ হয় এমন যেকোনও কিছু বর্জন করতে হবে। সবার উপরে এপিকিউরিয়দের নৈতিকতা দিয়ে মনকে বিষাক্ত হতে দেওয়া চলবে না। তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, মৃত্যু হচ্ছে স্রেফ সচেতনতার বিনাশ, ‘আমরা যখন অস্তিত্ববান থাকি, তখন দেখি মৃত্যু উপস্থিত নেই, আর আমরা যখন অনুপস্থিত থাকি তখন মৃত্যু অস্তিত্ববান থাকে, যুক্তি দেখিয়েছেন এপিকিউরাস। এনিয়ে চিন্তা করা অনর্থক। ‘মৃত্যু আমাদের কাছে কিছুই নয়, এই সঠিক উপলব্ধি অনস্ত সময় যোগ করে নয়, বরং অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত করে আমাদের জীবনের মরণশীলতাকে উপভোগ্য করে তোলে।৬০ 

এপিকিউরাস এবং তাঁর বন্ধুরা উদ্যানে অবসর উপভোগ করার সেই একই সময়ে সাইপ্রাসের এক হেলেনায়িত ফোনেশিয় যেনো (৩৪২-২৭০) অ্যাথেনিয় আগোরার একটা রোয়াক পেইন্টেড সোয়-য় শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি ও তাঁর অনুসারীরার এ কারণে স্টোইক নামে পরিচিত। আলেক্সান্দার গোটা বিশ্বকে যখন তাঁর শাসনের অধীনে নিয়ে আসবেন বলে মনে হচ্ছিল, যেনো তখন অসাধারণ সময় নিয়ে দারুণ অনুপ্রাণিত ছিলেন। মহাবিশ্ব একটা ঐক্য বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। দেহ ও আত্মার ভেতর কোনও বিভাজন নেই; গোটা বাস্তবতা ভৌত, প্রাণবন্ত এবং এক ধরনের আগ্নিময়, বাষ্পসদৃশ নিঃশ্বাসে সংগঠিত, যাকে লোগোস (‘যুক্তি’), নিউমা (‘আত্মা’) বা ঈশ্বর বলেছেন তিনি। বুদ্ধিমান, স্বর্গীয় এই শক্তি সবকিছুকে ঘিরে থাকে। এটা সর্বব্যাপী। মানবজাতি কেবল প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় প্রকাশিত যৌক্তিক লোগোস মোতাবেক চলেই সুখ লাভ করতে পারে। ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের ভেতরই রয়েছে মুক্তি; ঈশ্বর সবকিছু আগেই স্থির করে রেখেছেন বলে নিয়তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অর্থহীন। নীরবে হাল ছেড়ে দেওয়াই সঠিক প্রবণতা। স্টোইককে জীবনের ভেতর দিয়ে হালকাভাবে চলে বেড়াতে হবে, বাহ্যিক অবস্থার প্রতি উদাসীন থাকতে হবে, বিবেকের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে, নিজেদের সভ্যভাবে পরিচালিত করতে হবে এবং সব ধরনের চরম অবস্থা এড়িয়ে যেতে হবে। উদ্দেশ্য ছিল স্বর্গীয় লোগোসের ক্লান্তিহীন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছন্দ বজায় রেখে বাস করা, এগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করা নয়। 

স্কেপটিকদের প্রষ্ঠিাতা পিররো অভ এলিসেরও (সি. ৩৬৫-২৭৫) লক্ষ্য ছিল আতারাক্সিয়া। তাঁর সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না। কিছুই লিখেননি তিনি এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর মৃত্যুর আনুমানিক পাঁচ শো বছরের আগে স্কেপ্টিকদের কোনওরকম টেক্সটও উপস্থিত করা হয়নি। পিররো যেন জোর দিচ্ছিলেন যে, কোনও কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এক কথায় অসম্ভব, সুতরাং শান্তিতে থাকার জন্যে বিচার স্থগিত রাখাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যেসব লোক গোঁড়া ও আত্ম-নিশ্চিত তারা অসুখী হতে বাধ্য। কথিত আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘কোনও কিছুই সম্মানজনক বা মূল বা অন্যায় নয়। ‘রেওয়াজ ও অভ্যাস মানুষের সব কাজের ভিত্তি, কারণ প্রতিটি বস্তু সেই বস্তু থেকে বেশি কিছু নয়।’৬১ এটা অবশ্যই সামঞ্জস্যহীন ছিল। আমরা কিছুই জানি না, এ কথা সত্যি হলে পিররো কিভাবে জানেন যে এই কথাটাও ঠিক-বা আদৌ একটি দর্শন গড়ে তুলতে পারেন? কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে স্কেপটিজমকে জ্ঞানতাত্ত্বিক তত্ত্ব নয়, বরং থেরাপি মনে করেছিলেন পিররো। লোকে তাদের জোরাল মতামতে বড্ড বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল; সত্যি আবিষ্কারে খুই উদ্বিগ্ন ছিল তারা। সুতরাং একজন স্কেপটিক দয়া করে তাদের ব্যবস্থা থেকে সকল বুদ্ধিবৃত্তিক অস্থিরতাকে জোর করে দূর করে দেবে তাদের নিশ্চয়তাকে খাটো করবে। সিই তৃতীয় শতকে জীবন যাপন করা প্রথম স্কেপটিকাল লেখক সেক্তাস এম্পিকিরিকাস পিররো এবং তাঁর শিষ্যরা মনের শান্তি পাওয়ার খাতিরেই সত্যি আবিষ্কারের প্রয়াসে রত হয়েছিলেন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সন্তোষজনকভাবে সেটা করতে ব্যর্থ হলে হাল ছেড়ে দিয়ে অনেক ভালো বোধ করেছেন। ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখায় ছায়া যেভাবে দেহকে অনুসরণ করে সেভাবে প্রশান্তি হাজির হয়েছিল। তখনও অনুসন্ধান করে যাচ্ছিলেন বলে স্কেপতিকোই (‘অনুসন্ধানী’) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা, জানতে পেরেছিলেন যে সকল সম্ভাবনার প্রতি উন্মুক্ত মনকে রুদ্ধ না করে বরং এক ধরনের বিশৃঙ্খলাহীন প্রবণতাই সুখের চাবিকাঠি। 

এইসব হেলেনিস্টিক দার্শনিকের বেলায় অ্যাক্সিয়াল যুগ সত্যিকার অর্থে ভালোভাবেই অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তবু তাঁদের রচনায় আমরা পাঁচ শো বছরেরও বেশি সময় ধরে সাধু ও পয়গম্বরদের অনুসন্ধানের মহান অগ্রগামী আধ্যাত্মিকতার রেশ দেখতে পাই। কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, ইযেকিয়েল এবং সক্রেটিসের বীরত্বব্যাঞ্জক সংগ্রাম আরও সংযমী, অর্জনযোগ্য এবং যেমন বলা হয়ে থাকে, ‘বাজেট’ ভাষ্যে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। প্রকৃতিমুখী জীবন সম্পর্কে যেনোর আদর্শে দাওবাদের আভাস রয়েছে, কিন্তু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেকে এক করে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার বদলে স্টোইক স্রেফ নিজেকে স্থিতাবস্থায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তৃতীয় শতকের এই তিনটি গ্রিক দর্শনেই অ্যাক্সিয়াল যুগের বিপরীত অদৃষ্টবাদের অস্তিত্ব রয়েছে। বুদ্ধ চেয়েছিলেন তাঁর শিষ্যরা যেন অধিবিদ্যিক মতামতের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে না পড়ে; উপনিষদের অতীন্দ্রিয়বাদীরা তাদের সঙ্গে আলাপরতদের যৌক্তিক ভাবনার অর্থহীনতার যুক্তি দেখিয়ে নীরবতায় পর্যবসিত করেছিলেন, কিন্তু স্কেপটিকদের মতো স্রেফ ‘বিচার বিবেচনা স্থগিত’ রাখেননি তাঁরা। মানুষকে শব্দ ও মনোগত ধারণার ঊর্ধ্বে অবস্থান করা রহস্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্যে চিন্তার সাধারণ অভ্যাসকে বিনাশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন। ভারতের সন্ন্যাসীরা জগৎ- কে পেছনে ফেলে এসেছিলেন, কিন্তু তারা উপকণ্ঠের এপিকিউরিয় উদ্যানে বাস করেননি, আর সাধুদের অবশ্যই আগোরায় ফিরে গিয়ে সকল প্রাণীর প্রতি সহানুভূতির চর্চা করতে হবে বলে জোর দিয়েছিলেন বুদ্ধ। 

এখানেই রয়েছে পার্থক্য। এই হেলেনিস্টিক দার্শনিকরা কোনওরকম বীরত্বপূর্ণ নৈতিক দাবি করেননি। তাঁরা প্রত্যেকেই প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের অস্পষ্ট মেটা-ফিজিক্স একপাশে ঠেলে দিয়ে মানুষকে বাঁচার কৌশল শিক্ষা দেওয়ার প্রয়াস পাওয়া সক্রেটিসের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছেন। তাঁরা মনের সেই প্রশান্তি লাভ করতে চেয়েছিলেন প্রশান্তির সঙ্গে মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার সময় সক্রেটিসের যেমনটা ছিল। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে কথা বলা সক্রেটিসের মতোই পপুলারাইজার্স ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সক্রেটিস কখনও একথা বলেননি যে ঝামেলা দূর করাই মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য। যেনো, এপিকিউরিয়াস এবং পিররো শান্ত জীবন আকাঙক্ষা করেছিলেন এবং সব ধরনের চরম অবস্থা ও মহান অ্যাক্সিয়াল দার্শনিকদের সংগ্রাম এড়াতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তাঁরা। কেবল আতারাক্সিয়া কামনা করেছেন, চেয়েছেন ঝামেলা মুক্ত থাকতে। অ্যাক্সিয়াল সাধুরা অস্তিত্ব সহজাতভাবেই অসন্তোষজনক ও বেদনাদায়ক বলে যুক্তি তুলে ধরে এই ভোগান্তিকে অতিক্রম করে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু কষ্ট এড়ানো আর কোনও কিছু বা কাউকে নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেন, অস্বীকার করে পিছু হটায় নয়, বরং ভোগান্তির মোকাবিলার ভেতরই রয়েছে মুক্তি। এপিকিউরিয় বিচ্ছিন্ন উদ্যানে বুদ্ধের প্রমোদ উদ্যানের তুলনায় বেশি কিছুর আভাস ছিল। মিলটুকু আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমরা যখন ভাবি যে বেশিরভাগ এপিকিউরিয় তাদের প্রত্যাহারের পক্ষে যথেষ্ট অর্থিক সমর্থন ছিল, ব্রাত্যজনের যা থাকার কথা ছিল না। 

আতারাক্সিয়া কামনার বদলে অ্যাক্সিয়াল চিন্তকরা তাঁদের সমসাময়িকদের বেদনার বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। যারা অস্বীকার করে হাল ছেড়ে দিয়েছে জেরেমিয়া তাদের মিথ্যা পয়গম্বর’ বলে নিন্দা করেছেন। অ্যাথেন্সের ট্র্যাজিডিয়ানরা দুর্ভোগকে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন এবং দর্শকদের কান্নার নির্দেশ দিয়েছেন। কখনওই আপনার সুরক্ষিত অস্তিত্বের উপর যাতে আঘাত হানতে না পারে সেজন্যে নানা চেষ্টা চালিয়ে নয়, কেবল বিষাদের ভেতর দিয়ে গিয়েই আপনি মুক্তি অর্জন করতে পারেন। প্রার্থীকে অন্যের দুঃখের সঙ্গে সমব্যথী হতে সক্ষম করে তুলত বলে দুঃখের অভিজ্ঞতা আলোকনের পূর্বশর্ত ছিল। কিন্তু হেলেনিস্টিক দার্শনিকরা সম্পূর্ণ নিজের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। এটা ঠিক যে স্টোইকদের প্রকাশ্য জীবনে অংশগ্রহণ ও অন্যদের মঙ্গলের লক্ষ্যে উদারভাবে কাজ করার জন্যে তাগিদ দেওয়া হতো। কিন্তু ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেত বলে যাদের সঙ্গে তারা কাজ করত তাদের সঙ্গে সমব্যথী হওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। অ্যাক্সিয়াল যুগে এই শীতল স্বয়ংসম্পূর্ণতা অজানা ছিল। বন্ধুত্ব ও দয়া এপিকিউরিয় গোষ্ঠীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু উদ্যানের বাইরে তার বিস্তার ছিল না। আর যত দয়াময়ভাবেই চাওয়া হয়ে থাকুক না কেন, স্টোইকরা অন্য লোকজনের মতামতকে হেয় প্রমাণ করার লক্ষ্যে ঘুরে ঘুরে নানা জনের সঙ্গে যেচে তর্কে জড়িয়ে পড়ত বলে তাদের থেরাপিতে এক ধরনের আগ্রাসী ভাব ছিল। এই কৌশল লক্ষণীয়ভাবে বুদ্ধ ও সক্রেটিসের চেয়ে ভিন্ন ছিল, তাঁরা সবসময় তাদের সঙ্গে আলোচকরা আসলে কেমন সেখান থেকে শুরু করতেন, যেখানে তাদের থাকার কথা মনে করতেন সেখান থেকে নয়। 

বহু অ্যাক্সিয়াল যুগ চিন্তাবিদ খাঁটি লোগোস ও যুক্তির প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করতেন, কিন্তু হেলেনিস্টিক দার্শনিকরা স্বজ্ঞার চেয়ে বরং বেশি করে যুক্তিভিত্তিক ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, দোমোক্রিতাসের মৃত্যুকে ভয় পাওয়া জীবনের অপচয়মাত্র দেখাতেই অ্যাটমিজম প্রণয়ন করেছিলেন এপিকিউরাস, অ্যাটম ক্ষয় হয়ে গেলে এক সময় এমনিই তা ঘটবে। অ্যাটমের হাতে শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত বলে দেবতাদের কাছে সাহায্য চাওয়া অর্থহীন। স্টোইকরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, স্বর্গীয় প্রক্রিয়া লোগোস কর্তৃক নির্ধারিত এবং পরিবর্তন যোগ্য নয়, কেবল বৈজ্ঞানিকভাবে এটা বুঝতে পারলেই নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করা সম্ভবপর। তৃতীয় শতাব্দী গ্রিক জ্ঞানের এক মহান কাল ছিল। টলেমি ও সেলুকাসের নতুন হেলেনিস্টিক রাজ্যগুলো প্রাচীন পোলিসগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ছিল, এবং রাজারা তাঁদের রাজধানীতে পণ্ডিতদের আকর্ষণ করতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতেন, অনুদান ও ভাতার সাহায্যে উৎকোচ দিতেন তাদের। ইউক্লিড ও আর্কিমিডিস আলেক্সান্দ্রিয়ায় থেকে কাজ করেছেন। মিলেসিয় ও ইলিয়াটিয় দার্শনিকরা বর্তমান কালের জনপ্রিয় বিজ্ঞানের মতো মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওইসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন, যেখানে তৃতীয় শতাব্দীর নতুন বিজ্ঞানীরা গণিত, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিদ্যার নতুন পর্যায়ে ছিলেন। বিজ্ঞান এখন প্রাথমিক কালে ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা হারিয়ে সম্পূর্ণ সেক্যুলার প্রয়াসে পরিণত হয়েছিল। 

হেলেনিস্টিক দার্শনিকরা প্রাচীন প্যাগান ধর্মকে প্রভাবিত করেননি: উৎসর্গ, উৎসব ও আচার কোনও বিঘ্ন ছাড়াই অব্যাহত ছিল। রহস্য আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, প্রায়শঃই তাকে জুৎসই পূর্বাঞ্চলীয় কান্টের সঙ্গে মেশানো হতো। মানুষকে প্রচলিত দেবতার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার দায়ে ৩৯৯ সালে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এপিকিউরাস, যেনো এবং পিররো প্রাচীন বিশ্বাসকে হেয় করার চেষ্টা করলেও চতুর্থ শতকের পর কোনও দার্শনিককে আর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। এর আগে কখনওই সরকারীভাবে অনুমোদন পায়নি এমন এক নতুন ধরনের সহিষ্ণুতার জন্ম হয়েছিল, তবে সেটা অভিজাতদের মাঝেই শেকড় গেড়েছিল। অ্যাক্সিয়াল যুগের স্পর্শের বাইরে থাকা বেশিরভাগ মানুষই প্রাচীন আচার পালন চালিয়ে গেছে, এবং পঞ্চম শতাব্দী সিইতে ক্রিশ্চানিটি জোর করে রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করার আগপর্যন্ত তাই থাকবে। 

পূর্বসুরীদের মতো হেলেনিস্টিক দার্শনিকরা বিপ্লবী না হয়ে থাকতে পারেন, তবে তাঁদের স্থায়ী প্রভাব ছিল এবং অনেকভাবেই আসন্ন পাশ্চাত্য চেতনাকে মূর্ত করে তুলেছেন তাঁরা। পশ্চিমে ভারত ও চীনের সন্ন্যাসীদের তুলনায় আধ্যাত্মিকভাবে কম উচ্চাভিলাষী লোকজন ক্রমেই বিজ্ঞান ও লোগোসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। নিজের ভেতর এক দুর্জ্ঞেয় স্থানের আবিষ্কারের বীরত্বপূর্ণ প্রয়াস পাওয়ার বদলে হেলেনিস্টিক দার্শনিকরা নিরিবিলি জীবন কাটাতে তৈরি ছিলেন। মনের স্বজ্ঞামূলক শক্তিকে প্রশিক্ষিত করার বদলে বৈজ্ঞানিক লোগোসের শরণাপন্ন হয়েছেন তাঁরা। অতীন্দ্রিয় আলোকন অর্জনের বদলে পশ্চিম আরও জাগতিক আলোকনে উত্তেজিত বোধ করেছে। বিজ্ঞানের প্রতি পাশ্চাত্য প্রতিভা শেষপর্যন্ত বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এবং ষোড়শ শতাব্দীতে এর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এক নতুন অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচনা ঘটিয়েছে। মানবজাতিকে যারপরনাই সুবিধা দিলেও তা এক ভিন্ন জাতের মেধায় অনুপ্রাণিত ছিল। বুদ্ধ, সক্রেটিস এবং কনফুসিয়াসের বদলে নিউটন, ফ্রয়েড ও আইস্টাইন হবেন দ্বিতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের নায়ক। 

.

ভারতেও একটি নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে আলেক্সান্দারের সাম্রাজ্য থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল সেটা। চতুর্থ শতাব্দী থেকেই গাঙ্গেয় উপত্যকায় মগধ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এবং শক্তিশালী নন্দ রাজবংশের অধীনে নিজের সীমানা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেছিল। কিন্তু ৩২১ সালে সম্ভবত গোত্রীয় প্রজাতন্ত্রের সদস্য ছিলেন এমন একজন বৈশ্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসন দখল করে নেন, আগেই গ্রিকদের বিদায়ে ক্ষমতার শূন্যতার সৃষ্টি হওয়া পাঞ্জাবে ক্ষমতার ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর আমল বা অভিযান সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি আমরা, তবে মৌর্য সাম্রাজ্য শেষপর্যন্ত বাংলা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল এবং চন্দ্রগুপ্ত তখন মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে অনুপ্রবেশ শুরু করেছিলেন। অধিকতর প্রান্তিক গোত্রীয় রাজ্য থেকে আসায় বৈদিক ধর্মের সঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের জোরাল সম্পর্ক ছিল না, অগতানুগতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল তারা। স্বয়ং চন্দ্রগুপ্ত জৈনদের পছন্দ করতেন, এরা তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিল এবং দক্ষিণে নিজেদের থিতু করেছিল। তাঁর ছেলে বিন্দুস্বর মৌর্য অজীবকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন এবং ২৬৮ সালে সিংহাসনে আরোহণকারী তৃতীয় সম্রাট অশোক বুদ্ধদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন; এবং তাঁর ভাই বিতাশোক আসলে বৌদ্ধ সাধুতে পরিণত হয়েছিলেন। পালি উৎসসমূহ ধর্মান্তরের আগে অশোক নিষ্ঠুর, খামখেয়ালি শাসক ছিলেন বলে দাবি করে, অন্য ভাইদের হত্যা করেই সিংহাসনে বসতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি! সিংহাসনে বসার পর দেবনামপিয়-দেবতাদের প্রিয়’–উপাধী ধারণ করেন এবং ভয়ঙ্কর ধাক্কা খাওয়ার আগপর্যন্ত আরও নতুন নতুন অঞ্চল অধিকার অব্যাহত রাখেন। 

২৬০ সালে মৌর্য সেনাবাহিনী আধুনিক উরিষ্যার কলিঙ্গ অধিকার করে। এক বিরাট পাহাড়ের বুকে খোদাই করে রাখা ঘোষণার মাধ্যমে নিজের বিজয়কে নথিবদ্ধ করেছিলেন অশোক। নিজের সামরিক কৌশল সম্পর্কে কিছুই বলেননি তিনি, ক্ষয়ক্ষতির করুণ সংখ্যার উপর জোর দিয়েছেন। যুদ্ধে এক লক্ষ কলিঙ্গীয় সৈনিক মারা গিয়েছিল; পরে আঘাত ও ক্ষুধায় প্রাণ দিয়েছে “তার চেয়ে অনেক গুন’ আর ১৫০,০০০ কলিঙ্গীয়কে দেশান্তরী করা হয়েছে। এমনি দুর্ভোগের দৃশ্য দেখে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন অশোক। ‘দেবতাদের প্রিয়,’ বলেছেন তিনি, অনুশোচনা বোধ করেছেন, 

কোনও স্বাধীন দেশ যখন বিজিত হয়, হত্যাকাণ্ড, মৃত্যু আর দেশান্তর দেবনামপিয়র কাছে নিদারুণ শোকের ব্যাপার, এবং তাঁর মনের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে…এমনকি যারা পালানোর মতো যথেষ্ট ভাগ্যবান ছিল, এবং যাদের ভালোবাসা অটল, তাদের বহু, পরিচিত, সহকর্মী ও আত্মীয়স্বজনের দুর্ভাগ্যের কারণে কষ্ট পেয়েছে…আজ যদি কলিঙ্গ অধিকার করার সময় তার শত ভাগের এক ভাগ বা হাজার ভাগের একভাগ মানুষও একইভাবে হত্যা, নিহত বা দেশান্তরী হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, দেবনামপিয়র উপর তা দারুণ চাপ সৃষ্টি করত। ৬৪ 

অন্য রাজাদের আরও দখলের যুদ্ধ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়াই ছিল এই ডিক্রির উদ্দেশ্য। তাঁরা আদৌ কোনও অভিয়ানে নেতৃত্ব দিলে ধৈর্য ও হালকা শাস্তির’ মাধ্যমে বিজয় বাস্তবায়ন করতে হবে। ধৰ্ম্মই একমাত্র সত্যিকারের বিজয়, এ কথা বলে মানুষ ইহকাল ও পরকালে উপকৃত হবে এমন এক ধরনের নৈতিক প্রয়াসের কথা বুঝিয়েছেন অশোক।৬৫ 

তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ছিল এটা। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পরামর্শক ব্রাহ্মণ কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে প্রতিবেশী দেশসমূহকে অধিকার করে নেওয়া একজন রাজার পবিত্র দায়িত্বের ভেতর পড়ে। অবশ্য অহিংসা দিয়ে সামরিক শক্তিকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন অশোক। এই ঘটনার বিস্তারিত নিয়ে কিছু সন্দেহ আছে, অশোক সম্ভবত ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যাকে অতিরঞ্জিত করেছিলেন: মৌর্য সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ষাট হাজার, সুতরাং তারা কিভাবে এক লক্ষ কলিঙ্গীকে হত্যা করতে পেরেছিল বোঝা কঠিন। সুশৃঙ্খলিত বাহিনী ছিল বলে সাধারণত অযোদ্ধাদের হয়রানি করত না। অশোক সত্যিই দেশান্তরীদের কষ্টে এতটা বিষণ্ন হয়ে থাকলে কেন তবে তাদের স্রেফ পুনর্বাসিত করলেন না? হয়তো নিজের বিজয়ের ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে পরবর্তী বিদ্রোহ এড়ানোর চেষ্টা করে থাকবেন, নিশ্চিতভাবেই এরপর থেকে তিনি সব ধরনের যুদ্ধ পরিহার করেননি। অনেক সময় যুদ্ধ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়, স্বীকার করেছেন অশোক; এবং কখনওই সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেননি তিনি ৬৬ 

কিন্তু সম্ভবত তেমন কিছু আশা করাও বেশি হতো। এটা পরিষ্কার যে কলিঙ্গের সহিংসতা ও দুর্ভোগ দেখে সত্যিই ধাক্কা খেয়েছিলেন অশোক এবং ধম্ম ভিত্তিক নীতি চালুর চেষ্টা করেছিলেন। এই সময় নজীরবিহীন আকারের এক ভারতীয় রাজ্য শাসন করছিলেন তিনি। তাঁর অঞ্চলের দৈর্ঘ্য প্রস্থ জুড়ে পাহাড়ের বুক আর স্তম্ভে নিজের উদ্ভাবনী নীতিমালা খোদাই করে রেখেছিলেন। দর্শনীয় স্থানে রাখা হয়েছিল এসব লিপি এবং সম্ভবত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে জনগণের উদ্দেশ্যে জোরে পাঠ করা হতো। পশুর ছবিসহ খোদাই করা এবং বৌদ্ধধর্মীয় প্রতীক চাকা সদৃশ মোটিফসহ পালি ভাষায় লেখা ‘ঈশ্বরের প্রিয়জন এভাবে বলেছেন,’ দিয়ে শুরু হওয়া প্রতিটি লিপি অহিংসা ও নৈতিক সংস্কারের মানবীয় নীতিবাক্য প্রচার করেছে। এইসব ঘোষণার আওতা বিস্ময়কর: গ্রাম্পিয়ানস, ইতালি, জার্মানি ও জিব্রালটারে খোঁজ পাওয়া একই চেহারার হরফের সঙ্গে তুলনীয়।৬৭ 

অশোকের এ রকম একটি নীতি বাস্তবায়নযোগ্য ভাবার বাপারটি বোঝায় যে সমবেদনা ও অহিংসার অ্যাক্সিয়াল গুণ শক্ত শেকড় বিস্তার করেছিল যদিও কোনও রাজনীতিকের পক্ষে এগুলো কখনওই বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়নি। আশোক হয়তো আন্তরিকভাবেই সহিংসতা আরও সহিংসতা ছড়ায় এবং বিজয় কেবল পাল্টা আক্রমণের জন্ম দিতে পারে বলে বিশ্বাস করেছিলেন। তাঁর ধৰ্ম্ম বিশেষভাবে বুদ্ধধর্ম ছিল না, তবে মূল মতবাদের ধারার যেকোনও মানুষের কাছেই আবেদন রাখতে পারত। সম্ভবত তাঁর বিশাল রাজ্যের প্রজাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রণীত এমন একটি নীতি বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন অশোক। ধৰ্ম্ম বিশেষভাবে বুদ্ধ আনাত্তা (‘সত্তাহীনতা’) মতবাদ বা যোগ অনুশীলনের কথা উল্লেখ করেনি, তবে দয়া ঔদার্যের গুণের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে।৮ ‘ধৰ্ম্মের সঙ্গে…ধম্মের অংশগ্রহণকারী হওয়ার সঙ্গে তুলনা করার মতো কোনও উপহার হতে পারে না…,’ একাদশ প্রধান পাথরের ঘোষণায় খোদাই করেছিলেন অশোক। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে 

দাস ও ভৃত্যদের প্রতি ভালো ব্যবহার, মা এবং বাবার আনুগত্য, বন্ধু, পরিচিত আর আত্মীয়স্বজন, আর সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণদের প্রতি ঔদার্য আর জীবিত প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা। বাবা, ছেলে, বন্ধু, পরিচিতজন, আত্মীয়স্বজন আর পড়শীদের বলা উচিত, ‘এটাই ভালো, আমরাও তাই করব। একাজ করলে এই জগতে আর অন্য জগতে রয়েছে ধৰ্ম্মের উপহারের কল্যাণে অসীম উপকার। ৬৯ 

প্রজাদের উপর বুদ্ধধর্ম মত চাপিয়ে দেওয়া দূরে থাক, এই ঘোষণা জোর দিয়ে বলেছে যে, কোনওরকম ধর্মীয় বাড়াবাড়ি থাকতে পারবে না। ব্রাহ্মণরা বৈদিক ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যানকারী গৃহত্যাগীদের মতোই সমান শ্রদ্ধাযোগ্য। রাজা ‘উপহার ও স্বীকৃতি দিয়ে সকল গোত্র ও অতীন্দ্রিয়বাদী ও সাধারণ মানুষকে সম্মান জানান, ‘ বলছে দ্বাদশ প্রধান পাথুরে খোদাই লিপি। ‘বাকি সবার আবিশ্যিক মতবাদের প্রচারণা,’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউই অন্যের শিক্ষার অবমূল্যায়ন করতে পারবে না। এইভাবে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ বিকাশ লাভ করতে পারে। ‘সমন্বয়কে প্রশংসা করতে হবে, যাতে মানুষ একে অন্যের নীতিমালা শুনতে পারে। 

অশোক বাস্তববাদী ছিলেন। সহিংসতাকে নিষিদ্ধ করেননি তিনি; উদাহরণ স্বরূপ, বনচারীরা ঝামেলা শুরু করলে তা অনিবার্য হয়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। মৃত্যুদণ্ড পছন্দ রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সংসারে পশু-মাংস খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছিলেন অশোক, শিকার-নিষিদ্ধ পশু, পাখি ও মাছের তালিকা করেছিলেন। সাহসী পরীক্ষা ছিল এটা, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। তাঁর শাসনামলের শেষ দশ বছর নতুন কোনও খোদাই করাননি অশোক, হয়তো ইতিমধ্যেই তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২৩১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ধম্ম হারিয়ে যায়। সামাজিক টানাপোড়েন আর উপদলীয় কোন্দল দেখা দেয়, বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে সাম্রাজ্য। বলা হয়ে থাকে যে, অশোকের অহিংসার উপর অতিরিক্ত জোর দান সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেয় ও আগ্রাসনের প্রতি দেশকে নাজুক করে তোলে, কিন্তু অশোক কখনওই অহিংসাকে তত্ত্বে পরিণত করেননি। বরং এমনটাই হওয়া বেশি সম্ভব যে, সাম্রাজ্য স্রেফ এর সম্পদকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অশোক কখনও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাননি। বুদ্ধ ঐতিহ্যে তিনি সর্বজনীন রাজা চক্কবত্তী নামে পরিচিত, যাঁর শাসনামলে আইনের চাকা ঘুরেছিল। পরবর্তীকালের নেতৃবৃন্দ, যেমন শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক এবং মহাত্মা গান্ধী উপদলীয় ও সামাজিক বিভাজনকে অতিক্রম করে সমন্বয় ও ঐক্যের আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। 

অশোকের মৃত্যুর পর অন্ধকার যুগে পা রাখে ভারত। বেশ কিছু পরিমাণ দলিল টিকে গেলেও সিই ৩২০ সালের গুপ্ত রাজবংশের উত্থানের আগপর্যন্ত স্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এই কালপর্বে গড়ে ওঠা ও হারিয়ে যাওয়া রাজ্য ও রাজবংশ সম্পর্কে খুব সামান্যই জানতে পারি আমরা। তবে এটা জানি যে, বড় ধরনের আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল ভারত। এই সময় ভারতীয় ধর্ম ঈশ্বরবাদী হয়ে ওঠে ও মানুষ ঈশ্বরকে আবিষ্কার করে। মারাত্মকভাবে দেবতাদের ভূমিকা হ্রাস করে দেওয়া বেদ ও সন্ন্যাসীদের চড়া, প্রতিমাবিরোধী ধর্ম জাঁকালভাবে রঙিন মন্দির, বর্ণাঢ্য মিছিল, জনপ্রিয় তীর্থযাত্রা আর নানা বৈচিত্র্যময় দেবদেবীর প্রতিমার প্রতি ভক্তির হিন্দু অতিরঞ্জনের পথ খুলে দিয়েছিল। 

সম্ভবত চতুর্থ শতাব্দীর শেষদিকে সংকলিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ‘শাদা খচ্চরঅলা সাধুদের’ শিক্ষা থেকে এই পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণ লক্ষ করা যেতে পারে। প্রচলিত বৈদিক ধর্ম কখনওই তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল না। এমনকি তুঙ্গ অবস্থাতেও কেউই বিশেষ করে ইন্দ্র বা বিষ্ণু দেখতে কেমন ছিলেন তাতে আগ্রহী ছিল না। মূর্তি ও প্রতিমায় নয়, ভজন আর মন্ত্রেই ঈশ্বরকে অনুভব করত লোকে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ মূলত অতীন্দ্রিয়বাদী মতবাদ সামক্ষ্য যোগের শিক্ষায় প্রবলভাবে প্রভাবিত, তবে এখানে পরম বাস্তবতা ব্রাহ্মণকে ব্যক্তিরূপ রুদ্র/শিবের সঙ্গে একাত্ম করা হয়েছে এবং তিনিই যোগীকে সামসারার বেদনাদায়ক চক্র থেকে রক্ষা করবেন। এই মোক্ষ অর্জনের পর আলোকিত যোগী নিজের মাঝেই উপাস্যকে দেখতে পাবে। 

সম্ভবত সম্পূর্ণ নতুন উদ্ভাবন ছিল না এটা। বৈদিক ধর্ম উচ্চবিত্তদের হাতে অনুসৃত ও প্রচারিত হতো, কিন্তু এটা সম্ভব যে, সাধারণ উপাসকরা সবসময় ক্ষয়যোগ্য উপাদানে দেবতাদের প্রতিমা বানিয়েছে যা টেকেনি।১ অ্যাক্সিয়াল যুগের শেষদিকে সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার কাল থেকে টিকে থাকা এই জনপ্রিয় ধর্মবিশ্বাস সন্ন্যাসীদের ভিন্ন ধরনের অনুশীলনের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করেছিল। রিগ বেদে রুদ্র একেবারেই প্রান্তিক দেবতা ছিলেন; এবার স্থানীয় দেবতা শিবের সঙ্গে মিশে গেলেন তিনি, ব্রাহ্মণের অবতারে পরিণত হয়ে চলে এলেন সামনের কাতারে এবং যোগের অনুশীলনের ভেতর নিজেকে ভক্তদের কাছে প্রকাশকারী মহাবিশ্বের প্রভুতে পরিণত হলেন। প্রকৃতি ও সত্তার (আত্মা) শাসক প্রভুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যোগী সামসারার বন্ধন ছিন্ন করতে পারে: ‘ঈশ্বরকে যখন চিনতে পারে, তখন সকল বাঁধন থেকে মুক্তি পায়…তাঁকে ধ্যান করে তাঁর কাছে যাওয়ার প্রয়াস পেয়ে এবং আরও সামনে অবশেষে তাঁর মতো একই বাস্তবতায় পরিণত হয়ে সকল বিভ্ৰম ঘুঁচে যায়। সকল বিঘ্ন হারিয়ে যায় এবং মৃত্যুর মুহূর্তে সত্তা অখণ্ডণীয়ভাবে প্রভু রুদ্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। 

প্রভু কেবল দুর্জ্ঞেয় সত্তাই নন, বরং অনেকটা কাঠের ভেতর সুপ্তভাবে উপস্থিত থাকা আগুনের রূপের (মূর্তি) মতো: ফায়ার ড্রিল আগুন জ্বালিয়ে তোলার আগপর্যন্ত আমরা দেখতে পাই না। প্রভু আমাদের মাঝে তিলে লুকিয়ে থাকা তেলের মতো বা দইয়ের মাখনের মতো অবস্থান করেন। ধ্যান যোগীকে ‘ব্রাহ্মণের প্রকৃত সত্তার’ সঙ্গে সম্পর্কিত করে, যা আর নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা না থেকে বরং ‘অজন্ম, অপরিবর্তনীয়’ পর্বতচারী রুদ্রতে পরিণত হন।৩ তিনি এমনকি ‘যার যার মতো সকল সত্তায় সুপ্ত একাই গোটা মহাবিশ্বকে আবৃত করে থাকা ব্রাহ্মণের চেয়ে উচ্চতর।’৭৪ তারপরেও রুদ্র সত্তার মাঝে আত্মগোপনকারী। ‘বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান’। ধ্যান যোগীকে তার ব্যক্তিত্বের গভীরতর অঞ্চলে দেবতাদের বাস্তব রূপ (মূর্তি) দেখতে সক্ষম করে তুলেছে।৭৫ 

একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ঈশ্বরবাদী দর্শন গড়ে তুলতে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বেশ কিছু বিভিন্ন কর্মমুখী আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নিয়েছে: ব্রাহ্মণ ও আত্মা, পুনর্জন্ম ও মোক্ষের ধারণা, সামক্ষ্য, যোগ ও পবিত্র শব্দাংশ ওম-এর কীর্তনের উপনিষিদিয় ধারণা। এইসব নিরীশ্বরবাদী অনুশীলনকে স্রষ্টা ঈশ্বরের ইমেজের সথে মিলিয়েছে তা। পরবর্তী ধ্রুপদী হিন্দু মতবাদে এই সংশ্লেষ কেবল রুদ্র/শিব নয় বরং যেকোনও দেবতার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা সম্ভব এক নতুন ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলবে। ধ্যানে গম্য হয়ে ওঠার বাস্তবতার চেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রভুর নির্দিষ্ট পরিচয় কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যোগীর জানত যে, কতগুলো অধিবিদ্যিক প্রমাণের কারণে নয়, বরং তাঁকে দেখেছে বলেই এই দেবতার অস্তিত্ব আছে। 

শ্বেতাশ্বতরের একেবারে শেষ পঙক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন শব্দ আবিষ্কার করি আমরা। উপনিষদ ব্যাখ্যা করেছে যে, ‘যাহার অন্তরে ঈশ্বরের প্রতি প্রবল ভালোবাসা (ভক্তি) রহিয়াছে এবং যিনি তাঁহার গুরুর প্রতিও অনরূপ ভক্তি প্রদর্শন করেন’৭৬ কেবল এমন ব্যক্তির মাঝেই এখানে উল্লেখ করা মুক্তি দেখা দেবে। একটি ধর্মীয় বিপ্লব আসন্ন হয়ে উঠেছিল। উপনিষদের বিমূর্ত অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে নিজেদের বর্জিত বোধকারী লোকজন ও বিশ্বকে ত্যাগকারী সন্ন্যাসীরা তাদের জীবন ধারার সঙ্গে মানানসই এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে যাচ্ছিরলেন। অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্তর্দৃষ্টিতে অংশ নিতে চেয়েছেন তারা, কিন্তু তাদের প্রয়োজন ছিল অপেক্ষাকৃত কম বিমূর্ত ও ঢের বেশি মানসিক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ধর্ম। সুতরাং, উপাসকদের ভালোবাসেন, যত্ন নেন এমন এক দেবতার প্রতি ভক্তির (‘নিবেদন’) ধারণা গড়ে তুলেছিল তারা।৭৭ ভক্তির মূল কাজ ছিল আত্মসমর্পণ: ভক্তরা প্রভুকে বাধা দেওয়ার বদলে নিজেদের অসহায়ত্ব সম্পর্কে সজাগ হয়ে দেবতা তাদের সাহায্য করবেন বলে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। 

ভক্তি শব্দটি জটিল। কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে, ভারিজ: ‘বিচ্ছিন্নতা’ থেকে এসেছে এটা: লোকে ঈশ্বর ও নিজেদের ভেতরের বিরাট দূরত্ব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিল কিন্তু তাসত্ত্বেও যুগপৎ তাদের পছন্দের দেবতা ধীরে ধীরে নিজেকে নিজের সৃষ্ট মহাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে মখোমুখি তাদের সামনে এসেছেন। অন্য পণ্ডিতদের বিশ্বাস, এটা ভাজ-অংশ গ্রহণ, ভাগ নেওয়া-র সঙ্গে সম্পর্কিত, শ্বেতাশ্বতর যোগীরা যেভাবে প্রভু রুদ্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। এই পর্যায়ে ভক্তিতখনও শিশু অবস্থায় ছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট ছিল ভগবদ গীতা। তৃতীয় শতাব্দীর শেষদিকে এটি রচিত হয়েছিল বলে কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন। এটাই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছিল এবং অন্ধকার যুগে আবির্ভূত হিন্দু আধ্যাত্মিকতার গভীর প্রভাব সৃষ্টিকারী নতুন দিকে নিয়ে গিয়েছিল। 

ভগবদ-গীতা (‘প্রভুর সঙ্গীত’) হয়তো আদিতে ভিন্ন টেক্সট হয়ে থাকতে পারে, তবে কোনও এক পর্যায়ে একে মহাভারতের ষষ্ঠ খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পাণ্ডব ভাইদের মহান যোদ্ধা অর্জুন ও তাঁর বন্ধু কৃষ্ণের ভেতর কথোপকথনের রূপ নিয়েছে এটা। অর্জুনের বড় ভাই যুধিষ্ঠির যে ভীষণ যুদ্ধ এড়ানোর আশা করেছিলেন, তারই সূচনা ঘটতে যাচ্ছিল। সারথী হিসাবে কৃষ্ণকে নিয়ে রথের পাশে দাঁড়িয়ে সভয়ে রণক্ষেত্রের দিকে তাকিয়েছেন অর্জুন। গল্পের এই পর্যায়ের আগপর্যন্ত যুদ্ধের সম্ভাবনায় যুধিষ্ঠিরের চেয়ে কম অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তিনি। কিন্তু এখন যা ঘটতে যাচ্ছে তার বিশাল চেহারা দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেছেন। গোটা পরিবার নিজেদের বিরুদ্ধেই করুণভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাণ্ডবরা তাদেরই আত্মীয়স্বজনদের উপর হামলা করতে যাচ্ছেন। প্রাচীন শিক্ষা অনুযায়ী আপনজনের ঘাতক যোদ্ধা গোটা পরিবারকেই নরকে পৌঁছে দেয়। আপন সাহসী চাচাত ভাই আর প্রিয় গুরু বিষ্ণু ও দ্রোনকে হত্যার বদলে তিনি বরং রাজ্য ত্যাগ করবেন। নইলে অরাজকতা দেখা দেবে! সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। চাচাত ভাইদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী হলে আর কখনও সুখের দেখা পাবেন না তিনি, বাকি জীবন অমঙ্গল তাড়া করে ফিরবে পাণ্ডবদের। ‘রাজত্ব, আনন্দ আর গোটা জীবনেরই বা কি মূল্য থাকবে আমাদের কাছে?’ কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন তিনি।৮ নিরস্ত্র অবস্থায় ও কোনও প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে যুদ্ধে বরং প্রাণ হারানোই অনেক মহত্তের ব্যাপার হবে। 

যুদ্ধের সময় এই কথা বলে
রথের উপর এলিয়ে পড়লেন অর্জুন
তীর আর ধনুক নামিয়ে রাখলেন,
শোকে মূহ্যমান তাঁর মন।৭৯ 

ভগবদ-গীতা ধর্মীয় পরিবর্তনের মুহূর্ত চিহ্নিত করা অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম শেষ মহান টেক্সট। আমাদের কাহিনীর অনেক সময়ের মতোই সহিংসতার প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে একটি নতুন ধর্মীয় দর্শন অনুপ্রাণিত হয়েছিল। যুদ্ধের পক্ষে প্রচলিত সব যুক্তি তুলে ধরে অর্জুনের মনে সাহস যোগানোর চেষ্টা করেছেন কৃষ্ণ। আত্মা চিরন্তন, তাই আসন্ন যুদ্ধে যারা প্রাণ দেবে সেই সৈন্যরা আসলে মারা যাবে না, বলেছেন তিনি; যুদ্ধে নিহত সৈনিক সোজা স্বর্গে চলে যাবে। আসলে চাচাত ভাইদের বরং উপকারই করবেন অর্জুন। যুদ্ধ করতে অস্বীকার গেলে অর্জুনের বিরুদ্ধে কাপুরুতার অভিযোগ উঠতে পারে এবং তারচেয়ে মারাত্মক কথা তাতে ক্ষত্রিয় শ্রেণীর ধর্মের আবমাননা করবেন তিনি। যোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করা তার পবিত্র দায়িত্ব। দেবতারাই তাঁর কাছে এটা দাবি করছেন, মহাবিশ্বের ঐশী ব্যবস্থার দাবি এটা; সমাজেরও দাবি। ভাই যুধিষ্ঠিরের মতো ক্ষত্রিয় ধর্মের করুণ টানাপোড়েনে ভুগছিলেন অর্জুন। সম্রাট অশোক অহিংসতার আদর্শে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলেও নিজের সেনাবাহিনীকে ভেঙে দিতে পারেননি। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা যুদ্ধবিগ্রহের নিন্দা করতে পারেন, সন্ন্যাসীরা গোটা সমাজের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন, আশ্রয় নিতে পারেন বনে জঙ্গলে। কিন্তু কাউকে না কাউকে সম্প্রদায়কে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। সম্পূর্ণ দুর্ভাগ্যবশতঃ তার মানে দাঁড়াবে যুদ্ধ, কেবল আত্মরক্ষার খাতিরে হলেও। একজন যোদ্ধা কিভাবে বাধ্য হয়ে করা মন্দ কাজের প্রভাব সৃষ্টি না করে সমাজের প্রতি পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে পারবে? 

কৃষ্ণের প্রথম ধারার যুক্তিতে নতি স্বীকার করেননি অর্জুন। ‘আমি যুদ্ধ করব না!’ জোরের সঙ্গে বলেছেন তিনি।° এই মাত্রার যুদ্ধ অবশ্যই ভুল হতে বাধ্য। জাগতিক লাভের জন্যে রক্তপাত ঘটানো ঠিক হবে না। হয়তো তাঁর গৃহত্যাগীতেই পরিণত হওয়া উচিত? কিন্তু কৃষ্ণকে তিনি ভালোবাসেন, মরিয়া হয়ে তাঁরই শরণাপন্ন হয়ে সাহায্য কামনা করেছেন। অর্জুনের গুরু হতে রাজি হয়ে কৃষ্ণের কাঁধে মুক্তির সঙ্গে সকল জাগতিক কর্মকাণ্ড অসঙ্গতিপূর্ণ বলে বিশ্বাসী জৈন, বুদ্ধ এবং সন্ন্যাসীদের যুক্তি খণ্ডনের কঠিন দায়িত্বের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন কৃষ্ণ। কিন্তু এর মানে ছিল বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের কোনও মুক্তির উপায় নেই। ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রধান ত্রুটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন অর্জুন। কৃষ্ণ চেয়েছেন তিনি যেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটা খতিয়ে দেখেন, কিন্তু অন্যান্য মতবাদকে বাতিল করা সম্পূর্ণ নতুন শিক্ষা দেওয়ার বদলে প্রাচীন আধ্যাত্মিক অনুশীলনের সঙ্গে ভক্তির নতুন ধারণার সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন তিনি। 

কৃষ্ণ প্রস্তাব রাখলেন যে, ভিন্ন ধরনের যোগের অনুশীলন করবেন অর্জুন: কর্ম-যোগ। এক ভয়ঙ্কর পরামর্শ দিলেন তিনি: এমনকি ভয়ঙ্কর যুদ্ধরত একজন যোদ্ধাও মোক্ষ লাভ করতে পারে। এটা অর্জনের জন্যে নিজের কর্মের তাৎপর্য-এই ক্ষেত্রে যুদ্ধ, এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনের মৃত্যু-থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হবে। যেকোনও যোগীর মতো একজন কর্মী (কর্ম) পুরুষকে অবশ্যই আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিতে হবে। নিজেকে সামরিক অভিযান থেকে আসা খ্যাতি, সম্পদ বা ক্ষমতার প্রতি লালায়িত হতে দিতে পারবে না সে। খোদ কর্মসমূহ নয় বরং এইসব কাজের পরিণতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাই মানুষকে পুনর্জন্মের অন্তহীন পালার সঙ্গে বেঁধে রাখে। যোদ্ধাকে অবশ্যই ঠিক যোগীর মতোই বিচ্ছিন্নতা দেখিয়ে ব্যক্তিগত লাভের আশা ছাড়াই দায়িত্ব পালন করতে হবে : 

কাজের ফলের উপর নয়;
কাজের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে,
পরিণতির প্রতি এবং নিষ্ক্রিয়তার প্রতি
আকর্ষণ পরিহার করো! 

কর্মে তৎপর হও, শৃঙ্খলায় দৃঢ় থাকো;
সাফল্য ও ব্যর্থতায় নিরপেক্ষ থাকো-
এই প্রশান্তিকেই বলে শৃঙ্খলা। ৮১ 

কিন্তু প্রলোভেন ও আকাঙ্ক্ষা মানবীয় চেতনায় গভীরে প্রোথিত, তাই কেবল যোগের অনুশীলনের ভেতর দিয়েই যোদ্ধা তার অহমকে স্থানচ্যুত করার মতো নিরপেক্ষতার ধাপ অর্জন করতে পারে। নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্যে যোদ্ধাকে অবশ্যই তার কাজ থেকে ‘আমি’ ও ‘আমার’-কে দূর করে দিতে হবে। একবার তা অর্জন করতে পারলে সত্যিকার অর্থে ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়বে সে, কারণ ‘সে’ আর তখন যুদ্ধে অংশ নেবে না: ‘সবসময় সন্তুষ্ট, স্বাধীন; এবং কখনওই, এমনকি কর্মে তৎপর হলেও সে আসলে কিছুই করে না।৮২ ক্ষত্রিয়র দায়িত্ব ছিল; তার পক্ষে স্রেফ বনে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু কর্মযোগ চর্চার ভেতর দিয়ে আসলে এমনকি জগতে বাস করে বেঁচে থাকার সময়ও এ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেবে সে। অর্জুনকে প্রচলিত যোগ অনুশীলনের শিক্ষা দিয়েছেন কৃষ্ণ, কিন্তু তাঁর প্রস্তাবিত ধ্যান ক্ষত্রিয়দের জন্যে বিশেষভাবে প্রণীত ছিল, যাদের পক্ষে প্রতিদিন ধ্যানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো সম্ভব ছিল না। পেশাদার অতীন্দ্রিয়বাদীদের জন্যে আরও কষ্টকর পরিশ্রম সাপেক্ষ ধ্যানের প্রক্রিয়া ছিল, কিন্তু কর্মযোগ জাগতিক দায়িত্ব আছে এমন নারী বা পুরুষের পক্ষে পালনযোগ্য। প্রচলিত যোগ কখনও একজন দেবতার প্রতি কেন্দ্রীভূত ছিল না, কিন্তু কর্মযোগ ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ যোগীকে রুদ্র/শিবের প্রতি মনোযোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছে, কিন্তু কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন যে তাঁকে অবশ্যই বিষ্ণুর নামে ধ্যান করতে হবে। 

কৃষ্ণের কাছে অর্জুনের জন্যে বিস্ময়ের বস্তু ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, তিনি, অর্থাৎ কৃষ্ণ, কেবল বিষ্ণুর ছেলেই নন, আসলে মানবরূপী দেবতা স্বয়ং। যদিও ‘অজন্ম, অমৃত্যু, সৃষ্টির প্রভু,’ বিষ্ণু বহুবার মানুষের চেহারায় মর্ত্যে নেমে এসেছেন। বিষ্ণু মহাবিশ্বের স্রষ্টা, একে অস্তিত্ববান রেখেছেন তিনি, কিন্তু যখনই মারাত্মক সংকট দেখা দেয়- যখনই পবিত্র দায়িত্বের পচন ঘটে, আর বিশৃঙ্খলা রাজত্ব করে’-নিজের জন্যে এক পার্থিব রূপ তৈরি করেন তিনি, নেমে আসেন মর্ত্যো: 

গুণবান ব্যক্তিদের রক্ষার জন্যে
আর দুর্বৃত্তদের ধ্বংস করতে
পবিত্র দায়িত্বের মানদণ্ড স্থাপন করতে,
আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই। ৮৪ 

বিস্ময়কর বার্তা জানানোর পর এবার ভক্তির নিবেদন সম্পর্কে অর্জুনের সঙ্গে আরও খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারছিলেন কৃষ্ণ। অর্জুন নিজেকে কিভাবে খোদ কৃষ্ণকে অনুকরণের ভেতর দিয়ে অহম কেন্দ্রিক আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন। মহাবিশ্বের প্রভু ও শাসক হিসাবে কৃষ্ণ/বিষ্ণু অবিরাম সক্রিয় ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাজ (কর্ম) তাঁকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি: 

এইসব তৎপরতা আমাকে বন্দী করেনি
কারণ আমি বিচ্ছিন্ন ছিলাম
আমার সকল কাজে, অর্জুন,
যেন ওসব থেকে দূরে সরে ছিলাম আমি। ৮৫ 

কিন্তু কৃষ্ণকে অনুকরণ করতে চাইলে অর্জুনকে ঐশ্বরিকতার প্রকৃতি উপলব্ধি করতে হবে; কৃষ্ণ/বিষ্ণুর প্রকৃত রূপ দেখতে হবে। 

ঠিক রণক্ষেত্রেই অর্জুনের কাছে তাঁর ঐশী প্রকৃতির উন্মোচন ঘটালেন কৃষ্ণ, সকল বস্তু যার কাছে ফিরে যেতে বাধ্য সেই স্রষ্টা ও বিনাশী বিষ্ণু দেবতা হিসাবে বন্ধুর চিরন্তন রূপ দেখে বিহ্বল হয়ে গেলেন অর্জুন। গোটা মহাবিশ্বকে ধারণ করা স্বর্গীয় আভায় কৃষ্ণকে বদলে যেতে দেখলেন তিনি। ‘আপনার দেহে সকল দেবতাকে প্রত্যক্ষ করছি আমি!’ চেঁচিয়ে উঠেছেন তিনি। 

আপনার সীমাহীন আকৃতি সর্বত্র
দেখতে পাই,
অগুনতি বাহু,
পেট, মুখ, আর চোখ;
সকলের প্রভু,
আপনার সমগ্রে
আমি কোনও অন্ত
বা মধ্যম বা সূচনা
দেখি না। ৮৬ 

কৃষ্ণের দেহে সমস্ত কিছু-মানবীয় বা স্বর্গীয়-স্থান পরিপূর্ণ করে রাখা এবং নিজের ভেতর সম্ভাব্য সব উপাস্যের রূপ ধারণকারী উপস্থিত: ‘গর্জন তোলা ঝড়ের দেবতা, সূর্য দেবতা, উজ্জ্বল দেবতা আর আচারের দেবতা।’ কিন্তু কৃষ্ণ/বিষ্ণু আবার মানবজাতির মূল সত্তা ‘পুরুষের ক্লান্তিহীন আত্মাও।৮৭ নদী যেভাবে ছুটে চলে সাগরের দিকে আর মথ পোকা অনিবার্যভাবে আকৃষ্ট হয় অগ্নিশিখার প্রতি, ঠিক সেভাবে সবকিছু তাঁর দিকে ধেয়ে যায়। দেবতার জ্বলন্ত মুখের দিকে ধেয়ে যাওয়া পাণ্ডব আর কৌরব যোদ্ধাদেরও দেখলেন অর্জুন। 

অর্জুন ভেবেছিলেন কৃষ্ণকে আপাদমস্তক চেনেন তিনি, কিন্তু এখন, কে আপনি?’ বিস্ময়ে আর্তনাদ করে উঠেছেন। ‘আমি পরিণতি লাভকারী সময়, ‘ জবাব দেন কৃষ্ণ-সময়, যা বিশ্বকে গতি দিয়েছে এবং তাকে ধ্বংসও করেছে। কৃষ্ণ/বিষ্ণু চিরন্তন; ইতিহাসের প্রক্রিয়াকে অতিক্রম করে যান তিনি। বিধ্বংসী হিসাবে কৃষ্ণ/বিষ্ণু ইতিমধ্যে এখন আপাত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া সেনাবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন, যদিও অর্জুনের মানবীয় দৃষ্টিকোণে যুদ্ধ এখনও শুরুই হয়নি। পরিণতি নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়। মহাবিশ্বকে অস্তিত্ববান রাখার স্বার্থে একের পর আরেকটি যুগকে আসতেই হবে। পাণ্ডব ও কৌরবদের যুদ্ধ বীরের যুগের অবসান ঘটাবে, উদ্বোধন ঘটাবে এক নতুন ঐতিহাসিক মহাকালের! ‘এমনকি তোমাকে বাদ দিয়েও,’ অর্জুনকে বলছেন কৃষ্ণ, ‘বৈরী সারিতে বিন্যস্ত এইসব সৈন্য অস্তিত্ব হারাবে।’ 

এরা ইতিমধ্যে
আমার হাতে নিহত হয়েছে।
আমার সরঞ্জামে পরিণত হও,
আমার পাশে তীরন্দাজ। ৮৮

সুতরাং অর্জুনকে অবশ্যই যুদ্ধে নেমে জগতে ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিজের ভূমিকা রাখতেই হবে। 

এক বিভ্রান্তিকর দর্শন ছিল এটা। কৃষ্ণের শিক্ষাকে যেন মানবজাতিকে তাদের সবরকম ধ্বংসলীলার দায়-দায়িত্ব থেকে নিস্তার দিয়েছে বলে মনে হয়েছে। অসংখ্য রাজনীতিক ও যোদ্ধা জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁরা স্রেফ নিয়তির হাতের পুতুল, এবং একে তাদের ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ডকে ন্যায্য প্ৰতিপন্ন করার কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু অল্প কয়েকজন নিজেদের ব্যক্তিগত লাভ হতে শূন্য করেছেন, কৃষ্ণ যাকে অনিবার্য বলে জোর দিয়েছেন। যোদ্ধা-যোগীর শৃঙ্খলিত কর্মই কেবল বিধ্বংসী বিশ্বে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে। কৃষ্ণকে করুণাহীন মনে হয়, কিন্তু তারপরেও অর্জুনকে বলেছেন, তিনি ত্রাতা দেবতা, তাঁকে যারা ভালোবাসে কর্মের অশুভ ফল থেকে তাদের উদ্ধার করতে পারেন তিনি। কেবল ভক্তির লোকজনই কৃষ্ণের প্রকৃত রূপ দেখতে পারে এবং এই ভক্তির জন্যে প্রয়োজন সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ: 

কেবল আমারই জন্যে কাজ করা,
আমার উপর আকাঙ্ক্ষা করা
সংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত
কোনও সৃষ্টির প্রতি বৈরী নয়, অর্জুন,
ভক্তিপূর্ণ লোকই আমার
কাছে আসতে পারে। ৮৯

বিচ্ছিন্নতা ও নিরপেক্ষতা ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ যা জীবনের সকল দুর্ভোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে।৮৯ ভগবদ-গীতা সম্ভবত অন্য যেকোনও ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রের তুলনায় প্রভাবশালী ছিল। বোধগম্যতাই ছিল এর সবচেয়ে বড় গুণ। অন্যান্য আধ্যাত্মিকতা যেখানে অল্প কিছু মেধাবী, সাহসী অতীন্দ্রিয়বাদীর কাজে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে এই ধর্মটি ছিল সবার। খুব অল্প সংখ্যক মানুষেরই যোগে আত্মনিবেদন করার মতো সময় ও সুযোগ ছিল। কিন্তু ‘আমার উপর তারা নির্ভর করলে, অর্জুন,’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কৃষ্ণ, ‘নারী, বৈশ্য, শুদ্র, এমনকি শয়তানের পেটে জন্ম নেওয়া পুরুষও সর্বোচ্চ পথে পৌঁছাতে পারে।৯১ যে কেউই প্রভুকে ভালোবাসতে ও অনুকরণ করতে পারে, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ দায়িত্বের স্বার্থপরতাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। এমনকি একজন যোদ্ধা যার ধর্ম তাকে হত্যা করতে বাধ্য করে, সেও কর্মযোগের অনুশীলন করতে পারে। মহান দিব্যদর্শনের পর কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করলেন যে, গোটা জাগতিক বিশ্বই এক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে মরণশীল সত্তাগুলো বিচ্ছিন্নতা, বিনয়, অহিংসা, সততা এবং আত্মসংযমের অস্ত্রে আলোকনের জন্যে সংগ্রাম করে চলেছে ।৯২ ভগবদ-গীতা অ্যাক্সিয়াল যুগের আধ্যাত্মিকতাকে উপেক্ষা করেনি, বরং তাকে সকলের অনুশীলনযোগ্য করে তুলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *