৭. সবার প্রতি সহমর্মিতা (c. ৪৫০–৩৯৮)

. সবার প্রতি সহমর্মিতা (সি. ৪৫০ থেকে ৩৯৮ বিসিই

ইসরায়েলে অ্যাক্সিয়াল যুগ সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পঞ্চম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের দিকে পারস্য সাম্রাজ্যের অজানা কোণে নেহাতই ছোট, ক্ষতিগ্রস্ত একটি নগরী ছিল জেরুসালেম। সাধারণত পরিবর্তন ও উন্নয়নের পুরোধা এমন সব অঞ্চলেই মহা পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাতে নিদারুণ নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ইসরায়েল ও জুদাহ, কিন্তু এই সাম্রাজ্যগুলো প্রসারিত দিগন্ত ও বিস্তৃত জগতের ধারণা নিয়ে এসেছিল। আঞ্চলিক রাজধানী বাবিলনে তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছেছিল ইসরায়েলের অ্যাক্সিয়াল যুগ। জেরুসালেমে ফিরে আসা নির্বাসিতরা আর বিশ্ব ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রে ছিল না, বরং লোকচক্ষুর আড়ালেই বাস করছিল; নতুন ধর্মীয় দর্শনের অনুসন্ধানের চেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ইসায়ার কিছু অধ্যায় দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পরবর্তী সময়ে সম্প্রদায়ের চিন্তাভাবনার কথা প্ৰকাশ করে থাকতে পারে। দ্বিতীয় ইসায়ার পুরোনো স্বপ্ন মরে যায়নি। লোকে তখনও ইয়াহওয়েহ জেরুসালেমে ‘একটি নতুন স্বর্গ ও নতুন পৃথিবী’ গড়ে তুলবেন বলে আশায় ছিল, যেখানে কোনও কষ্ট থাকবে না এবং অতীতের দুঃখ বিস্মৃত হবে। অন্যরা সেই সময়ের প্রত্যাশায় ছিল যখন ঈশ্বরের শহরের তোরণ উন্মুক্ত হয়ে সকলকে-অস্পৃশ্য, বিদেশী ও খোঁজাদের-স্বাগত জানাবে, কারণ ইয়াহওয়েহ ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার আবাস হইবে সকল জাতিগণের প্রার্থনার মন্দির’। একদিন তিনি এইসব বহিরাগতকে নগরের অভ্যন্তরে নিয়ে আসবেন, এবং যায়ন পাহাড়ে তাঁর নামে উৎসর্গ করার অনুমতি দেবেন তাদের। কিন্তু আসলে আরও কঠোর বর্জনবাদী প্রবণতা অ্যাক্সিয়াল যুগের অবসান ঘোষণা করেছিল। 

৪৪৫ সালের দিকে পারসিয় প্রতিনিধি হিসাবে জেরুসালেমে একজন নতুন গভর্নরের নিয়োগ দেওয়া হয়। পারস্যের রাজধানী সুসার ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য নেহেমিয়া রাজা প্রথম আর্তাযারজিসের রাজপরিচারক ছিলেন। জেরুসালেমের প্রাচীর তখনও বিধ্বস্ত রয়ে গেছে শুনে বিস্মিত হয়ে রাজার কাছে জুদাহয় গিয়ে পূর্ব-পুরুষের শহর পুনর্নির্মাণের অনুমতি কামনা করেছিলেন তিনি। ছদ্মবেশে এখানে হাজির হয়ে গোপনে ‘তোরণে ফোকর আর পোড়া দাগসহ প্রাচীন বিরান দুর্গ দর্শনে গেছেন। এক পর্যায়ে ঘোড়া নিয়ে ভেতরে যাওয়ার পথ পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরদিন প্রবীণদের কাছে নিজের পরিচয় খুলে বলার পর নাগরিকরা ব্যাপক সমবেত প্রয়াসে মাত্র বায়ান্ন দিনে শহরের জন্যে একটি নতুন প্রাচীর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রত্যাবসিত দেশান্তরী গোলাহ ও তাদের পড়শীদের ভেতর সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটেছিল যে, কাজটা বিপজ্জনক ছিল। গোটা মিশন জুড়ে নেহেমিয়াকে স্থানীয় কিছু রাজবংশের অটল বিরোধিতা সামাল দিতে হয়েছে: পুরোনো উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের এলাকায় সামেরিনার গভর্নর সানবাল্লাত; তাঁর একজন কর্মকর্তা তোবিয়া; এবং ইদোমের গভর্নর গারশন। ভীতি ও টানাপোড়েনের ভেতর তৈরি হয়েছিল নতুন প্রাচীর: ‘প্রত্যেকে এক হাতে অস্ত্র ধরিয়া রাখিয়া অপর হাতে তাহার কর্ম সম্পাদন করিয়াছে। এবং প্রত্যেক নির্মাণ শ্রমিকই দেহের পাশে তাহার তলোয়ার প্রস্তুত অবস্থায় কাজ করিয়া গিয়াছে। 

এই সময় কালের সঠিক দিন-তারিখ স্থির করা বেশ কঠিন। পরে কোনও এক সম্পাদক কর্তৃক মেলানোর প্রয়াস পাওয়া কিছু সম্পর্কহীন দলিলের সম্মিলন এযরা ও নেহেমিয়া পুস্তকই আমাদের প্রধান উৎস। এযরা ও নেহেমিয়া সমসাময়িক ছিলেন বলে ধরে নিয়েছিলেন তিনি এবং এযরাকেই আগে জেরুসালেমে এনেছেন। কিন্তু আসলে এযরার মিশনকে আরও পরে, দ্বিতীয় আর্তাযারজিসের আমলে জায়গা দেওয়ার পেছনে সঙ্গত কারণ আছে। নগরের ভাগ্য ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন নেহেমিয়া। শহরের জনসংখ্যা দশ হাজারে বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি এবং অভিজাত গোষ্ঠীর হাতে দরিদ্র জনসাধারণের শোষণ রোধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, জেরুসালেমে তাঁর প্রথম তৎপরতা ছিল প্রাচীর নির্মাণ। ৪৩২ সালে সূচিত ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে নেহেমিয়া গোলাহর সদস্যদের স্থানীয় জনসংখ্যার সদস্যদের সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধ করে আইন জারি করেন, এমনকি যেসব ইসরায়েলি অভিবাসন করেনি তাদেরও। সানবাল্লাতের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন বলে প্রধান পুরোহিত এলিয়াশিবকে বরখাস্ত করেন তিনি। নির্বাসনে পুরোহিতদের কেউ কেউ এককালে ইসরায়েলি পরিবারের সদস্য ছিল কিন্তু এখন আগন্তুক ও শত্রু বিবেচিত হচ্ছে এমন কাউকে বিয়ে নিষিদ্ধ করেছিলেন। 

নির্বাসন কালে সাধারণ মানুষকে পুরোহিতদের পবিত্রতার বিধি অনুসরণে উৎসহিত করা হয়েছিল, তার মানে ছিল সাধারণ ইহুদিদের শাস্ত্রজ্ঞদের কাছে আচরিক আইনের দীক্ষা নিতে হবে। এযরা ছিলেন তাদের একজন, যিনি মোশির ব্যবস্থায়, ইস্রায়েলের ঈশ্বর সদাপ্রভুর ব্যবস্থায়, ব্যুৎপন্ন অধ্যাপক ছিলেন, এবং তাহার উপরে তাহার ঈশ্বর সদাপ্রভুর হস্ত থাকায় রাজা তাহার সমস্ত বাঞ্ছিত বিষয় তাহাকে দিয়াছিলেন। পারস্য দরবারের ইহুদি বিষয়ক মন্ত্রীও থেকে থাকতে পারেন তিনি। পারস্যবাসীরা এই সময় প্রজাদের বিধিবিধান সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মানানসই কিনা নিশ্চিত হতে সেগুলো খতিয়ে দেখছিল। বাবিলোনিয়ার আইন বিশেষজ্ঞ হিসাবে তোরাহ ও পারস্য আইনি ব্যবস্থার একটি সন্তোষজনক মোদাস ভিভেন্দি বের করে থাকবেন এযরা। জেরুসালেমে তোরাহ জারি করে একে দেশের সরকারী বিধানে পরিণত করাই ছিল তাঁর মিশন। বাইবেলিয় লেখক এযরার মিশনকে তাঁর জাতির ইতিহাসের বাঁক বদলকারী ঘটনা হিসাবে দেখেছেন: এযরার জুদাহ যাত্রাকে নতুন অভিবাসন হিসাবে তুলে ধরেছেন তিনি, এযরাকে নতুন মোজেস হিসাবে বর্ণনা করেছেন। জেরুসালেমে পৌঁছানোর পর তাঁর আবিষ্কারে ভীত হয়ে ওঠেন এযরা। পুরোহিতরা তখনও আম হা-আরেত-দের সঙ্গে শলাপরামর্শ করছেন, লোকেরা বিদেশীদের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করছিল। জেরুসালেমবাসীরা গোটা একটা দিন প্রবল হতাশায় রাজার দূতকে গভীর শোকের ভঙ্গিতে রাস্তায় বসে মাথার চুল ছিঁড়তে দেখেছে। তারপর গোলাহর সব সদস্যকে এক সভায় ডাকেন তিনি: কেউ হাজির হতে অস্বীকার করলে তাকে সমাজচ্যুত করা হবে, তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। 

নববর্ষের দিনে জল দ্বারের সামনের চত্বরে তোরাহ হাতে হাজির হলেন এযরা; একটা কাঠের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নেতৃস্থানীয় নাগরিকদের ঘেরাওয়ের ভেতর জনতার উদ্দেশে পাঠ করলেন তিনি, পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা করে চললেন। আমরা জানি না আসলে কোন টেক্সট পড়েছিলেন তিনি, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই জনতার কাছে দারুণ একটা ধাক্কা ছিল সেটা। ধর্মীয় সত্যি লিখিত অবস্থায় পড়া হলে ভিন্ন রকম শোনায়। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল জনতা, ইয়াহওয়েহর ধর্মের চাহিদা জেনে রীতিমতো বাকরহিত হয়ে গেছে তারা। এযরা তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, এটা এক উৎসবের কাল, আনন্দ করার উপলক্ষ্য, ইসরায়েলিদের যেখানে বুনো এলাকায় পূর্ব পুরুষের চল্লিশ বছর ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি চারণ করে সুক্কোথের মাসে বিশেষ কুঁড়েয় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেই টেক্সট পাঠ করে শুনিয়েছেন তিনি। লোকেরা জলপাই, মুর্দ, পাইন আর পামের ডাল খুঁজে আনতে বনে ছুটে গেছে, এবং অচিরেই পাতার ছাউনী দেওয়া খুপরিতে ভরে গেছে সারা শহর। উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল: রোজ সন্ধ্যায় এযরার মুখে বিধান শুনতে লোকজন সমবেত হতে লাগল। 

পরের অধিবেশন ছিল আরও ভাবগম্ভীর এক উপলক্ষ্য। মন্দিরের সামনের চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় সেটা, মুষলধারে বৃষ্টিতে শহর ভেসে যাওয়ার সময় লোকে কম্পিত শরীরে শুনে গেছে। এযরা বিদেশী স্ত্রীদের ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলেন তাদের, ফলে নারী ও শিশুদের গোলাহ থেকে বহিষ্কার করে আম হা- আরেতযে যোগ দিতে পাঠানো হলো। এখন যারা বাবিলনে নির্বাসিত হয়েছিল আর যারা তোরাহর কাছে নিজেদের সমর্পণে রাজি ছিল তাদের ভেতর ইসরায়েলের সদস্যপদ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। সমাজচ্যুতদের বিলাপ সম্ভবত ইসায়ার পুস্তকে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে: 

আব্রাহাম আমাদিগকে জানেন না
ও ইস্রায়েল আমাদিগকে স্বীকার করেন না,
তথাপি তুমি সদাপ্রভু আমাদের পিতা…
তুমি যাহাদের উপর কখনও কর্তৃত্ব কর নাই,
ও তোমার নাম যাহাদের উপর কীর্তিত হয় নাই। ১০

দুঃখকষ্ট ও আধিপত্য অন্যান্য এলাকায় বিকশিত হতে থাকা অ্যাক্সিয়াল যুগের চেতনার পরিপন্থী এক ধরনের আত্মরক্ষামূলক বর্জনবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। 

কিন্তু সেই বৃষ্টিভেজা শীতল দৃশ্যই গল্পের শেষ ছিল না। এযরা ও নেহেমিয়ার পুস্তক হিব্রু বাইবেলের অতি ক্ষুদ্র অংশ ধারণ করেছে। অনেকেই এগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক ছিল, কিন্তু এটাই একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে সম্পাদকদের হাতে বাইবেল সংকলিত হয়েছে এবং ইসরায়েল ও জুদাহর অধিকতর অন্তর্ভুক্তিবাদী ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। কোনও মানব সন্তানই পরিচ্ছন্ন নয় বলে জোরাল মত প্রকাশকারী P-র ঐতিহ্যসমূহ পেন্টাটিওকের প্রথম তিনটি পুস্তকে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং ডিউটেরোনমিস্টদের অধিকতর বর্জনবাদী দর্শনকে সীমিত করেছে। অন্যান্য পুস্তক ইহুদিদের রাজা ডেভিড মোয়াবের নারী রুথের বংশধর হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। জোনার পুস্তক ইয়াহওয়েহ কর্তৃক একজন হিব্রু পয়গম্বরকে অসিরিয় সাম্রাজ্যের রাজধানী নিনেভেকে রক্ষা করতে বাধ্য করতে দেখিয়েছে, যে সাম্রাজ্য ৭২২ সালে ইসরায়েল রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল। জোনা ঈশ্বরের কাছে প্রতিবাদ করলে ইয়াহওয়েহ এমন ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন যা অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্য অনেক সাধুই-বিশেষ করে জৈনরা-সমর্থন করতেন: ‘তবে আমি কি নবীর প্রতি, ঐ মহা নগরের প্রতি দয়ার্দ্র হইব না? তথায় এমন এক লক্ষ বিংশতি সহস্রের অধিক মনুষ্য আছে, যাহারা দক্ষিণ হস্ত হইতে বাম হস্তের প্রভেদ জানে না; আর অনেক পশুও আছে। ১১ 

ইসরায়েলের অ্যাক্সিয়াল যুগের প্রথম পর্যায়ের অবসান ঘটেছিল, কিন্তু শেষ অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, দ্বিতীয় বিকাশ উপভোগ করবে তা: রাব্বিনিক ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলামসহ সবই ইসরায়েলের অ্যাক্সিয়াল দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে এবং স্বর্ণ বিধি ও ‘আত্মসমপর্ণে’র আধ্যাত্মিকতা, সমবেদনা ও সকলের জন্যে উদ্বেগের ভিত্তিতে ধর্মবিশ্বাস সৃষ্টি করবে। 

.

পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পা রাখার সময় নগরের কিছু আপাত সাফল্য সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রবীণ অ্যাথেন্সবাসীরা অনিশ্চয়তার বোধে আক্রান্ত ছিল। পোলিসকে ক্ষমতার শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন পেরিক্লেস। অ্যাক্রোপলিসের নতুন দালানকোঠা ছিল বিজয়ের চিহ্ন; বিস্ময়কর সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন ভাস্কররা এবং মহান ট্র্যাজিডি রচয়িতারা সিটি দিওনিসিয়ায় তাঁদের মাস্টারপিস উপস্থাপন করে চলছিলেন। ৪৪৬ সালে অ্যাথেন্স ও ক্ষমতার দেশ স্পার্টা হেলেনিক বিশ্বকে নিজেদের ভেতর ভাগ করে নিয়ে তিরিশ বছর মেয়াদী এক শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয়: অ্যাথেন্স এজিয়ান নিয়ন্ত্রণ করবে আর ক্ষমতার দেশ স্পার্টা পেলোপোনেসাস দখলে রাখবে। শান্তি ও উন্নতির একটা কালের কথা ভাবতে পারছিল অ্যাথেন্স, কিন্তু তারপরেও নগর ও পিরায়াস বন্দর ঘিরে ফেলে প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন পেরিক্লেস। অনেক অ্যাথেন্সবাসীই তখনও অধীনস্থ পোলিসগুলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনে অসন্তুষ্ট থাকায় নিজেদের নাজুকতা সম্পর্কে বিষণ্ণভাবে সজাগ ছিল। ৪৪৬ সালে বোয়েতিয়ায় দারুণ ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল তারা; দেলিয়ান লীগ থেকে বিভিন্ন শহর বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়াস পেয়েছে, সামোস নিয়ে যুদ্ধ হয়েছে, পারস্যবাসীরা এখানে হস্তক্ষেপ করার হুমকি দিয়েছিল। প্রধান বিশ্ব শক্তি নয়, বরং স্রেফ ছোট, অতিপ্রসারিত নগর-রাষ্ট্র ছিল অ্যাথেন্স। কিভাবে চল্লিশ হাজার যোদ্ধা গোটা গ্রিস বিশ্বকে শাসন করতে পারে? কিন্তু তরুণ প্রজন্ম এটা উপলব্ধি করতে পারেনি। ম্যারাথনের যুদ্ধের পর জন্মগ্রহণ করায় কেবল সহজ সাফল্যের কথাই জানত তারা। ষাট বছর বয়সী পেরিক্লেসের প্রতি অধৈর্য হয়ে উঠছিল তারা, ৪৩০-র দশকে নগরে ছড়িয়ে পড়া নতুন নতুন সব ধারণায় কান দিতেই বেশি তৈরি ছিল। 

।বুদ্ধিবৃত্তিক জোরাল পরিবর্তনও ঘটেছিল এই বছরগুলোয়। দার্শনিকদের কর্মকাণ্ড ক্রমবর্ধমানহারে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠায় তাঁদের নিয়ে লোকে হতাশ, এমনকি হতবাক হয়ে উঠছিল। পারমেনাইদসের শিষ্য যেনো (সি. ৪৯০) বেশ কিছু স্ববিরোধী চতুর বাণী তৈরি করে গুরু পারমেনাইদসের বিতর্কিত ধারণাগুলোকে ন্যায্য প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আমাদের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণ সত্ত্বেও পারমেনাইদেস সবকিছুই অনড় বলে দাবি করেছিলেন। উড়ন্ত তীর আসলে গতিহীন উদাহরণ দিয়ে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যেনো। প্রতি সেকেন্ড তার আকারের সমান একটি নির্দিষ্ট স্থান দখল করে থাকে সেটা, তাই সেটা যেখানেই থাকুক না কেন সবসময়ই স্থির। চলমান কিছু যেখানে আছে সেখানেও নড়ে না আবার যেখানে নেই সেখানেও নড়ে না।১২ আবার যেনো যুক্তি দেখান যে অন্য যেকারও চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন অ্যাচিলিসের পক্ষে প্যানাথেনিয়ার দৌড় শুরু করাই আসলে অসম্ভব ছিল: গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে অর্ধেক দূরত্ব পেরুতে হতো তাঁকে; সেই জায়গায় পৌঁছানোর আগে চার ভাগের এক ভাগ জায়গা পেরুতে হতো। কিন্তু এই ধারার চিন্তা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলতে পারে: অ্যাচিলিস যে কোনও পরিমাণ দূরত্ব পেরুনোর আগে তাঁকে তার অর্ধেক পথ পেরুতেই হতো।” সুতরাং গতি সম্পর্কে স্থির মস্তিষ্কে কথা বলা অসম্ভব, তো পারমেনাইদেসের পরামর্শ মোতাবেক এ নিয়ে একেবারে কিছু না বলাই শ্রেয়। 

কাণ্ডজ্ঞানের অসাম্ভব্যতা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যেনো এবং এমনভাবে গতিকে এক অর্থে অটলতার ধারা বলে আবিষ্কার করেছিলেন যা পরবর্তীকালের দার্শনিকদের বিমুগ্ধ করবে। আমরা যেমন দেখব, চীনা যুক্তিবিদরা অনেকটা একইরকম হেঁয়ালি তৈরি করবেন। কিন্তু যেনোর বহু সমসাময়িক যুক্তি নিজেকেই হেয় করছে বলে বুঝতে পেরেছিলেন। সত্যি গঠন করা অসম্ভব হলে এইসব আলোচনার কি মানে থাকতে পারে? সিসিলিয় দার্শনিক এম্পোদোক্লেস (৪৯৫-৪৩৫) পারমেনাইদেসের কিছু কিছু দর্শন আঁকড়ে থেকেই স্বাভাবিক জগৎ-কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। চারটি উপাদান সত্যিই অপরিবর্তনীয় বলে যুক্তি দেখান তিনি, তবে সেগুলো ঘুরে বেড়ায় ও আমরা যেসব জিনিস দেখি সেগুলো গড়ে তুলতে মিলিত হয়। স্মিরনার অ্যানাক্সোগোরাস (৫০৮-৪২৮) প্রতিটি বস্তুই অন্য বস্তুর বিভিন্ন অংশ ধারণ করে বলে বিশ্বাস করতেন, যদিও খালি চোখে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাবে না। এ থেকে বলতে হয়, অস্তিত্ববান সবকিছুরই বীজ ধারণ করে বলে যেকোনও কিছুই চূড়ান্তভাবে ভিন্ন কিছুতে পরিণত হতে পারে। মিলেসিয়দের মতোই সবকিছুর বিকাশ লাভের উৎস খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন তিনি। একে নাউস (‘মন’) বলতেন তিনি। মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তা স্বর্গীয়, কিন্তু অলৌকিক নয়; স্রেফ বস্তুর অন্য এক রূপ। নাউস সবকিছু গতিশীল করে দেওয়ার পর তার আর কিছুই করার ছিল না; নৈর্ব্যক্তিক, প্রাকৃতিক শক্তি দায়িত্ব তুলে নিয়েছে এবং কোনওরকম নির্দেশনা বিনাই এই প্রক্রিয়া চলমান হয়েছে। দেমোক্রিতাস ( ৪৬৬-৩৭০) অসংখ্য ক্ষুদে ক্ষুদে বস্তুকণা শূন্য স্থানে ছুটে বেড়ানোর কথা কল্পনা করেছিলেন। তিনি এদের নাম দিয়েছেন আতোমোস (‘খণ্ডাতীত’) থেকে উদ্ভুত শব্দ ‘অনু’। অনু নিরেট, অদৃশ্য এবং অবিনাশী, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত বাধলে একসঙ্গে মিশে গিয়ে আমাদের চারপাশে চোখে পড়া পরিচিত বস্তু গঠন করে। অনু উধাও হয়ে গেলে বস্তু গুঁড়িয়ে যায়, আপাত তার মৃত্যু ঘটে, কিন্তু অণুগুলো তখন সত্তার নতুন রূপ গঠন করার কাজে চলে যায়। 

এইসব দার্শনিক বিশ্ব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন গজদন্ত মিনারে বন্দী লোকজন ছিলেন না। সেলিব্রিটি ছিলেন তাঁরা। উদাহরণ স্বরূপ, নিজেকে স্বর্গীয় দাবি করা এম্পেদোক্লেস পিঙ্গল জোব্বা গায়ে দিতেন, সোনালি গার্ডল বাঁধতেন, পায়ে দিতেন ব্রোঞ্জের জুতো। তাঁর কথা শুনতে ভীড় জমাত লোকে। পেছনে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি, এই দার্শনিকদের কোনও কোনও সহজাত ধারণা ছিল দর্শনীয়। দেমোক্রিতাসের অণু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের হাতে পরিণতি লাভ করবে; আর ভালোবাসা ও বিবাদের ভেতর মহাজাগতিক সংগ্রামের কল্পনা করেছিলেন এম্পেদোক্লেস, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম ও বিগ ব্যাং থিয়োরির চেয়ে ভিন্ন নয় তা।১৫ কিন্তু নিজেদের তত্ত্ব প্রমাণ করার কোনও উপায় ছিল না তাঁদের, তাই তাঁরা যতই অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হোন না কেন, কল্পনাই রয়ে গেছে এসব। সাধারণ মানুষের কাছে দর্শন দূরবর্তী হয়ে উঠছিল। এইসব কল্পনা নির্ভর সৃষ্টিতত্ত্ব মানুষের চাহিদার কোনও সমাধান দেয়নি, মৌলিক প্রত্যাশার বিপরীত ছিল সেসব। নিজের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণই যদি বিশ্বাস করতে না পারেন, তাহলে কোনও ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন কিভাবে? পারমেনাইদেস বা দেমোক্রিতাসের অসাধারণ ধারণাসমূহের সমর্থনে নিরেট প্রমাণ হাজির করতে না পারলে কি কারণে লোকে বিশ্বাস করতে যাবে? সাধারণ জ্ঞান এইসব যুক্তিবিদদের হাতে ক্রমাগত ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় অনেকেই দিশাহারা বোধ করতে শুরু করেছিল। বিজ্ঞান এভাবে সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করে চলছিল। কোপার্নিকাস, গালিলিও ও চার্লস ডারউইনের প্রকল্পগুলো প্রথমবারের মতো উপস্থাপিত হলে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীরা (ফিজিকোই) ক্রমবর্ধমানহারে গ্রিক সমসাময়িকদের উপর একই ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলেন। 

৪৬০ সালের দিকে অ্যানাক্সাগোরাস অ্যাথেন্সে আসেন এবং নিমেষে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। এবারই প্রথম অত্যন্ত ধার্মিক পোলিস অ্যাথেন্স সরাসরি নতুন ধ্যানধারণার কাছে উন্মুক্ত হয়েছিল। অনেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু অন্যরা হতাশা বোধ করেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অ্যানাক্সাগোরাস, বলা হয়ে থাকে, ৪৬৭ সালে থ্যাসে উল্কাপাতের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি। তাঁর এই কৃতিত্ব লাভ করার কথা নয়; তবে আকাশ থেকে পড়া বিশাল, জ্বলন্ত পাথরের কাহিনী শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে থাকবেন হয়তো। সে যাই হোক, সূর্য একটি পাথর আর চাঁদ পৃথিবীরই অংশ বলে সিদ্ধান্তে পৌছেছিলেন তিনি। মহাকাশের বস্তুনিচয় দেবতা নয়, বরং উত্তপ্ত লাল পাথর; এসবের উপাসনা করার বদলে মানুষের উচিত এগুলো থেকে দূরে থাকা।১৬ আইয়োনিয়ায় এধরনের কথাবার্তা মামুলি হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু অ্যাথেন্সে গ্রহণযোগ্য ছিল না। 

বুদ্ধিজীবীদের একটি নতুন মহল দর্শনকে আবার মর্ত্যে নামিয়ে এনে একে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা করেন। অ্যাথেনিয় চিন্তকদের উপর গভীর প্রভাব রেখেছিলেন তাঁরা, কিন্তু অনেকেই বিজ্ঞানীদের মতোই স্রেফ বিরক্তিকর মনে করেছে তাঁদের।” তাঁদের নাম ছিল সফিস্ট (‘প্রাজ্ঞজন’)। পরে সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল বেশ জঘন্য ভাষাতেই গালি দেবেন তাঁদের; এর ফলে আজ বিস্তারি, অপযুক্তিপূর্ণ তর্ক তুলে ধরে এমন কাউকে বোঝাতে ‘সোফিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তুতাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে বিশ্বাস করে নিজস্ব পথে সত্যির সন্ধানকারী আদি সোফিস্টদের বেলায় এটা ন্যায্য ছিল না। দর্শন ভুল বাঁক নিয়েছে বলে যুক্তি দেখিয়েছেন তাঁরা। সিলিলির লিয়ন্তিনামের সোফিস্ট জর্জিয়াস মিলেসিয় ও ফিসিকোইদের জটপাকানো যুক্তিকে এভাবে প্যারোডি করেছিলেন : 

  • কোনওই কিছুই অস্তিত্ববান নয় 
  • যদি অস্তিত্ববান হয়, সেটা কি ব্যাখ্যা করা হবে অসম্ভব। 
  • যদি সম্ভবও হয়, সেটা কাউকে বোঝানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।১৮ 

সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আর ভাষার উপযোগিতাকে অস্বীকার করার কি যুক্তি ছিল? অবিশ্বাস্য ফ্যান্টাসি সৃষ্টি করার বদলে মানুষকে সত্যিকার অর্থে সাহায্য করবে এমন দর্শন গড়ে তোলার সময় হয়েছিল। 

নিজেদের শিক্ষকের ভূমিকায় স্থাপন করেছিলেন সোফিস্টরা। গণতন্ত্ৰ যেকোনও মেধাবী লোকের পক্ষে সংসদে বাঙ্ময় ভাষায় কথা বলতে পারলে বা বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য রাখতে পারলে বিখ্যাত হয়ে ওঠা সম্ভব করে তুলেছিল। কিন্তু সাধারণ পাঠ্যক্রম তরুণদের এসব নৈপুণ্য আয়ত্তে সাহায্য করেনি। গ্রিক কিশোররা পড়া, লেখা, ক্রীড়া আর হোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলেও চৌদ্দ বছর বয়সেই শেষ হয়ে যেত তাদের শিক্ষার কাল। এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসেন সোফিস্টরা, প্রয়োজনীয় ফি দিলেই যে কাউকে উচ্চতর শিক্ষা দিতেন তাঁরা। এলিসের হিপ্পিয়াস অন্যতম একজন সোফিস্ট ছিলেন, বহুজ্ঞানবিদ হিসাবে নিয়মিত গণিত, স্মরণবিদ্যা, জরিপকাজ, ইতিহাস, সঙ্গীত কাব্য ও অঙ্কের শিক্ষা দান করতেন। এম্পেদোক্লেসের মতো তিনিও সেলিব্রিটি ছিলেন। অলিম্পিয়ান গেমসে কাবিতা আবৃত্তি করতেন, বিশাল দর্শকদের উদ্দেশে ভাষণ দিতেন। চারুবিদও ছিলেন তিনি, নিজেই নিজের জুতো-জামা বানাতেন। এই আত্মনির্ভরতাই তাঁর দর্শনকে ফুটিয়ে তোলে। মানুষকে অবশ্যই তার নিজস্ব অন্ত-দৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হবে। সাধারণ জ্ঞানকে হেয় না করে হিপ্পিয়াস ও তাঁর সহকর্মীরা শিষ্যদের তাদের মনের কর্মকাণ্ডের উপর আস্থা রাখা শেখানোর চেষ্টা করেছেন। কোনওদিন পরম সত্যি জানতে পারবে না তারা, তবে সকল চিন্তাই বস্তুগত এটা যখন বুঝতে পারবে, তখন অন্তত বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাবে। তাঁদের ধারণাসমূহ অন্য যেকারও ধারণার মতোই ভালো, সুতরাং নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত মনে করা উচিত তাদের। 

সোফিস্টরা অ্যাক্সিয়াল যুগের বহু ধারণাই স্পর্শ করেছিলেন: মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, স্বায়ত্বশাসন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং ক্ষুদ্র অভিজাত গোষ্ঠীর ভেতর জ্ঞানকে সীমিত রাখার বদলে সাধারণ মানুষের প্রতি অগ্রসর হওয়া। তবে একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল এখানে। এপর্যন্ত গ্রিকরা যোগীদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের মতো মৌলিক পরিবর্তনের প্রতি কোনও আকাঙ্ক্ষা দেখায়নি। মানবীয় সত্তা হিসাবে নিজেদের সম্ভাবনা সম্পর্কে জোরাল ধারণা ছিল তাদের, কিন্তু সেটা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে তেমন একটা কৌতূহল ছিল না। কি হতে পারে তারচেয়ে বরং কি আছে সেটাই নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল তারা।১৯ বর্তমানের উপর জোর দিয়ে মূলত বর্তমানেই তাদের আরও দক্ষ করে তুলবে এমন এক ধরনের প্রযুক্তি তেকনে-র প্রতি আগ্রহী ছিল। সোফিস্টরা তাদের এই বিশ্বের বাইরে নিয়ে যাবে, এমন কোনও তেকনে চাননি; ভিন্ন ধরনের ব্যক্তি নির্মাণের কোনও ইচ্ছা তাদের ছিল না, বরং শিষ্যদের জাগতিক দক্ষতা বাড়াতে চেয়েছিলেন মাত্র। অধিকার ছেড়ে দেওয়ার বদলে অর্থ আয়ের বেলায় দারুণ আগ্রহী ছিলেন সোফিস্টরা। অন্য দার্শনিকরা একে ঘৃণা করতেন, কিন্তু সোফিস্টরা বিষণ্ণ মার্সেনারি ছিলেন না। আন্তরিকভাবেই সাধারণ মানুষকে জন্মপরিচয় ও মর্যাদা নির্বিশেষে তাদের নতুন সুযোগের ফায়দা লাভে সাহায্য করে মূল্যবান সেবা দান করছেন বলে বিশ্বাস করতেন তাঁরা। 

তাঁদের কেউ কেউ অলঙ্কার শাস্ত্র এবং লেগে থাকার কলাকৌশল শিক্ষা দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ, জনসভায় বক্তৃতার উপর বেশ কয়েকটি হ্যান্ডবুক রচনা করেছেন জর্জিয়াস এবং যেকোনও বিষয় নিয়েই তর্ক করা সম্ভব বলে শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। একবার প্রতিরক্ষার অতীত ট্রয়ের হেলেনের প্রতিরক্ষা নিয়ে বিখ্যাত রচনা লিখেছিলেন। নিজে অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন। ৪২৭ সালে লিওনতিনামের রাষ্ট্রদূত হিসাবে প্রথম অ্যাথেন্সে পৌঁছানোর পর রাতারাতি আলোড়ন সৃষ্টি করেন জর্জিয়াস, তরুণের দল ভীড় জমাতে শুরু করে তাঁর ক্লাসে। তাঁর একজন ছাত্র ছিলেন পেরিক্লেসের ভাস্তে আলসিবিয়াদেস, একবার সোফিস্টিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে গণতন্ত্র সংক্রান্ত এক বিতর্কে চাচাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলেন তিনি। সংসদে প্রাণবন্ত বক্তায় পরিণত হন আলবিয়াদেস, এবং আমরা যেমন দেখব, অ্যাথেন্সের ক্ষেত্রে তাঁর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। সোফিস্টদের কোনও কোনও শিষ্য আয়ত্ত করা দক্ষতার অবশ্যই অপব্যবহার করেছে বটে, কিন্তু সেটা সোফিস্টদের দোষ নয়। কার্যকর বাগ্মীতা স্বাধীনতাকে প্রাণবন্ত রাখে বলে বিশ্বাস করতেন জর্জিয়াস। যুক্তিকে কিভাবে তুলে ধরতে হবে, সেটা যে জানে তার পক্ষে নিরীহদের বাঁচানো সহজ ও নিজের পোলিসকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অ্যাট্রিক বক্তা আন্তিফোন একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘যেকোনও গণতন্ত্রে সেরা বক্তার গলাতেই জয়ের মালা যায়। তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল না এটা, তবে গণতন্ত্র কিভাবে কাজ করে তার একটা বাস্তবভিত্তিক মন্তব্য ছিল। সংসদে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে বক্তব্য রাখতে পারেন যিনি তার কাছেই বিজয় গিয়ে থাকলে সোফিস্টদের নৈপুণ্য প্রকৃতপক্ষেই ন্যায় টিকে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। 

সকল সোফিস্টই প্রকাশ্য ভাষণের ব্যাপারে মনোযোগি ছিলেন না। আব্দেরার প্রোতাগোরাস সবচেয়ে স্বনামখ্যাত সোফিস্ট ছিলেন, অলঙ্কার শাস্ত্রে সামান্যই আগ্রহ ছিল তাঁর। আইন ও সরকারেই ছিল তাঁর মূল ঝোঁক, তবে আবার ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়েও লেখালেখি করেছেন, সত্যির প্রকৃতির উপর নিবন্ধ রচনা করেছেন। ৪৩০-র দশকে অ্যাথেন্সে পৌছেন তিনি এবং পেরিক্লেসের বন্ধুতে পরিণত হন, যিনি ইতালির নতুন বসতি থুরির সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন তাঁকে। শিষ্যদের সমস্ত কিছুকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন প্রোতাগোরাস। লোকমুখে শুনে বা প্রচলিত কোনও কথাই যেন তারা বিশ্বাস না করে, বরং নিজেদের বিচার বিবেচনা আর ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের বিপরীতে গিয়ে সকল সত্যিকে বিচার করতে হবে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে নিরেট প্রমাণ বিহীন স্বতঃপ্রণোদিত আঁচ-অনুমানে যেন তারা বিশ্বাস না করে। সাধারণ জ্ঞানের বিধানের পরিপন্থী হলে প্রচলিত পুরাণের উপর আনাড়ী নির্ভরতাও অগ্রহণযোগ্য। 

ক্রমশঃ জোরাল হয়ে ওঠা উদ্বেগের একটা সময়ে পদ্ধতিগত সন্দেহের শিক্ষা দিয়েছেন সোফিস্টরা। ব্যাপক ভ্রমণ করেছেন তাঁরা। তারা জানতেন অন্য সংস্কৃতির চমৎকার কাজ দেখানো ভিন্ন রীতি ছিল এবং শ্বাশত সত্যি বলে কিছু নেই বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। পারমেনাইদেস ও দেমোক্রিতাস যেখানে বিষয়ীকেন্দ্রীক বিশ্বাসকে কঠোরভাবে বাতিল করেছিলেন প্রোতাগোরাস তাকে আলিঙ্গন করেছেন। একজনের সত্যি তার প্রতিবেশীর সত্যির চেয়ে ভিন্ন হবে, তবে তার মানে এই নয় যে তাকে মিথ্যা বলে নাকচ করে দিতে হবে। প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি তার জন্যে সঠিক। সত্যিকে সুদূরে অবস্থিত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরের বাস্তবতা হিসাবে দেখার বদলে প্রত্যেকেরই তাতে ভাগ থাকার দাবি করেছেন প্রোতাগোরাস। তাকে কেবল নিজের মনের ভেতর অনুসন্ধান করতে হবে। ‘মানুষই সবকিছুরই মাণদণ্ড,’ জ্ঞানতাত্ত্বিক নিবন্ধে লিখেছিলেন তিনি, ‘কারণ যেসব বস্তু আছে তা আছে, আর যেসব বস্তু নেই সেগুলো নেই। ২১ ব্যক্তিকে অবশ্যই তার নিজস্ব মানবীয় বিচারের উপর নির্ভর করতে হবে। দুর্জ্ঞেয় কোনও কর্তৃপক্ষ নেই, নেই মানবজাতির উপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দিতে পারার মতো কোনও পরম ঈশ্বর। 

কোনও কোনও অ্যাথেন্সবাসী একে মুক্তিদায়ী আবিষ্কার করে এবং মৌলিক অনুমানসমূহকে প্রশ্ন করার এই অভ্যাস তাদের সামনে নতুন নতুন দরজা খুলে দেবে ও ধর্ম সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি যোগাবে বলে জানতে পারবে। এদেরই একজন ছিলেন নাট্যকার ইউরিপিদিস (সি. ৪৮০- ৪০৬), তাঁর বাড়িতেই প্রোতাগোরাস দেবতাদের উপর তাঁর কুখ্যাত নিবন্ধ পাঠ করেছিলেন। ‘দেবতাদের ব্যাপারে,’ শুরু করেছিলেন তিনি, ‘তাঁরা আছেন কি নেই সেটা জানার মতো কোনও উপায় আমার কাছে নেই, জানা নেই তারা কিসের তৈরি; কারণ বিষয়বস্তুর অস্পষ্টতা ও মানবীয় আয়ুর সীমাবদ্ধতাসহ এই জাতীয় জ্ঞানের পথে নানা বাধা রয়েছে।২২ পর্যাপ্ত তথ্য ছাড়া স্বৰ্গীয় সত্তা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে পারেননি তিনি। স্রেফ পারমেনাইদেসের বিধিই ধর্মতত্ত্বে প্রয়োগ করেছিলেন। দেবতাদের বাস্তবতা প্রমাণযোগ্য নয়, সুতরাং জ্ঞান বা কথোপকথনের কোনও সঠিক বিষয় হতে পারেন না তাঁরা। 

মহা শোরগোলের সৃষ্টি করেছিল এই নিবন্ধ। ৪৩২ সালে নগরী একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই ধরনের অধার্মিকতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং প্রোতারোগাস ও অ্যানাক্সাগোরাসকে অ্যাথেন্স থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু দেবদেবীদের নিয়ে অবিরাম কঠিন প্রশ্ন তুলে চলা ইউরিপিদিসের ট্র্যাজিডিসমূহে বাঙ্ময়ভাবে প্রকাশ পাওয়া নতুন এই সংশয়বাদ রয়ে যায়: তাঁদের কি অস্তিত্ব আছে? তাঁরা কি দেবতা? যদি না হন, জীবনের কোনও অর্থ থাকে কিভাবে? সোফিস্টদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন তিনি। ‘স্বর্গে দেবতারা আছেন বলে বিশ্বাস করেন আপনি?’ এই সময় নাগাদ লিখেছিলেন তিনি। “না, তেমন কিছুর অস্তিত্ব নেই, যদি কেউ নির্বোধের মতো প্রাচীন কালের রূপকথা আঁকড়ে থাকতে জেদ না করে…নিজেই ভেবে দেখুন: কেবল আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই।২৩ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জোরাল কণ্ঠে প্রাচীন ধর্মতত্ত্বের বিরোধিতা করেছে। স্বৈরাচারীরা হত্যা ও লুটপাট করেছেন, অথচ সৎ জীবনযাপনকারীদের চেয়ে তারাই বরং সুখে শান্তিতে ছিলেন। তাঁর নায়ক যিউসের ছেলে হেরাক্লেস দেবী হেরার হাতে উন্মাদে পরিণত হয়েছেন এবং স্বর্গীয় অনুপ্রাণিত উন্মাদনায় নিজের স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করেছেন। এমন একজন উপাস্যকে কিভাবে কেউ মেনে নিতে পারে? ‘এমন দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করতে পারে কে?’ নাটকের শেষে অ্যাথেন্সের রাজা থেসিয়াসের কাছে প্রশ্ন করেছেন হেরাক্লেস। ‘এইসব কাহিনী আসলে কবিদের করুণ পুরাণ ছাড়া আর কিছু নয়। ২৪ তবে স্বর্গকে পুরোপুরি নাকচ করেননি ইউরিপিদিস। প্রাচীন গল্পগাথাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলে এক নতুন ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলতে যাচ্ছিলেন তিনি। ‘আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে যে নাউস [মন] আছে তাই একজন দেবতা,’ বলেছেন তিনি।২৫ ট্রোজান উইমেন-এ প্রিয়ামের বিধবা স্ত্রী হেকুবাকে দিয়ে এক অচেনা দেবতার কাছে প্রার্থনা করিয়েছেন: “হে তুমি, যে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখ আর এভাবে বেঁচে থাকো, তুমি যেই হও না কেন, আমাদের জ্ঞানাতীত শক্তি, যিউস, তুমি প্রকৃতির কঠোর বিধান বা মানুষের বুদ্ধিমত্তা যাই হও না কেন, তোমার কাছেই আমার প্রার্থনা জানাই; কারণ তুমিই সকল মরণশীলকে ন্যায়বিচারের পথে চালিত করো, নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে চলো।২৬ 

৪৩১ সালে সিটি দিওনিসিয়ায় ইউরিপিদিসের মিডিয়া অভিনীত হয়। জেসনকে বিয়ে করা ও তাকে সোনালি পশম আবিষ্কারে সাহায্যকারী কোলচিসের নারীর কাহিনী বলা হয়েছে এখানে যে কিনা পরে নিষ্ঠুরভাবে স্বামীর কাছে পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রতিশোধ হিসাবে জেসনের নতুন স্ত্রী, তার বাবা এবং- শেষে-জেসনের ঔরসে যেসব ছেলেকে সে জন্ম দিয়েছিল-হত্যা করে। কিন্তু অতীতের নায়কদের বিপরীতে মিডিয়া কিন্তু দেবতাদের হুকুমে কাজ করছিলেন না; আপন কঠোর লোগোসে পরিচালিত হয়েছেন তিনি। শক্তিশালী মাতৃত্বের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরে, কেবল বাতিল করার জন্যে নিজের ঘৃণ্য পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে ধরে উপলব্ধি করেছেন যে, নিজেদের ছেলেদের হত্যা করতে না পারা পর্যন্ত জেসনের বিরুদ্ধে বদলা নিতে পারবেন না। যুক্তি পরিণত হচ্ছিল ভীতিকর উপায়ে। মানুষকে তা আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শূন্যতার পথে চালিত করতে পারে, এবং দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্ত হলে নিষ্ঠুর ও বিকৃত তৎপরতার পক্ষে জোরাল যুক্তি খুঁজে পেতে পারে। সবচেয়ে কার্যকর ও দারুণ শক্তিশালী প্রতিশোধ নেওয়ার মতো দারুণ মেধাবী ছিলেন মিডিয়া জর্জিয়াসের শিষ্য হয়ে থাকতে পারেন তিনি। 

ট্র্যাজিডির ক্যাথার্সিসের ক্ষেত্রে যুক্তির প্রয়োগ আবিশ্যিক অংশ ছিল। অ্যারিস্টটল পরে ‘সঠিকভাবে যুক্তি প্রয়োগের সামর্থ্য’ ধার্মিকতার আবেগকে পরিশুদ্ধ করার অপরিহার্য শর্ত বলে দাবি করবেন।২৮ বিশ্লেষণমূলক দৃঢ়তা ছাড়া আপনার পক্ষে অন্যের যুক্তি বোঝা সম্ভব হবে না। গ্রিকদের কাছে যুক্তি শীতলভাবে বিশ্লেষণমূলক ছিল না, বরং আবেগে পরিপূর্ণ ছিল। আদালত ও সংসদের বিতর্কসমূহ থিয়েটারের যুক্তিতর্কের মতোই আবেগময় ও নাটকীয় ছিল এবং এখানেও নাগরিকরা নিজেদের ভেতর থেকে ‘বেরিয়ে আসার’ একতাসিস শিখত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির দিকে অগ্রসর হওয়ার অনুভূতি লাভ করত।২৯ যুক্তি দর্শকদের তাদের সহানুভূতির প্রতি দাবি নেই এমন লোকদের প্রতি সমবেদনা বোধে বাধ্য করতে পারে। ইউরিপিদিস ‘অন্যের’ প্রতি, এমনকি অমন অপ্রীতিকর কাজ করা মিডিয়া ও হেরাক্লেসের প্রতিও সমবেদনার সঙ্গে হাত বাড়ানোর করুণ ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছেন। হেরাক্লেসের শেষে থেসিয়াস দূষিত, ভেঙে পড়া মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি বাড়িয়ে দেন। হেরাক্লেসকে মঞ্চের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দুই নায়ক পরস্পরকে ‘বন্ধুত্বের জোয়ালে’ জড়িয়ে ধরে এবং কোরাস তখন ‘শোক ও অনেক অশ্রুতে’ বিলাপ করতে থাকে…কারণ আজ আমরা আমাদের সবচেয়ে মহান বন্ধু পেয়েছি এইসব কথা দর্শকদেরও কাঁদতে আদেশ করে। এটা ছিল দিওনিসিয় একতাসিস, আমাদের সহজাত কুসংস্কার ও পূর্ব ধারণা থেকে সহানুভূতির কাজে প্রণোদিত করতে ‘বেরিয়ে আসা’, নাটকের আগে যাকে অসম্ভব মনে হতে পারত। 

মিডিয়া উপস্থাপনের সময় যুক্তির মাধ্যমে নিজেকে ভীষণ অপরাধে প্ররোচিত করা এক নারীর গল্প বলেছেন ইউরিপিরিদিস। তাঁর দর্শকরা হয়তো কিছু জোরাল রাজনৈতিক মহড়ার পর অ্যাথেনিয় সংসদে গ্রিক বিশ্বকে পেলোপোনেসিয় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া প্রলম্বিত বিতর্কের উল্লেখ প্ৰত্যক্ষ করে থাকবেন। ৪৩১ সালে দর্শকরা নাটকটি উপভোগ করার সময় এই আক্রমণের প্রস্তুতি এগিয়ে চলছিল। অ্যাট্টিকার বিনিময়ে সাম্রাজ্যকে বাঁচানো ছিল পেরিক্লেসের পরিকল্পনা। দেশের সমস্ত জনসাধারণকে শহরে চলে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি, পল্লী এলাকা থেকে প্রায় লাখখানেক মানুষ অ্যাথেন্সের দীর্ঘ প্রাচীরের ভেতরে জমায়েত হয়েছিল। স্পার্টান নৌবহর অ্যাট্টিকের পল্লী এলাকায় ধ্বংসলীলা চালানো আর অ্যাথেনিয় নৌবহর পেলোপোনেসাস ধ্বংস করার সময় সেখানেই ছিল তারা। ৪৩০ সালে এক প্লেগের প্রাদুর্ভাব জনাকীর্ণ শহরটিকে জীবন্ত নরকে পরিণত করে। আনুমানিক বিশ হাজার মানুষ-জনসংখ্যকার ২৫ শতাংশ-মারা পড়ে। ধার্মিক ও অবিশ্বাসীদের পাশাপাশি ভুগতে দেখে ভয় ও শোকে অনেক অ্যাথেন্সবাসী দেবতায় বিশ্বাস হারায়। পেরিক্লেসের উপর থেকেও আস্থা খুইয়ে বসে তারা, দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। কয়েক মাস পরে পুনর্বহাল হলেও ৪২৯ সালের শরতে মারা যাবেন তিনি। এদিকে অ্যাথেন্সে প্লেগ যখন মরণলীলা চালাচ্ছে, যুদ্ধ অচলাবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। অ্যাথেনিয় ও স্পার্টানরা পরস্পরের এলাকায় চুরি চালাচ্ছিল, কিন্তু বিরল ক্ষেত্রে মরণপণ লড়াইতে লিপ্ত হয়েছে, ফলে কেউই চূড়ান্ত বিজয় দাবি করতে পারছিল না। 

পেরিক্লেসের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে সিটি দিওনিসিয়ায় ঈদিপাস দ্য টাইরান্ট মঞ্চস্থ করেন সোফোক্লিস। থেবসে নাটকের সূচনা হয়েছে; ঈদিপাসের বাবা রাজা লেইয়াসের হত্যার বদলা নেওয়া হয়নি বলে এই শহরটি প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিল। তদন্তের ব্যবস্থা করেন ঈদিপাস এবং নিশ্চিত জানতে পারেন যে তিনি কেবল তাঁর পিতার অনিচ্ছুক হত্যাকারীই নন, বরং পরিচয় না জেনে নিজের মাকেই বিয়ে করেছেন। সোফিস্টরা মানুষ স্বাধীন ও মুক্ত এবং নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিতে পারে বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু, অ্যাথেন্সের আইনে যেমন দাবি করা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি কি তার সমস্ত কাজকর্মের জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী? এমনকি কেউ যখন খুব যত্নের সঙ্গে পরিকল্পনা করে, তখনও কি তার কাজের সম্পূর্ণ অর্থ আর মূল তাকে এড়িয়ে যায় না? সেগুলো কি অধরা রয়ে যায় না? সারা জীবন সঠিকভাবে কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন ঈদিপাস, সবসময় সবসেরা পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। কোনও দোষ না থাকলেও দানবীয় চরিত্রে, শহর দূষণকারীতে পরিণত হয়েছেন তিনি, অসহায়ভাবে কাজের কারণে কলুষিত হয়েছেন যার তাৎপর্য ঠিক সময়ে বুঝে উঠতে পারেননি। তিনি অপরাধী ও নিরপরাধ, কর্তা ও শিকার। 

প্রজ্ঞার জন্যে নামডাক ছিল ঈদিপাসের। একবার স্ফিংসের হেঁয়ালি সমাধান করে থেবসকে বাঁচিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, সম্ভবত তাঁর নামটি ওইদা: ‘আমি জানি’ থেকে নেওয়া। কিন্তু দেখা গেছে, নিজেকে যেমন বিশ্বাস করতেন আসলে তার উল্টোটা ছিলেন তিনি। দারুণ মূর্খ ছিলেন। সত্য ছিল অসহনীয় এবং-এক ভীতিকর ভঙ্গিতে মূল কাহিনীতে যোগ করেছেন সফোক্লিস-নিজের কাজের কথা জানতে পেরে নিজের চোখ উপড়ে ফেলেছিলেন।৩১ প্রজ্ঞার (ওদাই) সুখ্যাতি সত্ত্বেও আসলে সত্যের প্রতি অন্ধ ছিলেন তিনি। আপন বিকৃতি জ্ঞানের সীমানায়, ভাষা ও ধারণার অতীত-প্রায় অতীন্দ্রিয় অন্তর্দৃষ্টির পরিহাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ঈদিপাসকে। স্বৰ্গীয় হিসাবে প্রজাদের শ্রদ্ধা লাভকারী রাজা হয়ে নাটকের শুরু করেছেন তিনি, শেষ হয়েছেন শহরের মৃত্যু ও অসুস্থতার মিয়াসমা বহন করে আনা কলুষিত অপরাধী হিসাবে। 

কিন্তু তাঁর যাত্রা তখনও শেষ হয়নি। ঈদিপাসের অন্ধত্ব সম্পূর্ণ নতুন আবেগীয় আক্রম্যতা এনে দিয়েছে তাঁর জন্যে। ৩২ এখন তাঁর বক্তব্য শব্দহীন বিস্ময়ে পরিপূর্ণ (আয়ন… আয়ন! আইআই… আইআই!), করুণ রসের শিক্ষা লাভ করেছিলেন ঈদিপাস। হতভাগ্যা মেয়ে ইসমিন ও আন্তেগোনের দিকে হাত বাড়ানোর মুহূর্তে তাদের প্রতি সহানুভূতিতে নিজের কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি। কোরাসও ত্রাসে দারুণ পরিপূর্ণ ছিল তখন, তাদের ভীতি এতটাই প্রবল ছিল যে, খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়া মানুষটার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না তারা। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অবর্ণনীয় ভোগান্তির দৃশ্য সহানুভূতির শিক্ষা দেয় তাদের, ঈদিপাসের যন্ত্রণার গভীরতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভীতি মুছে যায়। কোমল সুরে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে তারা, ‘বন্ধু আমার,’ ও ‘প্রিয় আমার’ বলে সম্বোধন করে তাঁকে।৩৩ ট্র্যাজিক ঘরানার রেওয়াজ মোতাবেক তাদের সহানুভূতি দর্শকদের প্রতি একটা নিদের্শনা পাঠিয়ে দেয়, এমনিতে তাদের মনকে ঘৃণায় ভরিয়ে তুলত যে অপরাধ সেই অপরাধে অপরাধী মানুষটার প্রতি সহানুভূতি বোধ করার নির্দেশ দেয়। দর্শকরাও সহানুভূতির একতাসিসে তাদের সাবেক অনুমান পেছনে ফেলে আসার সময় দুয়ে’র বোধ লাভ করবে। 

অবশেষে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করে নিজের প্রাসাদে অদৃশ্য হয়ে গেলে ট্র্যাজিডিয়ানদের কাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগের শিক্ষা লাভ করেন ঈদিপাস। তবে এই নতুন জ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন ছিল। বিভিন্ন চরিত্র ও দর্শকরা যা শিখেছিল সেটা ছিল শুদ্ধকারী ক্যাথার্সিস বয়ে আনা এক ধরনের সহানুভূতি। মানবীয় অবস্থার অন্ধকার দ্ব্যর্থবোধকতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে ঈদিপাসকে তাঁর নিশ্চয়তা, স্পষ্টতা ও কথিত অন্তর্দৃষ্টি ছাড়তে হয়েছিল। তাঁর জন্যে অমন সম্মান বয়ে আনা বিচক্ষণতকে চুরমার করে দিতে হয়েছিল। অসীম সাহস নিয়ে নিজের শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছেন তিনি, যদিও এই শাস্তি তাঁর পাওনা ছিল না। অন্য মানুষদের কাছ থেকে এখন অপরিবর্তনীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি। গ্রিক ধর্মের প্রাচীন যুক্তিতে টাবুতে পরিণত হয়েছিলেন, বিচ্ছিন্ন, আলাদা একটি চরিত্র এবং সেকারণে পবিত্র। জীবনের একেবারে শেষদিকে সফোক্লিসের লেখা নাটক ঈদিপাস অ্যাট কোলোনাস-এ মৃত্যুর পর ঈদিপাস মহত্ব-বলতে গেলে দেবত্ব-লাভ করবেন এবং তাঁকে আশ্রয় যোগানো অ্যাথেন্সের আশীর্বাদের উৎসে পরিণত হবে তাঁর কবর।৩৪ 

৪২০-র দশকে পেলোপোনেসিয়ার যুদ্ধ যখন প্রলম্বিত হচ্ছে, একের পর এক নৃশংসতা আরেকটি নৃশংসতাকে ডেকে আনছে, তখন এক নতুন দার্শনিক অ্যাথেন্সে নামডাক অর্জন করতে শুরু করেন। চৌকষ সোফিস্টদের বিপরীতে বরং সামান্য মানুষ ছিলেন তিনি। টাকাকড়ি বানানোর কোনও আগ্রহ ছিল না তাঁর, বরং ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়ার কথা শুনলে ভয়ই পেতেন। বের হয়ে থাকা ঠোঁট, থ্যাবড়া, ওল্টানো নাক আর ভুড়িসর্বস্ব কুৎসিত মানুষ সক্রেটিস পাথর ভাঙা শ্রমিকের ছেলে। অবশ্য নিজেকে হোপলাইট বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার মতো অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করতে পেরেছিলেন, পেলোপোনেসিয় যুদ্ধের বীর যোদ্ধা ছিলেন তিনি। তুচ্ছ বংশ পরিচয় সত্ত্বেও অ্যাথেন্সের সেরা পরিবারের লোকদের ভেতর থেকে তাঁর প্রতি মোহান্ধ এবং দার্শনিক নায়ক হিসাবে তাঁকে শ্রদ্ধাকারী শিষ্যদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন সক্রেটিস। যেকারও সাথেই কথা বলতেন সক্রেটিস। প্রকৃতপক্ষে কথা বলার প্রয়োজন ছিল তাঁর। কিন্তু তারপরেও গভীর বিমূর্ত কথায় সক্ষম ছিলেন। এক সামরিক অভিযানের সময় একটা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে সারারাত অটল দাঁড়িয়ে থেকে সতীর্থ হোপলাইট যোদ্ধাদের বিস্মিত করে দিয়েছিলেন তিনি। অন্য এক উপলক্ষ্যে রাতের ভোজে যাওয়ার পথে গভীর গবেষণায় ডুবে গিয়ে সঙ্গীদের থেকে পিছিয়ে পড়েন এবং শেষে এক পড়শীর বারান্দায় বসে ভাবনায় মগ্ন হয়ে সন্ধ্যা পার করে দেন। ‘এটাই তাঁর স্বভাব,’ বলেছেন তাঁর একজন বন্ধু, ‘কোথায় সেটা কোনও ব্যাপার না, তিনি স্রেফ গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তবে দারুণ বাস্তব ছিল তাঁর চিন্তাভাবনা: সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে, অ্যাথেন্সবাসীদের নিজেদের সম্পর্কে আরও ভালো উপলব্ধির পথে নিয়ে আসার দায়িত্ব রয়েছে তাঁর। 

সক্রেটিসের সঙ্গে কথোপকথন অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা ছিল। কাউকে তাঁর কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক নৈকট্য আছে মনে হলেই ‘তাঁকে তর্কে টেনে আনা হতো; আর যে বিষয়েই কথা শুরু করুন না কেন, তাকে ঘিরে অবিরাম ঘুরতে থাকবেন, ‘ বলেছেন তাঁর বন্ধু নিসিয়াস, ‘যতক্ষণ না জানতে পারছেন যে অবশেষে অতীত ও বর্তমান জীবনের বিবরণ দিতে হচ্ছে তাকে আর একবার জড়িয়ে ফেলার পর সম্পূর্ণ ও পুরোপুরি পরখ না করা পর্যন্ত তাকে রেহাই দিতেন না সক্রেটিস। ৩৬ তথ্য জানানো নয় বরং লোকের পূর্বধারণাকে পুনর্নির্মাণ এবং আসলে তারা যে কিছুই জানত না সেটা তাদের উপলব্ধি করানোই ছিল সক্রেটিসের উদ্দেশ্য। ঈদিপাসের সহ্য করা কোনোসিসের কোমল ভাষ্য ছিল এই অভিজ্ঞতা। অন্যের কাছ থেকে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন না আপনি। এটা এমন কিছু যা কেবল আপনার গোটা সত্তাকে জাড়িয়ে রাখা কষ্টকর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জন করেছেন। বীরোচিত সাফল্য ছিল এটা, স্রেফ কতগুলো সত্যি বা ধারণার প্রতি সায় দেওয়া নয় বরং এটা ছিল নিজের ভেতর সত্যি আবিষ্কার করার জন্যে কোনও ছাত্রের অতীত ও বর্তমান পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় অনুশীলন। 

নিজেকে ধাত্রী বলে বর্ণনা করেছেন সক্রেটিস: তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে আগ্রহীদের মাঝে সত্যির জন্ম দিতেন তিনি। সাধারণত আলোচনার বিষয়বস্তু সংক্রান্ত স্পষ্ট, নিশ্চিত ধারণা নিয়ে কথোপকথনের সূত্রপাত ঘটাতেন তারা। উদাহরণ স্বরূপ, সাহস এক ধরনের অভিজাত গুণ বলে বিশ্বাস ছিল ল্যাচেস নামে এক সেনা অধিনায়কের। কিন্তু তারপরেও একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে সক্রেটিস যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সাহসী কাজ প্রায়শঃই নির্বুদ্ধিতা ও বোকামি হতে পারে-এই গুণটিকে তাঁরা দুজনই ‘আমাদের পক্ষে আনীচ ও ক্ষতিকর বলেই জানতেন। আরেকজন জেনারেল নাইসিয়া আলোচনায় যোগ দিয়ে সাহসের জন্যে সন্ত্রাসের উপলব্ধি থাকা দরকার বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তাই কোনও পরিস্থিতির বিপদ বোঝার মতো অভিজ্ঞ নয় যেসব শিশু ও পশুপাখি তারা সত্যিকারের অর্থে সাহসী নয়। উত্তরে সক্রেটিস বলেছিলেন, আসলে আমাদের ভয়ের সমস্ত ভীতিকর বস্তুই ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে থাকার কারণে অজ্ঞাত; অতীতের ভালো বা মন্দের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতের ভালো বা মন্দের জ্ঞানকে আলাদা করা অসম্ভব। আমরা বলি সাহস স্রেফ আরেকটা গুণমাত্র, কিন্তু সত্যিকারের অর্থে যিনি বীর তাকে অবশ্যই বীরত্বের জন্যে আবশ্যক সহিষ্ণুতা, বিচার, প্রজ্ঞা এবং ভালোত্বের গুণ আয়ত্ত করতে হবে। আপনি কোনও একটি গুণের চর্চা করতে চাইলে অন্যগুলোর উপরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সুতরাং সাহসের মতো কোনও একটি মৌল গুণ অবশ্যই অন্যগুলোর অনুরূপ হতে বাধ্য। কথোপকথনের শেষে তিন হোপলাইট স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তাঁরা প্রত্যেকেই রণক্ষেত্রের আঘাত সহ্য করেছেন বলে এই বিষয়ে তাঁদের বিশেষজ্ঞ হওয়ার কথা থাকলেও আসলে সাহসের সংজ্ঞা দেওয়ার বেলায় তাঁরা অক্ষম। সেটা কি, আবিষ্কার করতে পারেননি তাঁরা, কোন জিনিসটা তাকে অন্য গুণ থেকে আলাদা করে স্থির করতে পারেননি এবং দারুণ বিভ্রান্ত বোধ করেছেন। শিশুদের মতোই অজ্ঞ ছিলেন তাঁরা, আবার বিদ্যালয়ে ফেরার প্রয়োজন বোধ করেছেন। ৩৭ 

মিথ্যা বিশ্বাস উন্মোচন ও সত্যি প্রকাশের লক্ষ্যে জোরাল সংলাপ, দ্বান্দ্বিকতা উদ্ভাবন করেছিলেন সক্রেটিস। প্রশ্ন তোলা এবং উত্তরগুলোর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে সক্রেটিস ও তাঁর সহকর্মীরা প্রতিটি একক দৃষ্টিভঙ্গির সহজাত ভ্রান্তি ও অসামঞ্জস্যতা আবিষ্কার করেছিলেন। একের পর এক সংজ্ঞা বাতিল করা হতো, এবং প্রায়ই অংশগ্রহণকারীদের ল্যাচাস বা নাইসিয়াসের মতোই ঘোর লাগা অবস্থায় সংলাপের সমাপ্তি ঘটত। চতুর বা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নির্ভুল সমাধানে পৌঁছানো সক্রেটিসের লক্ষ্য ছিল না। দ্বৈরথ সাধারণত আসলে কোনও উত্তর না থাকার সিদ্ধান্তে নিয়ে যেত এবং এই বিভ্রান্তির আবিষ্কার স্পষ্ট সিদ্ধান্তের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ একবার আপনি কিছুই জানেন না উপলব্ধি করার পরই আপনার দার্শনিক অন্বেষণ শুরু হতে পারে। 

সক্রেটিসের দ্বান্দ্বিকতা পরম সত্যি নির্মাণের লক্ষ্যে আয়োজিত কিন্তু সবসময় নীরবতায় পর্যবসিত প্রতিযোগিতা ভারতীয় ব্রাহ্মদ্যোর গ্রিক ভাষ্য ছিল। শব্দের অপর্যাপ্ততা বোঝার মাধ্যমেই ভারতীয় সাধুদের কাছে অন্তর্দৃষ্টির মুহূর্ত হাজির হতো এবং এভাবে অনির্বচনীয়র আভাস মিলত। এমনি পরম মুহূর্তে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে একে ব্যাখ্যা করতে না পারলেও ব্রাহ্মণকে উপলব্ধি করত তারা। সক্রেটিসও তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্তরা মানবীয় অজ্ঞতার সৃজনশীল গভীরতা উপলব্ধি করার সময় সত্যির মুহূর্তকে বের করে আনার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। 

এভাবে পাওয়া জ্ঞান গুণ থেকে অবিচ্ছেদ্য ছিল। সোফিস্টদের বিপরীতে সাহস, বিচার, ধার্মিকতা আর বন্ধুত্ব ফাঁকা বুলি বলে বিশ্বাস করতেন না সক্রেটিস, যদিও সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে পারেননি। এগুলো রহস্যজনকভাবে আমাদের নাগালের বাইরে রয়ে যাওয়া খাঁটি ও বাস্তব কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে বলে মনে করেছেন তিনি। তাঁর সংলাপ যেমন দেখিয়েছে, আপনি কখনওই সত্যিকে চিহ্নিত করতে পারবেন না, তবে কঠোর পরিশ্রম করলে একে আপনার জীবনের বাস্তবতায় পরিণত করতে পারবেন। ল্যাচাস ও নাইসিয়াসের সঙ্গে আলোচনায় গুণ হিসাবে সাহসের প্রসঙ্গে আগ্রহী ছিলেন তিনি, ধারণা হিসাবে নয়। জ্ঞান হচ্ছে নৈতিকতা। আপনি ভালোত্বের সারবত্তা বুঝতে পারলে সঠিকভাবে আচরণে বাধ্য থাকবেন; বিভ্রান্ত বা উপরিগত হলে সর্বোচ্চ মান অর্জনে ব্যর্থ হবেন। সক্রেটিসের কাছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিমূর্ত তত্ত্ব প্রচার করা দর্শনের লক্ষ্য ছিল না; দর্শন ছিল বেঁচে থাকতে শেখা। এই বিশ্বে কেন এত অশুভের ছড়াছড়ি? তার কারণ লোকের জীবন ও নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞানের অপর্যাপ্ত ধারণা। নিজেদের অজ্ঞতার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারলে কেমন আচরণ করতে হবে বোঝার মতো ভালো অবস্থানে পৌঁছবে তারা। 

সক্রেটিস কিছুই লিখে যাননি বলে আসলে তিনি কি ভেবেছিলেন বা বলেছেন সঠিকভাবে জানা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে লেখালেখি অপছন্দ করতেন তিনি, সত্যের চতুর, মতবাদগত ধারণা উস্কে দেওয়ার উপায় মনে করতেন একে। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য প্লেটোর লেখা সংলাপই আমাদের মূল সূত্র। প্লেটো বিশেষ করে মধ্য ও শেষের দিকের রচনায় তাঁর নিজস্ব বহু ধারণা সক্রেটিসের প্রতি আরোপ করেছেন, কিন্তু ল্যাচাস: অন কারিজ-এর মতো গোড়ার দিকের সংলাপ সম্ভবত সক্রেটিসের কাজের ধারা সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। আমরা দেখতে পাই ভালোত্ব তাঁর মনোযোগের মূল বিষয় ছিল, একে অদৃশ্য মনে করতেন তিনি। সুতরাং, ভালো সম্পর্কে সক্রেটিসের ধারণা কনফুসিয়াসের রেন থেকে ভিন্ন নয়; তিনি যেন কখনওই পর্যাপ্তভাবে অনুভব বা প্রকাশের মতো নয় এমন এক পরম গুণের দুর্জ্জেয় ধারণার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, ভালোকে পরম, অনির্বচনীয় আদর্শে পরিণত করবেন প্লেটো। 

সক্রেটিস হয়তো তাঁর সংরক্ষিত আলোচনার অবসান চিহ্নিতকারী মানসিক দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি থেকে আরও অগ্রসর হওয়ার আশা করেছিলেন, কিন্তু তিনি এঅবধিই এগোতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। লোগোসের প্রবল প্রয়োগের ভেতর দিয়ে মানবীয় জীবনের পক্ষে আবিশ্যিক মনে হওয়া এক দুয়ে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি ও তাঁর সতীর্থরা যত নিবিড়ভাবেই যুক্তি প্রয়োগ করুন না কেন, একটা কিছু সবসময়ই ফাঁকি দিয়ে গেছে তাঁদের। যত গোঁড়ামির সঙ্গে ধারণ করা হোক না কেন প্রতিটি দৃঢ় মতবাদের অভ্যন্তরে তাঁর আবিষ্কৃত অজ্ঞতা দেখে গর্ব বোধ করতেন সক্রেটিস। তিনি কত কম জানতেন সেটা বুঝতে পেরেছিলেন এবং অবিরাম আপন ভাবনার সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে লজ্জিত ছিলেন না। অন্যের চেয়ে নিজের কিছুটা সুবিধা আছে মনে হলে সেটা কেবল তিনি কখনওই তাঁর তোলা প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবেন না জানা থাকার সুবাদেই। সোফিস্টরা যেখানে এই অজ্ঞতা থেকে বাস্তব কর্মকাণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন, একে জীবনের গভীর রহস্য প্রকাশ করা একতাসিস হিসাবে অনুভব করেছেন সক্রেটিস। মানুষকে অবশ্যই তাদের অধিকাংশ মৌলিক ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। কেবল এভাবেই তারা সঠিকভাবে চিন্তা ও কাজ করতে পারবে, বস্তুর প্রকৃত রূপ দেখতে পাবে, মিথ্যা মতামতের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে এবং তাদের সবসময় সঠিক আচরণে সক্ষম করে তোলা নিখুঁত স্বজ্ঞার স্পর্শে পৌঁছতে পারবে। যারা একাজ করবে না তারা কেবল নিজের সুবিধা মোতাবেক ও উপরিগতভাবে বেঁচে থাকতে পারবে। তাঁর নামে প্রচলিত সবচেয়ে স্মরণীয় এক বাণীতে তিনি যেমন বলেছেন: ‘অপরীক্ষিত জীবন বাঁচার অযোগ্য। ৩৮ 

অর্থ নিয়ে ভাবতে ব্যর্থ হওয়ার মানে ‘আত্মা’র (সাইকি) সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। সাইকির আবিষ্কার সক্রেটিস ও প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল। আত্মার বিপরীতে সাইকি দেহ থেকে ভিন্ন; ব্যক্তির জন্মের আগেও তার অস্তিত্ব ছিল, তার মৃত্যুর পরেও টিকে থাকবে। মানুষকে তা যুক্তি প্রয়োগে সক্ষম করে তোলে ও তাদের ভালোত্বের দিকে অনুপ্রাণিত করে। আত্মার পরিচর্যা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, জাগতিক সাফল্য লাভের চেয়ে ঢের বেশি জরুরি। ভুল কাজের ফলে আত্মা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত কাজ থেকে লাভবান হয়। ‘প্রতিশোধ নেওয়া বা অন্যায়ের বদলে অন্যায় করা উচিত হবে না আমাদের, তার কাছ থেকে আমরা যেমন ক্ষতিরই শিকার হয়ে থাকি না কেন, ৩৯ জীবনের শেষদিকে বলেছিলেন সক্রেটিস। হাতেনাতে বদলা নেওয়াটা প্রলুব্ধকারী বটে, কিন্তু প্রতিশোধ সবসময়ই অন্যায়; সুতরাং অন্য গাল পেতে দেওয়াই আবশ্যক। প্রতিশোধকে পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে দেখা গ্রিক রীতি থেকে নাটকীয় সরণ ছিল এটা, কিন্তু সক্রেটিস জোর দিয়ে বলেছেন, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার প্রতি সংযমের আচরণ আত্মার পক্ষে মঙ্গলকর বলে এটাই সুখের একমাত্র উপায়। ৪০ 

এইসব ধারণা গোঁড়া মতবাদ হিসাবে উপস্থাপিত হয়নি। প্লেটো তাঁর গুরুর শিক্ষা লিপিবদ্ধ করতে এলেন যখন, সংলাপের সাহিত্যিক ধরন আবিষ্কার করতে হয়েছিল তাঁকে। কনফুসিয়াসের মতো আলোচনার ভেতর দিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন সক্রেটিস, কখনওই স্পষ্ট অভিসন্দর্ভের আভাস দেননি। প্রত্যেককে অন্যের সঙ্গে আলোচনার ভেতর দিয়ে তার পক্ষে কোনটা মঙ্গলময় হবে বের করতে হবে। এই অ্যাগোনের ভেতর দিয়ে তারা নিজেদের মাঝে জেগে ওঠার মতো এক ধরনের আলোকনের অভিজ্ঞতা লাভ করবে। সক্রেটিসের কাছে যারা আসত তারা সাধারণত তারা কি নিয়ে কথা বলছে সেটা তাদের জানা আছে বলে মনে করত, কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে অজ্ঞতা সম্পর্কে সজাগ করে তুলে তাদের অভ্যন্তরে সবসময় অস্তিত্ববান প্রকৃত জ্ঞান আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যেতেন সক্রেটিস। অবশেষে সেটা আলোর মুখ দেখত যখন বিস্মৃত অন্তর্দৃষ্টির স্মরণ হওয়ার মতো মনে হতো। এই আলোকদায়ী, প্রায় স্বপ্নবিলাসী আবিষ্কার সঠিক তৎপরতায় অনুপ্রাণিত করবে বলে বিশ্বাস করতেন সক্রেটিস। 

যেকোনও ধরনের মৌখিক যোগাযোগের মতোই সক্রেটিসের দ্বান্দ্বিকতা সম্পূর্ণ মস্তিষ্কজাত চর্চা ছিল না। এক ধরনের দীক্ষা ছিল এটা। সক্রেটিসের এইসব সংলাপের প্লেটোর বিবরণ যুক্তিতর্কের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি ধারণাকে অনুপ্রাণিত করা গভীর আবেগে আবৃত। অংশগ্রহণকারীরা তাদের নিজস্ব সত্তার কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া এক ধরনের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠত। ধর্মান্ধতা বা গোঁড়া নিশ্চয়তা বিহীন এক ধরনের অবিরাম প্রয়াসের বোধ কাজ করত। সেজায়গায় পরমের প্রতি গ্রাহী, নিবিড় উন্মুক্ততা কাজ করত। প্লেটোনিক সংলাপে আমরা অন্যের উপর সক্রেটিসের প্রভাব অনুভব করতে পারি। পেরিক্লেসের ভাস্তে আলসিবিয়াদেস সক্রেটিসের প্রেমে পড়েছিলেন বলে মনে হয়, তাঁকে রহস্যময় চরিত্র মনে করতেন তিনি; ঠিক যখন মোটেই প্রত্যাশা করতেন না তখনই হাজির হতেন তিনি। বনদেবতা সেলিনাসের ক্ষুদে পুতুলের মতো ছিলেন তিনি, স্ক্রু খোলার পর ভেতরে দেবতার ছোট মূর্তি দেখা যেত। বন দেবতা মারিসাসের মতো ছিলেন তিনি, যার বাজনা দর্শকদের ঘোরের ভেতর নিয়ে গিয়ে তাদের মাঝে দেবতাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলত। কিন্তু সক্রেটিসের কোনও বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। স্রেফ তাঁর কথাই গভীরে পৌছে দিত মানুষকে। ‘যখনই তাঁর কথা শুনতাম, ধর্মীয় উন্মাদনায় থাকার সময়ের চেয়ে দ্রুততর হয়ে উঠত আমার হৃৎস্পন্দন, অশ্রু গড়িয়ে নামত আমার চোখ বেয়ে,’ স্বীকার করেছেন আলসিবিয়াদাস। চাচা পেরিক্লেসের কথা শোনার সময় কখনওই এমন অনুভূতি হয়নি তাঁর। সক্রেটিস কথা বলার সময় আলসিবিয়াদাসকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করতেন যে, “আমি এখনও খুঁতের একটা স্তূপমাত্র।’ পৃথিবীতে একমাত্র তিনিই গ্লানিতে ভরে তুলতে পারতেন তাঁকে। সক্রেটিসকে যেন ভাঁড়ের মতো মনে হতো, রসিকতা করে চলেছেন, কৌতুক করছেন, তরুণদের প্রেমে পড়ে চলেছেন, আর সারা রাত মদ পান করছেন। কিন্তু, বলেছেন আলসিবিয়াদাস, 

তিনি গুরুগম্ভীর হয়ে উঠে মনের কথা প্রকাশ করার সময় যেসব রত্ন বেরিয়ে আসত তা আগে কেউ কখনও দেখেছে কিনা তাতে আমার সন্দেহ আছে। অবশ্য একবার সেসব দেখেছিলাম এবং এমন স্বর্গীয়, সুন্দর ও অনন্যসাধারণ হিসাবে জানতে পেরেছিলাম যে, সংক্ষেপে বলতে গেলে, সক্রেটিসের নির্দেশ মতো কাজ করা ছাড়া কোনও উপায় দেখিনি। 

সক্রেটিসের লোগোই দর্শককে দিওনিসিয় দীক্ষার মতো এক ধরনের ‘উন্মাদনায়’ ভরে তুলত; শ্রোতা এমনভাবে নিজেকে ‘বিকল’ (একপ্লেক্সিস) মনে করত যেন আলোকনের উপান্তে পৌঁছে গেছে।৪১ 

অবশ্য সবাই সক্রেটিসের কাছ থেকে পরম আনন্দ লাভ করেনি। উদ্বেগ ও যুদ্ধের এই সময়ে লোকে বিভ্রান্ত, অন্তস্তলে আলোড়িত আর নিজেদের অপূর্ণতার ব্যাপারে অতিসচেতন হতে চায়নি। তারা চেয়েছে নিশ্চয়তা। ৪২৩ সালে কমেডি ক্লাউডস-এ সক্রেটিসের প্রহসনমূলক চিত্র তুলে ধরেন অ্যারিস্তোফেন্স। নাটকটি একেবারে অসম্ভব বিষয়ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষমতাবান সোফিস্টদের আপেক্ষিকতাবাদের প্রতি এক ধরনের গভীর অস্বস্তিবোধ তুলে ধরেছে। সক্রেটিস সোফিস্ট ছিলেন না, কিন্তু যেসব অ্যাথেন্সবাসীর তাঁর পদ্ধতির অভিজ্ঞতা ছিল না, তারা সম্ভবত গৃহীত মতামত সম্পর্কে তাঁর অবিচল হেয়করণ ও সোফিস্টদের পরম সত্যি অস্বীকারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি। সক্রেটিসকে তাঁর ‘যুক্তির দোকানে’ হাজির করেছেন আরিস্তোফেনস, যেখানে ভুলকে সঠিক যুক্তি দেখিয়ে লোকজনকে যিউসের বদলে মেঘের উপাসনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। শেষপর্যন্ত মূল চরিত্র এক অনুগত অ্যাথেনিয় নাগরিক এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যে গোটা স্কুলটাই পুড়িয়ে দেয় সে। আরিস্তোফেন্স কখনও কল্পনাও করতে পারেননি এমন এক অর্থে পূর্বাভাসমূলক হয়ে উঠেছিল এই কমেডি। 

এই সময় নাগাদ পেলোপোনেসিয় যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছিল অ্যাথেন্স। আসন্ন বিপর্যয়কে অনেকেই দার্শনিকদের ধর্মহীনতার অপরাধে স্বর্গীয় শাস্তি মনে করেছে। সক্রেটিসের শিক্ষাকে ঈশ্বর বিরোধিতা ভেবেছে তারা, যদিও প্রথাগতভাবে ধার্মিক ছিলেন তিনি এবং সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব পালনের মতোই নিয়মনিষ্ঠভাবে সরকারী আচার পালন করতেন। কিন্তু উদ্বেগ তখন হিস্টিরিয়ায় পরিণত হতে যাচ্ছিল। ৪১৬ সালে সংসদে এক আবেগঘন ভাষণে আলসিবিয়াদাস কাছের সেলিনাসের হাতে আক্রান্ত সিসিলির সেগেস্তার সহায়তায় অ্যাথেন্সের এগিয়ে যাওয়া উচিত বলে যুক্তি দেখান। জেনারেল নাইসিয়াস (সক্রেটিসের অনুশীলনের সঙ্গী) অভিযানের বিপক্ষে ছিলেন; কিন্তু আলসিবিয়াদাস এবং তরুণ প্রজন্ম জয়ী হন। যুদ্ধের পক্ষে ভোট দেওয়া বেশিরভাগ নাগরিকেরই সিসিলির আকার বা শক্তি সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না বলে বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত ছিল এটা। নৌবহর রওয়ানা দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে কারা যেন গোটা শহরে স্থাপন করা পথঘাট ও বাড়িঘর রক্ষার দায়িত্বে থাকা দেবতা হার্মিসের লিঙ্গ-প্রতীক হার্মস লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। কে দায়ী, জানা ছিল না কারও। কিন্তু এ ঘটনায় গোটা অ্যাথেন্সের ভিত্তি কেঁপে উঠেছিল। এই ভীষণ অপবিত্রকরণ স্বর্গীয় শাস্তি ডেকে আনবে ভেবে স্থির নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল লোকে। শুরু হয়েছিল ডাইনি শিকার, সন্দেহভাজনদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়; শেষপর্যন্ত সিসিলি থেকে ঈশ্বর বিরোধিতার জবাবদিহির করার জন্যে স্বয়ং আলসিবিয়াদাসকে তলব করা হয়। 

বেশ কিছু বিপর্যয় ঘটে যায়। সিরাক্রুজের সীমান্তে অবরুদ্ধ হয় অ্যাথেনিয় নৌবাহিনী; কাছের খনিতে আটক করা হয় বাহিনীকে। এক খোঁচায় চল্লিশ হাজার লোক ও নৌবহর হারায় অ্যাথেন্স। ৪১১ সালে স্পার্টানপন্থী এক ষড়যন্ত্রে অ্যাথেন্সের গণতন্ত্রী সরকার উচ্ছেদ হয়। অভ্যুত্থান ছিল স্বল্পায়ুর, পরের বছর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু এটা ছিল অ্যাথেন্সর আক্রম্যতার নতুন লক্ষণ। ৪০৫ সাল পর্যন্ত স্পার্টার সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল; এই সময় স্পার্টান জেনারেল লিসান্দার অ্যাথেন্সকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। আরও একবার তিরিশজন স্পার্টানপন্থী অভিজাত নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি অলিগার্কি পরবর্তী সন্ত্রাসের রাজত্বে এত অসংখ্য নাগরিককে হত্যা করে যে, তাতে উচ্ছেদ হয়ে যায় তারা এবং মাত্র এক বছর পরেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং নৌবহর ফিরে পায় অ্যাথেন্স, কিন্তু শক্তি ভেঙে পড়েছিল, সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে এবং পেরিক্লেসের মহান প্রতিরক্ষা প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। 

এমনি ভীষণ প্রেক্ষাপটে অ্যাথেন্সে দুটি মহান ট্র্যাজিডি মঞ্চস্থ হয়। ৪০৬ সালে অ্যাথেন্স পরাজয় মেনে নেওয়ার ঠিক আগে ইউরিপিদিস মারা যান; বিষণ্ণ আসন্ন বিপর্যয়ের আভাসে পরিপূর্ণ তাঁর শেষ তিক্ত নাটকগুলো তাঁর মৃত্যুর পর মঞ্চায়িত হয়েছিল। শেষ নাটকটি ছিল ৪০২ সালে অভিনীত দ্য ব্যাশে ৪২ নাটকের সূচনাতেই দেবতা দিওনিসাস তাঁর মা সিমিলি অন্তসত্তা হয়ে পড়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যানকারী এবং পরবর্তীতে তাঁর কাল্টকে নিষিদ্ধ করা শহর থেবসে ছদ্মবেশ নিয়ে হাজির হন। কিন্তু এবার সংখ্যাগরিষ্ঠ থেবসবাসীই হঠাৎ তাদের মাঝে হাজির হওয়া এই আকর্ষণীয় যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। শহরের যেসব নারী সঠিকভাবে দিওনিসিয় রহস্যে দীক্ষিত ছিল না তারা লাগামহীন উন্মাদনায় মেতে উঠে পশুর ছাল গায়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিল। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন তরুণ রাজা পেন্থিয়াস, কিন্তু কোনও লাভ হয় না। শেষপর্যন্ত প্রতিপক্ষের উপর অলক্ষ্যে নজর রাখার জন্যে নারীর বেশে সাজিয়ে নেন নিজেকে। কিন্তু তিনি একটি সিংহকে হত্যা করেছেন ভেবে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত অবস্থায় মেয়েরা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে তাঁকে। এক উন্মত্ত মিছিলের সামনে থেকে পেন্থিয়াসের মা অগা বিজয়ীর বেশে ছেলের মৃতদেহ থেবসে নিয়ে আসেন। 

ট্র্যাজিক নাটকগুলো অনেক সময় নিকটজনের হত্যা তুলে ধরেছে, কিন্তু অস্বাভাবিক হত্যাকাণ্ডের জন্যে ট্র্যাজিডির পৃষ্ঠপোষক দিওনিসাসকে দায়ী করে ইউরিপিদিস যেন গোটা ঘরানাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন। নাটকের শেষে কোনও আশার চিহ্ন নেই। রাজবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, নারীরা পরিণত হয়েছে পশুতে, বুনো ম্যানিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছে আলোকিত যুক্তি; আর থেসকে-এমনি ক্রান্তিকালের অ্যাথেন্সের মতো-যেন অভিশপ্ত বলে মনে হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য কোনও ব্যাখ্যা না দিয়েই হত্যা করেন, অত্যাচার করেন আর মানুষকে অপমানিত করেন এমন একজন দেবতার উদ্দেশ্যে বার্ষিক আবেগ প্রকাশের কি মুল্য থাকতে পারে? 

অ্যাথেন্স যেন ট্র্যাজিডি অতিক্রম করে যাচ্ছিল আর সেটা করতে গিয়ে আবার অ্যাক্সিয়াল যুগ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। নাটকটি বহিরাগতকে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়া বিপজ্জনক বলে পোলিসকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছে। ঈদিপাস অ্যাট কোলোনাস-এ (৪০৬) সোফোক্লিস দেখিয়েছিলেন যে, শহরের পক্ষে আশীর্বাদের কর্ম হয়ে উঠবে এমন এক সহানুভূতির তৎপরতায় মৃত্যুপথযাত্রী ঈদিপাসকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করছে অ্যাথেন্স। কিন্তু দ্য ব্যাশে- তে আগন্তুককে প্রত্যাখ্যান করে ধ্বংস হয়ে গেছেন পেন্থিয়াস। এটা কেবল রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়করই ছিল না, বরং রহস্য উদযাপনের সময় ব্যক্তি অন্তরের আগন্তুককে শনাক্ত ও গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। বার্ষিক উৎসবে দিওনিসাসকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে অ্যাথেন্স নগরের হৃদয়ে তাঁর সম্মানের স্থান তুলে ধরার অনন্যতা দিয়েছিল, কিন্তু বছরের পরিক্রমায় তা অন্যান্য পোলিসের অলঙ্ঘনীয় ভিন্নতার মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, সেগুলোকে শোষণ ও আক্রমণ করেছে এবং এই প্রক্রিয়ায় হুব্রিসের শিকারে পরিণত হয়েছে। 

শেষ এই নাটকে অ্যাক্সিয়াল দর্শনের প্রাণের দিকে অগ্রসর হয়েছেন ইউরিপিদিস। দিওনিসাসের নিয়মিত শোকপালনকারী মিনাদসের কোরাসকে সঠিকভাবেই তাঁর কাল্টে দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল; শান্তি, বিচ্ছেদ এবং সংহতির এক দিব্য দর্শনের অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা। কিন্তু পরিবর্তনের মতবাদে দীক্ষাহীন থেবসের নারীরা তাদের মননের অন্ধকার কোণের তাড়নায় স্রেফ নিয়ন্ত্রণের অতীত হয়ে গেছে। মাথার উপর ছেলের মুণ্ডের ভীতিকর ট্রফি ধরে শহরে প্রবেশের সময় অগা একতাসিস অর্জন করেননি, বরং কেবল আপন সাফল্যে আনন্দ লাভ করেছেন : 

পৃথিবীর চোখে মহান,
আমার অবদান মহান
আর সেখানে করা আমার শিকার।৪৩ 

অবর্ণনীয়, অস্বাভাবিক সহিংসতারই কর্মতৎপরতাই এই বন্ধ্যা স্বার্থপরতার মোক্ষ। 

এই নাটকে ঈশ্বরের অন্যতম আলোড়নকারী ও সত্যিকারের দুর্জ্ঞেয় অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছেন ইউপিরিদিস। দিওনিসাসকে নীতিহীন, নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু তারপরেও অবিবদনীয়ভাবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তিনি, তাঁকে দমন বা বিতাড়িত করা যায়নি। আগন্তুক হিসাবে মানবীয় ছদ্মবেশে তাঁকে অপ্রাকৃত বলে মনে হয়েছে। দিওনিসাস সবসময় মুখোশধারী দেবতা ছিলেন-মুখোশ সবসময় মনে করিয়ে দিত যে যা মনে হয় আসলে তিনি তারচেয়ে ভিন্ন কিছু। মানবরূপী অপচ্ছায়া নয় বরং কেবল যা দেখে তাতেই বিশ্বাস করা লোকদের চোখের সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করে ফেলে মঞ্চ থেকে আকস্মিক অন্তর্ধানই তাঁর মহত্তম অলৌকিকত্ব ছিল। সারা দুনিয়া জুড়ে নীরবতা নেমে এসেছিল, ফলে তাঁর উপস্থিতি আরও বেশি করে অনুভূত হয়েছিল।৪৪ প্রাচীন অলিম্পিয়ান দর্শন নিজেকে ছাপিয়ে প্রতীকের অতীত অনির্বচনীয় বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। 

৩৯৯ সালে সক্রেটিসের মৃত্যু ছিল এই সময়ের দ্বিতীয় মহান ট্র্যাজিডি। বিচারের সময় রাষ্ট্রের দেবতাদের শনাক্তকরণে ব্যর্থতা, নতুন দেবতাদের আমদানি ঘটানো এবং তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁকে। বিচার কালে তরুণ প্লেটো উপস্থিত ছিলেন; এই ঘটনা গভীর প্রভাব ফেলে তাঁর উপর। আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে সক্রেটিসের জবানবন্দী অপটু ছিল। তরুণ সমাজকে তিনি বেপথু করতে পারেন না, বলেছেন তিনি। কাউকে শেখানোর মতো যথেষ্ট বিদ্যা তাঁর নেই। অ্যাথেন্সের মঙ্গলের লক্ষ্যেই কাজ করেছিলেন তিনি, কিন্তু পোলিস তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তারপরেও নিজের ব্রত ত্যাগ করতে পারবেন না। ‘ভালো প্রসঙ্গে আলাপ ছাড়া একটা দিনও না কাটানো এবং আমাকে যেসব বিষয়ে কথা বলতে শোনো সেগুলো নিয়ে কথা বলাই কারও পক্ষে সবচেয়ে ভালো কাজ হতে পারে। বিচারকদের বিশ্বাস করাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি, ফলে দণ্ডিত হয়েছিলেন মৃত্যুদণ্ডে। 

দীর্ঘকাল থেকে সন্দেহ ও ভীতির বিষয় ছিলেন সক্রেটিস। আলসিবিয়াদাসের মতো তাঁর কোনও কোনও সহযোগী অ্যাথেন্সের সামরিক বিপর্যয়ে সংশ্লিষ্ট ছিলেন; সক্রেটিস পরিণত হয়েছিলেন বলীর পাঠায়। ভুল সময়ে ঠিক কথা বলেছিলেন তিনি। অ্যাথেন্সের প্রতি নিবেদিত হয়ে শেষপর্যন্ত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি, কারাগার থেকে পালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, এমনকি রায় অন্যায় হলেও নির্বাসনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন: তাঁর বয়স প্রায় সত্তর হয়ে গেছে, সোজাসাপ্টা বলেছেন তিনি, অন্য কোথাও গিয়ে বাঁচতে চান না। তিনি ছিলেন সত্যের পতাকাধারী, এবং বর্তমানের অধিপত্য বিস্তার করে চলা অসত্যের সাক্ষী (শহীদ) হয়ে জীবন দেবেন। কাউকে দোষ দিতে যাবেন না। মৃত্যুতে ট্র্যাজিক কিছু নেই, শিষ্যদের বলেছেন তিনি। সেটা কি, কেউ জানে না। এমনকি মহামঙ্গলময়ও হতে পারে সেটা। জীবন ভর তিনি বিশ্বাস করে এসেছিলেন যে, একটি দায়মোন, স্বর্গীয় সত্তা, তাঁকে অনুসরণ করে চলে, জটিল মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে কথা বলে। করণীয় সম্পর্কে কোনওদিনই কিছু বলেনি তা, তবে বিশেষ কিছু কাজের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। বিচারের সময় তাঁর মনের কণ্ঠের কথা না বলটা উৎসাহব্যাঞ্জক মনে হয়েছে তাঁর কাছে। নিশ্চয়ই তিনি সঠিক পথে ছিলেন, ভালোর কাছেই ফিরে যাচ্ছেন। 

নির্দিষ্ট বিষ পান করার সময় বন্ধুরা তাঁকে ঘিরে বসেছিলেন। প্লেটো বলেছেন, মৃত্যুর পর যাতে মেয়েদের ঝামেলা না হয় তাই হেমলক পান করার আগে গোসল করেছেন তিনি। কারাপ্রধানকে সৌজন্যের সঙ্গে ধন্যবাদ দিয়েছেন, নিজের বিপত্তি নিয়ে মৃদু রসিকতাও করেছেন। শান্তভাবে মৃত্যুর মোকাবিলা করতে পেরেছেন তিনি, বন্ধুদের শোক করতে নিষেধ করেছেন এবং নীরবে, ভালোবেসে তাঁদের সাহচর্য গ্রহণ করেছেন। বিধ্বংসী, সর্বগ্রাসী বিষাদের জায়গায় শান্ত, গ্রাহী শান্তি বিরাজ করছিল। অ্যাক্সিয়াল যুগ জুড়ে সাধুরা মৃত্যু নিয়ে ভাবিত ছিলেন। সক্রেটিস দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, বেদনা ও কষ্টের মাঝেও একজন মানুষের পক্ষে তার অবস্থাকে ছাপিয়ে যাওয়া প্রশান্তি অনুভব করা সম্ভব। 

.

কনফুসিয়াসের মৃত্যুর অল্প পরেই এক অস্বস্তিকর ও ভীতিময় যুগে পা রেখেছিল চীন, ইতিহাসবিদরা একে বলছেন যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর কাল। চীনের ইতিহাসে এক চরম পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল সেটা। ৪৫৩ সালে তিনটি পরিবার জিনের রাজকুমারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জিন এলাকায় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে: হান, ওয়েই এবং ঝাও। এটাই ছিল দীর্ঘকাল ধরে পতনোন্মুখ ঝোউ রাজবংশের সত্যিকারের সমাপ্তি: এর আগপর্যন্ত চীনের শাসকরা ঝোউ রাজাদের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হতেন; কিন্তু এবার অবশ্য স্রেফ সামরিক শক্তি বলেই এই নতুন রাজ্যগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ঝোউ রাজার এখানে কিছুই করার ছিল না। এই মুহূর্ত থেকেই চীনের একক অধিকার লাভের উদ্দেশ্যে বৃহত্তর ও শক্তিশালী রাজ্যগুলো ভয়ঙ্কর লড়াইতে জড়িয়ে পড়েছিল। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা ছিল দক্ষিণে চু রাজ্য, এটা ছিল অর্ধেক চীন; পশ্চিমা শেনসির রুক্ষ, যুদ্ধমান রাজ্য কিন; সমৃদ্ধ সামুদ্রিক রাজ্য কি; ও ‘থ্রি জিন’-হান, ওয়েই ও ঝাও-এর নতুন তিনটি রাজ্য; এবং উত্তরের স্তেপের কাছে ইয়ান। প্রথমদিকে কূটনীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সমতলের ছোট ছোট প্রিন্সিপালিটিগুলো নিজেদের রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী দুশো বছর সময়কালে বৃহত্তর, অধিকতর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের কাছে পরাস্ত হয়ে এক এক করে এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। 

যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর যুগ ছিল ইতিহাসের তেমনি বিল সময়গুলোর একটা যখন একের পর এক পরিবর্তন একটি অপরটিকে জোরাল করে উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়।৪৬ ২২১ সালে অবশেষে এইসব লড়াইয়ের অবসান ঘটলে চীনের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা পায়। কিন্তু যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর প্রাথমিক সময়ে বেশির ভাগ লোকই কেবল কেন্দ্রীয় সমভূমির জীবন আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সহিংস হয়ে ওঠার ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। এই অভিজ্ঞতার ত্রাস এক নতুন ধর্মীয় দর্শনের অনুসন্ধান আরও জোরাল করে তুলেছিল। 

খোদ যুদ্ধবিগ্রহই পাল্টে গিয়েছিল।৪৭ সৌজন্যের প্রতিযোগিতায় একে অন্যকে পরাস্ত করার প্রয়াসী দরবারী রথচালকদের ভেতর আর আচরিক দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব ছিল না। নতুন নতুন এলাকা দখল, জনগণকে অধীনে নিয়ে আসতে ও শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেই সামরিকায়িত রাজ্যগুলো যুদ্ধ করছিল। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছিল ও আরও বেশি করে ময়দানে গড়াচ্ছিল। ভয়ঙ্কর দক্ষতায় বৈশিষ্ট্যায়িত হচ্ছিল যুদ্ধগুলো, যার জন্যে প্রয়োজন ছিল নির্দেশনার ঐক্য, কৌশল, প্রশিক্ষিত বাহিনী আর বিপুল সম্পদ। যুদ্ধ এখন সামরিক বিশেষজ্ঞের হাতে পরিকল্পিত হচ্ছিল এবং নিয়ম, শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা সম্মান ও মর্যাদার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। প্রাচীনকালে নারী বা শিশু হত্যা বা বিকলাঙ্গকে আঘাত করার কথা কল্পনাও করতে পারত না কেউ; কিন্তু এখন “বয়স্ক হলেও যাদের শক্তি আছে তারা সবাই আমাদের শত্রু,’ বলেছিলেন এক আধুনিক জেনারেল। ‘আহতরা মরণোন্মুখ না হয়ে থাকলে কেন আমরা তাকে আবার আঘাত করা থেকে বিরত থাকব? ৮ 

ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইতিমধ্যেই রাজ্যগুলো এক নতুন সামরিক প্রযুক্তি গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। নগর প্রাচীরে হামলা চালাতে চলমান মিনার ও চাকাঅলা মই তৈরি করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা, খনি ও ভূগর্ভস্থ পরীখা খনন করেছেন এবং শত্রুর সুড়ঙ্গে ধোঁয়া পাঠাতে হাপর আবিষ্কার করেছেন। খোদ ল্যান্ডস্কেপকেও যুদ্ধের জন্যে সংগঠিত করা হয়েছে: চু ও কি হোনান ও শানতাং- এ প্রথম প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করে; কিন ইয়েলো রিভারের ডাইকসমূহ সুরক্ষিত করে। সীমান্ত বরাবর দুর্গ নির্মিত হয় ও পেশাদার সেনাছাউনীর মাধ্যমে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। অধিকহারে জমি নিষ্কাষণ করা হয় ও এইসব ব্যয়বহুল অভিযানের ব্যয় মেটানোর লক্ষ্যে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রথমবারের মতো খাল খনন করা হয়। 

অধিক হারে জনগণকে সংগঠিত করা হয়। রাজকীয় প্রাচীন সামন্তবাদী যুদ্ধে ক্ষেতমজুররা ছিল প্রান্তিক কুশীলব, যুদ্ধে কোনওরকম অংশ নিত না। এখন, লক্ষ লক্ষ ক্ষেতমজুরকে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হওয়া পদাতিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে যখন পাহাড়ি এলাকাসমূহ রথ-যুদ্ধের পক্ষে জুৎসই ছিল না তখন লুপ্ত জিন রাজ্যই ছিল পদাতিক বাহিনী ব্যবহারকারী প্রথম দেশ। ইউই এবং উ রাজ্য দুটোর জলাভূমি ভরা এলাকায় রথ চলাচলের পক্ষে অনেক বেশি হ্রদ আর জলপথ থাকায় তার পথ ধরেছিল। ক্রমশঃ যোদ্ধা ক্ষেতমজুর সমাজই সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে প্রধান উপাদানে পরিণত হয়েছিল। ধীরে ধীরে অভিজাত রথ-বাহিনী মিলিয়ে গেছে, সৈনিক পেশা পরিণত হয়েছে নিম্নশ্রেণীর পেশায়। স্তেপের যাযাবরদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন সমর বিশেষজ্ঞরা। চতুর্থ শতাব্দীতে ঝামেলাপূর্ণ রথ-বাহিনীর তুলনায় অনেক বেশি চলিষ্ণু ভয়ঙ্কর ফল নিয়ে কোনও সম্প্রদায়ের উপর আচমকা হামলা চালানোর ক্ষমতাঅলা অশ্বারোহী বাহিনীর সূচনা ঘটাবেন তারা। নতুন যোদ্ধারা যাযাবরদের প্রাচীন অস্ত্রও ব্যবহার করত: পুরোনো রেট্রোফ্লেক্স ধনুকের ঢের বেশি নিখুঁত তলোয়ার ও ক্রস-বো; আধা মাইল দূর থেকেও হত্যা রতে সক্ষম ছিল সেগুলো। 

আগ্রাসীভাবে প্রসারমান বৃহৎ রাজ্যগুলো মিতাচার ও সংযমের আদর্শকে একপাশে ঠেলে দিয়েছিল। অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান আবার সহিংস ও বিলাসী প্রদর্শনী হয়ে ওঠে। এক রাজা তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিপুল সম্পত্তি মাটি চাপা দিয়েছিলেন, নর্তক ও সাধারণ পরিবারের বাচ্চাদেরও উৎসর্গ করেছিলেন তার সাথে।৪৯ আধুনিক শাসকদের এখন নারী, বাদক, নর্তক, বাজিগর, ভাঁড় আর গ্ল্যাডিয়টরে বোঝাই বর্ণিল, জাঁকাল ঘরবাড়ি ছিল। মূলত যারা রাজকুমার ও প্রজাদের আচারায়িত দরবারী আলাপচারিতার পরামর্শ দিতেন, তাঁরা এখন চতুর বিতর্কের কৌশলের বিকাশ ঘাটিয়েছিলেন এবং জনসংযোগ ও কূটনীতির ক্ষেত্রে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। দরিদ্র ভবঘুরে শি-রাও রাজদরবারের আশপাশে জমায়েত হয়ে চাকরির আশায় নিজেদের প্রতিভার পরিচয় রাখছিল। তাঁদের কেউ কেউ পণ্ডিত ছিলেন। নতুন রাজ্য ওয়েই-এর ডিউক ওয়েন (৪৪৬-৩৯৫) পরিণত হয়েছিলেন বিদ্যার পৃষ্ঠপোষকে, তাঁকে প্রটোকল ও নীতি বিষয়ে পরামর্শ যোগানো সাহিত্যিকদের একটি চক্রের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন তিনি। এই রাজারা প্রতিযোগিতে পরিণত হওয়া অভিজাতদের আর বিশ্বাস করছিলেন না; বরং ক্রমবর্ধমানহারে এইসব ‘মূল্যবান ব্যক্তিদের’ পরামর্শের দিকে ঝুঁকছিলেন। কনফুসিয়াসের শিষ্য যিগজিয়া ডিউক ওয়েই-এর অন্যতম অনুগ্রহভাজন ছিলেন। 

কিন্তু এই প্রয়োগবাদী সময়ে শাসকরা কনফুসিয়াসকে বড় বেশি আদর্শবাদী মনে করেছেন, ফলে ক্রমবর্ধমান হারে শি-শ্রেণীর অন্য সদস্যদের মতো নগরে নিজেদের অবস্থান হারিয়ে চাকরির আশায় পল্লী এলাকায় ঘুরে বেড়ানো প্রান্তিক সমর বিশেষজ্ঞদের একটি দল যিয়ে-দের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন তাঁরা। যুদ্ধমান রাজ্যের সময় নাগাদ অবশ্য যিয়ে-দের অনেকেই নিম্ন শ্রেণী থেকে নিযুক্ত হচ্ছিলেন। যতক্ষণ পর্যাপ্ত পুরস্কার মিলছে যেকোনও সেনাবাহিনীতে যুদ্ধ করতে তৈরি মার্সেনারি ছিলেন এরা। অধিকতর অভিজাত কনফুসিয়বাদীদের বিপরীতে আগ্রাসী সক্রিয় মানুষ ছিলেন এরা। পরবর্তী কালের একজন ইতিহাসবিদের মতে, ‘তাদের কথা সবসময় অটল ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল, তাদের কাজ ছিল ক্ষিপ্র ও চূড়ান্ত। সবসময় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করত তারা এবং নিজেদের তোয়াক্কা না করে বিপদের দিকে ছুটে যেত, হুমকি দিত অন্যদের ৫০ 

কিন্তু পঞ্চম শতাব্দীর শেষদিকে যিয়েদের একজন সেনাবাহিনীর প্রতি পিছন ফিরে অহিংসার বাণী প্রচার শুরু করেছিলেন। তাঁকে ডাকা হতো মোজি, ‘গুরু মো’ (সি. ৪৮০-৩৯০)। তাঁর সম্পর্কে সামান্যই জানি আমরা, কারণ তাঁর নাম ধারণ করা সংলাপের বইগুলো অ্যানালেক্টসের চেয়ে ঢের বেশি নৈর্ব্যক্তিক, এবং ধারণা আড়ালে হারিয়ে গেছেন ব্যক্তি মোজি।৫১ ১৮০ জন লোকের কঠোর নিয়ন্ত্রিত ভ্রাতৃসংঘের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। কনফুসিয়াসের শিথিল সংগঠিত শিষ্যদের বিপরীতে মোজির মতবাদ একটি গোষ্ঠীর মতে ছিল। কঠোর বিধিবিধান ছিল এর, তীব্রভাবে সাম্যতার নীতি অনুসরণ করত এবং সদস্যরা ক্ষেতমজুর বা কারুশিল্পীদের মতো পোশাক পরত। মার্সেনারি হিসাবে কাজ করার বদলে মোহিস্টরা যুদ্ধ থামাতে হস্তক্ষেপ করত, অপেক্ষাকৃত ছোট অধিক আক্রমণযোগ্য শহরের প্রতিরক্ষায় অংশ নিত ভিত মোজির নয়টি অধ্যায় প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের কৌশল ও নগর প্রাচীর নির্মাণের সরঞ্জাম নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু মোজি দার্শনিকও ছিলেন। নিয়মনিষ্ঠ কর্মকাণ্ডে তৎপরতায় থেমে থাকেননি তিনি, বরং দরবার থেকে দরবারে ঘুরে বেড়িয়েছেন, শাসকদের কাছে নিজের দারুণ মৌলিক ধারণার প্রচার করে গেছেন। 

মোজির প্রমাণ থেকে গুরু মো আদিতে হয়তো একজন কারুশিল্পী বা চিত্রশিল্পী হয়ে থাকতে পারেন বলে মনে হয়। কর্মী মানুষের চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তিনি, বিশ্বের স্বর্গীয় সংগঠনকে ‘বিশ্ব জুড়ে গোলক আর বর্গক্ষেত্রের পরিমাপের জন্যে ব্যবহার করা’৫৪ চাকার মিস্ত্রী ও ছুঁতোরের সরঞ্জাম কম্পাস ও এল-স্কয়ার-এর সাথে তুলনা করেছেন। অ্যানালেক্টসের মোহনীয় প্রকরণের তুলনায় মোজির গদ্য কিছুটা নিরস, শ্লথ গতির, যাতে মনে হয় সম্ভবত স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন তিনি, লিখতে যাঁর কষ্ট হতো ৫ ঐতিহ্যের উপর প্রশংসনীয় দখল। ৫৫ সত্ত্বেও ধরনের বেলায় তাঁর বিব্রতভাবের অবশেষ থেকে মনে হয় অভিজাত সমাজের উচ্চ সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ সহজ ছিলেন না মোজি। মো এবং তাঁর অনুসারীরা উচ্চাভিলাষী মানুষ ছিলেন, মর্যাদা ও অবস্থান নিয়ে অভিজাত সম্প্রদায়ের বাড়াবাড়িতে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন। ব্যয় সংকোচন, বাড়াবাড়ি কমানো এবং তাঁর নিজ শ্রেণীর অধিকতর দরিদ্র রীতি ফুটিয়ে তুলবে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। 

উদাহরণ স্বরূপ, ঝোউ রাজবংশের কঠোর সমালোচক ছিলেন মোজি এবং কনফুসিয়াসের আদর্শ ঝোউ-এর ডিউকের প্রতি তেমন একটা সম্মান বোধ করতেন না। কনফুসিয়াসের কাছে খুবই অনুপ্রেরণাদায়ী ঝোউ আচার, সঙ্গীত ও সাহিত্যেও সামান্যই আগ্রহ ছিল তাঁর। দরিদ্র সাধারণ কখনওই এইসব ব্যাপক দরবারী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেনি, আর লি-কে যেন মোহিস্টদের কাছে সময় ও অর্থের দারুণ অপচয় বলে মনে হয়েছে। মোজি গভীরভাবে ধার্মিক ছিলেন, স্বর্গ ও প্রকৃতির আত্মার কাছে উৎসর্গ করা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু পূর্বপুরুষের মন্দিরে জাঁকাল আনুষ্ঠানিক আচারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। বিশেষভাবে ব্যয়বহুল শেষকৃত্য ও দীর্ঘ তিন বছর মেয়াদী শোক-কালের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি। অলস ধনীদের পক্ষে এসব বেশ মানানসই ছিল বটে, কিন্তু সবাই এইসব আচার পালন করতে গেলে কি অবস্থা দাঁড়াবে? শ্রমিকদের শেষ করে দেবে, অর্থনীতিতে ধস নামাবে আর রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেবে।৫৬ আচার সম্পর্কে কঠোর বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতেন মোজি। শাসকরা এইসব অনুষ্ঠানের পেছনে বেমানান অংকের অর্থ ব্যয় করতেন, তখন সাধারণ মানুষের খাবার আর কাপড় যোগাড়ের মতো প্রয়োজনীয় উপায় থাকত না। লি আত্মাকে উন্নত করতে পারেনি; শাস্ত্রজ্ঞরা স্রেফ তাদের সময়ের সমস্যা থেকে পিছু হটে গেছেন, প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানের আলোচনায় আশ্রয় নিয়ে বিশ্বকে মুক্ত করার সব আশা জলাঞ্জলি দিয়েছেন তাঁরা। 

কনফুসিয়াসের মৃত্যুর পরের সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল। আমরা যেমন দেখব, চতুর্থ ও তৃতীয় শতাব্দীতে কনফুসিয়বাদীরা দরিদ্রদের দুর্ভোগ নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন ও সমাজের সংস্কারের লক্ষ্যে ক্লান্তিহীন কাজ করে যাবেন। কিন্তু মোজির সময়ে শাস্ত্রজ্ঞদের কেউ কেউ হয়তো বিশাল প্রান্তরের ব্যাপক পরিবর্তন দেখে প্রবল ধাক্কা খেয়ে মো-র বর্ণিত উপায়েই সমাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন। মোজি অবশ্য ক্ষেতমজুরদের দুরবস্থায় দারুণ হতাশ ছিলেন, যুদ্ধ করার জন্যে তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হতো, জোর করে কর্ভিতে নিয়োগ দেওয়া হতো, আর করভারে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতো তারা। আশ্রয়, বস্ত্র আর নিরাপত্তার মৌলিক চাহিদা মেটানো আবিশ্যিক ছিল। মোজি বিপ্লবী ছিলেন না। শাসকশ্রেণীকে উৎখাত করতে চাননি তিনি, কিন্তু চীনা মূল্যবোধের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে বিশ্বাস করেছিলেন। মোজি বিশ্বাস করতেন, সাধু রাজারা জীবনের মৌল চাহিদা মেটাতে পেরেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাদের অবশ্যই ইয়াও, শান ও ইউ-র আদর্শে ফিরে যেতে হবে, যাঁরা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে আধুনিকতা, বিলাসিতা আর জাঁকাল প্রদর্শনীতে জীবন কাটাননি। তাঁরা নিজেদের বাড়ি ততখানি উঁচু করেই নির্মাণ করেছেন যাতে স্যাঁতসেঁতে না হয়ে পড়ে; তাদের দেয়াল স্রেফ বৃষ্টি আর তুষারপাত থেকে বাঁচানোর মতো পুরু ছিল আর ভেতরের পাঁচিলগুলো ছিল লিঙ্গদের বিচ্ছিন্ন করার মতো যথেষ্ট উঁচু।৭ মহান মর্যাদা আর বিপুল সম্পদ সত্ত্বেও পানি বণ্টন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের কৌশল আবিষ্কার করতে গিয়ে কার্যত সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্যে কাজ করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া ইউ ছিলেন মোজির প্রিয় মানুষ। 

মোজির বাণী সমগ্রবাদী ও প্রয়োগবাদী ছিল, তবু ইউটোপিয় স্বপ্ন লালন করেছেন তিনি। মানুষকে ঘৃণার বদলে ভালোবাসায় সম্মত করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতেন। কনফুসিয়াসের মতোই একক সূত্র রেন তাঁর দর্শনকে ধরে রেখেছিল, কিন্তু কনফুসিয়াস পরিবারের ভেতর সীমিত করে সমবেদনার নীতিকে বিকৃত করেছেন সবলে বিশ্বাস করতেন তিনি। তাঁর চোখে অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ল্যান চেতনা চলমান বহু সমস্যার মূল ছিল: পরিবার, উৎকট দেশপ্রেম, সম্মানের জন্যে প্রতিযোগিতা, প্রতিশোধ আর বেহিসাবী খরচ। সরলীকৃত কল্যাণবাদের সাহায্যে স্বজনপ্রীতির অহমবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন তিনি।৫৮ সবাইকে অবশ্যই তার নিজের লোকদের মতোই অন্যের প্রতি অনুভূতি থাকতে হবে। ‘অন্যদের অবশ্যই নিজের মতো দেখতে হবে,’ বলেছেন তিনি; এই ভালোবাসাকে অবশ্যই ‘সর্বব্যাপী হতে হবে, কাউকে বাদ দিতে পারবে না।৫৯ শাসকদের তরফ থেকেই সংস্কার আসতে হবে: জিয়ান আই-এর চর্চায় অনুপ্রাণিত করাই এইসব ভীতিকর লড়াইতে এক চীনাদের একে অপরকে হত্যা করা ঠেকানোর একমাত্র উপায়। 

জিয়ান আই-কে প্রায়শঃই ‘সর্বজনীন ভালোবাসা’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়, কিন্তু মোজির সমগ্রবাদী রেওয়াজের ক্ষেত্রে তা বড্ড বেশি মানসিক চাঞ্চল্য উদ্রেককারী।[৬০] চীনারা সবার প্রতি উষ্ণ প্রীতি ও দয়ার্দ্র মনোভাব গড়ে তুলবে, এমন আশা করেননি মোজি। অনুভূতির চেয়ে বরং ন্যায়বিচারের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন তিনি। জিয়ান আই ঔদার্যের পরিকল্পিত প্রবণতা ছিল, যাতে আপনি সবার, এমনকি- এবং সম্ভবত বিশেষ করে যারা আপনার নিকটতম সম্প্রদায়ে বাস করে না তাদেরও মঙ্গল কামনা করতে পারেন। সমতা, ন্যায়বিচার এবং ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল মানুষের প্রতি পক্ষপাতহীন সহানুভূতির উপর ভিত্তি করে জিয়ান আই গড়ে তোলা হয়েছিল। এটা শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে অনিবার্য বলে বিশ্বাস করেছিলেন মোজি। বর্তমানে শাসকরা কেবল তাঁদের নিজেদের রাজ্যকেই ভালোবাসেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করেন না। কিন্তু তাঁদের অন্যের প্রতি নিজেদের মতো একই রকম সহানুভূতি বোধের শিক্ষা দেওয়া গেলে সেটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ‘অন্যের দেশকে তোমার নিজের দেশের মতো, অন্যের পরিবারকে নিজের পরিবারের মতো, আর অন্যের সত্তাকে নিজের সত্তার মতো দেখ,’ তাগিদ দিয়েছেন মো। ‘বিভিন্ন দেশের প্রভুরা এক অন্যের প্রতি সহানুভূতি বোধ করলে তখন আর তাঁরা যুদ্ধে যাবেন না।’ ভাইদের ভেতর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে তারা ঝগড়া করবে; প্রভুদের জিয়ান আই না থাকলে তাঁরা সেনাবাহিনী তলব করবেন। ‘জিয়ান আই-এর অভাবই সবক্ষেত্রে বিশ্বের দুর্যোগ, অধিকারচ্যুতি, অসন্তোষ আর ঘৃণার উৎপত্তির কারণ। ৬১ 

স্বর্ণবিধি’র মোজির ভাষ্য হয়তো বা কনফুসিয়াসের চেয়ে কম বাঙ্ময়ভাবে প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে, তবে অবিলম্বে তাকে অনেক বেশি বিপ্লবী ভাবা হয়েছিল। পরিবারকে অন্যকে ভালোবাসা শেখার স্থান হিসাবে দেখার বদলে বিপরীত দিক থেকে- জিয়ান আই ‘সকলের জন্যে উদ্বেগ’ই আপনার পরিবার বা রাষ্ট্রকে ঠিকভাবে ভালোবাসা সম্ভবপর করেছে যুক্তি দেখিয়েছেন মোজি। মানুষ গোটা মানবজাতির প্রতি ঔদার্যের বোধের চর্চা না করলে পারিবারিক ভালোবাসা ও দেশপ্রেম সম্মিলিত অহমবাদে পরিণত হবে। তাঁর চোখে কনফুসিয় পরিবার স্রেফ বিশেষ-স্বার্থবাদী দল ছিল। এমনকি অপরাধীরাও তাদের পরিবারকে ভালোবাসে, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের অবস্থা ফেরাতে অন্যের উপর ডাকাতি করে। মানুষ তাদের পরিবার বা জাতিকে অতিক্রম করতে না পারলে জগতের দুর্গতির কারণ স্বার্থপরতার ভীষণ অশুভ আশঙ্কার সম্ভাবনায় অপরাধী হবে তারা। 

জিয়ান আই সরাসরি অহিংসার দিকে চালিত করেছে। তাঁর বইয়ের ‘রিজেকশন অভ এগ্রেশন’ নামের অধ্যায়ে যত্নের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যয় ও এ থেকে পাওয়া সুবিধার তুলনা করেছেন মোজি। যুদ্ধ ফসল নষ্ট করে, অগুনতি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে, অস্ত্র ও ঘোড়ার অপচয় ঘটায় ও পূর্বপুরুষদের পক্ষে উৎসর্গ করার মতো আর কাউকে অবশিষ্ট রাখে না। যুদ্ধের ফলে রাষ্ট্রের লাভবান হওয়ার যুক্তি দেখান শাসকরা, কিন্তু কোনও ছোট শহরের দখলের ফলে এমন এক সময়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে যখন ক্ষেতে কাজ করার জন্যে অনেক লোকের প্রয়োজন। এমন একটা জিনিস কিভাবে রাজ্যের পক্ষে ভালো হতে পারে? বড় রাজ্যগুলো ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের এলাকা দখল করে লাভবান হতে পারবে মনে করেছে, কিন্তু তাদের যুদ্ধের ফলে দশ হাজার লোকের ভেতর মাত্র পাঁচ জন লোক লাভবান হয়েছে। মোজির কোনও কোনও অধ্যায়, সম্ভবত মোহিস্টদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে লিখিত হয়ে থাকবে, আত্মরক্ষার স্বার্থে যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছে; অবরোধের সময় শহর প্রতিরক্ষার নির্দেশনা দেওয়া আছে তাতে। কিন্তু স্বয়ং মোজি সম্ভবত কঠোরভাবে শান্তিবাদী ছিলেন, সবধরনের সহিংসতার বিরোধী ছিলেন তিনি এবং বিশাল প্রান্তরের রাজ্যগুলোকে গ্রাস করতে চলা যুদ্ধের চক্র থেকে শাসকদের বের করে আনতে একের পর এক রাজ্যে ভ্রমণ করেছেন 

পারিবারিক মূল্যবোধ যাদের কাছে অলঙ্ঘনীয় ছিল সেইসব বহু চীনা মোজির ধ্যান-ধারণায় রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছিল বলে নিজের বিশ্বাসের পক্ষে যৌক্তিকভাবে কথা বলার জন্যে একটি কৌশলের সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এই কারণেই মোজি যুক্তি ও দ্বান্দ্বিকতার উপর প্রথম চৈনিক প্রবন্ধ ধারণ করে; তৃতীয় শতক নাগাদ রচিত পরবর্তী কালের কিছু অধ্যায় পদ্ধতিগত যুক্তি উত্থাপন, সংজ্ঞা ও নির্ভুল ব্যাকরণের নীতিমালার উন্নত উপলব্ধি তুলে ধরেছে। এই পদ্ধতি অ্যানালেক্টস-এর মোহনীয় কৌশল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। জুনযিরা দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা ও চিন্তাভাবনার পর তাঁর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করবে ও সহজাতভাবেই তা অনুভব করবে বলে ধরে নিয়েছিলেন কনফুসিয়াস। কিন্তু মোজি’র ‘উপযুক্ত ব্যক্তি’ (যিয়ান) সক্রিয় এবং যৌক্তিকভাবে তাদের সত্যির দিকে অগ্রসর হওয়া মানুষ ছিল। ‘গুণবান আচরণে এবং তর্কে দক্ষতা নিয়ে*৬৪ উত্তম ছিল তারা। ইতিহাসের এই সঙ্কটকালে বিরোধী পক্ষকে জিয়ান আই-এর গুরুত্ব বোঝাতে তাদের মন্তব্য সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট হওয়ার প্রয়োজন ছিল। মোহিস্টরা ভালো থাকার চেয়ে বরং ভালো কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল। কনফুসিয়াসের রেন প্রাথমিকভাবে অন্তস্থঃ গুণ ছিল, কিন্তু ‘উপযুক্ত মানুষ’রা আপাতদৃষ্টিতে বাহ্যিক জগমুখী ছিল। মোহিস্টরা আত্ম-চর্চার ধীর অগ্রগতিতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু তাদের বাস্তবভিত্তিক দক্ষতা, যুক্তি ও ইচ্ছাশক্তিকে সমাজের সেবায় প্রয়োগ করতে চেয়েছে। 

মোজি তাঁর দর্শনকে দশটি থিসিসে পর্যালোচনা করেছেন, এর প্রতিটি একটি প্রস্তাব হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানুষের কি ‘সবার জন্যেই উদ্বেগ থাকা উচিত?’ তাদের কি ‘আগ্রাসন প্রত্যাখ্যান করা উচিত? জাঁকাল শেষকৃত্য, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং স্বর্গীয় ইচ্ছার ব্যাপারে মোহিস্টরা কি মনে করে? মানুষের কাজ কি নিয়তি নির্ধারিত? মোহিস্টদের কিভাবে গুরুদের কাছে অগ্রসর হওয়া উচিত? প্রতিটি প্রস্তাবকে তিনটি মাণদণ্ডে বিচার করা হতো। এটা কি সাধু রাজাদের অনুশীলনের সঙ্গে মানানসই? এটা কি সাধারণ জ্ঞানের সমর্থন পায়? এবং-সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-এর থেকে কি মানবজাতি উপকৃত হবে? এর কোনও একটি পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বিলাসী শেষকৃত্য ও সঙ্গীত সমাজের কোনও সুবিধা বয়ে আনেনি, সুতরাং তাদের বিদায় নিতে হবে। কেউ কোনও দিন নিয়তি’র দেখা পায়নি, তো কনফুসিয়বাদীদের বিশ্বকে বদলাতে পারবে না বলে বিশ্বাসে বাধ্য করা নির্দিষ্টতাবাদ প্রকৃত উপযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে সঠিক প্রবণতা ছিল না। 

মোজির নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি খাঁটি সমগ্রবাদী ছিল। কোনও কাজের ফলে দরিদ্র উপকৃত হলে, অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুকে প্রতিহত করা গেলে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটালে ও জন শৃঙ্খলায় অবদান রাখলেই তাকে সৎকাজ বলা যাবে। মানুষকে অবশ্যই যুক্তির মাধ্যমে তাদের স্বার্থপরতা থেকে বের করে আনতে হবে; মানুষ স্বভাব-অহমবাদী, সুতরাং অকাট্য যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে হবে যে, তাদের কল্যাণ সম্পূর্ণই গোটা মানবজাতির কল্যাণের উপর নির্ভরশীল এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক ‘সকলের জন্যে উদ্বেগ’ সমৃদ্ধি, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে আবিশ্যিক ৬৫ মোহিস্টদের শাসকদের বোঝাতেই হবে যে আগ্রাসন তাঁদের পক্ষে সেরা বিকল্প নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ তাঁদের নিজেদের প্রজাদেরই দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। তাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে এবং বিজয় ঘৃণা ও ঈর্ষা উস্কে দিয়েছে। কেবল প্রত্যেকে সমতা নিয়ে অন্যের প্রতি আচরণ করলে ও আপন স্বার্থ অতিক্রম করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত সম্পদ, সুখ ও সাফল্য লাভ করতে পারবেন তাঁরা। শাসকদের অবশ্যই ‘কেবল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত৬৬ না থাকার শিক্ষা দিতে হবে। 

স্বার্থপর ও সহিংস হলে স্বর্গীয় ক্রোধ ডেকে আনবেন তাঁরা। কনফুসিয়াসের বিপরীতে, স্বর্গ নিয়ে কথা না বলতেই পছন্দ করতেন তিনি, মোজি তাঁর প্রায় প্রতিটি যুক্তির পক্ষে পরম ঈশ্বরের দোহাই দিয়েছেন। স্বৰ্গ কোন বৈষম্য ছাড়াই সকল মানুষকে ভালোবাসেন এবং তিনিই জিয়ান আই-এর উৎকৃষ্ট নজীর। ‘স্বর্গ সর্বব্যাপী, স্বার্থপর নন,’ জোরের সঙ্গে বলেছেন মোজি। 

স্বর্গ উদার ও ক্রোধহীন; স্বর্গের উপলব্ধি চিরন্তন ও কখনওই তা হ্রাস পায় না…স্বর্গ সকল মানুষকে জীবন দান ও তাদের বাঁচিয়ে রাখার ভেতর দিয়ে তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করেন। কেউ স্বর্গের লঙ্ঘন করলে স্বৰ্গ দুর্যোগ পাঠাবেন। সাধুরা স্বর্গকে তাঁদের আদর্শে পরিণত করেছে বলেই তাদের সকল কর্মকাণ্ড ফলপ্রসু ছিল। 

দীর্ঘদিন ধরেই অভিজাত গোষ্ঠী স্বর্গের এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক ধারণার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু মোজি সম্ভবত তখনও স্বর্গকে ব্যক্তিরূপ উপাস্য হিসাবে দেখা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস তুলে ধরেছেন। কিন্তু ঈশ্বর ও আত্মায় জোরাল, আক্ষরিক-মানসিক বিশ্বাস সত্ত্বেও মোজির ধর্মীয় অনুভূতি তেমন প্রখর ছিল না। কনফুসিয়াসের বিপরীতে স্বর্গের উপস্থিতিতে কোনওরকম বিস্ময় বা ভীতি বোধ করতেন না মোজি। তাঁর ধর্মতত্ত্ব তাঁর নীতিবোধের মতোই নিদারুণ বাস্তব ছিল। স্বর্গ কাজের। স্বর্গ মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে পারে যে, তাদের অবশ্যই সকলের জন্যে সহানুভূতি গড়ে তুলতে হবে, নইলে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে। 

সবাইকে তারা নিজেদের জন্যে যেভাবে ভাবে সেভাবে অন্যদের কথাও ভাবতে সম্মত করা গেলে সারা বিশ্বে শান্তি ও সামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হবে। সে জিয়ান আই-এর চর্চা করলে কেউই আর কোনও শহর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারবে না বা কোনও গ্রামে হত্যালীলা চালাবে না। ইউটোপিয়ার বর্ণনা দেওয়ার মুহূর্তেই সবচেয়ে বাঙ্ময় ছিলেন মোজি: 

এখন আমরা জিয়ান আই-কে আমাদের মাণদণ্ড হিসাবে ধরে নিয়ে জগতের মঙ্গল চাইলে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও জোরাল শ্রবণশক্তির অধিকারীরা অন্যদের জন্যে দেখবে ও শুনবে আর পথের জ্ঞানের অধিকারীরা অন্যদের সহ্য করা শেখাবে। যারা প্রবীণ এবং স্ত্রী ও সন্তানহীন তারা সহায়ের উপায় পাবে এবং বাকি দিনগুলো পার করতে পারবে; তরুণ ও এতিম যাদের বাবা মা নেই, তারা আদর যত্ন করার ও তাদের চাহিদা মেটানোর মতো কাউকে পাবে।৬৮ মোজি একে অসম্ভব স্বপ্ন বলে বিশ্বাস করেননি। এই অধ্যায় জুড়ে তিনি বারবার দাবি করেছেন: ‘কেবল জিয়ান আই- কে আমাদের আদর্শ হিসাবে নিয়ে যেখানে এইসব সুবিধা পাওয়া যাবে, আমি বুঝতে পারি না কিভাবে জগতের মানুষগুলো এই মতবাদের কথা শুনে সামলোচনা করতে পারে! ৬৯ সর্বজনীন স্বার্থহীনতার উপর ভিত্তি করে সাধু রাজারা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন; এই আদর্শ অতীতে কাজ দিয়েছে, আবারও তেমন করতে পারে। পৃথিবীকে বদলে দেওয়া সম্ভব, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, উপযুক্ত ব্যক্তিদের অবশ্যই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। 

যুদ্ধমান রাজ্যগুলোর কালে কনফুসিয়াসের চেয়ে বেশি সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন মোজি, কারণ তাঁর সময়ের সহিংসতা ও ত্রাসের প্রতি সরাসরি সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। তিনি গোটা চীনকে যুদ্ধের জন্যে সংগঠিত হতে দেখার সময় মনে হয়েছিল মানুষ জাতিই বুঝি নিজেদের পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে যাচ্ছে। স্বার্থপরতা আর লোভকে সামাল দিতে না পারলে পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলবে তারা। আবেগীয় পরিচয়ের উপর নয় বরং এমনকি প্রতিপক্ষেরও তাদের মতোই একই রকম চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা এবং ভীতি থাকার যৌক্তিক, বাস্তব উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল এক ধরনের সহানুভূতি গড়ে তোলাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় ছিল। পঞ্চম শতাব্দীর শেষদিকে হিমালয়ের পাদদেশের সাক্ক প্রজাতন্ত্রের এক ক্ষত্রিয় চুল-দাড়ি কামিয়ে গৃহত্যাগীদের মতো গেরুয়া বসন গায়ে মগধের পথে নামেন। তাঁর নাম ছিল সিদ্ধার্থ গৌতম, তখন তাঁর বয়স ছিল উনত্রিশ বছর। তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় তাঁর বাবা-মা বিলাপ করে কেঁদেছিলেন, পরে স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি। আমাদের আরও বলা হয়েছে যে, বিদায় নেওয়ার আগে স্ত্রীর ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত স্ত্রী ও তাঁদের সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে উঁকি দিয়েছিলেন তিনি, যেন স্ত্রী অনুরোধ করলে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবেন বলে বিশ্বাস করতে পারেননি। বাবার জাঁকাল বাড়িটিকে তাঁর কাছে সংকীর্ণ বোধ হচ্ছিল: খুচরো দায়িত্বের মিয়াসমা চেপে ধরেছিল তাঁকে। মানুষের জীবনের দিকে তাকিয়ে জন্মের আঘাতের ভেতর দিয়ে শুরু হয়ে কেবল পরের জীবন চক্র শুরু করার জন্যেই অন্তহীনভাবে ‘জরা, অসুস্থতা, মৃত্যু, বিষাদ আর দুর্নীতির’ ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে চলা দুঃখকষ্টের বিষণ্ণ চক্রই দেখতে পেতেন গৌতম। কিন্তু অন্য সংসারত্যাগীদের মতো গৌতম এইসব বেদনাদায়ক পর্যায়ের অবশ্যই ইতিবাচক প্রতিরূপ রয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ‘ধরা যাক, বলেছেন তিনি, ‘আমি যদি জন্ম, অজর, মৃত্যুহীন, বিষাদহীন, অপাপবিদ্ধ আর সব বন্ধন থেকে মহামুক্তির খোঁজে নামি?”৭১ তাঁকে বেঁধে রাখা প্রবল প্রেম ও আকাঙ্ক্ষা অগ্নিশিখার মতোই দপ করে নিভে যাবে বলে এই প্রীতিকর মুক্তিকে তিনি বলেছেন নিব্বানা* (‘নিভে যাওয়া’) * তাঁর সামনে এক কষ্টকর, দীর্ঘ অভিযাত্রা অপেক্ষা করে ছিল, কিন্তু কখনওই—এই জীবনেরই অর্জনযোগ্য-অনিশ্চিত, ভ্রান্তিময় এবং ক্ষণস্থায়ী নয় এমন এক ধরনের অস্তিত্বের আশা হারাননি। 

[* পালি নিব্বানা সংস্কৃতে নির্বানীয় পরিণত হয়েছে। ]

‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেনি, যাকে সৃষ্টিও করা হয়নি আবার যা অক্ষত থেকে যায়, এমন কিছু আছে’ জোরের সঙ্গে বলেছেন তিনি। ‘এটার অস্তিত্ব না থাকলে, একটা উপায় খুঁজে বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ৭২ 

গৌতমের পরলোকগমনের আনুমানিক একশো বছর পরে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানো পর্যন্ত তাঁর শিক্ষার অনুসারী ও মৌখিকভাবে সেসব প্রচারকারী সন্ন্যাসীদের মতো তিনি তা অর্জন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করতেন। তাঁকে ‘আলোকিত’ বা ‘জাগ্রত’ জন বলত তারা। এইসব বুদ্ধ ধর্মশাস্ত্র উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম সংস্কৃত আঞ্চলিক ভাষা পালিতে লেখা হয়েছিল; বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে এগুলোই আমাদের তথ্যের প্রধান উৎস। পূর্বাঞ্চলীয় গাঙ্গেয় সমতলে গড়ে ওঠা বেশির ভাগ নতুন মতবাদের মতো বৌদ্ধ শিক্ষা ও অনুশীলনগুলো (ধম্ম)** প্রবর্তকের জীবনের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ছিল; সুতরাং পালি টেক্সট তাঁর জীবনীর সেইসব বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দিয়েছে যেগুলো অন্যদের নিব্বানা অর্জনে সাহায্য করবে। লোকে আলোকিত হতে চাইলে তাদেরও ঠিক গৌতম বুদ্ধের মতোই বাড়ি ও সংসার ছাড়তে হবে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত পূর্বধারণা পেছনে ফেলে আসতে হবে। 

[** সংস্কৃত ধর্ম পালিতে ধৰ্ম্ম-তে পরিণত হয়েছে।]

পরে গৌতমের বিদায়ের গভীরতম তাৎপর্য বের করে আনা এক অতীন্দ্রিয় কাহিনী বলেছে বৌদ্ধরা। জন্ম নেওয়ার পর শিশুটির বাবা তাঁকে পরীক্ষা করে তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্যে কিছু ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁদের একজন গৌতম তাঁকে সন্ন্যাসী হয়ে নতুন আধ্যাত্মিক সত্যি আবিষ্কারের ব্যাপারে বিশ্বাসী করে তোলা চারটি অস্বস্তিকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ছেলেকে নিয়ে অনেক বেশি জাগতিক উচ্চাশা ছিল গৌতমের বাবার, তো এইসব বেদনাদায়ক বাস্তবতা থেকে তাঁকে দূরে ঠেলে রাখার উদ্দেশ্যে রাজপ্রাসাদের চারপাশে পাহারাদার দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। এভাবে বেপরোয়া বিলাসিতায় জীবন কাটালেও ছেলেটি সবসময় আসলে কারাবন্দী ছিলেন। গৌতমের প্রমোদ প্রাসাদটি প্রত্যাখ্যানকারী মনের এক উজ্জ্বল ইমেজ ছিল। আমরা যতক্ষণ আমাদের চারপাশে ঘিরে রাখা বিষাদ থেকে নিজেদের মনকে আগলে রাখতে চাই, ততক্ষণ আমরা বৃদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি লাভে অক্ষম থেকে যাই। কিন্তু গৌতমের বয়স ঊনত্রিশ বছর হলে মানবজাতির মতোই প্রবলভাবে বুদ্ধের ধম্মের আকাঙ্ক্ষাকারী দেবতারা হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের চারজন সদস্যকে প্রবীণ ব্যক্তি, অসুস্থ ব্যক্তি, লাশ, ও একজন সন্ন্যাসীর বেশে প্রহরীদের অতিক্রম করে ভেতরে পাঠান তাঁরা। এইসব ইমেজের কারণে গৌতম এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েন যে, সেদিন রাতেই গেরুয়া বসনে ঘর ছাড়েন তিনি। 

মানবীয় অবস্থার অনিবার্য অংশ ভোগান্তি একবার এর বিরুদ্ধে গড়ে তোলা আমাদের সতর্কতার বাধা ভেঙে ঢুকে পড়ার পর আমরা আর আগের মতো করে পৃথিবীকে দেখতে পারি না। গৌতম দুঃখের জ্ঞানকে তাঁর জীবনের আক্রমণ চালাতে দিয়েছেন এবং তাঁর অনুসন্ধান শুরু হতে পেরেছে। 

মগধের রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় ‘গৃহহীনতার’ প্রাথমিক বিষয় শিক্ষা দেওয়ার জন্যে একজন গুরুর খোঁজে থাকায় গৌতম সম্ভবত প্রচলিত কেতায়ই অন্য সন্ন্যাসীদের সম্ভাষণ জানিয়ে তারা কোন ধম্ম অনুসরণ করছে জানতে চেয়েছেন। প্রথমে সে সময়ের সেরা দুজন যোগী আলার কালাম ও উদ্দক রামপুত্তরের সঙ্গে বৈশালী শিক্ষা করেন তিনি। অসাধারণ ছাত্র ছিলেন বলে গুরুদের খুশি করে অচিরেই ঘোরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন, কিন্তু এইসব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তাঁদের দেওয়া ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেননি। সামক্ষ্য শিক্ষা অনুসরণ করতেন তাঁরা এবং একবার মননের এই সর্বোচ্চ শিখরে পৌছানোর পর প্রকৃতির বন্ধন থেকে পুরুষাকে মুক্ত করেছেন বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু অধিবিদ্যিক মতবাদের ব্যাপারে সারা জীবনই সংশয়ী ছিলেন গৌতম: এইসব ঘোর কিভাবে শর্তহীন ও অসৃষ্ট পুরুষা হতে পারে, যেখানে তিনি ভালো করেই জানেন যে, যোগ চর্চার মাধ্যমে নিজেই এসবের সৃষ্টি করেছেন? তাছাড়া, নিজের কাছে ফিরে আসার পর প্রকৃতপক্ষে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি বলে আবিষ্কার করেছেন তিনি। তখনও অপুনঃসৃষ্ট, লোভী, আকাঙ্ক্ষাকারী সত্তায় রয়ে গিয়েছিলেন। নিব্বানা অস্থায়ী হতে পারে না বলে তাঁর ঘোর নিব্বানা ছিল না। যোগ নিয়ে গৌতমের কোনও সমস্যা ছিল না, কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না এমন কোনও ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেননি। 

শিক্ষকদের ছেড়ে একদল অতীন্দ্রিয়বাদীর সঙ্গে যোগ দেন গৌতম। তাদের সঙ্গে চরম তপস্যা করে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটান। পেরেক বসানো তক্তপোষের উপর শুয়েছেন তিনি, নিজের মূত্র ও বর্জ্য খেয়েছেন, এমন কঠোর উপবাস পালন করেছেন যার ফলে তাঁর পাঁজরের হাড় ‘একসারি টাকু …বা পুরোনো খুপরির কড়িবর্গার মতো’ বের হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, মৃত ভেবে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছিল তাঁকে।” কিন্তু কোনওটাতেই লাভ হয়নি। অবশ্য তাঁর প্রায়শ্চিত্ত যত কঠোরই হোক—সম্ভবত বরং সেগুলোর কারণেই-তখনও মনোযোগ পাওয়ার জন্যে আর্তনাদ করে চলছিল তাঁর দেহ, তাঁকে পুনর্জন্মের বিষণ্ণ চক্রে বেঁধে রাখা কামনা ও আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত হচ্ছিলেন তিনি। তাঁর কাঙ্ক্ষিত মুক্তির কোনও আলামত ছিল না। 

তাসত্ত্বেও হাল ছাড়েননি গৌতম। এর পর থেকে কেবল নিজের অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করবেন তিনি। তাঁর আধ্যাত্মিক পদ্ধতির মূল বিশ্বাসে পরিণত হবে এটা। অব্যাহতভাবে শিষ্যদের তিনি বলে গেছেন, যত মহানই হোন না কেন, নিজস্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে না মিললে তাদের অবশ্যই অন্য কারও শিক্ষা মেনে নেওয়া চলবে না। অবশ্যই অন্যের কাছে থেকে কোনও মতবাদ বা বিশ্বাস গ্রহণ করতে পারবে না তারা। অনুসারীদের জন্যে আলোকন বয়ে আনতে ব্যর্থ হলে এমনকি তাঁর নিজের শিক্ষাকেও বাদ দিতে হবে। লোকে কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপর নির্ভর করে থাকলে নিজেদের অপ্রকৃত দর্শনেই বন্দী হয়ে থাকবে, কোনওদিনই নিব্বানার মুক্তি লাভ করবে না। সুতরাং হতাশা ও উপেক্ষার এক জট পাকানো মুহূর্তে কঠোর তপস্যায় ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য নিয়ে এবং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের কানা গলিতে নিজেই নিজের পথ বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গৌতম। ‘নিশ্চিতভাবেই,’ বলে উঠেছিলেন তিনি, ‘আলোকন লাভের অবশ্যই ভিন্ন পথ আছে!’ এবং যেন স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রকৃতই সামনে এগোনোর উপায় প্রমাণ করতেই নতুন এক সমাধান নিজেকে প্রকাশ করেছিল তাঁর সামনে।৭৫

সহসা খুব ছোটবেলার এক ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। তাঁকে একটা গোলাপ জাম গাছের নিচে রেখে বসন্তের ফসল রোপণের আগে আনুষ্ঠানিক ক্ষেতে লাঙ্গল চালানো দেখতে এগিয়ে গিয়েছিল তাঁর আয়া। ছোট ছেলেটি উঠে বসে সদ্য গজানো ঘাসের ডগাগুলোর লাঙ্গলের ফলার মুখে উপড়ে যাওয়া, পোকামাকড়ের দল প্রাণ হারানো দেখতে পান। এমনি হত্যাকাণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক অদ্ভুত বেদনার বোধ অনুভব করেছিলেন গৌতম, যেন বা তাঁর নিজের আত্মীয়স্বজনই নিহত হচ্ছে।৭৬ স্বার্থহীন এই সহানুভূতির বোধটুকু আধ্যাত্মিক মুক্তির একটা মুহূর্ত এনে দিয়েছিল। চমৎকার একটা দিন ছিল সেটা, নিজের মাঝে উপচে ওঠা নিখাদ আনন্দের অনুভূতি বোধ করেছিলেন সেই শিশুটি। জীবনে কখনও যোগাসনে না বসলেও সহজাত প্রবৃত্তির বশেই নিজেকে যোগীর আসনে বসিয়ে এক ঘোরের ভেতর প্রবেশ করেছিলেন তিনি। 

ছেলেবেলার ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে গৌতম বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেদিন তাঁর অনুভূত আনন্দ লোভ ও আকাঙ্ক্ষা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। ‘এটাই কি তবে,’ নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি, ‘আলোকনের সম্ভাব্য উপায় হতে পারে?’ একজন অপ্রশিক্ষিত বালক যোগীর পরমানন্দ লাভ করে নিব্বানার আভাস পেতে পারলে সম্ভবত আমাদের মানবীয় কাঠামোতেই মোক্ষের মুক্তি নির্মিত হয়েছে। আত্মসমর্পণে নিজের দেহকে উপোস রাখার বদলে ও যোগাসনকে মননের উপর আক্রমণে পরিণত করার বদলে তাঁর হয়তো চেতোবিমুক্তি, ‘মনের মুক্তি’ অর্থাৎ, নিব্বানার দিকে চালিত করা এইসব সহজাত প্রবণতার চর্চার করা উচিত। তাঁর উচিত খুবই স্বাভাবিকভাবে আবির্ভূত হওয়া অনাগ্রহী সহানুভূতির প্রবণতা এবং একই সময়ে মুক্তির পথে বাধা হতে পারে এমন মানসিক বা দৈহিক অবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো মনের সহযোগী বিভিন্ন অবস্থার (কুসলা) পরিচর্যা করা।৭ 

জৈনদের মতো প্রচলিত সহিংসতা, চৌর্যবৃত্তি, মিথ্যাচার, মাদকাসক্তি এবং যৌনাচারের পাঁচটি ‘অসহযোগী’ (অকুসলা) অবস্থাকে অবশ্যই সেগুলোর ইতিবাচক প্রতিরূপের সাহায্যে ভারসাম্য দিতে হবে বলে উপলব্ধি করেছিলেন গৌতম। কেবল আগ্রাসনকে দায়সারাভাবে এড়িয়ে চলার বদলে তাঁকে অবশ্যই সবকিছু ও সবার সঙ্গে দয়ার আচরণ করতে হবে, এবং প্রেমময়-দয়ার ভাবনার চর্চার করতে হবে। মিথ্যা না বলা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যা বলছেন সেটার ‘যুক্তিপূর্ণ, সঠিক, স্পষ্ট আর লাভজনক’৭৮ হওয়ার ব্যাপারটাও নিশ্চিত করতে হবে। চুরি থেকে বিরত থাকা ছাড়াও অবশ্যই সামান্য কিছু অধিকার নিয়েই খুশি থাকতে হবে তাঁকে। এখন থেকে নিজের মানবিক প্রকৃতি নিয়ে কাজ করবেন তিনি; এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন না। কয়েক মাসের ভেতর প্রথমবারের আবার কঠিন খাবার খেলেন তিনি, আবার স্বাস্থ্য ফিরে পেতে নিজের দিকে মনোযোগ দিলেন। বিশেষ ধরনের যোগ ব্যয়ামও শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথমে শুরু হয়েছিল ‘অভিনিবেশের’ (সাতি) অনুশীলন যেখানে ধ্যানের পূর্বশর্ত হিসাবে দিনের প্রতিটি ক্ষণে নিজের আচরণকে পরখ করেছেন তিনি, নিজের চেতনার ওঠানামার সঙ্গে মিলিয়ে অনুভূতি ও শিহরণের জোয়ার-ভাটা খেয়াল করেছেন এবং আকাঙ্ক্ষা, বিরক্তি আর কোনও একটি ঘণ্টায় তাঁর মনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন ধারণা সম্পর্কে সজাগ করে তুলেছেন নিজেকে। বিকলিত, আত্মসম্মানের অপরাধ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই অন্তদর্শন প্রণীত ছিল না। একজন চতুর অশ্বারোহী যেভাবে তার প্রশিক্ষণের অধীন ঘোড়ার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে চায় ঠিক সেভাবে স্রেফ নিজের দেহ ও মনেরক্ষমতা বুঝে সুবিধাজনকভাবে কাজে লাগানোর জন্যে সেগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন গৌতম। 

আরও অনেক গৃহত্যাগীর মতো গৌতমও জীবনটাই দুঃখ, এবং আকাঙ্ক্ষাই আমাদের দুর্ভোগের জন্যে দায়ী বলে বিশ্বাস করেছিলেন। অভিনিবেশের চর্চা মানবীয় অস্তিত্বের অস্থায়িত্ব আর ক্ষণায়ু এবং এর অসংখ্য হতাশা ও নিরাশা সম্পর্কেও দারুণ সজাগ করে তুলেছিল তাঁকে। ‘বেদনা, শোক, আর হতাশা হচ্ছে দুঃখ,’ পরে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। ‘আমরা যাকে ঘৃণা করি তার আওতায় নিক্ষিপ্ত হওয়াই ভোগান্তি, আমরা যাকে ভালোবাসি তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াই ভোগান্তি, আমরা যা চাই তা না পাওয়াই ভোগান্তি। * অবিরাম ভিন্ন কিছু হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা এবং তাঁর কাছে নেই এমন কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করে একের পর এক আকাঙ্ক্ষাগুলো কিভাবে তাঁর মন আর হৃদয়ের দখল নিচ্ছে খেয়াল করেছিলেন তিনি। আকাঙ্ক্ষার এই অন্তহীন স্রোতে মানবজাতি যেন এক নতুন ধরনের অস্তিত্বের-এক নতুন জীবন, বা পুনর্জন্ম-খোঁজ করে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। নিজের শারীরিক অস্থিরতা, অবিরাম নিজের অবস্থান বদলে বা বনের ভিন্ন অংশের উদ্দেশে পা ফেলার ভেতরই সেটা টের পাচ্ছিলেন তিনি। ‘জগৎ, যার স্বভাবই হচ্ছে বদলে যাওয়া, অবিরাম ভিন্ন কিছুতে পরিণত হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,’ উপসংহারে পৌছেছেন তিনি। ‘এটা পরিবর্তনের দয়ার উপর নির্ভরশীল, কেবল পরিবর্তনের ধারায় পড়লেই সে খুশি থাকে, কিন্তু পরিবর্তনের প্রতি এই ভালোবাসায় এক ধরনের ভীতি রয়েছে এবং খোদ এই ভীতিই দুঃখ।৮০ 

এগুলো স্রেফ যৌক্তিক ভাবনামাত্র ছিল না। অত্যন্ত দক্ষ যোগী ছিলেন গৌতম, সত্যকে বিকৃতকারী আত্মরক্ষাকারী ফিল্টারের ভেতর দিয়ে দেখার বদলে সরাসরি দেখতে শৃঙ্খলিত মনোযোগের সঙ্গে অভিনিবেশের চর্চা করেছেন। কিন্তু এইসব নেতিবাচক সত্যি নিয়ে ভাবনাতেই থেমে থাকেননি, যোগ চর্চার বেলায় পায়ের উপর পা তুলে বসে শ্বাসপ্রশ্বাসের আচার প্রাণায়ামের অনুশীলন করার সময় আরও ‘দক্ষ’ (কুসালা) অবস্থার চর্চা করেছেন। কেবল মন থেকে ঘৃণার বোধকেই অপসারিত করছিলেন না তিনি, বরং ‘সাবলীল, নিজের ব্যাপারে সচেতন এবং পুরোপুরি সতর্ক’ এমন এক মনের চর্চা করছিলেন। একের পর এক উদ্বেগজনক ভাবনা বাতিল করে তাঁর মন শান্ত এবং ‘অটল’ হয়ে উঠেছে…’ক্ষয়কারী সন্দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছে,’ এবং তিনি আর ‘অলাভজনক (অকুসালা) মানসিক অবস্থায় আক্রান্ত নন ১ বলে আবিষ্কার করেছিলেন। পর্যাপ্ত গভীরতায় এইসব মানসিক প্রয়াস অনুশীলন করা হলে যোগীয় উপায়ে সচেতন অবচেতন মনের অস্থির ও বিচ্যুতকারী প্রবণতাসমূহকে বদলে দিতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। 

পরবর্তী বছরগুলোয় এই যোগীয় অভিনিবেশ আকাঙ্ক্ষা, লোভ আর স্বার্থপরতার অধীন নয় এমন এক নতুন ধরনের মানুষের অস্তিত্ব দিয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন গৌতম। চরম কৃচ্ছ্রতা পালন করতে গিয়ে নিজেকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন তিনি, এবং বিশ্বাস করেছিলেন যে শৃঙ্খলিত, পদ্ধতিগতভাবে আয়ত্ত করা সহানুভূতি প্রাচীন প্রায়শ্চিত্তমূলক কৃচ্ছ্রতার স্থান দখল করতে পারে ও আকাঙ্ক্ষীকে এযাবৎ অজ্ঞাত তার মনবীয় মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন যোগ চর্চার সময় প্রতিটি ঘোরকে গোটা বিশ্বের প্রতি ইতিবাচক ঔদার্যের অনুভূতি দিয়ে মিলিয়ে চেতনার এক বিকল্প স্তরে প্রবেশ করতেন তিনি। 

এইসব ধ্যানকে ‘অপরিমেয়’ (অপ্পামানা) বলতেন তিনি। ইচ্ছা করেই মনের গভীরে যোগীয় যাত্রার প্রতিটি পর্যায়ে প্রেমের আবেগ-ঘৃণা কি না জানা বিশাল, প্রসারিত ও অপরিমেয় অনুভূতি’-উস্কে দিয়ে পৃথিবীর চার কোণে পাঠিয়ে দিতেন একে, সহানুভূতির ব্যাসার্ধ থেকে কোনও গাছ, পশু, বন্ধু, বা শত্ৰু বাদ যেত না। চতুর্মুখী কর্মসূচি ছিল এটা। প্রথমত, সবকিছু ও সবার জন্যে বন্ধুত্বের একটি অবস্থার চর্চা করতেন তিনি। এরপর সেই গোলাপ জাম গাছের নিচে যেভাবে ঘাসের ডগা আর কীটপতঙ্গের জন্যে সহানুভূতি বোধ করেছিলেন সেভাবে অন্য লোক ও বস্তুর সঙ্গে বেদনার সঙ্গে একাত্ম বোধ করে কষ্ট ভোগ করতে শিখতেন। ধ্যানের তৃতীয় পর্যায়ে ঈর্ষা বা ব্যক্তিগত অচলতার বোধ ছাড়াই অন্যের সুখে সুখী হওয়া ‘সহানুভূতিপূর্ণ আনন্দ’ তলব করতেন তিনি। সবশেষে, গভীরতম ঘোরে প্রবেশের পর এমনভাবে ধ্যানের বিষয়বস্তুতে ডুবে যেতেন যে বেদনা বা আনন্দের বোধের উর্ধ্বে উঠে যেতেন। অন্যদের প্রতি সামগ্রিক সাম্যতার একটি প্রবণতা লাভের প্রয়াস পেতেন গৌতম, আকর্ষণ বা বৈরিতার কোনও বোধ জাগত না। গৌতমকে সারাক্ষণই অন্য বস্তু বা মানুষ সত্তা থেকে কিভাবে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেখায় ব্যস্ত অহমবাদকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে দারুণ কঠিন ছিল এটা। প্রচলিত যোগ যেখানে যোগীর ভেতর অটল স্বায়ত্তশাসনের অবস্থা গড়ে তুলেছিল, গৌতম সেখানে পদ্ধতিগতভাবে অন্যের প্রতি নিজের সমগ্র সত্তাকে উন্মুক্ত করা শিখছিলেন এবং এভাবে অন্য সকল প্রাণীর প্রতি প্রেমময় দয়ার ভেতর দিয়ে অহমকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। ২ যোগের তীব্রতা দিয়ে এইসব ইতিবাচক, দক্ষ অবস্থার চর্চা করা হলে সেগুলো চৈতন্যের গভীরে অনেক সহজে স্থান করে নিতে পারে এবং পরিণত হতে পারে অভ্যাসে। আমাদের ভঙ্গুর অহমকে রক্ষার জন্যে আমাদের ও অন্যদের মাঝে গড়ে তোলা অবরোধ ভেঙে ফেলার লক্ষ্যেও ‘অপরিমেয়মমূহ’ প্রণয়ন করা হয়েছিল। মন এর সাধারণ, আত্মমুখী বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ‘প্রসারিত, সীমাহীন, বর্ধিত, ঘৃণাহীন বা খুচরো বৈরিতা৮৩ থেকে মুক্ত বলে অনুভব করে। সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়া হলে সহানুভূতির এই যোগ চর্চাকারীর পক্ষে ‘মনের মুক্তি’ বা নিব্বানা এনে দিতে পারে। ৮৪ 

স্বাস্থ্য ফিরে পেতে ও এই নিয়মকানুন উদ্ভাবনের পর সর্বোচ্চ আলোকনের দেখা পেতে গৌতম কতদিন সময় নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। পালি টেক্সট এটা বেশ জোরাল প্রক্রিয়া ছিল বলে ধারণা দেয়, তবে গৌতম স্বয়ং এই বর্ধিত পরিবর্তন লাভ করতে দীর্ঘ সাত বছরের মতো সময় লেগে যেতে পারে বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অনুশীলনকারী ধীরে ধীরে আমাদের জীবন ও সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলা স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকা শিখবে এবং এইসব উচ্ছৃঙ্খল আকাঙ্ক্ষায় কম প্রভাবিত হবে। সে এইসব আগ্রাসী ভাবনার ক্ষণায়ুর ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠা কঠিন হয়ে উঠবে এবং আমাদের শান্তি থেকে বঞ্চিতকারী বিচ্যুতিগুলোর দিকে খেয়াল রাখার ব্যাপারে ক্রমবর্ধমানহারে দক্ষ হয়ে উঠবে ৮৫ প্রক্রিয়ার সাধারণ নির্দেশক তুলে ধরতে চেয়েছে বলে এবং যাত্রার ঐতিহাসিক বিস্তারিত বিবরণে আগ্রহী না হওয়ায় গৌতম এক রাতেই আলোকন লাভ করেছেন বলে বর্ণনা করেছে টেক্সট। কিন্তু গৌতমের আলোকন প্রায় নিশ্চিতভাবেই আকস্মিক ‘নবজন্মের’ অভিজ্ঞতা ছিল না। পরে শিষ্যদের সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি, ‘এই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ, অনুশীলন আর চর্চা স্বল্প মাত্রায় কার্যকর হয়ে ওঠে, পরম সত্যের কোনও আকস্মিক ধারণা দেয় না। 

প্রচলিত গাথা অনুযায়ী উরুবেলা শহরের কাছে নিরঞ্জরা নদীর পাড়ে এক প্রমোদ বাগিচার বোধি বৃক্ষের নিচে বসে ছিলেন গৌতম। পালি ধর্মশাস্ত্ৰ আমাদের বলছে, একক ধ্যানের ভেতর দিয়েই তাঁকে চিরকালের জন্যে বদলে দেওয়া এক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন তিনি এবং নিজেকে পুনর্জন্মের চক্র থেকে বের করে এনেছেন বলে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু সাধারণভাবে চারটি মহান সত্যি হিসাবে প্রণীত এই নতুন অন্তর্দৃষ্টিতে নতুন কিছুর অস্তিত্ব সামান্যই আছে বলে মনে হয়। বেশিরভাগ সন্ন্যাসীই প্রথম তিনটির সঙ্গে একমত প্রকাশ করতেন: দুঃখের অস্তিত্ব, আকাঙ্ক্ষাই আমাদের দুর্ভোগের কারণ এবং এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় আছে। চতুর্থ সত্যিটি হয়তো সাফল্য নির্মাণ করে থাকবে: দুর্ভোগ ও বেদনা থেকে এর অবসানের নিব্বানার পথের দেখা পাওয়ার দাবি করেছেন গৌতম। প্রচলিতভাবে মহান অষ্টপথ নামে পরিচিত এই উপায়টি প্রার্থীকে ‘সরাসরি’ গৌতমের শিক্ষা উপলব্ধিতে সক্ষম করে তুলতে যোগের অনুশীলন এবং এবং একে দৈনন্দিন জীবনে সংহত করে তোলা নৈতিকতা (‘দক্ষ’ অবস্থার চর্চা), ধ্যান আর প্রজ্ঞা (পান্না) সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি কর্মপরিকল্পনা। গৌতম কখনওই মহান সত্যিগুলো অনন্য বলে দাবি করেননি বরং এই ঐতিহাসিক যুগে তিনি প্রথম এগুলোকে ‘উপলব্ধি’ করেছিলেন এবং নিজের জীবনে বাস্তবে পরিণত করেছিলেন। মানুষকে বন্দী করে রাখা আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা আর অজ্ঞতাকে নির্বাপিত করার কথা জানতে পেরেছিলেন তিনি। নিব্বানায় পৌঁছেছিলেন তিনি এবং তখনও শারীরিক অসুস্থতা ও অন্যান্য দুর্বলতার আক্রান্ত থাকলেও কোনওকিছুই তাঁর অন্তস্থঃ শান্তিকে স্পর্শ করতে পারেনি বা মারাত্মক মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারেনি। কঠোর পরিশ্রম ছিল তাঁর পদ্ধতি। ‘পবিত্র জীবন এর উপসংহার পর্যন্ত যাপন করা হয়েছে!’ বোধিবৃক্ষের নিচে ধ্যান শেষে বিজয়ীর সুরে চিৎকার করে উঠেছেন তিনি। ‘করণীয় যা ছিল করা হয়েছে; আর কিছুই করার নেই!’৮৮ 

নিব্বানা কি ছিল? আমরা যেমন দেখেছি, শব্দটি যে, আলোকন লাভের পর গৌতম ‘নিভে গিয়েছিলেন’। আলোকন পাওয়ার পর প্রায়ই তথাগত (“চলে গেছেন’) বলা হতো তাঁকে, যার মানে ‘তিনি’ আর উপস্থিত নেই। কিন্তু এর মানে ব্যক্তিগত বিলুপ্তি ছিল না। ব্যক্তি গৌতম নন, নিভে গিয়েছিল লোভ, ঘৃণা আর বিভ্রমের কুহক। মনের ‘অসহযোগী’ দশাগুলোকে দমন করে বুদ্ধ (এখন গৌতমকে এনামেই ডাকতে হবে আমাদের) সম্পূর্ণ স্বার্থহীনতার শান্তি অর্জন করেছিলেন। এটা এমন এক অবস্থা আমরা যারা এখনও অহমবাদের ফাঁদে আটকা পড়ে আছি তারা কল্পনা করাও শুরু করতে পারি না। সেকারণেই বুদ্ধ সবসময় নিব্বানার সংজ্ঞা দিতে অস্বীকার করেছেন: কেননা অনালোকিত ব্যক্তির কাছে এই অবস্থার বর্ণনা দেওয়ার কোনও উপায় না থাকায় সেটা ‘অসঙ্গত’ হবে।* তারপরেও কষ্ট সইবেন বুদ্ধ; অন্য সবার মতো বৃদ্ধ ও অসুস্থ হবেন, কিন্তু কঠোর ধ্যান ও নৈতিক প্রয়াসের ভেতর দিয়ে অন্তস্থঃ স্বর্গের দেখা পেয়েছেন তিনি, এই বিধান নিজেদের অনুশীলনে পরিণতকারী নারী-পুরুষকে বেদনার ভেতর বাস করতে, এর অধিকার নিতে, একে নিশ্চিত করতে এবং দুর্ভোগের মাঝেই গভীর প্রশান্তি লাভে সক্ষম করে তোলে। সম্ভবত আজীবন আবেগময় সততার অনুশীলনের ভেতর দিয়ে অন্যায় মৃত্যুদণ্ড মেনে নেওয়ার সময় তাঁকে প্রশান্তিতে থাকতে সক্ষম করে তোলা এই ধরনের একটা কিছু আবিষ্কার করেছিলেন সক্রেটিস। নিব্বানা এভাবে প্রতিটি ব্যক্তির অন্তস্থঃ সত্তায় পাওয়া যায়, এটা নেহাতই স্বাভাবিক একটা অবস্থা। জীবনকে অর্থবহ করে তোলা স্থির একটি কেন্দ্র এটা। যারা নিজের ভেতরের এই শান্তির স্থানের সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেছে তারা ভেঙে পড়তে পারে, কিন্তু একবার শান্তির এই মরুদ্যানে প্রবেশের অধিকার পেলে আর বিরোধপূর্ণ ভীতি ও আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়ে এখানে-সেখানে ছুটে বেড়াবে না তারা, এবং সঠিকভাবে স্থাপিত স্বার্থহীনতার অতীত সত্তা থেকে আগত এক শক্তি আবিষ্কার করবে। 

যারা এই অন্তস্থঃ জাগরণ লাভ করেনি তাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে যাওয়ায় নিব্বানা অতিপ্রাকৃত বাস্তবতা না হলেও দুর্জ্ঞেয় অবস্থা বলে বিশ্বাস করেছিলেন বুদ্ধ। আমরা যেখানে সম্পূর্ণ অহম মুক্ত জীবন কল্পনা করতে পারি না আমাদের সেই অসুখী অস্তিত্বের ইন্দ্রিয়জ উপাত্ত থেকে আমাদের ভাষা এসেছে বলে একে বর্ণনা করার মতো কোনও শব্দ নেই। আমাদের পরিচিত কোনও বাস্তবতার সঙ্গে কোনও মিল না থাকায় একেবারে জাগতিক পরিভাষায় নিব্বানা মানে ‘কিছু না’। কিন্তু যারা এই পবিত্র শান্তি আবিষ্কার করতে পেরেছে তারা অপরিমেয় সমৃদ্ধ জীবন যাপন করছে” বলে আবিষ্কার করেছে। পরে একেশ্বরবাদীরা ঠিক এইরকম ভাষায় ঈশ্বর নিয়ে কথা বলবে, ঈশ্বর ‘কিছু না’ বলে দাবি করবে, কারণ ‘তিনি’ আরেকটি সত্তামাত্র নন; এবং ঈশ্বরের ক্ষেত্রে আরোপের বেলায় অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারেই সীমাবদ্ধ বলে তাঁর অস্তিত্ব নেই বলাটাই বেশি সঠিক। ` তারা আরও দাবি করবে যে একটি নিঃস্বার্থ, সহানুভূতিময় জীবন মানুষকে ঈশ্বরের উপস্থিতি এনে দেবে। কিন্তু অন্য ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদীদের মতো ব্যক্তিরূপ একজন উপাস্যের ধারণাকে অতিরিক্ত সীমিত মনে করেছেন বুদ্ধ। কারণ একজন কর্তৃত্বপরায়ণ, তত্ত্বাবধায়ক উপাস্য আলোকনকে বাধা দান করা আরেকটি সজ্জা বা বাধায় পরিণত হতে পারেন বলে সবসময় কোনও অতিপ্রাকৃত সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে গেছেন বুদ্ধ। পালি টেক্সট কখনওই ব্রাহ্মণের কথা উল্লেখ করেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমতল থেকে বহু দূরের সাক্ক রাজ্য থেকে এসেছিলেন বুদ্ধ, এবং সম্ভবত এই ধারণার সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর ঈশ্বর বা দেবতা প্রত্যাখ্যান প্রশান্ত ও পরিমিত ছিল। স্রেফ শান্তির সঙ্গে এদের একপাশে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। এইসব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আক্রমণ চালানোটা অহমের অদক্ষ নিশ্চিতকরণ হয়ে দাঁড়াত। প্রাচীন দেবতারা অনেক সময় তাঁর জীবনে ভূমিকা রেখেছেন। উদাহরণ স্বরূপ, পালি টেক্সটে মৃত্যুর দেবতা মারা অনেক সময় বুদ্ধের প্রলোভনকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন, সহজ পথ বেছে নিতে বলেছেন তাঁকে, প্রায় যেন বুদ্ধের মনেরই একটা বৈশিষ্ট্য ছিলেন তিনি। 

কিন্তু তারপরেও নিব্বানা কি, সে সম্পর্কে শিষ্যদের একটা ধারণা দেওয়ার প্রয়াস পাওয়ার সময় প্রায়শঃই ইতিবাচক পরিভাষার সঙ্গে নেতিবাচক পরিভাষা যোগ করেছেন বুদ্ধ। নিব্বানা হচ্ছে ‘লোভ, ঘৃণা আর বিভ্রমের অবসান’; এটা ‘কলঙ্কহীন,’ ‘অদুর্বল’, ‘অখণ্ডিত’, ‘অলঙ্ঘনীয়’, ‘দুর্ভোগের অতীত’। আমরা অসহনীয় বলে আবিষ্কার করি এমন সমস্ত কিছুকে তা বাতিল করে। নিব্বানাকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত অন্যতম বুলিটি হচ্ছে এটা ‘মৃত্যুহীন’। কিন্তু নিব্বানা সম্পর্কে ইতিবাচক কথাও বলা যায়: এটা ‘সত্যি’, ‘সূক্ষ্ম’, ‘অপরপাড়’, ‘শান্তি, ‘ ‘চিরন্তন,’ ‘পরম লক্ষ্য’, ‘শুদ্ধতা’, ‘মুক্তি, স্বাধীনতা, দ্বীপ, আশ্রয়, বন্দর, শরণ, অন্যস্থান।১৯২ মানুষ ও দেবতাদের পরম লক্ষ্য এটাই, বোধের অতীত প্রশান্তি এবং নিদারুণ নিরাপদ আশ্রয়। এইসব ইমেজের অনেকগুলোই একেশ্বরবাদীদের অনির্বচনীয় ঈশ্বর অনুভূতির অভিজ্ঞতা প্রকাশে ব্যবহৃত শব্দের স্মারক। 

নিব্বানা আবিষ্কার করতে গিয়ে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন বুদ্ধ, কিন্তু সেটাই তাঁর জীবন ও ব্রতের শেষ ছিল না। প্রথমে স্রেফ এই প্রশান্ত অবস্থায় বিকশিত হতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল সম্ভবত এই সুখবর ছড়িয়ে দেওয়া দরকার, কিন্তু চিন্তাটাকে বড্ড বেশি ক্লান্তিকর ও হতাশাব্যাঞ্জক ভেবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ধম্মের ব্যাখ্যা দেওয়া দারু কঠিন ছিল। প্রত্যাখ্যান করা দূরে থাক, বেশির ভাগ মানুষই ইতিবাচকভাবে বিভিন্ন বাঁধনকে উপভোগ করে এবং আত্ম- পরিত্যাগের বাণী শুনতে চাইবে না তারা। কিন্তু তখনই ব্রহ্মা দেবতা (পূর্বাঞ্চলীয় গাঙ্গেয় এলাকায় ব্রাহ্মণের এক জনপ্রিয় অবতার) হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন। পালি টেক্সটে মারার মতো তিনিও বুদ্ধের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের একটি দিক তুলে ধরেছেন বলেই মনে হয়: কোনও গভীর স্তরে গৌতম সতীর্থ মানুষদের অবহেলা করে থাকতে পারেন না বলে উপলব্ধি করেছিলেন। দেবতারা তাঁদের ভূমিকা সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে নেমে এলেন, আলোকিত জনের সামনে প্রণত হলেন তাঁরা। ‘প্রভু,’ প্রার্থনা করলেন, ‘অনুগ্রহ করে ধম্ম শিক্ষা দিন। বেদনায় ডুবে যাওয়া মানবজাতির দিকে তাকান; জগৎ-কে বাঁচাতে দূরদূরান্তে ভ্রমণ করুন। পালি টেক্সট আমাদের বলছে, মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন বুদ্ধ, ‘সহানুভূতি থেকে বুদ্ধের দৃষ্টিতে এই জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন তিনি।৯৪ একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য ছিল এটা। একজন বুদ্ধ কেবল নিজের মুক্তি অর্জনকারী কেউ নন, বরং এমন কেউ যিনি অন্যের বেদনায় এখনও সহানুভূতিশীল হতে পারেন। পৃথিবীর চার কোণে পাঠানো তাঁর সহানুভূতি ও প্রেমময় দয়া আলোকন এনে দিয়েছিল তাঁকে। স্বার্থপর প্রত্যাহার তাঁর ধম্মের আবিশ্যিক গতিময়তাকে লঙ্ঘন করবে, যার দাবি ছিল বাজার এলাকায় ফিরে আসতে হবে তাঁকে, বিষাদগ্রস্ত এই জগতে জড়াতে হবে। বোধি-বৃক্ষের নিচে তাঁর অর্জিত দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল যে, নৈতিকভাবে বাঁচার মানে অন্যের জন্যে বাঁচা। পরবর্তী চল্লিশ বছরের জীবনের ক্লান্তিহীন গাঙ্গেয় সমতলের বিভিন্ন নগর আর শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বুদ্ধ, দেবতা, পশুপাখি আর নারী- পুরুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর শিক্ষা। 

বুদ্ধের আদি শিষ্যরা আগে থেকেই গৃহত্যাগী ছিল, কথিত আছে, তাঁদের একজন বুদ্ধের প্রথম বাণীর সময়ই আলোকন লাভ করেছিলেন। টেক্সট সব সময়ই এই প্রক্রিয়াকে একইভাবে বর্ণনা করেছে। বুদ্ধের মুখে মহান সত্যির ব্যাখ্যা শোনার সময় ‘প্রত্যক্ষ’ভাবে শিক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ শুরু করেছিলেন কোনদানা; তাঁর অভ্যন্তরে, যেন তাঁর সত্তার গভীরতম প্রদেশ থেকে তা ‘জেগে উঠেছিল’, যেন তাকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি, সবসময়ই জানতেন একে ১৫ অচিরেই ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ শ্রেণীর তরুণরা বুদ্ধের সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করেছিল। বৈশ্য বণিকরাও তাঁর আত্মনির্ভরশীলতার প্রতি গুরুত্ব দানে আকৃষ্ট হয়েছিল, আর যারা গৃহত্যাগীতে পরিণত হয়নি তারাও প্রায়শঃই তাঁর সাধারণ অনুসারী ও পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিল। অচিরেই একটি উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল বুদ্ধের ব্যবস্থা (সংঘ)। সন্ন্যাসীরা বুদ্ধের সহানুভূতিপূর্ণ, অভিনিবেশের যোগ সাধনার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন, তবে অন্যদেরও এই পদ্ধতির শিক্ষা দিতেন তারা। প্রাচীন বৈদিক আচারের মতো সুবিধাভোগী অভিজাতদের ধর্মবিশ্বাস ছিল না এটা। এটা ছিল ‘বহুর জন্যে’। সন্ন্যাসীরা প্রায়শঃই বিভিন্ন নগরের উপকণ্ঠের উদ্যানে থাকতেন বলে শহরবাসীদের পক্ষে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা সহজ ছিল। বণিক, অভিজাতজন ও সভাসদরা তাদের এলাকায় পৌঁছলে বুদ্ধের বাণী শুনতে হাজির হতেন। কিন্তু গৃহগত্যাগীরা বেশির ভাগ সময়ই চলার উপর থাকতেন, ‘সাধারণ মানুষের সুখ ও কল্যাণের লক্ষ্যে গোটা জগতের প্রতি সহানুভূতি থেকে ঘুরে বেড়াতেন। 

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের বুদ্ধ মতবাদ অনাত্তা (‘সত্তা নেই’) নিয়ে ধ্যান করা নিব্বানা লাভের অন্যতম জনপ্রিয় উপায় ছিল। চিরন্তন সত্তাই (আত্মা: পুরুষা) পরম বাস্তবতা, একথা বিশ্বাস করতেন না বুদ্ধ। অভিনিবেশের অনুশীলন মানবজাতির অব্যাহত পরিবর্তনের ভেতর থাকা সম্পর্কে সজাগ করে তুলেছিল তাঁকে; তাদের দেহ ও অনুভূতি এক মুহূর্ত থেকে আরেক মুহূর্তে পাল্টে যায়। নিজের পরিবর্তনশীল বিশ্বাস, আবেগ ও ধারণার পদ্ধতিগত পরীক্ষার পর একজন সৎ মানুষের এই উপসংহারেই পৌঁছতে হবে যে এগুলো এতটাই ত্রুটিপূর্ণ ও ক্ষণস্থায়ী যে কোনওটাই এত এত গৃহত্যাগীর কাঙ্ক্ষিত সত্তা হতে পারে না: ‘এটা আমার নয়; আমি আসলে যা ঠিক তা নয় এটা; এটা আমার সত্তা নয়।১৯৭ কিন্তু এমনকি আরও সামনে বেড়ে একটি ‘নিম্নতর’ স্থিতিশীল সত্তার বাস্তবতাও অস্বীকার করেছেন বুদ্ধ। প্রতিটি সচেতন সত্তা একটি সাময়িক, পরিবর্তনযোগ্য অস্তিত্বের পরম্পরা হওয়ায় ‘সত্তা’ ও ‘আমি’ পরিভাষা দুটি স্রেফ রীতি বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। আমাদের নিজস্ব কালে কোনও কোনও উত্তর- আধুনিকতাবাদী দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক একই রকম উপসংহারে পৌঁছেছেন। 

মানবীয় ব্যক্তিত্ব বোঝাতে জ্বলন্ত আগুন বা খরস্রোতা জলধারার মতো উপমা ব্যবহার করতেন বুদ্ধ। এর এক ধরনের পরিচয় থাকলেও এক মুহূর্ত থেকে আরেক মুহূর্তে কখনও এক থাকে না। অবশ্য, উত্তর-আধুনিক ধারণার বিপরীতে অনাত্তা বিমূর্ত, অধিবিদ্যিক মতবাদ ছিল না, বরং তাঁর সব শিক্ষার মতোই কর্মপরিকল্পনা ছিল। অনাত্তায় বৌদ্ধদের প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় এমন আচরণ করতে হয় যেন সত্তার কোনও অস্তিত্ব নেই। ‘সত্তা’র ধারণা ‘আমি’ ও ‘আমার’ সম্পর্কে কেবল অদক্ষ ভাবনার দিকেই চালিত করে না, বরং সত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভেতর ঘৃণা, প্রতারণা, গর্ব, নিষ্ঠুরতা এবং-সত্তা হুমকিতে পড়েছে মনে করলে-সহিংসতার দিকে চালিত করে। বুদ্ধ তাঁর অনুসারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে অন্যের ক্ষতি করে রক্ষা, প্রসারিত, তোষামোদ বা বর্ধিত করে তোলার মতো কোনও ‘সত্তা’ তাদের নেই। একজন গৃহত্যাগী অভিনিবেশের চর্চায় দক্ষ হয়ে উঠলে সে আর চলমান মানসিক অবস্থায় নিজের অহমকে প্রবেশ করাবে না, বরং নিজের ভীতি আর আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ক্ষণস্থায়ী, দূরাগত ঘটনা মনে করবে, যার সঙ্গে তার সামান্যই সম্পর্ক আছে। নিরাবেগের এই পর্যায় অর্জন করার পর, সাধুদের বুঝিয়ে বলেছেন বুদ্ধ, আলোকনের জন্যে তৈরি হয়ে যাবেন সাধু। ‘তার লোভ হারিয়ে গেছে, তার আকাঙ্ক্ষা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর মনের মুক্তির অভিজ্ঞাতা অর্জন করে সে। ১৯৮ 

টেক্সট আমাদের বলছে, অনাত্তা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা শোনার পর বুদ্ধের প্রথম শিষ্যদের হৃদয় আনন্দে ভরে উঠেছিল, সঙ্গে সঙ্গে নিব্বানার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তারা। আমরা যে সত্তাকে লালন করি তার অস্তিত্ব নেই শুনে কেন এতটা আনন্দিত হয়েছিল তারা? বুদ্ধ জানতেন, অনাত্তা শুনতে ভীতিকর মনে হতে পারে। একজন বহিরাগত ‘আমি নিশ্চিহ্ন, ধ্বংস হতে যাচ্ছি, আমি আর থাকব না! ৯৯ 

ভেবে ত্রস্ত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পালি টেক্সট দেখায় যে, লোকে স্বস্তি ও আনন্দের সঙ্গে অনাত্ত্যকে মেনে নিচ্ছে। সত্তার যেন অস্তিত্বই নেই, একবার এভাবে বাঁচতে শুরু করার পর তারা নিজেদের আগের চেয়ে সুখী বলে আবিষ্কার করেছে এবং অপরিমেয়র চর্চার সময়ের মতোই সত্তার একই রকম প্রসারণের অভিজ্ঞতা লাভ করছে। ঘৃণা, লোভ এবং আমাদের মর্যাদা ও বেঁচে থাকা নিয়ে উদ্বেগের নাগালের বাইরে বাস করা মুক্তিদায়ী প্রমাণিত হয়েছে। 

কিন্তু একে যৌক্তিকভাবে প্রমাণের কোনও উপায় ছিল না। অনুশীলন করাই বুদ্ধের পদ্ধতি পরীক্ষা করার একমাত্র পথ ছিল। কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন বিমূর্ত মতবাদগত নীতিশাস্ত্র নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল না তাঁর। প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন কারও কর্তৃত্বে কোনও একটি মতবাদ মেনে নেওয়া অদক্ষ ছিল; ব্যক্তিগত দায়িত্ব পরিহারের শামিল হওয়ায় তা আলোকনের দিকে চালিত করতে পারবে না। বিশ্বাসের মানে ছিল নিব্বানার অস্তিত্বে আস্থা রাখা এবং একে অর্জন করার প্রতিজ্ঞা। তিনি সবসময় জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁর শিষ্যরা যেন তিনি তাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তার সবই যেন পরখ করে নেয়। ধর্মীয় ধারণা সহজেই আঁকড়ে থাকার মতো আরেকটি বিষয়, মানসিক প্রতিমায় পরিণত হতে পারে, অন্যদিকে মানুষকে তা বিসর্জনে সাহায্য করাই ছিল ধৰ্ম্মের উদ্দেশ্য। এমনকি উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর নিজের শিক্ষাকেও বাতিল করতে হবে। এক পর্যটকের গল্প বলতে ভালোবাসতেন তিনি; চলার পথে এক বিরাট জলাশয়ের কাছে এসে হাজির হয়েছিল এই পর্যটক। ওপাড়ে যেতে উদগ্রীব ছিল সে। কিন্তু খেয়া নৌকা বা কোনও সেতু ছিল না সেখানে, তো একটা ভেলা বানিয়ে বৈঠা ঠেলে অন্যপাড়ে পৌছাল সে। কিন্তু তারপর, শ্রোতাদের কাছে জানতে চাইতেন বুদ্ধ, ভেলা নিয়ে এখন কি করবে এই পর্যটক? ওটা তার অনেক উপকারে এসেছে বলে পিঠে করে বয়ে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত তার? যেখানেই যাক সঙ্গে করে নিয়ে যাবে ওটা? নাকি ওটা বেঁধে রেখে চলা চালিয়ে যাবে? উত্তরটা পরিষ্কার। ‘ঠিক একইভাবে, সাধুরা, আমার শিক্ষা হচ্ছে ভেলার মতো, নদীর পেরুনোর জন্যে কাজে লাগাতে হবে, তারপর আর ধরে রাখতে হবে না, উপসংহারে পৌছাতেন বুদ্ধ। অভ্রান্ত বাণী দান বা বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল মেটানো নয় বরং মানুষকে বেদনার নদী পেরুতে সাহায্য করে ‘দূরের তীরে’ পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ। এই লক্ষ্য পূরণ করে না এমন সবকিছুই অপ্রাসঙ্গিক। 

সুতরাং, বিশ্ব সৃষ্টি বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে বুদ্ধের কোনও তত্ত্ব ছিল না। এইসব প্রসঙ্গ অবশ্যই দারুণ মনোমুগ্ধকর, কিন্তু এসব নিয়ে আলোচনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি। কেন? ‘কারণ, আমার শিষ্যগণ, এসব তোমাদের সাহায্য করবে না, পবিত্রতার অনুসন্ধানে এগুলো সাহায্যকারী নয়; শান্তি ও নিব্বানার প্রত্যক্ষ জ্ঞানের দিকে নিয়ে যাবে না। ১০১ তাঁর যোগ ও নৈতিক অনুশীলনের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বসৃষ্টি নিয়ে নাছোড়ের মতো লেগে থাকা এক সন্ন্যাসীকে তিনি বলেছিলেন তীর ছোঁড়া ব্যক্তির নাম এবং সে কোন গ্রামের বাসিন্দা না জানা পর্যন্ত চিকিৎসা পেতে অস্বীকার করা একজন আহত ব্যক্তির মতো সে। অর্থহীন তথ্য পাওয়ার আগেই মারা যাবে। একজন ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন কিনা জেনে কি লাভ হবে? তারপরেও শোক, বেদনা আর দুর্ভোগের অস্তিত্ব থেকে যাবে। ‘আমি এখানেই এইসব অসুখী অবস্থার উপশমের উপায় বাতলে দিচ্ছি,’ অধিবিদ্যিক ঝোঁক বিশিষ্ট সাধুকে বলেছেন বুদ্ধ, ‘সুতরাং সবসময় তোমাদের কি ব্যাখ্যা করিনি এবং সেটা ব্যাখ্যা না করার কারণও মনে রাখবে।১০২ 

ব্যাখ্যাকে সীমিত রাখার চেষ্টা করতেন বুদ্ধ! সক্রেটিসের মতো তিনি চাইতেন তাঁর অনুসারীরা নিজেদের মাঝেই সত্যি আবিষ্কার করুক। সাধারণ মানুষের বেলায়ও তা প্রযোজ্য ছিল। একবার গাঙ্গেয় উত্তর পাড়ের অধিবাসী কালমান গোত্রের লোকেরা বুদ্ধের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল। তাদের কাছে একের পর এক সাধু পাঠানো হয়েছে, ব্যাখ্যা করেছেন তাঁরা, কিন্তু প্রত্যেকেই অন্যের মতবাদকে হেয় করেছেন। কে সঠিক কিভাবে বুঝবে তারা? জবাবে বুদ্ধ বললেন, কালমানদের এমন দ্বিধার কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন। এবার আর চারটি মহান সত্যির বর্ণনা দিতে গিয়ে ওদের বিভ্রান্তি বাড়াতে গেলেন না তিনি, বরং উপস্থিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। কালমানরা অন্য কেউ তাদের হয়ে উত্তর বলে দেওয়ার আশা করছে, ব্যাখ্যা করলেন তিনি, কিন্তু নিজেদের হৃদয়ে দৃষ্টি দিলেই বেঁচে থাকার সঠিক পথ তাদের জানা আছে বলে অবিষ্কার করতে পারত। উদাহরণ স্বরূপ, লোভ কি ভালো না খারাপ? কালমানরা কি লক্ষ করেছে যে, কেউ আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলে চুরি, মিথ্যাচার বা এমনকি খুনও করতে পারে? এই ধরনের আচরণ কি স্বার্থপর লোককে অজনপ্রিয় এবং সেকারণে অসুখী করে তোলে না? আর ঘৃণা ও বিভ্রান্তিও কি বেদনা ও ভোগান্তির দিকে নিয়ে যায় না? আলোচনার শেষদিকে কালমানরা জানতে পারে, আগাগোড়াই সত্যিই বুদ্ধের ধম্ম জানত তারা। ‘সেজন্যেই তোমাদের বলেছি, অন্যের শিক্ষার উপর ভরসা করো না,’ উপসংহারে পৌঁছছেন বুদ্ধ। ‘যখন মন থেকে তুমি জানো যে কিছু কিছু জিনিস সহায়ক আর কিছু কিছু জিনিস অসহায়ক, তখন তোমাকে এই নীতির চর্চা করতে হবে এবং অন্য কেউ তোমাকে কি বলছে সেদিকে নজর না দিয়ে একেই আঁকড়ে থাকতে হবে।১০৩ গোড়ার দিকে বৌদ্ধ মতবাদের একটি কবিতায় বর্ণিত দক্ষ প্রবণতা অর্জনে সাধারণ মানুষকে সাহায্য করতে অপরিমেয়র ধ্যানের একটি ধরন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি: 

সকল প্রাণী সুখী হোক! দুর্বল বা শক্তিমান, উঁচু, মধ্য বা নিচু রাজ্যের
ছোট বা বড়, দৃশ্যমান বা অদৃশ্য, কাছের বা দূরের,
জীবিত বা অজাত-সকলেই সুখী হোক!
কেউ যেন কাউকে মিথ্যা না বলে বা
কোথাও কোনও সৃষ্টিকে ঘৃণা না করে।
কেউ যেন ক্রোধ বা ঘৃণা বশতঃ কোনও সৃষ্টির ক্ষতি না করে!
মা যেভাবে তার একমাত্র শিশুকে আদর করে,
আমরা যেন সকল প্রাণকে সেভাবে লালন করি!
আমাদের প্রেমের ভাবনা গোটা বিশ্বকে পূরণ করে রাখুক,
উপরে, নিচে, সর্বত্র,-
সীমাহীন; গোটা বিশ্বের প্রতি অবাধ, ঘৃণা ও বৈরিতা থেকে মুক্ত
এক সীমাহীন শুভেচ্ছা? ১০৪ 

এভাবে আচরণ করলে এবং ভবিষ্যৎ জীবন থাকলে, উপসংহারে পৌঁছেছেন বুদ্ধ, কালমানরা হয়তো কিছু ভালো কাজ পুঞ্জীভূত করতে পারবে এবং দেবতা হিসাবে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারবে। কিন্তু পরকাল বলে কিছু না থাকলে তাদের বিবেচনাপ্রসূত, সদয় জীবন ধারা হয়তো অন্যদের একইভাবে সাড়া দিতে উৎসাহিত করবে। আর কিছু না হোক, কালমানরা জানতে পারবে যে তারা ভালো আচরণ করেছে, যেটা সবসময়ই স্বস্তিকর।১০৫ 

এমনকি একমত না হলেও বুদ্ধ সবসময় যাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন সেইসব লোকের অবস্থানে প্রবেশ করতেন। বরাবরের মতো সহানুভূতিই ছিল চাবিকাঠি। কোসালার রাজা পাসেনাদি তাঁর অনুসারীদের একজন ছিলেন, একদিন তিনি ও তাঁর স্ত্রী পরস্পরের কাছে নিজস্ব সত্তার চেয়ে অন্য কিছুই তাদের কাছে এত প্রিয় নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বুদ্ধের একমত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু রাজাকে ভর্ৎসনা করলেন না তিনি কিংবা অনাত্তার আলোচনায়ও নামলেন না। তার বদলে পাসেনাদিকে এ-কথা ভেবে দেখতে বললেন: তিনি তাঁর নিজের চেয়ে প্রিয় কিছু নেই আবিষ্কার করে থাকলে অন্যরাও নিশ্চয়ই একই রকম বোধ করে। সুতরাং, সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন বুদ্ধ, “নিজেকে যে ভালোবাসে সে অন্যের ক্ষতি করতে পারে না। ১০৬ এটাই ছিল স্বর্ণবিধির তাঁর ভাষ্য। সাধারণ মানুষরা সন্ন্যাসীদের মতো সম্পূর্ণভাবে তাদের লোভ নিবারণ করতে পারে না, কারণ সন্ন্যাসীরা এই কাজে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত, তবে তারা অন্য লোকের আক্রম্যতার সঙ্গে সহানুভূতিশীল হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থপরতার অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করতে পারেন। এটা তাদের অহমের বড়াবাড়ির অতীতে নিয়ে গিয়ে সহানুভূতির আবিশ্যিক মূল্যের সঙ্গে পরিচিত করে তুলবে। 

জীবনের শেষদিকে রাজা পাসেনাদির স্ত্রী মারা যান এবং লাগাতার বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে লক্ষ্যহীনভাবে পল্লী এলাকায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিলে ন তিনি। একদিন দারুণ সব গাছে ভরা একটি উদ্যান আবিষ্কার করে বসেন। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে গাছপালার বিশালাকার সব শেকড়ের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর সময় সেগুলোর ‘আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের অনুপ্রেরণা’ দেওয়ার ধারা লক্ষ করেন। ‘শান্ত, কোনও বেসুরো কণ্ঠ তাদের শান্তি বিনষ্ট করছে না; সাধারণ জগৎ থেকে ভিন্ন হওয়ার একটা বোধ জাগাচ্ছে, জীবনের নিষ্ঠুরতা থেকে আশ্রয় যোগাচ্ছে।’ এইসব অনন্য সাধারণ গাছপালা দেখার পরই বুদ্ধের কথা মনে পড়ে গেল রাজার। লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে বুদ্ধ যেখানে অবস্থান করছিলেন—ততদিনে আশি বছরের বৃদ্ধে পরিণত হয়েছেন তিনি-সেখানে না পৌছা পর্যন্ত ছুটে চললেন।১০৭ সমসাময়িকদের অনেকের কাছেই এক সহিংস বিষাদময় বিশ্বে শান্তির আশ্রয় ছিলেন বুদ্ধ। একটি ভিন্ন, জগৎ থেকে আলাদা হয়েও বিস্ময়করভাবে এরই অংশ, নিরপেক্ষ, দারুণভাবে ন্যায়, শান্ত এবং আমাদের আস্থায় ভরে তোলা, সকল বৈরিতার বিরুদ্ধে আমাদের জীবনের একটা মূল্য থাকার আস্থা যোগানো একটি জায়গাই অ্যাক্সিয়াল যুগের বহু মানুষ ঈশ্বর, ব্রাহ্মণ বা নিব্বানার সন্ধানের সময় খোঁজ করেছিল। বুদ্ধ যেন তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ভেতরই একে মূর্ত করে তুলেছিলেন। লোকে তাঁর নির্লিপ্ততায় বিরক্ত হতো না, কোনও একজন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি তাঁর নিরপেক্ষতায়ও দমে যেত না। তিনি রসকসহীন, গম্ভীর বা অমানুষ হয়ে যাননি বলেই মনে হয়, বরং যারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হতো তাদের ভেতর অসাধারণ আবেগের সৃষ্টি করতেন। তাঁর অবিরাম, নিরন্তর সৌজন্য, প্রশান্তি এবং নিরপেক্ষতা যেন তাদের গভীরতম আকাঙ্ক্ষার কোনও তন্ত্রী স্পর্শ করে অনুরণন তুলত। কার্ল জেস্পারসের ভাষায় সক্রেটিস ও কনফুসিয়াসের মতো আদিআদর্শ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন তিনি-এমন কেউ যিনি মানবজাতি কি হতে পারে বা কি হওয়া উচিত তার নজীরে পরিণত হয়েছেন।১০৮ অ্যাক্সিয়াল যুগের এইসব নক্ষত্র আদিআদর্শে নজীরে পরিণত হয়েছেন; তাদের অনুকরণ অন্যদের তাঁদের মূর্ত করে তোলা বর্ধিত মানবতা অর্জনের সাহায্য করবে। একদিন এক ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে একটা গাছের নিচে বসে থাকতে দেখলেন। তাঁর প্রশান্তি, অনড়তা আর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ মহাবিস্ময়ে পরিপূর্ণ করে তুলল পুরোহিতকে। বুদ্ধ দাঁতাল হাতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে: অসাধারণ প্রশান্তিতে চালিত করা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা বিপুল শক্তি আর বিশাল সম্ভাবনার সেই একই বোধ বিরাজ করছিল। ব্রাহ্মণ এর আগে কখনও এমন কোনও মানুষ দেখেননি। ‘আপনি কি দেবতা, হুজুর?’ জানতে চেয়েছেন তিনি। ‘দেবদূত…নাকি প্রেতাত্মা?” না, জবাব দিয়েছেন বুদ্ধ। তিনি কেবল মানবীয় প্রকৃতিতে এক নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছেন। বেদনাময় এই বিশ্বে শান্তিতে, নিয়ন্ত্রণে এবং সতীর্থ প্রাণীকূলের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে বাস করা সম্ভব। লোকে একবার অহমবাদের শেকড় ছিন্ন করে ফেললে ক্ষমতার তুঙ্গে অবস্থান করে এবং সাধারণভাবে তাদের সত্তার সুপ্ত অংশগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে পারে। ব্রাহ্মণ কিভাবে তাঁকে বর্ণনা করবেন? ‘আমাকে জাগ্রত জন হিসাবে মনে রেখো। ১০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *