৫. দুর্ভোগ (c. ৬০০-৫৩০)

. দুর্ভোগ (সি. ৬০০ থেকে ৫৩০ বিসিই

ষষ্ঠ শতকে পুরোপুরিভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগে পা রাখে ইসরায়েল এবং আরও একবার পরিবর্তনের অনুঘটক ছিল লাগামহীন, হতবুদ্ধিকর সহিংসতা। জোসিয়ার অকাল-মৃত্যুর অল্প পরেই বাবিলনের রাজা নেবুচাদনেযার গোটা এলাকার অবিসম্বাদিত প্রভুতে পরিণত হন, পরের বিশ বছর কানানের নিয়ন্ত্রণ পেতে নব্য-বাবিলোনিয় সাম্রাজ্য মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেগে থাকে। কিন্তু বাবিলনের বিরোধিতা করা বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়েছিল। যখনই জুদাহ বাবিলোনীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে ক্ষুদে রাজ্যটির উপর চড়াও হয়েছেন নেবুচাদনেযার এবং তিনটি নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের ভেতর দিয়ে গোটা এলাকা অধিকার করে নিয়েছেন। ৫৯৭ সালে জুদাহর তরুণ রাজা জেহোয়াচিন বাবিলনের কাছে নতি স্বীকার করলে আট হাজার নির্বাসিতসহ দেশান্তরে পাঠানো হয় তাঁকে; রাজ পরিবারের সদস্য, অভিজাত গোষ্ঠী, সামরিক বাহিনীর সদস্য ও দক্ষ কারুশিল্পীরা এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন: ‘তাহারা সকলে বীৰ্য্যবান ও রণদক্ষ লোক ছিল। এটাই ছিল অ্যাক্সিয়াল যুগের দর্শন সৃষ্টিকারী দেশান্তরীদের প্রথম দল। 

জুদীয় রাষ্ট্রের আত্মা উপড়ে ফেলেছিলেন নেবুচাদনেযার, কিন্তু সিংহাসনে বাবিলোনিয় নিযুক্ত যেদেকিয়াকে নিয়ে আরও দশ বছর সংগ্রাম করে যায় রাজ্যটি। ৫৮৭ সালে যেদেকিয়া বিদ্রোহ করলে এতটুকু করুণা দেখাননি নেবুচাদনেযার। জেরুসালেমের উপর চড়াও হয় তাঁর সেনাবাহিনী, মন্দির ধ্বংস করে এবং নগরীকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। চোখজোড়া উপড়ে নেওয়ার আগে যেদেকিয়াকে আপন ছেলেদের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করা হয়, আরও পাঁচ হাজার দেশান্তরীসহ তাঁকেও বাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়, ভূমিস্যাৎ দেশে রেখে যাওয়া হয় শুধু দরিদ্র সাধারণ আর বাবিলনের পক্ষে যোগদানকারীদের। জুদাহকে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এবং ৫৮১ সালে তৃতীয় আরেকটি দলকে নির্বাসনে নিয়ে যাওয়া হয়। 

এক প্রবল দুর্ভোগের সময় ছিল এটা। সম্প্রতি কিছু কিছু পণ্ডিত বাবিলোনিয় নির্বাসন আসলে খুব বেশী কষ্টকর ছিল না বলে যুক্তি দেখিয়েছেন: প্রায় ৭৫ ভাগ লোকই রয়ে গিয়েছিল, আগের মতোই চলছিল জীবন যাত্রা। বাবিলোনিয়ায় নির্বাসিতরা ভালো সমাদরই পেয়েছিল। তারা সেখানে বসতি গড়ে ও খাজনা আদায়কারী, ব্যবসায়ের প্রতিনিধি আর বিভিন্ন খালের ব্যবস্থাপক হিসাবে জীবীকা নির্বাহ করে। কেউ কেউ ভূমির জায়গিরদারীও পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান জেরুসালেম, জুদাহ এবং গোটা লাভান্তে অসিরিয়া আক্রমণের তুলনায় ঢের বেশী ধ্বংসাত্মক বাবিলোনিয় আক্রমণের ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী ভোগান্তির কালের অন্যতম অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে দেশটি এক বিরান ধ্বংসাবশেষ হয়ে পড়েছিল জেরুসালেম ও এর মন্দির। শোকের পুস্তক এর ফাঁকা চত্বর, ভেঙে পড়া দেয়াল, ক্ষতিগ্রস্ত তোরণের বিবরণ দিয়েছে; জনাকীর্ণ, সমৃদ্ধ শহর এখন পরিণত হয়েছে শেয়ালের আস্তানায়। খাবারের আশায় লোকে ময়লার স্তূপ হাতড়ায়, মায়েরা তাদের শিশুদের মেরে মাংস সেদ্ধ করে আর তরুণ যুবারা কালচে চেহারা আর কঙ্কালসার শরীরে ঘুরে বেড়ায় বিধ্বস্ত পথে পথে।” এক ভীতিকর গহ্বরের দিকে তাকিয়ে ছিল ইসরায়েলের জনগণ, কিন্তু সবকিছু হারিয়ে কেউ কেউ দুঃখ, ক্ষতি ও অপমানের অভিজ্ঞতা থেকে একটি নতুন দর্শন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। 

বিদ্রোহ অর্থহীন হবে বুঝতে পেরে বাবিলোনিয়দের অব্যাহতভাবে সমর্থন দেওয়ার কারণে পয়গম্বর জেরেমিয়াকে নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। কোনও কোনও পয়গম্বর ভেবেছিলেন ইয়াহওয়েহ তাঁর মন্দিরে অবস্থান করেন বলে জেরুসালেমকে ধ্বংস করা যাবে না, কিন্তু জেরেমিয়া তাঁদের বলেছিলেন এটা বিপজ্জনক নির্বুদ্ধিতা। জাদুমন্ত্রের মতো ‘সদাপ্রভুর মন্দির, সদাপ্রভুর মন্দির, সদাপ্রভুর মন্দির’ বলে ভজন করা অর্থহীন। লোকে তাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন না আনলে ইয়াহওয়েহ নগরী ধ্বংস করে দেবেন। এটা ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, জেরেমিয়ার গর্দান কাটা যাওয়ার দশা হয়েছিল, কিন্তু খালাস পাওয়ার পর ভয়াল ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করে পথে পথে ঘুরে বেড়াত থাকেন তিনি। তাঁর নাম পরিণত হয়েছিল অতিরিক্ত নৈরাশ্যবাদীতার প্রতিশব্দে; কিন্তু জেরেমিয়া ‘নেতিবাচক’ ছিলেন না। ঠিকই ছিলেন তিনি। তাঁর অটল ও সাহসী অবস্থান অ্যাক্সিয়াল চেতনার অন্যতম আবিশ্যিক নীতি প্রকাশ করেছে: মানুষকে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠভাবে সবকিছু দেখতে হবে। বালিতে মাথা গুঁজে সত্যির-তা সেটা যতই বেদনাদায়ক ও ভীতিকর হোক না কেন-মুখোমুখি হতে অস্বীকার কওে আধ্যাত্মিক বা বাস্তবিক ক্ষেত্রে কাজ করতে পারবে না। 

পয়গম্বর হওয়াকে ঘৃণা করতেন জেরেমিয়া। যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে সারাদিন ‘সহিংসতা ও ধ্বংস!’ বলে চিৎকার করে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি; থামার চেষ্টা করলেই হৃৎপিণ্ড আর হাড়ে আগুন ধরে গেছে বলে মনে হতো তাঁর, আবার ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণে বাধ্য হতেন। হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, মনে মনে ভাবতেন জন্ম না নিলেই বোধ হয় ভালো হতো। আমোস ও হোসেয়ার মতো ঈশ্বর তাঁর বস্তুনিষ্ঠতা কেড়ে নিয়েছেন বলে মনে হতো তাঁর; প্রতিটি অন্ধিসন্ধি দুমড়ে দেওয়া বেদনা আসলে ইয়াহওয়েহরই বেদনা ছিল: ঈশ্বরও অপমানিত, একঘরে ও পরিত্যক্ত বোধ করছিলেন। দুর্ভোগকে অস্বীকার করার বদলে তাঁর সময়ের সন্ত্রাস, ক্রোধ ও দুর্ভোগের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে এবং তাঁর সত্তার সর্বত্র একে আগ্রাসন চালাতে দিয়ে মানুষের সামনে নিজেকে বিষণ্ণ লোক হিসাবে তুলে ধরেছেন জেরেমিয়া। অস্বীকার করাটা কোনও পছন্দ ছিল না; তাতে কেবল আলোকনই বাধাগ্রস্ত হতে পারত। 

৫৯৭ সালে প্রথম দেশান্তরের অল্প পরে নির্বাসিতদের মিথ্যা আশা যোগানো কিছু সংখ্যক তথাকথিত পয়গম্বরের বাবিলনে সক্রিয় হয়ে ওঠার কথা শুনতে পান জেরেমিয়া। নির্বাসিতদের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেন তিনি। অদূর ভবিষ্যতে দেশে ফেরা হচ্ছে না তাদের, আসলে জেরুসালেম ধ্বংস করে দিতে যাচ্ছেন ইয়াহওয়েহ। অন্তত সত্তর বছরের জন্যে নিজেদের বন্দিত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে, সুতরাং তাদের উচিত বসতি গড়ে তোলা, ঘরবাড়ি বানানো, বিয়ে করা আর সন্তান ধারণ করা। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাসিতরা কোনওভাবেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারবে না। ইয়াহওয়েহর বাণী ছিল এটা: ‘আর আমি তোমাদিগকে যে নগরে বন্দি করিয়া আনিয়াছি তথাকার শান্তির চেষ্টা কর, ও সেখানকার নিমিত্ত সদাপ্রভুর কাছে প্রার্থনা কর; কেননা সেখানকার শান্তিতে তোমাদের শান্তি হইবে।’ সত্যির মুখোমুখি দাঁড়াতে পারলে, মিথ্যা সান্ত্বনাকে অস্বীকার করতে সক্ষম হলে, এবং হৃদয়কে ঘৃণায় বিষাক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারলে ‘আশা সিদ্ধির ভবিষ্যৎ ভোগ’ করতে পারবে তারা পেছনে রয়ে যাওয়া লোকজন নয়, ৫৯৭ সালের নির্বাসিতরাই ইসরায়েলকে উদ্ধার করবে। দুঃসময়ের মোকাবিলা করে উঠতে পারলে আরও অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে পারবে তারা। ইয়াহওয়েহ তাদের সঙ্গে একটা কোভেন্যান্ট সম্পাদন করবেন। মোজেসের কোভেন্যান্টের মতো এবার পাথরের ফলকে খোদাই করা থাকবে না সেটা: 

আমি তাহাদের অন্তরে আমার ব্যবস্থা দিব, ও তাহাদের হৃদয়ে তাহা লিখিব; এবং আমি তাহাদের ঈশ্বর হইব ও তাহারা আমার প্রজা হইবে। আর ‘তোমরা সদাপ্রভূকে জ্ঞাত হও,’ এই কথা বলিয়া তাহারা আপন আপন প্রতিবাসীকে ও আপন আপন ভ্রাতাকে আর শিক্ষা দিবে না; কারণ তাহারা ক্ষুদ্র ও মহান সকলেই আমাকে জ্ঞাত হইবে, ইহা সদাপ্রভু কহেন।” 

সবকিছু হারিয়ে ইসরায়েলের কিছু কিছু লোক অন্তরের দিকে চোখ ফেরাচ্ছিল। প্রত্যেককেই নিজের দায়িত্ব হাতে তুলে নিতে হবে; অ্যাক্সিয়াল যুগের অধিকতর অন্তস্থঃ ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান আবিষ্কার করছিল তারা। 

অবশ্য বাবিলোনিয়দের মঙ্গল কামনা করা দুরস্ত, নির্বাসিতদের কেউ কেউ পাথরে আঘাত হেনে সন্তানদের হত্যা করতে চেয়েছে।১ নির্বাসন স্রেফ ঠিকানা বদল ছিল না। আধ্যাত্মিক স্থানচ্যুতিও ছিল। সংস্কৃতি ও পরিচয়ের শেকড় থেকে উন্মুল হয়ে শরণার্থীরা প্রায়শঃই তারা ক্ষয়ে যাচ্ছে ও মূল্যহীন হয়ে পড়ছে বলে মনে করেছে।” জুদিয় নির্বাসিতরা বাবিলনে সমাদর পেয়েছিল। কারাগারে বা শিবিরে রাখা হয়নি তাদের। ৫৯৭ সালে নেবুচাদনেযারের কাছে স্বাধীনভাবে আত্মসমর্পণকারী রাজা জেহোয়াচিন গৃহবন্দি ছিলেন, কিন্তু ভাতা দেওয়া হতো তাঁকে এবং বাবিলনের দক্ষিণের দুর্গে লোকলস্কর নিয়ে আরামদায়ক জীবন যাপন করতেন তিনি।১৩ দেশান্তরীদের কেউ কেউ রাজধানীতে বাস করত, অন্যরা নতুন খনন করা খালের ধারে অনুন্নত এলাকায় থাকত।১৪ একটা বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত নিজেদের ভালোমন্দ দেখভাল করতে পারত তারা। জেরুসালেমে অনেকেই কর্তৃত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ছিল; বাবিলোনিয়ায় তাদের কোনও রাজনৈতিক অধিকার ছিল না, সমাজের প্রান্তিক অবস্থানে ছিল তারা, স্থানীয় জনগণের দরিদ্রতরের চেয়েও নিচে ছিল তাদের অবস্থান। কাউকে কাউকে এমনকি কর্ভিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল।১৬ মর্যাদা খোয়ানোর প্রবল অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তারা। নির্বাসনের কথা বলার সময় প্রায়শঃই ‘বন্ধন’ (মাসারেহ) ও ‘শৃঙ্খল’ (যিগ্গিন)-এর মতো শব্দ ব্যবহার করত তারা।” কৌশলগত দিক থেকে হয়তো তারা ক্রীতদাস ছিল না, কিন্তু নিজেদের তেমনই ভাবত। 

শরণার্থীদের কেউ কেউ বাবিলনের দেবতা মারদুকের হাতে এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করা ইয়াহওয়েহর উপাসনা করতে পারছিল না। ১৮ প্রাচীন লোকগাথার উপর ভিত্তি করে রচিত জবের পুস্তকটি হয়তো নির্বাসনকালে লেখা হয়ে থাকতে পারে। একদিন ইয়াহওয়েহ স্বর্গীয় সভায় শয়তানের সঙ্গে এক কৌতূহলোদ্দীপক বাজি ধরে বসেন, তখনও অশুভের সীমাহীন চরিত্রে পরিণত হয়নি সে, বরং ‘ঈশ্বরের পুত্রদের’ একজন, সভার আইনি ‘প্রতিপক্ষ’ ছিল মাত্র।১৯ ইয়াহওয়েহর প্রিয় মানবসন্তান জবকে কখনওই সত্যিকার অর্থে পরীক্ষা করা হয়নি বলে যুক্তি দেখায় শয়তান, বরং ইয়াহওয়েহ তাঁকে রক্ষা করেছেন, তাঁকে সমৃদ্ধ হতে দিয়েছেন বলেই ভালো মানুষ আছেন। সমস্ত সহায়সম্পদ খোয়ালে অচিরেই ইয়াহওয়েহকে গালমন্দ করতে শুরু করবেন তিনি। ‘দেখ,’ জবাব দিয়েছেন ইয়াহওয়েহ, ‘তাহার সর্বস্বই তোমার হস্তগত। ২০ শয়তান অবিলম্বে জবের ষাঁড়, ভেড়া, উট, দাসদাসী আর সন্তানদের ধ্বংস করে; নানা রকম বাজে রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে থাকেন জব। সত্যিই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে চলে যান তিনি, বাজিতে জিতে যায় শয়তান। 

এই পর্যায়ে অবশ্য কতগুলো দীর্ঘ কবিতা ও আলোচনায় লেখক একজন ন্যায়বিচারক, উদার ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগকে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াস পেয়েছেন। জবের চারজন বন্ধু সব ধরনের প্রচলিত যুক্তি দেখিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁকে: ইয়াহওয়েহ কেবল দুষ্টদেরই শাস্তি দেন; আমাদের পক্ষে তাঁর লীলা বোঝা ভার; তিনি অতি ন্যায়বান এবং জব তাই নিশ্চয়ই তাঁর কোনও আচরণের জন্যে অপরাধী হয়ে থাকবেন। এইসব মসৃণ, সাবলীল সান্ত্বনা জবকে বরং আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে, ঈশ্বরের মতো আচরণ করায় এবং নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে নির্যাতন করায় সান্ত্বনাদানকারীদের গালমন্দ করতে থাকেন তিনি। ইয়াহওয়েহর বেলায় অদৃশ্য, সর্বশক্তিমান, খেয়ালি ও অবিচারক -আবার একই সময়ে বিচারক, উকিল ও জল্লাদ-একজন ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ সংলাপ অসম্ভব। 

শেষে ইয়াহওয়েহ জবের প্রতি করুণা দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলে যে মানুষটির প্রতি এমন রূঢ় আচরণ করেছিলেন তার প্রতি এতটুকু সহানুভূতি না দেখিয়ে বরং তাঁর নিজস্ব সাফল্য নিয়ে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ দিলেন। তিনি পৃথিবীর ভিত্তি স্থাপন করার সময়, বন্ধ দরজার পেছনে সাগরকে রুদ্ধ করার সময় কোথায় ছিলেন জব? জব কি বড়শী দিয়ে লেভিয়াথানকে ধরতে পারতেন, ঘোড়াকে ঘাস ফড়িংয়ের মতো লাফাতে বাধ্য করতে পারবেন, কিংবা নক্ষত্রমণ্ডলীকে তাদের কক্ষপথে পরিচালনা করতে পারবেন? কবিতাটি অসাধারণ হলেও অপ্রাসঙ্গিক। এই দীর্ঘ, বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতাটি আসল বিষয়ের ধারেকাছেও যায়নি: কথিত একজন প্রেমময় ঈশ্বরের হাতে কেন নিরীহ লোকরাই ভোগান্তির শিকার হয়? জবের বিপরীতে, পাঠকের জানা আছে যে জবের কষ্টের সঙ্গে ইয়াহওয়েহর দুর্জ্ঞেয় প্রজ্ঞার কোনও সম্পর্ক নেই, বরং সেটা ছিল এক তুচ্ছ বাজির পরিণতিমাত্র। কবিতার শেষে জব যখন-ইয়াহওয়ের আড়ম্বরপূর্ণ ক্ষমতার প্রদর্শনীতে একবারে পরাভূত-তাঁর সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়ে ‘ধুলায় ও ভস্মে বসিয়া অনুতাপ’ করলে জবের স্বাস্থ্য ও সম্পদ ফিরিয়ে দেন ঈশ্বর। কিন্তু প্রথম অধ্যায়ে নিহত সন্তান ও দাসদের আবার জীবিত করে তোলেননি তিনি। তাদের জন্যে কোনও ন্যায় বিচার বা ক্ষতিপূরণ ছিল না। 

জব সত্যিই নির্বাসিত কারও হাতে রচিত হয়ে থাকলে, এখানে দেখা যায় যে, সম্প্রদায়ের কেউ কেউ ইয়াহওয়েহর উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু অন্যরা সৃজনশীলভাবে বিপর্যয়ের প্রতি সাড়া দিয়েছে ও সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ধর্মীয় দর্শন গড়ে তুলেছে। রাজকীয় লিপিকাররা অতীতের টেক্সট সম্পাদনা অব্যাহত রেখেছিলেন। বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যে ডিউটেরোনমিস্টরা তাঁদের ইতিহাসে নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করেন এবং পুরোহিতরা বাবিলনের জীবনযাত্রায় তাঁদের প্রাচীন লোককথাকে অভিযোজিত করতে শুরু করেন, যেখানে জুদাহবাসীদের নিজস্ব কোনও মন্দির বা কাল্ট ছিল না। জীবনকে অর্থ দেওয়া সমস্ত কিছু মন্দির, রাজা আর দেশ থেকে বঞ্চিত অবস্থায় উন্মুল সংখ্যালঘু হিসাবে বাঁচতে শিখতে হয়েছে তাদের এবং আরও একবার নিজেদের ইতিহাস লিখতে, রেওয়াজ পরিমার্জনা করতে ও প্রথাগত পবিত্র বিভিন্ন প্রতীকের চরম উদ্ভাবনী ব্যাখ্যা করতে ভয় পায়নি। 

তরুণ পুরোহিত ইযেকিয়েলের পয়গম্বরত্বে অ্যাক্সিয়াল যুগের এই দর্শনের বিকাশ লক্ষ করি আমরা। ৫৯৭ সালে বাবিলনে নির্বাসনে পাঠানো হয় ইযেকিয়েলকে, চেবার খালের কাছে তেল আবিব-বসন্তকালীন পর্বত-গ্রামে বসতি করেন তিনি। যন্ত্রণাকর ত্রাস থেকে অধিকতর শান্তিপূর্ণ অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিকতায় উত্তরণ তুলে ধরা কতগুলো দিব্যদর্শনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি। ৫৯৩ সালে নির্বাসনে যাওয়ার মাত্র পাঁচ বছর পর, তখনও জেরুসালেম ও এর মন্দির অক্ষত ছিল, চেবার নদীর ধারে এক হতবুদ্ধিকর দিব্যদর্শন লাভ করেন ইযেকিয়েল।২১ প্রবল হাওয়া বইছিল; বিদ্যুতের চমক, বজ্রের শব্দ আর ধোঁয়া দেখতে পান তিনি; এমনি ঝড়ো অস্পষ্টতার ভেতর কোনওমতে চারটি করে মাথাঅলা যুদ্ধ রথ টানা চারটি অনন্য সাধারণ প্রাণীর অবয়ব আলাদা করতে পারছিলেন ইযেকিয়েল। ‘মহাজলরাশির কল্লোলের ন্যায়, সর্বশক্তিমানের রবের ন্যায়, সৈন্যসামন্তের ধ্বনির ন্যায়’ কানে তালা লাগানো শব্দে ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল তারা। রথের উপর সিংহাসনের ‘ন্যায়’ একটা কিছু ছিল, যার উপর ‘মনুষ্যের আকৃতিবৎ এক মূর্তি ছিল,’ যা থেকে ‘প্রতপ্ত ধাতুর ন্যায় আভা’ দেখা যাচ্ছিল; আবার তা ‘সদাপ্রভুর প্রতাপের মূর্ত্তির আভা’র মতো ছিল। ‘বিলাপ, খেদোক্তি ও সন্তাপের কথা লেখা’ শাস্ত্রগ্রন্থ ধরা একটা হাত এগিয়ে আসে; জাতির কাছে স্বর্গীয় বাণী পৌঁছে দেওয়ার আগে বেদনাদায়কভাবে তাঁর সময়ের সহিংসতা ও বিষাদকে আত্মস্থ করতে তা খেতে বাধ্য হন ইযেকিয়েল। 

ঈশ্বর বোধের অতীত হয়ে গিয়েছিলেন- তেল আবিবে নিজেকে যেন আগন্তুক মনে করেছিলেন ইযেকিয়েল। নির্বাসনের আঘাত ডিউটেরোনমিস্টদের পরিচ্ছন্ন যৌক্তিক ঈশ্বরকে চুরমার করে দিয়েছিল; তাঁকে আর ইয়াহওয়েহকে আর আব্রাহামের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া বন্ধু বা দাপটের সঙ্গে সভাপত্বিকারী স্বর্গীয় সভার রাজার মতো মনে হচ্ছিল না; সম্পূর্ণ দুজ্ঞেয়, মানবীয় যেকোনও রূপের অতীত ছিলেন তিনি। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া লিপিতে ডিউটেরোনমিস্টদের সেফার তোরাহর মতো স্পষ্ট কোনও দিকনির্দেশনা ছিল না; কোনও নিশ্চয়তা মেলেনি এ থেকে, বরং বেদনা ও বিষাদের অপূর্ণ আর্তনাদ তুলে ধরেছে। সেটা ছিল যুদ্ধের বিভ্রান্তি আর ত্রাসে ভরপুর সামরিক দর্শন। স্বর্গীয় সিংহাসনের বদলে আজকের দিনের ট্যাংক বা ফাইটার জেটের মতো এক যুদ্ধ রথে চেপে হাজির হয়েছেন ইয়াহওয়েহ। ইয়েকিয়েলের প্রচারের বাণী ছিল হুমকির চেয়ে সামান্য বেশী কিছু। ‘উদ্ধত ও দুর্বিনীত’ নির্বাসিতদের সতর্ক করে তাঁকে বলে দিতে হবে যে ‘তাহাদের মাঝে একজন পয়গম্বর রহিয়াছেন—তাহারা শুনুক বা না শুনুক।’ কোনও রকম করুণা বা সান্ত্বনার অবকাশ থাকবে না। ইযেকিয়েলকে বাকি জনগণের মতোই উদ্ধত ও দুর্বিনীত করে তুলতে যাচ্ছেন ইয়াহওয়েহ, ‘তাহার সিদ্ধান্ত হীরকের ন্যায় কঠিন আর হীরক লৌহের চাইতেও কঠিন।’ সবশেষে প্রচণ্ড শোরগোলের উপরে তুলে নেওয়া হয় ইযেকিয়েলকে। নিজের উপর ইয়াহওয়েহর হাত ‘ভারি’ হয়ে চেপে বসার অনুভূতি লাভ করলেন তিনি: ‘তিক্ততা ও ক্রোধে,’ অভিভূত হয়ে গেল তাঁর হৃদয় এবং এক সপ্তাহ ‘হতবুদ্ধি মানুষের ন্যায়’ তেল আবিবে শুয়ে থাকলেন তিনি। 

তারপরেও সান্ত্বনা ছিল। ইযেকিয়েল লিপি খেয়ে এর দুকূল ছাপানো দুঃখ ও ভীতি গ্রহণ করার পর ‘মধুর ন্যায় মিষ্টি লাগিল।২৩ ইয়াহওয়েহ কোনওরকম শান্তি বয়ে না আনলেও বাস্তবতা হলো যে নির্বাসনে থাকা জাতির কাছে এসেছিলেন তিনি। মন্দির তখনও অক্ষত ছিল, তবুও ইয়াহওয়েহ জেরুসালেমের উপাসনালয় ছেড়ে এসেছেন, নির্বাসিতদের সঙ্গে একাত্ম করেছেন নিজেকে। পরবর্তী ভাষ্যগুলোতে জুদাহবাসীদের রয়ে যাওয়া বহুঈশ্বরবাদীতা ও নীতিহীনতা ইয়াহওয়েহকে তাঁর শহর থেকে বিতাড়িত করেছিল বলে প্রত্যক্ষ করবেন ইযেকিয়েল।” তবে নির্বাসিতদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, বিপর্যয়ের [২৪] জন্যে তাদেরও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। ৫৯৭ সালের দেশান্তরীদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া ছিল ইযেকিয়েলের মিশন। পুনর্গঠনের কোনও কল্পকথার অস্তিত্ব ছিল না; তাদের দায়িত্ব ছিল অনুশোচনা করা এবং–কোনওভাবে—বাবিলনে সঠিক শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন গড়ে তোলা। কিন্তু তাদের বিষাদের পুরো ভার উপলব্ধি না করা পর্যন্ত এটা করতে পারবে না তারা। 

সম্ভবত ইযেকিয়েলের ব্যক্তিগত স্থানচ্যুতিও তাঁর এই অদ্ভুত বিকৃত তৎপরতায় প্রকাশ পেয়েছে-লোকের বিপদ বোঝানোর জন্যে পালন করতে বাধ্য হয়েছেন মনে করা অদ্ভুত মুকাভিনয়ের দায়িত্ব। ইযেকিয়েলের স্ত্রীর মৃত্যু হলে ইয়াহওয়েহ তাঁর শোক পালন নিষিদ্ধ করেন; আরেকবার ইয়াহওয়েহ ইযেকিয়েলকে একপাশে ফিরে ৩৯০ দিন ও অন্যপাশে ফিরে ৪০ দিন মেঝেয় শুয়ে থাকার হুকুম দেন, নিজেকে গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ দেন এবং তিনি যাতে কথা বলতে না পারেন সেজন্যে তালুর সঙ্গে তাঁর জিভ আটকে দেন। একবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে তেল আবিবের পথে পথে শরণার্থীর মতো ঘুরে বেড়াতে তাঁকে বাধ্য করেন ইয়াহওয়েহ। তিনি এমন প্রবল উদ্বেগে আক্রান্ত হয়েছিলেন যে কাঁপুনি থামাতে পারছিলেন না, স্থির হয়ে বসতে পারেননি, অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানচ্যুত লোকদের বেলায় এমনটাই ঘটে—সতীর্থ নির্বাসিতদের যেন বলছিলেন তিনি: জগৎ ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় তাদের আর স্বাভাবিক ছিল না। বিশ্রাম করতে পারে না তারা বা কোথাওই স্বস্তি পায় না। নির্বাসিতরা এই ব্যাপারটা পুরোপুরি উপলব্ধি না করতে পারলে-বাস্তবতা না বুঝলে-সামলে উঠতে পারবে না। ভালো ভালো কথা ভাবা বা নিজেদের শিগগিরই আবার দেশে ফেরার কথা বলে সান্ত্বনা খুঁজে কোনও ফায়দা নেই, কেননা সেটা মোটেই ঠিক না। তাদের অবশ্যই এইসব মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

ইযেকিয়েল পুরোহিত ছিলেন, মন্দিরের আচারের প্রেক্ষিতে সংকটের ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু তাঁর জাতির নৈতিক অবনতি শনাক্ত করতে গিয়ে প্রথাগত শাস্ত্রীয় রীতি ব্যবহার করেছেন। ৫৮৬ সালে জেরুসালেম ধ্বংসের কিছু আগে এক দিব্যদর্শনের মুখোমুখি হয়েছিলেন ইযেকিয়েল যেখানে ইয়াহওয়েহর জেরুসালেম থেকে বিতাড়িত হওয়ার কারণ দেখানো হয়েছিল তাঁকে। মন্দিরে এক নির্দেশিত সফরে নিয়ে যাওয়া হলে আতঙ্কের সঙ্গে তিনি লক্ষ করেন যে বিপর্যয়ের প্রান্তে পৌঁছেও জুদাহর জনগণ তখনও ইয়াহওয়েহ বাদে অন্য দেবতাদের উপাসনা করছে। মন্দির পরিণত হয়েছে এক দুঃস্বপ্নের মতো জায়গায়, কিলবিলে সাপ আর বিরক্তিকর পশুতে রঞ্জিত মন্দিরের দেয়াল। ‘নোংরা’ আচার পালনকারী পুরোহিতদের শোচনীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, প্রায় যেন তারা গোপন, অসঙ্গত যৌনতায় লিপ্ত: ‘হে মনুষ্য সন্তান, ইস্রায়েল কুলের প্রাচীন-বর্গ অন্ধকারে, প্রত্যেকে আপন আপন ঠাকুর ঘরে কি কি কার্য্য করে, তাহা কি তুমি দেখিলে?”২৫ আরেক কামরায় মহিলারা বসে আনোতোলিয় বৃক্ষ দেবতা তাম্মুযের জন্যে শোক করছিল। জুদাহর অন্য নাগরিকরা ইয়াহওয়েহ যেখানে বাস করতেন সেই পরম পবিত্র স্থানের দিকে পেছন ফিরে সূর্য দেবতার পূজা করছিল। 

তবে লোকজন যুগপৎ নৈতিক ও আচরিকভাবেও ইয়াহওয়েহকে প্রত্যাখ্যান করছিল। ইযেকিয়েলের স্বর্গীয় পথপ্রদর্শক তাঁকে বলেন যে, ইসরায়েল ও জুদাহর অপরাধ ‘অতি ভারী; এবং দেশ রক্তে পরিপূর্ণ ও নগর অত্যাচারে পরিপূর্ণ; কারণ তাহারা বলে ‘সদাপ্রভু দেশ ত্যাগ করিয়াছেন, সদাপ্রভু দেখিতে পান না। ২৬ আন্তর্জাতিক আগ্রাসনের এই পৃথিবীতে জুদাহবাসীদের পরস্পরের উপর চাপিয়ে দেওয়া সহিংসতা নিয়ে ইযেকিয়েলের আচ্ছন্ন থাকাটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। সংস্কারকে অবশ্যই তাদের নিজস্ব ব্যর্থতার পরিষ্কার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে একটি উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হওয়ার দরকার ছিল। নিষ্ঠুরতার জন্যে বাবিলনবাসীদের দায়ী করার বদলে, প্রতিপক্ষের উপর নিজেদের বেদনা আরোপ না করে, ইযেকিয়েল সতীর্থ নির্বাসিতদের নিজের ঘরের দিকে তাকাতে বাধ্য করেছেন। মন্দির কাল্টে রক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর আগপর্যন্ত বেশির ভাগ পৌরহিত্যসুলভ আলোচনা আচার কেন্দ্রিক ছিল; কিন্তু ইযেকিয়েল এবার রক্তকে হত্যা, আইনহীনতা ও সামাজিক অবিচারের প্রতীকে পরিণত করেছিলেন।২৭ অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন নৈতিক ঔচিত্যবোধ দিয়ে আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল। এইসব সামাজিক অপরাধ ঠিক বহু ঈশ্বরবাদীতার মতোই মারাত্মক ছিল, আসন্ন বিপর্যয়ের জন্যে ইস্রায়েল কেবল নিজেকে দায়ী করতে পারত। দিব্যদর্শনের শেষে ইয়াহওয়েহর রথকে পবিত্র শহর থেকে স্বর্গীয় প্রতাপ সঙ্গে নিয়ে অলিভ পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে যেতে দেখেন ইযেকিয়েল। 

দেশে রয়ে যাওয়া জুদাহবাসীদের জন্যে আশার কিছু ছিল না, যাদের পাপাচার ও রাজনৈতিক প্রতারণা জেরুসালেমের ধ্বংস বয়ে আনবে। জেরেমিয়ার মতো ইযেকিয়েলেরও তাঁর জাতির জন্যে কোনও ফুরসত ছিল না। কিন্তু ইয়াহওয়েহ নির্বাসিত দেশান্তরীদের সঙ্গে বাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভবিষ্যতের আশা ছিল। নিজের দুর্দশা ও আপাত বিক্ষিপ্ত অবস্থা সত্ত্বেও ইযেকিয়েলের এক নতুন জীবনের দর্শন ছিল। নির্বাসিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা মানুষের হাড়ে ভরা ক্ষেত দেখতে পান তিনি; তারা বলে যাচ্ছিল: ‘আমাদের হাড়গোড় শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, আমাদের আশা তিরোহিত হইয়াছে; আমরা মৃতবৎ।’ কিন্তু ইযেকিয়েল হাড়ের উপর ভাববাণী উচ্চারণ করলেন আর তাহাতে আত্মা তাহাদের মধ্যে প্রবেশ করিল, এবং তাহারা জীবিত হইল, ও আপন আপন পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইল; সে অতিশয় মহতী বাহিনী।২৮ সম্পূর্ণ অনুশোচনা করার পর নির্বাসিতদের একদিন আবার দেশে ফিরিয়ে নেবেন ইয়াহওয়েহ। কিন্তু সাধারণ কোনও পনুর্বাসন হবে না এটা। জেরেমিয়ার মতো ইযেকিয়েল জানতেন নির্বাসনের কষ্টকে অবশ্যই গভীরতর দর্শনের দিকে চালিত করতে হবে। ইয়াহওয়েহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন: ‘আমি তাহাদিগকে একই হৃদয় দান করিব, ও তোমাদের অন্তরে এক নতুন আত্মা স্থাপন করিব; আর তাহাদের মাংস হইতে প্রস্তরময় হৃদয় দূর করিব, যেন তাহারা আমার বিধিপথে চলে। ২৯ প্রথম দিব্যদর্শনে ইয়াহওয়েহ ইযেকিয়েলকে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর হৃদয়কে চকমকি পাথরের মতো কঠিন করে তুলবেন। কিন্তু ইযেকিয়েল-এবং সম্ভবত নির্বাসিতদের অন্য কেউ কেউ—তাঁদের কষ্ট আত্মস্থ করায়, নিজেদের দায়িত্ব গ্রহণ করায় এবং হৃদয়কে নমনীয় হতে দেওয়ায় মানবীয় হয়ে উঠেছিলেন। 

সবশেষে সম্ভবত জীবনের শেষদিকে জেরুসালেমের ধ্বংসের পর একটা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় ইয়াহওয়েহ শাম (‘ইয়াহওয়েহ এইখানে আছেন!’) নামে এক শহরের দিব্যদর্শন লাভ করেছিলেন ইযেকিয়েল। ইযেকিয়েলের কোনও শিষ্যের হাতে এই অধ্যায়গুলো সম্পাদিত ও পবিরর্ধিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মূল ধারণা সম্ভবত খোদ পয়গম্বরের কাছ থেকেই এসেছে। জেরুসালেম ও এর মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও পয়গম্বরের হৃদয়ে তা অক্ষত ছিল; সেগুলোর জাদুকরী তাৎপর্য প্রত্যক্ষ করেছেন ইযেকিয়েল। স্বর্গোদ্যানের অনুকৃতি হিসাবে সলোমনের মন্দিরের নকশা করা হয়েছিল; এবার এক পার্থিব স্বর্গের দিকে তাকিয়ে আছেন বলে আবিষ্কার করেছেন ইযেকিয়েল। নগরের কেন্দ্রে একটা মন্দির ছিল; স্যাঙ্কচুয়ারির নীচ থেকে তিরতির করে বেরিয়ে এসেছে একটা নদী, পবিত্র পাহাড়ের বুক দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় চারপাশের পল্লী এলাকা সারিয়ে তুলে জীবন ফিরিয়ে আনছে। নদীর কিনারে গাছপালা গজিয়েছে ‘তাহার পত্র ম্লান হইবে না, ও ফল শেষ হইবে না… তাহার ফল আহারের জন্যে ও পত্র আরোগ্যের নিমিত্ত ব্যবহৃত হইবে।’৩১ মন্দির ছিল গোটা বিশ্বের নিউক্লিয়াস; এ থেকে স্বর্গীয় শক্তি বিচ্ছুরিত হয়ে এককেন্দ্রিক তরঙ্গমালার মতো ইসরায়েলের ভূমি ও জনগণের কাছে পৌঁছেছে। উৎস থেকে যতই দূরে সরে গেছে প্রতিটি অঞ্চলে ততই পবিত্রতা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। 

নগরীকে ঘিরে রাখা প্রথম বৃত্তটি ছিল রাজা ও পুরোহিত, পবিত্র কর্মীগণের আবাস। এর পরের অঞ্চল ইসরায়েলের গোত্রগুলোর জন্যে খানিকটা কম পবিত্র। কিন্তু পবিত্রতার আওতার বাইরে, ভূমির বাইরে গোয়িমদের-বিদেশী জাতি-জগৎ। মন্দির কাল্টে ইয়াহওয়েহ ছিলেন কাদ্দোশঃ বিচ্ছিন্ন’ ও ‘অপর’। এখন মন্দির খোয়া গেলেও ইসরায়েল বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে পবিত্রতায় অংশ নিতে পারে। পুনর্বাসিত সম্প্রদায়ের এই ছবি ভবিষ্যতের বিস্তারিত পরিকল্পনা বা স্থাপত্য পরিকল্পনা ছিল না। এটা ছিল ভারতীয় জনগণ যাকে বলবে মান্দালা বা ধ্যানের প্রতীক, ২ সঠিকভাবে বিন্যস্ত স্বর্গমূখী জীবনের ছবি। এমনকি নির্বাসনেও ইয়াহওয়েহ তাঁর জাতির সঙ্গেই ছিলেন; গোয়িমদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যেন এখনও মন্দিরের পাশেই বাস করছে। তারা অবশ্যই ভাইয়ের মতো হয়ে যাবে না বা মিশে যাবে না, বরং চেতনার দিক থেকে ইয়াহওয়েহর চারপাশে সমবেত হবে। বাবিলোনিয়ায় প্রান্তিক বাসী হলেও তারা বহুঈশ্বরবাদী প্রতিবেশীদের চেয়ে ঢের বেশী কেন্দ্রের কাছাকাছি, মানচিত্রে যাদের অবস্থান নেই বললেই চলে। কিন্তু এই সময়ে অন্তস্থঃ জীবনের উপর গুরুত্ব আরোপ থেকে এমনও বোঝাতে পারে যে বিবরণ ইযেন্তিয়লের শিষ্যদের মন্দিরকে আত্মস্থ করে একে অন্তস্থঃ বাস্তবতায় পরিণত করতে সক্ষম করে তুলেছিল। পবিত্রতার বৃত্ত নিয়ে ধ্যান করে তাদের পুরোপুরি কর্মক্ষম করে তোলা দিকদর্শন নিজস্ব ‘কেন্দ্র’ আবিষ্কার করতে পেরেছে তারা। নির্বাসিতরা উপনিষদের সাধুদের মতো তীব্রভাবে মননকে বিশ্লেষণ করেনি, তবে এটা সম্ভব যে এই মান্দালা নিয়ে ধ্যান করার সময় কেউ কেউ তাদের অস্তিত্বের গভীরে এক ধরনের স্বর্গীয় সত্তা অনুভব করেছে। 

ইয়াহওয়েহ শামের উপর ধ্যানের পেছনে ইযেকিয়েল উৎসর্গ, আচারের পোশাক আর মন্দিরের মাপজোখ ও অনুপাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা আমাদের বলছেন, সামাজিক অনিশ্চয়তার কালে আচারের নতুন ধরনের গুরুত্বের দরকার পড়ে। বিশেষ করে স্থানচ্যুত লোকদের ভেতর দলকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা সীমানা টিকিয়ে রাখার চাপ এবং সম্প্রদায়কে সংখ্যাগরিষ্ঠের সংস্কৃতিকে ঠেকাতে সাহায্যকারী শুদ্ধতা, দূষণ ও মিশ্র বিয়ের ব্যাপারে এক ধরনের নতুন উদ্বেগ থাকে। ইযেকিয়েলের দিব্যদর্শন নিশ্চিতভাবে এক প্রতিরক্ষার মানসিকতা তুলে ধরেছে। তাঁর কাল্পনিক নগরে কোনও বিদেশীর প্রবেশাধিকার ছিল না; সব জায়গায় কেবল হুমকি সৃষ্টিকারী বহির্বিশ্ব থেকে ইসরারেয়লের পবিত্রতাকে অবরুদ্ধ করে রাখা দেয়াল আর তোরণ। 

ইযেকিয়েল ছিলেন অন্যতম শেষ গুরুত্বপূর্ণ পয়গম্বরদের একজন। ইসরায়েল ও জুদাহয় পয়গম্বরত্ব সবসময়ই রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, রাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই তা গুরুত্ব হারাতে শুরু করেছিল। কিন্তু মন্দিরের দায়িত্ব পাওয়া পুরোহিতরা উদ্ধারের অতীত হারিয়ে যাওয়া এক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের শেষ সূত্র হিসাবে এক নতুন গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন। মন্দির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর হতাশায় ডুবে যেতে পারতেন তাঁরা, কিন্তু তার বদলে নির্বাসিত পুরোহিতদের একটা ছোট দল পুরোনো আধ্যাত্মিকতার ধ্বংসাবশেষের উপর ভিত্তি করে এক নতুন আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি আমরা। পণ্ডিতরা বাইবেলের এই যাজকীয় স্তরটির নাম দিয়েছেন P, তবে এই P কোনও একজন ব্যক্তি নাকি যাজকীয় একদল লেখক ও সম্পাদক হতে পারেন কিনা আমরা তা জানি না। তাঁরা যারাই হোন না কেন, বিভিন্ন ঐতিহ্যের উপর দখল ছিল P-র; কোনওটা লিখিত আবার কোনও মৌখিকভাবে প্রচলিত।” হয়তো নির্বাসিত রাজা জেহোয়াচিনের রাজকীয় দরবারের মহাফেজখানায় বসেই কাজ করেছেন তাঁরা। P-র নাগালে থাকা দলিলের ভেতর J E বিবরণ, গোষ্ঠীপিতাদের বংশলতিকা এবং চল্লিশ বছর বুনো এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় ইসরায়েলিরা কোথায় কোথায় শিবির করেছিল বলে বিশ্বাস করত তার তালিকার একটি প্রাচীন আচরিক টেক্সট অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে P-র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল পবিত্রতার বিধি (সপ্তম শতাব্দীতে সংগৃহীত নানা ধরনের বিধিবিধান) আর P-র বিবরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ট্যাবারন্যাকল দলিল, যেখানে বুনো এলাকায় স্বর্গীয় সত্তার অবস্থানের জন্যে ইসরায়েলিদের তৈরি করা তাঁবু-উপাসনালয়ের বর্ণনা রয়েছে। মোজেস এখানে ইয়াহওয়েহর সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁর কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছিলেন বলে মিলনের তাঁবু বলা হতো এটাকে। P-র কিছু কিছু উপাদান প্রকৃতপক্ষেই প্রাচীন ছিল, তাঁর ভাষাও ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রাচীন, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য প্রাচীনপন্থী ছিল না। আপন জাতির জন্যে একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। 

JE কাহিনীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করেন P, লেভিতিকাস ও নাম্বারস পুস্তকের জন্যেও তিনি দায়ী। বেশিরভাগ পাঠক যাজকীয় এই কাহিনীকে অসম্ভব কঠিন আবিষ্কার করেন; সাধারণত এগুলো অন্তহীন জটপাকানো উৎসর্গের বর্ণনা আর বোধের অতীত বিস্তারিত খাদ্যরীতি বাদ দিয়ে যায়। মন্দির বিধ্বস্ত হওয়ায় বাতিল হয়ে যাওয়া নানা আচারের বয়ান দেওয়ার দিকে যাওয়া কেন? নির্বাসিতরা যেখানে অশুচি দেশে বাস করছে সেখানে আর পরিশুদ্ধতার উপর এত জোর দেওয়া কেন? প্রথম দর্শনে P-র বাহ্যিক বিধিবিধান ও আচারের আচ্ছন্নতাকে অ্যাক্সিয়াল যুগ থেকে অনেক দূরের মনে হয়, কিন্তু তারপরেও বহু ইস্যুতেই বৈদিক উৎসর্গের পরিমার্জনাকারী সংস্কারকদের সঙ্গে তাঁর মিল ছিল। নির্বাসিতরা ভিন্নভাবে বাস করবে, এটাই চেয়েছিলেন P; একথা মাথায় রেখে তিনি বিশ্বাস করেছেন যে, এইসব বিধান তাদের এক আত্মাহীন দেশে বন্দি করবে না, বরং এক গভীর স্তরে বদলে দেবে। 

আদি পুস্তকের প্রথম অধ্যায়, যেখানে ইসরায়েলের ঈশ্বর কিভাবে ছয় দিনে স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সম্ভবত P-র সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা; শুরু করার জন্যে এটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা। প্রথম সৃষ্টি কাহিনী শোনার সময় তাঁর শ্রোতারা সহিংস সংগ্রামের বয়ান শোনার প্রত্যাশা করেছিল। বাবিলনে বাস করছিল নির্বাসিতরা, যেখানে নববর্ষে দর্শনীয় প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে আদিম সাগর তিয়ামাতের বিরুদ্ধে মারদুকের বিজয় পুনরাভিনীত হতো, আর পৃথিবী সৃষ্টির সময় ইয়াহওয়েহর সাগর-দানো হত্যা করার নানা কেচ্ছা চালু ছিল। সুতরাং শ্রোতারা P-র সূচনাবাক্যে সাগরের উল্লেখে বিস্মিত হতো না: ‘আদিতে ঈশ্বর আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপরে অবিস্থতি করিতেছিলেন। কিন্তু এরপরই তাদের চমকে দেন P। যুদ্ধ বা হত্যার কোনও ব্যাপার ছিল না। ঈশ্বর স্রেফ তাঁর নির্দেশ উচ্চারণ করলেন: ‘পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক!’ আর অমনি-কোনও রকম সংঘাত বাদেই আলোর দেখা মিলল। আরও কিছু হুকুম জারি করে বিশ্বকে বিন্যস্ত করলেন ঈশ্বর : ‘আকাশ মণ্ডলের সমস্ত জল এক স্থানে সংগৃহীত হউক!’ ‘ভুমি তৃণ বীজোৎপাদক ওষধি ও সবীজ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উৎপাদক ফল বৃক্ষ, ভূমির উপরে উৎপন্ন করুক!’ এবং সবশেষে : ‘আমরা আমাদের প্রতিমূর্ত্তিতে, আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি!’ এবং প্রত্যেকবার কোনও রকম সংঘাত ছাড়াই “তাহা হইল। ৩৭ ভারতীয় শাস্ত্রজ্ঞরা যেভাবে সহিংসতাকে পদ্ধতিগতভাবে আচার-অনুষ্ঠান থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন ঠিক সেভাবে P পদ্ধতিগতভাবে প্রচলিত সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে আগ্রাসনকে উচ্ছেদ করেছিলেন। 

লক্ষণীয় আধ্যাত্মিক সাফল্য ছিল এটা। দেশান্তরীরা ভীতিকর আক্রমণের শিকার ছিল। বাবিলোনিয়রা তাদের মাতৃভূমি ধ্বংস করেছে, তাদের শহর-বন্দর ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে, তাদের সমস্ত মন্দির ভূমিস্যাৎ করেছে এবং জোর করে তাদের দেশান্তরে পাঠিয়েছে। আমরা জানি যে তাদের কেউ কেউ বাবিলোনিয়দের একইভাবে প্রতিদান দিতে চেয়েছে: 

হে বাবিল-কন্যা, হে বিনাশপাত্রি,
ধন্য সেই, যে তোমাকে সেই রূপ প্রতিফল দিবে,
যেরূপ তুমি আমাদের প্রতি করিয়াছ।
সেই ধন্য, যে তোমার শিশুগণকে ধরে,
আর শৈলের উপরে আছড়ায়?৩৮ 

কিন্তু P যেন তাদের বলছেন এটা চলার পথ নয়। তাঁর সৃষ্টি-কাহিনীকে তাদের বাবিলোনিয় বিজেতাদের ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি হিসাবে দেখা যেতে পারে। মারদুকের চেয়ে ঢের বেশী শক্তিশালী ছিলেন ইয়াহওয়েহ। বিশ্বকে রূপ দিতে গিয়ে সতীর্থ দেবতাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে নামতে হয়নি তাঁকে; সাগর ভীতিকর কোনও দেবী ছিল না, বরং মহাবিশ্বের কাঁচামালমাত্র; এবং সূর্য, চাঁদ আর নক্ষত্রমণ্ডলী কেবল সামান্য সৃষ্টি ও দাসমাত্র। মারদুকের সৃষ্টিকে বাৎসরিক ভিত্তিতে নবায়ন করতে হতো, কিন্তু ইয়াহওয়েহ মাত্র ছয় দিনে তাঁর কাজ শেষ করেছেন, সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিতে পেরেছেন তিনি। তাঁর কোনও স্বৰ্গীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, তিনি তুলনাহীন, মহাবিশ্বের একমাত্র অবিসম্বাদিত শক্তি ইসরায়েলিরা অন্য জাতির ধর্মের ব্যাপারে কাঠোর সমালোচনামূলক হতে পারত, কিন্তু সেই পথে যাননি P। বাবিলোনিয় ধর্মের প্রতি সস্তা কোনও বিদ্রূপ নেই, তাঁর বিবরণ প্রশান্ত, শান্ত। নির্বাসিতরা দারুণ সহিংস উৎখাতের মোকাবিলা করলেও এটা এমন জগৎ যেখানে সবকিছুই রয়েছে সঠিক স্থানে। সৃষ্টির শেষ দিনে ঈশ্বর ‘আপনার নির্ম্মিত বস্তুসকলের প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সকলই উত্তম। তিনি তাঁর সকল সৃষ্টিকে আশীর্বাদ করেছেন, এবং ধরে নেওয়া যায় তাতে বাবিলোনিয়রাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবারই ইয়াহওয়েহর মতো আচরণ করা উচিত: সাব্বাথ দিবসে বিশ্রাম গ্রহণ, ঈশ্বরের দুনিয়ার সেবা করা ও তাঁর সকল সৃষ্টিকে আশীর্বাদ করা। 

ইচ্ছকৃতভাবেই ট্যাবারন্যাকলসের নির্মাণের সঙ্গে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে সম্পর্কিত করেছেন P1৪ মোজেসকে দেওয়া এই উপাসনালয়ের নির্মাণ সংক্রান্ত নির্দেশনায় ইয়াহওয়েহ একাজে ছয় দিন লাগবে বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘কিন্তু সপ্তম দিন তোমাদের পক্ষে পবিত্র দিন হইবে; তাহা সদাপ্রভুর উদ্দেশে বিশ্রামার্থক বিশ্রাম দিন হইবে।৪২ তাঁবুর সভা শেষ হওয়ার পর ‘মোশি সকল কার্য্যের প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, তাহারা করিয়াছে; সদাপ্রভুর আজ্ঞানুসারেই করিয়াছে; আর মোশি তাহাদিগকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। P-র দৃষ্টিতে মিশর থেকে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু ডিউটেরোনমিস্টদের চেয়ে একেবারেই ভিন্নভাবে কাহিনীকে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। সিনাই পাহাড়ে সম্পদিত কোভেন্যান্টের কথা আনেননি P, ইসরায়েল ইয়াহওয়েহর প্রতিশ্রুত ভূমি থেকে নির্বাসিত হওয়ায় তা বেদনাদায়ক, সমস্যাসঙ্কুল স্মৃতিতে পরিণত হয়েছিল।৪৪ P-র পক্ষে সেফার তোরাহয় নয়, তাঁবু-সভায় ঈশ্বরের জীবনাদায়ী উপস্থিতির প্রতি কাহিনীর ক্লাইমেক্স দান করা হয়েছে। 

ইয়াহওয়েহ মোজেসকে বলেছেন যে ‘ইস্রায়েল সন্তানদের মধ্যে বাস (সকন) করিবার’৪৫ জন্যে তিনি তাঁর জাতিকে মিশর থেকে বের করে এনেছেন। তাঁর ভ্রাম্যমাণ মন্দিরে স্বর্গীয় সত্তা ইসরায়েল জাতি যেখানে যাবে সেখানেই তাদের সঙ্গে থাকবেন। সাধারণত ‘বাস করা’ হিসাবে অনূদিত মূল শব্দ শাকান – এর আসল অর্থ ছিল ‘যাযাবর তাঁবুবাসীর মতো জীবন যাপন করা।’ P ইয়োব (‘বাস করা’)-এর বদলে স্থায়ী অবস্থান বোঝানো এই শব্দটিকেই পছন্দ করতেন। ঈশ্বর ভবঘুরে জাতির সঙ্গে ‘তাঁবু’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাঁর কোনও স্থায়ী নিবাস নেই, বিশেষ কোনও মন্দিরে আবদ্ধ নন তিনি, বরং ইসারায়েলিরা যেখানে যাবে সেখানেই তাদের সঙ্গে শাকান-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৪৬ ] E বিবরণ সম্পাদনার সময় তাঁবুর সভা দিয়ে যাত্রাপুস্তকের শেষ করেছিলেন, যখন ঈশ্বর তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন, যখন ইয়াহওয়েহর প্রতাপ ট্যাবারন্যাকল (মিশকান) পরিপূর্ণ করে রেখেছিল আর তাঁর উপস্থিতির মেঘ তাঁকে ঢেকে ফেলেছিল: 

আর আবাসের উপর মেঘ নীত হইলে,
ইস্রায়েল সন্তানগণ আপনাদের প্রত্যেক যাত্রায় অগ্রসর হয়…
কেননা সমস্ত ইস্রায়েল-কুলের দৃষ্টিগোচরে তাহাদের সমস্ত যাত্রাতে
দিবাতে সদাপ্রভুর মেঘ এবং রাত্রিতে অগ্নি
আবাসের উপরে অবস্থিতি করে। ৪৭ 

বর্তমান কাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইয়াহওয়েহ এখনও বাবিলনের পথে তাদের চলমান অভিযাত্রায় তাঁর জাতির সঙ্গেই আছেন। ঈশ্বরের মতো ইসরায়েল জাতিও ভ্রাম্যমাণ। ডিউটেরোনমিস্টদের মতো P জোশুয়ার বিজয়ের ভেতর দিয়ে কাহিনী শেষ করেননি, বরং ইসরায়েলিদের প্রতিশ্রুত ভূমির সীমান্তে এনে রেখেছেন।৪৮ একটি বিশেষ দেশে বাস করায় ইসরায়েল জাতি নয়, বরং ঈশ্বরের উপস্থিতিতে বাস করাই এর কারণ, যিনি তাঁর জাতি যেখানেই থাকুক না কেন তাদের সঙ্গে ভ্রমণ করেন। 

বুনো এলকায় শিবির করার P-র বিবরণ নির্বাসিতদের পক্ষে বিধানের প্রতি আবেগকে তুলে ধরে। রাতে শিবির খাটানো আর যাত্রার সময় প্রতিটি গোত্রের তাঁবুর চারপাশে স্বর্গীয় নির্ধারিত অবস্থান ছিল। গণনা পুস্তকে নিষ্ঠুরভাবে চূর্ণবিচূর্ণ করার ইসরায়েলের ইতিহাসকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দৃষ্টিনন্দন ধারায় উপস্থাপন করা হয়েছে। J E বিবরণে নিজস্ব যাজকীয় কাহিনী যোগ করে P বাবিলনে নির্বাসন নির্বাসনের করুণ দীর্ঘ ধারায় সর্বশেষ সংযোজনমাত্র দেখিয়ে ইসরায়েলের ইতিহাস নতুন করে তৈরি করেছেন: আদম ও হাওয়াকে জোর করে স্বর্গ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল; ভাইকে হত্যার পর কেইন চিরস্থায়ী ভবঘুরে পরিণত হয়েছিলেন; বাবেলের মিনারে বিদ্রোহের পর মানবজাতি পৃথিবীময় বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আব্রাহাম উর ত্যাগ করেছিলেন, গোষ্ঠীগুলো মিশরে পাড়ি জমিয়েছে এবং ইয়াহওয়েহ তাদের বন্দিত্ব থেকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু চল্লিশ বছর ধরে আপন জাতির সঙ্গে সিনাই মরুভূমিতে ‘তাঁবুবাস’ করেছেন তিনি, এবং-তাৎপর্য ছিল-বাবিলনে সর্বশেষ অভিবাসনের ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর জাতির মাঝেই অবস্থান করছেন। 

নির্বাসিতদের সম্প্রদায় সম্ভবত ভালোরকম অসন্তোষ ও অভিযোগ করে চলছিল। P তাঁর বিবরণে বুনো প্রান্তরে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ‘বিড়বিড়ানির’ কাহিনী নির্মাণ করেছেন।৫° নির্বাসিতরা ‘গোঁয়ার প্রজন্মও ছিল, ‘ কিন্তু তাদের সামনে বাড়ার পথ দেখিয়েছেন P। প্রাচীন যাজকীয় বিধিবিধান অনুসরণ করে জীবন যাপন করলে এমনকি নির্বাসনেও তারা এমন একটি সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারে যেখানে ঈশ্বরের সত্তার ফিরে আসা সম্ভব। চমকপ্রদ উদ্ভাবন ছিল এটা। অচল হয়ে পড়া প্রাচীন আইনকানুন পুনরুজ্জীবিত করছিলেন না P। মন্দিরের সেবাদানকারী পুরোহিতদের জীবনযাত্রা পরিচালনাকারী আচারের বিধান, পবিত্রতার বিধি ও খাদ্যবিধি সাধারণ মানুষের বেলায় প্রযোজ্য ছিল না।৫১ এবার বিস্ময়কর দাবি তুলে বসেছিলেন P। যে ইসরায়েলের জাতীয় মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে তা আসলে পুরোহিতদের জাতি। সবাইকে এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যেন তারা মন্দিরে স্বর্গীয় সত্তার সেবা করছে, কারণ ঈশ্বর এখনও তাদের সঙ্গে অবস্থান করছেন। P-র বিধান গোটা জীবনকেই আচারের আওতায় নিয়ে আসে, কিন্তু স্থানচ্যুতির অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এইসব প্রাচীন মন্দিরাচারকে এক নতুন নৈতিক বিপ্লব সূচিত করার কাজে লাগিয়েছেন তিনি। 

নির্বাসিতরা অপবিত্র দেশে বাস করলেও জোরের সঙ্গে নির্বাসন ও পরিশুদ্ধতার ভেতর গভীর সম্পর্ক থাকার কথা বলেছেন P। পবিত্রতার বিধিতে ঈশ্বর ইসরায়েলিদের বলেছিলেন: “তোমরা পবিত্র হও, কেননা আমি সদাপ্রভু তোমাদের ঈশ্বর পবিত্র।৫২ ‘পবিত্র’ হওয়ার জন্যে ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়া প্রয়োজন ছিল। ইয়াহওয়েহ ছিলেন ‘অপর’, মামুলি, অপবিত্র বাস্তবতা থেকে দারুণ অন্যরকম। P-র প্রস্তাবিত বিধিবিধান বিচ্ছিন্নতার নীতির উপর ভিত্তি করে একটি পবিত্র জীবনধারা নির্মাণ করেছিল। মানুষকে অবশ্যই বাবিলোনিয় পড়শীদের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বাস করতে হবে, স্বাভাবিক জাগতিক বিশ্বকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ভিন্নতাকে অনুকরণ করে ইয়াহওয়েহর মতোই পবিত্র হয়ে উঠবে তারা, ঈশ্বরের মতো একই অবস্থানে থাকতে পারবে। নির্বাসন যেহেতু বিচ্ছিন্নতার জীবন, এই অনুশীলন চর্চার জন্যে বাবিলনই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। লেবীয় পুস্তকে উৎসর্গ, খাদ্যভ্যাস ও সামাজিক, যৌন ও কাল্টিক জীবন সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধান জারি করেছেন ইয়াহওয়েহ। ইসরায়েল এইসব আইনকানুন পালন করলে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইয়াহওয়েহ, সবসময় তাদের মাঝে অবস্থান করবেন তিনি। ঈশ্বর ও ইসরায়েল একসঙ্গে পথ চলেছেন। তারা তাঁর নির্দেশনা অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিলে ইয়াহওয়েহ তাদের শাস্তিদাতা শক্তি হিসাবে ‘পথ চলবেন’। তিনি তাদের ভূমি ধ্বংস করবেন, মন্দির বিনাশ করবেন এবং বিভিন্ন জাতির মাঝে তাদের বিক্ষিপ্ত করে দেবেন। P বোঝাতে চেয়েছেন, এটা ঘটবেই। ইসরায়েলি জনগণ পবিত্রতার জীবন যাপন করেনি আর সেকারণেই তারা এখন নির্বাসিত। কিন্তু তারা অনুশোচনা করলে এমনকি তাদের শত্রুপক্ষের দেশেও ইয়াহওয়েহ তাদের কথা মনে করবেন। আর আমি তোমাদের মধ্যে আপন আবাস [ মিশকান রাখিব, আমার প্রাণ তোমাদিগকে ঘৃণা করিবে না। আর আমি তোমাদের মধ্যে গমনাগমন করিব, ও তোমাদের ঈশ্বর হইব।৫৪ বাবিলোনিয়া নতুন স্বর্গোদ্যানে পরিণত হতে পারে, যেখানে সন্ধ্যার শীতলতায় ঈশ্বর আদমের সঙ্গে হেঁটেছিলেন। 

অ্যাক্সিয়াল যুগের মানুষ P-র পক্ষে পবিত্রতার জোরাল নৈতিক উপাদান ছিল, স্রেফ প্রথাগত কোনও ব্যাপার ছিল না। এর সঙ্গে প্রতিটি সৃষ্টির পবিত্র ‘ভিন্নতা’র প্রতি পরম শ্রদ্ধা জড়িত ছিল। স্বাধীনতার বিধিতে, ৫৫ ইয়াহওয়েহ জোরের সঙ্গে বলেছেন, কোনও কিছুকেই এমনকি জমিনও দাসত্বের অধীনে আনা যাবে না বা স্বত্ব লাভ করা যাবে না। সুবর্ণ জয়ন্তীতে, প্রতি পঞ্চাশ বছরে যা ঘোষণা করতে হবে, সব দাসকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে ও ঋণ বাতিল হয়ে যাবে। ইসরায়েলিরা ভিন্ন, পবিত্র জীবন যাপন করলেও অবশ্যই আগন্তুককে ঘৃণা করতে পারবে না: ‘আর কোনও বিদেশী লোক যদি তোমাদের দেশে তোমাদের সহিত বাস করে, তোমরা তাহার প্রতি উপদ্রব করিও না। তোমাদের নিকট তোমাদের দেশীয় লোক যেমন, তোমাদের সহপ্রবাসী বিদেশী লোকও তেমনি হইবে। তুমি তাহাকে আপনার মতো প্রেম করিও; কেননা মিসর দেশে তোমরাও বিদেশী ছিলে।’৫৬ সহমর্মিতা ভিত্তিক বিধি ছিল এটা। দুর্ভোগের অভিজ্ঞতা অবশ্যই অন্য জাতির দুঃখবেদনা উপলব্ধির দিকে চালিত করতে হবে। আপনার একান্ত বিষাদের অবশ্যই আপনাকে অন্যের কষ্ট উপলব্ধিতে সক্ষম করে তুলতে হবে। P অবশ্য বাস্তববাদী ছিলেন। ‘ভালোবাসার’ নির্দেশের কারণে মানুষকে সারাক্ষণ প্রেমপ্রীতিতে পরিপূর্ণ থাকার প্রয়োজন পড়েনি। অনুভূতির কথা লিখছিলেন না P। এটা ছিল আইনি বিধান, যেকোনও আইনি সিদ্ধান্তের মতো কৌশলী ও স্বল্পভাষী ছিল P-র ভাষা, যেখানে আবেগের খাপ খাওয়ার কথা নয়। মধ্যপ্রাচ্যীয় চুক্তিতে ‘ভালোবাসা’র মানে ছিল সহায়ক, আনুগত্য ও বাস্তব সমর্থন যোগানো। সুতরাং, ভালোবাসার নির্দেশনা বাড়াবাড়ি রকমের ইউটোপিয় ছিল না, বরং সবার নাগালেই ছিল। 

শুরু থেকে শেষপর্যন্ত P-র দর্শন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল। কিন্তু তারপরেও প্রথম পাঠে খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কিত বিধিগুলোকে কর্কশ ও খেয়াল-খুশিমতো নৈর্বাচনিক মনে হয়। কিভাবে সৃষ্টির দিনে সকল প্রাণীকে আশীর্বাদকারী একজন ঈশ্বর তাঁরই সৃষ্টি কিছু প্রাণীকে ‘অপরিচ্ছন্ন’ বা এমনকি ‘অপবিত্র’ ঘোষণা করতে পারেন? আমরা স্বাভাবিকভাবেই ‘অশুচি’ ও ‘অপবিত্র’ শব্দগুলোকে নৈতিক ও আবেগীয় তাৎপর্য দিয়ে থাকি, কিন্তু হিব্রু তামেই (‘অশুচি’) ‘পাপপূর্ণ’ বা ‘নোংরা’ বোঝায়নি। কাল্টে এটা একটা পরিভাষাগত শব্দ ছিল, এর সঙ্গে কোনও আবেগী বা নৈতিক দ্যোতনা ছিল না। গ্রিসের মতো বিশেষ কিছু কাজ বা পরিস্থিতি নৈর্ব্যক্তিক মিয়াসমা সক্রিয় করে মন্দিরকে দূষিত করে সেখান থেকে ঈশ্বরকে বিতাড়ন করে। P-র পক্ষে মৃত্যু অপবিত্রতার মৌল ও আদি নমুনা ছিল: জীবন্ত ঈশ্বর মৃতদেহের সঙ্গে তুলনার অতীত। তাঁর কোনও সৃষ্টির লাশের সংস্পর্শে আসার পর তাঁর সামনে দাঁড়ানো অপমানকর ছিল। সবরকম প্রধান দূষণকারী-অসঙ্গতভাবে ক্ষরিত রক্ত, কুষ্ঠরোগ, বর্জ্য-অপবিত্র, কেননা এগুলো মৃতের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এমন এক জায়গায় অনুপ্রবেশ করেছে যেখানে তার অধিকার নেই।৫৮ মন্দিরে স্বর্গীয় সত্তার সেবক পুরোহিতদের মৃতদেহ ও পচনের সবরকম প্রতীক এড়িয়ে চলতে হতো। এখন ইসরায়েলিরা তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে বাস করছে বলে সবাইকে একই কাজ করতে হবে। 

কিন্তু-খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক-অন্যান্য মানুষ অপরিষ্কার বা দূষণকারী ছিল, এই শিক্ষা দেননি P। বহিরাগতদের সমাজের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যে পবিত্ৰতা ও অপবিত্রতার বিধি প্রণীত হয়নি। P-র বেলায় বিদেশীদের বর্জন না করে ‘ভালোবাসতে’ হবে। আপনার প্রতিপক্ষের তরফ থেকে দূষণ আসে না, আসে নিজের কাছ থেকেই। বিধি ইসরায়েলিদের অপবিত্র বিদেশীদের এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়নি, বরং সকল প্রাণকে সম্মান দিতে বলেছে। ‘অপরিষ্কার’ পশু খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী খাদ্যাভ্যাসের বিধিতে ভারতীয় অহিংসার নীতির বেশ কাছাকাছি চলে এসেছিলেন P। অন্যান্য প্রাচীন জাতির মতো ইসরায়েলিরা পশুর আচরিক হত্যাকে খুন মনে করত না। শিকারকে তা আরও নিরবয়ব ও আধ্যাত্মিক বস্তুতে পরিণত করত, এভাবে পবিত্র করা হয়নি এমন কোনও পশু হত্যা বা তার মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। P ডিউটেরোনমিস্টদের বৈধ ঘোষণা করা ‘সেক্যুলার পশু হত্যা’ নিষিদ্ধ করেন, ইসরায়েলিরা কেবল তাদের ভেড়া বা গবাদিপশুর পালের গৃহপালিত পশুই খেতে পারবে বলে বিধান জারি করেন তিনি। সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে ‘পবিত্র’ ও ‘খাঁটি’ পশু ছিল এগুলো, এবং সেকারণে ইসরায়েলের সঙ্গে ঈশ্বরের কোভেন্যান্টের অংশীদার; এগুলো তাঁরই সম্পদ, কেউই তাদের আঘাত করতে পারবে না। সাব্বাথের দিনে ‘পরিচ্ছন্ন’ পশুদের অবশ্যই বিশ্রাম দিতে হবে, কেবল কোনও ধরনের মরণোত্তর জীবন দেওয়া হলেই তাদের খাওয়া যেত কিন্তু কিছুতেই কুকুর, হরিণ এবং বনে বাসকারী অন্যান্য ‘অপবিত্ৰ’ প্ৰাণী হত্যা করা যাবে না। যেকোনও অবস্থায় ফাঁদ পেতে এদের ধরা, শিকার করা, হত্যা করা, ব্যবহার করা বা খাওয়া নিষিদ্ধ। এগুলো নোংরা বা বিতৃষ্ণা জাগানো ছিল না। জীবিত অবস্থায় ইসরায়েলিদের স্পর্শ করায় নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কেবল মৃত্যুর পরেই সেগুলো অপরিষ্কার হয়ে যেত।৬২ কোনও অপরিষ্কার পশুর 

। সংস্পর্শে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী বিধি একে রক্ষা করত, কারণ এর মানে মৃতদেহটির ছাল খসানো বা খণ্ডবিখণ্ড করা যেত না। সুতরাং, এসব শিকার করা বা ফাঁদে ফেলা ছিল অর্থহীন। একইভাবে ‘অপবিত্র’ (শেঙ্কেত) হিসাবে শ্রেণীকৃত পশু জীবিত অবস্থায় অপবিত্র ছিল না। একই কারণে মৃত অবস্থায় ইসারয়েলিদের এদের স্রেফ এড়িয়ে চলতে হবে। সাগর ও আকাশের এইসব ‘কিলবিল করা প্রাণী’ নাজুকদের সহানুভূতি জাগানোর কথা। উদাহরণ স্বরূপ, তিরি পাখি ছোট বলে অনায়াসে এগুলোকে বেপথে চালানো যায়। যেহেতু এগুলো দ্রুতপ্রজ ও ‘অসংখ্য’ তারা ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ও তাঁরই আওতাধীন। ঈশ্বরের সকল প্রাণীই তাঁর অনন্য সৃষ্টি। P এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে সেসব সৃষ্টি করার দিন ঈশ্বর পরিষ্কার ও অপরিষ্কার প্রাণী আশীৰ্বাদ করেছেন এবং প্লাবনের সময় পরিষ্কার অপরিষ্কার প্রাণী নির্বিশেষে সবাইকে রক্ষা করেছেন। কাউকে আঘাত দেওয়া তাই পবিত্রতার লঙ্ঘন। 

অবশ্য P-র মাঝে উদ্বেগের অন্তপ্রবাহের অস্তিত্ব ছিল। দেহের প্রাচীর ভেঙে পড়ার ভীতি থেকে সৃষ্ট কুষ্ঠরোগ, বর্জ্য ও রজঃস্রাব সংক্রান্ত বিধিমালা সম্প্রদায়ের স্পষ্ট সীমানা সৃষ্টির প্রতি উদ্বেগ তুলে ধরেছে। P-র সবকিছু নির্দিষ্ট জায়গায় থাকার বিশ্বের স্মৃতিচারণ স্থানচ্যুতির মানসিক আঘাত থেকে সৃষ্ট। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিষ্ঠুর শক্তির প্রদর্শনীতে নির্বাসিতদের জাতীয় অখণ্ডতা লঙ্ঘিত হয়েছিল। অসন্তোষ ও প্রতিশোধভিত্তিক ধর্মকে এড়িয়ে যাওয়া এবং সকল প্রাণীর পবিত্রতার নিশ্চয়তা দেওয়া একটি আধ্যাত্মিকতার সৃষ্টি ছিল নির্বাসিত পুরোহিত ও পয়গম্বরদের মহান সাফল্য। 

ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুতে গ্রিসের বিভিন্ন পোলিসে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী সামাজিক সঙ্কট অবশেষে অ্যাথেন্সে হানা দেয়। অ্যাট্টিকার গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা শোষণের অভিযোগ তুলে অভিজাতদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হয়। গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী মনে হয়েছিল। নাজুক অবস্থায় ছিল অভিজাত গোষ্ঠী: ঐক্যদ্ধ ছিল না তারা, তাদের না ছিল সেনাবাহিনী, না পুলিস বাহিনী, কৃষকদের অনেকেই প্রশিক্ষিত হোপলাইট ছিল; ফলে তারা ছিল সশস্ত্র ও বিপজ্জনক। প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর ভেতর ন্যায়সঙ্গত সমাধান এনে দিতে পারবেন এমন একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর খোঁজ করাই ছিল অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়। সোলনকে বেছে নেয় অ্যাথেন্স। ৫৯৪ সালে সংবিধান সংস্কারের ক্ষমতা দিয়ে ম্যাজিস্ট্র্যাট হিসাবে নিয়োগ দেয় তাঁকে। 

সঙ্কটের সময় বিভিন্ন পোলিসকে পরামর্শ দিতেন এমন কয়েক জন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর এক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন সোলন। প্রথমে সম্পূর্ণ বাস্তব বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়: অর্থনীতি, বেকারত্ব বা বাজে ফসল। কিন্তু ক্রমবর্ধমানহারে আরও বিমূর্ত, রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুও বিবেচনার জন্যে বেছে নেন এই ‘প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা’। গ্রিসে ব্যাপক ভ্রমণ করেছিলেন সোলন, গোষ্ঠীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় পোলিসকে ঘিরে রাখা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন তিনি। অ্যাথেন্সবাসীদের বলেন যে তারা দিসনোমিয়ায় (‘বিশৃঙ্খলা’) বাস করছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে বিপর্যয়ের দিকে। আদিতে গ্রিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণকারী রীতিনীতিতে ফিরে গিয়ে ইউনোমিয়া (‘সঠিক ব্যবস্থা’) সৃষ্টি করাই তাদের একমাত্র আশা। হোপলাইট ও সম্পদের উৎপাদক হিসাবে কৃষকরা পোলিসের পক্ষে অনিবার্য ছিল। তাদের দমন করার প্রয়াসে অভিজাতরা সমাজে এমন এক অস্বাস্থ্যকর ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে যা কেবল আত্মধ্বংসী হতে পারে। 

স্রেফ কিছু আইনকানুন বাৎলে দিয়েই সন্তুষ্ট হতে পারেননি সোলন। অভিজাত কৃষক নির্বিশেষে সবাইকে একটি সুবিন্যাস্ত সমাজের মূলে অবস্থিত নীতিমালা ও সরকারের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে চেয়েছেন তিনি। সকল নাগরিককে অবশ্যই দিসনোমিয়ার পরিস্থিতির কিছু পরিমাণ দায়িত্ব নিতে হবে। এটা কোনও স্বর্গীয় শাস্তি নয়, বরং মানবীয় স্বার্থপরতার ফল, কেবল সমন্বিত রাজনৈতিক প্রয়াসই আবার শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে পারে। দেবতারা মানুষের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেন না, পরিস্থিতির উত্তরণে কোনও স্বৰ্গীয় আইন পাঠাবেন না তাঁরা। অ্যাক্সিয়াল যুগ সাফল্য ছিল এটা। এক খোঁচায় রাজনীতিকে সেক্যুলারাইজ করে দিয়েছিলেন সোলন। প্রাচীনকালের হোলিস্টিক দর্শনে ন্যায়বিচার ছিল অলৌকিক বিধান যা এমনকি দেবতাদেরও পরিচালনা করে; এইসব পবিত্র নীতিমালার লঙ্ঘনকারী বাজে সরকার প্রকৃতির ধারায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু এসবের কোনও ফুরসত সোলনের ছিল না। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মেই চলে, নারী-পুরুষের কর্মকাণ্ড দিয়ে একে প্রভাবিত করা যাবে না। গ্রিকরা সমস্যার বিভিন্ন উপাদানকে আলাদা করে প্রতিটি অংশকে অখণ্ডতা দিয়ে তারপর যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছুনোর এক নতুন বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতির কথা ভাবতে শুরু করেছিল গ্রিকরা। কোনও সঙ্কটের ফল অনুমানে তাদের সক্ষম করে তুলবে, এমন কার্য ও কারণের প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন জ্ঞানী ব্যক্তিদের গোষ্ঠীটি। কোনও একটি বিশেষ পোলিসের একটি নির্দিষ্ট সমস্যার অতীতে লক্ষ করে সর্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য বিমূর্ত সাধারণ নীতিমালা আবিষ্কার করতে শিখছিলেন তাঁরা।৫ 

সোলনের ইউনোমিয়ার নীতি কেবল গ্রিক রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক ছিল না, বরং আদি গ্রিক জ্ঞান ও দর্শনকে রূপদানেও সাহায্য করেছে। ভারসাম্যের নীতির উপর ভিত্তি করে প্রণীত ছিল এটা। সমাজের কোনও একটি অংশ অন্যগুলোর উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না। নগরীকে অবশ্যই হোপলাইট ফ্যালাংক্সের মতো একই কৌশলে কাজ করতে হবে, যেখানে সকল যোদ্ধা সমন্বিতভাবে কাজ করে। কৃষকরা যাতে তাদের নিপীড়নকারী অভিজাতদের শক্তির পাল্টা জবাব দিতে পারে সেজন্যে অবশ্যই তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভার থেকে তাদের নিস্তার দিতে হবে। তো কৃষকদের ঋণ মওকুফ করে দেন সোলন; প্রাচীন গোত্রীয় আমলের সকল নাগরিকের জনপ্রিয় সংসদে অবশ্যই অভিজাত্যমূলক প্রবীণদের সভাকে ভারসাম্য দিতে হবে। অভিজাত গোষ্ঠীর ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করার জন্যে জন্মের বদলে বরং সম্পদের প্রেক্ষিতে মর্যাদা স্থির করে দেন সোলন: বছরে দুই শো বুশেলের চেয়ে বেশি শস্য, মদ বা তেল যেই উৎপদন করুক, সেই এখন সরকারি পদের উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করেন সোলন, যেকোনও নাগরিককে সিটি ম্যাজিস্ট্র্যাটদের বিচারের অধিকার দেন।৬৬ শিক্ষিত অ্যাথেন্সবাসীরা যাতে সেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারে দুটো কাঠের ফলকে এইসব নতুন আইন খোদাই করিয়েছিলেন তিনি। 

সোলন সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, একবার সমাজের ভারসাম্যহীনতা দূর হয়ে গেলে অভিজাতরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আরও ন্যায়সঙ্গত উপায়ে শাসন করবে। কিন্তু অবশ্যই অধিকার খোয়ানোয় অসন্তোষ বোধ করেছে তারা, নতুন ব্যবস্থা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দরিদ্র সাধারণের ভেতর অস্থিরতা ও হতাশা দেখা দিয়েছিল। সোলন যাতে তাঁর সংষ্কার বাস্তবায়িত করতে পারেন সেজন্যে অ্যাথেন্সে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করার তাগিদ দিয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু স্বৈরাচার ভারসাম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা হওয়ায় অস্বীকার করেন তিনি। স্বল্পমেয়াদে ব্যর্থ হয়েছিলেন সোলন: লোকে তখনও তাঁর ধারণার জন্যে তৈরি ছিল না। কিন্তু তাঁর সংস্কারের প্রতি ব্যাপক-বিস্তৃত আগ্রহ অন্যান্য পোলিস থেকে পিছিয়ে পড়া অ্যাথেন্সকে প্রগতির পুরোভাগে এনে দিয়েছিল। স্বৈরাচার প্রত্যাখ্যান করে আদর্শ নাগরিকের নতুন মাণদণ্ডও স্থির করেছিলেন সোলন, ব্যক্তিগত লাভের কথা না ভেবেই যিনি সেবা করেছেন এবং সাধারণ মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে চাননি।৬৭ 

কিন্তু ৫৪৭ সালে অ্যাথেন্সের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন একজন স্বৈরাচার। কাছের নগরী ব্রাওরনের পেইসিস্ত্রাতোসের পরিবার মেসিদোনের কাছে উত্তরের সমতল নিয়ন্ত্রণ করত, অ্যাথেন্সের বহু অসন্তুষ্ট লোকের নেতায় পরিণত হন তিনি। ৫১০ সাল পর্যন্ত তিনি ও তাঁর ছেলেরা নগরী শাসন করবেন। উদার, মোহনীয় ও ক্যারিশম্যাটিক পেইসিস্ত্রাতোস নগরের বেলায় উপকারী ছিলেন। দরিদ্রতর কৃষকদের উদার হাতে ঋণ দেন তিনি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং নগরের চারপাশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও সড়ক পথ সংস্কার করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটে, জনগণ আধ্যাত্মিক নবায়ন উপভোগ করে। 

অ্যাথেন্সে একটি স্পষ্ট ধর্মীয় কেন্দ্র সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন পেইসিস্ত্রাতোস। তিনি ও তাঁর ছেলেরা একটি পাথরের মন্দির ও পাথুরে পাহাড়ী পাদদেশ ধরে আরামদায়ক প্রবেশ পথ বানিয়ে অ্যাক্রোপলিসকে দর্শনীয় কাল্টস্থলে পরিণত করেন। সম্পদশালী পৃষ্ঠপোষকরা মোহনীয় পাথরের বনের মতো স্যাঙ্কচুয়ারি ঘিরে রাখা বিভিন্ন দেবতার মূর্তি স্থাপন করে। প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হওয়া প্যানাথেনিয়ার উৎসবকেও নব জীবন দান করেন পেইসিস্ত্রাতোস, নগরের জন্ম উদযাপন করা হতো এই অনুষ্ঠানে। এর নিজস্ব অ্যাথলিটিক ক্রীড়া ছিল ৬৯ নববর্ষের উদযাপনের ক্লাইমেক্স ছিল এটা এবং অ্যাথেন্সের আদি ইতিহাস পুনরাভিনীত কিছু অন্ধকার, বিভ্রান্তিকর আচার অনুষ্ঠিত হতো এরপর। এইসব আচারের একটিতে অ্যাক্রোপলিসে এক গভীর অপরাধ বোধ জাগিয়ে তোলার মতো করে একটি ষাঁড় উৎসর্গ করা হতো। মারাত্মক আঘাতদানকারী পুরোহিতকে পালাতে হতো; আদালত আহ্বান করা হতো; এবং হত্যার দায়ে অপরাধী সব্যস্ত ছুরিটিকে ফেলে দেওয়া হতো সাগরে। ‘ষাঁড় হত্যা’র (বোওফোনিয়া) এই প্রহসনের পেছনে প্রতিটি নাগরিক বিসর্জন ও খোদ সভ্যতার অভ্যন্তরে অস্তিত্ববান সহিংসতার ভীতি ওত পেতে থাকে-প্ৰচলিত আচারে প্রায়শঃই ভোঁতা হয়ে যাওয়া এক ধরনের ভীতি-যেকারণে কোনও ব্যক্তি বা কোনও কিছুকে সবসময়ই মাশুল গুনতে হয়। 

প্যানাথেনিয়ার বিজয় এইসব অস্বস্তিকর আচারের অপার্থিব আভাকে অপসারিত করেছে। নগরের ভেতর দিয়ে আয়োজিত একটি মিছিল ছিল উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু, অ্যাথেনার নতুন মন্দিরের পূব প্রান্তে অ্যাক্রোপলিসে শেষ হতো এটা। এখানে নগরী দেবীর কাল্ট প্রতিমার জন্যে বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে সভ্যতার বিজয় প্রতীকায়িত করা সাইক্লপসের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের বিভিন্ন দৃশ্যের এম্ব্রয়ডারি নকশাঅলা একটি নতুন জাফরান জোব্বা সমর্পণ করত। সকল নাগরিকই এই মিছিলে প্রতিনিধিত্ব পেত: তরুণ ইফিব (কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলে, যারা পূর্ণ নাগরিক হয়ে উঠছে), প্রবীণ, কারুশিল্পী, বিদেশী নাগরিক, অন্যান্য পোলিসের প্রতিনিধিদল এবং উৎসর্গের শিকার। নিজের কাছে ও অবশিষ্ট গ্রিক বিশ্বের কাছে এক চোখ ধাঁধানো পরিচয় নিশ্চিত করার প্রয়াসে প্রদর্শনীর বিষয় হয়ে উঠত অ্যাথেন্স। 

কিন্তু অধিকতর ব্যক্তিগত ধর্মীয় অভিজ্ঞতার আকাঙ্ক্ষা বোধ করতে শুরু করেছিল গ্রিকরা। অ্যাথেন্স থেকে আনুমানিক বিশ মাইল দূরে এলিউসিস শহরের একটি কাল্ট সিটি ছিল পেইসিস্ত্রাতোসের নির্মিত অন্যতম নতুন ভবন; বলা হয়ে থাকে, পারসেফোনের খোঁজ করার সময় দেবী দিমিতার কিছু সময় এখানে অবস্থান করেছিলেন। এলিউসিয় রহস্য কাল্ট এবার অ্যাথেন্সবাসীদের ধর্মীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এটা ছিল দীক্ষানুষ্ঠান যেখানে অংশগ্রহণকারী মনের পরিবর্তিত অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করত। আচারগুলো রহস্যের আবহে আবৃত থাকায় কি ঘটত কেবল তার একটা অসম্পূর্ণ ধারণা পাই আমরা, কিন্তু মনে হয় যে, দীক্ষার্জনকারীরা (মিস্তেই) দিমিতারের পদচিহ্ন অনুসরণ করত; তাঁর কাল্টের-মেয়ে হারানোয় তাঁর শোক, হতাশা, ভীতি আর ক্ষোভ-ভাগ নিত। তাঁর বেদনার অংশ নিয়ে এবং সবশেষে পারসেফোনের সঙ্গে মিলনের আনন্দে যোগ দিয়ে তাদের কেউ কেউ অন্ধকারের মূলে দৃষ্টিপাত করেছে, আগের মতো আর মৃত্যুকে ভয় পায়নি তারা! 

অ্যাথেন্সে শুরু হতো প্রস্তুতি। দুই দিন ধরে উপবাস পালন করত মিস্তাই সাগরের বুকে দাঁড়িয়ে পারসেফোনের সম্মানে শূকরছানা উৎসর্গ করত তারা; তারপর বিরাট দল বেঁধে পায়ে হেঁটে এলিউসিসের উদ্দেশে রওয়ানা হতো। এই সময়ের ভেতর উপবাস এবং কি ঘটতে যাচ্ছে তার কোনও ধারণা না থাকার কারণে উদ্বেগে দুর্বল হয়ে যেত তারা। আগের বছর দীক্ষাপ্রাপ্ত এপোপতাই তাদের সঙ্গে যাত্রা করত, তাদের আচরণ ছিল হুমকিসৃষ্টিকারী ও আগ্রাসী। ছন্দময় ও সম্মোহিতের মতো পরিবর্তনের দেবতা দিওনিসাসকে আহ্বান জানাত জনতা, নিজেদের উত্তেজনায় ভাসিয়ে দিত, তো মিস্তাই অবশেষে এলিউসিসে পৌঁছালে ক্লান্ত, ভীত ও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠত তারা। ইতিমধ্যে সূর্য পাটে বসে যেত, মশাল জ্বালানো হতো, এবং অপার্থিব মিটমিটে আলোয় দিক না হারানো পর্যন্ত পথে পথে ঘুরে বেড়াত মিস্তাইরা; এক সময় পুরোপুরি দিশাহারা হয়ে পড়ত তারা। এরপর দীক্ষা কক্ষের নিকষ অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তারপর বড্ড অস্পষ্ট হয়ে উঠত গোটা দৃশ্যপট। পশু উৎসর্গ করা হতো; হয়তো কোনও শিশুর উৎসর্গের ব্যাপার জড়িত থাকা এক ভীতিকর ‘অবর্ণনীয়’ ব্যাপার ঘটত, একেবারে শেষমুহূর্তে যা বাতিল করা হতো। এক ধরনের ‘উন্মোচন’ ছিল এটা; পবিত্র বাক্স থেকে একটা কিছু ওঠানো হতো। কিন্তু সবশেষে কোর ও দিমিতারের পুনর্মিলন পুনরাভিনীত হতো এবং দীক্ষিতকে আনন্দ ও স্বস্তিতে ভরে দেওয়া উচ্ছ্বসিত দৃশ্য ও পবিত্র অটলতায় রহস্যের সমাপ্তি ঘটত। এলিউসিসে একতাসিস, স্বাভাবিক, কর্মব্যস্ত সত্তা থেকে ‘বেরিয়ে এসে’ এক নতুন অন্তর্দৃষ্টির অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তারা। 

কোনও গোপন মতবাদ শিক্ষা দেওয়া হতো না। অ্যারিস্টটল পরে যেমন ব্যাখ্যা করবেন, কিছু শেখার জন্যে নয়, বরং তাদের বদলে দিয়েছে বলে মনে করা এক ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করতেই এলিউসিসে যেত মিস্তাই। ৭২ ‘রহস্য হল থেকে বের হয়ে এসেছি আমি, মিস্তাইদের একজন রোমন্থন করেছে, ‘নিজেকেই নিজের কাছে আগন্তুক মনে হয়েছে।৭৩ গ্রিক ইতিহাসবিদ পুতার্ক (সি. ৪৬-১২০) মনে করেছেন যে মরণ হয়তো এলিউসিনিয় অভিজ্ঞতার মতো হতে পারে: 

গোড়াতে বিক্ষিপ্ত হয়ে ঘুরে বেরিয়ে, অন্ধকারে গন্তব্যহীন কিছু ভীতিকর পথে ক্লান্তিকর বৃত্তে হাঁটতে হাঁটতে তারপর শেষের ঠিক আগে ভয়ঙ্কর সব ব্যাপার-ত্রাস ও শিহরণ, ঘাম ও বিস্ময়। এবং তারপর তোমার সঙ্গে মিলিত হতে চমৎকার আলো এগিয়ে আসে, খাঁটি অঞ্চল আর ময়দান, পবিত্র বাণী ও পবিত্র দৃষ্টি তোমাকে স্বাগত জানাতে তৈরি।৭৪ 

প্রবল মনস্তাত্ত্বিক নাটকের মাধ্যমে পরিচালিত চূড়ান্ত বিচ্ছেদ মানুষকে দেবতাদের উপভোগ করা স্বর্গসম সুখের অনুভূতি দিত। 

যৌক্তিক, বিশ্লেষণমূলক দৃঢ়তার সঙ্গে ভাবতে শিখছিল গ্রিকরা, কিন্তু আবার সময়ে সময়ে অযৌক্তিকের কাছে আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তাও বোধ করছিল। অ্যাথেনিয় দার্শনিক প্রোক্লাস (সি. ৪১২-৪৮৫) এলিউসিসের দীক্ষানুষ্ঠান আচারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা এক ধরনের সিম্প্যাথিয়া বলে বিশ্বাস করতেন, যাতে তারা নিজেদের বিস্মৃত হয়ে ‘আমাদের বোধের অতীত এক উপায়ে আচারে সম্পূর্ণ মগ্ন হয়ে স্বর্গীয়’ হয়ে যেত। সব মিস্তাই এই সাফল্য লাভ করত না; কেউ কেউ স্রেফ ‘আতঙ্কে আচ্ছন্ন’ হয়ে যেত ও ভয়ের কাছেই বন্দী হয়ে থাকত, কিন্তু অন্যরা নিজেদের ‘পবিত্র প্রতীকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারত, নিজেদের পরিচয় ত্যাগ করে দেবতাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত, স্বর্গীয় অধিকারের বোধ পেত। ভারতে লোকে অন্তর্মুখীনতার কৌশলে একই ধরনের সুখের অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করেছিল। এলিউসিসে এমনি কোনও অন্তস্থঃ যাত্রার ব্যাপার ছিল না; এটা অ্যাক্সিয়াল যুগের কোনও কোনও অতীন্দ্রিয়বাদীর অর্জিত নিঃসঙ্গ একতাসিস থেকে একেবারে ভিন্ন। কোনও প্রত্যন্ত বুনো কুঁড়ে ঘরে এলিউসিসের আলোকন ঘটেনি, বরং হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতেই তা ঘটেছে। প্রাচীন, অ্যাক্সিয়াল পূর্ববর্তী বিশ্বের অংশ ছিল এলিউসিস। দিমিতার ও পারসেফোনের অনুকরণের ভেতর দিয়ে তাঁদের মৃত্যু থেকে জীবনে ফিরে আসার পুনরাভিনয় করে মিস্তাই নিজস্ব সত্তাকে পেছনে ফেলে তাদের স্বর্গীয় আদর্শের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। 

একই কথা ছিল দিওনিসাসের রহস্যের বেলায়ও। এখানেও অংশগ্রহণকারীরা সৎ মা হেরার কারণে পাগল হয়ে আরোগ্যের খোঁজে গ্রিসের বনে বাদারে ও মিশরের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা, সিরিয়া ও ফ্রিগিয়ায় দিওনিসাসের উন্মত্ত ঘুরে বেড়ানো অনুসরণ করে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। দিওনিসাসের পৌরাণিক কাহিনীগুলো বিধ্বংসী উন্মাদনা ও ভীতিকর বাড়াবড়ির কথা বলে, কিন্তু তাঁর শহর কাল্ট ছিল সুবিন্যস্ত, যদিও সেখানে কিঞ্চিত সীমালঙ্ঘনের আভাসসহ কার্নিভালের পরিবেশ বিরাজ করত।৭৭ হেরার কাছ থেকে গা ঢাকা দিয়ে থাকার সময় দিওনিসাস যেমন করতেন তেমনি করে নারীদের পোশাক পরত পুরুষরা। প্রত্যেকে মদ পান করত, গান-বাজনা চলত। দিওনিসাসের নারীভক্ত মিনাদরা মাথায় আইভি লতার মুকুট পরে ও জাদুর উইলো কাঠি নিয়ে রাস্তায় ছুটে বেড়াত। কিন্তু অনেক সময় গোটা দলটাই চেতনার উন্নত অবস্থা ঘোরে হারিয়ে যেত, এক উদযাপনকারী থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হতো সেটা। এটা যখন ঘটত, উপাসকরা বুঝতে পারত, দিওনিসাস তাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন। স্বর্গীয় আসরের এই অভিজ্ঞতাকে এন্থোস বলত তারা: ‘অন্তরে দেবতা আছেন।’ 

দিওনিসাসের প্রথায় বরবরই পরিহাসের উপাদান ছিল। নাগরিক মিছিলে পোলিসের সকল নাগরিক একসঙ্গে মিশে যেত, দাসরা অভিজাতদের পাশে নাচত। প্যানথেনিয়ার ঠিক উল্টো ছিল এটা; এখানে মিছিলে জনতার স্পষ্ট নির্দিষ্ট অবস্থান ছিল।৮ দিওনিসিয় ধর্ম বিদ্রোহের আভাস ধারণ করেছে, কারুশিল্পী, চিত্রশিল্পী ও ক্ষেতমজুরের কাছে আবেদন রেখেছিল যাদের কাছ থেকে স্বৈরাচারীরা সমর্থন লাভ করতেন; তো প্রায়শঃই দিওনিসাসের কাল্টকে উৎসাহিত করতেন তারা। ৫৩৪ সালে অ্যাথেন্সে সিটি দিওনিসিয়া স্থাপন করেন পেইসিস্ত্রাতোস, এবং অ্যাক্রোপলিসের দক্ষিণ ঢালে দিওনিসাসের উদ্দেশে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেন। এর পাশে পাথুরে পাহাড়ের শরীর কুঁদে বানানো একটি থিয়েটার ছিল। উৎসবের দিন সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবতার প্রতিমা বহন করে নগরে এনে মঞ্চে স্থাপন করা হতো। পরের তিন দিন নাগরিকরা প্রাচীন পুরাণের সমবেত আবৃত্তি শোনার জন্যে থিয়েটারে সমবেত হতো, ধীরে ধীরে তা পুরো মাত্রার নাটকে পরিণত হতো। সিটি দিওনিসিয়ার নাটকীয় আচারে গ্রিকরা অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সবচেয়ে কাছাকাছি আসবে। 

ষষ্ঠ শতাব্দীর দুটো প্রান্তিক আন্দোলনে মুষ্টিমেয় কিছু গ্রিক বিশ্বের অন্যান্য অংশে আবির্ভূত হতে চলা আক্সিয়াল যুগের আদর্শের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। প্রথমটি ছিল পোলিসের আগ্রাসী রীতিনীতি প্রত্যাখ্যান করে অহিংসার আদর্শ আলিঙ্গন করা অরফিক গোষ্ঠী।৯ অরফিকরা এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবেও পশু উৎসর্গ করতে রাজি ছিল না, কঠোর নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছিল তারা; নগরের রাজনৈতিক জীবনের জন্যে উৎসর্গ আবশ্যক ছিল বলে মূলধারা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। গ্রিসের বুনো, প্রান্তিক ও ‘অসভ্য’ অঞ্চল থ্রেসের এক পৌরাণিক বীর অরফিয়াস ছিলেন তাদের আদর্শ। বিষণ্ণ মানুষ অরফিয়াস সারা জীবন স্ত্রী ইউরিদিসের শোকে কাতর ছিলেন এবং সহিংস, ভয়ঙ্কর মৃত্যুবরণ করেছিলেন: আবার বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে থ্রেসের মহিলাদের এতটাই ক্ষিপ্ত করে তুলেছিলেন যে তাঁকে খালি হাতে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলেছিল তারা। তারপরেও শান্তিবাদী মানুষ ছিলেন অরফিয়াস, যাঁর অনুপ্রাণিত কবিতা বুনো পশুদের পোষ মানাত, তরঙ্গকে শান্ত করত আর পুরুষকে বিবাদ ভুলিয়ে দিত। দ্বিতীয় আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল সামোসের গণিতবিদ পিথাগোরাসের হাতে। ৫৩০ সালে ইতালি থেকে অভিবাসন করেছিলেন তিনি, পুবে ভ্রমণ করেছেন ও কর্মের ভারতীয় ভাষ্য শিক্ষা দিয়েছেন। কেবল একটি গোপন গোষ্ঠী গঠন করেছিলেন তিনি, এইটুকু ছাড়া ব্যক্তি হিসাবে তাঁর সম্পর্কে খুব কম জানি আমরা; এই গোষ্ঠীর সদস্যরা মাংস খেতে অস্বীকার করে দৈহিক পবিত্রতা অর্জন করত, উৎসর্গের আচারে অংশ নিতে অস্বীকার করত, এবং বিজ্ঞান ও গণিতের গবেষণায় আলোকনের খোঁজ করত। খাঁটি বিমূর্তের প্রতি মনোসংযোগ করে পিথাগোরিয়রা ভৌত পৃথিবীর দূষণ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে স্বর্গীয় ব্যবস্থার ঝলক প্রত্যক্ষ করার আশা করেছিল। 

অবশ্য ষষ্ঠ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ নতুন যুক্তিবাদের আলোড়ন দেখা দিলেও বেশিরভাগ গ্রিকই প্রচলিত সময়পরীক্ষিত দেবদেবীর পূজাআর্চাতেই সন্তুষ্ট ছিল। পিথাগোরিয়দের মতো আধ্যাত্মিক আলোকন লাভের উপায় হিসাবে নয়, বরং কেবল বিজ্ঞানের খাতিরেই অল্প কিছু দার্শনিক বিজ্ঞান গবেষণা শুরু করেছিলেন।৮১ কৃষ্ণ সাগর ও নিকট প্রাচ্যের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বিশিষ্ট সমৃদ্ধ বন্দর এশিয়া মাইনরের উপকূলবর্তী এক আইওনিয়ান পোলিস মিলেতাসে ছিল এইসব বিজ্ঞানীদের আবাস। প্রথম কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন থেলেস, ৫৯৩ সালে সূর্য গ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। স্রেফ কাকতালীয় অনুমান ছিল এটা, কিন্তু সূর্য গ্রহণকে স্বর্গীয় লীলার বদলে বরং একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসাবে দেখাতেই ছিল তাঁর আসল সাফল্য। ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন না থেলেস। তাঁর একমাত্র টিকে থাকা শেষবাক্যটি ছিল, —সবকিছুই জল, আর জগৎ দেবতায় আকীর্ণ।’ বহু আগে থেকেই আদিম সাগরকে মহাবিশ্বের স্বর্গীয় কাঁচামাল হিসাবে কল্পনা করা হয়ে এসেছে, কিন্তু পৌরাণিক এই স্বজ্ঞার প্রতি থেলেসের দৃষ্টিভঙ্গি কঠোরভাবে যৌক্তিক ছিল। অন্য দার্শনিকদের রচনায় টিকে থাকা তাঁর রচনার ছিটেফোঁটা লেখা থেকে মনে হয় অন্য সমস্ত প্রাণী জলের উপাদান থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং পানি ছাড়া জীবন অসম্ভব বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তিনি। পানি আকার বদলাতে পারে ও বরফ বা বাষ্পে পরিণত হতে পারে বলে এর ভিন্ন কিছুতে বিবর্তিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। একই চিন্তা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আরেক মাইলেসিয় দার্শনিক অ্যাক্সিমেনোস (৫৬০-৪৯৬) বিশ্বাস করেছিলেন যে, বাতাস আদিম বস্তু: বায়ুও জীবনের জন্যে অপরিহার্য উপাদান এবং বাতাস, মেঘ ও জলে রূপান্তরিত হয়ে পরিবর্তিত হতে পারে। 

বাস্তব প্রমাণের অভাবে এইসব অনুমান ফ্যান্টাসির চেয়ে বেশি কিছু ছিল; তবে এমনকি প্রচলিত প্রজ্ঞাকে উল্টে দিলেও কোনও কোনও গ্রিক তিক্ত সমাপ্তি পর্যন্ত লোগোসকে অনুসরণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল দেখিয়েছে বলে এসব তাৎপর্যপূর্ণও ছিল বটে। একটি একক কারণের খোঁজে বস্তু জগৎকে বিশ্লেষণ করার প্রয়াসে থেলেস ও অ্যানাস্কিমেনোস বিজ্ঞানীদের মতো ভাবতে শুরু করেছিলেন। তিনজন দার্শনিকের ভেতর সবচেয়ে উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী অ্যানাক্সিমান্দার (৬১০-৫৪৬) আরেক কদম এগিয়ে গিয়েছিলেন: আদিম বস্তুর অনুসন্ধানে একজন দার্শনিককে আরও মৌলিক, স্পর্শাতীত বস্তুর খোঁজে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অতীতে অগ্রসর হতে হতো। তিনি যুক্তি দেখান যে, মহাবিশ্বের মৌল উপাদান সম্পূর্ণ ‘অনির্দিষ্ট’ ( আপেইরন)। আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে অবস্থান করে বলে আমাদের বোঝার মতো এর কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, কিন্তু সবকিছুই এর পোতেনশিয়ার ভেতর অবস্থান করে। আপেরিওন স্বর্গীয়, কিন্তু দেবতাদের অতিক্রম করে যায়; এটা ছিল সকল প্রাণের এক অপরিমেয় ও অনন্ত উৎস। অ্যানাক্সিমান্দার কখনওই খুলে বলেননি এমন প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা অপেরিওন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে’ গিয়েছিল, এবং মহাবিশ্বের সকল উপাদান এখন সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে, অব্যাহতভাবে পরস্পরের উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। সময় প্রতিটি উপাদানকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থানের বিধান জারি করে মহাবিশ্বের উপর এক ধরনের ইউনোমিয়া চাপিয়ে দিয়েছে, কোনও একটি বিশেষ উপাদানের অপর উপাদানের উপর প্রাধ্যান্য বিস্তারের কোনও অবকাশ ছিল না। কিন্তু শেষপর্যন্ত সকল বস্তুই আবার আপেরিওনে আত্মীকৃত হবে। 

ধর্মতাত্ত্বিকরা যাকে একজন ‘দেবতাদের অতীত দেবতা’ বলেছিলেন সেই দেবতায় পরিণত হওয়ার ক্ষমতা আপেরিওনের ছিল, কিন্তু মানবজাতির দৈনন্দিন জীবন যাত্রার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক ছিল না। অতীতে সৃষ্টি বিজ্ঞান আক্ষরিকভাবে জীবনের উৎস বর্ণনার প্রয়াস পায়নি। পৃথিবীর বুকে জীবনের বিভ্রান্তিগুলো সম্পর্কে মৌল অন্তর্দৃষ্টি আবিষ্কারের জন্যে সৃষ্টি পুরাণগুলোর রূপ দেওয়া হয়েছিল। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দানবদের বিরুদ্ধে দেবতাদের লড়াইয়ের কাহিনীগুলো সবসময়ই অন্যের মৃত্যু বা অন্যান্য বস্তুর ধ্বংসের উপর নির্ভরশীল থাকা জীবনের কেন্দ্রে মৌলভাবে সংঘাতময় সংগ্রাম প্রকাশ করেছিল। আদিম উৎসর্গের গল্পকাহিনী দেখিয়েছে যে প্রকৃত সৃজনশীলতার জন্যে আপনাকে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। যখন নির্বাসিতরা হতাশায় হাল ছেড়ে দিতে পারত, P তাঁর সৃষ্টি গাথায় জোরের সঙ্গে বলেছেন, এই পৃথিবীর সবকিছুই উত্তম ছিল। কিন্তু মাইলেসিয় কোনও সৃষ্টিতত্ত্বকে নিরাময় উপাদান হিসাবে কাজে লাগানো অসম্ভব হতো। এসব তার জন্যে ছিল না; আধ্যাত্মিক দর্শনের সঙ্গে এসবরে কোনও সম্পর্ক ছিল না। মাইলেসিয়রা নিজেদের স্বার্থেই তাদের আঁচ-অনুমান সৃষ্টি করেছিল, ভবিষ্যৎ পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের বীজ উপ্ত হয়েছিল। মোটামুটি একই সময়ে ভারতের দার্শনিকরা এমন এক সৃষ্টি পুরাণ সৃষ্টি করেছিলেন যা ধর্মীয় অ্যাক্সিয়াল যুগকে আরেক কদম সামনে এগিয়ে দিয়েছিল। 

ভারতে উপনিষদ থেকে একেবারেই ভিন্ন সম্পূর্ণ এবং বৈদিক শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতি সামান্যই মনোযোগ দেওয়া নতুন এক দর্শন আবির্ভূত হয়েছিল। এর নাম ছিল সামক্ষ্য (‘বৈষম্য’), যদিও গেড়াতে শব্দটির অর্থ স্রেফ ‘ভাবনা’ বা ‘আলোচনা’ থেকে থাকতে পারে। সামক্ষ্য ভারতে দারুণ প্রভাশালী হয়ে উঠবে। প্রায় প্রতিটি দার্শনিক মতবাদ ও আধ্যাত্মিকতা এর কোনও না কোনও ধারণা গ্রহণ করবে-এমনকি যেগুলো সামক্ষ্য দর্শনকে অপছন্দ করত তারাও। কিন্তু গুরুত্ব সত্ত্বেও এই মৌল আন্দোলনটি সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। ষষ্ঠ শতাব্দীর কাপিলা নামে এক সাধুকে সামক্ষ্য দর্শন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হলেও তাঁর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, এমনকি সত্যিই তাঁর অস্তিত্ব ছিল কিনা তাও নিশ্চিত হতে পারি না। 

মাইলেসিয়দের মতো সামক্ষ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের বিশ্লেষণ করেছে, একেবারে সূচনার দিকে নজর ফিরিয়েছে এবং আমাদের জগৎকে অস্তিত্ব দেওয়া বিবর্তনের এমন এক প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছে। কিন্তু এখানেই মিলটা শেষ। গ্রিক দার্শনিকরা যেখানে বাহ্যিক জগৎমুখী ছিলেন, সামক্ষ্য সেখানে অন্তরে কাজ করেছে। মাইলেসিয়রা যেখানে তখনও ‘বিশ্ব দেবতায় পরিপূর্ণ’ দাবি করছিল, সামক্ষ্য ছিল নাস্তিক্যবাদী দর্শন। ব্রাহ্মণ বা আপেরিওনের কোনও অস্তিত্ব নেই, সবকিছু যাতে মিশে যাবে বিশ্বাত্মা বলে এমন কোনও শব্দও নেই। সামক্ষ্য ব্যবস্থার পরম বাস্তবতা ছিল পুরুষা (‘সম্পূর্ণতা’ বা ‘সত্তা’)। কিন্তু সামক্ষ্যের পুরুষা রিগ বেদের পুরুষা চরিত্রের মতো কেউ ছিলেন না, এবং উপনিষদের সাধুদের কাঙ্ক্ষিত সত্তা (আত্মা) থেকেও সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামক্ষ্য বিশ্বের অন্য চব্বিশটি শ্রেণী বিভাগের বিপরীত পুরুষা ছিলেন, পরম এবং পরিবর্তন যোগ্য নন। কিন্তু পুরুষা একক, অনন্য বাস্তবতা ছিলেন না। আসলে পুরুষা বিস্ময়করভাবে বহুগুন ছিলেন। প্রতিটি মানুষের মৃত্যু ও পুনর্জন্মের অন্তহীন চক্র সামসারায় বন্দী না ওয়া স্থান ও সময়ের অতীতে অবস্থান করা তার নিজস্ব চিরন্তন পুরুষা ছিল। আমাদের উপলব্ধি করার মতো এর কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল না বলে আত্মার মতো পুরুষা-কে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন ছিল। এটা ছিল মানুষের মুল সত্তা, কিন্তুমানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক না থাকায় ‘আত্মা’ নয়। আমরা যেভাবে চিনি, পুরুষার তেমন কোনও বুদ্ধিমত্তা ছিল না, ছিল না কোনও আকাঙ্ক্ষাও। আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা থেকে তা এতটাই দুরস্ত ছিল যে আমাদের সাধারণ জাগ্রত চেতনা আমাদের সবারই একটি করে চিরন্তন পুরুষা থাকার ব্যাপারে এমনকি সচেতনও ছিল না। 

একেবারে গোড়ায় পুরুষা কোনওভাবে প্রকিিত অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে জট পাকিয়ে ফেলেছিল। এই শব্দটির তর্জমা করা খুবই কঠিন। মন, বৃদ্ধিমত্তা এবং আলোকিত মানুষ যাকে তাদের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক অংশ বলে মনে করে সেই মানসিক অবস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকে বলে প্রকরতি কেবল বস্তুগত, দৃশ্যমান জগৎকে বোঝায় না। আমরা যতক্ষণ প্রকতির বলয়ে বন্দী থাকছি, ততক্ষণ মানবাজাতির চিরন্তন মাত্রা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাব। কিন্তু পুরুষা ও প্রকতি পরস্পর শত্রু ছিল না। নারী সত্তা হিসাবে বর্ণিত ‘প্রকৃতি’ পুরুষার প্রেমে পড়েছে। তাঁর কাজ ছিল তার আলিঙ্গন থেকে প্রতিটি ব্যক্তির পুরুষাকে নিষ্ক্রান্ত করা, এমনকি তাতে মানবজাতির তাদের অজ্ঞতার কারণে প্রকৃত সত্তা মনে করা বস্তুটির বিরুদ্ধে যাওয়া হলেও। ` প্রকৃতি আমাদের মুক্ত করতে চেয়েছে, মানব অস্তিত্বকে বৈশিষ্ট্যায়িত করা বিভ্রম ও ভোগান্তির হাত থেকে পুরুষাকে মুক্ত করতে চেয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই সমগ্ৰ প্ৰকৃতি–যদি আমরা সেটা জানতাম-আমাদের প্রত্যেকের চিরন্তন সত্তার (পুরুষা) সেবা করতেই অস্তিত্ববান ছিল। ‘পরম জ্ঞান অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রাহ্মণ থেকে ঘাসের ডগা পর্যন্ত সকল সৃষ্টিই পুরুষার কল্যাণের জন্যে।৮৩ 

কিভাবে পুরুষা প্রকৃতির ফাঁদে ধরা পড়লেন? কোনও ধরনের আদি পাপের অস্তিত্ব ছিল? সামক্ষ্য এইসব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বাস্তবতার বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক বিবরণ দেওয়ার লক্ষ্যে এর অধিবিদ্যিক প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল না। ভারতে বস্তুনিষ্ঠতা দিয়ে নয় বরং নিরাময় গুণ দিয়ে সত্যকে পরিমাপ করা হতো। সামক্ষ্যের অনুসারীদের মানবজাতিকে তার প্রকৃত সত্তায় প্রত্যার্বনের লক্ষ্যে কি করতে হবে সেটা আবিষ্কারের জন্যে প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষার এইসব সম্পর্কের বিবরণের উপর ধ্যান করার কথা ছিল। সামক্ষ্যের ধারণাগুলো প্রায় নিশ্চিতভাবেই উপনিষদের আধ্যাত্মিকতায় সন্তুষ্ট নয়, এমন গৃহত্যাগীদের বলয়ে জন্ম নিয়েছিল। নৈর্ব্যক্তিক ব্রাহ্মণে নিজেদের হারিয়ে ফেলার বদলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে চেয়েছে তারা। তাদের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, জীবন অসন্তোষজনক। কোথাও গড়বড় হয়ে গেছে, কিন্তু কিভাবে এই অসুখী অবস্থার সৃষ্টি হলো সেই ভাবনাচিন্তার পেছনে সময় খরচ করা অর্থহীন। ধ্যানের ভেতর তাদের আরেকটি অধিকতর পরম সত্তা থাকার তাদের ইঙ্গিত দেওয়া কোনও ধরনের অন্তস্থঃ আলোর ঝলক দেখতে পেয়েছিল তারা, কেবল সেটাকে তাদের আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্তকারী বিভ্রম ও আকঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই হতো। কোনও এক সময়ে সামক্ষ্যশব্দটি হয়তো মন ও বস্তুর প্রাকৃতিক বলয় থেকে সত্তাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ করা বুঝিয়ে থাকতে পারে। গৃহত্যাগী ইতিমধ্যে সমাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল; এখন তাকে পরের পদেক্ষপ নিতে হবে এবং তার সত্তার প্রকৃত কেন্দ্র আবিষ্কার করতে হবে: প্রকৃত আত্মা, তার আসল সত্তা, তার অমর পুরুষা। 

কেবল গৃহত্যাগীকে এই মুক্তি লাভে সাহায্য করার জন্যেই প্রণীত বাস্তবতারই বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছি সামক্ষ্য। বনের নির্জনবাসে নিজস্ব মানব প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে ধ্যান করতে পারত সে। কেবল মানবীয় বিপত্তির জটিলতার সঙ্গে পরিচিত হয়েই একে অতিক্রম করার আশা করতে পারত। সামগ্রিকভাবে গোটা মহাবিশ্বে ও প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে আবিষ্কার করা সম্ভব প্রকৃতির এমন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ‘ধারা’ (গুণ) থাকার শিক্ষা দিয়েছিল সামক্ষ্য, 

সত্য, ‘বুদ্ধিমত্তা,’ পুরুষার সবচেয়ে নিকটবর্তী
রাজা, ‘আবেগ’, শারীরিক বা মানসিক শক্তি
তমস, ‘জড়তা,’ সবচেয়ে নিম্নস্তরের গুণ 

সময়ের সূচনায়, ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টি অস্তিত্ব পাওয়ার আগে এই তিনটি গুণ আদিম বস্তুতে সহাবস্থান করছিল, কিন্তু পুরুষার উপস্থিতি ভারসাম্য নষ্ট করে উৎসারণের এক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটায়। আদি অভিন্ন ঐক্য থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম নতুন ধরনটি ছিল ‘মহাজন’ (গ্রেট ওয়ান) নামে পরিচিত মেধা (বুদ্ধি)। আমাদের প্রাকৃতিক সত্তার সর্বোচ্চ অংশ ছিল এটা, একে বিচ্ছিন্ন করে উন্নত করে তুলতে পারলে আমাদের তা আলোকনের একেবারে উপান্তে পৌঁছে দিতে পারে। বুদ্ধিমত্তা পুরুষার খুবই কাছের ছিল, আয়নায় যেভাবে ফুলের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে ঠিক সেভাবে সত্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে, কিন্তু অনালোকিত মানুষের মাঝে তা জগতের স্থূল উপাদানে আচ্ছন্ন থাকে। 

এরপরের আবির্ভূত উপাদানটি ছিল অহমের নীতি (অহঙ্কার)। অন্য সব সৃষ্টির উৎসারণ ঘটেছে অহঙ্কার থেকে: দেবতা, মানুষ, পশু, গাছপালা এবং অনুভূতিহীন জগৎ। অহম নীতিই আমাদের সমস্যার উৎস, কারণ প্রকৃতিকে তা এর বিভিন্ন অনুপাতে তিনটি গুণ সহ সমস্ত ভিন্ন সত্তায় পরিবর্তিত করেছে। দেবা ও সাধু পুরুষদের ভেতর সত্য (মেধা) প্রবল ছিল; রাজা সাধারণ লোকদের বৈশিষ্ট্যায়িত করেছে, যাদের আবেগময় শক্তি প্রায়শঃই ভুল পথে চালিত হয়েছে; আর পশুদের জীবন তমসের মানসিক অন্ধকারে অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু আমাদের অবস্থান যাই হোক, আমাদের অসুখের মূলে রয়েছে আমাদের মেকি সত্তায় বন্দী করা অহঙ্কারের নীতি, যার সঙ্গে আমাদের চিরন্তন পুরুষার কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা ভাবনা, অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করি। ‘আমি’ আমাদের গোটা সত্তাকেই বুঝি তুলে ধরে, এই ভেবে আমরা বলি, ‘ভাবছি,’ ‘চাই’ বা “ভয় লাগছে,’ তাই আমরা এই ‘আমি’কে টিকিয়ে রাখতে ও জাহির করার পেছনে প্রচুর শক্তি ক্ষয় করে থাকি, স্বর্গে এর চিরন্তন অস্তিত্ব আশা করি। কিন্তু এটা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যে অহমের দিকে এত জোরাল মনোযোগ দিই সেটা সময়ের অধীন বলে ক্ষণস্থায়ী। বার্ধ্যক্যে তা অসুস্থ, দুর্বল ও ক্ষয়ে যাবে, এবং শেষপর্যন্ত স্রেফ অন্য এক দেহে আবার নতুন করে এই কষ্টকর প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে দপ করে মরে যাবে। অন্যদিকে আমাদের প্রকৃত সত্তা, আমাদের চিরন্তন, স্বায়ত্তশাসিত ও মুক্ত পুরুষা মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করে চলে। খোদ প্রকৃতিও এই মুক্তি পেতে চায়। আমরা আমাদের জীবনের হতাশা ও বেদনার ঊর্ধ্বে উঠতে চাইলে অবশ্যই অহম যে আমাদের প্রকৃত সত্তা নয় সেটা জানতে হবে। একবার এই রক্ষাকারী জ্ঞানের অধিকারী হলে বোধের এক প্রবল তৎপরতায় আমরা মোক্ষ (‘মুক্তি’) লাভ করব। 

অজ্ঞতা আমাদের পিছে টেনে রাখে। প্রকৃতির বিভ্রমে আমরা এমনভাবে বন্দী হয়ে থাকি যে, নিজেদের সাধারণ মন-মানসিক জীবনকে পুরুষার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। আমাদের ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা আর আবেগই পরম এবং আমাদের মানব সত্তার জন্যে জরুরি বলে মনে করি আমরা। এর মানে আমাদের জীবন ভুলের উপর টিকে আছে। সত্তাকে আমাদের দৈনন্দিন অস্তিত্বকে পরিচালনা করা অহমেরই বর্ধিত রূপ বলে ধরে নিয়েছি আমরা। গৃহত্যাগীকে ধ্যান ও পাঠের এক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অজ্ঞতাকে শোধরাতে হয়েছিল। প্রার্থীকে অবশ্যই প্রকৃতির বিভিন্ন ধরন ও একে বিবর্তনকারী বিধিবিধানের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছে। এভাবে কেবল সামক্ষ্য ব্যবস্থার বুদ্ধিবৃত্তিক পাণ্ডিত্য নয় বরং তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সজাগ করে তোলার জ্ঞান লাভ করত সে। ধ্যানের প্রক্রিয়ায় পুরুষার একটা আভাস লাভের আশায় অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে বুদ্ধির উপর মনোসংযোগ করতে শিখত সে। একবার বুদ্ধিমত্তায় পুরুষাকে ঝিলিক মারতে দেখার পর গভীর উপলব্ধি লাভ করত সে, এটাই তার প্রকৃত সত্তা। চিৎকার করে উঠত, ‘আমি স্বীকৃতি পেয়েছি!” এবং অচিরে এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই থাকা প্রকৃতি ‘মনিবকে সন্তুষ্ট করার পর নর্তকের মতো” প্রত্যাহার করে নিত। 

এই মুহূর্তের পর আর ফিরে যাওয়ার উপায় থাকত না। একবার প্রকৃত সত্তায় জেগে ওঠার পর আলোকিত গৃহত্যাগী আর জীবনের দুর্ভোগের শিকার থাকে না। তখনও স্বাভাবিক জীবনে বাস করে চলে সে; তখনও অসুস্থ হয়, বুড়িয়ে যায়, এবং মারা যায়, কিন্তু পুরুষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ায় বেদনা আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষেই ‘আমি কষ্ট পাচ্ছি’ না বলে নিজেকে সে বলতে শোনে, ‘এটা কষ্ট পাচ্ছে,’ কারণ দুঃখ পরিণত হয়েছে দূরবর্তী অভিজ্ঞতায়, এখন তার উপলব্ধ প্রকৃত পরিচয় থেকে দুরস্ত। শেষপর্যন্ত সে মারা গেলে প্রকৃতি অস্তিত্ব হারায়, পুরুষা পরম মুক্তি লাভ করে, আর কখনওই আরেকটি মরণশীল, সময়ের চক্রে বন্দী দেহে প্রবেশ করবে না। 

এক অর্থে সামক্ষ্য যেন বৈদিক ধর্ম থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল বলে মনে হয়। সামক্ষ্য দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসর্গ ছিল অর্থহীন। দেবতারা প্রকৃতির কাছে এমনভাবে বন্দী ছিলেন যে, তাঁদের কাছে সাহায্য চাওয়া ছিল অর্থহীন। কারণ অহম-সত্তাকে মরতে হতো বলে আচারের মাধ্যমে স্বর্গে টিকে থাকবে, এমন একটি আত্মা নির্মাণের চেষ্টা করাও উল্টোফলদায়ী ছিল। আমাদের প্রকৃত সত্তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তোলা বিশেষ জ্ঞানই চিরস্থায়ী মুক্তি এনে দিতে পারে। কিন্তু বৈদিক প্রথার সঙ্গে সংঘাত থাকলেও চিরস্থায়ী দর্শনের প্রথাগত ও আদিআদর্শ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সামক্ষ্য প্রকৃত পরিবর্তন ছিল। লোকে সবসময় কোনও একটি স্বর্গীয় আদর্শের কাছে নিজেকে সমর্পিত করতে চেয়েছে, কিন্তু সামক্ষ্য তাদের বলেছে যে, এটা কোনও বাহ্যিক বাস্তবতা নয়, বরং অন্তরেই অবস্থান করে। কোনও দেবতাকে অনুসরণ করে নয় বরং তাদের সবচেয়ে প্রকৃত সত্তাকে জাগিয়ে তুলেই পরমকে লাভ করতে পারবে তারা। আদিআদর্শ কোনও প্রত্যন্ত পৌরাণিক বলয়ে অবস্থান করে না, বরং সেটা ব্যক্তির সহজাত। বাহ্যিক আদর্শ নজীরের মতো কোনও চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার বদলে তাদের অবশ্যই অন্তস্থঃ পুরুষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে হবে। 

সামক্ষ্য আত্ম-সচেতনতার এক নতুন পর্যায় চিহ্নিত করেছিল। ভারতে লোকে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিভ্রান্তিতে অস্পষ্ট হয়ে থাকা আমাদের দেহের মাঝে লুকানো বিভিন্ন প্রবৃত্তিতে বন্দী এবং ক্ষীণভাবে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন একটা সত্তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিল। সামক্ষ্যের অধিবিদ্যিক নাটক মুক্তির জন্যে মানুষের বিশেষভাবে আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছে। বৃহত্তর আত্মসচেতনতার চর্চা করে মানুষ নিজেদের ছাপিয়ে যেতে পারত। কিন্তু অহমই সত্তাকে বন্দী করে রাখে বলে তার মানে আত্মপ্রমোদ ছিল না। ভারতের লোকজন আমাদের জাগতিক অস্তিত্বের আঁকড়ে ধরা স্বার্থপর দশা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠছিল। অহম আমাদের ‘এটা কি আমার দরকার?’ এই প্রশ্ন ছাড়া কোনও কিছুর দিকে তাকাতে অক্ষম করে তোলে। ফলে আমরা স্বার্থপরতার জালে বন্দী থাকি বলে কখনওই কোনও বস্তুকে তার প্রকৃত রূপে দেখি না। সামক্ষ্য এমনি আঁকড়ে থাকা ভীতিকর অহামবাদ থকে সত্তার এমন এক অবস্থায় মুক্তির পথের ছবি আঁকতে পেরেছিল আমাদের স্বাভাবিক অহম-ভিত্তিক অস্তিত্বে আমরা যার কথা ভাবতেও পারি না। এমনি একটা অবস্থা স্বৰ্গীয় ছিল না; আমাদের মানবীয় প্রকৃতির পরিপূর্ণতা ছিল এটা, এবং এই মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করতে তৈরি যে কেউই তা অর্জন করতে পারত। 

ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল সামক্ষ্য। প্রথমটা ছিল জীবন যে দুঃখ, সেই ধারণা; শব্দটিকে প্রায়শঃই ‘দুর্ভোগ’ হিসাবে অনুবাদ করা হয়ে থাকে, কিন্তু এর বৃহত্তর অর্থ রয়েছে: ‘অসন্তোষজনক, কুটিল।’ কারও পক্ষে কখনও জানা সম্ভব নয় এমন কারণে এই অপবিত্র পৃথিবীতে আমাদের জন্ম ভীতিকর ও বেদনাদায়ক। অজ্ঞতা ও বিষাদে আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ন্ত্রিত হয়। মহাবিশ্বের সমস্তকিছুই ক্ষীয়মাণ, মরণশীল ও ক্ষণস্থায়ী। এমনকি মেকি ‘আমি’ যখন সুখী ও সন্তুষ্ট বোধ করে, তখনও একটা কিছু গড়বড় হয়ে যায়। ‘আমি’ সাফল্য অর্জন করলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অসন্তুষ্ট হয়। প্রায়শঃই ‘আমি’ কোনও লক্ষ্য বা বস্তুগত বিষয়ের আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটাকে হতাশাব্যাঞ্জক ও অসন্তোষজনক আবিষ্কার করে। সুখের মুহূর্তগুলোর প্রায় পরপরই আসে বেদনার কাল। কোনও কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমাদের শোরগোলময় অন্তস্থঃ জগৎ মুহূর্তেই এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে সরে আসতে পারে। আমাদের বন্ধুরা মারা যায়, লোকে অসুস্থ, বৃদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তাদের সৌন্দর্য ও প্রাণচাঞ্চল্য হারায়। এই সর্বজনীন দুঃখকে অস্বীকার করার মানে—অনেকেই যা করতে পছন্দ করে-এক ধরনের বিভ্রম, কারণ এটা জীবনেরই রীতি। কিন্তু, সামক্ষ্য যুক্তি দেখিয়েছে, ‘আমি’ যতই দুর্ভোগের শিকার হয় ও এই নিয়ন্ত্রিত জগতের সঙ্গে একাত্ম হয় ততই ‘আমি’ পুরুষার পরম, অনিয়ন্ত্রিত বাস্তবতার আকাঙ্ক্ষা করে বলে এই অপূর্ণ প্রকৃতি আবার আমাদের বন্ধুও বটে। আমরা অবিরাম নিজেদের চারপাশে ও উত্তাল অন্তরে নজর চালাই, নিজেদের ভিন্ন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করছি বলে আবিষ্কার করি: উপনিষদিয় সাধুদের মতো চিৎকার করে উঠতে হয় আমাদের, ‘নেতি নেতি, ‘ইহা নহে!’ সামক্ষ্য নৈরাশ্যবাদী মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা আশাবাদী ও উচ্চাভিলাষী ছিল। এখানে প্রকৃতিই চূড়ান্ত বাস্তবতা নয় বলে জোর দেওয়া হয়েছে। লোকে মুক্তির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে, করেছে; প্রকৃত সত্তা পুরুষার সন্ধান পেয়েছে তারা। সকল সৃষ্টিই-দেবতা, মানুষ, পশু, গাছপালা ও পোকামাকড়-দুর্ভোগের শিকার হয়, কিন্তু কেবল মানুষই বেদনা থেকে মোক্ষ লাভ ও মুক্তি অর্জনের ক্ষমতা রাখে। 

কিন্তু অনেক গৃহত্যাগী প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মুক্তিকে অত্যন্ত কঠিন আবিষ্কার করেছিল। কেউ কেউ পাঠ ও ধ্যানের ভেতর দিয়ে মোক্ষ লাভ করেছিল, কিন্তু অন্যরা আরও বেশি কিছুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। প্রকৃতি মানবজাতিকে এমন শক্তিশালী বন্ধনে আটকে রেখেছিল যে আরও কঠিন উপায়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কোনও কোনও গৃহত্যাগীকে এটা এখন সারা বিশ্বের বিভিন্ন মেডিটেশন হল ও জিমে চর্চা করা হয়, এমন অনুশীলন নির্মাণের পথে চালিত করেছিল। যোগ ভারতের অন্যতম মহান আবিষ্কার, এবং এর চূড়ান্ত বিবর্তিত ধরনে প্রায় নিশ্চিতভাবেই প্রকৃতির জটাজালে বন্দি পুরুষাকে মুক্তি দিতেই সামক্ষ্য বলয়ে এর নকশা করা হয়েছিল। আজকাল পশ্চিমে প্রায়শঃই শিক্ষা দেওয়া যোগ থেকে ধ্রুপদী যোগ বেশ ভিন্ন। ৮৬ এটা কোনও অ্যারোবিক অনুশীলন ছিল না, লোকজনকে শিথিল হতে, অতিরিক্ত উদ্বেগ চাপা দিতে বা তাদের জীবন সম্পর্কে ভালো বোধ করতে সাহায্য করত না-বরং সম্পূর্ণ উল্টো। যোগ ছিল অহমের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত আক্রমণ, শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় ভুলভ্রান্তি ও বিভ্রমসহ স্বাভাবিক সচেতনতাকে নিশ্চিহ্ন করে তার জায়গায় পুরুষার পরমানন্দের আবিষ্কার দিয়ে প্রতিস্থাপন করা শেখানো কঠোর নিয়মাচরণ। 

আবার, কারা যোগের উদ্ভব ঘটিয়েছিল আমরা সেই গৃহত্যাগীদের নাম জানি না। সাধারণ সহস্রাব্দের প্রথম শতাব্দীতে যোগ সূত্র রচনাকারী পতঞ্জলির সঙ্গে এটা সংশ্লিষ্ট ছিল। কিন্তু পতঞ্জলি প্রকৃতপক্ষেই বেশ প্রাচীন এইসব অনুশীলন আবিষ্কার করেননি। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন, হয়তো আর্য গোত্রগুলোর আগমনের আগে ভারতের স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে যোগের একটা ধরন সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। গোড়ার দিকের উপনিষদে যৌগিক কৌশলের কোনও কোনওটা, বিশেষ করে শ্বাসপ্রশ্বাসের চর্চার কথা বর্ণনা করা হয়েছে এবং বৈদিক আচারের সময় তার চর্চা করা হতো। তবে যেভাবেই সূচনা হয়ে থাকুক না কেন, ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ যোগ ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার ল্যান্ডস্কেপের অংশ হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিল। ব্রাহ্মণ, সনাতন বৈদিক সন্ন্যাসী ও তথাকথিত ধর্মদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এর চর্চা করত। বিভিন্ন গ্রুপ যোগের ভিন্ন ভিন্ন ধরন গড়ে তুললেও যোগ সূত্রে উল্লেখিত মূল অনুশীলনগুলো ছিল মৌল। 

খোদ যোগ শব্দটিই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে, ‘জোয়াল পরানো’। এককালে হামলার আগে ঠেলা টানা ঘোড়াকে বাঁধার কথা বোঝাতে ব্যবহৃত বৈদিক আর্যদের বুলি ছিল এটা। যোদ্ধারা যোগের পুরুষ ছিল। অব্যাহতভাবে জঙ্গী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত চিরন্তনভাবে চলার উপর থাকা দেবাদের মতো ছিল তারা, শ্লথ আসুরারা যেখানে বাড়িতে অবস্থান করত। অবশ্য, ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ যোগের নতুন পুরুষরা অন্তস্থঃ স্থান বিজয়ে নিয়োজিত ছিল; যুদ্ধে জড়ানোর বদলে অহিংসায় নিবেদিত ছিল তারা। যোগের মানে ছিল আমাদের সকল কষ্টের মূল কারণ অবচেতন মনে হামলা চালানো। আমাদের বন্দী করে রাখা পাঁচটি বৃত্তি (‘ঝোঁক’)-এর তালিকা দিয়েছেন পতঞ্জলি: অজ্ঞতা, আমাদের অহম বোধ, আবেগ, বিতৃষ্ণা ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতি লোভ। এই প্রবৃত্তিগুলো অশেষ ও নিয়ন্ত্রণাতীত শক্তিতে একটার পর একটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এগুলো আমাদের মানবীয় পরিচয়ের মৌল বিষয় বলে বিশ্বাস করত যোগীরা, কেবল সামক্ষ্য গুরুদের কল্পিত জ্ঞানের সাধারণ তৎপরতা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষে ঢের বেশি গভীরে প্রোথিত। আমরা যোগীরা যাকে বলেছে বাসনা, অর্থাৎ ব্যক্তি সত্তার কাছে নির্দিষ্ট সবকিছু সৃষ্টিকারী অবচেতন অনুভূতিতে নিয়ন্ত্রিত। এগুলো বংশধারা ও অতীত ও বর্তমান জীবনের কর্মের ফল। ফ্রয়েড ও জাং আত্মার আধুনিক, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করার অনেক আগেই ভারতের যোগীরা নজীরবিহীন জোরের সঙ্গে অবচেতন বলয়ের অনুসন্ধানের সূচনা করেছিল। বৃত্তি ও বাসনাসমূহকে নিশ্চিহ্ন, ‘পুড়িয়ে ফেলতে’ হতো। কেবল তখনই সত্তা নিজেকে মনস্তাত্ত্বিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকৃতির কষ্টকে ছুঁড়ে ফেলে মোক্ষের পুলক বোধ করতে পারত। কেবল তীব্র মানসিক শক্তি দিয়েই এই মহাপরিশ্রম সাপেক্ষ কৃতিত্বটি অর্জন করা সম্ভব ছিল। 

প্রথমে অবশ্য যোগীকে দীর্ঘ প্রস্তুতির কাল কাটাতে হতো। একটি ব্যাপক নৈতিক প্রশিক্ষণ শেষ না করা পর্যন্ত যোগের কোনও অনুশীলনই চর্চা করতে দেওয়া হতো না তাকে। যমস (‘নিষেধাজ্ঞা’) পালনের ভেতর দিয়ে শুরু করতে হতো শিক্ষার্থীকে। তালিকার একেবারে শুরুতে ছিল অহিংসা, ‘ক্ষতিকরহীনতা’। যোগী অন্য প্রাণীকে হত্যা বা আহত করতে পারবে না; এমনকি একটা মশাকে মারতে বা অন্যদের সঙ্গে রূঢ় ভাষায় কথাও বলতে পারবে না সে। দ্বিতীয়ত, চুরি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হতো তার উপর, তার মানে ছিল যাইচ্ছে তাই হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকত না তার; কেবল নির্দ্বিধায় তাকে দেওয়া খাবার ও পোশাক গ্রহণ করতে পারত, বস্তুগত অধিকারের প্রতি উদাসীনতার চর্চা করতে হতো তাকে। তৃতীয়ত, মিথ্যা বলতে পারত না সে, বরং ঘটনাকে আরও উপভোগ্য করে তুলতে বা নিজের কাছে প্রীতিকর করে তুলতে বিকৃত না করে অবশ্যই সবসময় সত্যি কথা বলতে হতো। সবশেষে, তাকে অবশ্যই যৌন সংসর্গ ও মনকে আচ্ছন্ন করে তোলা ও আধ্যাত্মিক অভিযানে প্রয়োজনীয় শক্তি হ্রাস করতে পারে এমন নেশা জাগানো বস্তু থেকে বিরত থাকতে হতো। প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি নির্দিষ্ট কিছু দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলনও (নিয়ম) দাবি করত। শিক্ষার্থীকে অবশ্যই আন্তরিকভাবে পরিচ্ছন্ন থাকতে হতো; তাকে অবশ্যই গুরুর শিক্ষা (ধর্ম) পাঠ করতে হতো, তার ভেতরের মনোভাব যাই হোক না কেন সবার সঙ্গে দয়া ও সৌজন্যের সঙ্গে আচরণ করতে হতো। 

প্রস্তুতি কর্মসূচি যোগীদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য তুলে ধরেছে। কেবল ক্ষণস্থায়ী অনুপ্রেরণামূলক অভিজ্ঞতা লাভে আগ্রহী ছিল না তারা। মানুষ হওয়ার এক ভিন্ন উপায়ে দীক্ষা লাভ ছিল যোগ, এর মানে ছিল প্রবলভাবে নৈতিক পরিবর্তন। নিষেধাজ্ঞা ও অনুশীলনগুলো আদি আদর্শ প্রতীকের প্রথাগত অনুকরণের নতুন, অ্যাক্সিয়াল যুগ ভাষ্য ছিল। যোগীদের অনালোকিত সত্তাকে পেছনে ফেলে আসতে হতো, আহম নীতিকে ত্যাগ করতে হতো, এবং এমন আচরণ করতে হতো যেন পুরুষা ইতিমধ্যে মুক্তি লাভ করেছেন। অতীতে আচরিকভাবে কোনও দেবতাকে অনুকরণ করার সময় লোকে নিজেদের স্বাভাবিক জীবন থেকে ‘বেরিয়ে আসার’ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, সত্তার আলোকন অনুভব করেছে। যামা ও নিয়মের বেলায়ও একই কথা সত্যি ছিল। অনুশীলনের ভেতর দিয়ে এইসব নৈতিক অনুশীলন দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত হবে, সেটা যখন ঘটবে, ব্যাখ্যা করেছেন পতঞ্জলি, শিক্ষার্থী ‘অবর্ণনীয় আনন্দ’ উপলব্ধি করবে। ‘অহম নীতি’কে পেছনে ফেলে আসার সময় চূড়ান্ত মুক্তির সাক্ষাৎ পেয়েছে সে। 

শিক্ষার্থী যামা ও নিয়ম রপ্ত করেছে, গুরু এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রথম প্রকৃত যৌগিক অনুশীলন: আসন, উপবেশন’ শুরু করার জন্যে তৈরি হতো। পিঠ সোজা করে পায়ের উপর পা তুলে সম্পূর্ণ নিশ্চল অবস্থায় একেকবারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। প্রথম দিকে এটা অস্বস্তিকর ছিল, অনেক সময় অসহনীয় কষ্টকরও। গতিই জীবন্ত সৃষ্টিকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে। চলমান সবকিছুই জীবন্ত। এমনকি আমরা যখন নিথর অবস্থায় আছি কল্পনা করি, তখনও অবিরাম চলমান থাকি: চোখ পিটপিট করি, চুলকাই, এক নিতম্ব থেকে অন্য নিতম্বে শরীরে ভর বদল করি এবং অনুপ্রেরণায় সাড়া দিতে মাথা ঘোরাই। এমনকি ঘুমের ভেতরও আমরা গড়াগড়ি যাই। কিন্তু আসনে যোগী মন ও ইন্দ্রিয়ের ভেতরের সম্পর্ক ছিন্ন করার শিক্ষা নিত। সে এমনভাবে স্থির হয়ে থাকত যে, মানুষের চেয়ে বরং তাকে মূর্তি বা গাছের মতো লাগত। অতীতে আর্যরা সারাদিন স্রেফ ঘরে বসে থাকা আসুরাদের ঘৃণা করেছে। এখন যোগের নতুন পুরুষ জীবনের কোনও চিহ্ন ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকছিল। 

এরপর প্রবৃত্তির জীবনের উপর আরও প্রবল আক্রমণ শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের কৌশল আয়ত্ত করত যোগী। দৈহিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে শ্বাসপ্রশ্বাস সবচেয়ে মৌলিক ও স্বয়ংক্রিয়, জীবনের জন্যে যারপরনাই জরুরি। অবশ্য প্রায়াণামে যোগী ক্রমেই ধীরে ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া শিখত। শ্বাস গ্রহণ ও ছাড়ার ভেতর যত বেশি সম্ভব বিরতি দেওয়াই ছিল তার লক্ষ্য, যাতে শ্বাসপ্রশ্বাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। তার হৃৎস্পন্দন শ্লথ হয়ে আসত; তাকে এমনকি মৃতও মনে হতে পারত; কিন্তু তারপরেও প্রাণায়ামে নিপুণ হয়ে উঠলে এক নতুন ধরনের জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করত সে। সাধারণ জীবনের ছন্দময় শ্বাসপ্রশ্বাসের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই নিয়ন্ত্রিত শ্বাসপ্রশ্বাসের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছিল বলে জানা গেছে। এটা সঙ্গীতের প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয় বলে কথিত স্থৈর্য, সঙ্গতি ও সাম্যের বোধ সৃষ্টি করত বলে উল্লেখ আছে। এক মহান, প্রশান্ত এবং মহানুভবতা-সত্তার একটা বোধ-অনুভূত হতো। 

এইসব দৈহিক অনুশীলন রপ্ত করার পর শিক্ষানবীশ যোগী একাগ্রতা, অর্থাৎ ‘একটি বিন্দুতে’ মনোসংযোগের চর্চা মানিসক অনুশীলনের জন্যে তৈরি হতো। এখানে চিন্তাভাবনায় অস্বীকৃতি জানিয়ে একটিমাত্র বস্তু বা বিষয়ে মনোসংযোগ করতে শিখত সে। ফুল, নিজের নাকের ডগা অথবা গুরুর কোনও শিক্ষা হতে পারত সেটা। অন্য যেকোন আবেগ বা সম্পর্ককে বাদ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তার মানে ছিল অনিবার্যভাবে ধেয়ে আসা বিচ্যুতিগুলোকে ঠেলে দূরে পাঠানো। একাগ্রতার বিভিন্ন ধরন ছিল। শিক্ষার্থী প্রত্যাহার (ইন্দ্রিয় থেকে প্রত্যাহার) শিক্ষা করত, কেবল বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিষয়কে নিয়ে ভাবত! ধরণায় (অভিনিবেশ) আপন সত্তার গভীরে পুরুষকে প্রত্যক্ষ করার শিক্ষা দেওয়া হতো তাকে, সেটা পুকুরের পদ্মের মতো উঠে আসছে বলে কল্পনা করতে হতো। প্রতিটি ধরণার বারটি প্রাণায়াম দীর্ঘ হওয়ার কথা ছিল এবং এইসব সমান্বত দৈহিক ও মানসিক কৌশলের মাধ্যমে কুশলী যোগী এমনভাবে তার অন্তস্থঃ জগতে ডুবে যেত ও সাধারণ ইহজাগতিক সচেতনতা থেকে দূরে সরে যেত যে এক ধরনের ঘোরে প্রবেশ করত সে। 

শিক্ষানবীশ বিস্ময়কর অনাক্রম্যতা আবিষ্কার করার কথা জানতে পেত। আরও দক্ষ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্কার করত যে, এখন আর গ্রীষ্মের গা তাতানো গরম বা শরীর জামিয়ে দেওয়া শীতের বৃষ্টি নিয়ে সজাগ নেই সে। আপন মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় এখন আপন পরিবেশের ব্যাপারে নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। ধ্যানের বিষয়বস্তু নতুনভাবে প্রত্যক্ষ করছে বলেও আবিষ্কার করত সে। সব স্মৃতির প্লাবন ও একে উস্কে দেওয়া ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে দমন করতে পারায় এখন আর নিজের উদ্বেগে বিচ্যুত হচ্ছে না। একে বস্তুনিষ্ঠ বা ব্যক্তিগত করেনি, নিজের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিকৃত লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখার বদলে প্রকৃত চেহারায় একে দেখতে পাচ্ছে। তার ভাবনা থেকে ‘আমি’ মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে, ফলে এমনকি সবচেয়ে মামুলি বস্তুগুলোও দারুণ অপ্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে। যোগী সামক্ষ্য সৃষ্টি পুরাণের মতো নিজস্ব বিশেষ মতবাদের ধারণা নিয়ে ধ্যান করার সময় এগুলোকে এত স্পষ্টভাবে অনুভব করে যে, এইসব সত্যির একটি যৌক্তিক নির্মাণ তুলনায় ম্লান হয়ে যায়। তার জ্ঞান আর তখন ধারণাগত থাকে না; প্রত্যক্ষভাবে এইসব সত্যি তার জানা হয়ে যায়। এসব তার অন্তস্থঃ জগতের অংশ হয়ে গেছে। 

যোগীরা নিজেদের দেবতার স্পর্শ লাভ করেছে বলে বিশ্বাস করত না; এইসব অভিজ্ঞতার ভেতর অলৌকিক কিছু ছিল না। হাজার হোক, সামক্ষ্য নাস্তিক্যবাদী বিশ্বাস ছিল, দেবাদের প্রতি এর কোনও আগ্রহ ছিল না। যোগীরা মানবীয় সত্তার স্বাভাবিক ক্ষমতাই বাড়িয়ে তুলছে বলেই বিশ্বাস করত। কঠোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যেকেউই এইসব মানসিক সাফল্য লাভ করতে পারে। মানবীয় পরিচয়ের এক নতুন মাত্রা আবিষ্কার করছিল তারা। এই দুর্জ্ঞেয়তা ‘মহাশূন্যে’ বাহ্যিক উপাস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়, বরং তাদের নিজস্ব অন্তস্থঃ সত্তার গভীরে অবতরণ ছিল। স্বাভাবিক, অহমকেন্দ্রীক অস্তিত্ব থেকে পদ্ধতিগতভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে যোগী তার নিজস্ব প্রকৃত সত্তাকে প্রকৃতির ফাঁদ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস পেয়েছে। 

ঘোরের অবস্থায় চলে যাওয়ার পর যোগী কতগুলো ক্রমবর্ধমান হারে গভীর মানসিক পর্যায়ের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতো, যার সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার কোনও মিল ছিল না। খাঁটি সচেতনতার পর্যায় ছিল সমাধি, যেখানে ‘আমি’ ও ‘আমার’ বোধ সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যেত। যোগী তার ধ্যানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম বোধ করত, অন্য কোনওকিছু সম্পর্কেই আর সজাগ থাকত না। নিশ্চিতভাবেই সেগুলো নিয়ে ধ্যান করার ব্যাপারে সজাগ থাকত না সে। অন্য আরও চরম পর্যায়ও ছিল যেগুলো খুব অল্পসংখ্যক বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোগ অনুশীলনকারীই অর্জন করতে পেরেছিল, কেবল স্ববিরোধিতার মাধ্যমেই সেসবকে বর্ণনা করতে পেরেছে তারা: এক ধরনের অনুপস্থিতির বোধ ছিল যা আবার উপস্থিতিও; পরিপূর্ণ এক ধরনের শূন্যতা; এক চিরন্তন উপস্থিতি; মৃত্যুতে প্রাণ। এসবকে বর্ণনা করার মতো কোনও শব্দ ছিল না বলে যোগীরা এইসব অভিজ্ঞতাকে ‘কিছু না’ বলেছে; এসবকে কোনও ঘরে প্রবেশ করে কেবল শূন্যতা, স্থান ও মুক্তি আবিষ্কার করার সঙ্গে তুলনা করেছে তারা। 

যোগীরা তাদের ধ্যানের আবিষ্কারকে ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছে। উপনিষদের শিক্ষার অনুসরারীরা অবশেষে ব্রাহ্মণের সঙ্গে একতাত্ম হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করত; সামক্ষ্য দর্শনের অনুসারীরা পুরুষাকে মুক্ত করার দাবি করেছে। কিন্তু মৌল অভিজ্ঞতা একই রয়ে গেছে। তারা যাই করেছে বলে মনে করুক না কেন, যোগীরা এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। অসাধারণ উচ্চাভিলাষী মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবী উপায় আবিষ্কারে চালিত করা দুর্ভোগের তীব্র উপলব্ধি। তাদের দুঃখ থেকে মুক্তি দেবে, এমন একটি আধ্যাত্মিক কৌশল আবিষ্কার করেছিল তারা। অবশ্য, যোগ সবার জন্যে ছিল না। সার্বক্ষণিক কাজ হওয়ায় প্রতিদিনের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জো ছিল না। কিন্তু অন্য সন্ন্যাসীরা এমন এক যোগ পদ্ধতি আবিষ্কার করবেন যা সাধারণ মানুষকে আলোকনের আভাস দেবে। 

.

এদিকে সঙ্কটে পড়েছিল চীন। ৫৯৭ সালে চু লীগ অভ চাইনীজ স্টেটের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করলে গোটা এলাকা সম্পূর্ণ নতন ধরনের আগ্রাসনে গ্রস্ত হয়ে পড়ে। বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। চু-র প্রাচীন আচারভিত্তিক যুদ্ধবিগ্রহের ফুরসত ছিল না; অন্য বৃহৎ রাজ্যগুলোও শত্রুর বিনাশ করতে হলেও আরও বেশি এলাকা দখল ও সম্প্রসারিত করার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ঐতিহ্যের বাঁধন ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করেছিল। যুদ্ধ বিগ্রহ আর অতীতের দৃষ্টিনন্দন অভিযানের মতো ছিল না, অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, ৫৯৩ সালে এক দীর্ঘমেয়াদী অবরোধের সময় সং-এর জনগণ নিজেদের সন্তানদের খাওয়ার অবস্থায় নেমে এসেছিল। প্রাচীন ক্ষুদেরাজ্যগুলো রাজনৈতিক বিনাশের মুখোমুখি হয়েছিল। তারা জানত, বড় রাজ্যগুলোর সঙ্গে পেরে উঠবে না, কিন্তু তারপরেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে নেওয়া হয়েছিল তাদের, প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল তাদের দেশ। উদাহরণ স্বরূপ, কি এত ঘন ঘন ক্ষুদে রাজ্য লু-র উপর আক্রমণ চালাচ্ছিল যে লু সাহায্যের জন্যে চু-র কাছে আবেদন জানাতে বাধ্য হয়েছিল-কিন্তু কোনও ফায়দাই হয়নি। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে চু পরাস্ত হয়েছিল। কি এতটাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিল যে লু’র ডিউক পশ্চিমের রাজ্য কিনের সাহায্যে কোনওমতো স্বাধীনতার একটা ভাব ধরে রাখতে পেরেছিলেন। 

অভ্যন্তরীণ সমস্যায়ও দুর্বল হয়ে গিয়েছিল রাজ্যগুলো। ষষ্ঠ শতাব্দীতে অব্যাহত গৃহযুদ্ধের ফলে কি, জিন ও চু মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। লু- তে তিনটি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যারনিয় পরিবার বৈধ ডিউককে সামান্য পুতুল রাজায় পরিণত করেছিল। এটাই সময়ের চিহ্ন ছিল। ঝোউ-এর মহান ডিউকের বংশধরকে আচরিক দায়িত্ব বাদে আর সব ধরনের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, ক্ষমতা দখলকারীদের উপর অর্থিকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তিনি। প্রাচীন রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ছিল; চীন যেন সোজা অরাজকতার দিকে ছুটে যাচ্ছিল বলে মনে হয়েছে। তারপরেও এইসব সংগ্রাম এক গভীর পরিবর্তনের সঙ্কেত দিয়েছে। রাজকুমারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী অভিজাতরা নিশ্চিতভাবে লোভ ও উচ্চাভিলাষে প্রণোদিত ছিল, কিন্তু প্রাচীনতম পরিবারগুলোর আধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রয়াস পাচ্ছিল তারা। চীনারা বেদনাদায়কভাবে অধিকতর সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলছিল; এতদিনকার রাজকুমারদের বংশ পরম্পরায় চ্যালেঞ্জহীন শাসনকে তা খাটো করে দেবে।” চেং ও লু-তে অর্থনৈতিক ও কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার ক্ষেতমজুরদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে চেং ক্ষুদে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী যিচান এক বিশাল ব্রোঞ্জের ডেগচিতে শাস্তিবিধি খোদাই করে প্রদর্শন করেন। এখন একটি নির্দিষ্ট আইনি বিধানের অস্তিত্ব ছিল, খামখেয়ালি শাসনের বিরোধিতা করার জন্যে যেকেউই তা পর্যালোচনা করতে পরত। 

প্রত্নতাত্ত্বিকরা যেমন আবিষ্কার করেছেন, আচরিক পরিপালনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ কাজ করছিল: লোকে আত্মীয়স্বজনের সমাধিতে নির্ধারিত আচরিক পাত্রের বদলে আজেবাজে জিনিস রাখছিল। মিতাচারের প্রাচীন চেতনা হারিয়ে যাচ্ছিল: অনেক চীনাই বিলাসিতার নতুন রুচি গড়ে তুলেছিল, চাহিদা সম্পদের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে অর্থনীতির উপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করেছিল। সামন্ত মর্যাদাক্রমের একেবারে নিচের সারির সাধারণ ভদ্রলোকদের (শি) কেউ কেউ মহান পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার অনুকরণ করতে শুরু করেছিল। ফলে অভিজাতের সংখ্যা গিয়েছিল বেড়ে, তাতে করে উদ্বেগজনক সংখ্যক শি যারপরনাই দরিদ্র হয়ে পড়েছিল। নব্য ধনীর সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, আশপাশে যথেষ্ট পরিমাণ জমি না থাকায় অভিজাতদের কোনও কোনও সদস্য আর জামিদারির মালিক থাকতে পারছিল না। রাজকুমারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়সহ অনেক ভদ্রলোক জমি ও পদবী হারিয়ে সাধারণে পরিণত হয়েছিলেন। অবনিতপ্রাপ্ত শি-দের কেউ কেউ লিপিকার, শাস্ত্রজ্ঞ, বা সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিল, যারা এখন শহর ছাড়তে বাধ্য হয়ে তাদের দক্ষতা নিয়ে পল্লী এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাস করতে বাধ্য হয়েছে। 

এটা স্রেফ সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট ছিল না। স্বর্গ ও জমিন এত স্বাধীন ছিল যে, অনেকেই স্বর্গীয় পথের প্রতি বর্তমান তাচ্ছিল্য গোটা মহাবিশ্বকেই বিপদাপন্ন করে তুলবে ভেবে ভীত হয়ে উঠেছিল। লু-র শাস্ত্রজ্ঞরা নতুন লোভ, আগ্রাসন ও বস্তুবাদকে পবিত্র আচারের প্রতি বিদ্রোহী আক্রমণ মনে করেছেন। অন্যরা আরও বেশি সংশয়বাদী ছিল। ৫৩৪ সালে এক টাইফুনে অনেক চীনা শহর ধ্বংস হয়ে যায়, এর পরপরই আসে ভয়ঙ্কর দাবানল। চেং-এ প্রধান গণক প্রধানমন্ত্রী যিচানের কাছে হাজির হয়ে স্বর্গকে খুশী করার জন্যে বিশেষ উৎসর্গ করার আহবান জানান। মাথা নাড়েন যিচান। ‘স্বৰ্গীয় পথ অনেক দূরে সরে গেছে; মানুষের পথই এখন আমাদের কাছে,’ জবাব দিয়েছেন তিনি। ‘আমরা আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারব না, যার মানে, তা কি আমরা জানি?’ স্বর্গ আমাদের জ্ঞানের অতীত বলে আমাদের নাগালের ভেতর যা আছে সেদিকে মনোসংযোগ করাই ভালো। এই সময় নাগাদ কং কিউ (৫৫১-৪৭৯) নামে পরিচিত এক তরুণ পড়াশোনা প্রায় শেষ করে এনেছিলেন, লু-র প্রশাসনের ছোট পদে নিয়োজিত হতে যাচ্ছিলেন তিনি। ক্ষুদেরাজ্যে নবাগত ছিল তাঁর পরিবার, সং-এর ডিউক বংশের সদস্য ছিল তাঁর পূর্বসুরীরা, কিন্তু আরও বহু অভিজাতদের মতো এই পরিবারও অভিবাসনে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে কোং কিউ শোভন দারিদ্র্যে বড় হয়েছেন, এবং তাঁকে জীবীকা অর্জন করতে হয়েছে। শাস্ত্রজ্ঞদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি এবং আন্তরিকতার সঙ্গে ঝোউ রাজবংশের, বিশেষ করে অনেক সময় স্বপ্নে তাঁকে দেখা দেওয়া ঝোউ-এর মহান ডিউকের ভক্ত ছিলেন। পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন কোং কিউ। তিরিশ বছর বয়সে লি-র উপর পড়াশোনায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং চল্লিশ বছর বয়সে, বলেছেন তিনি, পণ্ডিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। দরিদ্রে পরিণত অনেক শি-ই তিক্ত ও অসন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু আচারের গভীর অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন কোং কিউ, সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলে এগুলো চীনবাসীদের জন্যে স্বর্গীয় পথ এনে দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করেছেন। পরে কোং কিউর শিষ্যরা সগর্বে তাঁকে কোংফুযি, ‘আমাদের গুরু কোং’ বলে ডাকবে। পশ্চিমে আমরা তাঁকে ডাকি কনফুসিয়াস। চীনের অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচনা ঘটতে যাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *