৬. সহানুভূতি (সি. ৫৩০ থেকে ৪৫০ বিসিই)
ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে বৈধ ডিউকের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া তিনটি ব্যারনিয় পরিবার নিজেদের ভেতর প্রাধান্য বিস্তারের লক্ষ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় সামগ্রিক অরাজকতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল লু। শাস্ত্রজ্ঞদের পক্ষে বিশেষ বেদনাদায়ক ছিল এটা। গোটা চীনের মানুষজন সেই আদি ঝোউ রাজাদের আমলের সঙ্গীত শুনতে ও আনুষ্ঠানিক শাস্ত্রাচারে অংশ নিতে হাজির হতো। জিন থেকে আগত একজন পর্যটক চিৎকার বলেছিল: ‘ঝোউয়ের অনুষ্ঠান (লি) সবই আছে এখানে! কিন্তু এখন আমি ঝোউ-এর ডিউকের ক্ষমতা বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি ঝোউ ইস্তফা দিয়েছিলেন কেন। কিন্তু ৫১৮ সাল নাগাদ ঝোউ-এর একজন বংশধর লু-র বৈধ শাসক এতটাই দরিদ্র ছিলেন যে, তাঁর কাছে পুর্বসুরিদের মন্দিরে এইসব আচার পালনের জন্যে বাদক ও নর্তকদের মেটানোর মতো টাকাকড়ি ছিল না। অথচ তাসত্ত্বেও সে বছরই একজন ক্ষমতাদখলকারীর কাছে-একেবারেই অবৈধভাবে-রাজকীয় প্রাসাদে তাঁর নিজস্ব পূর্বপুরুষের মন্দিরে আচার পালনের জন্যে নর্তকদের আটটি দল ছিল। হতাশা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল। লি আর অভিজাত পরিবারগুলোর লোভ ও প্রদর্শনবাদীতাকে রুখতে পারছিল না, স্বৰ্গকে মনে হচ্ছিল ভিন্ন রকম।
রাজকীয় আচারের এই অবৈধ পালনের কথা জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন কনফুসিয়াস। ‘পথ কোনও অগ্রগতি লাভ করেনি,’ বিলাপ করেছেন তিনি।` শাসকরা সমাজকে সঠিক পথে রাখা পবিত্র মূল্যবোধ বাস্তবায়ন করতে না পারলে তাঁকেই সেটা করতে হবে। সাধারণ মানুষ হিসাবে দাও প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না তিনি; কেবল একজন রাজাই তা করার ক্ষমতা রাখতেন। তবে চীনের শাসকদের পথের শিক্ষা দিতে পারবেন ও তাঁদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেবেন এমন পবিত্র শিক্ষিত, ওয়াকিবহাল একদল মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে পারতেন। রাজনৈতিক ব্রতের আশা করেছিলেন কনফুসিয়াস, কিন্তু অবিরাম হতাশ হয়েছেন। রাজনীতিতে সফল হওয়ার পক্ষে বড় বেশি স্পষ্টবাদী ও সৎ ছিলেন তিনি, অর্থ ও হিসাব বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চাকর-বাকরের পর্যায়ের চেয়ে বেশি বড় পদ পাননি কখনও। কিন্তু এরচেয়ে ভালো কিছু হওয়ার ছিল না। রাজনৈতিক ব্যর্থতা চিন্তাভাবনার করার অবকাশ দিয়েছিল তাঁকে, নিজে সফল হতে না পারলেও অন্যদের উচ্চ পদের জন্যে প্রশিক্ষণ দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে অনুপ্রাণিত শিক্ষকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। এই সময়ের অন্য প্রান্তিকায়িত শি-র মতো ভবঘুরে পণ্ডিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, অন্তত একজন রাজকুমার তাঁকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন, এই আশায় বিশ্বস্ত শিষ্যদের একটা ছোট দল নিয়ে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন।
নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসী ছিলেন না কনফুসিয়াস, জাগতিক মানুষ ছিলেন তিনি, ভালো খাবার, চমৎকার মদ, ভালো গান আর উদ্দীপক কথোপকথন ভালোবাসতেন। নিজেকে গজদন্ত মিনারে বন্দী করে রাখেননি, অন্তর্মুখীনতার চর্চা বা ধ্যানের অনুশীলন করেননি, বরং সবসময় অন্যদের সঙ্গে কথপোকথনের ভেতর দিয়ে নিজের দর্শনকে গড়ে তুলেছেন। আমাদের প্রধান সূত্র অ্যানালেক্টস- এ তাঁকে বন্ধু ও শিষ্যদের সঙ্গে কথপোকথনে ব্যস্ত দেখতে পাই আমরা। তাঁর ঔদার্য ও প্রখর বুদ্ধিমত্তা-অস্বাভাবিক সমন্বয়-চুম্বকের মতো ছাত্রদের আকর্ষণ করত, কখনওই কাউকে ফিরিয়ে দেননি তিনি। তাঁর কোনও কোনও শিষ্য ছিলেন অভিজাত গোষ্ঠীর, অন্যরা সামান্য জন্ম পরিচয়ের। সম্ভবত দরিদ্র কিন্তু অতীন্দ্রিয়ভাবে মেধাবী ইয়ান হুই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষুদে দলের প্রতিটি সদস্যকে ভালোবাসতেন তিনি: শান্ত শক্তিশালী মিংযি; প্রাণবন্ত যিলু; ও বরাবর সাহসী ও সৎ যিগং। কোনও সম্ভাবনাময় ছাত্র এসে হাজির হলে অন্য সব গুণাবলী ছাড়িয়ে একটিমাত্র গুণের খোঁজ করতেন কনফুসিয়াস। ‘কেবল আগ্রহে ফেটে পড়াদেরই আমি দীক্ষা দিয়ে থাকি, ‘ বলেছেন তিনি। ‘কেবল উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটন্তদেরই আলোকিত করি। ৩ শিষ্যদের ভর্ৎসনা করেছেন তিনি, নিষ্ঠুরভাবে চড়াও হয়েছেন তাদের উপর, কিন্তু কখনওই তাদের পেছনে লাগেননি। যোগীদের কিছুটা ভীতিকর সাফল্যে বিস্মিত হওয়ার পর কনফুসিয়াসের দিকে ফিরে তাকানো স্বস্তিদায়ী, সঠিকভাবে উপলব্ধি করা গেলে যাঁর পথ যেকারও কাছে বোধগম্য ছিল। আন্তরিক, শান্ত ও বন্ধুসুলভ কনফুসিয়াস কখনওই পৌরহিত্য করেননি। দীর্ঘ ভাষণ বা লেকচারের কোনও ব্যাপার ছিল না, এমনকি শিষ্যের সঙ্গে মতানৈক্য হলে সাধারণত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে তৈরি থাকতেন তিনি। কেন থাকবেন না? ইয়াও বা শানের মতো স্বর্গীয়ভাবে অনুপ্রাণিত সাধু ছিলেন না তিনি। কোনও প্রত্যাদেশ বা দিব্যদর্শন ছিল না তাঁর। তাঁর একমাত্র মেধা ছিল শেখার ক্লান্তিহীন প্রয়াস ও অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার নিরবিচ্ছিন্ন ধৈর্য। ৪
কনফুসিয়াসের মৃত্যুর অনেকদিন পরে তাঁর শিষ্যদের হাতে অ্যানালেক্টস গ্রন্থিত হয়েছিল বলে তাঁকে কৃতিত্ব দেওয়া সমস্ত নীতিবাক্যই খাঁটি কিনা আমরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি না; তবে টেক্সটকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে বিশ্বস্ত সূত্র হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে পণ্ডিতদের বিশ্বাস। শত শত সংক্ষিপ্ত, সম্পর্কহীন মন্তব্য নিয়ে এটি রচিত, স্পষ্ট সংজ্ঞায়িত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার কোনও প্রয়াস নেই। ধরনটা কোনও চীনা ল্যান্ডস্কেপের মতোই ইঙ্গিতময়: পাঠকদের কি বলা হয়নি তার খোঁজ করার, পূর্ণাঙ্গ অর্থের জন্যে লেখার গভীরে খোঁজ করার এবং একটি ধারণার সঙ্গে অন্য ধারণার সম্পর্ক স্থাপন করার কথা। আসলে প্রাথমিক ধারণা যাই হোক, অ্যানালেক্টস-এ সামঞ্জস্যতা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কনফুসিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গি পরস্পর এত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত যে অনেক সময় বিভিন্ন বিষয়বস্তু আলাদা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্য দার্শনিকদের মতো আপন সময় থেকে নিজেকে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করেছেন কনফুনিয়াস। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষুদেরাজ্যের পরিচালনাকে নিয়ন্ত্রণ করে আসা ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি অবহেলাই চীনের চলমান বিশৃঙ্খলার মূল কারণ বলে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। ইয়াও ও শানের আমলে এবং পরবর্তীতে ঝোউদের গোড়ার দিকের শাসনে স্বর্গীয় পথ সঠিকভাবে অনুসৃত হয়েছিল এবং মানবজাতি সম্প্রীতির ভেতর একসঙ্গে বসবাস করেছে বলে বিশ্বাস ছিল তাঁর। লি মিতাচার ও ঔদার্যের চেতনাকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ রাজকুমার আদৌ দাও-এর কথা মাথায় আনেন না। বিলাসিতার খোঁজে দারুণ ব্যস্ত তাঁরা, যাঁর যাঁর নিজস্ব স্বার্থপর উচ্চাভিলাষের পিছু ধাওয়া করছেন। একই রকম মূল্যবান কোনও কিছুর আবির্ভাব ছাড়াই প্রাচীন বিশ্ব ভেঙে পড়ছিল। অতীতে দারুণ কার্যকর ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়াই ছিল কনফুসিয়াসের চোখ সবচেয়ে সেরা সামাধান।
ক্ষুদে রাজ্যগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার হুমকি সৃষ্টি করা লাগাতার যুদ্ধ- বিগ্রহের কারণে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন কনফুসিয়াস। কিন্তু তাসত্ত্বেও তাঁকে হতাশ করে নিজেদের বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ মনে হয়নি তাদের। কি-র মতো বড় বড় রাজন্যের সঙ্গে সামরিক দিক দিয়ে পাল্লা দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না লু, কিন্তু বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলার লক্ষ্যে সকল সম্পদ একত্রিত করার বদলে ব্যারনিয় পরিবারগুলো-সবগুলোই লোভ ও মিথ্যা অহমিকায় প্রণোদিত-আত্ম বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ‘পরিবার তিনটি’ সঠিকভাবে লি অনুসরণ করলে কখনওই এমনি অবস্থার সৃষ্টি হতো না। অতীতে আচার-অনুষ্ঠান সহিংসতা ও প্রতিশোধের বিপদ হ্রাসে সাহায্য করেছে এবং যুদ্ধের ত্রাস দূর করেছে। আবারও সেগুলোকে তা করতে হবে। শাস্ত্রজ্ঞ হিসাবে রাজকীয় তীরন্দাজী চর্চা ও রথ চালানোর অনুশীলনের চেয়ে আচারের পাঠ ও ধ্রুপদী রচনা পড়ার পেছনে বেশি সময় দিয়েছিলেন কনফুসিয়াস। এবার জুনযি-র ভূমিকাকে পরিমার্জিত করলেন তিনি: প্রকৃত ভদ্রলোককে যোদ্ধা নয়, পণ্ডিত হতে হবে। ক্ষমতার জন্যে যুদ্ধ করার বদলে জুনযিকে অবশ্যই লি মোতাবেক পারিবারিক, সামরিক ও সামাজিক জীবনের সঠিক আচরণ নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। নিজেকে কখনওই মৌলিক চিন্তাবিদ দাবি করেননি কনফুসিয়াস। ‘আমাকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সেটাই আমি নিজের থেকে কোনও কিছু সৃষ্টি না করে শিক্ষা দিয়েছি,’ একবার বলেছিলেন তিনি। ‘আমি প্রাচীনের প্রতি বিশ্বস্ত ও তাকে ভালোবাসি।’’ কেবল স্বর্গীয় অন্তর্দৃষ্টির আশীর্বাদ লাভ করা একজন সাধুই ঐতিহ্য ভঙ্গ করতে পারেন। ‘আমি স্রেফ অতীতের অনুসন্ধানে আন্তরিক একজন অতীত-প্রেমী একজন মানুষ।” কিন্তু এমনি অস্বীকৃতি সত্ত্বেও একজন উদ্ভাবক ছিলেন কনফুসিয়াস। ‘নতুনের ধারণা লাভে প্রাচীনকে সজীব করে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি।” পৃথিবী পাল্টে গিয়েছিল, কিন্তু ধারাবাহিকতার একটা মানদণ্ড না থাকলে কোনও ফলপ্রসু পরিবর্তন আসতে পারে না।
ঐতিহ্যকে ব্যাখ্যা করার কনফুসিয়াসের কায়দার কোনও কোনওটা গুরুত্বের দিক থেকে বিপ্লবাত্মকভাবে ভিন্ন ছিল। প্রাচীন ধর্ম স্বর্গের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিল: লোকে প্রায়শঃ দেবতা ও আত্মার আশীর্বাদ পাওয়ার লক্ষ্যেই উৎসর্গের আয়োজন করত, কিন্তু কনফুসিয়াস পৃথিবীর দিকে নজর দিয়েছেন। সমসাময়িক চেং-এর প্রধানমন্ত্রী যিচানের মতো আমাদের জানা বিষয়ে নজর দেওয়াই শ্রেয়তর বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে, স্বর্গের কথা না বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর শিষ্য যিগোং উল্লেখ করেছেন: ‘আমরা সংস্কৃতি ও ভালোত্বের বাহ্যিক চিহ্ন সম্পর্কে গুরুর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পেতাম, কিন্তু স্বর্গীয় পথের কথা কিছুই বলতেন না তিনি।১০ অধিবিদ্যিক বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না কনফুসিয়াস, ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা নিরুৎসাহিত করতেন তিনি। যিলু তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন একজন জুনযি কিভাবে দেবতাদের সঙ্গে আচরণ করবে; তিনি জবাব দিয়েছিলেন: ‘মানুষের সঙ্গে আচরণ শেখার আগে কেমন করে আত্মার সঙ্গে আচরণ শিখবে?’ যিলু নাছোড় হয়ে আবার যখন জিজ্ঞেস করলেন, পূর্বপুরুষের জীবন ধারা আসলে কেমন ছিল, কনফুসিয়াস ফের উত্তর দিয়েছিলেন: ‘জীবিতদের সম্পর্কে জানার আগে কিভাবে মৃতদের সম্পর্কে জানতে পারবে? ১১ কনসিয়াস সংশয়বাদী ছিলেন না। নিয়মনিষ্ঠভাবে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন তিনি; স্বর্গের কথা ভাববার সময় ঐশী ভীতিতে ভরে উঠতেন। ভারতীয় সাধুদের মতো নীরবতার মূল্য বুঝতেন তিনি। ‘আমি বরং নীরব থাকতেই পছন্দ করব,’ একবার অনুযোগ করেছিলেন তিনি। বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন যিগোং। ‘আমাদের শুরু কথা না বললে,’ আপত্তি করেছেন তিনি, ‘আমরা ছোটরা কিভাবে তাঁর সম্পর্কে অন্যদের শিক্ষা দেব?’ ‘স্বৰ্গ কথা বলে না,’ জবাব দিয়েছিলেন কসনফুসিয়াস, ‘তবু স্বর্গের নির্দেশে চারটি ঋতু তাদের পথ বেয়ে চলে, আর সেভাবে শত শত পশু প্রতিটি তার জাতের মতো হয়ে জন্ম নেয়! স্বর্গ কোনও কথা বলে না!’ স্বৰ্গ কথা বলতে না পারে, কিন্তু তা স্রেফ কার্যকর। অর্থহীন ধর্মতাত্ত্বিক আঁচ-অনুমানের পেছনে সময় নষ্ট না করে লোকের উচিত স্বর্গীয় নীরবতাকে অনুকরণ করে সশ্রদ্ধ নীরবতা বজায় রাখা। তাহলে হয়তো জগতে তারাও সম্ভাবনাময় শক্তিতে পরিণত হবে। চীনের ধর্মকে মর্ত্যে নামিয়ে এনেছিলেন কনফুসিয়াস। পরকালের জীবন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না হয়ে মানুষকে অবশ্যই এখানে ভালো হওয়া শিখতে হবে। তাঁর শিষ্যরা দেবতা ও আত্মার নিগূঢ় জ্ঞান লাভের জন্যে তাঁর কাছে পড়াশোনা করতে আসেননি। স্বর্গ নয়, তাদের পরম লক্ষ্য ছিল পথ। পথই চরম মূল্য ধারণ করে বুঝে নিয়ে এই পথে সাবধানে চলা ছিল জুনযির দায়িত্ব। কোনও স্থান বা ব্যক্তির কাছে নয়, বরং এটা তাদের এক দুজ্ঞেয় ভালোর অবস্থানে পৌছে দেবে। আচার-অনুষ্ঠানগুলো ছিল তাদের সঠিক পথে তুলে দেওয়ার পথনকশা।
কনফুসিয়াসের চোখে সবারই পরিপূর্ণ বিকশিত মানুষ জুনযি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রাচীন কালে কেবল একজন অভিজাতই জুনযি ছিলেন, কিন্তু কনফুসিয়াস জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পথের শিক্ষা নেওয়া যে কেউ ‘ভদ্রলোক’, একজন পরিপক্ক বা গভীর ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে। যিগোং একবার মত দিয়েছিলেন যে, দলটি তাদের লক্ষ্য হিসাবে ‘ভিখ বিহীন গরীব, অহঙ্কার বিহীন ধনী’ বেছে নিক। ‘মন্দ না,’ বলেছিলেন কনফুসিয়াস। ‘কিন্তু তারপরেও পথে আমোদিত হওয়া দরিদ্র হওয়া, ধনী অথচ আচারের ছাত্র হওয়াই ভালো।’ সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসিক অভ ওদেস-এর একটি পঙক্তি উল্লেখ করে এর জবাব দিয়েছিলেন যিগো :
যেভাবে বস্তু কাটা হয় সেভাবেই তা চোখা হয়,
যেভাবে বস্তু খোদাই হয়, সেভাবেই তা চকচকে করা হয়। ১৩
খুশি হয়ে উঠেছিলেন কনফুসিয়াস: তাহলে অবশেষে ওদেস বুঝতে শুরু করেছেন যিগোং! একজন জুনযি কিভাবে তার মনুষ্যত্বকে পরিমার্জিত ও উজ্জ্বল করে তুলবে এই পঙক্তিগুলো নিখুঁতভাবে সেটা তুলে ধরেছে। জুনযি জন্মসূত্রে নয়, বরং তাকে গড়ে তুলতে হয়। একজন ভাস্কর যেভাবে কঠিন পাথর কুঁদে সুন্দর কিছু বের করে আনেন, ঠিক সেভাবে জুনযিকে নিজের উপর কাজ করতে হতো। সত্যিকারের জুনযি সবসময়ই নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছে, যা হওয়ার কথা সেটা হওয়ার চেষ্টা করেছে। ‘কিভাবে এটা অর্জন করব আমি?’ জানতে চেয়েছিলেন ইয়ান হুই। সহজ ব্যাপার, জবাব দিয়েছেন কনফুসিয়াস ‘তোমার অহম দমন করে লি-র কাছে আত্মসমর্পণ করো।১৪ জুনযিকে অবশ্যই তার জীবনের প্রতিটি আচরণকে অন্যের প্রতি বিবেচনা ও সম্মানের আচারের কাছে সমর্পণ করতে হবে। লক্ষ্য ছিল ‘আচারকে উপেক্ষা করে কোনও কিছুকে না দেখা, আচারে প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে কোনও কিছু না শোনা, আচারের প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে কোনও কিছু না বলা, আচারের প্রতি অবহেলা দেখিয়ে কখনওই হাত বা পা না নাড়া।’ চীনের রাজকুমাররা এমন করে থাকলে এই পৃথিবীকে বাঁচাতে পারতেন। শাসক তাঁর অহম দমন করে একটি দিনের জন্যেও লি-র কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারলে স্বর্গের নিচের প্রতিটি মানুষ তাঁর মহত্মের কাছে সাড়া দিত! ১৫
ভারতীয় সাধুদের মতো ‘অহম নীতিকে’ সকল মানবীয় ক্ষুদ্রতা ও নিষ্ঠুরতার উৎস মনে করেছেন কনফুসিয়াস। লোকে স্বার্থপরতা ত্যাগ করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে লি-র কল্যাণকামী চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারলে পবিত্রতার সৌন্দর্যে বদলে যাবে। জুনযির আদিআদর্শ রূপের অনুরূপ, উন্নত মানবীয় সত্তা হয়ে উঠবে তারা। আচার-অনুষ্ঠান সাধারণ জৈবিক কর্মকাণ্ডকে একটি ভিন্ন স্তরে তুলে দেয়; আমরা যেন অন্যদের সঙ্গে অবহেলার আচরণ না করি বা তাদের সঙ্গে নেহাতই নিয়মরক্ষার খাতিরে সম্পর্কিত না হই, আমরা যেন কেবল উপযোগিতা আর স্বার্থপরতায় চালিত না হই তাই নিশ্চিত করে এগুলো। উদাহরণ স্বরূপ, ভক্তিপূর্ণ আচরণের নীতিগুলো ছেলেদের তাদের অভিভাবকদের কৃতজ্ঞতার সঙ্গে খাবার পরিবেশনের শিক্ষা দেয়, কিন্তু আজকাল অনেক ছেলেই খাবার স্রেফ টেবিলে উপর ছুঁড়ে ফেলে। ‘এমনকি ঘোড়া আর কুকুরও সমান আচরণ লাভ করে!’ হতাশায় চেঁচিয়ে বলেছিলেন কনফুসিয়াস; কিন্তু শ্রদ্ধা ও উপলব্ধির পরিবেশে খাবার গ্রহণ করা হলে তা মানবীয় হয়ে ওঠে।১৬ অ্যাক্সিয়াল যুগের মানুষ কনফুসিয়াস চেয়েছিলেন লোকে যেন তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হয়ে ওঠে। লি-র অনুসরণ স্রেফ কতগুলো আচরণের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছিল না; এর জন্যে দরকার ছিল মনস্তাত্ত্বিক তীক্ষ্ণতা, সংবেদনশীলতা ও সবরকম পরিস্থিতির বুদ্ধিদীপ্ত মূল্যায়ন।” “ভক্তিপূর্ণ আচরণ কেবল কিছু করার সময় কঠিন কাজ এবং বয়স্কদের আগে মদ ও খাবার দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া তরুণদের ভেতরই সীমাবদ্ধ নয়,’ ব্যাখ্যা করেছিলেন কনফুসিয়াস; ‘এটা তারচেয়ে অনেক বেশি কিছু।১৮ এই ‘অধরা’ কিছুটা কি ছিল? এটা ছিল ‘আচার-আচরণ’, উপসংহারে পৌঁছেছেন কনফুসিয়াস। আপনি কোনও আচার পালনে যে চেতনার প্রকাশ করবেন আপনার প্রতিটি ভঙ্গি ও মৌখিক অভিব্যক্তিতে সেটা ফুটে উঠবে। অসন্তোষ ও অধৈর্যভাবে পালিত হলে কোনও আচার অপমানকার হয়ে উঠতে পারে।
অবশ্য অতীতে প্রায়শঃই লি-র আক্রমণাত্মক ধার ছিল। রাজনৈতিক সুবিধা বা অভিজাতদের ব্যক্তিগত মর্যাদা বাড়ানোর কাজে লাগানো হতো এগুলোকে। কনফুসিয়াস পদ্ধতিগতভাবে লি থেকে এই অহমবাদকে উৎখাত করেন। আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে দীর্ঘ গবেষণা ‘পরাজয়ের’র (রাং) চেতনায় আচরিত হলেই এগুলো অর্থবহ হয়ে ওঠে বলে শিক্ষা দিয়েছিল তাঁকে। ছেলেদের বাবার কাছে, যোদ্ধাদের শত্রুর কাছে আর রাজাদের তাঁদের ভৃত্যদের কাছে পরাস্ত হতে হবে। আচার তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ বিসর্জন দিয়ে, তাদের জগতের কেন্দ্র থেকে সিংহাসনচ্যুত করে অন্য ব্যক্তিকে সেখানে বসানোর শিক্ষা দিয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে আচার-অনুষ্ঠান রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে একেবারে স্বার্থপর নীতিমালাকে সামনে নিয়ে আসা থেকে বিরত রেখেছে। এসব সমমর্মিতার একটি শৃঙ্খলিত অবাস গড়ে তুলেছে। সুতরাং সঠিক চেতনায় পালিত হলে আচার-অনুষ্ঠানগুলো লোককে অহমবাদের সীমাবদ্ধতা থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করা আধ্যাত্মিক শিক্ষা ছিল। মর্যাদা ও প্রাধান্যের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত সংস্কৃত একটি আচারবাদ মানবীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মর্যাদা ও মাহাত্ম্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে গোটা চীনকে আবার মানবিক স্থানে পরিণত করতে পারে।
লি মানুষকে অন্যদের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে আচরণের শিক্ষা দিয়েছিল। একই অনুষ্ঠানের অংশীদারে পরিণত হয়েছিল তারা: সঠিকভাবে শাস্ত্রীয় গীতিতে সামান্য ভূমিকা পালনকারীও অপরিহার্য ছিল এবং সামগ্রিক সৌন্দর্যে অবদান রেখেছে। আচার লোককে জীবনের পবিত্রতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে এবং পবিত্রতাও দিয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সমীহের লি রাজকুমারের স্বর্গীয় ক্ষমতার পরিচর্যা করেছে; ভক্তিপূর্ণ আচরণের নীতি লি মরণশীল মানুষকে পূর্বসুরিতে পরিণত হতে সক্ষম করে তোলা স্বর্গীয় শেন সৃষ্টি করেছে। অন্যদের সঙ্গে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আচরণ করে আচার-অনুষ্ঠান আচার পালনকারী ব্যক্তি ও তার মনোযোগ লাভকারীকে অস্তিত্বের পবিত্র মাত্রার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিত।
ভারতে যোগীরা পরমের সন্ধানে এক নিঃসঙ্গ যাত্রায় নেমেছিল। কনফুসিয়াস এটা বুঝতে পারতেন না। তাঁর দৃষ্টিতে পূর্ণ মানবসত্তার বিকাশের জন্যে আপনার অন্য লোকের প্রয়োজন আছে; আত্ম-বিকাশ একটি পারস্পরিক প্রক্রিয়া। ভারতীয় গৃহত্যাগীদের মতো পারিবারিক জীবনকে আলোকনের পথে বাধা না ভেবে কনফুসিয়াস ধর্মীয় অনুসন্ধানের নাট্যমঞ্চ মনে করেছেন একে, কেননা তা পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে অন্যের জন্যে বাঁচতে শিখিয়েছে।২০ জুনযির আত্ম বিকাশের জন্যে এই পরার্থবাদীতা জরুরি ছিল: ‘নিজেকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে অন্যকে প্রসারিত করতে হবে।২১ পরে পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার কারণে সমালোচিত হবেন কনফুসিয়াস – কারণ সবার জন্যেই লোকের উদ্বেগ থাকা উচিত-কিন্তু কনসফুসিয়াস প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবিরাম বিস্তৃত হয়ে চলা সমকেন্দ্রিক বৃত্তের কেন্দ্র মনে করেছেন, যার সঙ্গে সেই নারী বা পুরুষকে অবশ্যই সম্পর্কিত হতে হবে।২২ আমরা সবাই পরিবারে আমাদের জীবন শুরু করি, সুতরাং পারিবারিক লি আমাদের নিজেদের অতিক্রম করে যাওয়ার শিক্ষার সূচনা ঘটায়, কিন্তু সেখানেই এর শেষ হতে পারবে না। একজন জুনযির দিগন্ত ক্রমাগত প্রসারিত হবে। অভিভাবক, স্ত্রী ও ভাইবোনদের যত্ন নিয়ে লাভ করা শিক্ষা তার হৃদয়কে প্রসারিত করেছে, যাতে মানুষের জন্যে অধিকতর সহানুভূতি বোধ করে সে: প্রথমত নিকটতর সম্প্রদায়ের প্রতি, তারপর যে দেশে বাস করে তার প্রতি এবং সবশেষে গোটা বিশ্বের প্রতি।
কনফুসিয়াস সেইসব মানুষের একজন ছিলেন যারা পবিত্রতা পরার্থপরতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হওয়ার ব্যাপারটাকে স্ফটিক স্বচ্ছ করে দিয়েছিলেন। তিনি সাধারণত বলতেন: ‘আমার পথের ঠিক এর ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া একটা সুতো রয়েছে। বিমূর্ত অধিবিদ্যা বা জটিল শাস্ত্রীয় আঁচ-অনুমানের কোনও ব্যাপার ছিল না; সবকিছু সবসময় অন্য লোকের প্রতি পরম সমীহের সঙ্গে আচরণের গুরুত্বের কাছে ফিরে এসেছে। ‘আমাদের গুরুর পথ,’ বলেছেন তাঁর এক শিষ্য, ‘এটা ছাড়া আর কিছু না: অন্যের জন্যে তোমার সেরাটি [ঝোং] করা এবং বিবেচনা [৩]।২৩ পথ অন্যদের পবিত্রতার পরিপুষ্ট করে তোলায় নিবেদিত অন্তহীন প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যারা আবার শেষে তোমার ভেতরের সহজাত পবিত্রতাকে বের করে আনবে। ‘এমন কোনও বাণী কি আছে সারাদিন যার উপর কেউ কাজ করতে পারবে?’ গুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যিগোং। ‘সম্ভবত বিবেচনা [ ] সংক্রান্ত বাণী,’ বলেছেন কনফুসিয়াস। ‘অন্যরা তোমার প্রতি যেমন আচরণ করুক চাইবে না কখনও তাদের সঙ্গে তেমন আচরণ করবে না ২৪ আসলে শু-কে এভাবে অনুবাদ করা উচিত: ‘নিজের প্রতি পছন্দ। অন্যরা একে বলেছেন স্বর্ণবিধি; আবিশ্যিক ধর্মীয় অনুশীলন ছিল এটা, এবং যতটা মনে হয় তারচেয়ে ঢের বেশি কঠিন। যিগোং একবার এই গুণে দক্ষতা অর্জন করার দাবি করেছিলেন: ‘অন্যরা আমার প্রতি যেমনটা করুক বলে আশা করি না, অন্যের প্রতি তেমন করার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই,’ সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। মাথা নাড়ার সময় কনফুসিয়াসের কৃশ কিন্তু স্নেহার্দ্র হাসি কল্পনা করতে পারবেন যেকেউ। ‘আচ্ছা! এখনও ওই পর্যায়ে যেতে পারোনি তুমি। ১২৫
শু-র চাহিদা ছিল ‘সারাদিন, প্রতিদিন’ আমরা নিজেদের হৃদয়ে দৃষ্টি দেব, কোন কারণে কষ্টের সৃষ্টি হয় দেখব এবং তারপর সব অবস্থায় অন্য লোকের উপর দুর্দশা চাপানো থেকে নিজেদের বিরত রাখব। এর দাবি ছিল যে লোকে আর নিজেদের বিশেষ, বিচ্ছিন্ন শ্রেণীতে স্থাপন করবে না, বরং অবিরাম অন্যের সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে ভাগাভাগি করে নেবে। কনফুসিয়াসই প্রথম স্বর্ণবিধির ঘোষণা করেছিলেন। কনফুসিয়াসের কাছে এর দুয়ে মূল্য ছিল। তাঁর ভাষায় লি-র উপর পূর্ণ দখল মানুষকে রেন অর্জনে সাহায্য করেছে। আদিতে এই শব্দটি ‘মহৎ’ বা ‘প্রশংসনীয়’ বোঝাত, কিন্তু কনফুসিয়াসের আমল নাগাদ মানে দাঁড়িয়েছিল স্রেফ মানুষ। শব্দটিকে সম্পূর্ণ নতুন তাৎপর্য দেন কনফুসিয়াস, কিন্তু একে সংজ্ঞায়িত করতে অস্বীকার গেছেন তিনি। পরে কিছু কিছু দার্শনিক রেন-কে ‘ঔদার্যের’ সমার্থক করে তুলবেন, কিন্তু কনফুসিয়াসের চোখে তা ছিল খুবই সংকীর্ণ।২৬ চৈনিক লিপিতে রেন-এর দুটি অংশ ছিল: প্রথমত, মানুষের একটি সহজ প্রতীক-সত্তা; আর দ্বিতীয়ত, মানবীয় সম্পর্ক বোঝানো দুটো সমান্ত রাল চিহ্ন। সুতরাং রেন -কে ‘সমমনুষ্যত্ব’ হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে; কোনও কোনও পণ্ডিত মূল অর্থ ‘কোমলতা’ বা ‘সুনম্যতা”২৭ ছিল বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। সুতরাং, কনফুসিয়াসের সময়ের পরিচিত কোনও শ্ৰেণীতে ফেলা সম্ভব ছিল না বলে তাঁর চোখে রেন ছিল ব্যাখ্যার অতীত।২৮ কেবল নিখুঁতভাবে রেন-এর চর্চাকারী কেউই তা উপলব্ধি করতে পারত। সক্রেটিস বা প্লেটো যাকে “ভালো” বলে আখ্যায়িত করতেন রেন তেমন কিছুর অনুরূপ। রেন-এর অধিকারী একজন মানুষ নিখুঁতভাবে ইয়াও, শান বা ঝোউ-এর ডিউকের মতো একই স্তরে পরিপক্ক মানুষে পরিণত হয়েছে। কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, রেন-ই সাধু রাজাদের বিনা শক্তি ব্যয়ে শাসনে সক্ষম করে তোলা ‘পথের শক্তি’ (দাওদে) ছিল। একে আর জাদুকরী মনে করা যাবে না, বরং এটা সহিংসতা ও যুদ্ধবিগ্রহের চেয়ে ঢের কার্যকরভাবে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার মতো নৈতিক ফলপ্ৰসুতা।
রেন কি, জিজ্ঞেস করেছিলেন কনফুসিয়াসের এক শিষ্য, রাজনৈতিক জীবনে কিভাবে তাকে প্রয়োগ করা যেতে পারে?’ গুরু জবাব দিয়েছিলেন:
বাড়ির বাইরে এমন আচরণ করবে যেন তুমি গুরুত্বপূর্ণ কোনও অতিথির উপস্থিতিতে রয়েছ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করো, যেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ উৎসর্গ পালন করছ। তুমি নিজে যা পছন্দ করো না অন্যের প্রতি তেমন আচরণ করো না। তাহলে আর তোমার প্রতি বিরোধিতার কোনও বোধ কাজ করবে না, সেটা রাষ্ট্রীয় কোনও কাজই হোক বা কোনও পরিবারের ব্যাপারই হোক। ২৯
রাজকুমার অন্য শাসক ও রাষ্ট্রের প্রতি এমন আচরণ করলে নিষ্ঠুর যুদ্ধের কোনও অবকাশই থাকতে পারে না। কোনও রাজকুমারই তাঁর নিজের রাজ্যের ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটুক চাইবেন না বলে স্বর্ণবিধি অন্যের এলাকায় আগ্রাসন চালানো বা ধ্বংস করা অসম্ভব করে তুলবে। শাসকরা সাধারণ মানুষকে শোষণ করতে পারেন না, কারণ তাদের এক সুন্দর আয়োজনের সহঅংশীদার হওয়ায় ‘তাঁদের নিজেদের মতো’ মনে করবেন। বিরোধিতা ও ঘৃণা মিলিয়ে যাবে। রেন কি জিনিস ব্যাখ্যা করতে পারেননি কনফুসিয়াস, কিন্তু সেটা কিভাবে অর্জন করা যাবে লোকজনকে বলতে পেরেছিলেন। অন্যের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব অনুভূতিকে ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছে। এটা একেবারেই সহজ, যিগোংকে বুঝিয়ে বলেছেন কনফুসিয়াস :
রেন-এর বেলায় তুমি নিজে পদ ও অবস্থান কামনা করো; তাহলে পদ ও অবস্থান লাভ করার জন্যে অন্যদের সাহায্য করো। তোমার মেধাকে অর্থে পরিণত করতে চাও, তাহলে অন্যদের তাদের মেধাকে অর্থে পরিণত করতে সাহায্য করো-আসলে, কারও নিজস্ব অনুভূতিকে নির্দেশক হিসাবে গ্রহণের ক্ষমতা—রেন-এর পথে ঠিক এই ধরনের জিনিসই অবস্থান করে। ৩০
অবিরাম এরকম আচরণ, সাধারণ মানুষের মাঝে কল্যাণ বিলোনো ও নিজস্ব ব্যক্তিগত সুবিধার চেয়ে বরং গোটা রাজ্যের মঙ্গল কামনাকারী যেকোনও শাসক ইয়াও ও শানের স্তরের সাধুতে পরিণত হবেন। ৩১
সুতরাং কনফুসিয়াস ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি ও শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন আঁকড়ে থাকা নিরীহ রক্ষণশীল ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বিপ্লবাত্মক ছিল। প্রথাগত লি- র এক নতুন ব্যাখ্যা যুগিয়েছিলেন তিনি। অভিজাতদের মর্যাদার বাড়ানোর জন্যে নয়, বরং আত্ম-বিস্মৃতির চর্চাকে অভ্যাসে পরিণত করে তাকে বদলে দেওয়ার জন্যে এগুলো প্রণীত হয়েছিল। আচার-অনুষ্ঠান থেকে অহমবাদকে বিচ্ছিন্ন করে গভীর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সম্ভাবনা বের করে এনেছিলেন কনফুসিয়াস। দাসত্বমূলক সমরূপতাকে উৎসাহিত করেননি। প্রতিটি পরিস্থিতি অনন্য এবং অবশ্যই তাকে স্বাধীনভাবে বিচার করার কল্পনা ও বুদ্ধিমত্তার দাবি করেছে লি। এর আগে কেবল অভিজাত গোষ্ঠীই লি-র চর্চা করত। এখন কনফুসিয়াস জোর দিয়ে বলেছেন, যেকেউই আচার পালন করতে পারবে, এবং এমনকি ইয়ান হুইয়ের মতো সামান্য বংশ পরিচয়ের কেউও জুনযিতে পরিণত হতে পারবে।
অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্য চৈনিক দার্শনিকরা চীনের সমস্যার আরও বাস্তব সম্মত সমাধানের প্রস্তাব রাখবেন, কিন্তু সবসময় আইন ও শৃঙ্খলার চেয়ে বেশি কিছুর প্রতি লক্ষ্য স্থির করা কনফুসিয়াসের মতো উচ্চাভিলাষী ছিলেন না তাঁরা। মানবীয় মর্যাদা, মহত্ত্ব আর পবিত্রতা চেয়েছিলেন তিনি এবং জানতেন এর গুণাবলী আয়ত্ত করার জন্যে দৈনন্দিন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই কেবল সেটা লাভ করা সম্ভব। স্পর্ধিত পরিকল্পনা ছিল এটা। নিপীড়নের বদলে সাধারণ মানুষকে বর্ধিত মানবতার উপর নির্ভর করতে বলছিলেন কনফুসিয়াস। খুব অল্প সংখ্যক লোকই আসলে তাদের অহমবাদকে বিসর্জন দিতে তৈরি ছিল। কিন্তু যারা কনফুসিয়াসের পদ্ধতিকে বাস্তবে প্রয়োগের প্রয়াস পেয়েছে তাদের জীবন পাল্টে গেছে বলে আবিষ্কার করেছে তারা। গর্ব, অসন্তোষ ও অন্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের ইচ্ছার বিনাশ দাবি করত বলে রেন কঠিন ছিল। কিন্তু তাসত্ত্বেও, বিপরীতক্রমে রেন সহজ ছিল। ‘সত্যি কি রেন এত দূরের?’ প্রশ্ন করেছেন কনফুসিয়াস। ‘আমরা সত্যিই রেন-কে কামনা করলে, তাকে আমাদের একেবারে কাছে আবিষ্কার করতে পারব। কঠিনতমটির সম্পাদন শেষেই’—অর্থাৎ একজন ব্যক্তি লি-র দেওয়া শিক্ষা শেষ করার পর তার আগমন ঘটে। এর জন্যে অতিমানবীয় শক্তির চেয়ে প্রয়োজন ছিল অধ্যবসায়ের এবং সম্ভবত বাইসাইকেল চালানো শেখার মতো: একবার নৈপুণ্য আয়ত্ত করার পর তা অনায়াস হয়ে ওঠে। তবে সেটা আপনাকে ধরে রাখতে হয়। হয় আপনি অন্যদের সঙ্গে অবিরাম ভালো ব্যবহার করবেন-তারা যেই হোক-ঠিক যেন তাদের আপনার মতো একই মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে, কিংবা করবেন না। কিন্তু তা যদি করেন, তখন প্রায় বাস্তব নৈতিক শক্তি অর্জন করেন আপনি।
রেন-এর অনুসন্ধান আজীবনের সংগ্রাম ছিল; কেবল মৃত্যুতেই এর অবসান ঘটতে পারে।৫ পথের শেষে কি আছে তা নিয়ে তাঁর শিষ্যদের আঁচ-অনুমানে উৎসাহিত করেননি কনফুসিয়াস। খোদ এপথে চলাই দুৰ্জ্জেয় ও গতিশীল অভিজ্ঞতা ছিল। কনফুসিয়াসের প্রিয় শিষ্য ইয়ান হুইরেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘গভীর শ্বাস ফেলে’ সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন:
যতই উপরে তাকাই ততই তা আরও উঠে যায়। যতই গভীরে তাকাই, ততই তা কঠিন হয়ে ওঠে। একে সামনে দেখতে পাই, কিন্তু সহসা পেছনে চলে যায়। পায়ে পায়ে গুরু নৈপুণ্যের সঙ্গে একজনকে প্রলুব্ধ করেন। তিনি আমাকে সংস্কৃতি দিয়ে প্রসারিত করেছেন, আচার দিয়ে সীমিত করেছেন। আমি থামতে চাইলেও পারিনি। ঠিক যখন মনে হয়েছে আমার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে, একটা কিছু সাড়া দিয়ে উঠেছে, তীক্ষ্ণ ও স্পষ্ট হয়ে হাজির হয়েছে আমার সামনে। কিন্তু আমি তার নাগাল পেতে চাইলেও তার কাছে পৌছানোর কোনও উপায় খুঁজে পাইনি।
রেন আপনি ‘পেয়েছেন’ এমন কিছু নয়, বরং আপনি বিলিয়ে দেন এমন কিছু। রেন ছিল জীবন ধারণের কষ্টকর অথচ উদ্দীপক পদ্ধতি। খোদ এটাই আপনার কাঙ্ক্ষিত দুয়ে। একটি করুণাময়, সহমর্মিতার জীবন যাপন আপনাকে আপনার উর্ধ্বে নিয়ে যায়, ভিন্ন এক মাত্রার সঙ্গে পরিচিত করায়। আচার ও রেন-এর অব্যাহত অনুশীলন ইয়ান হুইকে ‘তীক্ষ্ণ ও স্পষ্টভাবে আমার সামনে হাজির হওয়া’ ভেতর থেকে উঠে আসা কিন্তু তারপরেও সঙ্গী হওয়ার মতো উপস্থিতি, সর্বব্যাপীতা ও দুর্জ্ঞেয়তা উভয়ই দিয়েছিল।
ইয়ান হুই মারা যাওয়ার পর নিয়মমাফিক সংযম ছাড়াই প্রবলভাবে কেঁদেছিলেন কনফুসিয়াস। ‘হায়, স্বর্গ আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছে, স্বৰ্গ আমাকে বিচ্ছিন্ন করেছে!৩৭ কোনও মানুষের মৃত্যু এমন শোককে যৌক্তিক করতে পারলে সেটা ছিল ইয়ান হুই-এর মৃত্যু। তিনি সবসময় বলেছেন যে, ইয়ান হুই তাঁর নিজের থেকেও পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। কনফুসিয়াসের ছেলে একই বছর মারা যান। এবং তিন বছর পরে মারা যান তাঁর প্রবীনতম শিষ্য যিলু। কনফুসিয়াস নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। ‘ফিনিক্স আসেনি,’ বিলাপ করেছেন তিনি। নদী কোনও পথ দেখায়নি। আমার সব শেষ হয়ে গেছে! এমনকি তাঁর আদর্শ ঝোউ-এর ডিউকও ঘুমে আর তাঁর কাছে দেখা দেননি ৪° ৪৭৯ সালে চুয়াত্তর বছর বয়সে মারা যান তিনি। তাঁর আত্ম-বিলুপ্তির উপায়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বলে ভেবেছিলেন, কিন্তু তারপরেও চীনা আধ্যাত্মিকতায় অনেপনীয় প্রভাব রেখে গেছেন। এমনকি প্রবলভাবে তাঁর শিক্ষার বিরোধিতাকারী অ্যাক্সিয়াল যুগের দার্শনিকরাও তাঁর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা অসম্ভব বলে আবিষ্কার করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল। ৫৫৯ সালে বর্তমানে দক্ষিণ ইরানের পারস্যের সিংহাসনে বসেছিলেন সাইরাস। দশ বছর পরে মিদিয়া দখল করেন তিনি; ৫৪৭ সালে লিবিয়া ও এশিয়া মাইনরের আইওনিয় উপকূলের গ্রিক পোলিসগুলো অধিকার করে নেন; এবং সবশেষে ৫৩৯ সালে বাবিলোনিয়ায় আক্রমণ চালান এবং বিজিত জনগণের কাছে মুক্তিদায়ী বীর হিসাবে অভ্যর্থনা পান। পৃথিবীর প্রত্যক্ষ করা বৃহত্তম সাম্রাজ্যের শাসকে পরিণত হয়েছিলেন সাইরাস। সম্ভবত নিয়মিত আচার পালনকারী জরোথ্রস্টিয় ছিলেন তিনি, কিন্তু প্রজাদের উপর নিজের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেননি। মিশরে সাইরাসকে আমান রে-র দাস বলে ডাকা হতো; বাবিলনে তিনি ছিলেন মারদুকের ছেলে; আর জুদিয় পয়গম্বর তাঁর নাম দিয়েছিলেন মেসিয়া, ইয়াহওয়েহর মনোনীত রাজা ৪১ আমরা এই পয়গম্বরের নাম জানি না। ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাবিলোনিয়ায় সক্রিয় ছিলেন তিনি, তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ইসায়ার মতো একই লিপিতে সংরক্ষিত হওয়ায় সাধারণভাবে দ্বিতীয় ইসায়া নামে পরিচিত। ক্রমশ বেড়ে ওঠা উত্তেজনার সঙ্গে সাইরাসের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি, নির্বাসিত জাতির দুর্ভোগের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করেছেন। ইয়াহওয়েহ সাইরাসকে তাঁর দাস হওয়ার আহবান জানিয়েছেন, তাঁর সাম্রাজ্যবাদী মিশন পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দেবে।৪২ সকল দেশান্তরীকে প্রত্যাবসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, সুতরাং জেরুসালেম পুনর্নির্মিত হবে, দেশ পুনরুজ্জীবিত হবে। নতুন অভিযাত্রার সূচনা ঘটরে: ইহুদি নির্বাসিতরা আরও একবার বুনো এলাকা পেরিয়ে প্রতিশ্রুত ভূমিতে পাড়ি দেবে।
ইয়েকিয়েলের যন্ত্রণাকাতর, কষ্টকর দিব্যদর্শনের বদলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন দ্বিতীয় ইসায়া, গীতধর্মী স্তোত্রগীত জাতীয় কবিতায় তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। জাদুকরী ঘটনা ও পরিবর্তিত সৃষ্টির কথা বলেছেন। প্রাচীন পুরাণকে
তাচ্ছিল্য দেখানো ডিউটেরেনোমিস্টদের বিপরীতে পেন্টাটিওকের সঙ্গে সামান্য সম্পর্কযুক্ত প্রাচীন পুরাণের উপর নির্ভর করেছেন দ্বিতীয় ইসায়া। P-র সাধারণ সৃষ্টি কাহিনীর বদলে স্বর্গীয় যোদ্ধা ইয়াহওয়েহর আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সাগর দেবতাকে হত্যার প্রাচীন কাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন তিনি, সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে সযত্নে P-র বাদ দেওয়া সহিংসতাকে আবার স্থাপন করেছেন। সানন্দে ঘোষণা করেছেন, ইয়াহওয়েহ ইসরায়েলের ঐতিহাসিক শত্রুদের পরাস্ত করার ভেতর দিয়ে আবার তাঁর স্বর্গীয় বিজয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছেন।
কিন্তু নিজেকে ইয়াহওয়েহর ভৃত্য দাবিকারী একজন বিষণ্ন মানুষকে নিয়ে রচিত চারটি অসাধারণ কবিতায় এইসব অতিরঞ্জিত ভবিষ্যদ্বাণী বিঘ্নিত হয়েছে।” এই ভৃত্য কে তার কোনও ধারণা আমাদের নেই। তিনি কি তবে জুদাহর নির্বাসিত রাজা ছিলেন? নাকি নির্বাসিতদের গোটা সম্প্রদায়কে তুলে ধরেছেন তিনি? বহু পণ্ডিত এই কবিতাগুলো দ্বিতীয় ইসায়ার রচনা নয় বলে বিশ্বাস করেন, কেউ কেউ এমনও মত প্রকাশ করেছেন যে, খোদ পয়গম্বরই এই ভৃত্য, যার অনলবর্ষী ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো বাবিলোনিয় কর্তৃপক্ষকে অসন্তুষ্ট করে থাকবে। অন্যরা ভৃত্যকে অ্যাক্সিয়াল যুগের রীতির সঙ্গে গভীরভাবে খাপ খায় এমন ধর্মীয় আদর্শ তুলে ধরা আদি আদর্শ নির্বাসিত নায়ক হিসাবে বিবেচনা করেছেন। কোনও কোনও নির্বাসিতের কাছে স্বর্গীয় যোদ্ধা নন বরং দুর্দশাগ্রস্ত ভৃত্যই ছিলেন আদর্শ।
প্রথম কবিতায় ভৃত্যটি বিশেষ মিশনের জন্যে ইয়াহওয়েহর তাঁকে মনোনীত করার ঘোষণা করছেন। ঈশ্বরের নিজস্ব প্রাণে পরিপূর্ণ হওয়ায় গোটা বিশ্বে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার গুরু দায়িত্ব চাপানো হয়েছে তাঁর উপর। কিন্তু অস্ত্রের শক্তিতে এর বাস্তবায়ন ঘটাবেন না তিনি। কোনও যুদ্ধ বা আগ্রাসী আত্ম- প্রতিষ্ঠার কোনও ঘটনা ঘটবে না। ভৃত্যটি অহিংস, করুণাময় অভিযান পরিচালনা করবেন:
তিনি চিৎকার করিবেন না, উচ্চ শব্দ করিবেন না,
পথে আপন রব শুনাইবেন না।
তিনি থেলা নল ভাঙ্গিবেন না;
সধুম শলিতা নিৰ্ব্বাণ করিবেন না। ৪৫
অনেক সময় অসহায় বোধ করেছেন ভৃত্য, কিন্তু প্রভু ইয়াহওয়েহ সবসময় তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, যাতে তিনি দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারেন, চকমকি পাথরের মতো করে তুলতে পারেন মুখের চেহারা এবং অপমান ও অসম্মানের মুখে স্পর্শাতীত থাকতে পারেন। কখনওই সহিংস প্রতিশোধ নেননি তিনি, বরং দৃঢ়ভাবে অপর গাল পেতে দিয়েছেন।
প্রভু সদাপ্রভু আমার কর্ণ খুলিয়াছেন,
এবং আমি বিরুদ্ধাচারী হই নাই, পারম্মুখ হই নাই।
আমি প্রহারকদের প্রতি আপন পৃষ্ঠ,
যাহারা দাড়ি উপড়াইয়াছে,
তাহাদের প্রতি আপন গাল পাতিয়া দিলাম,
অপমান ও থুথু হইতে আপন মুখ আচ্ছাদন করিলাম না। ৪৬
ঈশ্বর দাসের শত্রুদের বিচার করবেন ও শাস্তি দেবেন, তারা স্রেফ গলে যাবে, মথ আক্রান্ত পোশাকের মতোই ক্ষয় হয়ে যাবে।
চতুর্থ কবিতা এই চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে চোখ ফিরিয়েছিল। এখন এই দাস কেবলই বিরক্তি উৎপাদন করেন; ‘মানুষের ঘৃণা ও অপমানের শিকার’ তিনি; এতটাই বিকৃত যে মানুষ বলে চেনাই দায়। ভয়ে ও বিতৃষ্ণায় চোখ ফিরিয়ে নেয় লোকে। কিন্তু ইয়াহওয়েহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শেষপর্যন্ত ‘উচ্চ ও উন্নত ও মহামহিম হইবেন’ তিনি। যারা তাঁর অবনতি দেখেছিল বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে যাবে তারা, কিন্তু শেষপর্যন্ত বুঝতে পারবে, তাদের জন্যেই কষ্ট সয়েছেন তিনি। ‘আমাদের যাতনা সকল তিনিই তুলিয়া লইয়াছেন…আমাদের শাস্তিজনক শাস্তি তাহার উপরে বর্ত্তিল, আমাদের অপরাধের নিমিত্তে চূর্ণ হইলেন। বেদনাকে সাহস ও প্রশান্তভাবে মেনে নেওয়ার ভেতর দিয়ে তাদের জন্যে শান্তি ও উপশম নিয়ে এসেছেন তিনি।৪৭ ভোগান্তির লক্ষণীয় ভাষ্য ছিল এটা। বিজয়ের মুহূর্তে দাস ইসরায়েলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন বেদনা হচ্ছে এক চিরস্থায়ী বাস্তবতা, কিন্তু তাঁর কোনোসিস পরম পুলক ও একতাসিস-এর দিকে চালিত করেছে। তাঁর ঔদার্য সর্বজনীন, তাঁর একান্ত বলয় থেকে গোটা বিশ্বকে অন্তর্ভুক্ত করতে-দূরের দ্বীপ আর প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে-প্রসারিত হয়েছে। ‘যাকোবের সকল বংশকে ওঠানোই যথেষ্ট নয়, তাঁকে বলেছেন ইয়াহওয়েহ; ‘তাঁহাকে গণের দীপ্তি স্বরূপ করিব, যেন তুমি পৃথিবীর সীমা পর্যন্ত আমার পরিত্রাণ স্বরূপ হও।৪৮
তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয় ইসায়ার ভবিষ্যদ্বাণীতে কোনওভাবে ইসরায়েলের বিরোধিতাকারী জাতিদের জন্যে কঠিন বার্তা ছিল। তারা ‘অবস্ত্রবৎ ও অকিঞ্চিত্বৎ হইবে’, বাতাসে ভূসীর মতো উড়ে যাবে। এমনকি যেসব বিদেশী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে সাহায্য করেছে তাদেরও ইসরায়েলিদের সামনে প্রণত হতে হবে, তাদের পায়ের কাছে ধূলি লেহন করতে হবে।” এই অনুচ্ছেদগুলোয় ইসরায়েলের ভূমিকা মানবজাতির বিনয়ী দাসের নয়, বরং যোদ্ধা দেবতা ইয়াহওয়েহর বিপুল শক্তি প্রদর্শন। এই টেক্সটে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় এবং সম্ভবত এই পর্যায়ে নির্বাসিত সম্প্রদায়ের ভেতর দুটি ভিন্ন মতাদর্শ ছিল। দাস অহিংস ও আত্ম-বিসর্জনের মাধ্যমে জয়ী হয়েছেন; ইসরায়েলের দুর্ভোগকে প্রায়শ্চিত্তমূলক মনে করেছেন তিনি। কিন্তু অন্য নির্বাসিতরা অন্যকে পদানত করার ভিত্তিতে এক নতুন ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা করেছে। একটি রীতি অ্যাক্সিয়াল যুগের সঙ্গে গভীরভাবে মানানসই; অন্যটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে ব্যাকুল। এই টানাপোড়েন ইসরায়েলের ভেতরে অব্যাহত থাকবে।
দ্বিতীয় ইসায়া বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর কালের ঐতিহাসিক বিপর্যয় ইসরায়েল ও বিদেশী জাতিগুলোকে ‘আমিই সদাপ্রভু জানিতে পারায় সক্ষম করে তুলবে। বারবার এই শব্দগুলো দেখা দিয়েছে। স্বর্গীয় শক্তির এই নতুন প্রয়োগ সবাইকে ইয়াহওয়েহ কে ছিলেন এবং তিনি কি করতে পারেন সেটা বুঝিয়ে দেবে। তাঁর জাতিকে সাহায্য করার লক্ষ্যে উজ্জীবিত হয়ে সাইরাসের ব্রতকে অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি, এক আন্তর্জাতিক, বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন এবং বাবিলনের বিশাল সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। ইসরায়েল ঘরে ফিরে যাওয়ার পর বুনো প্রান্তরকে হ্রদে পরিণত করবেন ইয়াহওয়েহ, দেশে ফেরার পথে তাঁর জাতিতে আনন্দ যোগাতে সেখানে সিডার, বাবলা, মুর্দ আর জলপাই গাছ রোপণ করবেন। আর কোনও উপাস্য কি এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবেন? না, গোয়িমদের দেবতাদের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখিয়ে ইয়াহওয়েহ বলেছেন, ‘তোমরা অবস্তু ও তোমাদের কার্য্য অকিঞ্চন।’ সুস্থ মস্তিষ্কে কেউ তাদের উপাসনা করবে না।৫১ অন্য উপাস্যদের নিশ্চিহ্ন করে একমাত্র ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন ইয়াহওয়েহ, তাঁর সজীবতা বাবিলনের উপাস্যদের প্রাণহীন, জড় প্রতিমাগুলোর তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ৫২ ‘আমিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইয়াহওয়েহ, ‘ সগর্বে ঘোষণা করেছেন তিনি। ‘আমার পার্শ্বে আর কোনও উপাস্য নাহি।৫৩
বাইবেলে এটাই প্রথম দ্ব্যর্থহীন একেশ্বরবাদী উচ্চারণ ছিল, একজনমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস। মতবাদটিকে প্রায়শঃই ইহুদি অ্যাক্সিয়াল যুগের মহান বিজয় হিসাবে দেখা হয়, কিন্তু যেভাবে গ্রন্থনা করা হয়েছে তাতে করে একে কিছু মৌল অ্যাক্সিয়াল নীতিমালা থেকে পিছু হটা বলে মনে হয়। সর্বজনীন শান্তি ও সহমর্মিতার একটা সময়ের আকাঙ্ক্ষা করার বদলে দ্বিতীয় ইসায়ার আগ্রাসী উপাস্য অ্যাক্সিয়াল-পূর্ব স্বর্গীয় যোদ্ধার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন:
সদাপ্রভু বীরের ন্যায় যাত্রা করিবেন,
যোদ্ধার ন্যায় উদ্যোগ উত্তেজিত করিবেন;
তিনি জয়ধ্বনি করিবেন,
হাঁ, মহানাদ করিবেন;
তিনি শত্রুদের বিপরীতে পরাক্রম দেখাইবেন। ৫৪
আত্ম-শূন্যকারী দাসের বিপরীতে এই ঈশ্বর নিজেকে জাহির করা থেকে বিরত থাকতে পারেন না: ‘আমি, আমিই ইয়াহওয়েহ!” দাস যেখানে ‘আগাছা পর্যন্ত দুমড়াইয়া যাইতে অস্বীকার করিয়াছেন’, ৫৫ সেখানে এই আগ্রাসী উপাস্য গোয়িমদের শেকল বাঁধা অবস্থায় ইসরায়েলিদের পেছনে সার বেঁধে যেতে দেখার তর সইতে পারেননি। অ্যাক্সিয়াল যুগের আরও বহু সাধুর মতো সহিংসতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার বদলে দ্বিতীয় ইসায়া পবিত্র সমর্থন যুগিয়েছেন একে
পার্থিব নগর জেরুসালেমের প্রতি পয়গম্বরের গুরুত্ব আরোপও প্রাচীন অনুন্নত, ধর্মতাত্ত্বিক দর্শনের দিকে উল্টো ঘড়ি ঘোরানোর মতো মনে হয়েছে। ভারত ও চীনে প্রথা ক্রমাগত অন্তস্থঃ হচ্ছিল এবং ইসরায়েলেও ইযেকিয়েলের পবিত্র শহরের মান্দালা স্বর্গীয় বলয়ে একটি অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিক ঊর্ধ্বারোহণকে তুলে ধরেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ইসায়া’র আশার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পার্থিব যায়ন। ইয়াহওয়েহ সেখানে অলৌকিক কাণ্ড ঘটাবেন, এখানকার বিরান ধ্বংসাবশেষকে পার্থিব স্বর্গে পরিণত করবেন। নগর ছেড়ে যাওয়ার সময় ইযেকিয়েলের প্রত্যক্ষ করা ইয়াহওয়েহর ‘প্রতাপ’ যায়ন পর্বতে ফিরে আসবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে-’আর সমস্ত মর্ত্য একসঙ্গে দেখিতে পাইবে।৫৬ নাটকীয় কিছু আশা করছিলেন দ্বিতীয় ইসায়া। নির্বাসনের আগে ‘প্রতাপ’ মন্দিরের আচারে আহূত ও পুনঃস্থাপিত হতো, কিন্তু পুনরুজ্জীবিত জেরুসালেমে (যার দেয়াল ও বুরুজগুলো মূল্যবান রত্নে সাজানো) স্বর্গীয় সত্তা আরও বেশি শরীরী হয়ে উঠবেন এবং ইয়াহওয়েহ তাঁর জাতির সঙ্গে এমনি প্রগামক্ষ্য অপরিবর্তনীয়ভাবে মিলিত হওয়ায় চিরকালের জন্যে নিরাপদ হয়ে যাবে তারা। আরও কোনও জাতি আর তাদের আক্রমণ করার সাহস পাবে না:
তুমি উপদ্রব হইতে দূরে থাকিবে,
বস্তুত তুমি ভীত হইবে না;
এবং ত্রাস হইতে দূরে থাকিবে,
তাহা তোমার নিকটে আসিবে না।
যেকোনও অস্ত্র তোমার বিপরীতে গঠিত হয়,
তাহা সার্থক হইবে না। ৫৭
দ্বিতীয় ইসায়ার প্রতিশ্রুতিগুলো অস্বস্তিকরভাবে জেরুসালেম কোনওদিনই বাবিলোনিয়দের কাছে পরাস্ত হবে না বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা ‘মিথ্যা পয়গম্বরদের’ কাছাকাছি। এইসব সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী না ফললে কি ঘটবে?
প্রথমে সবকিছুই দারুণ সুন্দরভাবে পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছিল। বাবিলন অধিকার করার অল্প পরে ৫৩৯ সালের শরতে একটি ফরমান জারি করেন সাইরাস, প্রজা সাধারণের দেবতারা, যাদের প্রতিমা বাবিলোনিয়ায় আনিয়েছিলেন নেবুচাদনেযার, সেগুলোকে আবার তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, নতুন করে মন্দির তৈরি করতে হবে, এবং আবার তাদের ধর্মীয় আসবাবপত্র ও হাড়িকুড়ি স্থাপন করতে হবে। সাইরাসের নীতি সহিষ্ণু তো বটেই, বিচক্ষণও ছিল। অসিরিয় ও বাবিলোনিয় সাম্রাজাবাদকে বৈশিষ্ট্যায়িত করা সাশ্রয়মুলক ও ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মসূচির চেয়ে দক্ষ ছিল এটা। সাইরাস কেবল তাঁর প্রজাদের কৃতজ্ঞতাই লাভ করবেন না, বরং তাদের দেবতাদেরও আশীর্বাদ অর্জন করবেন।
সাইরাসের অভিষেকের কয়েক মাস বাদে ইহুদি নির্বাসিতদের একটি দল জেরুসালেমের উদ্দেশে পথে নামে, সঙ্গে ছিল মন্দির থেকে নেবুচাদনেযারের বাজেয়াপ্ত করা সোনা ও রূপার পাত্র। বাইবেল আমাদের বলছে, ৪২,৩৬০ জন জুদিয় তাদের দাস ও দুইশো মন্দির-গায়কসহ দেশের পথে যাত্রা করেছিল, কিন্তু বেশির ভাগ নির্বাসিতই বাবিলনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে আসলে প্রত্যাবর্তনকারীদের প্রথম দলটি সম্ভবত আরও ছোট ছিল। প্রত্যাবর্তনকারী দলের নেতা ছিলেন জুদাহর নাসি (‘অনুগত রাজা’) শেষবাযার। আমরা তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না। ডেভিডিয় রাজবংশের সদস্য হয়ে থাকতে পারেন তিনি, যদি তাই হয়ে থাকে, তাঁর আনুগত্যের চিহ্ন হিসাবে সাইরাসের হাতে চুমু খাওয়ার কথা, এবং পারস্য সরকারের সরকারী প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। ইউফ্রেতিসের পশ্চিমের পুরো এলাকা অধিকার করে রাখা পারস্য সাম্রাজ্যের পঞ্চম প্রদেশের (সাত্রাপি) অংশে পরিণত হয়েছিল জুদাহ।
বাইবেলিয় বিবরণ বিভ্রান্তিকর ও অসমাপ্ত হওয়ায় জুদাহর এই প্রাথমিক বছরগুলো সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। শেষবাযার নথি থেকে হারিয়ে গেছেন, তাঁর ভাগ্যে কি ঘটেছে জানা নেই আমাদের। তৃতীয় পারস্য সম্রাট দারিউসের (৫২১-৪৮৬) শাসনের দ্বিতীয় বছর, ৫২০ সালের আগে আর প্রত্যাবসিত সম্প্রদায় গোলাহ সম্পর্কে কিছু শুনতে পাই না আমরা। এই সময় জেরুসালেমে জুদিয় সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন রাজা জেহোয়াচিনের পৌত্র যেরুব্বাবেল, প্রধান পুরুত জোশুয়ার সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করছিলেন তিনি। মেয়াদ শেষে তিনিও রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। জুদাহর পঞ্চাশ বছরের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কিত কোনও বিবরণ নেই আমাদের কাছে।
দ্বিতীয় ইসায়ার ভবিষ্যদ্বাণীর উত্তেজনা নিয়ে গোলাহ জুদাহয় এসে থাকলে, নিশ্চয়ই নতুন আবাস দেখামাত্রই খুব দ্রুতই ধূলোর পৃথিবীতে নেমে এসেছিল। ওদের বেশিরভাগেই জন্ম হয়েছিল নির্বাসনে; বাবিলোনিয়ার আধুনিকতার পর তাদের চোখে জুদাহকে নিশ্চয়ই বিষণ্ন, অচেনা ও বিরান ঠেকে থাকবে। বাবিলোনিয় জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ায় নিশ্চয়ই নিজে দেশে নিজেদের বিদেশী ভেবেছে তারা। আগন্তুকে ভর্তি ছিল দেশটি, যারা তাদের মতোই বাবিলোনিয় যুদ্ধের পর জাতীয় মর্যাদা হারিয়েছিল; তারা দূরে থাকার সময় উপকূলীয় সমভূমি জ্যেরিল উপত্যকা ও উচ্চ ভূমিতে ফিলিস্তিন, মোয়াবিয়, আম্মোনিয়, এদোমিয়, আরব ও ফিনিশিয়রা বসতি গড়ে তুলেছিল। প্রত্যাবসনকারীরা তাদের আম হা- আরেত্য, ‘দেশের জাতি’ ডাকত। সত্তর বছরের অনুপস্থিতির পর সদ্য প্রত্যাবর্তনকারীরাও সতীর্থ ইসরায়েলিদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। উত্তরে প্রাচীন রাজ্যের বর্তমান রাজধানী হিসাবে পরিচিত সামারিনা থেকে জুদাহ শাসন করা হতো, প্রত্যাবসিত নির্বাসিতরা পৌছানোর পর ইসরায়েলি গভর্নরের কাছে তাদের চিঠি হাজির করতে হতো ৬০ নির্বাসনে দেশান্তরীরা বেশ চরমভাবে তাদের ধর্ম পাল্টে ফেলেছিল। যারা কখনওই জুদাহ ত্যাগ করেনি, যারা ইয়াহওয়েহর পাশাপাশি অন্য দেবতাদের পুজা করেছে এবং এখন বর্বরোচিত ও অচেনা মনে হওয়া অনুশীলন মেনে চলেছে, সেই ইয়াহওয়েহবাদীদের সঙ্গে কিভাবে খাপ খাবে তারা?
নির্মাণ প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়; গোলাহরা ফিরে আসার বিশ বছর পরেও ইয়াহওয়েহর কোনও মন্দির ছিল না। দ্বিতীয় ইসায়ার পূর্বাভাস মোতাবেক পুনর্বাসন তত সহজ প্রমাণিত হচ্ছিল না। সাবেক নির্বাসিতদের নির্মাণের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, বসবাসের কোনও জায়গাও ছিল না তাদের, ফলে বেশিরভাগই নতুন আবাস পাওয়ার আগপর্যন্ত মন্দির নির্মাণ স্থগিত রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। কিন্তু ৫২০ সালে যেরুবাব্বেলের আগমনের অল্প কয়েক মাস পরে এক নতুন পয়গম্বর হাগ্গাই প্রত্যাবসিতদের অগ্রাধিকারে ভুল থাকার কথা জানালেন। তারা নিজেদের জন্যে বাড়ি নির্মাণ করেছে, কিন্তু ধ্বংসাবশেষে ফেলে রেখেছে ইয়াহওয়েহকে, এটাই আসলে খারাপ ফসল আর অর্থনীতির বাজে অবস্থার কারণ। ৬১ জুৎসইভাবে পবিত্র হয়ে আবার নির্মাণ কাজে ফিরে যায় গোলাহ।
৫২০ সালের শরৎ কাল নাগাদ ভিত্তি স্থাপনের কাজ শেষ হয়ে যায়; ঐতিহ্যবাহী শরৎ উৎসবের তারিখে পুনঃনিবেদনের আনুষ্ঠানে সমবেত হয় গোলাহ। স্তোত্রগীত গেয়ে আর করতাল বাজিয়ে পবিত্র জায়গায় এগিয়ে যান
পুরোহিতরা। কিন্তু তাঁদের অল্প কয়েকজন সলোমনের দৃষ্টিনন্দন মন্দিরের কথা মনে রাখার মতো যথেষ্ট বয়স্ক ছিলেন; অন্যদের সম্ভবত অবাস্তব প্রত্যাশা ছিল। দ্বিতীয় মন্দিরের সাধারণ জায়গা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। ৬২ তাদের মনোবল চাঙা করে তোলার চেষ্টা করেন হাগ্গাই। গোলাহর কাছে দ্বিতীয় মন্দিরটি প্রথমটির চেয়ে বৃহৎ হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। অচিরেই যায়ন পাহাড় থেকে গোটা বিশ্ব শাসন করবেন ইয়াহওয়েহ। একমত প্রকাশ করেন হাগাইয়ের সহকর্মী যেকারিয়া। সকল নির্বাসিত ঘরে ফিরে আসার পর ইয়াহওয়েহর ‘প্রতাপ’ ফিরে আসার ভবিষ্যদ্বাণী করেন তিনি। বিদেশীরাও এমনকি জেরুসালেমে ভিড় জমাবে। সকল জাতির লোকেরা ‘এক এক যিহুদী পুরুষের বস্ত্রের অঞ্চল ধরিয়া এই কথা কহিবে, আমরা তোমাদের সহিত যাইব, কেননা আমরা শুনিলাম, ঈশ্বর তোমাদের সহবর্ত্তী।৬৩ হান্নাই ও যেকারিয়া উভয়ই ইতিহাসের এক বাঁকে এসে হাজির হয়েছেন বলে বিশ্বাস করেছিলেন, কিন্তু দ্বিতীয় ইসায়ার বর্জনবাদী দর্শন বেছে নেননি তাঁরা। ইহুদিরা শান্তিপূর্ণভাবে গোয়িমদের মন্দিরের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে কল্পনা করেছেন যেকারিয়া। তিনি চেয়েছিলেন জেরুসালেম যেন উন্মুক্ত নগরী হয়। বৃহৎ সংখ্যক মানুষ ও পশু এখানে বাস করতে আসবে বলে এর কোনও প্রাচীর থাকতে পারবে না। হান্নাই বা যেকারিয়ার কেউই সামেরিনা ও পুরোনো উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের প্রতি কোনও রকম বৈরিতা দেখাননি।৬৫
সম্ভবত দ্বিতীয় মন্দির-কালে লেখা ক্রনিকলসের দুটি পুস্তকে এই অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা স্পষ্ট।৬৬ এই পুরুহিত সম্প্রদায়ের রচয়িতারা প্রাথমিক পুনর্বাসন কালের বিভিন্ন সমস্যা মেটানোর লক্ষ্যে ডিউটেরোনমিস্টদের ইতিহাসকে পরিমার্জন করেছেন। প্রথমত, মন্দিরের কেন্দ্রিকতার উপর জোর দিয়েছেন তাঁরা, ডেভিডিয় রাজবংশকে কেবল মন্দির ও এর প্রথা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ঈশ্বরের ব্যবহৃত উপায় হিসাবে বিবেচনা করেছেন। দ্বিতীয়ত, মন্দির সবসময় কেবল জুদাহবাসীদের নয়, বরং ইসরায়েলের সকল গোত্রের উপাসনালয় ছিল বলে জোর দিয়েছেন তাঁরা। ক্রনিকলস রচয়িতা উত্তরের বিরুদ্ধে ডিউটেরোনমিস্টদের উক্তিগুলো বাদ দিয়ে গেছেন এবং ডেভিডিয় যুক্তরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছেন। হেযেকিয়ার সংস্কারকে দারুণ প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি, এবং দান থেকে বীরশেবা পর্যন্ত সকল গোষ্ঠীকে জেরুসালেমে পাসওভার উৎসব উদযাপন করার নিমন্ত্রণ করছেন বলে কল্পনা করেছেন।[৬৭] ৭২২ সালের বিপর্যয়ের পর উত্তরের রাজ্যকে শাপশাপান্ত করে কোনও উপসংহার নেই এখানে, এলাকায় অসিরিয়দের বিদেশীদের আমদানি করার কথাও নেই। উত্তরের গোত্রগুলোকে বা যারা নির্বাসনে গেছে তাদের একঘরে করতে চাননি লিপিকার। ইয়াহওয়েহর জাতিকে তাদের স্যাঙ্কচুয়ারির চারপাশে সমবেত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সম্ভবত ৫২০ সালে দ্বিতীয় মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তরের পবিত্রকরণের ভেতর দিয়ে ক্রনিকলসের প্রথম ভাষ্য শেষ হয়েছে। এটা ঠিক, স্বীকার গেছেন লিপিকার, প্রবীণ পুরোহিতদের কেউ কেউ প্রাচীন মন্দিরের মহিমার কথা মনে করে জোরে কেঁদেছেন। কিন্তু অন্যরা আনন্দে কণ্ঠস্বর চড়িয়েছেন, ‘আর তখন লোকেরা আনন্দ জন্য জয়ধ্বনি শব্দ ও জনতার রোদনের শব্দ বিশেষ করিয়া নিশ্চয় করিতে পারিল না, যেহেতু লোকেরা এরূপ উচ্চৈঃস্বরে জয়ধ্বনি করিল যে, তাহার শব্দ দূর হইতে শুনা গেল এই জটিল মুহূর্তে বেদনা ও আনন্দ ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল। হ্যাঁ, অতীতের ট্র্যাজিডির কারণে দুঃখ ছিল, কিন্তু সুখ আর প্রত্যাশাও ছিল। এক নতুন সূচনা ঘটেছিল, জেরুসালেমে নতুন করে মিলিত ইসরায়েলের লোকজনকে গোটা বিশ্বের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেওয়া সেই দাসের মতো মনে হয়েছে।
.
ইহুদিরা জেরুসালেমে মন্দিরের কাজ শেষ করার অল্প বাদেই ভিন্ন এক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথে পা বাড়িয়েছিল অ্যাথেন্স। প্রচলিত পথেই চলেছিল পেইসিস্ত্রিদের স্বৈরাচার, এখন সরকারে বৃহত্তর অংশীদারীর জন্যে অধীর হয়ে উঠেছিল অ্যাথেন্সবাসীরা। অবশ্য, ৫১০ সালে স্পার্টা স্বৈরাচারী পেইসিস্ত্রিদকে উৎখাত করে স্পার্টার অনুগত পুতুল সরকার কায়েমের জন্যে অ্যাথেন্সে আক্রমণ চালায়, কিন্তু বিদ্রোহ করে বসে অ্যাথেন্সবাসীরা, সিকিওনের ছেলে ক্লেইসথিনেসের সহযোগিতায় স্পার্টানদের বহিষ্কার করে তারা, স্বৈরাচার বিলুপ্ত করে ও ক্লেইসথিনেসকে নগরের মেয়র হিসাবে বহাল করে।
ক্ষমতায় থাকার সময় (৫০৮-৫০৭) কিছু চমকপ্রদ সংস্কারের সূচনা করেন ক্লেইসথিনেস।৬৯ প্রাচীন গোত্রীয় ব্যবস্থাকে এমনভাবে নতুন করে সংগঠিত। করেছিলেন তিনি যার ফলে অভিজাত নেতাদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। সোলোনের কাউন্সিল অভ ফোর হান্ড্রেডও নতুন করে পরিকল্পনা করেন তিনি: এবার এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচশোয়, প্রতিটি নতুন গোত্র থেকে এদের মনোনীত করা হতো। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে প্রতি বছর সদস্য নির্বাচন করা হতো, জীবনে মাত্র দুবার নির্বাচিত হতে পারতেন তারা; তার মানে ছিল বেশির ভাগ কৃষক, শিল্পী, ও বণিক কখনও না কখনও পরিষদে কাজ করবে এবং এভাবে সম্পূর্ণ নতুন ও অর্থপূর্ণভাবে নাগরিক হয়ে উঠবে। অ্যাথেন্স তখনও উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে নির্বাচিত নয় জন ম্যাজিস্ট্র্যাটের হাতে শাসিত হচ্ছিল, উৎসব, সেনাবাহিনী, ও ন্যায় বিচার পরিচালনার জন্যে দায়বদ্ধ ছিলেন এরা; আগোরার কাছে অ্যারোপোগাসের পাথুরে টিলায় মিলিত হওয়া অভিজাত কাউন্সিল অভ এল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতেন। তখনও অভিজাত সম্প্রদায় নগর পরিচালনা করলেও কাউন্সিল অভ ফাইভ হান্ড্রেড ও পিপল’স অ্যাসেম্বলি ক্ষমতার যেকোনও ধরনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারত।
এটাই এপর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল, গ্রিক বিশ্বে এর চমকপ্রদ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল। অন্য পোলিসগুলোও একই ধরনের পরীক্ষা চালানোর প্রয়াস পেয়েছে; টাটকা শক্তির স্ফূরণ ঘটেছিল গোটা এলাকায়। নাগরিকদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন ক্লেইসথেনিস। কাউন্সিল অভ ফাইভ হান্ড্রেড মাসে তিনবার সভায় বসত বলে সাধারণ কৃষক ও বণিকরা ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের সময়ের দশ ভাগের এক ভাগ রাজনীতির পেছনে ব্যয় করবে বলে আশা করা হতো। অবশ্য উৎসাহ হারায়নি তারা, অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছুই জানতে পেরেছিল। পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিষদের বিতর্কে অংশ নিতে সক্ষম হয়ে ওঠে, অ্যাথেন্সের সবচেয়ে মেধাবী লোকের চিন্তাধারা অনুসরণ করতে পারছিল তারা। পরীক্ষা দেখিয়েছে যে, নাগরিকরা ঠিকমতো শিক্ষিত ও অনুপ্রাণিত হলে কোনও সরকারের নিষ্ঠুর শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়নি এবং প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌক্তিকভাবে সংস্কার করা সম্ভব হয়েছিল। অ্যাথেন্সবাসীরা এই নতুন ব্যবস্থার নাম দিয়েছিল ইসোনোমিয়া (সাম্য ব্যবস্থা’)। কৃষক, বণিকদের অভিজাতদের সঙ্গে অধিকতর সমান অবস্থানে থাকায় পোলিস এখন অনেক ভারসাম্যমূলক অবস্থায় ছিল।
সত্য আর মুষ্টিমেয় নির্বাচিত কিছু লোকের গোপন, নিগূঢ় বিষয় ছিল না। এখন রাজনৈতিক বলয়ের এন মেসোই (‘একেবারে কেন্দ্রে’)-তে পরিণত হয়েছিল সেটা, কিন্তু গ্রিকরা তখনও তাদের রাজনৈতিক জীবনকে পবিত্র এবং পোলিসকে মানবীয় কর্মকাণ্ডে ঐশ্বরিকতার পরিবর্ধন মনে করত। ক্রমবর্ধমানহারে লোগোসের শহর হয়ে উঠলেও অ্যাথেন্স তখনও নিবেদিতপ্রাণ ধার্মিক নগরী রয়ে গিয়েছিল। অধিক সংখ্যক লোক সরকারে অংশ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্সিলের ফ্লোরে আয়ত্ত করা বিতর্কের দক্ষতা জ্ঞানের অন্যান্য বলয়েও প্রয়োগ করতে শুরু করেছিল তারা। রাজনৈতিক বক্তৃতা ও আইনকানুন এখন কঠোর সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল এবং হোপলাইটদের ভাষণ লোগোস আগ্রাসী রয়ে গিয়েছিল। বিরোধ, অ্যান্টিথিসিস ও বিরোধী মতকে বাদ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছিল বিতর্ক।
এই সময়ের দর্শন রাজনৈতিক জীবনের সংঘাতবাদী দিকের পাশাপাশি গ্রিকদের স্থিরতা ও সামঞ্জস্যতার আকাঙ্ক্ষাও তুলে ধরেছে। বিশেষভাবে এফেসাসে রাজ পরিবারের একজন সদস্য হেরাক্লিতাসের (৫৪০-৪৮০) রচনায় এটা সুস্পষ্ট; তিনি সাধারণত তাঁর বিভিন্ন ধারণাকে অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা আর হেঁয়ালির মতো বাক্যে তুলে ধরতেন বলে ‘রিডলার’ নামে পরিচিত ছিলেন। ‘প্রকৃতি’ তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আড়াল করতে ভালোবাসে’; দেখে যেমন মনে হয় আসলে বস্তু তার উল্টো।” প্রথম সম্পর্কবাদী হেরাক্লিতাস যুক্তি দেখিয়েছেন সবকিছু পরিপ্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে: সাগরের জল মাছের জন্যে ভালো, কিন্তু মানুষের পক্ষে রীতিমতো ক্ষতিকর; শাস্তি হিসাবে দেওয়া হলে আঘাত কল্যাণকর, কিন্তু খুনীর হাতে তা অশুভ।” অস্থির, ব্যাকুল মানুষ হেরাক্লিতাস মহাবিশ্ব স্থিতিশীল মনে হলেও কিন্তু আসলে তা নিরন্তর পরিবর্তনশীল এবং বিভিন্ন সংঘাতময় উপাদানের রণক্ষেত্র বলে বিশ্বাস করতেন। “শীতল বস্তু উত্তপ্ত হয়, উত্তপ্ত বস্তু শীতল হয়, ভেজা জিনিস শুকোয়, শুকনো জিনিস ভেজে।৭৪ বিশেষ করে আগুনের ক্ষেত্রে বিমোহিত ছিলেন তিনি: অগ্নিশিখা কখনও স্থির থাকে না; আগুন ছাইতে রূপান্তরিত হয়, পানি পরিণত হয় বাষ্পে। প্রতিযোগি উপাদানগুলোর কোনও একটিকে প্রাধ্যান্য বিস্তার করতে না দিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখা স্বর্গীয় শক্তি ছিল আগুন-ঠিক যেভাবে কাউন্সিলে বিভিন্ন মতের বিরোধ পোলিসের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখে। কিন্তু মহাজাগতিক উত্তাল অবস্থার আড়ালে এক ধরনের ঐক্য আছে। স্ববিরোধী বলে মনে হওয়া পরিবর্তন ও স্থিতিশীলতা আসলে এক ও অভিন্ন; রাত ও দিন একই মুদ্রার অপর পিঠ; উপরে ওঠা আসলে নিচে নামাই, এবং বাইরে বেরুনোর পথ প্রবেশ পথ হিসাবেও ব্যবহৃত হতে পারে। আপনি আপনার ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের উপর নির্ভর করতে পারেন না, কিন্তু প্রকৃতির পরিচালনার নীতি লোগোস বুঝতে হলে আপনাকে আরও গভীরে দৃষ্টি দিতে হবে। মানুষের বেলায়ও তা খাটে। গ্রিকদের জন্যে নতুন কর্মকাণ্ড অন্তর্মুখীনতা আবিষ্কার করেছিলেন হেরাক্লিতাস। ‘নিজের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম,’ বলেছেন তিনি।৬ স্বপ্ন, আবেগ ও মানুষের ব্যক্তিগত গুণাবলী পর্যালোচনা করে আপনি মানবীয় প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্যই জানতে পারেন, কিন্তু তা সবসময় হেঁয়ালি রয়ে যাবে: ‘আপনি সবকটা মেরু ঘুরে এলেও ভ্রমণ দিয়ে আত্মার সীমা জানতে পারবেন না।
রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে গ্রিকরা দেবতাদের ক্রোধ না ডেকেও প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রদ করা যায় বলে আবিষ্কার করেছিল; অন্য সময়- পরীক্ষিত ধারণা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল কেউ কেউ। আইয়োনিয় উপকূলের আরেক দার্শনিক যেনোফেনস (৫৬০-৪৮০) অলিম্পিয়ান দেবতাদের নৈরাশ্যজনকভাবে মানবরূপী বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। লোকে ভেবেছিল, দেবতারা ‘জন্ম গ্রহণ করেন, তাঁদের পোশাক আশাক আছে, কথা বলেন ও আমাদের মতো দেহধারী।’ চুরি, ব্যভিচার ও প্রতারণার অপরাধে তাঁরা অপরাধী। এটা স্পষ্ট যে, লোকে তাদের নিজস্ব রূপই স্বর্গের প্রতি প্রক্ষিপ্ত করেছে। ঘোড়া ও গরুও সম্ভবত তাই করত।
তবে, ‘দেবতা ও মানুষের ভেতর একজন মহান দেবতা রয়েছেন’ বলে বিশ্বাস করতেন তিনি; তিনিই একক; যিনি সকল মানবীয় গুণাবলীর উর্ধ্বে। সময় ও পরিবর্তনের অতীত, তিনি তাঁর মনের (নোউস) সাহায্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন; তিনি কোনও কিছু ভাবামাত্র তা হয়ে যায়।”
এশিয়া মাইনর থেকে এখন নতুন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হওয়া দক্ষিণ ইতালির এলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন যেনোফেনস। হেরাক্লিতাসের চেয়ে সামান্য ছোট এলিয়ার স্থানীয় পারমেনাইদস তাঁর ম্লান দর্শনকে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ ভেবেছিলেন। এক অগ্নিময় রথে চেপে স্বর্গে চড়েছিলেন তিনি, বলেছেন তিনি, ছায়াপথ ছাড়িয়ে ঢের দূরে, যেখানে এক দেবীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তাঁকে তিনি হাত ধরে আশ্বস্ত করেছেন: ‘কোনও দুর্ভাগ্যের কারণে এপথে আসোনি তুমি সত্যিই মানুষের চলার পথ থেকে অনেক দূরে এর অবস্থান-কিন্তু তা সঠিক ও ন্যায্য। তোমার সবকিছু জানা দরকার।*১ মানুষকে বিভ্রম থেকে মুক্ত করে আধ্যাত্মিক সেবা দিচ্ছেন বলে বিশ্বাস করতেন পারমেনাইদস। কোনও কিছুই যেমন মনে হয় তেমন নয় বলে মানবীয় যুক্তিকে অবশ্যই সাধারণ জ্ঞান, কুসংস্কার ও অপ্রমাণিত মতের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে; তখনই তা বাস্তবতাকে ধরতে পারবে। কিন্তু তাঁর বহু সমসাময়িক মনে করেছিলেন কোনও কিছু সম্পর্কে গঠনমূলকভাবে চিন্তা করা অসম্ভব করে তুলেছেন তিনি। ৩
সকল পরিবর্তনই বিভ্রম বলে মাইলেসিয়দের বর্ণনা মোতাবেকই পৃথিবীর বিকাশ ঘটে থাকতে পারে, যুক্তি দেখিয়েছিলেন পারমেনাইদস। বাস্তবতা একটি সাধারণ, সম্পূর্ণ ও চিরন্তন সত্তায় গঠিত। অস্তিত্বহীন বিষয় সম্পর্কে আমরা কিছুই বলতে পারি না, জোর দিয়েছেন তিনি। এভাবে সত্তা চিরন্তন ও পরিবর্তনের অতীত বলে পরিবর্তন বলে কোনও কিছু নেই। সুতরাং, আমরা কখনও বলতে পারি না যে, কোনও কিছু জন্ম নিয়েছে, কারণ তার মানে হবে এর আগে তার অস্তিত্ব ছিল না, এবং একই কারণে আমরা বলতে পারি না যে এটা মারা গেছে বা অস্তিত্ব হারিয়েছে। প্রাণী অস্তিত্ব লাভ করে ও বিদায় নেয় বলে মনে হয় বটে, কিন্তু বাস্তবতা সময় ও পরিবর্তনের অতীত বলে সেটা কুহকমাত্র। আবার কোনও কিছুই কোনও বিশেষ মুহূর্তে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানোর অর্থে ‘নড়তে’ পারে না। আমরা কখনওই বলতে পারব না যে, কোনও কিছু ‘বিকশিত’ হয়েছে, এক সময়ে এক রূপে ছিল, কিন্তু ভিন্ন কিছুত পরিণত হয়েছে। সুতরাং, হেরাক্লিতাসের দাবি মোতাবেক মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল নয়; আবার মাইলেসিয়দের যুক্তি অনুযায়ী এটা বিবর্তিতও হতে পারে না। মহাবিশ্ব সবসময় সকল জায়গায় একই রকম ছিল। এটা অপরিবর্তনীয়, অসৃষ্ট ও অমর।
মাইলেসিয়রা পানি ও বাতাসের মতো বিষয়গুলোর উপর তাদের দর্শনকে ভিত্তি দিয়েছিল। কিন্তু ইন্দ্রিয়জ প্রমাণকে বিশ্বাস করেননি পারমেনাইদস, বরং লক্ষণীয়, কঠোর সামঞ্জস্যতার সঙ্গে সম্পূর্ণ যৌক্তিক তর্কের উপর নির্ভর করেছেন। ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাবনা’র অভ্যাসের খোদ চিন্তন প্রক্রিয়ার উপর ভাবনা-চর্চা করেছেন তিনি। আরও বহু অ্যাক্সিয়াল সাধুর মতো মানবীয় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এক নতুন, জটিল সচেতনতায় পৌঁছেছিলেন তিনি। খাঁটি অস্তিত্বের সন্ধানেও নেমেছিলেন পারমেনাইদস। ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টি নিয়ে ভাবনার বদলে সর্বোত্তম সত্তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় এমন জগৎ সৃষ্টি করেছেন যেখানে বাস করা ছিল কঠিন। পরিবর্তন ও সরণ যদি কুহকই হবে তবে কেন কেউ কোনও কাজ করতে যাবে? তাঁর শিষ্য মেলিসাস নৌবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন: কিভাবে তাঁর চলমান জাহাজকে পরিচালনা করবেন তিনি? আমরা নিজেদের ভেতর যে ভৌত পরিবর্তন লক্ষ করি সেগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করব? আমাদের এই মানবীয় সত্তা কি প্রেতাত্মা? মহাবিশ্বকে সমস্ত গুণাবলী থেকে বঞ্চিত করে পারমেনাইদস হৃদয় থেকেও বঞ্চিত করেছেন একে। মানুষ কেবল লোগোসের সাহায্যেই জগতের প্রতি সাড়া দেয় না; আমরা একটা জটিল অবচেতন জীবনসহ আবেগবান সৃষ্টিও বটে। একে উপেক্ষা করে ও তাঁর যৌক্তিক শক্তির ব্যাপক চর্চা করে এক শূন্যতা আবিষ্কার করেছেন পারমেনাইদস: চিন্তা করার মতো কোনও বিষয় নেই। অ্যাক্সিয়াল যুগের দার্শনিকরা ক্রমবর্ধমানহারে স্থিতিশীল যৌক্তিক ভাবনা বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে জগৎ অচেনা হয়ে উঠবে ও মানুষ তাদের নিজেদের কাছেই অদ্ভুত হয়ে উঠবে।
তারপরেও খাঁটি, অটল লোগোস জাগতিক কর্মকাণ্ডে চমৎকারভাবে কার্যকর হতে পারে। পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ায় নতুন গ্রিক চেতনাকে প্রতীকায়িত করা এক নৌ-বিজয়কে অনুপ্রাণিত করেছিল তা। ৪৯৯ সালে অ্যাথেন্স ও ইরিত্রিয়া নির্বোধের মতো পারস্য শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী মিলেতাসের পক্ষে সাহায্য পাঠায়। দারিউস বিদ্রোহ দমন করেন, মিলেতাস অধিকার করেন এবং তারপর মূল ভূখণ্ডের মিত্রদের উপর চড়াও হন। অ্যাথেন্সবাসীদের পারস্য সাম্রাজ্যের শক্তি সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা ছিল না, কিসের মোকাবিলা করতে গেছে সম্ভবত বুঝতে পারেনি। কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া উপায়ন্তর ছিল না তাদের। ৪৯৩ সালে এক বিখ্যাত অ্যাথেনিয় পরিবারের সদস্য থেমিস্তোক্লেস ম্যাডিট্র্যাট নির্বাচিত হন, অ্যারোপেগাস কাউন্সিলকে একটি নৌবহর নির্মাণে রাজি করান তিনি।
বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত ছিল এটা। অ্যাথেন্সবাসীদের নৌ-যুদ্ধের কোনও দক্ষতা ছিল না; তাদের গর্ব আর আনন্দের বিষয় হোপলাইট সেনাবাহিনীতেই ছিল তাদের শক্তি। জাহাজ নির্মাণের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না তাদের। কিন্তু কাউন্সিল রাজি হয়, নৌ পরিচালনার বিশেষজ্ঞদের আমদানি করা হয়, এবং দুই শো ত্রাইয়ারমার ও চল্লিশ হাজার লোকের নৌবাহিনী গড়ে তোলে অ্যাথেন্সবাসীরা। ৮৪ এর জন্যে ঐতিহ্যের সঙ্গে চরম বিচ্ছেদের প্রয়োজন পড়েছিল। এর আগপর্যন্ত যারা নিজেদের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত করতে পারত কেবল তারাই হোপলাইট বাহিনীতে যোগ দিতে পারত, কিন্তু এখন অনাগরিকসহ অ্যাথেনিয় সকল পুরুষকে নেওয়া হলো নৌবাহিনীতে। অভিজাত, কৃষক, নিম শ্রেণীর লোক থেতদের একসঙ্গে একই বৈঠার বেঞ্চে বসে দাঁড় বাইতে হয়েছে। হোপলাইট ফ্যালাংসে অ্যাথেনিয়রা মুখোমুখি লড়াই করেছে; এখন শত্রুর দিকে পেছন ফিরে ত্রাইয়ারমেতে বসে থাকা তাদের কাছে অসম্মানজনক ঠেকছিল। বিশেষ করে পারস্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বিজয় স্থল পথে এসেছিল বলে অনেকে নিশ্চয়ই থেমিস্তোক্লেসের পরিকল্পনাকে অসন্তোষের চোখে দেখেছে। ৪৯০ সালে পারস্য নৌবহর এজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে নাক্সোস দখল করে, ইরিত্রিয়া অধিকার করে এবং অ্যাথেন্সের আনুমানিক পঁচিশ মাইল উত্তরে ম্যারাথনে নোঙর ফেলে। মিলিতাদেসের নেতৃত্বে অ্যাথেন্সের হোপলাইট সেনাবাহিনী তাদের মোকাবিলায় অগ্রসর হয় এবং সবরকম প্রতিকূলতার মুখে পারস্যের উপর শোচনীয় পরাজয় চাপিয়ে দেয়।৮৫ ম্যারাথন পরিণত হয় নতুন ট্রয়-এ; এর হোপলাইট বাহিনীকে বীরের আধুনিক প্রজন্ম হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়। প্রাচীন রীতি যেখানে দারুণ সফল হয়েছে তবে কেন ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া?
৪৮০ সালে নতুন পারস্য রাজা যারজিস বার শো ত্রাইয়ারমে আর এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে অ্যাথেন্সের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এমনকি স্পার্টা ও অন্যান্য পেলোপোনেশিয় নগরের সাহায্য নিয়েও অ্যাথেনিয় নৌবাহিনী মারাত্মকভাবে সংখ্যার কাছে হেরে যায়। ম্যাজিট্র্যাটদের কেউ কেউ নৌবহরকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মেলিতেদেসের ছেলে, ম্যারাথনের বীর সিমন আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাক্রোপোলিসে তাঁর সাজসরঞ্জাম ছেড়ে পিরাইউস বন্দরের দিকে রওয়ানা হন: ম্যারাথন ছিল অতীতে। পারস্যবাসীরা আসার আগে নারী, শিশু দাসসহ অ্যাথেন্সের সব বাসিন্দাকে সরিয়ে নিয়েছিলেন থেমিস্তোক্লেস, সারোনিক উপসাগরের উল্টোপাড়ের সালামিস দ্বীপে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাদের। পারস্যবাসীরা হাজির হওয়ার পর অপার্থিবভাবে শূন্য শহর আবিষ্কার করে; রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়ায় তারা, লুটপাট চালায়, অ্যাক্রোপোলিসের অনন্য- সাধারণ নতুন মন্দির পুড়িয়ে দেয়। অ্যাথেন্সবাসীরা তখন অসহায়ভাবে সালামিসে বসেছিল, এই অপমানের শোরগোল তাদের কানে পৌঁছাচ্ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মারাত্মক ফাঁদ পেতেছিলেন থেমিস্তোক্লেস। পারসিয়রা ধ্বংসলীলা শেষ করার পর তাদের নৌবহর সালামিসের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিল, কিন্তু তাদের জাহাজগুলোকে সংকীর্ণ উপসাগরে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। ত্রাইয়ারমেগুলো বেকায়দাভাবে পরস্পরের গায়ে লেগে জট পাকিয়ে গিয়েছিল। নড়াচড়া করতে পারছিল না। এক এক করে ওগুলোকে নিশানা করতে পারছিল অ্যাথেনিয়রা। সন্ধ্যা নাগাদ বেঁচে যাওয়া পারস্য জাহাজগুলো পালিয়ে যায় এবং দেশের এক বিদ্রোহ দমন করার জন্যে অ্যাট্টিকায় ফিরে যান যারজিস।
গ্রিক ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিল সালামিস, মৌলিকভাবে নতুন কিছুর জন্ম সূচিত করেছিল। যুক্তির শৃঙ্খলিত চর্চার ভেতর দিয়ে গ্রিকরা এক বিশাল সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করেছিল। নাগরিকরা বছর পরিক্রমায় যৌক্তিক শক্তি থেকে আবেগকে বিচিছন্ন করে যুক্তিসঙ্গতভাবে চিন্তা করতে না শিখলে থেমিস্তোক্লেস কোনওদিনই তাদের তাঁর পরিকল্পনা মেনে নিতে রাজি করাতে পারতেন না। অ্যাক্সিয়াল যুগের অনেকগুলো মূল্যবোধ তুলে ধরেছে তাঁর কৌশল। অতীতের দিকে পিঠ ফেরাতে বাধ্য হয়েছিল গ্রিকরা এবং এক পরীক্ষামূলক পথে পা বাড়িয়েছিল। পরিকল্পনা আত্ম-উৎসর্গের দাবি করেছে। গ্রিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে হোপলাইট ফ্যালাংস গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু সালামিসে তারা এই ‘সত্তা’-কে পেছনে ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছিল এবং বীরত্বের ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করে-পারস্যবাসীদের তাদের নগর ও পবিত্র স্থানগুলো ধ্বংস করতে দিয়েছে। সালামিস অ্যাক্সিয়াল মুহূর্ত ছিল, কিন্তু তারপরেও, গ্রিসে যেমন প্রায়শঃই হতো, বস্তুগত বিজয় ছিল এটা এবং আরও যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে গেছে।
৪৭৮ সালে অ্যাথেন্সের নেতৃত্বে একশোরও বেশি পোলিস একটি সামরিক কনফেডারেশন গঠন করে। ভবিষ্যৎ পারস্য-আগ্রাসন প্রতিরোধ, পারস্য-শাসন থেকে আইয়োনিয় নগরগুলো উদ্ধার ও গ্রিকদের মাঝে বন্ধুত্বের বিকাশ ঘটানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। সদস্যরা প্রতিবছর জাহাজ ও সাজসরঞ্জাম দেওয়ার ও লীগের পৃষ্ঠপোষক অ্যাপোলোর জন্মস্থান দেরোস দ্বীপে মিলিত হওয়ার অঙ্গিকার করে। ৪৭৭ সালে আক্রমণে নামে অ্যাথেন্স, এজিয়ানের উত্তর উপকূলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পারস্য শক্তঘাঁটি ইয়োন অধিকার করে নেয়। কিন্তু এই বিজয় সত্ত্বেও সুপ্ত ভীতি ও উদ্বেগ ছিল। ৪৭৬ সালে দিওনিসিয়ায় মহান নাট্যকার ফিনিকাস পারস্য যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি ট্রিলজি উপস্থাপন করেন। দ্য ফল অভ মিলেতাস টেকেনি, কিন্তু ইতিহাসবিদ হেরোদোতাস (৪৮৫-৪২৫) দর্শকদের উপর এর প্রভাব মনে রেখেছেন। ‘গোটা থিয়েটার কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, তাদের প্রবলভাবে স্পর্শ করা জাতীয় দুর্যোগকে আবার মনে নিয়ে আসায় ফ্রিনিকাসকে হাজার দ্রাকমা জরিমানা করেছিল তারা, এবং চিরকালের জন্যে নাটকটির মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।৮৮ মহান দিওনিসিয়ায় অভিনীত ট্র্যাজিডিগুলো সাধারণত চলমান ঘটনার বর্ণনা দিত না। ফ্রিনিকাস ট্র্যাজিডি থেকে অ্যাথেন্সবাসীর প্রত্যাশিত ক্যাথার্সিসের বা ‘শুদ্ধি’ জন্যে প্রয়োজনীয় বিচ্ছিন্নতা অর্জন করতে পারেননি।
ট্র্যাজিক নাটক এখন অ্যাথেন্সে মহামূল্যবান প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হচ্ছিল। প্রতি বছর সিটি দিওনিসিয়ায় খোদ পোলিসকেই মঞ্চে উত্থাপন করা হতো। নাট্যকাররা প্রায়শঃই সাম্প্রতিক ঘটনা তুলে ধরা বিষয় বেছে নিতেন, কিন্তু সাধারণভাবে সেগুলোকে সমসাময়িক দৃশ্য থেকে দূরত্বে স্থাপন করে পৌরাণিক চেহারায় তুলে ধরে দর্শকদের বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন ইস্যুতে ভাবতে সক্ষম করে তুলতেন। উৎসবটি সাম্প্রদায়িক ধ্যান ছিল, দর্শকরা এই সময় তাদের সমস্যা ও টানোপোড়েন নিয়ে চিন্তা করত। সমস্ত পুরুষ নাগরিকরা এখানে হাজির থাকতে বাধ্য ছিল। এমনকি উৎসব চলাকালীন সময়ের জন্যে কারাবন্দীদেরও মুক্তি দেওয়া হতো। প্যানাথেনিয়ার মতো অ্যাথেন্স ছিল প্রদর্শনী; সিটি দিওনিসিয়া ছিল নাগরিক গর্বের মহাপ্রদর্শনী। লীগের সদস্য নগরীগুলো প্রতিনিধি ও চাঁদা পাঠাত; অসাধারণ নাগরিকদের পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হতো; অ্যাথেন্সের সেবায় নিহত সৈনিকদের সন্তানরা যুদ্ধের সাজে মিছিলে যোগ দিত।
তবে সহজসাধ্য কোনও উৎকট স্বাদেশিকতার অস্তিত্ব ছিল না। নাগরিকরা কান্নার জন্যে বেদীতে সমবেত হতো। গ্রিকরা তাদের ভিন্ন পরিচয়কে স্পষ্টকরণে সহায়তাকারী মিথকে নাট্য-রূপ দেওয়ার সময় বরাবর অতীতের নিশ্চয়তাকে প্রশ্ন করত এবং ঐতিহ্যগত পরমকে কঠোর সমালোচনার বিষয়ে পরিণত করত। ট্র্যাজিডিসমূহ অ্যাক্সিয়াল যুগের আধ্যাত্মিকতাকে বৈশিষ্ট্যায়িতকারী আচারের অন্তস্থঃকরণ ও গভীর হয়ে ওঠাও চিহ্নিত করেছে। নতুন ঘরানা হয়তো দিওনিসাসের গোপন রহস্য আচারে জন্ম নিয়ে থাকতে পারে, যখন কোরাস আনুষ্ঠানিক কাব্যিক ভাষায় দিওনিসাসের দুর্ভোগের কাহিনী আবৃত্তি করত, আর তখনও দীক্ষিত না হওয়া নবাগতদের মাঝে অধিকতর প্রচলিত বুলিতে নিগূঢ় অর্থ ব্যাখ্যা করতে সামনে এগিয়ে আসত নেতা। কিন্তু সিটি দিওনিসিয়ায় এককালে একান্ত আচারগুলো প্রকাশ্যে আচরিত হতো; গণতন্ত্রায়িত করে এন মেসোই স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলোকে।
বছর পরিক্রমায় নতুন নতুন চরিত্র যোগ করা হয়েছিল; কোরাসের নেতার সঙ্গে সংলাপে যোগ দিয়ে নাটকের ধারাকে আরও নাটকীয় নৈকট্য যোগাত এরা। পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ সিটি দিওনিসিয়ার সময় অভিনীত নাটকগুলো অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্তর্মুখীনতাকে তুলে ধরেছে। মিথের সুপরিচিত চরিত্রগুলোর-আগামেনন, ঈদিপাস, আয়াক্স বা হেরাক্লেস-জটিল সিদ্ধান্ত নিয়ে যুঝে পরিণামের মোকাবিলা করে অন্তস্থঃ যাত্রা দেখিয়েছে এগুলো। অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন আত্মসচেতনতা তুলে ধরেছেন তাঁরা, দর্শকরা মূল চরিত্রের মন নিজেকে পরখ করতে দেখার সময় বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে ধ্যান ও কষ্টকরভাবে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেখত। এবং দার্শনিকদের মতো ট্র্যাজিডিয়ানরা দেবতাদের প্রকৃতি, গ্রিক সভ্যতার মূল্য এবং জীবনের অর্থ ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। প্রাচীনকালে কেউই এইসব গল্পকে এমনি পরম পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত করেনি। নাট্যকাররা এখন হেলেনিক বিশ্বে আবির্ভূত হতে চলা নজীর বিহীন বিভ্রান্তি নিয়ে অনুসন্ধান করার জন্যে মূল কাহিনীর সঙ্গে নতুন বিষয় যোগ করে তাকে অলঙ্কৃত করে বদলে দিয়েছেন।
ট্র্যাজিডিতে সহজ উত্তর বা একক কোনও দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব ছিল না। মূল চরিত্রগুলো ছিল অতীতের পৌরাণিক বীর এবং কোরাস প্রান্তিক চরিত্রদের তুলে ধরত: প্রায়শঃই মূল চরিত্রের জগৎ-কে অচেনা, অবোধ্য ও বিপজ্জনক মনে করে তাদের দিকে বিতৃষ্ণার সঙ্গে তাকানো নারী, প্রবীণ ব্যক্তি, আর বিদেশী। কোরাস পোলিসের পক্ষে কথা বলত না। প্রান্তিক ও প্রায়শঃই অল্পশিক্ষিত হলেও কেতাদুরস্ত ছিল তারা, কাব্যিক অ্যাট্টিক টানে কথা বলত, অন্যদিকে অভিজাত প্রধান চরিত্র পোলিসের কথ্য বাগধারা ব্যবহার করত। এভাবে দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত সৃষ্টি হতো, নায়ক বা কোরাস কেউই ‘সঠিক’ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে পারত না। দর্শকদের বিভিন্ন অন্তর্দৃষ্টিকে মূল্যায়ন করতে হতো, ঠিক যেভাবে কাউন্সিলে কাজটি করত তারা। কোরাসের-পোলিসে যাদের সাধারণত কোনও কণ্ঠস্বর ছিল না-কিংবা অনেক দিন আগে দূর-দূরান্তে জীবন কাটানো অতীতের পৌরাণিক বীরের-যুক্তি মূল্যায়ন করার মাধ্যমেই কেবল নাটকের মানে বের করতে পারত। ট্র্যাজিডি অ্যাথেনিয়দের নিজেদের ‘অন্যে’র প্রতি প্রক্ষিপ্ত করতে শিখিয়েছে; এবং যাদের ধারণা তাদের ধারণা থেকে লক্ষযোগ্যভাবে ভিন্ন সহমর্মিতায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে শিখিয়েছে।
সবার উপরে ট্র্যাজিডি দুর্ভোগকে মঞ্চে নিয়ে এসেছিল। জীবন যে দুঃখ, বেদনাদায়ক, অসন্তোষজনক ও কুটিল সেটা ভুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। পোলিসের সামনে একজন নিপীড়িত ব্যক্তিকে তুলে ধরে, সেই ব্যক্তির বেদনাকে বিশ্লেষণ করে ও দর্শককে তার সঙ্গে সহমর্মি হতে সাহায্য করে পঞ্চম শতাব্দীর ট্র্যাজিডিয়ানরা-অ্যাচিলাস (সি. ৫২৫-৪৫৬), সফোক্লিস (সি. ৪৯৬-৪০৫), ও ইউরিপিদিস (সি. ৪৮৪-৪০৬)-অ্যাক্সিয়াল যুগের আধ্যাত্মিকতার মূল কেন্দ্রে পৌঁছেছিলেন। শোক ও অশ্রু ভাগাভাগি করলে মানুষের ভেতর এক মূল্যবান সম্পর্ক তৈরি হয় বলে জোরের সঙ্গে বিশ্বাস করত গ্রিকরা। শত্রুরা তাদের এইভাবে তাদের একই মানবীয় পরিচয় জানতে পারে, ইলিয়াডের শেষে অ্যাকিলিস ও প্রিয়াম যেমন করেছেন: তাঁদের অশ্রু বিষাক্ত ঘৃণার শোক মুছে দেওয়া ক্যাথারসিস ছিল। সিটি দিওনিসিয়ায় অ্যাথেনিয়রা সশব্দে গ্লানিহীনভাবে কাঁদত। এটা কেবল নাগরিকদের ভেতর বাঁধনই জোরাল করত না, বরং ব্যক্তিবিশেষকে তারা যে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষাদের ক্ষেত্রে মোটেই একা নয় সেটা মনে করিয়ে দিত। সম্পূর্ণ নতুনভাবে তারা উপলব্ধি করতে পারত যে, সকল মরণশীল সৃষ্টিই কষ্ট সয়। ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতার বেলায় অন্যের সঙ্গে বোধ করার ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে সহানুভূতি ও সমবেদনার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ক্যাথারসিস অর্জিত হতো। ৪৭২ সালে সিটি দিওনিসিয়ায় উপস্থাপিত অ্যাচিলাসের দ্য পারসিয়ানস-এ এটা বিশেষভাবে স্পষ্ট।
ফ্রিনিকাসের দ্য ফল অভ মিলেতাস-এর বিপর্যয়ের ঠিক চার বছর পরে সমসাময়িক বিষয়বস্তু বেছে নিয়ে অ্যাচিলাস ঝুঁকি নিচ্ছিলেন। কিন্তু অ্যাথেনিয়দের সালামিসের যুদ্ধকে পারস্যবাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়ে তাঁর নাটক প্রয়োজনীয় দূরত্ব অর্জন করেছিল। এবার কোনও দাঙ্গা না বাঁধার কৃতিত্ব কেবল অ্যাচিলাসের নয় বরং অ্যাথেনিয় দর্শকদেরও ছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে পারসিয়রা শহরটাকে চুরমার করে দিয়েছিল, তাদের পবিত্র স্থানগুলো অপবিত্র করেছে, কিন্তু তারপরেও এখন তারা পারসিয় নিহতদের জন্যে কাঁদতে পারছিল। যারজিস, তাঁর স্ত্রী আতোসা এবং দারিউসের প্রেতাত্মা নিরাপত্তার আড়াল ছিঁড়ে ফেলে জীবনের ত্রাস তুলে ধরা বিচ্ছেদে তীক্ষ্ণ শোকে মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে কথা বলেছেন। এখানে কোনও বিজয়ী ন্যায়নিষ্ঠতা ছিল না; কোনও সংকীর্ণ আত্মতৃপ্তিও না। পারস্যবাসীদের শত্রু হিসাবে নয় বরং শোকার্ত জাতি তুলে ধলেছেন অ্যাচিলাস। পারস্যবাসীদের সাহসের তারিফ রয়েছে; গ্রিস ও পারস্য ‘সৌন্দর্য ও মহত্বে খুঁতহীন একই জাতির বোন হিসাবে’ বর্ণিত হয়েছে… পরাজিত যারজিসকে সৌজন্য ও সসম্মানে তাঁর প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার সময় শোকগীতি দিয়ে নাটকটি শেষ হয়েছে। দ্য পারসিয়ান মরীয়া সংঘাতের স্মৃতি দগদগে থাকা অবস্থায়ই সাবেক শত্রুর প্রতি প্রসারিত সহমর্মিতার এক অসধারণ নজীর ছিল।
নাটকটি যুদ্ধের শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে। হুব্রিসের অপরাধে দায়ী ছিলেন যারজিস। সীমা লঙ্ঘন করেছেন তিনি এবং তাঁর সাম্রাজ্যের স্বর্গীয়ভাবে আরোপিত সীমা মানতে অস্বীকার গেছেন। ভয়াল সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন দারিউসের প্রেতাত্মা:
….কেউ যেন
নিজের ভাগ্যকে তাচ্ছিল্য না করে আরও পাওয়ার লোভে
সম্পদ বিশাল অপচয়ে ঢেলে না দেয়। মহাসিংহাসনে আসীন যিউস
উদ্ধত, গর্বিত লোকদের কঠোর শাস্তি দেন ১৪
কিন্তু কেবল পারস্যবাসীরাই এমনি অতিরিক্ত গর্বের অপরাধে অপরাধী জাতি ছিল না। এই সময়ে অ্যাথেনিয়রা অন্যান্য পোলিসে আক্রমণ চালানো ও যুদ্ধে অর্জিত লুটের মাল নিজেদের বিশাল নির্মাণ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে নিজস্ব হুব্রিস নিয়ে ভাবিত হয়ে উঠছিল। যারজিস-এর সতর্কবাণী সম্ভবত লক্ষ্যভেদ করেছিল।৯৫
৪৭০ সালে সম্পদশালী দ্বীপ নাক্সোস দেলিয়ান লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেলে অ্যাথেন্স দ্রুত নগরে আক্রমণ চালিয়ে এর প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেয় এবং জোর করে আবার একে পথে নিয়ে আসে। বিভিন্ন পোলিসের ভেতর বন্ধুত্বকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে লীগ পরিকল্পিত হয়েছিল, কিন্তু এটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে, আসল উদ্দেশ্য ছিল অ্যাথেন্সের স্বার্থ উদ্ধার। পরের বছর লীগের নগরসমূহ পারসিয় যুদ্ধের অবসান চিহ্নিতকারী এক যুদ্ধে প্যামফিলায় পারসিয় নৌবহরকে পরাজিত করে। অনেকেই নিশ্চয় এখন পারস্য হুমকি সামাল দেওয়া যাওয়ায় লীগের আরও কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে কিনা সেকথা ভাবছিল। সালামিসের পর থেকে নিম্ন শ্রেণী, থেতরা নৌবাহিনীর মেরুদণ্ড গঠন করছিল, এবার শহরে আরও প্রধান হয়ে উঠেছিল তারা। প্রচলিত ধ্যানধারণায় এমনভাবে সীমিত ছিল ও সংসদে তাদের আরও উঁচু স্থান দেবে এমন যেকোনও মৌলিক পরিবর্তনে সমর্থন দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। বিভিন্ন শ্রেণীর ভেতর নতুন সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, একটি বিভক্ত শহরে পরিণত হচ্ছিল অ্যাথেন্স।
৪৬৭ সালে উপস্থাপিত ঈদিপাসের দুই ছেলে পোলিনিক্স ও ইতিওক্লেসের আপাত ব্যর্থ লড়াইয়ের কাহিনী তুলে ধরা অ্যাচিলাসের সেভেন অ্যাগেইন্সট থেবস-এ এইসব উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। গ্রিকরাই গ্রিকদের আক্রমণ করার সময়ের ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাতের মারাত্মক কাহিনী সম্ভবত নাক্সোসের সাম্প্রতিক ট্র্যাজিডির স্মারক হয়ে থাকতে পারে। আপন পোলিসে আক্রমণ চালানো পোলিনিক্স হুব্রিসের অপরাধে দায়ী, অন্যদিকে ইতিওক্লেস যেন প্রকৃত নাগরিকের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য সংযম ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণের প্রতীক; সময়ে সময়ে এক এক করে মঞ্চে ছুটে এসে সম্পর্কহীন প্রশ্ন করে ও নির্বোধ ও দুর্বোধ্য আচরিক চিৎকার করে ওঠা ভীত সন্ত্রস্ত নারীদের কোরাসের প্রাচীন যুক্তিহীন দর্শককে ঘৃণা করেন তিনি। তারপরেও লোগোসের পুরুষ ইতিওক্লেস স্বয়ং তাঁর বাবা ঈদিপাসের সংক্রমিত ও গোটা পরিবরকে দূষিত করে তোলা দূষণে আক্রান্ত হন।” নাটকের শেষে অবশেষে থেবসের প্রাচীরের বাইরে এক ভাই অন্য ভাইকে হত্যার ভেতর দিয়ে এই মিয়াসমা শেষ হয়।
সমন্বয়ের অতীত দুটি বিশ্বে বেদনাদায়কভাবে আটকে পড়া একটি বিচ্ছিন্ন সমাজকে তুলে ধরেছেন অ্যাচিলাস। ইতিওক্লেস ও দার্শনিকদের মতো কোনও কোনও নাগরিক প্রাচীন ধর্মের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে, কিন্তু একে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। তখনও মনের গভীরতর, অপেক্ষাকৃত কম যৌক্তিক স্তরে দোলাচলে ছিল সেটা। নাটকের শেষে প্রাচীন চথোনিয়ান ক্রোধ আধুনিক লোগোসের শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হয়। অ্যাথেনিয়রা পোলিসের যুক্তিবান মানুষ, ভাগ্যের নিয়ন্তা ভেবে থাকতে পারে, কিন্তু তখনও নিজস্ব প্রাণের অধিকারী স্বর্গীয় অনুপ্রাণিত দূষণে আক্রান্ত হতে পারে বলে ভেবেছে। অ্যাথেনিয় হুব্রিস কি নতুন মিয়াসমা সৃষ্টি করতে পারবে ও তাদের শহরকে ধ্বংস করে দেবে? দুটি ভিন্ন পথে টানাপাড়েনে ছিল গ্রিক মনন। কোনও সমাধান প্রস্তাব করেননি অ্যাচিলাস। চূড়ান্ত বিলাপে কোরাস ভাগ হয়ে যায়, অর্ধেক পোলিনিক্সের সাথে, বাকি অর্ধেক ইতিওক্লিসের শেষকৃত্যে।
৪৬১ সালে এফিয়ালতেস ও তাঁর বন্ধু পেরিক্লেসের নেতৃত্বে একদল তরুণ অ্যাথেনিয় সংসদের প্রবীণদের বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ চালায়, তারপর অ্যারোপোগাস কাউন্সিলকে সব ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে। তাদের শ্লোগান ছিল দেমোক্ৰেতিয়া (“জনগণের সরকার’)। এই অভ্যুত্থান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। কাউন্সিল অভ ফাইভ হান্ড্রেড অ্যারোপোগাসের স্থান দখল করে, এর পর থেকে সকল সিদ্ধান্ত জনপ্রিয় সংসদে নেওয়া হতে থাকে। কিন্তু নতুন গণতন্ত্র পুরোপুরি উদার ছিল না। বিতর্ক প্রায়শঃই রূঢ় ও আগ্রাসী ছিল। নাগরিকদের নিয়ে দরবার গঠিত হয়েছিল, যারা প্রায়শঃই বিচারক ও জুরির ভূমিকা পালন করত। আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না, বিচার ছিল আবিশ্যিকভাবে বাদী ও বিবাদীর ভেতর যুদ্ধ।
এর অল্প পরেই অ্যাচিলাসের লেখা একটি ট্রিলজি ওরেস্তেইয়া দেখিয়েছে এই অভ্যুত্থানে অ্যাথেন্সবাসীরা কতটা গভীরভাবে ঝাঁকি খেয়েছিল। আবারও নতুন ও পুরোনোর ভেতর বিরোধকে-এরিনিস ও অলিম্পাসের অধিকতর আধুনিক ‘রাজনৈতিক’ দেবতাদের ভেতর সংঘাত তুলে ধরেছেন অ্যাচিলাস। ট্রিলজিটি গোত্রীয় বিশৃঙ্খলা ও প্রতিশোধ থেকে পোলিসের বেরিয়ে আসা ও অ্যাথেন্সের অপেক্ষাকৃত শৃঙ্খলায় পৌঁছানোর ইতিহাস করেছে, নাগরিকরা যেখানে তাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিতে পারত। এটা অন্ধ-শক্তি থেকে অহিংস বিতর্কে রীতিতে বেদনাদায়ক উত্তরণ চিহ্নিত করেছে। কিন্তু তারপরেও অ্যাচিলাস স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে আইন-কানুনের চূড়ান্ত ভাষ্য কেবল আকাঙ্ক্ষাই হতে পারে, অর্জিত বাস্তবতা নয়।
অ্যাক্সিয়াল যুগের কেন্দ্রীয় ভাবনার বিষয় সহিংসতার সমস্যার মোকাবিলা করেছে ওরেস্তেইয়া। এখানে অস্বাভাবিক মৃত্যুতে দূষিত ও প্রতিশোধের হত্যার অন্তহীন চক্রে বন্দী একটি পরিবার আত্রেউসদের কাহিনী বলা হয়েছে। স্ত্রী ক্লিতেমনেস্ত্রার হাতে আগামেননের হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে শুরু হয়ে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণকারী ছেলে ওরেস্তেসের হাতে তাঁর নিজের মৃত্যু দিয়ে এগিয়ে গেছে এটি, এবং এরিনেস-মঞ্চে যাঁর ভীতিকর আবির্ভাব দর্শকদের ভেতর কোনও কোনও মহিলার গর্ভপাতের কারণ হয়েছিল থেকে ওরেস্তেসের পলায়নের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড নতুন করে মিয়াসমার সৃষ্টি করেছে বলে প্রধান চরিত্রগুলো সহিংসতা থামাতে পারেননি এবং যাদের আইন শৃঙ্খলার পক্ষে থাকার কথা ছিল পোলিসের পৃষ্ঠপোষক সেই অলিম্পিয়ানরা যেন মরণশীলদের এক বিজয় অসম্ভব পরিস্থিতিতে জড়িয়ে যাওয়ার সাধ্যাতীত নির্দেশ দেওয়ার বেলায় বিকৃত আমোদ পেয়েছেন। সুতরাং মানুষের জীবন অনিবার্য শোকে পরিপূর্ণ। ‘যে কাজ করবে তাকে কষ্ট পেতেই হবে,’ মন্তব্য করেছে কোরাস, ‘এটাই নিয়ম।৯৭ কিন্তু ‘প্রেয়ার টু যিউস’- আশার এক দুর্বল সুতো এগিয়ে দিয়েছেন অ্যাচিলাস। যিউস যতক্ষণ-’যিউস যেই হয়ে থাকুন’-স্বর্গ ও মর্ত্যের নিয়ন্ত্রণে আছেন, দুর্ভোগ মানবীয় অস্তিত্বের অংশ হয়ে থাকবে এবং তারপরেও যিউস ‘মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছেন’, এবং মানবজাতিকে প্রজ্ঞার পথে স্থাপন করেছেন:
তিনি আইন প্রণয়ন করেছেন: দুর্ভোগের ভেতর দিয়ে শিক্ষা নাও।
এমনকি ঘুমের ভেতরও বিষাদ প্রবেশ করে, হৃদয়ে চুঁইয়ে ঢোকে,
দুর্ভোগকে ভুলতে না পারা দুঃখ।
এমনকি যারা অনিচ্ছুক তারাও বুঝতে শেখে।
সকল জীবনই আসলে দুঃখ, কিন্তু বেদনা মানুষকে শিক্ষা দেয়, যাতে তারা তাদের আপাত নৈরাশ্যময় দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে।
ট্রিলজির শেষ খণ্ড ইউমেনাইদস-এ তখনও এরিনেসের ধাওয়া খেয়ে চলা ওরেস্তেস অ্যাথেন্সে এসে অ্যাথেনার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন, অ্যারোপোগাস কাউন্সিলকে এর বিচার করতে রাজি করান। প্রতিশোধের নিষ্ঠুর বিচারকে অবশ্যই আইনের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার কাছে হার মেনে নিতে হবে। ওরেস্তেস নিজের মাকে খুন করে রক্তের পবিত্র বিধান লঙ্ঘন করেছেন, সুতরাং তাঁকে সঠিক শাস্তি ভোগ করতেই হবে, যুক্তি দেখান এরিনেস। জুরি বিভক্ত হয়ে গেলেও চূড়ান্ত ভোটদানের অধিকারী অ্যাথেনা ওরেস্তেসকে খালাস দেন ও এরিনেসকে অ্যাক্রোপোলিসে উপাসনালয় দান করে শান্ত করেন। এখন থেকে তাদের ইউমেনাইদস, ‘সঠিকভাবে বিচার-পাওয়া জন’ বলে ডাকা হবে। পোলিসের গুণ-মিতাচার ও বিপরীত শক্তিসমূহের ভারসাম্য রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু অতীতের অন্ধকার কর্মকাণ্ড এখনও সজীব রয়ে গেছে। নারী-পুরুষ, দেবতা এবং হিংস্রতাকে অবশ্যই ভোগান্তি শিখতে হবে, অতীতের কুকীর্তিসমূহের স্মৃতি আত্মস্থঃ ও আত্মীকরণ করতে হবে। নাটকের একেবারে শেষে গম্ভীর মিছিলে করে ইউমেনাদেসদের নতুন পোলিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরিনেসের মাধ্যমে প্রতীকায়িত রক্তপাত, ঘৃণা ও সহিংসতার দূষণকারী দুঃস্বপ্ন অস্বীকার করা যাবে না। নগরকে অবশ্যই বিষাদের এই ভার মেনে নিতে হবে, নিজের ভেতর গ্রহণ করতে হবে, পোলিসের পবিত্র হৃদয়ে সম্মান দিতে হবে এবং একে শুভের শক্তিতে পরিণত করতে হবে।
কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছিল না অ্যাথেন্স। স্বাধীনতার মিষ্টি কথা সত্ত্বেও নগরটি অত্যাচরী শক্তি হিসাবে গোটা গ্রিসে নিন্দিত ছিল। স্বাধীন নগর রাষ্ট্রসমূহের দেলিয়ান লীগ আসলে অ্যাথেনিয় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল; কোনও পোলিস বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়াস পেলেই নিষ্ঠুরভাবে দমন করে খাজনা দিতে বাধ্য করা হতো। ৪৩৮ সালে অ্যাক্রোপোলিসে অ্যাথেনার অনন্য-সাধারণ মন্দির প্যান্থিয়নের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল, কিন্তু সতীর্থ গ্রিকদের অপমানকর শোষণের ভেতর দিয়ে এর নির্মাণ হয়েছিল। নগরীর ল্যান্ডস্কেপকে ছাপিয়ে যাওয়া নতুন মন্দির সাম্প্রাদয়িক অহঙ্কার ও প্রাধান্যের নিশ্চয়তা ছিল, তাসত্ত্বেও নাগরিকরা এক বিপজ্জনক পথে যাত্রা করেছে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন পেরিক্লেস। অ্যাথেনিয়দের পক্ষে ব্যাপক মাত্রার বিদ্রোহ দমন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এর সাম্রাজ্য ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত এর প্রতিষ্ঠাই ভুল ছিল, কিন্তু আথেন্স এখন এর হাতে নিয়ন্ত্রিত মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে বলে একে ছেড়ে দেওয়াও বিপজ্জনক হবে।
অ্যাথেন্স তার সীমাবদ্ধতার কথা বুঝতে শুরু করেছিল। ৪৪০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চায়িত সোফোক্লিসের আন্তেগোনে পারিবারিক আনুগত্য ও পোলিসের বিধানের ভেতর সমন্বয়ের অতীত সংঘাত তুলে ধরেছে, প্রধান চরিত্রদের-থেবসের রাজা ক্রিয়ন বা ঈদিপাসের মেয়ে আন্তেগোনে-কেউই যার মীমাংসা করতে পারেননি। আসলে কোনও সমাধান সম্ভবও ছিল না। নাটকটি দেখিয়েছে যে, দৃঢ় বিশ্বাস ও স্পষ্ট নীতিমালা অনিবার্যভাবে ভালো ফলের দিকে চালিত করবে না। সব চরিত্রেরই ভালো উদ্দেশ্য ছিল, তাদের কেউই চাননি ট্র্যাজিডি ঘটুক, কিন্তু তাদের আন্তরিক ও সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও পরিণতি ছিল বিপর্যয়কর এবং বিধ্বংসী ক্ষতি :৯৯ স্বাধীনতা ও মুক্তিকে সম্মান দেখানোর গর্বিত ঘোষণা সত্ত্বেও পোলিসটি সবচেয়ে ধার্মিক কারণে আইন লঙ্ঘনকারী, নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়ানো এবং আবেগময়, বিশ্বাসযোগ্য লোগোসের সাহায্যে সেগুলোর পক্ষে কথা বলতে সক্ষম একজন আন্তেগোনেকে জায়গা দিতে পারেনি পেরেছেন। বয়স্কদের কোরাস তাদের প্রগতির প্রতি স্তোত্রগীতিতে মানুষের ক্ষমতার অতীত কিছু নেই বলে দাবি করেছে। সব বাধা পেরুতে প্রযুক্তির সৃষ্টি করেছে সে এবং একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠন করার লক্ষ্যে যুক্তির ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। তার দৃষ্টির সমস্ত কিছুর অধিপতি সে নিজে, তাকে সম্পূর্ণ অপরাজেয় মনে হয়-কেবল তার আসল অসহায়ত্ব নিয়ে আসা মৃত্যুর ভীষণ সত্যি ছাড়া। এর কথা ভুলে গেলে হুব্রিসের শিকারে পরিণত হবে সে এবং ‘নিঃসঙ্গ গর্বে জীবনের শেষের দিকে ১০০ এগিয়ে যাবে।
অ্যাক্সিয়াল জাতিগুলো মানবীয় অবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তীক্ষ্ণভাবে সজাগ হয়ে উঠছিল, কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অংশে এটা তাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্যের দিকে হাত বাড়ানো বা জীবনের দুর্ভোগ থেকে উর্ধ্বে উঠতে সক্ষম করে তোলা আধ্যাত্মিক কৌশল নির্মাণ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, সহজাত আক্রম্যতার যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতাই অনেককে নিজেদের নাজুক সত্তার ভেতর পরমকে খুঁজে পেতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু গ্রিকরা যেন কেবল অতল গহ্বরই দেখতে পেয়েছিল। আর করার কিছু নেই উপলব্ধি করার পর ঈদিপাসের মেয়ে হিসাবে নিজের নিয়তি মেনে নিয়েছেন আন্তেগোনে, তিনি নিজেও গোটা পরিবারকে আক্রান্তকারী মিয়াসমার অসহায় শিকার বলে স্বীকার করেছেন। বোন ইসমিনের মতো ইতস্তত না করে গর্বের সঙ্গে আপন ভোগান্তির অধিকার নিয়েছেন আন্তেগোনে এবং আক্ষরিকভাবেই-নিজের সমাধিতে ‘নিঃসঙ্গ গর্বে হেঁটে’ গেছেন।
আলোকনের স্বপ্ন, সোফোক্লিস যেন তাঁর পোলিসকে জানাচ্ছেন, একটা কুহক। অসাধারণ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্য সত্ত্বেও মানবজাতি এখনও অভাবনীয় বেদনা ভোগ করে। দক্ষতা, নীতি, ধার্মিকতা ও যুক্তির ক্ষমতা দুঃখ থেকে তাদের বাঁচাতে পারেনি। নিজস্ব কর্মের ফল হিসাবে সেটা ভোগ করে না তারা, বরং বাইরের এক ঐশী উৎস থেকে আসে। মরণশীল নারী-পুরুষ তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা নয়। ট্র্যাজিডিকে এড়াতে সাধ্যমতো সবকিছু করতে হবে তাদের-আন্তেগোনে যেমন করেছেন। কিন্তু যখন প্রয়াসের শেষে এসে পৌঁছাবে, তখন অটলভাবে সাহসের সঙ্গে নিয়তিকে মেনে নিতে হবে। এটা, পরামর্শ দিয়েছেন সফোক্লিস, মানুষের মাহাত্ম্যকে গড়ে তুলেছে। কিন্তু ভারতে আলোকনের স্বপ্ন মারা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে, আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে স্পর্শযোগ্য বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছিল সেটা।
.
ভারতেও আধ্যাত্মিক শূন্যতা দেখা দিয়েছিল, নতুন সাধুরা উদ্যোমের সাথে, এমনকি মরীয়া হয়ে একটি নতুন সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন। পঞ্চম শতাব্দীর শেষদিকে জ্ঞানবাক্যের আমলে বিতর্কিত কর্মের মতবাদ সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। ১০১ নারী-পুরুষ প্রত্যেকে মৃত্যু ও পুনর্জন্মের এক অন্তহীন চক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে বলে বিশ্বাস করছিল; আকাঙ্ক্ষা তাদের কাজ করতে বাধ্য করে, এবং কর্মকাণ্ডের ভালোমন্দ তাদের পরবর্তী জীবন স্থির করে দেবে। খারাপ কর্মের মানে দাঁড়াবে দাস, পশু বা গাছপালা হিসাবে পুনর্জন্ম। ভালো কর্ম রাজা বা দেবতা হিসাবে পুনর্জন্ম নিশ্চিত করবে। কিন্তু এটাই সুখ-সমাপ্তি ছিল না: এমনকি দেবতারাও এই লাভজনক কর্ম নিঃশেষ করে ফেলবেন, মারা যাবেন এবং পৃথিবীতে আরও কম মর্যাদাবান রূপে জন্ম নেবেন। নতুন এই ধারণা জোরাল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের মেজাজ বদলে গিয়েছিল, অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছিল। একের পর এক ক্ষণস্থায়ী জীবনে অভিশাপগ্রস্ত মনে হয়েছে নিজেদের। এমনকি ভালো কর্মও রক্ষা করতে পারবে না তাদের। নিজেদের সম্প্রদায়ের দিকে তাকানোর সময় কেবল বেদনা আর ভোগান্তিই দেখতে পেত তারা। এমনকি সম্পদ ও বস্তুগত আনন্দ আসন্ন বার্ধক্য ও মরণশীলতার ভয়াল বাস্তবতায় আচ্ছন্ন ছিল। আসলে, বিশ্বাস করত তারা, ইহজাগতিক বস্তু ‘সকল ইন্দ্রিয়র শক্তি দুর্বল করে দেয়,’ এবং পতন ত্বরান্বিত করে।১০২ এমনি বিষণ্ণতা জোরাল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লোকে উদ্ধার লাভের উপায় খোঁজার জন্যে সংগ্রাম করছিল।
প্রাচীন বৈদিক আচার সমস্যার কোনও সমাধানই দিতে পারছিল না বলে মানু বেশি করে সেগুলোর প্রতি নিস্পৃহ হয়ে উঠছিল। বড়জোর দেবতাদের জগতে জন্ম নেওয়াই তাদের সবচেয়ে সেরা সফল হতে পারে, তবে নতুন দর্শনের আলোকে দুর্ভোগ ও মৃত্যুর অন্তহীন পুনরাবৃত্তি থেকে কেবল সাময়িক মুক্তি হতে পারে এটা। তাছাড়া, লোকে লক্ষ করছিল যে, আচার-অনুষ্ঠানগুলো এমনকি প্রতিশ্রুত বস্তুগত সুবিধাও বয়ে আনছিল না। কেউ কেউ ব্রাহ্মণার আচরিক শাস্ত্র প্রত্যাখ্যান করেছিল। উপনিষদ চূড়ান্ত মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও এই আধ্যাত্মিকতা সবার জন্যে ছিল না। বৈদিক চিন্তার খুঁটিনাটি বিষয়ের সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে প্রণীত ছিল তা, যা বেশির ভাগ লোকেরই স্রেফ ছিল না, এবং অনেকেই গোটা ব্যবস্থা যার উপর নির্ভরশীল ছিল সেই ব্রাহ্মণ ও আত্মার পরিচয় নিয়ে সন্দিহান ছিল। যোগ মোক্ষ-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু যোগী কিভাবে তার ঘোরের বিভিন্ন অবস্থার ব্যাখ্যা দেবে? বৈদিক প্রচলিত বিশ্বাসের সঙ্গে কি সেগুলোকে সমন্বিত করা যাবে? মোটামুটি এই সময়ে প্রণীত উপনিষদসমূহ পারবে বলেই দাবি করেছিল। কঠ উপনিষদ দাবি করেছে, আত্মা (প্রকৃত সত্তা) একজন রথচালক যেভাবে রথ নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক সেভাবে কথা দেহকে পরিচালনা করে। যোগী একজন ভালো রথ-চালকের ভালো ঘোড়ার মতো তার মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখে। এভাবে যার ‘বোঝার শক্তি আছে সে মনোযোগি ও সবসময় খাঁটি’ ১০৩ কিন্তু অন্যরা স্থির নিশ্চিত ছিল যে যোগ যথেষ্ট নয়। আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন আছে।
যোগ সার্বক্ষণিক কাজ ছিল। প্রতিদিন গৃহস্থের দায়িত্বের সঙ্গে স্পষ্টতই বেমানান ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রয়াসের দাবি ছিল এর। ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে বেশির ভাগ লোক গৃহস্থ কর্মের দাস হয়ে আপন শ্রেণীর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে একের পর এক সমস্যার মূল কারণ আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত কাজ করে যেতে বাধ্য হওয়ায় তার মোক্ষ লাভের কোনও সুযোগই নেই বলে ধরে নিয়েছিল। আকাঙ্ক্ষা ছাড়া একজন গৃহস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারে না, যুদ্ধ করতে পারে না বা সফল হতে না চেয়ে ব্যবসা করতে পারে না। প্রতিটি তৎপরতা তাকে সামসারার অন্তহীন চক্রে বন্দী করে ফেলা দায়িত্বের নতুন পালার দিকে চালিত করে। মুক্তি খোঁজার একমাত্র উপায় এইসব কোনও দায়িত্ব থেকে মুক্ত সাধু বা সন্ন্যাসীতে পরিণত হওয়া এবং বনে ‘চলে যাওয়া’। ভারতের লোকেরা সংসারত্যাগীদের দুর্বল ঘরছাড়া মনে করেনি, বরং অকুতেকাভয় অগ্রদূত হিসাবে তাদের শ্রদ্ধা করেছে; নিজেদের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করে মানবজাতির জন্যে একটি আধ্যাত্মিক সমাধান খুঁজে বের কারা প্রয়াস পাচ্ছিলেন তাঁরা। অঞ্চলের চলমান হতাশার কারণে অনেকেই অস্তিত্বের এক ভিন্ন মাত্রায় ‘জাগ্রত’ হওয়া আধ্যাত্মিক বিজয়ী জিনা বা একজন বুদ্ধের, আলোকিত জনের আকাঙ্ক্ষা করছিল।
এক সামাজিক সংকটের কারণে আধ্যাত্মিক অস্থিরতা আরও বেড়ে উঠেছিল। গ্রিকদের মতো উত্তর ভারতের পয়গম্বররা প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। বৈদিক ব্যবস্থা অবিরাম অভিবাসনে নিয়োজিত দারুণ চলিষ্ণু সমাজের আধ্যাত্মিকতা ছিল। কিন্তু ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ লোকজন ক্রমেই বৃহত্তর স্থায়ী বসতিতে থিতু হতে শুরু করেছিল এবং একাগ্রতার সঙ্গে কৃষি কাজে নিয়োজিত হচ্ছিল। ভারি লাঙ্গলসহ ইস্পাতের প্রযুক্তির প্রয়োগ বেশি পরিমাণে জমি আয়ত্তে এনে সেঁচ দেওয়া সম্ভব করে তুলেছিল এবং বন কেটে পরিষ্কার করা সম্ভব হয়েছিল। গ্রামগুলো এখন নালার নেটওয়ার্কসহ সযত্নে তত্ত্বাবধান করা জমির খণ্ডে ঘেরাও হয়েছিল। নতুন নতুন ফসল যুক্ত হয়েছিল: ফল, ধান, সেরেয়াল, তিল, গম, শস্য ও বার্লি। কৃষকরা ধনী হয়ে উঠছিল।১০৪ রাজনৈতিক পরিবর্তনও ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে ছোট ছোট রাজ্যগুলো বৃহত্তর এলাকার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। দক্ষিণ পশ্চিমের মগধ ও দক্ষিণ পশ্চিমের কোসালা ছিল এইসব নতুন রাজ্যের ভেতর বৃহত্তম। ধীরে ধীরে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন আরোপ করে রাজারা এইসব রাজ্য শাসন করতেন এবং আনুগত্যের প্রাচীন ধরনকে গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য থেকে অঞ্চলের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া এক ধরনের প্রাথমিক দেশপ্রেমে বদলে ফেলেছিলেন। ফলে প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষত্রিয় যোদ্ধা শ্রেণী আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নতুন রাজারা পুরোনো মতাদর্শের প্রতি মিষ্টি কথায় আনুগত্য দেখালেও তাঁদের পূর্বপুরুষদের মতো ব্রাহ্মণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না।
রাজতন্ত্রই সরকারের একমাত্র পদ্ধতি ছিল না। নতুন রাজ্যগুলোর পুবে প্রবীণদের সংসদ (সংঘ) বা প্রাচীন গোষ্ঠীর (গণ) হাতে শাসিত ভিন্নভাবে পরিচালিত বেশ কিছু রাজ্য আবির্ভূত হতে বাধ্য হয়েছিল। এই আলোচনা ভিত্তিক সরকারের সঙ্গে গ্রিক পোলিসের স্পষ্ট সাদৃশ্য ছিল, যদিও সত্যিকার অর্থে আমরা এইসব ভারতীয় সংঘ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। কতজনকে গোত্রীয় সংসদে অনুমতি দেওয়া হতো, কোন কোন শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত ছিল, বা পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হতেন কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রের মতো সমান সংখ্যার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে থাকতে পারে, তবে যেভাবেই সেগুলো সংগঠিত হয়ে থাকুক, এইসব ‘প্রজাতন্ত্র’-মাল্লা, কোলিয়া, বিদেহা, নায়া, বাজ্জি, সামক্ষ্য, কালামা এবং লিছাবি— এলাকার বিস্তার ঘটাতে ইচ্ছুক কোসালা ও মগধ রাজ্যের হুমকির মুখে আছে বলে ভাবলেও অধিকতর ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছিল। সংঘাতের আশঙ্কা বিরাজ করছিল, লোকে জানত এইসব রাজ্যের ভেতর যুদ্ধ বাঁধলে বিশেষ করে ইস্পাতের তৈরি হওয়ায় অস্ত্রশস্ত্র আগের চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে ওঠায় অতীতের হামলার তুলনায় ঢের বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে।
নতুন রাজ্যগুলো গাঙ্গেয় অববাহিকায় বাণিজ্য উজ্জীবিত করেছিল। তারা রাস্তা নির্মাণ করেছে ও বাণিজ্য পথ নিরাপদ করেছে। সম্পদের প্রতীক হিসাবে গবাদির পশুর জায়গা দখল করেছিল মুদ্রা; গোটা অঞ্চল জুড়ে ধাতু, কাপড়, লবন, ঘোড়া ও মাটির পাত্রের ব্যবসায়ী একটি বণিক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। কিছু সংখ্যক উদ্যোগী মানুষ বাণিজ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। আমরা পাঁচ শো কারখানা ও গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকায় সিরামিকের বাসকোসন বয়ে নিয়ে যাওয়া নৌকা-বহরের মালিক এক কামারের কথা পড়ি ১০৫ বাণিজ্য আরও সম্পদ সৃষ্টি করেছিল, রাজা ও সংঘ-গণরা তা বিলাসী পণ্য, সেনাদল এবং বাণিজ্য ও শিল্পের কেন্দ্রে পরিণত হতে চলা নতুন নতুন শহরের পেছনে ব্যয় করতে পারতেন।
বৈদিক লিপি সগর্বে হস্তিনাপুরের মতো বড় বড় শহরের কথা বলেছে, কিন্তু বাস্তবে সেগুলো বড় আকারে গ্রাম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। প্রত্নতত্ত্ব দেখিয়েছে যে, মাত্র ষষ্ঠ শতাব্দীতে নগরায়ন শুরু হয়েছিল এবং গাঙ্গেয় উপত্যকার পূর্বাঞ্চলীয় প্রান্তে নতুন নতুন শহর-বারানসি, রাজগৃহ, শ্রাবস্তি, কৌশম্বি এবং কাপিলাবস্তু-গড়ে উঠেছিল। পশ্চিমের প্রাচীন বৈদিক কেন্দ্রভূমি প্রধানত গ্রাম্য রয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতা পুবে স্থানান্তরিত হচ্ছিল, ব্রাহ্মণরা যাকে সবসময়ই প্রান্তিক ও অপবিত্র মনে করে এসেছিল। শহুরে পরিবেশের ক্ষেত্রে তেমন জুৎসই ছিল না বলে এবং পুবের এলাকাগুলোয় কখনওই শক্ত শেকড় ছড়াতে না পারায় এই পরিবর্তন সনাতন বৈদিক বিশ্বাসের প্রতি আরেকটি আঘাত ছিল। রাজারা পুরোহিতদের নিয়ন্ত্রণ ঝেড়ে ফেলতে শুরু করে থাকলে প্রজাতন্ত্রগুলো ব্রাহ্মণদের পুরোপুরি উপেক্ষা করতে যাচ্ছিল, প্রথাগত উৎসর্গের প্রতি কার্পণ্য দেখাচ্ছিল।
উদ্বৃত্ত পুড়িয়ে ফেলার জন্যে পটল্যাচ অনুষ্ঠানের বদলে তা প্রশাসনে চালান বা নগর নির্মাণ, বাণিজ্য ও শিল্পে বিনিয়োগের চেষ্টা করেছে। দেবতাদের তুষ্ট ও গৃহকর্তার মর্যাদা বাড়াতে জমকালো উৎসর্গের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ পূর্বাঞ্চলীয় এই জাতিগুলো বুঝতে পেরেছিল যে, উন্নত বাণিজ্য ও কৃষি বৈদিক আচারের চেয়ে ঢের বেশি সম্পদ এনে দিয়েছে তাদের।
ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল মেলানোর বদলে নতুন নগরগুলো ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করেছে। ব্যক্তিবিশেষ-সফল দোকানী, উদ্যোগী উৎপাদক ও চতুর মহাজন-প্রাধান্য বিস্তার করছিল, এবং এইসব লোক আর সহজে প্রাচীন শ্রেণী ব্যবস্থায় খাপ খাচ্ছিল না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ গোত্রীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে প্রতিস্থাপিত করছিল। এছাড়াও, যারা সফল হয়ে উঠছিল তারা আসছিল বৈদিক নিম্ন শ্রেণী থেকে। বণিক, কৃষক ও ব্যাংকাররা সাধারণ বৈশ্য ছিল, সাধারণভাবে তাদের অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদা সম্পন্ন বংশ পরিচয় থাকত। এখন কিছু কিছু জমির মালিক হয়ে উঠছিল ও কৃষি বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছিল: অন্যরা বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদনে নাম লেখাচ্ছিল ও ক্ষত্রিয়দের চেয়ে ধনী হয়ে উঠছিল তারা। কারুশিল্পীররা সাধারণত আসত স্বদেশী শুদ্র শ্রেণী থেকে, যাদের বৈদিক আচারে অংশ নেওয়ার অনুমতি ছিল না। আর্য সম্প্রদায়ের অংশ ছিল না তারা। প্রাচীন কালে তাদের কর্মকাণ্ড ছিল শ্রমিকের। কিন্তু নতুন শহরে বিশাল সিরামিক সাম্রাজ্যের অধিকারী কামারের মতো কিছু কিছু শুদ্র এক সময় অচিন্তনীয় সম্পদ ও মর্যাদা লাভ করছিল।
এসব পরিবর্তন ইতিবাচক ছিল বটে, তবে অস্বস্তিকরও। নগরায়নে বহু লোককে অস্পষ্টভাবে দিশাহারা ও খোয়ানোর বোধ যোগানো ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন জড়িত থাকে। কোনও কোনও পরিবার ধনী ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল, অন্যগুলোর পতন শুরু হয়েছিল। শহর ও বাণিজ্য বৃহত্তর চলিষ্ণুতাকে উৎসাহিত করেছে, এবং অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনের সঙ্গে নতুন নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি উস্কে দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র, অধিকতর সীমাবদ্ধ গোষ্ঠীগুলোকে খাটো করেছে। নতুন শ্রেণী বিভাজন শুরু হয়েছিল। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা বৈশ্য ও শুদ্রদের বিরুদ্ধে একাট্টা হতে যাচ্ছিল। প্রাচীন গ্রাম্য অভিজাত গোষ্ঠী শক্তিশালী বৈশ্য ও শুদ্র উপাদান বিশিষ্ট উদীয়মান শহুরে শ্রেণীর সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেছে। বণিক ও ব্যাংকারে পরিণত ধনী বৈশ্যরা ক্রমবর্ধমানহারে পল্লী এলাকায় কৃষিখাতের বৈশ্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। চারটি শ্রেণীর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী বিধিবিধান যেন বেখাপ্পা ঠেকছিল, লোকজনকে আবার নতুন করে একসঙ্গে বাস করা শিখতে হয়েছে। গোত্রীয় পরিচয় খোয়ানো কারও কারও ভেতর বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জাগিয়েছে ও তাদের শূন্যতায় নিক্ষেপ করেছে।
বিশেষ করে পুবে এইসব সামাজিক টানাপোড়েন প্রকট ছিল, যেখানে নগরায়ন বেশ অগ্রসর ছিল; এবং এই অঞ্চলেই ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের পরবর্তী পর্যায়ের সূচনা ঘটেছিল। আর্য বসতি স্থাপনকারীরা এখানে সংখ্যালঘু ছিল, স্থানীয় ঐতিহ্য তখনও যথেষ্ট প্রাণবন্ত ছিল। লোকে নতুন সমাধান খোঁজার বেলায় স্বাধীন ছিল। শহরগুলোর দ্রুত বস্তুগত সমৃদ্ধি শহরবাসীদের বছরের পর বছর একই সময়ে বারবার একই কাজ করে যাওয়া পল্লী এলাকার লোকজনের চেয়ে পরিবর্তনের গতি সম্পর্কে বেশি সজাগ করে তুলেছিল। জীবন যেন আরও বেশি প্রান্তিক ও ক্ষণস্থায়ী মনে হয়েছে, এবং জনাকীর্ণ, অস্বস্তিকর শহরগুলোয় রোগ-শোক আর উন্মুলতার অস্তিত্বের মতোই সদ্য লাভ করা জীবনই দুঃখ, এই স্থির বিশ্বাসকে নিশ্চিত করেছে তা। প্রথাগত মূল্যবোধ ধসে পড়েছিল, নতুন ব্যবস্থাকেও যেন ভীতিকর ও অচেনা মনে হয়েছে। শহরগুলো উত্তেজনাকর ছিল; সেসবের পথঘাট চমৎকারভাবে রঙ করা ক্যারিজে ভরে থাকত; বিশাল হাতি টানা বাহন দূরদূরান্ত থেকে মাল আনা-নেওয়া করত; ভারতের সকল অংশ থেকে আসা বণিকরা বাজার এলাকায় মিশে যেত। শহুরে শ্রেণী ক্ষমতাশালী, সজীব ও উচ্চাভিলাষী ছিল। কিন্তু জুয়া, নাচ, বেশ্যাবৃত্তি আর শহরের উন্মত্ত সরাইখানার জীবন প্রাচীন মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে থাকা লোকজনের কাছে ধাক্কার মতো ছিল। জীবন আগের চেয়ে ঢের বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠছিল। প্রজাতন্ত্রগুলোতে চলছিল অন্তর্কলহ আর গৃহযুদ্ধ। কেবল প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাতে পারত বলে রাজতন্ত্রগুলো দক্ষ ও কেন্দ্রীভূত ছিল। সেনাবাহিনী সামগ্রিকভাবে গোত্রের বদলে কেবল রাজার প্রতিই আনুগত্যের কথা বলত, ফলে নিজস্ব ব্যক্তিগত যুদ্ধ মেশিনের সাহায্যে শৃঙ্খলা আরোপ করতে পারতেন তিনি এবং প্রতিবেশি রাজ্য দখলে একে কাজে লাগাতে পারতেন। নতুন এই রাজকীয় ক্ষমতা অঞ্চলের বৃহত্তর স্থিতিশীলতা দিয়েছিল, কিন্তু রাজারা জোর করে তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারেন দেখে কেউ কেউ অস্বস্তিতে ভুগছিল। অর্থনীতির ইন্ধন ছিল লোভ, ব্যাংকার ও বণিকরা অন্তহীন প্রতিযোগিতায় জড়িত থাকায় পরস্পরের বিরুদ্ধে লেগে থাকত। এমনি নিষ্ঠুর একটি সমাজ কেমন করে উত্তর ভারতে যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা অহিংসার আদর্শের সঙ্গে খাপ খেতে পারে? গবাদিপশু চুরি করা যখন অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল সেই সময়ের চেয়ে জীবন এখন ঢের বেশি সহিংস ও ভীতিকর ঠেকছিল। সমসাময়িক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বৈদিক ধর্ম ক্রমবর্ধমানহারে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে শুরু করেছিল। বণিকরা অবিরাম চলার উপর ছিল, পবিত্র অগ্নি জ্বালিয়ে রাখতে বা প্রথাগত গৃহস্থলী আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারছিল না তারা। গবাদিপশু পালন যখন মূল পেশা ছিল তখন হয়তো পশুবলী অর্থবহ থেকে থাকতে পারে, কিন্তু এখন কৃষিকাজ ও বাণিজ্য তার জায়গা দখল করায় গবাদিপশুর সংখ্যা কমে আসছিল, ফলে সাধারণ জীবনে সহিংসতার অতিরিক্ত স্মারক উৎসর্গকে অপচয় ও নিষ্ঠুর ঠেকছিল। লোকের ভিন্ন ধর্মীয় সমাধানের প্রয়োজন ছিল।
স্বাভাবিকভাবে বণিকদের মতোই সময়ের পুরুষ সন্ন্যাসীদের দিকে তাকিয়েছে তারা। তারাও বৈদিক ব্যবস্থার সীমার বাইরে পা রেখেছিলেন এবং নিজস্ব পথ বেছে নিয়েছিলেন। এই সময় সন্ন্যাসীদের সর্বত্র দেখা যেত। সাধুদের কোনও কোনও সম্প্রদায় বনে বাস করতেন, বৈদিক আচার অনুসরণ করতেন তাঁরা, কিন্তু অন্যরা পুবের সমাজে যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ অগণন মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। শিস্যদের দল একজন গুরুকে ঘিরে জটলা পাকাত, যিনি জীবন যাপনের বিশেষ পথ বাৎলে দিতেন, তাঁর ধৰ্ম্ম (‘শিক্ষা’) মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি এনে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিতেন। তিনি গোপন আলোকন লাভ করেছেন বিশ্বাস করত বলে তাঁর শিষ্যরা সম্ভবত তাঁকে বুদ্ধ বা জিনা বলে ডাকত। এইসব মতবাদ সম্পর্কে আমরা তেমন কিছু জানি না। ভারত তখনও মৌখিক সমাজ ছিল, এইসব গুরুদের বেশিরভাগই কোনও লিখিত ধর্মশাস্ত্র রেখে যাননি; প্রায়শঃই প্রতিদ্বন্দ্বীদের যুক্তির উপর নির্ভর করতে হয় আমাদের, যাঁরা হয়তো তাঁদের শিক্ষাকে বিকৃত করে থাকবেন। এই গুরুরা যুগের প্রতিযোগী চেতনাকে ধারণ করেছেন এবং শিষ্যদের হাতানোর জন্যে ভয়ঙ্করভাবে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তাঁদের ধর্ম শিক্ষা দিতে পথে নেমেছেন। গেরুয়া পোশাক পরা সন্ন্যাসীদের জটলা বণিকদের কাফেলার পাশাপাশি বাণিজ্য পথে এগিয়ে যেত, বণিকদের পণ্যের মতোই তাদের আগমনের প্রত্যাশা করা হতো। শহরে কোনও নতুন গুরুর আবির্ভাব ঘটলেই তার বক্তব্য শুনতে লোকে দলে দলে হাজির হতো। বাজার এলাকায়, নগর মিলনায়তনে আর উপকণ্ঠের সজীব ঘাসের প্রান্তরে সমাজের সকল শ্রেণীকে নিয়ে আবেগময় আলোচনা হতো। গৃহস্থরা, যাদের সংসার ছেড়ে যাওয়ার কোনও ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু নতুন আধ্যাত্মিক জবাবের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল, প্রায়শঃই সাধারণ সমর্থক হিসাবে বিভিন্ন মতবাদের সঙ্গে জড়িত হতো। ‘মৌন সাধু’ সন্ন্যাসীরা শহরের পথে পথে নীরবে হেঁটে বেড়াতেন, থালা বাড়িয়ে ধরে খাবার মাংতেন, গৃহস্থ ও তাদের স্ত্রীরা উদ্বৃত্ত দিয়ে খুশি মনে সেগুলো পূর্ণ করে দিত। এটা ছিল পূণ্য কর্ম, হয়তো তাদের পরের জন্মে মোক্ষ লাভের সুযোগসহ সাধু হিসাবে জন্ম লাভ নিশ্চিত করতে পারে।
সর্বশেষ শিক্ষার কতগুলো সমরূপ উপাদান ছিল: জীবন দুঃখ, মুক্তি লাভের জন্যে আপনাকে অবশ্যই কৃচ্ছ্রতা সাধন ও ধ্যানের ভেতর দিয়ে কর্মতৎপর হতে তাড়িতকারী আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। বিস্তারিত টেক্সট বা ধারাভাষ্য ছিল না। ধর্মগুলো কঠোরভাবে বাস্তবভিত্তিক ছিল। শিখতে ইচ্ছুক এমন যেকারও বোধগম্য এমন একটি পদ্ধতির শিক্ষা দিতেন গুরু। শাস্ত্রজ্ঞ বা পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল না আপনার। এই কর্মসূচি সাধারণভাবে গুরুর নিজস্ব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ছিল। সেটা কার্যকর হলে এবং শিষ্যের জন্যে মুক্তি ও আলোকনের বোধ সৃষ্টি করতে পারলেই ধর্ম বৈধ হয়ে উঠত। কিন্তু তেমন কিছু করতে না পারলে গুরুকে ছেড়ে অন্য একজনকে বেছে নেওয়ার বেলায় তার ভেতর কোনও দ্বিধা কাজ করত না। আসলে পথে দেখা হলে সাধুদের পরস্পরকে সম্ভাষণ জানানোর নিয়মই ছিল এটা: ‘তোমার গুরু কে? আজকাল কোন ধর্ম পালন করছ?’
এইসব মতবাদের কোনও কোনওটা ক্রমবর্ধমান হতাশা তুলে ধরা চরম কৌশল শিক্ষা দিত।১০৬ হংসরা ছিল একবারে গৃহহীন; কেবল রাতেই গ্রাম অবস্থান করতে পারত, গরুর গোবর খেয়ে জীবন ধারণ করত। আদুম্বররা ফলফলাদি, বুনো গাছ আর শেকড়-বাকল খেয়ে বেঁচে থাকত। পরমহংসরা আঙুর বাগানে গাছের নিচে আর পরিত্যক্ত বাড়িতে ঘুমাত। মুক্তিদায়ী জ্ঞান অর্জনে ব্যাকুল কেউ কেউ সামক্ষ্য শিক্ষা অনুসরণ করে যোগের চর্চা করত। অন্যরা আরও বেশি সংশয়বাদী ছিল। সঞ্জয় নামের একজন গুরু কোনও ধরনের চূড়ান্ত জবাবের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছিলেন। কেউ কেবল বন্ধুত্ব তৈরি আর মনের শান্তির চর্চাই করতে পারে; সত্যি আপেক্ষিক হওয়ায় যেকোনও আলোচনা অনিবার্যভাবে সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যায় বলে একে এড়িয়ে যেতে হবে। আরেক গুরু অজিত বস্তুবাদী ছিলেন, পুনর্জন্মের মতবাদ অস্বীকার করেছেন তিনি: সকল মানুষই ভৌত সৃষ্টি হওয়ায় মৃত্যুর পর স্রেফ তাদের মূল উপাদানেই ফিরে যাবে। সুতরাং আপনি যেমন আচরণই করুন না কেন, সবার নিয়তিই এক হওয়ায় তার কোনও গুরুত্ব নেই, কারণ, তবে আপনার ইচ্ছামাফিক কাজ করে শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি ও কেবল এগুলোকে লালন করে এমন কর্ম সম্পাদনই হয়তো ভালো ১০৭
এইসমস্ত শিক্ষা মৃত্যু ও পুনর্জন্মের সামসারিয় অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় খোঁজার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই তুলে ধরে: কেউ কেউ ভীষণ কৃচ্ছ্রতা সাধনের ভেতর দিয়ে এটা অর্জন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করত, অন্যরা বৈরিতা ও অপ্রীতিকর বিষয় এড়িয়ে সেটা অর্জন করতে পারবে বলে ভেবেছে। কোনও ধরনের অধিবিদ্যিক সত্য আবিষ্কার নয় বরং মনের শান্তি লাভই ছিল উদ্দেশ্য। সোফোক্লিসের বিপরীতে এই সন্ন্যাসীরা মর্যাদার সঙ্গে তাদের দুর্ভোগকে মেনে নিতে হবে বলে ভাবেননি। উদ্ধার লাভের একটা পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর বলে বিশ্বাস করেছেন তারা। এই গুরুদের ভেতর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ছিলেন মাক্ষালি গোসাল (মৃ. সি. ৩৮৫)। স্বল্পভাষী ও মারাত্মক অতীন্দ্রিয়বাদী গোসাল ধর্মীয় অদৃষ্টবাদের শিক্ষা দিয়েছেন: “মানবীয় প্রয়াস অকার্যকর।’ মানুষ তার আচরণের জন্যে দায়ী নয়। ‘সকল পশু, সৃষ্টি, সত্তা, ও আত্মার শক্তি ও ক্ষমতার অভাব রয়েছে। নিয়তি, তাদের শ্রেণীর প্রয়োজনীয় শর্ত এবং ব্যক্তিগত স্বভাবের কারণে এদিক-ওদিক ঝুঁকে থাকে তারা ১০৮ অজীবক (‘জীবনের পথ’) নামে একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। গোসালের বিশ্বাস ছিল যে, মোক্ষ লাভের আগে ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল মানুষ নির্দিষ্ট কতগুলো জীবন যাপনে বাধ্য হওয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড কোনওভাবেই তাদের নিয়তিকে প্রভাবিত করতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও পরিহাসমূলকভাবে অজীবকরা একটি কর্কশ বিধান গ্রহণ করেছিল। কোনও পোশাক পরত না তারা, খাবার ভিক্ষা করত এবং এমন কঠোর খাদ্য রীতি অনুসরণ করত যে কয়েকজন উপোস করে মারাও গিয়েছিল। নিজেদের দেহে তীব্র যন্ত্রণাও আরোপ করত তারা। উদাহরণ স্বরূপ, নতুন সদস্যকে দলে দীক্ষা দেওয়ার সময় তাদের গলা পর্যন্ত মাটিতে দাবিয়ে এক এক করে মাথার চুল উপড়ে ফেলা হতো। তাদের সাহায্য করবে বিশ্বাস করে নয় বরং স্রেফ এমনি কৃচ্ছতা সাধনের নিয়তি নিয়ে ব্যক্তিগত চক্রের এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল বলে এসব প্রায়শ্চিত্ত করত।
এই অশুভ ধর্মের এমনি জনপ্রিয়তা কালের তীব্র উদ্বেগেরই লক্ষণ ছিল। গোসালের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর সাফল্য লাভের বেলায় ভীত থাকায় অন্য যেকোনও গুরুর তুলনায় তাঁকে অনেক বেশি কঠোরভাবে আক্রমণ করেছিলেন। খোদাই লিপি থেকে জানা যায়, রাজারা তাঁকে উপহার পাঠিয়েছেন ও অজীবক সমাজকে জমি দান করেছেন এবং গোষ্ঠীটি সাধারণ শতকের দশম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে টিকেছিল। আমাদের কাছে পূর্ণ চিত্র না থাকতে পারে, গোসাল হয়তো বহিরাগতদের কাছে গোপন রাখা বিশেষ কোনও ধরনের কার্যকর ধ্যানের কৌশল শিক্ষা দিয়ে থাকতে পারেন। তাঁর তাপসের চরম রূপ হয়তো নবদীক্ষিতদের বেদনা বা সুখের অতীত কোনও অবস্থায় পাঠানোর লক্ষ্যে প্রণীত ছিল এবং তাঁর অটলতা হয়তো স্রেফ প্রশান্তি ও স্থৈর্য লভের পদ্ধতি ছিল: সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত হলে, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও মানে থাকে না।
গোসাল এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুরু হয়ে ওঠা বর্ধমান জ্ঞানপুত্রের (সি. ৪৯৭-৪২৫) একজন শিষ্য ছিলেন বলে কথিত। শিষ্যরা তাঁকে মহাবীর, ‘মহান নায়ক’ বলে ডাকত। মগধের ক্ষত্রিয় সর্দারের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন তিনি, দেখার মতো দৈহিক সৌষ্ঠব, শক্তি আর সৌন্দর্য ছিল তাঁর, কিন্তু তিরিশ বছর বয়সে জগৎ সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোনও গুরুর সাহায্য ছাড়া নিজেই আলোকন লাভে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন বলে নবপ্রতিষ্ঠিত কোনও মতবাদে যোগ দিতে অস্বীকার গেছেন। আমাদের বলা হয়েছে যে, দেবতারা তাঁকে গৃহহীনতার দীক্ষা দিয়েছিলেন এবং সাড়ে বার বছর সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, নৈমিত্তিক কৃচ্ছ্রতা পালন করেছেন; তিনি পোশাক পরতেন না, উপবাস পালন করেছেন, ঘুম ও আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করেছেন নিজেকে। এই প্রাথমিক সময়েই তিনি গোসালকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন এবং গোসাল মোক্ষ লাভ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়ে নিজেকে আধ্যাত্মিক বিজয়ী জিনা হিসাবে আখ্যায়িত করতে না পারা পর্যন্ত তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ছয় বছর ভ্রমণ করেছেন। এই বিবরণ অবশ্য প্রাচীন টেক্সটের পরবর্তী সময়ের ব্যাখ্যা ১০৯ এটা মহাবীরের আধ্যাত্মিক প্রাধান্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সময়ের আগেই তিনি বিচিছন্ন হয়ে গেছেন বলে গোসালের প্রতি বৈরী আভাস দিয়ে থাকে। শেষপর্যন্ত সমন্বয় সাধন করেছিলেন তাঁরা: মহাবীরকে সত্যিকারের গুরু হিসাবে মেনে নিয়ে এবং একদিন গোসাল আলোকন লাভ করবেন বলে মহাবীর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন স্বীকার করে গোসাল মারা যান। এমন হতে পারে যে, দুটো মতবাদের ভেতর কোনও রকম ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল এবং মহাবীর খুব প্রাথমিক পর্যায়ে অজীবকে প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু শেষতক স্বাধীন শিক্ষা গড়ে তুলতে পা বাড়িয়েছেন।
মহাবীরের কর্কশ জীবনযাত্রার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সকল অতীন্দ্রিয়বাদীর মতো দেহের বাধা থেকে প্রকৃত সত্তাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন তিনি এবং এভাবে অন্তস্থঃ নিয়ন্ত্রণ ও মনের শান্তি অর্জন করতে চেয়েছেন। কিন্তু আগাগোড়া অহিংসায়, “ক্ষতি না করা’১১০ অনুপ্রাণিত একটি জগতের দিকে তাকানোর সম্পূর্ণ নতুন একটি উপায় বের করার আগে মোক্ষ লাভ করতে পারেননি। প্রতিটি মানুষের আলোকময়, প্রীতিকর ও বুদ্ধিমান অন্তস্থঃ জীবন্ত সত্তা, আত্মা (জীব) আছে। কিন্তু পশু, জল, আগুন, বাতাস এবং এমনকি পাথর ও নুড়িরও নিজস্ব জীব রয়েছে; সাবেক জীবনের কর্মের ফলে এখনকার অস্তিত্ব পেয়েছে তারা। সকল সৃষ্টি তাই একই প্রকৃতির অধিকারী এবং আমরা নিজেরা যেমনটি পেতে আশা করি ঠিক তেমনিভাবে প্রতিটিকে সমাদর করতে হবে।১১১ এমনকি গাছপালারও কোনও ধরনের সচেতনতা আছে; ভবিষ্যৎ জীবনে তারাও পবিত্র বৃক্ষে পরিণত হতে পারে এবং তারপর মানুষের আকার নিতে পারে ও সবশেষে অর্জন করতে পারে আলোকন। সহিংসা বিসর্জন দিলে পশুরাও স্বর্গে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারবে। মানুষের বেলায়ও একই নিয়ম খাটে, সতীর্থ সৃষ্টির কোনও ক্ষতি না করলে মোক্ষ লাভ করতে পারবে তারা। কোনও অতীন্দ্রিয়বাদী বিশ্বজগৎ সম্পর্কে এই সমবেদনার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে না পারা পর্যন্ত মোক্ষ লাভ করতে পারবে না।
মহাবীরের কাছে মুক্তি সহিংসতামুক্ত ছিল। বেয়াল্লিশ বছর বয়সে এই অন্তর্দৃষ্টি লাভ করার মুহূর্তেই আলোকনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তিনি। প্রাথমিক টেক্সট মোতাবেক সেই সময় এক নদীর ধারে ক্ষেতে অবস্থান করছিলেন তিনি।১১২ আড়াই দিন ধরে উপবাস করছিলেন, সূর্যের প্রখর আলোয় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন, জল পর্যন্ত স্পর্শ করেননি এবং তাঁকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া এক অনন্য জ্ঞান কেভালা অর্জন করেছিলেন। এখন একই সঙ্গে স্থান ও সময়ের প্রতিটি মাত্রায় বাস্তবতার সমস্ত স্তর ধরতে পারছিলেন তিনি, যেন তিনি দেবতা। প্রকৃতপক্ষে মহাবীরের কাছে দেবা ছিলেন প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে অস্তিত্ববান স্বর্গীয় আত্মাকে অনুভব ও সম্মান করে কেভালা অর্জনকারী একজন সৃষ্টিমাত্র।
স্বভাবতই সাধারণ সচেতনতাকে ছাপিয়ে যাওয়ায় মনের এই অবস্থাকে বর্ণনা করা সম্ভব ছিল না। যত নিম্ন স্তরেরই হোক না কেন, সকল সত্তার সঙ্গে পরম বন্ধুত্বের একটা অবস্থা ছিল এটা। সত্তার এই আলোকিত অবস্থায় ‘শব্দ ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, জাগতিক যুক্তির কোনও বিবৃতি তৈরি সম্ভব হয় না এবং মন তার নাগাল পায় না।’ আপনি কেবল ‘নেতি…নেতি’ (‘ইহা নহে… ইহা নহে’) বলেই কথা বলতে পারেন। আলোকিত ব্যক্তি এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করার পর আবিষ্কার করবেন যে, ‘এর সঙ্গে তুলনা করিবার ন্যায়’ কিছু নেই; ‘ইহা নিরাকার সত্তা…ইহা শব্দ নহে, নহে আকৃতি, আত্মা নহে, নহে স্বর্গও, স্পর্শ কিংবা সেইরূপ কিছুর ন্যায় নহে।’১১৩ কিন্তু মহাবীর নিশ্চিত ছিলেন, তাঁর বিধান অনুসরণকারী যেকেউ স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই অনির্বচনীয় অবস্থা অর্জন করবে এবং পরিণত হবে জিনায়। তাঁর অনুসারীরা একারণে জৈন নামে পরিচিত ও তাঁর ধর্ম ছিল, ‘বিজয়ীদের পথ’
মহাবীর ক্ষত্রিয় ছিলেন। দুঃখের নদী অতিক্রম করে মুক্তি অর্জন করা জিনাদের দীর্ঘ সারিতে তিনি স্রেফ একজন বলে বিশ্বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর জৈনরা পূর্ববর্তী যুগগুলোয় মোক্ষের সেতু আবিষ্কারকারী চব্বিশজন এই ধরনের ‘খেয়া অতিক্রমকারী’ ছিলেন বলে দাবি করে একটি বিস্তৃত পূর্ব ইতিহাস নির্মাণ করেছে। প্রত্যেকেই দৈহিকভাবে শক্তিমান ও সুন্দর এবং সিংহের মতো সাহসী ক্ষত্রিয় ছিলেন তাঁরা। এভাবে ‘মহান নায়ক’ মাহবীর যোদ্ধা শ্রেণীর একটি বিকল্প রীতির প্রস্তাব করছিলেন, নতুন বীরপ্রথা যুদ্ধকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে এর নিজস্ব সাহসের প্রয়োজন ছিল। পরবর্তীকালে জৈন ব্যবস্থা বিভিন্ন রাজা এবং সামরিক দায়িত্ব ত্যাগে ব্যর্থ কিন্তু ভবিষ্যৎ জীবনে ত্যাগের প্রত্যাশী যোদ্ধাদের পৃষ্ঠপোষকতা পাবে। অহিংসতার প্রতি অঙ্গিকার সত্ত্বেও এই ধর্ম প্রায়শঃই সামরিক চিত্রকল্প ব্যবহার করেছে। জৈন অতীন্দ্রিয়বাদী নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে সকল অনালোকিত মানুষের বৈশিষ্ট্য আগ্রাসনের অশুভ প্রভাব দূর করে দেওয়া একজন যোদ্ধা। অতীন্দ্রিয়বাদী যুদ্ধক্ষেত্রে একজন যোদ্ধার মতোই নিজের, পরিবারের ও ব্যবস্থার পক্ষে অহিংসার জীবন যাপন করে মাহাত্ম্য বয়ে আনবেন। জৈন সম্প্রদায়কে বলা হতো গণ: ‘একটি বাহিনী’। জিনা হওয়ার জন্যে প্রয়োজন ছিল প্রকৃত বীরের চিহ্ন বিক্রম, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ও নিজের প্রতি নিষ্ঠুরতা।
মহাবীরের মতো খুব অল্প জনই এমনি অটল সামঞ্জস্যতার সঙ্গে অহিংসার নীতি অনুসরণ করেছেন। পরবর্তীকালের জৈনরা একটি ব্যাপক ও পরকাল তত্ত্ব ও সৃষ্টিবিজ্ঞান গড়ে তুলবে; তারা এমন এক অধিবিদ্যা গড়ে তুলবে যেখানে কর্মকে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতায় ওঠা থেকে বিরত রাখা আত্মার উপর জমা হয়ে তাকে নিচে টেনে নেওয়া বিভিন্ন তৎপরতার গুণের সমন্বয়ে গঠিত ধূলির মতো সূক্ষ্ম বস্তু হিসাবে দেখা হয়েছে। আমরা যতদূর বলতে পারি, মহাবীর ও তাঁর গোড়ার দিকের অনুসারীরা এইসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অহিংসা ছিল তাঁদের একমাত্র ধর্মীয় দায়িত্ব। অহিংসা ছাড়া অন্যসব নৈতিক আচরণ অর্থহীন ছিল, এবং প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি এক ধরনের সহমর্মিতা অর্জনের আগে সেটা লাভ করা জৈনের পক্ষে সম্ভব ছিল না: ‘সকল শ্বাসপ্রশ্বাসগ্রহণকারী, অস্তিত্ববান, জীবন্ত, সংবেদশীল প্রাণী হত্যা করা যাইবে না, বা সহিংসতার মাধ্যমে নির্যাতন করা যাইবে না, নিপীড়ন করা যাইবে না, অত্যাচার চালানো যাইবে না, কিংবা বিতাড়িত করা চলিবে না। ইহাই জ্ঞানী আলোকিত জনের ঘোষিত খাঁটি, অপরিবর্তনীয় বিধান। ১১৪
এই উপলব্ধি অবশ্যই কোনও মতবাদগত সম্মতি ছিল না। জৈনদের এক গভীর স্তরে সজাগ হয়ে উঠতে হতো যে, এমনকি আপাত জড়বস্তুও, যেমন পাথরের জিনা আছে, যা ব্যথা পেতে পারে এবং কোনও জীবিত প্রাণই-তারা নিজেরা যতটা ভোগ করেছে তারচেয়ে বেশি যন্ত্রণা পেতে চায় না!
অতীন্দ্রিয়বাদের অনুশীলনের ভেতর দিয়ে জৈনরা এই অসাধারণ সত্যি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিল। ভিন্নভাবে আচরণ করতে শিখে তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে বলে আবিষ্কার করেছিল এবং বিশ্বকে নতুন করে দেখতে শুরু করেছিল। ভুলে কোনও পোকামাকড় মেরে ফেলা বা ঘাসের ডগা দুমড়ে দেওয়ার ভয় থেকে জুৎসই সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করতে বাধ্য ছিল তারা। যত্নের সঙ্গে জিনিসপত্র নামিয়ে রাখতে হতো, অন্য কোনও মূল্যবান প্রাণের ক্ষতি করার সমূহ আশঙ্কা ছিল বলে অন্ধকারে চলাফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমনকি গাছের ফল পর্যন্ত পাড়ত না তারা, বরং নিজ থেকে মাটিতে ঝরে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য হতো। জৈনদের খেতে হতো অবশ্যই, এবং গোড়ার দিকে ভিক্ষার থালায় নিজের হাতে পশুটিকে হত্যা না করে থাকলে মাংস গ্রহণের অনুমতি ছিল তাদের। অবশ্য সূক্ষ্ম নড়াচাড়া বা দৈহিক প্রবণতা ক্ষতির কারণ হতে পারত বলে যেকোনও রকম তৎপরতা থেকে বিরত থাকাই ছিল আদর্শ।
তবে জৈনদের অহিংসা ক্ষতি না করার ব্যাপারে আচ্ছন্নতা পুরোপুরি নেতিবাচক ছিল না। জৈনদের সকল প্রাণীর প্রতি এক ধরনের ইতিবাচক ঔদার্যের প্রবণতা গড়ে তুলতে হতো। সকল জীবিত প্রাণীর পরস্পরকে সাহায্য করতে হবে। তাদের অবশ্যই বন্ধুত্ব, শুভেচ্ছা, ধৈর্য ও কোমলতার সঙ্গে প্রতিটি মানুষ, পশু, গাছপালা, কীটপতঙ্গ, কিংবা নুড়িপাথরের দিকে অগ্রসর হতে হবে। যোগীদের মতো জৈনরা পাঁচটি ‘নিষেধাজ্ঞা’ (যম) অনুসরণ করেছে ও সহিংসতা, মিথ্যাচার, যৌনতা, চৌর্যবৃত্তি ও সম্পত্তির মালিকানা বিসর্জন দিয়েছে, তবে মহাবীরের এইসব যমের ব্যাখ্যা সকল বস্তুতে অস্তিত্ববান প্রাণশক্তির দর্শনে প্রাণিত ছিল। স্বভাবতই গেড়ার দিকের জৈনরা প্রথম শপথ অহিংসা (‘ক্ষতি না করা’)-র উপর বেশি জোর দিয়েছে, তাদের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে একে অনুসরণ করত তারা। কিন্তু অন্য শপথগুলোও অহিংসায় অনুপ্রাণিত ছিল। জৈনদের কেবল মিথ্যাচার থেকে দূরে থাকলেই চলত না, যাতে দয়াহীনতা বা অধৈর্যের কোনও আভাস না থাকতে পারে সেজন্যে তাদের বক্তব্যকে অবশ্যই পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে হতো। কথা থেকে আঘাতের সৃষ্টি হতে পারে বলে যতদূর সম্ভব কম কথা বলত তারা। অন্য প্রাণের ক্ষতির কারণ হলে এমনকি সত্যি কথা না বলাও ভালো। সতর্কতা ও সাবধানতার মনোভাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে জৈনদের শপথগুলো প্রণীত হয়েছিল। কেবল চুরি বর্জন করাই জৈনদের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না, প্রতিটি বস্তুর সার্বভৌম, মুক্ত নিজস্ব পবিত্র জীবা রয়েছে বলে কোনও কিছুই অধিকারে রাখতে পারত না তারা ১১৫
সকল সময়ে জৈনকে অবশ্যই তাদের চারপাশের সমস্ত কিছুতে প্রাণশক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ থাকতে হতো। লোকে সেটা বুঝতে না পারলে সতীর্থ প্রাণীর সঙ্গে সঠিক আচরণ করতে পারবে না, কিন্তু সেজন্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে জৈনদের সত্যিকারের বীরত্ব সূচক সংযমের প্রয়োজন ছিল যা তাদের জীবনকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে মনে হয়েছে। তারা আগুন জ্বালতে পারত না, গর্ত খোঁড়া বা লাঙ্গল চালাতে পারত না। কেবল ছাঁকা পানি পান করতে পারত, প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে বাধ্যতামূলকভাবে চারপাশ জরিপ করতে হতো এবং চিন্তাহীন একটি মুহূর্তও এড়িয়ে যেতে হতো। এভাবে শপথ রক্ষা করা হলে জৈনরা তাদের জন্যে আলোকন বয়ে আনা অসাধারণ আত্মসংযম এবং এক ধরনের সমবেদনা অর্জন করেছে বলে আবিষ্কার করতে পারত। সমবেদনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, মহাবীর শিক্ষা দিয়েছেন, জৈনকে অবশ্যই ‘জগতের জ্ঞান’ অর্জন করতে হবে, যাতে সে প্রতিটি বস্তুর পবিত্র প্রাণশক্তি থাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারে। এই বিশ্বজ্ঞান লাভ করার পর তাকে অবশ্যই ‘এর জন্যে সহমর্মিতা’র’১৬ চর্চা করতে হবে।
স্বর্ণবিধির নিজস্ব ভাষ্যে পৌঁছেছিলেন মহাবীর। নিজেরা যেমন আচরণ আশা করে জৈনদের সেভাবে অন্যদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। অন্যদের আঘাত দেওয়ার সময় কি করছে বুঝতে না পারা অজ্ঞ লোকদের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে গোটা বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে রাখা দুঃখ সৃষ্টি হয়েছে। সতীর্থ প্রাণের জীবা অস্বীকার করার মানে আপনার নিজের অন্তস্থঃ সত্তাকেই অস্বীকার করা। ১১৭ জৈনরা ব্যতিক্রমহীনভাবে সকল বস্তু ও মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে। একবার এই প্রবণতা অর্জন করার পর অবিলম্বে আলোকন অর্জন করবে তারা। মোক্ষ একজন তত্ত্বাবধানকারী ঈশ্বর কর্তৃক যোগ্য লোককে দেওয়া কোনও উপহার ছিল না। এই ধরনের ধর্মতত্ত্বে জৈনরা আগ্রহী ছিল না। কিন্তু তারা জানতে পেরেছিল যে, নিয়মনিষ্ঠভাব অনুসৃত হলে এই ধরনের অনুশীলন তাদের দুয় শান্তি এনে দিত।
আলোকন প্রাপ্তির পর মহাবীর চম্পা নগরীর উপকণ্ঠে এক বৃক্ষ দেবতার মন্দিরে প্রথম বাণী দান করেছিলেন।১১৮ প্রথম শতাব্দীর আপেক্ষিকভাবে পরের দিকে একটি টেক্সটে এই ঘটনার প্রথম বিস্তারিত বিবরণ মেলে, তবে জৈন প্রথার মূল বিষয়ে পরিণত হয়েছিল সেটা। বিপুল সংখ্যক দেব-দেবী, অতীন্দ্রিয়বাদী, সাধারণ জনতা এবং পশুপাখিসহ চম্পার রাজা-রানি এতে উপস্থিত ছিলেন, অটুট মনোযোগের সঙ্গে মহাবীরের অহিংসার বাণী শোনেন তাঁরা সবাই। এক প্রতীকী মুহূর্ত ছিল এটা। বৈদিক উৎসর্গে দেবতারা মানুষের পশু বলী দেখতে সমবেত হতেন। কিন্তু চম্পায় দেবতা, মানুষ ও জানোয়ার অহিংসার বাণী শুনতে সমবেত হয়েছেন এবং একক, প্রেমময় সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছে। ঐক্য ও সহমর্মিতার এই দর্শন জীবনের প্রতিটি কাজকে অনুপ্রাণিত করার কথা ছিল। জৈনরা যোগে আগ্রহী ছিল না, তবে নিজস্ব ধরনের ধ্যানের চর্চা করত তারা। দুপাশে হাত মেলে দিয়ে, যাতে শরীর স্পর্শ না করে, নিথর দাঁড়িয়ে তীব্রভাবে বৈরী ভাবনা বা ঝোঁক দমন করতেন সন্ন্যাসীরা, একই সময়ে সকল প্রাণের প্রতি দয়া ও ভালোবাসায় তাঁদের মন ভরে তোলার সচেতন প্ৰয়াস পেতেন ১১৯ একজন অভিজ্ঞ জৈন সাময়িক (‘প্রশান্তি’) নামে পরিচিত আধাধ্যানের অবস্থা লাভ করত যেখানে তার জানা থাকত যে, তাঁর সত্তার প্রতিটি তন্তুতে এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী সমান; এই সময় সকল বস্তুর প্রতি ঠিক একই রকম শুভেচ্ছা বোধ করতেন তিনি। তার কোনও পক্ষপাত থাকত না, থাকত না কোনও ঘৃণা, এবং যত ক্ষুদ্র, অপ্রীতিকর ও তাৎপর্যহীনই হোক, কোনও একটি প্রাণীকে নিজে থেকে আলাদা করতেন না। দিনে দুবার গুরুর সামনে এসে দাঁড়াত জৈনরা এবং ভুলে ‘বীজ, সবুজ গাছ, শিলি, গুবরে পোকা, ছত্রাক, ভেজা মাটি বা মাকড়শার জালে’র ক্ষতি করে থাকলে তার জন্যে অনুশোচনা করত। এই কথা বলে শেষ করত তারা: ‘আমি সকল জীবিত প্রাণীর কাছে ক্ষমা চাই। সকল প্রাণী যেন আমাকে ক্ষমা করে। আমি যেন সকল প্রাণীর বন্ধুত্ব লাভ করতে পারি, কারও সঙ্গে যেন শত্রুতা সৃষ্টি না হয়।১২০ কেবল সহিংসতা থেকে বিরত থাকা নয়, বরং সীমাহীন দয়া আর সমবেদনার অনুশীলন ছিল নতুন আদর্শ।